ভৌতিক কুকুর
মনটা খারাপ সদয় মজুমদারের। বোনের ঘর-সংসার সব ভেসে গিয়েছে বানের জলে। ভিটের উপর নাকি গলাজল।
চিঠি এসেছে সবে আজ সকালে। যদিও তাতে ওদিককার ডাকঘরের ছাপ রয়েছে সাত দিন আগের। পুষ্কুণ্ডি! নামটা শোনা আছে সদয়ের। বোনের গাঁ হল কুসুমপুর, সেখান থেকে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে। পুষ্কুণ্ডিতেই ওদের ডাকঘর বটে।
ভারত সেবাশ্রমের রিলিফই বাঁচিয়ে রেখেছে ওদের। তাঁরাই চাল, চিঁড়ে সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তাম্বু খাটিয়ে দিয়েছেন রেললাইনের গায়ে, চিঠি লেখার এই পোস্টকার্ডও তাঁদেরই দেওয়া। বিজয়া সব কথাই খুঁটিয়ে লিখেছে, সাধুবাবাদের কথা শতমুখে বলেও যেন তার তৃপ্তি হয়নি—
বোনটা বিধবা হয়েছে বছর পাঁচেক। ছেলে-মেয়ে আছে কয়েকটি, সবগুলিই বাচ্চা। এ অবস্থায়, সেই পাঁচ বছর আগেই সদয়ের উপর যদি সে চাপ দিত সাহায্যের জন্য, তাতে তার নিন্দে করতে পারত না কেউ। কিন্তু সে তা করেনি। কী করে চলছে, দুই একবার জানতে চেয়েছিল সদয়। তার উত্তরে সে লিখেছিল ভগবান চালিয়ে দিচ্ছেন।
অবশ্য সদয়েরও যে এমন কিছু একটা মোটা আয় আছে, তা নয়। বাবা কয়েক বিঘে ধান জমি রেখে যান, ভাগচাষিরাই তা চষছে চিরদিন।
একটা পেট সদয়ের, বিয়ে করেছিল, বউ মরে গেল ছেলেপুলে হবার আগেই। সদয় আর ও-ফ্যাসাদে যায়নি। এক বেলা নিজেই রাঁধে, তিন বেলা খায়।
মেঘা হল জাতে দোআঁশলা। কোনো কালে হয়তো বিলিতি রক্ত ছিল তার কোনো পূর্বপুরুষের গায়ে, তারই চিহ্ন ওই লম্বা লোম আর ভাঙা কান। সাদা রং, কলেবর এমন কিছু পুরুষ্টু নয়, কিন্তু রেগে গেলে যে ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ায়, তা ঠিক সিংহেরই মতো। ভীষণ তেজি, দুরন্ত একগুঁয়ে। একবার গাঁয়ে বাঘ ঢুকল যখন, একা তাকে তাড়া করল মেঘাই। অবশ্য তার পিছনে লাঠি কেনেস্তারা নিয়ে গাঁয়ের পালোয়ানেরাও কেউ কেউ গিয়েছিল। তা নইলে মেঘার বীরত্বের শোচনীয় পরিণামই হত সেদিন হয়তো।
বোনের বিপদের খবর পেয়ে কিছু একটা করা কর্তব্য মনে করছে সদয়। অথচ সঙ্গতি তার এমন-কিছু নেই। তবু মানুষ বলে যদি পরিচয় দিতে হয়। অন্যের কাছে না হোক, নিজের কাছেও দিতে হয় যদি, যাহোক একটা কিছু করতেই হবে।
সে যাহোক কিছুটা হল মাটির ভাঁড়ে একটি একটি করে জমানো কিছু টাকা। কত টাকা, সেখানে জমেছে, তাও হিসেব নেই সদয়ের। এ-ভাঁড়ের পত্তন করে যায় সদয়ের বউ, মাত্র কয়েক মাসের জন্য যে এসে আলো করেছিল এই ভাঙা কুঁড়ে। সেই থেকে এটাকে চালু রেখেছে সদয়। নিজের ভবিষ্যতের সুবিধার জন্য ততটা নয়। যতটা স্বর্গীয় স্ত্রীর স্মৃতি রক্ষার জন্য।
যখনি একটি টাকা জমেছে সদয়ের হাতে, অথচ অবশ্য করণীয় খরচা সমুখে কিছু দেখা যাচ্ছে না, তখনই সেই টাকাটিকে ভাঁড়ের ভিতরে নিক্ষেপ করেছে সদয়। মাঝারি আকারের ঘট একটি, মুখটাতে সরা চাপা দিয়ে উপরটা মাটি লেপে দেওয়া, মাঝখানে গলাবার মতো লম্বাটে ফোকর একটু। তক্তপোশের তলায় তোরঙ্গ আছে সদয়ের, সেই তোরঙ্গেরও তলায় আছে গর্ত মাটিতে। সেই গর্তে হল এই মূল্যবান ঘটের অধিষ্ঠান। তোরঙ্গ সহজে খোলে না সদয়, খুলবার দরকারই হয় না। ওতে সদয়ের নিজের ব্যবহারের কোনো জিনিসই নেই, আছে তার সেই বউ-এর কাপড়চোপড়—
বাক্স সে খোলে না, তবে কালেভদ্রে নাড়ে। অতি সাবধানে নাড়ে, ঘরের দরজা বন্ধ করে, মেঘাকে উঠোনে পাহারায় রেখে। বাড়িতে লোক ঢুকলেই মেঘা চেঁচিয়ে উঠবে, ঘরের ভিতরে সাবধান হয়ে যাবে সদয়।
দরজা বন্ধ করে তক্তপোশের তলায় মাথা ঢুকিয়ে দেবে, আধ শোয়া অবস্থায়। মাথা খাড়া করতে গেলেই তক্তপোশে ঠুকে যাবে। তোরঙ্গের এক পাশে একটা পিতলের গামলায় গোটাকতক বাটি-কুটি। আর এক পাশে একটা গঙ্গাজল-ভরা কলসি। তোরঙ্গের পিছনে একগাদা লোহালক্কড়, শাবল, কোদাল, কাটারি ইত্যাদি, যা কাজের বার হয়ে গিয়েছে বহুদিন আগে। সমুখে? তোরঙ্গের সমুখে থাকে শিল নোড়া এবং শিলের উপরে সাজানো সারি সারি টিনের কৌটো। তার কোনোটাতে একটু চিনি, কোনোটাতে চারটি সাগুদানা, কোনোটা একদম খালি।
এমন সুরক্ষিত ব্যূহের ভিতর সদয়ের তোরঙ্গটি থাকে যে পাঁচ মিনিট ব্যাপী টুং টাং ঘটাংঘট শব্দ না করে কারও পক্ষে তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয় কোনো দিক দিয়েই। পৌঁছানোর পর তোরঙ্গটি সমুখে টেনে এনে একপাশে সরিয়ে রাখতে হবে। তোরঙ্গের নীচে একখানা ভারী কাঠের পিঁড়ে ততক্ষণে আত্মপ্রকাশ করেছে। সেই পিঁড়ে হটাতে পারলে তবে পাওয়া যাবে সেই সুড়ঙ্গ, যার ভিতরে—
হ্যাঁ, তারই ভিতরে মাটির ভাঁড়ে টাকা আছে সদয়ের।
টাকা— এতদিনের একটি একটি করে জমানো টাকা আজ বার করল সদয়। মাত্র কয়েক মাসের পরিচিতা স্ত্রীর উদ্দেশে মিনতি জানাল—
‘তুমি খুশি হয়ে অনুমতি দাও। আমার বোনের বড়ো বিপদ—’ ভাঁড়ের মুখের মাটি ছুরি দিয়ে চেঁচে ফেলতে হল। সরাও তুলতে হল ছুরির মুখের চাড় দিয়ে। তারপর ভাঁড় উবুড় করল মেজেতে, সমুখে পিদিম রেখে। টাকা! টাকা শুধু! কাগুজে নোট হালে কিছু পড়েছে ভাঁড়ে, কারণ এখন আর রুপোর টাকা পাওয়া যায় না।
গুনে দেখা গেল টাকা আছে দু-শো সত্তর, আর নোট আছে বাইশ খানা। ওই নোটগুলো ভাঁড়ে আবার ভরল সদয়। বানের জলে যে-দেশ ভেসে গিয়েছে, সেখানে গিয়ে সাঁতারও দিতে হবে মাঝে মাঝে! আর তা যদি দিতে হয়, কাগুজে টাকার তো আদ্য শ্রাদ্ধ হয়ে গেল তক্ষুনি। থাকুক ও কয়টা ঘরে— চুরি হয়ে যায় তো যাবে।
কালই বেরোবে সদয়। পোস্টকার্ডের চিঠি আসতে সাত দিন লেগেছে। সেখানে মনি অর্ডার করলে মোটে কোনো কালে পৌঁছবে কিনা, সন্দেহ। তার চেয়ে টাকাটা নিয়ে সদয় নিজেই যাবে। সেটা দেখতে শুনতেও ভালো হবে, আর বিজয়া তাতে সাহসও পাবে যথেষ্ট। দেখে শুনে ওদের একটা বিলি ব্যবস্থা নিজেই করে দিয়ে আসতে পারবে সদয়, কিংবা ব্যবস্থা করার সুযোগ না দেখলে কিছু দিনের জন্য ওদের সঙ্গে করেও আনতে পারবে এখানে।
এখানে এসে তারা খাবে কী? কেন, ওই দু-শো সত্তর টাকা ভেঙেই খাবে। ও-টাকা তো ওদের নামেই উৎসর্গ করা হল, এখন তারা সেখানে বসেই খাক, আর এখানে এসেই খাক—
হঠাৎ কিন্তু মনে মনেই ভয়ানক চমকে উঠল সদয়। একথাটা আগে কি একবারও মনে হতে নেই? মেঘার কথাটা? মেঘা কার কাছে থাকবে? কিংবা, মেঘাকে আদৌ কারও কাছে রেখে যাওয়া সম্ভব হবে কি? এঃ, এত বড়ো কথাটা ভুল হয়ে গেল একেবারে? সংসারে যে জীবটা তার সবচেয়ে আপন, একমাত্র বন্ধন, তাকে হিসাবের ভিতরে না ধরেই সে বিদেশ যাত্রার মতো একটা মস্ত কাজে নামতে যাচ্ছে?
ঘর পাহারা দেবে নিতু মোড়ল। বিশ্বাসী ছোকরা। কিন্তু মেঘার পাহারা দিতে সে রাজি হবে না। মেঘা তাকে কামড়ে খেয়ে ফেলবে। সদয় যদি পালিয়ে যেতে পারেও ওকে ফেলে, ও নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে, যাকে পাবে তাকেই কামড়াবে, শেষপর্যন্ত নিছক প্রাণের দায়েই গাঁয়ের লোক ওকে ঠেঙিয়ে মেরে ফেলতে বাধ্য হবে।
এ তো বড়ো বিষম সংকট হল! দূরের পথ ওকে সঙ্গে নেওয়া শক্ত। রেলে খানিক, বাসে খানিক, বাদবাকি পথটা নৌকোয় যাওয়া যেতে পারে, নতুবা হেঁটে। তা রেল বা বাস, ভাড়া দিলেও ওরা কুকুর বোধ হয় তুলবে না গাড়িতে। উপায়?
ভেবে ভেবে ঠিক করল সদয়। হাঁটা পথে ও রাণাঘাট পর্যন্ত যাবে, কয়দিন লাগবে আর? দুই না হয় আড়াই দিন? তারপর চূর্ণি নদীতে নৌকো ধরবে একটা। নৌকোর মাঝি কুকুর নিতে অস্বীকার হয়তো করবে না। বিশেষ করে একটা টাকা ভাড়া যদি বেশি পায়।
চূর্ণি উজিয়ে গেলে কুসুমপুর থেকে ক্রোশ তিনেক দূরে গিয়ে নামা যাবে। সেখানে গিয়ে ক্ষেত্রে কর্ম বিধীয়তে। দরকার হলে সদয়ও সাঁতার দেবে, মেঘাও দেবে। এ ছাড়া উপায় যখন নেই আর—
মেঘাকে শিকল দিয়ে কস্মিনকালে বাঁধে না সদয়। আজ বাঁধতে বাধ্য হবে। রাস্তাঘাটে কখন কোনদিকে দৌড় মারে, ঠিক কী! হাজার হোক, জন্তু তো। গাঁ থেকে বেরোবার সময় ওর গলায় দড়িই পরিয়ে নেবে একটা। ভোর ভোর সময় তো বেরুচ্ছে সদয়! তখন কে আর দেখতে আসছে? তবে কেউ সত্যই দেখে যদি, সে ভয়ানক রকম অবাক হবে। মেঘার গলায় শিকল যে ধারণাতীত জিনিস!
পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় সদয়-মেঘাকে দেখা গেল কাঁচড়াপাড়ার ও পিঠে। এখন আর মেঘার গলায় দড়ি নেই, শিকলই একটা বারাকপুরে কিনে নিয়েছে সদয়। খুব আস্তে আস্তেই হাঁটতে হয়েছে, কারণ লম্বা দূরত্ব পয়দলে পাড়ি দেওয়ার দরকার সদয়েরও হয় না কোনোদিন, মেঘারও না। অল্পেই হয়রান হয়ে পড়েছে দু-জনেই। দুপুরে খাওয়ার সময়ে অস্পৃশ্যের মতো উঠোনে বসে খেতে হয়েছে সদয়কে, কারণ মেঘা আর সে একসাথে পাশাপাশি বসে খাবে, এই ওদের রীতি। আজ হঠাৎ তার অন্যথা করতে গেলে মেঘা অনর্থ বাধাবে। ছুটে এসে খাবার ঘরে ঢুকে অন্য খদ্দেরের খাওয়া পণ্ড করে দেবে।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। কোথায় রাত কাটানো যায়? সদয় ভেবে দেখল—কাছাকাছি রেলস্টেশন যেটা পাওয়া যাবে, তারই ওয়েটিং রুমে আশ্রয় নেওয়া ভালো। ‘কাল সকালের গাড়ি ধরব’ বললে আপত্তি হওয়ার কথা নয় রেলের বাবু বা খালাসিদের। তবে ওই কুকুর? যাহোক, তার ব্যবস্থা করা শক্ত হবে না। সব কিছু দোষ ত্রুটি ‘কাঞ্চনমূল্যেণ শুধ্যতি’— এ নীতিবাক্য বাক্য হিসাবে জানা না থাকতে পারে সদয়ের, অভিজ্ঞতা হিসাবে নিশ্চয়ই জানা আছে।
বড়ো রাস্তা থেকে একটা অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তা ডাইনে বেরিয়ে গেছে। মোড়ের চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করে সদয় শুনল— ওই রাস্তাই সোজা গিয়ে রেলস্টেশনে উঠেছে, আধ মাইলটাক দূরে। এক পেয়ালা চা খেয়ে নিয়ে একটা ন্যাড়া বিস্কুট মেঘাকে কিনে দিল সদয়। আর কিনে নিল ওই দোকান থেকেই এক কোঁচড় মুড়ি। রাতের খানা ওই, সদয়েরও মেঘারও।
মুড়ি কোঁচড়ে বেঁধে মেঘার গলার শিকল বাঁ-হাতে ধরে সদয় ধীরে চলেছে। রাস্তা কিছু মন্দ নয়। বর্ষাকাল হলেও কলকাতার বড়ো বড়ো রাস্তার মতো এতে বিশাল বিশাল গর্ত তত নেই। পাশে বাড়িঘর দোকানপসারও যেমন আছে তেমনি আছে ঘেরা বা না ঘেরা বাগানও। এক-একটা বাগানকে জঙ্গল বললেও মানহানির দায়ে পড়বার আশঙ্কা নেই।
এমনি একটা জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলবার সময় হঠাৎ মেঘা, ভৌ-উ-উ রবে হুংকার করে উঠল। এ-রকম ডাক গাঁয়ে ঘরে সে সারারাতই মাঝে মাঝে দেয়, কারণ শেয়ালের আনাগোনা সেখানে লেগেই আছে। এখানেও সেই শেয়ালই হবে— বা! সদয় বিশেষ গুরুত্ব দিল না মেঘার হুংকারকে।
জায়গাটা বিশ্রী। ডাইনে তো নিবিড় জঙ্গল বটেই, বাঁয়েও বসতি নেই। একটা আবাদি মাঠ, কিন্তু রাস্তার ধার দিয়ে সেদিকে বড়ো বড়ো দুটো বট গাছ রয়েছে, ডালপালাতে গোটা রাস্তাটাকে অন্ধকার করে। আলো? তেলের আলো এ-রাস্তায় আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের কাচে এত পুরু হয়ে কালি জমেছে যে দুই তিন হাতের চেয়ে বেশি জায়গা সে-আলো থেকে তিলমাত্র উপকার পায় না।
ভৌ-উ-উ-উ! মেঘা প্রাণপণে শিকল টানছে। সদয়কে সুদ্ধই বুঝি টেনে নামাবে ওই মাঠের ভিতরে। আর শিকল ছেড়ে দেওয়ার কথা তো কল্পনাই করতে পারে না সদয়। তাহলে আর সারারাত্রেও মেঘার লেজও ধরতে পারা যাবে না। সারা মাঠে, গোটা জঙ্গল সে চষে বেড়াবে শেয়ালের পিছনে।
‘কোথায় যাবেন?’—আওয়াজটা ঠিক পিছনে—
কী মোটা গলা! রাস্তায় জনমানব ছিল না ডাকের মাথায়। হঠাৎ এ মূর্তি কোথা থেকে এল? ঝটিতি মুখ ফিরিয়ে সদয় দেখল একটা নয়, দুটো ছায়ামূর্তি দেখা যায়। দুটোই তার পিছনে বটে কিন্তু একটা রাস্তার বাঁ-পাশ ঘেঁসে, অন্যটা ডান-পাশ।
‘কোথায় বাড়ি?’—প্রশ্ন করল দ্বিতীয় লোকটাও। এর গলা আবার বিশ্রী রকম মিহি, হঠাৎ শুনলে মনে হবে— মেয়েছেলে কথা কইছে কেউ—
‘বাড়ি এখানে নয়, ইস্টেশনে যাব’— সদয়ের ভালো লাগে না লোক দুটোর ধরনধারণ। অনেক লোকের সঙ্গেই দেখা হয়েছে এই গলিটাতে এযাবৎ, এই মুহূর্তে তারা কেউ কাছাকাছি নেই। কেউ নিজের বাড়িতে ঢুকেছে। কেউ পাশ কাটিয়ে কোনো কুচো-গলিতে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। শুধু এই লোক দুটো। যাদের এতক্ষণ সে কোথাও দেখতে পায়নি হঠাৎ যেন ঝুপ করে আকাশ থেকে নামল এসে। কী জানি কী এদের মতলব—
ওদিকে মেঘাকে সামলানো যাচ্ছে না। সে শিষ পা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে, সে ঝাঁপ খাচ্ছে সমুখের হাওয়ার উপরে, দাঁত বার করছে, ভৌ-উ-উ ডাকে সরগরম করে তুলছে মাঠ জঙ্গলের রাতের আকাশ।
‘পয়সাকড়ি কী আছে স্যাঙাত!’— বিনা ভূমিকায় প্রশ্ন করে মোটা গলা।
মিহি গলা থেকে তীক্ষ্ন পঞ্চম সুর বেরিয়ে আসে— ‘কুকুরটা তো বড্ড জ্বালালে—’
ততক্ষণে সদয় দুই এক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তার কাঁধার দিকে। মনোযোগ ষোলো আনাই এই পথিক বন্ধু যুগলের উপর নিবদ্ধ বলে মেঘার রাশ আর ঠিকমতো টেনে রাখতে পারেনি। শিকল ফসকে গিয়েছে হাত থেকে, আর সঙ্গেসঙ্গে এক বিকট চিৎকার করে মেঘা ঝাঁপিয়ে পড়েছে মিহি গলার উপরে। আত্মরক্ষার জন্য হাত তুলেছিল সে, কামড় বসিয়েছে সেই হাতে— ‘উ-হু-হু-উ, ওরে বাবা—’ পালটা চিৎকার ছেড়েছে লোকটা।
এদিকে মোটা গলা দুই পা এগিয়ে একেবারে সদয়ের মুখের উপরে তুলেছে পিস্তল। ‘খবরদার, চেঁচিয়েছ কী মরেছ—’
সদয়, জীবনে যে চড়টা চাপড়টাও মারেনি কাউকে ছেলেবেলার খেলার সাথীদেরও না, সেই চির নিরীহ সদয় আজ করে বসল এক কীর্তি। এক উন্মাদ কল্পনা পেয়ে বসল তাকে। ওই পিস্তল কেড়ে নিতে হবে ওই লোকটার কাছ থেকে, তা নইলে হয় জীবন যাবে, নয়তো যাবে গেঁজের টাকার থলে। এ দুটোর একটাকেও কিন্তু যেতে দিতে রাজি নয় সদয়। জীবনটা দরকার তার নিজের বাঁচবার জন্য, আর টাকাটা দরকার তার বোনকে আর বোনের বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে বাঁচাবার জন্য।
নৈরাশ্যই জোগায় দুঃসাহস। ‘মেঘা, দেখিস’ বলে এক চিৎকার ছেড়ে দিল লাফ সদয় ওই মুসকো দস্যুটার উপরে। আশা ছিল, আচমকা ধাক্কা খেয়ে ওটা উলটে পড়বে। পড়তও যেকোনো সাধারণ মানুষ। কিন্তু মাকলু গুন্ডা কোনো দিক দিয়েই সাধারণ মানুষ নয়। তার নিষ্ঠুরতা অসাধারণ তার বজ্জাতিবুদ্ধি অসাধারণ, সর্বোপরি দেহের শক্তি তার অসাধারণ। সেই শক্তির দৌলতেই, একটুখানি টাল খেয়েও সে সোজা দাঁড়িয়ে রইল এবং—
একটা অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে। দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে ফায়ার করে দিল হাতের পিস্তল। গুলি ঠিক কপাল ফুঁড়ে মগজে গিয়ে বিঁধল সদয়ের। সে পড়ে গেল সেই রাস্তার কাঁধার আগাছার ঝাড়ে।
ওদিকে মাকলুর দোস্ত কাবলু— সে কিন্তু হাত কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না মেঘার কামড় থেকে। হাতটা আবার ডান হাত। বাঁ-হাতে একখানা বড়ো ভোজালি ধরা থাকলেও তা দিয়ে আঘাত করতে সুবিধে পাচ্ছে না সে। গলা যেমন তার মিহি, বুদ্ধিও তার তেমনি। হাতের ভরসা ছেড়ে দিয়ে সে ল্যাং মারতে লাগল মেঘাকে।
ছয় ফুট লম্বা কাবলুর হাতের নাগাল পাওয়ার জন্য একদম খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হয়েছে মেঘাকে, পিছনের দু-খানা পা ভুঁই ছুঁয়ে ছিল কোনোরকমে। কাবলুর লাথি এসে সেই পায়ে পড়তেই সে ছিটকে পড়ল তিন হাত দূরে। কিন্তু পড়বার সময়ে মস্ত এক খাবলা মাংস বেমালুম তুলে নিয়ে গেল কাবলুর ডান হাত থেকে।
সুতরাং সে হাতে ভোজালি চালানোর আশা আগের চাইতেও এখন সুদূরপরাহত হয়ে দাঁড়াল কাবলুর পক্ষে। সে চিঁ চিঁ করতে লাগল— ‘কুকুরটাকে গুলি খাওয়া একটা মাকলু! কুকুরটাকেও খাওয়া একটা—’
মাকলু তখন সদয়ের কোমর থেকে গেঁজ খুলতে ব্যস্ত, হঠাৎ সে উঠে আসে কেমন করে? হাত চালাতে চালাতেই সে খেঁকিয়ে উঠল— ‘অকম্মার ঢেঁকি, একটা কুকুরকে সামলাতে পারিস না—’
কাবলুও হয়তো খেঁকিয়েই কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তা না করে সে পিন পিন করে চেঁচিয়ে উঠল— ‘হুঁশিয়ার—’
হুঁশিয়ারির কারণ ছিল। মাকলুর গলা শুনেই ভূশায়ী মেঘা তার দিকে তাকিয়েছে, এবং তাকাতেই তার সমুখে দেখেছে একটা নিঃসাড় নরদেহ। অনুমানেই সে বুঝে গিয়েছে যে ওই দেহ তার মনিবের না হয়ে যায় না, সে একটা গর্জন ছাড়ল, জিঘাংসা আর কান্না যার ভিতর সমানভাবে মেশানো।
কাবলু হুঁশিয়ার হতে বলেছে তাকে, কিন্তু হুঁশিয়ার হওয়ার সময় পায়নি মাকলু। বটগাছের একখানা ডাল যেন ভেঙে পড়ল হঠাৎ তার কাঁধে। অবশ্য জিনিসটা যে ডাল নয়, জ্যান্ত কুকুরটা, তা এক সেকেন্ড আগের ওই গর্জনটা কানে গিয়েছিল বলেই, বুঝতে তার কষ্ট হল না।
মেঘা এসে পড়েছে মাকলুর কাঁধে, কিন্তু মাকলু তো আর কাবলু নয়! বুনো মোষের কায়দায় এমন মাথা ঝাড়া দিল সে, এমন বেগে, যে দড়াম করে মেঘা পড়ে গেল মাটিতে, আর মাকলু সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে— ভ্যাক—
পিস্তল ডেকে উঠল মাকলুর। মেঘা এক দৌড়ে যমের দোরে গিয়ে সদয়কে ধরে ফেলল।
‘থাক, দুটোতে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাক ‘— সদয় তো রাস্তার কিনারেই পড়ে ছিল, ঝোপঝাড়ের ভিতর। মেঘাকেও টানতে টানতে তার কাছে নিয়ে গেল মাকলু। মেঘার গলার শিকল দিয়েই মেঘাকে বাঁধল সদয়ের হাতের সঙ্গে। মরা কুকুরকে বাঁধবার কী দরকার আছে, হাতের-যাতনায় অধীর কাবলু সে-প্রশ্ন করল না, আর করলেও হঠাৎ কোনো জবাব হয়তো দিতেই পারত না মাকলু।
প্রয়োজনের তাগিদে সে বাঁধেনি, তাগিদটা বোধ হয় ছিল একটা রসিকতা করবার, অতি কদর্য, নৃশংস, একটা রসিকতা।
মাকলু কাবলুকে পরদিন বিকালে দেখা গেল কেষ্টনগরের এক হোটেলে। কাবলুর ডান হাতে একটা লম্বা ব্যান্ডেজ।
বেলা হবে গোটা চা’রেক। দাশু গোলন্দাজের হোটেল। দাশু ডাকসাইটে গুন্ডা ছিল এককালে। কথায় কথায় গুলি চালাত এমন, যে লোকে ওর নামই দিয়েছিল গোলন্দাজ। এমনি চালাতে চালাতে একদিন এক দুশমনকে গুলি করতে গিয়ে দৈবাৎ মেরে ফেলে নিজের মেয়েকে।
এরপর গুন্ডামি ছাড়ল, করল এক হোটেল। গুন্ডামি ছাড়ল মানে নিজের হাতে খুনজখম আর করে না। কিন্তু এ তল্লাটে গুন্ডা দস্যু লুটেরা সবাইয়ের সাথেই এখনও এন্তার দহরম-মহরম আছে তার। ওর এই হোটেলটাই তাদের সদর সেরেস্তা। রাস্তার ধারের দুটো কামরা সর্বসাধারণের পানাহারের জন্য। ভিতরের দুটো দোর জানলাহীন ঘর, বিশেষ বিশেষ মক্কেলের জন্য সংরক্ষিত।
দোর এবং জানলা— দুটো জিনিসই অনুপস্থিত সে-দুটো ঘর থেকে। প্রশ্ন হতে পারে তাহলে লোক ঢোকে কেমন করে? আছে! আছে! ব্যবস্থা আছে তার! নিরাপদ সুব্যবস্থা। ক্রমশ প্রকাশ্য—
ঘরে একখানা ছিমছাম কাঠের টেবিল। বেশ বড়োই। চার খানা কাঠের চেয়ার চারিপাশে।
আপাতত ঘরে মাত্র ওরাই দুই জন। টেবিলে খাদ্য পানীয় হরেকরকম, আর একটা রক্তমাখা গেঁজে।
সদয় আর মেঘার লাশ বর্তমানে রাণাঘাটের থানায় পড়ে আছে। কেষ্টনগরের সদরে এসে পৌঁছয়নি এখনও, এলে ডাক্তার কাটবেন লাশ; মৃত্যুর কারণ যে কী, সে সম্বন্ধে সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করবেন সুযুক্তি সহ।
গেঁজে থেকে টাকাগুলো একটা একটা করে টেবিলের উপর ঢালছে— মাকলু। টুং টুং শব্দ!
‘আরে, আস্তে!’—সতর্ক করে দেয় কাবলু, একখানা বৃহৎ চিংড়ির কাটলেটে কামড় দিয়ে—
‘তুই পয়লা নম্বরের ভীতু। এঘরের কোনো আওয়াজ বাইরে যেতে পারে না, তা তুই ভালো করে জানিস। তবু বলে আস্তে, আস্তে, আস্তে—’
মাকলু দাঁত খিঁচোয়, কাবলুর দাঁত— কাটলেট চিবোয়।
চিবোনোরই ফাঁকে ফাঁকে কাবলু বলে— ‘একেই বলে দাঁও। ওই কুনো গলিতে সেই মরাংচে মানুষটা এক কাঁড়ি টাকা নিয়ে হাজির হবে, কে ভেবেছিল? স্রেফ গাড়ি ধরব বলে পথ হাঁটছি, বিধেতা কানে ধরে টাকাটা পাইয়ে দিলেন—’
‘দু-দুটো খুন—’ টাকাগুলো দুই ভাগে সাজিয়ে রাখতে রাখতে মাকলু মুচকি হাসে একটুখানি— ‘তুই যদি কুকুরটাকে সাবাড় করতে পারতিস, তাহলেও বুঝতাম যে কিছু একটা করলি!’
‘ভৌ-উ-উ-উ—’
চমকে উঠল মাকলু, কাবলু দুই স্যাঙাতই। ঠিক যেন এই ঘরের মধ্যেই! ঠিক যেন তাদের কানের কাছেই কুকুরটা ডাকল আবার। যেমন কাল সন্ধ্যায় সেই আঁধার গলিতে ডেকে উঠেছিল একবার, কাবলুর হাত কামড়ে ধরবার সময়, আর একবার মাকলুর কাঁধের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বার সময়।
চমকে উঠল দুই জনে, কাবলুর হাত থেকে ভুক্তাবশেষ চিংড়ির ন্যাজটা তো পড়েই গেল মাটিতে। মাকলু এদিকে-ওদিকে একবার তাকিয়ে দেখল, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল— ‘গোলন্দাজের বখরার কুড়ি টাকা থেকে দশ টাকা কেটে দেওয়া উচিত। ওর ঘর আর তেমন নিরাপদ নেই আগের মতো। কোথায় ফুটোফাটা হয়েছে, কে জানে। কিন্তু বাইরের কুকুরের ডাক স্পষ্ট শোনা গেল ঘরে বসে—
কাবলু সায় দিল মাথা নেড়ে, অধিকন্তু টিপ্পনী কাটল— ‘বাইরের শব্দ যদি ভিতরে বসে শোনা যায়, ভিতরে আমরা যা কিছু কথা কইছি, তাও তো বাইরে থেকে— ওরে ব্বাবা! তুই এই মাত্তর দাঁত খিঁচোলি আমায়, আস্তে কথা কইতে বলছিলাম বলে—’
টাকার বখরা করতেই এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল মাকলু, তার ভাগের খাবার প্লেট ভরতি সাজানোই রয়েছে এখন পর্যন্ত। এইবার সে প্লেটখানা সামনে টেনে আনতে গিয়েই একেবারে লাফিয়ে তিন হাত পিছনে গিয়ে পড়ল—
কাবলু তখন হাতের উপর মাথা রেখে দু-চোখ বুজেছে কেবল, বন্ধুর লাফের শব্দ শুনে চমকে উঠেই বসল একেবারে। টেবিলের উপরে একটা কুকুর, গলায় তার শিকল। চার পায়ে খাড়া হয়ে, মাথা নামিয়ে সে মাকলুর ভাগের চিংড়ির কাটলেট, মাংসের চপ আর গরম পরোটা গোগ্রাসে গিলছে—
কী এ? কুকুর? না কুকুরের ভূত? কুকুরও কি ভূত হয়? উপরে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে কাবলু, ওদিকের দেয়ালের গায়ে ঠেসান দিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাকলু। দুই জোড়া ড্যাবা ড্যাবা চোখে বিভীষিকার ছায়া; কেউ কারো মাথার দিকে তাকাবে এমন মনের অবস্থা তাদের কারো ছিল না তখন, থাকলে দেখতে পেত— মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠেছে দু-জনেরই।
কতক্ষণ? এক মিনিট? তারপরই ব্যস! সব ফর্সা! ফক্কিকার সব!
টেবিলে কুকুর নেই! প্লেটে সেই একগাদা খাবারের এক কণাও নেই! এবং চেয়ারে আসীন কাবলুর বা দেয়ালের গায়ে দণ্ডায়মান মাকলুর— হুঁশপবনও বিন্দুমাত্র নেই!
তা কয়েক মিনিট বাদেই তাদের হুঁশ হল। দেয়ালের একটা বিশেষ অংশে মাকালীর একখানা পট আছে মাথা সমান উঁচুতে। ফ্রেমে বাঁধানো বা হুকে টাঙানো নয়, এ ছবি দেয়ালের গায়েতেই আঁকা। পটের ডানদিকে একজন, বাঁয়ে আর একজন চেপে ধরল দেয়াল, আর সঙ্গেসঙ্গেই পটখানা সড়াক করে অদৃশ্য হয়ে গেল ভিতর দিকে। একটা ফোকর বেরিয়ে পড়ল দেয়ালে।
মাথাসমান পাঁচিল টপকানো তো ওদের সকলেরই অভ্যাস আছে। ফোকরের ভিতরে হাত গলিয়ে দিয়ে তড়াক করে ওরা লাফিয়ে উঠল উপর পানে, আর চোখের পলকে, অদৃশ্য হয়ে গেল ফোকরের ভিতরে। এবার ওদিক থেকে একটা চাপ ডাইনে বাঁয়ে, মা কালীর আবার আবির্ভাব হল পূর্বস্থানে।
যেখানটায় ওরা লাফিয়ে পড়ল, সেটা একটা ঢাকা বারান্দা। ফোকরের মুখ যখন বন্ধ হল, এ পিঠের দেয়ালেও ফুটে উঠল মাকালীর মূর্তি—। মূর্তির ঠিক সমুখের দেয়ালে একটা বন্ধ জানলা। বাইরের রৌদ্রোজ্জ্বল পৃথিবীকে এক পলক দেখে নেওয়ার জন্য দুই দস্যুর মন তখন আকুলিবিকুলি করছে একেবারে। দেখতে পেলে মনে সাহস পায় তারা, বুঝতে পারে যে পায়ের নীচে নরক এখনও মুখ ব্যাদন করেনি তাদের গিলে ফেলবার জন্য।
চিরদিন জানলাটা বন্ধই থাকে। গোলন্দাজ পারতপক্ষে এ জানলা খোলে না কখনো। কিন্তু আজ ভূতের ভয়ে দিশেহারা মাকলু-কাবলু হোটেলওয়ালার নিষেধ অমান্য করতে বাধ্য হল। চটপট খুলে ফেলল জানলা।
আর, কী সর্বনাশ! এই জানলার দিকে মুখ করেই হিংস্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, কে ওটা? সেই কুকুরটাই না? যাকে এইমাত্র ঘরের ভিতরে দেখে এল ওরা? টেবিলের উপরে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে কাটলেট খেতে?
হুবহু সেই চেহারা! তফাত শুধু এই যে তখন সেটা সাদা ছিল, এখন দেখাচ্ছে কালো! মিশকালো একেবারে, নরকের কুকুরের রং যেমন হওয়া উচিত, তেমনি। আর তখন ওর গলায় শিকলটা ছিল, এখন নাই। কোথায় গেল সে শিকল, যা দিয়ে কাল সন্ধ্যায় কাবলু-মাকলু ওকে ওর মনিবের হাতের সঙ্গে বেঁধে রেখে এসেছিল?
দুই জনেরই গা দিয়ে কালঘাম ঝরছে, হঠাৎ পিস্তল তুলল মাকলু—
‘ও ভূত কি জ্যান্ত, আমি পরখ করতে চাই। এই গুলিতেই তা প্রমাণ হবে—’
ভ্যাক করে আওয়াজ হল একটা। বুলেট ছুটল, বিঁধল গিয়ে কুকুরটার কপালে, সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আঃ, জ্যান্ত কুকুরই ছিল এটা। মরুক! একটা কুকুর মরলে তাতে কিছু লোকসান হয় না দুনিয়ার। জানলা বন্ধ করে ছুটে বেরুল দুই বন্ধু, ‘গোলন্দাজকে বল আমরা ঘুরে আসছি’ বলে সত্যিই বাইরের খোলা হাওয়ায় একটু বেড়াতে বেরুল তারা।
‘কিছু না, কিছু না’ — বলল মাকলু— ‘আমরা একটু নড়বড়ে হয়ে গিয়েছি। মনমেজাজ সুস্থ নেই। এটু ফুর্তির দরকার, চাঙ্গা করে তোলা দরকার নিজেদের। ওই কালো কুকুরটা, যার গলায় শিকল ছিল না, এটা— মানে রাস্তারই খেঁকি একটা। আমাদের মাথার ঠিক নেই বলেই দুটোর ভিতর মিল দেখতে পেয়েছিলাম—’
কাবলু সায় দিল তার কথায় ‘তার উপর ধর— এটা তো মরেই গিয়েছে। পড়ল আর মরল, চোখে দেখলাম তো! ওই তো ওইখানে—’
কালো কুকুরটার যেখানে পড়ে থাকবার কথা, সেদিকে আঙুল দেখাল কাবলু, কিন্তু চোখে তো পড়ে না কুকুরের লাশটা! মানে? এর মধ্যে কে তিন তাড়াতাড়ি কুকুরের লাশ সরাতে আসবে?
দুই জনেই ত্র্যস্তপায়ে এগিয়ে গেল। নাঃ, কুকুর তো নেই! সত্যিই নেই তো! এ কেমন ধারা হল? নিজেদের ওরা যা বলে প্রবোধ দিচ্ছিল এতক্ষণ, সেসবই এক সেকেন্ডে ধূলিসাৎ হয়ে গেল, ভূমিকম্পে বালির কেল্লার মতো। একবার এ-ওর মুখের দিকে চাইল শুধু, তারপরেই হাঁটতে লাগল— যেদিকে দু-চোখ যায়।
বড়ো রাস্তা। সন্ধ্যা হব হব করছে। আলো জ্বলছে পথে। বেড়াতে বেরিয়েছে সুবেশ নর-নারী। মাকলু-কাবলুও ভিড়ে মিশে গেল। এত লোকের মাঝে নিশ্চয়ই কুকুর-ভূতে তাড়া করতে পারবে না তাদের!
কিন্তু বৃথা আশা! অনেক লোক— ছেলে-বুড়ো তরুণ তরুণী— ডাইনে বাঁয়ে গিজগিজ করছে লোক— তারই মাঝে ঠিক তাদের পায়ের কাছে—
ঠিক যেন মাটি ফুঁড়ে গজিয়ে উঠল সাদা কুকুরটা। এবার আর শিকল নেই গলায়। হিংস্র দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। এক্ষুনি যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে এসে যুগল হত্যাকারীর উপরে—
কাবলু ফিসফিস করে বলল— ‘মাকলু! ওই আবার! ঠিক পিছনে পিছনে আসছে আমাদের! গুলি! গুলি কর শিগগির—’
হতাশ; নিরুপায় সুরে বলে উঠল মাকলু— ‘তুই গাধা! গুলি ওর কী করবে? দুই দুইবার করেছি গুলি, মরে উলটে পড়েছে দুই বারই। তবু সে পিছন ছাড়েনি। দেখছিস না? উপায় নেই, ঝেড়ে ফেলবার উপায় নেই ওকে! ওই ভূতকে!’
কিন্তু কই? কুকুরটা তো নেই ধারে-কাছে? উপস্থিত রেহাই দিয়ে গিয়েছে ওদের। ওরা দিশেহারার মতো হাঁটতে লাগল। কোথায় গেলে নিরাপদ হওয়া যাবে, তা ভেবে পায় না ওরা।
অবশেষে কালো আঁধারের বুকেও এক ফালি আলোর রেখা চোখে পড়ল বুঝি। যতই ক্ষীণ হোক সে রেখা, তবু আলোরই রেখা সেটা। মাকলু বলল— ‘আয়, এক কাজ করি। লটারি করি। দুই জনে দুই দিকে যাই। ও কিছুতেই আর একসাথে দুই দিকে দুই জনকে তাড়া করতে পারবে না। কাকে ছেড়ে কাকে আঁকড়ে থাকবে, তা অবশ্য জানি না। তবে গুলি করে আমিই মেরেছিলাম ওকে, আমার ঘাড়ই ভাঙবে খুব সম্ভব। তাহলেও তুই তো বেঁচে গেলি। অর্ধেক রক্ষে হল। যা ভাই যা, আমাকে ছাড়লে তুই হয়তো রেহাই পাবি—’
অবাক কাণ্ড! সামান্য দুটো পয়সার জন্য মানুষ খুন করতেও যার আটকায় না, তার গলা কেঁপে গেল— কুকর্মের সঙ্গীর কাছে বিদায় নিতে। কাবলুও বিমর্ষ খুব, তবু তার মনে ধরেছে কথাটা। গুলিটা কাবলু করেনি, সুতরাং ভূতের বিচারে সে রেহাই পেলেও পেতে পারে। বিদায় নিয়ে দুই জনে দুই দিকে চলেছে। জলঙ্গির বাঁধের কাছে এসে পড়ল মাকলু। হাওয়া খাওয়ার জন্য এখানেও লোক জমেছে ঢের। হাসি, গল্প, গান, সবে মিলে আনন্দের তরঙ্গ তুলেছে নদীর ধারে।
হঠাৎ মাকলু দেখল— সাদা কুকুরটা ধেয়ে আসছে ঠিক বাঘের মতো গর্জন করতে করতে। তার দু-চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে নরকাগ্নির শিখার মতো। কী যে হল মাকলুর! একেবারে সে জ্ঞান-চৈতন্য হারিয়ে ফেলল যেন। ভয়ে দিগবিদিক ভুলে গেল, ছুটতে লাগল প্রাণের ভয়ে।
আশেপাশে এক-শো মানুষ অবাক, হতভম্ব। ‘কী? হল কী মশাই? দৌড়োন কেন? পড়ে মরবেন যে!’ শত কণ্ঠে যুগপৎ প্রশ্ন। প্রশ্ন যারা করছে, তাদের দোষ নেই। যার ভয়ে মাকলু ধাবমান, সে তো অদৃশ্য অন্যের চোখে।
শত লোকের চিৎকারে কর্ণপাত না করে বাঁধের উপর দিয়ে ছুটছে মাকলু। হঠাৎ তার খেয়াল হল কী, যে-ভূতকে এতক্ষণ পিছনে দেখেছে, তাকে দেখল হঠাৎ বাঁয়ে। তড়াক করে সে ডাইনে ঘুরল, আর টাল সামলাতে না পেরে উলটে পড়ল গিয়ে একেবারে জলঙ্গির জলে।
চেঁচামেচি, চিৎকার! একটা জেলে ডিঙির জালে বেধে রাতদুপুর নাগাদ মাকলুর লাশ ডাঙায় উঠল। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থানায়, পথের মাঝে এক জায়গায় ধাঙড়েরা লাশ নামিয়েছে কাঁধ থেকে, জিরোচ্ছে একটু। ঘুরতে ঘুরতে একটা লোক এসে পড়ল অত রাত্রে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়—
মাকলুর মুখে ঢাকা তো ছিল না! রাস্তার আলো পড়ছিল তার মুখে। সে-মুখ স্পষ্ট দেখতে পেল লোকটা, আর ‘মাকলু রে’ বলে ছুটে এল, যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বুকে। কিন্তু তা সে করল না, হঠাৎ যেন সামনে দেখল কেউটের উদ্যত ফণা। ঝটিতি পিছন ফিরে তিরবেগে ছুটল— যেদিকে দু-চক্ষু যায়।
দেখেছে কাবলু— সেই সাদা কুকুরটাকেই আবার। তেড়ে আসছে তেমনি আগুনের হলকার মতো।
ছুট! ছুট! কাবলুও মরণদৌড় দৌড়োতে শুরু করল। দুপুর রাতের নিস্তব্ধ রাজপথে রেস দিতে লাগল এক পলায়মান খুনি আর এক নাছোড়বান্দা কুকুর-ভূত।
রেলগাড়ি চলেছে এত রাত্রেও।
রাস্তা বেয়ে কাবলু ছুটছে। রাস্তার পাশেই রেললাইন। গাড়ির গর্জন এগিয়ে আসছে উলটো দিক থেকে।
রাস্তায় কাবলু। লাইনে ট্রেন। প্রায় মুখোমুখি।
সাদা কুকুরটা তেড়ে আসছিল পিছন থেকে। কাবলু হঠাৎ তাকে দেখল সামনে। ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আর কি। কাবলুর টুটি লক্ষ করে। কাবলু আর্তনাদ করে উঠল একটা। তারপরই ডাইনে মোড় ঘুরল ভূতকে ফাঁকি দেবার জন্য।
মোড় ঘুরতে গিয়ে উলটে পড়ল লাইনের উপর। আর সেই মুহূর্তেই রেলগাড়িটা সশব্দে ছুটে চলে গেল তার দেহের উপর দিয়ে।
ওটা কি ট্রেনের ঝকঝক শব্দ? না, প্রেতের অট্টহাসি?