দেহান্তরী
পাড়াটা জমজমাট, কিন্তু রাস্তাটা সরু। এত সরু যে ওকে গলিও বলা চলে। আর সেই ছোট্ট নোংরা দোকানটা? ওই গলিরই মাঝামাঝি এক জায়গায়। হাজার বার ওর সামনে দিয়ে যাতায়াত করলেও নজরে পড়ত না জেনসেনের, যদি-না ওই ছোট্ট বিজ্ঞাপনটা লটকানো থাকত জানালার মাথায়।
সবুজ কাপড়ে লাল সুতোয় বোনা এক লাইন বিজ্ঞাপন, ‘নতুন নতুন জাতের জানোয়ার বানাই।’
চোখ দুটো ঠেলে বেরুল জেনসেনের। সে ভিতরে ঢুকল।
‘ছ-টা দিন তো আমায়’— বলল সে।
‘অত বেশি লোভ করবেন না।’ মৃদু আপত্তি জানাল দোকানি। টেবিলের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট মানুষটি, বামন বললেই হয়। সাদা লম্বা চুল কাঁধের উপরে ঝুলছে, চোখ দুটো জলো, সশব্দে নাক টানছে অনবরত।
বড়ো বড়ো চোখে চারদিক একবার দেখে নিল জেনসেন, তারপর বলল, ‘কাজের কথায় এসো হে! পৃথিবীর মাটিতে নেমে এসো।’
‘আমি তো সেখানেই আছি মশাই।’ বলল দোকানি। মাটিতে লাথিও একটা মারল কথাটা প্রমাণ করবার জন্য।
‘শুনে খুশি হলাম।’ বলে টেবিলের উপরে ঝুঁকে পড়ল জেনসেন। তার দুই চোখ ধকধক করে জ্বলছে। বামনের পানে তাকিয়ে বলল, ‘এই নতুন নতুন জাতের জানোয়ার— কীরকম জানোয়ার হে?’
‘রকম?’ বামন জবাব দিচ্ছে, ‘কোনোটা মোটা, কোনোটা সরু, কোনোটা লম্বা, বেঁটেও কোনোটা। পাগলাটেও হয় কোনো কোনোটা— কতরকম যে হয়, তার সীমা, সংখ্যা নেই।’
‘একটা পাগলাটে বোধ হয় সামনেই দেখছি।’ বলে উঠল জেনসেন।
‘ওই দেয়ালের আয়নাটার দিকে চোখ পড়েছে তাহলে।’ জবাব আসে সঙ্গে সঙ্গে।
জেনসেনের মর্যাদাবোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এই তিন পয়সার দোকানির সঙ্গে রসিকতার পাল্লা দেওয়া সাজে না তার। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি সাংবাদিক—’
‘তাইতেই—’ দোকানি যেন অনুকম্পায় বিগলিত।
‘কী তাইতেই?’ রেগে ওঠে জেনসেন।
‘ওই পাগলাটে ভাবটা—’
উপর-নীচ মাথা নাড়ছে জেনসন, ‘খুব সপ্রতিভ লোক। আমার খুব পছন্দ সেইসব লোক, যারা চটপট মুখের মতন জবাব দিতে পারে। একটু-আধটু খ্যাপাটে হলেও পছন্দ করি তাদের।’
দোকানি চোখ দুটো মুছল, নাকটা ঝাড়ল, পিটপিট করে চাইল ওর দিকে। তারপর বলল, ‘বলছেন সাংবাদিক, সাংবাদিকের ভদ্রতার অভাব কেন হবে?’
‘ওটা সাময়িক।’ অমায়িক জবাব জেনসনের, ‘খদ্দের হয়ে এখানে এসে পড়েছি বলে কটকট করে এমন কথা কাটাকাটি করে না কোনো দোকানি। শুনেছিলাম, দোকানিমহলে একটা চলতি কথাই আছে যে—খদ্দের সবসময়েই অভ্রান্ত।’
‘সবসময়ে? মোটেই না।’ কাটা জবাব বামনের।
‘সবসময়ই!’ জোরের সঙ্গে বলে ওঠে জেনসেন, ‘অবশ্য যদি দোকানির মতলব থাকে ব্যবসায় টিকে থাকবার। থাকুক সে কথা, এই নতুন জাতের জানোয়ার—’
‘কী হয়েছে তাদের?’ নিস্পৃহ প্রশ্ন বামনের।
‘বলি, ধাপ্পাটা কী?’
‘আমি বেচি ওসব। এর মধ্যে ধাপ্পাটা কোথায়?’
‘ব-টে আর কী!’ জেনসেন হাউইয়ের মতো ফেটে পড়ে, ‘নতুন জাতের জানোয়ার তৈরি করো? মানে মিউট্যান্ট? মানে বিবর্ত-জীব? মানে একজাতের জন্তুর দেহে পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে অন্য জন্তু বানানো? জানো তুমি এ-বিদ্যে?’
‘ওই আমার ব্যাবসা, আমি জানি না?’ বামন জোরে জোরে নাক ঘষছে, টকটকে লাল হয়ে উঠেছে নাকটা।
‘জানো মিউট্যান্ট কাকে বলে? বলো তাহলে। মিউট্যান্ট, বিবর্ত-জীব, দেহান্তরী জীব! বলো—’
‘বলব আবার কী?’ বামন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে, ‘ডজনে ডজনে তৈরি করছি। করব কী, ব্যাবসার গোপন রহস্য কাউকে জানানো যায় না, তা নইলে ল্যাবরেটরিটা একবার দেখিয়ে দিতাম—’
‘সব বাজে! স্রেফ ধাপ্পা?’ দু-হাত নেড়ে বামনের বক্তৃতা হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে চাইল জেনসেন, ‘ল্যাবরেটরি? হুঁ, মিউট্যান্ট হচ্ছে একটা আকস্মিক বিকৃতি, জীব-সৃষ্টির প্রবাহে সনাতন পদ্ধতির একটা ব্যতিক্রম। কদাচিৎ কখনো মহাজাগতিক রশ্মির প্রচণ্ড দাহ যদি এসে পড়ে কোনো জীবকোষের উপরে, কিম্ভূতকিমাকার প্রাণী তৈরি হয় তা থেকে—’
‘ভুল! বিলকুল ভুল!’ টেবিলের ওধার থেকে টংকার দিয়ে ওঠে বামনের কণ্ঠ, ‘বিকৃতিও নয়, ব্যতিক্রমও নয়। সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া রয়েছে একটা, যার ফলে জীব বিশেষের দেহে-মনে নিয়ে আসা যায় আমূল পরিবর্তন। সেই প্রক্রিয়ারই সৃষ্টি হল মিউট্যান্ট, বিবর্ত-জীব। সেই প্রক্রিয়াতেই কাজ করি আমি। ঠিক যেমনটি চাই, তেমন জিনিসটিই বার করে আনি ল্যাবরেটরি থেকে।’
‘সেই নব সৃষ্টির জিনিসটি আবার সন্তানও উৎপাদন করে নিজের মতন?’ জেনসেনের জিজ্ঞাসায় সুস্পষ্ট টিটকারি।
‘অবিশ্যি’
‘তাহলে তো তুমিই ভগবান!’
বামনের কণ্ঠ হঠাৎ তীক্ষ্ন হয়ে উঠল, ‘ভগবানকে অপমান করার তো কোনো দরকার দেখছি না।’
এ-ভর্ৎসনার কোনো জবাব খুঁজে না-পেয়ে, অন্যদিকে চোখ ফেরাল জেনসেন।
টেবিলের নীচে পায়ার সঙ্গে সঙ্গে তাক লাগানো, আর সবগুলো তাকেই শিশি-বোতল, নানা আকারের— নানা রঙের তরল পদার্থে ভরা।
‘ওসব কী?’ জিজ্ঞাসা করল অতঃপর।
‘শিশি, বোতল, বোয়াম—’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কী আছে ওতে? গলানো মিউট্যান্ট?’
‘অবান্তর প্রশ্ন!’
‘অবান্তর প্রশ্ন আমি কখনো করি না।’ বলল জেনসেন, ‘তুমি মিউট্যান্ট বিক্রি করো বিবর্ত-জীব— দেহান্তরী জীব। তাদের একটা খোঁয়াড় বা গুদোম থাকবে তো কোথাও?’
‘তা থাকবে বই কী! তবে সেখানে খদ্দেরের যাওয়া বারণ। চাহিদামতো জিনিস এখানে এনেই দেখাব আমি।’ জবাব দিল বামন।
‘বেশ, তাই দেখাও। গোটা কতক বেশ মানানসই চেহারার মিউট্যান্ট—’
‘কীরকম জিনিস বেশ পছন্দ তোমার?’
