১২. দরজার কড়া নড়ছে

দরজার কড়া নড়ছে

দরজার কড়া নড়ছে।

মনজুর বড় বিরক্ত হলো। এত ভোরে কে এল? ইদানীং সবাই মিলে তাকে খুব বিরক্ত করছে। অফিসের লোকজন আসছে–কখনো একা, কখনো দল বেঁধে। একবার এলে আর যেতে চাচ্ছে না। সেদিন করিম সাহেব এলেন, সঙ্গে নীল রঙের একটা বোতল। এই বোতলে হালুয়াঘাটের এক পীর সাহেবের পানি-পড়া আছে। এই বস্তু জোগাড় করতে তাকে যে কী পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে। সে গল্প এক ঘণ্টা ধরে করলেন। গল্প শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে এই পানি-পড়া জোগাড় করার চেয়ে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘিনীর কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে আসা অনেক সহজ।

গতকাল এসেছিলেন বাসারত সাহেব, একা আসেন নি— নিত্যানন্দ চক্রবর্তী নামে একজন আয়ুৰ্বেদ শাস্ত্রী নিয়ে এসেছিলেন। ছোটখাটো মানুষ হলেও নিত্যানন্দবাবু একাধারে কাব্যতীর্থ, আয়ুৰ্বেদাচাৰ্য, আয়ুৰ্বেদশাস্ত্রী, জ্ঞানশ্ৰী এবং বিদ্যাশ্ৰী। ভদ্রলোক মনজুরের নাড়ি ধরে ঝাড়া পয়তাল্লিশ মিনিট চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন। পয়তাল্লিশ মিনিট পর মনজুর বলল, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি ভাই?

আয়ুৰ্বেদশাস্ত্রী হাতের ইশারায় তাকে চুপ করে থাকতে বললেন এবং আরো দশ মিনিট এভাবেই কেটে গেল। মনজুর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, একী যন্ত্রণা!

নিত্যানন্দ চক্রবর্তী চোখ মেলে বললেন, আপনাকে একটা ওষুধ তৈরি করে দেব। ওষুধটার নাম ‘নালাদি ক্বাথ।’ নল, কুশ, কাশ এবং ইক্ষু এই চার উপাদানে নির্মিত। ওষুধটা এক মাস ব্যবহার করুন। তারপর এই যুগের বড় বড় ডাক্তারদের কাছে যান। তারা বলবে–কিডনি ঠিক আছে। যদি তা না বলে আমি আমার সংগ্রহে আয়ুৰ্বেদ শাস্ত্রের যে শতাধিক পুস্তক আছে সব পুড়িয়ে ছাই বানাব। সেই ছাই মুখে লেপন করে আপনাকে দেখিয়ে যাব।

মনজুর বলল, কত লাগবে ওষুধ তৈরি করতে?

বাসারত সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, এটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। কী লাগবে না-লাগবে তা আমি দেখব।

বেশ দেখুন।

নিত্যানন্দ চক্রবর্তী তখন তার চিকিৎসার গল্প শুরু করলেন। এক এমআরসিপি ডাক্তার কীভাবে তার কাছে ছুটে এসে করজোড়ে বলেছিলেন।— নিত্যবাবু, আপনার মতো কিন্তু আমার জীবনে দেখি নি। আপনি বয়োকনিষ্ঠ, নয়তো আপনার পায়ের ধূলা নিতাম।

মনজুর তাদেরকে জোর করেই ঘর থেকে বের করে দিল। নিত্যবাবু এবং বাসারত দুজনের কেউই যাবার নামটি মুখে আনছিল না।

 

আজ সেই নিত্যবাবুই এসেছেন মনে হচ্ছে। চারদিন পর তাঁর ওষুধ দিয়ে যাবার কথা–‘নালাদি ক্বাথ।’ চারদিন পার হয়েছে। আজ পঞ্চম দিন।

মনজুর উঠে দরজা খুলল। এই ভোরবেলায় জাহানারা চলে এসেছে। তার শরীর হলুদ রঙের চাদরে ঢাকা।

চাদরে পুরোপুরি শীত মানছে বলে মনে হচ্ছে না। অল্প অল্প কাঁপছে। জাহানারার হাতে টিফিন ক্যারিয়ারের একটি বাটি।

স্নামালিকুম স্যার।

ওয়ালাইকুম সালাম। সূর্য ওঠার আগে চলে এসেছ, ব্যাপার কী?

আপনি কেমন আছেন?

ভালোই আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে— নিত্যানন্দ চক্রবর্তী নামের এক লোক আমাকে ‘নালাদি ক্বাথ’ দিয়ে যাবে। ঐ বস্তু খাওয়ার পর শরীর আরো ভালো হয়ে যাবে। কিডনি যেটা নষ্ট সেটা তো ঠিক হবেই–অন্য যেটা কেটে বাদ দেয়া হয়েছে সেটাও সম্ভবত গজাবে। এস ভেতরে এস। টিফিন বক্সে কী?

ভাপা পিঠা। মা করে দিয়েছেন স্যার।

ভেরি গুড। চল ভাপা পিঠা খাওয়া যাক। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি–তুমি ততক্ষণে চায়ের পানি বসিয়ে দাও। চা খেয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। নয়তো নিত্যবাবুর জালে আটকা পড়ে যেতে হবে।

 

জাহানারা রান্নাঘরে চলে গেল।

তার মুখ মলিন। রাতে সে এক ফোটা ঘুমাতে পারে নি। পুরো রাত ছটফট করেছে। শেষরাতের দিকে বারান্দায় এসে বসেছে। বারান্দার কোনায় জাহানারার মাও বসে। ছিলেন। তিনি সেখান থেকে ডাকলেন, এদিকে আয় মা। জাহানারা মার কাছে গেল না। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

তিনি বললেন, তোর কী হয়েছে তুই আমাকে বল তো মা।

জাহানারা বলল, কিছুই হয় নি।

অনেক দিন থেকেই দেখছি।–তুই ছটফট করছিস। আমাকে বল তো মা, তোর কী হয়েছে?

জাহানারা তীব্ৰ গলায় বলল, বললাম তো কিছু হয় নি।

সে আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেল। জাহানারার মা তার পেছনে পেছনে ঢুকলেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ করলেন তাঁর মেয়ে বিছানায় শুয়ে ছোট্ট বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি কী করবেন ভেবে পেলেন না। বাকি রাতটা বিছানার পাশে চুপচাপ বসে কাটালেন। মেয়ের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার সাহসও তাঁর হলো না।

 

স্যার দেখুন তো চায়ে চিনি ঠিক আছে কিনা?

মনজুর চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, সব ঠিক আছে। তুমি চা খাচ্ছো না?

জ্বি না। আমি খালিপেটে চা খেতে পারি না।

খালিপেটে খেতে হবে কেন? পিঠা তো আছে। পিঠা নাও।

এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।

জাহানারা খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে মৃদু গলায় বলল, আপনাকে একটা কথা বলার জন্যে আমি এত ভোরে এসেছি। কথাটা বলেই আমি চলে যাব।

বল।

স্যার আপনি কিডনি চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আমি আপনাকে একটা কিডনি দিতে চাই।

মনজুর বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটি একেক সময় একেকভাবে কথা বলে। আজ সম্পূর্ণ অন্য রকমভাবে কথা বলছে।

তুমি কিডনি দিতে চাও?

জ্বি।

কেন বল তো?

জাহানারা জবাব দিল না। তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। মেয়েটা যে আজ কথা অন্যভাবে বলছে তাই না–তাকে দেখাচ্ছেও অন্য রকম। মনজুর বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।

জাহানারা বসল না। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনজুর বলল, তুমি কিডনি দিতে চাইলেই তো হবে না। ক্রস ম্যাচিঙের ব্যাপার আছে।

ক্রস ম্যাচিঙের অসুবিধা হবে না। আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আপনার ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। তিনি বলেছেন—ঠিক আছে।

মনজুর অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমি একবার তোমাকে কিছু সাহায্য করেছিলাম। তুমি কি তার প্রতিদান দিতে চাচ্ছে?

না। সেসব কিছু না।

তাহলে কী?

জাহানারা জবাব দিল না। তবে তীক্ষ চােখে তাকিয়ে রইল। চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল না।

মনজুর বলল, দেখ জাহানারা, আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছি। নগদ টাকা দিয়ে আমি কিডনি কিনব।

আপনাকে টাকা দিয়ে কিনতে হবে না স্যার।

আচ্ছা আমি ভেবে দেখি। যাও, তুমি বাসায় যাও।

জাহানারা একটি কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সে একটা রিকশা নিয়েছে। চাদরে মুখ ঢেকে সারাপথ ফুঁপাতে ফুঁপাতে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছে না। রিকশাওয়ালা এক সময় বলল, আম্মা কাইন্দেন না। মনডা শান্ত করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *