সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

১৪. রোবট বন্ধুর মৃত্যু

রোবট বন্ধুর মৃত্যু

দোলনা দুটো গদি মোড়া। আরামে হেলান দিয়ে বসে বেইলি আর ক্রোম ডায়ালটাকে লক্ষ করছে। মাটি ছুঁই ছুঁই করছে তাদের সন্ধানী বিমান। আর কয়েক ফুট নামলেই ওই যে লালচে বাদামি অধিত্যকাটার পাথুরে পিঠ— ক্রোডস-সাত এটা।

কী হয় কী হয়! চোখ-মুখ টান টান ওদের। নিরাপত্তার এত নিকটে এসেও এক্ষুনি হয়তো মারা পড়তে পারে ওরা, যদি কাঁটায় কাঁটায় ঠিকভাবে নামতে না-পারে বিমান। অনেক ফাঁড়াই ওরা কাটিয়ে এসেছে, তা ঠিক। তবু আসন্নটাও তুচ্ছ করবার মতো নয়।

যাহোক, একটামাত্র ধাক্কার উপর দিয়েই এ যাত্রায় কেটে গেল বিপদটা। চারটে আলোর রং পালটে গেল। খুটখাট করে আঙুলের ঠোকরে এক লাইন সুইচ উলটে দিল বেইলি। দু-জনের এই দলটার ওই-ই দলপতি, কারণ চাকরির বয়স ওর কয়েক মাস বেশি। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ও এলিয়ে পড়ল আসনে। কপালে ওর ফোঁটা ফোঁটা ঘাম।

ক্রোম বত্রিশটা দাঁত বার করে মনের আবেগ এককথায় প্রকাশ করে দিল, ‘মার দিয়া কেল্লা!’

বেইলি দাঁত বার করল না, ‘কো-ও-নো রকমে আর কী! ওপি-তে যদি পৌঁছোতে পারি আবার, শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। কার দৌলতে এ ভোগান্তি হল আমাদের, বুঝি আগে একবার। সরষে ফুল দেখাব বাছাধনকে।’

ক্রোম পকেট থেকে চুরুট বার করল। এই মুহূর্তে বেইলির ওতে রুচি নেই দেখে নিজেই ধরাল একটা, আর এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ধারণা তাহলে এই যে, জ্বালানি কম দিয়েছিল ওরা?’

‘আবার কী?’ বেইলি রেগে উঠছে ক্রমশ।

‘ওই ইঞ্জিনিয়ারটা! র‌্যামিরেজ! হিসাব করে কাজ করা ওর ধাতে নেই। ওঠো হে কার্ট! রেডিয়োটা ধরো, ওদের নাগাল পাও কিনা দেখো! আমাদের হাল বাতাও ওপি-কে।’

ওপি মানে হল ওপেন হাইমার। আন্তর্নক্ষত্র লাইনের সেরা বিমানদের অন্যতম। ক্রোডস গ্রহপুঞ্জে ঘোরাফেরা করে তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এই ক্ষুদে সন্ধানী প্লেনটাকে সেই ওপি-ই পাঠিয়েছিল। মাঝখান থেকে ঘটে গেল এই অনর্থ। জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার ফলে ওদের নেমে পড়তে হল ক্রোডস-সাতে।

জানালা খুলে বেইলি তাকাচ্ছে বাইরে, ‘ওহে, গ্রহটা তো সুন্দর দেখছি! পাঁচ কোটি বছর আগে পৃথিবী যেমনটা ছিল।’

ক্রোম ওদিকে রেডিয়োর চেয়ারে গিয়ে বসেছে। একটা সুইচ টিপতেই চড়চড় শব্দ বেরুল স্বরবর্ধক যন্ত্র থেকে।

বেইলি তাকিয়ে আছে, তবলা বাজাচ্ছে জানালার পাল্লায়, মেজাজ চড়ে উঠছে ডিগ্রিতে ডিগ্রিতে। চড়বার কারণ আছে। দক্ষ লোক বলে ওর সুনাম ছিল, এই দুর্ঘটনাটার জন্য সেটা মারা পড়বে হয়তো, ‘কী হে? এখনও যে সাড়া নেই? হল কী?’

ক্রোম দু-হাত উলটে দিয়ে বলল, ‘কী জানি!’

‘তোমার সংকেতটা ঢুকছে তো ঠিক?’

ছোট্ট একটা সুইচ টিপে দিয়ে ক্রোম বলল, ‘ওই, শোনো।’

সংকেতটা রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল, সেটা বাজতে লাগল বার বার।

‘ঢুকেছে, তা বুঝলাম। কিন্তু ওদিক দিয়ে বেরুচ্ছে কি?’ খেঁকিয়ে ওঠে বেইলি।

ক্রোম ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে পারত। তা হারাল না, ‘শোনো, সংকেত-টংকেত শিকেয় তুলে রেখে আমার নিজস্ব রাসভ রাগিণীতে আমি ডাকছি ওদের।’

মাইকের একটা নল খুলে নিয়ে সে মুখে লাগাল, এক্স-দুই, ওপেন হাইমারকে ডাকছি। এক্স-দুই, ওপেন হাইমারকে ডাকছি। ফাইভ-থ্রি-সেভন, সিক্স-ট্যু-ওয়ান, ফোর-সেভেন-এইট। ক্রোডস-সেভেন, আমরা ক্রোডস-সেভেনে নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছি—’

বার বার তিন বার এই মন্তর আউড়ে গেল ক্রোম, তারপর চুপ করে শুনতে লাগল কোনো সাড়া কোনো দিক থেকে আসে কিনা। শোনা যাচ্ছে, শুধু স্বরবর্ধকের পটপট শব্দ। ক্রোমের লাল মুখে দুর্ভাবনার চিহ্ন। আবার আবৃত্তি ওই একই মন্তরের। আবারও প্রতীক্ষা। নিষ্ফল প্রতীক্ষা।

‘কই, কিছু না।’ বেইলি হাঁ করে তাকিয়ে আছে স্বরবর্ধকের দিকে। শুনছে তার পটপটানি। ‘যন্তরটা বেগড়ায়নি তো হে?’ শেষকালে প্রশ্ন করল সে।

এবার ক্রোম রেগে উঠল, ‘বেগড়াবে কেন? ওপি-র বড়ো ইঞ্জিনিয়ারের হাত তো পড়ে না এতে, বেগড়াবার কোনো উপায় নেই। খুলে দেখাব?’

আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল বেইলি, ‘এসো, খেয়ে নিই আগে।’

তিন ঘণ্টা বাদে। রেডিয়ো খুলেও তার ভিতর গলদ কিছু আবিষ্কার করা যায়নি। বেইলি বেরিয়ে গিয়েছে হাওয়ার আর্দ্রতা পরীক্ষা করবার মতলবে। ক্রোমও একটা বিশেষ সুইচ টিপে দিয়ে বাইরে চলে এল বেইলির কাজে যোগ দেবার জন্য। ওইটি টেপার ফলে এখন ক্রমাগত সংকেত বাজতেই থাকবে রেডিয়ো থেকে থেকে, ‘এক্স-দুই— ফাইভ-থ্রি-সেভেন—’

বেইলি বলল, ‘যতটা মিল পৃথিবীর সঙ্গে থাকা সম্ভব, তা আছে। কত্তা খুশি হবেন।’

‘খুশি হওয়ার সুযোগ পেলে তবে তো?’ বলল ক্রোম, ‘আমরা যে এইখানে এসে পড়েছি তা তো কেউ জানেই না। এক্স-দুইতে খাবার যা আছে, তাতে এক হপ্তা আন্দাজ চলতে পারে। তারপর ওই মনোরম প্রান্তরে গিয়ে গোরুর মতো নিজের খাদ্য নিজে জোগাড় করে নিতে হবে আমাদের। কয়েক ঘণ্টা আগেও আমার বেশ অনুসন্ধিৎসা ছিল ক্রোডস গ্রহপুঞ্জের জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধে, কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে সাফ কথা কই দোস্ত, আমার একমাত্র জানবার বিষয় হল এই যে, অষ্টম দিনের দিন আমার ডিনারটা আসছে কোথা থেকে। দেখি, তোমার হাতের ওই পাঁজিখানা দাও তো!’

কথা বলতে বলতে ওরা ভিতরে এসে বসেছে আবার।

বিশাল কলেবরের পাঁজিটা বেইলির হাত থেকে ক্রোমের হাতে চালান হয়ে এল। পাতা ওলটাতে শুরু করেই সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহে, মাঝে মাঝে এই যে সবুজ তারার মার্কা, এগুলো কী বলো তো! আমি ছাই ভুলে গেছি।’

‘ও-মার্কার মানে হল এই যে, খবরটা পাঁচ-শো বছর আগেকার।’

‘ব-টে, ব-টে!’ বেইলির দিকে এক মিনিট হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকে ক্রোম অবশেষে মন্তব্য করল, ‘এইবার যেন মনে পড়ছে একটু একটু। পাঁচ-শো বছর আগেকার পৃথিবীর মানুষও তাহলে এ অঞ্চলে এসেছিল।’

আবার সে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল পাঁজির পাতায়। ‘পঁচিশ ঘণ্টায় দিন। কক্ষ ঈষৎ হেলানো। দুটো চাঁদ। আরে এ কী? চার চারটে ”আই’ অক্ষর। নীচে আবার লাইন টানা।’

আস্তে আস্তে ক্রোমের মুখখানা কালো হয়ে আসছে, ‘ওয়ালেস কী যেন বলছিল সেদিন।’

বইখানা নামিয়ে রেখে সে আবার হতভম্বের মতো তাকাল বেইলির দিকে।

‘হল কী?’ তার ভাবগতিক দেখে অস্বস্তি লাগছে বেইলির।

‘চার আইয়ের নীচে লাইন, ওর মানে আয়োনোস্ফিয়ার। আবহাওয়ার ঘনত্ব এখানে এত বেশি যে, আমাদের এই রেডিয়োর সংকেত তার ভিতর দিয়ে চলাচল করতে পারবে না। এ স্তরের বিদ্যুৎতরঙ্গ ভেদ করা এসব যন্ত্রপাতির কর্ম নয়। চাই আরও শক্তিমান গিয়ার।’

