সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

১৯. মহাবিমানের উল্লম্ফন

মহাবিমানের উল্লম্ফন

পৃথিবীর হাজার মাইল ঊর্ধ্বে।

ফ্লাই অ্যাওয়ে-২ তার কক্ষপথে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল, নিস্তব্ধ। এক-শো জন যাত্রী বহনের মতো বিশাল আয়তন বিমানটি, বর্তমানে তাতে লোক স্রেফ বৈমানিক কয়েকটি। বড়ো বেশি ফাঁকা লাগছে গর্ডন আর্পের।

আগে ছিল ডাক্তার, সম্প্রতি হয়েছে ক্যাপ্টেন, ওই গর্ডন আর্পে।

‘কখন আসছে তারা?’ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বার বার ওই একই প্রশ্ন করছে আর্পে। বিরক্তই হয়ে গিয়েছে সেকেন্ড অফিসার ফ্রেডরিক অয়েস্ট্রিকার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘প্রথম দল পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আসছে। এস ভি-১ মহাশূন্য বন্দরে পৌঁছে গিয়েছে সবাই, খেয়া বিমানে এইটুকু পাড়ি দিতে কতক্ষণ আর লাগবে?’

আর্পে নখ কামড়াচ্ছে। লম্বা, পাতলা মানুষটা চিরদিনই অস্থির প্রকৃতির, কিন্তু নখ কামড়ানো অভ্যাসটা তার আগে ছিল না, ওটা হালে আমদানি। তিক্ত স্বরে বলল নখর চর্বণের ফাঁকে ফাঁকে চিবিয়ে চিবিয়ে, ‘এইরকম একটা অভিযানে যাত্রী সঙ্গে রাখা, বদ্ধ পাগলে ছাড়া এ কাজ কেউ করে না।’

অয়েস্ট্রিকার টুঁ শব্দটিও করছে না। ওর পক্ষে যাত্রী বহন কিছু নতুন কাজ নয়। যাত্রী বহনের কাজই করেছে গত দশ বছর মঙ্গলের লাইনে। পাকা লোক, মজবুত কাঠামো, বয়স ত্রিশের বেশি নয়। মেজাজ বিষিয়ে রয়েছে, দশ বছর ক্যাপ্টেনি করার পরে আজ হঠাৎ অর্পের অধীনে সেকেন্ড অফিসারের পদ নিতে বাধ্য হওয়ার দরুন।

বাধ্য হয়েছে ঘটনাচক্রে। মহাশূন্য পরিক্রমার একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে আর্পে। পদ্ধতিটা পছন্দ হয়ে গিয়েছে আর্থ-সেন্টার কর্তৃপক্ষের। ফ্লাই অ্যাওয়ে-২ গড়ে তোলাই হয়েছে সেই পদ্ধতি অনুযায়ী ওড়াবার জন্য এবং যেহেতু সেভাবে ওড়াবার কলাকৌশল এই মুহূর্তে আর্পে ভিন্ন দ্বিতীয় ব্যক্তির আয়ত্ত নেই, তাই ক্যাপ্টেন করতে হয়েছে আর্পেকেই।

কিন্তু অয়েস্ট্রিকারকে অভিযান থেকে বাদই বা দেওয়া যায় কেমন করে? আর্পে নতুন পদ্ধতির আবিষ্কারক বটে, কিন্তু মহাকাশ পর্যটনের কালে বিমান চালনার মামুলি খুঁটিনাটি সে তো বিশেষ কিছুই জানে না। অথচ অয়েস্ট্রিকার ওদিকে অতিদক্ষ, আর্পের সঙ্গে তাকে জুড়ে দিতে পারলে আর্থ-সেন্টারের আর ভাবনার কিছু থাকে না। তাই অনেক সাধ্যসাধনায় তাঁরা সেকেন্ড অফিসারের পদটি গছিয়ে দিয়েছেন অয়েস্ট্রিকারকে, অদূর ভবিষ্যতের জন্য অনেক কিছু প্রলোভন দেখিয়ে।

আর্পে আবিষ্কারক মনিষ্যি, আবিষ্কারের আনন্দেই মশগুল হয়েছিল। ক্যাপ্টেনির দায়িত্ব ঘাড়ে চেপে বসবার পরে সে আনন্দ ফিকে মেরে আসছে ক্রমে। মহাকাশ বিমানের পরিচালনা সহজ ব্যাপার নয়, ওদিক দিয়ে নিজের অক্ষমতা সম্বন্ধে সে খুবই সচেতন। তার উপর, বোঝার মাথায় শাকের আঁটি এই যাত্রীবহনের ঝামেলা তার ধৈর্যচ্যুতিই ঘটিয়েছে একরকম। পাগলামি ওই আর্থ-সেন্টারের। এক-শোটা লোক, বিমানযাত্রায় যাদের হাতেখড়ি হতে যাচ্ছে এইবারই, অধিকাংশই স্ত্রীলোক এবং শিশু— ছিঃ ছিঃ—

জিনিসটার ফল ভালো যে হবেই, এ বিষয়ে আর্থ-সেন্টার এত নিশ্চিত কেমন করে যে হয়েছেন তা ভেবে পায় না আর্পে। পদ্ধতিটা নতুন, এ যাবৎ এমন প্রমাণ কিছুমাত্র পাওয়া যায়নি যে, এটা সাফল্যমণ্ডিত হবেই। যদি না-হয়? যদি বিপদ ঘটে? এই এক-শোটা নারী ও শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ি ওই আর্থ-সেন্টারকেই হতে হবে না? আর্পে? সে তো মরেই খালাস হবে। বেঁচে থেকে বিবেকের দংশনে জ্বলে মরতে হবে ওই হঠকারী কর্তাদের।

কিন্তু থাক সে কথা। কারা এই যাত্রীরা? এই এক-শোটা নারী ও শিশু?

বোঝাতে হলে আগের ইতিহাস খানিকটা আওড়াতে হয়। সেন্টৌরাস! দূর-অতিদূর সুদূরতম আলফা সেন্টৌরাস-এর উদ্দেশ্যে একটা অভিযান বেরিয়েছিল প্রায় বারো বছর আগে। সে অভিযান এখনও গন্তব্যস্থানে পৌঁছোতে পারেনি। ইতিমধ্যে আর্পে আবিষ্কার করেছে তার নতুন পদ্ধতি। হিসাব করে দেখা গিয়েছে যে, এই নতুন পদ্ধতি অনুযায়ী চললে দ্বিতীয় একখানা বিমান প্রথমটার একমাস পরেই সেন্টৌরাসে পৌঁছোতে পারবে, এত দিন পরে যাত্রা করেও। তেমন তেমন প্রয়োজন ঘটলে আগেও পারে পৌঁছোতে।

তা যদি পারে, তাহলে কর্তৃপক্ষ চুপ করে কেন বসে থাকবেন, ফ্লাই অ্যাওয়ে ১-এর প্রত্যাবর্তনের আশায়? সেন্টৌরাসে অভিযান পাঠানো হয়েছিল প্রয়োজনবশে— নিছক শখ মেটাবার জন্য নয়। প্রয়োজনটা জরুরি ছিল বারো বছর আগেই, এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্মমভাবে জরুরি। পৃথিবীর জনসংখ্যা না কমালে নয়। আগামী এক শতাব্দীর মধ্যে অন্তত এক-শো কোটি মানুষকে বিভিন্ন গ্রহে চালান দিতে না-পারলে ঘোর বিপর্যয় হবে এখানে। শোয়া বসা দূরে থাকুক, সবগুলো মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াবার পর্যন্ত জায়গা পাবে না।

উপনিবেশ! উপনিবেশ! মহাকাশের গ্রহে গ্রহে উপনিবেশ গড়ে তোলা ছাড়া উপায় নেই। অবশ্য মনুষ্যবাসের যোগ্য পরিবেশ খুব কম গ্রহেই আছে। দশটার ভিতর একটা গ্রহও যদি উতরে যায় ওদিক দিয়ে, আর্থ-সেন্টার ধন্য মনে করেন নিজেদের। যেমন মনে করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে এই রিপোর্ট পেয়ে যে, হাজার আলোকবর্ষ পারের সেন্টৌরাস গ্রহযুগলে মানুষ নিরাপদেই বাস করতে পারবে। ওখানকার অভিকর্ষ, আবহাওয়া প্রভৃতি শতকরা আশিভাগই পৃথিবীর অনুরূপ।

সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ফ্লাই অ্যাওয়ে-১কে পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন উইলোবির নেতৃত্বে। তবে সে বিমান ছিল ছোটো, বৈমানিক আর নানা শাখার বিজ্ঞানী ছাড়া অন্য কেউ তাতে ছিল না। তারা সেন্টৌরাসে পৌঁছে গবেষণা করতে পারবে, দুই-চারখানা ঘরবাড়ি গড়তে পারবে— এই পর্যন্ত। আসল উপনিবেশিদের পাঠানো হবে পরে।

সেই উপনিবেশিদের প্রথম দল হল এই যাত্রীদল, ফ্লাই অ্যাওয়ে-২ যাদের জন্য অপেক্ষা করছে কক্ষপথে। প্রধানত আগের বার যারা গিয়েছে, তাদেরই আত্মীয়পরিজন এরা। নারীরা যাচ্ছে তাদের স্বামীরা ইতিপূর্বেই গিয়েছে বলে। শিশুদের পাঠানো হচ্ছে, কারণ তাদের তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা আগে থেকেই সেখানে করে রেখেছে তাদের পিতারা।

ওই যে আসছে খেয়া-বিমান। এয়ার-লকের দরজা খুলে ক্যাপ্টেন আর্পে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়েছেন ওদের অভ্যর্থনা করবার জন্য। এটুকু সৌজন্য যাত্রীদের প্রাপ্য। মহাকাশ পরিক্রমায় এটা অলঙ্ঘ্য প্রথা। কাজেই, মনে মনে যত বিরক্তই হোক, আর্পেকে এগিয়ে যেতে হয়েছে হাজার কাজ ফেলেও।

খেয়াটা সরু, লম্বা, লালচে রঙের। একটা বিরাট তিমির মতো সে চলে আসছে বায়ুহীন ব্যোমসমুদ্র সাঁতরে। এয়ার-লকের গায়ে দরজাটা হাঁ করে আছে মস্ত একটা গুহার মতো। তারই ভিতরে তিমিটা এসে তার নাক ঢুকিয়ে দিল। গেঁথে গেল দু-খানা বিমান একত্রে। পৃথিবী থেকে হাজার মাইল উপরে। খেয়া থেকে একে একে যাত্রীরা এসে উঠতে লাগল ফ্লাই অ্যাওয়ে-২তে।

‘এই যে এই যে এই যে তুমি, এই যে তুমি এই যে তুমি মম্মি, মম্মি এই যে তুমি—’ শিশুরসনার কলকাকলীতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল ফ্লাই অ্যাওয়ের এয়ার-লক। তৃতীয় অফিসার স্টফার দাঁড়িয়েছিল আর্পের পাশেই, শিশুটি এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল তার হাঁটুর উপরে ‘ড্যাডি, ড্যাডি’ বলে।

স্টফারের অবস্থা একাধারে করুণ ও হাস্যকর। অজানা অচেনা শিশুর আচমকা পিতৃ-সম্বোধনে সে কী করবে, কী বলবে, ঠাউরে উঠতে না-পেরে ক্রমাগত বাচ্চাটার পিঠ চাপড়ে যেতে লাগল। আর্পে রীতিমতো রেগে উঠেছে, বিমানের শৃঙ্খলা-টৃঙ্খলা গোল্লায় গেল এইবার।

রেগেমেগে হঠাৎ হয়তো একটা বিসদৃশ কাণ্ডই সে করে বসত, এমন সময় খেয়া থেকে বেরিয়ে এল এক তরুণী ‘জুডি! জুডি!’ বলে ডাকতে ডাকতে। ‘জুডি! মাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছ সোনা! মাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছ জুডি?’

জুডির মায়ের বয়স আঠারো-উনিশের বেশি হবে না কোনো মতেই। প্যারি বা নিউইয়র্কের অপেরা বক্সে যেরকম শৌখিন অভিজাত মহিলাদের হামেশাই দেখা যায়, তাদেরই অন্যতমা। এইরকম মেয়েকে সেন্টৌরাসে পাঠানোর পিছনে কোন যুক্তি দেখতে পেয়েছেন আর্থ-সেন্টার? রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে গেল আর্পের। সে এক পা এগিয়ে এসে জুডির মায়ের ঠিক সামনে দাঁড়াল, ‘ভদ্রে! মাফ করবেন আমায়, কিন্তু আমার আশঙ্কা হচ্ছে আপনার কাগজপত্রে কিছু ভুল আছে হয়তো। তা যদি থাকে তো আপনাকে ফিরে যেতে হবে এই খেয়াতেই।’

জুডির মা তো অবাক, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ, তীক্ষ্ন স্বরে বলে উঠল, ‘ভুল! কী ভুল থাকবে কাগজে?’

‘না থেকেই পারে না।’ দৃঢ়স্বরে জবাব দিল আর্পে, ‘প্রথম বারের অভিযানে যাঁরা গিয়েছেন সেন্টৌরাসে, তাঁদের আত্মীয়রাই যেতে পারবেন এই বিমানে। কিন্তু প্রথম অভিযান পৃথিবী থেকে যাত্রা করেছিল বারো বছর আগে। বারো বছর আগে আপনার বিবাহ হয়েছিল, এই কথাই কি বলতে চান আপনি?’

‘না, তা বলতে চাই না।’ তরুণীর জবাবে শানিত বিদ্রূপ, ‘যা বলতে চাই, তা এই যে— বৈমানিকদের আত্মীয়া বলতে নিশ্চয়ই শুধু স্ত্রী বোঝায় না, বোঝাতে পারে কন্যাকেও। আমি যাচ্ছি ক্যাপ্টেন উইলোবির কাছে, তিনি আমার পিতা। আমার বিয়ে হয়েছিল মাত্র বছর আড়াই আগে, আর বিয়ের পরেই আমার স্বামী মারা যান। না-গেলে তিনি আমার সঙ্গেই থাকতেন এবং এতক্ষণ আপনার কান মলে লাল করে দিতেন।’

বাপ! আর্পে পালিয়ে বাঁচে, ‘অয়েস্ট্রিকার! তুমি দেখো ভাই!’

অয়েস্ট্রিকার এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ। সে কাউকে কোনো প্রশ্ন করতে গিয়ে কানমলা খাওয়ার ঝুঁকি নেবে না। আর্পের স্থান হল কলকবজার মহলে। ওই সবই সে ভালো বোঝে, আর এ বিমানে সে ছাড়া আর কেউ বোঝেও না এসব।

কিন্তু এক মাঘে শীত পালায় না। সন্ধ্যায় নতুন সংকট। বিমানে ডিনার। সমাগত যাত্রীদের সম্মানে। এটা অলঙ্ঘ্য প্রথা মহাকাশচারীদের সমাজে। ক্যাপ্টেনই গৃহকর্তা, তাঁর কাজ হল সবাইয়ের আদর-আপ্যায়ন করা। আর্পে কিন্তু ও কাজের ভার অয়েস্ট্রিকার আর স্টফারের উপর দিয়ে নিজে বেছে নিয়েছে অন্ধকার এক কোণের একখানা টেবিল।

এক-শো যাত্রী, তার উপরে বৈমানিকেরা তো আছেই। এত লোক যে একসাথে বসে খাওয়ার মতো প্রশস্ত জায়গা অত বড়ো বিমানেও নেই, একমাত্র সর্বনিম্নের খোল ছাড়া। তাতেও মালপত্র ছিল, সেগুলি এদিকে-ওদিকে সরিয়ে বেঁধে-ছেঁদে রেখে—

বেঁধে না রাখলে মেজে থেকে উঠে হাওয়ায় ভেসে বেড়াবে। বাতাসের চাপ তো নগণ্য?

আর্পের টেবিলে এক ছিমছাম মহিলা, বয়স একুশ থেকে একচল্লিশ, নামকরা টেলিভিশন- অভিনেত্রী, সিলিয়া গ্যাসপার্ডি।

‘আপনি সেন্টৌরাসে যাচ্ছেন কেন?’ নির্বাক থাকা অশোভন হয় বলেই আর্পে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হল সিলিয়াকে।

‘আমার স্বামীকে পাকড়াবার জন্য।’ সপ্রতিভ উত্তর, ‘আমাকে না-বলে পালিয়ে গিয়েছে। ভেবেছিল অতদূরে গিয়ে আমি আর শিং-এ দড়ি পরাতে পারব না তার। জানে না তো সিলিয়াকে—’

ওধারের টেবিল থেকে ভরাট গলার আওয়াজ উঠছে একটা। সেইদিকে তাকিয়ে আর্পেকে দস্তুরমতো স্তম্ভিত হতে হল। একটা দৈত্যাকার পুরুষ। কথা কইছে বিমান-যাত্রা সম্পর্কেই, ‘আমি যখন টাইটান আবিষ্কার করি, ধরুন সে আজ এক যুগ আগের কথা, তখন ওখানে কিছুই ছিল না। এখন একটা সভ্য উপনিবেশের পত্তন হয়েছে ওখানে, পৃথিবীর যেকোনো রাজধানী শহরের মতোই আরাম-বিরাম অনায়াসে পাওয়া যেতে পারে আজকের টাইটানে। একবার ভেবেছিলাম সেখানেই গিয়ে বসবাস করি।’

‘সেই তো ভালো ছিল—’ কে একজন বলল ওই টেবিলেরই লোক, ‘ওখানে আপনি খাতির পেতেন আলাদা রকম।’

দৈত্যাকার পুরুষটি যে কে, তা আর বুঝতে বাকি নেই আর্পের। ও হ্যামারস্মিথ, টাইটানের আবিষ্কারক যে হ্যামারস্মিথ, এটা আর কোন বৈমানিক না-জানে? তা ও আবার সেন্টৌরাসে চলেছে কীসের জন্য? কথাবার্তায় একটা অস্বাভাবিক দ্বন্দ্ব ফুটে বেরুচ্ছে লোকটার। একটা অশান্তির সৃষ্টি না-করে বসে!

সেই রাত্রেই ফ্লাই অ্যাওয়ে-২ নিঃশব্দে সেন্টৌরাসের দিকে পাখা মেলল। রাত্রির শেষ যামে, পাহারায় তখন আর্পেই স্বয়ং। বিমানে আর কেউ জেগে নেই তখন। এই নিশুতি সময়টাই বেছে নিয়েছে আর্পে, যাতে বিমান ওড়ানোর নতুন কায়দা আর কারও চোখে না পড়ে।

এই যে নতুন কায়দাটা, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উল্লম্ফন। হিন্দুদের কোনো এক কাব্যে নাকি এমন কথা লিখেছে, এক লাফে সমুদ্র পেরিয়ে চলে গেল এক বীর হনুমান। সেটা নিছক কল্পনাবিলাসই হতে পারে হয়তো, কিন্তু ফ্লাই অ্যাওয়ে-২-এর এই যে লাফ দেবার শক্তি, এটা কঠিন বাস্তব।

এই যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে এ বিমানের; তা জানে শুধু আর্পে, আর জানেন আর্থ-সেন্টারের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা জানেন বলেই ফ্লাই অ্যাওয়ে-২ আজ আকাশে উড়ছে।

আছে বৈশিষ্ট্য, সেটা কিন্তু সদাসর্বদা খাটাবার জন্য নয়। অর্থাৎ আকাশে উড়বার পরে যে ক্রমাগত একটার পরে আর একটা লাফ দিতেই থাকবে বিমানটা, তা মোটেই নয়। হিসাব করে আর্পে দেখিয়ে দিয়েছে যে পৃথিবী থেকে সেন্টৌরাস এই যে অকল্পনীয় দূরত্বটা, এর ভিতরে সেরকম লাফ ফ্লাই অ্যাওয়ে-২ দিতে পারবে মাত্র দুইবার। এক একবারে যত খুশি তত আলোক বর্ষ পরিমাণ পথ সে পেরিয়ে যাবে চোখের পলকে। কিন্তু—

প্রথম বারের লাফই বিমানকে করে রেখে যাবে ক্ষীণ, দুর্বল, জীর্ণ। দ্বিতীয় বার লাফের পরে তার আর আকাশে উড়বারই শক্তি থাকবে না। এর মানে দাঁড়ায় এই যে বিমান যদি দুটো লাফ দেয় শূন্যপথ পাড়ি দেবার সময়, দ্বিতীয় লাফের সঙ্গে সঙ্গেই তার পরমায়ুও শেষ হবে। সুতরাং একান্ত নিরুপায় না-হলে ওই দ্বিতীয় লাফটা বর্জন করে চলতে হবে।

ওটার প্রয়োজন হবে না বলেই আশা করে আর্পে, ওই দ্বিতীয় লাফের। তবে প্রথমটা? সেটা সে দিয়েছে, এইমাত্র। বিমান চালিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে। না-দিলে, প্রতিশ্রুতি সে কেমন করে রক্ষা করবে? আর্থ-সেন্টারের কাছে সে তো কথাই দিয়ে এসেছে যে মামুলি বিমানের চেয়ে অনেক কম সময়ে সে গন্তব্যস্থানে পৌঁছোবে! কিন্তু পৌঁছোনোর কথা পরে হবে, আপাতত সমস্যা, ফ্লাই অ্যাওয়ে-২-এর হল কী?

একটা অস্বাভাবিক কিছু যে ঘটেছে, সেটা ধরা পড়ল প্রথমে হাসপাতালে। ডাক্তার হয়েল বলে পাঠালেন ক্যাপ্টেনকে, ‘বিমানের ভিতর অক্সিজেন কমে যাচ্ছে, এর কারণ অনুসন্ধান করা হোক।’

সাধারণত বিমানে অক্সিজেন থাকার কথা নয় হাজার ফুট। তা থেকে বেশি যদি কমে যায়, শ্বাস নিতে কষ্ট হবে মানুষের। একজন রোগিনী ভুগছে সেই কষ্টে।

একজন রোগিনী ভুগছে শ্বাসকষ্টে, সেই থেকেই কি ধরে নিতে হবে যে অক্সিজেন কমে গিয়েছে বিমানে? আর তো কষ্ট হচ্ছে না কারও।

কিন্তু হয়েল এ আপত্তি খণ্ডন করে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে, ‘অন্য কারও কষ্ট না-হতে পারে আপাতত। কারণ বিমানের অন্য মানুষ সবাই বৈমানিক বলো, যাত্রী বলো— সবাই শ্বেতাঙ্গ। আর হয়েলের ওই রোগিনীটি, একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হল সেই এখানে, নিগ্রো রমণী।’

অবান্তর মন্তব্য একটা জুড়ে দিলেন হয়েল, ‘হোক নিগ্রো, একথা আমায় মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতে হবে, ওই নিগ্রো রমণীর মতো সুন্দরী আমি দেখিনি এ যাবৎ। অকারণে হ্যামারস্মিথের মতো লোক বিয়ে করেননি ওকে।’

হাম্যারস্মিথ? নিগ্রো রমণীকে বিয়ে? এতক্ষণে আর্পে বুঝতে পারছে টাইটানে না-গিয়ে সেন্টৌরাসে কেন যাচ্ছে হ্যামারস্মিথ। টাইটানে উপনিবেশ গড়ে উঠেছে, সমাজ তৈরি হয়েছে। সেখানে নিগ্রো স্ত্রীকে নিয়ে গেলে সামাজিক মর্যাদা মোটেই পাবে না হ্যামারস্মিথ। সেন্টৌরাস তো এখনও বন্য অবস্থায় রয়েছে। সেখানে প্রশ্ন তুলবার কেউ নেই।

কিন্তু হ্যামারস্মিথের স্ত্রী শ্বাসকষ্ট টের পাচ্ছে। অক্সিজেনের অভাব যখন ঘটে বাতাসে, কৃষ্ণাঙ্গদের উপরে সর্বপ্রথমে তার প্রভাব পড়ে। এটা পরীক্ষিত সত্য।

ওদিকে স্টফার এসে রিপোর্ট দিচ্ছে, সত্যই নয় হাজার থেকে কমে অক্সিজেনের ভাঁড়ার আট হাজার ফুটেরও কিছু কমে দাঁড়িয়েছে, ‘নিশ্চয় বিমানে ছিদ্র হয়েছে কোথাও, বেরিয়ে যাচ্ছে অক্সিজেন!’

আর্পে বিষণ্ণ হাসি হাসল, ‘বোধ হয় না। অক্সিজেন বেরিয়ে যাচ্ছে সারা বিমানের সর্বাঙ্গ দিয়ে, কোনো বিশেষ ছিদ্র দিয়ে নয়। আমরা মহাকাশের এমন এক স্তরে এসে পড়েছি, যেখানে কঠিনতম ধাতুও ঝাঁঝরা হয়ে যায় চালুনির মতো।’

একটা গুম গুম শব্দ শোনা গেল। না, বাজ ডাকছে না, কথা কইছে হ্যামারস্মিথ, ‘মহাকাশে এমন স্তর কোথাও নেই। কেউ শোনেনি এর কথা।’

‘এতদিন শোনেনি, কারণ এ স্তরে প্রথম বিমান এসেছে এই আমাদের ফ্লাই অ্যাওয়ে-২। এইবার শুনবে পৃথিবীর সবাই—’

অয়েস্ট্রিকারের দিকে আগুন দৃষ্টি হেনে আর্পে বলল, ‘তুমি নিগ্রো রমণীকে বিমানে তুললে সব জেনে শুনে?’

‘কী জেনে শুনে?’ সমান ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিল অয়েস্ট্রিকার, ‘কে জানত যে বিমান ঝাঁঝরা হয়ে অক্সিজেন বেরিয়ে যাবে? দশ বছর মঙ্গলের লাইনে বিমান চালিয়েছি, এমন আকাশ কোনোদিন পেরুতে হয়নি।’

‘এ আকাশে তুমি কেন, কোনো ক্যাপ্টেনকেই আসতে হয়নি কোনোদিন। ফ্লাই অ্যাওয়ে-১-এর ক্যাপ্টেন উইলোবিকেও না।’

‘উইলোবিকেও না? তিনি কি এ পথে সেন্টৌরাসে যাননি?’

‘না, এ পথ নতুন, আমাদের দ্বারাই আবিষ্কৃত। কোনো গোল হত না, ওই কালো মহিলাটি বিমানে না উঠলে। কী কুক্ষণে আমি যাত্রী অ্যাপায়নের ভার তোমার উপর দিয়েছিলাম।’

হয়েলের রিপোর্ট এল আবার, ‘রোগিণীর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আধঘণ্টার ভিতর তার প্রাণ বেরিয়ে যেতে পারে।’

হ্যামারস্মিথ গর্জে উঠল, ‘তা যদি যায়, ক্যাপ্টেন আর্পে, সেন্টৌরাসে পৌঁছোবার পর তোমায় ডুয়েল লড়তে হবে আমার সঙ্গে।’

‘লড়লে কী হবে? মৃত্যু?’ আর্পে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, ‘নতুন আকাশে বিমান চালায় যারা, তারা কেউ মৃত্যুকে পরোয়া করে নাকি?’

তারপর সব বৈমানিকের উপর দিয়ে চোখ একবার বুলিয়ে নিয়ে এসে আর্পে বলল, ‘এক পলকের ভিতর আমি এই বিমানকে পৃথিবীতেও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, অথবা সেন্টৌরাসেও পৌঁছে দিতে পারি। তবে তাতে বিমানখানা হবে ধ্বংস।’

‘এ সব উন্মাদের কথা।’ গর্জন শোনা গেল হ্যামারস্মিথের।

আর্পে কৃপার দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে, ‘আর তোমার কথা? সেটাকে অজ্ঞের কথা বলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো উদারতা আমার আছে। সে কথা যাক, বিমান ধ্বংস হলে তাতে ক্ষতি শুধু বৈমানিকদের, তাদের সেন্টৌরাসে গিয়ে বসে থাকতে হবে এক যুগ। যতদিন ফ্লাই অ্যাওয়ে-১ আবার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি না-হচ্ছে। তাকে যেতেও হবে মামুলি পথে, কারণ তার গঠন পদ্ধতি এই বিমানের মতো নয়। বৈমানিকদেরই অসুবিধা অনির্দিষ্টকালের জন্য পৃথিবীর সঙ্গে তাদের যোগ বিচ্ছিন্ন হলে। যাত্রীদের কথা ধরছি না, কারণ তারা তো সেন্টৌরাসে যাওয়ার জন্যই বেরিয়েছে।’

অয়েস্ট্রিকার বলল, ‘আমরা যদি সেন্টৌরাসে না-গিয়ে পৃথিবীতেই ফিরে যাই, ওই কৃষ্ণাঙ্গিনী মহিলাকে বাঁচাবার জন্য যাত্রীরা না-হয় পরে আবার যাত্রা করবেন, মামুলি কোনো বিমানে।’

আর্পে দৃঢ়স্বরে বলল, ‘তা হতে পারে না। নতুন পথে নতুন কৌশলে অবিশ্বাস্যরকম কম সময়ের মধ্যে সেন্টৌরাসে পৌঁছোবার শপথ নিয়েই আমি পৃথিবী থেকে বেরিয়েছি। কথা আমি রাখবই।’

হঠাৎ কোথায় কী একটা কল টিপল আর্পে, সমস্ত বিমানখানা ঢেকে গেল ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে। নিঃশব্দে দুলে উঠল বিমানটি একবার, তারপর সে আবার মসৃণভাবে এগুতে লাগল। আলোও ফুটে উঠল ধীরে ধীরে।

বৈমানিকেরা সবিস্ময়ে দেখল, অদূরেই তাদের চোখের সামনে উদয় হয়েছে এক সবুজে বাদামি রঙে মেশানো মহাগ্রহের।

‘ওই সেন্টৌরাস।’ বলল আর্পে, ‘খেয়া বার করো অয়েস্ট্রিকার, যাত্রীদের আগে রওনা করে দাও, তারপর তোমরা চলে যাও সেন্টৌরাসে। তাড়াতাড়ি করো। ফ্লাই অ্যাওয়ে-২ আর বেশিক্ষণ নেই, ভেঙে পড়ল বলে।’