আজি হতে শতবর্ষ পরে
তখন রাত ন-টা। রাতের খাওয়া সেরে নিজের স্টাডিতে বসে ধূমপান করছিলেন বিখ্যাত সলিসিটর মি. অসীম বর্মন। পাশের টেবিলে আস্তে অস্তে রেডিয়োতে একটা গান হচ্ছিল। হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে গেল। ঘোষক বললেন, ‘আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এইমাত্র খবর পাওয়া গেল বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক অধ্যাপক অরূপ চট্টোপাধ্যায় হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। তিনি প্রাণীজগতে ফ্রিজিং টেকনিক ব্যবহার করার বিদ্যায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। দশ বছর আগে অধ্যাপক চ্যাটার্জি ড. বিপ্লব দাশগুপ্তের সঙ্গে এই ফ্রিজিং টেকনিক নিয়ে মৌলিক গবেষণায় আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তাঁর সহকর্মীর হঠাৎ অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে অন্তর্ধানের পর তিনিও খানিকটা ভগ্নহৃদয়ে কাজকর্ম থেকে অবসর গ্রহণ করেন, যদিও তাঁর বিরাট পৈতৃক বাড়িতে কিছু গবেষণা তিনি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা তাঁর আত্মার সদগতি কামনা করি।’
মি. অসীম বর্মন স্তব্ধ হয়ে খানিকক্ষণ বসে রইলেন। তারপর ফোন তুলে নিয়ে ডাকলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু পদার্থবিজ্ঞানী ড. সরকারকে, ‘হ্যালো রমেন। আমি অসীম বলছি। এইমাত্র রেডিয়োতে জানলাম যে, অরূপ মারা গেছে। একটা বিশেষ অনুরোধ অরূপ আমাকে করে গিয়েছিল। সেটা এখনিই পালন করতে হবে। তুমি আমার বাড়িতে চলে এসো।’
সরকার বললেন, ‘হ্যাঁ, অরূপ আমাকেও বলেছিল যে, তার মৃত্যুসংবাদ শুনেই যেন তোমায় ফোন করি, তার শেষ ইচ্ছা জানবার জন্য। আমি এখনিই যাচ্ছি।’
বন্ধুর অপেক্ষায় বসে রইলেন মি. বর্মন। তাঁর চোখের সামনে ভাসতে লাগল অরূপের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সেই দৃশ্যটা। সেদিন, প্রায় পাঁচ বছর আগে হঠাৎ অরূপ তাঁর বাড়িতে এসে বললেন, ‘অসীম, তোমার সঙ্গে খুব প্রাইভেট কথা আছে। তুমি তো আমার বিশেষ বন্ধু এবং আমার সলিসিটরও বটে। আমি তোমার কাছে একটা সিলড চিঠি রেখে যেতে চাই। তুমি আমার মৃত্যুসংবাদ যদি কোনোদিন পাও তাহলে যত শীঘ্র পারো রমেনকে ডাকবে। ডেকে দু-জনে মিলে এই চিঠি খুলবে। এতে আমার অত্যন্ত জরুরি গোটা কতক নির্দেশ আছে, সেইগুলো পালন করবে।’
অসীমবাবু তখন বলেছিলেন, ‘তোমার হঠাৎ মরার কথা মাথায় এল কেন?’ তখন অরূপ বললেন, ‘আজ চেক আপ করিয়ে জানতে পেরেছি যে, আমার হার্টের অবস্থা খুব ভালো নয়। আমার ডাক্তার বলেছেন সাবধানে থাকলে বছর পাঁচ-সাত বাঁচতে পারি; তবে তার মধ্যে খারাপ কিছুও হতে পারে। আমার ওপর একটা অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব আছে। যদি হঠাৎ কিছু হয় আমি নিশ্চিন্ত থাকতে চাই যে, সে দায়িত্ব যথাযথ পালিত হবে। তুমি চিঠিটা খুললেই সব জানতে পারবে। এর বেশি কিছু আর জিজ্ঞাসা কোরো না।’
অ্যাটর্নি হিসেবে অনেকেরই শেষ ইচ্ছার অছি হিসেবে বর্মনবাবু থাকেন, তাই এটাও মেনে নিলেন। তবু বললেন, ‘যদি তোমার আগে আমি মারা যাই তাহলে?’
ড. সরকার জবাব দিলেন, ‘আমি রমেনকেও বলে গেলাম, তাহলে এই চিঠি তুমি রমেনকে দেবার ব্যবস্থা করে রাখবে। আর যদি দু-জনেই আমার আগে মারা যাও, আমি নতুন করে অন্য ব্যবস্থা করব।’
খানিকটা রহস্যজনক বটে, তবু ড. বর্মন আর বন্ধুকে ঘাঁটালেন না। মনে হল, বিপুল পৈতৃক সম্পত্তির ব্যাপারে কোনো গোপনীয় ব্যবস্থা করে যেতে চাইছেন তাঁর বন্ধু। তিনি বিপত্নীক ও নিঃসন্তান, তাই স্বভাবতই অ্যাটর্নি হিসেবে তাঁর কাছেই শেষ ইচ্ছার ব্যাপারটা রেখে যাচ্ছেন এবং বোধ হয় তাঁকে আর রমেনকে অছি করে যাচ্ছেন।
মিনিট কুড়ির মধ্যে ড. সরকারের গাড়ি এসে দাঁড়াল। অসীমবাবু বন্ধুকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। স্টাডিতে বসে অসীমবাবু বললেন, ‘শোনো রমেন, মনে হয় মামুলি ব্যাপারই। অসীমের তো অনেক সম্পত্তি, তারই দেখাশোনা বা দান-ধ্যানের ব্যাপার বলে মনে হয়। যাই হোক, আমি সিন্দুক থেকে ওর সিলড চিঠিটা বার করছি। আচ্ছা, তার আগে তুমি আমাকে খুব অল্প কথায় বলো তো, এই ফ্রিজিং টেকনিক, যা নিয়ে ও আর ওর বন্ধু বিপ্লব এত ফেমাস হল, সে ব্যাপারটা কী?’
রমেনবাবু বললেন, ‘শোনো, টেকনিক্যালিটি বাদ দিয়ে বলা যায়, ঠান্ডা করে রাখলে প্রাণীজগতের জিনিস অনেক দিন, এমনকী অনেক বছর অবিকৃত অবস্থায় রাখা যায়, তা তো জানো। কিন্তু সাধারণভাবে সেগুলির অনেক সময় প্রাণহানি হয়। বিশেষ করে উচ্চস্তরের জীবদের ফ্রিজ করে পচনের হাত থেকে বাঁচানো যায়, কিন্তু তার প্রাণটা বাঁচানো যায় না। নিম্নস্তরের প্রাণীদের, যেমন ধরো প্লান্ট লাইফ কিন্তু বাঁচিয়েও রাখা যায়। অর্থাৎ ধরো ছোলা বা গম যদি ঠান্ডা করে রাখা যায় বিশেষ পদ্ধতিতে, তাহলে দু-হাজার বছর পর আবার তা গরম করে তা থেকে গাছ করা যায়। রমেন আর বিপ্লব জীবজগতের উঁচু জাতের প্রাণীদের মানে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জীবন্ত অবস্থায় ঠান্ডা করে রেখে আবার পুনরুজ্জীবিত করার টেকনিক বার করেছে স্পেস ট্রাভেল রিসার্চের একটা অঙ্গ হিসেবে। ধরো যদি বহু বছর ধরে কোনো একটা প্রাণীকে ঠান্ডা ঘরে রেখে তারপর আবার তাকে বার করে আনা যায় ও পুনরুজ্জীবিত করা যায় এবং এই টেকনিকটা যদি খুব আয়ত্তাধীন হয়, তাহলে দশ বছরের মহাকাশ ভ্রমণে পালা করে কিছু যাত্রীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে। তাতে তাদের ওপর স্ট্রেন অনেক কম হবে। শুনেছি এই পদ্ধতিটা এরা দু-জনে প্রায় পারফেক্ট করে এনেছিল, অবশ্য তার পরেই আকস্মিকভাবে অরূপের কোলিগ মারা যাওয়ায় ও তো সব কাজই ছেড়ে দিল।’
কথা শেষ হতে মি. বর্মন সিন্দুক খুলে একটা মোটা খাম বার করলেন, বেশ করে সিল করা। খুলে দেখলেন তাঁদের উদ্দেশ্য করে একটা বিরাট চিঠি রয়েছে ডা. চ্যাটার্জির সই করা। চিঠিটা এইরকম—
প্রিয় অসীম ও রমেন,
ধৈর্য ধরে তোমরা পুরো চিঠিটা পড়বে। তাহলেই তোমাদের কর্তব্য কী জানতে পারবে। এবং যে জিনিসটা একটা নিছক পাগলামির মতো মনে হবে তোমাদের, তা হয়তো দেখবে, বিজ্ঞানের দিক থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
তোমরা জানো দশ বছর আগে বিপ্লব হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। আর আমি তখন অ্যাকটিভ ডিউটি সেরে অবসরগ্রহণ করে আমার বাড়িতেই কাজকর্ম করতে থাকি। বিপ্লব উধাও হবার পর কিছুদিন বেশ হইচই হয়েছিল, আমার কাছেও বহু লোক তার খোঁজে এসেছিল। তাই এই চিঠিটা তোমরা ছাপাবার ব্যবস্থা করবে, যাতে তারা তাদের জবাব পায়।
বিপ্লব উধাও হওয়ার প্রায় কয়েক মাস আগের কথা। একদিন কাজ শেষ করে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাবার পথে বিপ্লবের স্ট্রোক হয়। বয়স বেশি নয়, কিন্তু ওর প্রেশার খুব বেশি তাই, আর অত্যধিক স্ট্রেনের ফলে স্ট্রোকটা খুব মারাত্মক হয়। এ কথাটা সবাই জানে। কত মারাত্মক তা তোমরা জানো না। আমি জানি। কারণ স্ট্রোকের দু-মাস পরে একদিন বিপ্লব আমাকে ওর বাড়িতে ডেকে পাঠায়। শান্তস্বরে বলে, ‘শোনো, এই স্ট্রোকের যে রিপোর্টটা আমায় দিয়েছে চিকিৎসকরা, তা সত্যিই আমার ডেথ সেনটেন্স। ওরা বলেছে যে, হার্ট পার্মানেন্টলি ড্যামেজড। পূর্ণভাবে কর্মক্ষম জীবন আমার আর সম্ভব নয় ও সেমি রিটায়ার্ড জীবন যদি কাটাতে পারি তাহলে কয়েক বছর বাঁচব, তা না-হলে যেকোনো সময় আমি মরে যাব।’ কথাগুলো ঠিক, আমি ওর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেও তা জানতে পারি। তারপর বিপ্লব একটা সাংঘাতিক প্রস্তাব আমার কাছে রাখল।
ও বলল, ‘জীবনটা তো শেষই হয়ে গেছে, মরার আগে বিজ্ঞানের কাজে আমি নিজেকে লাগাতে চাই, তুমি সহযোগিতা করো। আমাকে ফ্রিজ করে রেখে দাও। পঞ্চাশ থেকে এক-শো বছর যদি এভাবে রাখা হয় তাহলে এক-শো বছর পর দুনিয়াটার কী বদল হয়েছে আমি দেখতে পাব। আর তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত এক্সপেরিমেন্ট সফল হবে। এমনও হতে পারে ততদিনে ড্যামেজড হার্ট আবার মেরামত করার পদ্ধতিও আবিষ্কার হবে। আর আমি যমকে ফাঁকি দিয়ে প্রায় পুনর্জীবন লাভ করব, বিজ্ঞানের একটা অদ্ভুত বিজয় দেখানো হবে।’
আমি তো শুনে হেসেই উড়িয়ে দিলাম। বললাম, ‘অসম্ভব, আমাকে খুনের দায়ে ফেলতে চাও নাকি? এ কাজ আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।’
বিপ্লব দমে গেল, কিন্তু কিছুই বলল না, শুধু গুম হয়ে বসে রইল। এর কিছুদিন পর দেখলুম ও আমার সঙ্গে জয়েন্ট প্রজেক্ট-এ কাজ বন্ধ করে দিল। নিজের পরীক্ষাগারে একা কাজ করতে লাগল। আমার সঙ্গে বিশেষ কথাও বলত না। অনেকের কাছে শুনলাম গভীর রাত পর্যন্ত ল্যাবে থাকে। কাজ করে, কারুকে থাকতে দেয় না। এমনকী ওর সহকারীদেরও তাড়িয়ে দেয়। কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। একদিন ওর কাছে গেলাম, বললাম, ‘এরকম পরিশ্রম করে নিজেকে মেরে ফেলছো কেন? অ্যাসিস্ট্যান্টদের দিয়ে কাজ করাও।’
ও বললে, ‘যতদিন বেঁচে আছি অ্যাক্টিভলি থাকতে চাই। তবে মরার পর তুমি যেন আবার খাঁড়ার ঘা দিও না। তাহলেই যথেষ্ট হবে।’
কথাটা বেখাপ্পা শোনাল। তখন মানে বুঝতে পারিনি। যাক, এর পরের ঘটনা খুব সংক্ষেপে বলা যায়। দশ বছর আগে বিপ্লবের অন্তর্ধানের দিন আমাকে ওর বাড়িতে সন্ধ্যায় খেতে ডাকল। আমি যথাসময়ে গেলাম। আমার হাতে ওর চাকর একটা খাম দিল। বলল, ‘সকাল বেলায় সায়েব এই চিঠিটা রেখে গাড়ি না-নিয়ে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেছেন। এখনও ফেরেননি।’
সেদিন ছিল স্বাধীনতা দিবস। সমস্ত বন্ধ। ল্যাবরেটরি বন্ধ। অফিস বন্ধ। তবে কোথায় গেল। চাকর বলল, চিঠিটা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আর কিছুই বলেননি। বেরিয়ে এলাম চিঠি নিয়ে, গাড়িতে বসে পড়ব বলে। একটু অপমানিত বোধ করলাম। নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে এ কীরকম ভদ্রতা! যাহোক, গাড়িতে বসে খাম খুলে দেখি একটা চিঠি আমার জন্য আর একটা রয়েছে পুলিশ কমিশনারের জন্য। পুলিশ কমিশনারের চিঠি খুব সংক্ষিপ্ত। স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করে ও আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য আত্মগোপন করছে। ওকে খোঁজার কোনো দরকার নেই। যথাসময়ে ও আবার আবির্ভূত হবে। আমার চিঠিটা একটু বড়ো। তাতে লেখা
প্রিয় অরূপ,
আমার অনুরোধ তো রাখলে না, তাই নিজের ব্যবস্থা নিজেই করেছি। এখন শুধু শেষরক্ষার ভার তোমার হাতে। দেখো যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ দিও না। আমি নিজেকে ফ্রিজিং চেম্বারে রেখে অটোম্যাটিক টাইমড সুইচ দিয়ে ফ্রিজ করে ফেলেছি আজ সকালেই। তুমি খবরটা যখন পাবে তখন আমার টেম্পারেচার .৭৫ সি জি। আমি সেই অবস্থায় থাকার জন্য অন্তত সাত দিনের ব্যবস্থা পাকা করে নিয়েছি। তুমি ল্যাবরেটরি ডিরেক্টর। যে ফ্রিজিং চেম্বারে আমি আছি সেটাতে সবাই জানে, একটা শিম্পাঞ্জিকে দু-বছরের জন্য ফ্রিজ করে রাখা হয়েছে। তুমি সেই চেম্বারটার ভার ডিরেক্টর হিসেবে নিজের হাতে নেবে। আর যতদিন পারো ওর সমস্ত কন্ট্রোল নিজের হাতে রাখবে। রিভাইভ করার চেষ্টা কোরো না। কারণ তাতে আমার বাঁচার আর মরার চান্স একই। কারণ আমার হার্ট খুব খারাপ।
পুনর্জীবিত করার টেকনিক আমি নাও সহ্য করতে পারি। অন্তত এখনকার টেকনিকে কিছুটা স্ট্রেন হয়। রিসার্চ চালিয়ে যেও, যদি পদ্ধতিটার আরও উন্নতি করা যায়। আমাকে জাগাবে আমার ভবিষ্যৎ বংশধরেরা ২০৭৬-এ। তার আগে ভগবানের দোহাই,আমাকে জাগিও না। আমার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তাই বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় এটুকু ত্যাগ করা আমার পক্ষে কিছুই নয়। তোমার কনসেন্স-ও তো ক্লিয়ার, যা করবার তা আমি নিজেই করেছি।
এরপর বিশেষ কিছু বলার নেই। বিপ্লবের শেষ অনুরোধ আমি ঠেলতে পারিনি। তাই পরীক্ষাগারের চার্জ নিয়ে আমি ফ্রিজির ইউনিটটা ব্যক্তিগত গবেষণার জন্য রেখেছি। অবসর নেবার আগে বাড়িতে অনেক খরচ করে পরীক্ষাগার তৈরি করি। আর বিপ্লবের ঠান্ডা শরীরকে স্থানান্তরিত করি ইউনিট সুদ্ধু। নিজের বাড়িতে নিয়ে আসি পার্সোনাল রিসার্চ আইটেম হিসেবে। তারপর থেকে যক্ষের ধনের মতন দশ বছর ওটাকে রক্ষা করে এসেছি সব সময়ে। বিদেশ যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছি। রিভাইভাল টেকনিকের দশ বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বিপ্লবের নিদ্রা সকালে ভাঙাতে চাইনি। ভেবেছি যা করা উচিত তা আমার পরে যাদের দায়িত্ব তারাই করুক। বিপ্লবের পুলিশকে লেখা চিঠিটা যথাসময়ে পৌঁছে দিয়েছিলাম। তোমরা আমার এই চিঠি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাবে। বলবে, আমার ইচ্ছা আমার সমস্ত সম্পত্তির আয় থেকে এই ল্যাবরেটরিকে মেনটেন করা হোক, আর বিপ্লবের শরীরকে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা হোক। এই আমার শেষ ইচ্ছা।’
লেখাটা পড়ে কিছুক্ষণ দুই বন্ধু স্তব্ধ হয়ে রইলেন, তারপর সঙ্গে সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করলেন মি. বর্মন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বিশেষ বন্ধু। তাঁকে বললেন, ‘বিশেষ দরকারে এখনিই আপনার কাছে যেতে চাই ড. সরকারকে নিয়ে।’
দু-জনে চিঠি নিয়ে চলে গেলেন। এরপর যা হল অল্পকথায় বলা যায়।
মুখ্যমন্ত্রী দেশের আইনজীবি, বৈজ্ঞানিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটা কমিটি গঠন করলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে। তাঁরা বললেন, ‘দশ বছর যখন হয়ে গেছে তখন সবদিক বিবেচনা করে দুই বৈজ্ঞানিকের সাধনাকে ব্যর্থ না-করাই উচিত। সরকার ওঁদের অনুরোধ মতো ব্যবস্থা নিন।’
মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে পাকা ব্যবস্থা করলেন যাতে সেই ফ্রিজিং চেম্বার বরাবরের জন্য চালু রেখে দেওয়া হয়। সমস্ত খরচের জন্য ট্রাস্টির টাকা তো আছেই। বেশি টাকা লাগলে সরকার নিজে দেবে।
বিপ্লবের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙানো হল না।… বিপ্লবের ও অরূপের বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা নিয়ে দিন কতক খুব উত্তেজনা হল। কিন্তু লোকে আস্তে আস্তে ব্যাপারটা ভুলে গেল। সরকারি একটা বিভাগ মারফত বিপ্লবের দেহ সংরক্ষণ ব্যবস্থার কাজ চলতে লাগল। সরকারি প্রচেষ্টায় অরূপ চ্যাটার্জির বাড়িতেই তার ল্যাবরেটরিতে সেই কাজ চলতে লাগল। অরূপ আর বিপ্লবের পদ্ধতিটাও বৈজ্ঞানিক জগতের একটা রুটিন কাজের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেল। দু-এক বছর ঘুম পাড়িয়ে আবার জাগিয়ে তোলা প্রায়ই হতে লাগল, বিশেষ করে মহাকাশ যাত্রা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার কাজে। বৈজ্ঞানিক ছাড়া সবাই ব্যাপারটা ক্রমে ভুলে গেল।
দুই
এক-শো বছর পার হয়ে গেল। ১৬ আগস্ট ২০৭৬-এর কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। ‘অরূপ চ্যাটার্জি মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অন লো টেম্পারেচার ফিজিয়োলজি’-র ডিরেক্টর একটা ইস্তাহার প্রকাশ করলেন। ইস্তাহারটা এইরকম—
আগামী কয়েক সপ্তাহের শেষে বিশ্বের একটা অত্যাশ্চর্য পরীক্ষার শেষ অধ্যায় শুরু হবে। এক্সপেরিমেন্টটা শুরু হয় এক-শো বছর আগে, এক বৈজ্ঞানিকের অপূর্ব আত্মোৎসর্গের মধ্যে দিয়ে। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার পর তিনি চেয়েছিলেন ফ্রিজিং টেকনিকের একটা এক্সপেরিমেন্টে নিজেকে গিনিপিগ করে ব্যবহার করতে। তাঁর কাহিনি বিস্তারিতভাবে যাঁরা জানতে চান, আমাদের অফিসে এসে এ সম্বন্ধে তথ্য নিয়ে যেতে পারেন। এক-শো বছর আগের এই মানুষটির আগামী ১৬ আগস্ট ঘুম ভাঙানো হবে। বিজ্ঞান এ বিষয়ে এখন বহুদূর অগ্রসর হয়েছে, তাই আমাদের মনে হয় এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু বিপদ নেই। ড. দাশগুপ্ত ও তাঁর সহকর্মীর টেকনিককেই ভিত্তি করে অনেক বছরে এই কাজ আজ অনেক এগিয়ে গেছে। দু-এক বছর ঘুম পাড়িয়ে জাগানো এখন একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু সমস্যাটা হল অন্যরকম। এক-শো বছরের পুরোনো এই মানুষটি বর্তমান জগতে নিজের মানসিক ভারসাম্য রাখতে পারবেন কি না। জেগে উঠে তাঁর মানসিক অবস্থা কীরকম হবে তা আমাদের অজানা। নিজের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে, নিজের পরিচিত আত্মীয়-বন্ধু জগতের কোনো চিহ্নমাত্র না-পেয়ে এই মানুষটির নিঃসঙ্গতা তাঁকে কতদূর আঘাত দেবে— এ সবই আমাদের কাছে অজানা। আমরা তাই স্থির করেছি, নতুন দুনিয়ায় এই মানুষকে খুব ধীরে ধীরে জগতের সংস্পর্শে আনতে হবে। প্রথম কয়েক সপ্তাহ তিনি তাঁর বন্ধুর পরিচিত বাড়িতেই কাটাবেন। বেশিরভাগ সময় তাঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হবে। দৈনিক কয়েক ঘণ্টা করে তাঁকে জাগিয়ে রাখা হবে ও তিনি ধীরে ধীরে জগতের সঙ্গে পরিচয় নেবেন। আমরা চাই না যে বাইরের জগৎ থেকে কোনো অবাঞ্ছিত শক তাঁর ওপর আসে। তাই তাঁর প্রাইভেসি এই সময়ে আমরা অতি সযত্নে রক্ষা করব। তাঁর সগোত্র দু-একজন বৈজ্ঞানিক, একজন ডাক্তার ও একজন মহিলা মনস্তত্ত্ববিদ তাঁকে সাহচর্য দেবে ও তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেবে। পরে ধীরে ধীরে তিনি বহির্জগতে আসবেন। তাঁর মনে যা-কিছু চিন্তা উঠবে তা রেকর্ড করার ব্যবস্থা আমরা রাখব, যাতে তাঁর মনের অবস্থা আমরা সবসময় বুঝতে পারি। যথাসময়ে এই রেকর্ড থেকে তাঁর অনুমতি নিয়ে আমরা ডায়েরি মতন করে তাঁর অভিজ্ঞতা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করব।
২০ আগস্ট। ড. বিপ্লব দাশগুপ্ত সম্পর্কে দ্বিতীয় ইস্তাহার প্রকাশ হল।
ড. দাশগুপ্তকে যথাসময়ে রিভাইভ করা হয়েছে। রিভাইভ করার পর প্রথম দিকে তাঁর অবস্থা ছিল ক্লোরোফর্মে আচ্ছন্ন রোগীর যেরকম অবস্থা হয়। জ্ঞানলাভ করে তিনি ধরে নিয়েছিলেন তিনি তাঁর ল্যাবরেটরিতেই আছেন, আর তাঁর সকালে নিদ্রা ভাঙানো হয়েছে। জ্ঞান হতেই তিনি বললেন, ‘কে অরূপ? তুমি আমার ঘুম ভাঙালে?’
তাঁর সামনে ছিলেন আমাদের এক বৈজ্ঞানিক ড. মিত্র। আবছা আলোয় তাঁকেই তিনি অরূপ ভাবলেন। তখন ড. মিত্র বললেন, ‘না, আমি অরূপ নই।’
‘তবে তুমি কে? অরূপ কোথায়, এটা তো দেখছি তারই একতলার ঘরের মতো লাগছে।’
ড. মিত্র বললেন, ‘এটা অরূপের বাড়ি বটে, তবে আপনাকে বেশ কয়েক বছর আমরা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। সেইসময় যা-কিছু হয়েছে তা আপনাকে আস্তে আস্তে জানাব।’
‘আমি কতদিন ঘুমিয়ে ছিলাম, দশ-বারো বছর না তারও বেশি?’
‘আরও বেশি দিন।’
ড. দাশগুপ্ত হঠাৎ চুপ করে গেলেন। খানিকক্ষণ পর আস্তে আস্তে বললেন, ‘এটা তো অরূপেরই বাড়ি। তার মানে অরূপ আর বেঁচে নেই। তাই না! তা না-হয় নেই, কিন্তু আর সব পরিচিত লোকেরা কেউ নেই কেন? বড়োজোর পনেরো বছর আমি ঘুমিয়েছি। তার মধ্যে সবাই নিশ্চয় মরেনি!’
‘ড. দাশগুপ্ত, আপনাকে আস্তে আস্তে কে কোথায় আছে সবই জানানো হবে, আপাতত আপনি বিশ্রাম করুন। কিছু রবীন্দ্রসংগীত শুনুন। আপনার প্রিয় গানগুলো আমরা আনিয়ে রেখেছি। আর এই ওষুধটা খেয়ে ফেলুন।’
কয়েক দিনের প্রশ্নোত্তরে ড. দাশগুপ্ত ধীরে ধীরে জানলেন যে তাঁর পরিচিত কেউ তো নেইই, তাঁর পরিচিতদের নাতিরাও অনেক ক্ষেত্রে নেই। ধীরে ধীরে জানলেন তাঁর ঘুমের মধ্যে এক-শো বছর কেটে গেছে, যেমন তিনি চেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে সবটা শুনলেন।
তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, ‘তাহলে আমারও আর বাঁচার দরকার নেই। এক্সপেরিমেন্টটা তো সফল হয়েছে। আমি তাতেই খুশি। আমার দুনিয়া বলতে তো একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট মনুষ্যজাতি নয়। আমার নিজের পরিচিত মানুষই আমার দুনিয়া। তারা যদি কেউ না-থাকেন, তবে আমি একা জেনে আর বুঝে কী করব? তোমরা আমাকে আবার শান্তিতে ঘুমোতে দাও, আমি আর বাঁচতে চাই না।’
‘না ড. দাশগুপ্ত, তা হয় না। বিজ্ঞানের প্রয়োজনেই আপনাকে আরও কিছুদিন একাকীত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। আমরা দেখতে চাই, এক-শো বছর নিদ্রার পর মানুষ কতটা নিজেকে অ্যাডজাস্ট করতে পারে। বিজ্ঞানের প্রয়োজনে ভালো না লাগলেও কিছুদিন আপনাকে বাঁচতে হবে।’
ড. দাশগুপ্ত আদর্শ বৈজ্ঞানিক ছিলেন। তাই আমাদের প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেছেন। অন্তত সাময়িকভাবে সব কিছু দেখতে, শুনতে ও নিজের মনের প্রতিক্রিয়া ডায়েরিতে লিখতে রাজি হয়েছেন। এরপর থেকে বুলেটিন হবে তাঁর ডায়েরিটাই।
ড. বিপ্লব গুপ্তের ডায়েরি
সব শুনে বুঝে শুধু মনে হচ্ছে মানুষ কী বোকা! আমি ঘুমোবার আগে ভাবতুম যমকে ফাঁকি দিয়ে এক-শো বছর বাঁচলে কী অভিজ্ঞতা না-হবে। কিন্তু এ অভিজ্ঞতা একা নিয়ে আমি কী করব? আমার জগৎকে তো এ অভিজ্ঞতা পৌঁছে দিতে পারব না। আর এখানকার জগতের কাছে এসব তো স্বাভাবিক ডাল-ভাতের মতো। আমি তাদের কাছে একটা আদিমকালের ইতিহাস। অভিজ্ঞতা একা একা পেলে দেখছি কিছু সুখ নেই। তবে বিজ্ঞানের প্রয়োজনে যদি কিছুদিন বাঁচতে হয় তাহলে আমার খারাপ লাগলেও তা করতে হবে। এত লোক আমার জন্যে এত করেছে, এখন বাকিটুকু আমাকে করতেই হবে। অনেক কিছু নিশ্চয়ই আমার অজানা, সেগুলি জানতে আমার খুব একটা কৌতূহল নেই। কারণ আমি একাই তা নতুন করে জানব। অতীতের দরজা যারা জানে না তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া তো যাবে না। কালকে প্রথম এই বাড়ির বাইরে আমায় নিয়ে যাবে বলেছে। দেড়শো কিলোমিটার ট্রিপ দিয়ে বাংলার গ্রামে যাব। এক-শো পঁয়তাল্লিশ বছরের মানুষের এই প্রথম বিশ্বজগৎ দর্শন হবে।
সেপ্টেম্বর ২০৭৬
সকালে প্রাতরাশের টেবিলে এলেন আমার দু-জন সঙ্গী মনস্তত্ত্ববিদ কুমারী ঘোষ আর পদার্থবিজ্ঞানী ড. আমেদ। কুমারী ঘোষ বললেন, ‘ড. দাশগুপ্ত, আজ থেকে আপনি যা দেখবেন, কিছু যদি আপনার নতুন লাগে, প্রশ্ন করবেন। প্রশ্নোত্তরগুলির মাধ্যমে আপনি ধীরে ধীরে বর্তমান জগতের সঙ্গে পরিচিত হবেন। প্রাতরাশের পরই আমরা বেরিয়ে পড়ব। কোনদিকে যাবেন বলুন।’
‘আচ্ছা, আমার বাড়ি হচ্ছে তো বর্ধমান জেলার হলুদবাড়ি গ্রামে; সেইখানেই চলুন।’
‘বেশ, তাই হবে।’
গাড়িতে চড়ে বসলাম। সামনে আমি, পেছনে আমেদ আর গাড়ি চালাচ্ছেন কুমারী ঘোষ। ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে মনে হল, এ তো আমার পরিচিত মোটরগাড়ির মতো নয়, এ তো ইলেকট্রিক মোটর চালাবার ব্যবস্থা।
‘কুমারী ঘোষ আপনাদের এই গাড়িটি কীসে চলছে? পেট্রোলে নিশ্চয়ই নয়?’
কুমারী ঘোষ বললেন, ‘আমার নাম সুমিত্রা, আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন। না, এটা পেট্রোলে চলে না, ব্যাটারিতে চলে।’
ড. আমেদ বললেন, ‘পেট্রোল তো আপনাদের যুগেই ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছিল। এখন বিশেষ দরকার ছাড়া যানবাহন আর পেট্রোলে চলে না, এটা একটা ব্যাটারি চালিত গাড়ি। ব্যাটারি এখন অনেক উন্নত ধরনের হয়েছে, খুব হালকা আর সুবিধেজনক করে তৈরি হয়।’
‘ব্যাটারি চার্জ করেন কী করে?’
‘তা রাস্তাতেই দেখতে পাবেন। আপনাদের সময়কার পেট্রোল পাম্পিং স্টেশনগুলো এখন ব্যাটারি চার্জিং স্টেশন হয়ে গেছে। তা ছাড়া গাড়ির ছাদটা দেখুন।’
ছাদটায় দেখলুম একটা মৌচাকের মতো করে ফিউয়েল সেল করা।
‘ও, আপনারা বুঝি সূর্যরশ্মিও কাজে লাগাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, ব্যাটারি ছাড়া গাড়ির নিজের চালেতে বেশ খানিক সূর্যের কিরণ পড়ে, সেটাও আমরা ব্যবহার করি। তবে কেবল তাতে কুলোয় না, তাই সঙ্গে ব্যাটারির ব্যবস্থা।’
‘বাঃ, বেশ, তাহলে তো রাস্তায় ধোঁয়ার পাট প্রায় আপনারা চুকিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সময় এ নিয়ে কথা হত। কিন্তু পেট্রোল সস্তা থাকায় এসবে গবেষণা বেশিদূর এগোয়নি।’
‘আপনি দেখবেন, আমাদের বহু কাজেই আজকাল ব্যাটারি আর সূর্যকিরণের সাহায্যে সমস্ত স্মল স্কেল এনার্জির প্রয়োজন মেটানো হয়। এ বিষয়ে আপনি ধীরে ধীরে আরও অনেক জানতে পারবেন।’
গাড়ি চলতে লাগল। রাস্তাঘাট বেশ চওড়া, কিন্তু সেই পুরোনো শহরের ভিড় ও দৈন্য কিছুই নেই মনে হল। বুঝতেই পারছিলাম দেশের অবস্থা অনেক বদলে গেছে। শহরতলি ছেড়ে গাড়ি পড়ল গিয়ে গ্রামের দিকে। কিন্তু মাইলের পর মাইল যাচ্ছি, জঙ্গলের মতো লাগছে, বড়োজোর আম-কাঁঠালের বন। এই সময় মাঠভরা ধানের চাষ নেই কেন? কোথাও কোথাও শুধু দেখছি বিরাট কারখানার মতোন শেড। আমার সঙ্গীদের বললাম।
‘আচ্ছা, আমাদের সময় ধানের চাষে এই সময় মাঠ ভরতি থাকত রাস্তার দু-পাশে। আপনারা চাষবাস তুলে দিয়ে জঙ্গল করে ফেলেছেন, ব্যাপার কী? সারা রাস্তা তো দেখছি কিছু ফল-ফুলের বাগান, কিছু ডেয়ারি, আর তা না-হলে জঙ্গল। দেশের খাদ্যসংস্থান হয় কী করে?’
‘ড. দাশগুপ্ত, আপনার অন্তর্ধানের কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়ে সারা দুনিয়ার কৃষিব্যবস্থা একদম পালটে গেছে।’ বললেন ড. আমেদ, ‘আপনি বলুন তো, কী হতে পারে, যার জন্য খাদ্যদ্রব্যের চাষ বন্ধ হয়ে গেছে?’
‘বুঝেছি, আপনারা গাছপালার জগৎ থেকে ”সালোকসংশ্লেষ” পদ্ধতি— মানে ফোটোসিনথেসিস- এর মারফত স্টার্চ তৈরি শিখে নিয়েছেন। বাঃ!’
‘হ্যাঁ, আপনার অনুমান সত্য। সূর্যের কিরণের সাহায্যে আবহাওয়ার কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ে তা সিনথেসিস করে শ্বেতসার তৈরি করে সমস্ত উদ্ভিদজগৎ, আপনাদের যুগের বৈজ্ঞানিকরাই সেই পদ্ধতি আয়ত্ত করেছেন। তার ফলে শত শত বর্গমাইল জুড়ে লক্ষ লক্ষ চাষির হাড়ভাঙা খাটুনিতে যে শস্য উৎপাদন হত, আর তা প্রয়োজন হয় না। কোনো দেশেই হয় না।’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান, ফোটোসিনথেসিস ব্যাপারটা নিয়ে আমার বন্ধু বায়োকেমিস্ট অনিল সোম তো খুব কাজ করত, আর আমাকে মাঝে মাঝে এসে বলত। সব ভুলে গেছি। ব্যাপারটা খুলে বলুন তো একটু।’
‘খুব সহজে এইভাবে বলা যায়— শ্বেতসার পদার্থে আছে কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। আর এই শ্বেতসার তো আমাদের মূল খাদ্য। কারণ দেখুন, আমরা যে প্রোটিন খাই সেই প্রাণীরাও আবার গাছপালা খেয়ে তাদের পুষ্টি জোগায়। তাই আমাদের উদ্ভিদের সাহায্য ছাড়া আগে চলত না। বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস থেকে কার্বন, আর জল থেকে হাইড্রোজেন-অক্সিজেন নিয়ে সূর্যকিরণের তেজকে কাজে লাগিয়ে স্টার্চ তৈরি করতে পারত একমাত্র উদ্ভিদরাই, পাতার মধ্যকার সবুজ পদার্থ ক্লোরোফিলের সাহায্যে। ক্লোরোফিলের সাহায্যে যে ঠিক কী করে এই বিক্রিয়াটা হয় সেটা বার করতেই আমাদের বৈজ্ঞানিকদের অনেক সময় লেগে গেল। একবার ল্যাবে কৃত্রিম স্টার্চ বানাতে পারলে আর চিন্তা কী? খাদ্যসমস্যা চিরদিনের মতো মিটে গেল। সঠিক পদ্ধতিটা তো আপনাকে আমি বলতে পারব না, বুঝতে পারছেন। ফিজিক্সের লোক, অত কেমিস্ট্রি জানি না।’
আমি বললাম, ‘আমাদের কাছে তো এটা একটা স্বপ্নের মতো মনে হত। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, দুর্ভিক্ষে ফসল নষ্ট হয়ে কম লোক মারা গেছে নাকি! এখন আর সেরকম কখনো ঘটবে না। বিশ্বে তো আপনারা সত্যিই এবার বিপ্লব এনে দিয়েছেন।
আপনি তাহলে বলছেন যে, আমি সকালে ব্রেকফাস্টে যে কর্নফ্লেক্স আর রুটি খেলাম তা কৃত্রিমভাবে উৎপন্ন স্টার্চ থেকে তৈরি?’
‘হ্যাঁ, অবশ্য তার সঙ্গে কিছু ভিটামিন ও অন্যান্য জিনিস মেশানো হয়। আপনি যে দুধ খেলেন তাও কৃত্রিম।’
‘তা তো বুঝলাম, তাহলে আপনাদের গ্রাম বলতে এখন ফলের বাগান, ফুলের বাগান আর বড়োজোর মাংসের জন্য কিছু পোলট্রি, ফিশারি ইত্যাদি। বাকি জায়গা তাই দেখছি শুধু জঙ্গল করে দিয়েছেন।’
‘হ্যাঁ, তার ফলে সারা পৃথিবী এখন আবার আগের মতন হয়ে গেছে, যেমন ছিল সভ্যতার গোড়ায়। ফলে পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে গেছে। যাকে বলে জীবজগতের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকের ভারসাম্যতাও আগের চেয়ে অনেক বেশি এসে গেছে।’
‘বাঃ আপনাদের কাছে যা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার আমাদের কাছে তা সত্যিই ছিল নিছক স্বপ্নমাত্র। একবার আমার সহকর্মীদের আমার মতন এক-শো বছর টপকে পৃথিবীতে যদি আনা যেত! দেশের লোক তাহলে আগের মতন আর অভাবে নেই।’
‘তা তো নেই বটেই।’
‘তারা করে কী? চাষই যদি বন্ধ তাহলে কোটি কোটি চাষি এখন কী করে? খাবার তৈরির কারখানায় আর কত জন লাগে?’
‘আপনি আপনাদের গ্রামে গেলেই এ প্রশ্নের জবাব পাবেন। চাষির সংখ্যা খুবই কমে গেছে, গ্রামের চেহারাও একদম বদলে গেছে।’
আমি বললাম, ‘আমি বরাবর বলে আসছি যে, সূর্যকিরণ আমরা সম্পূর্ণ অপচয় করছি। তার সদব্যবহার করে আপনারা দেশের চেহারাটাই পালটে দিয়েছেন।’
বলতে বলতে গাড়িটা আস্তে আস্তে বসতি এলাকার দিকে আসতে লাগল। ড. সুমিত্রা ঘোষ দেখতে দেখতে বললেন, ‘ওই যে বিরাট প্রায় এক বর্গমাইল জুড়ে ঘেরা জায়গা দেখছেন, ওইটা হল ফোটোসিনথেসিস করার একটা কারখানা। এ ছাড়া দেখুন, অনেক বাড়ির ছাদে সূর্যকিরণ ধরবার ব্যবস্থা ও সোলার ইঞ্জিন রয়েছে। দু-পাশে দেখুন ফুলের-ফলের বাগান, মধ্যে মধ্যে পোলট্রি আর খামার। প্রত্যেক এলাকার সঙ্গে চাষিদের বাড়ি রয়েছে, যদিও আগের তুলনায় বাড়িগুলি অনেক ছড়ানো। গ্রামের কেন্দ্রে হচ্ছে হাট-বাজার, থিয়েটার, সিনেমা, খেলার মাঠ, বিদ্যালয় ইত্যাদি।’
বলতে বলতে এক জায়গায় গাড়ি থামল। আমি দেখলাম, আমার পুরোনো বাসস্থান সংস্কার করে অতিযত্নে সংরক্ষণ করা রয়েছে। আর দরজায় লেখা রয়েছে ‘স্বাগতম। ড. দাশগুপ্ত।’ নিজের পুরোনো বাড়ি ওইভাবে দেখে আমার চোখে জল এসে গেল। নেমেই কারুকে কিছু না-বলে ঘরটির মধ্যে ঢুকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে অশ্রুপাত করলুম। তারপর কিছুটা সামলে নিয়ে আবার সঙ্গীদের কাছে এলাম। বসলুম, ‘মাপ করবেন, অনেক বয়েস তো হল, তাই দুর্বল হয়ে গেছি।’
তাঁরা উত্তরে বললেন, ‘আপনার এই অশ্রুপাত আমরা বুঝি, কারণ এক-শো বছরে মানুষ তো মানুষই রয়ে গেছে। আপনার বাড়িটি যাতে আপনি দেখতে পান, তার জন্য এক-শো বছর এটিকে আপনার গ্রামের লোক আর সরকার বাঁচিয়ে রেখেছেন। সেটা আজ সার্থক হল।’
গ্রামের লোকজন আমায় একটা বিশেষ অভ্যর্থনা জানাতে চাইল। আমি বললাম, ‘না! তা আমি চাই না। আমি চাই তোমাদের মধ্যে বেছে বেছে নানান বয়সের লোক অন্তত জন দশ- পনেরো, আমার সঙ্গে আজকের দিনটা থাক, খাও, আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলব।’
তাই স্থির হল। অনেক বিবেচনা করে ওরা জন পনেরো লোক ঠিক করল। তাদের বয়স দশ থেকে আশি পর্যন্ত— ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বুড়ি সবরকম। চায়ের আসরে বসে সত্তর বছরের বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার নাম কী?’
‘আমার নাম কল্যাণ ভট্টাচার্য। আপনার কথা আমি জানি। আপনার কথা আমি শুনি আমার বাবার কাছে। আমার বাবার নাম সুজিত ভট্টাচার্য।’
‘ও, সুজিতের ছেলে তুমি? সুজিতের সঙ্গে আমার খুবই চেনা ছিল, আমার কথা ও তোমায় বলেছিল?’
‘হ্যাঁ, সে এক মজার গল্প, তখন আমার দশ বছর বয়স। স্কুলে রচনা লিখতে দিল, দেশের একজন নামকরা বৈজ্ঞানিকের জীবনী লেখো। আমি বাড়ি এসে বললাম, ‘বাবা, কার কথা লিখব?’ বাবা বললেন, ”কেন, আমাদের গ্রামের লোকই তো রয়েছে, বিপ্লব দাশগুপ্ত,” বলে আপনার কাহিনি সব বললেন। পায়ে পায়ে আপনার বাড়িটাও দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রচনা লিখে নিয়ে গেলাম। তারপর ক্লাসে কী মজা হল জানেন! আমরা সবাই ভীষণ ধমক খেলাম, টোকাটুকি করেছি বলে। পঁচিশটা ছেলে-মেয়ে সবাই লিখে নিয়ে গেছে বিপ্লব দাশগুপ্তের জীবনী। মাস্টারমশাই কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, আমরা পরস্পর পরামর্শ করিনি। তিনি তো এ গ্রামের লোক নন, তাই এখানে আপনার কী পরিচয় তা তিনি জানেনই না। আমরা গ্রামের নাম বদলাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনেকে বললেন, ‘আপনি জীবিত, আপনার নামে এখন গ্রামের নাম করার মানে হয় না। তাতে অনেকে ভাববে আপনি আর জীবিত নেই।’
অনেকের সঙ্গে অনেক কথা হল, গ্রামটার জীবনযাত্রা ভীষণ বদলে গেছে। একেবারে অজ গ্রাম ছিল আমাদের সময়। এখন কেমব্রিজ বা ওই ধরনের অবস্থাপন্ন গ্রাম্য টাউনশিপ বলে মনে হয়। ধান চাষ প্রায় উঠে গেছে, আছে খালি শৌখিন চাষ। হাড়ভাঙা খাটুনি নেই, লোকও অনেক কম।
ঘরে যে নানা বয়সের লোক ছিল, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আমার সময়কার এক-শো বছর আগেকার এই গ্রামের মানুষদের মুখের ছবি খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু মিল খুবই কম। তখন গ্রামের মানুষদের মুখে একটা আলাদা ছাপ ছিল। এখন শহরের সঙ্গে গ্রামের তফাত খুবই কমে গেছে। এদের সকলেরই বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, মেয়েরাও ছেলেদের মতো শার্ট-প্যান্ট পরা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা শাড়ি পরো না?’
একটি মেয়ে বলল, ‘এমনিতে তো এরকম পোশাকেই কাজকর্মের সুবিধা। সেজেগুজে বেড়াতে গেলে শাড়ি পরি, তাও কুঁচি দেওয়া সেলাই করা শাড়ি পাওয়া যায়, গলিয়ে পরে নিলেই হল। আপনাদের সময় তো শুনেছি লম্বা একফালি কাপড় কিনে নিজে নিজে ঘুরিয়ে পরতে হত।’
বৃদ্ধ কল্যাণবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার মার ওইরকম কাপড় আমর কাছে কয়েকটা আছে, দেখাব তোদের।’
বেশ মজা লাগল। আমি চিরকাল বলে এসেছি, সেলাই-করা ধুতি আর বোতাম-দেওয়া চাদর কেন পাওয়া যায় না। এখন দেখছি এরা সেই ব্যবস্থাই করেছে। তবে সেটা মেয়েদের, ছেলেরা ধুতি পরা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। একটি বছর-বারো বয়সের ছেলেকে বললাম, ‘তোমার নাম কী? তুমি কার ছেলে?’
ও বলল, ‘আমার নাম টিংকু। আমার ঠাকুরদাকে আপনার মনে আছে? তাঁর নাম ছিল সুনীলকুমার মিত্র। আপনার সঙ্গে ছোটোবেলায় নাকি দাদুর একবার খুব মারামারি হয়েছিল। দাদু আপনার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল।’
মনে পড়ল, সত্যিই ইশকুলে আমার দু-ক্লাস ওপরে পড়ত একটা গুন্ডামতন ছেলে, সবসময় আমাদের জ্বালাতন করত, আমি স্যারকে বলে দিয়েছিলাম বলে সে কী কাণ্ড!
‘জানেন, দাদু বলতেন, মাথা ফাটার পর থেকেই নাকি আপনার বুদ্ধি খুলে গেল। তার আগে নাকি কেবল ক্লাসে অঙ্ক ভুল করতেন। আচ্ছা, আপনাদের সময় ঘোড়াতে-গোরুতে গাড়ি টানত, না? তারপর মোমবাতি জ্বেলে পড়তে হত, আমাদের মতো এরকম বিজলি বাতি জ্বলত না।’
আমি হেসে বললাম, ‘তুমি যে আমাকে একেবারে প্রস্তর যুগে পাঠিয়ে দিচ্ছ দেখছি! তবে, গ্রামে তখনও সত্যিই লন্ঠন জ্বেলে পড়তে হত রাত্রে। শহরের আর গ্রামের মধ্যে একটা বিরাট তফাত ছিল। সেটা আর নেই দেখে সত্যি ভারি আনন্দ হচ্ছে।’
‘লন্ঠন মানে কেরোসিনের বাতি, না? আমাদের মিউজিয়ামে একটা আছে দেখেছি।’
‘আচ্ছা, এখন গ্রামে সেই আগের মতো দুর্গাপুজো, কালীপুজো এসব হয় না? আগে নানারকম উৎসবে কত ঘটা হত।’
ছেলে-মেয়েরা হাঁ করে রইল। কল্যাণ হেসে বলল, ‘সে সব এরা অনেকেই জানে না। আমাদের ছোটোবেলা থেকেই ঢাক ঢোল বাজিয়ে বারোয়ারি পুজো করা প্রায় উঠে গেছে, আমরা মা-ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনেছি।’
‘সে কী, আমাদের সময় তো মনে হত, এ সব বন্ধ করা অসম্ভব!’
‘আসলে বেশি হইচই যারা করত, তাদের যে খুব একটা ধর্মবিশ্বাস ছিল তা তো নয়; তাই ঠিক হল যে আনন্দ উৎসব বছরে কয়েক দিন করা হবে, আর যাঁরা ধর্ম বা দর্শনতত্ত্বে আগ্রহী, তাঁদের জন্য নানারকম সভাসমিতি, আলোচনাচক্র থাকবে। পুজো করতে চাইলে যে যাঁর নিজের বাড়িতে করতে পারবেন। এখন আমরা নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, দোলযাত্রা, রাখিপূর্ণিমা এসব পালন করি। তা ছাড়া কালীপুজোর দিন বাজি পোড়ানো, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়ানো— এ সবের উৎসাহ একটুও কমেনি।’
যুক্তি দিয়ে বিচার করলে, সত্যিই খুব ভালো ব্যবস্থা। তবুও এক-শো বছর আগের কলকাতায় পুজোর সময়টা মনে পড়ে মন খারাপ লাগল। বললাম, ‘তাহলে তখন যে কত সুন্দর সুন্দর মাটির প্রতিমা, শোলার সাজ তৈরি হত, তাও উঠে গেছে?’
কল্যাণবাবু বললেন, ‘না, বিদেশে সে সবের চাহিদা আছে খুব। ওইসব কারিগররা এখনও অনেক মূর্তি বানায়, অনেক বিদেশে পাঠানো হয়, এখানকার লোকেও কিছু কেনে। তবে আমার মা বলতেন, পুজোর জন্যে যে মূর্তি তৈরি হত, তার নাকি মুখের ভাবই আলাদা ছিল। সেরকম মিষ্টি মুখ নাকি এখনকার কুমোররা আর করতে পারে না।’
‘আপনাদের সময়কার উৎসবের গল্প বলুন না’— বলতে বলতে সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। ভেবে দেখলাম, সত্যি আমার গল্প শুনতে এদের ভালো লাগারই কথা। আমি তো একটা জীবন্ত ইতিহাস বই। এদের গল্প আমি শুনে কী করব? কার জন্যেই বা লিখে রাখব? এখনকার মানুষকে এখনকার জীবনযাত্রার কথা শোনাবার কোনো মানে হয় না। যত নতুন নতুন জিনিস দেখছি ততই পুরোনো বন্ধুদের মনে পড়ছে। ভবিষ্যতে সমাজ কীরকম হবে, ধর্মবিশ্বাস কীরকম হবে, এসব নিয়ে আমরা কত জল্পনা-কল্পনা, তর্কাতর্কি করতাম; কিন্তু সত্যি করে কী হয়েছে, তা এখন আর আমার সেই সমাজতত্ত্ববিদ বন্ধু অরুণকে জানাতে পারব না, অর্থনীতিবিদ রমাপদকেও জানাতে পারব না। বললাম, ‘তোমরা এত সব করেছ, একটা টাইম মেশিন বানাতে পারোনি? আমাকে তাহলে আবার আমার সময়ে পাঠিয়ে দিতে পারতে?’
‘কেন, আমাদের সঙ্গে থাকতে বুঝি আপনার ভালো লাগছে না?’ একটি ছোটো মেয়ে বলল।
আমার মনে হল সত্যি, আমি ভারি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। বৈজ্ঞানিকোচিত ব্যবহার করছি না। এরা যাতে আমার কষ্ট না-হয় তার জন্য কত চেষ্টা করছে, আর আমি তার মর্যাদা দিতে পারছি না। বললাম, ‘না না, তা মোটেই না। শুধু ভাবছি আমাদের দেশের এত উন্নতি, আমার বন্ধুরা কেউ জানতে পারল না। তাদের আর তাদের উত্তরসূরীদের জন্যেই তো এতটা সম্ভব হয়েছে!’
তারপর অনেকক্ষণ ধরে ওদের আমাদের সময়কার গল্প বললাম, পুজোর সময় সেই ঢাকের শব্দ, দল বেঁধে পুজো দেখতে যাওয়া, রাত জেগে যাত্রা দেখা— এইসব সবাই শুনে ভারি খুশি।
‘আচ্ছা, গ্রামের এতটা পরিবর্তন এত তাড়াতাড়ি কী করে হল, বলো তো? আমাদের সময় তো মনে হত না যে, আরও এক-শো বছর পরে গ্রাম অন্যরকম হয়ে যাবে।’
অল্পবয়সি যারা ছিল তারা বলল, ‘কী জানি, আমরা তো ছোটোবেলা থেকেই এরকম দেখে আসছি।’
কল্যাণবাবু বললেন, ‘আসল বৈপ্লবিক পরিবর্তনটা হয়েছে আপনি ঘুমানোর কুড়ি-পঁচিশ বছর পর, আমার তখনও জন্ম হয়নি। আপনাদের সময় থেকেই তো খাদ্য-সমস্যা ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠেছিল। তারপর সারা পৃথিবীতেই বেশ একটা সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। সেইসময় নানা দেশের একদল বৈজ্ঞানিক মিলে স্টার্চ সিনথেসিসের প্রক্রিয়াটা আবিষ্কার করে ফেললেন। সেইটাই সবচেয়ে বড়ো পদক্ষেপ। তার ফলে খাদ্যসমস্যা একরকম মিটেই গেল, অন্তত না-খেয়ে আর কারুকে থাকতে হল না। অবশ্য তখন কারখানায় যে গুঁড়ো ময়দার মতো পদার্থ তৈরি করে দিত, সেটা খেতে ভারি বিশ্রি ছিল। তবু যাহোক, দুর্ভিক্ষটা তো মিটে গেল। তারপর আস্তে আস্তে স্টার্চ তৈরির অনেক উন্নতি হল। এখন যে শস্য তৈরি হচ্ছে, তার স্বাদ আর চেহারা তো প্রায় স্বাভাবিক চাল-গমের মতো।’
‘হ্যাঁ, আমি তো খেয়ে কিছুই বুঝিনি।’
‘গ্রামগুলো তো একেবারেই কৃষিনির্ভর ছিল। তাই ধানের চাষ উঠে যেতে গ্রামের সমাজব্যবস্থাও বদলে গেল, খেতের বদলে বড়ো বড়ো কারখানা গড়ে উঠল, গ্রামের আশপাশেই। শহর থেকে বিস্তর লোক সেসব কারখানায় কাজ করতে গেল। শহরের ভিড়ও তাই কমে গেল। অবশ্যই ব্যাপারটা ক-দিনে হয়নি। বেশ কিছু বছর ধরে আস্তে আস্তে ওলটপালট হয়ে এমনি দাঁড়িয়েছে।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ গ্রামের আর কেউ বিজ্ঞানের ব্যাপারে নাম করেছে নাকি?’
একজন বলল, ‘হ্যাঁ, অর্জুন ভট্টাচার্য। সে তো গত দু-বছর হল চাঁদে রয়েছে।’
‘তাই নাকি! কে সে? তার ঠাকুরদার নাম কী?’
‘তার ঠাকুরদা অজিত ভট্টাচার্য।’
‘ও, অজিতদা তো আমার খুবই পরিচিত ছিল। তাহলে অর্জুন আমার নাতিই হল।’
একটি মেয়ে সলজ্জভাবে বলল, ‘অর্জুন আমার বিশেষ বন্ধু, ও ফিরে এলে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা। আপনি বিদেশে গেলে টেলিভিশনে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেন।’
‘বেশ তো, আমি যদি পারি তার খবর তোমাকে পাঠাব। নাম কী তোমার?’
‘আমার নাম লিপিকা।’
অক্টোবর ২০৭৬
দু-দিন হলুদবাড়ি গ্রামে কাটিয়ে আজ সকালে ফিরেছি। ট্রিপটা বেশ টনিকের কাজ করেছে। আমার সঙ্গে অন্তত গ্রামের লোকদের একটা যোগসূত্র মনে অনুভব করছি। তাই আর একা একা লাগছে না। যেন মনে হচ্ছে, আমি অতিবৃদ্ধ এক পিতামহ, বহুদিন বেঁচে আছি, অথচ আমার পরের জেনারেশন সব মারা গেছে। ড. আমেদকে বলেছি এবার কয়েকটা দিন শহরে ঘুরব, শহরটাকে ভালো করে দেখতে চাই। কাল থেকে আমাদের শহর দেখার প্রোগ্রাম।
সকালে খাওয়া-দাওয়া করে শহর দেখতে বেরিয়েছি। পাশে বসে আছে সুমিত্রা। আজ গাড়ি চালাচ্ছেন ড. আমেদ। বার বার মনে হচ্ছে, যেন স্বপ্ন দেখছি। সুমিত্রা যেন আমারই মেয়ে। আবার চমকে উঠছি। সুমিত্রা তো আমার নাতির মেয়েও হতে পারে। আমার আসল বয়স তো এক-শো পঁয়তাল্লিশ। কলকাতার রাস্তা অক্টোবর মাসের আবহাওয়া, বেশ খরখরে রোদ। আমরা তো গাড়িতে বসে আছি। রাস্তায় বেশ লোক রয়েছে, সবার গায়ে হালকা ওভারকোট, মাথায় হুড। বৃষ্টি নেই, তবু এই অদ্ভুত বেশ কেন?
সুমিত্রাকে জিজ্ঞেস করলাম। সে বলল, ‘ওগুলো ইনসুলেটেড কুলিং ওভারকোট। যখন চাঁদে মানুষ বাস করতে গেল, প্রথমেই তাদের দরকার হচ্ছিল শুধু দারুণ শীতের পোশাক নয়, দারুণ গরমের জন্যেও হালকা পোশাক। তাই থেকে বেশ কিছুদিন, অন্তত বছর পঞ্চাশ আগে এই কোট তৈরি করা হয়েছে। এতে শরীর সবসময়ে, যত গরমই হোক, কুড়ি থেকে বাইশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপ থাকে। আবার শীতকালে ঠান্ডা দেশেও এটার সাহায্যে ওই টেম্পারেচার মেনটেন করা হয়। অথচ পোশাকটা খুবই হালকা। আমাদের গাড়িতেই ওইরকম এক সেট পোশাক নিয়েছি। রোদে নেমে পরে দেখবেন চলুন।
রাস্তায় নামলাম, খুব চড়া রোদ, অক্টোবরে যেমন হয়। দাঁড়ানো যায় না। গায়ে কোটটা পরলাম। খুবই হালকা পোশাক। পরে একটা ছোটো ফিতে টেনে বেঁধে দিতে বলল। দেওয়ামাত্রই শরীর জুড়িয়ে গেল!
‘বাঃ, আপনারা তো সত্যিই এবার গরমের দেশের উপযোগী একটা বিশেষ পোশাক বার করেছেন দেখছি! চমৎকার! আমাদের সময় এত হালকা পোশাক এভাবে কাজ করবে ভাবাই যেত না।’
‘হ্যাঁ, ব্যাটারি আর রেফ্রিজারেশনের সরঞ্জাম ক্রমেই মিনিয়েচারাইজড হচ্ছে, তাই এটা সম্ভব হয়েছে। এখন রেফ্রিজারেশনের জন্য আর ভারী যন্ত্রপাতি লাগে না। আর সবচেয়ে মজা কী জানেন? গরমে বা রোদে সূর্যের তাপটাই কাজে লাগানো হয় শরীর ঠান্ডা করতে। আপনার কোটের হাতাটা দেখুন, অজস্র হালকা টিউব গেছে। এইগুলি দিয়ে অনর্গল ঠান্ডা হাওয়া পাঠানো হয়, আর গরম হাওয়া টেনে নেওয়া হয়। এনার্জি পাওয়া যায় সূর্যের তাপ থেকেই। ওই একই পদ্ধতিতে এখন বাড়িতে আর গাড়িতেও কুলিং সিস্টেম রাখা হয়েছে।’
আবার গাড়িতে বসা গেল।
শহরটা আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে। লোক আগের চেয়ে অনেক কম লাগে। গাছপালা বেশি। খানিক যেতে যেতে শহরের একটু বাইরের দিকে দেখলাম একটা পাওয়ার হাউস। কিন্তু দেখে বোঝা যায় যে, ওটা কয়লাতে বা তেলে চলে না। ওদের জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘আপনার ঘুমানোর পঞ্চাশ বছর পরে ”হাইড্রোজেন ফিউশান রিঅ্যাকশন” ব্যবহার করে পাওয়ার জেনারেশন সম্ভব হয়। এটা তারই একটা মডেল। আমরা এখান থেকে সারা পশ্চিমবঙ্গ-সহ আশপাশের আরও কিছুটা অঞ্চলের প্রয়োজনীয় সব পাওয়ার জোগান দিই। যদি দেখতে চান একদিন নিয়ে যাওয়া যাবে।’
‘কলকাতার জনসংখ্যা এখন কত?’
‘পনেরো লক্ষের কিছু বেশি। কলকাতার মতন আরও গোটা কতক বড়ো শহর গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে। তার ফলে কলকাতার ওপর চাপ অনেক কমে গেছে। তা ছাড়া শহরে থাকতে লোকে আর খুব আগ্রহ দেখায় না। বাইরে থাকাই পছন্দ করে।’
‘আচ্ছা, কলকাতার দু-একটা আমার চেনা জিনিস কীরকম অবস্থায় আছে আমি দেখতে চাই।’
‘কী দেখবেন বলুন?’
কিছুটা ভেবে বললাম, ‘আমাদের সময় কলকাতায় এলেই লোকে দেখত কালীঘাটের মন্দির, বেলুড় মঠ, মনুমেন্ট, মিউজিয়াম, হাওড়া ব্রিজ ইত্যাদি। সেগুলোর অবস্থা কী দেখলে হয়, অন্তত বাইরে থেকে।’
‘বেশ তো, চলুন-না।’
প্রথমেই নিয়ে গেল কালীঘাট। মন্দির রয়েছে, আশেপাশে বাগান ও অনেক খোলা জায়গা। ওরাই বলল, ‘মন্দির আছে তবে আগের মতন অত দর্শনার্থীর ভিড় নেই। অনেক কমে গেছে।’
মনুমেন্টটা রয়েছে, মোটামুটি সেইরকমই; কিন্তু জাদুঘরের পুরোনো বাড়িটা আর নেই, অনেক বড়ো বাড়ি হয়েছে। হাওড়া ব্রিজ দেখতে গিয়ে দেখি গঙ্গার ওপর অন্তত সাতটা ব্রিজ হয়ে গেছে। প্রায় সব বড়ো রাস্তাগুলোর যোগাযোগ আছে। বেলুড় মঠের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাগানটিও বেশ সাজানো গোছানো আছে। ওরা বলল, ‘ঐতিহাসিক বাড়িগুলো মোটামুটি দেখলে চিনতে পারবেন, কারণ ওগুলো সযত্নে রক্ষা করা হয়েছে।’
খানিকটা ঘুরতে ঘুরতে এবার ক্লান্ত লাগল, বললাম, ‘ফিরে চলুন, মোটামুটি শহরটা বেশ খানিকটা বদলে গেছে বুঝতে পারছি, আর দেখে লাভ নেই।’
অরূপের বাড়িতে ফিরে আসা হল। তারপর ওরা বলল, ‘এবার বলুন, আপনার আর কী দেখবার জানবার ইচ্ছে।’
আমি বললাম, ‘একবার দেশের বাইরে যাওয়া যায় না? ইংল্যান্ড বা আমেরিকায়, ওখানেও তো আমি অনেক দিন কাটিয়েছি।’
ওরা বলল, ‘আমাদের অফিসে আসুন, একটা মজার ব্যাপার আপনাকে দেখাব।’
অফিসে নিয়ে গিয়ে প্রথমেই দেখাল একরাশ টেলিগ্রাম এসেছে নানান দেশ থেকে। বিশ্বের সমস্ত জানা-অজানা জায়গায় তারা আমায় দেখতে চায়, আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়, আমি নাকি পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। আমার জাগার ব্যাপারটা চাঁদে যাওয়ার মতো টেলিভাইসড হয়েছে ও দুনিয়ার সবাই তা দেখেছে। সব দেখেশুনে আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে না। আমি যে বিশ্বে একান্তই একা— এটা আরও বেশি করে বুঝতে পারছি। আমি হচ্ছি একটা ভূত, আর সবাই জ্যান্ত ভূত দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ দেখতে চায় বলে মনে হয় না। আমি বললাম যে, ‘তাহলে বিদেশে আমি যাব না। কী স্বদেশে, কী বিদেশে এমনিতেই আমি একা। তাতে সবাই এরকম করলে আমি আরও বেশি একাকিত্ব অনুভব করব। আমি সাধারণ মানুষ, সেইরকমই আমি থাকতে চাই।’
সুমিত্রা বলল, ‘আমরাও ভেবেছি, খুব হইহল্লা আপনাকে নিয়ে করা যাবে না। বেশ শুনুন, আপনাকে আমরা বেনামে নিয়ে যাব। কেউ জানবে না আপনি কে, আপনার পরিচয় বদলে দেব। শুধু যদি বিশেষ কোনো বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে আপনার কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলে তাকেই আপনার পরিচয় দেব, দরকার হলে। আপনি কবে যেতে চান? আর কোথায় যেতে চান?’
আমি বললাম, ‘একবার কম্ব্রিজের লো টেম্পারেচার ল্যাবরেটরিতে যেতে চাই, আর একবার নিউইয়র্কে যেতে চাই, আর কোথাও আপাতত নয়। আচ্ছা, বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে নিয়মকানুন কী আছে?’
‘বিশেষ কিছুই নেই। গত পঞ্চাশ বছর হল কোনো দেশে যাবার বিশেষ বাধা নেই। কারণ সব দেশে লোক কম। জনসংখ্যা সর্বত্র কমে গেছে। তাই লোকে যদি আসে তাতে কেউ আপত্তি করে না। কাজের তো অভাব নেই। পাসপোর্ট, ভিসা উঠে গেছে।’
‘আমরা যাব কীসে, প্লেনে নিশ্চয়ই না।’
‘যাওয়ার সময় দেখবেন আর একটা সারপ্রাইজ। সেটা কিন্তু এখন বলব না। তাহলে সারপ্রাইজ থাকবে না।’ সুমিত্রা বলল।
বেশ মজার ব্যাপার মনে হল। কী আবার সারপ্রাইজ? রকেট-ট্রাভেল নাকি?
‘সামনের সপ্তাহেই আপনাকে কম্ব্রিজে নিয়ে যাওয়া হবে। আপাতত এখানেই বিশ্রাম করুন।’
***
কাল সন্ধ্যায় একটা স্পেশাল সিনেমা দেখলাম। আমার জন্য অনেক যত্ন করে সংগ্রহ করেছে। এক-শো বছর আগের বিশেষ বিশেষ দৃশ্য আর ঘটনাবলি। সবচেয়ে অভিভূত হলাম দুটো দৃশ্য দেখে। একটা হল, আমি আর অরূপ প্রথম ফ্রিজিং টেকনিক আবিষ্কার করে যে বিরাট অভিনন্দন পেয়েছিলাম তার দৃশ্য। দেখতে দেখতে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমার সমসাময়িক সব পরিচিত মুখের কথা মনে পড়তে লাগল। অরূপ আর আমার দিল্লি আর লন্ডন যাত্রা সবই দেখাল।
তার পরেরটা হচ্ছে আমার অন্তর্ধানের ঠিক পরেই— অরূপের প্রেস কনফারেন্স। সেখানে অরূপকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। অনেকে মনে হল অরূপকেই কিছু-একটা খুনের দায়ে অভিযুক্ত করতে চাইছে। বেচারা অরূপ! আসল সত্য চেপে রাখতে গিয়ে ওর তো সত্যিই ভীষণ মুশকিল হয়েছিল।
তারপরের দৃশ্যটাও বেশ মজার। অরূপের মৃত্যুর পর অসীম বর্মনের সাংবাদিক বৈঠক, আসল ঘটনা প্রকাশ, আর তা নিয়ে হইহই। দু-একজন সাংবাদিক যাঁরা দুটোতেই এসেছেন তাঁরা বললেন যে, অরূপ যে কিছু জানে অথচ বলছে না, এটা তাঁরাও বুঝতে পেরেছিলেন। ব্যাপারটা রহস্যময় লাগলেও কিছু হদিশ করতে তাঁরা পারেননি।
আমার সমসাময়িক কলকাতাকে দেখে আমি বেশ বুঝতে পারছি, মরে গেলে আর বাঁচা যায় না। আমি সত্যিই আর দশজনের মতো বেঁচে নেই। আমি যেন পরকাল থেকে প্ল্যানচেট-এ নেমে এসেছি। আবার যেকোনো সময় চলে যাব। জীবনটা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আমি আর সেটাকে ধরতে পারব না। তার ভেতর ঢুকতেও পারব না। যেটা তখন ভেবেছিলাম মজার একটা অভিজ্ঞতা হবে, এখন দেখছি সেটা একটা অর্থহীন পাগলামো মাত্র।
***
কালকে আমরা ইংল্যান্ড যাত্রা করলাম। সেই বিশেষ রহস্যটা ভেদ হল। সঙ্গে সুমিত্রা আর আমেদ ছিল। গাড়ি করে চলে গেলুম শহর থেকে দূরে একটা বেশ ফাঁকা জায়গায়। মনে হল প্রথমটা যেন ‘এয়ারপোর্ট’। তারপর দেখলাম, না, মাঠের মধ্যে বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব স্টেশন। ‘ব্যাপার কী, আমরা কি তবে টিউবে বিলেত যাত্রা করব?’
সুমিত্রা বলল, ‘ঠিক তাই, ইন্টার-কন্টিনেন্টাল টানেল সমস্ত মহাদেশকে যুক্ত করেছে। সুড়ঙ্গগুলো খানিকটা চ্যাপ্টা ‘ইউ’-এর মতো। আপনাকে এঁকে দেখাচ্ছি।’ বলে একটা গোল আঁকল।
‘মনে করুন, এই বৃত্তটা পৃথিবীর একটা সেকশন। আমরা আছি ‘ক’ বিন্দুতে, আর কম্ব্রিজ হল ‘খ’ বিন্দুতে। ‘ক’ থেকে ঢালু করে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে যদি এগিয়ে যান, আর মাঝপথে আবার উঠে যান, তাহলে ‘খ’-তে পৌঁছোবেন। মাধ্যাকর্ষণের জোরে ‘ক’ থেকে নামতে আপনার গতি বাড়বে যতক্ষণ ঢালু পথে যাচ্ছেন। ঢালুর মাঝপথে যখন আসবেন, তখন সেখানে যা আপনার গতিবেগ তা নিয়ে আপনি এবার ওপরে উঠে যাবেন। বিশেষ কোনো এনার্জি খরচই হবে না।’
‘কিন্তু ”ফ্রিকশন” তো আছে।’
‘হ্যাঁ, তার জন্য কিছুটা গতি নষ্ট হবে। তাই বিশেষভাবে তৈরি সুড়ঙ্গে এয়ার কুশনের ওপর ওটা চলে, অনেকটা ”হভারক্রাফট”-এর মতো। আর নিজস্ব মোটর দিয়ে যেটুকুন স্পিড লস হয় তা পুষিয়ে নেয়। তা ছাড়া হাওয়ার সঙ্গে ঘর্ষণ কমানো হয় টানেলের ভেতরের হাওয়া পাতলা করে রেখে। তেলের অভাবের জন্য আজকাল এইভাবে যাওয়া-আসা খুব বেড়ে গেছে।’
‘কিন্তু সুড়ঙ্গ খুঁড়তেই তো বিরাট খরচ হয়।’
‘তা হয় বটে, তবে ট্যানেলিং টেকনিকেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। লেসার রশ্মির সাহায্যে টানেল করা হয়। তাই সমুদ্রের তলা দিয়ে এরকম গভীর সুড়ঙ্গ করা সম্ভব হয়েছে। এই পাতাল রেলে করে আমরা যাব।’
বলতে বলতে একদম সিল করা রকেটের মতো দেখতে একটা বিরাট টিউব-ট্রেন এসে দাঁড়াল। আমরা একটা স্পেশাল কামরায় উঠে বসলাম। তারপর অবশ্য যাত্রাটা অত্যন্ত বিরক্তিকর। সুড়ঙ্গটা অন্ধকার। মোটা কাচের ছোটো ছোটো জানলা দিয়ে শুধু অন্ধকারই দেখা যাচ্ছে। তাই ওদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাব মনে করলাম। ওরা বলল, ‘না, আপনার সঙ্গে এক ইংলিশ অধ্যাপকের আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। নাম ড. জনসন। তিনি আপনার বিষয়ে জানেন। উনিই আপনাকে নিয়ে যাবেন, ওঁর সঙ্গে কথা বলুন।’
পাশের কামরা থেকে ভদ্রলোককে নিয়ে এল। আমারই বয়সি মনে হল। তারপরই মনে হল আমার ঘুমোনোর আগের বয়স, এখনকার নয়। অর্থাৎ পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর, এক-শো পঁয়তাল্লিশ নয়।
করমর্দন করেই তিনি বললেন, ‘আপনার মতো একজন বৈজ্ঞানিকের সংস্পর্শে এসে আমি সত্যিই গর্বিত। সারা বিশ্ব আপনাকে দেখতে চায়। কিন্তু আপনি শুনলাম লুকিয়ে থাকতে চান। অবশ্য আপনার মানসিক অবস্থাটা আমরা কিছুটা বুঝি। বিশাল মানব অরণ্যে আপনি একা বোধ করছেন। যত বেশি লোক দেখেন, আপনার একাকিত্ব তত বেড়ে যায়। বলুন, আপনি আমাদের দেশের সম্বন্ধে কী জানতে চান?’
আমি বললাম, ‘দেখুন, আমার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত লোক তো অনেকেই ওখানে ছিল। কিন্তু তাদের কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। আমি অন্যপ্রসঙ্গে অল্পবিস্তর আপনার থেকে জানতে চাইবে। প্রথমত, আমার সময়ে পূর্ব দুনিয়া আর পশ্চিম দুনিয়াতে ছিল অনেক তফাত। এখন কী অবস্থা হয়েছে? রাজনীতির অবস্থাটাই বা কী, আর রাষ্ট্রসংঘের কী খবর? মানুষ কতটা পরস্পরের কাছে এসেছে?’
ড. জনসন বললেন, ‘দেখুন, বৈজ্ঞানিক হিসেবে আপনি খানিকটা ভবিষ্যদদ্রষ্টা, সুতরাং আপনি বুঝতেই পারছেন যে, আরও যত বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে, তার ফলে পৃথিবীর মানুষ অনেক কাছে এসেছে।’
‘হ্যাঁ, অনেকগুলো ব্যাপার তো দেখতেই পাচ্ছি। যেমন পাসপোর্ট, ভিসা প্রভৃতি উঠে গেছে, লোকের যেকোনো দেশে বাস করার বাধা নেই; কিন্তু আমাদের সময়কার আণবিক অস্ত্রের ব্যাপারে খানিকটা সুরাহা হয়েছে কি?’
‘তাও হয়েছে। প্রথমদিকে ব্যাপারটা খারাপের দিকেই যাচ্ছিল। অনেক দেশই আস্তে আস্তে বোমা তৈরি শিখে গেল। কিন্তু তারপর ছোটো ছোটো দুটো দেশে, যাদের নাম আপনাকে বলব না, হঠাৎ বেধে গেল অ্যাটমিক লড়াই। হঠাৎই বেধে গেল। কেউ ভাবেইনি, এত ছোটো দেশের সাহস হবে এরকম সাংঘাতিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে। ফলে ওই দুটো দেশ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল। তা ছাড়া আপনাদের দেশগুলোরও বেশ সাংঘাতিক ক্ষতি হল। তখন পৃথিবীর সমস্ত দেশ একসঙ্গে স্থির করে, এ অস্ত্র ত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। সব দেশ মিলে গড়ে তুলল একটা নতুন সংগঠন। যার কাজ হল যাতে কোনো দেশে আণবিক অস্ত্র উৎপাদন না-হয়, তার ব্যবস্থা করা। ব্যবস্থাটা বেশ সার্থক হয়েছে, কিন্তু হওয়ার আগে দুটো ছোটো ছোটো দেশের আত্মহত্যা করার প্রয়োজন ছিল। হলও তাই। তবে আর একটা কথা, একদিকে পৃথিবীর মানুষ নিজেদের সংখ্যা-নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল। আর একদিকে মূল খাদ্যসমস্যা একদম মিটে গেল। তাই লড়াইয়ের জন্য খুব একটা দরকারও আর রইল না। তবে দেশে দেশে বিবাদ বিসংবাদ যে একেবারেই চলে গেছে, তা নয়। নানান ব্যাপারে যথেষ্ট বিবাদ হয়, তবে কেউই আর সশস্ত্র সংঘাতের দিকে এগোতে চায় না। মোটামুটি বিশ্ব আদালত বা ওই জাতীয় প্রতিষ্ঠান মারফত যে রায় বেরোয় সেটা বড়ো-ছোটো সব দেশই মেনে নেয়।’
নানান গল্প করতে করতে একদিন কেটে গেল। পরেরদিন আমার সঙ্গীরা বলল, ‘এইবার লন্ডন ইন্টার-কন্টিনেন্টাল টিউব স্টেশন এসে যাচ্ছে। আমরা শিগগির টানেলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসব। খানিক পরেই আলো দেখা গেল আর আমাদের ট্রেনটা থেমে গেল। বেরিয়ে দেখি ঠিক একটা বড়ো টিউব স্টেশন। নানান জাতের লোক, সাদা-কালো সবাই ব্যস্ত হয়ে গাড়ি থেকে উঠছে-নামছে। আমরাও নামলাম। তারপর ইংরেজ বন্ধুটির সঙ্গে একটা ছোটো মোটরগাড়ি করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলাম।
লন্ডন, সেপ্টেম্বর ২০৭৬
লন্ডন, সেপ্টেম্বর ২০৭৬। আমি শেষ লন্ডনে এসেছিলাম এক-শো দু-বছর আগে, একটা সম্মেলনে আমাদের পদ্ধতিটা আলোচনা করতে। আজ আবার এলাম। লন্ডন বিশেষ বদলায়নি। মনে হয় বাড়ির সংখ্যা কিছু কম, গাছপালা বেশি। হোটেলে গিয়েই একটা মজার ব্যাপার দেখলাম। একজন বিজাতীয় লোক, বোধ হয় মধ্য ইউরোপের; সে হোটেল কাউন্টারে এসে নিজের পকেট থেকে একটা ছোটো স্পিকিং টিউব বার করল। একটা বোতাম টিপে দিল, আর বিজাতীয় কথাবার্তা বলতে লাগল। হোটেলের লোকটিও দেখি একটা চোঙায় ইংরেজিতেই জবাব দিয়ে যাচ্ছে, কানে তার হেডফোন। ইংরেজ বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপারটা কী?’
