আঙুল যাদের ছ-টা
কী কালো! কী প্রকাণ্ড!
আন্তর্নক্ষত্রচর এই পার্থিব বিমানের পেরিস্কোপ থেকে যে অগুন্তি তারা এতক্ষণ চোখে পড়ছিল, তাদের বৃহৎ একটা অংশকে আড়াল করে দিয়ে ওই অতিকায় বর্তুলাকার মহাব্যোমযান নেমে আসছে ঠিক একখানা আকাশজোড়া কালো মেঘের মতো।
ইঞ্জিনিয়ার টার্কোর মুখ থেকে অনর্গল বেরুচ্ছে শাপমন্যি, ‘গোল্লায় যাক, জাহান্নমে যাক ওরা, যেখান থেকেই এসে থাকুক, যে-জাতেরই যা-হোক, নিপাত যাক দুশমনেরা! দেখে ফেলেছে নিশ্চয়! দেখে ফেলেছে আমাদের!’
ইঞ্জিনঘরে পর্দা খাটানো আছে। তাতে সব কিছুর ছবি ফুটছে। একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির ভিতরে যেদিক থেকেই যা আসুক, তার চেহারা ধরা পড়বেই এটির উপরে। সেই পর্দার পানেই ভ্রূকুটি করে তাকিয়ে আছে টার্কো। ধনুকের মতো বাঁকা পা দু-খানা ক্রমশ ফাঁক হচ্ছে ধাতু দিয়ে গড়া অনাকৃতা ডেকের উপরে। হাতের দুটো প্রকাণ্ড মুঠি, বুঝি তার অজান্তেই একবার খুলে যাচ্ছে, একবার বন্ধ হচ্ছে। বন্ধ হওয়ার ধরনটাই এইরকম, যেন কিলিয়েই টার্কো ওই ব্যোমচর দানবকে এ আকাশ থেকে তাড়িয়ে ছাড়বে। কদমছাঁট মাথাটা কুঁজিয়ে-আসা কাঁধের উপর যত নেমে আসছে, গলাটা তত মুটিয়ে উঠছে ষাঁড়ের গলার মতো।
বাঁয়ে চোখ ফেরাল টার্কো। থরে থরে সাজানো যন্ত্রপাতি, তার মধ্যে ডায়ালে ডায়ালে পরিমাপক সংখ্যা আঁকা রয়েছে। দূরত্বের পরিমাণটা একবার দেখে নিল শুধু ওই ধাবমান দানবের থেকেই নয় কেবল, পায়ের দিকের ওই অজানা অচেনা চাঁদটার থেকেও। কোনোরকমে ওই চাঁদে নেমে যদি চুপিসাড়ে গা ঢাকা দিতে পারা যেত!
যেত নিশ্চয়ই, একটু আগে টের পেলে! ওই হানাদারের আচমকা আবির্ভাব। এত আচমকা সে এত কাছে এসে পড়ল কেমন করে? সতর্কতার অভাব ছিল এ-তরফেই, টার্কো তা মুক্তকণ্ঠেই বলতে রাজি আছে। রেখে-ঢেকে কথা সে কাউকে বলে না। ঝাল ঝাড়ল রেডিয়ো ঘরের দিকে তাকিয়ে, ‘চোখ বুজে ছিলে নাকি?’
রেডিয়োর অ্যাবে খেঁকিয়ে উঠল। তার ঘরেও অজস্র ডায়াল। তাদেরই ভিতরে আঙুল চালাচ্ছিল এতক্ষণ। চালিয়েই যাচ্ছে এখনও। তারই মধ্যে দাঁত বার করল ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো, ‘নীচের ওই চাঁদটার বর্ণালি বিশ্লেষণ নিয়ে আমি ব্যস্ত আছি, সেটা জানো না বলতে চাও? চোখ মেলে রাখা, তা তুমিই বা রাখ নি কেন? যতই কানা হও, হানাদারটা তো গতরে রীতিমতো পুরুষ্টু! চোখে না-পড়ার মতো তো নয়!’
‘আমারও তো তুমিই হাত-পা বেঁধে রেখেছিলে! বিমান একটুও যেন না-নড়ে, কড়া হুকুম দিয়ে রাখনি? নড়লে বিশ্লেষণ ঠিক হবে না, বলনি? তোমার কাজে এতটুকু অসুবিধে ঘটলে তুমি কীরকম চেল্লাচিল্লি করো, তা জানি-না নাকি?’
ঝাঁঝালো গলায় কৈফিয়ত কেটে টার্কো প্রশ্ন করল, ‘দুটো কাজ কেউ একসঙ্গে করতে পারে নাকি? বিশেষ করে আন্তর্নক্ষত্রে বিমান চালাবার সময়?’
অ্যাবে মোটে কানই দেয়নি টার্কোর কথার শেষ দিকটায়। ‘চেল্লাচিল্লি’ শব্দটাই তাকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছে একদম, ‘ওই উপগ্রহটার ভিতরে কী আছে আর কী নেই, তা এতদূর থেকে সঠিক বলে দেওয়া খুবই সহজ কাজ বোধ হয় তোমার বিবেচনায়?’
ঝুঁকে পড়ে নিজের যন্ত্রপাতিই মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকল অ্যাবে, আর টার্কোর দিকে ছুড়ে মারল তিক্ত রসিকতা, ‘বুট পরা পা একখানা যখন নেমে আসছে পিঠের উপরে, জানতে পারলে পিঁপড়ের মনের অবস্থাটা কীরকম হয়? আগে জানতে না বোধ হয়? এইবার জানবে, ওই দৈত্যাকার হানাদার পিঠে চেপে বসার সঙ্গে সঙ্গে—’
তেতো ধোঁয়া আসছে একটা সরু নলের মুখ থেকে। রেডিয়ো ঘরেও বটে, ইঞ্জিনঘরেও বটে। অ্যাবে আর টার্কো ঝটিতি মুখ ফেরাল ক্যাপ্টেনের টেলিভিশন পর্দার দিকে। ওটা সবসময়ই সংরক্ষিত থাকে, ক্যাপ্তেনের আদেশ নির্দেশ জানাবার জন্য। দু-জনেই দেখতে পেল, পর্দায় ক্যাপ্তেনের ছবি। নিজের ঘরে বসে তিনি এক গাদা কাগজ পোড়াচ্ছেন সযত্নে। তার ভিতরে এমন এমন কিছু ম্যাপ রয়েছে, টার্কোরা জানে তা একবার নষ্ট হলে নতুন করে আর তৈরি করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ ক্যাপ্টেন দস্তুরমতো মরিয়া। এদিক থেকে যে ওরা যার যার ঘরের পর্দায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, এটা নিজের কেবিনে বসেই জানতে পেরেছেন ক্যাপ্টেন জানুয়ার। তিনিও তাকিয়েছেন তাঁর পর্দার দিকে। চোখাচোখি হয়ে গেল এদিকে ক্যাপ্টেন আর এদিকে ইঞ্জিনিয়ার-রেডিয়োম্যানের মধ্যে। যদিও পাশাপাশি ঘর নয়, এবং ব্যবধানটার ভিতরে ধাতু দিয়ে গড়া দেয়াল আছে অন্তত আধ ডজন।
ক্যাপ্টেন জানুয়ারের চড়িয়ে-ভাঙা গাল দুটো আজ যেন আরও বেশি চুপসে গিয়েছে, মুখের হাঁ একদম বুজিয়ে দিয়ে তারা যেন পরস্পরের সঙ্গে মিলে যাওয়ার চেষ্টা করছে পাল্লা দিয়ে। কোঁচকানো ভ্রূর নীচে থেকে কালো চোখ একবার তাকাচ্ছে অ্যাবের দিকে, আর একবার টার্কোর দিকে—
‘মনে করো ওই হানাদারটা অন্য কোনো ছায়াপথের বাসিন্দা। কী মনে করে ও আমাদের দেশে এল, তা জানি না যখন, নিজেদের দিক থেকে সাবধান থাকা ভালো। পার্থিব সাম্রাজ্যের ভিতর যত যত গ্রহে উপনিবেশ আছে আমাদের, তার একটা ফিরিস্তি, কোন কক্ষপথে কত দিন উড়লে কোথায় যাওয়া যায়, সেখানে জল হাওয়া উত্তাপ আর জীবজগৎ উদ্ভিদজগতের অবস্থা কী, তার সব কিছু বিবরণ কেন আর ওদের হাত তুলে দিই?’
অ্যাবে অসন্তুষ্টভাবে বিড়বিড় করছে, ‘এ কথা তো আগে বলেননি! তা যদি বলতেন, তা হলে এত ঝক্কিঝামেলা মাথায় নিয়ে আমরা কি আসি আপনার লোকসানি কারবারের শরিক হতে?’
একটু থেমে সে সংযত করে নিল নিজেকে, কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, ‘মাথার উপরে ওই যে ওঁরা রয়েছেন, ওঁদের দানবাকার বিমান থেকে রশ্মি বিকরণ করছেন কমসে-কম ষাট রকম এ যাবৎ। এক রকমেরও মানে বুঝতে পারিনি।
ক্যাপ্টেন তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, ‘বুঝতে পারা যাবে, এমন আশা করি কেমন করে? গ্রহান্তরের কথা নয়, অন্য সৌরমণ্ডলের ব্যাপার নয়— একেবারে আলাদা এক ছায়াপথের বাসিন্দা ওরা। কেমন হবে জীবগুলো, আন্দাজ করতে যাওয়া দুঃসাহসের কাজ। তবে একটা দিকে অন্তত অভিযোগ করার কিছু নেই। ওরা এখনও পর্যন্ত ক্ষতির চেষ্টা করেনি আমাদের।’
‘এখনও পর্যন্ত করেনি, তা ঠিক।’ তিক্তকণ্ঠে বলে উঠল টার্কো, ‘হয়তো কারণ আছে তা না-করার। কিন্তু দুই-পাঁচ মিনিট বাদেই যে করবে না, তার নিশ্চয়তা কিছু আছে? ধরে নিচ্ছি ওরা দিগ্বিজয়ে বেরোয়নি, বেরিয়েছে অহিংস গবেষণায়। কিন্তু অভিযানের মুখে অন্য সভ্যতার প্রতিনিধি কাউকে, যেমন ধরুন— আমাদের এই দলটাকেই হঠাৎ দেখতে পেলে অহিংস সৌজন্যেই তাদের পথ থেকে সরে যাবে, এমনটা আশা করার কোনো ভিত্তি আছে কি?’
জানুয়ার হঠাৎ কোনো জবাব দিচ্ছেন না দেখে, সে সাহস পেয়ে দাবি জানাল, ‘আপনি যদি বলেন, আমাদের এই মোচার খোলার মতো বিমানটারই চারদিকে বিদ্যুতের বেষ্টনী ছুড়ে দিই এক্ষুনি। ওরা যে আমাদের সাবড়ে দেবার মতলবেই নেমে আসছে, তাতে সন্দেহ না-রেখে, যথাশক্তি দিয়ে ওদের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি হওয়াই আমাদের দরকার।’
‘দরকার নিশ্চয়ই।’ চিন্তিতভাবেই জবাব দিলেন জানুয়ার, ‘কিন্তু বেষ্টনী-ফেষ্টনী দিয়ে কতদূর কী কাজ হবে, ভাবছি তাই।’
‘হয়তো কিছুই হবে না।’ বলল টার্কো, ‘তবু বাছাধনদের দেখিয়ে দিতে চাই যে, ক্ষুদে হলেও হুল ফোটাতে জানি আমরা।’
‘বেশ, তাই ফোটাও তাহলে।’ বললেন ক্যাপ্টেন।
তাঁর কথার সুর শুনে অঙ্গ জ্বলে গেল টার্কোর। ক্যাপ্টেন যেন ধরেই নিয়েছেন যে এ-পক্ষের করবার কিছুই নেই। ওই পঞ্চাশ মাইল চওড়া দৈত্য-বিমান আসবে, আর গিলে ফেলবে পৃথিবীর এই সর্বত্রগামী মহাব্যোমযানকে, যাকে নাকি ত্রিংশ শতাব্দীর বিমান-বিজ্ঞানীরা সাজিয়ে দিয়েছেন সবরকম অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে। টার্কো মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, আসুক ওই দৈত্য, এক হাত শিক্ষা ওকে না-দিয়ে ছাড়বে না সে।
জানুয়ার লক্ষ করলেন, তাঁর সম্মতি আদায় করেই টার্কো টেলিভিশন সংযোগ কেটে দিল, তাঁর ধরাছোঁয়ার আড়ালে যাওয়ার জন্য। অর্থাৎ বিদ্যুৎবেষ্টনীর নাম করে অন্য কিছু-একটা সে প্রতিরোধ খাড়া করতে চাইছে, যার কথা আগে থাকতে সে জানাবে না ক্যাপ্টেনকে। এটা তো অন্যায়! এরকম স্বাধীনতা তো কাউকে দেওয়া যায় না!
ক্যাপ্টেন অ্যাবের দিকে তাকালেন। সে চিন্তিত, বিবর্ণ। বোঝাই যাচ্ছে, টার্কোর ভাবভঙ্গি তারও ভালো লাগেনি। ক্যাপ্টেন তাকে বললেন, ‘দেখা যাক, ও কী করে। আগে থাকতে ঘাঁটাব না, কাজের উপরে থাকলে টার্কোর মেজাজ থাকে ভালো। আমি তোমার ঘরেই আসছি।’ রেডিয়ো ঘরের টিভি সংযোগও কেটে গেল এর পরে।
রেডিয়ো ঘরটাকে অ্যাবে করে রেখেছে যেন গুদামখানা। মাঝারি আকারের ঘরখানা মালপত্রে আষ্টেপৃষ্ঠে বোঝাই। সবই যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম, তা কিন্তু একেবারেই নয়। মেঝেতে গাদা করা রয়েছে, ওই যে হাজারো রকমের বড়ো-ছোটো টুকিটাকি জিনিস, ও সবই অ্যাবের নিজস্ব। সারা জীবনে তার সঞ্চয় বলতে ওইগুলিই। যখনই যেখানে পুরোনো, ভাঙা যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ পেয়েছে, কিনে নিয়েছে এই আশায় যে, একদিন হয়তো তা কাজে লাগবে তার।
কাজ? হ্যাঁ, একটা উঁচুদরের কাজ যে একদিন সম্মানীয় করে তুলবে অ্যাবেকে— এ স্বপ্ন প্রথম যৌবন থেকেই দেখে আসছে। একটা নব আবিষ্কার, যার সাহায্যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সুদূরতম কোণের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে। রেডিয়োর গতি অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত নয়, টেলিভিশনেরও না। এ-যাবৎ পৃথিবীর মানুষ ব্যোমযাত্রায় দশ-বিশ আলোকবর্ষের চেয়ে বেশি দূরত্বে পৌঁছোতেই সক্ষম হয়নি। পৌঁছে থাকলেও গিয়েছে আর চলে এসেছে, সেখানে খবরাখবর দেওয়া-নেওয়ার মতো ঘাঁটি গড়ে রেখে আসতে পারেনি। কী করে পারবে? বিজ্ঞান এমন কোনো সূত্রের সন্ধান দিতে পারেনি এখনও, যার সাহায্য দৃষ্টি বা শ্রুতিকে অসীমে পরিব্যাপ্ত করা যেতে পারে।
অ্যাবে স্বপ্ন দেখে, সে কাজ সেই হাসিল করবে একদিন।
মেঝেতে ছড়ানো ওইসব গাদা গাদা যন্ত্রপাতির টুকরো, ওর সেই মহান আবিষ্কারেই সম্ভাব্য উপকরণ। ওদের উপরে দরদের অন্ত নেই অ্যাবের। এ বিমানে যখন সে চাকরি নেয়, পহেলা নম্বর শর্তই তাই ছিল যে ব্যক্তিগত একটা ল্যাবরেটরি সঙ্গেই যাবে তার। জানুয়ার আপত্তি করার কোনো কারণ দেখতে পাননি, কিন্তু ল্যাবরেটরির স্বরূপ যখন তাঁর চোখের সামনে উদঘাটিত হল, তাঁর মুখ দিয়ে বাক্যস্ফূর্তি হল না আর। কোন অভিধানেই যে ল্যাবরেটরি শব্দের অর্থ লিখেছে বাতিল লোহালক্কড় বলে, তা তার জানা ছিল না।
আজ অ্যাবে হতাশ নয়নে তাকিয়ে আছে ওই লোহার গাদার দিকে। সে-পদ্ধতির এখনও আবিষ্কার হয়নি, যার সাহায্যে ব্রহ্মাণ্ডের সুদূরতম ছায়াপথের বাসিন্দাদের সঙ্গেও ভাবের আদান-প্রদান সম্ভব হওয়ার কথা। আবিষ্কার হয়নি, কিন্তু সুদূরতম সে-ছায়াপথের বাসিন্দারা ওই যে আগবাড়িয়ে এসে হাজির হয়েছে অ্যাবেরই দোরগোড়ায়। ওই যে তাদের পঞ্চাশ মাইল চওড়া বিমান। এখন কীভাবে কথা কওয়া যায় ওদের সঙ্গে?
কী জাতীয় জীব আছে ওর ভিতরে, জানা যাচ্ছে না এখনও। জানা এক সময়ে যাবেই। কিন্তু হয়তো এমন সময়ে যাবে যে, জানার দরুন লাভবান হওয়ার অবকাশ আর পাবে না অ্যাবেরা। আত্মপ্রকাশ ওরা করবেই, কিন্তু সম্ভবত তা করবে, এই মশার মতো ক্ষুদে বিমানখানাকে নস্যির মতো নাসারন্ধ্রে আকর্ষণ করে নেবার মুহূর্তেই।
অথচ অ্যাবের আবিষ্কারের স্বপ্ন যদি স্বপ্নই থেকে না-যেত এখনও, তাহলে আলাপে-পরিচয়ে ওদের সঙ্গে একটা সন্ধি স্থাপন হত হয়তো, হঠাৎ একটা অসম কলহে লিপ্ত হতে হত না। হয়নি তা, হয়নি।
কিন্তু, যত নৈরাশ্যই থাকুক মনে, হাত কিন্তু ক্রমাগতই চলছে ওর। নানা কৌশল, হরেকরকম কায়দা সে করে যাচ্ছে রেডিয়োর উৎক্ষেপণে। দেখতে চায়, কোনোটাতেই সাড়া দেয় কিনা ওই রাক্ষুসে আগন্তুক।
ক্যাপ্টেন জানুয়ার এসে ঢুকলেন নিঃশব্দে, অ্যাবে টেরও পেল না। ক্যাপ্টেন একবার তাকিয়ে দেখলেন শুধু। দেখলেন যে, অ্যাবের কপালে বড়ো বড়ো ফোঁটায় ঘাম জমে উঠেছে গভীর উত্তেজনায়। ওকে বিরক্ত না-করে তিনি একটা লোহার গাদার উপরে খাঁটি হয়ে বসলেন, অনির্দিষ্ট কাল প্রতীক্ষার জন্য তৈরি হয়ে। অনির্দিষ্ট কাল। অর্থাৎ যতক্ষণ-না হানাদারেরা একটা কিছু করে। ওদের চাল না-দেখে এরা তো বড়েটাও টিপতে পারে না! ওরা যখন প্রবল। কত গুণ প্রবল? এক-শো মিটারের যত গুণ বড়ো পঞ্চাশ মাইল।
অবশ্য আয়তনই বলের পরিচায়ক নয়, তা জানুয়ার বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু কথা তো তা নয়। অত বড়ো বিমান যারা গড়েছে, অত বড়ো বিমান যারা অন্য ছায়াপথ থেকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে এই সুদূর সৌরমণ্ডলে, তারা বিজ্ঞানী হিসেবেও যে মহাশক্তিধর, তা স্বীকার না-করবে কে? পৃথিবীর লোক তো এখনও অন্য ছায়াপথে গবেষণা চালাতে পারেনি বিমান পাঠিয়ে।
ক্যাপ্টেন চুপ করে বসে আছেন, কারণ কথা কইলেই যে সহকর্মীদের কাজের ক্ষতি হবে, তা তিনি জানেন। বসে আছেন নিঃশব্দে। হঠাৎ বিমানখানা কেঁপে উঠল আপাদমস্তক থরথর করে। কী হল? কী হল? শত্রুর বিমান বৈদ্যুতিক তরঙ্গের আঘাত হেনেছে নাকি?
প্রশ্নটা গলা ছেড়েই করতে হল ক্যাপ্টেনকে। অ্যাবে জবাব দিতে পারল না চট করে, কিন্তু ইঞ্জিন ঘরের টেলিভিশন পর্দা হঠাৎ ফুটে উঠল চোখের সামনে, আর তাতে দেখা গেল টার্কোর হাস্যবিকশিত মুখ, ‘বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ওদের দিক থেকে কী করে আসবে? আমাদের বিদ্যুৎ বেষ্টনীই ছড়িয়ে আছে দিগদিগন্তে। আমি দিয়েছি ছড়িয়ে। রীতিমতো লড়াই না-করে ওরা পার হতে পারছে না সেটা। কাঁপুনিটা বৈদ্যুতিক আঘাতের দরুন নয়। আমরা চাঁদে নেমেছি। সেই ধাক্কায় দরুনই বিমান কাঁপল।’
‘চাঁদে নেমেছি!’ মস্ত একটা আশ্বাস। এখন লড়াই হলেও খানিকটা সুবিধা এ-পক্ষের। এদের পায়ের নীচে শক্ত মাটি, ওদের ফাঁকা শূন্য। হঠাৎ মারা নাও পড়তে পারে।
‘এখন তাহলে কতকটা নিরাপদ আমরা।’ বললেন ক্যাপ্টেন।
টার্কো জবাব দিল, ‘এবারে ওদের পালা ক্যাপ্টেন। এই বোমাটা যতক্ষণ গড়ে তুলতে না পারছি, ততক্ষণই জারিজুরি ওদের, তারপর দেখে নেব।’
‘বোমা? কী বোমা?’ আঁৎকেই উঠলেন ক্যাপ্টেন।
‘অ্যাটম!’ হাঁকল টার্কো ওধার থেকে, ‘দরকার হলে হাইড্রোজেন বোমাও গড়তে পারি এইখানে বসে। তবে তা করতে হলে আমার ইঞ্জিনখানাই ভেঙেচুরে ফেলতে হয় উপকরণের জন্য। দরকার নেই, অ্যাটম বোমার ধাক্কাই আগে সামলাক তো!’
ক্যাপ্টেন রেগে কাঁই, ‘খবরদার টার্কো! আমায় হুকুম না-নিয়ে তুমি বোমা ছুড়বে না ওদের উপরে। তা সে অ্যাটম বোমাই হোক আর ধানিপটকাই হোক। ওরা এখনও পর্যন্ত এমন কোনো ভঙ্গি দেখায়নি, যাকে শত্রুতাব্যঞ্জক মনে করা যেতে পারে।’
‘আমাদের ছায়াপথের এলাকায় অনধিকার প্রবেশটাই এক নম্বর শত্রুতা নয় কি?’ টার্কোর গলায় বিদ্রোহের সুর।
সে-সুরে ক্যাপ্টেনের আরও রেগে যাওয়ায় উচিত ছিল। তাই যেতেনও হয়তো তিনি, কিন্তু হঠাৎ তাঁদের সবাইকে চকিত হতবাক করে দিয়ে একটা ঘটনা ঘটল মাথার উপরকার রাক্ষুসে বিমানে। মিশকালো দেয়ালটা যেন ফাঁক হয়ে গেল, সেই ফাঁকের ভিতর দিয়ে দৃষ্টিগোচর হল প্রকাণ্ড একটা কক্ষ, আলোয় আলোয় সমুজ্জ্বল। সেই ঘরে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে অগুন্তি জীব। মানুষেরই মতো।
মানুষ? আছে বই কী! মানুষের চেহারার আদল অনেকখানিই আছে তাদের মধ্যে। কেবল ওই চোখ! গোল গোল ভাঁটার মতো, সাদার ভিতর নীল, নীলের ভিতর মণিটা আবার ঘোর কালো। মুখের হাঁ ঠিকই আছে, নেই তার উপরে-নীচে ঠোঁট। মাথায় চুল নেই, চকচকে সাদা কী যেন একটা আবরণে তা ঢাকা। খানিক ঠাহর করে দেখবার পরে অ্যাবে বলে উঠল, ‘শুধু মাথা নয়, সারা গায়েই সাদা লোম ওদের।’
লম্বা? না, মানুষের মতো অত লম্বা নয়, শরীরও পাতলা।
সবদিক বিচার করে ‘অপমানুষ’ আখ্যা এদের অনায়াসেই দেওয়া যায়।
একটি বিশেষ অপমানুষ দল ছেড়ে এগিয়ে এল এই বার, আর ঠিক যেন এদেরই দেখাবার জন্য দু-খানা হাত উঁচু করে ধরল। লম্বা, সরু দু-খানা হাত, গোটা দেহটার সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছে গড়নের দিক দিয়ে। আর সেই হাতে বিশেষ লক্ষ করবার জিনিস, আঙুল প্রতি হাতেই ছ-টা করে। তিনটে আঙুল বেঁটে, মানুষের বুড়ো আঙুলের মতো। বাকি তিনটে লম্বা, মানুষের হাতের মধ্যমা তর্জনী অনামিকার মতো। সাজানোরই বা কী কায়দা আঙুলগুলোতে! একটা লম্বা, একটা বেঁটে। আবার একটা লম্বা, একটা বেঁটে।
বেশ কিছুক্ষণ সময় এরা পেল, অপমানুষটির হাত পর্যবেক্ষণের জন্য। তারপর সে পিছিয়ে গেল ঘরের ওপাশে। সেখানে দেয়ালের গায়ে কালো বোর্ড রয়েছে একখানা। খড়িমাটি নিয়ে অপমানুষটা কী যেন লিখতে যাচ্ছে বোর্ডে। তার সহযোগীরা ডাইনে-বাঁয়ে সরে গিয়েছে, প্রতিপক্ষ যাতে বোর্ডের লিখন অবাধে পড়তে পারে, তারই সুযোগ দেওয়ার জন্য বোধ হয়।
অপমানুষটি এইবার দুই হাত উঁচু করে ধরল বারোটা আঙুল মেলে। তারপরে হাত গুটিয়ে নিয়ে বোর্ডে খাড়া দাগ দিল একটা। মানে কী এর?
সে আবার ফিরল এদের দিকে। আবার দুই হাত উঁচু করে বারো আঙুল দেখাল, তারপর বোর্ডের খাড়া দাগের পাশে লম্বা করে টানল আর একটা দাগ।
দুটো দাগ। প্রতিবারে বারো আঙুল দেখিয়েছে। ও কি চব্বিশ সংখ্যার কোনো একটা জিনিস বোঝাতে চাইছে?
কিন্তু না, ও তো থেমে যায়নি। আবার হাত দেখাচ্ছে, আবার দাগ কাটছে। বার বার সাত বার। সাত বারং চুরাশি? কী চুরাশি?
না, চুরাশিও নয়। আবার হাত তুলেছে ও। তবে এবারে এক হাতের ছ-টা আঙুল দেখাচ্ছে অন্য হাতের মোটে দুটো, বাকি চার আঙুল মুড়ে রেখেছে।
ছয়ে আর দুইয়ে হল আট। আর আছে আগের চুরাশি।
একুশে বিরানব্বই।
বি-রা-নব্বই? বলছে বিরানব্বই? যার মানে হল ইউরেনিয়াম? পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়ামকে এযুগে ডাকেন বিরানব্বই বলে। বিরানব্বই সংখ্যক ধাতব পদার্থ। কিন্তু অন্য ছায়াপথের বাসিন্দা এরা, সে নামকরণের খবর পেল কোথা থেকে?
তবে কি পৃথিবীর মানুষের অজান্তে পৃথিবীর নাড়ির খবর এই অন্য ছায়াপথবাসীরা নখদর্পণে দেখতে পায়?
অসম্ভব কী? যারা পঞ্চাশ মাইল চওড়া বিমান গড়ে, তাদের জ্ঞানের পরিমাপ করা পৃথিবীর মানুষের পক্ষে সম্ভব হবে কেমন করে?
কিন্তু অপমানুষটি চুপ করে দাঁড়িয়ে নেই। বোর্ডের উপরে গাদা গাদা ধাতুপিণ্ড এঁকে যাচ্ছে। বিরাট স্তূপ এঁকে ফেলল একটা।
ইউরেনিয়ামের গাদা?
অপমানুষটি সেই গাদার মাঝখান দিয়ে লম্বা দাগ টেনে দিল এইবার। দাগের দু-দিকে দুটো গাদা এইবার, দুটোই সমান।
অর্থাৎ?
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘ওদের প্রস্তাব হল এই যে, এই চাঁদের মাটিতে যে ইউরেনিয়াম আছে, তা আধা-আধি বখরা হোক দুই দলের মধ্যে। আমি এতে আপত্তির কিছু দেখি না। কারণ এলাকাটা যদিও আমাদের, আগে আমরা এটা দখল করিনি। ওরা অনধিকারী হলেও আগে এসেছে এবং আবিষ্কার করেছে জিনিসটা।’
এর পরে ক্যাপ্টেন জানুয়ার দেখা দিলেন নিজের টেলিভিশনে। দু-হাত বাড়িয়ে তিনি যেন আলিঙ্গন করতে চাইছেন ওদের। ওদিক থেকে ভেসে এল একটা আনন্দ-কলরব। অ্যাবে এদিকে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। সে যা অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে পারেনি, মামুলি আঁকজোঁক কেটেই তা হাসিল করেছে এই অপমানুষেরা। অন্য ছায়াপথবাসীদের সাথেও ভাবের আদান-প্রদানে সক্ষম হয়েছে অত্যন্ত আদিম উপায়ে।