১৪. মিতুল-২
দাদা যে এভাবে ফিরে আসবে আমরা ভাবতেই পারিনি। ফোনটা পেয়ে তিতলি মনে করেছে বম্বে পৌঁছে সংবাদ দিচ্ছে, একদিন দেরিতে।
তা নয়। দাদা দমদম এয়ারপোর্টে—বলছে বাড়িতে চলে আসছে। রাতে থাকবে। দাদা বম্বে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। তিতলির সঙ্গে একসঙ্গে নিয়মভঙ্গ করবে বলে, আমাদের ‘মৎস্যমুখীতে থাকবে বলে। দাদা তো খরচের আধাআধি আগেই দিয়ে গিয়েছিল। বাকিটা আমরা দুই বোনে দিচ্ছি। মনটা খচখচ করছিল দাদা ‘মৎসমুখী’-তে থাকবে না বলে। আমারও, তিতলির তো বটেই। হঠাৎ এসে পড়ে দাদা আমাদের সব আয়োজন পরিপূর্ণভাবে সার্থক করে দিল। তিন ভাইবোন একসঙ্গে কাজটা সম্পূর্ণ করলাম।
আর জিনা না থাকলেই দাদা অন্যরকম। ‘মৎসমুখী’-তে খুব বেশি লোক তো বলা হয়নি। দাদা খুব খুশি। মাছভাজাই হয়েছিল দুটো, তোপসে মাছভাজা আর ভেটকি ফ্রাই। আর মাছের রান্না হয়েছিল তিনটে—চিংড়িমাছের মালাইকারি, রুইমাছের দইমাছ আর চিতলপেটির কালিয়া। পাঁচরকম মাছ! এবং খাসির মাংস। রাবড়ি, জিলিপি, আইসক্রিম। হইহই করে সুন্দরভাবে হয়ে গেল খাওয়াদাওয়া। মাগো তুমি যদি দেখে থাকো আমাদের চেষ্টা, নিশ্চয়ই তোমার তৃপ্তি হয়েছে। বাবার বেলাতেও খুব যত্ন করেই ‘মৎসমুখী’ করা হয়েছিল, কিন্তু এতরকম তুমিই করতে দাওনি—আর খাওয়া-দাওয়াটা হয়েছিল শিবুদের দালানে।
এটা হল তোমার নিজস্ব বাসগৃহে। কিন্তু দাদার হঠাৎ এসে পড়াটা আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি আনন্দের হয়েছিল মা, অর্জুনের পুনরার্ভিাবের চেয়েও বেশি। মা, এই মুহূর্তেই যে তোমাকে আমাদের বিশেষ জরুরি দরকার। অর্জুন ফিরে এসেছে তিতলির জীবনে। কিন্তু তিতলির অভিমান কাটেনি।
দিদি হিসেবে আমার কী বলা উচিত বলো তো তিতলিকে? ওকে কি আমার উৎসাহ দেওয়া উচিত অর্জুনের প্রসঙ্গে? আমি তো চাই একটি কোনও সঙ্গী ওর থাকুক। তিতুর জীবনে স্থিতি আসুক। অর্জুনের ছেলেটি ভারি মিষ্টি হয়েছে। অভিকে ভালো না লেগে উপায় নেই। কিন্তু এই বয়সে তো আর দিদিরা বোনকে উপদেশ দেয় না। বিশেষত অত উচ্চশিক্ষিত, স্বাধীনচিত্ত বোনকে। ওর বন্ধুরা, মৌ আর রিলা এবং মৌয়ের স্বামী দেব প্রবল সাহায্য করেছে আমাদের।—ওদের সাহায্য ছাড়া কাজ উঠত না।—তিতুর বন্ধুভাগ্য ভালো, প্রেমের ভাগ্যটা ভালো নয়। মাগো, তুমি ওকে সব দেখাও তুমি ওকে বলে দাও ওর কী করা উচিত। আমি তো ফিরে যাচ্ছি আগামী কালই—তিতুর জীবন যাতে পূর্ণতা পায়, তার হৃদয় মন থেকে প্রাণরস না ফুরিয়ে যায়, শুধু কাজ কাজ আর কাজ নিয়ে ডুবে না থাকে ল্যাব-অন্ত-প্রাণ হয়ে—তুমিই সেটা দ্যাখো, মা। ওকে যে একা দেখতে ভালো লাগছে না আমার! এবার থেকে পৃথিবীতে তিতুর নিজের মানুষ কেবল দাদা আর আমি—দুজনে থাকি পৃথিবীর দুই প্রান্তে। আর তিতু তৃতীয় প্রান্তটিতে। এই পুণ্য ত্রিভুজটি তুমি ধরে রেখো, মা যেন আমরা দূরে দূরে সরে না যাই—জীবনের ধাক্কায় ছড়িয়ে না পড়ি। নামেই গ্লোবাল ভিলেজ, আসলে তো উলটোই হচ্ছে। এই যে বিশ্বভুবন—এখানে আমরা সবাই তো দূরে দূরে ছিটকেই যাচ্ছি সর্বক্ষণ—এরই মধ্যে একটু গ্রন্থি বাঁধার চেষ্টা—তুমি আমাদের আশীর্বাদ করো যেন সফল হই।
.
আজ দাদা বম্বে চলে গেল। আমি যাচ্ছি আগামীকাল। কিন্তু যাবার আগে আমরা একটা চমৎকার জিনিস ঠিক করেছি। প্রত্যেক বছর আমরা তিন ভাইবোন কলকাতায় আসব—একসঙ্গে ক’টা দিন হইচই করে যাব তোমার বাড়িতে। সময়টা ঠিক হয়নি—যখন কাচ্চাবাচ্চাদের ছুটি থাকবে—ক্রিসমাসে হলেই ভালো—তখন কলকাতাও লক্ষ্মীমেয়ের মতো ঠান্ডা থাকে। দাদারই আইডিয়া—জানি না দাদা এটা কতটা পেরে উঠবে, জিনা নিশ্চয় রাজি হবে না। কিন্তু দাদা এবার শুরু করেছে নিজের মতো করে বাঁচতে। এবং তিতলিও।
*
কিন্তু আমি? আমি তো বিবাহিত মেয়ে। সুখী সংসারের গিন্নি। অশোকের স্ত্রী। জিৎ, জয়ার মা। সিমেন্সের চাকুরে। কিন্তু আমার বাঁচাটা কি আমার নিজের মতো? নাকি অন্য কারুর মতো করে বাঁচি আমি? এই যে আমি তাড়াতাড়ি ফিরে যাচ্ছি, কেন না অশোক গৃহকর্মে অপটু—এত বছর বিদেশে কাটিয়েও সে বাজার করা, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালানো, আর ওয়াশিং মেশিন চালানো ছাড়া কোনও সংসারের কাজ পারে না। এমনকি ডিশ ওয়াশার চালাতে গেলেও তার গোলমাল হয়ে যায়।
এটা কি আমার নিজের মতো করে বাঁচার উদাহরণ, না তার বিরুদ্ধে প্রমাণ? নাকি আমার ক্ষেত্রে এটাই নিজের মতো করে বাঁচা? আমার স্বামী, আমার পুত্রকন্যা, তারাই আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন এবং পরিপূর্ণতা। তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে, নিজের দিকটাও বিসর্জন না দিয়ে এই যে আমি নিজস্ব জীবনযাপন করছি, এটাই আমার নিজের মতো বাঁচা। কিছু কিছু তোমাকে ছাড়তেই হবে সকলের সুখের জন্য, শান্তির জন্য। খানিকটা কমপ্রাোমাইজ না করলে সংসার কোনও সম্পর্ককেই স্থায়িত্ব দেওয়া যায় না। সে স্বামী-স্ত্রীই বলো আর পরিণত বয়স্ক সন্তানই বলো, কিম্বা ঝি-চাকরই বলো। কিন্তু মাগো, সেই কমপ্রাোমাইজের সীমারেখাটা টানতে হবে কোনখানে? সেটাই আসল। জিনার সঙ্গে দাদার যেরকম একশোয় একশোভাগ কমপ্রাোমাইজ করে চলার দুর্বল নীতি (দুর্নীতিই বলব) সেইটে আমি মানতে পারি না। অশোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো ওরকম নয়। ও-ও মানিয়ে নেয় ওর মতো করে। আমি তো মাঝে মাঝেই চলে আসতাম তোমাদের কাছে—কিন্তু এসে শ্বশুরবাড়িতে থাকতাম বলেই কিনা জানি না,—অশোক কোনওদিনই বাধা দেয়নি। মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ার নামই তো জীবন। সম্পর্ক ভেঙে ফেলা সহজ। টিকিয়ে রাখাই কঠিন। তিতলির নিজের মতো করে বাঁচার অর্থ যদি হয় একলা চলো রে—তবে আমি তাতে আপত্তি করব। ওটা কখনও একটা স্থায়ী নীতি হতে পারে না—হাইফেনের মতো জীবনের দুটো পর্বকে জুড়ে রাখতে পারে বড়জোর।
লম্বা, জার্নির মধ্যে একটু ব্রেক, একটু জিরিয়ে নেওয়া। ফিরে যাবার আগে তিতুকে আমি এইটেই বুঝিয়ে দিয়ে যেতে চাই। একা বাঁচার মধ্যে শক্তি আছে নিশ্চয়ই কিন্তু হারানো সম্পর্কের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতেও যথেষ্ট শক্তি লাগে। জটিলতর, প্রবলতর শক্তি। নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া একরকম। আর আরেকজন মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নেওয়া, সেটা অন্য। মানুষজীবনটা তো একা কাটানোর জন্যে নয়। জীবন সবাইকে নিয়েই।
.
তোমরা দুটোই জেনেছিলে, মা। বাবা আর তুমি। তিতুর কাছে বাবার খাতা দেখলাম, ঠাকুরদার জাবদা খাতায় তোমাদের বিয়ের হিসেবপত্র দেখলাম, কোথা থেকে তোমরা কোথায় এসে পড়েছিলে, মা?
অথচ আমাদের কিছুই বুঝতে দাওনি। কেন বোঝাওনি মা? কেন বলোনি আমাদের বাড়ির গল্প আমাদের? কেন জানতে দাওনি আমাদের শেকড়ের কাহিনি? কীসের ভয়ে ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করেছিলে আমাদের?
শেষ পর্যন্ত তো সবই মুছে যায়। কী হত জানলে? নিজেদের অতীতকে না চিনলে ভবিষ্যৎকেও তো চেনা যায় না। বর্তমানটাও নড়বড়ে হয়ে যায়। তোমাদের কষ্টের প্রকৃত পটভূমিটা জানলে, সেই কষ্টের আসল ওজনটাও ঠিকমতন বুঝতাম আমরা।
এত সব ছিল আমাদের? এত সব হারিয়েছি আমরা? অথচ তোমরা কিছুই জানতে দাওনি আমাদের? আমরা কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিয়ে যাব আমাদের ঠাকুরদার খাতা, আমাদের বাবা-মায়ের খাতা। উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের প্রাপ্য এই অমূল্য পারিবারিক সম্পত্তি। খাতার খবর শুনে চমকে গেলেও, আমাদের মতো অবাক না হয়ে দাদা বলল, ওকে নাকি ছোটবেলায় শিবুদা একদিন বলেছিল, ‘জানিস, তোদের হাতি ছিল। ফিটন গাড়ি ছিল। তোরা অবশ্য দেখিসনি সে সব।’
দাদা সেই থেকে মাঝে মাঝে ভাবত শিবুদার অদ্ভুত কথাটা। শিবুদা ভীষণ গুল মারত, এটাও গুল বলেই ধরে নিয়েছিল দাদা। কিন্তু ওর এটা ভেবেই অবাক লাগত, যে আমাদের ‘হাতি ছিল’ বলে শিবুদার কী লাভ?
এখন দাদার মনে হচ্ছে হয়তো কেউ শিবুদাকে কথাটা বলেছিল—বিনুদিদির কাছে শুনে থাকবে। বিনুদিদি তো সবই দেখেছিল। তোমাদের বিয়েও দেখেছিল। বংশের অধ:পতনের সাক্ষীও ছিল সেই। উত্তরাধিকার সূত্রে আমাদের হাতে এসে পড়েছে অমূল্য সম্পদ—আমাদের পরিচয়—আমাদের ইতিহাস। আমরা কারা। শিবুদাদের বাড়ির দেড়খানা ঘরে আমরা কেন। আশ্চর্য লাগছে ভাবতে, এতকাল ধরে তক্তাপোশের তলায় ছিল ট্রাংকগুলো। আমরা দেখিওনি তাতে কী আছে। তুমিও কোনওদিন বলোনি।
কেন বলোনি মা?
কী ভয় ছিল তোমার মনে? সত্যকে ভয় কীসের? নিজের বংশপরিচয়, জানার মধ্যে কীসের ভয় থাকতে পারে? ঠাকুরদা জেলে গিয়েছিলেন, সেই লজ্জা? সেটাই এত বড় হয়ে উঠল, নাকি তোমার নিজেদের মধ্যে দারিদ্র্যের অহংকার এতটাই বড়, এতটাই উঁচু হয়ে উঠেছিল, যাতে ঐশ্বর্যের ইতিহাসকেও চাপা দেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ে।
মা, এটা কিন্তু ভুল। এই বাক্য উচ্চারণেও হয়তো পাপ, তবু বলে ফেললাম। জানি, তোমাদের সাহসের অন্ত ছিল না, পরিশ্রম, সততা দিয়ে আজ আমাদের জীবনকে এইখানে এনে পৌঁছে দিয়েছ তোমরাই। এই কীর্তি অসামান্য। মাপ কোরো, তবু বলব, তোমাদেরও ভুল হয়েছিল। তোমাদের সন্তানদের শিকড়ছাড়া করে দেওয়াটা ঠিক হয়নি মা। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েও যেতে পারত। অনেক শক্তিক্ষয় হয়েছে তোমাদেরও এই লুকোচুরি করতে গিয়ে।
এর কোনও দরকার ছিল না। যদি জানাতে, মা, হয়তো আরও একটু স্বপ্ন লেগে থাকত আমাদের চোখের পাতায়। হয়তো আর একটু বেশি আত্মবিশ্বাস। হয়তো।—নাও হতে পারত।
জানতে পারলে কী ক্ষতি ছিল দাদার? একজনের খাট শেয়ার করে ঘুমোয়, আরেকজনের টেবিল শেয়ার করে পড়ে যে দাদা। প্রচণ্ড বেশি আত্মবিশ্বাসের ফলেই দাদা দাঁড়াতে পেরেছে। আর সেটাতে চাটুজ্যে পরিবারের কোনওই অবদান নেই, তাও আর মনে হয় না। জিন তো নি:শব্দেই তার কাজটা করে যাচ্ছে।
.
ট্রাংক শুধু একটাই খুলেছে তিতু। খাতা শুধু দুখানাই বের করেছে। সবটা পড়া হয়নি। দাদা চলে গেছে। আমিও যাচ্ছি।
কিন্তু যে-দাদাটা এসেছিল, যে-আমি এসেছিলাম সেই সংকর্ষণ ফিরছে না, সেই মিতুলও ফিরছে না। আমরা যে-বাবা-মায়ের কাছে এসেছিলাম শুধু তাদেরই নয়, অন্য এক জোড়া বাবা-মাকে বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে যাচ্ছি।
যাদের সঙ্গে এতদিন দেখা হয়নি আমাদের। দাদা বলছিল পরের বারে মেয়েটাকে নিয়ে আসবে—খাতাগুলো দেখাতে। মাগো কেন আমাদের বেলায় এত দেরি করলে? এখন আমাদের কোনও প্রশ্নেরই আর উত্তর দেবার কেউ নেই।
এখন শুধু একতরফা সম্পর্ক।