১৫. পুনশ্চ

১৫. পুনশ্চ

সেদিনটা ছিল রবিবার। ৩০শে মার্চ ১৯৯৭ সাল। চৈত্র মাসের পড়ন্ত রোদের ধূসর আলোয় ইন্দিরাভবনকে কেমন অদ্ভুত অপার্থিব দেখাচ্ছে। সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ ভবনের বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে গেলেন লন্ডনে ভারতের হাই কমিশনার মিঃ এল. এম. সিংভি। তার একটু পরেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারী কাজকর্ম সেরে চলে গেলেন তাঁর সচিব। বসু কোমরের ব্যথায় মাসভোর কষ্ট পেয়েছেন, প্রায় রোজই বাড়িতে অফিসের অনেক কাজ সারতে হচ্ছে। শরীরের অবস্থা ‘নরম্যাল’ হওয়ার আগেই বাজেটের দিন, নিজের প্রশ্নোত্তরের দিন ঐ ব্যথা নিয়েই বিধানসভায় বসে থাকতে হয়েছে, অল্প সময়ের জন্য হলেও মহাকরণেও যেতে হয়েছে।

রবিবার দুপুরটা আর বিশ্রাম পেলেন না। দুপুর থেকেই ফোনের পর ফোন। আর ফোনে যে সংবাদটা পেলেন, তারপর আর বিশ্রাম নেওয়া যায় না। তারপর পাঁচটা থেকেই বিভিন্ন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চলছে। বসু বসেছিলেন স্ট্রেইটব্যাক এক সাধারণ চেয়ারে, কোমরের পিছনে ডাক্তারের নির্দেশমত কালোর ওপর সাদা সূতোর এমব্রয়ডারি করা একটা ছোট কুশন। পরণে সাদা হালকা স্ট্রাইপ দেওয়া ফুলশার্ট আর গাঢ় ময়ূরনীল রঙের লুঙ্গি। মুখটা ঈষৎ ক্লান্ত। প্রথমেই বললেন, “দিল্লীতে তো গভর্নমেন্ট পড়ে যাচ্ছে, কংগ্রেস সাপোর্ট তুলে নিচ্ছে, আবার ‘ক্রাইসিস’, দুপুরে দেবেগৌড়া ফোন করেছিল, তারপর আবার চন্দ্রবাবু নাইডু। বলছে ‘এক্ষুণি দিল্লী আসুন, আপনাকে আসতেই হবে’, আমার তো শরীর ভাল নয়।” আবার ফোন বেজে উঠল, কেন্দ্রের এক মন্ত্রী রামুওয়ালিয়া, সেই একই অনুরোধ। দু’চার কথায় বসু জানিয়ে দিলেন, তাঁর বক্তব্য, ওধারের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জেনেও নিলেন। তারপর আমাকে বললেন, “মনে হচ্ছে কংগ্রেসের কেশরী প্রাইম মিনিস্টার হতে চায়। যাই হোক কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ ওরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে; তিনজন পেছনে আছে ভাস্কর রেডি, সীতারাম কেশরী আর কেরালার করুণাকরণ। তবে কংগ্রেসের অবস্থা তো ভাল না। ওরা ভোটও চায় না, অথচ বি. জে. পি. ভোট চাইছে। কংগ্রেস চায় যুক্তফ্রন্টের কয়েকজনকে নিজেদের দিকে নিয়ে নিতে, কিন্তু ভেবে দেখছি, তাতেও তো ওদের মেজরিটি হবে না। এখন বোধহয় পার্লামেন্টীয় পার্টির মিটিং চলছে, কংগ্রেস তো অলরেডি প্রেসিডেন্টের কাছে দাবি পেশ করেছে, প্রেসিডেন্ট না কি কংগ্রেসের দাবি বিবেচনাও করছেন। দেখা যাক্।”

আমার কথাবার্তা বেশি দূর এগোল না। আবার ফোন বাজল। এবার ভি. পি. সিং। ফোন করছেন সরাসরি হাসপাতাল থেকে। বসু ভি. পি. সিং-কে বললেন, “আপনি কংগ্রেসের সঙ্গে কথাবার্তা চালান, বি. জে. পি-কে আমাদের ঠেকাতেই হবে। না, আমি এখনই যেতে পারছি না, আমার ট্রিটমেন্ট চলছে, তাছাড়া আমার বাজেট সেশন চলছে, আমি এমনি এখানেই বেশি বেরোচ্ছি না। আমি ১১ তারিখ পলিটব্যুরো মিটিং অ্যাটেন্ড করতে দিল্লী যাচ্ছি, তখন কথা হবে।”

কালো কর্ডলেসটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বসু বললেন, “উপায় তো আমাদের একটা বার করতেই হবে। একটা পলিসি, একটা প্রিন্সিপল্-এর কথা ভাবতেই হবে। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা নয়, তবে ন্যূনতম কর্মসূচী নিয়ে একটা জায়গায় আমাদের পৌঁছোতেই হবে। যে কোনভাবে যুক্তফ্রন্টের ঐক্য তো অক্ষুণ্ণ রাখতেই হবে।”

দু’চারটে কথা এগোতেই আবার ফোন। ফোনের ওপারে প্রণব মুখার্জি। বসু বললেন, “আপনারাই তো সাপোর্ট তুলে নিয়েছেন, আপনারই জানেন এরপর কি হবে। কথা বলুন, পলিসি ঠিক করুন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে, না হলে তো বি. জে. পি. এসে যাবে, ওরা তো ইলেকশন চাইছে।” ফোনের কথা শেষ হল। “আপনার কি মনে হয়, কংগ্রেস কেন হঠাৎ এই রকম সিদ্ধান্ত নিল?”—এই প্রশ্নের উত্তরে বসু বললেন, “আমার তো মনে হয় কংগ্রেসের অন্য কোনও মতলব আছে। ওরা সম্ভবত মুপানারের দল ভাঙাতে চাইছে। তবে পরিস্থিতির ওপর আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যুক্তফ্রন্টের জোট তো ঠিক রাখতেই হবে—আসলে কোয়ালিশন চালানোর অভিজ্ঞতা থাকাটাও খুব দরকার।” এই পর্যন্ত বলে বসু থামলেন। “তাহলে এখন কি হবে? আবার বোধহয় আপনাকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ আসবে”–এই চরম প্রশ্নটা করেই ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে বসুর উত্তর “আমার শরীরটা খারাপ হয়েছে ঠিকই, তা বলে আমার মাথাটা তো খারাপ হয়নি। মাথাটা এখনও ঠিক কাজ করছে।”

আবার সেই নাটক। পরের দিন সকালে কাগজের হেডলাইন—’সমর্থন তুলে সরকার গড়তে চাইল কংগ্রেস’। কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরী ৩০শে মার্চ ১২টায় রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে শঙ্করদয়াল শর্মার হাতে সমর্থন প্রত্যাহারের চিঠি তুলে দেন। তিন পাতার এক চিঠি। চিঠি জুড়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ব্যর্থতার অভিযোগ। তার সঙ্গে রয়েছে সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক দাবি। অন্যদিকে যুক্তফ্রন্ট নেতৃত্বের বক্তব্য সমর্থন-বিচারের একমাত্র জায়গা লোকসভা। রাষ্ট্রপতি কি করবেন তার আভাস তখনও পাওয়া যায়নি। যুক্তফ্রন্টের বিশ্বাস কেশরী একটা বড় ঝুঁকি নিয়েছেন, সকলের সমর্থন তিনি পেতে পারেন না, ফলে কংগ্রেসেও একটা ভাঙন দেখা দেবে। ৩১ তারিখে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক। সি. পি. এম. পলিটব্যুরোর বৈঠকও এগিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু কংগ্রেসে ভাঙন ধরার বদলে উলটোটা ঘটল। দলের বড় নেতারা সকলেই কেশরীর পাশে দাঁড়ালেন। কংগ্রেস ঘর গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এদিকে যে দলকে ঠেকাতে এত তৎপরতা, সেই বি. জে. পি. জানিয়ে দিল তারা সরকার গঠনে আগ্রহী নয়। সরকার গড়ার চেষ্টা না করে বি.জে. পি. ভোটে যাওয়ার পক্ষপাতী। অ্যাডভানি-বাজপেয়ী রাষ্ট্রপতিকে জানিয়ে দিলেন কংগ্রেস যদি ২৭১ জনের সমর্থন দেখাতে পারে তাহলেই একমাত্র যেন তাঁদের ডাকা হয়, দেবেগৌড়া সরকারের পতন হলে কংগ্রেসকে যদি ডাকা হয় এবং তারা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ না করতে পারে তাহলে নির্বাচন হবেই।

রাষ্ট্রপতি যুক্তফ্রন্টের সংসদের মুখোমুখি হওয়ার দাবি মেনে নিলেন। ঠিক হল ১১ই এপ্রিলের মধ্যেই দেবেগৌড়ার সরকারকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে। যুক্তফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি কংগ্রেসকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন জানাল। মোর্চার প্রথম সারির নেতারা ৩১ তারিখে সকালের মধ্যেই দিল্লী এসে পৌঁছলেন। সি. পি. আই. (এম)-এর হরকিষেণ সিং সুরজিৎ কেরালার কোঝিকোড থেকে বাঙ্গালোর হয়ে দিল্লী পৌঁছলেন সকাল দশটা নাগাদ। পার্টির পলিটব্যুরো সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক সেরে তিনি অন্ধ্র ভবনে কথা বললেন তেলেগু দেশম দলের নেতা, অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর সঙ্গে। পরে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয় তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী ডি. এম. কে. নেতা এম. করুণানিধির সঙ্গেও। নাইডু, করুণানিধি সকালেই দিল্লী চলে আসেন। চন্দ্রবাবু নাইডু তামিল মানিলা কংগ্রেসের নেতা জি. কে. মুপানারের সঙ্গেও কথা বলেন। মুপানার তার আগের দিন গভীর রাতে দিল্লী পৌঁছেছেন। বিকেলে স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকের শেষে ঠিক হয় কংগ্রেসকে তাদের এই সিদ্ধান্ত ফের ভেবে দেখতে বলার অনুরোধ করা হবে।

বসু দিল্লী রওনা হলেন ১লা এপ্রিল মঙ্গলবার বিকেল ৫.১৫-এর উড়ানে। রাতের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নতি কিছু হল না। আপস-রফার জন্য বিভিন্ন দলের নেতারা বিভিন্ন সূত্র নিয়ে আলাপ আলোচনা চালিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে স্ট্যাণ্ডিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ভি. পি. সিং হাসপাতালেই কেশরী এবং দেবেগৌড়ার সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করবেন। একটা সমাধান সূত্রের ক্ষীণ হদিস পাওয়া গেল মাত্র। নাহলে কংগ্রেস ও যুক্তফ্রন্টের নেতারা সকলেই নিজেদের অবস্থানে অনড়। আবার এদিকে বি. জে. পি. তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বলেছে সরকার গড়ার সুযোগ পেলে তা গ্রহণে তাদের আপত্তি নেই। স্নায়ুর লড়াই তুঙ্গে উঠেছে। কোনও সুস্পষ্ট ছবি পাওয়া যাচ্ছে না। কংগ্রেস শর্ত দিচ্ছে ফ্রন্টের নেতা পরিবর্তনের। সেই শর্তও যুক্তফ্রন্ট মানতে রাজি নয়।

২রা এপ্রিল বসু নিঃশ্বাস ফেলার সময় পেলেন না। সকালে পলিটব্যুরোর বৈঠক। তারপর বঙ্গভবনে কোনও রকমে দুপুরের খাওয়া সেরেই বেরিয়ে গেলেন ভি. পি. সিং-এর সঙ্গে কথা বলতে অ্যাপোলো হাসপাতালে। সন্ধ্যেবেলা বঙ্গভবনে বসুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন প্রণব মুখার্জি। বসুকে তিনি অচলাবস্থা নিরসনে সক্রিয় উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানালেন। সুরটা বেশ নরম। কংগ্রেসের দিক থেকে ব্যাপারটা তখন এই রকম দাঁড়িয়েছে—প্রথমে সমর্থন তুলে নেওয়া এবং সরকার গঠনের দাবি; তারপর কংগ্রেসের নেতৃত্বে কোয়ালিশনের প্রস্তাব; তারপর নেতাবদলের শর্ত। সবশেষে যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে কোয়ালিশনে অংশ নেওয়ার সম্মতি। বসু প্রণববাবুকে বামদলগুলির অবস্থানের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন। বসু পরে আমাকে বললেন, “প্রণবকে বললাম একটা রাবিশ চিঠি দিলেন প্রেসিডেন্টকে, কি না আমরা গভর্ণমেন্ট ফর্ম করব—মেজরিটি কোথায়? আসলে ভেবেছিল যুক্তফ্রন্ট থেকে কিছু লোক ভাঙিয়ে নেবে,—যাই হোক সেটা পারেনি।”

পরের দিনও পরিস্থিতির গুণগত কোনও পরিবর্তন হল না। বসু বুঝলেন আরও কয়েকদিন না গেলে সংকটের সমাধানসূত্র বেরোবে না। বসুর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট ও কংগ্রেস দু’দিকের বড় বড় নেতারা সকলেই কথা বলতে আসছেন। জ্যোতিবাবুর বিচক্ষণতার ওপর সকলেরই অগাধ আস্থা। বঙ্গভবনে বসুর সঙ্গে দেখা করলেন বিদেশমন্ত্রী আই. কে. গুজরাল। সকালে এসেছিলেন কংগ্রেসের মাধবরাও সিন্ধিয়া আর সন্ধ্যায় অর্জুন সিং। দুপুরবেলা বসু গেলেন রাষ্ট্রপতি শংকরদয়াল শর্মার সঙ্গে কথা বলতে। বসু ইতিবাচক সমাধান সূত্রের কথা ভাবছেন। সুরজিতের সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে। সুরজিৎ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস যেহেতু সরকারকে সমর্থন করছে, সরকারের নীতি, কর্মসূচীর ব্যাপারে তাদের নিশ্চয়ই বক্তব্য থাকতে পারে। সে বক্তব্য জানানোর অধিকারও তাদের আছে। সেক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে কংগ্রেসের নিয়মিত আলোচনার কোনও একটি স্থায়ী ব্যবস্থা থাকতে পারে।

৪ঠা এপ্রিল মনে হল বরফ গলবে। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরী সন্ধ্যাবেলা বঙ্গভবনে ‘জ্যোতিবাবু’র সঙ্গে প্রায় ৪৫ মিনিট বৈঠক করলেন। বৈঠকে সি. পি. এমের সাধারণ সম্পাদক হরকিষেণ সিং সুরজিৎ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গভবনের ভি আই পি লিফটের সামনে তখন নিরাপত্তারক্ষী আর ক্যামেরাম্যানের . ভিড়। এর আগে সকালে এসেছিলেন দেবেগৌড়া। প্রত্যেকেই চাইছেন ‘জ্যোতিবাবু’র সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে, কারণ ‘বাসুজি’ ছাড়া এই পরিস্থিতির জট খোলার বুদ্ধি আর কে-ই বা দিতে পারবেন?

বসু ৪ তারিখে একবারই বঙ্গভবন থেকে বেরিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন এসকর্ট হাসপাতালে জনতা দলের অসুস্থ নেতা বিজু পট্টনায়ককে দেখতে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ কেশরী এলেন, বসু আগে থেকেই তৈরী হয়েছিলেন, পরনে ওঁর ফরম্যাল পোশাক। চারতলায় বসুর স্যুইটের বড় হল ঘরে বৈঠক হল। কেশরী আটটা দশ নাগাদ হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন। দেবেগৌড়ার বিরুদ্ধে সব ক্ষোভ উজাড় করে দিয়ে এসেছেন বসুর কাছে, কোনও অভিযোগই গোপন রাখেন নি। সুরজিৎ তারপরও খানিকক্ষণ রয়ে গেলেন বসুর কাছে। সাড়ে আটটা নাগাদ বসু একটু একা হলেন, কিন্তু ফোন অবিরাম বেজেই চলল। কেশরীর মনোভাব, উদ্দেশ্য সবই বসুর কাছে তখন স্ফটিকের মত স্বচ্ছ। ঘটনাস্রোত কোন্ দিকে বইবে অনুমান করতে তাঁর ভুল হল না। মনে হচ্ছে চরম পরিণতি এড়ানো সম্ভব হবে। এই বৈঠকের সূত্র ধরেই ফ্রন্টের মুখপাত্র জয়পাল রেডি জানালেন, ফ্রন্ট কংগ্রেসকে আনুষ্ঠানিক আলোচনা চালানোর জন্য চিঠি পাঠাবে। চন্দ্রবাবু নাইডু শনিবার দিল্লী আসার পর এই চিঠি পাঠানো হবে। বসু কলকাতা ফিরলেন শনিবার ৫ই এপ্রিল রাতে। দিল্লীতে রীতিমত ধকল গেছে। শরীরটাও ‘নরম্যাল’ হয়নি। রবিবার ৬ই এপ্রিল সকাল দশটায় বামফ্রন্টের বৈঠক। রবিবার সকালে পার্টি অফিসে বামফ্রন্টের বৈঠকে গেলেন, বিকেলে ইন্দিরা ভবনে দেখা করতে এলেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার মহন্ত। তারপরেই এলেন কয়েকজন ডাক্তার। বসুর শারীরিক অস্বস্তিটা থেকেই গেছে, মেডিকাল রিপোর্ট নিজেই হাতে করে নিয়ে বসু দেখালেন, নতুন ওষুধ, নতুন চিকিৎসা শুরু হল। বললেন “তবে আবার তো ৮ তারিখে দিল্লী যাচ্ছি, কখন আর এই সব নতুন চিকিৎসা শুরু হবে জানি না।”

শনিবার বসুর অনুপস্থিতিতে দিল্লীতে অবস্থার আরও যেন অবনতি হল। কংগ্রেস সভাপতি কেশরী কংগ্রেসের সদর দপ্তরে দিল্লী প্রদেশ কংগ্রেস আয়োজিত সভায় দেবেগৌড়ার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিষোদগার করেন। তিনি বলেন যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে তাঁর কোনও বিরোধ নেই। তাঁর আপত্তি দেবেগৌড়াকে নিয়ে—কারণ ঐ লোকটি “নিষ্কর্মা, সাম্প্রদায়িক, গদিলোভী এবং অভদ্র”। এইভাবে কেশরী বুঝিয়ে দিলেন ফ্রন্টের নেতৃত্ব পরিবর্তনই তাঁর উদ্দেশ্য। ঐদিকে কংগ্রেসের ভেতরকার অবস্থাও অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। শরদ পাওয়ার তাঁকে জানিয়ে দেন কেশরীর আচরণে সাংসদরা ক্ষুব্ধ। রাজেশ পাইলটও বলে দেন, সাংসদদের সঙ্গে আলোচনা না করে আস্থা ভোট নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া চলবে না। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে কেশরী রাতে দৌড়ে গেলেন ভি. পি. সিং-এর কাছে। জানিয়ে এলেন দেবেগৌড়াকে সরালেই এই সংকটের সমাধান হবে। ভি. পি. এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। সন্ধ্যায় ফ্রন্টের স্ট্যাণ্ডিং কমিটির বৈঠক বসল। আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ফ্রন্ট স্থির করল, সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য কংগ্রেসের কাছে লিখিত কোনও প্রস্তাব তারা পাঠাবে না। স্থির হল ৯ তারিখের আগে স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক ডাকা হবে না।

৭ই এপ্রিল সোমবার বসু মহাকরণে গেলে সাংবাদিকরা সামনে রাখলেন আবার সেই পুরোনো প্রশ্ন—’বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কোনও সম্ভাবনা আছে?’ এই একই প্রশ্ন বসুর আর ভাল লাগে না। যথেষ্ট বিরক্ত গলায় বললেন, “বার বার একই কথা জিজ্ঞেস করেন কেন? এটা এখন ক্লোজড চ্যাপ্টার।” বসু দিল্লী রওনা হলেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। এবার দিল্লী তাঁকে আটকে দিল বেশ কয়েকদিন। ১৩ তারিখে ফেরার ইচ্ছা ছিল, হয়ে উঠল না। ফিরলেন একেবারে বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। পয়লা বৈশাখ রাত ১১টায়। দিল্লীতে বসু যেন মধ্যস্থতার জীবন্ত প্রতীক—কেন্দ্রে সরকারের জটিল সংকট তো আছেই তার ওপর আবার কেন্দ্রীয় ভূতল পরিবহণমন্ত্রী টি. জি. বেঙ্কটরামন বসুকে ট্রাক-ধর্মঘট মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয়স্তরে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করেন।

৯ই এপ্রিল বুধবার বসু যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। খুব সকালেই কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার আগেই চন্দ্রবাবু নাইডু যান হরকিষেণ সিং সুরজিতের বাসভবনে। সেখানে একপ্রস্থ কথাবার্তার পর বসুর সঙ্গে আবার একদফা আলোচনা হয়। সকালেই যুক্তফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় জট খুলতে ফ্রন্টের পক্ষে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলবেন হরকিষেণ সিং সুরজিৎ, চন্দ্রবাবু নাইডু এবং ফারুক আবদুল্লা। পরে অবশ্য মুলায়ম সিং যাদব ও জনতাদলের শরদ যাদবও এতে যোগ দেন। আলোচনায় বসতে চেয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয় কংগ্রেস সভাপতি সীতারাম কেশরীর কাছে। কেশরীর বাড়িতে ঐ চিঠি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে কেন্দ্রীয় কল্যাণমন্ত্রী বি. এস. রামুওয়ালিয়ার ওপর। বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ফ্রন্টের নেতৃত্ব বদল হবে না। সকাল সাড়ে নটা থেকে ১২টা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়ার বাড়িতে এই বৈঠক বসে। এই বৈঠকে দেবেগৌড়া ছাড়া উপস্থিত ছিলেন সুরজিৎ, বসু, শরদ যাদব, লালুপ্রসাদ যাদব, চন্দ্রবাবু নাইডু, এ. বি. বর্ধন, জয়পাল রেডি, মুলায়ম সিং যাদব, জি. কে. মুপানার, কে. করুণানিধি, বীরেন্দ্রকুমার বৈশ্য, মুরাসোলি মারান এবং ফারুক আবদুল্লা।

বি. এস. রামুওয়ালিয়ার কাছ থেকে চিঠি পাবার পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির জরুরী বৈঠক ডাকেন কেশরী। বেলা আড়াইটে নাগাদ মিটিং শুরু হয়। চিঠি নিয়ে আলোচনা চলে ৪৫ মিনিট। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কারা ফ্রন্টের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন এ নিয়ে বাদানুবাদও চলে। শেষ পর্যন্ত বিস্ময়করভাবে বাদ পড়েন কেশরীর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা করুণাকরণ এবং বিজয় ভাস্কর রেডি। রাতে কেশরী যান আকবর রোডে দলের সাংসদদের ভোজসভায়। বিকেলবেলা জম্মু কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা-র পান্ডারা রোডের বাসভবনে আবার দু’পক্ষের প্রতিনিধি দলের সম্মিলিত বৈঠক হল। ৫টা থেকে প্রায় সাড়ে তিনঘণ্টা আলোচনা চলল কিন্তু কোন সমাধানসূত্র বেরোল না। বৈঠক শেষ হবার পর দু’পক্ষ দু’দিকে চলে গেলেন, ফ্রন্টের প্রতিনিধিরা গেলেন ৭নং রেসকোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা চলে গেলেন কেশরীর বাড়ি, পুরানা কিলা রোডে।

১০ই এপ্রিল পরেরদিন সকালে আবার আলোচনা শুরু হল কংগ্রেস নেতা শরদ পাওয়ারের বাড়িতে। আরম্ভ হল সওয়া দশটা নাগাদ, চলল একঘণ্টার ওপর। কোনও সমঝোতার আশা দেখা যায় না, আলোচনা ব্যর্থ হয়, নিশ্চিত হয়ে যায় ভোটাভুটি হতে চলেছে লোকসভায়, ৭নং আকবর রোডে ফ্রন্টের নতুন অফিসে স্টিয়ারিং কমিটির জরুরী বৈঠক ডাকা হয়। এই বৈঠকেও বসু উপস্থিত ছিলেন, একঘণ্টা বৈঠক চলে। বৈঠকের পর সাংবাদিক সম্মেলনে সুরজিৎ বলেন তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশনে যাবেন না, তাছাড়া নেতৃত্ব পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়, একটা সমন্বয় কমিটি করা যেতে পারে আর একটা খসড়া বিবৃতি হতে পারে, যেখানে কংগ্রেস বলবে কোথায় তাদের অসন্তোষ ছিল বলে সমর্থন প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এদিকে বি. জে. পি. সব বিকল্পই খোলা রেখে দেয়। গভীর রাতে বি. জে. পি-র শীর্ষ নেতারাও বৈঠকে বসেন। শোনা যায় বি. জে. পি. ভোটাভুটি থেকে বিরতও থাকতে পারে।

১১ই এপ্রিল সংসদের মুখোমুখি হল যুক্তফ্রন্ট সরকার। লোকসভায় বিতর্ক চলল টানা বারো ঘন্টা। দেবেগৌড়া তাঁর আস্থা প্রস্তাব পেশ করার সময় আধঘণ্টার ভাষণে সরকারের কাজকর্মের খতিয়ান তুলে ধরেন, আর শাণিত আক্রমণ করেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সীতারাম কেশরীকে। শনিবার ১২ই এপ্রিল সকালে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক দিয়ে শুরু হল দ্বিতীয় পর্ব। আগের দিন সকালে বঙ্গভবনে বসুর কাছে ফ্রন্টের নেতারা সদলবলে আসেন। বসু ও নেতারা যা প্রধানমন্ত্রীর কাছে, কারণ ভোটের আগে বেশ বোঝা যাচ্ছিল যে যুক্তফ্রন্ট যদি নেতৃত্ব বদলাতে রাজি হয়, তাহলে আস্থা ভোটে তারা সরকারকে সমর্থন করবে। নেতৃত্ব পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়ে কথা উঠলে বসু ও সুরজিৎ দৃঢ়তার সঙ্গে আপত্তি তোলেন, তাঁরা মনে করেন সেটা হবে কংগ্রেসের কাছে আত্মসমর্পণ করা। দেবেগৌড়াও বলেন স্টিয়ারিং কমিটিতে যা সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আমি তার বাইরে বেরোতে পারবই না। এরপর তিনি লোকসভায় চলে যান।

এদিকে অন্ধ্রভবনে ফ্রন্ট্রের শীর্ষনেতাদের এক বৈঠকে যোগ দেন বসু। সাড়ে বারোটা থেকে এই বৈঠক শুরু হয়। বসু ও সুরজিৎ বার বারই বলতে থাকেন এখন আস্থাভোট নিয়ে বিতর্ক চলছে, এখন নেতৃত্ব বদলের প্রশ্ন অবান্তর। অন্যান্য কয়েকজন নেতা বলেন, নির্বাচনের মুখোমুখি হওয়াই সমীচীন। কয়েকজন বলেন, নির্বাচন এড়াতে নতুন পথ নেওয়া যেতে পারে কি না ভেবে দেখা দরকার। বসু তখন স্পষ্ট ভাষায় বলেন “আমরা যুক্তফ্রন্ট গড়েছিলাম বি. জে. পি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার জন্য। ফ্রন্টের শরিকরা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন হবে না। কংগ্রেস এখন অন্যায় দাবি করে সমর্থন প্রত্যাহার করেছে। উদ্দেশ্য ফ্রন্ট ভেঙে দেওয়া। কেউ চাইলে কংগ্রেসের সঙ্গে যেতে পারে কিন্তু এতে তাদের ভাবমূর্তি কিছু উজ্জ্বল হবে না। এর আগে বহু ফ্রন্ট হয়েছে, ভেঙেও গেছে। একটা সরকার পড়ে গেলেই সব শেষ নয়। আবার ফ্রন্ট গড়া হবে, আবার যুদ্ধ হবে। বামপন্থীরা কোনও অন্যায় সমঝোতায় নেই।”

বৈঠক চলল প্রায় আড়াই ঘন্টা। মধ্যাহ্নভোজের সময় প্রায় গড়িয়ে গেল। বসু ও সুরজিৎ অন্ধ্রভবন থেকে বেরিয়ে এলেন। তখনও সেখানে অনেকেই রয়ে গেলেন। বঙ্গভবনে বসু ফিরে মধ্যাহ্নভোজন সারলেন। বিশ্রাম আর হল না। বিকেল তিনটের পর আবার বেরোলেন। আবার ফ্রন্টের নেতাদের বৈঠক। বসু এই বৈঠকে বলেন, “কংগ্রেস ফ্রন্টকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ করার চেষ্টা করছে। আস্থাভোট চলার সময় কখনই নেতৃত্ব পাল্টানো যায় না। লড়াইয়ের মাঝখানে কেউ সেনাপতি বদল করে না। ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্রন্ট সংসদে ভোটভুটির মুখোমুখি হোক। তারপর যা করা হবে ঐক্যবদ্ধভাবেই করা হবে।”

লোকসভায় আস্থাভোটে হেরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া। সভায় উপস্থিত ছিলেন ৪৫৬জন সদস্য। সরকারের পক্ষে ভোট পড়ল ১৫৮টি, বিপক্ষে ২৯২টি। কংগ্রেস ও বি. জে. পি. উভয়েই সরকারের বিপক্ষে ভোট দেয়। রাতে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে সোজা রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে শঙ্করদয়াল শর্মার হাতে তাঁর মন্ত্রীসভার পদত্যাগপত্র তুলে দেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তাঁর পনের বিশ মিনিট কথা হয়।

শুরু হয় তৃতীয় পর্ব। নতুন নেতা খোঁজার পর্ব। ১২ই এপ্রিল সকালে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়ার বাসভবনে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা আলোচনা শুরু করেন। এবার ‘জ্যোতি বসু’ প্রথমেই তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব খারিজ করে দেন। বসু আমাকে পরে বলেন “দিল্লীতে আমাকে সবাই বলছে ‘আপনি হোন, আপনি হোন’। আমি বললাম, ‘বার বার একই কথা বলছেন কেন। জানেন তো এটা সম্ভব নয়’।” চন্দ্রবাবু নাইডুর নাম উঠলে চন্দ্রবাবুও এ প্রস্তাবে সম্মত হন না। আলোচনা চলতে থাকে। ছবিটা অস্পষ্ট থেকেই যায়। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মতে পরিস্থিতি একই জায়গায় থমকে যায়। আলোচনায় অবশ্য কয়েকটি নাম উঠে আসে, যেমন, আই. কে. গুজরাল, জি. কে. মুপানার, রামবিলাস পাশোয়ান প্রমুখ। তবে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সম্ভব হয় না। রবিবার ১৩ই এপ্রিল বসুর সারাদিন কাটে তৎপরতার মধ্যে। সকাল ১০টা থেকে পার্টির পলিটব্যুরোর বৈঠক। প্রথম দফার বৈঠক বসে টানা তিনঘণ্টা, মাঝে মধ্যাহ্নভোজের সামান্য বিরতি। বঙ্গভবনে ফিরে খানিকক্ষণ বিশ্রামের পর ৬টার সময় চার বামদলের বৈঠক, তারপর সাড়ে ৭টায় ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক। দেবেগৌড়া ঐ বৈঠকে জানান যে ভোট এবং বি. জে. পি-কে ঠেকাতে যদি নতুন নেতা নির্বাচন করে সরকার গড়া যায়, তাহলে তিনি পদ ছাড়তে রাজি আছেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত জানার পর ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি ১৭ই এপ্রিল তাদের পরবর্তী বৈঠকে নেতা বদলের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এরপর জনতা দলের রাজনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক বসে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে। ইন্দ্রকুমার গুজরালকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি আছেন কি না এ প্রশ্নও এ বৈঠকে করা হয়। গুজরালকে লক্ষ্য করে লালুপ্রসাদ যাদব এক সময় বলে ওঠেন, ‘আপনি পি. এম. হওয়ার জন্য তদ্বির শুরু করে দিয়েছেন!’ জবাবে গুজরাল বলেন, “সি. পি. এম. নেতা হরকিষেণ সিং সুরজিৎ আমাকে প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। আমার কিছু করার নেই, আমি একেবারেই আগ্রহী নই।’

বসু কলকাতায় ফিরলেন ১৪ই এপ্রিল সোমবার রাত সাড়ে এগারোটায়। শরীর ভাল নয়। দিল্লীতে একমিনিট বিশ্রাম পান নি। ঠিক করেছেন ১৭তারিখ স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে আর যাবেন না, এখান থেকেই মতামত জানিয়ে দেবেন। মঙ্গলবার সারাদিন ফোনের পর ফোন—চন্দ্রবাবু নাইডু, ইন্দ্রকুমার গুজরাল, লালুপ্রসাদ ও মুলায়ম সিং যাদব প্রত্যেকেই বসুর মতামত চাইছেন, পরামর্শ চাইছেন, নিজেদের মতটাও তাঁকে জানাচ্ছেন। এদিকে কলকাতায় পৌঁছলেন প্রণব মুখার্জি, উদ্দেশ্য জ্যোতিবাবুর সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা ভবনে বসুর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হল না। দিল্লী থেকে বসুর কাছে সনিবন্ধ অনুরোধ এল ১৭ তারিখের মিটিং- এ উপস্থিত থাকার জন্য। বসু দায়িত্ব এড়াবার লোক নন। তড়িঘড়ি টিকিটের ব্যবস্থা করা হল, সন্ধ্যার উড়ানে বসু আবার দিল্লী রওনা হলেন। পরদিন বৈঠকে আলোচনা হল, কিন্তু সিদ্ধান্ত হল না। তারপরেও দফায় দফায় আলোচনা হয় কিন্তু মতৈক্য হয় না। কেউ মুপানারকে চান তো কেউ ইন্দ্রকুমার গুজরাল, রামবিলাস পাশোয়ানের নামও ওঠে। দুপুরে বঙ্গভবনে গিয়ে বসুর সঙ্গে দেখা করে আবার কথা বলেন চন্দ্ৰবাবু নাইডু। রামবিলাস পাশোয়ানও বসুর সঙ্গে দেখা করেন। আপত্তি নেই তাঁরও। ফারুক আবদুল্লাও বসুর সঙ্গে কথা বলতে আসেন। বসু বলে গিয়েছিলেন ১৮ তারিখে ফিরতে পারেন। কিন্তু বসুর অগ্রণী ভূমিকা সে সময় এমন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল যে কাজ সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত তাঁকে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা ফিরতে দিলেন না। বসু কলকাতায় ফিরলেন ২০শে এপ্রিল রবিবার রাতে। ১৯ তারিখ শনিবারেও একই চিত্র। বঙ্গভবনে তাবড় তাবড় নেতাদের নিয়ত আনাগোনা। প্রথমে দেবেগৌড়া এলেন, তারপর চিদাম্বরম, তারপরে মুলায়ম, শেষে চন্দ্রবাবু নাইডু। ‘বাসুজি’ যেন বিচক্ষণতার মূর্ত প্রতীক। সকলকেই একবার নয়, বেশ কয়েকবারই তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য তাঁর কাছে যেতেই হয়েছে। শনিবার সকালে এক সময় শেষকালে বেশ অসহায় অবস্থায় চন্দ্রবাবু নাইডু জ্যোতিবাবুকে বলেন ‘সর্বসম্মত প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না, আপনিই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিন।’ বসু স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এবার বসু ভি. পি. সিং-এর প্রস্তাবিত গুজরালের নাম নিয়ে অন্যদের সঙ্গে জোরদার আলোচনা চালান, ফলে খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়। গুজরালের নাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পায়, ফ্রন্টের পক্ষ থেকে নাইডু কেশরীর বাড়ি গিয়ে নতুন নেতা নির্বাচনের কথা তাঁকে জানিয়ে আসেন। খবরটা কানে আসামাত্র মুলায়ম বঙ্গভবনে জ্যোতিবাবুর দ্বারস্থ হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কিরণময় নন্দ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। বঙ্গভবন হয়ে ওঠে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্টি অফিসের মত। বসুর ডাকে চলে আসেন ফারুক আবদুল্লা, এ. বি. বর্ধন, সীতারাম ইয়েচুরি। লালুর সঙ্গে বৈঠক সেরে আসেন চন্দ্রবাবু নাইডু। প্ৰায় দেড় ঘন্টার বৈঠক হয়। বৈঠকের পর গুজরালকে তাঁর দক্ষিণ দিল্লীর মহারানিবাগের বাসভবন থেকে অন্ধ্রভবনে ডেকে পাঠান চন্দ্রবাবু নাইডু, সেখানে তাকে ফ্রন্টের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। শনিবার রাতে বসে যুক্তফ্রন্টের স্ট্যাণ্ডিং কমিটির বৈঠক। বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইন্দ্রকুমার গুজরালের নাম ঘোষণা করেন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবেগৌড়া।

প্রায় এক বছরের মাথায় দ্বিতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন বসু। এবারে রাজনৈতিক সংকট ছিল একেবারে দাবার ‘চেকমেট’— সর্বসম্মত প্রার্থী বাছতে ফ্রন্টের গাঁ উজাড়। মুলায়মের নামে লালু বেঁকে বসেন, গুজরালের নামে মুলায়ম খুব একটা খুশি নয়, লালুও নন, রামবিলাস পাশোয়ানের নামও লালুর কাছে অগ্রাহ্য, তামিল মানিলা কংগ্রেসের পাল্লা ভারী মুপানারের দিকে; ভি. পি. সিং আবার মুলায়মকে চান না, চান গুজরালকে। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। শনিবার সকালে বঙ্গভবন হয়ে দাঁড়ায় নাটকের মূল মঞ্চ। দেবেগৌড়া, চন্দ্রবাবু নাইডু, চিদাম্বরম, মুলায়ম প্রত্যেকেরই একটাই অনুরোধ বসুকে—’আপনিই সবসেরা প্রার্থী, আপনিই হোন প্রধানমন্ত্রী। লালু ফোন করে বসুকে তাঁর অনুরোধ জানান। বসু হলে কারো কোনও আপত্তিই নেই। ফ্রন্টের ঐক্য বজায় রাখার এই একটাই উপায়। জ্যোতিবাবু নির্বিকার। ষাট বছর ভারতের রাজনীতি করছেন। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন এখানে তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও স্থান নেই। তাঁর দল সি. পি. এম-এর সিদ্ধান্তে তাঁকে চলতেই হবে। তাঁর দল আগেই জানিয়ে দিয়েছে সরকারে তারা কোন মতেই যোগ দেবে না। এ সিদ্ধান্ত ‘পুর্নবিবেচনার’ আর প্রশ্ন ওঠে না। জ্যোতিবাবুর জবাবের পর আবার শুরু হয় নেতা খোঁজার পালা। শেষপর্যন্ত আটাত্তর বছর বয়সী প্রবীণ রাজনীতিক গুজরাল হলেন ভারতের দ্বাদশ প্রধানমন্ত্রী আর চন্দ্রবাবু নাইডু প্রস্তাব করলেন মুলায়মকে করা হোক উপ প্রধানমন্ত্রী। জ্যোতিবাবুর ঘরে এই বৈঠকের সিদ্ধান্তই শেষ পর্যন্ত ফ্রন্টের সিদ্ধান্ত বলে গৃহীত হয়। রাতে দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বসুকে টেলিফোন করে ধন্যবাদ জানান। বসু বললেন, “বঙ্গভবনে গুজরাল আমাকে ফোন করলেন রাত সাড়ে ১১টার সময়। ওরা অবশ্য ফোনটা আমায় দেয়নি। আমি শুয়ে পড়েছিলাম। পরের দিন আমি গুজরালকে বললাম মাঝরাতে ফোন করেছিলেন। উনি বললেন আমি তখনই আপনাকে প্ৰথম ধন্যবাদ জানাতে চেয়েছিলাম।”

২১শে এপ্রিল সোমবার সকালে গুজরাল রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোকহলে এক জমকালো অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ নিলেন। বসু এক ফ্যাক্স বার্তায় তাঁকে অভিনন্দন জানালেন। কিন্তু টি. এম. সি. দল ফ্রন্ট থেকে সরে দাঁড়াল। সোমবার সকালে গুজরালের শপথ শেষ হওয়ার পর ১২টা নাগাদ বসু মুপানারের ওয়েস্টার্ন কোর্টের বাড়িতে ফোন করে বলেন, ‘আমাদের ভুল বুঝবেন না, টি. এম. সি-র দায়িত্বের দপ্তরগুলি সব আগের মতই আপনাদের জন্য রাখা হয়েছে।’ এদিকে লালুপ্রসাদ যাদব মুলায়মের উপ-প্রধানমন্ত্রিত্ব মেনে নিতে পারেন না। তিনি বলেন এ ব্যাপারে ফ্রন্টে ঐক্যমত হয়নি। গত শনিবার দুপুরে বঙ্গভবনে বসুর সঙ্গে ফ্রন্টের শীর্ষনেতাদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত হওয়ার পর মুলায়ম খুশি হয়ে ফিরে যান ২ নম্বর কৃষ্ণ মেনন মার্গের সরকারি বাসভবনে, মিষ্টিমুখও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু লালুপ্রসাদ বলতে থাকেন, ক্ষমতার দুটো কেন্দ্র হয়ে গেলে সরকার চালানো সম্ভব নয়, তিনি এটা মানতে পারছেন না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থগিত থাকে।

গুজরাল যেদিন প্রথম সংসদে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গেলেন, সরাসরি কলকাতার বাড়িতে বসে দূরদর্শনে বসু সেই অনুষ্ঠান দেখলেন। বললেন “খুব ভাল হয়েছে, শিক্ষিত, সৎ, ভদ্র একজন। ফিট লোক হয়েছেন।” পরে বললেন “আমি প্রণবকে বললাম—’আপনারা এতদিন চালিয়েছেন, নরসিমহা রাও তো চালিয়েছেন পাঁচ বছর, তো কি হয়েছে, কি করেছেন কেউই তো জানে না।—আপনারা একটা কারণ বলুন, কোথায় অসুবিধা আপনাদের।—রিভিউ করুন—একটা মিনিমাম প্রোগ্রাম আছে, মতামত দিন’—উত্তরে কিছু বলে না, চুপ করে থাকে।” বসু বললেন “কো- অর্ডিনেশন ফ্লোরে হবে, ওসব কমিটি টমিটি হবে না। তাহলে সি. পি. এম সরে আসবে। দেখা যাক্ কংগ্রেস কি করে!”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *