২০. পদ্মা মেঘনার দেশে

২০. পদ্মা মেঘনার দেশে

“একটা মজার কথা শোনো”, বললেন কমল বসু, “আমি যখন দু’আড়াই বছরের কোলে চড়ে ঘুরতে যেতাম ওঁর শিশু, তখন বাড়ির কাজের লোকের কোলে, মামাদের বারদির বাড়ির বাগানে। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমার মামার বাড়ি আর ওঁর বারদির বাড়ি ছিল এতটাই কাছাকাছি; পরে অবশ্য আমার মামারা ঢাকা টাউনে চলে আসেন।”

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বাবার সঙ্গে কমল বসু চলে এসেছেন এপার বাংলায়। ময়মনসিংহে জন্ম হলেও বড় হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের । বিভিন্ন বর্ধিষ্ণু মহকুমায়; কলকাতা শহরে। মুখ্যমন্ত্রী স্বামীর সঙ্গে আবার ওপার বাংলায় যাওয়া হল এক যুগ পরে। ১৯৮৭ সালে, সরকারী আমন্ত্রণে। শিকড়ের টান। ছোটবেলার স্মৃতি কি কখনও ভোলা যায়? দেশভাগের পর বসুরও সেই প্রথম বাংলাদেশ যাওয়া। “দেশভাগ হওয়ার আগে তো পার্টির কাজেও কত যেতাম”, বললেন বসু, “ময়মনসিংহ যেতাম, তখন সময় পেলে কখনও কখনও বারদিতে দিদিমার কাছেও ঘুরে আসতাম। আর ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে তো প্রায় প্রতি ছুটিতেই যাওয়া হত বারদি।” বাংলাদেশেই খুব ছোটবেলায় বসু প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন—ভরা মেঘনা নদী, সুপারি নারকেল গাছের সারি, ফুটবল খেলার আদিগন্ত ঘোর সবুজ মাঠ, বড় গভীর পুকুর, আর মানুষজনের আবেগময় উষ্ণতা। শৈশবের সেই আনন্দময় স্মৃতি এখনও তাঁর মনে জ্বল জ্বল করছে। “এখনও মুখে লেগে আছে সেই মাগুরমাছের কালিয়া আর ‘কেঠো’ (কাছিমের) মাংসের স্বাদ। পিঁয়াজ আদাকুচি দিয়ে ‘কেঠোর’ ডিম আর মেটুলির সেই চমৎকার রান্না।”

বাংলাদেশের সঙ্গে বসুর নাড়ীর যোগ। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশও “বারদির সন্তান” বসুকে সেইভাবেই অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। বসুর মনে হয়েছিল এ যেন দ্বিতীয়বার ঘরে ফেরা। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী কমল বসু, শ্যালিকা মঞ্জুলা রায়—তাঁদের মনেও জন্মস্থান দেখার মায়াবী উত্তেজনা। প্লেন বাংলাদেশের মাটি ছুঁতেই “সে যেন এক অন্য অনুভূতি।” চারদিকে অগণিত মানুষ উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন প্রিয় নেতা ‘জ্যোতি বসু’কে চোখের দেখা দেখার জন্য। লাল গোলাপের মালায়, গোলাপগুচ্ছে, ‘আদাবে’, নমস্কারে ভেজা কয়েকটা অনির্বচনীয় মুহূর্ত। ঘোর কাটিয়ে নেন বসু। শুরু হয় ঠাসা প্রোগ্রাম। যেন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। সাভার-এ বীর শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েই আবার অন্যত্র। আর পায়ে হাঁটলেই আশেপাশে পেছনে অগণ্য মানুষের ভিড়। তখন এরশাদ ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। “এরশাদ এত ভিড় দেখে রীতিমত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন,” বললেন বসু, “আমাকে বললেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশে নির্বাচনে দাঁড়াতেন তাহলে আমি ভীষণভাবে হেরে যেতাম, এত জনপ্রিয়তা তো আমারও নেই।”

সেবার বসু ছিলেন পদ্মা গেস্ট হাউসে। ভি ভি আই পি-দের জন্য তৈরি এই চমৎকার গেস্ট হাউসে কিছুদিন আগেই থেকে গেছেন বিশ্ববিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মহম্মদ আলি। বসুর অভ্যর্থনায় এতটুকু ত্রুটি নেই। সোহিনী রাগিণীতে সানাই বাজছে। মনোরম পরিবেশ। বাংলাদেশের মানুষের নির্ভেজাল আনন্দের উত্তাপ যেন প্ৰতি মুহূর্তে তাঁকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সরকারী সফরের শীতল নিয়মবিধি বসুর ক্ষেত্রে খাটে না। ‘জ্যোতি বসু’ যেন তাদেরই ঘরের লোক। দেশভাগের পর প্রথম বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় বসুর এই কথাটাই বার বার মনে হয়েছিল।

“কত যত্ন করেছিলেন মুজিনুর রহমান”, বললেন কমল বসু, “তখনকার পি এম পদ্মা গেস্ট হাউসে লাঞ্চ হল, নিজের নাতি কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখাশোনা করছেন, যেন নিজের ঘরের লোক এইভাবে, দশ রকমের মাছ, খেতেই হবে এত জোরজার, না খেলে আবার ওঁরা সত্যিই দুঃখ পান।”

পাশাপাশি আর একটি সুন্দর গেস্ট হাউস, ‘মেঘনা’। সেখানেও একদিন ডিনারে আমন্ত্রণ করলেন তখনকার হোম মিনিস্টার। সেও এক এলাহি কাণ্ড। “একদিন ‘মেঘনা’য় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল”, বললেন কমল বসু, “গান গাইলেন ফিরোজা বেগম। ফিরোজা বেগম তো নজরুলগীতির ধারক ও বাহক। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব। উনি এক আপনভোলা জাত-শিল্পী, একগুচ্ছ ফুল যদি সামনে রেখে দাও তো ওঁর গান যেন আরও প্রাণ পায়—এক নাগাড়ে, নিবিষ্টভাবে পনের-ষোলটা গান গেয়ে যায়, একটু গলাও ভেজায় না—আমি তো মন্ত্রমুগ্ধ।” ফিরোজার কথায় কমল বসু একটু উদাস, একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান, “জানো, ফিরোজা আমাকে বললেন, আমি যখন দশ বারো বছরের মেয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তুলতাম পদ্মফুল, শালুক—মা বলতেন ‘ওমা এ মেয়ের কি হবে জানি না, এ মেয়ে তো এ জগতের নয়’। ৮৭ সালের সফরটা আমাদের খুবই ঠাসবুনটের ছিল”, কমল বসু আবার ফিরে আসেন বাস্তবে, “এই সাভার তো, এই এরশাদের বাড়ি, এই লাঞ্চ, এই ডিনার তো এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তারপর যাওয়া হল বারদিতে লোকনাথবাবার আশ্রমে। জলপথে সেখানে যেতে লাগে পাক্কা দেড়টি ঘণ্টা। কিন্তু আমরা গেলাম বাংলাদেশ আর্মির হেলিকপ্‌টারে। দুটো হেলিকপ্‌টার গেল। লাগল মোটে পনের মিনিট।” বসু হেলিকপ্‌টার থেকে নামতেই দেখলেন মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র মানুষ। মুখে হাসি, মনে ভালবাসার উত্তাপ। যেন দাঁড়িয়ে আছে তাদের ‘বারদির সন্তান’কে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। “লোকে লোকারণ্য অবস্থা”, বললেন কমল বসু, “হেলিকপ্‌টার থেকে নেমে আলের ওপর দিয়ে হেঁটে বেশ খানিকটা যেতে হয়। তখন সকালবেলা। আমাদের ‘বাল্যভোগ’ প্রসাদ দিলেন, সব সিদ্ধ, ওপরে একটু ঘি ছড়ানো, দুধ থেকে যেন গোলাপী লাল আভা বেরোচ্ছে, ‘পায়েস’ও দিলেন, সেই সব খাওয়া হল, ঘুরে দেখাও হল। গ্রাম যেন ভেঙে পড়েছিল ‘জ্যোতি বসু’কে দেখতে। আমার মনে পড়ে গেল আমার দিদিমার কথা। বারদির লোকনাথবাবার আশ্রমে তাঁর নিত্য আনাগোনা ছিল। দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দরী, বুদ্ধিমতী মহিলা, পাতলা ঠোঁট দুটো সব সময় পানে টুকটুকে লাল। ঝুল ঘোমটা দিয়ে বাবাকে খাইয়েও দিয়েছিলেন। পরিবারের ‘বড় মা’—’বড় মা’র আরও অনেক গল্প আছে। আশ্রমের আঙিনায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ করে মনে পড়ে যায় তাঁর অমূল্য কয়েকটা কথা ‘কখনও কাউকে অসূয়া কোরো না, অসূয়া যে করে তারই কমে, তারই ক্ষতি হয়’।”

বসুর মনে পড়ে যায় ছোটবেলার কথা। বাবার হাত ধরে এই আশ্রমে যে কতবার এসেছেন তার ঠিক নেই। উৎসবের দিন ‘খিচুড়ি’, ‘পায়েস’ও খেয়েছেন পরম আনন্দে বড় হয়ে যুক্তিবাদী মন আর মাথা ঠেকাতে চায়নি, তবে বাবাকে আঘাত করতেও মন চাইত না, বলতেন মনে মনে করেছি’। লোকের ভিড় ঠেলে আশ্রম থেকে বেরোতে বেরোতে বেশ রোদ চড়ে যায়। রাতে আবার সোনারগাঁও হোটেলে ডিনার। এসেছিলেন বাংলাদেশের বহু বিশিষ্ট নাগরিক। ছিলেন জসীমউদ্দিনের মেয়ে।

“বারদির বাড়িটার তখন বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা,” বললেন বসু। “সরকারী কাজে ব্যবহার হলে ভাল হয়, ঘুরে ঘুরে সব দেখা হল, সেই বাগান আর নেই, তবে সেই কুয়োটা ছিল, আর সেই পুরোনো কাজের মুসলিম মহিলাটিও ছিলেন, প্রায় অশক্ত অবস্থা, তাকে কাঁথা দেওয়া হল। বাড়ির ফলকটা দেখলাম, বাবার নামটা খানিকটা পড়া যায়, তারিখ সন অবশ্য অক্ষত ছিল। ছবির মত মনে পড়ে গেল ছোটবেলাকার দিনগুলো। অনেক জায়গায় ফুল দিয়ে আমাদের নাম লিখে রেখেছে আমাদের স্বাগত জানানোর জন্য, যেখানেই যাই, পিছন পিছন লোকজনের বিরাট ভিড় এগোতে থাকে—সে এক অদ্ভুত অনুভূতি।”

আবেগে উত্তাপে হু হু করে কেটে যায় দিন, দেশে ফেরার সময় হয়ে আসে। এক যুগ পরে বাংলাদেশ দেখে মনপ্রাণ ভরে গেলেও যেন সাধ মেটে না—ছোট্ট মুঠিতে যেন সারা পৃথিবীটা উপচে পড়তে চায়। চোখ ভরে যা দেখা হল তা হৃদয়ে থিতোবার আগেই যেন আরও বেশি দেখা অপেক্ষা করে থাকে। “মনে হল আরও ধীরে ধীরে যদি দেখার সুযোগ পেতাম, থাকতামও যদি আর ক’টা বেশি দিন”–আক্ষেপ করলেন কমল বসু।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর দ্বিপাক্ষিক বিষয়ের শান্তিপূর্ণ সমাধান করেছেন বসু। চাকমা সমস্যা নিয়ে বসু অনেক চিন্তা ভাবনা করেছেন। বললেন “উগ্রপন্থীরা পাশাপাশি রাষ্ট্রে অপরাধ করে আগে অনেক সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নিত—এটা যাতে না হয় আমি ওঁদের সরকারকে অনুরোধ করেছি।” চাকমা সমস্যা সম্পর্কে বসুর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন দৈনিক বাংলা পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেছিলেন, “চাকমাদের…কথা বলতে হবে বাংলাদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল শক্তির সঙ্গে। ভারতের মাটিতে বসে তাঁরা যদি বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার স্বপ্ন দেখেন তবে তা হবে তাঁদের জন্য বোকামি। আমি কেন্দ্রকে বার বার বলেছি যাতে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলে এর মীমাংসা করা হয়। ধরুন শ্রীলংকার কথা। এল টি টি ই পৃথক তামিল রাষ্ট্র চায়। কিন্তু আমরা তার বিরোধী। তামিলদের অনেক সমস্যা আছে সত্য। তার সমাধানও দরকার। তবে তা হতে হবে শ্রীলংকার আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রেখে। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-এর উদাহরণ আপনাকে দিতে পারি। সেখানে নেপালীদের ভাষা ও সংস্কৃতিরক্ষার জন্য চুক্তি হয়েছে। পার্বত্য পরিষদ নামে একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। অ-নেপালী ও নেপালীরা আজ একত্রে সম্প্রীতির মাধ্যমে বসবাস করছে। আমরা যখন পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসিনি তখনও আমাদের দাবী ছিল নেপালী ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। চাকমাদেরও উচিত বাংলাদেশের অখণ্ডতা মেনে নিয়ে অ-চাকমাদের সঙ্গে বসবাস করা। ভারতের মাটিতে বসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র আমরা মেনে নেবো না (দৈনিক বাংলা ১৮ই জুন, ১৯৯১)।”১

বিবিসির সান্ধ্যকালীন বাংলা অনুষ্ঠানে এই সংবাদটি প্রকাশ হওয়ার পর চাকমারা ১৯শে জুন একটি বিক্ষোভ মিছিল বার করে। মিছিলে ‘জ্যোতিবাবু বাংলাদেশের দালাল’ এই ধরনের অভিযোগ করা হয়েছিল। চাকমা সমস্যার যাঁরা সমাধান চান না তাঁরা বসুর মন্তব্য পছন্দ করেন নি। কিন্তু বসু চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে। তাঁর মূল বক্তব্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্ত্বা ক্ষুণ্ণ করা চলবে না। বসু এই সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওকে অনুরোধ করেন। ১৯৯৩ সালের ৬ই মে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদক রাশেদ খান মেনন বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য বসুর সঙ্গে কলকাতায় দেখা করেন। বসু বলেন দলের শান্তিপূর্ণ সমাধানসূত্র প্রধানমন্ত্রীকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।

আর একটি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা বসুর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া মেটানো সম্ভব হত না—সেটি হল তিনবিঘা সমস্যা। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেই তিনবিঘা হস্তান্তরের চুক্তির বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। ১৯৮০ সালের ৯ই জুলাই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মন্ত্রীসভা এক বৈঠকে চুক্তি অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় সরকারকে এ বিষয়ে অবহিত করে দেয়। ঐ বৈঠকের সভাপতিত্ব বসুই করেছিলেন। বসু বিভিন্ন সমাবেশে বলতে থাকেন, “দু’ দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি ভারতকে মানতে হবে। আমরা বামফ্রন্টের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ইতিপূর্বে প্রস্তাব নিয়েছি যে, তিনবিঘা বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হোক। তিনবিঘা এলাকার কিছু মানুষ, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী, তাঁদের আশংকা ছিল জমি হস্তান্তর করলে তাঁরা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। তাঁদের আশংকার কথা জানতে পেরে আমি তা সরেজমিনে দেখতে আমাদের মুখ্য সচিবকে পাঠিয়েছিলাম। তদন্তে দেখা গেছে সেখানকার অধিবাসীদের আশংকা ঠিক নয়। তিনবিঘা যাতে দ্রুত বাংলাদেশ পেতে পারে তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১২ই জুলাই, ১৯৯১)।”

দফায় দফায় বসু প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেন, তাঁকে রাজিও করান এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ দিল্লীতে তিনবিঘা হস্তান্তরের দ্বিপাক্ষিক চূড়ান্ত চুক্তি হয়। বসু নিজে তার আগে ৯১ সালের নভেম্বর মাসে তিনবিঘা এলাকা সফরও করেন। ১৯৯২ সালের ২১শে এপ্রিল ফরোয়ার্ড ব্লকের কেন্দ্রীয় কমিটি দিল্লীতে এক বৈঠকে তাদের তিনবিঘা হস্তান্তরবিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে। বি. জে. পি-ও বসুকে ‘বাংলাদেশী এজেন্ট’ বলতে থাকে। বসু ও তাঁর দল সংগ্রাম চালিয়ে যান। বিরোধীপক্ষের সংখ্যা বাড়তে থাকে— ফরোয়ার্ড ব্লক, বি. জে. পি, কংগ্রেস ও এস. ইউ. সি. সহ আরও কয়েকটা রাজনৈতিক দল তো ছিলই, এবার কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু অফিসার ও রাজনীতিকও এই নীতির বিরোধিতা শুরু করেন। সব বাধা অতিক্রম করে ১৯৯২ সালের ২৬শে জুন তিনবিঘা হস্তান্তর হয়।

সাপ্তাহিক বিচিত্রার ১২ই জুলাই ১৯৯১ সংখ্যার ঐ একই সাক্ষাৎকারে বসু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আর্থিক লেনদেন ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বাড়াবার ওপর বিশেষ জোর দেন। প্রসঙ্গত বসু বলেন, “গত বছর এক ক্যানাডিয়ান কোম্পানি আমাকে বলেছিল, ‘বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া গেছে। যা ঐ দেশের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকবে। আপনারা, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ যদি এই গ্যাস কেনে তবে বাংলাদেশ আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবে। আপনারাও উপকৃত হবেন।”…এখন বাংলাদেশে জনগণের সরকার হয়েছে। আমার আশা আছে সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার। বাংলাদেশ যদি উদ্বৃত্ত গ্যাস বিক্রী করতে পারে তবে পশ্চিমবঙ্গ তা ন্যায্যমূল্যে কিনবে। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই।” চিরকাল বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যাপারে বসু বিশেষ জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশবিরোধী সংগঠন ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’র অপপ্রচারে কোনওরকম সহায়তা তো কেরেনই নি বরং তাঁদের সভাসমিতি পর্যন্ত করতে দেন নি এবং সীমান্ত পর্যন্ত এগোতে দেন নি। ফলে শান্তিবাহিনীর নেতাদের মত ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’র নেতারাও বসুর ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ৯০-এর দশকে বেশ কয়েকটি সাংবাদিক সম্মেলনে বসু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন ‘বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর যথেষ্ট আস্থা ও শ্রদ্ধা রয়েছে”। বাংলাদেশের মানুষ কি ভারতবিরোধী? এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জবাব দেন, “আমার জানা নেই ওই দেশের মানুষ ভারতের জনগণের বিরোধী কিনা। আর বিরোধিতা করলে নিশ্চয় তার কারণ আছে। সেই কারণটির অনুসন্ধান দরকার।” বসুর মুখ থেকে বাংলাদেশ-বিরোধী কোনও জবাব না পেয়ে ঐ সাংবাদিক চুপসে যান।

ভারতে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ নিয়ে বি. জে. পি. যতই অপপ্রচার চালাক, বসু বরাবরই এব্যাপারে একটা সহানুভূতিমূলক মনোভাব পোষণ করেন। বসুর মতে, “সারা পৃথিবীতে যেখানে একই সীমান্তরেখা আছে সেখানে এমন ঘটনা আকছারই ঘটে থাকে, এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তবে ঢালাও অনুপ্রবেশের ঘটনা এতটা সত্য নয়।” ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের অপারেশন পুশ ব্যাক কার্যক্রমের নিন্দা প্রথম করেন বসু। তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা যিনি এই কার্যক্রমকে ‘অমানবিক’ বলে বর্ণনা করেন। এই ‘অপারেশন পুশব্যাক’ কার্যক্রম অনুযায়ী দিল্লীতে বসবাসকারী বাংলাভাষাভাষীদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া শুরু হয়। এদিকে বি. জে. পি-ও প্রচার শুরু করে বাংলাদেশী হিন্দুদের গ্রহণ করা হোক আর মুসলমানদের বিতাড়ণ করা হোক। বসু বি. জে. পি-র এই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা করেন। বসুর মতে এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত সমস্যার বিচার করা উচিত ঐতিহাসিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। বসুর সমালোচনার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯২ সালের ১লা অক্টোবর বি.` এস. এফ-কে বাংলাভাষাভাষীদের প্রতি মানবিক আচরণ করার নির্দেশ দেন। ১৯৯৩ সালের ৬ই মে এই সমস্যা নিয়ে কলকাতায় রাশেদ খান মেনন বসুর সঙ্গে আবার দেখা করেন, বসু তাঁকে একতরফা ‘পুশব্যাক’ যাতে না হয় সে বিষয়ে আশ্বাস দেন।

তাছাড়া যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বসুর বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৯১ সালে সি. পি. আই. (এম)-এর দৈনিক মুখপত্র ‘গণশক্তি’র মাধ্যমে আর্ত বাংলাদেশীদের সাহায্যের জন্য পাঠকদের কাছে আবেদন জানানো হয়। স্বতঃস্ফূর্ত দান করেন মানুষ ও পার্টির লোকজন।

আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বিষয় হল গঙ্গার জলবন্টন সমস্যা। বসুর মতে এই সমস্যা বহুদিনের। বহুকাল ধরে কেন্দ্রীয় সরকার গঙ্গার জল বন্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করে চলেছেন কিন্তু কিছুতেই এর সন্তোষজনক সমাধান হচ্ছে না। “আমার কথা হল একটা স্থায়ী সমাধান দরকার,” বসু বললেন, “আমি তো কাউকেই বঞ্চিত করতে চাই না।” ১৯৯৩ সালের ৬ই মে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বসু এ বিষয়ে আলোচনা করেন। ‘দৈনিক বাংলা’ এই আলোচনা প্রসঙ্গে লেখে …”ফারাক্কায় নজিরবিহীন পানি প্রত্যাহারের দরুণ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে…পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জনাব মেননকে জানিয়েছেন, তিনি ইতিমধ্যে সমস্যাটির ব্যাপারে দিল্লীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কলকাতা বন্দরের নাব্যতার জন্য পানি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে নয়। তিনি আরও বলেছেন, কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষকেও আমি অনুরোধ করেছি, বাংলাদেশকে পানি দেওয়ার ব্যাপারে তারাও যেন কেন্দ্রের সাথে কথা বলে।”“

গঙ্গার পানি বন্টনসমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় তিনবছর পর। ১৯৯৬ সালের শেষে বসুর বিশেষ ইতিবাচক উদ্যোগে এই সমস্যার এক দীর্ঘ প্রেক্ষাপট আছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারত দু’দেশেই রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে গেছে। বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। ভারতেও ক্ষমতায় এসেছে সংযুক্ত মোর্চার নতুন সরকার। দুই সরকারই দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে বিশেষ আগ্রহী। সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বিদেশমন্ত্রী আই. কে. গুজরাল ঢাকা সফরের সময় জানিয়ে এসেছেন সম্পর্ক-উন্নতির ক্ষেত্রে বাধাগুলি যথাসম্ভব দূর করা হবে। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদও দিল্লীতে চারদিন ধরে নানা বিষয়ে আলোচনা করে গেছেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি রোমে বিশ্বখাদ্য সম্মেলন চলার সময় দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া ও শেখ হাসিনার মধ্যেও একদফা আলোচনা হয়েছে।

বসুর ঢাকা সফরে যাওয়ার কথা নভেম্বরের শেষে। দু’পক্ষেরই আশা বসুর মধ্যস্থতায় একটা স্থায়ী সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে। তাহলেই ৯৬এর শেষে, ডিসেম্বরে হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লীতে এসে চূড়ান্ত সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করতে পারবেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়ার সঙ্গে বসুর আলোচনা হবে কারণ জলবন্টনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সরাসরি জড়িত। এখানে গঙ্গাজলের ব্যাপারে দু’চার কথা বলে নেওয়া যাক। হুগলী নদী দিয়ে জলস্রোত কমে যাওয়ার ফলে নদীর বুকে পলিস্তর জমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে নদীর নাব্যতা কমে যায়। তখন কলকাতা বন্দরকে বাঁচাবার স্বার্থে হুগলী নদীতে জলস্রোত বাড়ানো জরুরী হয়ে পড়ে। কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর জন্য, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, ভাঙন রোধ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদি নানা উদ্দেশ্যে ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় প্রকল্প রূপায়ণের পর গঙ্গার জলের একটা অংশ হুগলী নদীতে পাঠানো হবে, বাকিটা পাঠানো হবে পদ্মা দিয়ে বাংলাদেশে। সত্তরের দশকে ব্যারেজ তৈরির পর দু’দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গার জল বন্টন শুরু হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় কিছুদিন পর। মূল গঙ্গায় জলস্রোত কমতে থাকে। ফলে ফারাক্কায় পাওয়া জলের পরিমাণও কমে যায় এবং সেই অনুযায়ী হুগলী ও পদ্মাতেও জলের পরিমাণ কমে যায়। কলকাতা বন্দর, হলদিয়া বন্দর এক বিপজ্জনক অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। অন্যদিকে পদ্মার জল কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় প্রভূত সমস্যা দেখা দেয়।

বাংলাদেশ পদ্মায় বেশি জল ছাড়ার লাগাতার দাবী জানায়, এদিকে হুগলী নদীর জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জলও মেলে না। জলপ্রবাহ না বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব বলে মনে হয়। বিহার ও উত্তরপ্রদেশে সেচের কাজে গঙ্গার জল ব্যবহার হয়, ফলে গঙ্গার জল কমে বই বাড়ে না। দু’পক্ষেরই যুক্তি আছে, ফলে সব চাহিদা নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

১৯৯৬ সালের নভেম্বর মাসের শেষে আবার বসুকে যেতে হল পদ্মা-মেঘনার দেশে। ২৭শে নভেম্বর বুধবার বিকেলে বসু বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন দীর্ঘ ন’বছর পর। দুপুর ঠিক আড়াইটের সময় ঢাকায় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বসু নামলেন ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের বিমান থেকে। গোটা ঢাকা শহর তখন তাঁর অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে। বিমানবন্দরে বসুকে সাদর আদাব জানালেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। দু’দেশের সাংবাদিকদের এক বিশাল বাহিনীর মধ্যে বসুর তখন প্রায় বন্দী অবস্থা। একটি ছোট্ট মেয়ে একগুচ্ছ ফুল তুলে দেয় বসুর হাতে, বসু মেয়েটিকে আদর করে, হাসিমুখে ফুলের তোড়া হাতে নেন। বসুর সঙ্গে একই বিমানে ঢাকায় গেছেন পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র পুলিস মন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী। আরও ছিলেন মুখ্যসচিব, সেচসচিব, উচ্চপদস্থ অন্যান্য অফিসার এবং ভারতীয় সাংবাদিকদের এক বিরাট দল। বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রী ছাড়াও বসুকে ঢাকা বিমানবন্দরে স্বাগত জানান বাংলাদেশের হাই কমিশনার সি. এম. সফি সামি, ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার দেব মুখার্জি, কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার জাহাঙ্গীর সাদাত প্রমুখ। তাছাড়া ছিলেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিনিধি রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রণো প্রমুখ। আওয়ামি লীগের পক্ষ থেকে ছিলেন আবদুল জলিল। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত নেতা বর্তমানে সাংসদ আবদুল কাদের সিদ্দিকি।

বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েই বসু জানান “আমি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একরাশ ভালবাসা আর শুভেচ্ছা নিয়ে এসেছি। আমাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।” সেই দিনই সকালে ঢাকা রওনা হওয়ার আগে জলবন্টনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়ার সঙ্গে বসু কথা বলেন, কলকাতা ছাড়ার আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বসু বলেন কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে কোনও সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন না। যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা গৃহীত হবে। আর একটা ব্যাপার বার বার খুব স্পষ্ট ভাষায় বসু বলতে থাকেন, “আমি বাংলাদেশ যাচ্ছি শেখ হাসিনার সরকারী আমন্ত্রণে, ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নয়।”

জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিশাল কনভয় বসুকে নিয়ে যায় সোনার গাঁ হোটেলে। সেখানেই বসুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানেই বসেছে ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের কন্ট্রোল রুম। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের পর বসু গেলেন ‘পদ্মা’ গেস্ট হাউসে। ৮৭ সালে এখানেই থেকেছিলেন সস্ত্রীক। ‘পদ্মা’ গেস্ট হাউসে শুরু হল প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। আলোচনায় বসলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং বিদেশ মন্ত্রণালয়ের অফিসাররা। গঙ্গার জলবন্টন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক চলে ঘণ্টাখানেক। রাতে বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করা হয় বসুকে হোটেল শেরাটনে। “এবারের প্রোগ্রামটা ছিল খুব ভাল করে সাজানো”, বসু বললেন, “গতবারের মত ঠাসা, তাড়াহুড়ো ছিল না, আমি বলেছিলাম সকাল ১০.৩০ থেকে আরম্ভ করতে, ঠিক সেই মতই করেছিল, যথেষ্ঠ সময় পাওয়া গেছে, কোনও তাড়াহুড়ো হয়নি।”

হোটেল শেরাটনে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীর দেওয়া নৈশভোজে বসু বলেন “ভারতের প্রতিনিধি হয়ে আমি আসিনি। এসেছি আপনাদের আমন্ত্রণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই। যেহেতু এসেছি, তাই গঙ্গার জলবন্টন বা অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হবে। যা আলোচনা হবে তাতে মিল-অমিল সবটাই গিয়ে বলব আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভারতে যাওয়ার আগেই এই আলোচনা হবে।” বসু আরও বলেন, “বাংলাদেশকে আমরা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি, কোনও ইস্যুতে দু’দেশের বন্ধুত্ব বাড়লে, দু’দেশের মানুষের সম্পর্ক ভালো হলে দু’দেশেরই লাভ। কিছুদিন আগে আমি লন্ডনে শেক্‌সপীয়রের জন্মস্থানে গিয়ে বলেছিলাম, ভারত এবং বাংলাদেশ এই দু’দেশের জাতীয় সংগীতই একই কবির লেখা। বাংলাভাষার উন্নতিতে বাংলাদেশ যা উদ্যোগ নিচ্ছে তাতে আমরাও গর্বিত। বাংলাদেশ চায় ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে তাদের পণ্যের ওপর করভার কমানো হোক। মাছের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই তা হয়েছে। আরও কি করা যায়, আমরা দেখছি। আমরা দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চাই।” নৈশভোজে বাংলাদেশের শিল্পীরা বসুকে গান গেয় শোনান। “ওরা গান চমৎকার গায়, শিল্প সংস্কৃতিতে সত্যি ওদের তুলনা নেই”–বসু মন্তব্য করলেন।

পরের দিন বৃহস্পতিবার ২৮শে নভেম্বর বসুর যাওয়ার কথা তাঁর জন্মস্থান ও পৈতৃক বাসভবন বারদিতে। ঢাকা থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে ৪০ কিলোমিটার দূরে, (তখনকার বৈদ্যের বাজার) এখনকার সোনার গাঁ থানায় বারদি গ্রাম। তার আগে যাবেন ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ সাভার-এ শহীদদের পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে। দুপুর, ১১টা ২০ মিনিট নাগাদ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেলিকপ্‌টার যখন বসুকে নিয়ে বারদি ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে নামল, তখন চারদিকে গিজগিজ করছে অগণিত মানুষ। হেলিকপ্‌টারের দরজা খুলে বসু যেই মাটিতে পা রাখলেন উল্লাসে আর করতালিতে বারদির আকাশবাতাস মুখর হয়ে উঠল। সেদিন সকালে বারদিতে যেন ছুটির মেজাজ। পাওয়ার লুমের আওয়াজ নেই, নেই তাঁতের খুটখাট্ শব্দ। জেলেরা মেঘনায় মাছ ধরতে যান নি, গ্রামের বৌ- ঝিরা সবাই চলে গেছেন বারদি ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে। চারিদিকে যেন আনন্দের উচ্ছলতার জোয়ার বইছে। সবাই আবেগে আপ্লুত, শ্রদ্ধায় আনত হয়ে দেখতে এসেছেন ‘বারদির কৃতী সন্তান’ জ্যোতি বসুকে। সে এক অভিনব দৃশ্য। ঢোলকলমির ঝাড় ঘেরা, বাবলা ফুল, নারকেল, খেজুর গাছের সারি দেওয়া মেঠো পথ, খানাখন্দ, খালবিল পেরিয়ে কাতারে কাতারে মানুষ এসে জড় হয়েছেন সেই ইউনিয়ন পরিষদের মাঠে—তাদের স্বপ্নের নায়ককে দেখে চক্ষু সার্থক করতে। আন্তরিক অভ্যর্থনার পসরা নিয়ে অগণ্য মানুষ এগিয়ে যায় বসুর দিকে, তখন কোথায় নিরাপত্তাবলয়, কোথায় রক্ষী, কোথায় পুলিস-বেষ্টনী—ভালবাসার জোয়ারে খড়কুটোর মত সে সব কোথায় ভেসে যায়! আবালবৃদ্ধবনিতা কে নেই সেই ভিড়ে? সকলেরই চেষ্টা একটু কাছে যাবার। কারো কারো হাতে এক গুচ্ছ রঙীন ফুল রোদের দীপ্তিতে ঝক্‌ঝক করছে। শুভেচ্ছার পালা এক সময় শেষ হয়। বসু রওনা হন বাড়ির দিকে। কোনও গাড়ি ছিল না, কারণ রাস্তাটা এত সরু যে রিকশা চলাও মুসকিল। বসু আসবেন বলে বাড়ি সংস্কার হয়েছে, রাস্তাও মেরামত করা হয়েছে। কোনওরকমে তিনচাকার রিকশা চলার মত করা হয়েছে। রিকশা রেডি ছিল। কিন্তু বসু রিকশায় উঠলেন না। মাটির রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে চললেন। রাস্তার দুধারে অজস্র বিস্ময়াবিষ্ট উৎসুক মুখের সারি, বসুর মাথার ওপরে চলছে পুষ্প বৃষ্টি। এক সময়ে এসে পৌঁছলেন স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ির সামনে। সামনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে প্রথমে বসলেন নিচের তলার একটা ঘরে। ছোটবেলার কত স্মৃতিই না জড়িয়ে রয়েছে এই ঘরের প্রতিটি ধূলিকণায়। ঘুরে ঘুরে বার বার সব দেখলেন—সব মনে আছে, সব। সঙ্গীদের বলতে লাগলেন, দেখতেও লাগলেন। সেই ঘরে বসে গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তা হল। চা খাওয়া হল। বিদ্যুৎ নেই। তালপাতার পাখায় একজন হাওয়া করতে লাগল। নস্টালজিয়ার কি সম্মোহনী শক্তি! কাল তো বসুর পিঠের ব্যাথাটা সামান্য বেড়েছিল কিন্তু এক কিলোমিটার পথ তো হেঁটে পেরোলেন। আর কোথায় সেই কাঠিন্য, সেই গাম্ভীর্য, মুখে অনাবিল হাসি, শিশুর মত পবিত্র, কথা বলে চলেছেন অনর্গল। ঘণ্টাখানেক রইলেন। যেন ফিরে গেলেন টাইম মেশিনে এক যুগ আগে, যখন বাংলাদেশ দু’টুকরো হয়ে যায়নি।

ইচ্ছা ছিল ফেরার সময় পায়ে হেঁটেই যাবেন কিন্তু সফরসঙ্গীদের অনুরোধে রিকশা চড়তেই হল। পাশে বসলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী। রিকশাওয়ালার অবস্থা দেখার মত। জ্যোতি বসুকে রিকশায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে সে। তার হাত পা তখন উত্তেজনায় কাঁপছে। বসু বসলেন, হাত দুটো কোলের উপর জড় করা, পাশে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী। রিকশা চলল। পেছনে জনস্রোতের জোয়ার। কয়েক মিনিট পরে রিকশা এসে পৌঁছোয় ময়দানে। সামনে হেলিপ্যাড, চারদিকে গাছগাছালিতে ভরা টিনের চালের, খড়ের চালের বাড়ি, কোথাও কোথাও দেখা যায় দু’একটা পাকা বাড়ি, পাশেই তৈরি হয়েছে মঞ্চ। সেখানে বসুর গণ-সংবর্ধনা হবে। লোকে লোকারণ্য। দুধসাদা মঞ্চ। কোটপ্যান্ট পরা বসু আসন করে পা মুড়ে বসলেন। সংবর্ধনা শুরু হল। উপহারের পর উপহার, মানপত্রের পর মানপত্র। সকলেই যেন এই কৃতী পুরুষকে কিছু না কিছু দিয়ে নিজেই ধন্য হতে চায়। তারপর শুরু হল বক্তৃতা। বক্তৃতা ঠিক নয় নির্ভেজাল হৃদয়ের উষ্ণতার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ। তাঁরা বলছেন আমরা গর্ব করি রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে নিয়ে, গর্ব করি মুজিবর রহমানকে নিয়ে। ঠিক তেমনই গর্ব করি আমাদের গ্রামের মানুষ জ্যোতি বসুকে নিয়ে। আবার আমরা কবে তাকে পাবো—আর একজন বললেন। আর একজন বললেন ‘আমাদের এ আনন্দের ভাষা নেই।’ আরও একজন বললেন ‘এখানকার মানুষ আপনাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসে, আপনাকে কাছে পেতে চায়, আপনার কাছে যেতে চায়।’

প্রায় সাত-আটজনের ভাষণ হল। এবার বসুর পালা। যাঁকে ঘিরে এত কাণ্ড তিনিও কম আপ্লুত নন। তিনি বলেন “আপনাদের এই ভালবাসার কথা আমি কোনওদিন ভুলব না। আমার এখানে এসে অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ছোটবেলার কথা। এখানে আমাদের একটা বাড়ি আছে। ঐ জমিটা আমার দাদুর ছিল, দাদু আমার মাকে দেন। মায়ের জমিতে আমার বাবা দোতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। পাকাপোক্ত বাড়ি। আমার অবশ্য কলকাতাতেই জন্ম। আমরা স্কুল ছুটির সময় এখানে প্রায়ই বেড়াতে আসতাম। আমার এই গ্রামটা খুব ভাল লাগত। তাই আমি মাকে বলতাম এখানে আসার জন্য। আমরা গোয়ালন্দ থেকে স্টীমারে করে নারায়ণগঞ্জে আসতাম। সেখান থেকে নৌকোয় করে কিছুটা এসে মেঘনার পাড়ে নেমে, তারপর পায়ে হেঁটে বাড়ি আসতাম। তখন আমাদের বাড়িতে দারুণ মাংস ভাত রান্না হত। পৃথিবীর বহুদেশে গেছি, এমন রান্না আমি আর কোথাও খাইনি। সেই মাংসভাত খাবার লোভেই বেশি বেশি করে এই গ্রামে আসতাম। ঢাকার কাছে সাভার-এ আমার দিদির শ্বশুরবাড়ি ছিল। এখন কেউ নেই। দিদি জামাইবাবু দুজনেই মারা গেছেন। …এই যে মাঠে আমরা সভা করছি—ছোটবেলায় দেখেছি, এখানে ফুটবল খেলা হত। এখানে গরুর হাট বসতে দেখেছি। আপনারা আমাকে আবার আসতে বলছেন। বয়স হয়েছে। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই আসব। ন’বছর আগে যখন এসেছিলাম তখন আমার স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। এবার তিনিও আমন্ত্রিত ছিলেন, কিন্তু অসুস্থতার জন্য আসতে পারেন নি। গতবার চলে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী আমাকে বলেছিলেন এত তাড়াতাড়ি চলে যেতে খারাপ লাগছে। আসলে এই জায়গা ওঁরও ভাল লাগে। উনি ছোটবেলায় এখানে ছিলেন, ওর জন্ম ময়মনসিংহে। যাই হোক আপনারা যা উপহার দিলেন, আমি ওঁকে দেব। বলব আপনাদের কথা। আপনারা বার বার বলছেন, আমি কেন চলে যাচ্ছি। আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি, “তবু যেতে দিতে হয়।’ যেতে আমাকে হবে উপায় নেই।”

বসু তাঁর ভাষণে আরও বলেন, “আমি শেখ মুজিবর বেঁচে থাকার সময়েই তাঁকে বলেছিলাম আমাদের এই বাড়িটি যেন বাংলাদেশ সরকার নিয়ে নেয়। এর জন্য আমাদের কোন ক্ষতিপুরণ চাই না। সেখানে যে কাগজপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে আমি তা করে দেব।” প্রায় সাত বিঘা জমির ওপর এই বাড়িটি বসু আসার আগে সারানো হয়েছে, বাড়ির চারধারে ঘেরা হয়েছে কাঁটাতার দিয়ে। রঙও করা হয়েছে।

সভা শেষ হয়। হাত নেড়ে উল্লসিত জনতাকে অভিনন্দন জানিয়ে বসু উঠে পড়েন হেলিকপ্‌টারে। ধুলোর ঝড় উড়িয়ে, কানফাটানো শব্দ করে হেলিকপ্‌টার আকাশে উড়ল। বারদি থেকে বসু বিদায় নিলেন। অনেকেরই চোখে জল। কারও গাল বেয়ে জল ঝরছে। চারিদিকে এক বিষাদময় নিস্তব্ধতা। বসুও বিহ্বল হয়ে পড়েন। সারাজীবন অসংখ্য মানপত্র প্রশংসাপত্র পেয়েছেন বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে। কিন্তু বারদির আশ্রমের কর্মচারীরা তাঁদের ‘বারদির মহান সন্তান’, ‘স্বনামধন্য পুরুষ’কে হৃদয়ের সব ভালবাসা উজাড় করে হাতে লেখা যে মানপত্রটি দিয়েছিলেন সেটি বসু সযত্নে রেখে দিয়েছেন নিজের বাড়ীর হলঘরে। বৃহস্পতিবার ২৮শে নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারসূত্রে জানা যায় ‘জ্যোতি বসু’র নামে বাংলাদেশ সরকার বারদি থেকে আনন্দবাজার পর্যন্ত একটি রাস্তার নামকরণ করবে। আবার বারদিতে পোস্টার ও পড়েছে বারদিতে দ্রুত একটি কলেজ স্থাপন করা হোক এবং প্রস্তাবিত এই কলেজের নাম রাখা হোক ‘জ্যোতি বসু মহাবিদ্যালয়’। বাংলাদেশ সরকার বসুর পৈতৃক বাসভবনে বসু ও তাঁর পরিবারের নামাঙ্কিত একটি মিউজিয়াম তৈরি করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বসু তাতে সায় দেন না, তিনি বলেন “মিউজিয়াম করে কি হবে? তার চেয়ে বাড়িটা জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা হোক।”

বারদি দেখে যেন আশ আর মেটে না। আবার নদীর বুক থেকে দেখলেন বসু তাঁর প্রিয় বারদিকে। শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশ সরকার বসুর জন্য বুড়িগঙ্গার ওপর নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করে। ঘড়িতে তখন ১১.৪৫ মিনিট। সূর্য মাঝ আকাশে। পাগলাঘাট জেটি থেকে যাত্রা শুরু করে বিরাট এক লঞ্চ। বুড়িগঙ্গা দিয়ে দক্ষিণে, প্রথমে ধলেশ্বরী নদীর সংযোগস্থল এবং পরে মেঘনার সংযোগস্থল চাঁদপুর পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে আসে পাগলাঘাটে। ‘ঐ দেখুন শীতলাক্ষা নদী এসে মিশেছে বুড়িগঙ্গায়, তার ঠিক ওপারেই মেঘনার পাড়ে বারদি গ্রাম। এখান থেকে খুব দূরে নয়।’—বসুর কৌতূহল যেন বেড়ে গেল, ডেকে দাঁড়িয়ে রোদে চিকচিক্ করা সোনার মুকুট পরা ছোট ছোট জলের ঢেউ ছাড়িয়ে চোখ মেলে দিলেন সুদূর দিগন্তে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন মনে এসে গেল। চুপ করে দেখতে লাগলেন। জল কেটে লঞ্চ এগোতে থাকে, পাগলাঘাট পেরোলো, কিছুদূর যাওয়ার পর এল কোতল্লা। চারিদিকে দেখা যায় পোশাকের কারখানা, তেলের মিল, সব্জি প্রসেসিং মিল, আর প্রচুর ইটভাটা। নদীর দু’পারে আগেকার বিক্রমপুর আর এখনকার মুন্সিগঞ্জ জেলা। আর একটু এগোলেই ধলেশ্বরী নদী এসে মিশেছে বুড়িগঙ্গায়। ফেলে এলেন বক্তাবলী। ১৯৭১ সালের ২৯শে নভেম্বর এই বক্তাবলীতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ৮টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে নির্মম নরহত্যার তান্ডবলীলায় মেতেছিল। ধলেশ্বরীর পরই কমলাঘাট বন্দর। বাংলাদেশের একটি বাণিজ্যকেন্দ্র। এর কাছেই জ্ঞানী অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান। আর খানিকটা গেলেই বিরাট উদাত্ত মেঘনা নদী। এসে গেল চাঁদপুর বন্দর। এখানে থেকে লঞ্চ ঘুরে উত্তর মুখে যাত্রা করল। নদীতে অজস্র বালিহাঁসের ভিড়। তার সঙ্গে রয়েছে পণ্যভরা নৌকা, যাত্রীবাহী নৌকার ভিড়। লঞ্চ আর জাহাজের যান্ত্রিক আওয়াজে নদীর জলের ছলছলাৎ শব্দ কোথায় ডুবে যায়।

লঞ্চের মধ্যেই মধ্যাহ্নভোজ সারেন বসু। তারপর একটু বিশ্রাম নিতেই হয়। পুরোনো বারদির টুকরো টুকরো ছবি ক্যালাইডোস্কোপের মত ভেসে ওঠে। সময় দ্রুত বয়ে যায়। যাত্রার বৃত্ত শেষ হয় আবার সেই পাগলাঘাটে। বসু ফিরে যান সোনার গাঁ হোটেলে। সন্ধ্যায় ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা বসুর সঙ্গে হোটেলে দেখা করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পার্টির সভাপতি অমল সেন, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেনন, পলিটব্যুরোর সদস্য মহবুল হাসান প্রমুখ।

১৯৮৭ সালের সেই সফরের সঙ্গে দীর্ঘ নয় বছরের ব্যবধানে ১৯৯৬ এর এই বাংলাদেশ সফরের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেবার এসেছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে, রাজনৈতিক তেমন কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। এবারও শেখ হাসিনার আমন্ত্রণেই এসেছেন কিন্তু সঙ্গে এনেছেন একটা বিশেষ সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছা। শনিবার ৩০শে নভেম্বর শেখ হাসিনা আর বসুর গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের মূল এজেন্ডা—গঙ্গার জলবন্টন সমস্যা। প্রত্যেকেরই মনে আশা এই বৈঠক ইতিবাচক হবে। শেখ হাসিনার সঙ্গে বসার আগেই অবশ্য দফায় দফায় এই সমস্যা নিয়ে অফিসার ও মন্ত্রী পর্যায়ে বেশ কয়েকটা বৈঠক হয়ে যায়। বসুর সফরকে বাংলাদেশ সংবাদমাধ্যম খুবই গুরুত্ব দেয়। ঢাকায় রাস্তাঘাটে জ্যোতি বসুকে নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে, তাঁদের ধারণা জ্যোতি বসুই পারবেন এর সমাধানসূত্র খুঁজে বার করতে। রোজই বসুর খবর প্রতিটি সংবাদপত্রের শিরোনামে। বসুর সাদা কালো ও রঙীন ছবি ছাপা হয় প্রথম পাতায়। জ্যোতি বসু কোথায় যাচ্ছেন, কি বলছেন সব অনুপুঙ্খ প্রতিবেদন থাকে খবরের কাগজে। শুধু হাসিনা সরকারের সমর্থক কাগজগুলোই নয়, বিরোধী পত্রিকাগুলোও সমান গুরুত্ব দিয়ে বসুর সফরের সংবাদ দিতে থাকে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক এ. বি. এম. মুসা তাঁর ব্যক্তিগত কলামে লেখেন, এতদিন পর ভারত সরকার বুঝতে পেরেছে যে জ্যোতি বসু তথা পশ্চিমবঙ্গের সাহায্য ছাড়া গঙ্গার জলবন্টন সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাঁর মতে, দু’দশক ধরে সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণ জলের অভাব নয়, অভাব আগ্রহ ও আন্তরিকতার। বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক ও প্রবীন সাংবাদিক কামাল লোহানি বলেন জ্যোতি বসুর বাংলাদেশ আগমনে এদেশে আশার সঞ্চার হয়েছে। শুধু জলবিতর্ক নয় তাঁর এই সফর সামগ্রিকভাবে দু’দেশের সম্পর্ককে আরও নিবিড় করবে।

শনিবার বেলা এগারটায় বসু গেলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অফিসে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে সেদিন বাড়তি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা। স্থানীয় কোন সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। অনুমতি পেয়েছিল কেবলমাত্র ভারতীয় চিত্রসাংবাদিক এবং বাংলাদেশ টি ভি এবং সংবাদ সংস্থার চিত্রসাংবাদিকরা। “কেমন আছেন, শরীর ভাল তো?” ঘরে ঢুকে প্রথমেই কুশল প্রশ্ন করেন শেখ হাসিনা। হাসিনার পরণে জামদানী ঢাকাই। জবাবে বসু বলেন “ভালই আছি। তবে বয়স তো হচ্ছে।” বসু হাসিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সফর সঙ্গীদের। বসুর সঙ্গে তাঁর মন্ত্রীসভার দুই মন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসাররা। অন্যদিকে ছিলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আজাদ ও পদস্থ অফিসাররা। আলোচনা শুরুর আগে ভারতীয় চিত্রসাংবাদিকরা একগুচ্ছ ছবি তোলেন, এরই মধ্যে কুশল বিনিময় ও ব্যক্তিগত কিছু কথাবার্তা চলতে থাকে। বসু বললেন “অনেকদিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা হল। গতবার যখন এসেছিলাম তখন কথা হয়েছিল। আপনার বাবার সঙ্গেও আপনাকে দেখেছিলাম।”

শেখ হাসিনা হেসে জিজ্ঞেস করেন : ‘কেমন দেখলেন বারদিতে আপনাদের পুরোনো বাড়ি?”

বসু : “ভালই লাগল, কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হয়েছে দেখলাম, রঙটঙ হয়েছে। মেরামতি হয়েছে। আমি তো আগেও বলেছি, বাড়িটা আপনারা সরকারের পক্ষ থেকে নিয়ে নিন।”

বসুর পক্ষ থেকে হাসিনাকে একটি শাল, শাড়ি ও ছবির অ্যালবাম উপহার দেওয়া হয়। হাসিনাও বসুকে একটি শাল দেন। হাসিনা বলেন জ্যোতি বসু আসাতে তাঁরা খুব খুশি হয়েছেন। এর পর গঙ্গাজলবন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা চলে এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট। বাংলাদেশের চাহিদা এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে মোটামুটি একটা মীমাংসাসূত্র বের করা হয়। বাংলাদেশকে কখন কতটা জল দেওয়া হবে সেই ব্যাপারে একটা খসড়া প্রস্তাব চূড়ান্ত হবার পথ প্রশস্ত হয়। কিছু খুঁটিনাটি আলোচনা বাকী থেকে যায়, দুজনেই আশা করেন অদূর ভবিষ্যতে আরও আলোচনার মাধ্যমে সেসব মিটে যাবে এবং একটা চূড়ান্ত মতৈক্যে পৌঁছানো যাবে। বৈঠকের শেষে হাসিনা এবং বসু দুজনেই বলেন, আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে, তাঁরা দুজনেই আশাবাদী।

বিকেলে আবার বৈঠক হয় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। এবার ৫০ মিনিট তাঁদের কথাবার্তা হয়। বসুকে রাষ্ট্রপতি বলেন : “ছোটবেলা থেকে আপনার নাম অনেক শুনেছি। আপনার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল, আজ সেই সুযোগ হল। আপনি আরও অনেকদিন ভালোভাবে কাজ করুন।” তারপরই বসু যান শিল্পকলা আকাদেমি আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায়। সন্ধ্যায় বসেন বাংলাদেশ বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায়। ওয়ার্কার্স পার্টি রাতে বসুর সম্মানার্থে এক নৈশভোজের আয়োজন করে। ওয়ার্কার্স পার্টির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বসু বলেন, “ফারাক্কার জল সমস্যা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এর সমাধান কেন এতদিন হয়নি? শুধু প্রকৃতি বিরূপ বলে তো নয়, আমাদের বন্দর রয়েছে। পানীয় জল নোনা হবার সমস্যাও রয়েছে। এসব দেখেশুনেই আমরা চেষ্টা করছি সমাধানে। তাই সঙ্গে করে বিশেষজ্ঞদের এনেছি। ওঁদের বলেছি ২০ বছর ধরে কতটা জল কীভাবে গেছে, তা খতিয়ে দেখতে। তারপর কোথায় কী সমস্যা দেখা দিয়েছে সবটা বের করুন। তারপরে আমরা দেখব কীভাবে সমাধানের রাস্তা বের করা যায়। দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের ব্যাপারটা পরে ভাবা যাবে। এখনই যতটুকু করা যায়, সেটা আগে করি। তবে আমি তো সই করতে পারব না, উপদেশ দিতে পারি মাত্র।” বসু আরও বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার বলছে জ্যোতি বসুই সমাধান করবে। এসব বলে কেন্দ্র দায়িত্ব এড়াতে পারে না। দায়িত্ব ওদের।”

রবিবার বসুর সফরের শেষ দিন। সকালে বসু গেলেন ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন পরিদর্শনে। ছিলেন প্রায় একঘণ্টা। বসুর সম্মানে মিশন কর্তৃপক্ষ এক সভার আয়োজন করেন, সেখানে বসু সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে তাঁর বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন ও দু’দেশের সম্পর্কের উন্নতির উপর বিশেষ জোর দেন। তারপর সোনার গাঁও হোটেলে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ আয়োজিত এক বণিকসভায় বসু ভাষণ দেন। বসু বলেন “ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আপনাদের কিছু সমস্যা আছে—আপনারা আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বলুন। তাছাড়া, দু’দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। দু’দেশের যুবসমাজ একই ভাষায় কথা বললেও একে অপরকে জানে না। কেন যে এখনো কলকাতা-ঢাকা-চট্টগ্রাম যাত্রীবাহী বাস চালু হল না বুঝতে পারি না।” বসু বললেন, “বনগাঁ ও অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে শতশত লরিতে পণ্য যাতায়াত করে। কিন্তু এর মধ্যে ভারতের পণ্যই বেশি আসে বাংলাদেশে, প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার মত। এটা আরও বাড়ানো দরকার যাতে দু’দেশের মধ্যে আমদানি রপ্তানির এই ব্যবধান কমে। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যবৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও নানা রাজনৈতিক কারণে হয়নি। চট্টগ্রামে চমৎকার আধুনিক বন্দর আছে। এই বন্দর দিয়ে বাণিজ্য হতে পারে। জলপথে পণ্য পরিবহণে ব্যয়ও কম। এতে দু’দেশই উপকৃত হবে। ত্রিপুরাসহ সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যের অগ্রগতি ঘটবে। প্রাকৃতিক গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারেও দু’দেশ একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারে।” সভায় চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুণও ভাষণ দেন। এরপর বণিকসভা বসু ও তাঁর সফর সঙ্গীদের মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করেন।

রাতে বসুর সম্মানে শেখ হাসিনা এক নৈশভোজের আয়োজন করেন। বসু বলেন “সকলেই প্রায় বহুদিনের চেনা, পারিবারিক উষ্ণতাটুকু খুব ভাল লেগেছিল। আমড়া দিয়ে ইলিশমাছ রান্নাও বেশ নতুন রকমের লেগেছিল।”

ছ’দিনের সফর শেষ হয়। সোমবার বসু কলকাতায় ফেরেন। ঢাকায় বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বসু বলেন এবার আর চট্টগ্রাম, সিলেট যাওয়া হল না। আর গঙ্গাজল বণ্টনের ব্যাপারে যা কথাবার্তা হল এই সফরে তাতে তিনি বিশেষ আশাবাদী। শেখ হাসিনা ৯ বা ১০ই ডিসেম্বর দিল্লী যাবেন, তার আগেই বসু গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা সেরে রাখবেন। বসুকে ঢাকা বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আবদুর সামাদ আজাদ, সাংসদ বাঘা সিদ্দিকি, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রণো প্রমুখ। বস্তুত বসুরই উদ্যোগে এবং মধ্যস্থতায় জলবন্টন নিয়ে দু’দেশের মধ্যে বিরোধিতার অবসান হয়। জলবন্টন নিয়ে দু’দেশের স্বার্থরক্ষা করে ৩০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় দিল্লীতে ১২ই ডিসেম্বর ১৯৯৬-এ। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক- উন্নতির ক্ষেত্রে এটা একটা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *