১২. সংকর্ষণ-১ : দমদমের পথে
যাক, মায়ের কাজকর্ম ভালোয় ভালোয় মিটে গেল। তিতু-মিতু দুজনেরই প্রবল খাটনি গেছে। এত বড় ব্যাপার। যদিও মঠ থেকেই সবকিছু অর্গানাইজ করেছে, তবুও তো কাজ প্রচুর। মানুষদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ, যত্নআত্তি করা, আতিথেয়তা করা, জিনাও করেছে ওর সাধ্যমতো, কিন্তু ওর যে সাধ্যটাই খুব সীমিত। বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটাকে এবারে আনা উচিত ছিল। ঠাকুরদাদা ঠাকুমার শেষ কাজে পৌত্রীর উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। জিনা কী যে পাগলামি করে। আর আমিই বা কেন যে ওর সবরকম পাগলামি সহ্য করি! কেন মানি? এটা শান্তির জন্যে, নাকি পলায়নি বৃত্তি থেকে? আমার মেয়েটারই ক্ষতি হচ্ছে এতে সবচেয়ে বেশি। তৃণাকে খুব মিস করছিলাম। মিতুও ছেলেমেয়েদের আনেনি।—ওদের না হয় স্কুল খোলা, এবং থাকে ইয়োরোপে, আনার খরচ অনেক—কিন্তু বম্বে তো সাগরপারে নয়। তৃণার হাতেও সময়ও ছিল। সে নিজেই আসতে চায়নি। কলকাতা ওর ভালো লাগে না। আমার আত্মীয়স্বজনদের ওর বোরিং লাগে। হিন্দু রিচুয়ালস, ওর মায়ের কাছ থেকে ও শিখেছে, মানুষের মন ক্ষুদ্র করে দেয়। হিন্দু সংস্কৃতি বিষয়ে ওর মা নিজে তো কিছুই জানে না। মেয়েকেও অযথা বিরুদ্ধ মত শেখাচ্ছে। আমাদের শ্রাদ্ধের মন্ত্রের মতো মন্ত্র হয়?
দেহ থেকে আত্মাকে মুক্তি দিয়ে কোথায় কোন আলোর রাজ্যে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয়!
আমিও তো একদিন মরব। এবং জিনা কাট্রিনাকে আমার শ্রাদ্ধ করতে দেবে না। বেশ, তবে আমি উইলে লিখে যাব, আমার যদি ব্রাহ্মমতে শ্রাদ্ধ না হয়, আর আমার কন্যা যদি স্বয়ং সেটি না করে, তাহলে সম্পত্তি ওদের মা-মেয়ে নয়, সোজা মাদার টেরেসার কাছে চলে যাবে। ওদের আমার উত্তরাধিকার অর্জন করতে হবে। উইথ আ প্রাইস। রিচুয়ালসের প্রসঙ্গে ব্রাহ্ম মতটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। যে অন্তরঙ্গ উপাসনাটি হয় তাতে মন্ত্রগুলি সবই আছে, কিন্তু পিণ্ডি চটকানোর পর্ব নেই। উপরি পাওনা সুন্দর সুন্দর ব্রহ্মসঙ্গীত। মা’র শ্রাদ্ধ তো মঠ থেকে করা হল, আমাদের কিছু ভাবতে হয়নি। নিজেরা করলে, একটু অন্যভাবে করতাম হয়তো। ব্রাহ্ম মতে। একটু নিজের মতো করে। এও মন্দ নয়। মন্ত্রগুলি অসাধারণ। মহারাজ আমাকে সব বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সংস্কৃত বুঝি না শুনে।
সব হিন্দু রিচুয়ালস মানুষের মন ক্ষুদ্র করে কিনা জানি না—অন্তত শ্রাদ্ধশান্তির সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রগুলি তার বিপরীত কাজ করে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।
ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধব: ওঁ মধু মধু মধু….
এভাবে কোনও শ্রাদ্ধের শান্তি ভাবা যায়?
‘শ্রাদ্ধ’ শব্দাটাও কী সুন্দর। শ্রদ্ধা থেকে শ্রাদ্ধ।
‘তর্পণ’ শব্দটাও। তৃপ্তিসাধন থেকে তর্পণ।
পরলোকগত আত্মাকে শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। তারই তৃপ্তি সাধনের চেষ্টা করছি আমরা। এই তো আমাদের পারলৌকিক ক্রিয়া।
পিণ্ডদান ব্যাপারটা আমাদের যতই বিশ্রী লাগুক, আসলে তো সেই তৃপ্তিসাধনের প্রয়াস—কিছু উৎসর্গ করুন প্রিয়জনকে, এতে মন ক্ষুদ্র হবে কেন?
জিনার নিজেরই মনটা একেবারে চাবিবদ্ধ। তাতে কিছুই প্রবেশ করতে পারে না। তৃণাকে তেমনি করে ফেলছে। ওকে আটকাতে হবে, তৃণাকে মুক্তমনা হতে হবে, নইলে তার নিজেরই লোকসান। পৃথিবী মুক্তমনেরই সম্পত্তি।
কত পুরোনো লোকজনের সঙ্গে দেখা হল তিতলির কল্যাণে। শিবু এসেছিল। মেসোমশাই মাসিমাও এসেছিলেন। মাসিমা বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছেন। তবু এসেছিলেন শিবুর সঙ্গে। মেসোমশাই এখনও বাজার করেন শুনলাম। শুধু আমাদেরই মা-বাবা কত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন! অজস্র লোককে খবর দিয়েছিল বটে তিতু-মিতু! আমাদের ছোটবেলার সব লোকজনকে ধরে এনেছিল, পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজন, স্কুলকলেজের বন্ধুরা, পারেও বটে। আবার তো ডেকেছে ‘মৎসমুখী’-তে। সেদিন আমার থাকা হবে না—জিনার তাড়ার চোটে আজই ফিরে যাচ্ছি। মেয়েকে রেখে এসেছে। জিনা অস্থির হয়ে পড়ছে। অথচ এত করে বললাম, তৃণাকে নিয়ে যাই, কিছুতেই রাজি হল না মা-মেয়েতে।
.
আজকের ‘সারপ্রাইজ গেস্ট’ ছিল অর্জুন। সত্যিই ওর লজ্জাও করল না আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতে? তিতলিকে মুখ দেখাতে?
ওর চেহারাটা বিশেষ পালটায়নি। অথচ তিতলির জীবনের ওপর দিয়ে কত ঝড়ঝাপটা বয়ে গেল। এল কেমন করে আমাদের বাড়িতে? আমি একটাও কথা বলতে পারিনি ওর সঙ্গে। ওর মুখ দেখলে আমার গায়ে জ্বালা ধরছিল। ছি ছি! কী নির্লজ্জ ছেলে!
এবার তিতলিকে নিয়ে খুব ভাবনা হয়েছে। মিতুল আর অশোক ওদের সংসারে থিতু হয়েছে। ছেলেমেয়ে দুটো খুব মিষ্টি। আমি, জিনা, তৃণা যাহোক একটা পরিবার গড়েছি। তিতলিটাই একলা। শি হ্যাজ লেফট রাহুল। অথচ ওরই বিয়ে ঠিকঠাক ছিল মিতুলেরও আগে থেকে। ওই অর্জুনের সঙ্গে। ‘বেনে বউ বলে ওর বন্ধুরা ওকে খ্যাপাত। হঠাৎ অর্জুন বলা নেই কওয়া নেই একটা বড়লোক ব্যবসায়ী গুজরাটির মেয়েকে বিয়ে করে কেপটাউনে চলে গেল। পরে তিতলি ঠিকই করে ফেলেছিল ও কোনওদিন বিয়ে করবে না। এবার নিজের কেরিয়ার তৈরি করায় মনপ্রাণ সঁপে দেবে। সেই মর্মে জানিয়েও দিয়েছিল আমাদের। মা-বাবাকেও’ তোমরা কেউ আমার বিয়ের সম্বন্ধ করবে না—আমি বিয়ে করব না।
কলকাতায় এসে একবার লজ্জার মাথা খেয়ে গিয়েছিলাম অর্জুনদের বাড়িতে দেখলাম ওর বাবা-মা একমাত্র ছেলের বিচ্ছেদে মুহ্যমান হয়ে আছেন। ছেলে ফেরেনি। কেবল নিজের ছেলের একটা ফটো পাঠিয়েছিল। সেই ফটোটি ওঁরা এনলার্জ করে বাঁধিয়ে রেখেছেন। বংশধরের ছবি। কী আর বলব? ফিরে এলাম।
.
সেই অর্জুন চন্দ্র দেশে ফিরেছে। শধু তাই নয় বেহায়া বেশরম হয়ে আমাদেরই বাড়ির কাজে, আমার মায়ের শ্রাদ্ধে এসে উপস্থিত হয়েছে। রজনীগন্ধা হাতে। কে ওকে নিমন্ত্রণ করেছিল কে জানে।
আমার মা যদি আজ জীবিত থাকতেন, তাহলে কি তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে পারত অর্জুন চন্দ্র? মা অবশ্য কিছুই বলতেন না। মায়ের পলিসিই ছিল, ফ্রি টু কাম অ্যান্ড ফ্রি টু গো। সেই যে রবি ঠাকুরের—’যাবার সময় হলে যেও সহজেই, আবার আসিতে হয় এসো।’
কিন্তু তিতলি? তিতলি তো রবিঠাকুর নয়। সে কী অর্জুনকে সইতে পারছে? তিতলি ওকে কীভাবে নিচ্ছে সেটাই কথা। কে ওকে ডাকল? কেমন করে এল অর্জুন? তিতু-মিতুর এই উদারতা আমি বুঝতে পারছি না। উইমেন ক্যান বি স্ট্রেঞ্জ। জিনা নেহাত অর্জুনের প্রসঙ্গ কিছুই জানে না, তাই। জানলে, জিনা নির্ঘাত ওকে অপমান করে তাড়িয়ে দিত। একদিকে রক্ষে, জিনা কাউকেই চেনে না, কিছুই জানে না আমাদের সম্পর্কে, আমাদের পারিবারিক ইতিহাস। অবশ্য ইতিহাসের আছেটাই বা কী? নেহাত দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, ভদ্র একটি শিক্ষিত শহুরে পরিবার। এই তো? সেটা জিনার না জানায় মঙ্গল। আমি যেভাবে পড়াশুনো করেছি, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের গ্যাসলাইটে পড়ার চেয়ে সেটা কম ক্রেডিটেবল নয়—এখন তা বুঝতে পারি। এক জায়গায় পড়াশুনো, আর-এক জায়গায় স্নান-খাওয়া, আর-এক জায়গায় ঘুমুতে যাওয়া—এর মধ্যে বড় হয়েছি আমি। আর আমার ঘর-গেরস্থালি নিয়ে সংগ্রামের এনার্জি নেই। জিনার ইচ্ছের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি ঘরে। সবটা এনার্জি দিয়েছি আমার কেরিয়ারে। বিজ্ঞাপনে এস.সি. একটা চমক দেওয়া নাম। কম পরিশ্রম করিনি এখানে পৌঁছুতে। জিনা আমাকে দেখেছে যখন তখনই আমি উদীয়মান নক্ষত্র—আমার বাল্য-কৈশোরের কাহিনি ওর তো কোনওদিনই শুনতে, জানতে আগ্রহ হয়নি। ও নিজের মতো করে যেমন আমাকে বুঝে নিয়েছে, চিনে নিয়েছে, তাতেই ও তৃপ্ত। তার বেশি জানতে চায় না। ও মিতু-তিতুকে জানে পছন্দ করে, কেন না আমার বোনেরা ওর সঙ্গে মানিয়ে চলে।
বাবার শ্রাদ্ধের সময়ে জিনা-তৃণা কেউই আসেনি। তৃণার পরীক্ষা চলছিল। ঠাকুরদার শ্রাদ্ধ তার চেয়ে জরুরি ছিল না। স্কুলের অ্যানুয়েল পরীক্ষার জন্য মা-মেয়ে বম্বেতে থেকে গেল।
এবারেও জিনা না এলেই ভালো করত। এখানে এসেও জিনা এমনভাবে আমার ইচ্ছের রাশটা নিজের মুঠোয় রেখেছে যে বোনেদের সময়ই দিতে পারছি না। এই তো শ্রাদ্ধ শেষ হলে সন্ধেবেলাতেই উড়ে যাচ্ছি বম্বে। অথচ অশৌচান্ত সেইভাবে তো হয়নি এখনও। ‘মৎস্যমুখী’ হয়নি। ‘নিয়মভঙ্গ’ তো সপরিবারেই করার কথা। আমারই তো প্রধান অশৌচ? জিনা আরও দুদিন থাকবে না। তিতু-মিতু অবশ্য কিছুই বলেনি। এই না-বলাটা আরও খারাপ। আমিই তো বড় দাদা। মায়ের প্রথম সন্তান। পুত্রসন্তানও বটে। মৎসমুখীর ব্যাপারটা তিতলির ওপর ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাচ্ছি, কাজটা অসম্পূর্ণ রেখে। অথচ অফিসে ছুটি নিয়েছি। এটা ঠিক হচ্ছে না। বিশেষ করে আজ অর্জুনকে দেখেই আমার আরও মনে হচ্ছে, আমার ক’টা দিন থাকা উচিত ছিল তিতলির কাছে। আমেরিকায় গিয়ে গত দু-বারই আমরা রাহুল আর তিতলির গেস্ট হয়েছিলাম। রাহুলকে জিনার খুব পছন্দ হয়েছিল। ছেলেটি বেশ। তিতলিটা বেশ সুখেই সংসার করছিল তো,—হঠাৎ কী যে হল, জানি না। তিতলি রাহুলকে ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে। আর সে রাহুলের সঙ্গে থাকবে না, মনস্থির করেছে, ফিরে গিয়ে একাই থাকবে। আমাদের কাছে সেটা ঘোষণাও করে দিয়েছে। গত চার-পাঁচ বছর ধরেই ওরা জুটি বেঁধেছিল। বিয়ে হোক না হোক, একলাটি তো ছিল না, দিব্যি ঘরসংসার করছিল দুজনে। বাচ্চাকাচ্চা ওরা চায় না,—তাই বিয়ের ঝঞ্ঝাট পোয়াতে চায়নি। মা জানতেন রাহুলের কথা। মা ওকে মেনেও নিয়েছিলেন। বাবাকে জানানো হয়নি। বাবার হার্ট ভালো না। কীভাবে নেবেন কে বলতে পারে। সেই তো চলেই গেলেন। কিন্তু মা জেনে গেছেন, এই পৃথিবীতে তিতলি আর একা নেই। ওর একজন জীবনসঙ্গী আছে। নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন। কিন্তু এখন তো তিতলি আবার নি:সঙ্গ। ঠিক কীজন্যে রাহুলকে যে ছাড়ল? কিছুই বলেনি আমাকে। তবে কি ও জানত, অর্জুন কলকাতায় আছে?
দুটোর মধ্যে কি যোগ আছে কোনও?
Unlikely…সম্ভবতই নেই।
আমিই কি বেশি বেশি অঙ্ক কষছি? হিসেব করছি? দুয়ে দুয়ে চার করছি? আসলে বিশ্বের হিসেবটা নিপাতনে সিদ্ধ হয়। দুয়ে দুয়ে পাঁচ হয়ে বসে থাকে অনায়াসে। সম্ভবতই রাহুলকে ছেড়ে আসার সময়ে তিতলি জানত না অর্জুনের খবর। আমার বোনেরা খুবই ব্রাইট, খুবই স্মার্ট। খুবই জেনারাস। বাট হু ইনভাইটেড অর্জুন টুডে—আই ওয়ানডার। হুইচ ওয়ান অফ দেম? ইট শিওরলি ওয়াজ নট মি!