সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

২৪. ধূমকেতুর উদরে

ধূমকেতুর উদরে

মাইক্রোফোনে কথা কইছে জর্জ পিকেট—

‘কেন যে বলছি এসব কথা, তা জানি নে। কেউ যে শুনতে পাবে একথা, তার আদৌ সম্ভাবনা নেই। শুনেছি বিশ লক্ষ বছর পরে এই ধূমকেতু আবার পৃথিবীর ধারে-কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের। তখনও কি বেঁচে থাকবে মানুষ জাতটা? থাকে যদি, তখনকার মানুষের চোখে এই ধূমকেতুর চেহারা কি আজকের মতোই জমকালো ঠেকবে? হয়তো সেদিন তারাও একটা অভিযান পাঠাবে এই ধূমকেতুর রহস্য উদঘাটনের জন্য, যেমন বর্তমান পৃথিবী পাঠিয়েছে আজ। হয়তো সেই অভিযাত্রীরা এসে আমাদেরই আবিষ্কার করবে ধূমকেতুর উদরে—

‘কেন করবে না? অত-অত-কল্পান্ত পরেও আমাদের এই বিমান যে অটুট থাকবে— এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা একমত। জ্বালানী থাকবে চৌবাচ্চায়, হয়তো বাতাসও থাকবে প্রচুর। কারণ, আমরা যে নিশ্বাস নিয়ে নিয়ে খরচ করে যাব সব বাতাস, এমন ভরসা নেই কিছু। বাতাস ফুরোবার আগেই খাদ্য ফুরিয়ে যাবে। অবশ্য না-খেয়ে মরার যন্ত্রণা সইবার জন্য ততদিন আমরা বেঁচেই বা থাকব কেন? এয়ার-লক খুলে বেরিয়ে পড়লেই তো সব ঝামেলার অবসান!

‘খুব বাচ্চা ছিলাম যখন, একটা বই পড়েছিলাম— উইন্টার অ্যামিড দ্য আইস। মেরু-পর্যটনের গল্প। তাতে বর্ণনা ছিল যে-দৃশ্যের, তাই আজ চোখে দেখছি এই ধূমকেতুর লেজের ভিতরে। বরফ! বরফ! সর্বত্রই বরফের স্তূপ। বিশাল বিশাল গাদা বরফের, তাদের গায়ে হাজার ছিদ্র। আমাদের ”চ্যালেঞ্জার”কে ঘিরে রয়েছে ওই রকমই কয়েক ডজন গাদা। ঠান্ডা হয়ে দাঁড়িয়ে নেই গাদাগুলো, ঘুরপাক খাচ্ছে পরস্পরের চারদিকে। তবে কথা এই, সে ঘুরপাক এত মন্থর, অনেকক্ষণ ধরে ঠাহর করলে তবেই তা নজরে পড়ে।

‘তা বলে পৃথিবীর সেই মেরুমণ্ডলের শীতকে যেন আমাদের এই ধূমকেতুর লেজের শীতের সঙ্গে তুলনা করতে যাবেন না। এখানে তাপাঙ্ক শূন্যর নীচেও সাড়ে চার-শো। সূর্য থেকে আমাদের দূরত্ব থাকবে এতখানি যে তার আলো আমাদের স্পর্শ করবে যখন, নক্ষত্রের আলোর মতো তা ঠান্ডা লাগবে দেহে। শীতের রাতে লুব্ধকের আলোতে হাত-পা গরম করার চেষ্টা করেছেন কোনোদিন? তাহলে আন্দাজ করতে পারবেন যে কী আরামে ছিল চ্যালেঞ্জারের যাত্রীরা।’

ব্যস! আর কথা সরল না জর্জ পিকেটের গলা দিয়ে। ভাবের আবেগে বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেল তার স্বর। পৃথিবীর শীতের রাতে বরফ-ঢাকা মাঠের উপরে নক্ষত্রালোকের মৃদু আভা যে কী মোহময়ী, মনে পড়ে গেল তার, এই ধূমকেতুর লেজের ভিতর বসে। পাঁচ কোটি মাইল পিছনে পড়ে আছে পৃথিবী। বড়োদিনের গির্জার ঘণ্টা কবে সে শুনেছিল সেই পৃথিবীর তারায়-ভরা স্তব্ধ নিশীথে, তারই স্মৃতি এই মুহূর্তে আকুল করে তুলল তার প্রবাসী চিত্তকে।

হারিয়ে ফেলেছি! হারিয়ে ফেলেছি আমার সেই সোনার পৃথিবীকে! চিরদিনের জন্য! চিরদিনেরই জন্য! একটা হাহাকার বুকের ভিতর থেকে গলা পর্যন্ত ঠেলে উঠে সেইখানেই আটকে গেল শেষমুহূর্তে। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে পারল না জর্জ, কিন্তু চোখের জল ছেড়ে দিল অঝোরধারে।

কিন্তু গোড়ার দিকে সমস্ত ব্যাপারটাই চমৎকার লেগেছিল এমন! মাত্র ছ-মাস আগে! ভাবতেও অবাক লাগে; মাত্র ছ-মাস আগে আঠেরো বছরের ছোকরা জিমি র‌্যান্ডাল তার বাড়ির পুরোনো ভাঙা দূরবিনে প্রথম দেখতে পেল এই ধূমকেতুকে। দেখতে পেয়েই তার করে দিল মাউন্ট স্ট্রমোলোর মানমন্দিরে। তখন ওটাকে দেখাচ্ছে একটা কুয়াশার ঝাঁটার মতো। বিষুবরেখার দক্ষিণে। আকাশে যেখানে এরিডেনাস নক্ষত্রপুঞ্জ, সেইখানে। তারাগুলোর মাঝখান দিয়ে দিয়ে পথ করে করে বেরিয়ে আসছে ক্রমশ। মঙ্গলের অনেক পিছনে তখন ওটা। বিরাট দীর্ঘ একটা কক্ষপথ ধরে সূর্যের দিকে এগিয়ে আসছে অবিচলভাবে।

র‌্যান্ডালের ধূমকেতু—

ওই নামই এ যুগে হয়েছে ধূমকেতুটার। আগের বার যখন পৃথিবীর আকাশে ওর উদয় হয়েছিল, তখন ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টি নিবদ্ধ করবার জন্য কোনো মানুষ ছিল না পৃথিবীর বুকে। মানবজাতির অভ্যুদয়ই হয়নি তখনও এ গ্রহে। আর এর পরের বার যখন এ দেখা দেবে এই আকাশে, তখনও হয়তো পৃথিবী থেকে কোনো মানুষের অবাক দৃষ্টি প্রসারিত হবে না ওর পানে। আরও বিশ লক্ষ বছর পরমায়ু আছে না কি এই মানবজাতির? না, না, মানুষের সাথে এ ধূমকেতুর শুভদৃষ্টি— এই প্রথম এবং এই শেষ।

সূর্যের যত কাছে আসছে, ততই কলেবরে বাড়ছে ধূমকেতুটা। ওর দেহ থেকে লম্বা পালকের আকারে গ্যাস উঠছে ফুঁসে ফুঁসে, সে গ্যাস কখনো-বা ফোয়ারার আকারে ছুটে যাচ্ছে মহাকাশ বিদীর্ণ করে। ওর যেকোনো একটা ফোয়ারার আয়তন এক-শোটা পৃথিবীর সমান হবে। একটা পতাকা যেন পত পত করে উড়ছে বহিরাকাশের কোনো অননুভূত সমীরণে। সে পতাকার দৈর্ঘ্য মঙ্গলের পাশ দিয়ে ছুটে আসবার সময়ই ছিল চার কোটি মাইলের মতো।

সেই সময়ই জ্যোতিষীদের মাথায় আসে এই পরিকল্পনা। ব্রহ্মাণ্ডের সর্বকালের অতুলনীয় এই যে প্রপঞ্চ, এর সম্বন্ধে একটু-কিছু জানবার চেষ্টা করলে তো হয়! জানবার উপায় হিসেবে তাঁরা প্রস্তাব দিলেন যে, একখানা আন্তর্নক্ষত্র মহাবিমান অবিলম্বে ধাওয়া করুক ওর পিছনে, পারে তো ওর নাগাল ধরে ফেলুক, ঢুকে পড়ুক ওর জঠরে। নেড়ে-চেড়ে দেখে আসুক ওর নাড়িভুঁড়ি।

সেই কল্পনা থেকে এই চ্যালেঞ্জারের অভিযান। ধূমকেতু শিকারের জন্য। এরকম উদ্দেশ্যে এর আগে কোনো অভিযান বেরোয়নি পৃথিবী থেকে, পরেও বেরুবে বলে আশা নেই। কারণ এ-বারের অভিজ্ঞতা তো ভয়াবহ হতে চলেছে! এরপরও কি আবার মানুষ হাত দেবে এরকম মারাত্মক ব্যাপারে?

কয়েক হপ্তা ধরে, ভোরের কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে একে দেখা যাচ্ছিল, দ্বিতীয় আর একটা ছায়াপথের মতো আকাশের প্রান্ত থেকে প্রান্ত পর্যন্ত অসীম অলস দৈর্ঘ্যে প্রসারিত। ছায়াপথেরই মতো, কিন্তু আসল ছায়াপথের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল।

তারপর মঙ্গলের সান্নিধ্য ছেড়ে ও এগুতে লাগল সূর্যের দিকে। ধূমকেতু প্রথম এল তাপের সংস্পর্শে। প্রথম, অর্থাৎ বিশ লক্ষ বছরের মধ্যে এই প্রথম। আগের বার যখন সে সংস্পর্শে ও এসেছিল, তখন ম্যামথের দাপাদাপিতে কম্পিত হচ্ছে পৃথিবীর মাটি।

সূর্যের যত নিকটবর্তী হচ্ছে ও, ততই ওর গা থেকে ছুটে বেরুচ্ছে জাজ্বল্যমান বাষ্পীয় প্রপাত, লেজের নকশা উলটেপালটে যাচ্ছে একই রাতের ভিতরে প্রহরে প্রহরে। কিন্তু যেভাবেই ওলটাক, তার গতি সবসময়েই সূর্যের বিপরীত দিকে। যেন সূর্যমণ্ডলের হৃদয় থেকে একটা অগ্নিঝটিকা বেরিয়ে ওকে ঠেলতে ঠেলতে দূরে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত।

চ্যালেঞ্জার অভিযানে চাকরি পাওয়া, জর্জ পিকেটের পক্ষে একেবারেই ছিল অপ্রত্যাশিত। বিজ্ঞানের ‘ব’ জানে না। পেশায় সংবাদপত্রের রিপোর্টার। রিপোর্ট লিখবার মতো রোমাঞ্চকর কিছু তথ্য লাভ করবে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে— এই আশাতেই একটা আবেদন পাঠিয়েছিল। কিন্তু বিড়ালের বরাতে শিকে ছিড়বে, এমন ভরসা মোটেই করেনি। কী করে যে ছিড়ল, এখনও তা বুঝতে পারেনি। পারমাণবিক বোমা যখন তৈরি হল প্রথম, তখন সে প্রকল্পে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পেয়েছিল এক রিপোর্টার, তার নাম উইলিয়াম লরেন্স। সেই আর এই। রিপোর্টার মহলে এই দুই জনের নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে ভাগ্যবান হিসেবে।

কেন পেল পিকেট এ চাকরি? বিবাহিত নয়, সে একটা সুবিধা ছিল ওর স্বপক্ষে। তারপরে স্বাস্থ্য ভালো, ওজন এক-শো কুড়ি পাউন্ডের উপরে নয়। গলগ্রহ নেই সংসারে কেউ— এ সবই ওর যোগ্যতার ফর্দটাকে দীর্ঘায়িত করেছিল। কিন্তু ওরকম যোগ্যতা তো আরও কয়েক হাজারের ছিল নিশ্চয়! যাক গে, তারা তখন হয়েছিল ঈর্ষান্বিত, এখন ভাববে, ‘বড্ড ফাঁড়াটা কেটে গিয়েছে বাবা!’

পিকেট রিপোর্টার হিসেবেই যোগ দিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই; কিন্তু যোগ দেওয়ার পরে তাকে এখন নানা কাজ দেখতে হচ্ছে বিমানে। সে হয়েছে সেক্রেটারি। ‘লগ’ লিখতে হয় তাকে, ভাঁড়ারের হিসাব রাখতে হয়, মেলাতে হয় পয়সাকড়ির হিসাবও। মহাকাশের এ স্তরে ‘ওজন’ বলে কিছু নেই, তিন ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট যেকোনো লোকের পক্ষে, তা না-হলে ঘুমের সময়ের অভাবই কাহিল করে ফেলত পিকেটকে।

প্রায় সারাক্ষণই সে কাজে ডুবে আছে। খুপরির মতো একটুখানি অফিস। কখনো হয়তো সেখানে বসে খাতা লিখছে। বিরাট ভাঁড়ার বিমানের খোলে, কখনো-বা সেখানে দাঁড়িয়ে মিলিয়ে নিচ্ছে ঊনকোটি চৌষট্টি রকম মাল। যখন এসব কিছুই করছে না, তখনই বেরুচ্ছে নিজের টেপ রেকর্ডার নিয়ে। টুকে নেবার মতো কিছু চোখে পড়লে বা কানে এলে, টুকে ফেলবে তক্ষুনি।

বিমানে বিজ্ঞানী আর ইঞ্জিনিয়ার মিলে মানুষ আছে কুড়িটা। সুযোগমতো এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাপ করে নিয়েছে পিকেট, যথাসম্ভব ঘনিষ্ঠতাও। অল্পাধিক সদ্ভাব সকলের সঙ্গেই, রাগারাগি কারও সঙ্গেই না। অবশ্য এখন সদ্ভাবেও কিছু আসবে-যাবে না, তার অভাবেও না। কারণ, মরণ আসন্ন। মরণ আসন্ন জেনেই মাইকে অমন মরাকান্না কাঁদছিল সে।

আলাপ জমানো সবচেয়ে শক্ত হয়েছিল ডক্টর মার্টেনসের সঙ্গে। অথচ তা জমানোও তো দরকার ছিল। কারণ অন্য সবাইয়ের চাইতে উনিই বেশি ওয়াকিবহাল। সত্যিকার জ্ঞানদানের সামর্থ্য ওঁরই আছে। পিকেটকে বেশ কিছুদিন ঘুরতে হয়েছিল সুযোগের সন্ধানে। এমন সুযোগ, যাতে ওঁকে না-চটিয়েও দুটো কথা জেনে নেওয়া যায়।

অবশেষে সে সুযোগ জুটেছিল একদিন। চ্যালেঞ্জার তখনও ওই ধূমকেতুর দুই কোটি মাইল পিছনে, তবে দূরত্বটা দৈনিক কমে আসছে দ্রুতবেগে। পর্যবেক্ষণশালায় হঠাৎ মার্টেনসকে নিরিবিলি দেখতে পেয়ে সে জিজ্ঞাসা করে বসেছিল বিনা ভূমিকায়— ‘ডক্টর মার্টেনস! ঠিক কী কী জিনিস দিয়ে গড়ে উঠেছে ওই র‌্যান্ডালের ধূমকেতু?’

ছোকরার ধৃষ্টতা নিয়ে মাথা ঘামালেন না বিজ্ঞানী। বরং উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তার জ্ঞানস্পৃহা দেখে। তিনিও বিনা ভূমিকায় জবাব দিলেন, ‘অনেক কিছুর মিশাল বাপু! তা ছাড়া, সূর্য থেকে যত দূরে যাব, ততই পালটে যাবে সেসব উপাদান। তবে মোটামুটি জেনে রাখো— ধূমকেতুর লেজে প্রধানত যা যা থাকে, তা হল— অ্যামোনিয়া, মিথেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড, জলীয় বাষ্প, সাইয়ানোজেন—’

‘সায়ানোজেন?’— পিকেট বিস্ময় দমন করতে না-পেরে জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘সাইয়ানোজেন গ্যাসটা না বিষাক্ত? পৃথিবী যদি ওর ভিতর দিয়ে যেতে বাধ্য হয় কখনো, কী হবে বলুন দেখি!’

‘কিচ্ছুই হবে না।’ ডক্টর নির্বিকার ভাবে জবাব দিলেন, ‘দেখতে যতই জমকালো হোক, আমাদের মান অনুযায়ী ধূমকেতুর লেজ জিনিসটা প্রায় ফাঁকা, একদম শূন্য। ওই লেজের ভিতর পৃথিবীর সমান আয়তনের একটা জায়গা বেছে নাও যদি, তাতে বাষ্প পাবে কতটুকু জানো? একটা দেশলাই বাক্সে যতটুকু রাখা যায়।’

‘অত হালকা জিনিসের অমন জমকালো শোভা?’ অবাক হয়ে যায় পিকেট।

‘জমকালো দেখায় এইজন্য যে ধূমকেতুর লেজের উপরে সূর্য থেকে বিদ্যুৎবাহী পরমাণুর বর্ষণ হচ্ছে অবিশ্রান্তভাবে।’ বুঝিয়ে দিলেন মার্টেনস।

পিকেট এইবার তার আসল প্রশ্নে এল, ‘লেজের ব্যাপার মোটামুটি বুঝলাম। এইবার বলুন তো, ধূমকেতুর হৃদয়ে আমরা প্রবেশ করব কবে? কেন্দ্রবিন্দু যাকে বলে?’

‘ছুটছি তো আমরা প্রাণপণে।’ বললেন ডক্টর, ‘তবু সময় লাগবে। দুই হপ্তা আরও। কেন্দ্রবিন্দু এখনও দুই কোটি মাইল দূরে। তবে আশার কথা এই যে, অত দূরত্বে থেকেও আমরা ওর সম্বন্ধে কিছু দামি তথ্য ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি। এই ধরো না কেন, ওই কেন্দ্রবিন্দু যে অতি ছোট্ট ব্যাপার একটা, তা আর অজানা নয় আমাদের। বলতে কী, ওর ব্যাসের পরিমাণ হল পঞ্চাশ মাইল মাত্র। তাও আবার নিরেট পঞ্চাশ মাইল নয়— হাজারে হাজারে ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র পদার্থ ভিড় করছে ওইটুকু জায়গার মধ্যে, ভেসে বেড়াচ্ছে পরস্পরের গায়ে ধাক্কা মেরে মেরে।’

‘সেই হাজার হাজার পদার্থের ভিড়ে আমরাও ঢুকতে পারব তো?’

‘আগে কাছাকাছি পৌঁছোই, তারপর বুঝতে পারব। হয়তো নিরাপত্তার খাতিরে আমরা চাইবই না ঢুকতে, কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে দূরবিনের সাহায্যে দেখে নেব, যা-কিছু ওখানে দেখবার আছে। তবে একথা তোমায় অকপটে বলছি— একেবারে কেন্দ্রে না-যদি ঢোকা হয় ব্যক্তিগতভাবে আমি ভারি নিরাশ হব তাতে।’

‘আমিও হব।’ বলল পিকেট। সব কথাই উঠে গিয়েছে টেপ রেকর্ডে, সেটা বন্ধ করে দিয়ে ভাবতে লাগল— বিপদের আশঙ্কা না-যদি থাকে, কেন হবে না কেন্দ্রে প্রবেশ করা? এত কাছে এসে—

সত্যিই ছিল না বিপদের আশঙ্কা। অর্থাৎ ধূমকেতুর দিক থেকে না। কিন্তু এল বিপদ। ঘোরতর বিপদ। ধূমকেতুর কোনো দোষে নয়, বিমানেরই আভ্যন্তরীণ ত্রুটিতে।

হঠাৎ কম্পিউটার বিগড়ে গেল।

ভাঁড়ার ঘরে শুকনো মাংসের বাক্স গুনছিল পিকেট। গোনা, মানে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে দেখা একবার। যোগ বিয়োগ করে অঙ্কের ফলটি তুলে ধরবে কম্পিউটার, পিকেটের কাজ সংখ্যাটি শুধু লিখে নেওয়া।

তা যন্ত্রের দিকে তাকিয়ে পিকেট দেখল, সংখ্যা উঠেছে ৯৯৯৯৯৯৪৩।

সে চমকে উঠল। এত বাক্স মাংস চ্যালেঞ্জারে? অত বোঝা খোলের ভিতর ঢুকবে কোথায়? আর ঢুকলেই বা তা নিয়ে একটা বিমান উড়বে কেমন করে?

তা ছাড়া, গত হপ্তায় কম্পিউটার দেখিয়েছে— মাংসের বাক্স অবশিষ্ট আছে ষাটটা। তা থেকে এ ক-দিনে খরচও হয়েছে দশ-পনেরো বাক্স। তবু বাকি রইল ৯৯৯৯৯৯৪৩?

পিকেট স্বভবতই ভাবল— যন্ত্র চালু করবার সময়েই কিছু ভুল সে নিজেই করে থাকবে। সব খুলে ফেলে আবার নতুন করে চালু করল সে। ফল আবারও পূর্ববৎ। তবে এবার সংখ্যা উঠেছে নতুন একটা। নিঃসন্দেহে বিগড়েছে কম্পিউটার।

বিরক্ত হয়ে পিকেট চলল ডক্টর মার্টেনসকে এত্তেলা করতে। কারণ, এসব যন্ত্রপাতির খবরদারির মালিক তিনি।

ব্যায়ামঘরে দেখা মিলল তাঁর। প্রত্যেক বৈমানিককেই এখানে দৈনিক এক ঘণ্টা ব্যায়াম করতে হয়। এ স্তরে মাধ্যাকর্ষণ নেই। পেশির নিয়মিত চালনা না-হলে তা শুকিয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার ভয় আছে।

মার্টেনস একজোড়া ভারী ডাম্বেল নিয়ে কসরত করছিলেন প্রাণপণে, মুখে ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ জাতীয় অভিব্যক্তি একটা। এমন সময় পিকেট গিয়ে জানাল সুসংবাদ। এবার অভিব্যক্তিটা দাঁড়াল স্রেফ ‘মরেঙ্গে’-ব্যঞ্জক।

কম্পিউটারের মূল বোর্ড মার্টেনসের ঘরে, সেখানে গিয়ে দুই-একটা প্রশ্ন রাখা হল যন্ত্রের কাছে। উত্তর যা মিলল, তাতে মাথায় হাত দিয়ে বসতে হল ডক্টরকে। আর ‘মরেঙ্গে’ নয়, ‘মর গ্যয়া’। কম্পিউটারের বারোটা বেজে গিয়েছে। পৃথিবী থেকে কোটি কোটি মাইলের দূরত্বে দিকচিহ্নহীন বহিরাকাশে, পৃথিবীর কয়েকটি সন্তান আজ একান্ত অসহায় দিশেহারা, ‘কোন পথে যাব, কাহারে শুধাব’ অবস্থা।

‘মেরামত করা চলবে তো নিশ্চয়ই!’ পিকেটই আশ্বাস দিতে চায় ডক্টরকে।

মাথা নাড়লেন মার্টেনস, ‘যারা গড়েছিল, তাদের পক্ষেও তা অসাধ্য। মানুষের মস্তিষ্ক যেমন, অগুন্তি মাইক্রো-সার্কিটের নিরেট সমষ্টি একটা ওই কম্পিউটার। স্মৃতির তন্ত্রীগুলি এখনও চালু আছে, কিন্তু গণনার তন্ত্রী সব অকেজো এখন। ও-দিয়ে আর কোনো কাজ হবে না।’

‘তা হলে?’ হকচকিয়ে যায় পিকেট।

‘তাহলে ধরে নাও যে আমরা সব মরে গিয়েছি। কম্পিউটার যখন নেই, তখন আমরাও থাকব না। পৃথিবীতে ফিরবার পথ বাতলাবে কে? সব তো গণনার কাজ, আঁক কষার ব্যাপার। কাগজে-কলমে সেসব আঁক কষে বার করতে হলে উঁচুদরের গণিতজ্ঞ চাই কয়েক-শো এবং সময় চাই কয়েক মাস।’

‘আপনি হাসালেন স্যার।’ বলল পিকেট, ‘বিমান অক্ষত রয়েছে। খাদ্যপানীয় প্রচুর রয়েছে, অথচ আপনি বলছেন যে, এতগুলি বুদ্ধিমান মানুষ অনিবার্যভাবেই মারা পড়বে। গোটা কতক আঁক কষতে পারছে না বলে?’

‘গোটা কতক?’ ‘গোটা’ শব্দটার উপর অসম্ভব জোর দিয়ে ডক্টর বললেন, ‘গোটা কতক? এক লক্ষটা আঁক! এই ধূমকেতুর খপ্পর থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে ফেরার সঠিক কক্ষ নিরূপণ করতে হলে আলাদা আলাদা রকমের এক লক্ষটা হিসাব করতে হবে অন্তত, যার প্রত্যেকটাই উঁচুমানের গাণিতিক জ্ঞানের অপেক্ষা রাখে। অমন যে চৌকশ যন্ত্র কম্পিউটার, তারও সেসব হিসাব করতে মিনিট দশেক লাগত অন্তত।’

জর্জ পিকেট গণিতজ্ঞ নয় তেমন, কিন্তু বিমানবিদ্যার সম্বন্ধে সামান্য যেটুকু জ্ঞান তার আছে, তাইতেই তার আক্কেল গুড়ুম হল, ডক্টরের কথা শুনে। পরিস্থিতিটা উপলব্ধি হল তার। অতি উন্নত কম্পিউটারের কাছে যে কাজ জলবৎ সহজ ছিল, মানুষের মস্তিষ্ক তা কোনোমতেই করে উঠতে পারবে না। অথচ পারা তো চাই! না-পারার অর্থ যে মৃত্যু!

জর্জ পিকেট গণিতজ্ঞ নয়, কিন্তু গণনার হাতসাফাইয়ের সাথে সে একেবারে অপরিচিত নয়। তার পিতামহী ছিলেন জাপানি, এক জ্ঞাতি ঠাকুরদা ছিলেন ইয়োকোহামার ব্যাঙ্কের হিসাবনবিশ। জাপানিরা হিসাবের ব্যাপারে একটা যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে থাকে, তার নাম অ্যাবেকাস। বল-ফ্রেম। একটা চৌকো কাঠামোর ভিতরে সারি সারি তার, তারে তারে গাঁথা পুঁতি। প্রতি তারে দশটা। তাদেরই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অতি দ্রুত, অতি নিখুঁত হিসাব করতেন ঠাকুরদা। তাঁরই কাছে শিখেছিল পিকেট। বড়ো বড়ো গুণ ভাগ। লক্ষের সঙ্গে লক্ষের, কয়েক সেকেন্ডে করতে পারত সে-সময়।

চর্চার অভাবে সে বিদ্যে সে ভুলেছে। কিন্তু চেষ্টা করলে কি আবার তা ফিরে পাওয়া যায় না? মার্টেনসকে কিছু না-বলে সে গোপন সাধনায় লেগে গেল। ভাঁড়ারে বল-ফ্রেম বানানোর উপকরণ সবই আছে। বিমানের ভাঁড়ারে না-থাকে— এমন জিনিস নেই। তিনদিন অভ্যাসের পরে পিকেট এসে পরীক্ষা দিল মার্টেনসের কাছে, ‘দেখুন দেখি, আমার এই বল-ফ্রেম দিয়ে আঁক কষিয়ে নিতে পারেন কি না!’

মার্টেনস স্তম্ভিত। সামান্য কয়েকটা পুঁতি? কম্পিউটারের কাজ করবে ওরা? হেসেই উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন পিকেটের কথা। কিন্তু তার জেদ দেখে রাজি হলেন পরীক্ষা করতে। পরীক্ষার ফলে—

মরবার জন্য তৈরি হচ্ছিল যে বৈমানিকেরা, তারা কোমর বেঁধে লেগে পড়ল জীবন বাঁচাবার জন্য। এক ডজন বল-ফ্রেম তৈরি করে হাতে হাতে ধরিয়ে দিল পিকেট। চ্যালেঞ্জার চলেছে ধূমকেতুর পুচ্ছ বিদীর্ণ করে কেন্দ্রের দিকে, তার বৈমানিকেরা খুট খুট করছে অ্যাবেকাসের পুঁতি নিয়ে।

পনেরো দিনের অভ্যাসের ফলেই এক ডজন ওস্তাদ হিসাবনবিশ তৈরি। ছয় সংখ্যার অঙ্কের সঙ্গে ছয় সংখ্যার গুণ তারা নামিয়ে দিতে লাগল দশ পনেরো সেকেন্ডে! নির্ভুলভাবে। মার্টেনস একটার পরে একটা হিসাব আদায় করতে লাগলেন তাদের কাছ থেকে। ধূমকেতুর কবল থেকে বেরুবার পথ তারাই দেখিয়ে দিল। ওই পথে চলুক চ্যালেঞ্জার, পৃথিবীর রেডিয়ো অচিরেই শুনতে পাবে একদিন।

পিকেটের আনন্দ দেখে কে! র‌্যান্ডালের ধূমকেতু সম্পর্কে অনেক কিছু তথ্য সে শোনাতে পারবে পৃথিবীকে।

____

দৈনন্দিন ডায়ারি

স্বয়ংক্রিয় হিসাবের যন্ত্র।