২১. এখন জ্যোতি বসু

২১. এখন জ্যোতি বসু

এখন জ্যোতি বসু ভাল নেই। অথচ এখন ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে জ্যোতি বসুর নামটা ধ্রুবতারার মত জ্বলজ্বল করছে। এখন ভারতীয় রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর মত যথার্থ অভিজ্ঞ, ক্ষুরধার বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন, সুপক্ব রাজনীতিজ্ঞ আর কেউ নেই। তাঁর তুল্য সর্বজনগ্রাহ্য জননেতাও নেই। এদিকে ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে রাজধানীর অস্থির রাজনীতি আর একবার প্রমাণ করেছে যে প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে না বসেও তিনি রাজনীতির কর্ণধার হতে পারেন। তবুও জ্যোতি বসু ভাল নেই। এদিকে আগুন ঝরানো বিদ্রোহী বিরোধীপক্ষ ছেড়ে চলে এসেছেন অনেকদিন এগিয়েছেন ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে। সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের সংসদীয় জীবনে, ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছে কোয়ালিশনের পাকা ভিত। সেই দৃঢ়মূল ভিতের ওপর আজ বিশ বছর দাঁড়িয়ে রয়েছে জ্যোতি বসুর বামপন্থী কোয়ালিশন সরকারের ঋজু ইমারত। দেশবিদেশের কাছে ‘এক রহস্য’ আর বিরোধীদের ঈর্ষার কারণ। তবুও কিন্তু জ্যোতি বসু একেবারেই ভাল নেই।

জ্যোতি বসুর ভাল না থাকার কারণ একটা নয় অনেক। বললেন, “এখন পৃথিবীর চেহারা পালটে গেছে, এখন সামনে অন্য বাস্তব, চিন্তাভাবনাও তো সেইভাবে করতে হবে।” একটু থেমে বললেন “আমি তো পার্টিতে এখন মাইনরিটি।” বসুর মতে ‘নিজেদের’ আদর্শচ্যুত না হয়েও ‘অস্তিত্ব বজায়’ রাখা যায়, ‘জনগণের আস্থাও অর্জন’ করা যায়। পরিস্থিতির খাতিরে, বিরাট বিপর্যয় এড়াতে গেলে কঠিন ফ্রেমের মধ্যে থাকলে চলে না, কখনও কখনও ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে জগৎটা দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।” বসু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝাতে চাইলেন : “এই ইউনাইটেড ফ্রন্টের কথাটাই ধরা যাক। আমরা আগে তো এই ধরনের জোট বাঁধিনি। কংগ্রেসের কিছু লোক যখন ভেঙে বেরিয়ে এল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, তখন তো তাদের সমর্থন নেওয়া হল। আর যাই হোক কংগ্রেস তো সাম্প্রদায়িক পার্টি নয়, কিন্তু বি. জে. পি. হল আগাগোড়া সাম্প্রদায়িক—তো জোট হল, আর এতে পারস্পরিক সুবিধাই হয়, প্রধান বিরোধীপক্ষকেও ঠেকানো যায়।” কোথায় যেন একটা কাঁটা খচ্খচ্ করে। কয়েকটা পুরোনো ঘটনা মনে পড়ে যায়। সেই ১৯৪৮-৫০ সালে বি. টি. রণদিভের ‘সেক্‌টেরিয়ান’ নীতির বিরুদ্ধে বসুর সোচ্চার বিরোধিতা (“আই থরোলি ডিসঅ্যাপ্রুড বি টি আর’স স্ট্র্যাটেসিজ”–বসু বললেন) আর ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের হেফাজতে তাঁর পার্টির জেলে থাকার কথা। তখন ভবানী সেন, সোমনাথ লাহিড়ী, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত এবং বিশ্বনাথ মুখার্জি সকলেই ‘বি টি আর লাইনে চলেছেন। বসু তখন প্রায় একা; অজয় ঘোষের মধ্যপন্থী লাইনে তিনি চলেছেন। অজয় ঘোষ তখন ক্রুশ্চেভের ১৯৫৬ সালের বিংশতিতম সি পি এস ইউ কংগ্রেসে গৃহীত নতুন ধ্যানধারণা, নতুন নীতিতে বিশ্বাসী। তখন তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে আপোসনীতির পক্ষেও যুক্তি দেখিয়েছেন, সি. পি. আই-এর কট্টর কংগ্রেসবিরোধিতার অবসান হতে চলেছে যদিও তিনি কংগ্রেস-কমিউনিস্টসম্পূর্ণ ঐক্যের সমর্থন একেবারেই করেন নি। যখন পার্টি ভাগ হল, আলাদা পার্টি গড়ার সময় এল, বসু এবং আরও কয়েকজন কিছুদিন নিরপেক্ষ রয়ে গেলেন, একটা কোঅর্ডিনেশন কমিটিও গড়া হল। তবে বেশিদিন এই অবস্থায় থাকা গেল না, পরিস্থিতি আর তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ তাঁকে সি. পি. আই. (এম)-এর দিকেই ঠেলে দিল। চোখে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন মুখে বিপ্লবের মন্ত্র নিয়েই বসু এলেন বিধানসভায়। সে আজ এক যুগ আগেকার কথা। এখন তিনি যথেষ্ট নমনীয়, কখনও রীতিমত ‘সিনিকাল’ কখনও বা ঈষৎ উদাস। এখন কি ভাবেন বসু? এখনও কি আগের মতই তাঁর বিপ্লবের স্বপ্ন আছে?

উত্তরে বসু বললেন, “হ্যাঁ, লক্ষ্যটা এখনও একই আছে, তবে কোন্ পথে সেখানে পৌঁছনো যাবে তা নিয়ে, আমি মনে করি, এখনও বিতর্ক শেষ হয়নি। তবে হ্যাঁ, আমি বলি ‘লেফট্ সেকটেরিয়ানিজম’ চলবে না, আর হ্যাঁ ‘সশস্ত্র সংগ্রামের পথও’ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমরা চাই শান্তিপূর্ণ পথে জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। দীর্ঘ মেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা দেখা খুব কঠিন। এখন ‘পার্লামেন্টারি’ এবং ‘একস্ট্রা পার্লামেন্টারি’ লড়াই—দুটোই চালিয়ে যেতে হবে। আমরা ‘পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট’ এইভাবেই গড়ে তুলতে চাই।”

আর একটা প্রশ্ন। সেই ১৯৪৮ সালের পার্টির যে ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়?” দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সে সম্পর্কে বসু এখন কি বলেন, কি ভাবেন?

বসু উত্তরে বলেন : “সে তো অনেকদিনের কথা। হ্যাঁ, মুসলিম লীগের জন্য পাকিস্তান হবে জিন্না তো এইভাবেই ইন্ডিয়ায় মুসলিমদের মোবিলাইজ করেছিলেন। আমরা বলতাম মুসলিম লীগকে অবহেলা করা চলবে না, তবে আমরা ভারত দু’ভাগ হোক তা চাইনি। আমরা ‘ওয়ান ইন্ডিয়া’ চেয়েছিলাম, অনেক প্যামলেট ইত্যাদি বারও করেছিলাম। পরে বলেছিলাম, আমরা ‘পলিটিকাল ফ্রিডম’ পেয়েছি তবে ‘ইকনমিক সভারেটি’ পাইনি। এই স্ট্যান্ড অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। শরৎ বোস, সুরাবর্দী দাবি করেছিলেন ‘ইনডিপেন্ডন্ট বেঙ্গল’ তাও টেঁকেনি।”

এখন কি আত্মসমালোচনার কোনও জায়গা আছে?

বসু জবাব দিলেন : “না, এখন আর কি? এখন তো সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতি, অন্য সিচুয়েশন, অ্যানাদার রিয়ালিটি’, এখন পলিসি ‘ফ্রেন্ডশিপ উইথ্ নেবাস’, পাকিস্তান, বাংলাদেশ…।”

আর ভারতীয় সংবিধান সম্বন্ধে বসু এখন কি ভাবেন? ‘ভারতীয় সংবিধান বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়া হোক’—এই ধরনের একটা মন্তব্য বসু এক সময় করেছিলেন। সেও বহুদিনের কথা। এখনও কি তাই মনে করেন?

বসু উত্তরে বললেন : “হ্যাঁ, একবার আমি বিধানসভায় ভারতীয় সংবিধান সম্বন্ধে কয়েকটা বিরূপ কথা বলেছিলাম বটে। আমি বলেছিলাম বুর্জোয়া এই সংবিধানের আর্টিকেল-এ অধিকার (রাইট) দেওয়া হয় আর ‘ফুটনোটে’ সেগুলো নিয়ে নেওয়া হয়। তাছাড়া সংবিধানে জুরুরী অবস্থা (এমারজেন্সি) ঘোষণা করার অধিকার দেওয়া আছে, সেটা ভয়ংকর কথা, মেনে নেওয়া যায় না। তবে তখন একটু বাড়াবাড়ি হয়েছিল, এখন ও কথা বলি না, আমাদের সংবিধানে অনেক ভাল ভাল জিনিস আছে, সেকুলারিজম-এর ব্যাপারটা খুবই ভাল। তাছাড়া বিভিন্ন রাইটের ব্যাপারে নানা ব্যবস্থা আছে, তবে হ্যাঁ আর্টিকল ৩৫৬ নিয়ে এখনও বলি, এখনও ওটা নিয়ে আমাদের ‘রিজার্ভেসন’ আছে।”

উত্তরপ্রদেশের সরকার সম্বন্ধে বসু বললেন “হ্যাঁ, এখন রাজনীতি এই রকমই হবে।” রাজনীতিতে এখন নীতির বালাই নেই। বললেন “এই তো স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পুরো হল। চারিদিকে কত কি হচ্ছে, কিন্তু সত্যিই কি গর্ব করার মত আমরা কিছু করতে পেরেছি—এখন আছে মুখ থুবড়ে পড়া ধনতান্ত্রিক অবস্থা, এক বিরাট বিদেশী ঋণের বোঝা আর সবচেয়ে খারাপ কথা দুর্নীতিগ্রস্ত একদল রাজনীতিজ্ঞ দেশটা শেষ করল।” বসুর কথায় হতাশার সুর বাজে—”গত ষাট বছর ধরে জনগণের সঙ্গে, জনগণের মধ্যে কাজ করছি কিন্তু এমন পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি কখনও দেখিনি। আমাদের সময় রাজনীতি অন্যরকম ছিল, আমার তো মাঝে মাঝে এখনকার চিন্তাভাবনার স্তরে নামতে বেশ অসুবিধা হয়।”

“আর একটা ব্যাপার আমাকে অবাক করে, সেটা হল রাজনীতিতে ‘অ্যান্টি সোস্যালদের’ দাপট। এরাই দেখি ভোটে জিতে বিধানসভায় আসছে, সংসদেও আসছে, এটা খুবই চিন্তার কথা। এখন রাজনীতিতে শুধু ‘মাস্ল আর মানি’র জোর। সাধারণ মানুষের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস আছে, তাদের বোঝানো উচিত কোন্‌টা ঠিক আর কোন্‌টা ভুল।”

প্রাক্তন সিবিআই অফিসার এন. কে. সিং-এর লেখা ‘দ্য প্লেইন ট্রুথ’ বইটা পড়ে বসুর খুব ভাল লেগেছে। বললেন, “ভদ্রলোকের বেশ সাহস আছে, সব খোলাখুলি লিখেছেন।” নিজের পার্টির সম্বন্ধে বসু এখন কি ভাবেন? বললেন, “সমালোচনার উর্ধ্বে আমরা কেউই নয়। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি গোড়াতেই বীজটা নষ্ট করে দিতে, যাতে সেটা আর বাড়তে না পারে। আমাদের পার্টিতে বহিষ্কারের ঘটনা বাড়ছে। আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, সংশোধনী ব্যবস্থা নিই।” “সমস্যা আরও আছে”, বসু বলেন, “ধর্মের ব্যবসা, ধর্মের নামে রাজনীতির সমস্যা, আছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপদ। ১৯৯২ সালে ৬ই ডিসেম্বর তো এদেশের ইতিহাসে একটা কলঙ্কময় দিন। কত জ্বলন্ত সমস্যা রয়েছে দেশে, মানুষ খেতে পাচ্ছে না, এদিকে ধর্ম, সম্প্রদায় নিয়ে হানাহানি চলছে। এখন বি. জে. পি-ই দেশের বিরাট বিপদ। দেশে অন্তবর্তী নির্বাচনও আসন্ন। লোকে বি. জে. পি-কে ভোট দিলে মুস্কিল।” সাম্প্রদায়িকতা ছাড়াও বসুর আর এক দুশ্চিন্তা হল বিচ্ছিন্নতাবাদ। দিল্লীতে গিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার সময় বসু দেখেছেন কেউ নিজের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে গিয়ে একতিল ছাড়তে রাজী নয়। ভারতের কথা কেউ ভাবে না। “আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের কি সত্যিই কোনও জাতীয়তাবোধ আছে?” বসু প্রশ্ন করেন স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে, “ভারতবর্ষের ইতিহাস অবশ্য অনেকটা সেই কথাই বলে, স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি আমরা। দেশও কিন্তু অখণ্ড থাকেনি। নিজেদের রাজ্যের সংস্কৃতি, ভাষা ভালাবাসাটা কোনও মন্দ কথা নয়, তবে আমরা যে ভারতীয় এই কথাটা যেন সব সময় মনে থাকে। আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এখন আর ভারতবর্ষকে একটা ‘নেশন’ বলে কেউ ভাবে না।”

“আমার তো বন্দীর জীবন, নিজের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই—লিখে দিও এ কথা তোমার জীবনীতে”–বসুর স্বরে বিষণ্ণতার আভাস। ভারতের নক্ষত্র কমিউনিস্ট নেতা বসেছিলেন তাঁর বাসভবনের বৈঠকখানায়। ১৯৭২ সালে কংগ্রেসের এক পার্টি সম্মেলনের সময় ইন্দিরা গান্ধীর জন্য সল্ট লেকে তৈরি হয়েছিল ইন্দিরা ভবন। বসু এখন সেখানেই থাকেন। বসু বসেছিলেন সোফার ওপর। একটু দূরে বসুর ডানদিকে রয়েছে কাস্তে হাতুড়ি প্রতীকের গোলার্ধ, তারপাশে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্যপালের দেওয়া রুপোলি মিনিয়েচার চারমিনার; উত্তর কোরিয়ার চক্‌চকে কালো কাঁচের ফুলদানী তার পাশে শোভা বাড়াচ্ছে। কাঁচের কেসে বন্দী ঘড়ির সোনালি পেন্ডুলাম দুলে যাচ্ছে অবিরাম। দেওয়ালে ছুটন্ত ঘোড়া ফ্রেমে বন্দী। বিলাসবহুল আসবাব নেই, নেই সজ্জার বাড়াবাড়ি। বসুর সোফার পাশের টেবিলে একটা ছোট সাধারণ ফোন। হাতে ছোট্ট সাদা রিমোট কন্ট্রোল-বেল, দরকার হলে কাজের লোককে ডেকে নেন।

বসে কথা বলছেন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত ‘ফেনোমেনন’। এ যাবৎ আর কোনও মার্কসবাদী নেতা শিখরে এতদিন থাকেন নি। এখন দলের মধ্যে রিপুকর্মে পারঙ্গম। দেশের দীর্ঘতম কমিউনিস্ট সরকারের দীর্ঘতম মেয়াদের মুখ্যমন্ত্রী। জাতীয় রাজনীতিতে অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব। অবশ্যম্ভাবী কারণেই জীবন- থেকে-বিশাল ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে গেছে।

তবুও কেন তিনি বিষাদগ্রস্ত? অনেক কিছুই তো করতে পেরেছেন? “করতে পেরেছি?”—বসু নিজেকেই যেন নিজে জিজ্ঞেস করেন। “করতে পারা” কথাটার কোনও মানে হয় না, ক্ষমতা আর গৌরব ব্যাপারটা অত্যন্ত ক্ষণভঙ্গুর”–আবার সেই স্বগতোক্তি। ফিরে যান আগের কথায়, “এতদিন তো আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি, গণতন্ত্রও আছে এদেশে, তবে রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? আমি তো কমিউনিস্ট, মাঝে মাঝে মনে হয় যেন বদ্ধ হয়ে আছি, চারদিকে পাহারাদার।”

এই আক্ষেপ অর্থহীন নয়। বাড়িতে দুর্গের মত অতন্দ্র প্রহরা। কম্যান্ডোরা বাজপাখীর চোখ নিয়ে সদাসতর্ক। পদে পদে নিরাপত্তারক্ষী। আছে লালবাজারের বিস্ফোরক স্কোয়াডের অনুসন্ধান, ধাতব অনুসন্ধান যন্ত্রের শাব্দিক সিগন্যাল। “এর কোনও মানে হয় না”, বসু বলেন, “এইভাবে পাহারা দিয়ে কারো জীবনরক্ষা করা যায় নাকি?” কারো বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকলে খাওয়ার পদগুলোও নিরাপত্তারক্ষীরা চেখে দেখার নিয়ম এক সময় ছিল, বসুর ব্যাপারটা একেবারে পছন্দ নয়—আমি ওসব বারণ করে দিয়েছি, একটা রুচি শালীনতাবোধ আছে তো মানুষের!”

এখন বসুর শরীরও আর তেমন সহযোগিতা করে না। অথচ ব্যস্ততা, ছোটাছুটি বেড়েছে বই কমেনি। রাজধানীতে নিত্য আসা যাওয়া। রাজ্যের মধ্যে জনসভায় তাঁর চুম্বক আকর্ষণ এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। ‘জ্যোতিবাবু আসছেন নাকি?’—সাধারণ মানুষের এই জিজ্ঞাসা এখনও আছে। এখনও একাধিক সভায় লোককে বলতে শুনেছি, যতদিন আছে জ্যোতি, দেশের নাই কোন ক্ষতি’। মন ভালো নেই, শরীর ঠিক নেই, তবুও বসু এখনও জনসভায় যেতে বেশ ভালবাসেন। আর জনসভা সেরে এসে মনমেজাজ বেশ প্রফুল্ল থাকে। তখন বোঝা যায় ঐটাই তাঁর ‘এলিমেন্ট’। এখন প্রায়ই তাঁকে তাঁর পুরোনো স্পন্ডিলাইটিস্-এর ব্যথা বেশ কষ্ট দেয়। মার্চ মাসে খুব কষ্ট পেলেন। রে-চিকিৎসা চলল বহুদিন, তারপর একসারসাইজ, তারপর বেল্ট বেঁধে সোজা-চেয়ারে বসে কাজকর্ম চালানো। ঐ বেল্ট পরেই অফিসে গেছেন, বিধানসভা চলার সময় নিজের প্রশ্নোত্তরের দিন বেশ কয়েক ঘণ্টা থাকতেও হয়েছে। প্রথমদিকে হাঁটতে রীতিমত কষ্ট ছিল, হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি সবই চলেছে। তাছাড়া আছে কোলাইটিসের ব্যথা। এ ব্যথাও অনেকদিনের, তলপেটের দু’পাশ ভার ভার লাগে, মাঝরাতে অনেক সময় পেটে ব্যথা হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুম হয় না। বই পড়ে ব্যথা ভোলার চেষ্টা করেন। প্রায় পরীক্ষানিরীক্ষা হয়, বলেন, “ডাক্তাররা কেউই ব্যায়রাম ধরতে পারছে না, ‘নরম্যাল’ কিছুতেই হচ্ছে না।” অন্য কোনও অসুবিধা নেই। আগের মতই দ্রুত হাঁটেন, কাজকর্ম করেন। দিল্লীর নাটকীয় রাজনীতিতে মন্ত্রণাপরামর্শ দিতে গিয়ে যথেচ্ছ অনিয়ম হয়। বাইরে থেকে দেখলে সহজে বোঝা যায় না উনি ভাল নেই। বলেন, “ভেতরের কলকব্‌জা তো ঠিকই আছে, আর মাথাটাও ঠিক আছে”; “কমপিউটার মাথা”—বলেন স্ত্রী কমল বসু। সম্প্রতি কোলাইটিস-এর চিকিৎসার জন্য আর একবার শরীরের ভেতরটা মেশিনে ঝাড়াই বাছাই হল, কয়েকদিন আগে বেরিয়াম পরীক্ষা হল, ঘণ্টাদুয়েক অপেক্ষা করতে হল, কষ্টও পেলেন খুব। বললেন “আসুরিক ব্যাপার। খুব কষ্ট হয়েছে।” বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সব রিপোর্ট খতিয়ে দেখে বসুকে বললেন “আমি যদি না জানতাম এসব আপনার সব অরগ্যান-এর ছবি, তাহলে আমি ভাবতাম এগুলো ৩০/৪০ বছরের কোন যুবা ব্যক্তির হবে।” গত মাসে এক কিলো ওজন কমে গেছে বসুর। এখন তিনি বেশ কৃশকায়, মুখে নিস্পৃহ ভাব, তেমন কাঠিন্যের ছাপ এখন আর নেই

রাতে যেদিন ঘুম ভাল হয় না, তারপর দিন সকালে উঠতে একটু দেরী হয়ে যায়। ভোরে উঠে হাঁটার অভ্যাস কোনদিনই বসুর নেই, একতলায় থাকেন এখন, সামনের বাগানের রাস্তায় বা বারান্দায় পায়চারি করার সুযোগ থাকলেও বসু তা করেন না। “সব সময় তো ঘাড়ের ওপর পুলিসের দল নিঃশ্বাস ফেলছে, শান্তিতে আর কোথায় হাঁটব?”—ঈষৎ ঝাঁঝের সঙ্গে বসু বলে উঠলেন। অগত্যা ঘরেই, নিজের শোবার ঘরেই রাতে খাবার পর বাঁধা ১০ মিনিট হাঁটা, তখন টেলিফোন বাজলে বসুর বেশ বিরক্ত লাগে, তেমনি বিরক্ত লাগে বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে জামাকাপড় বদলানোর আগেই ফোন বাজলে।

সকালবেলা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে উঠে পড়েন। তখন মনমেজাজ খুব একটা প্রফুল্ল থাকে না, রাতে ঘুম ঠিকমত প্রায়ই হয় না, পেটে ব্যথা অস্বস্তি তো আছেই। তারপর ব্রেকফাস্ট সারেন আটটা নাগাদ। কোনও কোনও দিন একটু দেরীও হয়ে যায় ব্রেকফাস্ট খেতে। ব্রেকফাস্ট সামান্যই খান। দুধ বা দুধজাত জিনিস খাওয়া বারণ তাই একটু ফলের রস আর জল দিয়ে কর্ণফ্লেকস, দু’চার কুচি পেঁপে অথবা আপেল, এক কাপ চা। পাঁউরুটি পছন্দ করেন না। কদাচিৎ মনে হলে দু’এক স্লাইস খান। চা খেতে খেতেই অনেকগুলো কাগজে চোখ বুলিয়ে নেন তাড়াতাড়ি। তারপর আছে ওষুধ খাওয়া। ৯টার পর সাধারণত টেলিফোন আসতে শুরু করে, তারপর স্নান সারেন। ১০টা থেকে ১০.৩০টার মধ্যে তৈরি হয়ে যান। ‘রাইটার্সে’ পৌঁছে যান সাড়ে এগারটা নাগাদ, কখনও কখনও প্রায় ১২টাও বেজে যায়। তবে ব্যতিক্রমও আছে। শুক্রবার পার্টি সেক্রেটারিয়েটের মিটিং থাকলে আরও সকালে উঠে স্নান করে তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, ১০টার মধ্যেই পৌঁছে যান আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে পার্টির সদর দফতরে। অনেক সময় সকাল ১০-৩০টার পর বাড়িতে ভিজিটর আসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে, কথাবার্তা বলে অফিসে বেরোন। দিনেরবেলা বিকেলের দিকে যদি কোনও বাইরের প্রোগ্রাম না থাকে তো দুটো নাগাদ বাড়ি এসে দুপুরের খাওয়া সারেন—সাধারণ বাঙালী খাওয়া—সামান্য ভাত, এক হাতা ডাল, একটু সব্‌জী, এক টুকরো মাছ। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেন লাঞ্চের পর। তারপর মিটিং থাকলে, কোথাও কাছে বা দূরে প্রোগ্রাম থাকলে বেরোন আবার। নাহলে বিকেল থেকেই শুরু হয় বাড়িতে লোক আসা। কোনও দিন বিদেশের কোনও বিশিষ্ট আধিকারিক, কোনও দিন অন্য রাজ্যের মন্ত্রী, কখনও পার্টির কোনও নেতা, নিজের কোনও ক্যাবিনেট মন্ত্রী আর তাছাড়া নিজের সেক্রেটারি, অফিসাররা তো প্রায় রোজই আসেন ফাইলপত্র নিয়ে। কাজ ফেলে রাখা বসুর একেবারেই পছন্দ নয়। আলোচনা সইসাবুদ সব চটপট সেরে ফেলতে চান। সাধারণত রাত আটটার মধ্যেই দেখাসাক্ষাতের পালা শেষ হয়ে যায়। তারপর একটু নিজস্ব সময়। বিকেলে এক কাপ চা ছাড়া কিছু খান না। গরমকালে এক গ্লাস ডাবের জল। এই সময় খুব সামান্য কিছু স্ন্যাকস্ কোনওদিন খান, একটু আলুভাজা বা ঐ ধরনের কিছু, সবদিন খান না, আবার কোনওদিন খেলে রাতে একটু স্যুপ ছাড়া আর কিছু খান না। এসময় নিজের দরকারী কাগজপত্রে চোখ বোলান, পরের দিন বক্তৃতা থাকে অনেক সময়, বিধানসভা চলার সময় প্রশ্নোত্তর থাকে, সেই সব কাগজপত্র পড়েন, কয়েকটা দরকারী ফোন সারেন, ফোনে বেশি কথা বলা বসুর ধাতে নেই, দরকারী কয়েকটা বাক্যের ব্যবহার হয়ে গেলেই কথা শেষ। টেলিফোন আসতেও থাকে পর পর, কখনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কখনও অর্থমন্ত্রী, কখনও পার্টি অফিস থেকে, কখনও বিদেশ থেকে। সাড়ে ন’টা নাগাদ রাতের খাওয়া। কোনওদিন সামান্য স্যুপ, নয়তো ছোট ছোট তিনটি রুটি একটু সব্‌জি বা মাছ। মাংস পছন্দ করতেন এক সময়, এখন চিকেন ছাড়া অন্য মাংস খেতে ভরসা পান না। হাল্কা রান্নাই এখন পছন্দ। বিধানসভা চলার সময় যেদিন বিকেলে বিধানসভা যাওয়া থাকে, সেদিন আর দুপুরে বাড়ি ফেরেন না। রাইটার্স থেকে সরাসরি চলে যান রাজভবনে। সেখানে আছে পুরোনো কাজের লোক রামু। যত্ন করে লাঞ্চ রান্না করে রাখে সে। বসু খেয়ে সেখানেই একটু বিশ্রাম নেন, দরকার হলে দু’একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টও সেখানে সেরে নেন, তারপর চলে যান বিধানসভায়, বা অন্য প্রোগ্রাম থাকলে সেখানে, তারপর বাড়ি। এখনও বসু বিস্তর জনসভায় যান, বক্তৃতা দেন, এই তো সেদিন কোমরে বেল্ট লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির কনভেনশনে ভাষণ দিলেন টানা ৪৫ মিনিট। নির্বাচনের সময় ওঁর রুটিন ওলট পালট হয়ে যায়, রাতে বেশ দেরি হয় খেতে, সকালের ব্রেকফাস্ট সারেন সময়ে, তারপর আর কোনও ঠিক থাকে না। নিয়মিত ডাক্তার আসে, ব্লাডপ্রেসার ইত্যাদি চেক করতে, বসুর শরীরে অন্য কোনও সমস্যা আপাতত নেই কিন্তু এক যন্ত্রণার অস্বস্তি তাঁর নিত্য সঙ্গী। শনি-রবিবারও তাঁর ছুটি নেই। সকাল বিকেল বাড়িতে লোকের পর লোক। তাছাড়া আছে উদ্বোধন, ফিতে কাটা ইত্যাদি। কোনও কোনও রাতে বাইরে ডিনারের আমন্ত্রণ থাকে, আটটা নাগাদ বেরিয়ে যান, ফেরেন একটু রাতে। তবুও কিছুতেই যেন তাঁর মন লাগে না। প্রশাসনের সব দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হয়, যেটা তাঁর টেবিলে আসার কথা নয়, সেটাও বসুর সিদ্ধান্তের জন্য বা মধ্যস্থতা অথবা হস্তক্ষেপের জন্য এসে পড়ে। বয়সানুপাতে অস্বাভাবিক পরিশ্রম করেন। “এই তো সেদিন”, বললেন স্ত্রী কমল বসু, “কতটা যে রক্ত টেনে নিয়ে গেল পরীক্ষা করার জন্য, আর সেই দিনই দেখলাম অমানুষিক খাটলেন, এক সেকেণ্ড যেন সেদিন ওঁর নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমারই মাঝে মাঝে অবাক লাগে।” দিল্লীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি সঙ্গীন হল, বসুর ডাক পড়ল, ঠিক করলেন তখনই যাবেন না, শরীর ঠিক নেই, কয়েকদিন পর শরীরটা সামলে তবে যাবেন। তবুও তখনি চলে যেতে হল। আবার ফিরে এসে ভাবলেন কয়েকদিন পরে যাবেন, কিন্তু ফোনে আবার ভি. পি. সিং, আবার মুলায়ম, আবার চন্দ্রবাবুর আর্জি— অগত্যা যেতেই হল। একদিনের মধ্যে তড়িঘড়ি টিকিট করে উড়ে গেলেন রাজধানী। “এইভাবে ২/১ দিনের মধ্যে এত ঘন ঘন যাতায়াত করলে বেশ স্ট্রেইন হয়”– বললেন। কিন্তু মুখে বসুর ক্লান্তির ছাপ নেই, বিরক্তি বা ব্যথারও কোনও ছাপ নেই। সবটাই ভেতরে চেপে রাখার বিস্ময়কর ক্ষমতা রাখেন, চোখমুখকে অনুভূতি প্রকাশ করার অনুমতি দেন না।

এখন ‘জ্যোতিবাবু’র ভূমিকা পথ দেখানোর, দিক নির্দেশকের আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার। আছেন পেডেস্টালের ওপর—সঠিক দূরত্বে। সেই অবস্থান থেকেই স্পষ্ট দেখতে পান ত্রুটিবিচ্যুতি সব। শ্রবণ সজাগ রেখেছেন, শোনেন সব কথাই মন দিয়ে, অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় অংশটুকু “কানে নেন কিন্তু ব্রেনে নেন না।” যিনি বলছেন তাঁকেও মনে মনে বিচার করে নেন। এখনও তাঁর ক্যারিসমা অটুট, এখনও তিনি ভারতে কমিউনিজমের জীবন্ত অক্ষপ্রতিম এবং একলা পথের পথিক হওয়া সত্ত্বেও এখনও তাঁর বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার ওজন সকলের চেয়ে অনেক বেশি ভারী।

এখন ‘জ্যোতিবাবু’ যে শিখরে রয়েছেন কেমন করে তিনি পৌঁছলেন সেখানে? কেমন করে হলেন জীবদ্দশায় কিংবদন্তী রাষ্ট্রনায়ক? জননেতা হিসেবে ‘জ্যোতিবাবু’র এই অসামান্য সাফল্যের রহস্যটা কী? কারও মতে তাঁর ব্যক্তিত্বের ক্যারিসমাই তাঁর জনপ্রিয়তার উৎস, যদিও আমি বলি ‘ক্যারিসমা’ কথাটার দ্যোতনা ছায়াপথের মতই অস্পষ্ট, ধারণাটা আপেক্ষিক এবং অবশ্যই কখনও কখনও আরোপিতও বটে। কেউ বলেন তাঁর নির্মল নির্দাগ ভাবমূর্তিই তাঁকে জননায়কের আসনে বসিয়েছে। কিন্তু কেবলমাত্র পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি নিয়ে শীর্ষে পৌঁছানো যায় না। কেউ বা মনে করেন তিনি সৎ প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক, যদিও আমি বলি, ব্যাপ্তির ডানা না লাগালে ওপরে ওঠা দুরূহ হয়ে পড়ে। আমি মনে করি আসল রহস্য নিহিত আছে তাঁর বিশেষ কয়েকটি চারিত্রিক গুণের সমন্বয়ে। আর বিস্ময়ের কথা এই যে, একটি গুণ আর একটি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে অনেক সময় মেলানো যায় না। এ কথায় জটিল, বহুস্তরী ব্যক্তিত্ব। আর অসাধারণ নমনীয়তার সঙ্গে বিচরণ করতে পারেন স্তর থেকে স্তরান্তরে। কমিউনিস্ট ধ্যানধারণায় স্থির প্রত্যয়ের মানুষ অথচ অদ্ভুত উদার, প্রগতিশীল, ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন। আধুনিকমনা অথচ অসম্ভব ঐতিহ্য-সচেতন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে এখনও প্রবল বিশ্বাস অথচ প্রখর বাস্তববুদ্ধি দ্বারা চালিত। সামাজিক অথচ মিতভাষী, গম্ভীর অথচ সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন, আপাত উদাসীন কিন্তু গভীরভাবে মানবিক। বিশাল অভিজ্ঞতার মানুষ, অথচ অনেক বিষয়েই তাঁর শিশুর মত সারল্য। আবেগদীপ্ত ভাষণ দেন না অথচ শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারেন। ইংরেজি শিক্ষা পেয়েছেন কিন্তু নিজের সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করেন। যখন যেখানে থাকেন তখন তেমন পোশাক পরেন কিন্তু মনের পছন্দ বাঙালী ধুতি পাঞ্জাবী। সর্বভারতীয় স্তরে, ভারতকে ‘নেশন’ হিসাবে অনায়াসে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিন্তু বাঙালিয়ানাও বিসর্জন দিতে রাজী নন। পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষা সত্ত্বেও অন্তরে খাঁটি বাঙালী। এই সব অদ্ভুতভাবে আপাত পরস্পরবিরোধী নানা গুণ নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘জ্যোতিবাবু’র দুর্ভেদ্য চরিত্র। পরতে পরতে বিশ্লেষণ করলে রহস্য আর অধরা থাকে না ঠিকই কিন্তু বিস্ময়টুকু থেকেই যায়। এই ‘বিস্ময়’কেই আমি বলব ‘ক্যারিসমা’ যার স্বচ্ছ সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। আর একথা স্বীকার করতে বাধা নেই, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সাফল্যে এই গুণটির আংশিক অবদান আছে। তবে তাঁর অন্যান্য গুণের অবদানও কিছু কম নয়। যেমন, তাঁর একটানা অসাধারণ পরিশ্রম করার ক্ষমতা, বিধানসভার ভেতরে বাইরে তাঁর জেহাদ, তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা এবং তীক্ষ্ণ বাস্তববুদ্ধি। আরও আছে। তাঁর মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, পরিমিতিবোধ এবং প্রকৃত ক্ষমতা ও ক্ষমতার মোহ এই দুটো বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারার জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি। লক্ষ্মণরেখাটা অতিক্রম করা উচিত কিনা তা বোধহয় ‘জ্যোতিবাবু’র মত কেউ বোঝেন না। এই তো গেল সাফল্যের পেছনে তাঁর ব্যক্তিগত গুণের কথা। কিন্তু ঘটনারও কিছু অবদান আছে। একটু সরলীকৃতভাবে বলা যায়, ১৯৭৭ সালে সি. পি. আই-এর স্বতন্ত্র মেরুদণ্ড দুর্বল করে, সি. পি. আই. (এম)-এর সঙ্গে এক অক্ষে চলে আসা, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে ঘোর অনিশ্চয়তা, একদলীয় সরকারের অবসান ইত্যাদি ঘটনাস্রোতে জ্যোতি বসু সঠিক সময়ে সঠিক দিক নিদর্শনে শীর্ষে পৌঁছে গেছেন। আজ পাঁচ দশকের ওপর তিনি কমিউনিস্ট রয়েছেন, অক্ষচ্যুত হন নি একদিনের জন্যও। দুশ্চিন্তাচ্ছন্ন হয়েও তিনি কিন্তু আশাবাদী, ‘সিনিক্যাল’ হলেও হতাশ নন। এখানেই জ্যোতি বসুর চরিত্রের বিশেষত্ব। ১৯৯৭ সালের মে দিবসে পার্টির মুখপত্র ‘গণশক্তি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বসু বলেছেন, “দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজেও বামপন্থীদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। জনগণের স্বার্থ ছাড়া কমিউনিস্টদের অন্য কোনও স্বার্থ নেই। আমরা বার বার বলেছি, কংগ্রেসের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলতে হবে। এখন রাজনৈতিক যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে তার জন্য কংগ্রেসই দায়ী…. আমাদের পার্টিতে বিতর্ক হয়, আলোচনা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।”

প্রায় বছরখানেক পরে পার্টি পত্রিকার এই সাক্ষাৎকারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বসু বুঝিয়ে দিলেন তাঁর অবস্থানবিন্দু। আর একবার সার্থকভাবে প্রমাণিত হল পাঁচ দশকের পরিপক্ব কমিউনিস্ট রাজনীতিকের যোগ্যতা অর্থাৎ ‘ফিটনেস’ আর যে যোগ্যতম অর্থাৎ ‘ফিটেস্ট’ সেই থাকে, ডারউইনিয় এই আপ্তবাক্যটি কি তাঁর সাফল্যের আর একটা চাবিকাঠি নয়?

কথায় কথায় মনে হয় এই ভাল না থাকাটা বোধকরি সাময়িক। লাগাতার ভাল না থাকা বসুর ধাতে নেই। ইতিবাচক দিকটা আবিষ্কার করতেই তিনি অভ্যস্ত। আবার অহেতুক বাড়াবাড়িও তাঁর পছন্দ নয়। চিন্তার ব্যবচ্ছেদে আর মিতভাষে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাই ‘এখনকার জ্যোতি বসু’কে নিয়ে তাঁর মনে কোনও উদ্বেলতা নেই। “পাহাড়ের চূড়ায় উঠে কেমন লাগে?”—এই প্রশ্নের উত্তরে মৃদু হেসে তিনিই বলতে পারেন “যত উঁচু তত অক্সিজেনের অভাব; এখানে বাতাস কম, আলো অনেক। আর সেই আলোয় অনেকদূর দেখা যায় বলেই দেখতে পাই আশেপাশে আরও অনেক উচ্চতর চূড়া। তাই বলি এখনও অনেক, অনেক বাকী।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *