১৪. ভারতের ভাগ্যবিধাতা হলেন না কেন
১৯৯৬-এর ১৫মে-র রাত। চারিধারে নীলচে আছা আলো-আঁধারির মধ্যে ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল ছটায় প্লাবিত নির্জন এক দ্বীপের মত দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ ইন্দিরা ভবন। রাত তখন ঠিক এগারটা। বাতাসে শোনা গেল চাপা সাইরেনের শব্দ। মাথায় ঘূর্ণায়মান লাল আলো নিয়ে বসুর কনভয় এসে দাঁড়াল ইন্দিরা ভবনের বড় গেটের সামনে। রিমোট কন্ট্রোলে মুহূর্তে নিঃশব্দে খুলে গেল ছাইরঙা গেট। বসুর সাদা অ্যামবাসাডর গাড়ি গিয়ে থামল পোর্টিকোর তলায়। গাড়ি থেকে নেমে, কোনও দিকে না তাকিয়ে সিঁড়ি ভেঙে, দ্রুতপায়ে সামনের কাঁচের বড় দরজা পেরিয়ে বসু চলে গেলেন কারুকার্যমণ্ডিত কাঠের প্যানেলের ওপারে। একেবারে সটান নিজের বেডরুমে। অবশেষে একদম একা। নিজের মুখোমুখি। গত কয়েকদিন ধরে যে প্রবল ঝড় তাঁর অনুভূতিগুলো দুমড়ে মুচড়ে চলে গেল, সেদিকে ফিরে তাকানোর শক্তিটুকু যেন আর নেই। একটা গভীর শ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন তিনি। পাশের ছোট টেবিলে এক বাটি পাতলা স্যুপ রেখে গেল যোগেন। খাবার এতটুকু ইচ্ছে নেই। মাথার ভেতর তখনও যেন ভয়ানক হাতুড়িপেটা চলছে, মাথাধরার মলমটার জন্য হাত বাড়ালেন বসু।
সরকার গড়ার দৌড় শুরু হয়েছিল ৯ তারিখেই। কিন্তু একটা সময় মনে হল, এক অনিশ্চিত সংখ্যগরিষ্ঠতার খাতিরে কোনও দলই তাঁদের সব মতবিরোধ ধামাচাপা দিয়ে জোট বাঁধতে পারবে না। পলিটব্যুরোর বৈঠকে উদ্ভূত পরিস্থিতি আলোচনা করতে ১০ই মে জ্যোতি বসু দিল্লীতেই ছিলেন। লোকসভায় সব-চেয়ে বেশি আসন ছিল বি. জে. পি-র, কিন্তু তাদের ক্ষমতার বাইরে রাখতে কংগ্রেস ও তৃতীয় ফ্রন্ট যেভাবে আদাজল খেয়ে লেগেছিল, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল বি. জে. পি-র সরকার টিকবে না। কিন্তু বি. জে. পি-র ভাবসাব দেখে মনে হতে লাগল, যুদ্ধ তারা জিতেই গেছে। আবার উল্টোদিকে বি. জে. পি-বিরোধী দুই প্রধান শক্তির মধ্যেও মতপার্থক্য এতটাই যে, তাদেরও কাছাকাছি আসা ছিল প্রায় অসম্ভব। তৃতীয় ফ্রন্টের আশা ছিল, কংগ্রেস সাংসদদের একাংশ দল ছেড়ে বেরিয়ে নরসিমহা রাও-ও বি. জে. পি-বর্জিত সরকারে যোগ দিলেও দিতে পারেন। পাশাপাশি নরসিমহা রাও-ও তখন সমর্থন জোগাড়ের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, যাতে তাঁর ভাঙাচোরা কংগ্রেসও সরকার গড়ার দাবি জানাতে পারে। বামপন্থী দলগুলি আবার নানা খুঁটিনাটি মতবিরোধ আর দোটানাতেই ব্যতিব্যস্ত। তামিল মানিলা কংগ্রেস ও অসম গণ-পরিষদের মত দল সবার জন্য দরজা খোলা রেখেও কাউকেই পাকা কথা দিচ্ছে না।
এভাবেই নতুন সরকারের শপথ নেওয়ার দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, রাজনীতির অঙ্কও জটিল থেকে জটিলতর হল। বি. জে. পি অবশ্য আগাগোড়াই বলে আসছিল, প্রয়োজনীয় গরিষ্ঠতা তারা জোগাড় করতে পারবে। সেই আস্থাটুকু তৃতীয় ফ্রন্টেরও ছিল, কিন্তু প্রস্তাবিত বি. জে. পি-বিরোধী জোটের নেতা হিসেবে কাউকেই তারা তুলে ধরতে পারেনি। জ্যোতি বসু বা ভি. পি. সিং কেউই এই প্রস্তাবে সাড়া দেন নি। অতএব অচলাবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।
দিল্লী রওনা হওয়ার আগে বসু কলকাতা থাকার সময়েই ভি. পি. সিং-এর কাছ থেকে একটা ফোন পেয়েছিলেন। “তিনি আমায় বললেন জনতা দল ও অন্য জোটসঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা আমাকেই তাঁদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেছেন।”
খানিকটা থেমে বসু বলেন, “এমন কথা শুনতেও ভারি ভাল লাগে। কিন্তু সে মুহূর্তে আমি কোনও কথা দিতে পারিনি ভি. পি-কে; শুধু বললাম, “আমি দিল্লীতে আসছি, সেখানে না হয় এ নিয়ে কথা হবে।”
বসুর দিল্লীর ফ্লাইট অসম্ভব ‘লেট’ করল। বঙ্গভবনের পাঁচতলার স্যুইটে তিনি যখন পৌঁছলেন তখন ঘড়ির কাঁটা রাত সাড়ে দশটা ছুঁই ছুঁই। খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে, ধুতি পাঞ্জাবি ছেড়ে, গাঢ় খয়েরি রঙের বাটিকের লুঙ্গি আর সাদা হালকা স্ট্রাইপ দেওয়া সূতির শার্ট পরলেন। এত টেনশনের মধ্যেও অভ্যাসমত কলারের বোতাম আর ফুলহাতা শার্টের হাতের বোতামটা লাগাতেও ভুললেন না। ডেকে পাঠালেন বঙ্গভবনের হেড বাবুর্চি মহেন্দ্রকে, বললেন ‘রাতের খাবারটা দিয়ে দাও।’ কিন্তু ক্রমাগত ফোনের উপদ্রবে শান্তিতে কি খাওয়ার জো আছে? বসু খান অতি সামান্য, সাধারণত পরিচ্ছন্নভাবে এবং দ্রুত খাওয়া সারেন। সে রাতে সামান্য খাবারটুকু কোন রকমে গলাধঃকরণ করলেও রাতের খাওয়ার পর বেডরুমে মিনিট পনের হাঁটাহাঁটি করার যে রোজকার অভ্যাস—তার বারোটা বাজল। এবং ফোনের উল্টোদিকে সে কংগ্রেস নেতা, বাঘা শিল্পপতি বা তৃতীয় ফ্রন্টের নেতা, যিনিই থাকুন না কেন, সকলেরই আবদার, প্রধানমন্ত্রী হতে আপনাকে রাজি হতেই হবে।
এই প্রস্তাব নিয়ে বসু যে দারুণ আশ্বস্ত ছিলেন তা কিন্তু নয়, বিগত কয়েক বছরের মধ্যে তিনি যখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন, তখনও এ প্রস্তাব উঠেছিল। “আমার মনে হল এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে”–বসু বললেন। “কিন্তু এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছাতেই তো আর সব হবে না, শেষ কথা বলবে দলের পলিটব্যুরো আর কেন্দ্রীয় কমিটি। আর নিতান্ত মাথা খারাপ না হলে আমার দলের আসল শক্তি বা দলের মতামত যাচাই না করে আমিই বা কীভাবে প্রস্তাবে সায় দিই!” বসু তাঁর এই সংশয়ের কথা জানালেন হরকিষেণ সিং সুরজিৎকে। দুজনের মধ্যে সামান্য আলোচনাও হল। বসুর তখন প্রশ্ন, “জোট সরকার নিয়ন্ত্রণ করার মত যথেষ্ট শক্তিশালী আমরা নই। এই বারো হাঁড়ির সংসার আমি কীভাবে সামলাবো? আর তাছাড়া, আগের ট্রাডিশন অনুযায়ী কংগ্রেসও যে আচমকা সমর্থন তুলে নেবে না, তাই বা কে জানে।”
বঙ্গভবনে বসুর সে ভারী অস্থির এক রাত। বিমানযাত্রার ধকল তো ছিলই, আর দিল্লীতে পা দেওয়ার পর থেকে একের পর এক কাজের ধকলে শরীরও আর বইছিল না। তৃতীয় ফ্রন্টের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তখন তাঁর কাছে দিনের আলোর মত স্বচ্ছ। কিন্তু পাশাপাশি এটাও বেশ বুঝতে পারছেন, যে কোনও মূল্যে বি. জে. পি-কে ঠেকাতেই হবে। আর বি. জে. পি-বিরোধী জোট যদি ক্ষমতায় আসে, তবে তা চালানোর জন্য চাই একজন জবরদস্ত নেতা। বসুর কথায়, “সব মিশিয়ে পরিস্থিতি এমন ঘোরালো হয়ে উঠল যে, ঠিক করলাম ব্যাপারটা দলের উপরেই ছেড়ে দেব।” তা হলেও বসু কিন্তু রাজনৈতিক ময়দানের বেড়ার ধারে বসে রইলেন না। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “হ্যাঁ, তৃতীয় ফ্রন্টের বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতেই আমি পিছিয়ে আসতে পারি না। কোনও বিকল্প না পাওয়া গেলে, আমি সর্বসম্মত প্রার্থী হতে রাজি আছি, যদিও আমার শরীরস্বাস্থ্য বিশেষ ভাল নেই। তবে হ্যাঁ, সবটাই নির্ভর করছে, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির উপর।”
পরদিন সকালেই পলিটব্যুরোর বৈঠক বসল। দলের এই সীমিত ক্ষমতা নিয়ে একটা জোট সরকার চালানো যে কতখানি বিড়ম্বনা সে কথা বসু আবার বললেন। সেই সঙ্গে ওটাও জানালেন তিনি সরকারে যোগ দিতে প্রস্তুত, কারণ এই মুহূর্তের ‘ঘটনাপ্রবাহে’ এটাই রাজনৈতিকভাবে ঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু পলিটব্যুরোর অধিকাংশ সদস্যই তুমুল আপত্তি করলেন। সরকারে সামিল হওয়ার প্রস্তাবের তাঁরা ঘোরতর বিরোধী। বৈঠকের গতিপ্রকৃতিতে তিনি যে চরম হতাশ হয়েছেন সেটাও বসু গোপন করেন নি। “তবে কেন আমরা এতদিন ধরে দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়লাম, কেন তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার ডাক দিলাম? আমরা কি ধরেই নিয়েছিলাম যে, এ সরকারে আমরা কখনই যোগ দেব না?” বসুর কথায়, “আমার মনে তখন এমনতরো হাজার প্রশ্ন। ১১ই মে সকালে মুলায়ম সিং যাদব দেখা করতে এসে নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য আবার আমায় চাপাচাপি করলেন। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারা ভি. পি-কে কেন ধরছেন না? যদিও ওঁর স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না, চিকিৎসা চলছে, তবু আমার মতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি। কিন্তু মুলায়ম কিছুতেই শুনলেন না। এমন কি সন্ধ্যেবেলা টিভিতেও বলে বসলেন, তাঁর দল ও তাঁদের ফ্রন্ট জ্যোতি বসুকেই নেতা হিসেবে দেখতে চায়।”—”নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য আমার উপর তখন ক্রমাগত চাপ আসছে। আর আমি দলের মনোভাব জানার অপেক্ষায় আছি। তৃতীয় ফ্রন্টের বিশ্বাসযোগ্যতা রাখতে সেই গুরুভার সর্বসম্মত প্রস্তাবে আমি রাজিও হয়ে গিয়েছি। আর তাছাড়া অচলাবস্থাও তো কাটানো দরকার। এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবে আমি খুব পরিষ্কার ‘না’ বলে দিয়েছি। কিন্তু রাজনীতিতে কখনও কখনও এমন এক একটা মুহূর্ত আসে, যখন পরিস্থিতির দাবিতে সেই সময়ের প্রয়োজনটা আগে মেটাতে হয়। মাথায় রাখতে হয় মানুষের চাহিদার কথাটা, কারণ আমাদের কাজের বিচারের ভার তো তাঁদেরই হাতে। যে কোন মূল্যে বি. জে. পি-কে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে দূরে রাখতে আর তৃতীয় ফ্রন্টের পতাকা উড়িয়ে রাখতে আমি ঠিক সেই কাজটাই করছিলাম।”—বসু নিজের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করলেন।
১২ তারিখেও পলিটব্যুরোর বৈঠক চলল। নিজের অন্তর্দ্বন্দ্বের সঙ্গে কোন প্রতারণা বসুর ধাতে নেই, অতএব তিনি প্রস্তাব দিলেন, পলিটব্যুরোতে যেহেতু এই ইস্যুর কোনও ফয়সালা হল না, বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটিতে তোলা হোক। ১৩ই মে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্ধারিত বৈঠকে এই প্রস্তাব পেশ করা মাত্র দলের নেতারা সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন, সরকারে যোগদানের সম্ভাবনা পত্রপাঠ খারিজ হয়ে গেল। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ বসু ও সুরজিৎ কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের একটি প্রতিলিপি নিয়ে বিহার ভবনে গেলেন। সেখানে আলোচনাকক্ষ তখন ইন্দ্ৰজিৎ গুপ্ত, মুলায়ম সিং যাদব, লালুপ্রসাদ যাদব, আই. কে. গুজরাল, সুরেন্দ্র মোহন, ওয়াসিম আহমেদ ও রামবিলাস পাসোয়ানের মত প্রথম সারির ফ্রন্ট নেতাদের দাপটে সরগরম। ছিলেন না শুধু বিশ্বনাথপ্রতাপ। জম্মুর উধমপুর থেকে তিনি তখন সবেমাত্র ফিরেছেন, আর একটু অসুস্থ বোধ করায় এয়ারপোর্ট থেকেই সোজা বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন।
সি. পি. এম. কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত জানা মাত্র ওই বৈঠকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তব্য ফ্রন্ট নেতাদের কাছে বসুই ব্যাখ্যা করে শোনালেন। নেতারা কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে চাইছিলেন না। সবচেয়ে ভেঙে পড়লেন মুলায়ম। সঙ্কট আরও ঘনীভূত হল। সবাই বিলক্ষণ বুঝলেন, যদি ফ্রন্ট নেতারা তাঁদের নেতা পছন্দ করতে না পারেন বি. জে. পি-ই সরকার গড়তে যাবে। ইতিমধ্যে সবার অলক্ষ্যে বৈঠকের মাঝপথেই ভি. পি-র অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ওয়াসিম আহমেদ বিহার ভবন থেকে ভি. পি-র বাড়ির দিকে রওনা হলেন। সেখানে গিয়ে সব কথা তিনি খুলে বললেন বিশ্বনাথপ্রতাপকে। আর ওদিকে ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি এসে চোখের সামনে থেকে সরকারকে লুঠ করে নিয়ে যাবে’ এই যুক্তি দেখিয়ে ফ্রন্ট নেতারা সি. পি. এম-কে তাঁদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানালেন। সুরজিৎ তাঁদের কথা দিয়ে এলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি এ নিয়ে আবার আলোচনায় বসবে।
বসু যখন বঙ্গভবনে ফিরলেন তখন সাংবাদিক সমর্থক রাজনীতিকদের এক ছোটখাটো জনতা সেখানে তাঁর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। সকলেই চাইছেন বসুর মুখ থেকে শুনবেন শেষবেশ কী হল। তাঁদের অনুরোধে কর্ণপাত না করে বসু সোজা চলে গেলেন নিজের স্যুইটে। সেখানে তখন অপেক্ষা করছিল ছেলে চন্দন। বসুকে চন্দনই জানাল, তাঁর বাবা নেতৃত্ব নিচ্ছেন কি না, সে ব্যাপারে নাকি নরসিমহা রাও-ও খোঁজখবর করেছেন।
প্রমাদ গুনল বি. জে. পি। পরে বি. জে. পি-র এক নেতা কবুল করেছিলেন, ফ্রন্ট্রে নেতা হিসেবে জ্যোতি বসু নির্বাচিত হলে তাঁদের কপালে অশেষ দুঃখ ছিল। যাই হোক, বসু কয়েকটা দরকারি ফোন ধরলেন, তারপর চন্দন ও জনাকয়েক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্মীয়ের সঙ্গে রাতের খাওয়াটা সারলেন। বাবাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চন্দনেরও কিন্তু প্রবল আপত্তি ছিল। ইতিমধ্যে কলকাতা থেকে স্ত্রী কমল বসুর ফোনও এসে গেছে, তিনিও শারীরিক কারণে বসুকে এই গুরুদায়িত্ব না নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। তাছাড়া, বসু প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর গোটা পরিবারই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও উগ্রপন্থী সংগঠনের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠবে, এই ছিল তাঁদের যুক্তি। বসু ছেলে, স্ত্রী সকলকেই বোঝালেন, প্রধানমন্ত্রীত্বের ব্যাপারটা একটা বৃহত্তর রাজনৈতিক ইস্যু এবং ওখানে ব্যক্তিগত মতামতের কোনও মূল্য নেই।
ফ্রন্ট নেতাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সি. পি. এমের কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের আগের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য পরদিন সকালেই যে আবার বিশেষ বৈঠকে বসছে, সদস্যদের তা রাতেই জানিয়ে দেওয়া হল। বসু পরে বলেন, “ন’জন সদস্য ততক্ষণে দিল্লী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তা সত্ত্বেও আমরা আবার বৈঠকে বসলাম। ঠিক হল, অনুপস্থিত সদস্যদের নথিভুক্ত মতামত বৈঠকে গ্রাহ্য হবে।” কিন্তু ১৪ই মে-র বিশেষ বৈঠকেও কমিটির সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রইল। পরিস্থিতিগত বিশ্লেষণ হল, তাত্ত্বিক আলোচনাও গড়াল অনেক দূর। বসু নীরব শ্রোতা হয়ে রইলেন। এক সময় মনে হল যথেষ্ট আলোচনা’ হয়েছে, একটা জায়গায় পৌঁছনো দরকার। নিজেই ভোটাভুটির প্রস্তাব দিলেন। ভোটাভুটিতেই অধিকাংশ সদস্য স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, কেন্দ্রে যোগ দিয়ে বসুকে প্রধানমন্ত্রী বানানোতে তাঁদের মোটেই সায় নেই। “আমি হয়ে গেলাম মাইনরিটি”—বললেন বসু।
পরে প্রধানমন্ত্রী পদে বিকল্প প্রার্থীদের নিয়ে বসুর সঙ্গে ফ্রন্ট নেতাদের আরও এক প্রস্থ আলোচনা হল। বসু ও বিশ্বনাথপ্রতাপকে এই তালিকা থেকে সরিয়ে রাখার পর তামিল মানিলা কংগ্রেসের জি. কে. মুপানার ও জনতা দলের এইচ. ডি. দেবেগৌড়ার নাম উঠল। বসু প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দেবেগৌড়ার নাম প্রস্তাব করতেই তা গৃহীত হল। কৃতজ্ঞ দেবেগৌড়া কিন্তু ১৪ই মে বসুকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে আবার একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি লেখেন :
১৪ই মে,
নয়া দিল্লী
….‘কেন্দ্রে তৃতীয় ফ্রন্ট সরকারকে নেতৃত্ব দিতে আমার নাম প্রস্তাব করার জন্য প্রথমেই আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। এটা আপনার বিনয় ও মনের উদারতার পরিচয়। কিন্তু অত্যন্ত খোলা মনে আমি আপনাকে এটা মনে করিয়ে দিতে চাই যে, আপনি দেশের প্রবীণতম রাজনৈতিক নেতা এবং বিগত আঠারো বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে একটি জোট সরকার পরিচালনা করে আসছেন। এই বিপুল অভিজ্ঞতা এবং দলীয় নেতা হিসেবে আপনার প্রশ্নাতীত ভাবমূর্তির কথা বিবেচনা করে আমার ধারণা, এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে দেশের হাল ধরার জন্য আপনিই সর্বোত্তম ও যোগ্যতম ব্যক্তি।
আমি নিশ্চিত, বি. জে. পি. ও কংগ্রেস-বিরোধী সব ধর্মনিরপেক্ষ দল নির্দ্বিধায় আপনার নেতৃত্বকে মেনে নেবে। তার আরও একটা কারণ, সর্বসম্মতভাবেই আমরা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছিলাম, যাতে আপনার প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ সুগম হয়।
যে কোনও পরিস্থিতিতে সরকার পরিচালনায় আপনি আমার ও আমার দলের সমর্থন পাবেনই। আমি আবার বলছি, সরকারের যাবতীয় টানাপোড়েনে আমি সব সময়ই আপনার পাশে দাঁড়াব। এই বিশাল দেশের দুরূহ সমস্যা মেটাতে যদি কখনও কোনও সামান্য পরামর্শ দিতে পারি, তা-ও দেব নিঃসঙ্কোচে।
সবশেষে এটুকুই বলব, এই সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে ও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সব দলের অনুভূতিকে মর্যাদা দিয়ে, আপনাদের দলের কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের আগেকার সিদ্ধান্ত বদলাবে বলেই আমার আশা ও বিশ্বাস। দেশের ভালর জন্যই আপনার প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ প্রশস্ত করা উচিত। আর তা নিশ্চিত করতেই, আমি আমার দলের পূর্ণ সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি…।’ এইচ. ডি. দেবেগৌড়া
বসু এর পরই রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার সঙ্গে দেখা করে যুক্তফ্রন্টের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কাছে খুলে বললেন। বসুর কথায়, “আমি ওঁকে বললাম, সভায় আমাদের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নেই ঠিকই, কিন্তু আমাদের সমর্থন করবে জানিয়ে কংগ্রেস দু’দুটো চিঠি দিচ্ছে। আমরা আপনাকে অনুরোধ করব সেই চিঠি পাওয়ামাত্র আপনি আমাদের সরকার গড়তে ডাকুন।” রাষ্ট্রপতি এতেও রাজি হয়ে গেলেন। “বেলা দেড়টা নাগাদ প্রেসিডেন্টের ওখান থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সমর্থনের আশ্বাস জানিয়ে কংগ্রেসের চিঠি এল অস্বাভাবিক দেরিতে। রাষ্ট্রপতির কাছে সে চিঠি যখন পৌঁছে দেওয়া হল, ঘড়িতে তখন চারটে বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। এত দেরি দেখে তিনি ইতিমধ্যে, বি. জে. পি-কে সরকার গড়তে ডেকে ফেলেছেন।
“ব্যাপারটা চরম নাটকীয় সন্দেহ নেই”, বসুর মন্তব্য। “তবে আমি রাষ্ট্রপতিকে কোনও দোষ দিতে চাই না। পরিস্থিতির চাপেই তিনি এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।” এর ফলেই বি. জে. পি. অবশেষে সরকার গঠন করল এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ইতিহাসের হ্রস্বতম মেয়াদ কাটিয়ে এক পক্ষকালের মধ্যেই উচ্ছেদের অপমান হজম করে প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীকে সরে যেতে হল। অতঃপর প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবেগৌড়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এল যুক্তফ্রন্ট সরকার।
এই বিরাট রাজনৈতিক ভ্রান্তি’ (বসু এভাবেই গোটা ব্যাপারটা ভাবতে ভালবাসেন সম্পর্কে বসুর বক্তব্য কিন্তু অসম্ভব চাঁছাছোলা। “আপনার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে এবং সরকারে যোগদানের বিষয়ে আপনার দলের এই মনোভাবের কারণ কি?”—এই প্রশ্নের উত্তরে বসু বললেন, “আপাতদৃষ্টিতে আমার তো মনে হয় সঠিক রাজনৈতিক বোধের অভাবটাই এর কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠরা আমাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা দেখেনি, তাই ওই পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। দলে এ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত যে ভুল ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই”–বসুর স্পষ্ট জবাব। “এ এক ঐতিহাসিক ভুল”—সঙ্কটের মুহূর্তে পরিস্থিতি বিচার করে তিনি যে কর্তব্য স্থির করেছিলেন, দল তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি।—”আর সেই কারণেই তো শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটির পথে যেতে হল, এটা তো অস্বীকার করতে পারি না।”—বললেন বসু।
বসুর ধারণা ছিল, মোরারজি দেশাইয়ের সরকারকে সমর্থন না জানানোয় মানুষ যেমন তাঁদের দায়ী করে এসেছে, তেমনই সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় জনগণ তাঁদেরই দুষবে। মোরারজি-পর্বের ইতিহাস তাঁর স্পষ্ট মনে আছে— “আমি তখন বুখারেস্টে ছুটি কাটাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের ফোনটা যখন এল তখন আমি সমুদ্রের ধারে। তিনি বললেন, ‘তাঁর সরকার গভীর সঙ্কটে, আমি যেন এক্ষুণি দেশে ফিরে আসি’। সচরাচর আমি যখন বিদেশে থাকি, নেহাত সাংঘাতিক কিছু না হলে ঘরের ব্যাপারে মাথা ঘামানো আমার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু সে মুহূর্তে আমার মনে হল, প্রয়োজনীয় গরিষ্ঠতা না থাকায় মোরারজি সরকারের পতন হয়তো অবধারিত, কিন্তু আমাদের সমর্থন তুলে নেওয়ার যে কোনও প্রয়োজন ছিল, তা-ও নয়। কিন্তু আমি দেশে ফেরার আগেই দল মোরারজির পাশে না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এবং একটা বিরাট ভুল করে বসেছে। কিন্তু সেবারেও আমি ছিলাম ‘মাইনরিটি’…আর ইন্দিরা, যিনি রাজনীতিতে কখনও নৈতিকতার ধার ধারতেন না, তিনি নতুন সরকারকে সমর্থন জানালেন। কিন্তু মোরারজি সরকারের পতনের জন্য আমাদের দলকেই দায়ী করা হল, আর দলের এই সিদ্ধান্তে আখেরে ইন্দিরার ক্ষমতায় আসার পথটা পরিষ্কার হয়ে গেল, সেটাও আমাদের ভুল হয়েছিল”, বিষণ্ণ গলায় বললেন বসু।
দীর্ঘ দু’দশক ধরে একটি কমিউনিস্ট সরকার পরিচালনার বিরল অভিজ্ঞতা বসুর আছে। ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের নানা শরিককে এক সূতোয় বেঁধে রাখার কৃতিত্বও তাঁরই। স্বাভাবিক কারণেই তাঁকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কৌতূহল। প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করতে এ হেন বসুকে জোরাজুরি করা হলে তাঁর মনোভাব কি হবে, সেটাও নিশ্চয়ই সবাই জানতে চাইবেন। আসল কথা, প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য তিনি কোনও কালেই লালায়িত ছিলেন না। এ প্রশ্নের উত্তরে বার বার বলেছেন—”মাথা খারাপ না কি? দেখো, যে কেউ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারে, এর জন্য আবার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার দরকার কি? ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীদের নামের তালিকা পড়লেই আমার কথাটা যে সত্যি তা বোঝা যাবে—প্লেন চালাতে চালাতে এসেও দেশ চালানো যায়!”—এ রকম আরও কত কথা! নির্বাচনের ঠিক আগে লন্ডনের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে বসু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা এক কথায় খারিজ করে দিয়েছিলেন। গার্ডিয়ানের ঐ সাংবাদিক পরে এই জীবনীকারকে বলেছিলেন, “এ জাতীয় প্রশ্নে সকলেই সাধারণত একটা গতানুগতিকভাবে ‘না-না’ বলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে আমিও আপনার সঙ্গে একমত—বসু তাঁর মনের কথাটাই বলেছেন। বিষয়টা আসলে বসুর ‘প্রোবিটিই (সততা) তাঁকে এতটা এগিয়ে দিয়েছে।” তাহলে প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর নাম প্রস্তাবিত হলে কেন তিনি তা গ্রহণ করতে রাজি হয়েছিলেন?—”দেশের জন্য”, “সাম্প্রদায়িক সরকার ঠেকানোর জন্য”, “এতে দেশের উপকার হত”। দেশেরও বহু মানুষের বিশ্বাস জোট সরকার পরিচালনায় বসুর যে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং সরকার ও দলীয় রাজনীতিতে তাঁর যে অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব তাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বের ভার নিলে তাঁর দল ও দেশ দুইই লাভবান হত। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে, যদি বসু ভারতের ভাগ্যবিধাতা হতেন, তাহলে একটি ক্ষুদ্র আঞ্চলিক দলের তকমা ঝেড়ে ফেলে নিঃসন্দেহে সি. পি. এম. প্রকৃত অর্থেই জাতীয় দলে পরিণত হতে পারত। বাঙালীর কৃতিত্বের কথাও বাঙালীরা তুলেছেন। তবে বিষয়টা ‘বাঙালীয়ানা’ বা বাঙালীত্বের জয়ের নয়, কারণ বসুর গ্রহণযোগ্যতা বহু আগেই পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়েছে। সম্ভবত এই কারণেই বোম্বেতে ট্যাকসি ড্রাইভারকে বলতে শুনেছি ‘বাসুজি ইমানদার আদমি হ্যায়, আচ্ছা সে দেশ চালা লেতা’। শুনেছি দিল্লীর অটো রিক্শাচালকের মুখে ‘জ্যোতিবাসুজি পরধানমন্ত্রী হোতা তো সহি হোতা, উনকা জাতপাত বা বিচার আচ্ছা হ্যায়’। ভি. পি. সিং তো প্রকাশ্যেই বসুকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন, “ভারতের জনমানসে জ্যোতিবাবু এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। রাজ্যস্তরে একটি শরিকি জোটের নেতা হিসেবে পরপর পাঁচবার ক্ষমতায় এসে ঐক্যমত স্থাপন করে তিনি নিজের অসমান্য দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন।”
জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী না হওয়া এবং সি. পি. আই. (এম) দলের সরকারে যোগদানের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না বেঠিক ছিল তা একমাত্র ইতিহাসই বলবে। শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। বসু অবশ্য বললেন, “আমি কমরেডদের বললাম, রাজনৈতিক কারণ যাই হোক না কেন, শরীরের দিক থেকে তোমরা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছ। এটা তোমরা ভালই করেছ।”
২
১৬ই মে সকালবেলা বসু রাজ্যসরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান নিয়ে খানিকক্ষণ রাজ্যের মুখ্যসচিবের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন। আগামী ২০শে মে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ঐতিহাসিক পঞ্চমবার। রাজ্যের আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। সারা দিন ধরে অজস্র ফোন আসছে, অভিনন্দনের পর অভিনন্দন। দেশ বিদেশ থেকে সকলেই জানতে চাইছেন কেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন না। বার বার সেই একই কথা। বসু বললেন “এরা একটা সামান্য কথা বোঝেন না, এটা তো আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়। পার্টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠরা চান নি, তাই আমি হইনি, এটা পার্টির সিদ্ধান্ত, আর আমাদের পার্টিতে পার্টির সিদ্ধান্তই শেষ কথা।” সন্ধ্যেবেলা গেলেন আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে পার্টি অফিসে, কমরেডদের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহারই করলেন, যদিও বোঝা যাচ্ছিল অন্যদিনের তুলনায় সেদিন উনি যেন একটু বেশি চুপচাপ। কমরেডদের সঙ্গে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আলাপ আলোচনা করলেন, ১৭ই মে রাজ্য কমিটির মিটিং, সেই মিটিং-এর এজেন্ডা নিয়েও কথাবার্তা হল।
২০শে মে এসে গেল। রাজভবনের প্রাঙ্গনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। দিল্লীর ব্যাপারটা তখন মন থেকে ‘সুইচ অফ’ করার চেষ্টা চলছে। অসম্ভব গরম ছিল সেদিন। ঝলমলে হলুদ সার্টিনের ঢেউ খেলানো বাহারি পর্দার সামনে লাল ভেলভেটের সিংহাসনের মত উঁচু চেয়ারে বসে আছেন জ্যোতি বসু। পঞ্চমবারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। ভীষণ গরমে ঈষৎ ক্লান্ত অথচ প্রসন্ন মুখচ্ছবি। আগের দিন বললেন, “আমার মন খারাপ, নাতনীরা এখানে নেই, ওরা থাকবে না এই অনুষ্ঠানে আমার ভাল লাগছে না।” ২১শে মে দিল্লীর যুক্তফ্রন্ট থেকে জরুরী আমন্ত্রণ। নতুন সরকারকে পরামর্শ দেবার জন্য স্টিয়ারিং কমিটি গড়া হবে, বসুকে যেতেই হবে। দিল্লী থেকে বসু ফিরলেন ২৪ তারিখে। ২৭ তারিখে আর একটা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, এবার খোলা জায়গায় রোদের আঁচে নয়, ভেতরে ঠাণ্ডা বাতাবরণে। ২৮ তারিখে হল পঞ্চম বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং। বসুকে দিল্লী যেতে হল আরও কয়েকবার, বেশ ঘন ঘন। “আমি কি করে অনবরত দিল্লী কলকাতা করি? আমাকে সব কমিটিতে রাখবেন না।”—বসু অনুরোধ জানালেন।
সি. পি. আই. (এম)-এর সরকারে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা গণমাধ্যমে অব্যাহত রইল। ফ্রন্টের অন্যান্য সদস্যরা তখনও আশা করছেন, সি. পি. আই. (এম) হয়তো সিদ্ধান্ত বদল করবে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সি. পি. আই. সরকারে যোগদান করার সিদ্ধান্ত নিল। তাতে ফ্রন্টের সদস্যরা আরও আশান্বিত হয়ে উঠলেন। লালুপ্রসাদ যাদব, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, সি. পি. আই. (এম) এক মাসের মধ্যে সরকারে যোগ দেবে। এমনকি ভি. পি. সিংও এ ব্যাপারে বেশ আশাবাদী মন্তব্য করলেন। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু বললেন, “সি. পি. আই. (এম) নেতারা একই মঞ্চে সমস্ত অসাম্প্রদায়িক শক্তি জড় করতে সফল হয়েছে, এদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’
অতীত নিয়ে বাড়াবাড়ি করা বসুর স্বভাবে নেই। পঞ্চমবার রাজ্যে ক্ষমতায় ফিরলেন। সামনে অনেক কাজ। যে সব জায়গায় নিজের পার্টির দুর্বলতা গত নির্বাচনে ধরা পড়েছে, সে সব জায়গার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। তার চেয়ে বড় সমস্যা কেন্দ্রে। যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন করা এবং ন্যূনতম কর্মসূচী রূপায়ণে তারা ভুল পদক্ষেপ নিলে সেটার সমালোচনা করা। এ প্রসঙ্গে বসু বললেন, “আমাদের যেমন বহুদলীয় জোট নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, যুক্তফ্রন্টের সেটা নেই। তাছাড়া ১৩ দলের জোট, একটা চরম পরীক্ষা তো বটেই। সব বিষয়ে হয়তো একমত হওয়া সব সময় সম্ভব নয় তবে অনেক বিষয়ে একমত হওয়া অবশ্যই যায়। আমাদের নীতি হবে এই সরকারকে একই সঙ্গে সমালোচনা এবং সমর্থন করার। এবং আমরা চাই এই সরকার স্থায়ী হোক। যদি এই সরকার কংগ্রেসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, তাহলে এরা বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আমাদের সঙ্গে অনেক অর্থনৈতিক, সামাজিক বিষয়ে হয়তো মিলবে না কিন্তু এখন আমাদের প্রথম লক্ষ্য হল বি. জে. পি-কে ঠেকানো।”
যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পর গড়া হল স্টিয়ারিং কমিটি। তৈরি হল ১৩টা দলের ন্যূনতম কর্মসূচী। সি. পি. আই. (এম)-এর অবস্থান হল বেশ জটিল কারণ এরা যুক্তফ্রন্ট সরকারকে যে কোন উপায়েই হোক সম্পূর্ণ সমর্থন করবে আবার কর্মসূচী রূপায়ণে ভুলভ্রান্তি হলে এই সরকারকে সমালোচনা করতেও ছাড়বে না। “কেন্দ্রের জনতা সরকারেরও এই ধরনের কর্মসূচী ছিল না, ছিল না পরামর্শ দেওয়ার জন্য এই রকম কোনও স্টিয়ারিং কমিটি। সেদিক থেকে এই যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিনবত্ব আছে বই কি!—মন্তব্য করলেন বসু, “যাই হোক, আমার কথা হল যুক্তফ্রন্ট সরকারের স্থায়িত্ব আমরা চাই, আবার এও চাই যে বামদলগুলি আলাদাভাবে নিজেদের ঐক্য বজায় রাখুক।”