কালচক্রের সওয়ার
নাম? নাম বলে আর অত বড়ো বিজ্ঞানীকে বিব্রত করতে চাই না। বন্ধুজনেরা আদর করে তাঁকে ত্রিকালপন্থী বলে ডাকেন। আমরা আরও একটু সংক্ষেপ আর সরল করে নেব ওই ডাক-নামাটকে, বলব ‘তেরকেলে’।
ওই বন্ধুদের নিয়েই কথা শুরু করতে হয়। তেরকেলের বন্ধু যে কত, তার লেখাজোখা নেই। বিভিন্ন বৃত্তির, বিভিন্ন বয়সের লোক তাঁরা। একটা বিষয়ে শুধু মিল আছে তাঁদের মধ্যে। সবাই শিক্ষা আর সংস্কৃতির দিক দিয়ে উঁচু পর্যায়ের লোক।
সেদিন তাঁরা কয়েক জন ডিনারের বেশ কিছু আগেই এসে পড়েছেন তেরকেলের বাড়িতে। সব বন্ধুরই বাঁধা নিমন্ত্রণ এখানে। প্রতি বৃহস্পতিবার এসে তাঁরা ডিনারের টেবিল অলংকৃত করবেন।
তা, আগেই এসে পড়েছেন যখন, কী আর করবেন, ঘুরতে ঘুরতে ল্যাবরেটরিতেই এসে ঢুকলেন। গৃহকর্তা সেখানেই রয়েছেন। একটা বুক সমান উঁচু টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে।
‘এটা কী হে?’ টেবিলের উপরে একটা বৃহৎ যন্ত্রের দিকে আঙুল তুলে তাঁরা জানতে চাইলেন, ‘কী এটা? সাইকেলের মতো, অথচ সাইকেল নয়?’
‘সাইকেলই।’ হাসিমুখে জবাব দিলেন ত্রিকালপন্থী, ‘তবে চাকাহীন সাইকেল। চাকার দরকার তো স্থানগত দূরত্ব অতিক্রম করতে। আমার এ যন্ত্র যা দূরত্ব অতিক্রম করবে, সেটা স্থানগত নয়, কালগত। তাই দেখ, চাকার বদলে কাঁটা বসিয়েছি কতকগুলি। এই কাঁটাটা এক-শো বছরের, এইটে হাজার বছরের, এইটে লাখ, এইটে কোটি—’
ধমক দিয়ে উঠলেন মনস্তাত্ত্বিক বন্ধু, ‘আরে, কী সব বলছ আবোল-তাবোল? হাজার বছর, লাখ বছর… এ সবের মানে কী?’
‘মানে এই যে, এই যন্ত্রে চড়ে হাজার বছরের কাঁটা ঘুরিয়ে দিই যদি, চক্ষুর পলকে আমি হাজার বছর পরের ভবিষ্যৎ কালে পৌঁছে যাব।’
সবাই হাঁ করে চেয়ে রইলেন ত্রিকালপন্থীর পানে। এমন আজগুবি কথা ধাঁ করে যদি তাঁরা বিশ্বাস করতে না-পেরে থাকেন, কে তাঁদের দোষ দেবে?
তেরকেলে বিজ্ঞানী বুঝলেন তাঁদের অবস্থাটা। ছোটো ছেলেদের যেভাবে পড়া বুঝিয়ে দেন মাস্টারমশাই, সেইভাবে বলতে লাগলেন, ‘স্থানের দূরত্ব অতিক্রম করবার জন্য গাড়ি আছে, ঘোড়া আছে, রেল-স্টিমার-ব্যোমযান— কত কী-ই চালু হয়েছে, আরও হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু কালের দূরত্ব অতিক্রম করবার মতো কোনো যানবাহন এ যাবৎ কিছু আবিষ্কার হয়নি, সেই অভাবটা পূর্ণ করবারই চেষ্টা করছি আমি।’
‘চেষ্টা যদি সফল হয়?’ অবিশ্বাস স্পষ্ট হয়ে উঠল মনস্তাত্ত্বিকের প্রশ্নে।
‘সফল হলে, ওই তো বললাম, ইচ্ছামতো ভবিষ্যকালের যেকোনো যুগে আমি চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব নিজেকে, এই চর্মচক্ষু দিয়ে দর্শন করতে পারব, বিশ হাজার বছর পরের মনুষ্যসমাজের অবস্থা, বা লক্ষ বছর পরের ভূপ্রকৃতির পরিবর্তিত চেহারা। ওই যে জিনটা দেখছ, ওইটাতে চড়ে বসব। এই যে কাঠিটা দেখছ, এটাকে এই গর্তে ঢুকিয়ে আস্তে করে চাড় দেব একটা, আর সারি সারি সাজানো ওই যে কাঁটাগুলি, ওর যেটা খুশি ঘুরিয়ে দিয়ে হাজার বা লাখ বছরের ওপারে পৌঁছে যাব সাঁ করে।’
দু-মিনিট সবাই নিস্তব্ধ। এই খামখেয়ালি বিজ্ঞানী বন্ধুর আত্মপ্রত্যয়কে হেসে উড়িয়ে দিতে হলে কী ভাষায় সেটা দেওয়া যায়, তাই বোধ হয় ভাবছিলেন তাঁরা। দু-মিনিট অন্তে কিন্তু তাঁদের দিক থেকে একটাইমাত্র নিরীহ প্রশ্নই এল, ‘যন্ত্র শেষ হয়েছে? নাকি হতে দেরি আছে এখনও?’
