২১. বিশাল আকাশ

এক সন্ধ্যায় মনজুর সাহেব হীরুদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। রমরমা দেখে বিস্মিত ও মুগ্ধ হন। তিনি মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। সেই বিয়ের দাওয়াতের কার্ড নিয়ে এসেছেন। চারদিকের কায়দাকানুন দেখে হকচাকিয়ে গেছেন। তিথি বের হয়ে বলল, কেমন আছেন চাচা? তিনি হকচাকিয়ে গেলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ভাল আছি। আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছ মা? তিথি তীক্ষ্ণ গলায় বলে, আপনি কী আমাকে চিনতে পারছেন? ঐ যে অভাবের সময় টাকার জন্যে যেতাম। আপনি এত আদর করতেন। মনে আছে। মনজুর সাহেব কিছু বলেন না। মুখ শক্ত করে বসে থাকেন।

মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন বুঝি?

হুঁ।

বড় মেয়ে না ছোট মেয়ে?

ছোট মেয়ে। যেও কিন্তু।

যাব। অবশ্যই যাব। আপনার কাছ থেকে আদর খেয়ে আসব। আপনার আদরের কথা সব সময় আমার মনে হয়।

উঠি তিথি।

না, না। আপনি কেন উঠবেন। আমি আপনাকে চা বানিয়ে খাওয়াব। আপনার মনে আছে চাচা আপনি এক’দিন হালুয়া বানিয়ে চামুচে করে আমাকে খাইয়েছেন। মনে আছে, না মনে নেই?

মনজুর সাহেব বড়ই অস্বস্তি বোধ করেন। তার অস্বস্তি দেখে গভীর করুণায় তিথির মন হঠাৎ কেমন যেন ভরে যায়। হঠাৎ মনে হয় কী দোষ এই লোকটার? কোনো দোষই তো নেই।

অরুর চিঠি এসেছে। সে চিঠি লিখেছে নিউ জার্সি থেকে। সে ভাল আছে। সুখে আছে। স্বামীর সঙ্গে আছে। এই হচ্ছে চিঠির বক্তব্য। স্বামী কে? সে কোথায় আছে সেই সব কিছুই নেই। বড়ই সংক্ষিপ্ত চিঠি। শুধু চিঠির এক কোণায় লেখা তিথি, তোকে রোজ স্বপ্নে দেখি। তিথি তোর কী হয়েছে রে?

তিথির কী হয়েছে সে নিজেও জানে না। সে শুধু জানে যে তার হাঁটতে ভাল লাগে। মতিঝিল থেকে টিপু সুলতান রোড, সেখান থেকে গেণ্ডরিয়া। গেণ্ডারিয়া থেকে সূত্রপুর। এত ভাল লাগে কেন হাঁটতে? শুধু মাঝে মাঝে হঠাৎ মেঘে মেঘে আকাশ যখন কালো হয়ে যায়, যখন চক্রাকারে আকাশে সোনালি ডানার চিল উড়তে থাকে। তখন কেন জানি সব ছেড়েছুড়ে ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। এমন কোনো ঘর যে ঘরে দুবাহু বাড়িয়ে কেউ-একজন অপেক্ষা করে আছে। যে ঘরে পা দেয়া মাত্র বলবে মেঘলা দিনে কোথায় কোথায় ঘুরছিলে বল তো? তিথি হাসবে। সেই মানুষটা কোমল অথচ রাগী গলায় বলবে, হাসবে না তো। হাসির কোনো ব্যাপার না। দেখ না। কেমন ঝড় শুরু হল। এই দিনে কেউ বাইরে থাকে? তিথি বলবে, হোক ঝড়; এস না। আমরা খানিকক্ষণ ভিজি।

তুমি কী পাগল হলে তিথি?

হ্যাঁ পাগল হয়েছি। এস তো।

তিথি সেই মানুষটাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে। লোকটি যতই রাগ করবে সে ততই মজা পাবে। কিন্তু তিথির জন্যে তেমন কেউ অপেক্ষা করে নেই, কোনোদিন করবেও না। তার জন্যে অপেক্ষা করবে বিশাল আকাশ। যে আকাশ সবার জন্যেই অপেক্ষা কবে। আবার কারো জন্যেই করে না।

Leave a Reply to হামিদুল Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *