১২. ঘরে বাইরে
১৯৮৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় রাজীব গান্ধী পণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের ‘লালদুর্গ ভেঙে গুঁড়িয়ে’ দেবেন। নির্বাচনী প্রচারে রাজীব কলকাতায় এসেছিলেন তিনবার। আর প্রতিবারই প্রতিটি জনসভায় বসুকে ঝাঁঝালো ভাষায় আক্রমণ করতে ছাড়েননি—”বসুর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এবার ওঁর অবসর গ্রহণ করা উচিত, রাজ্য ছেড়ে দেওয়া উচিত নবীন নেতাদের হাতে।” বসুও কথাটা হজম করার পাত্র নন। তিনি পাল্টা জবাব দিলেন “রাজীব কেন্দ্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। প্রশাসন চালাবার দক্ষতা সে কবে অর্জন করল? হ্যাঁ, এ কথা সত্যি, আমার বয়স হয়েছে, আমি স্বাভাবিক নিয়মেই অবসর নেব কিন্তু তার আগে আমি রাজীবকেই ‘রিটায়ার’ করিয়ে দেব।”
রাজীব, বসুকে এই ধরনের উগ্র ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছিলেন কেন? রাজনীতিবিশারদদের মতে এর সম্ভাব্য কারণ হল, কংগ্রেসের তখন কোনও সুচিন্তিত কর্মসূচী ছিল না। ভোটারদের নিজেদের দিকে টানার ঐ একটা অস্ত্রই তাদের সম্বল ছিল—সেটা হল জ্যোতিবাবুর সমালোচনা। তাছাড়া রাজ্যে কংগ্রেস দল বহু উপদলে দীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। যাইহোক রাজীব গান্ধীর জ্যোতিবাবুকে এই ব্যাক্তিগত আক্রমণে কোনও ফল কিন্তু হয়নি। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে সি. পি. আই. (এম) আবার জয়লাভ করল এবং তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসীন হল। এবারে ৮২ সালের থেকে বেশী ভোটই পেল বামফ্রন্ট। সি. পি. আই. (এম) পেল ১৮৭টি আসন আর অন্যান্য ফ্রন্ট সদস্যের মধ্যে ফরওয়ার্ড ব্লক, আর. এস. পি, সি. পি. আই, পশ্চিমবঙ্গ সমাজবাদী পার্টি ও অন্যান্য মিলিয়ে আরও ৬৪টি আসন—মোট আসন সংখ্যা দাঁড়াল—২৫১। বিরোধী পক্ষ পেল খুব কম সংখ্যক আসন, কংগ্রেস—৪০টি, এস. ইউ. সি. আই. ২টি এবং মুসলিম লীগ ১টি। ভোটাররা এর থেকে স্বচ্ছ রায় আর কি দেবেন!
১৯৮৭ সালে বসু আবার বাসস্থান বদল করলেন। এবার বসু উঠে গেলেন সল্টলেকে ইন্দিরা ভবনে। ইন্দিরা ভবন তৈরি হয়েছিল ১৯৭২ সালে, আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে। ইন্দিরা গান্ধী এসে এই বাসভবনে থাকতেন। হাল্কা বরফ-ছাইরঙা আধুনিক স্থাপত্যের দোতলা বাড়ি, সামনে ও দু’পাশে ঝাউগাছ আর মরশুমী ফুলের চমৎকার বাগান, পেছন দিকে নারকেল গাছ, আম গাছ আরও অনেক বড় বড় গাছের ঝাড়।
রিমোট কন্ট্রোলে খুলে যায় গাঢ় ছাইরঙা গেট। ড্রাইভওয়ের দু’পাশে দেবদারু গাছের সারি, গাড়ি গিয়ে থামে পোর্টিকোর তলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁ-ধারে বসুর বৈঠকখানা, সোজা কাঁচের দরজা দিয়ে ঢুকলে বাড়ির মাঝখানে হলঘর। বসু ও তাঁর স্ত্রী একতলাতেই থাকেন। বাড়ির বাইরে ছোট আউট হাউস, কখনও কখনও বাইরের ভিজিটর সেখানেও অপেক্ষা করেন। আউট হাউসের বাইরেই একটা ছোট তুলসীমঞ্চে তুলসী গাছ। সারা বাড়িতে অতন্দ্র পুলিস প্রহরা। বাইরে সশস্ত্র গোর্খা ব্ল্যাকক্যাট নিজেদের পজিশনে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা, ছুঁচ গলবার উপায় নেই
এই সময় থেকে বসু জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করেছেন। মধ্যস্থতায় তাঁর যথেষ্ট সুনাম হয়েছে। মতপথ আদর্শ নির্বিশেষে অনেক জাতীয় নেতাই তাঁর শলাপরামর্শ চান। বিরোধীপক্ষের রাজনীতি তিনি করেছেন প্রায় তিন দশক ধরে আর ১৯৮৭তে প্রায় এক দশক হল কোয়ালিশন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেই প্রথম থেকে একই মতাদর্শের একই দলে আছেন, ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে এটাও যথেষ্ট বিরল ঘটনা—তাঁর মত এমন রেকর্ড সেই সময় আর কোনও নেতার ছিল না। অতএব প্রায়ই তাঁর ডাক পড়ে, দিল্লীতে, মাদ্রাজে, দেশের অন্যত্র। ৮০ সালের শেষভাগে এসে বসুর মনে হয় সারা দেশে সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে শক্তিশালী করতে গেলে তাঁর দলকে জাতীয়স্তরে আরও বলিষ্ঠ হতে হবে। যাদবপুরে এক নির্বাচনী সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘দিল্লীতে ক্ষমতা দখল না করতে পারলে সমাজের আমূল পরিবর্তন করা অসম্ভব, যদিও রাজ্যে জনগণের স্বার্থে বেশ কিছু জরুরী সংস্কারের কাজ করা কিছু অসম্ভব নয়।’
বসু বুঝেছিলেন জনতাদল কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসবে। ১৯৮৮ সালের সি. পি. আই. (এম) দৈনিক ‘দেশহিতৈষী’র বিশেষ শারদ সংখ্যায় এ প্রসঙ্গে বসু একটা সুদীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছিলেন—শিরোনাম—ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার’। সম্প্রতি গঠিত জাতীয় মোর্চা প্রসঙ্গে বসু বললেন, “বামফ্রন্ট হল কোয়ালিশন সরকার। এটা এমন কয়েকটি বামপন্থী দলের জোট যাদের একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচী আছে। এই ফ্রন্টের মধ্যে যে মতানৈক্য বা মতবিরোধ একেবারেই হয় না তা নয়, কিন্তু আমরা চেষ্টা করি আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো মুছে ফেলতে। এই তো এত বছর ধরে এই সফল পরীক্ষা চলছে আমাদের রাজ্যে। আর আমি আমাদের এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি কর্মসূচীভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জোট কেন্দ্রেও সফল হবে।”
১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই বসু জাতীয় মোর্চার জয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত ছিলেন। তাঁর অনুমান যথার্থ ছিল। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না, জনতা দল কেন্দ্রে সরকার গড়ল। ভি. পি. সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন। পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৭টি আসন পেল, তার মধ্যে সি. পি. আই. (এম) একা পেল ২৭টি আসন।
কিন্তু কেন্দ্রে জনতাদলের আসন স্থায়ী হল না। বি জে পি-র যুদ্ধং দেহি মনোভাব আর মন্ডল কমিশন নিয়ে আন্দোলনের ফলে কোয়ালিশন ভাঙো ভাঙো হল। এই বিপর্যয় এড়াতে বসু যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছিলেন, ভি. পি. সিং-এর পরামর্শে তিনি এল. কে. আদবানিকে রথযাত্রার পরিকল্পনা ত্যাগ করার অনুরোধ করেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তাতে কোনও ফল হয়নি, হিংসাত্মক ঘটনা নিজস্ব পথে বেড়েই চলে। বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করে। দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়, চন্দ্রশেখর, দেবীলাল, জনতাদলের আরও কয়েকজন সদস্য ভি. পি. সিং-এর নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেন এবং সমাজবাদী জনতা পার্টি তৈরী হয়, তাদের নেতা হন চন্দ্রশেখর। বি. জে. পি. সমর্থন প্রত্যাহার করার ফলে, সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়, ভি. পি. সিং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এবার প্রধানমন্ত্রীর গদিতে এলেন চন্দ্রশেখর, তাঁর সরকারকে সমর্থন দিল কংগ্রেস। কয়েক মাস পর আবার নাটকের অংক পরিবর্তন। কংগ্রেস সমর্থন তুলে নেয়, এক তুচ্ছ কারণে, রাজীব গান্ধীর ওপরে নাকি নজরদারি করা হচ্ছে। চন্দ্রশেখর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সি. পি. আই. (এম) তখন ভি. পি. সিং সরকারের কয়েকটি নীতির সমালোচনা করতে ছাড়েনি। মন্ডল কমিশনের রিপোর্টের বিষয়ে সি. পি. আই. (এম) ‘আদার ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট’এর ‘সংরক্ষণ নীতি’র সমর্থন করলেও এ কথা বলেছিল যে এই নীতি রাজনৈতিক মাপকাঠির বিচারে এবং অবশ্যই জাতীয়স্তরে জনগণের এবং বিভিন্ন দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে কার্যকর করা উচিত ছিল। আর চন্দ্রশেখরের সরকার যে ভেঙে যাবে সেটা আগে থেকেই জানা ছিল, কারণ এই সরকার কংগ্রেস ভাঙা নেতাদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা দখল করা আর বি. জে. পি. ঠেকানো।
২
ইতিমধ্যে বসু বেশ কয়েকবার ইংল্যান্ডে ঘুরে এসেছেন। ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে বসু ইংল্যান্ড গেলেন লন্ডন স্কুল অব্ ইকনমিকসের আমন্ত্রণে। আর একটা আমন্ত্রণ ছিল জন রাডক্-এর। ১৫ থেকে ১৯ জুলাই ইউরোপীয়ান নিউক্লিয়ার ডিসআরমামেন্ট কনভেনশনে’ বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ। ১৯৮৯তেও বসু লন্ডন স্কুল অব্ ইকনমিকসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন হাউস অব্ কমন্স-এ আর মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরিতে, আজকের যুগে মার্কসবাদের প্রয়োগ নিয়ে একটা অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ভাষণ দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের ২৬শে জুন বসু আবার ইংল্যান্ডে গেলেন, রইলেন ১৭ই জুলাই পর্যন্ত। এবার গেলেন পরিবারের সঙ্গে। রোজই নানা প্রোগ্রাম থাকত। ২৭শে জুন লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এর আই. পি. প্যাটেল নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন লাঞ্চের; সেখানে বিদগ্ধ বহু মানুষের সঙ্গে আদানপ্রদানের পরই সন্ধ্যায় আবার ভারতীয় হাই কমিশনার কুলদীপ নায়ারের ডিনারের নিমন্ত্রণ, সেখানেও ভারতীয়, অভারতীয় এবং অনাবাসী ভারতীয়দের এক বিরাট সমাবেশ। পয়লা জুলাই রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে কেবল অনাবাসী ভারতীয় শিল্পপতিদের সঙ্গে আলোচনা এই সব আলাপ আলোচনার সময় বসু বার বার একটা কথা জোর দিয়ে বলছিলেন, “এক-দলীয় সরকারের দিন শেষ হয়ে গেছে, এখন কোয়ালিশনের যুগ।” সে সময় কেন্দ্রের জাতীয় মোর্চার স্থায়িত্ব সম্পর্কে তিনি দৃঢ় আশা পোষণ করছিলেন, যদিও কিছুদিন বাদে ঘটনাটা অন্য রকম ঘটে।
বসু কলকাতা ফিরলেন ১৭ই জুলাই। ততদিনে পৌর নির্বাচনে পার্টির অভূতপূর্ব জয় হয়েছে। খবরটা লন্ডনে বসে এখানকার তৎকালীন পুরমন্ত্রীর টেলিফোনেই পেয়েছিলেন। বসুর সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হবার কথা ছিল ১৯৯২-এর মার্চ মাসে, কিন্তু বসু সিদ্ধান্ত নিলেন বিধানসভা নির্বাচন লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গেই অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই, ১৯৯১ সালের মে মাসে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে বসুর মনে হয়েছিল তাঁর দল হয়তো আগের মত আশানুরূপ ফল করবে না, তাছাড়া রাজীব রাজ্যের কমিউনিস্ট সরকার ভেঙে দেওয়ারও চেষ্টা করতে পারে আর বসু ক্ষমতায় ফিরলে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করার অপচেষ্টাও করা হতে পারে। বসু সেসব কথায় কান দেন নি মোটেই, তিনি বললেন, সাধারণ মানুষ তাদের কাজের বিচারেই চিরকাল ভোট দিয়েছে এবং জনগণের সিদ্ধান্ত ছাড়া আর অন্য কিছুই ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। তবে বসু বিরোধীপক্ষকে কোনওদিনই লঘুভাবে বিবেচনা করেন নি। এ প্রসঙ্গে বসু বললেন, “রাজীব আমাদের রাজ্যে বিশেষ নজর দিত, ওর সব কাজে বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শে আমাদের সরকার ভেঙে দেওয়ার হীন চেষ্টাও চালাচ্ছিল, তাছাড়া সিদ্ধার্থ আবার এসে হাজির হল, রাজীবেরই নির্দেশে, উদ্দেশ্য ছিল গনি খান চৌধুরিকে সরিয়ে রাজ্য কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হওয়া। রাজীব এতই অপরিণত ছিল যে সে বুঝতে পারেনি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ‘মুখ্যমন্ত্রী’ সিদ্ধার্থশংকর রায়ের শাসনকালের সেই ভয়াবহ বাড়াবাড়ি এখনও ভুলতে পারেনি।”
সিদ্ধার্থশংকর রায় বসুকে ব্যক্তিগত আক্রমণের রাস্তাই বেছে নিলেন। একদিকে কংগ্রেসের কলকাঠি অন্যদিকে মৌলবাদী, হিন্দু বি. জে. পি. দলের ধর্মীয় উত্তেজনা। বিজেপিও ‘ভোটব্যাংকের’ কারণে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য সরাসরি বসুকে দায়ী করল। বসুর মামার বাড়ি ছিল ঢাকায়, বসুর বাবা ছিলেন বারদির জামাই, এই সুবাদে বি. জে. পি বসুকে বলল, ‘বাংলাদেশের দালাল।’
মে মাসে লোকসভার মধ্যবর্তী নির্বাচন এগিয়ে এল। ভি. পি. সিং-এর সরকার সম্বন্ধে বসু বললেন, “এটা ঠিকই ভি. পি. সিং-এর সরকার মোটে এগার মাস টিঁকেছিল। যদি কোয়ালিশন সদস্যরা ঐক্যমত বজায় রাখতে পারতেন তো সরকার অবশ্যই পুরো মেয়াদের জন্য টিঁকে যেত। তবে একটা ব্যাপারে আমি খুব খুশী যে এই প্রথম, দীর্ঘ ৪৩ বছরে আন্তঃরাজ্য কাউন্সিলের মিটিং হয়েছিল। এই ভি. পি. সিং- এর আমলেই উন্নয়ন কাউন্সিলের মিটিংও হয়েছিল। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা এই মিটিং-এ কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রীরা, বি. জে. পি. এবং অন্যান্য দলও মতাদর্শ নির্বিশেষে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে যোগ দিয়েছিল”, বসুর মতে “কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয়সাধনের ক্ষেত্রে এই আন্তঃরাজ্য কাউন্সিলের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এটাকে একটা বাতিল কাউন্সিল করে রাখা ঠিক নয়। তাছাড়া সরকার ভেঙে দেওয়ার বিষয়টা সংসদে যাওয়ার আগে এখানে উপস্থাপনা করে আলোচনা করা উচিত।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজীব গান্ধী বসু সম্পর্কে নিজের ধারণা বদলাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এক সময় তিনি বুঝেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর জনপ্রিয়তা কতখানি। প্রকাশ্যে তিনি স্বীকার করলেন, ‘জ্যোতি বসুর কোন তুলনা হয় না, জ্যোতি বসু জ্যোতি বসুই’। বিভিন্ন বিষয়ে বসুর পরামর্শও নিতে শুরু করলেন, বিরূপ সমালোচনা করাও বন্ধ হল কিন্তু সুসম্পর্ক সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্তরে যাওয়ার আগেই এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল। ১৯৯১-এর ২১শে মে ঠিক নির্বাচনের আগে মাদ্রাজের কাছে শ্রীপেরুমবুদুরে রাজীব গান্ধী নিহত হলেন শ্রীলঙ্কার উগ্রবাদীদের হাতে। ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনের অনুরোধে উগ্রবাদীদের দমন করার উদ্দেশ্যে শ্রীলংকায় সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই কাজেরই প্রতিশোধ নিলো উগ্রবাদীরা। সারাদেশ তখন শোকে মুহ্যমান, কংগ্রেসের প্রতি জনগণের সহানুভূতির ঢেউএ নির্বাচনে কংগ্রেস বিপুলভাবে জয়ী হল, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পেল। পি. ভি. নরসিমহা রাও প্রধানমন্ত্রী হলেন। পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসু পুননির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে এলেন। চতুর্থবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেন, যদিও লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল আগের জেতা পাঁচটি আসন হারাল।
সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে বসু রওনা হলেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। সেখানেও ব্যস্ততার শেষ নেই—প্রথমেই ইংল্যান্ডের ফরেন অ্যাফেয়ারস্ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে মিটিং, তারপর ব্রিটিশ গ্যাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ওভারসীজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা। তাছাড়া এই সময় রাশিয়ায় গরবাচভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হয়। এই প্রসঙ্গে লন্ডন টাইমস্ পত্রিকার প্রতিবেদক লিখেছেন, বসু জানতেন অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। বসুকে টাইমস্ পত্রিকায় ‘একজন ঝকঝকে আপাদমস্তক নিখুঁত ৭৭ বছর বয়সী সফল মুখ্যমন্ত্ৰী’ বলে বর্ণনা করা হয়। বসু সেবার ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন ব্রিটেনের সরকারী অতিথি হিসাবে। ফলে কমনওয়েলথ্ বিভাগ আর ব্রিটিশ ফরেন অফিসে তাঁকে যেতে হয়েছিল। দেখা করতে হয়েছিল লেবার এম. পি. টনি বেন-এর সঙ্গে। তাছাড়া ইন্ডিয়া হাউস, আর ‘দরবার কোর্টেও’ গিয়েছিলেন। এরই মধ্যে একদিন সময় করে ঘুরে এলেন লন্ডনের ইষ্ট এন্ড এলাকায় যেখানে বহুদিন আগে বসু সিলেটি নাবিকদের কথ্য ইংরেজি ভাষা শেখাতেন। “প্রত্যেকবারই আমার সেই পুরোনো জায়গাটা আবার দেখার ইচ্ছা থাকত, কিন্তু কিছুতেই সময় করে উঠতে পারতাম না। এবারে গিয়ে দেখলাম জায়গাটা সেই রকমই আছে। ভাঙা বাড়ি, সব রয়েছে, শুধু মনে হল রাস্তাটা আগের থেকে অনেকটা চওড়া হয়েছে। বাংলা সাইনবোর্ড লাগানো কয়েকটা দোকানও দেখলাম।” বাংলাদেশের বাসিন্দারা বসুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।
