জীবন কোথায় নেই?
‘এই বোধ হয় পথের শেষ’—
জেরি গারফিল্ড ইঞ্জিন থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আর এগোনো সম্ভব নয়।’
পেটের নীচের পাইপ থেকে প্রথমে ভস ভস, পরে হিস হিস করতে করতে গ্যাস বেরিয়ে গেল খানিকটা, তারপর সব নিশ্চুপ। চুপসে গিয়েছে হাওয়ার গদি, যার উপর ভর রেখে পাথরে পাথরে বুক ঘষে ঘষে সাপের মতো পথ চলে টহল গাড়ি ‘র্যামব্লিং রেক’। হেসপেরিয়ান অধিত্যকার মোচড়-খাওয়া অষ্টাবক্র পাথরের চাঙড় একটা, তারই উপরে সে এলিয়ে পড়ল গভীর অবসাদে।
না, নেই। পথ নেই এগিয়ে যাওয়ার। জেট বলো, ট্র্যাকটর বলো, কোনো-কিছুই ওই খাড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে ঠেলে পার করে দিতে পারবে না ‘এস—৫’ কে। ‘মর্নিং স্টার’ বিমানের সরকারি তালিকায় ওই নামই লেখা আছে র্যামব্লিং রেক-এর। এস-৫।
দক্ষিণ মেরু আর মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে। মানে, শুক্রের দক্ষিণ মেরু— পৃথিবীর নয়। মাত্র ত্রিশ মাইল। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়াল, ওই ত্রিশটা মাইল পেরুনো ঠিক যেন শুক্র থেকে নেপচুনে পাড়ি দেওয়ার মতোই অসম্ভব ঠেকেছে। ফিরে যেতে হবে। নির্ঘাত ফিরে যেতে হবে চার-শো মাইলের এই দূরত্বটা অতিক্রম করে, যার প্রতি ইঞ্চি পথ এমন বিপদসংকুল যে তার কথা ভাবতে গেলেই বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।
কিন্তু আবহাওয়া? আশ্চর্যরকম পরিষ্কার। যেকোনোদিকে হাজার গজ পর্যন্ত স্পষ্ট চোখে পড়ছে। সমুখের ওই গিরিচূড়াটা পর্যবেক্ষণ করতে রাডার লাগছে না; খোলা চোখেই সব কিছু লক্ষ করা যাচ্ছে। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে একটা সুকোমল সবুজ মেরুজ্যোতি। সে যেন চুইয়ে পড়ছে ওই আলগা হালকা মেঘপুঞ্জ থেকে, যা বহু লক্ষ বছর ধরে ক্রমাগত পাক খাচ্ছে শুক্রের শূন্যদেশে।
আলোটা সবুজ, দূরের জিনিস সব কিছুই কুয়াশায় অস্পষ্ট। মাঝে মাঝেই মতিভ্রম হয়— আমরা কি জলের তলায় চলছি-ফিরছি নাকি? এটা কি পাহাড়ের পিঠ? না, অগভীর কোনো সমুদ্রতল? জেরির তো একবার মনে হল— মাছের ঝাঁক সাঁতরে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে।
কিন্তু আষাঢ়ে ভাবালুতার প্রশ্রয় জেরি কখনো দেয় না। রূঢ় বাস্তবের দিকে সঙ্গীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই বলল ‘তাহলে বিমানে বলে পাঠাই যে আমরা ফিরে আসছি?’
‘আরে না না।’ ব্যস্ত হয়ে নিষেধ করলেন ডক্টর হাচিন্স, ‘একটু ভাবতে দাও আমায়।’
জেরি তাকাল দলের তৃতীয় সদস্যের দিকে। সে তাকানোর মানেই হল, ‘আপনি একটু বোঝান ডক্টরকে।’
কিন্তু এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ। খামখেয়ালিপনায় তৃতীয় সদস্য কোলম্যানও কম যান না হাচিন্সের চেয়ে। সে দুর্বার অনুসন্ধিৎসাকে খামখেয়ালি ছাড়া অন্য কিছু বলে ভাবতে পারে না ইঞ্জিনিয়ার মনিষ্যি কাঠখোট্টা জেরি। কোলম্যানেরও তা পুরোমাত্রায় আছে। হাচিন্সের মতো কোলম্যানও বিজ্ঞানী। দুই বিজ্ঞানীতে তর্কাতর্কির কুকুর-কুণ্ডলী অবশ্য লেগেই আছে সর্বদা। মতের মিল তাঁদের কখনো যদি দেখা যায়, তবে তা হল মাত্র ওই একটা বিষয়েই, ‘প্রাণ দিয়েও অভিযান সার্থক করব।’
‘দুটোই পাগল! বিজ্ঞানী মানেই হিতাহিতজ্ঞানহীন!’ মনে মনে মন্তব্য করে জেরি।
কিন্তু সে মন্তব্য মুখে প্রকাশ করার অধিকার তো জেরির নেই! একটা মৃদু প্রতিবাদ মাত্র করল সে, তাও অস্ফুট গুঞ্জনে! ওরই মারফতে নিজের বিবেককে সান্ত্বনা দিয়ে তারপর সে স্থির হয়ে বসে রইল, হাচিন্সের ভাবনা কখন শেষ হবে, তারই প্রতীক্ষায়।
ক্ষুদে একটুখানি কেবিন ‘এস-৫’-এ। তারই ভিতর পায়চারি করছেন হাচিন্স, আর কখনো দাঁড়িয়ে পড়ছেন দেয়ালে ঝোলানো কোনো চার্টের সমুখে, কখনো-বা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন তাকে সাজানো কোনো যন্ত্রপাতি। হঠাৎ গাড়ির সন্ধানী আলোটার মুখ তিনি ঘুরিয়ে দিলেন সমুখের গিরিশিখরের দিকে, আর দূরবিন চোখে লাগিয়ে তার আগাপাস্তলা পরীক্ষা করতে লাগলেন তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে।
কোলম্যান সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন, কখন হাচিন্স তাঁর হাতেও একবার দূরবিনটা দেবেন।
আর জেরি? সে ভয়েই তটস্থ; এখনই বুঝি হাচিন্স তাকে হুকুম করে বসেন ওই শিখরের গা বেয়ে উপরপানে গাড়ি চালিয়ে দিতে! বিজ্ঞানী তো! বিশ্বাস নেই ওঁদের, ওঁরা হয়তো ভুলেই যাবেন যে এস-৫ একখানা গাড়ি মাত্র, পাহাড়ে ছাগল সে নয়।
হঠাৎ গলা দিয়ে এক ঝলক হাওয়া বার করে দিলেন হাচিন্স সশব্দে, আর কোলম্যানকে বললেন, ‘দ্যাখো, দ্যাখো, ওই কালো দাগটার ঠিক পাশে! কী দেখছো, বলো তো!’
দূরবিনটা কোলম্যানের হাতে তুলে দিলেন ডক্টর।
এবার হাঁক করে ওঠার পালা কোলম্যানের।
‘জব্দ! ডাহা জব্দ হয়ে গেলাম সত্যি!’ অবশেষে বললেন তিনি, ‘ঠিকই তুমি বলেছিলে ডক্টর! আছে, নদী আছে শুক্র গ্রহে। শুকনো বটে, কিন্তু ওটা জলপ্রপাত ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারে না।’
‘তা হলে স্বীকার করছো যে বাজি তুমি হেরেছ? কম্ব্রিজে ফিরব যখন, বেল গুর্মেটে খাওয়াতে হবে একটা ডিনার। শ্যাম্পেন সমেত—।’
কোলম্যান খুশি হবেন কেমন করে? বাজি হেরে কে কবে খুশি হয়? বিশেষ করে হেরে যাওয়ায় দরুন যদি নগদ গচ্ছা দিতে হয়? বিরস বদনে তিনি বললেন, ‘মনে করিয়ে না-দিলেও চলবে। কিন্তু নদীর কথা ছাড়াও অন্য অনেক কথা বলেছ তুমি। সেগুলো এখনও প্রলাপের পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে, তা মনে রেখো।’
জেরি আর চুপ করে থাকতে পারল না। দুই বিজ্ঞানীর কথার মাঝে সে বলে উঠল, ‘এ সব কী বলছেন আপনারা? নদীর কথা? জলপ্রপাতের কথা? ওসব যে শুক্রে থাকতে পারে না, তা তো শিশুরাও জানে! গ্রহটা তো গরম বাষ্পে তুর্কি হামাম হয়ে আছে। এখানে মেঘ কখনো এমন জমাট বাঁধে না, যা থেকে বৃষ্টি হতে পারে।’
হাচিন্স একেবারে ভিজে বেড়ালের মতো নিরীহ। অতিমাত্রায় বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘থার্মোমিটারের দিকে শেষ কবে তাকিয়েছিলে?’
‘তা, কয়েক দিনই হল বোধ হয়।’ স্বীকার করতে বাধ্য হয় জেরি। যদিও তার মন্তব্যের সঙ্গে থার্মোমিটারের যোগাযোগটা কোথায়, হঠাৎ তা বুঝে উঠতে পারে না।
‘তাহলে একটা খবর দিই, শোনো।’ জবাব দিলেন ডক্টর, ‘তাপ নেমেছে দু-শো ত্রিশে, আরও নামছে, নামবে। এই কয়েকটা কথা মগজে আনবার চেষ্টা করো, প্রথমত আমরা প্রায় মেরুতে এসে গেছি, দ্বিতীয়ত কালটা শীত ঋতু, তৃতীয়ত, সমতল থেকে আমরা ছয় হাজার ফুট উপরে আছি এখন। হাওয়াতে শীতের কামড় টের পাচ্ছো না? তাপ যদি আর কয়েকটা ডিগ্রি কমে, বৃষ্টি হবে। জল যা ঝরবে, তা ফুটন্ত গরম বটে, তবু জল। জর্জ কোলম্যান স্বীকার করুন বা না-করুন, শুক্র সম্পর্কে আমাদের সব ধারণা উলটে যেতে বসেছে এইবার।’
‘কেন? কেমন করে?’ জেরি জিজ্ঞাসা না-করে পারে না, যদিও সে আগেই আন্দাজ করতে পেরেছে যে, তার প্রশ্নের উত্তরটা হবে কী!
উত্তর হল এই— যেখানে জল, সেখানেই জীবন। যেহেতু শুক্রের গড়পড়তা উত্তাপ হল পাঁচ-শো ডিগ্রির উপরে, আমরা একথা গোড়া থেকেই ধরে নিয়েছি যে, গ্রহটা অবশ্যই হবে নিষ্প্রাণ। কিন্তু এখানে এসে অবধি দেখছি যে, শুক্রের অন্তত এই অংশটা অনেকটা ঠান্ডা। সেই কারণেই, মেরুতে পৌঁছোবার জন্য এত ব্যস্ত আমি। এই পার্বত্য অঞ্চলে হ্রদ-টদ আছে হয়তো, দেখতে চাই তাদের।’
‘কিন্তু জল যদি পড়েও কখনো—’ তর্ক তোলেন কোলম্যান, ‘ফুটন্ত জলে কোনো প্রাণী বাঁচবে?’
‘আমাদেরই পৃথিবীতে অনেক সামুদ্রিক উদ্ভিদ আছে, যারা ফুটন্ত জলে বাঁচতে পারে।’ জবাব দিলেন হাচিন্স, ‘গ্রহান্তর নিয়ে গবেষণা শুরু করবার পরে প্রথম যে তথ্যটি আমরা জেনেছি, তা হল এই যে, প্রাণশক্তির টিকে থাকা যেখানে সম্ভব, সেইখানেই উদ্ভব হবে প্রাণীর। শুক্রেও সে সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে যেন!’
‘তোমার ধারণাটা সত্যি কিনা যাচাই করে দেখতে পারলে ভালো হত।’ বললেন কোলম্যান, ‘কিন্তু দেখছোই তো, যাচাই করা সম্ভব নয়। গাড়ি তো পাহাড়ে উঠবে না।’
‘না, গাড়ি উঠবে না।’ স্বীকার করলেন হাচিন্স, ‘কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই উঠতে পারব। এই তাপ নিবারক পোশাক পরেও পারব। মেরুর দিকে কয়েকটা মাইল মাত্র হাঁটা পথ। রাডারে যে ম্যাপ ধরা পড়েছে, তাতে তো দেখা যায়, পাহাড়ের মাথায় উঠতে পারলে তারপরে জমিনটা প্রায় সমতল। ধরো, মেরুতে পৌঁছোতে ঘণ্টা বারো লাগুক? এর চেয়েও খারাপ পরিবেশে, বারো ঘণ্টা কেন, বাইশ ঘণ্টাও আমরা বাইরে বাইরে কাটিয়েছি অনেক সময়।’
কথাটা ঠিক। পৃথিবীতেও ‘ডেথ ভ্যালি’ আছে। তার চেয়ে মাত্র এক-শো ডিগ্রি বেশি গরম এই শুক্রের সমতলে। সেই ডেথ ভ্যালিতে মানুষ থাকে তো! তাপনিবারক পোশাক না-পরেই টিকে থাকে। শুক্রে তবে তাপহরণ পোশাক পরে—’
কোলম্যান কাজের কথা পাড়লেন এইবার, ‘নিয়ম হল এই যে, একা কেউ কোথাও যাবে না। আবার সবাইয়ের যাওয়ারও উপায় নেই, গাড়ির কাছে একজন থাকা চাই। তাহলে লটারি করতে হয়, কে যাবে তোমার সাথে, কেই-বা থাকবে এখানে। কীসের লটারি করা যায়, বলো দেখি! দাবা, না তাস?’
‘দাবার সময় লাগবে ঢের।’ মাথা নাড়লেন হাচিন্স। চার্টের টেবিল থেকে পুরোনো তাস এক সেট টেনে নিয়ে এসে জেরিকে বললেন, ‘ফাটো হে!’
জেরি টেনে বার করল ইস্কাবনের দশ।
‘তুমি নিশ্চয় ওর উপরে থাকবে জর্জ।’ শুভেচ্ছা জানালেন ডক্টর।
‘ধুত্তোর! চিড়েতনের পাঞ্জা!’ কোলম্যান মুখটা বিকৃত করে বললেন, ‘শুক্রের প্রাণীদের আমার নমস্কার দিও হে জেরি।’
হাচিন্স বলেছিলেন বটে যে, পাহাড়ে ওঠা শক্ত হবে না এমন কিছু। কিন্তু কার্যকালে অন্যরকম দেখা গেল। খাড়াই যে খুব বেশি তা নয়, কিন্তু বোঝা তো বইতে হচ্ছে কম না। অক্সিজেনের সরঞ্জাম, তাপ নিবারক পোশাক এবং অবশ্যপ্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, সবে মিলিয়ে মাথাপিছু এক-শো পাউন্ড অন্তত বইতে হচ্ছে। সে অবস্থায় চড়াই ওঠা, পরম শত্রুকেও যেন এমন বিপদে না পড়তে হয় কখনো।
অভিকর্ষ কম। পৃথিবীর তুলনায় শতকরা তেরো ভাগ কম। তার দরুন একটু সুবিধা অবশ্যই রয়েছে; কিন্তু সেই জলের তলার মতো গোধূলি আলোতে কখনো পাথরের গা বেয়ে উঠছি টিকটিকির মতো, কখনো একটু আলিশার মতো বাড়ন্ত পাথর ধরে হাঁফ ছেড়ে নিচ্ছি এক মিনিট। তারপরই আবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি উপরের কোনো অবলম্বন আঁকড়ে ধরার জন্য— সবে মিলিয়ে সে যেন একটানা দুঃস্বপ্ন একটা। কিন্তু মরি মরি! ওই সবুজ আলোটা! আকাশ বাতাস সব কিছুকে ম্লান করিয়ে দিচ্ছে যেন! পৃথিবীর চাঁদের আলো এর কাছে কোথায় লাগে? জেরি ভাবে, শুক্রের চাঁদ নেই, তার জন্য দুঃখও নেই। এখানে চাঁদ করত কী? মেঘের আড়ালে ঢাকাই থাকত চিরদিন। আর তা না থাকলেও এই মেরুজ্যোতির কাছে সে চাঁদের আলো দাঁড়াতেই পারত না। তা ছাড়া, সমুদ্রও তো নেই এখানে যে, তাতে জোয়ার-ভাটা খেলবে সেই চাঁদের আকর্ষণে!
দুই হাজার ফুট উঠবার পরে তবে একটু সোয়াস্তি পেলেন আরোহীরা। এর উপরে আর চড়াই নেই তেমন, যা আছে— তাকে বলা যায় ঢালু সমতল একটা। সেই সমতলের বুক চিরে চিরে এমনসব খাত রয়েছে চারিদিকে, বহতা জল ছাড়া অন্য কিছুর দরুন যাদের সৃষ্টিই হতে পারত না। খানিকটা পরেই তাঁরা এমন একটা খাত আবিষ্কার করলেন, প্রসার বিচার করে যাকে অনায়াসে নদী নাম দেওয়া যেতে পারে।
ওই খাত ধরে কয়েক-শো গজ চলবার পরে জেরি বলল, ‘একটা কথা ভাবছি ডক্টর! হঠাৎ ঝড় ওঠে যদি? আপনিই-না বলছিলেন যে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে? গরম জল মাথার উপরে তোড়ে নামছে আকাশ থেকে— এ কল্পনাতে আনন্দ নেই।’
বিরক্ত হয়ে হাচিন্স জবাব দিলেন, ‘ঝড় যখন আসবে, জানান দিয়ে আসবে হে! আগে তার আওয়াজ উঠবে একটা, আমরা উঁচু পাহাড়ে উঠে পড়বার সময় পাব।’
হাচিন্স হয়তো ঠিকই বলেছেন, কিন্তু জেরি বেচারি কোনো আশ্বাস পাচ্ছে না তাঁর কথায়। পাহাড়ের গা ছেড়ে এই সমতলে ঢুকবার পর থেকেই রেডিয়োর যোগাযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তারা। সাথিদের সঙ্গে সংস্রব কেটে যাওয়া এরকম স্থানে খুব মারাত্মকই হয়ে উঠতে পারে। এরকম অবস্থা আগে আর কখনো হয়নি জেরির।
মর্নিং স্টারে যতক্ষণ তারা ছিল, পৃথিবী থেকে দশ কোটি মাইল দূরে এসেও মনে হত আত্মীয়পরিজনরা এখনও নাগালের মধ্যেই আছে। রেডিয়ো মারফত দুই-চার মিনিটের মধ্যেই তাদের কাছে নিজের খবর পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হত, অথবা পেতে পারা যেত তাদের কুশলবার্তা। কিন্তু এখন? কয়েক গজ চড়াই তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে বাদবাকি মানবজাতির থেকে। এখানে যদি তাদের ভাগ্যে কিছু ঘটে যায়, কেউ জানতেও পারেবে না তা। যদি-না ভবিষ্যতে কোনো নতুন অভিযান তাদের মৃতদেহ আবিষ্কার না-করে— এই পর্বতচূড়ার শুকনো নদীর খাতে এসে।
জর্জ কোলম্যান? তিনি আসছেন না খোঁজ নিতে। তিনি এস ৫-এ বসে আছেন। নির্দিষ্ট কয়েকটা ঘণ্টা থাকবেন বসে। তার মধ্যে হাচিন্স আর জেরি ফিরে না-গেলে টহল গাড়ির মুখ ফিরিয়ে তিনি ফিরে যাবেন মর্নিং স্টারে। ব্যস!
মেরুর দিকে তিন মাইল অগ্রসর হওয়ার পরে হাচিন্স আবার দেখলেন থার্মোমিটার, ‘আরও নেমেছে তাপ। এক-শো নিরানব্বই এখন। শুক্রের পিঠে এত কম উত্তাপের কথা এর আগে শোনেনি কেউ। চেষ্টা করে দেখো না জেরি, জর্জকে খবরটা জানানো যায় কি না রেডিয়োতে।’
জানানো যে যাবেই না, জেরি তা সুনিশ্চিতভাবে জানে। তবু ডক্টরের কথায় সে চেষ্টা শুরু করল। এস ৫-এর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা তো বটেই— দূরবর্তী মর্নিং স্টারের সঙ্গেও। এ গ্রহের ঈথার তরঙ্গে আরোহ-অবরোহ কোথায় কী আছে, তা তো জানা নেই তেমন! হয়তো নিকটের চাইতে দূরের কোনো বিন্দুতে সাড়া জাগানো সহজ হতেও পারে।
কিন্তু কই? কোথায় ঝড় শুরু হয়েছে কে জানে, তারই আওয়াজ ছাড়া অন্য কিছু কানে আসে না। শব্দবাহী তরঙ্গ একটাও ধরা পড়েনি যন্ত্রে।
যাক। না হল নেই। হাচিন্স এগিয়ে চলেছেন আবার। হঠাৎ তিনি থেমে পড়লেন এক জায়গায়, কয়েকটা যন্ত্র নিয়ে কয়েক মিনিট নাড়াচাড়া করে বলে উঠলেন, ‘কী দেখলাম জানো জেরি? অক্সিজেনের পরিমাণ এখানকার হাওয়ায় বেশি। দশ লক্ষে পনেরো ভাগ। টহল গাড়িতে পেয়েছিলাম পাঁচ ভাগ, সমতলে তো মোটে আভাসই পাইনি বলতে গেলে।’
জেরি নাক সিঁটকে বলল, ‘পনেরো? তাতেই আপনি এত উৎফুল্ল? এক মিলিয়নে পনেরো? পনেরো ভাগ অক্সিজেনে কেউ শ্বাস নিতে পারে না কি?’
হাচিন্স রেগে উঠলেন, ‘তুমি একটা আস্ত গবেট। শ্বাস কে নিতে যাবে? অক্সিজেন তৈরি হচ্ছে— এইটিই হল বড়ো কথা। তৈরি করছে কেউ-না-কেউ। পৃথিবীর কথাই ধরো। সেখানে অক্সিজেন আসে কোথা থেকে? জীবনী শক্তিসম্পন্ন কোনো কিছু থেকে। ধরো, বাড়ন্ত উদ্ভিদ থেকে। পৃথিবীতে যখন উদ্ভিদ জন্মায়নি, সেখানকার হাওয়াও ঠিক এই শুক্রের মতোই ছিল। কার্বন ডাই অক্সাইড, অ্যামোনিয়া আর মিথেনের একটা জগাখিচুড়ি মাত্র। তারপর উদ্ভিদ জন্মাল, উদ্ভিদই হাওয়াকে এভাবে পালটে দিল আস্তে আস্তে যে, একদিন তা জীবের শ্বাস নেবার যোগ্য হয়ে উঠল।’
‘ওঃ, তাই বুঝি?’ বললে জেরি, ‘সে প্রক্রিয়া শুক্রেও শুরু হয়েছে, বলছেন?’
‘মনে তো হয়, তাই।’ উত্তর দিলেন হাচিন্স, ‘কোনো কিছু জিনিস যে অতি নিকটেই অক্সিজেন তৈরি করছে, সন্দেহ নেই তাতে। আর, সে কোনো উদ্ভিদ ছাড়া আর কিছু কী হতে পারে?’
জেরি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘তা যদি হয়, উদ্ভিদের পরবর্তী ধাপই হবে জীব, না কি বলেন?’
যন্ত্রপাতি গুটিয়ে তুলে হাচিন্স বললেন, ‘অবশ্যই। তবে কিনা, জীবের আবির্ভাব হতে আরও কয়েক কোটি বছর লেগে যেতে পারে এখনও।’
আরও কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সব জল্পনার শেষ হল ওঁদের। সমুখে বিশাল এক হ্রদ। অনন্ত বারি সম্ভার নিয়ে কত দূরে দূরে যে প্রসারিত রয়েছে, তা চর্মচক্ষে ঠাহর পাওয়া যায় না। কিন্তু—
কথায় বলে জলই জীবন। কিন্তু এ হ্রদের জল দেখে জীবনের বদলে জেরির যা মনে পড়ল, তা হল মরণ। কালো একখানা দিগন্তবিস্তারী দর্পণ যেন পড়ে আছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে জড়িয়ে। দিগন্তসীমায় রাশি রাশি কুয়াশা, ভূতুড়ে বাষ্পের ধোঁয়াটে স্তম্ভ সারি সারি নৃত্য করছে জলের উপরে, ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে। এ কি বৈতরণী না কি? খেয়া নিয়ে আসবে চেরন১ এক্ষু নি? হাচিন্স আর জেরিকে ইহলীলা থেকে রেহাই দিয়ে ভবপারে নিয়ে যাওয়ার জন্য?
হাচিন্স একটা শিশিতে হ্রদের জল ভরে ফেললেন খানিকটা, বিমানে গিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে ওই জলের।
উনি জল নিয়ে ব্যস্ত, জেরি বলে উঠল, ‘ওটা কী ব্যাপার বলুন তো?’
‘কোনটা?’ প্রশ্ন করলেন বটে হাচিন্স, কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা না-করেই সেদিকে এগিয়ে গেলেন দ্রুতপদে। হ্রদের ধারেই দুটো শিলাস্তূপ, দুটোর ভিতরকার ব্যবধান কমে আসছে তিলে তিলে। কোনো একটা-কিছু যেন বুজিয়ে দিচ্ছে ব্যবধানটা।
কী ও? মনে হয় যেন একটা কালো কার্পেট। এক প্রান্ত তার হ্রদের জলে নেতিয়ে নেমে এসেছে। কালোয় কালো মিশেছে কোন যে মিলন রেখায়, তা দূর থেকে বুঝবার জো নেই।
‘কার্পেট?’ জেরি হাঁইফাঁই করছে উত্তেজনায়, ‘কিন্তু কার্পেট কি আপনি আপনি বেড়ে যেতে পারে না কি? ওই দেখুন, দুটো পাথরের ভিতর ফাঁক আর নেই বললেই চলে!’
‘না, ফাঁক আর নেই।’ উত্তেজনা হাচিন্সেরও কম নয়। তবে সে উত্তেজনার সঙ্গে উল্লাস মিশিয়ে বলল, ‘ফাঁকটা গ্রাস করেছে ওই কার্পেট। না, কার্পেটও নয়, কার্পেট হলে বাড়ত না ওভাবে। ওসব হল উদ্ভিদ—’
‘উদ্ভিদ? উদ্ভিদ কি অত তাড়াতাড়ি বাড়ে না কি?’ ক্ষেপে ওঠে জেরি।
‘বাড়ে না, তবে নড়ে। নড়তে নড়তে ছড়িয়ে পড়ে। আইভি লতাকে নড়তে নড়তে ছড়িয়ে পড়তে দেখোনি পৃথিবীতে? সমুদ্রে একজাতীয় ক্ষুদে উদ্ভিদ আছে— প্ল্যাঙ্কটন, জানো অবশ্য। তাদের দেখোনি সাঁতার দিতে? কালো কার্পেট বলে যাকে ভুল করছো, তাই হল শুক্র গ্রহের প্রথম উদ্ভিদ— জীবনের প্রথম স্ফুরণ এই নিস্প্রাণ গ্রহে।’
জেরির দিকে আর না-তাকিয়ে সেই কার্পেটাকারের কালো উদ্ভিদপুঞ্জের দিকে দুই বাহু বাড়িয়ে ছুটে গেলেন হাচিন্স। তাঁর আনন্দের কি সীমা আছে আজ? তিনি আবিষ্কার করেছেন যে, শুক্রে জলও আছে, জীবনও আছে। হোক সে-জীবন একান্ত আদিম স্তরের, তবু তারই দৌলতে শুক্রের বন্ধ্যা অপবাদ আজ ঘুচে গেল। জীবধাত্রী বলে পৃথিবী আর মঙ্গলের সমপর্যায়ে সে উন্নত হল?
____
১ গ্রিক পুরাণের মতে বৈতরণীর মাঝি।