উত্তর হল, ‘শেষ হয়নি, তবে দেরিও হবে না। আগামী বৃহস্পতিবারে যখন তোমরা আসবে এ বাড়িতে তখন হয়তো আমি দশ-বিশ হাজার বছর পরের ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে এক চক্কোর ঘুরে এসে সদ্যলব্ধ অভিজ্ঞতার গরম গরম গল্প শোনাতে পারব তোমাদের।’
পরের বৃহস্পতিবারে বন্ধুরা এলেন যখন, তেরকেলে বিজ্ঞানী দৃশ্যমান নন। ঘর-করুনী মিসেস ওয়াচেট বললেন, ‘কত্তাকে দেখতে পাচ্ছি না বেলা দশটার পর থেকে। ল্যাবরেটরি ঘর বন্ধ, তিনি ভিতরে থাকতেও পারেন, না-ও পারেন। সাড়া পাচ্ছি না কিছু। তবে ওই দশটার সময় তিনি আমার হাতে এই চিঠিখানা দিয়েছিলেন, আপনাদের দেবার জন্য।’
চিঠি হাতে হাতে ঘুরতে লাগল অতঃপর। তেরকেলে তাতে লিখছেন
আমি যদি সময়মতো ফিরতে না-পারি, তোমরা খেতে শুরু করে দিও, আমার ভাগের খাবারটা একপাশে সরিয়ে রেখে। হিসাবের চাইতে বেশি সময় লেগে গেল ‘কালচক্র’ শেষ করতে। সবে এইমাত্র কাজ সেরে উঠে দাঁড়িয়েছি। একবার হাতে-কলমে পরখ না-করে এলে শান্তি পাচ্ছি না। তার উপর, তোমাদের কাছে প্রতিশ্রুতই আছি— সদ্যলব্ধ অভিজ্ঞতার গল্প তোমাদের শোনাব বলে। সেই অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় করতে বেরুচ্ছি।
কালচক্র নামটা বেশ মানানসই লাগছে না? যদিও চাকা নেই—
তোমাদের তেরকেলে
‘ভালোয় ভালোয় ফিরলে হয়।’ বললেন মনস্তাত্ত্বিক বন্ধু।
‘ঠিক ফিরবে। ততক্ষণ এসো আমরা ডিনার শুরু করে দিই। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে কিছু খেতে ভালো লাগবে না।’ বললেন সাংবাদিক।
তেরকেলে-বিজ্ঞানী তখন কোথায়?
গোড়া থেকেই বলা যাক তাঁর কাহিনি। সেই সকাল দশটা থেকে।
না, দশটা নয় ঠিক, একটা মিনিট বাকি আছে তখনও দশটা বাজতে। কালচক্রের শেষ পরীক্ষানিরীক্ষায় ষোলো আনা খুশি হয়ে তেরকেলে ঠিক সেইসময় চড়ে বসলেন জিনের উপরে। দু-হাতে দুটো কাঠি। একটা হল ভবিষ্যদর্শনের ছাড়পত্র, অন্যটা অতীতদর্শনের। প্রথমটা ঢুকিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট একটা ফুটোর ভিতরে, তারপরে সামান্য একটা চাড়।
মাথাটা যেন ঘুরে উঠল বোঁ করে। হঠাৎ মনে এল একটুখানি সংশয়। ‘এটা কী করে বসলাম? এর পরিণাম কী?’ ভয় পেয়ে গেলেন তেরকেলে বোধ হয়, অজানার আতঙ্ক। সঙ্গে সঙ্গেই অন্য ছিদ্রে ঢুকিয়ে দিলেন দ্বিতীয় কাঠিটা। সেটাতেও চাড় একটু। তাকিয়ে দেখেন, ল্যাবরেটরিতে নিজের জায়গাটিতেই বসে আছেন কালচক্রে সওয়ার হয়ে। কোথাও কিছু বদলায়নি। এক মুহূর্তের মধ্যে বদলাবেই বা কী?
কিন্তু ওকী? ঘড়িতে দশটা বাজতে এক মিনিট দেখে তিনি কালচক্রের জিনে চড়েছিলেন না? এ তবে কী? ঘড়ি যে এখন বলছে সাড়ে তিনটে! দিশেহারা হয়ে তিনি প্রথম কাঠির চাড় দিলেন আবার।
ধপ করে একটা আওয়াজ। কোথায় আওয়াজ হল, কীসে হল, ঠাহর পেলেন না তেরকেলে। কিন্তু আওয়াজটা হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে একটা অদম্য গতিবেগের সঞ্চার হল যেন তাঁর কালচক্রে। দুর্বার বেগে তিনি যেন ছুটে চলেছেন কোথায়। ঘর-করুনী মিসেস ওয়াচেট দরজা খুলে ঘরে ঢুকছেন, হেঁটে চলেছেন বাগানের দিকের জানালার কাছে। ঘরটা লম্বা, মিনিটখানেক লাগতে পারে জানালায় পৌঁছুতে, কিন্তু তেরকেলে যেন দেখলেন, মোটাসোটা ভদ্রমহিলাটি মেজেটা পেরিয়ে যাচ্ছেন হাউইয়ের মতো ক্ষিপ্রবেগে।
বিজ্ঞানী ছুটেই চলেছেন? না, ঠায় বসে আছেন ল্যাবরেটরিতে? বুঝবার জো নেই। ওদিকে খেয়াল করবার, ও-বিষয়টা বিচার করবার ফুরসুত নেই তেরকেলের। চোখের সমুখে দিনের আলো নিবে এল, রাত্রি এল রাশি রাশি আঁধার নিয়ে, দেখতে দেখতে সে রাত্রিও ভোর। তারপরে আবার রাত্রি, আবার প্রভাত, পালটা-পালটি— শ্বাস ফেলবার সময় নেই। কানের ভিতর ক্রুদ্ধ অস্ফুট গুঞ্জন বাসা বেঁধেছে একটা, যেন স্তিমিত কল্লোলে একটা ভয়াল ঘূর্ণি পাতালে সেঁধিয়ে যাচ্ছে তালপ্রমাণ জলকে পাঁজাকোলায় জাপটে ধরে।
সে অনুভূতি বিশ্লেষণ করা অসাধ্য। এইটুকু কেবল মনে হচ্ছিল যে স্বস্তি পাচ্ছেন না তেরকেলে, এক মুহূর্তের জন্য নয়। এই বুঝি পড়ে যাই, এই বুঝি হাড়গোড়-ভাঙা ‘দ’ বনে যাই, এমনি একটা সর্বগ্রাসী আতঙ্ক। ছুটছেন, না বসে আছেন স্থাণুবৎ? না ছুটলে এই দুরন্ত কাঁপুনি কেন? এই পলকে পলকে দৃশ্যান্তর ঘটে কেন?
একবার আলো, একবার অন্ধকার, দৃষ্টিকে পীড়িত করে তুলছে মুহুর্মুহুঃ। রাত্রি আসছে বাদুড়ের মতো কালো পাখায় দশদিক আচ্ছন্ন করে, তারপরই জ্বলন্ত সূর্য লম্ফে লম্ফে অতিক্রম করে যাচ্ছে মহাশূন্য কান্তার। সেই লাফের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদটাকে দেখা যায় এক একবার, এই প্রতিপদের ক্ষীণ রেখা একটুখানি, তার পরেই পূর্ণিমার জ্যোতির্ময় চন্দ্রগোলক!
গতিবেগ আরও যেন দ্রুততর! দিবা-রাত্রির আগম-নিগম একসাথে মিলেমিশে যাচ্ছে যেন, বিরতিবিহীন এক ধূসরতা সর্বত্র। তাও আবার ফেটে যায় ওই, আকাশে আশ্চর্য নীলিমা, ছুটন্ত মার্তণ্ড যেন একটা দীর্ঘায়িত বহ্নিরেখা। তার শেষপ্রান্তে শশী সূর্য নক্ষত্রমালার সমগ্র দ্যুতিকে নিবিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার মতো জাজ্বল্যমান সুমহান এক আকাশজোড়া আলোকতোরণ।
তারই অলোকে আশেপাশে মাটির পৃথিবী চোখে পড়ছে এইবার। সবই যেন কুয়াশায় ঢাকা, অস্পষ্ট। পায়ের নীচে একটা পাহাড়ের সানুদেশ যেন। এটা কি সেই পাহাড় নাকি, যার উপরে তেরকেলে বিজ্ঞানীর বাড়ি ছিল একদিন? গাছপালা সব এমন কিম্ভূতকিমাকার কেন তাহলে? রং তাদের এই সবুজ, এই বাদামি। এই তারা শাখাপ্রশাখা মেলে ছড়িয়ে পড়ছে দিগদিগন্তে, এই আবার কুঁকড়ে শুকিয়ে ঢলে পড়ছে মাটির বুকে।
ভূপৃষ্ঠও কি পালটে যাচ্ছে নাকি? শক্ত মাটি গলে গলে ধারায় বয়ে যাচ্ছে দূরদূরান্তে? সূর্যবলয়? ও কি মিনিটে মিনিটে পাড়ি দিচ্ছে ক্রান্তি থেকে ক্রান্তিতে? তার মানে তো এই দাঁড়ায় যে, এক মিনিটে এক বছরের কালান্তরে পৌঁছে যাচ্ছে কালচক্র?
বরফ! বরফ! তুষারঝঞ্ঝা! সারা পৃথিবী আচ্ছন্ন করে তুষার জমে গেল সুগভীর। ওই আবার গলেও যাচ্ছে সে-তুষার, বসন্তের উজ্জ্বল শ্যামলিমায় আবৃত হয়ে গেল রুক্ষ মাটির বুক।
এই যদি হয় ভবিষ্যের পৃথিবী—
কৌতূহলে আতঙ্কে মিলে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি জুড়ে বসছে বিজ্ঞানীর মস্তিষ্কে। এই ভাবীকালের পৃথিবীতে মানুষের কী অবস্থা? তার সভ্যতার কীদৃশ পরিণতি? জীবজন্তু উদ্ভিদের কতখানি রূপান্তর বা বিবর্তন? পৃথিবী ধেয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে দিয়ে, ছায়াছবির পর্দায় নতুন নতুন চেহারা পলকের জন্য দেখা দিয়ে পলকেই মিলিয়ে যাচ্ছে আবার চোখের আড়ালে! এভাবে ছুটে লাভ কী? কোনো কিছুর সম্বন্ধেই জানা তো যাছে না কিছুই! জানতে হলে সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে হয় এক জায়গায়, গভীরভাবে মনসংযোগ করতে হয় পরিবেশের উপরে। তবে তো জ্ঞানার্জনের সুযোগ আসবে।
দাঁড়িয়ে পড়া। জিনিসটা নিরাপদ নয়। কালচক্র গড়ে তুলবার সময়েই কথাটা মনে হয়েছিল ত্রিকালপন্থীর। চলার জন্য যে যন্ত্রের উদ্ভাবন, তাকে থামাতে গেলে হঠাৎ একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে। চক্র হতে পারে চুরমার, চক্রের সওয়ার গুঁড়িয়ে গিয়ে রেণু রেণু হয়ে মিশে যেতে পারে ধরার ধুলোর কণায় কণায়।
নিশ্চয়ই। গুরুতর আশঙ্কাই আছে। কথাটা গোড়াতেই মনে হয়েছিল। তখন ভেবেছিলেন, যন্ত্রটা আগে গড়ে উঠুক, তার পরে ও গলদ শোধরাবার একটা উপায় বার করা যাবে। কিন্তু যন্ত্র শেষ হয়ে গেল যখন, মনের আনন্দে ওই প্রয়োজনীয় কথাটা বেমালুম ভুল হয়ে গেল বিজ্ঞানীর, কালবিলম্ব না-করে তিনি চড়ে বসলেন কালচক্রে।
এখন? আবহমান কাল তিনি ছুটতে থাকবেন নাকি তাহলে?
তা তো আর হয় না! নামতে হবেই একদিন। আর হবেই যখন, এখনই হয়ে যাক না! পৌঁছানো গিয়েছে খ্রিস্ট-তিরোধানের এক-শো শতাব্দী পরে, এবার একবার থামা যাক। যদি এই থামাতেই পরমায়ু শেষ না-হয়ে যায়, মূল্যবান অভিজ্ঞতা অনেকখানি লাভ হবে।
যাত্রা শুরুর কাঠিটা ছিদ্রপথে ঢুকিয়েই রেখেছিলেন। সেটাকে বিজ্ঞানী হেঁচড়ে টেনে বার করে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে কালচক্র বন বন করে ঘুরপাক খেল কয়েক বার, মাতালের মতো টলতে লাগল তারপরে। আর বিজ্ঞানী ডিগবাজি খেয়ে ছিটকে পড়লেন কয়েক ফুট তফাতে।
বাজ পড়ার মতো একটা আওয়াজ কানে এল বিজ্ঞানীর, চেতনাই বোধ হয় হারিয়ে ফেললেন কয়েক মুহূর্তের জন্য। জ্ঞান যখন ফিরে এল, নরম ঘাসের উপর তিনি বসে আছেন, শিলাবৃষ্টি মাথায় করে। কালচক্র উলটে পড়ে আছে সমুখে। আকাশ পৃথিবী ধূসর বর্ণ, কিন্তু কানের ভিতর সেই ঘূর্ণীর মৃদুকল্লোলটা আর নেই। বিজ্ঞানী চারদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করছেন বসে বসে।
বাগানের ভিতর ঘাসে-ঢাকা একটুখানি সবুজ মাঠ। রডোডেনড্রনের ঝোপে ঝোপে ঘেরা। শিলাবৃষ্টিতে লাল আর বেগুনে ফুল রাশি রাশি ঝরে পড়েছে প্রতি ঝোপের নীচে। শিলাগুলো কালচক্রকে ঘিরে ঘিরে নৃত্য করছে। মাটিতে পড়েই ছিটকে যাচ্ছে চারিদিকে। ছোটো একখানা দুধ-সাদা মেঘ যেন রচনা করেছে যন্ত্রটাকে বেষ্টন করে। বিজ্ঞানী ওদিকে ভিজে সপসপ করছেন চামড়া পর্যন্ত, ‘চমৎকার আতিথ্য তোমাদের’— চারদিকের ভূপ্রকৃতিকে সম্বোধন করে তিক্তস্বরে বলে উঠলেন তেরকেলে, ‘যে লোক হাজার হাজার বছর ডিঙিয়ে দেখতে এল তোমাদের, তার জন্য অভ্যর্থনাটির আয়োজন করেছ ভারি সুন্দর!’
কিন্তু বসে বসে ভেজা তো বোকামি ছাড়া কিছু নয়! বিজ্ঞানী উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিক লক্ষ করতে লাগলেন আশ্রয়ের সন্ধানে। শিলাবৃষ্টির দরুন চারিদিক ঝাপসা। তবু রডোডেনড্রনগুলোর পিছনে কী যেন একটা বিরাট ইমারত অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। কোনো একরকম সাদা পাথরে যেন তা গড়া। দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মতো অন্য কিছুই নেই কোনোদিকে।
শিলাবৃষ্টি মাথায় করেই ওই সাদা ইমারতের দিকে অগ্রসর হলেন তেরকেলে। সাদা জিনিসটা কোনো বাড়ি বা মন্দির নয়, ব্রোঞ্জের বেদির উপরে মর্মরে গড়া প্রকাণ্ড একটা ডানাওয়ালা স্ফিংক্স। ডানা দুটো ছড়ানো থাকার দরুন মনে হয়, এক্ষুনি বুঝি বেদি ছেড়ে উড়ে চলে যাবে।
তেরকেলে বিজ্ঞানী কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন ওই মূর্তির দিকে তাকিয়ে? আধমিনিট না আধঘণ্টা? যতক্ষণই হোক, হুঁশ হতেই দেখলেন শিলাবৃষ্টি থেমে আসছে। দূরে দূরে আরও অনেক অনেক আকাশচুম্বী অট্টালিকা ভেসে উঠছে চোখের উপর, তাদের পিছনে অরণ্যে ঢাকা একটা ঢালু গিরি সানুদেশ। হঠাৎই কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল বিজ্ঞানীর, তাড়াতাড়ি কালচক্রটাকে খাড়া করে তুলবার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পালানোই ভালো।
ওদিকে সূর্য দেখা দিয়েছে আকাশে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের টুকরো ভেসে চলে যাচ্ছে দিগন্তের কোলে। বড়ো বড়ো বাড়িগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এইবার। তাদের গায়ে গায়ে কারুকার্যের বাহার যথেষ্ট, কিন্তু কেমন যেন নিষ্প্রভ, বেমেরামত, ভেঙে পড়ার মতো চেহারা। সেই ভয় ভয় ভাবটা চেপে বসছে বিজ্ঞানীর মনে। এক অচেনা জগতে তিনি যেন একা, অসহায়। এর কবল থেকে পালিয়ে বাঁচবার জন্য তিনি যন্ত্রটাকে নাড়া দিলেন প্রাণপণে আর তাতেই ওটা ঘুরে এসে আঘাত করল তাঁর চিবুকে। কেটে গেল অনেকখানি।
তা যাক, যন্ত্রটা চালু হয়েছে আবার। এক হাত জিনে রেখে আর এক হাতে কাঠি নিয়ে বিজ্ঞানী লাফিয়ে উঠবার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ওঠা আর হল না। সবচেয়ে নিকটের বাড়িটার দোতলায়, একটা খোলা গোল বারান্দায় একদল লোক দেখা গেল। পরনে তাদের কী একরকম দামি মোলায়েম পোশাক। তারাও বিজ্ঞানীকে দেখছে, ভালো করেই দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।
বিজ্ঞানীর দৃষ্টিও ওদিকেই। কিন্তু আশেপাশেও মানুষের আওয়াজ পাওয়া যায় যে! স্ফিংক্সের কাছাকাছি ফুলগাছের ঝাড় বেড় দিয়ে দিয়ে অনেক লোক দৌড়ে আসছে। ওদের ভিতর একজন সোজা এল বিজ্ঞানীর দিকে। হালকা ছোট্ট চেহারার মানুষটি। চার ফুটের বেশি হবে না মাথায়। বেগুনে রঙের ঢোলা রেশমি পোশাক তার, কোমরে চামড়ার বেল্ট দিয়ে আটকানো। পায়ে চপ্পল, হাঁটু পর্যন্ত অনাবৃত, মাথাতেও নেই কোনো আচ্ছাদন। ওদের ওইরকম বাহুল্যবর্জিত বসন দেখেই বিজ্ঞানীর প্রথম খেয়াল হল যে স্থানটার আবহাওয়া গরম।
কী সুন্দর চেহারা ওর! কী অনিন্দ্য সৌষ্ঠব! কিন্তু স্বাস্থ্য যেন অতিপলকা। মুখে একটা লালচে আভা, যেটা সাধারণত ক্ষয়রোগীর মুখে দেখা যেত আগের দিনে। এ চেহারার মানুষকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তা তাদের সংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন। কালচক্র থেকে হাত নামিয়ে সেই হাত এই অচেনা জগতের অধিবাসীর দিকে এগিয়ে দিলেন বিজ্ঞানী। আরও লোক এসে পড়েছে দলে দলে। তারা ঘিরে ধরেছে ওঁকে, অবাক হয়ে দেখছে শুধু। ভয়ডরের কোনো আভাস নেই তাদের ব্যবহারে, নেই বিরক্তির বা বিতৃষ্ণার কোনো চিহ্ন। গায়ে-পড়া হয়ে বিজ্ঞানীকে তারা ঠেলতে ঠেলতেই নিয়ে চলল তাদের বাড়ির দিকে। কালচক্র পড়ে রইল স্ফিংস্কের পাশে। থাকুক-না, কে নেবে?
বাড়িটাতে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হলঘর। চমৎকার সাজানো, রাজপ্রাসাদের মতোই। কিন্তু সবই যেন অতিসেকেলে, জীর্ণ, শ্রীহীন। আসবাবপত্র ভেঙেছেও একটু-আধটু। তা ভাঙুক, ভাঙা চেয়ারে বসে ভাঙা টেবিলেও দিব্যি খাওয়া যায়, পেটে যদি ক্ষিধে থাকে, আর খাদ্য যদি উপাদেয় হয়।’
রাশি রাশি ফল টেবিলে। নানা রকমের সুপক্ক রসাল ফল। কোনোটাই ঠিক পরিচিত নয় বিজ্ঞানীর। না-হওয়ারই কথা তো! হাজার হাজার বছরের বিবর্তন তো ফলের উপরেও চিহ্ন রেখে যাবে। মানুষগুলো যদি ছ-ফুট থেকে চার ফুটে নেমে থাকে, ফলগুলো ছ-ইঞ্চি থেকে দেড় ফুটে উঠতে বা চার ইঞ্চি থেকে এক ইঞ্চিতে নামতে পারবে না কেন?
আকার যেমনই হোক, ফলগুলি খেতে অতি মিষ্টি। বিজ্ঞানী পেট ভরেই খেল। আশ্চর্য! এরা কি ফল খেয়েই বাঁচে? সন্ধ্যা আসন্ন, সেকালে সান্ধ্যভোজই ছিল সারাদিনের সবচেয়ে বড়ো ভোজ। সম্ভবত সে-রীতি পালটায়নি। তাহলে এর মানে কী? ফল খেয়েই ডিনার সমাধা করল এরা?
খাওয়ার পরে ওরা বাইরে গিয়ে নাচ শুরু করল। ফুলের কেয়ারিতে ঘেরা সবুজ লন আনন্দ-কলরবে হয়ে উঠল মুখর। বিজ্ঞানীর সম্বন্ধে ওদের কৌতূহল নিবে গিয়েছে এর মধ্যেই। ওঁর দিকে কেউ আর নজরই দিচ্ছে না। কোনো বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করবার বা কৌতূহলকে অনুসন্ধিৎসার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যম আর অভ্যাস এদের মধ্যে যেন নেই। বিজ্ঞানী অবাক হয়ে ভাবেন, কালচক্রের আবর্তনে মানবজাতির কি উন্নতি না-হয়ে অধঃপতন হল? এদের তো মানুষ বলে ধারণা করাই শক্ত! সারি সারি মোমের পুতুল যেন হাত ধরাধরি করে নাচছে পুতুল নাচের আসরে।
বিরক্ত হয়ে বিজ্ঞানী এগিয়ে গেলেন চারিদিকটা ঘুরে-ফিরে দেখবার জন্য। দিনের আলো তখনও আছে খানিকটা। যতটা যা পারা যায়, এরই মধ্যে দেখে নিয়ে তিনি তাঁর মেশিনে উঠে বসলেন। আশা করা যাক তাঁর নিজের বাড়ির ডিনার টেবিলে বন্ধুরা তখনও উপস্থিত থাকবেন, তাঁর ফিরে যাওয়ার প্রতীক্ষায়।
অদূরে একটা বিরাট বাড়ি, পাহাড়ের গায়ে। যেমন লম্বা-চওড়া, উঁচুও তেমনি। ছ-তলা-আটতলা হবে অন্তত। অন্যসব বাড়ির চাইতে বেশি ভাঙাও যেন। ওটা কী, তা দেখতে হবে। সেইদিকেই পা বাড়িয়ে দিলেন বিজ্ঞানী।
চলে যাচ্ছেন স্ফিংক্সের পাশ দিয়ে। হঠাৎ বুকের ভিতরটা ধক করে উঠল। কালচক্র কই? কালচক্র? নেই তো! নেই! নেই!
এদিকে-ওদিকে, ঝোপঝাড় তন্ন তন্ন করে লক্ষ করছেন বিজ্ঞানী, কোথাও কোনো চিহ্ন নেই যন্ত্রটার। বেমালুম উবে গিয়েছে একেবারে। কে নিয়ে গেল? বিজ্ঞানীকে নৈরাশ্যের নরকে ডুবিয়ে দিয়ে তাঁর বৈতরণীর খেয়া কে অপহরণ করল? ওই যন্ত্রটি না-পেলে তো এইখানেই তাঁর চির নির্বাসন! দশ হাজার বছর পরের এই অধঃপাতিত পরিবেশে! নিজের দেশে, নিজের যুগে, নিজের মতো মানুষদের সান্নিধ্যে ফিরে যাবার তো কোনো পথই নেই তাঁর! কে চুরি করল তাঁর যন্ত্র? ওই নাচিয়ে-গাইয়ে সজীব পুতুলেরা ছাড়া আবার কে? বিজ্ঞানী ধেয়ে গেলেন তাদের দিকে মারমূর্তি হয়ে, ‘আমার মেশিন কই? কালচক্র? কী করেছ সেটা তোমরা?’
তাঁর ক্রুদ্ধ মূর্তি আর তর্জনগর্জন একেবারে যেন ত্রস্ত করে তুলল এই পুতুলের মতো মানুষগুলোকে। এক মুহূর্ত তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে, তারপরে দুদ্দুড় করে ছুটে পালাতে লাগল বাড়ির দিকে। বিজ্ঞানী আর অনুসরণ করলেন না তাদের। নিজের এই অসংযমের জন্য তিনি এখন লজ্জাই বোধ করছেন। এরা যে এই অপকর্মটি করেনি— এ বিশ্বাসও হচ্ছে একটু একটু করে। কখন তারা করল? তারা তো ফলাহারেই ব্যস্ত ছিল বিজ্ঞানীকে নিয়েই। কখন তারা অত বড়ো ভারী মেশিনটাকে সারিয়ে ফেলল? সরিয়ে ফেলবার শক্তিই বা পেল কোথায়? ওরা সব ক-টি পুতুল একত্র হয়েও তো কালচক্রকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না।
বিজ্ঞানী ফিরে এসে আবার স্ফিংক্সের আশেপাশে ঘুরতে থাকলেন। নরম মাটিতে অনেকগুলো পায়ের দাগ দেখা যায় যেন। খালি পায়ের দাগ। কিন্তু ওই পুতুলদের পায়ে তো চপ্পল রয়েছে। এই নগ্নপদ মানুষ তা হলে এল কোথা থেকে? এ যাবৎ তো এমন একটিও মানুষ চোখে পড়েনি, যার পায়ে চপ্পল নেই! সমস্যা! এরা ছাড়াও অন্য মানুষ এখানে আছে নাকি?
পায়ের দাগগুলো সবই শেষ হয়েছে ওই স্ফিংক্সের বেদির কাছে। বেদিটা বিজ্ঞানীরও মাথার উপরে আরও অনেকটা উঁচু। ব্রোঞ্জের একটা ঘর যেন, অনেকটা জায়গা জুড়ে। চারদিকের দেয়াল খোপে খোপে ভাগ করা। বিজ্ঞানীর সন্দেহ হল, ও খোপগুলির কোনো একটাতে হয়তো গোপন দরজা আছে, সেই দরজা খুলে তস্করেরা কালচক্রকে হয়তো বেদির জঠরে টেনে নিয়ে গিয়েছে।
সে-দরজা আবিষ্কার করা এবং তারপরে সেটা খুলে বা ভেঙে ফেলা— এই হল বিজ্ঞানীর এখন প্রথম কাজ।
ভাঙা? কী দিয়ে ভাঙা যাবে? কুড়ুল নেই, মুগুর নেই, এ যুগে পৃথিবীতে ওসব জিনিসের ব্যবহারই নেই মনে হচ্ছে। লোহার বা কাঠের একটা মোটা ডান্ডা দিয়ে ঘা দিতে পারলে বেদির দেয়াল ভেঙে পড়তে পারে বই কী! বিশেষ মজবুত বলে তো মনে হয় না ওই ব্রোঞ্চের পাত।
কোথায় পাওয়া যায়? অদূরের ওই ছ-তলা ভাঙা বাড়িটার দিকেই দৌড়োলেন বিজ্ঞানী। অনেক কালের পুরোনো মনে হয় ওটাকে। যে-যুগে তৈরি হয়েছিল, হয়তো তখনও ডান্ডা-মুগুর কুড়ুল-শাবলের ব্যবহার ছিল পৃথিবীতে।
বিজ্ঞানী যখন রওনা হলেন ওই বহুতলা বাড়িটার উদ্দেশে, তখনও বেলা কিছু আছে। মনে হল, সন্ধ্যার আগেই তিনি ফিরে আসতে পারবেন, কাজ সেরে। ফিরে আসা তো দরকার! তাঁর প্রাণভোমরা যে পড়ে আছে ওই স্ফিংক্সের বেদির ভিতরে। কালচক্র উদ্ধার করতে না-পারলে তো তিনি চিরবন্দি এ সুদূর ভবিষ্যের যুগে।
হ্যাঁ, মনে হয়েছিল যে বাড়িটা খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু কিছুক্ষণ হাঁটবার পরেই ভুল ভাঙল বিজ্ঞানীর। বেশ দূর আছে ওটা, গিয়ে দেখে শুনে ফিরে আসতে রাত এক প্রহর হয়ে যাবে। অচেনা স্থান, আকাশে চাঁদ উঠবে কি না কে জানে।
কিন্তু, রওনা যখন হয়েই পড়েছেন, আর ডান্ডা-মুগুর যাহোক একটা কিছু নেহাতই চাই যখন, নিবৃত্ত হয়ে ফিরে আসার প্রশ্নই তো ওঠে না! যথাসম্ভব পা চালিয়ে এগিয়ে চললেন বিজ্ঞানী। একটা নীচু পাহাড়ের মাথায় বাড়িটা, ওপাশে সমুদ্র দেখা যায়। জায়গাটা যেন তাঁর খুবই পরিচিত, অবশ্য বাড়িটা নয়। হয়তো তাঁর যুগের অনেক অনেক পরে ওটা তৈরি।
নীচের তলায় ঢুকেই পরিচয় পেয়ে গেলেন যে, কী ছিল বাড়িটা। মিউজিয়াম। বিরাট বিরাট হল আর দীর্ঘ দীর্ঘ গ্যালারি। এক একটা ঘরে এক একটা বিভাগ। বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখার জন্য নির্দিষ্ট আলাদা আলাদা মহল! পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা— বাদ নেই কিছু। তা ছাড়া নৃতত্ত্ব বিভাগ, ভাস্কর্য, চিত্রবিদ্যা— এ সবের জন্য স্বতন্ত্র সংরক্ষিত স্থান। সবই ভগ্ন জীর্ণ অবশ্য। অধিকাংশই এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, বোঝাই যায় না যে জিনিসটা কী ছিল।
সময় থাকলে এই মিউজিয়ামের ভগ্নাবশেষ দেখে দেখেই ছ-মাস কাটিয়ে দিতে পারতেন বিজ্ঞানী। এত বড়ো, এমন বহু বিচিত্র সংগ্রহশালা একদা ছিল সেখানে। কিন্তু সময় তাঁর নেই। তিনি যার জন্য এসেছেন, তাই খুঁজে ফিরছেন ঘরে ঘরে। অবশেষে তা পাওয়া গেল। একটা ঘরে শুধু কঙ্কালসার লৌহযন্ত্র সারি সারি সাজানো। তারই একটাতে ঝুলতে দেখা গেল ভারী এক লৌহদণ্ড। দণ্ডটা খুবই মজবুত, কিন্তু যে নাট-বল্টু দিয়ে তা এক সময়ে সংলগ্ন ছিল মূলযন্ত্রের গায়ে সেইটে গিয়েছে ক্ষয়ে। জোরে একটা টান দিতেই ডান্ডাটা খুলে চলে এল বিজ্ঞানীর হাতে।
কার্যসিদ্ধি! আর কী নেওয়া যায়? আর কী পাওয়া যায় হাতের মাথায়? একটা বায়ুশূন্য কাচের আধারে দেখতে পেলেন মস্ত এক তাল কর্পূর। আশ্চর্য! যে কর্পূর দেখতে দেখতে উবে যায় চোখের সামনে, তাই টিকে রয়েছে যুগযুগান্ত অতিক্রম করে? আস্ত? অবিকৃত? কৌতূহলের বশেই কাচের জার সমেত কপূর্রটা ঝাড়নে বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন বিজ্ঞানী, সমুখে যে দরজা দেখতে পেলেন, তাই দিয়েই। খানিকটা দূর চলে আসবার পরেই ঘটল মারাত্মক দুর্ঘটনা। পায়ের নীচে থেকে মাটি সরে গেল। বিজ্ঞানী পড়ে গেলেন এক সুগভীর কূপে।
কূপের উপরটা সেকালে লোহার পাত দিয়ে ঢাকা ছিল। সেটা স্বভাবতই জীর্ণ হয়ে গিয়েছে। তার উপরে জমছে ধুলোর পুরু আস্তরণ। সেই ধুলোর উপরে পা ফেলা মাত্রই নীচের লোহার পাত গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে একেবারে।
বিজ্ঞানী পড়লেন নরম বালিতে। অন্ধকার নিবিড়, কিন্তু আশেপাশে কথা শোনা যায়। স্ফিংক্সের কাছাকাছি যেসব চার ফুট মানুষ দেখতে পেয়েছিলেন, তাদেরই কথার মতন কথা। পকেটে দেশলাই রয়েছে, তারই একটা কাঠি জ্বেলে ফেললেন বিজ্ঞানী।
কূপের তলাতে তিনি বসে আছেন, তাঁর চারদিকে চার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে চার সুড়ঙ্গ। কথা শোনা যায় সেইসব সুড়ঙ্গের ভিতরই। দেশলাই কাঠিটা হাতে নিয়ে বিজ্ঞানী একটা সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে চললেন। মানুষ যখন আছে, তখন আর ভয় কী? এখানকার মানুষ তো খারাপ নয়!
সুড়ঙ্গ আর সুড়ঙ্গ নেই, ক্রমে প্রশস্ত হতে হতে একটা চত্বরের আকার নিয়েছে। সেই চত্বরে বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি, তাতে নানারকম কাজ করছে উপরের মানুষের মতোই দলে দলে বামন; কিন্তু বেঁটে আকার ছাড়া উপরের ওদের সঙ্গে নীচের এদের আর কোনো সাদৃশ্যই নেই।
দেশলাই কাঠি নিবে এসেছিল, আর একটা জ্বেলে ফেললেন বিজ্ঞানী। তারপর আর একটা ব্যাপার দেখে তিনি অবাক হচ্ছেন, মানুষগুলো অন্ধকারে দিব্যি কাজ করছিল, এখন আলো দেখে তারা দু-হাতে চোখ ঢেকে পিছু হটছে। মুখে কাতর আর্তনাদ। এরা আঁধারের জীব না কি? আলো সহ্য করতে পারে না?
লোকগুলোর গায়ে লম্বা সাদা লোম, তেকোনা মুখে চিবুক বলে কোনো জিনিস নেই। চোখ বলতে যা আছে, তা শুধু একটা চিড়মাত্র— তার উপর-নীচে পাতা নেই মোটে। সোজা হয়ে হাঁটতে তারা পারে না। এমন কুঁজো হয়ে পালানোর জন্য ছুটছে যেন মনে হয় বুঝি-বা চার হাত পায়ে হাঁটছে চতুষ্পদের মতো।
আলো এরা সইতে পারে না, বিজ্ঞানীর এই অনুমান। তা হলে দেখা যাক না, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলে এরা কীরকম ব্যবহার করে। এবারে যখন দেশলাইয়ের কাঠি নিবল বিজ্ঞানী আর আলো জ্বাললেন না।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আশেপাশে নিঃশ্বাসের শব্দ। দুর্বোধ্য ভাষায় চাপা গলার ফিসফিসানি। বিজ্ঞানীর গায়ে ঠান্ডা লোমশ হাতের স্পর্শ। কী জানি কেন, গা ঘিনঘিন করে উঠল বিজ্ঞানীর। তবু তিনি ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, এমন সময়ে শিউরে উঠলেন গলায় ধারালো দাঁতের কামড় লেগে। এরা হিংস্র?
বগলে লোহার ডান্ডাটা ছিলই। সেইটা বাগিয়ে ধরে আঁধারের ভিতরই এলোপাথালি পিটোতে লাগলেন বিজ্ঞানী। মিহি গলার বহু আর্তনাদে পাতালের অন্ধকার বিদীর্ণ হয়ে গেল অমনি। তাড়াতাড়ি আবার আলো জ্বালতেই বিজ্ঞানী দেখলেন, কুঁজো হতে হতে দৌড়ে পালাচ্ছে তাঁর আততায়ীরা।
আলো হাতে নিয়ে আরও কিছুদূর এগিয়ে গেলেন, না-গিয়ে করবেন কী? একটা নিরাপদ আশ্রয় তো চাই রাত কাটাবার জন্য? ঘুরতে ঘুরতে একসময় কিন্তু তাঁকে থমকে দাঁড়াতে হল ভয়ে বিস্ময়ে। একখানা টেবিলের উপরে নরদেহ একটা। চার ফুট পরিমাণ লম্বা। নীচের অঙ্গে রেশমি পোশাক পরাই আছে এখনও। উপরের অঙ্গ থেকে খাবলা খাবলা মাংস যেন এইমাত্র ছিঁড়ে খাচ্ছিল কোনো হিংস্র জন্তু। হুঁ, তা হলে নীচের এরা স্রেফ ফলাহারী নয়!
সেখান থেকে দূরে সরে গিয়ে বিজ্ঞানী বসে পড়েছেন। ঝোলা থেকে কর্পূরের তাল বার করে তাই পোড়াচ্ছেন ক্রমাগত। আলো নিবতে দিলে এই পাতালবাসী নরখাদকদের হাতে প্রাণ যাবে। বসে বসে ভাবছেন। কালচক্রের আবর্তনে মানবজাতর এ কী অধোগতি! যারা ছিল ধনী, বিলাসী, শ্রমবিমুখ, তারা পরিণত হয়েছে উপর পৃথিবীর ওই ফলাহারী জাতিতে। আর যারা ছিল শ্রমজীবী, দারিদ্র্যে নিপীড়িত, তারা মানুষের সংস্কার হারিয়ে নেমে গিয়েছে পশুর পর্যায়ে, বাস করে আঁধারে, ভোজন করে নরমাংস। মাংস অবশ্য ওই উপরতলার মানুষদেরই। হয়তো একটা বিনিময়ের বন্দোবস্ত আছে উপরে ও নীচে। নীচওয়ালারা পোশাক তৈরি করে দেয় উপরওয়ালাদের, আর উপরওয়ালারা ওদের দেয় দেহমাংস। সেটা মৃতদেহের না জ্যান্তদেহের, তা অবশ্য বোঝা যায় না।
ওইখানে কর্পূরের আগুনের সমুখে বসে থাকতে থাকতে একসময় বিজ্ঞানী দেখলেন, নিকটেই একটা জায়গায় একটু একটু আলো আসছে উপর থেকে। উঠে গিয়ে দেখলেন এ আর একটা কূপ, চোঙের মতো উঠে গিয়েছে ওপরপানে। এর গায়ে মাঝে মাঝে আংটাও লাগানো আছে ওঠা-নামা করার জন্য। উপর পৃথিবীর সঙ্গে এই পাতাল রাজ্যের এইগুলিই যোগাযোগের পথ। বিজ্ঞানী আংটা ধরে ধরে উঠে গেলেন উপরে, উঠেই দেখেন সমুখেই তাঁর কালচক্রে। এই কূপটা নেমে গিয়েছে স্ফিংক্সের বেদির ভিতর দিয়ে। ভগবান স্মরণ করে বিজ্ঞানী উঠে বসলেন কালচক্রে, কাঠি চালিয়ে দিয়ে ছুটে চললেন নিজের যুগে।
যখন সেখানে পৌঁছালেন, বন্ধুরা তখনও ডিনার শেষ করতে পারেননি। তাঁদের ডেকে বিজ্ঞানী বললেন, ‘আমার জন্যে কিছু রেখেছ তো? উঠো-না, আমি স্নানটা সেরে এখনই আসছি। খেতে খেতে গল্প শোনাব তোমাদের।’