১. ছেলেবেলা : ১
সেদিন সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি। ৮ই জুলাই, ১৯১৪ সাল। ৪৩/১, হ্যারিসন রোডের বাড়ির বাইরে গাড়িবারান্দার নীচে তখন বৃষ্টির ঝাপটায় বিপর্যস্ত মানুষের গাদাগাদি ভিড়। এদিকে বাড়ির অন্দরমহলে তখন দারুণ ব্যস্ততা। হেমলতা বসু প্রসব ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। ঘোর বর্ষার ভারী দুপুর ঢিমে তালে গড়িয়ে বিকেল হয়। বাড়ির দালানের বড় দেওয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে বাজে, হেমলতা বসু এক শিশুপুত্রের জন্ম দেন। জন্মের আনন্দ উত্তাপ বাড়ির বাইরে জড় হওয়া সাধারণ মানুষকেও ছুঁয়ে যায়। আমহার্ষ্ট স্ট্রীট আর হ্যারিসন রোডের মোড়ের সেই বাড়ি জীৰ্ণ অবস্থায় আজও দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে আরও কয়েকটি পাঁজর বার করা বাড়ি, স্যাঁতসেঁতে আলোআঁধারি ছাপাখানা আর একশো বছরের নামকরা বাঙালির সন্দেশের দোকান—সবেতেই মিশে আছে ব্রিটিশ আমলের পুরোনো কলকাতার সোঁদা গন্ধ।
প্রসবঘরের ধাত্রী হেমলতাকে বার বার বলতে থাকেন ‘ছেলে খুব সুন্দর হয়েছে’, আত্মীয়-পরিজন বলতে থাকেন ‘ছেলের মুখটি হয়েছে ঠিক বাবার মত’। হেমলতার প্রথম ছেলের বয়স তখন দশ, নাম সৌরীন্দ্রকিরণ। আর সৌরীন্দ্রকিরণের ফুটফুটে বোন সুধার বয়স সাত। ডাক্তার নিশিকান্ত বসু ছোটছেলের নাম রাখলেন ‘জ্যোতিরিন্দ্র’। কেমন করে হল এই নামকরণ? বসু নিজেই বললেন : “ঐ যে বাঙালিদের প্রদীপ জ্বালানোর কি একটা প্রথা আছে না? যে নামের ওপর প্রদীপের শিখা বহুক্ষণ জ্বলেছিল, দেখা গেল সেই নামটা ‘জ্যোতিরিন্দ্র’। দ্বিতীয় নামটা ছিল ‘রথীন্দ্র’। বাবা মা প্রথম নামটাই বেছে নিলেন।”
‘জ্যোতিরিন্দ্র’ জ্যোতি বসু হলেন কবে?
বসু বললেন : “সে অনেকদিন পরে, বাবা যখন আমাকে লোরেটো কিন্ডার- গার্টেন স্কুলে ভর্তি করতে গেলেন, তখন উনি নামটা ছোট করে দিলেন। আমি জ্যোতি বসু হয়ে গেলাম। আদরের নাম হল “গনা”।”
মা, বাবা, দাদা, দিদি আর জ্যাঠতুতো ভাইবোনেরা সকলেই ‘গনা’ বলে ডাকেন। ছোটবেলায় গনা দুরন্ত বা বায়নাদার কোনটাই ছিল না, বরং সে ছিল একটু লাজুক প্রকৃতির, শান্ত চুপচাপ। খাবার সময় দৌরাত্ম্যির বালাই ছিল না, তবু প্রায়ই মা ফকিরাকে বলতেন একটা জ্যান্ত আরশোলা সুতোয় ঝুলিয়ে সামনে দেখাতে। আরশোলার নাচানাচি দেখতে দেখতে হেসেখেলে দিব্যি খেয়ে নিত ছোট্ট গনা। বাড়ির কাজের ছেলে ফকিরাই ছিল গনার ছোটবেলার খেলার সাথী।
শিক্ষিত, উচ্চশ্রেণীর বাঙালি ভদ্রলোক পরিবারের একান্নবর্তী সংসারে গনা বড় হয়ে ওঠে। বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন স্বনামধন্য চিকিৎসক। ঠাকুরদাদা কাজ করতেন আসামের ধুবড়ি কোর্টে। ঠাকুরমা ছিলেন পরমাসুন্দরী। তাঁদের আট ছেলে ও এক মেয়ে ছিল। বড় ছেলে নলিনীকান্ত ছিলেন কোর্টের জজ, মেজ যামিনীকান্ত উকিল, কুমুদিনীকান্ত আমেরিকা থেকে এবং রোহিনীকান্ত ঢাকা থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। নিশিকান্ত বসু ডিব্রুগড়ের বেরী হোয়াইট মেডিকেল স্কুল (১৯৪৭ সালে যার নাম হয় আসাম মেডিকেল কলেজ) থেকে ডাক্তারি পাস করেন। ঢাকায় কয়েক বছর প্র্যাকটিস করার পর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাড়ি দেন। ছ’বছর আমেরিকায় থাকার সময় তিনি তাঁর ছোটভাইকেও সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য নিয়ে যান। ভাই তের বছর আমেরিকায় ছিলেন।
বসুর মা হেমলতা ছিলেন ঢাকার কাছে বারদি গ্রামের উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের পরম আদরের একমাত্র সন্তান। বিয়ের সময় হেমলতার বয়স ছিল বার, নিশিকান্তের উনিশ। হেমলতার স্বভাব ছিল খুব কোমল আর পরিপাটি। বিকেলবেলা যত্ন করে ঢাকাই শাড়ী পরতেন, কপালে থাকত সিঁদুরের টিপ। “মায়ের প্রিয় রঙ ছিল লাল। হাঁটার সময় পিঠে ফেলা চাবির গোছায় ঝঝম আওয়াজ হত। খুব পান খেতেন। মাকে খুব ভালো লাগত আমার। ফটো তোলার সময়ে আমি ঠিক মায়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়তাম,” বসু মৃদু হেসে বললেন।
বারদির সঙ্গে গনার নাড়ির যোগ। ছোটবেলায় ছুটি কাটানোর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল বারদি। সে সময় বাংলা দু’টুকরো হয়নি, কোথাও কাঁটাতারের বেড়া, বাধানিষেধের কড়াকড়ি ছিল না, ছিল না সীমানা নিয়ে কোনও বিরোধ বা তিনবিঘা নিয়ে রাজনীতির কচকচি। সে অনেকদিন আগেকার কথা। তবু আজও বসুর মনে গেঁথে আছে রূপসী মেঘনা নদীর বুকে পালতোলা নৌকার সারি, গোয়ালন্দের সেই হইচই, স্টীমারের ভোঁ, জসীম নামে সেই দাড়িওলা সারেং, স্টীমার ছাড়ার আগে তড়িঘড়ি খেয়ে নেওয়া মাংসের ঝোলের সেই আস্বাদ, আর সেই প্রায় ভাঙো ভাঙো পুরোনো কাঠের জেটি। বার বার মনে পড়ে যায় টুকরো টুকরো ছেঁড়া ছবি—সেই বিরাট পুকুর, সবুজ ফুটবল-মাঠ, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রম।
১৯১৭ সালে বসুপরিবার উঠে গেলেন আর একটি বড় ভাড়াবাড়িতে। গনার বয়স তখন তিন। নতুন বাড়ির নাম হিন্দুস্থান বিল্ডিংস্, মালিক নলিনীরঞ্জন সরকার। বাড়িটা ছিল ‘ইঙ্গবঙ্গ’ কলকাতার একেবারে কেন্দ্রস্থলে। কাছেই চৌরঙ্গি রোড। অদূরেই ময়দান। ন’টা ফটকঅলা ভিক্টোরীয় আমলের বিরাট বাড়ি। বাড়ির অন্য বাসিন্দারা অধিকাংশই হয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নয় একেবারে পাক্কা সাহেব। রাস্তার কোণের চমৎকার দোতলা বাড়িটা ছিল এক সাহেবী দোকান—হোয়াইটএ্যাওয়ে লেইল, পুরোনো কলকাতার ইংরেজি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স্। হিন্দুস্থান বিল্ডিংসে ছেলেবেলার কথা মনে করলেই গনার চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে ওঠে একটা সাদাকালো বিশাল ঘড়ি, ঘড়িটা ছিল হোয়াইটএ্যাওয়ে লেইড্ড্ল-এর একেবারে ওপরে তিনকোণা মাথার মাঝখানে গেথেঁ বসানো। ঘড়িটা দেখতে গনার কি ভালই না লাগত! প্রতিদিন বিকেলবেলা বাড়ির কাজের লোক রাধিকার সঙ্গে ময়দানে বেড়াতে যাবার সময় সে ওপর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কতবারই না ঘড়িটা দেখত!
