সাতদিন পরেই চাকরিটা গেল, অর্থাৎ প্রথমে সাসপেনশন, উপযুক্ত কৈফিয়তের অভাবে, পরে খতম, যা নিয়ম মত করতে হয়। পিতৃদেব জানিয়েছেন, অনুগ্রহ করে তার ‘গৃহ’ ত্যাগ করলে সুখী হবেন, কারণ একটা মাতাল (এতদিন বলতে সাহস করেননি, ভাবতেন, ওসব একটু আধটু হয়ে থাকে।) হাতী পোষা সম্ভব নয়। তা আমি জানি, সেইজন্যেই কলকাতার বাইরে, কোথাও একটা পেট চালানো গোছের চাকরির সন্ধান করছি, তা ছাড়া চিকিৎসারও দরকার, পেটটা বোধহয় পচে যাচ্ছে। এ অবস্থায়, একদিন এক পুরনো বন্ধু এল, রাজনীতি করে। সে তো পরিষ্কারই বলল, (মদ খাওয়া ভল্লুক বানচোত, ক্ষেপেই আছে।) আমার মধ্যে যে একটা সংগ্রামী মানুষ আছে, তা নাকি ও চিরকালই (মাইরি!) জানত, এমন কি ওর পার্টির নেতারা যত জানে, যে পার্টির সঙ্গে আমার বিশ বছরের তাজা রক্তের (এখন কি বাসি?) যোগাযোগ হয়েছিল, যাদের আদর্শ নিয়ম নীতি, সবকিছুকেই খাঁটি হিন্দুর বেদের মতই, যাকে বলে, অভ্রান্ত বলে জেনেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম, সেই পার্টি্র নেতাদের নির্দেশেই ও এসেছে, ওদের পার্টির দরজা আমার জন্যে খোলা। এখন সসম্মানে ঢুকে, আমি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। তা ছাড়া, আমার পরিচয়টাও দেখতে হবে, লোকে যখন শুনবে, আমি কী ভাবে চাকরি ছেড়েছি, একেবারে মার মার কাট কাট, জনসাধারণ আমাকে লুফে নেবে, (ফিলম, এস্টারের মতন?) নেতা হবার যোগ্যতা ও সাহস আমার আছে। সবাই গোপালঠাকুর চিনে বসে আছে, যেন আমি জানি না, আমার চাকরির চক্রের মত, পার্টিরও চক্র আছে, এবং চাকরির চক্রে যেমন ঘুষ খাওয়া অপরাধ নয়, তেমনি পার্টিচক্রের মধ্যেও কোন পাপই পাপ না, যদি পার্টির প্রয়োজন হয়, (যেমন ভোটের চুরি, ঘরের বউকে বেশ্যা, বেশ্যাকে ঘরের বউ সাজিয়ে সবাই কাজ সারে, কিংবা যাকে কুকুরের মত ঘৃণা করি, হয়তো ও বেলাই ঠেঙিয়ে মারব, অথচ এ বেলা তার গালে চুমো খেয়ে কথা বলছি, পলেটিকস্ যে!) তারপরে ধাক্কা মেরে একদিন গেটের বাইরে। তোমার পরিচয় ‘মানুষ’ নয়, ‘পার্টিম্যান’, তখন যদি তোমার মনে হয়, পার্টির নেতা ভুল করছে বা অন্যায় করছে, বা ধর তোমার প্রেমিকাকেই লুটছে, কিংবা একটা আন্দোলনই বানচাল হয়ে যেতে পারে, তো খবরদার, একটি কথা নয়, যন্ত্রের মত, এগিয়ে চল, পোষা কুকুরের মত ‘লয়াল’ হও, কারণ কি না, যত পাপই করি, আখেরে, ভালর জন্যেই তো! স্বাধীনতাকে ভয় পায় না, এমন পার্টি আমি কোথাও দেখিনি, আর আমি যে গর্তের বাইরে এটা বন্ধুকে বোঝানো, যাকে বলে, একেবারই দুঃসাধ্য কারণ আমার চেনা জঘন্য স্বাধীনতা ওর কাছে হয়তো কোন অর্থই বহন করবে না। অতএব, কাটো, নড়ুই যা হচ্ছেন তা দাশের নোকে দেখছেন।
কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ধারে যে কথাটা আমাকে ভাবিয়েছিল, (মাস খানেক তো হল।) আমি দেখছি, সেটা আমাকে ছাড়ছে না, এবং চিন্তা এই জেদ, (মামদোবাজী।) সত্যি বলতে কি, এক এক সময় যেন, আমাকে, কী বলব, ক্লান্ত করে ফেলছে, মানে চিন্তাটা ফো আমাকে ধরে ধরে মারছে, আর বলছে, এটা অসম্ভব যে নীতাকে আর আমি কখনো দেখতে পাব না, বুকের কাছে নিয়ে (মাইরি, ভাবলেই গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠছে, এটা কিন্তু সত্যি, ওকে পেলে আমার কাউকেই বুকের কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করত না।) মুখখানা যাকে বলে, খুব কাছে নিয়ে, আদর করতে পারব না। আজ এখন মফস্বল থেকে ফিরছি, একটা ফ্যাক্টরীতে সুপারভাইজারের ইন্টারভিউ দিয়ে, চাকরিটা হয়ে যেতেও পারে, তবে কে জানে, ঘুষ-টুধ দিতে হবে কি না, তা হলেই তো গেল। কিন্তু এ চিন্তার থেকেও, নীতার চিন্তাই বেশী হচ্ছে আমার। সেই তুম্বোমুখো ইনভেস্টিগেটর কয়েকদিন হল ছেড়ে গিয়েছে আমাকে, তাতে যেন নীতার চিন্তাটা করার বেশী সুযোগ পাচ্ছি। এখন তো, সত্যি বলতে কি, আমার দিব্যি লাগার কিছু নেই, হাসি পেয়ে যাচ্ছে ওই ভেবে, (উল্লুক) নীতার কথা ভেবে আমি কখন হয়তো কেঁদেই ফেলব। এক এক সময়, খালি এই কথাই মনে হতে থাকে, যা হয়তো কখনোই সম্ভব ছিল না, (শিয়ালদহ থেকে নেমে, বাসে উঠলাম। আমি আবার এখন বাড়িতে থাকি না, অন্য জায়গায় একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি, চাঁদনি চকের কাছে।) আচ্ছা, যদি এরকম হত, আমি আর নীতা, এমন ভাবে মিশে যেতে পারতাম, যে, কখনোই ছাড়াছাড়ি হবে না, মানে, তার থেকে এ কথা বলছি না, ওই যে কী বলে, সেকস্ এ্যাটাচমেণ্ট না কি এ্যাডজাস্টমেণ্ট, এ সব বলে, যেন একেবারে যেখানেই থাকি, এ্যাটাচমেণ্টের টানে দুজনে পাগলের মত ছুটে কাছে এলাম, লোকে দেখে বলল, ওফ, শালা ভালবাসা, কারণ তারা তো আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না, আমি সেরকম ছাড়াছাড়ি না হওয়ার কথা বলছি না। আমি বলছি, (মাইরি বলতে সাহস পাচ্ছি না।) আমি বলছি কি, যদি এইরকম হত যে, দুজনে কখনও কারুর কাছে মিথ্যে বলব না, না না, সবাই বে বলে আমি ঠিক সেরকম বলতে চাইছি না বোধহয়, (মাথাটা ঘুরছে, আমি আজকাল সব কথা যেন ভাল করে ভাবতেই পারি না। আমি বলছি, দুজনে দুজনে কাছে মিথ্যে বলব না মানে কি—যার অর্থ হল, কোন সুখ, কোন দুঃখ, অর্থাৎ হ্যাঁ—যদি, যাকে বলে ‘কামনা বাসনা’ ইত্যাদিও, যা মনের মধ্যে জাগে, আর ডুবে যায়, যা কখনোই বাইরে প্রকাশ পায় না কারুর সাধ্য নেই, ভেতরটাকে দেখতে পায়, আর সেখানটাই যদি দুজনের কাছে খুলে দিতে পারতাম, আর ওফ, ভীষণ খারাপ, খারাপ ব্যাপার দুজনেই দুজনের মধ্যে দেখতে পেতাম, তবু না, পেছু হটা নয়, কারণ মিথ্যেটা তো ওকে বা আমাকে একলা কষ্ট দিচ্ছিল না, দুজনকে, তাই ভয় পাবার কী আছে, তবু যাকে বলে সত্য। বউ নয়, বেশ্যা নয়, প্রেমিকা নয়, কী বলে, তা আমি জানি না, কারণ এই তিন প্রকারের দ্বারা, আমি যে কথা বলছি, তা সম্ভব নয়, উপায় নেই তাদের, তারা সকলকেই, যাকে বলে খুব অসহায়, অতএব; ওসব না, যদি, ও ভয়হীণ, লজ্জাহীন-ঘৃণাহীন (দুজনের মাঝখানেই মাত্র যে লজ্জা ঘৃণা ভয় আছে।) সত্য দুজনে, দুজনের কাছে প্রকাশ করতে পারতাম, অর্থাৎ ওই সেই স্বাধীনতা, যার ভয়ে মরি, সেই স্বাধীনতার স্বাদের জন্যই, দুজনে দুজনের কাছে ছুটে আসতে পারতাম, অর্থাৎ সত্যের জন্যই একমাত্র পাগল হয়ে উঠতাম আমরা, হ্যাঁ যে সত্য, যদি বল দুজনের জিভের লালার স্বাদ গ্রহণও আছে কি না, তবে নিশ্চয়ই আছে, সে তো থাকবেই, কারণ জীবত্ব আছেই, তা নয়, আমি কি বলছি, বোধহয় পাগলামির কথাই বলছি, সেকস্ এটাচমেণ্টের যেমন পাগলামি, তেমনি সত্যের কোন এ্যাটাচমেণ্ট যদি থাকত, তা হলে আচ্ছা, তার চেয়ে আমি যদি ঘটনা দিয়েই বোঝই–কিন্তু একি, আমি যে সিঁড়ি উঠে এলাম, এটা কোথাকার কোন বাড়ির সিঁড়ি?
কী আশ্চর্য, আমি দেখছি, আমি নীতার এ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি, সামনেই নীতার ঘর, বন্ধ রয়েছে। এর মানে কী, মাথাটা খারাপ হয়ে গেল নাকি, বুঝতে পারছি না। ওই সেই, ওই যে বললাম, আমার ভেতরে সেই চিন্তার জেদ, কারণ, আমার ভেতরের তো ধারণা, নিজের গলাতেই নাকি আমি কনুই বসিয়েছি, (কী যে বলে!) অতএব ভেতরটাই ঠেলতে ঠেলতে এখানে নিয়ে এসেছে।
পিছনে, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালাম, না, চিত্রা নয়, সেই তুমবোমুখো ইনভেস্টিগেটর। সিঁড়িতে একটা খুব বড় ছায়া ফেলে, থপথপিয়ে উঠে আসছে। কে জানে কোত্থেকে এল, পেছনে পেছনেই ঘুরছিল বোধহয়, এসে আমার সামনে দাঁড়াল! আর সেই খোকনের মত নিরীহ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। না, ঠিক নিরীহ বলা যাবে না বোধহয়। অনেকটা খোকনের চোখে কৌতূহল মেটাবার যেমন ঝিলিক ফুটে ওঠে, সেইরকম। তারপরে পকেটে হাত দিয়ে, একটা চাবি বের করে, সেই মোট খসকা খসকা গলায় বলল, ঘরটা খুলে দেব?
আমি বললাম, দিন।
লোকটা ঘর খুলে, যেন আমাকে আপ্যায়ন করছে, এমনি ভাবে ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি আলো জ্বলে দিল, কারণ অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। তারপর নিজেই, নীতার শোবার ঘরে ঢুকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাল। যেন আমাকে অভ্যর্থনা করছে। আমি লোকটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নীতার শোবার ঘরে ঢুকলাম, ঢুকে খাটের কাছে গেলাম, সেখান থেকে আয়নার দিকে তাকালাম। মুখ ফিরিয়ে, ঘরের চারদিকেই একবার দেখলাম, লোকটার সঙ্গে আবার আমার চোখাচোখি হল, এখন যেন লোকটা ভূত দেখছে। কেন, আমি কি ভূত হয়ে গিয়েছি, আমার কি ছায়া পড়ছে না? এই তো বেশ, বড় ছায়া। পড়েছে, কিন্তু আমার যেন মনে হল, আমি পাশের ঘরে না গিয়ে পারব না, যে ঘরের দরজাটা বন্ধ রয়েছে, কেন না, নীতা কি ওখানে আছে, এ কথা আমার মনে হল, অথচ আমি তো জানি, তবু ওই যে কী একটা জেদ, নীতা আছে। তাই আমি পাশের ঘরের দরজার কাছে গেলাম, আর তুমবোমুখো নিজে এগিয়ে এসে, ভেজানো দরজাটা খুলে দিল, যেন কোন মাননীয় ভিজিটরকে বিশেষ কিছু দেখাচ্ছে। আমি ঘরটার মধ্যে ঢুকলাম, আর সত্যি বলতে কি, আনি নীতারই গন্ধ পেলাম যেন, এবং নীতা কি জামাকাপড় বদলাচ্ছে, কেন না— কিন্তু না, ঘরটা কী রকম ভীষণ অন্ধকার, আমি বেরিয়ে এলাম। এসেই বাথরুমের দরজাটার দিকে আমার চোখ পড়ল, আমি খুলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু না। থাক, বরং কাঠের পার্টিশনের ওপারে যাই, এবং তাই গেলাম, আর রেফ্রিজারেটর চুপচাপ রয়েছে দেখলাম, সেই একটা গিটি গিটি চাপা শব্দ নেই, যেন মরে রয়েছে, তবু হাতলটা ধরে আমি খুলে ফেললাম, কিছু নেই, শুধু কয়েক বোতল জল। সেই সেদিনের জল নাকি, না কি পরে আবার কেউ বোতলে জল পুরে রেখে দিয়েছে, কে জানে। রেফ্রিজারেটর বন্ধ করে, ফিরতেই দেখলাম, তুম্বোমুখে আমার পেছনেই, কিন্তু আমি বেসিনটার ওপরে ঝুঁকে পড়লাম, যদিচ, সেই আমার জলে ডুবিয়ে দিয়ে যাওয়া প্লেটগুলো এখন আর নেই, (সেই নীতা শেষ খেয়েছিল, রাত্রে খেতে যাবার কথা ছিল।) কে নিয়েছে কে জানে। ত কেন যে কলের মুখটা খুলে দিলাম, জানি না, কলকল করে জল পড়তে লাগল। আমি ঘরের দিকে ফিরে দাঁড়ালাম, আর আমার চোখের সামনে একটা জলপ্রপাত ভাসতে লাগল, বোধহয় উশ্রী-প্রপাতই হবে, সেই গাছের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কলকল করে নামছে, আর রোদের ঝিলিকে যেন…।
মোটিভটা কী, এই মার্ডারের…।
এই শেষ না হওয়া কথাটা, খসকা খসকা চাপা গলায়, জিজ্ঞাসার মত আমি শুনতে পেলাম। মোটিভ! মার্ডার! কিন্তু মোটিভ, আমি কী বলব, কিসের মোটিভ, আর মার্ডার, মার্ডারের কিছুই কি আমি জানি? আমি আবার নীতার খাটের দিকে গেলাম। কিন্তু এই শীতের সন্ধ্যারাত্রির ধোঁয়া যেমন বিশ্রী দম আটকে ধরে, আমার সেইরকমই লাগল। আমি লোকটার দিকে আবার দেখলাম, তাকিয়ে আছে থাকুক, আমি পিছন ফিরে, নীতা শেষ যেখানে উপুর হয়েছিল, সেখানে গেলাম, সেখানটা ছুঁতে ইচ্ছে করল, জানি, এখন কিছুই আর নেই, তবু মানুষের একটা কী রকম আছে, সে না থাকা জিনিসকেও পেতে চায়, নীতা তো এখানেই, (যদিও চাদরটা টান টান করা এখন আর ভীষণ শাদা, কোন দাগ নেই, যেন শূন্যতার মত হা হা করছে।) ছিল।
পিছনে শব্দ পেয়ে দেখলাম, লোকটা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে, কী যেন বলল, কিন্তু আমার কানে গেল না। সেদিন নীতা কী রকম নেচেছিল, তখন বোঝাই যায়নি পরে ওরকম রাগ করতে পারে। আমি হাতটা নামিয়ে, খাটের কাছে নীচু হলাম। আবার আমার কানে উশ্রী প্রপাতের শব্দটা বাজল, রোদ ঝলকানো নীল জলের ঢল আমি যেন দেখতে পাচ্ছি। আর তখনই, নীতার সেই একটা গান, যেটা ওর খুব প্রিয় ছিল, বাংলা করলে, যার মানে, ক্যাকটাসের বুকে ইতিমধ্যেই রোদ পড়েছে। আমার মনে পড়ল, যেন শুনতে পেলাম, ও গুনগুন করেছে।
মেজাজটাই খিচড়ে গেল। এর পরে আর নেই কেন ?
হাহাহা। এর পর আর কী কী হতে পারত?
Besh to, eta ki kore holo moshai…?? Manush bole megh na chaite jol, eta deki tar purutai ultu moshai….? Dum kore shuru aber dum kore sesh…?
ekanei ki shesh?
Ta besh, besh