সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

১৮. কত রহস্য ওই অসীমে!

কত রহস্য ওই অসীমে!

কালো! কালো! কালো গ্রহ!

অবশ্য গ্রহটা কালো হবে, এটা জেনেশুনেই আমরা এর আবিষ্কারে বেরিয়েছিলাম। যেটা জানা ছিল না, সেটা হল এই যে— গ্রহটা আগাগোড়াই প্রলয়পয়োধিজলে নিমগ্ন। বিমান নামাবার মতো এতটুকুন ডাঙা জমিও কোথাও নেই।

মহাকাশে লক্ষ কোটি জ্বলজ্বলে নক্ষত্র, তাদেরই তলায় বর্তুল কালো একটি বিরাট রেকাবি, ভেজাল মেশানো তামার মতো নোংরা রং, কাঁধির উপর দিয়ে চারিদিকেই আবছা কুয়াশা। রেকাবির এ প্রান্তে যে নক্ষত্র এক্ষুনি অস্ত যাচ্ছে, এক ঘণ্টা বাদেই তাকে আবার উদয় হতে দেখা যাবে অন্যপ্রান্তে। চেনা চেনা নক্ষত্রপুঞ্জ আকাশের কোণে কোণে, তফাত শুধু এই যে, পৃথিবী থেকে এদের এত বেশি উজ্জ্বল দেখাত না। ওই যে উজ্জ্বলতম পুঞ্জটা, চলতি ভাষায় যাকে উড়ুক্কু মাছ বলি আমরা, ওর ভিতরে দেখছি একটা নতুন তারা, সারা মহাশূন্যে ওর মতো দীপ্তি অন্য কারও নেই। ওই হল আমাদের নিজস্ব সূর্য।

কিন্তু ও সূর্যকে আমরা দেখছি না এখন। সেই অপরূপ চিকনের কাজও দেখছি না মুগ্ধ নয়নে, তারার সঙ্গে তারা গেঁথে বিশ্বপ্রকৃতি যার কারুসৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছেন গগন জুড়ে। আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে ওই কালো বৃত্তটারই দিকে, যদিও নিবিড় কুয়াশার ভিতর দিয়ে ওর সুস্পষ্ট কোনো চেহারা, সাদা চোখে তো নয়ই— দূরবিনের সাহায্যেও আমরা ধরতে পারছি না।

আমরা আছি ছ-জন। এই মহাকাশযানের বৈমানিক আমরা এই ছ-টিই সাকুল্যে। ঠাকুরদা চেরুশিন, ঠাকুরদা বলে তাঁকে আমরা ডাকি। তাঁর সুপরিণত বয়সের জন্যই, অন্য কোনো কারণে নয়। তিনিই বিমানের ক্যাপ্টেন এবং অভিযানের নেতা। তারপর ভ্যারেন্টসভেরা দু-জন, স্বামী-স্ত্রী। তারপর রয়েছেন আরও এক দম্পতি, ইউলাদশেভরা। সবশেষে রয়েছি আমি, র‌্যাডি ব্লোখিন, বয়স ও অভিজ্ঞতা দু-দিক দিয়েই অর্বাচীন।

‘তাহলে কি ফিরেই যাব নাকি?’ প্রশ্ন করলেন ঠাকুরদা চেরুশিন।

চিফ ইঞ্জিনিয়ার টোলিয়া ভ্যারেন্টসভ বলল, ‘তা ছাড়া আর করবার কী আছে? আমাদের এই যে রকেটটি, এ শুধু শুকনো মাটিতে নামবার জন্যই তৈরি। অথচ এখানে তো দেখছি জল জল, শুধুই জল। সমুদ্র ছাড়া আর কিছু নেই গ্রহটাতে। ঘরে তৈরি কুঁদ আমাদের আছে বটে কয়েকখানা, ছ-টা আনাড়ি কারিগরও আছি আমরা। চেষ্টা করলে বছর খানেকের ভিতর জলের উপর ভাসবার মতো একটা পাটাতন আমরা গড়তেও পারি হয়তো। তবে সে জিনিস জলে ভাসিয়ে তার ওপর প্লেন নামানো যে আত্মহত্যারই নামান্তর, তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না কাউকে। জলে ডুবে মরার এ ঝুঁকি কে নেবে?’

রহিম ইউলাদশেভও আপত্তি জানাল, ‘জ্বালানিও তো কমে আসছে। এখানে নামা মানে সাত বছরের বাড়তি বিলম্ব। সেই বাড়তি সাত বছর চলবার মতো বাতাসও আমাদের সঙ্গে নেই। তা ছাড়া, আমরা— বয়েসও তো হচ্ছে আমাদের।’

রহিমের বউ আয়েশা জামা ধরে টান দিল ওর। ঠাকুরদার সামনে বয়সের কথা তোলা যে শিষ্টাচার নয়, এটা রহিম ভুলে গিয়েছে। বুড়োর বয়স যে নব্বইয়ের উপর।

গেলিয়া ভ্যারেন্টসভা ঠাকুরদাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল, ‘এখন ফিরে গেলেও কেউ বলতে পারবে না যে আমরা শুধু হাতে ফিরলাম। অনেক কিছুই আমরা দেখেছি, শুনেছি।’

সকলের সব কথা শোনার পরে চেরুশিন এইবার একটিমাত্র কথা বললেন, ‘তাহলে এর সমাধান একটা মাত্রই আছে।’

সমাধান? কিছু বুঝতে না-পেরে আমরা হতভম্বের মতো নেতার দিকে তাকালাম। তারপর আয়েশা, একমাত্র আয়েশাই বুড়োর কথার তাৎপর্য ধরতে পেরেছে। সে যেন চেঁচিয়েই উঠল একেবারে, ‘না না, কোনোমতেই না।’

সতেরো বছর! সতেরো বছর আগে ঠাকুরদাকে কথাটা বলতে শুনেছিলাম আমি। সে কথা হল এই, ‘জীবনের দৈর্ঘ্য মাপতে হয় কাজ দিয়ে, কথা দিয়ে নয়।’ শুনেছিলাম ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের দিন। হেমন্তের শেষ তখন। ভিজে ভিজে একটা হাওয়া বইছে, হাড়ের ভিতরে বিঁধে যাচ্ছে যেন। ক্ষুদে প্লেনটাতে চেপে আমি চলে এসেছি পায়ে পায়ে মাড়ানো কালো কালো ঘাসে-ঢাকা মাঠের উপর দিয়ে, ন্যাড়া ন্যাড়া গাছের সূচোলো মাথাগুলো সযত্নে এড়িয়ে সিসে-রং ঢেউয়ে ঢেউয়ে উত্তাল কুইবিশেভ সমুদ্র পেরিয়ে।

এসে তারপর চোখে পড়ল টিলার উপরে নীল বেড়া দিয়ে ঘেরা সবুজ রঙের একখানি ইটের বাড়ি। তার দরজায় পশুলোমের জামা গায়ে এক বুড়ো দাঁড়িয়েছিলেন, মাথায় তাঁর ঘন সাদা চুল। ফোটোতে আগেই দেখেছি তাঁকে, চোখে পড়া মাত্রই চিনলাম।

এমন ক্ষুদে বিমান আমার যেখানে-সেখানেই নামানো চলে। নামালাম তাঁর পায়ের কাছেই, কিন্তু তা থেকে বেরুতে গিয়েই পড়ে গেলাম এক নর্দমায়। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন আমায় টেনে তুলবার জন্য। তারপর হেসে বললেন, ‘এসে আগে জামাকাপড় বদলাও, পরিচয় নেব তার পরে।’

সেই আমার প্রথম আলাপ প্যাভেল অ্যালেকজান্দ্রোভিচ বেরুশিনের সাথে। প্রসিদ্ধ ক্যাপ্টেন তিনি বৈমানিক মহলে। শুক্রের দিকে প্রথম অভিযান যখন হয়, উনি ছিলেন অন্যতম বৈমানিক। শনিতে, নেপচুনে— সর্বত্রই প্রথম অভিযাত্রী দলের সদস্য। বৃহস্পতিতে যখন স্পুটনিক গেল, উনিই ক্যাপ্টেন তার। আজ সেই লোক, গৌরবোজ্জ্বল জীবনের শেষ অংশটার অবসর যাপন করেছেন কুইবিশেভ সমুদ্রের কূলে।

নক্ষত্রলোকের সঙ্গে আমারও কিঞ্চিৎ যোগ ছিল, অপ্রত্যক্ষভাবে। শিক্ষা পেয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতো। পূর্ব আফ্রিকাতে কিলিমাঞ্জোরো গিরিচূড়ায় যখন আন্তর্গ্রহ পর্যটনের স্টেশন গড়া হল, আমি ভার পেয়েছিলাম সেটা তৈরি করবার। সেইসময় একটা খসড়া আমি রচনা করি। সৌরজগৎটাকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়বার একটা উন্মাদ পরিকল্পনা।

সেটা একবিংশ শতাব্দীর শুরু। পৃথিবীর প্রায় সব বিজ্ঞানীই তখন একমত হয়েছেন যে, সৌরজগতের অধিকাংশ গ্রহই মনুষ্যবাসের অযোগ্য, বলতে গেলে মানুষের কোনো কাজেই তারা কোনোদিন আসবে না। আমার মনে হল, অযোগ্য এবং অকেজোই যখন, ওগুলোকে ঢেলে সাজালে ক্ষতি কী? পুর্নবিন্যাসের ফলে যদি পৃথিবীর পর্যায়ে উঠে আসতে পারে ওরা, তাতে কারও তো আপত্তি হওয়ার কথা নয়।

প্রস্তাবটা আমার যা ছিল, তা এইরকম— মঙ্গলকে আর শুক্রকে টেনে আনা হোক পৃথিবীর কক্ষপথের অভ্যন্তরে। মঙ্গলে আবহাওয়া নেই, ওখানে একটা আবহাওয়া তৈরি করে দিতে হবে। শুক্রে আবহাওয়া আছে, তবে তা দূষিত। তা থেকে কার্বনিক অ্যাসিড বাষ্পটা নিষ্কাশিত করে দিতে হবে। তারপর রইল শনি, ইউরেনাস, নেপচুন। ওদের সব টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে, যাতে ওদের অভিকর্ষ বেশ খানিকটা হ্রাস পেতে পারে। তারপর ঘটাতে হবে ধারাবাহিক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ওদের ভিতর, যাতে ওই টুকরোগুলো সূর্যের কাছাকাছি এসে রোদ পোয়াতে পারে খানিকটা।

পরিকল্পনার এইখানেই শেষ নয়। প্রস্তাব ছিল যে ট্রাইটনে একটা উপনিবেশ বসানো হবে আবিষ্কারকদের। সেইখানে ঘাঁটি করে তাঁরা আন্তর্নক্ষত্র অভিযানে বেরুতে পারবেন। এই ধরুন হাজারখানেক বছরের মধ্যেই কাছাকাছি নক্ষত্রমণ্ডলগুলোর চারিদিকটাতে দিয়ে আসতে পারবে একটা চক্কোর।

অবাক কাণ্ড, আমার এই রোমাঞ্চকর পরিকল্পনার প্রত্যেকটা অংশই একবাক্যে প্রত্যাখ্যান করলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু আমি কি তাতে হতাশ হই? দোরে দোরে ঘুরতে থাকলাম। বিজ্ঞানী, বৈমানিক কারও সঙ্গে দেখা করতে বাকি রাখলাম না। চেরুশিনকেই বা বাদ দেব কেন? সেইজন্যই—

আমি একা নই। চেরুশিনের কাছে তরুণদের আনাগোনা ছিল একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। নানা শ্রেণির। কেউ বহিরাকাশের বৈমানিক হতে চায়, কেউ বই লিখতে চায় গ্রহ-নক্ষত্র সম্বন্ধে, কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করেছে। এ ছাড়াও স্থানীয় জনগণের প্রতিনিধিও তিনি ডেপুটি সভার, সে হিসেবেও অনেকে আসত তাঁর কাছে।

চেরুশিন সেইভাবেই মৃদু মৃদু হাসছিলেন, যেভাবে সব সুপ্রতিষ্ঠিত বৃদ্ধেরাই উচ্চাশাপরায়ণ তরুণদের স্বপ্নের কথা শুনবার সময় হেসে থাকেন চিরদিন। অবশেষে বললেন তিনি, ‘তোমার হয়েছে গোড়ায় গলদ, র‌্যাডি গ্রিগরিয়েভিচ! দুনিয়ার আগে আগে চলতে চাইছ তুমি। সারা সৌরমণ্ডলে সর্বত্র তুমি উপনিবেশ বসাতে চাইছ তো? কিন্তু তার দরকারটা কী? এই পৃথিবীতেই তো যথেষ্ট জায়গা রয়েছে, আমাদের সকলের জন্যই। আর আরাম বিরাম তো পৃথিবীতে যা পাওয়া যাচ্ছে, অন্য কোথাও গিয়ে তার ব্যবস্থা করা সুদূরপরাহত ব্যাপার। তবে সবুর করো, তিন-শো বছর কাটতে দাও। তখন এসব প্রস্তাব কাজে আসবে। এখন ওসব নিয়ে মাথা ঘামানো বৃথা। যা এখন কাজে লাগবে না, তা নিয়ে এখনই অস্থির হয়ে বেড়ানোতে ফল কিছু নেই। সময় হলে সৌরমণ্ডলের পুনর্বিন্যাসে অবশ্যই হাত দেবেন ভাবীকালের লোকেরা। তখন প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা তারাই তৈরি করে নেবে, প্রাচীন পুথির পাতা উলটে তোমার খসড়ার খোঁজ কেউ করবে না।’

চেরুশিন আমায় হতাশ করে দিলেন বটে, কিন্তু আমার সমুখে দরজা বন্ধ করে দিলেন না তাঁর গৃহের। নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন, ‘মাঝে মাঝে এসো, গল্প করব।’ আমি ঘন ঘনই গিয়েছি, তাঁর হাতে অবসর আছে একথা শুনতে পেলেই গিয়ে জুটেছি। তিনি আমার সঙ্গ পছন্দ করেন, আমার কল্পনা ও পরিকল্পনার উপরে অশ্রদ্ধা নেই তাঁর— এটা তিনি সর্বদাই বুঝতে দিয়েছেন আমায়।

অবশ্য তাঁর কাছে গিয়ে স্রেফ নিজের কথাই আমি বলেছি প্রতিদিন, তাও নয়। তাঁর কাজে সাহায্যও করেছি কিছু। কাজ তাঁর ছিল। তিনি নিজের স্মৃতিকথা রচনা করছিলেন। নিজের হাতেই লেখেন, তবে আমায় পেলে ইলেকট্রোনিক টাইপরাইটার চালাবার ভার আমার উপরেই ছেড়ে দেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেই। তিনি বলে যান, আমি লিখে যাই।

একদিন তিনি চন্দ্র অভিযানের বিবরণ শুরু করলেন এইভাবে, ‘আমাদের অভিযান চন্দ্রের দিকে উড়ে চলল। সেখানে গিয়ে অনেক কিছু তোড়জোড় করবার আছে আমাদের।’

আমার মনে আছে, ওইটুকু লিখেই আমি অযাচিত উপদেশ দিতে গিয়েছিলাম বৃদ্ধকে, ‘ওভাবে লিখলে চলবে না তো প্যাভেল আলেকজান্দ্রোভিচ! স্মৃতিকথা লিখতে হলে তার রেওয়াজ হল ছেলেবেলার কথা আগে বলা। নিজের জন্মতারিখটা দিতে হয়, বংশাবলি উদ্ধৃত করে দিতে পারলে আরও ভালো। আর আপনি কিনা শুরু করেছেন একেবারে, আমাদের অভিযান চন্দ্রের দিকে উড়ে চলল বলে?’

সেইদিন সেই উপলক্ষ্যে সেই কথাটা আমি শুনেছিলাম চেরুশিনের মুখ থেকে, ‘জীবন? জীবন হল ঘটনা নিয়ে। জীবনের দৈর্ঘ্য মাপতে হয় কাজ দিয়ে, কথা দিয়ে নয়। আমার জীবনের প্রথম ঘটনা হল চন্দ্রাভিযান, কাজেই তারই কথা।’

আমি তবুও গোঁ ছাড়িনি, বলেছিলাম, ‘পাঠক তো লেখকের সম্বন্ধে ঘটনা ছাড়াও অনেক কিছু জানতে চায়! তিনি লোক কেমন ছিলেন, কী ধরনের শিক্ষা পেয়েছিলেন।’

‘ভুল! ভুল!’ বলে উঠেছিলেন চেরুশিন, ‘আমাকে নিয়ে অন্য লোক করবে কী? তাদের বিবেচ্য হল, আমি কাজ করেছি কতখানি এবং কোনদিকে! সেইজন্যেই—’

আমি আর তর্ক করতে সাহস করিনি। লিখে গিয়েছি তাঁর কথামতো।

এর কিছুদিন পরেই—

চিন্তাটা আমার মাথায় চেরুশিনই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বলা চলে। কথা প্রসঙ্গে একদিন আক্ষেপ করেছিলেন, ‘হাতের মাথায় আর নতুন কিছু নেই হে আবিষ্কার করবার! সৌরমণ্ডলের অন্ধিসন্ধি এখন আমাদের নখদর্পণে। আন্তর্নক্ষত্র অঞ্চলগুলোতে অভিযান চালানো ছাড়া বৈমানিকদের আর করণীয় কী আছে? কিন্তু সেকাজে হাত দিতে হলে যা প্রস্তুতি দরকার, তা এখন নেই কোনো দেশে। কতদিনে যে বিমানবিদ্যার ততখানি উন্নতি হবে!’

আমি সেদিন কোনো উত্তর করিনি তাঁর কথার। কিন্তু কথাটা নিয়ে চিন্তা করেছিলাম পরে। গভীরভাবেই চিন্তা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘হাতের মাথায় আর নতুন কিছু নেই আবিষ্কার করবার।’ হাতের মাথা বলতে অবশ্য সৌরজগতের আভ্যন্তরীণ পরিবেশকেই বোঝাতে চেয়েছেন তিনি।

সৌরজগতের সীমান্ত হল পৃথিবী থেকে চার আলোক-ঘণ্টার দূরত্বে। আর সেই সীমান্ত থেকে নিকটতম নক্ষত্রের দূরত্ব হল চার আলোকবর্ষ। এখন এই যে আলোকের চার ঘণ্টা আর চার বছরের ব্যবধান, এটার কি কিছুই থাকতে পারে না? শূন্য কি একেবারে মহাশূন্যই এখানে? কথাটা যেন অসম্ভব মনে হয়।

এই বিরাট ব্যবধানটার ভিতরে কোনো কিছুই যে নেই, এমন কল্পনা আমরা করি কেন? করি শুধু এই কারণে যে, প্রখরতম দূরবিন দিয়েও চোখে আমরা কিছু দেখিনি ওইখানটাতে। এখন কথা হল, দেখতে পাওয়ার প্রথম শর্তই হল আলো। ওখানে যে সব জিনিস আছে, গ্রহ-উপগ্রহাদি, তাদের যদি আলো না-থাকে একটুও, তাহলে তো দেখা যাবে না তাদের!

এ তর্কের সূত্র ধরে ধরে আমি একটা সম্ভাবনার সমুখে পৌঁছে গেলাম ধীরে ধীরে। সেটা হল এই যে, আলোকহীন গ্রহ ওই শূন্যাকার মহান ব্যবধানের ভিতর থাকলেও থাকতে পারে। থাকতে পারে দশ-বিশ হাজারও। তারা তো নাগালের ভিতরেই বলতে গেলে! চার আলোকবর্ষ আর এত কী দূর?

সুতরাং চেরুশিনের এ আক্ষেপের ভিত্তি নেই। আবিষ্কার করার মতো জিনিস এখনও আছে হাতের মাথাতেই। উদ্যোগ করলেই হয়।

এতদিন তারা আবিষ্কৃত হয়নি কেন? তার উত্তর এই যে, কেউ খোঁজেনি তাদের। খুঁজলেও তাদের পাত্তা পাওয়া শক্ত ছিল। যার আলো নেই, তাপ নেই, তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে কেমন করে?

কিন্তু, আলো নেই আলো নেই বলে এই যে চিৎকার, এটাও আবার ভিত্তিহীন প্রমাণ হতে পারে। হয়তো একটুখানি আলো আছে, সেই অনুপাতে তাপও আছে তাদের! কিন্তু তা এত সামান্য যে এত দূর থেকে তা মালুম হওয়ার কথা নয়। চোখে পড়বে কাছে গেলে।

বহিরাকাশে এমন ছোটো ছোটো নক্ষত্র শত শত আছে, যাদের আলো বা তাপ সাধারণ নক্ষত্রদের গড়পড়তা আলো বা তাপের চেয়ে অনেক কম। ফলে দূরবিনের সাহায্য ছাড়া পৃথিবীর মানুষ দেখতে পায় না তাদের। দেখতে পেয়েছেও অল্পদিন আগেই, সবে এই বিংশ শতাব্দীতে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো আর নিষ্প্রভ যারা— রেড-ডোয়ার্ফ যাদের নাম, তাদের তাপমাত্রা হল দুই হাজার থেকে তিন হাজার ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড!

এখন কথা এই সৌরমণ্ডলের অব্যবহিত সান্নিধ্যে আঁধার শূন্যের বুকে এমন আঁধার গ্রহ যদি থাকে, যার তাপমান রেড-ডোয়ার্ফদেরও দশ ভাগের এক ভাগ মাত্র, তা হলে? তাদের তাপ হাজার ডিগ্রির উপরে যাবে না, এক-শো ডিগ্রি হওয়ারও কোনো বাধা নেই। ওদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো আকার যাদের, তাদেরই উজ্জ্বলতা হবে অতি সামান্য, ছোটোদের তো থাকবেই না। ছ-শো ডিগ্রির কম তাপ যাদের, তারা বিকিরণ করে শুধু একটা অদৃশ্য ইনফ্রারেড (লাল-উজানি) রশ্মি।

সুতরাং, ওইসব গ্রহেরা (যদি থাকেই তারা) অদৃশ্য হতে বাধ্য। অদৃশ্য, যেহেতু তারা আলোক বিকিরণ করে না।

ভয়ে ভয়ে আমি এবার গেলাম চেরুশিনের কাছে। আমার ধারণার কথাও তাঁকে বললাম ভয়ে ভয়ে। কিন্তু সে ভয় কেটেও গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। চেরুশিনের চোখ দুটো জ্বলে জ্বলে উঠছে, স্বচক্ষেই দেখলাম। না, আমার কথা উনি অসার বলে মনে করেননি।

অনেক আলোচনা হল তারপর। একবছর ধরেই হতে থাকল। চেরুশিন ওদিকে চিঠিপত্র লিখছেন ঝুড়ি ঝুড়ি। যাঁরা মহাকাশ গবেষণায় লিপ্ত, যাঁর মহাকাশ পর্যটনে আগ্রহী, চন্দ্র, মঙ্গল, ইউনন, আইওতে যাঁরা গিয়েছেন বা যেতে চাইছেন, আকাশে আকাশে বিমান নিয়ে এই মুহূর্তে যাঁরা চক্কোর দিচ্ছেন, সকলের সঙ্গেই টেলিফোনে, টেলিগ্রামে, রেডিয়োগ্রামে অহরহ আলাপ-আলোচনা চলল তাঁর।

অবশেষে এক বছর পরে রকেট বিমান আকাশে উড়ল আমাদের। গন্তব্য ড্র্যাকো নক্ষত্রপুঞ্জের এক অন্ধকার তারকা। ‘ইনফ্রা ড্র্যাকোনিস’ নামকরণ চেরুশিনই করেছেন তার। বৈমানিকের সংখ্যা ছয়। দুই দম্পতি ভ্যারেন্টসভেরা আর ইউলদাশেভেরা, বৃদ্ধ চেরুশিন এবং বালক আমি। কেন্দ্রীয় পরিচালক সংস্থা চেরুশিনের এবং আমার সম্বন্ধে আলোচনা করেছিল। চেরুশিনের ব্যক্তিত্বের সমুখে দাঁড়াতেই পারেনি কোনো আপত্তি।

চেরুশিন সম্বন্ধে ওদের আপত্তি ছিল এই যে, তিনি অতিবৃদ্ধ। আমার সম্বন্ধে ছিল এই যে, আমি অতিতরুণ।

সে কথা যাক। আমরা উড়লাম। চার আলোকবর্ষ দূরে গিয়ে তল্লাশি চালাব আমরা। ত্রিশ বছর লাগবে আমাদের যেতে-আসতে। চেরুশিনের বয়স নব্বই, তিনিও কি ফিরে আসার আশা করছেন? একবারই ওকথা উঠেছিল পরিচালক সংস্থার সমুখে। চেরুশিন জবাব দিয়েছিলেন, ‘কী বলছেন আপনারা? সাড়ে বিরানব্বইয়ে তো মধ্যবয়সের শুরু! আমি তো এখনও যৌবন পেরুইনি! ঘরের কাছে কাজাকস্তানে যান, ঘরে ঘরে দেড়শো বছরের কর্মঠ লোক দেখতে পাবেন।’

বিমান উড়ছে। ঠিক চৌদ্দো বছরে পৌঁছোল আঁধার নক্ষত্র ইনফ্রা ড্রাকোনিসে। এসেই বুঝলাম, আমাদের ঠিকে ভুল হয়েছে গোড়াতেই। এই ইনফ্রাটা একটামাত্র নক্ষত্র নয়, একজোড়া। আমরা এসে পড়েছি যেখানে, তার নাম স্বভাবতই দিতে হল ইনফ্রা-এ। ইনফ্রা কি এখান থেকে বেশি দূর নয়। এই ধরুন পৃথিবী থেকে শনি যতদূর, তার চেয়ে কিছু বেশি।

যাহোক, আমরা ইনফ্রা-এ-তে পৌঁছেচি। কিন্তু নামব কী করে ওর উপরে? সম্পূর্ণ তারাটাই শত শত মাইল পুরু বরফে ঢাকা। আমাদের হিসাব আগাগোড়া ভুল। ভাবা গিয়েছিল, এখানকার তাপ হবে শূন্যের উপরে দশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, এসে দেখছি তা শূন্যের নীচে ছয়। আবহাওয়ায় হরেকরকম গ্যাস। শুক্রের মতো কার্বন ডাই অক্সাইড আছে, আছে হাইড্রোজেন, জলীয় বাষ্প, ঘন মেঘ। বৃহস্পতির মতো আছে মিথেন, অ্যামোনিয়া। তাদের নীচে বিশাল সমুদ্র। জমে আছে অনন্তকাল ধরে। এখানে কোথায় নামবে বিমান? নেমে কী দেখবে?

কিন্তু হতাশ হওয়া চেরুশিনের ধাতুতে নেই। তিনি বললেন, ‘ইনফ্রা-এ’-তে যখন নামা যাচ্ছে না, ‘ইনফ্রা-বি’-তে যাওয়া যাক। তিন বছর সময় বেশি লাগবে? লাগুক, কী আর করা যাবে? ত্রিশ বছর বরাদ্দ ছিল যাতায়াতের জন্য, সেটা না-হয় তেত্রিশে দাঁড়াবে।

হায় যিশু! ইনফ্রা-বি-তে পৌঁছে দেখা গেল, মহাসমুদ্র সেটাও, তবে ইনফ্রা-এ-র মতো জমাট বেঁধে অন্তহীন তুষারকান্তারে পরিণত হয়নি। কালো জলে ঢেউ উঠছে আথালপাথাল। এই জলের উপরেই বা নামা যাবে কেমন করে?

ইঞ্জিনিয়ার বলল, ‘ফিরে যাওয়া উচিত। সকলেই সায় দিল তাতে! সকলেই চেরুশিন ছাড়া। তিনি বললেন, একটা সমাধান আছে।’

আয়েশা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কক্ষনো না! না! না!’

যে সমাধানের কথা বললেন চেরুশিন, সে হল ব্যাথিস্ফিয়ার।

আমরা সবাই সমস্বরে বিরোধিতা করলাম এ প্রস্তাবের, কিন্তু চেরুশিন অটল। তিনি ওই সমুদ্রের তলায় নামবেন ব্যাথিস্ফিয়ারে বসে। যদি জলের তলায় কোনো জীব থাকে, তার বিবরণ রেডিয়ো মারফত উপরে পাঠাবেন। যতক্ষণ মৃত্যু এসে তাঁকে গ্রাস না-করে। মৃত্যু অবশ্য অনিবার্য। কারণ ব্যাথিস্ফিয়ার যন্ত্রটা জলের তলায় নামতেই সক্ষম, উপরে উঠে আসার ক্ষমতা তার নেই। ওতে করে নামা মানেই হল মৃত্যুবরণ করা।

তবু অটল চেরুশিন। তিনি বসলেন ব্যাথিস্ফিয়ারে। আমরা তাঁর অধীনস্থ কর্মচারী, আজ্ঞা পালনে বাধ্য। আমরা জলে নামিয়ে দিলাম তাঁকে। ব্যাথিস্ফিয়ার অদৃশ্য হল।

রেডিয়োতে শুনতে পাচ্ছি চেরুশিনের ভরাট কণ্ঠ, ‘ধীরে ধীরে নামছি আমি। সেকেন্ডে দুই মিটার আন্দাজ। সন্ধানী আলো খুলে দিয়েছি, জলের তলায়ও উদ্দাম স্রোত, ঘূর্ণী, ঢেউয়ের পরে ঢেউ! কত ছোটো ছোটো প্রাণী। কুচো চিংড়ির মতো। যত নীচে নামছি, গরম তত বেশি। এটা কী? মাথা নেই, লেজ নেই? তিমি? দ্রুত চলে যাচ্ছে ওদিকে। সাবমেরিন নয় তো?

এরা কী আবার? কচ্ছপ আর অক্টোপাশের মাঝামাঝি এক জানোয়ার। পাঁচটা দাঁড়া এদের। এরা ঘিরে ধরেছে আমায়। অবশ্য ব্যাথিস্ফিয়ারের ইস্পাতের কাঠামো এরা ভেদ করতে পারবে, এমন ভয় নেই।

উদ্ভিদ? পাকানো পাকানো শিকড়, মোটা মোটা গুঁড়ি, ডাল থেকে বাটির মতো ছোটো ছোটো ফুল বা ফল তলার দিকে ঝুলে রয়েছে। এখানে ইনফ্রা-রেড আলো, সে আলো আসছে সমুদ্রতল থেকে।

কে যেন ব্যাথিস্ফিয়ার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আলোর সমুখে কিছুই দেখছি না কিন্তু। সমুদ্রতল ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে। গাছ! গাছ! আর কী আশ্চর্য! বাগানে যেমন সারি বেঁধে গাছ বসানো হয়, এখানেও যেন তেমনি—

একটা কালো খাদ! ব্যাথিস্ফিয়ার নেমে যাচ্ছে তারই ভিতর! বিদায়! মস্কোতে আমার বিদায় সম্ভাষণ জানাবে।’

এক মুহূর্তের নীরবতার পরে হঠাৎ একটা চিৎকার, ‘ফেটে গেল!’ ব্যাথিস্ফিয়ারের উপরে দমাদম আঘাত পড়ছে! প্রচণ্ড আঘাত! তার সঙ্গেই জল ঢোকার শব্দ! বৃদ্ধের গলাতেও যেন জল ঢুকেছে। হাঁইফাঁই করতে করতে তিনি বলছেন, ‘খাদের তলায় বড়ো বড়ো বাড়ি! গম্বুজ, মিনার! অদ্ভুত সব জীব! ওরা কী—?’

বজ্রাঘাতের মতো একটা শব্দ, তারপর একটা আর্তনাদ!

কারা যেন প্রমত্ত উল্লাসে কোলাহল করে উঠল, তারপর সব স্তব্ধ!

লাউডস্পিকার ঘিরে পাঁচটি মানুষ স্তব্ধ হয়ে আছে, কিন্তু তার ভিতর দিয়ে কারও কণ্ঠস্বর আর আসছে না। ইঞ্জিনিয়ার ভ্যারেস্টসভ বলল— অতিমৃদুস্বরে বলল, ‘ত্রিশ বছর পরে আমরা আবার আসব এইখানে।’

____

এক আলোকবর্ষ হল—পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের তেষট্টি হাজার গুণ।

ব্যাথিস্ফিয়ার ইস্পাতের একটা ঘর। জলের তলায় নেমে গিয়ে সেখানকার বিবরণ উপরে পাঠাতে হলে এই যন্ত্রই ব্যবহার করতে হয়।