১৩. সংকর্ষণ-২ : প্লেনে

১৩. সংকর্ষণ-২ : প্লেনে

জিনা এত জোর করল, যে আমি আগেই চলে এলাম। সারাটা জীবন আমি এইভাবে জিনার জোর-জুলুমের কাছে নতিস্বীকার করে চলেছি। জিনা মেয়ে খারাপ নয়, তার উদ্দেশ্য অসাধু নয়, শুধু তার কালচারাল ওরিয়েন্টশনটা একেবারে আলাদা। এবং এত বছরের মধ্যেও জিনা একবারও চেষ্টা করল না আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু পরিবারের চরিত্রটাকে বুঝতে, চিনতে। আমাকেই বা কতটুকু চেনে ও? আমার একটা বিপুল অংশই তো ওর অজানা, অচেনা। জিনা যতটুকু সংকর্ষণকে চেনে, সেটা শুধু tip of the iceberg—সেটা ওর গড়ে নেওয়া সংকর্ষণ—সেটা বম্বের অ্যাড ওয়ার্লডের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক সংকর্ষণ চ্যাটার্জি।

মহিম হালদার লেনের সংকুকে ও কোনওদিনই চেনবার চেষ্টা করেনি, আমার মা-বাবা-বোনেদের না চিনলে সেই আমি-টার খোঁজ পাবে ও কেমন করে? জিনা, আমার মা-বাবাকেও চিনত না। সেখানেই তো ক্ষতির শেষ নয়, ও আমাদের মেয়েকেও আগলে রেখেছে। চিনতে দেয়নি তার ঠাকুরদা-ঠাকুমাকে। শ্রাদ্ধেও আসতে দিল না। নিজের মায়ের কাছে রেখে এল মেয়েকে।

আমিও কি চেষ্টা করেছি।

আমার কি উচিত ছিল না চেষ্টা করা?

আমি শান্তিপ্রিয়। যাতে কাজের বিঘ্ন হয় সেটা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। এসকেপিস্ট? হয়তো। জিনাকে তুষ্ট রাখলে সংসারে শান্তি থাকে। মানে, চমৎকার ডিসিপ্লিন থাকে। জিনা অত্যন্ত সুগৃহিণী—আমার কাছে সেইসব দৈনন্দিন সুবিধেগুলি খুব জরুরি। আরাম, সুবিধা ছোটবেলায় যেগুলো জীবনে ছিল না, উচ্চাশার ফলস্বরূপ এইসব জালে পা দিয়ে ফেলেছি, এখানে একবার পা পড়লে আর রক্ষে নেই। জাল বলব না, বরং চোরাবালি বলাই ভালো। জাল কেটেও বেরুনো যায়। চোরাবালিতে একবার পা পড়ে গেলে ডুবে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। আমি এখন সেই ডুবো-বালির চড়ায় আটকে আছি। চাকরিতে যত উন্নতি হচ্ছে, জিনারও প্রতিপত্তি ততই বাড়ছে, ঘরকে স্বর্গ বানাচ্ছে সে। যাতে আমার মন বাইরে চলে না যায়।

কাজেকর্মে উন্নতি করলে পুরষদের আর পুরাতনী পত্নীতে মন বসে না, মন উঁড়ু উঁড়ু, পায়ে বেড়ি বলে মনে হয়। এ সত্য তত্বটি সে ভালোরকম জানে। এবং তার প্রতিষেধক সবরকম ব্যবস্থাই সে গ্রহণ করে।

আমাকে চোখে চোখে রাখা, আমাকে যারপরনাই আরামে রাখা, নিয়মিত জিম করে, ব্যায়াম করে জিনা নিজের শরীরটাতেও যুবতির শক্ত বাঁধুনি ধরে রেখেছে, সুন্দরী তো সে ছিলই, এখনও নিত্য নতুন পোশাকে নজর, নিত্য নতুন গয়না, নতুন নতুন হেয়ারস্টাইল—আমি অ্যাড-ম্যান—আমার সবই নজরে পড়ে। সবই বুঝতে পারি। আমার মায়া হয়। আমি যে সংসার ভেঙে কোনওদিনই চলে যাব না কোথাও, তার কারণ তৃণা। জিনা তার মেয়ের নাম দিল ক্যাট্রিনা—আমি দিলাম তৃণা। এইভাবেই আমি সর্বক্ষণ ওর সঙ্গে কমপ্রাোমাইজ করে চলি। কিন্তু তৃণা ওই ক্যাট্রিনা হয়েই বড় হচ্ছে। ওকে তৃণা করতে পারিনি আমি।

জিনা আমার মা-বাবাকে চিনল না, তৃণাকেও চিনতে দিল না। মা-বাবা যে দরিদ্র, এটাই জিনার কাছে তাদের প্রধান এবং একমাত্র পরিচয়। ওরা সাধারণ দরিদ্র মধ্যবিত্ত, বরং হয়তো নিম্নবিত্তের দিকেই—আমি জিনার কাছে মিথ্যে বলিনি। প্রথমে বলতে শুরু করেছিলাম আমার কথা—আমাদের কথা। কিন্তু যেই বুঝলাম জিনা জানতে চায় না, জিনার আগ্রহ নেই, জিনা আমার পরিবারের প্রতি কোনও সম্মান পোষণ করে না, যদিও তারাই আমাকে তৈরি করেছে—তখন থেকে ওকে আর কিছু বলি না।

বলার ছিলই বা কী?

আমার মা খুব মমতাময়ী, খুব পরিশ্রমী, আত্মত্যাগী মহিলা ছিলেন? আমার বাবাও খুবই পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের মানুষ করেছেন। আমাদের নিজের বলতে কিছুই ছিল না—সোনাদানা নয়, জমিজমা নয়, শুধু একগুচ্ছ অবিচ্ছেদ্য সুনীতি, আর গরিব, গোপন, নিতল এক ইঁদারা ভরতি ভালোবাসা। যার কোনও প্রকাশ ছিল না বাইরে। ফল্গুধারার মতো অন্ত:সলিলা সেই মমতা। জিনার পক্ষে বোঝা অসম্ভব। ওদের বাড়িতে ওদের পরিবারের মধ্যে বহি:প্রকাশ ব্যাপারটা অতীব মূল্যবান। ডিয়ারেস্ট, ডালিং ছাড়া সম্বোধন নেই। কথায় কথায় আলিঙ্গন, কথায় কথায় চুম্বন। ওদের বহিরঙ্গটা অত্যন্ত জরুরি—ঘরদোর গোছানো, বাসনকোসনের মহার্ঘতা, আসবাবপত্রের স্টাইল, এইসব দিয়ে জিনা মানুষের মূল্য মাপে। আমাদের সংসার ওকে এনে রাখিনি কোনওদিন। বিয়ের পরে দুজনে এসে হোটেলে উঠেছিলাম। মা-বাবাকে, মিতু-তিতুকে সেইখানেই এনে জিনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। জিনা স্বচক্ষে মহিম হালদার লেনের বাড়ি দেখলে, ওর সঙ্গে আর আমার বিয়েটা টিকত না।

কে জানে হয়তো ভালোই হত।

কিন্তু তখন তো উদ্দাম প্রণয়। জিনার মতো সুন্দরী, ফ্যাশনদুরস্ত যুবতি আমাকে চাইছে, এতেই আমি ধন্য, কৃতকৃতার্থ।

জিনা মেয়ে অবশ্য ভালো। বাবা-মাকে অর্থ সাহায্য করায় তার কোনওদিন আপত্তি ছিল না। মাকে ভালো দেখে একটা ওলড এজ হোমে রাখার পরামর্শও তারই। আমরা তো মা’র কথা শুনে তাঁকে আরেকটু হলেই ঠাকুমার বৃন্দাবনযাত্রার মতোই কাশীতে পাঠিয়ে দিচ্ছিলাম। আমরা বড় বেশি বাধ্য ছেলেমেয়ে। মা যা বলেন, তার অন্যথা করার কথা ভাবতেও পারি না। যদি বা সেটা তাঁর নিজের পক্ষে মঙ্গলময় না-ও হয়। কিন্তু জিনা পারে। জিনার কাছে বাস্তব সুবিধা-অসুবিধার চেয়ে গুরত্বপূর্ণ আর কিছুই নয়। আর আমাদের বাল্যকাল কেটেছে ঠিক ওইটেকেই ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে। সবরকমের বাস্তব অসুবিধাকে আমরা অগ্রাহ্য করতে শিখে গিয়েছিলাম বলেই আমাদের পক্ষে জীবনধারণ, জীবনযাপন, জীবনগঠন সম্ভবপর হয়েছিল।