১৪ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা বসু উড়ে গেলেন সুইডেনে। পরের দিন সেখানে সাধারণ নির্বাচন। অনেক দিন ক্ষমতায় থাকার পর তখন সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি ক্ষমতা হারাতে বসেছে। বসু আরও কয়েকটা সভাসমিতিতে অংশগ্রহণ করলেন, রাজ্যে শিল্প বিনিয়োগ নিয়ে কথাবার্তাও চলল। বসু দেশে ফিরলেন ২০শে সেপ্টেম্বর। দেশে ফিরেই বসুর প্রথম কাজ হল রুগ্ন শিল্পগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং রাজ্যে আরও নতুন শিল্প স্থাপন করা। তখন কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া অর্থনীতি এবং শিল্পনীতি শ্রমিকবিরোধী বলে কমিউনিস্ট মহলে যথেষ্ট সমালোচিত হচ্ছে। ১৯৯১ সালের ২০শে নভেম্বর বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলো এই নীতির প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকে। তাদের মতে এই নীতি পশ্চিমবঙ্গের শিল্প বিকাশের পরিপন্থী। গণমাধ্যমগুলো বসুকে ‘দ্বৈত’ মনোভাবসম্পন্ন বলে সমালোচনা করে, বলা হয় বসুর পার্টি ঐ নীতির সমালোচনা করছে, অথচ রাজ্যে নয়া শিল্পনীতি রূপায়িত হয়ে চলেছে। বসু নিজস্ব যুক্তি দিয়ে তাঁর পার্টির অবস্থান সম্পর্কে বিবৃতি দেন। এ বিষয়ে বিশদভাবে পরের অধ্যায়ে বলা যাবে।
ভারতে রাজনীতির মানচিত্র তখন দ্রুত বদলাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও এবং অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং শিল্পসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি নতুন নীতি রূপায়ণে সচেষ্ট হয়েছেন। এদিকে মৌলবাদ উগ্র রূপ নিয়েছে, এগোচ্ছে বাবরি মসজিদের বিধ্বংসী কর্মকান্ডের দিকে। জাতীয় স্তরে ভারতের রাজনীতিতে জ্যোতি বসুর বুদ্ধি পরামর্শ মর্যাদা পাচ্ছে। জ্যোতি বসুর দল কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনায় তখন মুখর। বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার বিরুদ্ধে রাও সরকারের ব্যর্থতা আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ১৯৯৩ সালে রাও মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় কিন্তু মাত্র সাতটি ভোটের ভেলায় রাও সরকার পার হয়ে যায়।
৩
১৯৯২ সালের গ্রীষ্মে বসু রওনা হলেন তাঁর ইংল্যান্ড ও ইয়োরোপের বার্ষিক সফরে। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এ এক বক্তৃতায় বসু ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আই এম এফ লোনের শর্তারোপের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি ও ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তাঁর মতে এতে দেশের অর্থনীতির মান আরও নেমে যাবে।
প্রতিবারের মত এবারও তিনি ওদেশের শিল্পপতি, বিদেশমন্ত্রকের অফিসার, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ইংল্যান্ড থেকে বসু এরপর প্রথমে স্ক্যান্ডানেভিয়া ও পরে জার্মানি ও ইতালিতে যান। “বসু বিদেশ থেকে যখন ফেরেন, তখন দেখে মনে হয় ওঁর বয়স কমে গেছে, চেহারায় চক্চকে ভাব, তবে ক’দিন বাদেই সেই ভাবটা কোথায় চলে যায়, আবার আগের মতই লাগে। আসলে ওখানে টেনশনটা থাকে না, এখানে নামলেই টেনশনের শুরু”—মন্তব্য করলেন বসুর মন্ত্রীসভার এক সদস্য।
“৯২ সালের শেষে এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটল যার কুফল অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ল, বলতে গেলে সেই ফল মানুষ এখনও ভোগ করছে, কিন্তু দুঃখের কথা এখনও অনেক মানুষ ঠিক বুঝতেও পারছে না”–বসু মন্তব্য করলেন। বসু কথাটা বললেন, ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে। “আমি রীতিমত শকড্ হয়েছিলাম, আজকের দিনে সভ্যদেশে এও সম্ভব?”—বসু বললেন, “এই ঘটনা আমাদের, সব ভারতীয়ের বিরাট লজ্জা।” ৭ই ডিসেম্বর বামপন্থী দলগুলি এই নিন্দনীয় ঘটনার প্রতিবাদে ‘বাংলাবন্ধ’ ডাকে। সারা ভারতে ‘বন্ধ’ পালিত হয় পরের দিন। ৯ই ডিসেম্বর বি. জে. পি. আর একটি ‘বন্ধ’ ডাকে, পশ্চিমবঙ্গে এই বন্ধ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। সাধারণের সতর্কতা সত্ত্বেও ৯ই ডিসেম্বর রাতে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। পুলিশি ব্যবস্থা সত্ত্বেও এই দাঙ্গায় মারা যান ৩৩জন মানুষ সারাদেশে বিশেষ করে বম্বে শহরে নিহত হন আরও অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ। বসুর মতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভারতে মারাত্মক বিষের মত কাজ করে, “এর বিপদ যে দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তা এখনও”, তিনি বলেন, “বোধহয় সব দেশবাসী বুঝতে পারছে না।”
বি. জে. পি-র মোকাবিলায়, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতায়, নয়া অর্থনীতির সমালোচনায় এবং নরসিমহা সরকারের টলমল অবস্থার মধ্য দিয়ে কেটে যায় ১৯৯২ সাল। ১৯৯৩ সালে বসু শিল্প বাণিজ্যের উন্নয়নে বিশেষ জোর দেন। দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম এসে যায়, বসু এবার লন্ডনে যাওয়া পেছিয়ে দেন অক্টোবর মাস পর্যন্ত। অক্টোবর মাসে তিনি কিউবা যাবার আমন্ত্রণ পান। লন্ডনে কয়েকদিন সভাসমিতির পর কিউবা যাত্রা। কিউবায় তিনি থাকেন এক সপ্তাহ, দেখা হয় ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে কথাও হয়। ১৯৭৩ সালে কাস্ত্রোকে কলকাতায় স্বাগত জানিয়েছিলেন বসু। কাস্ত্রোর সঙ্গে ঘন্টা দুয়েক বসুর কথা হয়। “কাস্ত্রো খুবই চমৎকার মানুষ” বসু বললেন, “আমাকে এয়ারপোর্টে গাড়ি করে বিদায় জানাতেও এসেছিলেন।”
১৯৯৪ সালে বসুর আশি বছর পূর্ণ হল। ৮ই জুলাই তাঁর জন্মদিনটা কাটল লন্ডনে, রুসি মোদির সঙ্গে ডিনারে কাটল জন্মদিনের সন্ধ্যা। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এ এক বক্তৃতায় বসু সেবার বলেছিলেন “ভারতবর্ষে শতকরা ৭০ভাগ মানুষ কৃষিজীবী। দুঃখের বিষয় কেন্দ্রের সরকার কৃষকদের কথা ভাবে না। ভূমিসংস্কারের কাজ কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। প্রকৃত ভূমিসংস্কার একমাত্র কেরালায় ও পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে।” লন্ডন থেকে বসু সেবার গেলেন সুইজারল্যান্ড এবং জারম্যাটে। জারম্যাট জায়গাটা দেখে বসুর চমৎকার লেগেছিল, “কোনও দূষণ নেই, শহরের বাইরে চার কিলোমিটার দূরত্বে টুরিস্টদের গাড়ি রাখতে হয়।” সেখান থেকে গেলেন ম্যাটারহর্নে “সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই ‘ম্যাজেস্টিক’,” বললেন বসু। “কেবল কার-এ করে পাহাড়ের ওপর গেলাম, সেখান থেকে নিচের প্রকৃতিকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে, যাই হোক সব ভাল জিনিসই এক সময় শেষ হয়ে যায়”–এই ভেবে বসুই কেবল কারের রিটার্ন সারভিসের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন। এর পরেই লন্ডন হয়ে দেশে ফেরা।