আলফা সেন্টৌরির পথে
‘নড়ো না—’
জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওই কথাই সবার আগে মনে পড়ল গেরার্ডের। আর তারই দরুন বোধ হয় প্রাণটা বেঁচে গেল তার। যেখানে শুয়েছিল সে, রয়েছে সেইখানেই।
গদির সঙ্গে পেঁচিয়ে বাঁধা। কানে আসছে ইঞ্জিনের ভরাট আওয়াজ। তা তো আসবেই! কিন্তু ওই সোঁ সোঁ শব্দটা কীসের? যান্ত্রিক ঘষড়ানির গর্জন ছাড়া আর কিছু যখন শোনা যায় না, তখনই পাইলটের নিশ্চিন্দি থাকবার কথা।
নিজের মনে গেরার্ড ভাবছে— তা হলে কি সেই ব্যাপারটাই শুরু হয়ে গেল?
অন্যদিক দিয়ে সবই তো স্বাভাবিক লাগছে। আন্তর্নক্ষত্র পর্যটনে গতিবেগ যা হওয়ার কথা, ডি এফ সি-তিন তাতে পৌঁছে গিয়েছে। পৌঁছোবার পরেও আছে বেঁচে, সে নিজে এবং তার বিমান। বেঁচে আছে, প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে একচল্লিশ লক্ষ মাইল, অর্থাৎ আলোর গতির চাইতে ২২.৪ গুণ গতিবেগের ধকল সহ্য করেও। সহজ কথা নয়!
আগেও দু-বার অভিযান চালানো হয়েছিল আলফা সেন্টৌরির দিকে। এই স্তরে পৌঁছোবার পরে সে-দুটো বিমানের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। ব্রাউন আর সেলিনি। আন্তর্নক্ষত্র আকাশ পর্যটন প্রকল্পের সেরা বৈমানিক দু-জন। আলফার দিকে বিমানের মোড় যেই ঘুরল, তারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
ধীরে, অতিধীরে দু-চোখ খুলছে গেরার্ড। চোখের পাতা বিষম ভারী লাগছে। কেন এমন হয়? গদির চাপ চামড়ার উপরে স্বাভাবিকই রয়েছে তো! তা মানে তো এই যে অভিকর্ষের কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেনি। তবে? চোখের পাতা খুলতে এত কষ্ট কেন হয়?
অনেক চেষ্টার পরে ওরা খুলল। বিমানের কাঠামোতে যন্ত্রপাতিগুলো ঝুলছে ঠিক তার চোখের সামনে। হাত-পা না নেড়েও শুধু চোখের নজর এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে মিটারগুলো পড়ে ফেলা সম্ভব হতে পারে। সেই চেষ্টাই করেছে গেরার্ড অশেষ ধৈর্যের সঙ্গে। গতিবেগ ২২.৪ গুণ। তাপ ইঞ্জিনঘরে স্বাভাবিক। বিমানের অন্য অংশে ৩৭ ডিগ্রি। হাওয়ার চাপ ৭৭৮ মিলিমিটার। জ্বালানি ১, ২, ৩নং ট্যাঙ্ক পুরো, ৪নং দশ ভাগের নয় ভাগ। অভিকর্ষ ১ জি। ক্যালেন্ডার—
ক্যালেন্ডারটা শুধুই ক্যালেন্ডার নয়; একে একটা সর্বার্থসাধক দেয়াল-ঘড়ি বললেই ভালো হয়। এক একটা সেকেন্ড আলাদাভাবে ধরা পড়বে এর কাঁটায়। পড়বে, কিন্তু এই মুহূর্তে তা পড়ছে না তো! সেকেন্ডের কাঁটা নিশ্চল।