‘তাহলে তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে যে হারিয়ে গেছি আমরা। ওপি-র সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই আমাদের।’ খোলাখুলি কথা বলাই অভ্যাস বেইলির।

হারিয়েই যাক আর যাই হোক, দুটো সমর্থ পুরুষের পক্ষে বসে বসে হা-হুতাশ করা একান্ত লজ্জার ব্যাপার। তারা বেরিয়ে পড়ল চারদিকটা ঘুরে-ফিরে দেখবার জন্য।

সত্যিই মনোরম জায়গা এই ক্রোডস-সাত। হলদে রং সূর্যটার তেজ আছে বেশ। অধিত্যকার বাদামি পাথর ঝকমক করছে তার আলোতে। দু-পাশে নীচু উপত্যকা, তাতে গাছ লতাপাতার অভাব নেই। আর সে সবই পৃথিবীর উদ্ভিদের সগোত্র। নদীর কুলকুল শব্দও কানে আসে যেন। আর একটা হ্রদ তো ওই অদূরেই দেখা যায়। ভিজে বালির সৈকত জলের ধার থেকে উঠে এসে অধিত্যকার পাদমূলে বিশ্রাম নিয়েছে। পাহাড় থেকে নেমে এসে ওই সৈকত ধরেই হাঁটছে দু-জন। একটা নদী এসে কলকল্লোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে হ্রদের বুকে। কথা তারা কমই কইছে। ক্রোম ভাবছে, দুর্বল রেডিয়ো নিয়ে আয়োনোস্ফিয়ারের এ-স্তরে ওঠা তার উচিত হয়নি। কিন্তু বড়ো রেডিয়ো তো তোলাও যেত না এক্স-দুইয়ে। এই প্লেনগুলো এত ছোটো—

বেইলি ভাবছে, যত অযোগ্য লোকের পাল্লায় পড়ে তার আজ এমন হাড়ির হাল! প্রথমত, ওই র‌্যামিরেজটা। জ্বালানি কম দিয়ে রওনা করে দিল মৃত্যুর মুখে। দ্বিতীয়টা এই ক্রোমটা। কোন স্ফিয়ারে প্লেন নিয়ে যাচ্ছে, সে স্তরের উপযোগী রেডিয়ো সঙ্গে আছে কিনা, খোঁজ নিল না একবার। বিড়ম্বনা আর কী!

একটা পাথরের মাথায় বসে ছিল ওরা। ‘প্রায় বাড়িরই মতো।’ বলল ক্রোম।

‘তা ঠিক।’ সংক্ষেপে জবাব দিল বেইলি।

‘অত গুম হয়ে কী ভাবছ? র‌্যামিরেজকে শিক্ষা দেওয়ার কথা?’

‘আলবত! একবার ফিরি তো আগে।’

‘ফিরতে পারো যদি, তবে তো?’

‘অবশ্যই পারব। ওরা খুঁজবে না আমাদের?’

‘নিশ্চয় খুঁজবে। সন্দেহ শুধু এই যে, আমরা জ্যান্ত থাকতে থাকতে ওরা হয়তো খুঁজে পাবে না আমাদের। এটা ক্রোডস-সাত। ওরা হয়তো প্রথমে যাবে এক নম্বর ক্রোডসে, তারপরে দুই নম্বরে, এইভাবে ওরা সাত পর্যন্ত আসতে আসতে আমরা যে এদিকে অক্কা পাব না, এর নিশ্চয়তা কী?’

‘তা ব-টে—’

‘তবে মন্দের মধ্যে ভালো বলতে হবে, জায়গাটা সুন্দর। বরাত খারাপ হলে একটা বরফের দেশেও নেমে পড়তে পারতাম।’

একটা ছোট্ট সরীসৃপ এসে ক্রোমের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ক্রোম লক্ষ করল, তার পায়ের পাতা চ্যাপটা, আর চওড়া! জলচর নাকি?

‘জলের নমুনা নেওয়া যাক খানিকটা।’ বলল ক্রোম, ‘হয়তো একদিন খেতে হবে এই জলই।’

ফ্লাস্ক ভরে জল নিয়েছে ক্রোম, হেঁটে চলেছে আবার সৈকত ভেঙে, পাহাড়ের পাদদেশ ঘেঁষে ঘেঁষে। এইবার পাহাড়টা মোড় খেয়ে দূরে সরে গেল। সৈকতের উপরে এখানে ছোটো ছোটো ঝোপঝাড়। দ্বিতীয় একটা ছোটো নদী। বেইলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সেই নদীর খাতের দিকে।

তার মনে কী হচ্ছে বুঝতে বাকি নেই ক্রোমের। সে বলে উঠল, ‘পাঁজি কিন্তু বলছে, এসব গ্রহে মানবজাতীয় প্রাণী নেই কোনোরকম।’

‘না-থাকে যদি, নদীর ধার অমন সরলরেখার মতো সোজা হয় কী করে?’

উত্তর খুঁজে না-পেয়ে ওরা নদীর কূল ধরে ধরে উজানে হাঁটতে লাগল। কী তোড় জলের! ঘূর্ণিও মাঝে মাঝে। সবই স্বাভাবিক ঠেকতে পারত, যদি-না পাড় দুটো কাটা খালের মতো সোজা হত। হাঁটতে হাঁটতে ওরা আবার অধিত্যকার নীচে এসে পড়েছে। পাহাড়ের গায়ে জলপ্রপাত একটা, ‘চলো, উপরে উঠে দেখি।’ বলল বেইলি।

পাহাড়ের গায়ে গায়ে দেদার পাথরে চাঁই। তাদেরই উপরে পা ফেলে ফেলে উঠছে ওরা। নদী বয়ে যাচ্ছে প্রখর স্রোতে। তার উপর দিয়ে দিয়ে সুঁড়ি পথ একটা, পায়ের তলায় নিরেট পাথর। পথের অন্যপাশে খাড়া পাহাড় উঠে গিয়েছে অধিত্যকার মাথা পর্যন্ত। ‘মানুষজাতীয় কিছু যে ছিল, তার প্রমাণ পাচ্ছি না।’ বলল ক্রোম, ‘নদীর পাড় হয়তো প্রকৃতির খেয়ালেই অমন সরলরেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘কিন্তু এই পথটা?’ বেইলি পা ঠুকল পথের পাথরে, ‘পথটা যদিও-বা প্রকৃতির খেয়ালে পয়দা হয়ে থাকে, এই গাঁইতির দাগগুলো নিশ্চয়ই মানুষের হাতের!’

‘মানুষ বা দানব প্রকাণ্ড কিছু, তাতে ভুল নেই।’ বলে ক্রোম কোমর থেকে পিস্তল খুলে হাতে নিল।

দু-জনই খুব সতর্ক এখন। পায়ে পায়ে এগুচ্ছে। পাথরের উপরে পরের পর দাগ এখনও দেখা যাচ্ছে। ডাইনে নদী অনেক নীচে, বাঁয়ে পাহাড়ের গা। হঠাৎ সেই পাহাড়ের গায়ে একটা দরজা দেখা গেল। ‘গুহা যে!’

‘জন্তু-জানোয়ারের গুহা নয়।’ বলল বেইলি, ‘গুহার দেয়াল পালিশ করবার জন্য কোনো জানোয়ার অমন মেহনত করে না।’ বাইরে দাঁড়িয়েই সে গুহাপ্রাচীরের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল ক্রোমের।

ঠিক দরজা বরাবর দেয়ালটাই চোখে পড়ে। দুই পাশে বেশ অন্ধকার, গুহার ভিতরে। কী জানি কী চিজ ওত পেতে আছে সেখানে, তা কে বলবে? ক্রোম উলটোপালটা পাথর ছুড়তে লাগল সেই অন্ধকার লক্ষ করে। কেউ না। কিছু না।

এইবার টর্চের আলো বাগিয়ে ধরে ওরা ভিতরে ঢুকল।

ওই যে! একসঙ্গেই দু-জনের চোখে পড়ল জিনিসটা। ইস্পাতের ছোট্ট টেবিল একটা রয়েছে গুহার মেঝেতে। তার পাশে খাটিয়াও একখানা। খাটিয়ার উপরে যা যা ছড়িয়ে আছে, তাকে বিছানারই জীর্ণ ছিন্ন টুকরো বলে ধারণা করে নিতে হয়। আসবাব আরও কিছু কিছু রয়েছে, কিন্তু সেসব খুঁটিয়ে দেখার কথা মনে হল না ওদের। দৃষ্টি ওদের নিবদ্ধ হয়েছে একটা কঙ্কালের উপরে, বিছানায় বসে টেবিলের উপরে সেটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।

নিকটে এসে তারা মনোযোগ দিয়ে দেখল। মানুষেরই কঙ্কাল, সন্দেহ নেই। কিন্তু কত কালের পুরোনো, কে জানে। হাড়গুলো সাদা হটহট করছে, চাঁছা, ছোলা, পরিষ্কার।

‘কে ছিল লোকটা?’ ফিসফিস করছে ক্রোম। টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে আবিষ্কার করছে ইস্পাতের নানা ছোটোখাটো আসবাব, বৈমানিকের পোশাক একপ্রস্থ। তাও হালকা ইস্পাতের পাতের, তবে একান্ত জীর্ণ দশা তারও। ‘আমাদেরও এই দশাই হবে কিনা, তা কে বলবে? বলল সে অবশেষে।

‘মরতে একদিন হবেই তো!’ দার্শনিকসুলভ মন্তব্য করতে গিয়েও হঠাৎ চমকে উঠল বেইলি, ‘আরে, একী?’ আলমারির তাকে একখানা বই। উপরের জমাট ধুলো সাবধানে ঝেড়ে-ঝুড়ে মলাটের উপরকার ছাপা যতই তা অস্পষ্ট হয়ে থাকুক, কোনোরকমে পড়ে ফেলল সে।

পড়ল, ‘থান্ডারার এব লগ। ডিসেম্বর ২৮২৭।’

‘কী? কোন সাল?’

‘দুই হাজার আট-শো সাতাশ, প্রায় তিন-শো বছর আগেকার ব্যাপার।’

ক্রোম ঘনিয়ে এল কাছে, ‘খোলো তো!’

কিন্তু হায়! খুলতে গিয়েই দেখা গেল, ভিতরের কাগজ আর কাগজ নেই। ধুলো! ধুলো হয়ে গিয়েছে সব। একরাশ ধুলো ছড়িয়ে পড়ল বেইলির উপর। ক্রোম সশব্দে আপশোস করে উঠল, ‘সব আশা ধূলিসাৎ! থান্ডারার সম্পর্কে কিছু আর জানবার আশা রইল না।’

‘নাঃ!’ বেইলির নৈরাশ্যও কম নয়, ‘কে ইনি, কেন এসে নেমেছিলেন এই ক্রোডস-সাতে, কী ছিল তাঁর বিমানে— কিছুই আর জানা যাবে না। তবে হ্যাঁ, নিজেরা গোয়েন্দাগিরি করতে পারি অবশ্য খানিকটা। তাই করা যাক, এসো।’

‘কিন্তু মলাটের উপরে আরও কী যেন লেখা রয়েছে না?’ বলল ক্রোম।

এ লেখাটা আবার এমন ফিকে হয়ে গিয়েছে যে পড়বার জন্য গুহার বাইরের আলোতে মলাটখানা নিয়ে যেতে হল। অনেক গবেষণার ফলে ওর পাঠোদ্ধার হল যখন, বেইলি পড়ল, ‘জি হল্যান্ড, ক্যাপ্টেন—’

‘তিন-শো বছর আগের ক্যাপ্টেন হল্যান্ড। খুঁজলে নামটা অবশ্যই পাওয়া যাবে বিমান দপ্তরের পুরোনো নথিপত্রে।’

ক্রোম মাথা নেড়ে বলল, ‘সে পরের কথা। ফিরে চলো এখন, রেডিয়োতে কিছু ধরা পড়ল কিনা, দেখা যাক।’ আপশোসের আর শেষ নেই তার।

‘একটা বড়ো জাহাজে যদি আসতাম আর ব্যাটারির বদলে জেনারেটর যদি থাকত বিমানে।’

বেরিয়ে পড়বার আগে তবু আর একবার গুহাটা পরীক্ষা করে দেখা যাক, নতুন কিছু তথ্য তাতে মিলে যেতেও পারে। দু-জনেই দেয়ালের উপর টর্চ ফেলতে লাগল আবার। মেহনতের পুরস্কারও মিলল হাতে হাতেই! বাটালির মতো কোনো জিনিস দিয়ে দেয়ালের গায়ে কেটে কেটে লেখা হয়েছে, ‘আর বেশিদিন বাঁচব না। ফ্রাইডে না থাকলে কবে পাগল হয়ে যেতাম। অনেক দামি মাল নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে অর্থাৎ রোবটের চালানটা—’

এ যে অনেকগুলো সমস্যা একসাথে! ফ্রাইডে কে বা কী? বিমানসঙ্গী? উঁহু, বিমানসঙ্গীর ওরকম নাম হয় না। চাকর? মান্ধাতার আমলের রবিনসন ক্রুসো বইয়ের কথা মনে পড়ে। তাতে এক ফ্রাইডে চাকরের উল্লেখ আছে যেন। অথবা কুকুর? আর এই রোবটের চালান জিনিসটা কী? থান্ডারার কি অনেক অনেক রোবট বিমানে বোঝাই নিয়ে মহাকাশ যাত্রা করেছিল? কেন?

অনেক খোঁজখবরের দরকার রয়েছে দেখা যায়। পরে আসা যাবে আবার। আগে একবার রেডিয়োটার হাল দেখে আসা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

কিন্তু না, নতুন কিছু খবর নেই রেডিয়োর। মরে পড়ে আছে আগের মতো। গিয়ার পালটাতে না পারলে এ বস্তুর থেকে এখানে আর কোনো কাজ পাওয়া যাবে না।

সারাদিন আর বেরুল না ওরা। পালা করে করে ঘুমিয়ে নিল সারাদিন। রাতটা ভোর হতে যা দেরি, প্রাতরাশ সেরে নিয়েই ওরা রওনা হয়ে পড়ল আবিষ্কারের অভিযানে। ফ্রাইডের খোঁজ নিতে হবে। কী সে? কে সে? কী হল তার ভাগ্যে? মানুষ হোক, জন্তু হোক, তার কঙ্কালটা তো খুঁজে না পাওয়ার কোনো কারণ নেই!

সন্ধান শুরু হবে গুহা থেকেই। হঠাৎ কোনো প্রেরণা পাওয়া যেতে পারে সেখানে।

ওরা গুহায় গিয়ে পৌঁছোল, সঙ্গে সঙ্গে যা পেয়ে গেল, তা প্রেরণার চাইতে অনেক বেশি। দরজার বাইরে থেকেই ওরা শুনতে পেল, ভিতরে কে কথা বলছে। আওয়াজটা ধাতুপাত্রের বাজনার মতো খনখন করছে বটে, কিন্তু কথাটা নিশ্চিত মানুষের ভাষায়—

কে একজন ডাকছে, ‘মালিক! মালিক! মালিক!’

কী এ? কে এ? তিন-শো বছর আগেকার ফ্রাইডে কিন্তু আজও বেঁচে থাকতে পারে না! ভূত? এই একত্রিংশ শতাব্দীর অতি বৈজ্ঞানিক যুগে আজ ভূত দেখতে হবে মহাকাশযাত্রী বৈমানিকদের?

দু-জনেই একসাথে টর্চের আলো ফেলল। উজ্জ্বল একটা মূর্তি, ঠিক মানুষের আকার। রোবট! রোবট ওদের কাছে নতুন জিনিস নয়, চিনতে এক মুহূর্তও দেরি হল না। উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ধাতব দেহের উপরে টর্চের আলো পড়েছে বলে।

রোবট যখন, হুকুম করা চলে। ‘এদিকে এসো।’ ডাকল বেইলি।

ও এসে দরজায় দাঁড়াল। সাড়ে পাঁচ-ফুট হবে মাথায়। আর মাথাটা দেখতে ডিমের আকারের। অর্থাৎ মস্তিষ্ক ওর দস্তুরমতো উন্নত স্তরের। গায়ের ধাতুফলকে খোদাই করা রয়েছে, ‘ইউ-ই রোবট— বার্মিংহ্যাম— ইংল্যান্ড। ক্রমিক নং ৪৩১২৩। এমএ।’

‘এমএ কী?’ জিজ্ঞাসা করল বেইলি।

রোবটই জবাব দিল, ‘মালটিপল অ্যাপটিচুড। অশেষ নৈপুণ্যের অধিকারী! না-করতে পারি, এমন কাজ নেই।’

‘কী কাজ করতে থান্ডারারের?’

‘থান্ডারার যতদিন ছিল, গুদোমে বসে থাকতাম। আমি একা নই, আরও দু-শো রোবট। থান্ডারার বেরিয়েছিল গ্রহে গ্রহে এক একটা রোবট পৌঁছে দেবার জন্য। মাঝপথে ইঞ্জিন ফেটে গেল। ওইখানে নামতে গিয়ে পাহাড়ে খেল ধাক্কা। বিমান ধ্বংস হল, ক্যাপ্টেন হল্যান্ড ছাড়া আর সবাই মারা পড়ল।’

কথা বলতে বলতে হঠাৎই কিন্তু তার গলা বন্ধ হয়ে এল। একটুখানি সামলে নিয়ে সে বলল, ‘আমিও টিকব না বেশিদিন। আমি দুর্বল হয়ে গেছি। রোবটেরা এতদিন টেকে না। আমি যে টিকে আছি তিন-শো বছর, সে শুধু এই কারণে যে—

আসুন, আপনাদের দেখাই, কেমন করে আমি টিকে আছি।’

আগে আগে ফ্রাইডে চলল, পিছনে ওরা। সুঁড়িপথ বেয়ে আরও খানিকটা উপরে উঠতে হল। সেখানে দ্বিতীয় এক গুহা। এটা আবার অনেক বড়ো। এক আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়ল সেখানে। নানা রকমের যন্ত্রপাতি তো ছড়ানো রয়েছেই, তা ছাড়াও কঙ্কাল পড়ে আছে দু-শো রোবটের।

কঙ্কাল মানে? মানে দু-শোটা রোবট খুলে ফেলে এটা থেকে একরকম, ওটা থেকে আর এরকম যন্ত্র বার করে নেওয়া হয়েছে। এলোমেলো ছড়িয়ে রয়েছে অদরকারি কলকবজা শুধু।

ফ্রাইডে বলছে, ‘তিন-শো বছরে আমার দেহের যন্ত্রপাতিগুলো বার বার বদলাতে হয়েছে। নতুন যন্ত্র সংগ্রহ করেছি ওইসব রোবট খুলে খুলে। নিজেই মেরামত করে নিয়েছি নিজের দেহ। একবার দুইবার নয়— অসংখ্য বার। কিন্তু এবার আর মেরামতের উপায় নেই। যে যন্ত্র এক্ষুনি বদলানো দরকার আমার দেহে, তা আর কোথাও নেই। ওই সব রোবট কঙ্কাল থেকে সে যন্ত্র আমি আগেই বার করে নিয়েছি। এবার আমারও শেষ ঘনিয়ে এসেছে। ভয়ানক দুর্বল বোধ করছি।’

একটু থেমে সে আবার বলল, ‘শেষ হয়ে যাওয়ার আগে যদি আপনাদের কিছু কাজ করে দিয়ে যেতে পারি, অবশ্যই দেব। তবে চটপট বলতে হবে। আমার আর সময় নেই বেশি।’

ক্রোম আর বেইলি তখন ঘুরে ঘুরে দেখছে, দরকারি জিনিস কী পাওয়া যায় তিন শতাব্দীর পরিত্যক্ত এই গুদোমে। খাদ্যসামগ্রীতে ভরতি সিল করা বাক্স পড়ে আছে কতকগুলো। বেইলি বলল, ‘খাবারগুলো খারাপ না-হয়েও থাকতে পারে।’

‘বলো কী? এতদিনেও?’ সন্দেহ প্রকাশ করে ক্রোম।

‘বলা যায় না কিছুই।’ অন্যদিকে এগিয়ে গেল বেইলি।

আর একটা বাক্সের উপরে লেখা আছে, ‘বিম রেডিয়ো-এ-৭’।

‘এ কী হে?’ বেইলি স্পষ্টতই বিচলিত। ক্রোমও তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে ওই বাক্সটার উপরেই।

‘কিন্তু এটা যে কাজে লাগাব, বিদ্যুৎ পাব কোথায়?’ নিজের মনেই যেন কথা কইছে বেইলি।

ক্রোম অন্য একটা বাক্সের উপরে টর্চ ফেলেছে, ‘দেখো, এটা আবার কী?’

একটা নয়, অন্তত এক ডজন প্লাস্টিকের বোতল, অস্বচ্ছ। ভিতরে কী জিনিস, বুঝবার উপায় নেই। তবে লেবেল রয়েছে, ‘অ্যাসিড ব্যাটারি, বিদ্যুতের উপাদান।’

‘অ্যাসিড ব্যাটারি?’ ‘অ্যাসিড’ কথাটার উপরে অনেকখানি জোর দেয় ক্রোম।

একসাথে নানা চিন্তা ক্রোমের মাথায়। অবশেষে সে বলল, ‘ঠিক আছে! ঠিক আছে! রাসায়নিক ক্রিয়া থেকেও বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পারে। সেকালে ওই দিয়েই কাজ চালানো হত। জিনিসটা যদি নষ্ট না-হয়ে থাকে, লেগে যাবে কাজে। ফ্রাইডে, এদিকে এসো তো!’

রোবট আদেশ পালন করতে দেরি করে না। দুটো প্যাকিং বাক্সের উপরে জিনিসগুলো সে তুলল ক্রোমের নির্দেশে। রেডিয়োর বাক্স, অ্যাসিডের বোতল— সব কিছু। রেডিয়োটা এত ভারী, শুনলে একালের লোকে বিশ্বাস করবে না সহজে। ফ্রাইডে যদি সাহায্য না-করে, এটাকে এক্স-দুই পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া, এত এত চড়াই-উতরাই ভেঙে, সম্ভবই হবে না ওদের পক্ষে।

না-নিয়ে যেতে পারলেও তো চলবে না। একটিমাত্র এরিয়াল ওদের, তা এক্স-দুইয়ে খাটানো রয়েছে। সেটাকে খুলে এখানে আনা, সে বহু সময়সাপেক্ষ।

‘ফ্রাইডে! পারবে ভাই, এগুলো আধ মাইলটাক বয়ে নিয়ে যেতে?’ কাঁচুমাচুভাবে জিজ্ঞাসা করে ক্রোম।

রোবটের কাজ অবশ্য হুকুম তামিল করাই, কিন্তু ক্রোম তাকে হুকুম করার কে?

‘আমি খুবই দুর্বল বোধ করছি, কিন্তু চেষ্টা করব।’ বলল ফ্রাইডে।

ফ্রাইডে মাথায় তুলে নিল অত বড়ো বোঝাটা। টলতে টলতে চড়াই উঠছে ওটা নিয়ে। ক্রোমের লজ্জা করছে, ওকে এভাবে খাটিয়ে নিতে। বেইলি তার মনের ভাব বুঝে মুচকি হাসল, ‘আরে, ও তো একটা মেশিন মাত্র!’

‘হোক মেশিন।’ জোর গলায় বলল ক্রোম, ‘আচারে-আচরণে ও হুবহু মানুষই। তা ছাড়া ভেবে দেখো, তিন-তিন-শো বছর ও আমাদের জন্য এই বিজন গ্রহে অপেক্ষা করে আছে। ঠিক যেন মারাত্মক সংকটে আমাদের এই উপকারটুকু করবার জন্যই। স্বীকার করছি, ও মেশিন হলেও আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছি।’

এক্স-দুইয়ের পাশে বোঝা নামিয়ে দিয়ে ফ্রাইডে হাঁপাতে লাগল। কিন্তু তার দিকে নজর দেবার আর সময় নেই ওদের। দু-জনে লেগে গেল সেকেলে পুরোনো ধাঁচের ওই প্রকাণ্ড রেডিয়োটাকে জুড়ে তেড়ে খাড়া করবার জন্য। কাজ শেষ হতে বিকেল প্রায় পার হয়ে গেল। ব্যাটারি থেকে বুড়-বুড় শব্দ উঠছে। সরু একটা তার এঁকেবেঁকে ভিতরপানে এরিয়ালের দিকে চলে গিয়েছে।

‘এইবার চেষ্টা করা যেতে পারে না কি?’ জানতে চায় বেইলি।

‘বোধ হয়।’ বলে ফোন জায়গা মতো লটকে দিল ক্রোম। একটা সূচ ধীরে ধীরে নড়ছে। ক্রোম বলল, ‘আমাদের যা বৈদ্যুতিক শক্তি ছিল, তার ডবল পাচ্ছি এখন। এবারে কাজ হওয়া উচিত, যদি না ওপেন হাইমার ইতিমধ্যে বহুদূরে চলে গিয়ে থাকে। তারপর আরও এক সমস্যা ওই সূর্যটা নিয়ে, শব্দক্ষেপকে বাধা দেবে কিনা ওর উত্তাপ, কোনো ধারণাই নেই সে সম্পর্কে।’

এইবার একটা সুইচ টিপে দিতেই ক্ষুদে একটা হলদে বালব জ্বলে উঠল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল ক্রোম। এতক্ষণে তার মনে পড়ল ফ্রাইডের কথা, ‘ও গেল কোথায়?’

‘জানি না তো!’ বলল বেইলি। ফ্রাইডেকে কোনোদিকেই দেখা যাচ্ছে না।

‘বেচারা দুর্বল হয়ে পড়ছিল।’

বেইলি বলল, ‘আরে, মেশিন তো!’

ক্রোম একটু ভেবে সায় দিল, ‘তা বটে।’

ক্রোম ডায়াল ঘোরাচ্ছে। মাইকের ভিতরে কথা কইছে, ‘মে-ডে, মে-ডে, মে-ডে। সন্ধানী বিমান-২নং ওপেন হাইমারকে ডাকছে। ডাকছে ক্রোম। ক্রোডস-সাতে নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছি। ক্রোডস-সাত—’

বার বার অনেকবার এই একই সংকেত আওড়াল ক্রোম। কোনো সাড়া নেই কোনো দিক থেকে। অবশেষে বেইলিকে মাইকে বসিয়ে ক্রোম ভিতরে চলে গেল টেপ-রিপিটার নিয়ে আসবার জন্য। সেটা এইখানে লাগানো দরকার। টেপে একবার বার্তাটা ধরে নিতে পারলে, তারপর আপনা থেকেই ওটা আউড়ে যেতে থাকবে।

টেপ খাটানোর পরে আর করবার কিছু নেই, হাত গুটিয়ে বসে ওরা চুরুট ফুঁকতে লাগল। কান খাড়া রয়েছে রেডিয়োর দিকে, মুখে বিড়বিড় করছে ক্রোম— ‘তি-ন-শো বছর! ধারণা করাই যায় না—’

স্বরবর্ধক ফটফট করে উঠল, ‘হ্যালো ক্রোম! হ্যালো ক্রোম! ওপেন হাইমার ডাকছে ক্রোমকে।’

একটা গগনভেদী জয়ধ্বনি যুগপৎ দু-জনের কণ্ঠ থেকে। একসঙ্গে দু-জনে লাফিয়ে গিয়ে পড়ল ট্রান্সমিটারের উপরে। রিপিটার খুলে নিয়ে ক্রোম মুখোমুখি কথা কইতে শুরু করল, ‘কে কথা কইছো?’

ওপেন হাইমারের রেডিয়ো যন্ত্রী, ‘এম বালা। হয়েছিল কী?’

‘কী যে হয়েছিল, তা বোঝাতে গিয়ে ওরা ওপেন হাইমারের ইঞ্জিনিয়ারদের বাপান্ত শুরু করে দিল তখন। খানিকক্ষণ ধৈর্য ধরে শুনবার পরে এম বালা বলল, ‘তোমরা নিরাপদ তো?’

‘তা, আমাদের গায়ে অঁচড়টাও লাগেনি।’

‘তিন নম্বর সন্ধানীকে বারো ঘণ্টার ভিতর পাঠানো হচ্ছে। পৃথিবী পরিমাণের বারো ঘণ্টা। মেরামতির লোকজন সমেত। ঘণ্টা দশেক বাদে আবার খবর পাবে, সজাগ থেকো।’

দু-জনে নেতিয়ে পড়ল মাটিতে অতি আনন্দের অবসাদে। এক মিনিট বাদেই ক্রোম লাফিয়ে উঠল, ‘এ আনন্দের অংশ ফ্রাইডেকেও না-দিই যদি অন্যায় হবে। কোথায় ফ্রাইডে?’

ফ্রাইডে কোথাও নেই।

খুঁজতে খুঁজতে তাকে ওরা আবিষ্কার করল এক নম্বর গুহায়। যেখানে তিন-শো বছর ধরে পড়ে আছে ক্যাপ্টেন হলান্ডের কঙ্কাল।

সেই গুহাতেই মেঝেতে পড়ে আছে রোবট ফ্রাইডে, অসাড় মৃত।

প্রায় দুই মিনিট দু-জনই স্তব্ধ। তারপর ক্রোম বলল, এ গ্রহ ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্যাপ্টেন হল্যান্ডকে কবর দেওয়া আমাদের কর্তব্য, কী বলো?’

‘অবশ্যই।’ বলল বেইলি।

‘যদিও ফ্রাইডে ছিল মেশিন মাত্র, তবু ওকেও আমি কবর দিতে চাই। তুমি সেটাকে ছেলেমানুষি ভাববে না তো?’

গাঢ়স্বরে বেইলি জবাব দিল, ‘না না, তা কেন ভাবব?’