জেনসেনকে ভাবতে হল একটু। ‘এই ধরো— ফিকে নীল গণ্ডার একটা। লম্বায় ধরো এই সতেরো ইঞ্চি। ওজন ধরো এই নয় পাউন্ডের মধ্যে।’
‘রাখি না। বাজার-চালু জিনিস নয়। তৈরি করতে হবে।’ বলল বামন।
‘যা ভেবেছি। তৈরি করতে হবে! বেশ, ক-দিন লাগবে তৈরি করতে?’
‘তা দু-হপ্তা,’ বামন ভেবে বলল, ‘তিন হপ্তাও লাগতে পারে।’
‘তিন মাসও বলতে পারতে। বা তিন বছর। বা গোটা জীবনকাল।’
বামন আপোশ করতে চায়, ‘ওই আকারের মধ্যেই গোলাপি রঙের হাতি নেবে একটা? আছে মজুদ—’
‘বাজারে অচল।’ বিজয়গর্বের হাসি জেনসনের মুখে, ‘যেকোনো চুল কাটার দোকানে ডজনে ডজনে আছে। তা ছাড়া ও তো মিউট্যান্টই নয়; ব্রাজিলের জঙ্গলে এক বেঁটে সাদা হাতির জাত আছেই, তাদের বাচ্চা হয় ছাগলছানার আকারের, রংও তাদের দুই-তিন বছর পর্যন্ত গোলাপিই থাকে।’
‘হ্যাঁ, জানো দেখছি খবরটা।’ স্বীকার করল বামন, ‘তাহলে আর করা যাবে কী? তোমার কোনো কাজে লাগতে পারছি না আমি—’
‘সে হবে না—’ চেঁচিয়ে ওঠে জেনসেন, ‘মিউট্যান্ট আমার চাই-ই! একটা অন্তত দেখাও। যেকোনোরকম।’
‘তা যদি বলো—’ দু-চোখ মুছে, ঘন ঘন বার কতক নাক-টানা দিয়ে, পিছনের দরজা দিয়ে বামন বেরিয়ে গেল।
জেনসেন কী করবে ততক্ষণ? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে? সে পাত্রই সে নয়। ঝুঁকে পড়ল টেবিলের উপর দিয়ে। ওপিঠে হাত বাড়িয়ে নীচের তাক থেকে টেনে আনল হাতে যেটা ঠেকল— সেই বোতলটাই।
ভিতরে দেখা যায়— কমলালেবু রঙের তরল পদার্থ একটা, আধবোতলের মতো। ছিপি খুলে জিনিসটা শুঁকল জেনসেন। গন্ধটা মনোরম, স্কচ হুইস্কিকে চারগুণ ঘনীভূত করলে যেরকম দাঁড়াবার কথা— সেইরকম যেন। জিভে জল আসছে, তবু ছিপি বন্ধ করে জেনসেন তাড়াতাড়ি বোতলটা যথাস্থানে রেখে দিল।
বামন একটা কুকুরের বাচ্চা এনেছে, তার একটা চোখের চারদিকে কালো বৃত্ত।
‘এই নাও, খুব সস্তায় হবে।’
‘তা তো হবেই।’ বলল জেনসন, ‘তোমায় পুলিশে দেওয়া দরকার।’
‘কারণ?’
‘ওটা মিউট্যান্ট বলতে চাও?’
খুব যেন আহত হয়েছে মনে মনে, এইরকম ভাবখানা দেখিয়ে বামন বলল, ‘তুমি বলতে চাও-না বুঝি? বেশ, তাহলে নয় ওটা মিউট্যান্ট। তুমিই যখন জহুরি এ-ব্যাপারের।’
কুকুরবাচ্চাটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখেছিল, তুলে নিয়ে সে আবার বেরিয়ে গেল পিছনের দরজা দিয়ে। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একটা কাণ্ড ঘটল। কুকুর বাচ্চাটা ফিরে তাকাল জেনসেনের দিকে, আর নাক সিটকে বলে উঠল, ‘সবজান্তা!’
দোকানি ফিরে এলে জেনসেন বলল, ‘কথা কইছিল যেন জন্তুটা। পুতুলনাচের আসরে অনেক কেঠো পুতুলকেও কথা কইতে শোনা যায়।’
‘তা যেতে পারে বই কী!’ বলে এমন একটা হাঁচি হাঁচল বামন যে তাকের বোতলগুলো পর্যন্ত ঝনঝন করে বেজে উঠল।
জেনসন বলে যাচ্ছে, ‘গোড়ায় বলেছি— সাংবাদিক আমি। সংবাদ হিসেবে মুখরোচক হবে, এমন কিছু দেখতে পেলে আমি লেগে থাকি তার পিছনে; যতক্ষণ না একটা এসপার-ওসপার কিছু হয়ে যায়। এসপার-ওসপার! বুঝেছ?’
‘বুঝেছি বই কী! এসপার না-হলে কাজেই তখন ওসপার।’
‘বেশ। বোঝো। ভালো করে বোঝো। তোমার বলবার কথা এই যে, মিউট্যান্ট বেচার ব্যাবসা তোমার। ভালো কথা। ও কথা নিয়ে বেশ খানিকটা লেখা যায়। খবরের কাগজে পুরো একটা স্তম্ভই লেখা চলে হয়তো।’
‘তাই না কি?’ বামনের সাদা ভ্রূ দুটো উপর-পানে ঠেলে উঠল, খুব যেন সে চিন্তায় পড়েছে এই লেখালেখির কথা শুনে।
জেনসেনকে দেখায় রীতিমতো হিংস্র, ‘ওস্তাদ লিখিয়ের হাত থেকে একটা স্তম্ভ যখন দেখা দেয় কাগজে, তাতে অনেক চিন্তার খোরাক পায় লোকে। ওতে ভালো কথাও থাকে, থাকে বিশ্রি কথাও অনেক। লোকে সবই পড়ে। বিশেষ করে বিশ্রি কথাগুলো বেছে বেছে পড়ে পুলিশেরা। দামি খবরের জন্য লেখকের কাছে কৃতজ্ঞতার সীমা থাকে না তাদের। কিন্তু তারা তৎপর হয়ে ওঠার আগেই চিড়িয়া এদিকে উড়েছে। খবরের কাগজ চিড়িয়ারাও পড়ে কিনা!’
‘পড়ে বুঝি?’ উদাসীনভাবেই মন্তব্য করল বামন।
টেবিলের উপরে সশব্দে এক চাপড় মারল জেনসেন, ‘এক্ষুনি একটা কুকুরছানা তুমি বেচতে এসেছিলে আমার কাছে। কুকুরছানা টিটকারি দিল, ‘সবজান্তা’। আমি স্বকর্ণে শুনেছি তো। ভেনট্রিলোকুইজম! কথা তুমিই কয়েছিলে। স্বর ছুড়ে মারবার কায়দায় মনে হল কথা কয়েছে কুকুর। এটা ধোঁকাবাজি, ভদ্র ভাষায় প্রতারণা। ঠকিয়ে পয়সা নেওয়ার চেষ্টা। চুরিই একরকম।’
‘কিন্তু পয়সা তো নিইনি মশাই!’ ডান হাত বার বার ঝাড়তে থাকে বামন, ‘নিতামও না, তুমি ওটা কিনলেও না।’
‘কিনলেও না?’ জেনসেন অবাক, ‘মৌফতে দিয়ে দিতে নাকি?’
‘না, তাও নয়। দাম হিসেবে চাইতাম অন্য কিছু, পয়সার চাইতে যা আমার দরকার অনেক বেশি।’
বামন চারদিক দেখে নিল একবার, তারপর সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে কী যেন বলল জেনসেনকে। আর তা শুনে জেনসেনের চোখ যেন ঠিকরে বেরুতে চাইল একেবারে। এক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘এবারে আর বুঝতে বাকি নেই, তুমি বদ্ধ পাগল।’
এতক্ষণে একটু কিন্তু ভাব দেখা গেল বামনের কথায়, ‘মানে আর কী, মালমশলার বড়ো বেশি অভাব কিনা এ-কারবারে! বিশেষ করে জীবদেহ থেকে যেসব জিনিস সংগ্রহ করতে হয়, সেই সবের। মিউট্যান্ট তৈরি করব যে, প্রোটোপ্লাজম কোথায়? জীবদেহ গড়বার সেই আধা-তরল মূল উপাদান? নিজে তৈরি করে নেওয়া, তাতে সময়ও লাগে, হাঙ্গামাও ঢের।’
‘তাই খদ্দেরের দেহ থেকে—’ বলতে যায় জেনসেন।
‘ঠিক তাই।’ ওর কথা শেষ করতে দেয় না বামন, ‘কিন্তু তাতে তো লোকসান কিছু নেই খদ্দেরের! সে টেরও পাবে না যে কিছু-একটু বেরিয়ে গেল তার দেহ থেকে; কিন্তু তুমি যখন কুকুরছানাটা নিলেই না, তোমার কাছে আর সে-জিনিস চাইব কী করে?’
জেনসেন হাতঘড়ির দিকে তাকাল, ‘যাক, আমি যাচ্ছি। তোমার ব্যাপার-স্যাপার বুঝতে কিছু বাকি নেই আমার। কাগজে লিখব আমি তোমার কথা—’
বামন তো ভয় পাওয়ার লক্ষণ কিছু দেখায় না। অথচ জেনসেন যে আশা করে রয়েছে যে ভয়ে ওর হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে যাবে। ওটা না-করে যদি চলে যেতে হয়—এক রকমের হার মেনেই যাওয়া হল ওর কাছে।
মানুষের হামবড়াই থাকে অনেকরকম। জেনসেনেরও এটা এক রকমের হামবড়াই।
‘সুখের বিষয়।’ সেই হামবড়াইয়ের বশেই জেনসেন বলতে থাকে আবার, ‘সুখের বিষয়, লেখবার কথা অনেক পেয়েছি তোমার সম্বন্ধে। মিউট্যান্ট বেচার নাম করে জোচ্চুরি চালানো— এই হল এক নম্বর! দুসরা নম্বর— ওই শিশি-বোতল বোয়ামগুলো। হ্যাঁ হে, ওরা কীরকম কমিশন দেয় তোমায়?’
‘ওরা? কারা?’ আকাশ থেকে পড়ে যেন বামন।
‘মাদক বস্তুর বেআইনি কারবারিরা।’ কথাগুলো যেন একটা একটা করে জেনসেন বিঁধিয়ে দিতে চায় বামনের মগজে, ‘ওদের কাছ থেকেই আসে তো এসব মাল? দেশ-বিদেশের সরেস মদ, হাসিস, চরস, এক-শো একরকম নিষিদ্ধ নেশার জিনিস? ”নতুন নতুন জাতের জানোয়ার”? স্রেফ সংকেতবাণী একটা। জানোয়ার মানে সেইসব চিজ, যা সেবনের ফলে মানুষ জানোয়ার বনে যায় তড়িৎ-ঘড়িৎ। বোঝো লোক, যে জানে সন্ধান।’
‘ওসব পাত্রে তো ওষুধপত্র আমার! মিউট্যান্ট বানানোর কাজে যা দরকার হয় হামেশাই—’
‘বুঝেছি হে বুঝেছি, আর কথা বাড়াও কেন? কীরকম দামে বিক্রি করো হে এসব?’ যে বোতলটার গন্ধ জেনসেন আগেই শুঁকে রেখেছে, সেইটের দিকেই আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই এটার কী দাম?’
বামন বোতলটা তুলে নিল তাক থেকে, জেনসেনের হাতে দিয়ে বলল, ‘এর দাম তোমায় দিতে হবে না, তবে খালি বোতলটা আমার ফেরত চাই।’
জেনসেন আবারও ছিপি খুলল, আবারও শুঁকল ভিতরের জিনিসটা। তারপর আঙুলের ডগায় একটুখানি তুলে নিয়ে চুষে দেখল আঙুলটা। দেখতে দেখতে মুখে-চোখে ফুটে উঠল তার অনির্বচনীয় আনন্দ।
‘ওহে, সবকথা ফিরিয়ে নিচ্ছি আমি, নিষিদ্ধ নেশার কথা-টথা যা যা বলেছি, সব— সব।’ আর একবার আঙুল ভেজাল, আর একবার চুষল, ‘নিষিদ্ধ হোক, যাই হোক, মদ বানাতে জানে বটে ওরা। আমি তোমার বাঁধা খদ্দের হয়ে যাব হে, কাল থেকে রোজ হাজিরা পাবে আমার এই সময়।’
এবারে আর আঙুল চোষা নয়, বোতল মুখে তুলে লম্বা এক চুমুক। জিনিসটা গলা দিয়ে নামছে, যেন মশাল শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে উদরের পথ বেয়ে।
‘বাপস!’ হাঁফ ছেড়ে নিয়ে বোতলটার দিকে অবিমিশ্র শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকিয়ে রইল জেনসেন। একমাত্র আপশোস— মালটা পরিমাণে কম, সিকি-পাইটও নয়। আপশোস!
আর এক চুমুক! ‘জিতা রহো নিষিদ্ধ মালের ব্যাপারীরা।’
বামনটাও আবার কী বলছে এসময়?
বলছে, ‘একটা কথা মনে রেখো হে! আমার সঙ্গে ব্যবহার যা করেছ তুমি, রীতিমতো অভদ্র।’
বোকার মতো হাসল জেনসেন সেকথা শুনে। হাসা ছাড়া আর করবেই বা কী? ব্যবহার? তখন কি আর জেনসেন জানত যে, নতুন জাতের জানোয়ার বলতে যা বোঝায়, তা হল—
এ কী? বোমা ফাটছে নাকি পেটের ভিতর? দোকানের দেয়ালগুলো যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল দৃষ্টির বাইরে, তারপরই আবার হুড়মুড় করে ধেয়ে এল ওকে চারদিক থেকে চেপে ধরবার জন্য। পাঁচ সেকেন্ডের বেশি নয়। তার ভিতরই তার দুই পা থেকে সব শক্তি যেন গলে বেরিয়ে গেল একদম। এতক্ষণ টলছিল, এইবার সে সমুখের দিকে কুঁজো হল, তারপরই মুখটা গিয়ে থুবড়ে পড়ল মেজেতে।
কত যুগ যেন কেটে গেল তারপর। দীর্ঘ দীর্ঘ যুগ, ধোঁয়াটে, আধো-ঘুমে আচ্ছন্ন, আড়ষ্ট। চাপা আওয়াজ মাঝে মাঝে কানে আসে যেন— গুমা গুম গুম। সে ভাবটা কেটে গেল ক্রমশ। জেনসেন যেন দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠছে আস্তে আস্তে।
চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে রয়েছে জেনসেন, যেমন করে কুকুর-শেয়াল থাকে। মাথা ঘুরছে, মগজে ধরাও পড়ছে না স্পষ্ট কোনো ধারণা। মাথার তালুতে কেউ যেন মুগুর বসিয়ে দিয়েছিল এক ঘা। বোধ হয় সেই তর্ক-বিতর্কের ফলে। বোধ হয় সেই অপয়া বামনটাই। তার শেষ কথাগুলো মনে পড়ে। সব কিছু ধোঁয়াটে হলেও সেই কথা ক-টা জ্বলজ্বলে হয়ে ফুটে রয়েছে মগজে, ‘ব্যবহার যা করেছ, রীতিমতো অভদ্র!’
অভদ্র? দাঁড়াও বাপধন! অভদ্রতা আর কতটুকু দেখেছ তুমি? একটু চাঙ্গা হয়ে উঠতে দাও আমায়। মাথার এই ঘোরঘোর ভাবটা কাটুক। তোমার হাত, পা, নাক, কান ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরোগুলো দেশের চার কোণে ছড়িয়ে দিয়ে আসব।
চোখে কিন্তু কিছুই ঠাহর হয় না স্পষ্ট। দূরের জিনিস তো একদম না। নাক কিন্তু কাজ করে যাচ্ছে চমৎকার। কতরকম গন্ধই যে একসাথে টের পাচ্ছে জেনসেন।
পায়ের নীচে এই যে মেজেটা, যেমন মসৃণ, তেমনি ঠান্ডা। ঠান্ডা যেন বরফ। কী হতে পারে? কাচ? এত লম্বা-চওড়া? এমন মোটা?
জিনিসটা কাচই কিনা, ভালো করে দেখবার জন্য নীচের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল জেনসেন। কাচই বোধ হয়, তা নইলে মেজেতে তার ছায়া পড়ে কেন? তার ছায়া? ধুত্তোর! তার ছায়া ওরকম কেন হবে? এ যে একটা খুদে চতুষ্পদের ছায়া। এ ছায়া হতেই পারে না জেনসেনের ছায়া। নিশ্চয়ই না।
নিশ্চিতকে সুনিশ্চিত করবার জন্য জেনসেন মাথা নাড়ল জোরে জোরে। কী সর্বনাশ! ছায়াটাও মাথা নাড়ে যে! একটা সন্দেহ! একটা আতঙ্ক! মর্মভেদী হাহাকার একটা! কিন্তু সে হাহাকার কণ্ঠ দিয়ে তো বেরুল না জেনসনের! যা বেরুল, তা একট ক্ষীণ ঘড়ঘড় আওয়াজ মাত্র।
ছায়াটার রং ফিকে নীল। লম্বায়— এই ধরো ইঞ্চি সতেরোর মতো। কুৎসিত নাকটার উপরে শিং একটা আবার।