১১. অর্জুন-২

১১. অর্জুন-২

তিতলির কানে কথাগুলো ঢুকছে না। অর্জুনের মুখখানা ওর চোখে ভাসছে। অর্জুন চন্দ্র। ছোটবেলার মুখ।

সাদা ট্রাউজার্স আর ঘন টি-শার্ট। ঠোঁটের ওপর অল্প গোঁফের রেখা। নীলচে ধূসর চোখ স্বপ্ন দ্যাখে, মোটা চশমার নীচে। এক মাথা ব্যাক ব্রাশ করা বাদামি চুল। ধপধপে ফরসা রং। বেনেদের বাড়িতে নাকি সাহেবদের পদধুলি পড়ত—এই নীল চোখ, বাদামি চুল তারই স্মৃতি। দু-আঙুলে একটা চারমিনার। কমনওয়েলথ স্কলারশিপে বিলেতে পড়তে গেল অর্জুন। ফিরে এলে তিতলির সঙ্গে বিয়ে হবে। তিতলি তখনও আমেরিকায় যায়নি, দেশেই রিসার্চ করছে। আমেরিকায় পড়তে যাবার ব্যাপারে প্রধান উৎসাহদাতা ছিল অর্জুন নিজেই।

‘আমি তো তিন বছর থাকছি না, ততদিন তুমিও যাও না আমেরিকাতে—ওখানে অনেকরকম পসিবিলিটিজ—।’

যাবার আগে ইউসেফি থেকে কাগজপত্র এনে দিয়েছিল অর্জুনই। না, না, করেও অ্যাাই করে ফেলল তিতলি। দাদা, বাবা, মায়েরও মহা-উৎসাহ। অতগুলো অ্যাপ্লিকেশনের খরচ জোগানোর মতো রোজগার তখনও ছিল না তিতলির। দাদা দিল খরচ।

স্কলারশিপ পেয়ে যখন রওনা হল, পথে থেমেছিল ইংল্যান্ডে। অর্জুন হিথরো এয়ারপোর্টে এসে তিতলিকে নিয়ে গেল তার অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানে ওরা তিনজনে থাকে। বাকি দুজন সেই ক’দিনের জন্যে উধাও হয়ে গেল। একটি পাকিস্তানি ছেলে, আর একটি গুজরাটি ছেলে। গুজরাটি ছেলেটি এসেছে সাউথ আফ্রিকা থেকে। গান্ধিজির সাউথ আফ্রিকা। পাকিস্তানি ছেলেটার সঙ্গে বেশ ভাব জমেছিল অর্জুনের—শামিম তার নাম। সে খুব আধুনিক মনের। বামপন্থী ছেলে—তারিক আলির শিষ্য। মহেশ একেবারে উলটো। মহেশ প্যাটেল নামেই গুজরাটি, কার্যত সে সম্পূর্ণ বিদেশি। সাউথ আফ্রিকাই তিন প্রজন্ম ধরে তার দেশ। ইন্ডিয়াতে কখনও পা রাখেনি তাদের বংশের কেউ।

‘উই হ্যাভ নাথিং টু ডু উইথ ইন্ডিয়া। উই বিলং টু সাউথ আফ্রিকা’—অর্জুনকে পরম বিস্মিত করে দিয়ে বলেছিল মহেশ।

নাম জিগ্যেস করলে বলত—হেস। মহেশ নয়। গুজরাটি জানত না, হিন্দিও না, শুধু ইংরিজি, আর আফ্রিকানা।

সেই হেস-ও রুম খালি করে চলে-গিয়েছিল অন্যত্র কোথাও। যাতে তিতলির অস্বস্তি না হয় ওই ফ্ল্যাটে থাকতে। ছোট্ট দু-কামরা ফ্ল্যাটে তিনজন আছে। একটা ঘরে ওরা দুজন, শামিম আর অর্জুন আর এক ঘরে হেস।

.

‘বিলেতে এসে বিলেত বিষয়ে যতটুকু জেনেছি তার চেয়ে ঢের বেশি শিক্ষালাভ করেছি পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিষয়ে।’—বলে হেসে উঠেছিল অর্জুন।

‘থাকি বিলেতে, ওঠাবসা করি এক পাকিস্তানি আর এক সাউথ আফ্রিকান ইন্ডিয়ানের সঙ্গে। কপালে এই লিখেছিল ভগবান। তুই যেখানেই যাস—একদার ভারতসন্তানেরা তোর সঙ্গ ছাড়বে না—নো সাহেব, নো মেমসাহেব’—

ঘর ছেড়ে দিলেও ওদের আসাযাওয়া ছিল সমানেই। জামাকপড়, বইপত্র, এটা-ওটা নিতে আসতেই হাচ্ছিল ওদের। তিতলি, অর্জুনের বাগদত্তা হিসেবে তাদের কাছে যথেষ্ট সম্মান, সমাদর পেয়েছিল। দুজনেই তাকে যথাসাধ্য উষ্ণ, আন্তরিক আতিথেয়তা দিতে চেষ্টা করেছিল। ঘরে ছেড়ে দেওয়া তারই অঙ্গ। শামিম তো দারুণ কাবাব রান্না করে খাইয়েছিল ওদের প্রথম দিনেই।

আমেরিকাতে চলে যাবার পরে অর্জুনের সঙ্গে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আর তার পরে এল অনিলা। হেস-এর ছোট বোন। নিজের নাম বলত ‘আ-নীলা’, পড়তে এসেছিল আইন। হেস অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ত। নীলা প্রথমে থাকত কাছাকাছিই আর একটা মেয়েদের মেসে। তখনই ছেলে মেয়েদের মিশ্র-মেসে থাকা শুরু হয়ে গেছে ইংল্যান্ডে। কিন্তু মুখে যতই বলুক সাউথ আফ্রিকান—ওরা তো ভিতরে ভিতরে ইন্ডিয়ানই! ওই সব মিক্সড লজিং ওদের মনোমতো ছিল না। মেয়েরা-মেয়েরা থাকবে। তাতে টেনশন অনেক কম হয়। অনেক বেশি রিল্যাক্সড থাকা যায়। সর্বক্ষণ পুরুষদের প্রতি মনোযোগ কেনই বা দিতে হবে? আত্মসচেতন হয়ে, রূপসচেতন হয়ে চব্বিশ ঘণ্টা সামাজিক থাকা,—ওতে না হয় পড়াশুনো, না হয় রিল্যাক্সেশন।

.

মহেশের বোন অনিলা আসার কিছুদিন পরে ওরা আলাদা ফ্ল্যাট নিল। ভাইবোনে সেখানে সংসার পাতল। গুজরাটি খাওয়াদাওয়া—সাউথ আফ্রিকান-গুজরাটি বলাই ভালো। ইন্ডিয়ান-গুজরাটি যে নয়, সে বিষয়ে অতিরিক্ত সচেতন দুই ভাইবোন। অর্জুন তিতলিকে জানাত এই অপরূপ ভ্রাতা-ভগিনীর কথা—এই মানসিকতার স্বপক্ষে কোনও গভীর যুক্তিও নেই তাদের।—শুধু আপ্রাণ চেষ্টা লোককে জানিয়ে দিতে, ওরা কিন্তু ইন্ডিয়ার মানুষ নয়। ওরা আসলে সাউথ আফ্রিকান। কেউ না ভুল করে ওদের ইন্ডিয়ান ভেবে বসে।

যে-উদ্বেগটা শামিমের হলে মানাত, কেন না, সে পাকিস্তানি।

কিন্তু তার কিচ্ছু আসত-যেত না।

‘আররে ভাই, পুরা তো ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট হী কহা যাতা হ্যায়! ইসমে শরমকা বাত থোড়াই!’

সেই ইন্ডিয়া-হেটার নীলাকেই বিয়ে করল অর্জুন। বিয়ে করে কেপটাউনে সংসার পাতল। কেমন করে ঘটল এসব? তিতলি জানত না, জানার চেষ্টাও করেনি সেভাবে, প্রবৃত্তি হয়নি—শামিমের ডাক্তারি ডিগ্রি হয়েছিল, অর্জুনের ডক্টারেট ডিগ্রি হয়েছিল, হেসও চার্টাড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পাস করেছিল, শুধু নীলারই ব্যারিস্টার হওয়া হয়নি।

আস্তে আস্তে চিঠি কমে আসছিল। তারপর ফোনও কমতে শুরু করল। তারপর সব শুনশান। অর্জনের খবর নেই। ফোন ধরে শামিম। এবং বলে অর্জুন বেরিয়ে গেছে। কখনওই বাড়িতে ধরা যায় না অর্জুনকে।

একদিন শামিমই জানাল অর্জুন আর থাকে না ওইখানে। অন্যত্র বাসা নিয়েছে।

‘কেন? কেন? কেন?’

শামিম বলল, ‘আমি জানি না, আস্ক হিম।’

নতুন ফোন নম্বর দিল শামিম।

ফোন ধরল নীলা।—’নীলা স্পিকিং।’

‘আরে, এটা কি তবে হেস-এর ফ্ল্যাট?’ তিতলির সব গুলিয়ে গেল।

‘ইয়েস, হেস, নীলা অ্যান্ড অর্জুন’স।’

‘অর্জুন! অর্জুন ওখানে কী করছে?’

‘হি লিভস হিয়ার। উই লিভ হিয়ার। হেস ইজ ইন কেপটাউন। ওয়ান্ট টু টক টু অর্জুন?’

‘না: থাক। ধন্যবাদ।’

ফোন রেখে দিল তিতলি। এবং বাথরুমে গিয়ে বমি করল কমোডের মধ্যে।

তারপর একটা চিঠি, অর্জুনের হাতের লেখায়—’তিতলি, জানি না তোমাকে কী বলব। আমি নীলাকে বিয়ে করেছি। আমরা সামনের মাসে কেপটাউনে চলে যাচ্ছি। ততদিনে আমাদের ছেলের বয়েস হবে তিন মাস। ছেলের নাম? অভিমন্যু।’

তোমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করছি বলেই এই চিঠি।—তুমি স্বভাবতই উদার, তাই পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। যদিও ক্ষমার স্বপক্ষে কোনও যুক্তিও আমি দেখাতে পারব না।—অর্জুন।’

চিঠিটা পেয়ে আলাদা করে কোনও ধাক্কা লাগেনি তিতলির। টেলিফোনে ‘নীলা স্পিকিং’-টুকুই যথেষ্ট ছিল। কেবল প্রশ্ন ছিল একটাই।

কেন নীলা?

এবং নীলার দিক থেকে—কেন অর্জুন?

ভীষণ, ভীষণ ‘ইন্ডিয়ান’ এই অর্জুনকে কেন পছন্দ হল নীলার? কটা চোখ দেখে? ফরসা রং দেখে? কিন্তু অর্জুনকে পছন্দ হলেই অর্জুনের স্বদেশকে তার পছন্দ হবে তার কোনও মানে নেই। কলকাতাতে তো সে যাবেই না। যাবে না গুজরাটেও। তার নিজের দেশ আমেদাবাদের ধারে কাছে যেতে চায় না সে। পা-ই দিতে রাজি নয় সে ইনডিয়ার মাটিতে। না হয় কলকাতা ‘ডার্টি সিটি’, গুজরাট কী দোষ করল?

‘গুজরাট আমাদের ঠাঁই দেয়নি বলেই তো কেপটাউনে চলে যেতে হয়েছিল ঠাকুরদাকে।’ সেই অপরাধ থেকে কোনওদিন মার্জনা পায়নি গুজরাট। অনিলা আর মহেশ গুজরাটকে অস্বীকার করে সাউথ আফ্রিকাকেই তাদের পিতৃভূমি-মাতৃভূমির মর্যাদা দিয়েছে। ওদের মা-বাবা দুজনেরই জন্ম হয়েছিল সাউথ আফ্রিকায়। এবং সেই যুগে বাদামি ভারতীয়দের অবস্থা কেমন ছিল সেই সাদা চামড়ার দেশে পৃথিবীর কারুরই তা জানতে বাকি নেই। তবুও সেই আপার্থইডের বিষে জর্জর, মনুষ্যত্বের অপমানে লাঞ্ছিত সাউথ আফ্রিকাকেই ওরা স্বদেশ বলে মান্য করে। স্বেচ্ছায়! কেন? কেন? তিতলি কোনওদিনই বোঝেনি। হয়তো অর্জুন কিছু বুঝেছিল।

সেই অর্জুন—এতগুলো বছর পর!

কাঁধের কাছে মিতুলের হাতের আলতো ছোঁওয়া পেয়ে চমকে উঠল তিতলি—’কী রে?’

মিতুল যেন বুঝেছে তিতলি কী ভাবছিল। কেন ভাবছিল? যেন কোনও যন্ত্রণার হদিস পেয়েছে ও তিতলির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাত খাবি না? চল ওঠ।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *