সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

১৫. অস্য দগ্ধোদরস্যার্থে

অস্য দগ্ধোদরস্যার্থে

ত্রিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এক রাত্রিতে—

টম নাক ডাকাতে শুরু করেছে পাশের ঘরে। সুইচ টিপে টেলিভিশন বন্ধ করে দিল এলা। ক্ষিপ্রপদে ক্লজেটের দিকে এগিয়ে গেল। হয়েছে। সারি সারি ছ-টা বোতল খালি। নয়া-বিয়ারের। বিয়ার ছিল হাজার বছর আগে। দেখতে সেইরকমই। স্বাদও অনেকটা তেমনই। আসলে কিন্তু বস্তু কিছু নেই তার ভিতরে। ঝাড়া ছয় বোতল, আট বোতল পর পর গিলে না-ফেললে শিশুরও নেশা হয় না।

ছ-টা খেয়েছে টম, এক ঘণ্টা অন্তত নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকবে। এলার পক্ষে এক ঘণ্টাই যথেষ্ট। ক্লজেটের দরজা সে খুলে ফেলল। ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ আজ আর হল না দরজায়। এলা কবজায় তেল দিয়ে রেখেছে। ওই যে বিকাল বেলা বারান্দায় যখন বল লোফালুফি খেলছিল টম। ব্যায়াম বলতে ওই তো একটাই। না, আরও একটা আছে, সাঁতার। সুইমিং পুলে। পঞ্চাশটা ফ্লাটের জন্য একটা পুল। পালা করে সাঁতার দেয় ফি-রোজ আটটা করে পরিবার। ছয়-আষ্টে আটচল্লিশ হল। বাকি থাকে দুটো পরিবার। তা এমনটা এ-যাবৎ ঘটেনি যে পঞ্চাশের মধ্যে অন্তত দুটো পরিবার সাঁতারে অনিচ্ছুক নেই।

এলা ঠিক মনে করতে পারছে না, আজ টম বল লুফতেই গিয়েছিল, না সাঁতার কাটতে। পারছে না, কারণ মাথার ঠিক নেই। ঠিক নেই, কারণ দারুণ একটা উত্তেজনা পেয়ে বসেছে তাকে। কিউ স্ট্রিট ছাড়া অন্য কিছু আসছে না মাথায়। যখনই যায় ওখানে, তখনই হয় এমনি অবস্থা। কাজটা বেআইনি, কাজটা করতে হয় স্বামীর অগোচরে। এ-স্বামীটা আবার আইনকে বেজায় ডরায়, হাবা-গোবা মানুষ বলে যাকে।

কোট গায়ে চড়িয়ে কলার দিয়ে গলা ঢেকে নিল এলা। রাস্তায় ঠান্ডা হবে। হাতব্যাগটা নেবার জন্য হাত বাড়িয়েছে, পাশে ছিল গাড়ির চাবি, ঝনঝন শব্দে সেটা মেঝেতে পড়ে গেল।

ও ঘরে টম নড়ে চড়ে উঠল, জড়িত স্বরে ডাকল, ‘এলা!’

‘এই যে গো—’

‘যা-কো—?’ অর্থাৎ যাচ্ছ কোথায়?

‘এই একটু হাওয়া খাব বাইরে দাঁড়িয়ে।’

‘সিগ-সিগ।’ মানে সিগারেটের প্যাকেটটা দাও।

‘চ্যা-টু-ফো।’ অর্থাৎ চ্যানেল টুয়েন্টি-ফোর নম্বরে টেলিভিশন চালিয়ে দিয়ে যাও।

টেলিভিশন খুলে দিতেই তা থেকে হাসির একটা গররা হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘরের ভিতর। টম আবার নাক ডাকাতে শুরু করল। এলা আবার আর ওটা বন্ধ করবে না। ঘুমপাড়ানি গানের কাজ করবে টেলিভিশন।

ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে দরজা বন্ধ করল এলা, অটোমেটিক এলিভেটরের দিকে পা চালিয়ে দিল। গোড়ায় এ জিনিসটা ভারি অপছন্দ ছিল এ বাড়ির বাসিন্দাদের। এলা বলে নয়, অনেকেই এলিভেটরে না-চেপে পিছনের সিঁড়ি ব্যবহার করত, যেটা দমকল কর্মীদের জন্য সংরক্ষিত। টের পেয়ে সরকারি লোকেরা তালা বন্ধ করে দিল সে-সব সিঁড়িতে।

কেয়ারটেকারকে জিজ্ঞাসা করেছিল এলা তখন, ‘আগুন যদি লাগে?’ লোকটা জবাব দিয়েছিল, ‘আমি চাবি নিয়ে আসব তখন।’

‘তার সময় না-থাকে যদি!’

‘পুড়ে মরবে তোমরা!’ দমবার লোক নয় কেয়ারটেকার, ‘এলিভেটর বসানো হয়েছে তোমাদের জন্য। এলিভেটরকে ফাঁকি দিতে দেওয়া হবে না কাউকে। ফাঁকি দিলে ফেল পড়বে এলিভেটর কোম্পানি। একটা কোম্পানি ফেল হওয়া মানে দেশের অর্থনীতিতে চিড় খাওয়া।’

অগত্যা সেই থেকে এলিভেটর চাপছে এলা। চালক বলে কেউ নেই, যন্ত্রেই চালায়। এলা যখনই চাপে এতে, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই চাপে। আজও তাই। কী না ঘটতে পারে এর ভিতর? চলতে চলতে দুটো তলার মাঝামাঝি জায়গায় থেমে পড়তে পারে। গুন্ডা বদমাইশ যদি এতে আগে থেকে ঢুকে থাকে, নিরীহ আরোহীর টুঁটি চেপে ধরে ব্যাগটা কেড়ে নিতে পারে তার। এমনকী, ভবঘুরে ছেলের দল অকারণেই এসে তাকে দু-ঘা চড়চাপড় বসিয়ে দিয়ে যেতে পারে, স্রেফ মজা করবার জন্যই। কী বলা যাবে তাদের? করবে কী তারা? করার একটা কাজ তো চাই। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মতো মাথা যার নেই, তার জন্য স্কুলও নেই থার্ড গ্রেডের উপরে। খাও দাও, চরে বেড়াও— এই ব্যবস্থা তাদের জন্য। তা, চরবার পক্ষে তাদের অন্যতম প্রিয় স্থান হল এলিভেটরগুলি।

যাহোক, আজ এলিভেটর খালি। লবিও। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবার জন্য কেউ কোথাও নেই। ভালোই। এলা রাস্তায় নেমে গেল। শীতের ঠান্ডা হাওয়ার একটা ঝাপটা এসে এক মুহূর্তের জন্য দম বন্ধ করে দিল তার। সে মাথা নীচু করে ঢু মারল সেই কনকনে হাওয়ার তলপেটে। এগিয়ে চলল জোর কদমে।

গাড়ি বার করতে সে সাহস পায়নি। নম্বর যদি কেউ টুকে নেয়? পদযাত্রীদেরও বিধিনিষেধ অনেক মেনে চলতে হয় এ যুগে। তবু, বরাত জোর বলতে হবে, লাইসেন্স নম্বর এক একটা এখনও সেঁটে বসেনি তাদের কপালে। কালে কালে অবশ্য হবে নিশ্চয়ই।

ঠান্ডা হাওয়াটাই লোকজনকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে রাস্তা থেকে। এক আধখানা গাড়ি কদাচিৎ পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে নিঃশব্দে, কিন্তু ভিড় কোথাও নেই। কিউ স্ট্রিটে যদি থাকে? দশ নম্বর কুইয়ার মু স্ট্রিট। ঠিকানাখানা মুখস্ত তার। মরে গেলেও ভুল হবে না।

না, ভুল হবে না। কিন্তু মনে হলেও বড়ো লজ্জা করে। সে কেন পারে না অন্য লোকের মতো হতে? যা আপনা থেকে জুটছে, তাইতেই খুশি থাকতে কেন পারছে না সে?

না, কিছুতেই না। পারে না, পারছে না, পারবেও না কোনোদিন। দিন, মাস, তিন মাস, ছ-মাসও সে হয়তো প্রবৃত্তির মুখে লাগাম টেনে রাখতে পারে, কিন্তু তারপরই একদিন আচমকা একটা ঝোড়ো হাওয়া যেন এসে পড়ে কোথা থেকে। খড়কুটোর মতোই তার সংযমকে নিয়ে যায় উড়িয়ে। আগে আগে টমের নয়া বিয়ারে ঘুমের বড়িও মিশিয়ে দিতে হয়েছে এক একদিন। এখন আর হয় না। ওর ঘুমটা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

হয় না সে সব কিছু করতে, কিন্তু দরকার হলে সে তাতে এখনও দ্বিধা করবে না যে, তাও ঠিক। যদিও মানুষ এলা সে ধরনের নয়। লুকোছাপার ইতরতা ছিল না তার স্বভাবে। কিন্তু দিন দিন, ওই সর্বনাশা প্রবৃত্তির তোড়ে তার চরিত্রেরই যেন শালীনতা ভেসে যাচ্ছে। ইতর হয়ে যাচ্ছে সে। ইতর! ইতর!

এলার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। শীতে নয় কিন্তু। টম কী করবে? যদি সে কোনোদিন টের পায় এলার এই পতনের ব্যাপার? মানুষটা যে বড়ো সরল, বড়ো সাদাসিধে ওই টম! অস্বাভাবিক ঝোঁক কোনোকিছুর উপরে নেই তার। এলার মতো আচরণ যেকোনো অবস্থাতেই কেউ করতে পারে, এটা তাকে বোঝানোই যাবে না।

মনে মনে পাক খাচ্ছে নানান চিন্তা, কিন্তু পা ওদিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে কুইয়ার স্ট্রিটের দিকে। পাড়াটা নোংরা। চাঁদ উঠেছে। তার মরা আলোতে ভাঙা ভাঙা রং-চটা বাড়িগুলোকে কী কদর্যই-না দেখাচ্ছে! ইটে ধরেছে নোনা, চিমনি পড়েছে বেঁকে। ময়লা! ময়লা! গাদা গাদা ময়লা চারদিকে। জানালার কাঠামো, ডাস্টবিন, নর্দমা, ক্ষয়ে-যাওয়া সিঁড়ি— সব আচ্ছন্ন জমাট পুরু ময়লায়। একটা প্লেট ঝুলছে, এমনই এক বাড়ির দেয়ালে ‘কিউ স্ট্রিট।’

সারি সারি বাড়ি, সারি সারি দরজার নীচে চাঁপ চাঁপ অন্ধকার। একটা চাঁপ যেন নড়ছে আবার। এইবার যেন ভয় ভয় করছে এলার। যেমন ভয় ভয় করে একা এলিভেটরে হঠাৎ কোনো বেয়াড়া মস্তানকে দেখতে পেলে, যার মুখে হিংস্র হাসি, হাতে বাইসিকেলের চেন।

কিন্তু ভয় যতই করুক, ফিরে যাওয়ার তো কথাই ওঠে না! এত দূর যখন আসা গিয়েছে! আর, পরে কবে আবার সুযোগ হবে, তার ঠিক ঠিকানা নেই যখন!

আঁধারের সেই চাঁপটা আবার নড়ছে। আঁধারের ভিতর চকমকিয়ে উঠছে ছুরির ঝলকানি। এলা কোনোমতে ককিয়ে উঠল, ‘না না, আমি কোনো ইয়ে নই!’

আঁধারের ভিতর দরজাটা ঈষৎ ফাঁক ছিল না কি? তা না-হলে ওপার থেকে এ সুগন্ধটা আসে কেমন করে? যত ক্ষীণই হোক-না কেন, ও-গন্ধের সঙ্গে একবার যার পরিচয় হয়েছে, তার কাছে তো ওটা অবিস্মরণীয়! এবার সে আকুল হয়ে বলে উঠল, ‘আমায় ঢুকতে দাও। ঢুকতেই এসেছি আমি!’

একটা অল্পবয়সি ছোকরা, কুড়ির নীচেই হবে বয়স, কিন্তু যে দৃষ্টি নিয়ে এলার দিকে সে চাইছে, কী ঘেন্না মেশানো তাতে! আশ্চর্য! একই অপরাধে তারা লিপ্ত, অথচ পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে তারা কোনোমতেই পারে না।

‘তুমি দশ নম্বরে ঢুকবে? সংকেতটা কী?’ অবশেষে এল প্রশ্ন।

এলা জবাব দিল ফিসফিস করে, ‘পষ্টো কথা।’

‘ঠিক আছে।’ ছোকরা বুড়ো আঙুল বেঁকিয়ে পিছন দিকে দেখাল। নিজে সরে দাঁড়াল আঁধারের ভিতর। প্রহরী। অবশ্য, প্রহরী তো হবেই রাখতে। সতর্ক না থাকলে চলবে কেন ওদের?

দরজার ভিতরে একটা লম্বা হল, সারি সারি চিঠির বাক্স তার দেয়ালে দেয়ালে, সারি সারি ইলেকট্রিক বিল। সে জানে তিন-এর নম্বর ঘণ্টা তাকে টিপতে হবে। টেপার সঙ্গে সঙ্গেই হল ঘরের ও-মাথার বন্ধ দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চার-তলায় উঠতে লাগল। দু-ধারে দেয়ালে কালি ঝুলি, মাকড়সার জাল। গায়ের কোটে যেন ঘষা না-লাগে, এলাকে সাবধান হতে হল। চার-তলায় কোনো দরজায় কলিং বেল নেই আর। তিন-এ নম্বর দরজা একটা রয়েছে বটে, তাইতে খুট খুট শব্দ করল এলা। তিনটে ছোটো শব্দ, দুটো লম্বা। দরজাটা খুলে গেল। শিকলে বাঁধা দরজা, হাত সরিয়ে নিলেই বন্ধ হয়ে যাবে আবার।

দুটো রক্তচক্ষু উঁকি দিয়েছে ওধার থেকে, ‘কী?’

এইবার দ্বিতীয় সংকেত, ‘জো পাঠিয়েছে আমাকে।’ বলল এলা।

দরজা হাট হয়ে খুলে গেল এইবার। এলা যেন ছিটকে ঢুকে গেল ভিতরে। দরজা সঙ্গেসঙ্গে জাম হয়ে আটকে গেল।

ঘরটা বড়ো, যথাসম্ভব পরিচ্ছন্নও বটে। ছোটো ছোটো টেবিল পাতা রয়েছে। লালে সাদায় চেক-মেলানো কাপড় দিয়ে ঢাকা। টেবিলগুলোর পাশে পাশে পরিবেশকেরা ঘুরছে-ফিরছে। টেবিলের এলাকা পেরিয়ে গেলে একটা কাউন্টার, তার এপাশে অনেক টুল। কাউন্টারে সস্তা হবে মনে করে এলা সেইখানে গিয়ে একটা টুল দখল করল।

ওপাশে পরিবেশক আছে। এলার সমুখের জায়গাটুকু সে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিল। ঘরোয়া আলাপের সুরে বলল, ‘এখানে আসার পক্ষে আপনার বয়স তো কম।’

‘ভোট দেবার বয়স তো হয়েছে আমার!’

লোকটার কথায় সন্দেহের রেশ, ‘তাই না কি?’ তারপরেই বলল, ‘কী দেব?’

ঠোঁট শুকিয়ে জুড়ে আসছিল এলার। জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে থেমে থেমে বলল, ‘ধরুন যদি, এই ধরুন—’

কথা জোগায় না মুখে, সংকোচে, ভয়ে। কিন্তু সেই সুগন্ধটা আবারও আসছে। এবার আরও জোরালো, আরও লোভনীয়, জিভে জল টেনে আনার মতো। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সে এবার বলেই ফেলল, ‘একটুকরো খাঁটি রুটি। খাঁটি।’

পরিবেশকের মুখখানা যা হল, দেখবার মতো। যত রাজ্যের দুঃখ-দুশ্চিন্তায় মুষড়ে-পড়া শুকনো মুখ, ‘আবার খাঁটি মাখনও চাইবেন তো? যে মাখন পনির থেকে তৈরি হয়? গোরুর বাঁটের দুধের পনির? আর সেইসব গোরু! বুড়ি গোরু, গায়ে গন্ধ কী বিশ্রি, সারা গায়ে ময়লাই বা কত! কাদা, খড়, গোবর, মাছি ভনভন করছে—’

‘আমি খাঁটি মাখন চাই গো, খাঁটি সেই মাখন।’

লোকটা তবু বলছে, ‘বেশ ভেবেচিন্তে বলছেন তো কথাটা? বিজ্ঞাপন পড়েন-না নাকি? না পড়লেও রেডিয়ো ঘোষণা তো শুনতেই হয়! কী সব বলে, শোনেননি? অল্প দামের মাখানি, সাধারণী পুষ্টি কোম্পানির ল্যাবরেটরিতে তৈরি, নানা জিনিসের সমন্বয়ে বানানো। পরিষ্কার তো বটেই, জীবাণুমুক্তও। চিরকাল টাটকা থাকবে, ছাতা পড়বার উপায় নেই, পোকা জন্মাবার উপায় নেই। উপায় নেই কারণ, একটা জীবাণুর প্রাণধারণের মতো পুষ্টিকর কিছু নেই ওতে। তবু খেলে পেট ভরবে আপনার, খিদে পাবে না অনেকক্ষণ।’

এলার মাথা নীচু হয়ে গেল। লোকটার চোখে চোখ মিলিয়ে চাইতে পারছে না। মুখ নীচু করেই মরিয়ার মতো বলে উঠল, ‘তাহলেও খাঁটি মাখন আমি চাই, ল্যাবরেটরির মাখানি নয়। তা ছাড়া খাঁটি জ্যাম চাই। ফল আর চিনি দিয়ে তৈরি, অন্যকিছু নয়। আরক, আচার এসব কিচ্ছু না।’

‘দাম পড়বে অ-নেক!’

‘কত?’

‘খাঁটি রুটি একখানা এক-শো ডলার। এক দলা মাখন পঁচিশ ডলার আর জ্যাম দুই আউন্সের দাম ত্রিশ।’

‘ডলার আছে আমার।’ এলা পার্স বার করে তা থেকে এক-শো পঞ্চান্ন ডলারের নোট গুনে দিল, ‘কয়েক মাস ধরে জমাচ্ছি এক রাত খাব বলে।’

লোকটা ডলারগুলো তুলে নিল, কিন্তু তার পরেও দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে, তার দৃষ্টি এলার আঙুলের বিয়ের আংটির দিকে।

অবশেষে সে বলল, ‘যে তরুণী মহিলারা আসেন এখানে, বেশি আসেন না অবশ্য, তাঁদের আমি বোঝাতে যাই না প্রায়ই। কিন্তু আপনি বিবাহিতা, দায়িত্বের জীবন আপনার। তা ছাড়া, বয়সও বড্ড অল্প। আপনার কী যে করা উচিত এই মুহূর্তে, জানেন তো? ডলারগুলো ফেরত নিন আমার কাছ থেকে। নিয়ে কালবিলম্ব না-করে পালিয়ে যান এখান থেকে। বাড়ি চলে যান, যেখানে আপনার স্বামী রয়েছেন। দু-জনে মিলে সাধারণী পুষ্টি কোম্পানির একপ্রস্থ খাবার গরম করে নিয়ে খেতে বসুন। টিভি ডিনার যার নাম। নাইলনের মাংস, তুলোর রুটি, জল বার-করা আলু, রাসায়নিক সবজি। কী বলেন?’