দুই নম্বর ত্রুটি এই। গেরার্ড উঠে বসতে যাচ্ছিল। দেখতে যাচ্ছিল যে ঘড়ির ত্রুটিটা শোধরানো যায় কিনা। যাচ্ছিল, কিন্তু গেল না। উঠলও না, বসলও না। বিমানে উঠবার আগে এক মাস ধরে নিজের মনকে সে ক্রমাগত জপিয়েছে, ‘নড়ো না, নড়ো না।’ কাজেই নড়া তার হল না।
না-নড়ে যতটা বোঝা যায়, সেটা বুঝে নাও আগে। যেকোনো পরিস্থিতিতে। তারপরে প্রয়োজন যদি হয়, সম্ভব যদি হয় এবং সবচেয়ে বড়ো কথা, নিরাপদ যদি মনে হয়, তখন তবে নড়তে পারো।
ব্রাউন আর সেলিনি পৃথিবীর মানুষের জ্ঞানগোচরের বাইরে চলে গিয়েছে। কীসে যে নিয়ে গেল তাদের, কেউ জানে না। চমৎকার লোক ছিল, চৌকস লোক ছিল ওরা। উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অসাধারণ। প্রকল্পের ভিতর অতুলনীয় লোক। সম্ভাব্য সব কিছু বিপদের প্রতিকার যাতে আগে থাকতে করা যায়, তার ব্যবস্থা ছিল তাদের বিমানে, অবশ্য ডি এফ সি-তিনেও তা আছে।
ডি এফ সি-তিনের কথা থাকুক। ব্রাউন আর সেলিনির হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার কারণ কেউ আন্দাজ করতে পারেনি এখনও। কারণটা অনৈসর্গিক নয় বোধ হয়, অসাধারণও নয়। কী তবে? ওই সেকেন্ডের কাঁটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে তার কোনো যোগ আছে কি?
সেই সোঁ সোঁ শব্দটা! সুরেলা, শান্ত, একটানা। খুব জোরালো নয়, তবু মেজাজ বিগড়ে দিচ্ছে গেরার্ডের। নিস্তব্ধ থাকবার কথা ওটা। যখন মানুষ না-নিয়েই স্বয়ংচালিত টেস্ট-প্লেন আনাগোনা করত আকাশের এই স্তরে, তখন তো টেপরেকর্ডে ধরা পড়েনি এমন কোনো আওয়াজ! এটা কী? এটা কেন? বিমানের গতি ব্যাহত হচ্ছে না এর দরুন। বিমানের কোনো আকস্মিক গলদ থেকে যে এর উৎপত্তি হয়েছে, এমনও ধারণা করা যায় না। এটা স্রেফ একটা উপসর্গ। এর হেতু যে কী, ধরতে পারছে না ও।
কিন্তু হেতু তো থাকবেই কিছু! দ্বিতীয় বার নিঃশ্বাস ফেলবার আগে সে-হেতু খুঁজে বার করতে হবে, দৃঢ় সংকল্প ওর।
নিঃশ্বাস ফেলবার আগেই!
নিঃশ্বাসের কথা মনে হতেই একটা দারুণ চমক খেলো গেরার্ড। নিঃশ্বাস কই? এতক্ষণে গেরার্ডের হুঁশ হয়েছে যে জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে একবারও সে শ্বাস নেয়নি বা ফেলেনি। তাতে অসুবিধে কিছু টের পাচ্ছে না এখনও। পাচ্ছে না, কিন্তু পেতেই বা কতক্ষণ? আর পাবে যখন, তখন একেবারে সব নিকাশ হয়ে যাবে না তো?
সেই ভয়েই গেরার্ড লাফিয়ে উঠে পড়তে যাচ্ছিল। উঠলে আবার তার ফল কী হত, কে জানে। ওর বরাত জোর, উঠে পড়ার পক্ষে বাধার সৃষ্টি হল একটা। দু-চোখে যে আড়ষ্ট ভাবটা টের পাচ্ছিল এতক্ষণ, সেইটাই যেন বানের জলের মতো তোড়ে এসে তার সমস্ত দেহটাকেই পরিপ্লাবিত করে দিল। নড়ে বসার শক্তিই রইল না তার— উঠে দাঁড়ানো তো দূরের কথা।
এদিকে সেই আকস্মিক মৃত্যুভয়টাতে ধীরে ধীরে ভাটা পড়ে আসছে। আড়ষ্টভাব কমে আসবার আগেই উঠে পড়ার ঝোঁক কেটে গিয়েছে গেরার্ডের।
একটা জিনিস সে বুঝতে পারছে ধীরে ধীরে। যে ভয়টা এসেছিল, সেটা দৈহিক নয়, আনুভূতিক। শ্বাস-প্রশ্বাস নেই? না-থাকুক, তার দরুন অসুবিধেও নেই। কিন্তু নেই কেন? ওটা কি একান্তই সাময়িক? সাময়িক যদি হয়, সে সময়টা কত দীর্ঘ? আর যদি না-হয় সাময়িক, তা হলে ওর স্থায়িত্ব কি গেরার্ডের মৃত্যু পর্যন্তই?
ইঞ্জিনের শব্দ। চোখের পাতা ভারী। নিঃশ্বাস নেই। ক্যালেন্ডার নিশ্চল। এই চারটি ব্যাপারে একসঙ্গে মেলাও। যোগফল কী? কিছু না। একটু কিছু নেড়ে দেখলে হত। যা-হোক কিছু। অন্তত একটা আঙুল। কিন্তু প্রলোভন দমন করল গেরার্ড। ঘুম থেকে সে জেগেছে, এমন বেশিক্ষণ নয়। জোর আধ ঘণ্টা। সেই আধ ঘণ্টাতেই চার চারটি ব্যতিক্রম সে লক্ষ করেছে। এ ছাড়া আরও কি নেই আশেপাশে?
অবশ্যই আছে। হয় ব্যতিক্রম হয়ে বসেছে ইতিমধ্যেই, নয়তো হতে যাচ্ছে অচিরেই। চাই শুধু নিজের অব্যবহিত পরিবেশটার ওপরে চোখা নজর রাখা। তা হলেই ধরা পড়ে যাবে গেরার্ডের চোখে। এমন নয় যে, ধরতে পারলেও সেক্ষেত্রে ওর নিজের কিছু করবার থাকবে। এ বিমানে যা-কিছু করবার, কম্পিউটারই তা করে।
প্রকল্পের কর্তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, ব্রাউন আর সেলিনি হারিয়ে যাওয়ার দরুন। তাঁদের আশঙ্কা হয়েছিল যে যন্ত্রপাতির কাজে খেয়ালখুশিমতো হস্তক্ষেপ করার ফলেই নিজের নিজের বিমান নষ্ট করে ফেলেছে ওরা। ডি এফ সি-তিনের বেলায় ক্যাপ্টেনের হস্তক্ষেপের কোনো উপায় তাঁরা রাখেননি। বলতে গেলে, বিমান যতক্ষণ চলতে থাকবে, ততক্ষণ গেরার্ড যেন সাধারণ একজন যাত্রীমাত্র। তার কাজ শুরু হবে ওটা থামবার পরে।
পক!
মৃদু, মোলায়েম শব্দ একটু। কন্ট্রোল-বোর্ডের ডান দিক থেকে এল। মাথাটাই তড়াক করে ওইদিকে ঘোরাতে চাইছিল গেরার্ড, কিন্তু তক্ষুনি মগজের ভিতর থেকে হুকুম এল, ‘নড়ো না।’ মাথা না-ঘুরিয়ে সে শুধু চোখ ঘোরাল।
কই, এমন কিছুই তো চোখে পড়ে না, যা থেকে ও-শব্দ হয়ে থাকতে পারে। বিমানের তাপ নির্দেশকের ফলকে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তাহলে তো বোঝা যেত যে কোথাও কিঞ্চিৎ ধাতব সম্প্রসারণ বা সংকোচনের জন্যই হয়েছে আওয়াজটা। তা তো নয়!
চোখ বুজে একটু ভাবতে চাইছে গেরার্ড। কিন্তু সে কি সোজা? একটু আগে চোখ মেলা যেমন শক্ত লাগছিল, এখন তেমনিই শক্ত মনে হচ্ছে চোখ বোজা। ওই ক্যালেন্ডার! জ্ঞান ফিরে আসার পরেই ওর চেহারা ঠিক কীরকম দেখা গিয়েছিল, তাই মনে করতে চাইছে ও।
সে ছবিটা মনে যখন এল আবার, চোখ মেলে আবার তাকাল গেরার্ড। ঠিকই হয়েছে তো! আওয়াজটা করেছে ওই ক্যালেন্ডার। এক সেকেন্ড এগিয়ে এসেছে। এগিয়ে আসার ফলেই ওই ‘পক’ শব্দটা। শব্দ করার পরেই আবার সেকেন্ডের কাঁটা নিশ্চল হয়ে আছে।
কতক্ষণ লাগে ওই কাঁটার এক সেকেন্ডের পথ এগিয়ে আসতে? প্রশ্নটা ওঠেনি কোনোদিন, হিসাবও কেউ করেছে বলে জানা নেই গেরার্ডের। এখন তো জানা দরকার হয়ে পড়ল। এক সেকেন্ড মানে কতক্ষণ? আবার কতক্ষণে ওই কাঁটা এক ঘর এগুবে? আন্দাজ করো! হিসাব করো!
মনে মনে গুনে যাচ্ছে গেরার্ড। গোড়ায় পাঁচ সেকেন্ড ছেড়ে দাও, যে-সময়টা গোনা হয়নি। তারপর থেকে এই—
এক সেকেন্ড ছয়, এক সেকেন্ড সাত, এক সেকেন্ড আট—
এইটুকু গুনতে-না-গুনতে একটা নরক যন্ত্রণা শুরু হল দেহে।
প্রথমত, অকারণে একটা দারুণ ভয় কোথা থেকে এসে গ্রাস করে ফেলল ওকে। ধমনীতে ধমনীতে রক্তের বদলে বইছে যেন ভয়ের প্রবাহ। সে-প্রবাহ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে ক্রমশ। এদিকে পেটের ভিতর পাক খাচ্ছে অবিরত। সারা শরীরে যেখানে-সেখানে এক একটা নাড়ী যেন স্পন্দিত হয়ে উঠছে— টিপ টিপ টিপ টিপ, জামার নীচে ঢেউ ভাঙছে যেন গায়ের চামড়ার।
এতক্ষণ ইঞ্জিনের শব্দের উপরেও ছিল অন্য একটা সোঁ সোঁ শব্দ। এইবার শব্দ শোনা যাচ্ছে তৃতীয় একটা, মাথার ভিতর মেঘের ডাকের মতো একটা গুরু-গুরু গর্জন। ভয় বেড়েই চলেছে, তার সঙ্গে ব্যথা, কী হয় কী হয় উত্তেজনাও সেইসঙ্গে। পেশিগুলো শক্ত হয়ে আসছে তক্তার মতো, বিশেষ করে তলপেটে আর কাঁধে; আর কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত হাত দু-খানাতে। হঠাৎ মারাত্মক উপসর্গ শুরু হল অন্য একদিকে। কোমর ভাঁজ হয়ে আসছে ধনুকের মতো, চেষ্টা করেও সোজা রাখতে পারছে না গেরার্ড।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলল এই যন্ত্রণা। চরমেও উঠল এক সময়। তখন মন বলে অবশিষ্ট রইল না কিছু, ব্যক্তিত্ববুদ্ধিও না। গেরার্ড যেন একটা বিভীষিকার আধারে পরিণত হয়েছে শুধু।
কতক্ষণ যে চলল এই অবস্থা, হুঁশ নেই ওর।
অবশেষে ফোঁটা ফোঁটা করে চৈতন্য যখন ফিরতে লাগল, গেরার্ড দেখল সে বসে আছে তার গদির উপরে, কন্ট্রোল-বাক্সটাকে ঠেলে ধরে আছে এক হাতে, নইলে যেন সেটা ভেঙে এসে তার দেহের উপরে পড়বে। জামাকাপড় ভিজে গেছে ঘামে, সে-ঘাম শুকোবার নয়, সে-ঘামে দেহ ঠান্ডা হচ্ছে না। ফুসফুসেও ঈষৎ ব্যথা, কিন্তু নিঃশ্বাস? এখনও নিঃশ্বাস নেই গেরার্ডের নাসিকায়।
ভগবানের রাজ্যে এ-সব কী? এই যন্ত্রণাতেই কি প্রাণ গেল ব্রাউন আর সেলিনির? গেরার্ডেরও যাবে সুনিশ্চিত, যদি আরও দুই-একবার হয় এর আক্রমণ। দুই বারের বেশি দরকার হবে না। যদি ঘন ঘন আসে। আসে যদি, আর তাতে যদি গেরার্ডের মৃত্যুও না-ঘটে, বুদ্ধিহীন জড়ে যে পরিণত হয়ে যাবে, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
সে অবস্থায়—
ডি এফ সি-তিন একদিন ফিরবে অবশ্য পৃথিবীতে, কম্পিউটার যন্ত্রই তাকে নিয়ে যাবে ফিরিয়ে। কিন্তু গেরার্ড, কী দেখল এই অভিযানে এসে, তা বলতে পারবে না। কাউকে গুছিয়ে বলার ক্ষমতা তার থাকবেই না।
কিন্তু এই আর এক অবাক কাণ্ড। ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে গেরার্ড দেখছে— এই যে অতিদীর্ঘ নরক-যন্ত্রণা, তার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিন সেকেন্ড! ক্রোধে বিস্ময়ে স্থিরদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে সেকেন্ডের কাঁটার দিকে, এমন সময় তা থেকে আবার একটু মৃদু শব্দ বেরুল, ‘পক’!
অর্থাৎ, তিন নয়, চার সেকেন্ড ধরা যেতে পারে গেরার্ডের যন্ত্রণার আয়ু। গেরার্ড দৃঢ়সংকল্প নিয়ে আবার গুনতে শুরু করল, এক সেকেন্ড এক, এক সেকেন্ড দুই, এক সেকেন্ড তিন—
না, এবার এ-গণনায় ছেদ পড়তে দেবে না ও, যতই যন্ত্রণা হোক বা অন্য কারণে চিত্ত যতই বিক্ষিপ্ত হোক। ক্যালেন্ডারের ওই এক সেকেন্ড যে আসলে কত দীর্ঘ সময়, তা সে হিসাব করে বার করবেই। পরিস্থিতিটা কী, সে-সম্বন্ধে একটা ধারণা সে করেছে ইতিমধ্যে। ওই যে ধরাছোঁয়ার বাইরে সোঁ সোঁ আওয়াজটা হচ্ছে, ওটা হয়তো কোনো অজ্ঞাত বিদ্যুৎপ্রবাহ থেকে উদ্ভূত। ওই প্রবাহের আওতায় এসে সময়মান দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছে। কাল সম্বন্ধে বৈমানিকের নিজস্ব ধারণা যা ছিল, এখনও তাই রয়েছে। কিন্তু বাইরে থেকে, ধরো পৃথিবী থেকে যারা ডি এফ সি-তিনের গতিবিধির উপরে নজর রেখেছে, তাদের সম্মুখে অন্য হিসাব আসছে একটা। অভিযানে বেরুবার পরে বিমানখানা কত যুগ ধরে ছুটে চলেছে অনির্দেশ পথে, সেই অতিবাহিত যুগযুগান্তরের হিসাব।
বিমানের বয়স বাড়ছে এক হারে, তার ভিতরে বসে বৈমানিকের বয়স বাড়ছে অন্য হারে।
পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলে দিয়েছিলেন, ডি এফ সি-তিন আলফা সেন্টৌরিতে পৌঁছোবে দশ মাসে। কিন্তু সেই দশ মাসের হিসাব বিমানের পক্ষে যেরকম, বৈমানিকের পক্ষে সেরকম নয়। যত চিন্তাই মাথায় আসুক গেরার্ডের, গণনায় সে বিরতি দেয়নি। এক থেকে গুনতে গুনতে সে পৌঁছে গিয়েছে সাত হাজার দু-শোতে।
সাত হাজার দু-শোতে পৌঁছোবার পরে ক্যালেন্ডারে সেকেন্ডের কাঁটায় শব্দ হল, ‘পক’। অর্থাৎ—
অর্থাৎ? বিমানের এক সেকেন্ড হল গেরার্ডের সাত হাজার দু-শো সেকেন্ড অর্থাৎ দু-ঘণ্টা।
তা যদি হয়, বিমান দশ মাসে অবশ্যই পৌঁছোবে আলফা সেন্টৌরিতে, কিন্তু সেই দশ মাস হবে গেরার্ডের পক্ষে ছয় হাজার বছর। অতদিন সে বাঁচবে না, ফিরবেও না পৃথিবীতে। যেমন ফেরেনি ব্রাউন ও সেলিনি।
তাদের বিমান হয়তো ফিরতে পারত, যদি পরিচালক হিসেবে তাতে কম্পিউটার বসানো থাকত। তা ছিল না।
গেরার্ড? সে ছয় হাজার বছর বাঁচবে না। ডি এফ সি-তিন এই সূর্যটারই এলাকা ছাড়িয়ে বেরুবার আগে মারা পড়বে গেরার্ড। আর আলফা সেন্টৌরি? সেখানে যখন শেষ পর্যন্ত হাজির হবে এই বিমান, গেরার্ডের শেষ চিহ্ন বলতে বিমানের ভিতর পড়ে থাকবে খানিকটা জায়গা নিয়ে ধুলোর আস্তরণ একটা।
ফিরে যাওয়া?
যাওয়ার উপায় নেই। একটা নির্দিষ্ট পথে ধাবমান রয়েছে ডি এফ সি, আলোকেরও ২২.৪ গুণ গতিবেগ নিয়ে। সে-কক্ষপথ থেকে তাকে বার করে আনা, তারপর পৃথিবীমুখী অন্য কক্ষে তাকে স্থাপন করা— এসব হল কম্পিউটারের কাজ, গেরার্ডের নয়। যন্ত্রই এখানে কর্তা, যন্ত্রী কেউ নেই এ বিমানে। তা কম্পিউটার অসময়ে এ কাজ করবে কেন? তার উপর নির্দেশ রয়েছে আলফা সেন্টৌরিতে আগে পৌঁছোবে, তারপর সেখানে একটা নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে যাবে যখন, তখন সে ফিরে আসবে বিমান নিয়ে।
বৈমানিক যদি তার আগেই মারা যায়, কম্পিউটার করবে কী তার? সে-খোঁজ নেওয়ার, বা অর্ধপথ থেকে ফিরে আসার কথা বিবেচনা করবার দায়িত্ব তার নেই। না দায়িত্ব, না ক্ষমতা।
তাই চলেছে বিমান। সৌরমণ্ডলের সীমা অতিক্রম করার আগেই গেরার্ডের মৃত্যু লক্ষণ দেখা দিল। মুমূর্ষু গেরার্ড। মরেই যেন গিয়েছে গেরার্ড।
না, ঠিক মরেনি তখনও। অর্ধমৃত। বাইরে থেকে কেউ দেখলে বলবে মৃতই। তবে কথা এই যে, বাইরে থেকে কেউ এখন আসবে না। কেউ দেখতে আসবে না যে গেরার্ড সত্যিই মরে গিয়েছে, না হতচৈতন্য নিঃসাড় দেহটার ভিতরে জীবনটা এখনও ধুকধুক করছে একটুখানি।
কিন্তু, কী আশ্চর্য! সত্যিই কেউ এল যে বাইরে থেকে!
এসে দাঁড়াল গেরার্ডের শয্যার পাশে। আর গেরার্ড জেগে উঠল আস্তে আস্তে। বিলুপ্ত চেতনার প্রত্যাবর্তন শুরু হল ধীরে ধীরে।
কী যে দেখছে সে, কী যে অনুভব করছে, তা সে জানে না। একটা কথা কেবল মগজে ঢুকছে— বাইরের সে সোঁ সোঁ আওয়াজ আর নেই। ক্যালেন্ডারের সেকেন্ড এখন আর ব্যবহারিক দুই ঘণ্টার সময় নয়, গবাক্ষ দিয়ে জোরালো আলো এসে পড়েছে বিমানে। আর— আর নিঃশ্বাস বইছে তার নাকে।
গেরার্ডের এই চেতনাটুকু যে ফিরিয়ে আনল, সে কে? কীরকম?
বলা শক্ত, বললে হাস্যকর শোনাবে। একটা অতিপলকা কলেবর, জ্যান্ত, খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে গোল হয়ে, ঘিরে আছে তার শয্যাকে। কিন্তু সন্দেহ হয় যে! কলেবর একটা? না, পরস্পরে জোড়া অনেকগুলো?
কী করে এ বা এরা এসে ঢুকল বিমানে?
কথা কইছে এরা। কী আশ্চর্য! ইংরেজি ভাষা এরা জানে নাকি? যদিও একটু বিটকেল ধরনের ইংরেজি, তবু ইংরেজি বলে চেনা যায়। এরা বলছে, ‘তুমি গেরার্ড তো? আমরা ক্লাইনেস্টাইন বিডেমুং। আমাদের ভালোবাসা নাও। আমরা এখানে, ওখানে, সেখানে অনেক, অনেক আছি। ভালোবাসা, ভালোবাসা নাও।’
‘তোমরাও আমার ভালোবাসা নাও।’ কী জানি কেন, ভালোবাসা জানানোটাই যেন সবচেয়ে বেশি দরকারি জিনিস বলে মনে হল গেরার্ডের।
তারপর বিমানের পর বিমান আসছে, ডি এফ সি-তিনের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে তাদের কোনো একখানা, গেরার্ডকে বিডেমুংরা নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের বিমানে। খুব ঘনিষ্ঠতা, ‘সর্বখাদক তোমায় ভালোবাসেন। আগে এসেছিল ব্রাউন আর সেলিনি। আমরা তাদের কাছে পৌঁছোবার আগেই সর্বখাদক খেয়ে ফেললেন তাদের। সেই থেকে আমরা খোঁজে খোঁজে আছি আবার কে কবে আসে? আমরা তোমাদের ভালোবাসা দিতেই চাই, তোমরা বার বার এসো— এই আমরা চাই। আমাদের দেশে নিয়েও যেতে চাই। তবে সর্বখাদকের আনাগোনা বড়ো বেশি এ-পথে, আগে আমাদের জানান দিয়ে এলে তবেই পৌঁছোতে পারবে সে দেশে।’
অতঃপর একদিন বিডেমুংরাই ডি এফ সি-তিনকে স্থাপন করল পৃথিবীমুখী কক্ষপথে, তারপরে গেরার্ডকে তাতে চড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিল ভালোবাসা জানিয়ে।
বিমান ছুটে চলেছে পৃথিবীর দিকে, হঠাৎ রেডিয়োতে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল, ‘ডি এফ সি-তিন! ডি এফ সি-তিন! গেরার্ড আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? তুমি কি বেঁচে আছ গেরার্ড? তোমার জন্য দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে আছি আমরা পৃথিবীর লোক। যদি শুনতে পাও আমার কথায় সাড়া দাও।’
ও-স্বর হার্টেলের। প্রকল্পের পরিচালক হার্টেল। সে সাড়া দিল, ‘ডি এফ সি-তিন বলছি প্রকল্পকে। হার্টেল, আমি গেরার্ড।’ তারপরই কী জানি কী ভেবে, কিংবা হয়তো কিছু না-ভেবেই গেরার্ড তার সম্ভাষণের সঙ্গে যোগ করল— ‘আমার ভালোবাসা নাও।’