সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

২৩. ফিরে চলো গুহামানবের যুগে

ফিরে চলো গুহামানবের যুগে

ব্যাপারটার শুরু হল হঠাৎই।

কিংবা শুরু না-বলে ‘শেষ’ বলাই উচিত হবে বোধ হয়।

ল্যানরসের সেন্ট্রাল গ্যারাজে এসে ঢুকল একখানা ভিনদেশি চেহারার মোটর, আর সব কিছু ব্যাপারের ইতি ঘটল সেখানেই।

এই সেন্ট্রাল গ্যারাজের মালিক হিউ জোনস। ষোলো আনা মালিক। গাড়ির নম্বরটা দেখলেন, গেঁথে রাখলেন মগজে। গেঁথে রাখলেন বিশেষ কোনো মতলব নিয়ে নয়, ওটা কেমন একটা অভ্যাস জোনস মশাইয়ের। যেকোনো গাড়ির নম্বর একবার দু-চক্ষে দেখেছেন কি তা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে তক্ষুনি। সে আর ইহজন্মে ভুল হবে না কোনোদিন।

গাড়িটা ভিনদেশি, মানুষটাও এদেশি নয়। ময়লা রং, অনামুখো চেহারা। বেড়ে খাপ খেয়েছে গাড়িতে আর গাড়োয়ানে। সাধারণতই খাপ খায় ওটা, বরাবর লক্ষ করে আসছেন হিউ জোনস।

পাম্পের দিকে এক পা এগিয়ে জোনস বললেন, ‘পেট্রোল, স্যার?’

‘ধন্যবাদ! না।’ জবাব এল আরোহীর দিক থেকে, ‘আমি এসেছি শুধু এই কারণে যে, মানে, আপনি গাড়ি কেনা-বেচার কাজও করে থাকেন, সেইরকমই শুনেছি আমি।’

হিউ জোনস মুখখানাতে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুললেন এক সেকেন্ডের নোটিশে। দস্তুরমতো বিষণ্ণ গাম্ভীর্য— ‘ভুল শুনেছেন, বলতে পারিনে। করি কেনা-বেচা, দায়ে ঠেকলে। তবে সত্যি কথা যদি শুনতে চান তো শুনুন। ওতে কিচ্ছু নেই। সারা তল্লাট তল্লাশি করে আসুন, এমন লোক একটাও দেখতে পাবেন না, যার গাড়ি নেই।’

‘তা ঠিক। গাড়ির সংখ্যা একটু বেশি।’ আগন্তুক কথা কইছেন প্রতি শব্দে জোর দিয়ে, ‘মানে, একটু অতিরিক্ত রকমই বেশি। অবশ্য, আমার নিজেরও যখন রয়েছে গাড়ি, আমার অন্তত ও নিয়ে নালিশ করা চলে না।’

‘যাতে নালিশ করা চলে, তার জন্যই বুঝি বেচতে চান ওটা?’

‘ধরেছেন ঠিক। মোটরের মালিক আর থাকব না।’

‘আমিও হব না। মোটর? চক্ষুশূল মশাই! এই কারবার দেখছেন তো? পেট্রোল বেচে রুটি রোজগার করি, তা নইলে কাল সকালেই সব কিছু বিলিয়ে দিতাম।’

‘দিচ্ছেন-না যখন, আমার গাড়িটাও কিনবেন হয়তো। কত দেবেন?’

‘কী করে বলব, বলুন?’ ব্যাজার মুখে জবাব দিলেন জোনস, ‘এ-ঢঙের গাড়িও দেখিনি আগে, আপনাকেও আগে দেখিনি এদেশে।’

‘আগে দেখেননি, এবারে নিত্যি দেখবেন।’ আগন্তুকের দিক থেকে অকুণ্ঠ আশ্বাস, ‘আমি ওই ”ল্যরিক্যুম” বাড়িটা কিনেছি। নাম আমার অ্যানড্রজ।’

‘স্বাগত মি. অ্যানড্রজ। স্বাগত জানাই আপনাকে আমাদের দেশে। আমার নাম হচ্ছে হিউ জোনস। স্রেফ হিউ বলে ডাকে সবাই। আপনিই তাহলে কিনেছেন ল্যরিকুম? একটু নির্জন, এই যা। গরমের দিনে আরামের। পরিবারে—?’

‘কেউ না! একদম একা—’

‘কিন্তু ল্যরিক্যুমে থাকতে হলে গাড়ি তো দরকার হবে মিস্টার অ্যানড্রজ! গাঁ থেকে তো অনেকখানি দূরে! অবশ্য গলিপথটা মোটর চালাবার উপযুক্ত নয় তেমন, কিন্তু বললেই মেরামত করে দেবে কাউন্সিল।’

অ্যানড্রজ লম্বা একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন এইবার, ‘রাস্তার ভয়ে মোটর বেচে দিচ্ছি, এমনটা মনে করলে দারুণ ভুল করবেন মিস্টার হিউ! ওসব প্রাচীন পথঘাটের উপর খুব শ্রদ্ধা আমার। মোটর চালাবার জন্য ওরা তৈরি হয়নি। মোটর থেকে ওদের মুক্তি দেওয়াই উচিত যেকোনো ভদ্রলোকের। যেরকম পাড়ায় বাড়ি আমার, মানে ওই ল্যরিক্যুম, তার যোগ্য রাস্তাই সেখানে রয়েছে এখন। যেখানকার যা। মসৃণ তেল চকচকে রাজপথ অন্য অঞ্চলের জন্য, আমার পাড়ায় তা মানাবে কেন?’

একটু থেমে দূরের পাহাড়টা একবার দেখে নিলেন অ্যানড্রজ। তারপর আবার হিউকে সম্বোধন করে বললেন, ‘একটু নিরিবিলি থাকতে চাই মশাই। শান্তিতে দিন কাটাবার ইচ্ছে। সেইজন্যই গাড়িটা ছেড়ে দিতে চাই। কাজে লাগবে না এটা।’

গাড়িটা এমনি যদিও খুব খাপসুরত নয়, কলকবজা ভালোই। তিন-শো পাউন্ড দামে বিনা ওজরেই কিনে নিলেন হিউ জোনস।

এ হল সকাল বেলার কথা।

বিকাল বেলায় হিউয়ের দরবারে তার বোনাই হাজির। বোন গুয়েনের স্বামী ডেফিড উইলিয়ামস। রীতমতো খারাপ মেজাজ ডেফিডের। গাড়ি খারাপ হয়েছে।

কোনোদিন হয় না যা, আজ তাই হল। ডেফিডের ওই গাড়ি, ট্রায়াম্ফ মেফ্লাওয়ার, গুয়েন যাকে ঠাট্টা করে নাম দিয়েছে ‘তেরকেলে ফুলকপি’, সাত বচ্ছরে এক মিনিটের জন্যও তকলিফ দেয়নি এতটুকু। তাকে আজ নাড়ানো গেল না। বিকেল বেলা গুয়েনকে নিয়ে একটু বাজার-টাজার করতে যাবে ডেফিড, এমন সময় সে আবিষ্কার করল যে, গাড়ি অনড়।

দু-ঘণ্টা ধরে গলদঘর্ম হল বেচারি ডেফিড। শেষকালে রেগেমেগে উঠে দাঁড়িয়ে গাড়ির বাপান্ত শুরু করল তারস্বরে, ‘জাহান্নমে যা তুই! জাহান্নমে যাক সেই অকম্মা কারিগর, যে গড়েছিল তোকে।’

গুয়েন একটু প্রতিবাদ না-করে পারল না, ‘বিবেচনা করো ডেফি, তেরকেলে ফুলকপি তিন কালের ভিতর এক লহমার জন্যও বেগড়ায়নি কোনোদিন। বুড়ো হলে সকলেই অচল হয় মাঝে মাঝে, বেচারি গাড়ির উপরে রাগলে চলবে কেন?’

‘রাগলে চলবে না, তা মানি।’ ফুঁসতে লাগল ডেফিড, ‘কিন্তু সত্যিই বলো দেখি, এর কোনো মানে হয়? তন্নতন্ন করে দেখলাম— ব্যাটারি, প্লাগ, পয়েন্ট সব ছিমছাম নিখুঁত, পেট্রোল টইটুম্বর, তবু গাড়ি চলবে না। অথচ দেখতে পাবে, কাল সকালে তোমার ভাই এসে ওর গায়ে একবার হাত বুলিয়ে দিলেই ও সোনামুখ করে দুদ্দুড় করে দৌড়োতে শুরু করবে।’

অতঃপর বিকাল বেলাতেই ডেফিড সম্বন্ধী হিউয়ের দোকানে হাজির হয়ে খবর দিল, ‘গাড়িটা বিগড়েছে হে! একবার যেও।’ মেজাজ তার সপ্তমে তখন।

পরদিন সকালে হিউ এলেন। গায়ে হাত বোলানো তো সামান্য কথা, হাতুড়ি-পেটাও করলেন মে-ফ্লাওয়ারকে, নট-নড়ন-চড়ন। ‘লোক পাঠিয়ে দেব এখন, ওকে কারখানায় নিয়ে যাবার জন্য। এখানে বসে কিছু করা যাবে না—’ এই বলে হিউ বিদায় নিলেন। তাঁকে পেট্রোল পাম্প খুলতে হবে আবার।

যাক, হিউও পারেনি তাহলে! মন্দর ভালো! গুয়েন কারণে-অকারণে শোনাতে পারবে না যে, তার দাদা ভালো কারিগর ডেভিডের চেয়ে। মেজাজটা কাল থেকেই বিষিয়ে রয়েছে, একটু একটু করে তার উন্নতি হতে লাগল।

‘ওগো! শুনছ? আজ আবার স্কুল বাসটার হল কী?’ গুয়েন চিৎকার করতে করতে ফিরে আসছে রাস্তার দিক থেকে। সে গিয়েছিল ছেলে-মেয়ে দুটোকে বাসে তুলে দেবার জন্য। তা বাস মোটে আসছেই না। যে-সময়ে আসে, তার পরেও আধঘণ্টা হয়ে গেল।

কান পেতে শুনল ডেফিড, রাস্তায় বহু বহু বাচ্চার উল্লাস-কলরব শোনা যায় বটে। বাস আজ আর আসবে না ভেবে তারা তাথৈ নাচ শুরু করে দিয়েছে।

ডেভিড বেরুল। রাস্তার কিয়স্কে টেলিফোন আছে, ডাকল টাইন গর্স মোটর্সকে। তারাই বাস পাঠায় রোজ। ছ-খানা গাঁ থেকে বাচ্চাদের কুড়িয়ে নিয়ে নিকটতম পাঠশালে পাঠায়, তেরো মাইল দূরে। ডেফিড তাদের কাছে জানতে চাইল, বাস আজ আসছে না কেন। গর্সদের জবাব শুনে সে হতভম্ব— বাস আজ গ্যারাজ থেকে বার করাই যায়নি। কী যে হয়েছে, কে জানে? কিন্তু বাস, ট্রাক, কার— কিছুই নড়ছে না। মোটর সমাজে এমন সংক্রামক পক্ষাঘাত কোথা থেকে এল, এ কেউ ভেবে পাচ্ছে না।

‘পেট্রোলে ভেজাল আছে নিশ্চয়।’ এধার থেকে হাঁকল ডেফিড।

‘ডিজেল! ডিজেল! আমরা ডিজেলে চালাই।’ বলল গর্সরা।

ক্ষিপ্তের মতো ক্ষিপ্রবেগে ডেফিড ছুটল সম্বন্ধী হিউয়ের দোকানে, ‘ওহে, এসব ব্যাপার কী?’

‘ব্যাপার এই যে আমার নিজের গাড়িটা আমি কিছুতেই নাড়াতে পারছি না।’ হাঁটু গেড়ে গাড়ির পাশে বসে ছিল হিউ, উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘খুব বেশি তুষারপাতের পরে এমনটা হয় কখনো কখনো। কিন্তু তুষার তো পড়েনি মোটেই, আবহাওয়া বরং গরম।’

‘গরম বলেই গাড়িরা সব ধর্মঘট করেনি তো?’ রসিকতার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করে ডেফিড।

সে-দিকে একটুও কর্ণপাত না-করে হিউ নিজের মনেই বলছে তখন, ‘একটা কিছু গোলমাল ঘটেছে কোথাও। বড়োদিনের সময়ও চারধার এমন শান্ত থাকে না। দুধের লরি পর্যন্ত আসছে না। পোস্ট অফিসের ভ্যানও না। কারনারভনে যায় মাস্টারটা, স্কুটারে চড়ে। সেও যায়নি আজ। চাকার উপরে চলে-ফেরে যারা— সব আজ অচল।’

চেঁচিয়ে উঠল ডেফিড ওদিক থেকে, ‘আরে দেখো, দেখো! পাদরি ইভান্স হেঁটে চলেছেন পথ দিয়ে। তাঁর সেই সনাতন ফোর্ড আজ নেই।’

দুই শালা-বোনাই বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই পাদরি ইভান্স এসে পড়লেন তাদের কাছে, ‘রেডিয়োর বিশেষ খবর শোনোনি বোধ হয়?’

‘রেডিয়োতে বিশেষ খবর আছে নাকি?’ পাদরিকে যথাযোগ্য অভিবাদনাদি করবার পরে ডেফিড বলল, ‘আমরা ল্যানরসেরই বিশেষ খবরটা হজম করে উঠতে পারিনি এখনও। গাড়ি চলছে না, জানেন নিশ্চয়ই। আপনার ফোর্ড যখন সঙ্গে নেই, তখন ধরে নিতে পারি পক্ষাঘাত তারও হয়েছে।’

‘ধরেছো ঠিক।’ জবাব দিলেন ইভান্স, ‘ফোর্ডখানাকে কোনোমতেই চালু করতে না-পেরে বিরক্ত হয়ে রেডিয়ো খুলেছিলাম। সঙ্গেসঙ্গে কানে এল বিশেষ বার্তা— কোনো মোটর গাড়ি, মোটর সাইকেল, বাস, লরি কিছুই চলছে না সারা দেশে।’

‘পেট্রোলে চলে না যেসব বাস, তারাও নাকি? সেই ডার্ভগুলো?’ জানতে চাইল ডেভিড।

‘স-ব। রেডিয়ো বলছে, যেসব যান ভিতরের তাপে চলে তারা সবাই অচল। জাহাজও। আইরিশ মেইল বোট এখনও হোলিহেডে পড়ে আছে।’

‘প্লেন?’

‘প্লেনের কথা বলেনি কিছু।’

ডেফিড মরুব্বিয়ানা ঢঙে বলল, ‘যোগাযোগটা অদ্ভুতই হয়েছে বলতে হবে। তবে কাল পর্যন্ত ঠিক হয়ে যাবে সব। এমনধারা কাণ্ড বরাবর চলতে পারে না। একটা সিগারেট নিন মিস্টার ইভান্স! হিউ, তুমিও নাও—’

‘লাইটার ছেড়ে দেশলাই বার করো, যদি থাকে পকেটে।’ বলতে বাধ্য হল হিউ, কারণ সিগারেট উপহার দেবার পরে লাইটারটা বৃথাই বার বার ক্লিক ক্লিক করছে ডেফিড। ‘জাহান্নামে যাক লাইটার’— বলে অকেজো জিনিসটা পকেটে পুরতে পুরতে ডেফিডের চৈতন্য হল যে পাদরির সমুখে ‘জাহান্নাম’ কথাটা উচ্চারণ করা অন্যায় হয়েছে তার। সঙ্গে সঙ্গে সবিনয়ে বলল, ‘ক্ষমা করবেন মিস্টার ইভান্স।’

‘উত্তেজিত হবার কারণ আছে তোমার।’ বললেন পাদরি, ‘দেশলাই থাকে তো দেখো। ওদের পক্ষাঘাত হয়নি বোধ হয়।’

তারপর?

তারপর চলল একটানা দুর্ভোগ। হপ্তা পেরিয়ে গেল। সারা দেশে অচল অবস্থা। পৃথিবী যেন গুহামানবদের যুগে ফিরে গিয়েছে আবার।

শহরের তুলনায় গ্রামে হইচই স্বভাবতই বেশি। প্রত্যেকে প্রত্যেকের হাঁড়ির খবর রাখে কিনা! দু-জন লোক একত্র হল তো ওই ব্যাপার নিয়েই গবেষণা।

কিন্তু আশ্চর্য! এ-প্রলয়ে স্থির মাত্র একজন। হিউ জোনস দিব্যি বহাল তবিয়তে ঘুরছে-ফিরছে। নিজের আয় এক পেনি নেই আজকাল, গাঁয়ের মধ্যে সবচেয়ে অস্থির হওয়ার কথা তারই। কিন্তু হয়েছে ঠিক উলটো। এমন একটা ঢং ধরেছে সে, যেন তার বহুকালের আরাধনার ধন হাতে হাতে এসে গিয়েছে হঠাৎ। ‘এই তো ভালো!’— বলছে সে, ‘পূর্বপুরুষেরা তো মোটরে না-চড়েও বেশ কাটিয়ে গিয়েছিলেন! তাঁরা কি বড়ো দুঃখী ছিলেন মনে করো? না, অসভ্য অজ্ঞান ছিলেন?’

পাদরি ইভান্স টাট্টু কিনে ফেলেছেন একটা। তাঁর তো তিনখানা গাঁয়ে টহল না-দিলে চলে না রোজ! কোথায় কে মরছে, পাদরিকে হাজির থাকতেই হবে তার শেষ সময়ে। কোথায় কী সভাসমিতি হচ্ছে, পাদরি ছাড়া কে আর সভাপতি হবে? লিখিয়ে-পড়িয়ে লোক গাঁয়ে তো তিনিই একমাত্র!

সেদিন টাট্টুর পিঠে চড়ে কোথায় যেন যাচ্ছেন তিনি, হঠাৎ এক এঁদো গলির মুখে নতুন মুখ দেখলেন একখানা। ঠাহর করে দেখলেন, গলিটা ল্যরিক্যুম যাওয়ার গলি। এখানে নতুন লোক যদি দেখা দেয় একজন, অনায়াসে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, সেই লোকই মিস্টার অ্যানড্রজ, ল্যরিক্যুমের নতুন মালিক।

সময়টা স্বাভাবিক হলে অনেক আগেই অবশ্য অ্যানড্রজের খবর নিতেন পাদরি। কারণ, কর্তব্যবুদ্ধির বশে যে লোক গির্জায় যাবে না, যাবে না রবিবার দিনও, তাকে খুঁজে বার করে গির্জায় হাজিরা দেওয়ার শুভবুদ্ধি মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া পাদরিরই অন্যতম কাজ।

অ্যানড্রজ এ-গাঁয়ে এসেছে মাস খানেক। সে-খবর রাখেন ইভান্স। এ যাবৎ যায়নি গির্জায়। পাদরির সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করার কোনো সদিচ্ছা যে তার আছে, এমন কোনো আভাসও দেয়নি। এ অবস্থায়, ফোর্ডখানা অচল না-হলে কবেই ইভান্স হানা দিতেন এই অসামাজিক অধার্মিক আগন্তুকের আস্তানায়। কিন্তু টাট্টু নিয়ে আর কত ঘোরা যায়? জরুরি কাজগুলোই রোজকার রোজ করে উঠতে পারছেন না পাদরি।

আজ যাহোক কিন্তু দৈবাৎই দেখা। অ্যানড্রজের কথা মনে করে ইভান্স এ পথে আসেননি। উনি যাবেন পাহাড়ের ওপিঠে স্ট্যানডন গাঁয়ে। সেখানকার কিছু লোক একটা ঘরোয়া পাঠশালা পত্তনের চেষ্টায় আছে। স্বভাবতই পাদরি হচ্ছেন তাদের প্রধান ও প্রথম পৃষ্ঠপোষক। ঘরটা কোথায় হবে, তাই ঠিক করে দেবার জন্য আজ যাচ্ছেন তিনি।

সে-কাজে দশ মিনিট দেরি হলে ক্ষতি হবে না। সেই দশ মিনিটে ইভান্স মগজধোলাই করে দিয়ে যাবেন এই অসামাজিক অধার্মিক আগন্তুককে।

‘সুপ্রভাত!’ ঘোড়া থামিয়ে পাদরিই প্রথম কথা কইলেন, ‘আলাপ নেই যদিও, আমি হচ্ছি ইভান্স, এ গাঁয়ের পাদরি। অপরাধ যদি না-নেন, তাহলে জিজ্ঞাসা করি, আপনিই কি আমাদের নতুন প্রতিবেশী মিস্টার অ্যানড্রজ? যিনি ল্যরিক্যুম কিনেছেন?’

‘সুপ্রভাত!’ পাদরির সম্ভাষণে একটু হকচকিয়ে গেলেও চটপট আত্মস্থ হয়ে অ্যানড্রজ বললেন, ‘আপনার অনুমান ঠিক। আমিই অ্যানড্রজ। আপনার কাছে ক্ষমা চাইবার আছে আমার। এতদিন এসেছি, আপনার সঙ্গে দেখা করিনি।’

‘আমার সঙ্গে দেখা না-করা একটা অপরাধ নয়, তার জন্য ক্ষমা চাইবেন কেন?’ হাসিমুখে জবাব দিলেন ইভান্স, ‘আমি কে? ভগবানের দোকান আগলাই মাত্র। দর্জির দোকানে কেউ যায় না জামার দরকার না-হলে, মুদির দোকানে যায় না, রুটিতে ঘাটতি না-পড়লে। আপনি যে গির্জায় যাওয়ার দরকার বোধ করেননি, এতে তো একদিক দিয়ে আমার উৎফুল্ল হবার কথা। এইরকমই বোঝার কথা যে বিবেক আপনার নির্মল, ভগবান যিশু খ্রিস্টকে আপনি নিজের অন্তরেই দেখতে পান সর্বদা।’

কথাটা এরকমভাবে মোড় খেয়ে যাবে হঠাৎ, তা অ্যানড্রজ আগে মোটেই অনুমান করতে পারেননি। আগের চাইতেও বেশি হকচকিয়ে গেলেন তিনি। এবার সে-ভাব কাটিয়ে উঠতে দেরি হতে লাগল একটু।

সেই সুযোগে ইভান্স পাড়লেন অন্য কথা, ‘ভগবানের বিশেষ দয়া যে আপনার উপরে আছে, হাতে-হাতেই তার প্রমাণ পেয়েছে ল্যানরসের লোক। মোটরমাত্রই অচল হয়ে গেল সারা দেশে যেদিন, সেই দুর্বিপাকের কয়েক ঘণ্টা আগেই আপনি বেচে ফেলেছেন আপনার গাড়িখানা। হাতে হাতে তিন-শো পাউন্ড লাভ। ভগবান একান্তই যার সহায়, এমন লাভ তার ছাড়া আর কারও হয় না।’

‘না, না, ভগবানকে এর ভিতর কেন টানছেন? স্রেফ লেনদেনের কথা?’ বিড়বিড় করে একথাটা কোনোমতে বলে ফেললেন বটে অ্যানড্রজ, কিন্তু বলার পরেই তাঁর মনে হল, ওটা না বললেই হত ভালো।’

‘আচ্ছা, নমস্কার! চলি।’ বললেন পাদরি, ‘স্ট্যানডনে একটা কাজ রয়েছে। এবার যখন আলাপ হল, দেখা হবে। না, না, আপনাকে আসতে হবে কেন? আমিই আসব আপনার কাছে, যদি আপনার আপত্তি না-হয়। বলেন কী! আসব না? আপনার বিবেক নির্মল। ভগবানের জ্ঞাত লোক আপনি। আপনার সংস্পর্শে এলেই পুণ্য অর্জন হবে।’

টাট্টু ছুটিয়ে পাদরি চলে গেলেন।

অ্যানড্রজ পায়ে পায়ে ফিরলেন বাড়ির দিকে।

ল্যরিক্যুম বাড়িটা বহুদিনের বাড়ি। বাড়িটার বৈশিষ্ট্যও অনেক। আগের মালিকেরা কয়েক পুরুষ ওখানে বসবাস করেননি ঠিকই; তবে একেবারে বিধ্বস্ত হতেও দেননি। অ্যানড্রজ ওটা কিনে নেন অন্তত এক বছর আগে, যদিও হস্তান্তরের খবরটা গাঁয়ের লোক জেনেছে খুবই অল্পদিন আগে। কেনার পর অ্যানড্রজ অনেক কিছু যন্ত্রপাতি বসিয়েছেন এক বছর ধরে। গাঁয়ের লোকের ধারণা ছিল যে ভূতপূর্ব মালিকেরাই করিয়ে দিচ্ছেন এই মামুলি মেরামত।

আসলে কিন্তু যন্ত্রগুলি মামুলি নয় মোটেই; অ্যানড্রজ একজন দক্ষ বিজ্ঞানী। ইদানীং তাঁর গবেষণা যে-খাতে চলেছিল, তারই জন্য যা যা প্রয়োজন—

মাটির তলায় একখানা ঘর তৈরি করে তারই ভিতরে সেইসব সরঞ্জাম বসিয়েছেন তিনি। সেইসবের মাঝখানে এসে আজ নীরবে দাঁড়ালেন অ্যানড্রজ। ভাবতে লাগলেন নতুন সব কথা। বিজ্ঞানের চিন্তাই করেছেন এতকাল, বিবেকের কথা ভাবেননি। আজ ভাবতে হল।

বিবেক নির্মল?

তাই কী? পাদরির কথাগুলো মর্মান্তিক লেগেছে। ভগবানের জ্ঞাত লোক? বিবেক নির্মল? হয়তো সে-গর্ব তিনি করতেই পারতেন, যদি-না মোটরখানা হিউ জোনসকে বেচে আসতেন। মোটর চলাচল বন্ধ করে দেবার কয়েক ঘণ্টা আগে।

না, বিবেক নির্মল নয়।

বেলা যখন বারোটা, তখন সারা দেশে রাস্তায় রাস্তায় মোটর ছুটল আবার গর্জন করতে করতে। শহরের আদালতে দাঁড়িয়ে একটি ভদ্রলোক তখন হাকিমকে বলছেন, ‘আমি অপরাধী। গবেষণায় মত্ত হয়ে ন্যায়-অন্যায় বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলাম। দেশের প্রচুর ক্ষতি করেছিলাম মোটরের গতি রুদ্ধ করে। যে নতুন রকম বৈদ্যুতিক রশ্মি সৃষ্টি আর বিকিরণ করে ও-কাজ করতে পেরেছিলাম, তার উৎপাদন যন্ত্র নষ্ট করে ফেলে এসেছি নিজের হাতে। এই দেশের আইনযোগ্য দণ্ড দিন আমাকে। আমি আত্মসমর্পণ ও অপরাধ স্বীকার করছি।’

রেডিয়োতে বিশেষ বার্তা বেরুল আজ আবার। সে বার্তাতেই প্রকাশ পেল যে, অপরাধী বিজ্ঞানী বর্তমানে অ্যানড্রজ নামে পরিচিত হলেও ওটা তাঁর আসল নাম নয়, আসল নাম বিশ্ববিদিত, সেটা এখন গোপনই থাকুক।