‘না।’ এলার কথা এবার স্পষ্ট।

লোকটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল, ‘রুটি চাইছেন, খাঁটি রুটি। কী আছে ওতে, জানেন তো? খাঁটি ময়দা। মাটিতে একরকম আগাছা জন্মায়, তার নাম গম। তারই ফল তুলে নিয়ে দু-খানা নোংরা পাথরের মধ্যে ফেলে পেষা হয় তা। মাটিতে গজায় গম। ভেবে দেখুন, কী নোংরা সেই মাটি। মানুষ তো বটেই— জানোয়ারেরাও পায়ে দলে যায় সেই মাটি। গম জন্মায় তাতেই, তাও কি আবার খেতে আছে? আপনি কখনো খেয়েছেন সে চিজ? না, এইবারই প্রথম?’

হঠাৎ সে থেমে গেল। এলার পিছনে আর একজন এসে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশককে থামতে দেখে এলাও পিছনপানে তাকিয়েছে। নতুন লোকটা বেঁটে, মোটা, ট্যারা, মুখে ভাবলেশের চিহ্ন নেই।

‘উপদেশ দিচ্ছ আবার মার্ভিন? ওইজন্যই কি তোমায় মাইনে দিই আমি? তরুণী ভদ্রমহিলার ডলারগুলি নিয়ে বাক্সে তোলো, আর তিনি যা খেতে চান, তা এনে দাও। খদ্দেরদের চরিত্রশোধনের চেষ্টা যদি আর কখনো করতে দেখি তোমায়—’

মালিক পিঠখানা চাপড়ে দিল এলার। এলার সারা গা ঘিনঘিন করে উঠল সে স্পর্শে। কিন্তু তা নিয়ে ভাববার সময় আর কোথায়? ঠিক তার সমুখেই ওই যে সেইসব আকাঙ্ক্ষিত বস্তু, খাঁটি রুটি একখানা। উনুন থেকে গরম বেরিয়ে এল এইমাত্র। মুখে দিলে কুড়মুড় কুড়মুড়, তারপরই গলে জল। পাকা শস্য, উজ্জ্বল রোদ আর স্নিগ্ধ বর্ষণের পরশ ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে আছে রুটিতে।

শুধু রুটি নাকি? খাঁটি মাখন তাতে মাখানো, সোনালি মাখন, গলে যেতে যেতেও যাচ্ছে না, ক্লেভার পাতার গন্ধে মনোহারি। আর ওই জ্যাম—

জ্যাম? রেডিয়োতে সাধারণী পুষ্টি কোম্পানির বিজ্ঞাপন সে শুনেছে। বাদামের খোসার সঙ্গে পুরোনো জুতোর শুকতলি মিশিয়ে সে-জ্যাম রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। জীবাণুমুক্ত হোক আর যা-খুশি তাই হোক, খেতে তা এমন সুস্বাদু নয়।

‘আর একখানা রুটি—’ অর্ডার হাঁকল এলা। সে যেন মরিয়া আজ।

আর একজন এসে বলল পাশের টুলে, ‘রাং-এর মাংস এক টুকরো, ভালো করে ঝলসানো।’

‘তার সঙ্গে আর কিছু?’ পরিবেশক এবার আর বক্তৃতা করে না।

‘খাঁটি আলু তার সঙ্গে ফরাসি কায়দায় ভাজা।’

‘দাম জানেন তো? দুই হাজার ডলার পড়বে।’

‘ঠিক হ্যায়।’

এলা থ মেরে গিয়েছে। একবার না-তাকিয়ে পারল না ওর দিকে। আর তাকিয়েই কেমন আঁতকে উঠল। এ লোককে কেমন চেনা চেনা মনে হয় যেন!

সে আঁতকানো ভাবটা ধরা পড়ে গিয়েছে আগন্তুকের চোখে, সে মোলায়েম সুরে কথা শুরু করল, ‘চোরে চোরে কী যেন সম্পর্ক হয়? আপনি আমি একই পাপের পাপী যখন, আসুন আলাপ করতে করতে খাওয়া যাক। আপনি নিরামিষের ভক্ত বুঝি? খাঁটি মাংস কিন্তু খু-উ-ব ভালো জিনিস। খেতেও অপূর্ব, পুষ্টির দিক দিয়েও অতুলনীয়!’

‘নিরামিষ খাচ্ছি, নিরামিষের ভক্ত বলে নয়। আমিষের দক্ষিণা হাতে নেই বলে—’ শুকনো হাসি হেসে জবাব দিল এলা। সেইমাত্র আলু-মাংসের প্লেটখানা সমুখে রেখে গিয়েছে পরিবেশক। তার ধোঁয়ার গন্ধেই এলার পাগল হবার জোগাড়।

‘ওঃ, এই কথা?’ অত্যন্ত অমায়িকভাবে আগন্তুক বলল, ‘আসুন তাহলে, এই একখানা স্টিকই বখরায় খাওয়া যাক। পরিমাণে কম হলেও আনন্দ হবে বেশি।’

এলা, কী যে তার হয়েছে— এলা আপত্তি করতে পারল না। নিজের আধখানা স্টিক থেকে বড়ো এক টুকরো কেটে নিয়ে মুখে পুরল। ধন্যবাদ? দিয়েছিল বোধ হয় একটা। কিন্তু না-দিয়ে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

হঠাৎ নীচে একটা চাপা গোলমাল—

মালিক হুড়মুড় করে এসে পড়ল, ‘পুলিশ এসেছে। তবে আপনারা বসে থাকুন, আমি সব ম্যানেজ করে দিচ্ছি।’

পরিবেশকেরা বিদ্যুৎবেগে খাবারের সব প্লেট লুকিয়ে ফেলল। টেবিলে টেবিলে দেখা দিল প্যাকেট প্যাকেট তাস। হোটেল চোখের নিমেষে জুয়ার আড্ডায় পরিণত হল। ত্রিংশ শতাব্দীতে জুয়া নিষিদ্ধ খেলা নয় এদেশে।

কিন্তু আগন্তুক আর দাঁড়াল না, ‘পুলিশের সঙ্গে দেখা হওয়া চলবে না আমার। আমায় ওরা খুঁজে বেড়াচ্ছে কয়েক বছর থেকে।’

এলা বলল, ‘আমিও সরে পড়তে পারলে বাঁচি।’ মাংসের টুকরো তখনও তার মুখে। ফেলতে মন সরছে না।

আগন্তুকের সঙ্গে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে, পুলিশের দেখা গেল না কোথাও, যদিও গোলমাল তখনও চলছে আড়ালে আড়ালে।

কুইয়ার স্ট্রিট ধরে দুই পা এগুতেই একখানা গাড়ি। দাঁড়িয়ে আছে আলো নিবিয়ে। এলা চমকে উঠল, ‘পুলিশের গাড়ি না?’ জিজ্ঞাসা করল সাথিকে।

সাথি খপ করে এলার হাত চেপে ধরল, ‘হ্যাঁ, ওটা পুলিশেরই গাড়ি এবং আমিও পুলিশ। অনেকদিন ঘুরছি আপনার পিছনে। আপনি সরকারি খাবার পছন্দ করেন না, সুযোগ পেলেই বে-আইনি খাবার খান, খাঁটি রুটি, মাখন, মাংস, এ সন্দেহ আমাদের বহুদিন থেকেই। আজ হাতেনাতে ধরেছি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে আপনাদের মতো লোকের দ্বারা। এর সাজা না-দিলে চলে না।’

‘কী সাজা?’ হয়তো একটা রাত আটকে রাখবে। এই আশা এলার মনে। জবাব এল, ‘সাজা? ঠান্ডি গারদ। বিশ বছর পর্যন্তও হতে পারে তা।’