১২. রাত এগারোটার মত বাজে

রাত এগারোটার মত বাজে।

তিথিদের বাসা শান্ত হয়ে আছে। ইরা-মীরা তাদের ঘরে, দরজা বন্ধ। আলো নেভানো। হয়ত শুয়ে পড়েছে। কিংবা হয়ত ঘর অন্ধকার করে চুপচাপ দুবোন বসে আছে।

জাফর সাহেব বসে আছেন বারান্দায়। বারান্দার বাতিও নেভানো। এই বাড়ি আজ এক অভিশপ্ত বাড়ি। আজ রাতে এই বাড়ির একটি মেয়ের বিয়ে হবার কথা ছিল। এই বাড়িতেই বাসর হবার কথা ছিল।

তিথি খুব কাঁদছে। তার হাতে তার নীল তোয়ালে। তিথির সমস্ত দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা কি এই সামান্য নীল তোয়ালের আছে?

শায়লা মেয়ের পিঠে হাত রেখে মূর্তির মত বসে আছেন। এই ঘরের বাতিও নেভানো। অন্ধকারই ভালো। দুঃখের রাত তো অন্ধকারই হবে।

ভেজানো দরজায় টুক টুক করে শব্দ হল। নুরুজ্জামান ভীত গলায় বলল, মা, একটু শুনবেন?

শায়লা বের হয়ে এলেন। নুরুজ্জামান বলল, রাত দেড়টার সময় একটা ট্রেন আছে। আমি চলে যাব। যাবার আগে আপনার পা ছুঁয়ে একটু সালাম করতে চাচ্ছিলাম।

নুরুজ্জামান নিচু হয়ে সালাম করল। শায়লা বললেন, দুঃখের দিনে চলে যাচ্ছ। আচ্ছা যাও। থেকেই বা কি করবে। আবার কোন দিন যদি মেয়ের বিয়ে ঠিক হয় তোমাকে খবর দেব, তুমি এসো।

জি আচ্ছা। আমি কি তিথির সঙ্গে একটু কথা বলব মা? যদি অনুমতি দেন।

অনুমতির কি আছে? তিথি কথা বলবে কি না সেটাই হল কথা। এসো, ভেতরে এসো।

নুরুজ্জামান ঘরে ঢুকলো।

শায়লা বললেন, তিথি, নুরু চলে যাচ্ছে। তার কাছে বিদায় নিতে এসেছে–বলে তিথির ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। মনে হচ্ছে নুরুজ্জামান একা কিছু কথা বলতে চায়। বলুক।

তিথি ধরা গলায় বলল, আপনি আবার আসবেন। সিলেটে যাবার সময় আপনাকে অপমান করেছি। কিছু মনে রাখবেন না। সে রাতে আপনি যেমন কষ্ট পেয়েছিলেন। আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম।

নুরুজ্জামান বলল, আমি কিছু মনে করি নি। আমি অতি সামান্য মানুষ। এই সামান্য মানুষকে আপনারা যে ভালবাসা দেখিয়েছেন তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। আমি আপনাকে ছোট্ট একটা কথা বলতে চাই। বলব?

বলুন।

মারুফ সাহেব যে কাজগুলি করেছেন, আপনাকে ভালবাসেন বলেই করেছেন। আজ যদি তাকে আপনি দূরে সরিয়ে দেন তাহলে সবচে বড় কষ্টটা হবে আপনার আপনি কোনদিনই মানুষটাকে ভুলতে পারবেন না। বনের পাখি উড়ে যায় কিন্তু মায়া পড়ে থাকে। মায়ার কষ্ট ভয়ংকর কষ্ট।

কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে নুরুজ্জামান সাহেব।

কষ্ট সহ্য করার দরকার কি? মারুফ সাহেবের চরিত্রে অনেক ভুল-ত্রুটি আছে। সেই সব ভুল-ত্রুটি আপনি যদি ভালবাসা দিয়ে ঠিক না করতে পারেন তাহলে কিসের আপনার ভালবাসা?

তিথি বিস্মিত গলায় বলল, আপনি এত সুন্দর করে কথা বলা কোথায় শিখলেন?

নুরুজ্জামান বলল, আমি আপনাদের কাউকে না জানিয়ে একটা কাজ করেছি। হয়ত অন্যায় করেছি, তবু করলাম।

তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, কি করেছেন?

আমি মারুফ সাহেবকে তার বাসা থেকে নিয়ে এসেছি। উনি নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে তাকে ডেকে নিয়ে আসি। আপনি যেমন কাঁদছেন, উনিও কাঁদছেন। বিশ্বাস না হলে নিচে এসে দেখুন। আসবেন?

অনেকক্ষণ তিথি চুপ করে রইল। একসময় নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, যান তাঁকে ডেকে নিয়ে আসুন।

 

নুরুজ্জামানের ট্রেন রাত দুটায়। এখনো কিছু সময় আছে। সে যাবার আগে ইর মীরাকে পাতার বাঁশি শুনাচ্ছে। শুধু ইরা মীরা না, জাফর সাহেব এবং শায়লাও খুব আগ্রহ নিয়ে বাঁশি শুনতে এসেছেন।

তিথি কথা বলছে মারুফের সঙ্গে। থাকুক, তারা কিছুক্ষণ একা থাকুক।

তিথিদের ঘরের বাতি জ্বলছে। মারুফ কোনই কথা বলছে না। সে বসে আছে মাথা নিচু করে।

এক সময় মারুফ বলল, বিশ্রী শব্দ কোত্থেকে আসছে?

তিথি বলল, বাঁশির শব্দ। মনে হয় নুরুজ্জামান সাহেব পাতার বাঁশি বাজাচ্ছেন।

এ তো ভয়াবহ জিনিস!

তিথি হেসে ফেললো। তার হাসি আর থামছে না। মারুফও খুব হাসছে।

নুরুজ্জামান রবীন্দ্র সংগীতের সুর তোলার চেষ্টা করছে। পাতাগুলি ভাল না, সুর আসছে না–নুরুজ্জামান বাজাতে চেষ্টা করছে —

ভালবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন মিছে এ ভালবাসা।

পাতার বাঁশিতে সুর না ধরলেও যাদের জন্যে এই বাণী তারা হয়ত ঠিকই বুঝেছে কারণ এক সময় তিথি কোমল গলায় বলল, তুমি কাছে আস তো, তোমার মাথার চুল আঁচড়ে দেই।

Leave a Reply to হামিদুল Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *