২৮. তুই রাজাকার, তুই রাজাকার

ফরিদের টাকা পয়সার একটা বিলি ব্যবস্থা হয়েছে। আনিসের পরামর্শে একটা ট্রাস্টি বোর্ড করা হয়েছে। সেই ট্রাষ্টি বোর্ডের সভাপতি সোবাহান সাহেব। সদস্য তিনজন— আনিস, ডাক্তার এবং কাদের। কাদেরকে সদস্য করা হয়েছে ফরিদের পিড়াপিড়িতে। সে নিজে ট্রাষ্টি বোর্ডে থাকবে না। তবে খেটে খাওয়া মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কাদেরকে রাখতে চায়। ট্রাষ্টি বোর্ড ফরিদের সমস্ত টাকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা এবং যুদ্ধে নিহত প্রতিটি বাংলাদেশী নাগরিকদের নাম ঠিকানা সংগ্রহে ব্যয় করবে। একটি বিশাল মিউজিয়াম তৈরি হবে। মিউজিয়ামের নাম স্বাধীনতা মিউজিয়াম। সেই মিউজিয়ামে পৃথিবীর প্রতিটি দেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত সমস্ত গ্ৰন্থ থাকবে। এই ট্রাষ্টের একমাত্র কাজ হবে দেশের মানুষদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।

ফরিদ এখন তার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেছে। মহানন্দে আছে। তার মাথায় অন্য একটা পরিকল্পনা এসেছে। সে পাঁচটা টিয়া পাখি জোগাড় করে তাদের কথা শেখাচ্ছে। কথাটা হচ্ছে তুই রাজাকার। এইসব টিয়া পুরোপুরি কথা শিখে গেলে এদের উপহার হিসেবে বিশেষ বিশেষ মানুষদের কাছে পাঠানো হবে। তারাই পাবেন যারা এক সময় রাজাকার ছিলেন। আজ দেশের হৰ্তাকর্তাদের একজন হয়ে বসে আছেন।

ফরিদের এই প্রজেক্টের নাম হচ্ছে প্ৰজেক্ট রাজাকার। তবে প্রজেক্টের কাজ ঠিকমত। এগুচ্ছে না। প্রথমত, পাখিগুলোকে কথা শিখতে খুব বেগ পেতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, টাকা পয়সার অভাব। ফরিদ তার সব টাকা পয়সা ট্রাষ্টি বোর্ডে দিয়ে দেওয়ায় খুবই বেকান্দায় অবস্থায় পড়েছে। সোবাহান সাহেবের কাছে অনেক ঘুরাঘুরি করেও কিছু আদায় করতে পারেনি। তবে রহিমার মা তার আজীবন সঞ্চয় ভেঙে মামাকে এক হাজার টাকা দিয়েছে। সেই টাকায় আরো বারটি টিয়া কেনা হয়েছে। পাখির খাচা বারান্দায় বুলিছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফরিদ সেই পাখিগুলোকে শুনাচ্ছে— তুই রাজাকার। মুখে অবশ্য বলতে হচ্ছে না। টেপ রেকর্ডারে টেপ করা আছে। টেপ বাজানো হচ্ছে। ফরিদকে এই কাজে সাহায্য করছে পুতুল। আজকাল সে বড়ই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। কারণ তার দাদাজান সোবাহান সাহেবের সঙ্গে শহীদদের নাম সংগ্রহের জন্যে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরছেন। এই প্রথম তিনি একটি কাজ আনন্দ ও আগ্রহ নিয়ে করছেন। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ প্ৰান্ত এসে তিনি বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজে পেয়েছেন।

পাখিগুলোর যত্ন করতে পুতুলের খুব ভাল লাগে। খাচায় বন্ধ এই পাখি গুলোর সঙ্গে সে হয়ত নিজের জীবনের খানিকটা মিল খুঁজে পায়। মাঝে মাঝে আনিসের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। লজ্জায় সে মাথা নিচু করে ফেলে। আনিস বলেন, কেমন আছ পুতুল?

পুতুল তার জবাব দেয় না। মনে মনে বলে, আপনি ভাল থাকলেই আমি ভাল। আপনি সুখী হলেই আমি সুখী। দিনে একবার হলেও আপনাকে দেখতে পাচ্ছি- এই বা কম কি? এমন সৌভাগ্য কজন মেয়ের হয়?

এক মঙ্গলবার ভোরে প্রচণ্ড চিৎকার এবং হৈচৈ-এ নিরিবিলি বাড়ির সমস্ত নীরবতা ভঙ্গ হল। ফরিদা পাগলের মত চেচাচ্ছে। চোঁচানোর কারণ একটি পাখি কথা শিখেছে। পরিষ্কার বলেছে- তুই রাজাকার, তুই রাজাকার। প্রথম পাখিটি কাকে দেয়া যায়?

Leave a Reply to হামিদুল Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *