২২. বৈরাগ্য?

২২. বৈরাগ্য?

“‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/যখন বাইবো না আর খেয়াতরী এই ঘাটে’—এখন আমার মনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো প্রায়ই ঘুরপাক খায়”—বললেন বসু। গত ২৯শে জানুয়ারি বইমেলায় নিজের ইংরেজি জীবনীগ্রন্থ বেরোবার সময় এই লাইনগুলিই মনের মধ্যে বার বার এসেছিল। নিজের ভাষণে বলার ইচ্ছাও ছিল, তর্জমার অভাবে প্রকাশ্যে বলেন নি। কিন্তু এখন নিয়ত এই সুরেই কথা বলেন। “এখন তো ডে টু ডে একজিস্টেন্স”, “আর কি, এখন তো অন দ্য ওয়ে আউট”, কিংবা “হঠাৎ একদিন সকালে উঠে কাগজে দেখবে…” কথাটা শেষ করার সুযোগ দিই না, প্রসঙ্গান্তরে চলে যাই। অন্য দিনও আবার একই কথা গানের ধুয়ার মত বার বার ফিরে আসে “এখন আমার হল সারা”, “আর এই পিঞ্জরে নয়”—ইত্যাদি।

“অনেক হয়েছে এবার আমি ছেড়ে দিতে চাইছি”—জানালেন বসু। ১৯৯৭ সালের ৮ই জুলাই ৮৩বছর পূর্ণ করে ৮৪ বছরে পা রাখছেন। বয়সের তুলনায় তাঁর বাইরের চেহারা প্রকৃতির মির্যাকল বলা যেতে পারে। বয়স তাঁকে পরাজিত করতে পারেনি। কিন্তু মন? মন কি বলে? এই তো সেদিন পর্যন্ত মনের তারুণ্য অটুট রেখেছিলেন, জীবনকে কখনও বিস্বাদ বৈচিত্র্যহীন মনে হয়নি। এখন মনে হয়। মনে হয় শিথিল মুঠি থেকে বালি ঝরে পড়ার মত নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে নির্মম সময়ের প্রতিটি পল। এই ভাবনা আজকাল তাঁকে উদাস করে, বিষণ্ণও করে।

পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার কথা হয়েছিল। খাড়াই পাহাড়ের মাথায় উঠতে গেলে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়, প্রাণপণে ‘গ্রিটা শক্ত রাখতে হয়, প্রতি মুহূর্তে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, ভয়ডর থাকলে চলেনা। “সেসব অনেকদিনের কথা, তবে যুদ্ধটা ভুলিনি”—বললেন বসু। আর হেলিকপ্‌টারে করে পাহাড়ের মাথায় যদি কাউকে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে তার গুণের যাচাই আর হয় কী করে? সে তো পরীক্ষায় না বসেই ফুলমার্কস পাওয়ার মত ব্যাপার। ষাট বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের পর মনের দিক থেকে বসু এখন বিধ্বস্ত, পরিশ্রান্ত। রাজনীতিতে অবক্ষয়, সমাজবিরোধীদের অনুপ্রবেশ ও ব্যাপক দুর্নীতি তাঁর অসহনীয় মনে হয়। বললেন “বি. জে. পি. একটা বর্বর দল, লোকে তো এদেরও ভোট দেয়।” বসুর এখন মনে পড়ে পার্টির সেই সব পুরোনো দিনগুলোর কথা—যখন পোস্টারের কাগজ কেনার পয়সা ছিল না, খবরের কাগজে লালরঙ দিয়ে স্লোগান লেখা হত। মনে পড়ে জেলের শক্ত বিছানা আর পুলিসের চোখ রাঙানি। বিশ বছরের প্রলেপে এখনও সেই সব অনুভূতির শুশ্রূষা হয়নি। কিছু কিছু ক্ষত এখন যেন বেশি দগদগে হয়ে উঠেছে। “এখন তো অস্তাচলের সময়”—আবার সেই একই কথা। ক্ষমতার মন্দ দিকটা দীর্ঘদিন বড় কাছ থেকে দেখেছেন বসু। সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়ে যায়। নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন, সবাই অভিনন্দন জানাচ্ছেন। এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেই অভিষেকের দিনই একটা মূল্যবান কথা নেহরুকে বলেছিলেন—”আজ আপনি ক্ষমতায় আসীন হলেন, আগামীকাল থেকে আপনার কাছে স্বার্থ ছাড়া আর একটি লোকও আসবে না।” বিশ বছর একটানা মুখ্যমন্ত্রীর পদে যিনি রয়েছেন তাঁর থেকে বেশি এই কথাটার যাথার্থ্য আর কে বুঝবে?

‘পলিটিক্স ইজ্ দ্য লাস্ট রিসর্ট অব্ দ্য স্কাউন্ড্রেলস্’, ‘পাওয়ার করাপ্‌টস্’, ‘পলিটিক্স অ্যাডমিট্স স্ট্রেইন্‌জ্ বেডফেলোস’–এই সব কথাগুলো আগে নির্ভেজাল মিথ্যা ফাঁকা বুলি মনে হলেও এখন এই সব কথাগুলো প্রায়ই জিজ্ঞাসা-চিহ্ন গায়ে সেঁটে বসুর মনের সামনে ভিড় করে। সত্য খুঁজতে গিয়ে মনে মনে ক্ষতবিক্ষত হন, দ্বন্দ্বে দীর্ণ হন।

সমবয়সী বন্ধুবান্ধবরা অনেকেই চলে গেছেন। সমস্তরের মানুষের একান্ত অভাব। নবীনদের চিন্তাভাবনায় কতটা আস্থা রাখতে পারেন? অগ্নিপরীক্ষা তো এখনও বাকী। আবার বললেন, “আমি এখন পিস্ফুলি সরে যেতে চাই, এখন নতুনরা দেখুক, আমি মুক্তি চাই।”

তবে যে এখনও কাতারে কাতারে লোক ওঁকে দেখতে আসে, শুনতে আসে ওঁর কথা। এই তো সেদিন বছরের গোড়ার দিকে শহীদ মিনারে বিরাট জনসভা, ওঁর যাবার কথা ছিল, শরীর বেঁকে বসল, যেতে পারলেন না। হু হু করে ভিড় পাতলা হয়ে গেল। ‘জ্যোতিবাবু আসছেন না’ শুনেই দলে দলে গ্রামের লোক চলে গেল বিকল্প আকর্ষণের দিকে, পাতাল রেল, কালীঘাট, চিড়িয়াখানা দেখতে। তাহলে কি হবে? “কি আবার হবে? কেউ তো আর ২০০ বছর বাঁচে না, অতদিন ঐ চিড়িয়াখানার কচ্ছপরাই বেঁচে থাকে, ‘ডিমরাল্যাইজিং’ ব্যাপার—একদিন তো ছাড়তেই হবে। আর প্রকৃতি কোনও শূন্যতা রাখে না,”…বাক্যটা অসম্পূর্ণ রেখে দেন। “একজন ব্যক্তিবিশেষের অনুপস্থিতিতে তো আর পৃথিবী ভেঙে পড়বে না, জীবন, রাজনীতি তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাবে”–আবার বলেন বসু।

উত্তরসূরীর কথা ভেবেছেন? ভেবেছেন বই কি, যতটা না ব্যক্তির কথা ভেবেছেন তার থেকে বেশি ভেবেছেন নিজেদের নীতি আর কর্মসূচীর কথা। আর গ্রহণযোগ্যতার কথা ভাবেন নি? সে কথাও ভেবেছেন। “সেটা ঠিক করবে সময় আর সাধারণ মানুষ”, বসু বিশ্বাস করেন জনগণই নেতা তুলে আনে আর ফেলেও দেয়, তবে মর্জিমাফিক তারা এ কাজ করে না, নেতার আচার আচরণ, কাজকর্ম দেখেই তারা রায় দেয়। আর সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আরও সুকঠিন। চড়াই উৎরাই, কাঁটা, পাথর সবই আছে। কথায় কথায় ব্যক্তির ওপর ফোকাসটা সরিয়ে নেন বসু, আলো ফেলেন এক আদর্শ জননেতার প্রাথমিকভাবে কি কি গুণ থাকা উচিত তার ওপর। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের কবিতার কয়েকটা লাইন মনে এসে যায়—’পথ ভাবে আমি দেব/রথ ভাবে আমি/মূর্তি ভাবে আমি দেব/ হাসেন অন্তর্যামী।’ বলা বাহুল্য মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেও বসু এক বিরাট মাপের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে থেকে যাবেন। “কেউ কাউকে মনে রাখে না, কেউই অমর নয়”—আবার বললেন বসু। বরাবরই মিথের ছটা ভেদ করে নিজের জীবনটাকে দেখতে চেয়েছেন বসু। তাঁর জীবনের মূল লক্ষ্য সম্বন্ধে তিনি নিজে কি বলেন? “আরও সুন্দর একটা দুনিয়া বসানো, যেখানে জাতপাতের হানাহানি নেই আর একটাও গরীব লোক নেই, যেখানে নিজের কাজটুকু করে নিজের প্রয়োজন মেটাবার ক্ষমতা আছে প্রতিটি লোকের”—এমন পৃথিবীর স্বপ্ন এখনও বসু মনে লালন করেন। একটু থেমে বললেন, “আজকাল মঙ্গলগ্রহে প্রাণ আছে কি না এ নিয়ে অনেক লেখাটেখা পড়ছি। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার আছে, আমরা কি এই পৃথিবী-গ্রহের সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে পেরেছি? পৃথিবীতে এখনও দারিদ্র্য আছে, শোষণ আছে, আছে বঞ্চনা—মঙ্গলগ্রহের প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে এত উত্তেজনা তাই আমার অর্থহীন মনে হয়।”

এখন উদাস মুহূর্তে মনে হয় সত্যিই মূলত কোনও ‘অ্যাচিভমেন্ট’ আদৌ হল কি না। মাঝে মাঝে ইতিহাস মনকে আচ্ছন্ন করে। “বাবাকে তো আমি সুখী করতে পারিনি”—আত্মকথনের ভঙ্গিতে বললেন বসু “আর স্ত্রী আর সন্তানের প্রতিও সঠিক সময়ে সঠিক কর্তব্য করার জন্য আমি কাছে ছিলাম না।” পথটা গোলাপের পাপড়িতে ঢাকা নয় জেনেই এ পথের পথিক হয়েছিলেন। বৃত্ত এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। তবে কেন এই বৈরাগ্য?

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *