সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

২৫. হাসপাতালের ‘টি’ ওয়ার্ড

হাসপাতালের ‘টি’ ওয়ার্ড

এটা পৃথিবীর শেষ যুদ্ধও নয়, যুদ্ধ বন্ধ করবার যুদ্ধও নয়। এর নামকরণ হয়েছে ‘মার্কিন স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণের যুদ্ধ।’ এ নাম দিয়েছেন জেনারেল কার্পেন্টার। যখন-তখন যেকোনো উপলক্ষ্যে পরম শ্রদ্ধা ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে এ নাম উচ্চারণে ক্লান্তি নেই জেনারেল মহাশয়ের।

কিছুসংখ্যক জেনারেল আছেন, যাঁদের নইলে সেনাবাহিনী অচল হয়। আছেন কিছু রাজনীতিজ্ঞ জেনারেল, যাঁদের না-পেলে অচল হয় প্রশাসন। সর্বোপরি রয়েছেন কতিপয় জনসংযোগদক্ষ জোনরেল, যেকোনো যুদ্ধকে সাফল্যের পথে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে যাঁদের অবদান অমূল্য, অপরিহার্য। কার্পেন্টার হচ্ছেন এই তৃতীয় শ্রেণির (মর্যাদায় নয় কিন্তু, গণনায়) জেনারেল।

রেখে-ঢেকে কথা বলেন না কার্পেন্টার, মারপ্যাঁচের ত্রিসীমা মাড়ান না, আদর্শ তাঁর যেমন আকাশচুম্বী, তেমনি সহজবোধ্য। আমেরিকার চোখে কার্পেন্টারই সৈন্যবাহিনী, কার্পেন্টারই প্রশাসন। কার্পেন্টারই একাধারে জাতির ঢাল, তরোয়াল এবং বলিষ্ঠ দক্ষিণ বাহুও।

এই কার্পেন্টারেরই আদর্শ হল মার্কিন স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়ণ। প্রেস-সংস্থার ভোজে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘আমরা অর্থের জন্য লড়ছি না, ক্ষমতার জন্যও লড়ছি না, লড়ছি না সারা পৃথিবীকে কুক্ষিগত করবার লোভেও। যার জন্য সর্বস্ব পণ করে আমরা লড়ে যাচ্ছি, তা হল— মার্কিন স্বপ্নের রূপায়ণ।’

ওই কথাই তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানানভাবে শুনিয়েছেন কংগ্রেস নং ১৬২-তে, ওয়েস্ট পয়েন্ট সেনানীদের বার্ষিক উৎসবে, সানফ্রান্সিসকো পাইয়োনিয়ার্স ক্লাবে। মার্কিন স্বপ্নটা যে কী বস্তু, তাও ব্যাখ্যা করেছেন বই কী! কখনো বলেছেন, ‘এ-স্বপ্নে আর যাই থাকুক, আগ্রাসনের নীতি স্থান পায়নি এর ভিতর, পৃথিবীর জাতিসমূহকে দাসজাতিতে পরিণত করবার কোনো মতলব নেই আমাদের।’

আবার কখনো এমন কথাও শোনা গিয়েছে তাঁর মুখে, ‘এ-স্বপ্ন হল সভ্যতাকে বজায় রাখবার স্বপ্ন। সংস্কৃতি, কবি-মানসিকতা, জীবনের কোমল-মধুর ভাবাদর্শগুলি যাতে বিলুপ্ত না-হয় মানবসমাজ থেকে, তারই জন্য এ-স্বপ্নকে রূপায়িত করবার সাধনা আমাদের।’

আমেরিকা লড়েই চলেছে। জেনারেল কার্পেন্টার বলেছিলেন, সৈনিক চাই দশ কোটি। আমেরিকা দশ কোটি লোকই পাঠিয়েছে বাহিনীতে। জেনারেল কার্পেন্টার চেয়েছিলেন দশ হাজার হাইড্রোজেন বোমা। দশ হাজার বোমাই তিনি পেয়েছিলেন, নানাস্থানে নিক্ষেপও করেছিলেন তাদের। শত্রুরাও বদলা নিতে ছাড়েনি। তারাও ফেলেছিল দশ হাজার বোমা, তার ফলে আমেরিকার বেশিরভাগ মহানগরীই বিধ্বস্ত হয়েছে।

জেনারেল কার্পেন্টার বললেন, ‘এই বর্বরতার গ্রাস থেকে আত্মরক্ষা করতে হলে আমাদের আশ্রয় নিতে হবে ভূগর্ভে। এক হাজার ইঞ্জিনিয়ার আমি চাই।’ এসে গেল এক হাজার ইঞ্জিনিয়ার, তারা ধ্বংসস্তূপের নীচে নীচে গড়ে তুলল এক-শোটা ভূগর্ভ-নগরী।

‘পাঁচ-শো স্বাস্থ্যবিশারদ আমি চাই, আট-শো জন যানবাহন নিয়ন্তা, তাপনিয়ন্ত্রণ বিশারদ দু-শো জন, পৌরশাসক এক-শো, যোগাযোগ-ব্যবস্থাপক এক হাজার, শ্রমিক-সংগঠক সাত-শো—’

সব মিলিয়ে, নানা বিভাগের জন্য বিশারদ ও ওস্তাদের যে তালিকা কার্পেন্টার পেশ করলেন, তা সরবরাহ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে জাতিটা। অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন কার্পেন্টার। কড়া নির্দেশ পাঠিয়েছেন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় সংস্থার হেড অফিসকে— ‘এ জাতির প্রত্যেকটা নর ও নারীকে গড়ে তুলতে হবে এক একটা ওস্তাদ করে। প্রত্যেকের জন্য বাছাই করে দিন একটামাত্র নির্দিষ্ট কাজ, সেই কাজে তাকে পোক্ত হতে দিন, দক্ষ হতে দিন, সক্ষম হতে দিন অসাধ্যসাধনে। তা না-হলে মার্কিন স্বপ্নকে রূপায়িত করা সম্ভব হবে না।’

ওয়াল স্ট্রিটের হুন্ডি-কারবারিদের ভোজে সভাপতিত্ব করতে গিয়ে তিনি বক্তৃতা দিলেন, ‘আমাদের এ-স্বপ্ন নতুন কিছু নয়। প্রাচীন গ্রিকদের মগজেও ছিল এ-স্বপ্ন, ছিল রোমকদেরও। এ হল শ্রেয়ঃ এবং প্রেয়কে লাভ করার স্বপ্ন— সংগীত, চারুকলা, কাব্য ও কৃষ্টির সাধনা। এ সাধনার অর্থ হল হাতিয়ার মাত্র, উচ্চাশা হল সোপান, কর্মশক্তি স্রেফ একটা যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছু নয়।’

ওয়াল স্ট্রিট ফেটে পড়ল হাততালিতে। জেনারেল কার্পেন্টার হুন্ডির কারবারিদের কাছে চাইলেন দেড়শো বিলিয়ন ডলার, তারা তা দিতে পেরে ধন্য হয়ে গেল যেন। অর্থটা হাতে পেয়ে কার্পেন্টার যত্রতত্র ওস্তাদ বসিয়ে দিতে লাগলেন দরাজ হাতে— খনিজ পদার্থের ওস্তাদ, পেট্রোলের ওস্তাদ, ব্যাপক উৎপাদনের ওস্তাদ, কীসের ওস্তাদ নয়? প্রত্যেকের মাইনে বছরে এক ডলার করে। স্বপ্ন-রূপায়ণে যারা আত্মনিয়োগ করবে, খাওয়া-দাওয়া আমোদ-আহ্লাদের সময় তারা পাবে কোথায়? অর্থ দিয়ে করবে কী তারা?

খ্রিস্টাব্দ ২১১২। মহাযুদ্ধ চরম পর্যায়ে এখন। কিন্তু কার্পেন্টারের সমস্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে বসে আছে এ-সময়ে—

কী সে জিনিস?

বিভিন্ন মহাদেশে সাতটা রণাঙ্গনে যুদ্ধ চলেছে, যুদ্ধমান জাতিসমূহের রাজধানীতে রাজধানীতে অহর্নিশ ব্যস্ততা আর উন্মাদনা; বিরাট বিরাট কারখানা থেকে অস্ত্রের সরবরাহ আসছে অবিরাম প্রবাহে, কিন্তু এসব ব্যাপারের কোনোটার উপরেই সর্বনিয়ন্তা কার্পেন্টারের মনোযোগ নিবদ্ধ নেই এখন, তিনি ভাবছেন অন্য কথা।

সে-কথা হল টি-ওয়ার্ডের কথা।

একদা যেখানে ছিল সেন্ট আলবান্স, সেইখানেই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হাসপাতাল। মাটির উপরে নয় অবশ্য, তিন-শো ফুট গভীর ভূগর্ভে। সেই সেন্ট আলবান্স হাসপাতালের টি-ওয়ার্ড নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কার্পেন্টার।

টি-ওয়ার্ড! নামটাই গোলমেলে। হাসপাতালে বিভাগ আছে উনিশটা। তাদের নাম যথাক্রমে এ-ওয়ার্ড, বি-ওয়ার্ড, সি-ওয়ার্ড ইত্যাদি। ‘এ’ থেকে ‘এস’ পর্যন্ত উনিশটা অক্ষর দিয়ে নামকরণ হয়েছে উনিশটা ওয়ার্ডের। তালিকায় এস ওয়ার্ডই শেষ ওয়ার্ড। অথচ কার্পেন্টারের মাথা খারাপ হতে বসেছে যা নিয়ে, তা হল টি-ওয়ার্ড।

এর মানে কী?

মানে যে কী, কেউ তা জানে না। সবাই জানে শুধু এই কথা যে তালিকায় নাম না থাকলেও টি-ওয়ার্ড একটা সত্যিই আছে, তার দরজা সবসময় ডবল তালা দিয়ে বন্ধ করা থাকে। কী আছে সে দরজার ওপিঠে, কী হয় সেখানে, কেউ বলতে পারে না। কোনো বাইরের লোককে ঢুকতে দেওয়া হয় না ওর ভিতরে। কোনো রোগীকে কখনো দেখা যায় না ওই দরজা দিয়ে বেরুতে। ডাক্তারেরা অবশ্য আসেন এবং যান। যাওয়ার সময় এমন হতবুদ্ধির মতো দেখায় তাঁদের যে তাই নিয়েই হাসপাতাল কর্মীদের জল্পনার অন্ত থাকে না। নার্স আছে কয়েক জন, টি-ওয়ার্ডে কাজ করে তারা? কী কাজ? কাদের কাজ? তাদেরও মুখে ডবল কুলুপ, শত প্রশ্নেও জবাব দেবে না তারা।

না, কিছুই জানবার উপায় নেই। আর সে-উপায় নেই বলেই কানাঘুসো চলে সকল স্তরে। গুজব! কেবল গুজব! পরস্পরবিরোধী, আজগুবি, আষাঢ়ে সব গুজব! এক ঝাড়ুদারনি ঢুকেছিল সাফ-সাফাইয়ের জন্য। ঢুকে সে গোটা ওয়ার্ডে একটা জনপ্রাণীও দেখেনি। একটিও না। স্রেফ দুই ডজন বিছানা পড়ে আছে সারি সারি। আর কিছুই না। সেসব বিছানায় কেউ শুয়েছিল রাতে? তা শুয়েছিল চাদর-টাদর কোঁচকানো। সবগুলি নয়, কয়েকটা। লোকজন যে ওখানে থাকে, তার চিহ্ন কিছু দেখা যায়? হ্যাঁ, তা যায় বই কী। টেবিলে টেবিলে আয়না, চিরুনি, বুরুশ, স্নো, পাউডার ক্রিম—

তবে হ্যাঁ, কেমন যেন ধুলোমাখা, নোংরা সব। কদাচিৎ কখনো ব্যবহার হয়।

অতএব বাইরে গুজব উঠল— টি-ওয়ার্ড ভূতের ওয়ার্ড, ভূত থাকে ওখানে।

তারপরেই এক আর্দালি, তার ডিউটি হল রাতের বেলায়। সে এক রাতে গানের আওয়াজ পেল ওই ওয়ার্ডের ভিতর। কীরকম গান? মনে হয়েছিল যেন বিদেশি কোনো ভাষার। শোনাল যেন— কাউ-ডি-অনাস-ইগর-টুর—

না, তা হলে ভূত নয়। হয়তো বিদেশি গুপ্তচর সব আছে ওখানে। আহত চর, যাদের অন্য রোগীদের সাথে মিশতে দেওয়া উচিত নয়।

এর পরে রান্নাবাড়ির লোকদের উপরে জেরা শুরু হল গুজব সম্রাটদের। খাবারের ট্রে যায় ওখানে? তা যায়, চব্বিশটা। দিনে তিন বার। চব্বিশটা ট্রে যাচ্ছে ভিতরে, আসছে বাইরে। কখনো কখনো ট্রে ফেরত আসে খালি অবস্থায়। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, যেমনকার খাবার তেমনি রয়েছে, কেউ স্পর্শও করেনি।

জনমত এইভাবে আকার নিতে লাগল যেন টি-ওয়ার্ড একটি আড্ডাখানা, হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিদের হুল্লোড়ের জায়গা। কাউ-ডি-ইগর-টুর, না ছাই! লোককে ধোঁকা দেওয়ার ফিকির শুধু।

এই জনমতই শিকড় গাড়তে লাগল হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে। সত্যিকার রোগীরা আগে করত হাসাহাসি, এখন শুধু করেছে রাগারাগি। সরকারি হাসপাতালে এমনধারা অনাচার? মার্কিনের স্বপ্ন রূপায়িত হচ্ছে কাউ-ডি-ইগরের গান গেয়ে? রাগারাগি যখন মারামারিতে পর্যবসিত হল, তখন কার্পেন্টারের কানে উঠল ব্যাপারটা। তিনি ডেকে পাঠালেন টি-ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত ওস্তাদকে। এলেন ক্যাপ্টেন এডসেল ডিমক। বেশ বলিষ্ঠ যুবক, মাত্র তিন বছর আগে ডাক্তারি পাশ করেছেন। কিন্তু মাথায় টাক পড়েছে এর মধ্যেই।

‘শোনো ডিমক।’ বললেন কার্পেন্টার, ‘আমাদের নীতি যে কী, তা তোমার না-জানার কথা নয়। নীতি হল, প্রত্যেকের জন্য একটা করে নির্দিষ্ট কাজ, আর প্রত্যেক কাজের জন্য একটা করে নির্দিষ্ট মানুষ। এখন দেখা যাচ্ছে, সেন্ট আলবান্স হাসপাতালের টি-ওয়ার্ডে কোনো একটা লোক গাফিলতি করে চলেছে তার নির্দিষ্ট কাজে। সেই লোকটা কে, তার গাফিলতিটা ঠিক কোন জাতীয়, এটা জানা দরকার। আশা করি তুমি পারবে আমাকে জানাতে। আমার প্রথম প্রশ্নই হল, টি-ওয়ার্ড পদার্থটি কী?’

ডিমক যেন ঠিক করতেই পারে না যে কী উত্তর দেবে এ-প্রশ্নের। খানিকটা ঢোঁক গিলে, কিছুক্ষণ ডাইনে-বাঁয়ে পর্যায়ক্রমে তাকিয়ে, তারপর বলল, ‘এটা একটা বিশেষ ওয়ার্ড, তালিকা-বহির্ভূত। যুদ্ধে আহতদের মধ্যে বিশেষ একটা শ্রেণির জন্য এটা আলাদা করা রয়েছে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে যারা আকস্মিক কোনো আঘাত পেয়ে, আঘাতটা অবশ্য দেহে নয়, মস্তিষ্কে—’

‘রোগী আছে তাহলে ওখানে?’ মাঝখান থেকে প্রশ্ন করে বসেন কার্পেন্টার।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, রোগী আছে বই কী! দশজন স্ত্রীলোক, চৌদ্দোজন পুরুষ।’

একতাড়া রিপোর্ট ডিমকের নাকের উপর নাচিয়ে কার্পেন্টার বললেন, ‘সেন্ট আলবান্সের অন্য বিভাগের রোগীরা বলে টি-ওয়ার্ডে কোনো রোগী নেই।’

ডিমক স্তম্ভিত। ও-অপবাদ মিথ্যে, জোরগলায় সে জানিয়ে দিল।

‘তা বেশ।’ কার্পেন্টার বললেন, ‘রোগী আছে তাহলে। চব্বিশ জন। তোমার কাজ হল তাদের আরাম করে তোলা, তাদের কাজ হল আরাম হয়ে ওঠা। বাগড়া পড়ছে কোন দিক থেকে?’

‘বাগড়া পড়ছে তাদের অস্বাভাবিক আচরণ থেকে। প্রথমত অনেক সময় তারা খায় না কিছু।’

‘খায় না? তাহলে বাঁচে কী করে?’

‘সমস্যা তো সেখানেই। খায়ও না, ঘুমোয়ও না। উপরন্তু তারা উবে যায় যখন-তখন।’

‘উবে যায়?’ কার্পেন্টার রেগে উঠছেন, এই ছোকরা ওস্তাদ ঠাট্টা করছে নাকি তাঁকে? তা ছাড়া এ কথার আর কী মানে হতে পারে? উবে যায়?

‘ঠিকই বলছি স্যার, উবে যায় ওরা। এই হয়তো একজন বিছানায় বসে আছে, এই সে নেই। এই হয়তো একজন দাঁড়িয়ে আছে, চোখের পলক পড়বার আগেই সে অদৃশ্য। নিয়মিত চব্বিশ জন থাকবার কথা এখানে, এক এক সময় পাওয়াও যায় চব্বিশ জনকেই। অন্য সময় আবার একজনকেও দেখতে পাবেন না। সেইজন্যই ডবল তালা দিয়ে বন্ধ রাখি ওয়ার্ডটা। কিন্তু বৃথা, বাইরে যতই তালা ঝুলুক, ভিতর থেকে তারা উধাও।’

‘যারা পালায়, তাদের তিনজনকে হাজির করো আমার কাছে।’ হুকুম দিলেন কার্পেন্টার।

‘তিনজন?’

একজনের কথা বলা যাক প্রথমে—

নাথান রিলি কিছুই খাননি টি-ওয়ার্ডে, কখনো খান না। তিনি খান অন্যত্র। নিউ ইয়র্কের এক অভিজাত হোটেলে প্রাতভোজন পর্ব সমাধা করলেন ফরাসি টোস্ট আর ডিমের মোরব্বা দিয়ে, দুই পাঁইট বাদামি ‘এল’ তার সঙ্গে। তারপর একটা জন-ড্রু ফুঁকতে ফুঁকতে টেবিল ছেড়ে উঠলেন, মাথা ঈষৎ হেলিয়ে সম্ভাষণ জানালেন মাননীয় জিম কর্বেটকে। কর্বেট কথা বলছিলেন ডায়মন্ড জিম ব্র্যাডির সঙ্গে, কথা বন্ধ করে ভিড়লেন এসে রিলিকে পাকড়াবার জন্য—

‘এবারে পতাকা কারা জিতবে বলে মনে করো, রিলি?’

নাথান রিলিকে চিন্তা করতে হল না। এক সেকেন্ডের মধ্যে জবাব দিলেন, ‘কেন? ডোজার্স!’

‘ওদের এমন কী আছে, যার দরুন—’

‘ওদের আছে স্মাইডার, ফুরিলো, ক্যাম্পানেলা। পতাকা ওরা নেবেই এবার, জিম। লিখে রাখতে পারো, মিলিয়ে নিও।’

কর্বেট স্বীকার করলেন, ‘তোমার কখনো ভুল হতে দেখিনি নাথান।’

রিলি হেসে ক্যাশিয়ারের ডেস্কের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, চেক কেটে দিলেন প্রাতভোজনের বাবদ, তারপর রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে ঘোড়ার বাস ধরলেন— ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের। পঞ্চাশ নং স্ট্রিট আর আট নং অ্যাভেনিউর মোড়ে নেমে পড়ে ঢুকলেন এক বাড়িতে। নীচে রেডিয়ো মেরামতের দোকান, উপরে বুকির অফিস। বুকি একবার তাঁকে দেখে নিয়েই একখানা খাম বার করল দেরাজ থেকে, তাতে রয়েছে পনেরো হাজার ডলার। পনেরোখানা হাজারি বিল রিলির হাতে গুনে দিয়ে বুকি বলল, ‘এগারো নম্বরে রকি মার্সিয়ানোই জিতেছে। তুমি কী করে আগে থেকে টের পাও হে ন্যাট?’

‘টের পেতে হয়। আমার তো ওই পেশা। ভুল হলে খাব কী?’ বললেন রিলি। তারপরই প্রশ্ন করলেন, ‘ইলেকশন নিয়েও কিছু ধরাধরি করছ নাকি হে?’

‘আইজেনহাওয়ার বারোতে পাঁচ। স্টিভেনসন—’

‘অ্যাডলাইয়ের কথা ছাড়ো।’ অসহিষ্ণুভাবেই বলে উঠলেন রিলি, ‘এই বিশ হাজার রইল আমার আইকের উপর।’ কথার সঙ্গেসঙ্গে কাউন্টারে বিশ হাজার ডলার গুনে দিলেন বুকির সামনে।

ওয়ালডর্ফ-এ রিলির ফ্ল্যাট। সেখানে অপেক্ষা করছেন এক যুবক রিলির জন্য।

রিলি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনিই হেনরি ফোর্ড, কী বলেন? বাইসিকেলের দোকান আছে? হালে একটা যন্ত্র তৈরি করেছেন? কী নাম রেখেছেন যেন?’

যুবক উত্তর দিলেন, ‘ইপসিমোবাইল—’

রিলি মাথা নেড়ে বললেন, ‘পছন্দ হচ্ছে না নামটা। অটোমোবাইল নাম দিলে কেমন হয়?’

‘চমৎকার হয়!’ সোৎসাহে জবাব দিলেন যুবক।

‘তাহলে আর কী? অটোমোবাইল চালু করার জন্য কিছু অর্থের দরকার বুঝি? তা আমি নিলাম— দুই লক্ষ ডলারের শেয়ার।’ সঙ্গে সঙ্গে চেক লিখে দিলেন রিলি। হেনরি ফোর্ড বিদায় হয়ে গেলেন ধন্যবাদ দিয়ে। রিলি ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়েই শোবার ঘরে ঢুকলেন গিয়ে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে পোশাক বদল করলেন। তাঁর পরনে এখন ছাই-রং-এর শার্ট আর প্যান্ট। শার্টের বুক-পকেটের উপর চারটি অক্ষর লেখা— ইউ এস এ এইচ, অর্থাৎ ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি হসপিটাল।

পোশাক পরার সঙ্গেসঙ্গে উবে গেলেন রিলি।

আর উবে যাওয়ার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই আবার দেখা দিলেন টি-ওয়ার্ডে তাঁর খাটিয়ার পাশে। ব্যস, আর যায় কোথায়! তিন জোড়া হাত তাঁকে জড়িয়ে ধরে ফেলল, আর একজোড়া দেড় সি সি সোডিয়াম থাইয়োমর্ফেট ইঞ্জেকশন ঢুকিয়ে দিল তাঁর দেহে। ব্যস, রিলি অজ্ঞান।

জেনারেল কার্পেন্টারের সমুখে তাঁকে হাজির করা হল যখন, নিছক একা তিনি নন। টি-ওয়ার্ডের আরও দুই রোগী, উঁহু ভুল হল— এক রোগী ও এক রোগিণী— জর্জ হ্যানমার ও লেলা মাশান— এঁরাও আছেন তাঁর সঙ্গে। এঁরাও অন্তর্ধান করেছিলেন ওয়ার্ড থেকে, ফিরে আসামাত্র গ্রেফতার হয়েছেন।

কার্পেন্টারের প্রশ্নের উত্তরে গলগল করে নিজেদের প্রাতঃকালীন ভ্রমণসূচি বর্ণনা করে গেলেন তিনজনেই। রিলির গতিবিধির বিবরণ তো আগেই দেওয়া হয়েছে, বাকি দু-জনের বক্তব্যও সমান আজগুবি। সেকেন্ড— কর্পোরাল হ্যানমার নাকি এই সকালেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিয়ে এলেন। সে-বক্তৃতা শুনে পর পর গ্লাডস্টোন, পিট, চার্চিল আর ডিজরেলি অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁকে। ডিজরেলি নিজের রোলস রয়েস গাড়িতে চড়িয়ে হ্যানমারকে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্যাটার্সল হোটেলে, ভরপেট খাইয়ে দিয়েছেন গিনেস আর হাড়ের গ্রিল।

আর মেডিক্যাল সার্জেন্ট লেলা মাশান? তাঁর বৃত্তান্ত আরও রোমাঞ্চকর। তিনি সকাল বেলাটা কাটিয়েছেন জুলিয়াস সিজারের আমলের রোমে। সিজারের সঙ্গে পথে দেখাও হয়েছিল এবং দেখার সঙ্গেসঙ্গেই ঝগড়া; কারণ সিজার ছিলেন ব্রিটিশ রানি বোডিশিয়ার শত্রু ও মৃত্যুর কারণ। এদিকে লেলা আবার হচ্ছেন সেই বোডিশিয়ারই কন্যা।

এ কী? এসব কী? এই তিনটি লোকই কি উন্মাদ? প্রথম হেনরি ফোর্ড, আইজেনহাওয়ার, এঁরা কেউ এ যুগের লোক নন; তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছিল শ-তিনেক বছর আগে। তেমনি গ্লাডস্টোন, চার্চিল গয়রহ ইংরেজ রাষ্ট্রনায়কেরা, তাঁরা এক একজন এক এক শতাব্দীর, তাও সেসব শতাব্দী অতীতের গর্ভে বিলীন হয়েছে আইজেনহাওয়ারদের আগে আগে। আর লেলা মাশানের গুলির গল্প? জুলিয়াস সিজার? যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে তিনি মারা গিয়েছেন?

নিঃসন্দেহে মিছে কথা বলছে এরা। লাগাও ট্রুথ সেরাম, সে-ওষুধ পড়লে এক্ষুনি মুক্তকণ্ঠে সত্যকথা বলতে শুরু করবে।

কিন্তু কাকে লাগাবে ট্রুথ সেরাম? হুকুম জারি করেই কার্পেন্টার হাঁ করে ফেললেন— সেরাম যাদের দেওয়া হবে, তারা কেউ তাঁর সমুখে আর নেই, উবে গিয়েছে একদম।

ভাবতে বসলেন কার্পেন্টার। ইতিহাসটাই গুলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর। একই দিনের ভিতরে জুলিয়ার সিজার, আর গ্লাডস্টোন আর জিম কর্বেটের সহাবস্থান সম্ভব হয় কেমন করে?

এ-সমস্যার সমাধান? কোনো ইতিহাসের ওস্তাদ যদি পারে তো হবে। কিন্তু ইতিহাসের কোনো ওস্তাদ আর এ-যুগে তৈরি হচ্ছে না, নিজের চেষ্টায় যারা শিখেছিল ইতিহাস, তাদের মধ্যে বেঁচে আছেন একমাত্র প্রোফেসর স্ক্রিম, তাও তিনি জেল খাটছেন গত দশ বছর ধরে, আরও দশ বছর খাটবেন।

অপরাধ? কার্পেন্টারের মার্কিন স্বপ্নকে তিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন গাঁজাখুরি বলে।

আজ সেই স্ক্রিমকেই ডেকে আনতে হল, ইতিহাসের এই ধাঁধার জট খুলবার জন্য। তিনি সব শুনে বললেন, ‘ওরা কালান্তরে ভ্রমণ করার বিদ্যাটা আয়ত্ত করেছে। টাইম-মেশিনে চেপে নয়— কল্পনায় দোলায় চেপে। যুদ্ধে হাইড্রোজেন বোমায় ঝলক খেয়েছিল ওরা, তাতে কল্পনার ফোয়ারের মুখ খুলে গিয়েছে ওদের মগজে। যার যা মনের গোপন বাসনা ছিল আহত হওয়ার আগে, কল্পনার দৌলতে সে-বাসনা এখনও তৃপ্ত করছে ওরা। আপনার মার্কিন স্বপ্ন যদি গাঁজাখুরি না-হয়, এদের এ-সব স্বপ্নকেই বা কেন বলব গাঁজাখুরি? ওদের বোমা বিকৃত মস্তিষ্কের কাছে ওই সবই সত্য?’

‘এর সমাধান কে করবে?’ কার্পেন্টার প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন।

স্ক্রিম হেসে বললেন, ‘এর সমাধানের শক্তি কারও যদি থাকে, তবে আছে মহাকবিদের। যাঁরা কল্পনা জগতের সম্রাট।’

মহাকবি? হায়, সব বিদ্যারই ওস্তাদ হাজারে হাজারে তৈরি হয়েছে কার্পেন্টারের ফর্মাইশে। কিন্তু কবি তৈরি করার ফর্মাইশ তো তিনি করেননি কোনোদিন। আর করলেই বা কী হত? ফর্মাইশ দিয়ে অনেক কিছুই বানানো যায়, যায় না কেবল কবি।

____

এক লক্ষ কোটিতে এক বিলিয়ন।