তিনি বললেন, ‘মিনিয়েচার ট্রান্সলেটর’ বা ‘ক্ষুদে অনুবাদক’, যেকোনো ভাষা থেকে অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করার যন্ত্র। আজকাল একদেশে অন্য দেশের লোক ব্যবহার করে। অবশ্য এতে কেবল সাধারণ কাজ চালানো যায়, কারণ মোট পাঁচ-শো-সাত-শো কথার অনুবাদ সম্ভব হয়। তবে তার মধ্যে মোটামুটি অনেক কাজই চলে যায়।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু এতগুলো ভাষার কথা, আর তার বিকল্প একটা যন্ত্রের মেমারিতে রাখা তো সম্ভব নয়।’
‘না, তা তো বটেই। যন্ত্র একটাই, যে দেশে যাচ্ছেন সেই দেশের আর আপনার দেশের স্পেশাল টিউব নিতে হয়, তা না-হলে চলে না। আপনি ইংরেজি জানেন, তাই আপনার দরকার নেই। তবু দেখতে চান তো হোটেলেই এক সেট ভাড়া পাওয়া যাবে। বাংলায় অবশ্য পাবেন না, তবে হিন্দিতে পাবেন। চলুন-না, এক সেট নেওয়া যাক।’
একটা নিলাম, দেখলাম আমি হিন্দিতে মোটামুটি সাধারণ কথা বললে লাউড স্পিকারে সেটা থেকে ইংরেজিতে তার অনুবাদ বেরিয়ে আসে। আবার আমার সঙ্গী ইংরেজিতে জবাব দিলে সেটা আমার কাছে হিন্দি হয়ে আসছে। যন্ত্রটা খুব ছোটো ‘ওয়াকিং টকি’-র মতো। অবশ্য অনুবাদ হওয়াটা একটা নতুনত্ব।
লো টেম্পারেচার ল্যাবরেটরিতে গেলাম কম্ব্রিজে। সেখানে আমার জানাশুনো বিখ্যাত অধ্যাপকদের ছবি আছে দেওয়ালে। কিন্তু তাদের কেউ তো আর থাকতে পারে না। একজন প্রায় পঁচাত্তর বছর বয়সের প্রাচীন অধ্যাপক, এখন রিটায়ার্ড। তাঁর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হল আগেকার দিনের। আমার মুখে পুরোনো দিনের কথা শুনে তিনি কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘ইয়ং ম্যান’, তুমি এসব কী করে জানলে? তোমার তো তখন জন্মই হয়নি?’ তারপর বললেন, ‘আমাদের স্বর্গীয় প্রফেসর ম্যাকমিলান লো টেম্পারেচার ফিসিয়োলজিতে ভারতীয় অবদানের কথা বার বার বলতেন। বিশেষ করে সাম প্রফেসর দাশগুপ্ত হু ইউজড হিমসেলফ অ্যাজ অ্যা গিনিপিগ। বাই জোভ, নাউ দ্যাট আই সিম টু রিমেমবার দ্যাট প্রফেসর হ্যাজ বিন রিভাইভড-উয়েট অ্যা বিট।’ বলেই একটা খবরের কাগজের থেকে একটা ফোটো বার করে সেটাকে দেখলেন। বললেন, ‘ইউ লুক রিমার্কেবলি লাইক হিম। কিন্তু তিনি তো ভারতের বাইরে যেতে অস্বীকার করেছেন।’
আমি দেখলাম যে, ইনি প্রায় ধরে ফেলেছেন ব্যাপারটা। কোনোরকমে ধমাচাপা দিয়ে আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলুম। তখনও তিনি বিড়বিড় করছেন, ‘হি লুকস রেদার সিমিলার, বাট দেন মোস্ট ইন্ডিয়ানস ডু লুক সিমিলার!’
কম্ব্রিজ থেকে ফিরে দু-একদিন বিশ্রাম করে আমরা এবার রওনা দিলাম নিউইয়র্কের দিকে। আবার সেই পাতাল রেল। এবার আটলান্টিক পাড়ি দিলাম। নিউইয়র্কে পৌঁছে দেখলাম, শহরটা বেশ বদলে গেছে। আমেরিকানরা আমাদের সময় থেকেই এনভায়রনমেন্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়েছিল। এখন তাই সব শহরগুলো আগের চেয়ে শান্ত ও সবুজ পরিবেশ গড়ে তুলেছে। ওদের কর্মচাঞ্চল্য আগের মতো অতটা নেই, আগের চেয়ে খানিকটা ধীর-স্থির। কথাবার্তাতেও অনেকটা সৌম্য-শান্ত ভাব এসেছে। কাপড়-জামা বেশভূষা অনেকটা ঘরোয়া, যার যেটা ভালো লাগে পরে। মোটামুটি প্রাচ্যের প্রভাব ওদের ওপর পড়েছে।
এখান থেকে বিশেষ ব্যবস্থা করে আমায় স্পেস সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানকার অধ্যক্ষের কাছে আমার পরিচয় জানানো হল। তিনি তো শুনেই অবাক, উত্তেজিত হয়ে সবাইকে ডাকতে যাচ্ছিলেন। তখন আমি বললাম, ‘না ড. হার্ভার্ড! কাউকে বলবেন না। আমি এখন ছদ্ম পরিচয়ে আছি এবং থাকতে চাই। তবে আপনাকে জানালাম, কারণ আপনাদের যে একদল কর্মী দু-বছর হল চাঁদে একটা কলোনি গড়ে তুলেছে, তাদের মধ্যে একজন ভারতীয় আছে। তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
‘ও, আপনি অর্জুনের সঙ্গে কথা বলবেন? তাকে জানলেন কী করে?’
‘তাকে নয়, তার ঠাকুরদা আমার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, আমরা ছিলাম একই গ্রামের মানুষ। আমি তার খবর নিতে এসেছি।’
‘বেশ তো, আমি এখনিই ব্যবস্থা করছি।’ বলেই তিনি ‘মুন স্টেশন’-কে ডাকলেন ট্রান্সমিটার সিগন্যালে। একটা টিভি স্ক্রিনে মুন স্টেশনের টেলিভিশন রুমটা ভেসে উঠল। তারপর তিনি বললেন, ‘আই ওয়ান্ট অর্জুন টু কাম টু দ্য স্ক্রিন।’ বলতেই একটি বছর তিরিশের ভারতীয় যুবকের মূর্তি ফুটে উঠল। সে বলল, ‘কী খবর ড. হার্ভার্ড?’
ড. হার্ভার্ড বললেন, ‘তোমার দেশের লোক এসেছেন দেখো, প্রফেসর বিপ্লব দাশগুপ্ত— দ্য ম্যান ফ্রম দ্য পাস্ট।’
অর্জুন কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। সে বলল, ‘কী ব্যাপার? কে বিপ্লব দাশগুপ্ত?’
ড. হার্ভার্ড বললেন, ‘অর্জুন তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। তুমি না একজন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক, ইউ ডোন্ট ইভেন নো ইয়োর মোস্ট ফেমাস ম্যান অফ সায়েন্স হু ফ্রিজ হিমসেলফ।’
এতক্ষণে অর্জুনের উপলব্ধি হল আমি কে। অবাক হয়ে স্ক্রিনে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘ক্ষমা করবেন, প্রফেসর দাশগুপ্ত। আপনি হচ্ছেন আমাদের একটা উপকথা, চন্দ্রলোক থেকে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি, কিন্তু হওয়া উচিত ছিল উলটো। আপনি যদি চন্দ্রালোক থেকে আমার সঙ্গে কথা বলতেন, তবেই বোধ হয় ঠিক হত। আপনি তো ভারতীয় বিজ্ঞান জগতে দেবতার স্থান নিয়েছেন।’
বললাম, ‘অর্জুন, হলুদবাড়ি গ্রামে গিয়ে তোমাদের বাড়িতে তোমার ঠাকুরদার ছবি দেখলাম। তিনি আমার বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। তাই তুমি কিছুটা আমার নাতির মতন। অবশ্য তোমার ঠাকুরদা বেঁচে থাকলে এক-শো পঞ্চান্ন বছর বয়স হত। তিনি তো মারা গেছেন, প্রায় সত্তর বছর আগে।’
অর্জুন বলল, ‘হ্যাঁ, আমি জন্মাবার আগে। বাবার যখন তিরিশ বছর বয়েস, তখন তিনি মারা যান। বাবা বেঁচে থাকলে তাঁর বয়সই প্রায় এক-শো হয়ে যেত।’
হিসাবের অঙ্কে মাথা গোলমাল হয়ে গেল, তাই বললাম, ‘যাক ও কথা, চাঁদে তোমরা দু-বছর একটানা কাটাচ্ছ, কীরকম লাগছে?’
ও বলল, ‘অদ্ভুত বা ভীষণও বলতে পারেন। আমরা মোট পনেরো জন আছি, কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই এই পনেরো জনের মনে হয়, তারা যেন বিশ্বসংসারে একদম একা পড়ে গেছে; থাকতে থাকতে ক্রমেই আমাদের ব্যক্তিত্ব বদলে যাচ্ছে। তাই আমাদের মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন যে, এবার আবার পৃথিবীতে আমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে।’
আমি বললাম, ‘অর্জুন, তোমরা পনেরো জনে একা মনে করছো, আর আমি পৃথিবীতে বসে লোকজন ঘেরা, তবু ভীষণ একা লাগছে। আমার নিঃসঙ্গতাটা তুমি হয়তো কিছুটা বুঝবে। যাক ও কথা, ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো। তারপর তুমি ফিরলে তো একটা নেমন্তন্ন খাচ্ছি। লিপিকা তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তোমাদের বাড়ির সকলেও তোমার খবর জানতে চেয়েছিলেন। এবার তাহলে বিদায়!’
অর্জুনও হেসে বলল, ‘বিদায়।’
ড. হার্ভার্ডকে বিদায় জানিয়ে আমরা হোটেলে চলে এলাম, এবার দেশে ফেরা। আর আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির করা।
***
আবার দেশে। একদিন বিশ্রামের পর পুরো মেডিকেল চেক-আপ হল। এক্সপার্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আমায় পরীক্ষা করে স্কায়াগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে বললেন, ‘ড. দাশগুপ্ত, আপনি জানেন যে, আপনার হার্টের অবস্থা খুবই খারাপ!’
‘হ্যাঁ, তা তো জানিই, সেইজন্যই তো এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম।’
‘তাহলে শুনুন, হার্ট-ট্রান্সপার্ট এখন একটা অতিসাধারণ অপারেশন, আর আমাদের হার্ট ব্যাঙ্কে যথেষ্ট হার্ট সংরক্ষিত আছে। আপনাকে আমরা অস্ত্রোপচার করে হার্ট বদলে দিলে আপনি পঁচিশ বা তিরিশ বছর সুস্থ শরীরে অনায়াসে থাকতে পারবেন।’
আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা আমি ভেবে কালকে জবাব দেব।’
***
সারারাত ভেবেছি। ভেবে দেখলাম, বিজ্ঞানের যে প্রশ্নটা জড়িয়ে ছিল আমার বাঁচার সঙ্গে, সেটা শেষ হয়ে গেছে। এখন যে প্রশ্নটা আছে সেটা হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই সম্পূর্ণ অপরিচিত জগতে নতুন করে বেঁচে থাকবার চেষ্টা করে, আবার একঘেঁয়েমি আর একাকিত্ব ভোগ করা ছাড়া আর কী লাভ হবে? অপারেশন আমি করাব না। স্বাভাবিকভাবেই যখন সময় হবে আমি আমার অসমাপ্ত নিদ্রা আবার শুরু করতে চাই।
***
তিন মাস পরের বুলেটিন।
আমরা দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ড. বিপ্লব দাশগুপ্ত হৃদরোগে ভুগছিলেন। অস্ত্রোপচারে রাজি না হওয়ায় আমরা তাঁর ইচ্ছামতো তাঁকে বিশ্রাম নিয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে দিয়েছি। গত রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় স্ট্রোকে মারা গেছেন। এইভাবে বিপ্লব দাশগুপ্তের অদ্ভুত জীবন সমাপ্ত হল।