এম-১
মোটা সাঁড়াশি দিয়ে কেঁচোটাকে আটকে ফেলেছে ভেইল, টেনে তুলছে কাদার ভিতর থেকে। কেঁচোর মতো কেঁচো বটে। লম্বায় দশ থেকে বারো ফুট। সে আন্দাজে মোটা হলে অবশ্য ভেইলের সাধ্যই হত না ওকে তুলে এনে কাচের বোয়ামে বন্ধ করার। ফিনফিনে সরু, প্রায় আমাদের পৃথিবীর কেঁচোর মতোই। তাইতেই রক্ষা।
বলা বাহুল্য, এ কেঁচো গ্রহান্তরের। লুকোছাপার দরকার কী? গোড়া থেকেই জানিয়ে দেওয়া ভালো যে কথা হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে। এই প্রথম এখানে পদার্পণ হয়েছে পৃথিবীর দু-টি মানুষের। এসেছে তারা মহাশূন্যযান ‘এম-১’-এ সওয়ার হয়ে। পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র তাদের পাঠিয়েছে, সেটা অনুমান করে নিতে যেকোনো বুদ্ধিমান লোকের এক সেকেন্ডের বেশি লাগবার কথা নয়। সুতরাং দেশের নামটা না-হয় ঊহ্যই থাক আপাতত।
একটা কথা, এই এম-১-এর এই অভিযানের উপলক্ষ্যে ঢাক-ঢোল আদৌ বাজেনি সে দেশে। তার কারণ, ব্যাপারটা প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো এক দেশের কাছ থেকে গোপন রাখা সাংঘাতিক রকম দরকার ছিল। মঙ্গলের মাটিতে পাড়ি দেবার কোনো মতলব এদিকে কিছুমাত্র নেই, এমনটা বুঝলে পরে ওদিকের ওরাও ও ব্যাপারে নিরুৎসুক থাকতে পারে হয়তো। আর তা যদি থাকে তো সেই সুযোগে এদিকের এরা প্রতিযোগিতার দৌড়ে খানিকটা এগিয়ে যেতেও পারে হয়তো, এইরকমই আশা ছিল আর কী!
যাই হোক, এম—১ যখন রওনা হল পৃথিবী থেকে, হইচই কিছু হয়নি। লুনা সিটি রকেট ঘাঁটির লোকেরা অবশ্য জানবেই, আর জানবেন মহাকাশ গবেষণা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা দু-চারজন। তা ছাড়া আর কেউ সেদিন হাজির ছিল না ঘাঁটিতে। দেশের সবজান্তা সাংবাদিকরা পর্যন্ত ফাঁকি পড়েছিলেন নিমন্ত্রণ থেকে। ফলে এম-১ উড়ল, ছুটল। মঙ্গলে নিরাপদে অবতরণ করে কুশলবার্তা জানাল পৃথিবীর বন্ধুজনদের। মুষ্টিমেয় কতিপয় লোক ছাড়া এই এত সব পিলে চমকানো খবর কেউ কিছুই পেল না।
সব কিছু লুকিয়ে রাখবার এই যে দারুণ আগ্রহ, পরবর্তী পরিস্থিতিটার জন্য ওটাই আবার দায়ী নয় তো?
কথাটা খুলে বলা যাক।
প্রস্তুতিতে খুঁত কিছুই ছিল না। মহাকাশ পরিক্রমায় বিমান পাঠানো, এটা এদেশের পক্ষে নতুন কিছু নয়। অভিজ্ঞতা প্রচুর, তোড়জোড় সেই অভিজ্ঞতারই অনুযায়ী বিপুল। মানুষ এর আগে মঙ্গলে নামেনি তা ঠিক, কিন্তু বিমানদূতেরা চালকহীন অবস্থাতেই এসে এসে গ্রহটার অন্ধিসন্ধি যথাসম্ভব জেনে গিয়েছে। পাহাড় প্রমাণ ফোটো রয়েছে পৃথিবীর গবেষণা বিভাগে। দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের পরীক্ষানিরীক্ষা, অনুমান ও সিদ্ধান্তের সব কিছু বিবরণ সুশৃঙ্খলায় গ্রথিত রয়েছে সেখানে। তারই তত্ত্ব ও তথ্য অনুসরণ করে এম-১-কে নিরাপদ ও কর্মক্ষম, উপরন্তু আরামপ্রদও করে তুলবার পক্ষে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণেই শৈথিল্য দেখাননি কর্তারা। কেবল একটি জায়গায় বাদে।
বিমানের ইঞ্জিনখানি দেখিয়ে নেওয়া হয়নি কাল স্যুমানকে। অথচ মহাকাশযাত্রী বিমান গড়বার বেলায় স্যুমানকে ডাকতে এর আগে কখনো ভুল হয়নি কর্তাদের। এদিক দিয়ে ওই লোকটিই যে দুনিয়ার সেরা শিল্পী, এটা সারা দুনিয়াই মানে।
তাঁকে দেখিয়ে নেওয়ার অসুবিধাও কিছু ছিল না। ভদ্রলোক দোরগোড়াতেই থাকেন। অন্য অন্য ব্যাপারে গবেষণা বিভাগ তাঁকে ডাকেও অহরহ। এইক্ষেত্রেই শুধু ব্যতিক্রম হয়েছে, ডাকা হয়নি। সমস্ত কাজটি সমাধা হয়েছে স্যুমানকে আড়াল করেই।
কারণ? কারণ, এক যুগ ধরে এদেশের পাকা বাসিন্দা হলেও, স্যুমান গোড়ায় ছিলেন এমন এক দেশের লোক, যার সঙ্গে এদের সম্পর্ক ছিল একসময় সর্বতোমুখী শত্রুতার। সে ইতিহাস ভুলতে পারেনি গবেষণা বিভাগ। কাজে স্যুমানকে তাঁরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে পারে না; গোপন ব্যাপার তাঁর কাছে গোপনই রাখে। এম-১-এর বৃত্তান্ত ওঁকে তাই জানানোই হয়নি।
ভেবেছিলেন বই কী! গবেষণা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা অনেক ভেবেছিলেন কথাটা। আলাপ-আলোচনা তর্কাতর্কি অনেক হয়েছিল তাঁদের মধ্যে। শেষপর্যন্ত সর্বসম্মতভাবেই সাব্যস্ত হয়েছিল যে, স্যুমানকে এটা জানানো অত্যাবশ্যক নয়। যাঁরা এম-১-কে গড়েপিটে মহাশূন্য পথে পাঠাচ্ছেন, তাদের যোগ্যতা স্যুমানের চেয়ে কম বলে ধারণা করবার কোনো কারণই চোখে পড়ে না।
থাকুক সে পুরোনো কথা।
আজকের কথা হল এই যে, মঙ্গলের মাটিতে আজ তৃতীয় দিন এম-১-এর। মেরু থেকে দেড়শো মাইল দক্ষিণে নেমেছে বিমান। লাল ধুলোয় সমাচ্ছন্ন মঙ্গলের আকাশ বাতাস এবং ভূ-পৃষ্ঠেরও শতকরা আশি ভাগ। বিশেষ কায়দায় তৈরি মুখোশ সঙ্গেই এনেছে বৈমানিকেরা। লাল গ্রহের আকর্ষণের গণ্ডিতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সেটা পরে ফেলেছে মুখে। বলা বাহুল্য, অক্সিজেনের নল ঢোকাবার মতো ফুটো আছে সে মুখোশে।
পৃথিবীর পণ্ডিতেরা হিসাবটা ঠিকই করেছিলেন। এম-১-কে তাঁরা নামিয়ে দিয়েছেন মঙ্গলের এমন একটি জায়গায়, যেখান থেকে গ্রহটার দুটো অংশেই কিছু কিছু খোঁজখবর চালানো যায়। দুটো অংশ? হ্যাঁ, দুটো অংশই বলা যায় বই কী! এক অংশে জল আছে, অপর অংশে নেই জল। মেরুর নীচে দু-শো মাইল বরফগলা জলে সরস, তারপর থেকেই একটানা মরুভূমি— রুক্ষ, শুষ্ক, জ্বলন্ত।
ভেইল কেঁচো খুঁড়ছিল এই দুই অংশের সীমারেখায়। জল এখানকার মাটিতে অল্পই, ফলে ধুলো রূপান্তরিত হয়েছে কাদায়। আর সে কাদা জন্ম দিয়েছে অতিকায় রাক্ষুসে কেঁচোকে। মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে নিয়ে যাবার মতো জ্যান্ত জিনিস এ যাবৎ মোটে দুটো দেখতে পেয়েছে ভেইলেরা। এক এই কেঁচো, আর এক ওই ওদিককার শেওলা। সজল অঞ্চলে দাপট কী সে শেওলার! ওই যে বলা হয়েছে যে ভূপৃষ্ঠের শতকরা আশি ভাগই শুধু ধুলোয় ঢাকা, বাকি বিশ ভাগ ঢাকা পড়েছে ওই শেওলায় আর ব্যাঙের ছাতায়। প্রত্যেক রকমের নমুনা নিয়েছে ভেইলেরা। তেরোরকম ব্যাঙের ছাতা আর সাতাশরকম শেওলা।
এখন এই কেঁচো ডজন দুই তুলে বোয়ামে ভরতে পারলেই কাজ শেষ এখানকার। ফোটোগ্রাফ যেসব নেওয়ার, নিয়ে শেষ করেছে ওরা। মেরুর ছবি, মরুর ছবি, সরলরেখার মতো যেসব লম্বা দাগকে আগে পৃথিবীর লোকে মনে করত মানুষের কাটা খাল বলে, তাদের ছবি। পাথরের নমুনা, ধুলোর নমুনা কয়েক বস্তা। সব আয়োজন শেষ। মেয়াদ ফুরোলো তাদের। বাড়ি ফিরতে হবে আজ, বেলা ঠিক পাঁচটায়।
বাড়ি ফিরতে হবে, সে চিন্তায় রোমাঞ্চ লাগে। ফেরার পালাও নিশ্চয়ই নীরবে উদযাপন করবেন না দেশের লোক, যেমন করেছিল যাত্রা শুরুর পালাকে। সেবার যা ছিল সংশয়ে আচ্ছন্ন নতুন একটা প্রয়াস মাত্র, এবার তা দাঁড়িয়েছে বিজয়গর্বে মণ্ডিত একটা অভিনব সাফল্য। মঙ্গল গ্রহে অভিযান চালিয়ে ফিরে এসেছে দুঃসাহসী বিজ্ঞানীরা! এবার কি আর জয়ধ্বনি দিয়ে তাদের বরণ করে নেবে না পৃথিবীর মানুষ?
আজও বেতারে একটু কথা হয়েছে ও নিয়ে। গবেষণা বিভাগ আভাস দিয়েছে একটা সমারোহ ব্যাপারের। রাষ্ট্রপতি নিজেই হয়তো লুনা সিটিতে হাজির থাকবেন। জ্ঞানীগুণী সমাজের একটা অভূতপূর্ব সমাবেশ হবে মঙ্গলজয়ী যুগল বীরকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য।
যাক, শেষ হল এই নোংরা কাজটা। আর কেঁচো তুলবার দরকার নেই, কারণ বোয়াম নেই আর। কতগুলো হল? ওরে বাপস! আঠারোটা! সারা পৃথিবীর লোকে করুক-না গবেষণা! কেঁচোর অভাব হবে না।
উঠে দাঁড়িয়ে পিঠটা সবে সোজা করেছে ভেইল।
আকাশে আকাশে লাল ধুলো। দেখলে ভয় করে। অতি সহজেই ও-ধুলোকে জমাট রক্ত বলে কল্পনা করে নেওয়া যায়। সূর্যটাকে দেখাচ্ছে দূর দূরান্তরের কোনো ক্রুদ্ধ দানবের আগুন-চোখের মতো। এক পলক ওদিকে তাকিয়ে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল ভেইল। বোয়ামগুলো ঝুড়িতে বসিয়ে কাঁধে তোলার জন্য তৈরি হল। এখন মাইল দুই হাঁটতে হবে এম-১-এর কাছে পৌঁছোবার জন্য। বেলা তিনটে বাজবে তাতেই। তারপর খাওয়া, একটু বিশ্রাম করা, তারপর বসে প্রতীক্ষা করা— কখন সংকেত আসবে বেতারে, আর অমনি রকেট ছুড়ে মারতে হবে শূন্যপানে, ফেরার পথে গতিবেগ সংগ্রহ করবার জন্য।
ঝুড়ি তুলে কাঁধে নেবার জন্য নীচুপানে ঝুঁকেছে ভেইল, এমন সময় হঠাৎই আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে হল তাকে। দূর থেকে ওই কে আসছে না? কুঁজো হতে হতেও ভেইল দেখে ফেলেছে তাকে। লোকটা দৌড়ুচ্ছে না। কারণ পৃথিবীর জীব মঙ্গলের মাটিতে চেষ্টা করলেও দৌড়ুতে পারবে না। চিৎকারও করছে না লোকটা। কারণ শব্দ বহনের উপযোগী বাতাস নেই মঙ্গলে। তবু—
তবু তার হাঁটার ভঙ্গি, ওদিকে জলের রাজ্য বলে লাল ধুলোর ঘনত্ব একটু কম, ভঙ্গিটাও নজরে পড়েছে ভেলের। ব্যস্ততারই ভঙ্গি, তাতে সন্দেহ নেই। কিংসটন ছাড়া আর তো কেউ হতে পারে না! কারণ ভেইল নিজে আর তার সহকারী বৈমানিক কিংসটন ছাড়া তৃতীয় মনুষ্য সন্তান তো মঙ্গলে নেই!
কল্পনাশক্তি অতিমাত্রায় প্রবল হলে দূরের মূর্তিটাকে মঙ্গলের মানুষ বলে কি ভাবতে পারত ভেইল?
না, পারত না তাও। গোড়ায় গলদ। মূর্তিটার পরনে মহাকাশচারীর উপযোগী কিম্ভূতকিমাকার পোশাক, মায় মুখোশ আর অক্সিজেনের চোঙ সমেত ঠিক ভেইলেরই প্রতিচ্ছবি একটি।
মঙ্গলে এমন পরিচ্ছদ যদি তৈরি হত আর তা পরবার মতো জীব যদি মঙ্গলে থাকত, তাহলে আর ভাবনা ছিল কী? কেঁচো না-খুঁড়ে সেইসব জীবের আশেপাশে আনাগোনা করাই হত সেক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ।
এসে পড়েছে লোকটা। কিংসটনই।
একটা আঙুল তুলল ভেইল। তার অর্থ, সে জানতে চাইছে ব্যাপার কী। এ সময়ে বিমান ছেড়ে আসবার তো কথা নয় কিংসটনের! প্রথমত আসার প্রয়োজন নেই কিছু, দ্বিতীয়ত অজানা দেশে বিমানখানাকে অরক্ষিত ফেলে আসা উচিতও নয়।
ভেইল তুলেছিল এক আঙুল, কিংসটন তুলল একসাথে দু-হাতের দশ আঙুল। তার অর্থ— পরিস্থিতি সাংঘাতিক, বিমান বিপন্ন।
সংকেতের ভাষায় কথাবার্তা বেশি দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। গুরুতর বিষয়ে আলোচনার দরকার হলেই ওরা সাহায্য নেয় খাত পেনসিলের। এইখানে মরু সীমানায় দাঁড়িয়ে সেভাবে কথা চালানো সময়সাপেক্ষ তো বটেই, বিরক্তিকরও। কাজেই আর সময় নষ্ট না-করে দু-জনে পা বাড়িয়ে দিল উত্তরপানে। ওই দিকেই মাইল দুই দূরে রয়েছে তাদের এম-১।
বিমান বিপন্ন— এর চেয়ে মারাত্মক কথা আর কিছুই হতে পারে না। মঙ্গলের এই দগ্ধ মরু থেকে পৃথিবীতে ফিরে যাবার একমাত্র ভরসা ওই এম-১। সে যদি বিগড়ে থাকে, অভিযানটারই ভরাডুবি। লুনা সিটির সঙ্গে বেতারে যোগাযোগ বজায় রাখা অসম্ভব হতে পারে, রকেট উৎক্ষেপণের পথ বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকতে পারে, বিমানখানাকে হাওয়ার বুকে ভাসাবার সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যেতে পারে।
যথাসম্ভব জোর পায়ে হেঁটে চলেছে ভেইল, কাঁধে সেই কেঁচোর ঝুড়ি। বিপদের খবর দূর থেকে শুনেই হাল ছেড়ে বসে পড়বে, এমন দুর্বলচেতা মানুষ ভেইল নয়। যতক্ষণ শ্বাস, বিপদ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা সে করবেই। মরতে যদি হয়, মৃত্যুর মুহূর্তেও ‘হেরে গেছি’ একথা সে স্বীকার করবে না।
নির্ভেজাল নৈরাশ্যই যে মনটা জুড়ে আছে তার, তাও নয়। কালো মেঘের বুকে বিজলিও খেলে যাচ্ছে এক-আধবার। কিংসটন ভুল করেও থাকতে পারে। হয়তো খুঁত যেটা ধরা পড়েছে যন্ত্রপাতিতে, তা সামান্য চেষ্টাতেই শোধরানো যেতে পারে। ভেইল নিজে তো বিমানের পাকা মিস্ত্রি। কিংসটনও তাই অবশ্য। তবে এমনটা খুবই হতে পারে যে, বিমানকে অল্প একটুখানি বেচাল চলতে দেখেই সে ঘাবড়ে গিয়েছে অতিরিক্তরকম। কাজ জানলেই যে মাথা ঠিক রেখে কাজ করে যাওয়া যায় বিপদের সময়ে, তা তো নয়!
ভাবতে ভাবতেই বিমানে এসে পৌঁছে গেল একসময়।
ভেইলের দিক থেকে প্রশ্নের প্রতীক্ষায় রইল না কিংসটন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল গোটা ইঞ্জিনটার দিকেই।
ইঞ্জিন বিগড়েছে? স্যুমানকে না-ডাকার ফলই ফলে গেল বুঝি?
মুখ থেকে মুখোশ খুলে, হাত থেকে দস্তানা খুলে ইঞ্জিনটা নেড়ে চেড়ে দেখছে ভেইল। কোথায় কী হল? বাইরে থেকে কিছুই যে বোঝা যায় না! বুঝতে হলে ইঞ্জিন খুলতে হবে।
খুলতে হবে। খুললে পরে হয়তো টের পাওয়া যাবে কোথায় কী গলদ ঘটেছে ওর জঠরে। হয়তো সে গলদ সংশোধন করা অসম্ভব না-হতে পারে ভেইলের পক্ষে। যদি হয় সম্ভব, তার পরে আবার ইঞ্জিন জোড়া দেওয়ার পালা। খোলা, মেরামত করা, জোড়া দেওয়া— কমসে কম এক মাসের ধাক্কা।
এদিকে বেতারের যোগাযোগ কেটে গিয়েছে। ইলেকট্রিক বন্ধ হয়েছে। আজ বিকাল পাঁচটায় লুনা সিটি থেকে যে সংকেত আসবার কথা ছিল, তা আসবার আর আশা নেই। লুনার ওস্তাদ ইঞ্জিনিয়ারেরা হাজার চেষ্টা করেও মঙ্গলের মরুতে পাঠাতে পারবে না কোনো খবর। প্রথমে তারা হবে বিস্মিত, তারপরে হবে ভীত, সবশেষে হবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতবুদ্ধি। এমন সর্বনাশা পরাজয়ের কলঙ্ক আগে কখনো মুখে মাখতে হয়নি তাদের।
কিন্তু লুনার ইঞ্জিনিয়ারেরা চুলোয় যাক, ভেইল আর কিংসটন এখন করে কী?
এ তাকিয়ে আছে ওর পানে। কয়েক মিনিট। অনেক মিনিট।
‘জীবনের দাম বেশি নয়। ওর জন্য ভাবি না।’ অবশেষে বলে ভেইল, ‘কিন্তু এম-১-কে ফিরে যে যেতে হবেই। যে অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করেছি এই অভিযানে— এইসব লিখিত বিবরণ, এইসব সজীব-নির্জীব নমুনা, গ্রহ-গবেষণার ক্ষেত্রে যুগান্তর নিয়ে আসবার মতো এই যে অমূল্য সব ফোটোগ্রাফ; এ যদি পৃথিবীতে না-পৌঁছায় কোনোদিন, মানবজাতির সে ক্ষতি কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হবে না কোনোদিন।’
‘জীবনের দাম বেশি নয়।’ সায় দিল কিংসটন, ‘কিন্তু জীবন দিলেও কী করে এম-১-কে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানো যায়, আমি তা বুঝতে পারছি না। তুমি যদি পথ দেখাতে পারো, আমি রাজি সে পথে হাঁটতে।’
ভেইল উত্তর দিল না সে কথার। যন্ত্রপাতি নিয়ে ইঞ্জিন খুলবার কাজে সে লেগে পড়েছে।
* * *
পাঁচ হপ্তা পরের কথা।
এবারে আর মঙ্গলের কথা নয়, কথা হবে পুরোনো পৃথিবীর। স্থানটা বলতে গেলে একটা মরুভূমি, মাইল সাতেক দূরে লোকালয়। এই সাত মাইল অতিক্রম করবার মতো ভালো রাস্তা নেই। লোক চলাচল থাকলে তবে তো রাস্তা বানাবার তাগিদ হবে সরকারের?
একটা মানুষ আজ দেখা যাচ্ছে সেইখানে। মরুভূমির উলটো দিকে সে চলেছে। দু-পা চলছে, আর থামছে একটু করে। মাঝে মাঝে বসেও পড়ছে এক একবার। শুয়ে পড়বার সাহস নেই। তাই কখনো বসে, কখনো দাঁড়িয়ে, তবু ক্রমাগত পথ চলতেই হচ্ছে তাকে!
লম্বা চেহারা, গাল ভাঙা, কোটরগত চক্ষুতে পাগলের মতো চাউনি। লম্বা দাড়ি, অন্তত এক মাসের বকেয়া মাল। মাথার চুলে পাক ধরেছে বিলক্ষণ।
পাক ধরেছে মাথার চুলে, অথচ বয়স মোটে তেত্রিশ তার।
সে কথা ভাবলে এত দুঃখেও হাসি পায় ওর। বছর গুণতিতে তেত্রিশ হলে কী হবে, মনের বয়স যে ডবল তার! বয়স বাড়ে অভিজ্ঞতায়। ওর মতো অভিজ্ঞতা আর কবে কার হয়েছে?
ধুঁকতে ধুঁকতে সে এগিয়ে চলেছে। সাত মাইলের মাথায় এক লাইন নীচু পাহাড়, তার ওপিঠেই বড়ো রাস্তা। দেদার মোটর চলছে। প্রাইভেট গাড়ি, লরি, ট্রাক— সবরকম।
রাস্তা ঘেঁষেই এক চাঁই পাথরের উপর সে বসল। পেট জ্বলছে, কিন্তু খাওয়ার কথা মনে হতেই তার বমি এল যেন। আর খাওয়া! যা সব খেয়ে এসেছে এই ক-দিনে, তাতে জন্মের মতো খাওয়ার পাট বোধ হয় উঠেই গিয়েছে ওর।
রাজপথ ধরে ডাইনে বা বাঁয়ে দুই-চার মিনিট হাঁটলেই একটা কাজ চালানো গোছের হোটেল-মোটেল অবশ্যই পাওয়া যায়। পকেটে পয়সারও খামতি নেই। একটুখানি তৎপর হলেই পেটের এই জ্বালাটা ঠান্ডা করা যায়, কিন্তু তৎপর হওয়ার কোনো লক্ষণই সে দেখাচ্ছে না। ঠায় বসে আছে পাথরের উপরে।
গাড়ির পরে গাড়ি চলে যাচ্ছে। আরোহীরা, চালকেরা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে লোকটাকে। ও নিজে উঠে দাঁড়িয়ে একটু কাকুতিমিনতি করলে কেউ-না-কেউ অবিশ্যি তুলে নিত ওকে। লোকটা যে চুপচাপ বসে আছে, শুধু চলৎশক্তিরই অভাবে, তা আর বুঝতে বাকি আছে কার? কিন্তু মুখ ফুটে যে দয়া প্রার্থনা করবে না, তাকে দয়া করতেই বা বয়ে গেছে কার?
অবশেষে কিন্তু অযাচিতভাবেই একজন এগিয়ে এল দয়া করতে। একখানা ট্রাক ঘড়াং করে থেমে গেল ওর সামনেই, ‘দোস্ত কোথাও যাবে নাকি? আমি নিয়ে যেতে পারি খানিকটা।’
‘কপাল ভেঙেছে না কি?’ দরদের প্রশ্ন ট্রাকওয়ালার।
আরাম করে তার পাশে বসে প্রথমে ধন্যবাদ জানাল, ‘না, তেমন কিছু নয়। পয়সা কড়ি আছে। মানে, অসুখ করেছিল খুব—’
ট্রাকওয়ালা আর কথা বাড়াল না। একটানা গাড়ি হাঁকিয়ে চলল ঘণ্টা দুই। একটা গ্রামের ভিতর দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে, এমন সময় ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘ভাই, এইবার আমায় নামিয়ে দাও।’
‘এখান থেকে রেল লাইন কিন্তু পাক্কা চল্লিশ মাইল।’ বলল ট্রাকওয়ালা।
‘তা হোক, ধন্যবাদ!’ বলে ও নেমে পড়ল।
তারপর উলটোপালটা দৌড়োদৌড়ি। কখনো উত্তরে, কখনো দক্ষিণে। পুবে কখনো, পশ্চিমে কখনো। যাতে পুলিশকে পিছন থেকে ঝেড়ে ফেলা যায়। পুলিশ অবশ্যই লেগেছে পেছনে। মরুভূমির মাঝে পড়ে আছে মহাকাশচারী ‘এম-১’, অথচ তার বৈমানিকদের পাত্তা নেই, এ কেমন কথা?
বিমানে বৈমানিকরা ছিল যে, তাতে সন্দেহ নেই! না থাকলে বিমান নামাল কে? বিমানের ভিতরে মঙ্গলের শিলা আর ধূলি, কেঁচো আর শেওলা, দু-শো ফোটো, দিস্তাখানেক মাপজোকের হিসাব— এসব সুশৃঙ্খলায় সাজিয়ে রাখল কে?
লোকালয় থেকে বেশি দূরে নামেনি এম-১। কাজেই পুলিশ খবর পেয়েছে, খুঁজতেও বেরিয়েছে পলাতক বৈমানিকদের। কোথায় পালাল তারা? কেনই-বা পালাল? সারা দেশের লোক উদগ্রীব হয়ে আছে বীরের মতো অভ্যর্থনা দিয়ে ওদের গ্রহণ করবার জন্য, আর ওরা ওদিকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে ঘৃণ্য সমাজবিরোধীর মতো— এ কেমন কথা?
এম-১ যেখানে নেমেছিল, তার প্রায় হাজার মাইল দূরে এক ছোট্ট কারখানায় এক অল্প মাইনের মিস্ত্রি একদিন লাঞ্চে বসেছে টিফিনের সময়। লোকটা এখানে নতুন। কাজ করে ভালো, মাইনে নেয় কম। কারখানায় আসার সময়ই কৌটোতে কিছু বিস্কুট রুটি নিয়ে আসে, তাই তার খাবার।
না, মাংস সে খেতে পারে না। মাংস খাওয়ার নাম কেউ করলেই সে বমি করে ফেলে। মনে পড়ে বহু দূরদূরান্তের এক অন্য জগতের কথা। লাল মাটি, লাল ধুলো, বড়ো বড়ো কেঁচো, ধেড়ে ধেড়ে ব্যাং-এর ছাতা, হরেকরকম রংবেরং শেওলা— সব খেয়েছে সে একে একে। ইঞ্জিন মেরামতে সময় লেগে গেল একটা মাস, অথচ পৃথিবী থেকে খাবর আনা হয়েছিল দুই হপ্তার। হিসাবে ভুল ছিল না। কারণ মঙ্গলে পৌঁছোবার পরে চারদিনের দিন তাদের ফেরার পথে পাড়ি জমাবার কথা।
ভাঁড়ার ঘর শূন্য। শেওলা আর ব্যাঙের ছাতা তারা কাঁচা খেয়েছে, সিদ্ধ করে খেয়েছে, ভেজে খেয়েছে। পাছে রসনা টের পেয়ে যায় স্বাদটা, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি গিলে ফেলেছে কোঁৎ কোঁৎ করে। কিন্তু বৃথাই গেলা! উদরে পৌঁছোনোর সঙ্গেসঙ্গে হুড় হুড় করে আবার বেরিয়ে এসেছে স—ব।
মেরামতের কাজ এগুচ্ছে না, খাটবার শক্তি লোপ পাচ্ছে। এম-১ কেমন করে তাহলে ফিরবে পৃথিবীতে? খাবার চাই! যাতে জীবনটা বাঁচবে, দেহে বল আসবে, এমন খাবার চাই! চাই!
কারখানায় বসে বিস্কুট চিবুচ্ছে নতুন লোকটা।
হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর। ঠিক তার সামনেই। ‘আপনিই জেমস ভেইল, ফার্স্ট ক্লাস টেস্ট পাইলট—’
ভেইল আড়ষ্ট হয়ে তাকিয়ে রইল সমুখের পুলিশ দু-জনের দিকে।
‘কেন যে এত কষ্ট দিলেন আমাদের। কিন্তু জন কিংসটন কোথায়? আপনার সহকারী পাইলট?’
কে কথা কইছে? ভেইল বুঝতে পারছে না কথাটা কার। না-পারুক ও শুনেছে সে কথা। কথাটা ছোটো— ‘আমি তাকে খেয়ে ফেলেছিলাম।’