আমার না ছিল একটা পড়ার ঘর, না ছিল একটা শোবার ঘর। কিন্তু তাতে পড়াশুনোও আটকে থাকেনি, অনিদ্রাতেও ভুগতে হয়নি। নীলু আর আমি একসঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়তাম। আমরা বন্ধুও ছিলাম, প্রতিদ্বন্দ্বীও বটে। দুজন দুজনকে আপ্রাণ সাহায্য করতাম, এবং চেষ্টা করতাম হারিয়ে দিতে। এতে দুজনেরই উপকার হত। ফাইনালে দুজনেই স্টার পেলাম, জয়েন্ট দুজনেই র‌্যাংক পেলাম যাদবপুরে ভরতি হবার মতো। নীলু এখন অবশ্য আমেরিকায় থাকে—আমার সঙ্গে নিয়মিত ই-মেইলে যোগাযোগ আছে। নীলুরা আমেরিকায় থাকে বটে, কিন্তু বাঙালি বউ নিয়ে দিব্যি ডালে-ঝোলে-অম্বলে, রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা করে কাটাচ্ছে। আমি দেশে থেকেও বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, হাজার হাজার মাইল দূরে এক দ্বীপে বাস করি। নীলু এসেছিল বম্বেতে, জিনাকে-আমাকে-তৃণাকে ডিনার খাওয়াল তাজে। জিনাও ওদের ডেকেছিল বাড়িতে, পার্শি রান্না খাইয়ে দিল। এরকম NRI বন্ধুবান্ধব জিনার পছন্দ। কিন্তু নীলুদের সদানন্দ রোডের বাড়িতে জিনাকে যদি নিয়ে যেতাম? ও-বাড়িতে পদাপর্ণও করতে পারত না জিনা। বাড়ির সামনেই একটা পেঁপে গাছের নীচে একগাদা ময়লা-আবর্জনা-এঁটোকাঁটা জড়ো করে রাখত পাড়ার লোকজন। নীলুর দিদিটা খুব সুন্দর কীর্তন গাইতে পারত, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী ছিল। অল্প বয়েসেই বিয়ে হয়ে কোথায় যেন চলে গেল। মিতুলও গান গাইত। গানের গলা খুব ভালো ছিল মিতুর। কিন্তু গানের স্কুলে দিতে পারেননি ওকে বাবা—বাবার অজস্র টিউশনি সত্বেও সেই মাইনেটুকু জোটাতে পারেননি। তবুও মিতু গান শিখত। রেডিও থেকে। আমাদের একটা রেডিও ছিল। আনন্দের যা কিছু খোরাক সব জোগাত ওই রেডিও। রেডিওতে ‘অনুরোধের আসরে’ হত বাংলা গান, আর রেডিও সিলোনে হিন্দি ফিল্মের গান—দুপুরবেলা, সন্ধ্যাবেলা নাটক হত, বাংলায় খবর পড়তেন নীলিমা সান্যাল, আর বিভূতি দাস, সুরজিৎ সেন ইংরিজিতে। বেলাদির মহিলামহল, দিদিভাই ইন্দিরাদির মিষ্টি গলায় ছোটদের আসর—গল্পদাদুর আসর—কত কী! রেডিওটাই আমাদের সংসারে এন্টারটেইনমেন্টের উৎস ছিল। মা-ও শুনতেন, দিনে তিনবার রবীন্দ্রসঙ্গীত। বাবা শুনতেন খবর। রবিবার সকালে সঙ্গীতশিক্ষার আসরে মিতু-তিতু গান শিখত। তিতু সুন্দর হিন্দি গান গাইত, মা যদিও পছন্দ করত না।—মিতুল লক্ষ্মীমেয়ের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে মাকে খুশি করত।

মিতুর গানের সঙ্গে ছোট্ট তিতলি কী সুন্দর নাচত। নিজে নিজে কমপোজ করে বানিয়ে-বানিয়ে আপনমনে নাচত মেয়েটা। ওর অঙ্গেপ্রত্যঙ্গে নাচ ছিল। লেখাপড়াতে ভালো ছিল দুজনেই। জীবনে দাঁড়িয়ে গেছে। কিছু অভিযোগ নেই জীবনের কাছে। কিন্তু আরেকটু যত্ন, আরেকটু সুযোগ ওরা পেতে পারত যদি—অনেক বেশি প্রস্ফুটিত হত তাদের গুণগুলো। কিন্তু দোষ দেব কাকে? আওয়ার পেরেন্টস ডিড দেয়ার বেস্ট। এর চেয়ে ভালো মা-বাবা কারুর জোটে না। ওদের আর্থিক সঙ্গতি ছিল না বটে, কিন্তু অন্তরের দৈন্য ছিল না। দে হ্যাভ এনরিচড আস ইন দেয়ার ঔন ওয়েজ।

.

ম্যানেজমেন্ট পড়াবার সময়ে একদিন একটা ছোট্ট জিনিস বলেছিলেন প্রফেসর চক্রবর্তী। আমার মাথায় সেটা প্রায়ই ঘোরে। উনি বলেছিলেন, বেশির ভাগ মানুষই জানে না সে কী চায়। আর যদিও বা জানে, তারা জানে না সেটা কেমন করে চাইতে হয়।

‘উই ডোন্ট নো হোয়াট উই ডিজায়র, অ্যান্ড দেন, ইভন ইফ উঁই ডু, উই ডোন্ট নো হাউ টু ফলো আওয়ার ডিজায়ার।’

আমার খুব মনে ধরেছিল কথাটা। তক্ষুনি প্রফেসর চক্রবর্তীকে জিগ্যেস করেছিলাম, ‘হাউ ডাজ ওয়ান ফলো ওয়ান’স ডিজায়ার?’

‘তিনটে জিনিস জরুরি,’ তিনি বলেছিলেন,—’প্রথম, চিনে নিতে হবে তোমার বাসনা কী। তারপর জানতে হবে ওই বাসনা কেন? বাসনার উদ্দেশ্য কী? তোমার চোখে কোনও স্বপ্ন আছে কিন? যদি স্বপ্ন থাকে, তাহলে বাসনা পূরণের জন্য চেষ্টাও থাকবে। যদি চেষ্টা থাকে, সাহসও থাকবে।

চেষ্টা মানে লেগে-থাকা। নাছোড়া হতে হবে। নইলে বাসনা পূরণ হবে না। স্বপ্ন সত্যি হবে না। সমানে লেগে থাকলেই হবে। ধৈর্য চাই। ওরে মন হবেই হবে। কোনও স্বপ্নই এত দুর্বল নয় যে অর্থের অভাবে সফল হল না—লেগে থাকলে, টাকাকড়ি সব আপনি এসে যাবে।

বাসনার পিছনে একটা স্বপ্ন থাকা চাই। স্বপ্নের পিছনে নাছোড় লেগে থাকা চাই। আর লেগে-থাকার জন্যে চাই সাহস। ব্যস—এই চারটে জিনিসই মানুষের আসল সম্পদ। এরাই মানুষের অন্তরিন শক্তির উৎস, সক্ষমতার ফরমুলা। বাসনা, স্বপ্ন, নাছোড় লেগে থাকা, আর নির্ভীক আত্মবিশ্বাস—যার অন্য নাম সাহস।’

আমি জীবনে আজ যেখানে পৌঁছেছি সেখানে পৌঁছুতে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে প্রফেসর চক্রবর্তীর সেই একদিনের কয়েকটা কথা।

কী বাসনা?

কেন বাসনা, কোন স্বপ্নের জন্য বাসনা?

নাছোড় লেগে থাকা থাকতে হবে—যখন মনে হচ্ছে তীরে এসে তরি ডুবল বলে—তখনও ছেড়ে দিলে চলবে না—ওই ডুবো নৌকোও ভেসে উঠে ঠিক তীরে গিয়ে ঠেকবে। সেই নির্ভীক আত্মবিশ্বাস থাকা চাই। তাহলেই লেগে থাকতে পারবে। লেগে থাকলেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। স্বপ্ন সত্যি মানেই বাসনা পূরণ।

এইভাবে মনে মনে অঙ্ক কষে নিয়েছিলাম। জীবনে অনেকবার কাজে দিয়েছে প্রফেসর চক্রবর্তীর এই ফরমুলা।

এখনও দিল।

আমি কী চাই?

আমি চাই আমার অতি স্নেহের সহোদরা বোনেদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে —আমি চাই ওদের সঙ্গে একসঙ্গে মায়ের অশৌচভঙ্গ করতে—চাই ছোটবেলার কথা স্মরণ করতে, চাই বাবা-মায়ের কথা বলবলি করতে। আমাদের তিনজনের চেয়ে আপন আর তো কেউ নেই। আচ্ছা, আমাদের বাবা-মায়ের স্বপ্ন কী ছিল?

তাঁদের বাসনা কী ছিল? তাঁরা কীভাবে সেই স্বপ্ন, সেই বাসনাকে ধাওয়া করেছিলেন? তাঁদের তো আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখিনি কখনও—আমারাই যদি হই তাঁদের সেই স্বপ্ন, সেই বাসনা, তবে তো পূরণ হয়েছে সেই বাসনা। বাস্তবায়িত হয়েছে সেই স্বপ্ন। দিবারাত্রের অমানুষিক পরিশ্রমের নাছোড় শ্রমের সুফল ফলেছে। দেড়খানা ঘরের মধ্যে বসে, সন্তানদের জন্য যে বিপুল বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা—তার জন্যে চাই অনন্ত দু:সাহস আর অটুট আত্মবিশ্বাস। ওই মন্ত্র তবে তাঁদেরও ইষ্টমন্ত্র ছিল?

.

প্লেনে উঠলেই জিনা ঘুমিয়ে পড়ে, আর প্লেনে বসে বসে আমার নানারকমের সত্য দর্শন হয়। ভাগ্যিস সঙ্গে কাজ আনিনি। সঙ্গে ল্যাপটপটা থাকলেই অফিস চলে আসত। আর এত সব ভাবনাচিন্তার সময় হত না। জিনার সিন্ধান্তই ফাইনাল হত।

বাবা-মাকে এইভাবে ভেবে দেখিনি আগে কখনও। আজই মনে হল। হঠাৎ। তৃণার জন্য কি এত বড় করে স্বপ্ন দেখি আমরা? এত খাঁটি? নাকি আমাদের বাসনার লক্ষ্য ছোট হয়ে গেছে? গুটিয়ে গেছে, গ্লোবাল ভিলেজের বিস্তারের দরুন? ওদের স্বপ্ন ওরাই দেখে, আমাদের স্বপ্ন আমরা।

.

মিতু আছে তার শ্বশুরবাড়িতে। মায়ের জন্যে কেনা ফ্ল্যাটে তিতলি একা। মাকে ও-বাড়িতে নিতে পারল না বলে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়েছে। এই পৃথিবীতে একটা প্রায়-চল্লিশ মেয়ের একা-একা শুধু চাকরিটুকু অবলম্বন করে বেঁচে থাকা বেশ কঠিন। ইমোশনাল সার্পোটও তো লাগে! তবু মা’র কাছে থাকলে, সেটা পেত। কিন্তু এখন তো তিতু একদম একলা।

তিতু মিশুক মেয়ে, হাসিখুশি হুল্লোড় করতে ভালোবাসে—শি লাইকস কম্পানি—ব্যাচেলর লাইফ ওর ভালো লাগার কথা নয়। বাট নট অর্জুন চন্দ্র আগেইন। নো। বড্ড কষ্ট দিয়েছে আমার বোনটাকে, বড্ড অপমান করেছে। ওকে বড্ড বিশ্বাস করেছিলাম আমরা। আজ অনেকদিন পরে এমনভাবে, এতক্ষণ ধরে আমি আমার বোনেদের কথা, আমার মা-বাবার কথা ভাবছি।

কলকাতা ডাজ দিস টু মি। ব্রিংস মি ব্যাক টু মাইসেলফ।

ব্রিংস মি হোম।

বম্বে কুড নেভার বিকাম মাই হোম। ইটস স্টিল মাই ওয়ার্ক প্লেস।

আজকে আমার ফিরে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। জিনা যেত, যেত। একাই যেত। আমার উচিত তিতলির সঙ্গে একত্রে ‘মৎস্যমুখী’র রিচুয়ালটির শেয়ার করা। মিতু রইল ওর পাশে—বাচ্চাদের কাছে জার্মানিতে না ফিরে গিয়ে—যদিও ওর অশৌচভঙ্গ নয়—আর আমিই ছুটলাম বম্বেতে, সাত তাড়াতাড়ি চাকরিতে জয়েন করবার অজুহাতে।

আত্মীয়স্বজন যাঁরা মৎস্যমুখীতে আসবেন, তাঁরা দেখবেন মায়ের জন্য ছেলের সময় নেই। শুধু মেয়েদেরই আছে। কথাটা তো মিথ্যেও নয়।

জিনা প্লেনে উঠেই ঘুমিয়ে পড়ে। খাবার দিতে এলেও ওঠে না। আর আমার প্লেনেই যত চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে মাথার ভেতরে। এখন যেমন। জিনা পাশে বসে ঘুমিয়ে কাদা। আমি চেষ্টা করছি মনটাকে পরিচ্ছন্ন করে নিতে, ভাবনাগুলোকে খোলসা করে নিতে। আমি কি সত্যিই থাকতে চাই? আমি কি বম্বে যেতে চাইছি না?

 বেশ, আমি যদি ‘মৎসমুখী’-তে থাকতেই চাই, তাহলে তো সেটা এখনও পারি। ‘মৎসমুখী’ হচ্ছে পরশুদিন। গরম প্রচণ্ড, তাই দুপুরে নয়, রাত্রেই খাওয়া। বারটা শনিবার পড়েছে, ভালোই হয়েছে। পরের দিন অফিস নেই। ইশকুল-কলেজ নেই। আমি কাল সন্ধ্যার ফ্লাইটেই চলে আসব আবার। রবিবার ফিরব।

খরচ হবে?

তা হোক।

একবারই তো। এই তো শেষবার।

জিনারও বোঝা দরকার। আমার ইমিডিয়েট পৈতৃক পরিবারে আমি একলা নই—আমরা তিনজন।

আমি আমার বোনেদের ভালোবাসি। আমাদের রিচুয়ালগুলিরও গুরুত্ব আছে। পার্শিদের রিচুয়ালগুলিকে তো জিনা প্রচণ্ড সম্ভ্রম দিয়ে থাকে।

আমি জিনাকে-তৃণাকে কিছুই জানাচ্ছি না। কিন্তু আমি নিজে তো অশৌচে আছি। ‘মৎস্যমুখী’-তে বোনেদের সঙ্গে একত্রেই অশৌচভঙ্গ করব আমিও। মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান। না, এটাই ঠিক সিদ্ধান্ত। আমি ফিরেই যাব। কালই। টুমরো’জ ইভনিং ফ্লাইট শুড বি ফাইন। শুড আই কল দেম? তিতু-মিতুকে কি জানিয়ে দেব যে আমি আসছি? না সারপ্রাইজ দেব?

কাল আর গেস্ট হাউসে নয়, তিতুর কাছেই উঠব। অন্তত একটা রাত তো কাটিয়ে আসি ওর নতুন ফ্ল্যাটে। তিতু খুশি হবে।

—এবার একটা নতুন পাতা ওলটানো হোক জিনার এবং আমার সুস্থ সংসারযাত্রার খাতায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *