সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

১৬. ক্লোরোফাগ

ক্লোরোফাগ

এদিকে-ওদিকে কত সূর্য! কাছে কাছেই!

দূরে দূরেও অনেক অনেক তারা। সেসব যে কত দূরে, তার হিসাব করতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সূর্যগুলির আবার গ্রহও আছে। কিছু কিছু গ্রহ প্রায় পৃথিবীর মতোই। তাতে সমুদ্র আছে, মহাদেশ আছে, মহাদেশে রয়েছে মহানগরী, সুদীর্ঘ রাজপথ আর মহাকাশ চারণের বিমানবন্দর।

সবচেয়ে বড়ো কথা, মানুষ আছে সেখানে। অনেক— অনেক মানুষ।

সেসব মানুষ বিমান গড়ছে, বিমান ছুটছে মহাশূন্যে পাড়ি দিয়ে কল্পনাতীত দূরত্বে। নতুন নতুন গ্রহে নামছে তারা, ভাঙচুর করে তারপর আবার মনোমতো করে গড়ে তুলছে তাদের। সূর্যগুলো ক্রোধে জ্বলছে তাদের ঔদ্ধত্য দেখে, ঝটিকা তুলছে প্রমত্ত আলোড়ন তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করবার জন্য। কিন্তু মুছে ফেলবার মতো জীব নয় এই মানুষরা। মজবুত করে বাড়ি তৈরি করছে রৌদ্রঝঞ্ঝাকে রুখবার জন্য। প্রকৃতির প্রত্যেকটা শক্তিই তাদের চেয়ে বৃহৎ, তাদের চেয়ে প্রবল। কিন্তু সেটাকে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। কাজ করে যায় আপন মনে। উদ্দেশ্য সিদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত করেই যাবে। সে উদ্দেশ্য হল প্রকৃতিকে জয় করা।

ভয় কাকে বলে, জানত না তারা। ইদানীং কিন্তু জেনেছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা পরমাণুর ভিতরে বিকৃতি এসেছে দেখে। সর্বত্র নয়, একটামাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহে। অগণ্য তারকাপুঞ্জে আকীর্ণ মহাশূন্য। তার ভিতর কোথায় ছিল বিশেষ একটা সৌরমণ্ডল, সেই মণ্ডলে কোথায় ছিল একটা বিশেষ গ্রহ, সেইখানে ঘটেছে এই অনর্থ। যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি মারাত্মক। একটা পরমাণুতে ঘটেছে বিকৃতি।

জীবিত? না, জীবিত ঠিক বলা যায় না ওকে। তবু কাজ করে যাচ্ছে জীবিতেরই মতো। দুটো জটিল বস্তুর সমবায় এটা। দুটোতে জোড়াও খুব ভালোভাবে লাগেনি। একটার ভিতরে যেই এল পরিবর্তন, জন্ম নিল নতুন পরমাণু একটা। এইরকমই চলল। পরমাণুতে পরমাণুতে ছেয়ে গেল গ্রহটা। তখন মানুষেরা বাধ্য হল ওদের দিকে নজর দিতে। যদিও বড়ো বড়ো জিনিসের দিকে তারা নজর দেয়নি কোনোদিন, পরম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অগ্রাহ্য করেছে জ্বলন্ত সূর্য, ছুটন্ত ঝড় আর অপার মহাশূন্যকে।

নতুন এই পরমাণুকে সাধারণ মানুষ নাম দিল বীজাণু। ডাক্তারেরা নাম দিলেন এর ক্লোরোফাগ। সাধারণ এবং অসাধারণ সব মানুষই জানল— বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে সাংঘাতিক জিনিস হল ক্লোরোফাগ।

মাঝারি আকারের গ্রহ আল্টৈরা। তার আকাশে ভাসছে মহাশূন্য বিমান ‘তারকারানি’। ছোটো ছোটো খেয়া বিমান এসে তারকারানির গায়ে লাগছে মাঝে মাঝে, নানাস্থানের যাত্রী পিলপিল করে তা থেকে বেরিয়ে তারকারানিতে উঠে পড়ছে, সুদূর কোনো গ্রহে পাড়ি জমাবার জন্য।

আল্টৈরা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নয়। তারকারানির মতো বিশাল বিমানকে এখানে মাটিতে নামানো নানাদিক দিয়েই অসুবিধা, খরচার দিক দিয়ে বিশেষত। অত্যাধুনিক নভশ্চর এই তারকারানি, গতিবেগ এর অশ্রুতপূর্ব, মাত্র পঞ্চাশ দিনে, মানে পৃথিবীর সময়মানে পঞ্চাশ দিনে এ রেগুলাস থেকে কাসিং পর্যন্ত পাড়ি দেয়, যে দূরত্বের পরিমাণ হল পাঁচ-শো আলোকবর্ষ।*

খেয়া বিমানগুলি খুবই ব্যস্ত। আল্টৈরা থেকে এত বেশি যাত্রী কোনোবারই ওঠে না তারকারানিতে, আর এত বেশি নারী ও শিশু কোনোবার থাকে না যাত্রীদের মধ্যে। মেয়েদের চোখ লাল দেখাচ্ছে যেন। কাঁদছিল নাকি ওরা?

খেয়ারা একে একে যাত্রী চড়িয়ে দিল তারকারানিতে। যাত্রী এবং মাল। ভিতরে ঢুকে যাত্রীরা এগিয়ে যাচ্ছে একটা লম্বা বারান্দা ধরে। সেই বারান্দারই একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের লক্ষ করছেন বিমানের ডাক্তার।

ডাক্তারের বাহ্যত ভাবটা হেলাফেলার। কিন্তু মনে মনে তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। আল্টৈরার মহিলারা এত মোটা কেন? ডাক্তারের অভিজ্ঞতা এইরকম যে, কৃশকায়া মহিলাদের চিকিৎসা করা অপেক্ষাকৃত সোজা। ওষুধে ধরে তাদের চট করে। এইসব মুটকি যদি অসুখে পড়ে—

পড়বে না, কে বলতে পারে তা? মহামারিতে কামেরুন ধ্বংস হয়ে গেল, আল্টৈরাতেও যে তার বীজাণু ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েনি, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? এই যে অগুন্তি মোটা মেয়ে উঠল তারকারানিতে, এরা যদি মহামারীর মুখে পড়ে যায়, ডাক্তার নর্ডেনফেল্ড হিমশিম খেয়ে যাবেন তাদের নিয়ে।

অবশ্য সান্ত্বনা আছে এইটুকু যে, হিমশিম বেশিক্ষণ খেতে হবে না। ও মহামারির ছোঁয়াচ লাগলে মুটকিরাও বেশিক্ষণ বাঁচবে না, বাঁচবেন না ডাক্তার নিজেও।

ডাক্তার মনে মনে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন। ঝোঁক চেপে যাচ্ছে কারও উপরে কোনো একটা কড়া হুকুম জারি করবার। দরকার হলে কড়া হতে তিনি জানেন। সম্প্রতি তা টের পেয়েছে রেগুলাসের বোটানিক্যাল গার্ডেন। কাসিংয়ের জন্য এক লট গাছপালা তারা পাঠাচ্ছিল তারকারানিতে বোঝাই করে। ডাক্তার হুকুম দিয়েছেন, সব গাছকে হাসপাতাল-ব্লকে আটক রাখা হবে। কোয়ারান্টাইন যাকে বলে। বিশ্বাস কী যে, ওইসব উদ্ভিদ ক্লোরোফাগের বিষ বহন করে আনছে না রেগুলাস থেকে?

বিমানে যারা উঠেছে, আল্টৈরার ডাক্তারদের সার্টিফিকেট তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আছে। স্বাস্থ্য ভালো! স্বাস্থ্য ভালো! স্বাস্থ্য ভালো! প্রতি সার্টিফিকেটের এক বয়ান। এ বয়ান যে কত অন্তঃসারশূন্য, তা বেশ জানেন নর্ডেনফেল্ড। না, ঘুস খায়নি ডাক্তারেরা। জেনেশুনে জোচ্চুরি করবে না কোনো ডাক্তার। কিন্তু জ্ঞান বুদ্ধি তাদের কতটুকু? ক্লোরোফাগ কার ভিতরে ঢুকেছে, কার ভিতরে ঢোকেনি, কী করে জানবেন ভদ্রলোকেরা? এমনও হতে পারে যে আল্টৈরা থেকে যাত্রা করার পাঁচ মিনিট পরেই এই হাজারখানিক স্বাস্থ্যবান যাত্রী শয্যাগত হয়ে পড়বে ক্লোরোফাগের আক্রমণে।

প্রত্যেকটা যাত্রী তার ডাক্তারি সার্টিফিকেট জমা দিয়ে যাচ্ছে নর্ডেনফেল্ডের হাতে। তিনি তাকিয়েও দেখছেন না সেগুলির দিকে। তিনি যে জিনিসের দিকে তাকাচ্ছেন, সে হল প্রত্যেকটি যাত্রীর মুখ। ক্লোরোফাগের সুস্পষ্ট লক্ষণ কিছু আছে কি না জানেন না তিনি— কেউই জানে না। তিনি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, কারও মুখে অস্বাভাবিক কোনো কিছুর পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে কিনা। যেমন ধরো, একটা লালচে আভা, যেমন ধরো ফুটফুট কালো বা সাদা দাগ, যেমন ধরো ফুলো ফুলো ভাব বা চুপসে যাওয়া ভাব।

স্বাভাবিক থেকে এক চুল এদিক-ওদিক হলে নর্ডেনফেল্ড ক্যাঁক করে ধরবেন তাকে। বাহ্যিক হেলাফেলার ভাব? ওটা তাঁর ছদ্মবেশ, ওর আড়ালে ওৎ পেতে আছে শিকারির তীক্ষ্ন জিঘাংসা।

সব খেয়া বিমানই যাত্রী খালাস করে বিদায় নিয়েছে। বাকি শুধু একখানা। আগে থেকে খবর এসেছে ক্যাপ্টেনের কাছে, একটিমাত্র ছোটো মেয়েকে নিয়ে একখানা বিমান ভিড়বে তারকারানির গায়ে। কাগজপত্র দেখলেই ক্যাপ্টেন বুঝতে পারবেন যে, মেয়েটিকে আটকাবার মতো কোনো আইন নেই বলেই বিমানবন্দর বাধ্য হয়েছে তাকে ছেড়ে দিতে। আইন থাকলে ছাড়ত না, কারণ এ বালিকার ইতিহাস অজ্ঞাত। প্রমাণ না থাকলেও সন্দেহ করবার কারণ আছে যে, ওর আত্মীয়জনেরা কেরুমানের সঙ্গে কোনো-না-কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল।

একটিমাত্র যাত্রী আসতে বাকি, একটি আট বছরের বালিকা। নর্ডেনফেল্ড বিরক্ত। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, সেই অষ্টমবর্ষীয়ার শুভাগমনের আশায়? ওদিকে জেনসেন তাঁর জন্য বসে আছে চারতলার পানশালায়। পানীয়ের জন্য ব্যস্ত নন ডাক্তার। তাঁর ব্যস্ততা জেনসেনের সঙ্গে খানিকটা আলাপচারির জন্য। যাত্রীর লাইনে ওকে দেখেই ডাক্তার বলে দিয়েছেন, ‘দেখা হয় যেন চার-তলায়। এই ঝামেলাটা মিটলেই আমি আসছি।

জেনসেন প্রায়ই যাতায়াত করে আন্তর্নক্ষত্র বিমানপথে। ইনসিয়োরেন্স এজেন্ট সে। রেগুলাস কাসিং লাইনের প্রত্যেক বন্দরেই প্রচুর কাজ করে। হেন মাস যায় না, যাতে একবারও তাকে তারকারানিতে চড়তে না-হয়। আর চড়লেই তো দেখা হতেই হবে নর্ডেনফেল্ডের সঙ্গে। বহুবার হয়েছে দেখা, একটু ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে তা থেকে। নর্ডেনফেল্ড সাধারণত সব লোককেই অপছন্দ করেন। কিন্তু এই জেনসেন সেদিক দিয়ে ব্যতিক্রম। লোকটার কথায় বুদ্ধির দীপ্তি আছে। আনন্দ পাওয়া যায় সে কথা শুনে।

যাক, এসে গিয়েছে শেষ খেয়া। ঢুকেছে ছোট্ট মেয়েটা। খেয়া বিমান ওই ফিরে যায় কর্তব্য সমাধা করে। একটু বাদেই মেয়েটি এল। শত শত লোক যেভাবে ডাক্তারের সমুখ দিকে হেঁটে চলে গিয়েছে এতক্ষণ, ঠিক সেইভাবেই চলে যাচ্ছে মেয়েটাও। বেশ গম্ভীরভাবেই এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছে। ডাক্তারকে দেখে বিনীতভাবেই বলল, ‘মাপ করবেন, এইপথেই কি যেতে হবে আমায়?’

গম্ভীর জবাব ডাক্তারের, ‘ওই দরজার ভিতর দিয়ে।’

মেয়েটি ধন্যবাদ দিয়ে ঢুকে পড়ল দরজার ভিতরে। নর্ডেনফেল্ডেরও আর প্রয়োজন নেই দাঁড়িয়ে থাকার। তিনিও অনুসরণ করলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। মেয়েটিকে দেখলেন, বসে আছে একটা সোফায়। ভাবখানা এইরকম যেন কেউ একজন তাকে ওইখানে বসিয়ে দিয়ে খোঁজ নিতে গিয়েছে— কোথায় সে থাকবে, কী সে খাবে ইত্যাদি।

চারতলার পানশালায় জেনসেন প্রতীক্ষা করছে। ডাক্তার তার সামনে বসে ধীরে ধীরে চুমুক দিতে লাগলেন গেলাসে। জিজ্ঞাসা করলেন প্রায় উদাসীনভাবে, ‘আল্টৈরা থেকে এলে যখন, সেখানকার খবর অবশ্যই পেতে পারি তোমার কাছে। কী হালচাল দেখলে?’

জেনসেন জবাব দিল, ‘হালচাল বলতে, ইনসিয়োরেন্সের বাজার একটু মন্দা। লোক সব চঞ্চল। যে যার পরিবার পরিজনকে অন্য অন্য গ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ভিড় দেখছ তো বিমানে?’

‘ভিড়? তা দেখছি! ক্লোরোফাগের আতঙ্কে দেশছাড়া হচ্ছে সবাই!’

‘ক্লোরোফাগ আসছে না কি?’

‘কেমন করে বলি তা? কামেরুনে এসেছিল, এখানেই বা আসার বাধা কী? তবে, বিমানযাত্রীরা কেউ এখন পর্যন্ত ওতে আক্রান্ত হয়নি বলেই যেন মনে হয়।’

‘আক্রমণ তো হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। মনে নেই, কামেরুনে কী হল? সব চলছিল কাঁটায় কাঁটায়— ঠান্ডা, স্বাভাবিক, সুষ্ঠুভাবে। হঠাৎ এক রাত্রির মধ্যে ওলটপালোট। দুই দিনে একটা গ্রহ জনমানবশূন্য।’

‘কামেরুনের খবর কিছু পাও?’

‘দুই বছরের ভিতর কিছু না। আগে এই তারকারানি নিয়মিত ভিড়ত ওই কামেরুনে। দুই বছর থেকে রাস্তা পালটে ফেলেছে। কামেরুনকে এক আলোকবর্ষ তফাতে রেখে যাতায়াত করে সব বিমান। খবর কী করে আসবে?’

‘তবে ওই আল্টৈরার লোক হঠাৎ চঞ্চল হল কেন এমন? খবর কিছু না-যদি পেয়ে থাকে ওরা?’

হল কী, একখানা ক্ষুদে, একান্ত ক্ষুদে বিমান কোথা থেকে এল পরশুদিন? হঠাৎই আকাশে তাকে দেখা গেল। বিমানবন্দরে সে নামল না। কী করল, জানো?’

‘কী করল?’

‘ঝুপ করে নেমে পড়ল হ্রদের ধারে। দূরবিন লাগিয়ে কেউ কেউ দেখেছিল। একখানা লম্বা হাত একটা ছোটো মেয়েকে ঠেলে বার করে দিল এয়ার-লক থেকে।* তারপর সে উড়ে গেল আবার! কী করল জানো?

‘বলো, শুনি।’

‘উড়তেই থাকল, উড়তেই থাকল। অবশেষে সূর্যের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। পুড়ে মরল আর কী! আরোহী, বিমান পুড়ে মরল সব কিছু।’

‘বলো কী?’

‘তারপর মেয়েটাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল পুলিশ, পৌরসভা, বিমানবন্দর একে একে সবাই। কাগজপত্র আছে ওর সঙ্গে। তাতে ওর নামধাম পরিচয় নাকি আছে, সার্টিফিকেট আছে ডাক্তারের। আছে প্রচুর অর্থ। এবং একটা অনুরোধ, মেয়েটাকে যেকোনো সুসভ্য গ্রহে স্থিতু করিয়ে দেওয়া হয় যেন। যেহেতু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ওর আপনজন কেউ নেই!’

‘সেই মেয়েটাই কি ওই এল শেষ খেয়ায়?’ বিড়বিড় করে প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করলেন ডাক্তার। তারপর বিদায় নিলেন জেনসেনের কাছে।

বিদায় নিয়েও কিন্তু তক্ষুনি পানশালা ত্যাগ করা হল না তাঁর। টেলিভিশনে ক্যাপ্টেনের ছবি ফুটে উঠল, ‘ডাক্তার আছো?’

‘আছি।’ জবাব দিলেন নর্ডেলফেল্ড।

‘একটা ছোট্ট মেয়ে এসেছে। বন্দর কর্ত,পক্ষ বলছে, তাকে আটকাবার কোনো আইন নেই বলেই তাকে বিমানে চড়তে দেওয়া হয়েছে। কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থান নেই। যেকোনো সভ্য গ্রহে ওকে নামিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ এমন কোনো গ্রহ, যে ওকে আশ্রয় দিতে রাজি হবে। ওর ইতিহাস জানার কোনো উপায় নেই— একথা শুনেও যারা রাজি হবে।’

‘ওর ইতিহাস আমি জানি।’ বললেন ডাক্তার নর্ডেনফেল্ড, ‘ও কামেরুনে ছিল। ওর দেহে ক্লোরোফোগের বীজাণু না-থাকে যদি তো সে হবে বিশ্বের সেরা বিস্ময়।’

ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন পানশালা থেকে। মেয়েটা তখনও আগেরই জায়গায় সোফায় বসে আছে। কেউ তাকে নিয়ে যেতে আসেনি। আশ্চর্য! মেয়েটাকে এতটুকু চঞ্চল দেখাচ্ছে না। যেন একা থাকা ওর খুব অভ্যাস আছে, এইরকম ভাব একটা।

ডাক্তার তাকে উঠে আসতে বললেন। নিয়ে চললেন হাসপাতালের ঘরে। এদিকে বিমান ছেড়ে দিয়েছে। কাসিংয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে! গতিবেগ? সে যে কত, তার হিসাব দেওয়া যাবে না। পাঁচ-শো আলোকবর্ষের দূরত্ব তাকে পঞ্চাশ দিনে পাড়ি দিতে হবে। পৃথিবীর সময় অনুযায়ী পঞ্চাশ দিন। অর্থাৎ এক দিনে দশ আলোকবর্ষ। এখন হিসাব করে নিন, যার প্রয়োজন।

হাসপাতাল ঘরটা বড়ো। বিমানখানা তৈরি হওয়ার পরে দু-বার মাত্র এ ঘর ব্যবহারে এসেছে, কয়েক দিনের জন্য। কারণ সুস্থ লোক ছাড়া কেউ তো আতর্নক্ষত্র বিমানপথে ভ্রমণ করে না! ওই দু-বার দু-টি লোক আকস্মিকভাবেই পীড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তবে সেরেও উঠেছিলেন চটপট। গত দু-বছর এ ঘরে মানুষ থাকেনি একদিনও। এবার ওতে ঠাঁই পেয়েছে সেই গাছগুলি, রেগুলাস থেকে যাদের কাসিং পাঠানো হয়েছে। ওদের পাতার রং কোনোভাবে পালটাচ্ছে কিনা, রোজ দু-বেলা লক্ষ করছেন ডাক্তার। কোথাও যদি দাগ ধরে পাতায়, বা দু-চারটে করে ফুটকি দেখা দেয়, সন্দেহ করার কারণ ঘটবে। এই সন্দেহ যে ক্যামেরুনের ক্লোরোফাগ রেগুলাস পর্যন্ত বিষাণু ছড়িয়ে দিয়েছে, তার ক্রিয়া শুরু হয়েছে উদ্ভিদের জগতে।

এখন এই মেয়েটি, একেও তো রাখতে হয় হাসপাতাল ঘরেই। তাকে জেলখানায় আটকে ফেলার মতো আইন নেই দেশে। কিন্তু হাসপাতালে আলাদা করে রাখার জন্য আইন লাগে না। ডাক্তারের নির্দেশই সে ব্যাপারে যথেষ্ট। ওকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেওয়া যায় না, তার ফল মারাত্মক হতে পারে। তারকারানির সমস্ত যাত্রী এবং সমস্ত বৈমানিক— হাজারের উপরে তাদের মিলিত সংখ্যা, সব মারা পড়তে পারে রাতারাতি। উদ্ভিদের উপরে বিষের ক্রিয়া একটু মন্থর হলেও, রক্তমাংসের দেহের উপরে তা কাজ করে বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্রবেগে।

যাহোক, মেয়েটাকে রাখতে হবে এই হাসপাতাল ঘরেই। ডাক্তারের হুকুমে সঙ্গে সঙ্গেই একটা বেড়া দেওয়া হল ওর মাঝ বরাবর। বেড়ার একপাশে রইল ওইসব গাছ, অন্যপাশে রইল মেয়েটা। তেমন তেমন হলে ডাক্তার নিজে এসে ওই গাছগুলোর পাশেই একটা খাটিয়া পেতে ফেলবেন নিজের জন্য। তেমন তেমন তো হতেই পারে। ক্লোরোফাগ যদি মেয়েটার হয়ই, ডাক্তারেরও অবশ্যই হবে!

ক্লোরোফাগের আতঙ্ক এভাবে হতবুদ্ধি করে ফেলেছে সব গ্রহের মানুষকে যে আল্টৈরাতে কেউ এই মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টামাত্র করেনি। সর্বদাই শত হস্ত দূরে রেখেছে তাকে। ওর কাগজপত্রগুলো পর্যন্ত পড়তে সাহস করেছে, শুধু রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সেগুলি শোধিত হওয়ার পরে।

তারকারানিতেও সেইরকমই হত, এ বিমানের ডাক্তারটি অন্য ধাতুর না-হলে। সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয় যতই প্রবল হোক, একটা ছোটো মেয়েকে একেবারে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ফেলে রাখতে তাঁর বিবেকে বাধল। তিনি আলাপ করলেন ওর সঙ্গে।

নাম ওর ক্যাথি ব্রান্ড। ছ-বছর মাত্র বয়স যখন ওর, তখনই ওকে একটা অন্ধকূপে নিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়। ওর বাবাই বন্ধ করেন। কামেরুনেই বাড়ি ছিল ওদের। কী যে হল, হঠাৎ ওর বাবা একদিন ওকে নিয়ে গেলেন ইউনিভার্সিটির বাড়িতে। জনপ্রাণী সেখানে ছিল না। উপরে উঠে গিয়ে ওর বাবা ওকে একটা ঘরে পুরে ফেললেন। জানালা তো নেইই সে ঘরের, দরজাও না। মেঝের ঠিক উপরেই দেয়ালের গায়ে সুড়ঙ্গ একটা। তার ভিতর দিয়ে একটা লোক কোনোমতে যেতে-আসতে পারে। লোহার একটা কবাট দিয়ে বন্ধও করা যেত সে সুড়ঙ্গের মুখ।

দিনে একবার দুইবার ওর বাবা আসতেন ওই সুড়ঙ্গের বাইরে। ক্যাথির ঘরে কখনো ঢুকতেন না। কথা যা বলবার, বাইরে থেকেই বলতেন। ক্যাথি ভিতরে বসে শুনত। খাবার-দাবার? প্যাক করা টিনের খাবার। টিনের মুখ বাবা কেটে দিতেন। কিন্তু মুখ খুলে নিতে হত ক্যাথিকেই। এইভাবে কত বছর যে কেটেছে, তা হিসাব নেই ওর।

ওর তা হিসাব নেই, কিন্তু নর্ডেনফেল্ডের পক্ষে তা হিসাব করে নেওয়া শক্ত হল না। কাগজপত্রে ওর জন্মতারিখ লেখা আছে। সে হিসাবে ওর দশ এখন। ছ-বছর বয়সে ও ঢুকেছিল অন্ধকূপে। তাহলে প্রায় চার বছর ও কাটিয়েছে সেখানে। কী ভয়ানক!

ঘরটার বর্ণনা দিয়েছে ক্যাথি। বলেওছে যে বাড়িটা ছিল ইউনিভার্সিটির। তাহলে তো ধরে নিতে হয় ওটা জীববিদ্যার অপচন কক্ষ। ঘর তৈরি করে প্রথমেই ওকে জীবাণু মুক্ত করা হয়। ওতে আগম-নিগমের একমাত্র পথ হল একটা জীবাণুনাশক ট্যাঙ্কের ভিতর দিয়ে। ক্যাথি যাকে বলছে সুড়ঙ্গ, সেইটাই ওই ট্যাঙ্ক নিশ্চয়।

তাহলে আরও এক সিদ্ধান্ত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ক্যাথির বাবা তাহলে জীববিদ্যার বীজাণুবিশারদ ছিলেন। কোনো ইউনিভার্সিটিতে চাকরি করতেন নিশ্চয়, কামেরুনে ক্লোরোফাগের আক্রমণ যখন শুরু হল, তিনি নিজের মেয়েটিকে নিয়ে পুরে ফেললেন ওই অপচন কক্ষে।

তারপর বার করে আনলেন। কেন আনলেন?

তার উত্তর ক্যাথি দিতে পারে না।

কীভাবে আনলেন?

তার উত্তর ও দিতে পারে। একটা বস্তার ভিতরে পুরে। বস্তাটা নাইলন বা ওইরকম অন্য কিছু উপাদানে তৈরি। বাবা ওটা সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন। ক্যাথি ওতে ঢুকল। মুখটা কী জানি কীভাবে আপনিই বন্ধ হয়ে গেল। বাতাসের ব্যাগ থলের ভিতরই ছিল নিশ্বাস নেওয়ার জন্য।

বস্তা টেনে নিয়ে বাবা সোজা এসে উঠলেন এক ক্ষুদে বিমানে। বস্তার মুখ খুললেন আল্টৈরাতে এসে।

দিনের পর দিন কাটে। নর্ডেনফেল্ডের বড়ো কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন, ক্যাথির সঙ্গে গল্প করা। ফাঁকে ফাঁকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা গাছগুলির। কোনো গাছে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মুশকিল হয়েছে, কোথা থেকে এক জাতীয় ক্ষুদে পোকার আমদানি হয়েছে ওইসব গাছে। প্রথমে দুটো-চারটে ছিল, এখন বোধ হয় তাদের সংখ্যা হাজার হাজার।

অন্যদিক দিয়ে গাছগুলো সুস্থ।

কিন্তু সুস্থ নয় ক্যাথি ব্রান্ড। তার সারা গায়ে চামড়া ফেটে ফেটে যাচ্ছে, কসানিও ঝরছে দুই-এক জায়গায়। ক্লোরোফাগ! ক্লোরোফাগ! ক্লোরোফাগ! চার বছর অন্ধকূপে আটক রেখেও ওর বাবা শেষ রক্ষা করতে পারেননি। নাইলনের থলিতে করে বাইরে এনেছিলেন ওকে, সেই থলেতেই কোনোরকমে ঢুকে পড়েছিল ক্লেরোফাগের বীজাণু।

নিশ্চয় তার বাবার নিজের দেহেও শেষপর্যন্ত ঢুকেছিল ওরা, তা নইলে তিনি সূর্যের বুকে আত্মাহুতি দিলেন কেন বিমান সমেত?

যাহোক, বাবা তো আত্মাহুতি দিয়েছেন। ক্যাথিকে বাঁচায় কে? তাকে বাঁচাবার মতো বিদ্যে নর্ডেনফেল্ডের নেই। শুধু ক্যাথিই বা কেন, এই বিমানের হাজার যাত্রীকে, এই বিমানখানাকেও বাঁচাবার ক্ষমতা নেই তাঁর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কারও নেই।

কিন্তু কীভাবে কী হল, কেউ জানে না।

সেদিন সকালে নর্ডেনফেল্ড এসেছেন ক্যাথিকে দেখতে। আজ তাকে মুমূর্ষুই দেখতে পাবেন, আশঙ্কা ছিল তাঁর কিংবা হয়তো মৃতই। কিন্তু ঘোরতর বিস্ময়, তাঁর জীবনের বৃহত্তম বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য আজ।

ক্যাথির সর্বাঙ্গ আচ্ছন্ন সেই ক্ষুদে ক্ষুদে কালো পোকায়। যা কাল পর্যন্ত বাসা বেঁধে ছিল শুধু গাছগুলোর উপরে।

কালো পোকাদের ভিড় আবার সেইসব জায়গাতেই বেশি, যেখান থেকে কাল রস ঝরতে দেখা গিয়েছিল। স্বাভাবিক!

কিন্তু যা অস্বাভাবিক, তাও নজরে পড়ছে ধীরে ধীরে। রস শুষে নিয়ে পোকারা ক্ষতমুখ থেকে সরে যাচ্ছে, আর ক্ষত বা চামড়া ফাটার চিহ্ন পর্যন্ত মিলিয়ে যাচ্ছে দেখতে দেখতে। সারা সকালটা ডাক্তার ঠায় বসে পোকাদের কাণ্ডকারখানা দেখলেন। দুপুর নাগাদ পোকারা ক্যাথির দেহ থেকে নেমে গেল যখন, দেহে কোনো ব্যাধি নেই ক্যাথির।

উচ্ছ্বসিত একটা জয়োল্লাস বেরিয়ে এল ডাক্তারের মুখ থেকে। বিশ্বজগৎ রক্ষা পেল। ক্লোরোফাগের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই পোকা। গ্রহে গ্রহে ছড়িয়ে দাও তাদের। চাষ করো ওই পোকার সযত্নে।

ক্যাথি মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এল।

সংসারে ওর কেউ নেই। ডাক্তার নর্ডেনফেল্ডই ওর প্রতিপালনের ভার নিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে ও মেয়ে অবিস্মরণীয়। ওকে অবহেলিত হতে দেওয়া যায় না।

____

* পৃথিবী থেকে সূর্যের যা দূরত্ব , তার তেষট্টি হাজার গুন দূরত্বকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ ।

* বিমান যখন শূন্যে ওড়ে,তখন তা থেকে বেরুবার একমাত্র দরজা । মাটিতে এ দরজা ব্যবহার হয় না ।