১৮. নেপথ্য নারী
সাজানো গোছানো বৈঠকখানায় জ্যোতি বসু খানিকটা জড়সড় হয়েই বসেছিলেন। কিন্তু এক্ষুণি যে মেয়েটির সঙ্গে দেখা হবে, তার সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করা যায়, সেটা কিছুতেই মাথায় আসছিল না। শুনেছেন মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, ভাল গান গাইতে পারে, সেতার বাজায়, এমনকি চমৎকার ছবিও আঁকে। তা না হয় হল, কিন্তু মেয়েটি তাঁর জীবনে এলে তিনি কি সুখী হতে পারবেন? কিংবা, তার চেয়েও বড় কথা, ওকে তিনি কীই বা দিতে পারেন? এই চৌত্রিশ বছর বয়সেই রাজনৈতিক জীবনের ব্যস্ততা তাঁর পুরো সময়টাই প্রায় কেড়ে নিয়েছে। আর এটা এমন একটা বয়স, জীবনের অভ্যেসগুলোও রীতিমত শেকড় গেড়ে ফেলেছে। যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের এই সন্ধিক্ষণে, সব নতুন করে কি আর খাপ খাওয়ানো যাবে?
এসব সাতপাঁচ ভাবনার মধ্যেই বসুকে উঠে দাঁড়াতে হল, কারণ ঢলঢলে চেহারার একটি দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে ঘরে ঢুকল। প্রথমেই নজর কেড়ে নিল তার ডাগর দু’টি চোখ- কি স্নিগ্ধ আর কি গভীর সে চাহনি! গায়ে কাঁচা-সোনা রঙের আভা, শ্রীময়ী মুখখানি ঘিরে নেমেছে একরাশ লম্বা কালো চুলের ঢল। এক নিমেষে বসু বুঝলেন, মেয়েটির সম্পর্কে বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হয়নি। যা শুনেছিলেন, তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। মেয়েটি যথার্থ সুন্দরী। মেয়েটির সঙ্গে বছর দশেকের যে ফুটফুটে মেমসাহেবের মত বাচ্চা মেয়েটি ঢুকেছিল, তার দিকে তাকিয়ে বসু একটুখানি হাসলেন। গত কয়েকদিন ধরে যে সংশয়ে দুলছিল তাঁর মন, প্রায় অলৌকিকভাবে তা যেন মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল। বসু মনস্থির করে ফেললেন।
বসুকে সন্দেশ আর ডাবের জল খেতে দেওয়া হল। বোনকে পাশে নিয়ে মেয়েটি বসল তাঁর ঠিক উল্টোদিকের সোফায়। বাচ্চা মেয়েটি তখনও অসীম কৌতূহলে তাঁকে দেখে যাচ্ছে। খানিকবাদে মেয়েটি মৃদুস্বরে বোনকে সেখান থেকে উঠে যেতে বলল। কিন্তু বসু তখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, কী বলে কথাবার্তা শুরু করা যায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বুকের মধ্যে হাতুড়ি। তারপর দুম করে বলে ফেললেন, “এঁরা আমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথাবার্তা বলছিলেন— মানে আমাদের বাবা-মা, তা আমার এ ব্যাপারে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আপনার মতটা।…”
ওপার থেকে বসু বোধহয় একটু সলজ্জ নীরবতা বা বড়জোর সম্মতিসূচক অল্প ঘাড়নাড়া আশা করেছিলেন। তার বদলে এমন একটা পাল্টা প্রশ্ন আসবে, এমনটা মোটেও ভাবেন নি। “আপনি কি বাবার চাপে পড়েই এ বিয়েতে সায় দিয়েছেন?” মেয়েটি সরাসরি প্রশ্ন করে। গলার আওয়াজটা মধুর অথচ বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। “না- না-না, সে রকম কিছু নয়”—লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি বসু তাঁকে আশ্বস্ত করেন।
“কিন্তু আপনি তো রাজনীতির বিরাট জগতকেই আপনার কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সাতপাকে বাঁধা পড়ে অতবড় দুনিয়াকে সঙ্কুচিত করতে চাইছেন কেন? এটা তো আপনাদের আদর্শের বিরুদ্ধে যায়”, মেয়েটি সপ্রতিভভাবে জিজ্ঞেস করে।
বসু সত্যিই এতটা আশা করেন নি। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, “না, আমরা কিন্তু বিয়ের বিপক্ষে নই। চিরকুমারসভার সদস্য হবার প্রতিজ্ঞা আমাদের জন্য নয়।”
সে যাই হোক, ষোলো আনা টান ছিল দু’পক্ষেরই। মধ্য-তিরিশে বসুর তখন অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ, রুক্ষ সৌন্দর্যে রোম্যান্টিকতার স্নিগ্ধ ছোঁয়া। বসুজায়া কমলের ছোট বোন মঞ্জুলার কথায়, “দিদি তখন ওঁর প্রেমে এত পাগল যে, বলেই দিল ওঁকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না।”
ওঁদের বিয়ে হয়েছে আটচল্লিশ বছর আগে। এই দীর্ঘ পথ কিন্তু আগাগোড়াই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। জীবনে যত যন্ত্রণা, যত উদ্বেগ বসুকে ভোগ করতে হয়েছে, তার সমান ভাগ কমলকেও বইতে হয়েছে। অসামান্য মনোবল আর অসীম সাহসের সঙ্গে তিনি পেরিয়ে এসেছেন বহু দুস্তর দিন।
কমল বসু পুরোপুরি অরাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। বাবা বীরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট। আদতে ঢাকার বাসিন্দা মা আশালতা বসুকে পরিচিতরা চিনতেন ‘ময়না” বলে। বসুর বাবা ডাঃ নিশিকান্ত বসু ছিলেন বারদির জামাই। “উনিই সম্বন্ধ করে বাবা-মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন”—জানালেন মঞ্জুলা রায়, কমল বসুর ছোট বোন। বীরেন্দ্রবাবুর মেয়েরা ‘নিশিকাকা’কে চিনত, তবে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। চার ভাই বোনের মধ্যে কমলই ছিল সবচেয়ে বড়। পরের দু’ভাই সুবিমল (বিমল) ও মুকুল (সুধাময়) আর সবচেয়ে ছোট বোন মঞ্জুলা—বসু ও কমলের প্রথম সাক্ষাতের দিন দিদির হাত ধরে যে মিষ্টি মেয়েটি ঘরে ঢুকেছিল। দিদির চেয়ে সে চোদ্দ বছরের ছোট। এদিকে ডাঃ নিশিকান্ত বসু তখন ছোট ছেলের জন্য একটি সুপাত্রীর খোঁজ করছেন। সেই ছেলে জ্যোতির তখন রাজনীতিই ধ্যানজ্ঞান, নাওয়া খাওয়ার, বাড়ি ফেরার কোনও ঠিক নেই, নেই তেমন কোনও উপার্জন। সে পরিষ্কার বলে দিয়েছে বিয়েটিয়ে করবে না। বাবা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছেলেকে একটু নরম করালেন, বাবার পছন্দ করা পাত্রীকে দেখতে যেতে সে রাজী হল।
আর প্রথম দর্শনেই কমল ওঁর ধনুর্ভঙ্গ পণ চুরমার করে দিল। কিন্তু শুধু দুজনের মধ্যে তীব্র আকর্ষণটাই নয়, ওঁদের গোটা পরিবারটাকেও বসুর ভারী ভাল লেগে গেল। কমলের স্নেহশীলা মা—সে আমলে যাঁর রূপের বিশেষ খ্যাতি ছিল, উদারমনস্ক, হৃদয়বান বাবা, ছটফটে দু’টি ভাই ও আদুরে ও মিশুকে ছোট্ট বোনটি—সবাই মিলে বসুকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেললেন। ১৯৪৮ সালে ৫ই ডিসেম্বর ওঁদের বিয়েও হয়ে গেল।
উত্তর কলকাতার এক ম্যারেজ রেজিষ্ট্রেশন ব্যুরোতে ওঁদের বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন করা হল। রেজিষ্টারে এ বিয়ের সাক্ষী হিসেবে সই করলেন বসুর বড়দি সুধার স্বামী ডঃ স্নেহময় দত্ত, কমলের মামা শ্রী জীবনরঞ্জন নাগ এবং বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্নেহাংশু আচার্য। বসু শপথ নিয়েছিলেন ইংরেজিতে—’আই, জ্যোতি বাসু, ম্যারিড কমল বসু ডটার অর্…’—ইত্যাদি। মালাবদল করা হল। রেজিষ্ট্রারের স্ত্রী সেই শুভ মুহূর্তে হঠাৎ শাঁখও বাজিয়ে দিলেন। বীরেন্দ্রবাবুরা তখন থাকতেন মুদিয়ালিতে। সন্ধ্যায় সেখানে তিনি অতিথি আপ্যায়নের ছোটখাট আয়োজন করলেন। তখন খাদ্যনিয়ন্ত্রণের নিয়ম চলছে, খাওয়ানো হল ডালপুরী আলুর দম ইত্যাদি।
পরের দিন বসু নব পরিণীতা বধূকে নিয়ে উঠলেন নিজের বাড়ি হিন্দুস্তান পার্কে। নতুন বৌ বরণ করার সময় আত্মীয়স্বজন কিছু নিয়ম আচার তো পালন করবেনই— বসুর সেটা একেবারেই পছন্দ নয়। “এসব প্রথা, স্ত্রী আচার আবার কি”, বাধ্য বিনীত মেয়ের মত কমল অবশ্য সবই করলেন, মাছও ধরলেন, দুধে আলতায় দাঁড়ালেন, ননদ সুধাকে গিনি দিয়ে প্রণামও করলেন, বসু তখন আর ধৈর্য রাখতে পারছেন না, “এসব কি হচ্ছে?” বেশ জোরে চেঁচিয়ে নতুন বৌ-এর উদ্দেশে ইংরেজিতে বলে চলেছেন— “কমল, কাম অন, কাম অন, কমল…”। বড়দি সুধার মেয়ে নেনু, বসুর ভাগ্নী, মামাকে বকে উঠল—”মামা, তোমার সব তাতে বাড়াবাড়ি, আমাদের একটু আনন্দ করতে দাও না।” বসু চুপ করে গেলেন।
“তখন শ্বশুরবাড়িতে ছিল আমার শাশুড়ির বারদি থেকে আনা একজন কাজের লোক, তার নাম ছিল সুখদা”, বললেন কমল বসু, “সে আমায় কত যত্ন করে ইলিশমাছ রান্না করে খাওয়াল একদিন, বলল ‘তোমার শাশুড়ি থাকলে তোমাকে কত আদর করতেন’। তার কাছে আমার শাশুড়ির অনেক গল্প শুনতাম, তিনি খুব পান খেতেন আর রাতে উঠে মাঝে মাঝে সুখদাকেও পান খাওয়াতেন। তখন আমি সদ্য- পরিণীতা,—নতুন বাড়িতে নতুন পরিবেশে সুখদার সেই মমতাপূর্ণ ব্যবহার আমি ভুলতে পারিনি, ভোলা যাবে না।”
বিয়ের পর প্রথম কয়েকটা মাস কীভাবে যে কেটে গেল! ‘কমল’ ‘কমল’ আর ‘কমল’—কমলের অবুঝ নিষ্পাপ রোম্যান্টিকতায় বসু তখন মন্ত্রমুগ্ধ। স্কুলের সার্টিফিকেটে নাম ছিল ‘কমলা’, ডাক নাম ছিল ‘কমল’। বিয়ের সময় শ্বশুরমশাই বললেন ‘কমল নামটাই বেশ’–সেই থেকে ‘কমলা’ হয়ে গেলেন খাতায় কলমে ‘কমল’। “মাঝে মাঝে উনি বলতেন নেহরুর ‘কমলা’, আমারও কমলা”—চার দশক পিছিয়ে গিয়ে বললেন আজকের শ্রীমতী কমল বসু।
তখন দুজনের দুজনকে আবিষ্কার করার সময়। বসু জানলেন মেয়েটি কেবল আকর্ষণীয়াই নয়, বুদ্ধিমতী, কোমলস্বভাব এবং ভাবপ্রবণ! আরও জানলেন তাঁর স্ত্রী একজন কবি, আগে শুনেছিলেন ভাল ছবি আঁকেন, এখন দেখলেন কবিতার ডায়রি। দেখে বসু উচ্ছ্বসিত : “মাই ওয়াইফ ইজ্ আর পোয়েটেস্!”—বিস্ময় আর ধরে না! মুগ্ধ হয়ে যান স্ত্রীর বাংলা ভাষা আর সংস্কৃত ভাষার জ্ঞান দেখে। ঠিক ঠিক মুহূর্তে কেমন চমৎকার আবৃত্তি করে দেন রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন! আরও জানলেন স্কুলকলেজে কমল কখনও রচনায় দ্বিতীয় হয়নি, প্রথমস্থানটা ছিল তার একচেটিয়া।
আর কমলও যেন দিনে দিনে স্বামীকে আবিষ্কার করে—মানুষটা বাইরে কি গম্ভীর অথচ ভেতরে ভেতরে কত কোমল, কত রোম্যান্টিক। আর কি আদর্শবাদী। আর এত জ্ঞানী মানুষের সাহচর্য সে আগে কখনও পায়ই নি। এই বয়সেই জীবন সম্বন্ধে সে কত কিছু জেনে ফেলেছে! কেমন সহজ করে একদিন রাতে বুঝিয়ে দিল ডায়ালেকটিকাল মেটিরিয়ালিজ্ম’ (দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ) কাকে বলে। আর কত ইংরেজি কবিতাই না জানে, কী শেলীর লাইন তো কণ্ঠস্থ। বেশ পারে সৌন্দর্যের তারিফ করতে—কখনও বলে “ইউ আর গ্লিটারিং লাইক আ মরনিং সান” (“তুমি যেন সকালের ঝলমলে রোদ’) আবার কখনও আবৃত্তি করেন ইংরেজ কবি বায়রণের কবিতা :
“শি ওয়াক্স ইন বিউটি, লাইক দ্য নাইট
অব ক্লাউডলেস ক্লাইম্স এ্যাণ্ড স্টারি স্কাইস্”
কিন্তু রূঢ় বাস্তবের কঠিন ছোঁয়ায় এ স্বপ্নও দীর্ঘস্থায়ী হল না। সেই প্রথমরাতের মুগ্ধতার মধ্যেই বসু হঠাৎই কমলকে বলেছিলেন : “আচ্ছা, তুমি পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ? পুলিস বোধহয় আমায় ধরতে আসছে।” কমল চমকে ওঠেন। “এ কি ছন্দপতন! এ কি অশুভ কথা।” বসু আলতো করে তার হাত দুটো ধরে বলেন, “কিছু মনে কোরো না। তোমার মনটা একটু তৈরি করতে চাইছিলাম। বুঝতে পারছো তো এটাই কিন্তু আমার জীবন।” বার বার মনে করিয়ে দিতেন নিজের জীবনের অনিশ্চয়তার কথা। মনটা আকাশে উড়লেও পা দুটোকে যেন শক্ত জমিতে রাখতে চাইতেন। “একদিন ভোররাতে বললেন”, কমল জানালেন, “এইবার বোধহয় তোমার মা-বাবা বুঝতে পারছেন, কার হাতে মেয়ে দিয়েছেন, দেখো কান্নাকাটি না পড়ে যায়।”
সেই বিচ্ছেদ বড় তাড়াতাড়িই এল। বিয়ের তিন মাস পূর্ণ হবার আগেই বসুকে গা ঢাকা দিতে হল। কমল হয়ে গেলেন একেবারে একা। সেই গভীর ভালবাসার মানুষটা হঠাৎ চলে যেতে বাধ্য হল। মনের সেই উথাল পাথাল শূন্যতার অনুভূতি আগলাবার মত কেউ তখন কাছেও নেই। একাই করেছেন মনের সঙ্গে বোঝাপড়া। একটু একটু করে নিজেই বুঝতে শিখলেন স্বামীর জীবনের অনিশ্চিত গতি। তবে সেটা ছিল সবে শুরু। বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ শূন্যতা ভরাবার চেষ্টা করতেন কবিতা লিখে। “শ্বশুরমশাই খুব উৎসাহ দিতেন”, বললেন কমল বসু, “বলতেন, লেখো, মা, লেখো।” বাড়িতে একটা আমগাছ ছিল, তখন চৈত্র মাস, আমের মুকুল সবে ধরেছে, একটা রকিং চেয়ারে বসে নির্জনে দুপুরে কবিতা লিখতেন, ভাবতেন ভালবাসার সেই মানুষটার কথা। কবিতায় খাতা ভরে উঠত। তখন কে জানত কিছুদিনের মধ্যেই উঠবে প্রবল ঝড় আর দকা ঝোড়ো হাওয়ায় শুকনো পাতার মত কোথায় চিরকালের মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সেই সব কবিতা।
বসু স্ত্রীকে ছেড়ে থাকতে একদম ভালবাসতেন না, কমলের কথা সব সময়ই মনে পড়ত। কাজের জগতে আরও বেশি করে ডুবে থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, তবুও ক্ষণে ক্ষণে সেই লাবণ্যময় মুখখানি চোখের সামনে ভেসে উঠত। এদিকে কমলের কাছে সময় হয়ে উঠত ভারী সীসের মত। নিঃসঙ্গতার সঙ্গে সে এক প্রাণান্তকর যুদ্ধ। দুজনেই দুজনের সঙ্গে দেখা করবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন। দেখা হত লুকিয়েচুরিয়ে। “ঠিক যেন অভিসারের মত”, বললেন কমল বসু “বিদায় নেবার সময় দুজনেরই মন ভারী হয়ে উঠত।” চলে গেলে আবার সেই অতল বিরহ। সে সময় মঞ্জুলা এসে থাকত দিদির সঙ্গে। মঞ্জুলার কথায়, “এক রাতে দরজায় একটা আলতো টোকা শুনে আমি উঠলাম। খুলতেই ভূত দেখার মত চমকে গেলাম—দেখি, সম্পূর্ণ অচেনা একটি লোক দরজায় দাঁড়িয়ে। চোখে চশমা, সরু গোঁফ আর মাথার চুলগুলো উল্টে আঁচড়ানো।—আমি তো ভাবলাম দিদিকে জেরা করবে বলে সাদা পোশাকের পুলিস এসেছে। ভয়ে তখন আমি ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে শুরু করেছি। তক্ষুণি লোকটি আমায় ভ্যাবাচাকা খাইয়ে বলে উঠল, আরে খুকু, আমি রে আমি, তোর জামাইবাবু!
“আমি নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ওটা যে সত্যিই জামাইবাবু, তা বুঝতে আমার আরও বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল”, হাসতে হাসতে মঞ্জুলা বলেন, “দিদির সঙ্গে গোপনে তিনি দেখা করতে এসেছিলেন।” আত্মগোপনপর্বে বাড়ির বাইরে ও ভিতরে বসু মাঝে মাঝে স্ত্রীকে এমন আচমকাই দেখা দিতেন। চকিতের দেখা। হু হু করে কোথা দিয়ে মুহূর্তগুলো উড়ে যেত। আশেপাশে সাদা পোশাকের পুলিস সব সময়ই ঘুরঘুর করত। মঞ্জুলার কাজ ছিল বাড়ির চারপাশে নজর রাখা, যাতে বিপদ দেখলে আগেভাগেই দিদি-জামাইবাবুকে সতর্ক করে দেওয়া যায়।
ছদ্মবেশে বসুর চেহারা একেবারে পাল্টে যেত। কমল বসুর কাছে এ নিয়ে ভারী মজার একটা গল্প শোনা গেল। বসুর ভগ্নীপতি স্নেহময় দত্ত একদিন দেখতে পেলেন তাঁর মেয়ে অরুণা (নেনু) তাঁদের ৩৯, হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ির সামনে এক সুদর্শন যুবকের সঙ্গে হাঁটছে। স্নেহময়বাবু সাংঘাতিক রক্ষণশীল লোক, এ দৃশ্য দেখেই তিনি ক্ষেপে গেলেন। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরেই তিনি স্ত্রীকে জানালেন “নেনু এক ছোকরার সঙ্গে বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছে।” অরুণার মা সুধাও এ খবর শুনে চটে লাল। অরুণা বাড়ি ফেরামাত্র তিনি মেয়ের গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিলেন। “কোন্ সাহসে তুমি রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও?”—মায়ের কথা শুনে অরুণা তো প্রথমে থ, শেষে বুঝতে পেরে বলল, “মা, ওটা তো মামামণি ছিল, তোমার আপন ভাই।” বোঝো! গর্বের হাসি হেসে কমল বলেন, “আমার স্বামীর ছদ্মবেশ ছিল এতই নিখুঁত।”
বাড়িতে আসার ঝুঁকি নিতে যখন ভরসা পেতেন না, বসু তখন কমলের ছোট ভাই মুকুলের হাত দিয়ে স্ত্রীকে চিঠি পাঠাতেন। বেশিরভাগ চিঠিতেই থাকত নানা উদ্ধৃতি, প্রবচন। কোনওটায় লিখতেন, ‘মানুষ ভাবে টাকা দিয়েই বুঝি ভালবাসা মাপা যায়। ভুল। ভালবাসাই ভালবাসার একমাত্র মাপকাঠি।” কিংবা “পরিস্থিতি বিচার করেই বাঁচো, সিদ্ধান্ত নাও’। আবার শেখাতেন কত কী! ‘মনে রেখো তুমি পৃথিবীতে দু’শো বছর বাঁচার জন্য আসোনি। এর মধ্যেই তোমায় সব করতে হবে, সবাইকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে, সবার জন্য করতে হবে’। কখনও লিখতেন, ‘জানো তো, বন্ধুত্ব স্নিগ্ধ, প্রাণ-জুড়োনো জলের মত কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে তা হয়ে যেতে পারে টলটলে উত্তেজক পানীয়’। লিখতেন দেশের জন্য তাঁর একমুখী আদর্শের কথা। কমল কিন্তু উত্তরে লিখতেন, “আমি স্তালিনের বউ হতে চাই না।” আবেগে, উত্তাপে ভরা সেই ছোট ছোট চিঠিগুলো কমল সযত্নে রেখে দিতেন একটা ভেলভেটের বাক্সে।
স্বামীর পথ চেয়ে থাকাটা কমলের কাছে ছিল ধৈর্যের বিরাট পরীক্ষা। কখনও কখনও বিছানায় বসে জানালা দিয়ে চেয়ে থাকতে থাকতেই ঘুমে ঢলে পড়তেন তিনি। আর শুধু প্রতীক্ষাই তো নয়, তার সঙ্গে মিশে থাকত ভয়। দুশ্চিন্তার নানা ভাবনা মাথায় ভিড় করে আসত, কিন্তু বাড়িতে দ্বিতীয় কোনও মহিলা ছিলেন না, যাকে সব বলে একটু হাল্কা হওয়া যায়। পর পর তিনটে বিরাট ঘর, মাঝখানেরটা ছিল তাঁদের শোবার ঘর, কোলে বড় টানা বারান্দা। কখনও শ্বশুরের ঘরে গিয়ে বসতেন। “শ্বশুরের মনে ছোটছেলেকে নিয়ে কোনও দুঃখ কিন্তু ছিল না, বাইরের লোকের কাছে গর্বভরেই ছেলের কথা বলতেন, বিছানার ওপর টান হয়ে বসে থাকতেন, কত ভাল উপদেশ দিতেন আমায়, তবুও আমার মন মানতো না”—বলেন কমল বসু। কখনও নিশুতি রাতে এসে দাঁড়াতেন ব্যালকনিতে, মনকে যেন বোঝাতেন, এখানে দাঁড়ালেই স্বামীর সঙ্গে দেখা হবে। আর এখান থেকে সরে গেলে ওঁর বিপদ ঘটতে পারে। রাতে হরিদাসী নামে এক পরিচারিকা কমলের ঘরের বাইরে শুত। অনেকবার এমন হয়েছে, সেই ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যেই শ্বশুরমশাই এসে বলতেন, ‘কমল দরজা খোলো। পুলিস এসেছে। প্রথমবার যখন ওরা এল, আমি দরজা খুলতেই ঝড়ের মত ঢুকে ওরা প্রতিটি আনাচকানাচ তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করল। আর আমার স্বামী যে রকম শিখিয়ে দিয়েছিলেন, সেইমত কঠিন মুখে আমি ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইলাম, মাথায় ঘোমটা তুলে; ভেতরে ভেতরে আমার দেহ ভয়ে নীল হয়ে গেলেও চোখে মুখে আমার বিন্দুমাত্র ভয়ের চিহ্ন ছিল না। সেই সব দিনগুলোর কথা কমল আজও স্পষ্ট মনে করতে পারেন, “পুলিসরা গোটা বাড়িতে তল্লাশি চালাল, সমস্ত কিছু উল্টেপাল্টে দেখল, তারপর যেমন হুড়মুড় করে ঢুকেছিল, তেমন করেই আবার বেরিয়ে গেল। দুশ্চিন্তায়, দুর্ভাবনায় সারা রাত ঠায় বসে কাটালাম তারপর।”
কমলের শ্বশুরমশাই কিন্তু তাঁকে সব সময় প্রবোধ দিতেন। “প্রায়ই তিনি আমায় বলতেন, ‘মুখ ভার করে থেকো না’। তারপর পাশেই লেকের ধারে হাঁটতে নিয়ে যেতেন। একটা বেঞ্চে বসে কোনও কোনও দিন চোখ মুদে ধ্যান করতেন, সাধকের মত ছিলেন, কোনও কোনও দিন তিনি আমায় বোঝাতেন, জীবন সম্পর্কে নানা শিক্ষা দিতেন, চুপচাপ পাশে বসে আমি শুনে যেতাম। একদিন তিনি বললেন, ‘ঠাকুর ইচ্ছে করলে এখনই ফুরফুরে হাওয়া দেবে’। বললে বিশ্বাস করবে না, কথাটা বলামাত্র সেই প্যাঁচপেচে গরমের দিনে মিষ্টি হাওয়া বইতে শুরু করল। আর একদিন হঠাৎ বললেন ঠাকুর ইচ্ছা করলে তুমি গনাকে (জ্যোতি বসুর ডাকনাম) দেখতে পাবে’—কথাটা শুনে আমার বুকের মধ্যে রক্ত ছলাৎ করে উঠল, তাকাতেই দেখি, চেনা ছদ্মবেশে আবার স্বামী এদিকেই এগিয়ে আসছেন। হঠাৎ যেন আবির্ভূত হলেন! এত অবাক আর এত খুশি হয়েছিলাম সেদিন।”
যেদিন কমল বুঝেছিলেন তিনি গর্ভবতী, সে দিনটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভাললাগা দিনগুলোর একটা। খবরটা স্বামীকে দেওয়ার জন্য তিনি আর তর সইতে পারছিলেন না। কিন্তু এই আনন্দটা ভাগাভাগি করে নিতে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধৈর্য ধরতে হয়েছিল। ইতিমধ্যে নজরদারি আরও কড়া হয়েছে। বসুর ভগ্নিপতি ডঃ স্নেহময় দত্তের বন্ধু প্রসাদ বসু তখনকার পুলিসের আই. জি. ছিলেন।। উনি বার বার তাঁকে বলেছিলেন ‘তোমার শালা কিন্তু এখানে ঘোরাফেরা করছে, পুলিসের কিন্তু নজর আছে।’ যাই হোক, ১৯৫১ সালের ৩১শে আগষ্ট ল্যান্সডাউন রোডের শিশুমঙ্গল হাসপাতালে ডাঃ পিল্লাই-এর তত্ত্বাবধানে কমল একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। “মেয়েটা হয়েছিল খুব সুন্দর, ফুটফুটে, চোখ দুটো চমৎকার, ঠোঁটটা ঠিক ওঁর মত”—আর্দ্রস্বরে বললেন কমল বসু, “আমি ছোট ভাই মুকুলকে বললাম খবরটা ওঁকে পৌঁছে দিতে। মুকুল এক বাক্স সন্দেশ কিনে নিয়ে গিয়ে ওঁকে খবর দিল। ওঁর তো খুশি আর ধরে না, মেয়ের খুব সখ ছিল, সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে দেখতে চাইলেন। কিন্তু সে সাধ ওঁর মেটেনি—পথে বেরোনো মাত্র সাদা পোশাকের এক পুলিস এসে ওঁকে বলল, ‘জ্যেতিবাবু, আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।’ ‘কে জ্যোতিবাবু, আপনারা বোধহয় ভুল করছেন’, তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিলেন। ওরা আবার বলল, ‘আপনাকে আমরা চিনতে পেরেছি, জ্যোতিবাবু, আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।’ অগত্যা উনি হাল ছেড়ে দিলেন—ওঁকে গ্রেফতার করা হল। আর তার দশ দিনের মধ্যে ডায়রিয়া আর ডিহাইড্রেশনে ভুগে বাচ্চাটি মারা গেল।” কমলের স্বর আর্দ্র হয়ে ওঠে—”কিন্তু সে কথা আমায় কেউ জানায়নি, ডাক্তার আর নার্সরাও নয়। ওঁকে খবর দেওয়া সত্ত্বেও উনি জানতে পারেন নি, চিরকুটটা পড়ার আগেই আবার ওঁকে পুলিস ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা সেই ছোট্ট মুখটার ওপর একটা অক্সিজেন মাস্ক চাপা দিয়ে আমাকে বুঝিয়েছিল, ওর চিকিৎসা চলছে। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে কি সত্যিটা আড়াল করা যায়?”
“সেদিনের কথা ভাবলে আজও বুকের মধ্যে টন্টনিয়ে ওঠে। উনি কাছে নেই, কোলও খালি হয়ে গেল, বিধাতার কি নিষ্ঠুর পরিহাস! সে এক অসহ্য দুঃসময়।” “প্রায়ই দেখতাম”, ছোট বোন মঞ্জুলা বললেন, “দিদি কাঁদছে, বাবা সান্ত্বনা দিচ্ছে, আমরা ছোট ভাইবোনেরা কেমন যেন গুম্ হয়ে বসে আছি, সামনে যেন কোনও আলো নেই।” জীবনে কিছু ক্ষত এমন থাকে যেখানে সময়ও কোনও প্রলেপ লাগাতে পারে না।
কমলের কোমল রোম্যান্টিক মনটা যেন ভেঙে খানখান হয়ে গেল। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর স্বামীর ক্ষেত্রে রাজনীতিটা নিছক যৌবনের নেশা নয়। বসুই তাঁকে বলেছিলেন, “রাজনীতি আমার প্রথম প্রেম, আমার ধমনীতে রাজনীতি। ও আমি কোনও মতেই ছাড়তে পারব না।” একদিন বসুর বাবাও ছেলেকে বলেছিলেন, “হ্যাঁরে গনা, তুই এসব কেন ছাড়ছিস্ না? দ্যাখ তো, মেয়েটা কেমন কষ্ট পাচ্ছে।” তা, বসুর বাবা ছিলেন লোকনাথবাবার পরম ভক্ত। উত্তরে বসু দেওয়ালে টাঙানো লোকনাথবাবার বিশাল ছবিটা দেখিয়ে বলেন, “তুমি ওঁকে ছাড়তে পারবে?” এরপর নিশিকান্তবাবু আর কথা বাড়ান নি।
বসু জেলে থাকাকালীন কমল প্রায়ই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। বসু ও তাঁর কমরেডদের জন্য সঙ্গে থাকত নানা ফলমূল, বসুর প্রিয় খাবারদাবার। পুলিস অফিসাররা সে সব ঘেঁটে দেখতেন, একবার একটা তরমুজ ধাক্কা দিয়ে ফুটবলের মত গড়িয়ে দিয়েছিল পুলিস, কমলের দারুণ রাগ হয়েছিল তখন। শীতের সময় কমল ওঁর জন্য একবার একটা পুলওভার এনেছিলেন, সেটাও হাতড়ে হাতড়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল। বসুর সেটা এতটুকু ভাল লাগেনি। স্বামীর সঙ্গে কমলের কথাবার্তা হত একটা অস্বাভাবিক চওড়া টেবিলের দু’পাশে বসে, আর টেবিলের প্রান্তে বসে একজন পুলিস সে সব কথা শুনতেন। একদিন সেই পুলিসটি আচমকা টেবিলের ওপর উঠে বসল। মেজাজ হারিয়ে কমল তীব্র ভর্ৎসনার সুরে বললেন, “আপনার কি এতটুকু মানবিকতা নেই? আমরা তো যথেষ্ট জোরেই কথা বলছি, আপনিও ভালই শুনতে পাচ্ছেন।” কমল পরে বলেন, “আমার স্বামীকে অবশ্য দেখলাম চুপ করে থাকতে। বুঝলাম, তিনি অতিকষ্টে রাগ সংবরণ করলেন।” বিয়ের বহু বছর বাদে বসু-দম্পতি প্রথমবার তাঁদের বিবাহ-বার্ষিকী পালন করার সুযোগ পান। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বসু ততদিনে নির্বাচনে জিতে এসেছেন, তখন তিনি বিধানসভার বিরোধীদলের নেতা। কমলও তখন ধীরে ধীরে স্বামীর ঝোড়ো রাজনৈতিক জীবনে ধাতস্থ হয়েছেন।
সেই দিনটার কথা খুব ভাল মনে আছে মঞ্জুলার। “জামাইবাবু, দিদি আর আমি পার্ক স্ট্রীটের ‘পিপিং’-এ খেতে গিয়েছিলাম।” কমল মনে করিয়ে দেন, “থ্রিকোর্স লাঞ্চ ছিল সেটা।” “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, তারপর আমরা গেলাম স্টুডিয়ো ওরিয়েন্টে। সেখানে দিদি আর জামাইবাবু ‘পোজ’ দিয়ে ছবি তোলাল। এর আগে কালো ঢাকাই শাড়ী পরে দিদির আর একটা ছবি তোলানো হয়েছিল, জামাইবাবুর কাছে সেই ছবি থাকত জেলে থাকার সময়, আত্মগোপন অবস্থায় থাকার সময়। যাই হোক, সেদিন আমিও অবশ্য বাদ গেলাম না,—ওরা বলল আমার বিয়ের জন্য নাকি ছবি লাগবে।” হাসতে হাসতে মঞ্জুলা বলতে থাকেন, “এতেই শেষ নয়। এরপর আমরা একটা সিনেমা দেখার বায়না করলাম। অগত্যা ভবানীপুরের ‘রূপালী’ সিনেমায় গিয়ে জামাইবাবুকে টিকিটের লাইনে দাঁড়াতে হল। ওখানে তখন চলছিল দিলীপকুমার-মধুবালার ছবি ‘সাঁইয়া’। গল্পটা অবশ্য ট্রাজেডি’ ছিল, শেষ দৃশ্যে নায়িকা মারা গেল আর নায়কও বন্দুকের গুলিতে নিজেকে শেষ করে দিল। তবে সেটা কোনও ব্যাপার না, দিনটা আমাদের দারুণ কেটেছিল…।”
কমল বসু আবার ফিরে গেলেন বিয়ের পরের দিনগুলিতে। “বিয়ের কিছুদিন পর আমি ওঁর সঙ্গে এক মিটিং-এ গিয়েছিলাম। বক্তৃতা দিয়েছিলেন বঙ্কিম মুখার্জি, মণিকুন্তলা সেন, উনিও বলেছিলেন। তখন আকাশে ঘোর ঘনঘটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমুল বৃষ্টি নামল, মিটিং হল, দারুণ লাগল, খুরি করে চা খাওয়া হল, সবাই মিলে চীনেবাদাম খাওয়া হল। উদ্দামগতিতে ঝড় উঠল, ট্রাম বাসে করে কোনও রকমে দু’জনে বাড়ি ফিরলাম। দুজনেই ভিজে কাক। জামাকাপড় পালটে, দু’কাপ গরম গরম কফি নিয়ে খাটে বসলাম মুখোমুখি, আর উনি আমার হাত ধরে বলে চললেন কত কবিতা, কত কবিতা…শেলী, কীট্স আর এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং-এর অনবদ্য সব কবিতা। সেই সন্ধ্যাটা মনের মধ্যে এখনও জ্বলজ্বল করে।” “আরও মনে পড়ে, সেই বিয়ের পর ‘রোমান হলিডে’ দেখতে যাওয়া। একবার আমার এক মাসীশাশুড়ী, আমরা আন্নামাসী বলতাম, স্কুলের শিক্ষিকা, ওঁর থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, খুব আমুদে ছিলেন, উনি হঠাৎ একদিন আমাদের দুজনের জন্যে দুটো ম্যাটিনী শো’র টিকিট এনে হাজির। ছবির নাম ছিল ‘মাই ব্লু হেভেন্স’–আমাদের যে কি ভাল লেগেছিল। মনে পড়ে ‘তাজমহল’ দেখে উনি আমায় বিখ্যাত ‘স্নোস্টম’ কবিতাটা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। এই সব দিনগুলো ছিল যেন মরুভূমির মধ্যে ‘ওয়েসিস্’- এর মত। বিয়ের পর কোনও সন্ধ্যায় হয়তো উনি বাড়ি ফিরেছেন, আমি হয়তো শ্বশুরমশাই-এর ঘরে আছি—আমায় ডেকে নিতেন, আমাকে দেখতে চাইতেন। বাড়িতে কেউ ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে এটা ভেবে ওঁর ভাল লাগত।” আসলে মানুষটা ছিলেন খুবই রোম্যান্টিক। রোম্যান্টিক না হলে কেউ বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে পারেন? দেখতে পারেন হাইকোর্টকে লেনিনগ্রাদের ‘স্মল্নি’ বানানোর স্বপ্ন?
“মাঝে মাঝে দিদি জামাইবাবু যখন কথা বলত, আমি কান খাড়া করে থাকতাম”, হাসতে হাসতে বললেন মঞ্জুলা, “আমার তখন অসীম কৌতূহল, আমরা দিদিকে ভীষণ ভক্তি করতাম, দিদির কথা আমাদের ভাইবোনদের কাছে বেদবাক্যের মত ছিল। দিদি অপূর্ব ছবি আঁকত—একটা ছবি ছিল খুব সুন্দর—”দুটো হাত পদ্মফুল দিচ্ছে—যাইহোক দিদি জামাইবাবু দেখলাম একদিন নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন মগ্নভাবে, একজন বলছে ‘এখানে রজনীগন্ধার ফুল থাকবে, আর একজন বলছেন শেলীর বইটা নিয়ে পড়ব’—কথাগুলো আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিল, তাই এখনও মনে আছে।”
কখনও কখনও কমল বাসে করে চলে যেতেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে মহিলা সমিতির সভায়। বললেন, “তখন আমার অল্প বয়স, চন্দনও হয়নি, মনে খুবই সৎসাহস, খুবই উদ্দীপনা, বাসে করে চলে যেতাম সোস্যাল ওয়ার্কের জন্য সেই উত্তর কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে, আমি ছিলাম, সোমনাথ চ্যাটার্জির স্ত্রী রেণু দেবীও ছিলেন। কে আমাদের প্রেরণা দিতেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন জানো?— প্রখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসুর স্ত্রী ‘উষসীদি’। উষসীদি ছিলেন চমৎকার মানুষ, আকাশের মত বড় ছিল তাঁর মন। আর কি যে স্নেহশীলা ছিলেন, প্রায়ই আসতেন আমাদের হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে, কখনও নিয়ে আসতেন মিঠে-পান, কখনও এক বাক্স সন্দেশ, আমাদের খাওয়াতেন, খাইয়ে বলতেন ‘চল্ কমল আমরা কাজে বেরিয়ে পড়ি’। একদিন এক শিশি ঘি নিয়ে এলেন, বললেন ‘জ্যোতিবাবুকে দিবি, মাথার কাজ করে, ব্রেণ খাটায়, খাঁটি ঘি, উপকার হবে’। আবার স্বামী বলতেন ‘শি ইজ্ আ ভেরি গুড় অর্গ্যানাইজার, আমরা তো এই রকমই চাই’। খুব উপকারী মানুষ ছিলেন উষসীদি। আমার তো মনে হয় উনি একজন মহীয়সী মহিলা, কত লোকের যে উপকার করতেন। পরে যখন আমার স্বামী চীফ মিনিস্টার হলেন, কত নিডি মানুষকে আমার কাছে নিজে নিয়ে এসে বলেছেন ‘দেখতো কমল, বড় বিপদ এদের—যদি কিছু সাহায্য করতে পারিস’। পরে যখন আমার বুদ্ধি আরও পরিণত হয়েছে বুঝেছি কত খাঁটি আর কত দয়াশীলা হলে মানুষ মানুষের উপকার করতে পারে।”
বসু যখন বিরোধী নেতা, তখন কমল প্রায়ই বিভিন্ন রাজনৈতিক বৈঠকে যেতেন। বিধানসভায় শাসকদল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বসু যখন তোপ দাগতেন, দর্শক গ্যালারিতে কমলকে মাঝে মাঝেই দেখা যেত। ছোট বোন খুকুও কখনও কখনও সঙ্গে থাকত। কমল বলেন, “ওঁর বক্তৃতার সময় কপালে হাত রেখে ডাঃ বি. সি. রায় চুপচাপ বসে থাকতেন, মনে হত যেন তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। বসু যখনই জিজ্ঞেস করতেন, ‘ডাঃ রায় কি ঘুমোচ্ছেন?’ তিনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলতেন, “না না, কে বলেছে আমি ঘুমোচ্ছি? আর সঙ্গে সঙ্গে সভায় হাসির হুল্লোড় উঠত।” বসু বললেন, “আমার ও অন্যান্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে কলকাতায় এ. কে. গোপালন ও সি. পি. এমের অন্য নেতাদের নিয়ে যে মিছিল হয়, কমল কিন্তু তাতেও হেঁটেছিল।
“খোকার” (চন্দন বসু) জন্ম ১৯৫২ সালে। “প্রসববেদনা উঠেছিল রাত দুটোয়”, মৃদু স্বরে বললেন কমল বসু, “ভাইরা তখন বেশ ছোট। উনি বাড়ি নেই, শেষ রাতে বাবা হন্যে হয়ে একটা ট্যাক্সি খুঁজতে বেরোলেন। আমাকে সার্কাস অ্যাভিনিউ-এর ইস্ট এন্ড নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হল। সে আমলের বিখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ বিবেক সেনগুপ্ত খুব যত্ন করে আমাকে দেখতেন, ওঁর হাতেই খোকা হল ভোর ৫টা ১৬ মিনিটে।” বসু তখন শহরের বাইরে, কিন্তু স্ত্রীকে নার্সিংহোমে দেওয়া হয়েছে শুনেই তক্ষুনি রওনা হলেন। স্বামীকে পাশে দেখতে পেয়ে তবে কমল নিশ্চিন্ত! তাঁর কথায়, “আমি তখন লেবার রুমে। তিনি আমার পাশে এসে মৃদু স্বরে জানতে চাইলেন, “খুব যন্ত্রণা, তাই না? এটুকু যে সহ্য করতেই হবে।’ আমি নিশ্চিত, ওই তীব্র যন্ত্রণার মুহূর্তে কোনও স্বামী তাঁর স্ত্রীকে এমন কথা বলতেই পারবেন না। উনি বলতে পেরেছিলেন, কারণ ওঁর জীবনের শিক্ষাই ছিল—কষ্টটা হাসিমুখে সয়ে যাও। আমিও ওঁর কথা মেনে মুখ বুজে রইলাম।”
বসু স্ত্রীর হাতটা আঁকড়ে ধরলেন, খানিক বাদে যন্ত্রণা কমে এল। প্রসব হল খুব সহজে, একদম স্বাভাবিকভাবে। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিস্টার বসু, স্ত্রীকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলেন?” “আসলে নির্দিষ্ট তারিখের কয়েকদিন আগেই চন্দনের জন্ম হয়েছিল, তাই আমি বাইরের কাজ নিয়েছিলাম”, বসু জানালেন। বসু ছেলে দেখলেন, স্বামী-স্ত্রীর আনন্দের হাসিতে ঘর আলো হয়ে উঠল। ছেলেকে মায়ের মতই দেখতে হয়েছে। নার্সরা আদর করে ডাকছে ‘চিঙ্কু’ বলে। পার্টি অফিসে ঠাসা কাজের মধ্যেও বসু রোজ সকাল-বিকেল, দু’বেলা ছেলেকে দেখতে আসছেন—”একদিনও বাদ ছিল না, রোজ দু’বেলা আসতেন, একদিন গ্রাইপ ওয়াটার এনেছিলেন।”—স্ত্রী কমল বসু জানালেন। হিন্দুস্তান পার্কের বাড়িতে তখন কোনও মহিলা নেই, তাই ১৮/৭ গড়িয়াহাট রোডে বাবা-মার কাছেই কমলকে রাখা হল।
বসুর কঠিন জীবন কিন্তু যে-কে-সেই রইল। তাঁর স্ত্রীর ভাষায়, “ওই সময় ওঁর জীবন ছিল পুরোপুরি কৃচ্ছ্রসাধনের। ঘড়ি ধরে ঠিক সকাল ন’টা থেকে দশটার মধ্যে স্রেফ ডাল, ভাত আর বেগুনভাজা দিয়ে খাওয়া সারতেন। তারপর গনগনে রোদ মাথায় করে ছাতা ছাড়াই বাড়ি থেকে গড়িয়াহাট মোড় অবধি আসতেন। ফিরতেন গভীর রাতে, একেবারে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে। ফিরেই সোজা চলে যেতেন খোকার কাছে। খোকা তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে, তাকে জাগিয়ে দিয়ে আদর করতেন, ছড়া পড়তেন, আর খোকা যে বাবাকে দেখে কি খুশীই হত, নিজের ভাষায় সেও বাবাকে তার আদর জানাতো।” “এই নিয়মের একদিনও ব্যতিক্রম হতনা” মঞ্জুলা বললেন, “জামাইবাবুর সেই ছড়াটা এখনও আমার মনে আছ :
“তুমি যে সোনা কথা শোনো না
পিঁপি (পিপড়ে) ধরে না ছিঃ।”
সেই সকালে বেরোতেন, আর ফেরার কোনও ঠিক থাকত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে কমলও ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। কোনও কোনও দিন বেশি দেরী দেখে উতলা হতেন, কখনও বা কান্নাকাটিও শুরু করে দিতেন। “আসলে আমার খুব দুশ্চিন্তা হত, মনে হত কোনও বিপদ হয়নি তো, রাজনীতির ধরনধারন তখনও যেন আমার পুরো ধাতস্থ হয়নি। আমার বাবা তো অস্থির হয়ে ঘরে পায়চারি শুরু করতেন, দুশ্চিন্তায় তাঁর ভুরু কুঁচকে যেত। অথচ দিনের পর দিন ওঁর সেই একই রুটিন। একদিন বাবা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ঠিক করলেন, সদর দরজা বন্ধ করে দেবেন। খুকুই ওঁকে কোনক্রমে নিরস্ত করল, “বাবা, দিদির দোহাই, তুমি গেট বন্ধ কোরো না।” উনি যথারীতি দেরী করে ফিরলেন, এবং বাবা দরজা খুলেই শুনিয়ে দিলেন, আশা করি ভবিষ্যতে এমন আর কখনও হবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে ওঁর ঝটিতি জবাব, সব সময় এরকমই হবে।’ আসলে পরিবারের প্রতি প্রবল টান থাকলেও, রাজনীতির সঙ্গে ছিল তাঁর অচ্ছেদ্য নাড়ির যোগ, তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা বিসর্জন দিতে তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না।”
দাদু-দিদিমা আর মামা-মাসির আদরে প্রশ্রয়ে চন্দন বড় হতে থাকল। আর বসু দিনের পর দিন কাটাতে থাকলেন কলকাতার বাইরে। যখনই কোন বড় গণ- আন্দোলনের প্রস্তুতি চলত, পরিবারের সঙ্গে বসুর দেখা হত কালেভদ্রে। সে সময়ের কথা উঠতেই কমল বসুর দু’চোখ জলে ভরে ওঠে, “আমরা খুব সচ্ছল ছিলাম না। আমার স্বামী শুধু ছিলেন পার্টির হোলটাইমার। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবদের সাহায্য না পেলে আমি চন্দনকে মানুষই করতে পারতাম না। খোকা ছিল খুব ছটফটে আর দুরন্ত, খুকু সব সময় ওকে সামলাতো।” স্বামীর ঘন ঘন গ্রেফতার ও দীর্ঘ অদর্শন কমলের প্রায় গা-সওয়া। কখনও কখনও বসু আবার স্বেচ্ছা নির্বাসনেও যেতেন। কিন্তু স্ত্রীর যে এই সহিষ্ণুতা তার পুরো মর্যাদা দিতেন। বলতেন, “তুমি কত ভাল, কমল। খুব কষ্ট হয় যে, তোমাকে আমি সঙ্গ দিতে পারি না।”
শিক্ষক-আন্দোলনের সময় বসু যখন বিধানসভায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, ছোট ছেলের হাত ধরে কমল স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যান। “গ্রেফতারি এড়াতে তিনি স্পীকারের অনুমতি নিয়ে টানা সাতদিন বিধানসভায় কাটিয়েছিলেন। তখন সচিব ছিলেন অজিতারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, খুব উদার মনের মানুষ, তিনি আমাকে আর খোকাকে বিধানসভা ভবনে নিয়ে গেলেন। চন্দন তখন খুব ছোট, ভাল করে কথা বলতেও শেখেনি। গোটা বাড়িটা তখন পুলিস ঘিরে রেখেছে। আমি শুনতে পেলাম, ওদেরই একজন ওয়্যারলেসে কাউকে খবর পাঠাচ্ছে, ‘এক জেনানা হ্যায়, এক বাচ্চা ভি হ্যায়।’ আমার তো চোখ ফেটে জল আসতে লাগল। খোকার তখনও কথা ফোটেনি, কিন্তু বাবাকে দেখে ওর খুসি আর ধরে না। তখন ওখানে একজন বেয়ারা ছিল রহমান নামে, খুব ভালবাসত আমাদের। আমার স্বামী বলতেন, এই বিশাল বড় ঘর, চারপাশে সব মৃত মানুষদের প্রতিকৃতি, একলা শুয়ে কেমন যেন অপার্থিব মনে হয়। রহমান অবশ্য সেই ঘরের বাইরেই শুত আর আমায় সব সময় ভরসা যোগাত, ওঁর কোনও ভয়ের কারণ নেই।
একদিন রহমান এসে দু’কাপ চা আমার সামনে রাখল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দু’কাপ কেন, রহমান?’ ও একগাল হেসে জবাব দিল, ‘একটা খোকাবাবুর জন্য।’ ভারী ভাল লেগেছিল ওর ব্যবহার। একদিন যখন ওখান থেকে ফেরার সময় আমরা অজিতাবাবুর গাড়িতে এসে বসেছি, আমার স্বামীও আমাদের পিছু পিছু এসে ওই গাড়িতে একটু বসলেন। খোকার মুখ তো খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। কিন্তু তিনি যেই গাড়ি থেকে নেমে গেলেন, খোকার ছোট্ট বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে সময় আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি, হু হু করে কেঁদে ফেললাম”–বিষণ্ণ গলায় স্মৃতির পাতা উল্টে যান কমল।
কিন্তু সামনে তখন আরও ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছিল। কমলের কথায়, ‘ষাটের দশকটা তো একটা দুঃস্বপ্ন’। ওঁকে তখন বলা হত ‘চীনের দালাল’। শহরের পথেঘাটে পোড়ানো হচ্ছে ওঁর কুশপুত্তলিকা। পুলিস তো কুকুরের মত হন্যে হয়ে বসুকে খুঁজছে। আর তার সঙ্গে একের পর এক শাসানি। উড়ো ফোন আর চিঠিতে হুমকি প্রায় রোজকার ব্যাপার। আমার তখন অল্প বয়স, একদিন সন্ধ্যাবেলা পর পর তিনটে উড়ো ফোন এল, নাম বলে না, একই গলা, আমি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে হেঁটে শ্বশুরের ঘরে গিয়ে ওঁকে কথাটা জানালাম। এবার ফোন বাজল, আবার বাবা ফোনটা ধরলেন, ধরেই ধমক—’কে তুমি, একদম চোপ্, কোনও দরকার নেই, না আমার ছেলে খুব ভালই আছে’। তখন ফোন বন্ধ হল। আমি নানাভাবে নিজেকে নিজেই বাঁচাবার চেষ্টা করতাম। একদিন একটি লোক এসে আমাকে বলল, ‘তারকেশ্বরের পূজোর জল আছে, একটু নেবেন?’ আমি তখন জীবনের খারাপ দিকটা বুঝতে শিখেছি, পোড় খেয়ে শক্তও হয়েছি, দূর থেকেই হাত জোড় করে নমস্কার করে বললাম, না, আমার কোন দরকার নেই, আপনি জল নিয়ে যেতে পারেন। ভয় হল ওটা তো অ্যাসিডও হতে পারে। তখন তো আমরা চীনের দালাল’, আমরা যেন অচ্ছুৎ, বাড়িতে কেউই আসে না, লোকজনও জটলা করে নানারকম আলোচনা করত, লোকে আমাদের বাড়িতে আসতে ভয় পেত। কয়েকজন সত্যিকারের বন্ধু ছিলেন, তাঁরা আসতেন, খোঁজখবর নিতেন। যেমন অধীর চক্রবর্তী, সুধাদি, অজিতারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, তাঁর স্ত্রী সুরতীর্থের নীহারিকা মুখোপাধ্যায়, স্নেহাংশু আচার্য এঁরা সকলে। যখনই রেডিও খুলতাম, সব সময় ঝঝন করে দামামার মত বাজনা বাজছে। বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটত। একলা থাকতাম, কখন হয়তো রেডিও খুলে খেতে বসেছি, একটা মানুষের কণ্ঠ শোনার জন্য—এখনও মনে আছে, যেই রেডিওর নব্ ঘোরালাম, বেতারে ভেসে এল দুই প্রেমিক প্রেমিকার সংলাপ: মেয়েটি ছেলেটিকে বলছে ‘যুদ্ধে যাও, যুদ্ধে যাও, নইলে তোমায় আমি বিয়ে করব না।’ –এই সব তখন সব সময় হত। পূরবী মুখোপাধ্যায় তখন জেলমন্ত্রী ছিলেন। মাঝে মাঝে মনে হত, যে কোনও সময় একটা বুলেট সাঁ করে এই ঘরে ঢুকে আমাদের শেষ করে দেবে।—খোকাও ততদিনে বছর দশেকের হয়েছে। আর যত বড় হচ্ছে, চেহারার আদলটা হচ্ছে হুবহু মায়ের মত। অসম্ভব দুরন্ত হয়েছে, মাঝে মাঝে জোর করে ঘরে রেখে দিতে হয়।”
বসু যখন আবার পরিবারের কাছে ফিরলেন, তখনই যেন সব কষ্ট মুছে গেল। তবে খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল সেই কয়েকটা আনন্দের দিন। একদিন সকালে একটা কালো পুলিস ভ্যান বাড়ির সামনে এসে থামল। তিনজন পুলিস অফিসার গাড়ি থেকে নেমে ছুটে উঠোনে এসেই বেল বাজালেন। “সেই বেলের আওয়াজ শুনেই বুকটা ধক্ করে উঠেছিল”—দরজা খুলতেই তাঁরা হানা দিলেন বেডরুমে। ওঁদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল চন্দনের। সে ধড়ফড় করে উঠে বসে দেখল, মা ঘরে এক কোণায় গুটিসুটি দাঁড়িয়ে কাঁদছেন আর বাবাকে পুলিস ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঘটনাটা এখনও ওর স্পষ্ট মনে আছে।
প্রবল নিঃসঙ্গতা যেন কমলকে সব সময় গিলতে আসত। ছোট বোন খুকু (মঞ্জুলা) ততদিনে বিয়ের পর স্বামী জয়ন্তর সঙ্গে ইংল্যান্ডে প্রবাসী। ছোটভাই মুকুল ও ইংল্যান্ডে লীডস্ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বিমল একাই দিদিকে হাসিখুশি রাখতে চেষ্টা করত। এদিকে, বাবা মারা গেছেন ১৯৫৯-এ। কমলের মা-র শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। তাঁর শ্বশুরমশাই তো মাসের পর মাস কলকাতার বাইরে কাটান। হিন্দুস্তান পার্কের বিরাট বাড়ি তখন খাঁ খাঁ করছে, সঙ্গী বলতে বৃদ্ধ হরিদাসী। তবু কমল কখনও কোন পরিস্থিতিতেই হাল ছাড়েন নি। শ্বশুরমশাই যেদিন মারা গেলেন, সেদিনও কমলকেই সব করতে হয়েছিল। “আই টুক্ দ্য বুল বাই দ্য হর্ন”- বললেন কমল বসু, “মাঝরাতে দরজায় জোর আওয়াজ শুনে ভাবলাম পুলিস এসেছে বুঝি। তারপরই হরিদাসীর গলা শুনতে পেলাম, বাবা নাকি খুব অসুস্থ বোধ করছেন। ঝট্ করে সেই মুহূর্তে বাবার একটা কথা আমার মনে পড়ে গেল। বাবা আমাকে প্রায় বলতেন, ওঁর যদি কখনও খুব শরীর খারাপ হয়, তাহলে যেন ওঁর বন্ধু, সে আমলের বিখ্যাত ডাক্তার সুরেন ঘোষকে খবর দেওয়া হয়। সেইমত আমি সুরেনবাবুকে ফোন করলাম। ফোন ধরল তাঁর বাড়ির কাজের লোক।”
“তখন গভীর রাত। কাজের লোকটি আমায় বলল ‘এখন কলে বেরোনো সম্ভব নয়। ডাক্তারবাবুর নিজেরই শরীর ভাল নয়, ঘুমোচ্ছেন। অন্য কাউকে খবর দিন।’ বলেই ও দুম করে ফোন নামিয়ে রাখল। আমি ভাবলাম এভাবে ছাড়লে চলবে না। ফের ফোন করে রীতিমত ধমকের সুরে বললাম, দেখো, আমি যা বলছি শোনো, বাবুকে এক্ষুণি ঘুম থেকে তোলো। নইলে বাবু উঠে সব শুনলে তোমার চাকরিটি যাবে।’ এবারে কাজ হল। ডাক্তারবাবু ভোররাতে এলেন। সুরেনবাবুর হাতে বাবার তালুটা গুঁজে দিয়ে আমি বাবাকে বললাম, “বাবা, চোখ খুলুন। দেখুন, কে এসেছেন। আপনি না বলেছিলেন সুরেনবাবু এসে ছুঁলেই আপনি সেরে উঠবেন।’ বাবা ধীরে ধীরে চোখ খুলে বন্ধুর দিকে তাকালেন, তারপরই চিরকালের জন্য চোখ বুজলেন। আমার স্বামী তখন জেলে। কীভাবে তাঁকে খবরটা দেওয়া যায় তাই ভাবছি।”
তখন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব ছিলেন মৃগাঙ্কমৌলি বসু। কমল গিয়ে ওঁকেই ধরলেন, বসুকে কিছুদিনের জন্য প্যারোলে মুক্তি দিতে হবে, যাতে তিনি বাবার শেষ কাজ করতে পারেন। মৃগাঙ্কবাবু কিছুতেই রাজী হন না। বললেন, ‘আমি স্মল ফ্রাই’, সামান্য সরকারি অফিসার, একেবারে চুনোপুঁটি, এ ব্যাপারে কিছু করতে পারব না।’ কমল একটুও না দমে আবার বললেন, ‘আপনি মোটেও চুনোপুঁটি নন। আমি কি করে এটা বিশ্বাস করি? আমি তো বেশিরভাগ আদেশেই আপনার সই দেখি, আর তাছাড়া এটাও তো · ঘটনা যে, আপনার আদেশেই আমার স্বামী এখন জেলে!’ মৃগাঙ্কবাবু কিন্তু অনড়, কিছুতেই তাঁকে টলানো গেল না। কমল এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন, কিন্তু ঠিক করলেন শেষ চেষ্টা একটা করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি সরকারের কাছে আর্জি পাঠালেন এ. কে. গোপালনের মাধ্যমে, গোপালন তখন সংসদের একজন বিশিষ্ট বিরোধী নেতা। নেহরুকেও গোটা ব্যাপারটা জানিয়ে কমল চিঠি দিলেন। শেষমেস বসুকে মাত্র একদিনের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হল, কিন্তু আগেপিছে রইল সতর্ক পুলিস পাহারা। পরে কমলের অনুরোধে তৎকালীন মুখ্যসচিব আর. গুপ্ত বাবার শ্রাদ্ধে বসুকে একদিনের জন্য প্যারোলে ছাড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
সব সময় মনে হত মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে। এখনও মনে পড়ে ১৯৭০ সালের সেই কালো দিনটার কথা—৩১শে মার্চ। “৩০শে মার্চ উনি সন্ধ্যায় পাটনা যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরোলেন। আমি তিনতলা থেকে খাবার ঘরের জানালা দিয়ে মাথা বাঁকিয়ে ঝুঁকে দেখলাম ওঁর কালো গাড়িটা যেন অতল অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তখন অন্ধকারপক্ষ চলছে, চারিদিকে মিমিশে কালো আঁধার। কি জানি আমার মনটা কেমন ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল, অথচ এই রকম বাইরে যাওয়াটা তো রোজকার ব্যাপারই ছিল, কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার সেই দৃশ্যটা এখনও মনে আছে। মনটা কেমন যে ‘কু’ গেয়ে উঠেছিল। রাতে ভাল করে ঘুম হল না। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ একটা টেলিফোন এল। ফোনের ওপারে কথা বলছেন ডি আই জি রঞ্জিৎ গুপ্ত, আমি কিছু বলার আগেই উনি বললেন, ‘মিসেস বাসু, শুনুন, পাটনায় একটা ফায়ারিং হয়েছে, আপনি কোনও ভয় পাবেন না, মিঃ বাসু ভাল আছেন, ওনার কোনও আঁচড় লাগেনি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, একটু পরেই আপনাকে খবরের কাগজ, তাছাড়া অন্যান্য লোকজন ফোন করে বিরক্ত করবে, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না।’ আমি ফোনটা ছেড়েই কেমন যেন হয়ে গেলাম, ওঁর কিছু হয়নি শুনলাম, তবুও…চন্দন এসে বসল ড্রয়িং রুমের সোফায়, ওর বয়স তখন ১৭/১৮। আমার মুখটা বোধহয় কাঁদো কাঁদো হয়ে গিয়েছিল, চন্দন আমায় বলল, মা তোমার এত উতলা হলে চলবে কি করে, মনে রেখো তুমি কার স্ত্রী, তোমার জীবনে কত সংঘাত আসবে মা, বাবা কতবড় রাজনীতিক, সেই বাবার স্ত্রী তুমি, ভয় পেওনা মা’–আমি ঐটুকু ছেলের কথায় সেদিন এত অভয়, এত মনের জোর পেয়েছিলাম তা বলার নয়। ততক্ষণে ফোন বাজতে শুরু করেছে, একটুও বিরাম নেই, মনটা আরও যেন উথালপাথাল করছে। এমন সময় এলেন একজন রাজনৈতিক নেতা, আমাদের খুব বন্ধুলোক ছিলেন, আমায় বললেন, ‘কমলবৌদি কোনও ভয় পাবেন না, উনি ভাল আছেন, দাঁড়ান কথা বলবেন? আমি ফোনে লাইন করে দিচ্ছি’—বলে উনি পাটনায় ফোনে লাইন ধরলেন, আমি ওঁর সঙ্গে কথা বললাম। ওঁর গলাটা প্রথম যেই কানে এল আমি কথা বলব কি, আমার দু’চোখ দিয়ে তখন ঝরঝর করে জল পড়ছে। আমার মনটা শান্ত হল’–বার বার কৃতজ্ঞচিত্তে কমল বসু সেই নেতার কথা বললেন, “সেই বিপদের মুহূর্তে কতবড় মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি, আমি তা আজও ভুলিনি, কোনও দিন ভুলতে পারবও না। পরের দিন উনি প্লেনে ফিরলেন, আমরা এয়ারপোর্টে গেলাম, আমার এখনও মনে আছে স্নেহাংশুবাবু আমাকে ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে আবেগপূর্ণ গলায় বলছেন, ‘জ্যোতি, জ্যোতি—কমল, কমল’। এয়ারপোর্টে তখন কাতারে কাতারে লোক, তারা শুধু তাদের প্রিয় নেতা জ্যোতি বসুকে একবার চোখের দেখা দেখতে এসেছে। বাড়ি ফিরলাম, বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। আমার ঠিকে কাজের মেয়ে ছিল সাবিত্রী, সে আমায় প্রায় বলত ‘সোনাবৌদি তুমি আমাকে এত কাপড় দাও, একটা ‘নতা নতা’ পাড় কাপড় দিও তো।’ আমি সেদিনই একটা চওড়া লাল ফুললতা কাটা পাড়ের শাড়ী সাবিত্রীকে দিয়ে দিলাম, কাপড়টা একবারই আমি পরেছিলাম, সাবিত্রী যে কি খুশী হয়েছিল তা বলার নয়।”
বসু যখন রাজ্যের ভার নিলেন, সময় সত্যিই পালটাল। “ঐযে কথা আছে না ‘চক্রবৎ পরিবর্ততে সুখানি দুঃখানি চ’—গোটা ব্যাপারটাই তখন ভারী অদ্ভুত ঠেকত আমার। পুলিস তখন আর আমাদের শত্রু নয়। প্রথম প্রথম আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হতে চাইত না, এরাই কি তারা, গত কয়েক বছর ধরে যারা সারা দিনরাত আমাদের পিছনে পড়ে ছিল? সেই পুলিসরাই এখন আমাদের দেহরক্ষী, আমাদের নিরাপত্তার ভার তাদেরই হাতে!”
বিপদের দিনগুলোতে যাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কমল তাঁদের ভোলেন নি। “বাপের বাড়ির লোকজনই আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আমার বাবা কত রাতে খোকাকে কোলে করে পায়চারি করেছেন, খুকু, আমার ছোটবোন সে ছিল আমার ডান হাত, আমার সুখে দুঃখে সব সময় পাশে থেকেছে, আমার খোকাকে পুরোপুরি সামলেছে, আর মা সব সময় নাতির জন্য ভাল জিনিসটা তুলে রাখতেন। ওঁদের ছাড়া আমি আর আমার ছেলে বাঁচতেই পারতাম না। আর ছিলেন স্নেহাংশু আচার্য, বিপদের সময় আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। মনে পড়ে সেই রহমানকেও, চূড়ান্ত অপমানের দিনগুলোতে সে আমাদের অদ্ভুত সম্মান দিয়েছিল। বহু বছর বাদে, রাজভবন চত্বরে রহমানের সঙ্গে দেখা। আমি সেখানে বার্ষিক পুষ্প-প্রদর্শনীতে প্রাইজ দিতে গেছি। বৃদ্ধ অথর্ব রহমান এগিয়ে এসে বলল, ‘আমায় চিনতে পারছেন মেমসাব?’ বললাম, ‘তোমায় কখনও ভুলতে পারি?’ ওর ছেলের তখন একটা চাকরির ভীষণ দরকার, স্বামীকে বলে ব্যবস্থা করে দিলাম।”
কমল বসু কারো দুঃখ সহ্য করতে পারেন না। অন্যের কষ্টের কথা শুনলে তিনি রীতিমত কাতর হয়ে পড়েন। যাঁরা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন তাঁর কোমলপ্রাণ আর ক্ষমাশীল স্বভাবের কথা। পুরোনো দিনের একটা ঘটনা বলি। যখন চিঙ্কুর বয়স পনেরো, তখন তাঁর দিদিমা তাকে একটা বেশ দামী সাইকেল উপহার দিয়েছিলেন। কিছুদিন বাদে হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ি থেকে সেই সাইকেলটা চুরি যায়। বসু তখন ডেপুটি চীফ মিনিস্টার। বসুর বাড়িতে যে পুলিসটির ডিউটি ছিল তাকে সাসপেন্ড করা হয়। ‘ব্ল্যাক বুকে’ তার নাম ওঠে। এই সময় কমল বসু জানতে পারেন সেই লোকটির চাকরি-জীবনের আর মাত্র আটমাস বাকি আছে। খবরটা জানার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তৎকালীন পুলিসের ডি আই জি সত্যব্রত বসুকে ফোন করে বলেন “বেচারী বড্ড গরীব, মিঃ বসু, অনুগ্রহ করে লোকটিকে ছেড়ে দিন, ওর পরিবার না খেয়ে মারা পড়বে, প্লীজ, ঈশ্বরের ইচ্ছা হলে আমার ছেলে বড় হয়ে গাড়ি কিনবে কিন্তু এই গরীব লোকটির রুটি কেড়ে নেবেন না, একটা সামান্য সাইকেলের জন্য ওর রুজি মারবেন না”–ডি আই জি শ্রীমতি বসুর অনুরোধ রেখেছিলেন। সেই পুলিসের চাকরি যায়নি।
আর একদিনের ঘটনা। বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। রাতে বাড়ি ফিরে দেখেন, বাড়ির প্রধান ফটক বন্ধ, তালা মারা। জানা গেল তার নিরাপত্তারক্ষী ভুল করে চাবির গোছা বাড়ি নিয়ে চলে গেছে। সেই কর্মীর মোটা জরিমানা করা হল এবং তারও নাম ‘ব্ল্যাক বুকে’ ওঠানো হল। আবার কমল ফোন করলেন সত্যব্রত বসুকে, “বড্ড গরীব লোকটা, আমার কাছে প্রতি মাসে রেশন কেনার জন্য ৬ টাকা ধার নেয়—সে কি করে এত টাকা জরিমানা দেবে বলুন? ওর নাম ‘ব্ল্যাক বুক’ থেকে কাটিয়ে দিন, প্লীজ়্, ও মারা পড়বে।” এবার ডি আই জি নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল, ‘অসম্ভব, সি. এম- এর ডিউটিতে গাফিলতি করেছে, ওকে ফাইন দিতেই হবে, আমার পক্ষে ওকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়।’ কমল বসুও নাছোড়বান্দা, “দেখুন মিঃ বসু, টু আর ইজ্ হিউমান, টু ফরগিভ ডিভাইন’, ক্ষমা করে দিন, ওকে ক্ষমা করে দিন।” মিঃ বসুর পক্ষে এবার এই অনুরোধ রক্ষা না করা অসম্ভব ছিল। অর্ডার ফিরিয়ে নেওয়া হল, লোকটির চাকরি বেঁচে গেল।
এমন আরও কত ঘটনা যে আছে। একবার দেখলেন পাশের বাড়ি থেকে তাঁর এক ভদ্র প্রতিবেশী পরিবারকে অকথ্য অপমান করে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। অপরাধ—তাঁরা সময়ে ভাড়া দিতে পারেনি। তাঁদের এই অপমান কমলের বুকে বাজল। বললেন “ভদ্রলোকের মেয়েটি তখন অন্তঃসত্ত্বা, একজন ভদ্র রিটায়ারড্ অফিসার আর তাঁর আসন্নপ্রসবা মেয়েকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে এমন একটা অমানবিক ব্যাপার সহ্য করি কি করে?—ফোন করলেন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে, সেই পরিবার আশ্রয়চ্যুত হলেন না।
দুঃসময়ে কত লোক অসম্মান করেছে, মানসিক ব্যথা দিয়েছে তাঁকে, “একটু ভাল করে শাড়ী পরলেই ব্যঙ্গ করে বলেছে, ‘কমিউনিস্ট নেতার বৌ’, আমার খোকাকেও কত দুঃখ দিয়েছে”, প্রবঞ্চনাও অনেকে কম করেনি। যখন কাঁটায় পাথরে মন ক্ষতবিক্ষত হয়েছে তখন কেউ প্রলেপ লাগাতে আসেনি, একা, অসমসাহসে বুক বেঁধে দুর্গম পথ পেরিয়েছেন। কিন্তু এজন্য কমল বসুর মনে এতটুকু ক্ষোভ নেই, নেই কোন জ্বালা। এমন সহৃদয়, স্নেহশীলা, উদারমনা মহিলা বিরল। যারা অতীতে দুর্ব্যবহার করেছে, যেমন ধরা যাক পুলিস, তাদের সঙ্গে উনি কেমন করে এতটা মহানুভবতা করতে পেরেছিলেন? উত্তরে উনি আমাকে বললেন, “আসলে আমি জানি দারিদ্র্য কি, আমি জানি অপমান কাকে বলে। আমি এগুলোর মধ্যে দিয়ে এত বেশি গেছি, আমি চাই না আর একটা মানুষের এই সব অভিজ্ঞতা হোক। আমার মনে হয় যার মনে দয়ামায়া নেই, ক্ষমা নেই সে আবার কেমন মানুষ?—জানো ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের অন্যদের দয়ামায়া করতে শেখাতে হয়, আমি খোকার জন্য অনেক পাখি পুষে ছিলাম, অনেকদিন আগে, ও তখন খুব ছোট, জন্তু জানোয়ার পশুপাখিকেই প্রথম যাতে ওরা মায়া করতে শেখে, আর সেই দয়ামায়া ভালবাসাটা পরে যাতে মানুষের ওপর পড়ে।”
এই হলেন কমল বসু। স্বামীর থেকে দশ বছরের ছোট। এখনও সেই সুন্দর ঋজু চেহারা, পাকা গমের মত উজ্জ্বল গায়ের রং, গভীর দু’টি টানাটানা মায়ামাখানো চোখ। টানা বিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের ‘ফার্স্টলেডি’—কিন্তু একছিটে অহংবোধ নেই। চমৎকার ব্যক্তিত্ব। গুণী মহিলা, কথায় কথায় সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি প্রবচনের উদ্ধৃতি দেন। নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারেন, আরও বেশি পারেন নিজের গুণগুলো নিপুণভাবে লুকিয়ে রাখতে। জানার ইচ্ছা, শেখার ইচ্ছা সমান প্রবল, একটু আবেগপ্রবণ, রোম্যান্টিক মনের মানুষ, অথচ প্রখর বুদ্ধিমতী। তাঁর বুদ্ধিতে দীপ্তি আছে, কিন্তু এতটুক দহন নেই। আর আছে অসম্ভব সূক্ষ্ম রসবোধ এবং অদ্ভুত নিসর্গচেতনা। তাঁর বর্ণনা যেন ‘ছবি লেখা’—বোঝা যায় এর নীচে লুকিয়ে রয়েছে এক অতি সংবেদনশীল শিল্পী মন।
মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে বহুবার বিদেশে গেছেন। গেছেন ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, ফ্রান্স। সোস্যালিস্ট দেশগুলিতেও গেছেন—বুডাপেস্ট, রাশিয়া, হাঙ্গেরী আর রোমানিয়া। ইংল্যান্ড আর আমেরিকায় গেছেন বেশ কয়েকবার। সেই সব দিনগুলোর কথা তাঁর মুখে চিত্রময়ী ভ্রমণকথার মত শোনায়। নিজের ওপর স্পটলাইটের আলোর ঝলক তাঁর পছন্দ নয়, নেপথ্যে থাকতেই ভালবাসেন। নীরবে কাজ করেন, তাঁর অভিধানে ‘সাধারণ মানুষ’ বা ‘সামান্য মানুষ’ বলে কিছু নেই—”মানুষ মানুষই, তাকে সেইভাবেই দেখতে হবে, প্রয়োজন হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।” বাড়ির কাজের লোক যোগেন, দিলীপ, বসন্ত সবাই এ কথা জানে—”মা, লোকজনের খুব খেয়াল রাখেন।” “এ ব্যাপারে আমার স্বামীও কম যান না, লোকজনদের দিয়ে দেওয়াতে ওঁর জুড়ি নেই। খেতে বসেই টেবিলে রাখা খাবারদাবার যা হয়তো একটু উদ্বৃত্ত হল, সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, ‘দিয়ে দাও, দিয়ে দাও, ওদের দাও, ওরা খাবে ওরা খুশি হবে’, সে যাই হোক চাইনীজ খাবার বা বাঙালী রান্না বা মিষ্টি—ওদের না দিলে ওঁর শান্তি নেই। নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতে ভালবাসেন। রান্নায় দ্রৌপদী বললে অতিশয়োক্তি হয় না। এ প্রসঙ্গে আবার পুরোনো দিনে ফিরে গেলেন, “বাবা, ছেলে দুজনেই মাংস খেতে বেশি ভালবাসে তাই প্রায়ই মাংস রান্না করতাম। রাঁধতেও অনেক সময় লাগত। একবার পূজোর সময় উনি আমায় হঠাৎ কিনে এনে দিলেন প্রেসার কুকার। তখন প্রেসার কুকার সবে উঠেছে। কি ভালই না লেগেছিল, চট্ করে মাংস রান্না হয়ে যেত। একদিন রাঁধছি, আমার সম্পর্কে দেওর হয় একজন, ক্যামেরা নিয়ে এসে হাজির— এসেই তাড়া ‘বৌদি চট করে তৈরি হোন ফটো তুলব’, উনি তখন পার্টি অফিসে বেরোবেন, আমি হাত ধুয়ে চট করে আলনা থেকে একটা খয়েরি রঙের ঢাকাই শাড়ী টেনে পরে নিলাম। চন্দন দাঁড়ালো আমাদের পাশে। ঐ ছবিটা তোমার ইংরেজি জীবনীতে ছাপা হয়েছে।” ছবিটা সেই সময়কার প্রচলিত পোজে তোলা, স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন আর স্ত্রী বসে আছেন চেয়ারে। এখানেও ঠিক তাই, জ্যোতি বসু দাঁড়িয়ে আছেন, সুবিন্যস্ত, পরিপাটি চুল, পরণে পরিচ্ছন্ন ধুতি পাঞ্জাবী, মুখে প্রসন্নতা, চেয়ারে বসে আছেন স্ত্রী কমল বসু, ছবির নেপথ্য ঘটনা শুনে লক্ষ করলে বোঝা যায় রন্ধনক্লান্ত, ঈষৎ ঘর্মাক্ত লালচে সুখী মুখচ্ছবি, পাশে দাঁড়িয়ে রোগা চেহারার দীপ্ত মুখের এক বালক, তাঁদের ছেলে চন্দন।
“আমাদের এই বাড়িটা যেন একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। লোকজনের মুখ দেখতে পাই না, সারাদিন কানে বাজে শোঁ শোঁ করে প্লেন ওড়ার আওয়াজ”- বললেন কমল বসু। শ্রীমতি বসু কথা বলছিলেন ইন্দিরাভবনের একতলায় হলঘরে। হলে বসার তিনটি কাঠের কারুকার্যমন্ডিত সোফা, ঈষৎ অবিন্যস্ত, মাঝের ‘সেন্টার টেবিলে’ একটি সোনালি পেন্ডুলামের ঘড়ি, নানা টুকিটাকি, ওষুধপত্রের বোঝা। হলের ঠিক মাঝখানে সাধারণ ছোট আকারের লাল কার্পেট, তার ওপর বেতের ছোট ছোট বাস্কেট, বসুকে বিভিন্ন সংস্থার উপহার দেওয়া কয়েকটি মডেল, একদিকে শ্বেতপাথরের ভেনাস মূর্তি, আর কাঁচের শোকেসে শ্বেতপাথরের হাতী। মেঝেতে জ্যোতি বসুর প্রতিকৃতি, অয়েলপেন্টিং, গ্লাস-পেন্টিং-এর ভিড়। স্বামী-স্ত্রীর যুগ্ম তৈলচিত্রও মেঝেতে দাঁড় করানো আছে। আছে বিদ্যাসাগরের ছবি, শেখ মুজিবর রহমানের ছবি। দেওয়ালে ঝোলানো বাটিকের ওয়াল হ্যাংগিং, হলে ঢোকার মুখে কাশ্মিরী কারুকার্যমন্ডিত কাঠের প্যানেল। দু’ধারে ঝুলছে ধানের শীষের গুচ্ছ। সোফার পাশের টেবিলে গোটা চারেক ফোন, লাইন কিন্তু একটাই, কমল বসুরও অনবরত ফোন বাজতে থাকে। সিলিং-এ ঝালর দেওয়া সাধারণ ঝাড়বাতি। হলে ঢুকতেই যেটা প্রথম নজর কাড়ে সেটা হল জ্যোতি বসুর এক বিরাট অয়েলপেন্টিং— মুখের বিরাট প্রতিকৃতি, মুখে চমৎকার হাসি—স্ত্রী হেসে বলেন, “দেখে মনে হয় যেন ব্রডিংন্যাগের লোক!” তার পাশেই আর একটা বিরাট ছবি, ভারতমাতার— ওপরে লেখা “রেসপেকটেড্ জ্যোতিবাবু, প্লীজ্ সেইভ আওয়ার মাদার ইন্ডিয়া।” যাকে নিয়ে এত কান্ড তিনি নির্বিকার; উদাসীনভাবে হেঁটে চলে যান নিজের ঘরে। এসব তুচ্ছ ব্যাপার যেন তাঁকে স্পর্শই করে না। “আমার স্বামী ঠিক মেশিনের মত। কাজকর্ম, খাওয়াদাওয়া সব ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় হয়, এখনও যা পরিশ্রম করেন! এই সেদিন নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য কতটা যে রক্ত টানল ডাক্তার, আর সেইদিন দেখলাম, অন্য দিনের থেকে দশগুণ বেশি পরিশ্রম করলেন।”
যুক্তিবাদী কমিউনিস্ট নেতার স্ত্রী হয়েও কমল বসু নিজের সত্তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তিনি ধর্মশীলা, ঈশ্বরবিশ্বাসী, পুণ্যমনা মহিলা। বজায় রেখেছেন নিজস্ব পরিচয়— অসংখ্য মানুষের কারো কাছে তিনি ‘কমলদি’, কারো কাছে ‘কমল বৌদি’, কারো কাছে ‘মাসীমা’, কারো কাছে স্নেহময়ী ‘মা’। ‘জ্যোতি বসুর স্ত্রী’ এই পরিচয়ই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি জানেন যে তিনি ‘এক বড় মাপের মানুষের’ সুযোগ্যা সহধর্মিণী, কথার মধ্যে মধ্যে প্রায় স্বামীকে বলেন, ‘জ্যোতি বসু’, বলেন ‘সি. এম.’, বলেন “আমার স্বামীর জীবনটা এক সাধনার মত, এক লক্ষ্যে, এক আদর্শে সারাজীবন চললেন, আজও তার বিরাম নেই, এখনও কি বয়সের তুলনায় কম খাটেন? এ নিয়ে নিজের কোন ভ্রূক্ষেপই নেই।”
এই কারণেই স্ত্রী কমল বসু একেবারেই চাননি যে জ্যোতি বসু দেশের প্রধানমন্ত্রী হোন। “কারণ আমি ভেবেছিলাম”, তিনি জানালেন, “ওনার খুব ধকল হবে, এতবড় বোঝা কি করে বইবেন? তাছাড়া ‘পাঁচমিশালীর’ সঙ্গে…।” যখন বসুর প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে রাজধানী সরগরম, তখন কমল বসু ছোট বোন মঞ্জুলা রায়ের বাড়িতে ছিলেন। খবর শুনেই প্রথম স্বামীকে দিল্লীতে ফোন করেন, “শোনো, তুমি প্রধানমন্ত্রী হয়ো না গো… যেটুকু শরীরে শক্তি আছে তাও আর থাকবে না, তুমি হয়ো না।”
মাঝে মাঝে মানসিক অবসাদে ভোগেন কমল বসু। ১৯৯৬ সালটা বড় খারাপ গেছে। একই বছরে হারিয়েছেন মাকে আর আদরের ভাই ‘বিমল’কে। পেয়েছেন আমেরিকা থেকে আত্মীয়বিয়োগের খবর। এতগুলো দুঃসংবাদ সহ্য করা তাঁর পক্ষে যথেষ্ট কষ্টকর হয়েছে। মা হারানোর ক্ষতি অপুরণীয়, তাছাড়া ভাইটির কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না, এই তো তার আগের বছর কত আনন্দ করে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজো দেখালেন তাকে, এক বছরের মধ্যেই সে চলে গেল। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী প্রবোধ দেন “প্রারব্ধ প্রদীপের তেল ফুরিয়েছিল, মা, কি করবে?”—তবু দিদির স্নেহময়ী মন মানতে চায় না। বাড়ি থেকে বেরোতে ইচ্ছা করে না, কোনও আনন্দ অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে গিয়ে মনে হয় শরীর বুঝি সহযোগিতা করবে না। কখনও কখনও মনে হয় ঈশ্বরের মুখোমুখি হয়ে যদি শান্তি পাই। কিন্তু তার কি উপায় আছে? ‘সেলিব্রিটি’র স্ত্রী হওয়ার বিড়ম্বনা অনেক। নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে কিছু থাকে না। এই তো সেদিন আড়াই বছর পর, শোকসন্তপ্ত মন নিয়ে গিয়েছিলেন কালীঘাটে ‘মা’কে দর্শন করতে। সামনে পেছনে পুলিস, নিরাপত্তারক্ষী তো আছেই। “তার ওপর পূজো দেব কি, ঘাড়ের ওপর একগাদা ফোটোগ্রাফার, ছবি তুলছে আমার, কোথা থেকে সব খবর পেয়ে যায়, যেখানে যাই সেখানেই ধাওয়া করে। আমি বলি, ‘কেন ছবি তুলছেন, একটু নিজের মনের শান্তির জন্য পূজো দিচ্ছি, আর কাগজে তো নানা কথা লিখবেন’, একজন অল্পবয়সী রিপোর্টার জিজ্ঞাসা করল আপনি দেশের জন্য পূজো দিচ্ছেন তো?’–আমি বললাম ‘অবশ্যই অবশ্যই, সে কথা আবার জিজ্ঞেস করে?’ পরের দিন দেখি কাগজে ছবি – মুখ্যমন্ত্রীজায়া কালীঘাটে পূজো দিচ্ছেন।’ আসল কথা উনি, আমার কেন, পরিবারের কারোর কোনও ব্যক্তিস্বাধীনতায়, কোনও দিন হাত দেন না, আমার বিশ্বাস আমার, ওঁর অবিশ্বাস ওঁর, নিজের।” এ ব্যাপারে বসুর জীবননীতি—’বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচতে দাও, কে কি করছে তাতে হস্তক্ষেপ করতে যেও না, হ্যাঁ, তবে ভুল করলে শুধরে দেবার চেষ্টা কর।’ আর নিজের বিবেকের কাছে নিজে ঠিক থাকো।”
উনপঞ্চাশ বছর সঙ্গে আছেন কমল বসু, সুখে দুঃখে, উত্থান পতনে, ঝড়ে জলে, ফুলে কাঁটায়। স্বামীর ব্যক্তিজীবন ছাড়াও খবর রাখেন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটির। নিজের মতটাও তাঁকে নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেন। লোকচরিত্র, রাজনীতি, জীবন সম্পর্কে এতদিন পাঠ গ্রহণ করেছেন ‘জ্যোতি বসু’র কাছ থেকে। বিনয় তাঁর মজ্জাগত, লোকসমক্ষে স্বামীর খ্যাতির ছটা নিজের গায়ে লাগাতে তাঁর বেশ অনীহা। ধৈর্য, সহিষ্ণুতার প্রতিমূর্তি হিসাবে নিজেই ভাস্বর। কমল বসু এই রকমই। মৃগনাভির মত লুকিয়ে রাখতে চান আপন স্বভাবের সুরভি। এটাই তাঁর আসল পরিচয়। একটা কথা ভীষণই সত্যি, কমলের এই বলিষ্ঠতা, সাহস আর দুঃখকে জয় করার অসম্ভব শক্তি না থাকলে তাঁর স্বামী কিছুতেই হয়ে উঠতে পারতেন না আজকের ‘জ্যোতি বসু’।
২
“আমার মা আর আমি বাবার রাজনৈতিক জীবনে কোনও দিনই বাধা হইনি, আমাদের দিক থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা ছিল চিরকাল, আর, হ্যাঁ এখনও তাই আছে”–বললেন, জ্যোতি বসুর একমাত্র সন্তান, চন্দন বসু। এগার বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই পশ্চিমবঙ্গের সব বড় বড় জেলই চন্দন বসুর দেখা হয়ে গিয়েছিল। দু’বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল বিধানসভায়। তারপর আর একটু বড় হয়ে বিকেলবেলা মায়ের সঙ্গে কতবার যে বাবার সঙ্গে জেলে দেখা করতে গিয়েছিল—আলিপুর জেল, প্রেসিডেন্সি জেল, দমদম জেল। ছোট থেকেই ‘পুলিস’, ‘রাজনীতি’, ‘পলিটিক্স’ আর ‘জেল’ এই কথাগুলো প্রায় বাড়িতে শোনা যেত। এই কথাগুলোর মানে যে খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না তা সেই বয়সেই সে ভালরকম বুঝেছিল। ‘পলিটিক্স’ মানে যে ব্যাপারটা তার বাবাকে দিনের পর দিন তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখত, তখন বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করলেও বা বাবার সঙ্গে খেলতে ইচ্ছে করলেও বাবাকে সে পেত না। আর ‘পুলিস’ মানেই সেই উর্দিপরা অভদ্র লোকের দল যারা ভোরবেলা শোবার ঘরে ঢুকে বাবাকে ধরে নিয়ে যায় আর ‘জেলখানা’ মানেই সেই মনখারাপ করা বিবর্ণ লাল ছাইরঙা দেওয়াল, যেখানে বাবা থাকতেন দিনের পর দিন। মায়ের সঙ্গে সেও সেখানে যেত, চারপাশে পুলিস কড়া পাহারা দিত। যেই একজন চেঁচিয়ে উঠত ‘টেইম হো গয়া’, অমনি তার গলার ভেতর কান্না ডেলা পাকিয়ে উঠত, এবার তাদের বাড়ি ফিরে যেতে হবে বাবাকে ছেড়ে। বাবা থাকবেন জেলখানায়। সেই নিষ্করুণ দিনে ব্যঙ্গ করার লোকেরও অভাব ছিল না। ছোট্ট মিষ্টি ছেলে হয়তো হাতে চকলেট দিয়েই কেউ বলতেন ‘তোর বাবা এখন জেলে লপ্সি খাচ্ছে আর খড়ের গাদায় শুয়ে আছে’ অবোধ শিশু কি বুঝত সেই জানে, কথাটা শুনেই তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠত।
মা এবং মাসি দুজনেই জানালেন, ছোটবেলায় চিঙ্কু ওরফে চন্দন ছিল অসম্ভব দুরন্ত। সব সময় ছটফট করত, দৌড়াদোড়ি করত, বারান্দা, ছাদ দিয়ে ঝুঁকত, সামলানো এত মুস্কিল ছিল যে মাঝে মাঝে তাকে ঘরে আটকে রাখতে হত। আর হাত পা কেটে যাওয়া, ছড়ে যাওয়া তো লেগেই ছিল। আবার রক্তও বন্ধ হত না সহজে। যখন চার পাঁচ বছরের ছেলে, একবার কাশ্মীরে ডাল লেকের জলে শিকারা থেকে টুপ করে পড়ে গিয়েছিল। কোট প্যান্ট, সোয়েটার গায়ে ছিল, সম্ভবত এক শিকারা থেকে আর একটা শিকারায় যাওয়ার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য একজন ফুলওলা, শিকারায় ফুল নিয়ে ঘুরছিল, হঠাৎ দেখতে পেয়ে চন্দনকে জল থেকে তুলেছিল। ‘প্রাণভরে আশীর্বাদ’ করার বা ‘ধন্যবাদ’ দেওয়ার আগেই সে যেন কোথায় মিলিয়ে যায়।
প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বড় হয়ে উঠলেও, চন্দন ছেলেবেলায় বেশ প্রাণবন্ত আর হাসিখুশী ছিল। দাদু, দিদা, মাসি আর দুই মামার আদরে সময়টা তার তেমন মন্দ কাটেনি। তবে বাবা বাড়ি আসলে যেন বাড়িটা আরও আলো হয়ে উঠত, শিশু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত কখন বাবা বাড়ি ফিরবে। “তবে বড় হয়ে বাবার সঙ্গে অনেক জায়গায় আমরা গেছি, সেই দিনগুলো ছিল চমৎকার, নিছক বেড়ানোর জন্য বাবা যেতেন না, সব সময় পার্টির কোনও না কোনও প্রোগ্রাম থাকতই।” বললেন চন্দন, “এমনি করেই আমরা গেছি দার্জিলিং-এ রতনলাল ব্রাহ্মণের বাড়ি, দিল্লীতে ভূপেশকাকুর বাড়ি; ভূপেশকাকু আমাদের খুবই যত্ন করতেন। আরও গেছি জলন্ধরে, দক্ষিণ ভারতে। আমার একবার মনে আছে আমরা একটা ট্রেনে উঠলাম তিনজন একসঙ্গে, কিন্তু বাবা রইলেন আলাদা কম্পার্টমেন্টে, আমার ব্যাপারটা মোটেই ভাল লাগেনি। আসলে বাবার তো এম. এল. এ-র ফ্রি পাস ছিল, বাবা ছিলেন ফার্স্টক্লাসে আর আমাদের জন্য অত দামী টিকিট কেনার ক্ষমতা বাবার ছিল না। বাবা পাশাপাশি বোগির ব্যবস্থা করেছিলেন, যে স্টেশনে যেই গাড়ি থামছিল বাবা তাড়াতাড়ি নেমে আমাদের কামরায় এসে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছিল। সিগনাল সবুজ হলেই বাবা নেমে নিজের কামরায় ফিরে যেত। আমাদের টাকা ছিল না, কিন্তু বাবা আমাকে বুঝতে দিত না”, পুরোনো দিনে ফিরে গেলেন চন্দন বসু।
“বাবা চেয়েছিলেন আমি অনেকদূর পড়াশোনা করি, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি পড়াশোনায় আমার মন ছিল না”, চন্দন অকপটে স্বীকার করেন, “আমি যখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বি. কম. পড়ি, তখন ডলি নামে একটি মেয়েকে ভালবাসতে শুরু করেছি, স্বাভাবিক কারণেই তখন আমার টাকাকড়ির দরকার। তাই প্রথমে অল্পদিনের জন্য বেঙ্গল ল্যাম্প কোম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি রইলাম, তারপরে কিছুদিন রইলাম একটা ছোট কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে। তারপরেই ঢুকলাম ব্যবসার জগতে। খুব ছোট জিনিস দিয়ে শুরু করি। বাবাই বলেন, “নিজে কিছু কর, সে মুড়ি বিক্রী কর আর দোকানই চালাও, নিজে স্বাধীন ব্যবসা কর।’ তা আমি ছোটখাটো ব্যবসা কম করিনি, লোকের কাছে কম কথাও শুনিনি, অনেকেই ‘সর্বহারার ছেলে’ বলে শ্লেষ করতে ছাড়েনি, আমি এন্টালী বাজারে একটা চায়ের দোকান করেছিলাম, টেলেক্স কাগজের ব্যবসা করেছিলাম, বঙ্গলিপি খাতা বিক্রি করেও রুজি রোজগার করেছি এক সময়। আশি সালে দুর্গাপুরে একটা বিস্কুট কারখানা করি। বাবা প্রথমেই স্পষ্ট কথায় বলে দিয়েছিলেন, “তোমার ব্যবসার ব্যাপারে আমি কোনও সাহায্য করতে পারব না, নিজে যা পারো, কর।’ যাই হোক, যেদিন আমি একটা ডিশে চারটে বিস্কুট বাবার সামনে ধরে দিয়েছিলাম, সেদিন বাবার উজ্জ্বল সেই মুখটার কথা আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না।”
“আসলে, আমার সুবিধা তো দূরের কথা, অসুবিধাই যে বেশী সে কথা লোকে বুঝতে পারে না”, চন্দন বলে চলেন, “আমার নাকি বেশ জোর আছে একথা ভেবেই অনেকে আমার সঙ্গে কাজ করতে এসে পিছু হঠে যায়। এটাই বোধহয় বিখ্যাত ব্যক্তির ছেলে হওয়ার মূল্য। যাই হোক, আমি ‘জ্যোতি বসু’র ছেলে এ কথাটা তো আর অস্বীকার করতে পারি না। বাবা যে নিজের নীতির ব্যাপারে কতটা অনড় তা আমি ছাড়া কেই বা বুঝবে বা বুঝতে চাইবে?”
১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে চন্দন বিয়ে করেন ডলি ওয়াহিকে। অতিথি আপ্যায়নের আয়োজন হয় কলকতার দক্ষিণ সোমনাথ হলে। ডলি ওয়াহির বাবার নাম ওঁঙ্কারমোহন ওয়াহি, মা—শ্যামা ওয়াহি। চন্দন সল্টলেকে আলাদা একটি বাড়িতে স্ত্রী ও তিন মেয়ের সঙ্গে থাকেন। ফুটফুটে তিনটি মেয়ে—’মল্লিকা’, ‘যূথিকা’ এবং ‘বীথিকা’, সবাই তাদের চেনে ‘পায়েল’, কোয়েল’ আর ‘দোয়েল’ নামে।
চন্দন চায়নি তার বাবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী হোন। “আগেও বহুবার বাবার কাছে প্রধানমন্ত্রীত্বের অফার এসেছে, কিন্তু আমার মনে হয় বাবা রাজ্যে যেমন আছে, সেটাই ভাল। এখন আর অত ঝক্কি না নেওয়াই ভাল।” বাবার সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক খোলামেলা, বন্ধুর মত। একেবারে যে মতান্তর হয় না তা নয়।
কিন্তু বাবা খুব প্রোগ্রেসিভ ধরনের মানুষ আর কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো একদম পছন্দ করেন না। অথচ বাবা উদাসীনও নন, এত কাজের মধ্যেও সবার খোঁজখবর নেন। আর সকলের সঙ্গে সমান সমান লেভেলে মিশতে পারেন, আমার সঙ্গে আমার মত, আমার ছোট মেয়ে দোয়েলের সঙ্গে তার মত।”
যখন চিঙ্কু ছোট ছিল তার প্রায়ই মনে হত বাবা কবে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরবে। “বাবা ফিরে এলেন ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি হয়ে গেলেন ‘জনগণের মানুষ, সেটা বিরাট সম্মানের ঠিকই, তবে আমি সেই ‘পরিবারের বাবা”, “নিজের বাবার জন্য এখনও আকুল হয়ে থাকি।”