একদিন ঠাণ্ডা কনকনে ক্রীসমাসের এক সকালে বাবা তাকে নিয়ে গেলেন সেই হোয়াইটএ্যাওয়ে লেইল দোকানে। সেখানে তার বয় স্কাউটের পোশাকের অর্ডার দেওয়া হল। তারপর সোনালি রঙের লিফটে চড়ে বাবার সঙ্গে দোতলায়। সেখানে গিয়ে অপার বিস্ময়ে গনার চোখের পলক আর পড়ে না। সে যেন এক খেলনার স্বর্গরাজ্য—চারিদিকে বিরাট বিরাট রঙিন বেলুন, রংবেরঙের শিকল, আলো ঝলমলে চীনে লণ্ঠন। বাড়ি ফিরে সে মায়ের কাছে গল্প না করে পারে না। লালপাড় ঢাকাই শাড়ি পরে পূজার আসনে বসা হেমলতা ছোটছেলের কথা শুনে মৃদু মৃদু হাসেন।
বসুপরিবার থাকতেন হিন্দুস্থান বিল্ডিংস্-এর দোতলায়। উল্টোদিকেই ম্যাডান থিয়েটার, যার আর একটা নাম ছিল ‘প্যালেস্ অব ভ্যারাইটিজ্’। এখন তার নাম ‘এলিট’ সিনেমা। দূরে দেখা যেত মাইলের পর মাইল ফাঁকা ময়দান। বাড়ির মালিক নলিনীরঞ্জন সরকার থাকতেন তিনতলায়। শ্রী সরকার ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য এবং হিন্দুস্থান ইনসিওরাস্ কোম্পানির মালিক। এই হিন্দুস্থান বিল্ডিংস্-এর এখনকার নাম—ফুনানি চেম্বারস্।
জ্ঞানচন্দ্র ছিল ঐ বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো কেয়ারটেকার। তার সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। জ্ঞানচন্দ্রের মুখে একঝোড়া ভোজপুরী গোঁফ, সারা মুখে বয়সের অজস্র আঁকিবুকি। নিশিবাবুকে তার ভালই মনে আছে। ডাক্তারবাবুর চেম্বার ছিল এস্. এন. ব্যানার্জি রোডে, মোগলাই খানার নামী মুসলিম রেস্তোঁরা ‘আমিনিয়া’র পাশেই ডাক্তারবাবুর ছোট্ট, ফরসা ছেলেটিকেও সে ভোলেনি। তার বেশ মনে পড়ে টমাস গন্জালেস নামে এক ভবঘুরে প্রতি শনিবার রাতে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেমন বেহালা বাজাতো। দূর থেকে বেহালার আওয়াজ কানে গেলেই ছোট্ট গনা ঘর থেকে বারান্দায় ছুটে বেরিয়ে আসত আর বাজনা শুনে খিলখিল করে হেসে লুটিয়ে পড়ত। তখন জ্ঞানচন্দ্রের বয়স কম, সেও হাসিতে যোগ দিত। ব্রিটিশ আমলের সেই নিশুত রাতে, তারাভরা খোলা আকাশের নীচে দুজনের কলহাস্য যেন ঘুরে ঘুরে আসত। কিছুদিন হল জ্ঞানচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে।
যৌথ পরিবারে জ্যেঠতুতো, খুড়তুতো দাদাদিদির সঙ্গে গনা বড় হয়ে ওঠে। ডাঃ নিশিকান্ত বসু ছিলেন পরিবারের মাথা। তিনি ছিলেন বিশাল এক বটগাছের মত। যার যখন প্রয়োজন হত, তাঁরই ছায়ার নীচে তারা সাদর আশ্রয় পেত। ধুবড়িতে যখন তাঁর বড়ভাই-এর মৃত্যু হয়, তাঁর পুরো পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। তাছাড়া তাঁর ছোটভাই, যিনি আমেরিকায় পড়াশোনা করছিলেন, তাঁর পরিবারেরও দায়িত্ব ছিল নিশিকান্ত বসুর ওপর। ভাইপো ভাইঝির পড়াশোনার সব খরচ তিনিই চালাতেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত উদারমনা, স্নেহপ্রবণ মহিলা। “আমার মা ছিলেন খুব বড় মনের মহিলা, আমাদের বাড়িতে থাকতেন আমার জ্যাঠামশায়ের পুরো পরিবার, মেজ কাকা, মেজ কাকিমা, তাঁদের পাঁচ সন্তান, আমার ছোটকাকা, ছোটকাকিমা ও তাঁদের মেয়ে।” বসু সগর্বে বললেন : “আমার জ্যেঠতুতো ও খুড়তুতো ভাইবোনদের তিনি আমাদের সঙ্গে সমানভাবে স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন, বাবাকে কখনও এত বড় পরিবারের আর্থিক দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ভর্ৎসনা করেন নি।”
বাবার কাছাকাছি থাকতে ছোট্ট গনার খুব ভাল লাগত। প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় তার কাজ ছিল বাবার চেম্বারে ঢুকে চুপচাপ বসে বাবা কেমন করে রোগী দেখছেন তা মন দিয়ে দেখা। কোনও কোনও দিন খানিকবাদে রাধিকা এসে বলত : “মা ডাকছেন, বাড়ি চলো।” বাবাকে ছেড়ে বাড়ি যেতে গনার মোটেই মন চাইত না। “বাবা ছিলেন গোঁড়া ঈশ্বরভক্ত”; বসু বললেন, “জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাস অটুট ছিল। প্রায়ই একটা কথা বলতেন, ‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য’।” শৈশবে বাড়িতে পূজোপাঠের সাধারণ আবহাওয়া থাকলেও জ্যোতি বসু গতানুগতিক পথে আস্তিক হয়ে ওঠেন নি, পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছেন প্রখর যুক্তিবাদী এক মানুষ। তবে কখনই তিনি পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনের ধর্ম-বিশ্বাসে আঘাত করেন নি। একদিন বসু তাঁর বাবার মুখে শোনা এক অলৌকিক ঘটনার কথা শোনালেন। “বাবা তখন আমেরিকায়, ডাঃ লিন্ডার্স স্যানাটরিয়ামে কাজ করেন। আমেরিকান রোগীদের মধ্যে বাবার তখন বেশ সুনাম হয়েছে। একদিন সকালে বাবা হুইটনি পারকার গোলবার্গ নামে এক মহিলা রোগীকে পরীক্ষা করছিলেন। তাঁর পেটে একটা টিউমার হয়েছিল। হঠাৎ সেই মহিলা চিৎকার করে উঠলেন——কথা বলবেন না, দাঁড়ান, দেখুন আপনার ঠিক পেছনে আমি একজন যোগীকে দেখতে পাচ্ছি, তিনি কে তা আমি জানি না, নিশ্চয়ই তিনি আপনার গুরু, তাঁর মাথার চুলগুলো মাথার ওপরে চূড়ো করে রাখা, আমি তাঁর কোমর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি’। কয়েক মিনিট বাবার মুখে কথা সরল না। তাঁর স্থির বিশ্বাস হল ঐ যোগী আর কেউ নয়—তাঁর আরাধ্য গুরুদেব লোকনাথ ব্রহ্মচারী। নিজের সৌভাগ্যকে তিনি যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। কিন্তু আমি এই গল্পটা কোনওদিনই বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি”, বসু বললেন, “তবে আমার বাবার গভীর বিশ্বাসে আঘাত করতে চাইনি, চুপচাপ শুনে গেছি। এই ঘটনাকে এক ‘হ্যালুসিনেশন’ ছাড়া আর কিই বা ভাববো?”
বাবা যখন তাঁকে বারদির আশ্রমে সেই পুণ্যাত্মাকে প্রণাম করতে বলতেন, বসু উত্তর দিতেন “মনে মনে করেছি”। বাবা জোর করতেন না। উৎসবের দিনে যখন আশ্রমে নিয়ে যেতেন তখন বসু সানন্দে ‘খিচুড়ি’ আর ‘পায়েস’ প্রসাদ খেতেন।
ছ’বছর বয়সে তাকে ভর্তি করা হল ধর্মতলার লোরেটো কিন্ডারগারটেন স্কুলে। ছাত্র হিসাবে গনা ছিল রীতিমত মেধাবী। তিন বছর পড়ার পর সে পেয়ে গেল ডাবল প্রমোশন। বাবা তখন চেষ্টা করলেন যাতে ছেলেকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি করা যায়। কিন্তু দেখা গেল একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় সে বছরকার মত সেখানে ভর্তি বন্ধ হয়ে গেছে। ডাঃ নিশিকান্ত বসু চান না ছেলের শুধু শুধু একটা বছর নষ্ট হয়। আবার ঘোরাঘুরি শুরু করেন। ন’বছরের গনার অবশ্য কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, নিশ্চিন্তে সে গাড়ির মধ্যে বসে রাস্তার দোকানপত্র, লোকজন দেখতে থাকে। শেষ পর্যন্ত লোরেটো ধর্মতলার মাদার সুপিরিয়র-এর মন একটু নরম হয়। তিনি ছাত্র নিতে সম্মত হন। শর্ত একটাই—মেয়েদের সঙ্গে পড়তে হবে। স্কুল শুরু হয়, ক্লাসভর্তি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আর ইংরেজ মেয়েদের মাঝে একটিই ছোট ছেলে—তার নাম জ্যোতি বসু। প্রথমে কয়েকদিন ছেলেটির একটুও ভাল লাগে না, একে লাজুক স্বভাবের, আরও যেন চুপচাপ হয়ে য়ায়। স্কুলে যেতে একেবারে ইচ্ছে করে না, মায়ের কাছে আর্জি জানায়, ‘স্কুলে যাব না”। “কিন্তু এ ব্যাপারে মা ছিলেন ভীষণ কড়া”–বসু বললেন, “মা নতুন টিফিন বাক্সে কাঁটা চামচ দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন, আমার আর কিছু করার থাকত না।” ধীরে ধীরে অবশ্য আড়ষ্টতা কেটে যায়, কয়েকজন বন্ধুও হয়, ছেলেটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে শেখে। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক জীবনে এই মানিয়ে নেওয়ার শিক্ষা কম কাজে লাগেনি।
ছেলেবেলার সে সময়টা ছিল ভারী আনন্দের। আকাশের রং ছিল ঘোর নীল, গাছপালা ছিল ঘন সবুজ আর রাস্তাগুলো ছিল ফাঁকা, ঝক্ঝকে আর যেন বেশি চওড়া। যখন বসু ছোট ছিলেন তখন কলকাতা শহরে অনেক কিছুই ছিল যা আজ আর দেখতে পাওয়া যায় না। যেমন বেতো ঘোড়ার ছ্যাকড়া গাড়ি, রাস্তায় গ্যাসের বাতি, ঘোড়ার জল খাওয়ার লোহার বিরাট টব, বাসনে নাম লেখানোর ফেরিওলা আর জল দেওয়ার ভিস্তিওলা। তখন দেখা যেত ওয়ালফোর্ডের লাল ছাতখোলা ডাবলডেকার বাস, ঝকঝকে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টাল দোকান আর ‘টু-লেট’ লাগানো বড় বড় বাড়ি। ছিল ইডেন গার্ডেনে মায়াবী গ্যাসের আলোয় ব্যাণ্ডের বাজনা, ল্যাসিয়া আর ফিটন গাড়ির বাহার। আজকের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর দু’ধার জুড়ে বসত মনকাড়া কার্নিভাল।
পরের বছর বসু সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে সেকেণ্ড স্ট্যাণ্ডার্ডে ভর্তি হলেন। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আর খাঁটি ইংরেজ মিলিয়ে ত্রিশজনের ক্লাস। বাঙালি ছেলে মাত্র দুজন। তার মধ্যে বসু একজন। ইংরেজরা সব সময়ে বাঙালিদের পেছনে লাগত। শিক্ষকরা বেশির ভাগই ছিলেন জেসুইট ফাদার, তাঁরাও তাদের তেমন কিছু কড়া শাসন করতেন না। বসুর বিশেষভাবে মনে পড়ে ফাদার শীলস্-এর কথা। ফাদার শীল্স ছিলেন আইরিশ। কড়া মেজাজের মানুষ। হুঙ্কার দিয়ে ক্লাসঘরে ঢুকতেন—”ইউ, গাটারস্নাইস, ইউ, স্নেইক্স্ ইন্ দ্য গ্রাস”–ছেলেরা ভয়ে সিটিয়ে যেত। “তিনি পড়াতেন চমৎকার”–বসুর এখনও মনে আছে তাঁর পড়ানোর ভঙ্গি। ফাদার শীল্সই ছিলেন বসুর স্কুলজীবনের একমাত্র শিক্ষক যাঁর সঙ্গে পরবর্তী জীবনেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। বসু তাঁর একমাত্র ছেলে চন্দনকে এক সময়ে ফাদার শীল্স-এর রাঁচীর কনভেন্টে পড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি পার্টির পুরো সময়ের কর্মী হিসাবে সামান্য ভাতা পেতেন, তাই চন্দনকে সেই স্কুলে পাঠানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
কিশোর বয়সে বসুর তেমন কেউ অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল না। স্বভাবত তিনি ছিলেন মুখচোরা। বসুর নিজের কথায় : “মা আমাকে প্রায়ই বকাবকি করতেন ক্লাসের অন্য ছেলেদের সঙ্গে তেমনভাবে মেলামেশা না করার জন্য।” দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বসুর কাছের মানুষের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়, কিন্তু কোন সম্পর্কই তেমন নিবিড়ভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। তবে বন্ধুকৃত্য করতে তিনি ভোলেননি, সাহায্যের হাত বাড়াতেও দ্বিধা করেননি। কিন্তু বন্ধুত্বের মায়া কখনই তাঁর বিচারবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। ভেতরে তিনি নির্জন, একা, ভিড়ের মধ্যে নিজস্বতাটুকু হারাতে রাজি নন। স্ত্রী কমল বসুর কথায় “চাপা ধরনের মানুষ, মুখ ফুটে কিছু বলবেন না।”
ছেলেবেলা কেটেছে কড়া নিয়ম কানুনের মধ্যে। সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। ক্লাসের ইংরেজ আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধুদের কাছে বসু সাগ্রহে শুনতেন হিচককের, ‘ব্ল্যাকমেইল’, ‘দ্য ফ্যান্টম অব্ দ্য অপেরা’, ‘দ্য ব্লু এন্জেল’—এইসব ছবির গল্প। বাড়ির রাস্তার ওপারেই ছিল ম্যাডান থিয়েটার বা ‘প্যালেস অব্ ভ্যারাইটিজ’। নাটক দেখতে বসুর আরও ভাল লাগত। অনুমতি ছিল না সিগারেট খাবার। এমনকি চা পান করারও। বসু জীবনে প্রথম চায়ের আস্বাদ নেন লন্ডনে। বাবা নিশিকান্ত বসু ছিলেন কঠিন শৃঙ্খলার মানুষ। প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এই মানুষটির মেজাজ ছিল অসম্ভব শান্ত। বাবার প্রভাবে আর স্কুলের শিক্ষায় বসু হয়ে ওঠেন মৃদুভাষী, সংযমী আর অপরের ব্যক্তিগত ব্যাপারে একেবারে অনাগ্রহী। এখনও অনেকেরই বাইরে থেকে দেখে তাঁকে মনে হতে পারে কঠিন বা উদাসীন। কিন্তু বসু তাঁর নিজস্ব ভাল লাগা বা না লাগা প্রকাশ করেন কখনও সূক্ষ্ম, কখনও বা পরোক্ষ ভঙ্গিতে। বাহ্যিক আড়ম্বর, ব্যক্তিগত অনুভূতির ঢালাও প্রকাশ তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়।
বসু যখন স্কুলে তখন পরিবারের অনেকেই বিদেশে পড়াশোনা করছেন। ডাঃ বসু তাঁর বড় ছেলে সৌরীন্দ্রকিরণকে মাত্র সতের বছর বয়সে আমেরিকায় ডেন্টিষ্ট্রি পড়তে পাঠান। সেই সময় নিউ ইয়র্কে তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে একই ঘরে ছিলেন। বসুর জ্যেঠতুতো দাদা গেলেন ইংল্যাণ্ডের লন্ডন স্কুল অব্ ইকনমিক্স-এ। সেখানে তিনি এক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করেন, তাঁদের একটি ছেলেও হয়। পরিবারকে ইংল্যান্ডে রেখে তিনি দেশে ফেরার পর যখন ডাঃ নিশিকান্ত বসু জানতে পারেন, তক্ষুনি তিনি ভাইপোকে সেই পরিবারকে দেশে আনার আদেশ দেন। জ্যাঠাইমা তো যারপরনাই দুঃখিত। ইংরেজ পুত্রবধূ তিনি কেমন করে মেনে নেবেন? ছেলেবেলার এই ঘটনার কথা বসুর বেশ পরিষ্কার মনে আছে। সেই ইংরেজ মহিলা, নাম আইরিন, এলেন, বেশ লম্বা চেহারা, মিষ্টি স্বভাব, সঙ্গে তিন বছরের ছেলে বাণ্টি। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কিছু কিছু বাংলা কথা রপ্ত করে ফেললেন, বাঙালি পদ রান্না করতেও শিখে ফেললেন, হয়ে গেলেন পরিবারের এক আপনজন। সেই বয়সেও বসুর একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত ঠেকত—”মাকে আমি প্রায়ই বলতাম, তোমরা ইংরেজ বৌদিকে রান্নাঘরে রান্না করতে দিচ্ছ অথচ আমার খেলার সাথী ফকিরাকে রান্নাঘরের চৌকাঠ পেরোতে দিচ্ছনা কেন? ফকিরা আমাদের বাড়ির কাজকর্ম করত, জাতে সে ছিল মুসলমান। আমি তার সঙ্গে খুব খেলতাম। মা ফকিরাকে ভালবাসতেন কিন্তু রান্নাঘর মাড়াতে দিতেন না, আমার খুব অবাক লাগত।” এছাড়া বসুর মনে হত পূর্ব পশ্চিম কেমন অনায়াসে মিলেমিশে যায়— একথা ভাবতেও খুব ভাল লাগত। অথচ সেই সময়টা ছিল পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের গাঁটছড়া খোলার সময়। সারা ভারতে তখন স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে।