১০. নতুন যুগের ভোর
১৯৭৭এর শুরুতেই সুখবর। “হঠাৎই যেন আমাদের দুঃস্বপ্নের শেষ হল”—বললেন বসু। ১৮ই জানুয়ারী ইন্দিরা গান্ধী এক সংক্ষিপ্ত বেতারভাষণে দেশে জরুরী অবস্থার অবসান ঘোষণা করলেন, ঘোষিত হল লোকসভার নির্বাচন। বসু জানতেন জরুরী অবস্থা অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না, প্রধানমন্ত্রীকে আজ না হয় কাল এই স্বৈরতন্ত্রী শাসন তুলে নিতেই হবে, তবে নির্বাচন যে ঘোষিত হবে এটা তাঁর প্রত্যাশিত ছিল না। বসুর মতে ইন্দিরা গান্ধীর ধারণা ছিল দেশের মানুষের সমর্থন তাঁর সঙ্গে আছে এবং জরুরী অবস্থায় দেশের সব কিছু ঠিকঠাক চলছে এরকম একটা আত্মবিশ্বাসও তাঁর জন্মে গিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বসু বললেন, “সম্ভবত ওঁর স্তাবকরা ওঁকে তাই বুঝিয়েছিল…., নির্বাচনটাকে ইন্দিরা মনে করেছিল অনেকটা গণভোটের মত এবং ও ভেবেছিল সেটা ওর রাজনীতির পক্ষেই যাবে। তাছাড়া বিদেশে ওর এক ‘স্বৈরাচারী ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে যাচ্ছিল, সেটাও দূর করা ও দরকার মনে করেছিল।”
এই নাটকীয় ঘোষণার পরই দেশের রাজনৈতিক ছবি আমূল পালটে যায়। সমস্ত বন্দী রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়া হয়। আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোরারজি দেশাই কংগ্রেসের ‘জাতীয় বিকল্প’ সরকার গড়ার উদ্যোগ নেন। জনতাদল সারাদেশে নানাবিধ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দাবি জানায়।
“যে ঘটনাটা ইন্দিরাকে যথেষ্ট উদ্বেগ দিয়েছিল সে সময়”, বসু বললেন, “সেটা হল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে জগজীবন রামের পদত্যাগ।” ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জগজীবন রামের সম্পর্কের কয়েক বছর ধরেই অবনতি হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী রামকে সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দী হিসাবে দেখতে শুরু করেছিলেন এবং ছোটখাট বিষয়েও আর তাঁর পরামর্শ নিতেন না। জগজীবন রাম মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করার পর গড়লেন ‘কংগ্রেস ফর ডেমোক্রাসি’।—এই দলে ছিলেন এইচ্ এন. বহুগুণা, নন্দিনী সৎপথি, কে. আর. গণেশ, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত প্রমুখ। “তখনও ইন্দিরা ঠিক বুঝতে পারেনি কত তাড়াতাড়ি ও জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে পার্টির ওপর নিজের প্রভাবও যে কমছে, তাও বোঝেনি”, বসু মন্তব্য করলেন। ইতিমধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণ, জ্যোতির্ময় বসু এঁরা সকলে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন আর জে. পি-ও বিরোধী ঐক্যের জন্য কাজকর্মও শুরু করে দিয়েছেন।
১৬ই মার্চ নির্বাচন আরম্ভ হল, শেষ হল ১৯শে মার্চ। ফলাফল বেরোলে বসু যার পরনাই বিস্মিত হলেন। ইন্দিরা গান্ধী এবং সঞ্জয় গান্ধী দুজনেই পরাস্ত হয়েছেন। “যদিও ব্রিটিশ কাগজগুলো এই ফলাফলের কথা আগেই বলেছিল, আমি অবশ্য তখন ঠিক বিশ্বাস করিনি”—বসু বললেন। রায়বেরিলির আসন ইন্দিরা গান্ধী হারালেন রাজনারায়ণের কাছে, ৫৫,০০০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে। সঞ্জয় গান্ধী, বংশীলাল দুজনেই মুছে গেলেন। জনতা দল এবং সি. এফ. ডি. (কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি) পেল ২৯৯টি আসন। কংগ্রেস পেল মোটে ১৫৩টি আসন। সি. পি. আই. (এম) পেল ২২টি এবং সি. পি. আই. ৭টি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস পেল মোট তিনটি আসন এবং সি. পি. আই.—যারা জরুরী অবস্থায় কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল তারা কোনও আসনই পেল না। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং দিল্লীতে কংগ্রেস কোনও আসন পেল না। ১৯৭১ সালের ৩৫০টি আসন থেকে এক অস্বাভাবিক পতন হল কংগ্রেসের।
জনতাদলের পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তাদের সরকার গঠন করতে আমন্ত্রণ জানানো হল। প্রধানমন্ত্রীত্বের পদের জন্যে দৌড় শুরু হল। জয়প্রকাশ নারায়ণ এই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলেন, কিন্তু এই পদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতা, যেমন বাবু জগজীবন রাম এবং চৌধুরী চরণ সিং-এর মধ্যে মধ্যস্থতা করে দিলেন। শেষ পর্যন্ত জয়প্রকাশ নারায়ণ এবং কৃপালনির মত গেল মোরারজি দেশাই-এর পক্ষে। প্রধানমন্ত্রীত্বের পদের জন্য এই কাড়াকাড়ি প্রসঙ্গে বসু মন্তব্য করলেন, “আসলে ঝোপঝাড় আর গাছগাছালির ওপর নজর দিতে দিতে গোটা বনটার দিকে আর এদের চোখ পড়ে না। এটা বড় বিপজ্জনক খেলা, যে কোন মুহূর্তে মুখ থুবড়িয়ে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। আসলে ক্ষমতার জন্যে কাড়াকাড়ি করা বা জোর করা উচিত নয়, ক্ষমতা আসা উচিত স্বাভাবিকভাবে, যেমন গাছে পাতা আসে।”
রাজ্যে নির্বাচনে আসন সমঝোতা নিয়ে সি. পি. আই. (এম)-এর সভা হল। দিল্লীতে দলের সেন্ট্রাল কমিটির সভা বসল। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জনতা দলসহ অন্যান্য পাঁচটি বামপন্থী দলের নেতারা সি. পি. আই. (এম)-এর পার্টি অফিসে বৈঠক করলেন। বসু জানালেন, “আমরা চেয়েছিলাম দলের শক্তি, সংগঠন এবং প্রার্থীর নিজস্ব ওজন ও গুণ অনুযায়ী আসন ভাগ করতে। এদিক থেকে বিচার করলে আমাদের দলই সবচেয়ে উপযুক্ত ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জনতা দলের নেতারা সেটা মানতে চাইলেন না। আমরা শতকরা ৫২ ভাগ আসন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু ওঁরা নিজেদের অবস্থান থেকে একচুল নড়তে চাইলেন না।” সি. পি. আই. (এম) এবং অন্যান্য বামপন্থী দল রাজ্য বিধানসভার সব ক’টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিল। তখন, সি. পি. আই. যেহেতু কংগ্রেসকে সমর্থন দিচ্ছিল সেহেতু তারা ফ্রন্টের সদস্য হল না।
“এই নির্বাচনও ছিল”, বসু বললেন, “এক চ্যালেঞ্জের মত।” রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্বাচনের পক্ষে তেমন অনুকূল ছিল না, তাছাড়া সারা দেশে সেই সময়টা ছিল এত অদ্ভুত যে পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা অস্থির উত্তেজনাও ছিল, কারণ, বসুর মতে, “কোনও নির্বাচনই এই রকম সার্বিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর হয়নি।” এর ওপরে ছিল সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নানা ষড়যন্ত্র আর লোকের চাপা ক্ষোভ। প্রসঙ্গত বসু অভিযোগ করলেন সিদ্ধার্থশংকর রায় কলকাতা, ব্যারাকপুর, দমদম, ডায়মন্ড হারবার, আরামবাগ ইত্যাদি জায়গায় নির্বাচনী বুথ দখল করিয়েছিলেন পুলিসের সাহায্য নিয়ে। মুখ্য নির্বাচনী অফিসার এ সম্পর্কে অন্য দল এবং জনগণের কাছ থেকে একটার পর একটা অভিযোগ পান এবং দিল্লীতেও সেকথা জানান, এতে সিদ্ধার্থশংকর রায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। এক আমলাকে দিয়ে তিনি বেতারে এই অভিযোগের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানোর ব্যবস্থাও করেন।
যাই হোক ৩০শে এপ্রিল সিদ্ধার্থশংকর রায়কে গদি ছাড়তে হল। অন্যান্য ন’টি রাজ্যের কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীরাও পদত্যাগ করলেন। যুদ্ধ শুরু হল। বসু এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন সাতগাছিয়া কেন্দ্র থেকে। ১৯৭২ সালের নির্বাচনী ষড়যন্ত্রের সময় তিনি বরানগর কেন্দ্র থেকে নাম তুলে নিয়েছিলেন। সাতগাছিয়া কেন্দ্র থেকে বসুর লড়া সেই শুরু। ১৯৭৭ সাল থেকে। এখনও তিনি ঐ কেন্দ্র থেকেই নির্বাচনে লড়েন, এই নিয়ে পাঁচবার তিনি পর পর এই সাতগাছিয়া থেকেই জিতলেন। বসুর সাতগাছিয়া জায়গাটা “বেশ ভালই লেগে গিয়েছিল। ওখানকার লোকেরা খুবই সরল আর সাদাসিধে।” ১৯৭৭-এর নির্বাচনী প্রচারের সময় বসু জায়গাটা থেকে ভাল সাড়া পেয়েছিলেন, তাছাড়া ওঁর মনে হয়েছিল, ঐ জায়গার উন্নতির প্রচুর সম্ভাবনা আছে। প্রথম নির্বাচনেই বসু তার প্রতিদ্বন্দ্বী (সি.পি.আই-এর) জুমান আলি মোল্লাকে বিপুল মার্জিনে হারিয়েছিলেন। বসু পেয়েছিলেন ৪৫,৫৩৮টি ভোট, মোল্লা পেয়েছিলেন মাত্র ৭,০৭২।
১৯৭৭-এর নির্বাচনী ফলাফল বুঝিয়ে দিল জনগণ কংগ্রেসের প্রতি আস্থা হারিয়েছে। বিধানসভায় সি. পি. আই. (এম) দল পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। তারা পেল মোট ১৭৮টি আসন, কংগ্রেসের রইল ২০টি আসন আর সি. পি. আই. পেল মাত্র ২টি আসন। জনতাপার্টি, ইন্দিরা-বিরোধী ঢেউএ কেন্দ্রে যারা ক্ষমতায় এসেছিল, তারা পেল মাত্র ২৯টি আসন। বসু আশান্বিত হলেন, “বোঝাই গেল কংগ্রেসের বাড়াবাড়ির জন্য জনগণ তাদের পরিত্যাগই করেছে।”
বসুর নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নিল ২১শে জুন। বসুর পরিবারের সকলেই সেদিন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আনন্দ হলেও উচ্ছ্বাস দেখানো বসুর স্বভাবে নেই, বরং ‘স্বল্পোক্তি’ করার জন্যই বসুর খ্যাতি আছে। সেদিন সকাল থেকেই বসুর বাড়ির সামনে গাড়ির মেলা। বসুর শ্যালিকা মঞ্জুলা রায় এ প্রসঙ্গে বললেন, “আমাদের তখন খুব আনন্দ হচ্ছে। এতদিন বাদে এত কষ্টের পর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল, জামাইবাবু মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন, আমার মাও খুব খুশী, শপথ নিতে যাবার সময় মা পেছন পেছন যাচ্ছেন, মার চোখমুখ জ্বজ্বল্ করছে। আমি একবার বেরোবার সময় দূর থেকে জামাইবাবুর দিকে তাকিয়ে আনন্দে উচ্ছ্বাসে বলে উঠলাম, ‘জামাইবাবু, জামাইবাবু’—জামাইবাবু একবার একটু তাকিয়ে, কোনও উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে এগিয়ে গেলেন। কোনও পাত্তাই যেন দিলেন না। বুঝলাম ভেতরে ভেতরে হয়তো একটু টেন্সও আছে। তাছাড়াও জামাইবাবু কোন ব্যাপারেই উল্লাস প্রকাশ করার মত ব্যক্তিও নন।”
শপথ নেওয়ার ঠিক ষোলদিন পরেই বসু তেষট্টি পূর্ণ করে চৌষট্টিতে পা দিলেন। তখন তাঁর শরীরের অবস্থা বেশ ভাল, মনও আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মনে আনন্দ আছে, কিন্তু আত্মসন্তোষ নেই। বামফ্রন্টের ৩৬ দফা কর্মসূচীর ওপর জোর দেওয়া হল। বেশি জোর দেওয়া হল আইনশৃঙ্খলা-ব্যবস্থার ওপর। বামফ্রন্ট সরকার তদন্ত কমিশন নিয়োগ করল রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকান্ডের তদন্ত করার জন্য। বসু হলেন মুখ্যমন্ত্রী, তাছাড়া নিজের হাতে দায়িত্ব রাখলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, জেল, পরিবহণ এবং পরিষদীয় বিভাগ ছাড়া ক্রীড়াদপ্তর, পাবলিক ওয়ার্কস দপ্তরের নগরোন্নয়ন বিভাগ এবং যুবকল্যাণ এবং বিদ্যুৎ দপ্তরের। ৩৬ দফা কর্মসূচীতে গরীবদের জন্য কয়েকটি বিশেষ উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। বসুর এই মন্ত্রিসভার চরিত্রতে বেশ ভারসাম্য ছিল—খুব অল্পবয়সী বা খুব বেশি বয়সী কেউ এই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না। ২৩জন সদস্যের এই মন্ত্রিসভায় বসুকে নিয়ে ন’জন ছিলেন ট্ৰেডইউনিয়ন আন্দোলনের নেতা, তিনজন সি. পি. আই. (এম) মন্ত্রী ছিলেন কৃষাণ ফ্রন্ট্রের এবং চার-পাঁচজন মন্ত্রী ছিলেন কৃষক গোষ্ঠীর নেতা। ২৯৪ জন সদস্যের মধ্যে ২৩২ জনই ছিলেন বামফ্রন্টের সদস্য।
রিমোট কন্ট্রোলে রাজ্য শাসন করার ইচ্ছা বসুর ছিল না। প্রথম দিনই বসু তাঁর মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের বলেছিলেন, “আমরা রাইটার্স বিলডিংস থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ করব না, আমরা আমাদের কর্মসূচী রূপায়ণ করব মাঠ থেকে আর কারখানা থেকে, জনগণের সহায়তা নিয়ে, কারণ এরাই আমাদের ক্ষমতার উৎস।” মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধান প্রশ্ন ছিল বসুর সরকারের স্থায়িত্ব সম্পর্কে। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বসু জবাব দিয়েছিলেন, এই সরকার অবশ্যই পুরো পাঁচ বছর থাকবে কারণ এর ভিত খুবই শক্ত।
বসু তাঁর নিজের বাড়ি হিন্দুস্তান পার্কেই ছিলেন। তাঁর দিন শুরু হত সাতটা নাগাদ। প্রাতঃভ্রমণ করার অভ্যাস তাঁর ছিল না। মাঝে মাঝে সকালবেলা তিনতলার টানা বারান্দায় দাঁড়াতেন। কখনও কখনও বেরিয়ে চলে যেতেন তাঁর বন্ধু, আর. এস. পি-র কমরেড যতীন চক্রবর্তীর বাড়ি। তিনি কাছাকাছিই একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। সেখানে কোনও কোনও দিন যতীনবাবুর স্ত্রী রানী গরম গরম লুচি আর আলুভাজা করতেন—চা সহযোগে জলপান করতেন। বাড়ি ফিরে স্নান করেই ৯টা—৯-৩০ মধ্যেই অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি। “একটা নির্দিষ্ট সময়ে দিন শুরু করতাম”, বসু বললেন, “কিন্তু দিন শেষ হত দল বা জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী।” বাড়ি ফেরার কোনও ঠিক ছিল না। রাইটার্সে বিরাট লম্বা দিন আর তার পর সন্ধ্যাবেলা পার্টি অফিস।
বসু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে এবং দ্রুত কাজকর্ম করতে অভ্যস্ত ছিলেন। দীর্ঘসূত্রিতা তাঁর একেবারেই পছন্দ নয়। ‘হ্যাঁ কিংবা না, যা হোক বলে দিতে দেরী ক’রো না’, আমি আমার সহকর্মীদের সব সময় এই কথাই বলি”, বসু বললেন, “টেবিলে ফাইলের স্তূপ জমতে দিও না।” জমে থাকা কাজ বসুর চক্ষুশূল। এ প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা আছে। একবার জ্যোতিবাবু যতীনবাবুকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। জ্যোতিবাবু তখন মুখ্যমন্ত্রী এবং যতীনবাবু পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের মন্ত্রী। জ্যোতিবাবু বললেন, “যতীনবাবু আপনার সঙ্গে তো আর কাজ করা যায় না।”
“কেন, কি হল? কোন ভুল হয়েছে?” উদ্বিগ্ন যতীনবাবু জিজ্ঞেস করেন। জ্যোতিবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, “এই গতকালই এই ফাইলটা আপনাকে দিলাম আর আজকেই কাজ শেষ করে আপনি আমায় ফেরত দিলেন! এত দ্রুত কাজ করলে আমি তাল রাখব কি করে?”
“আপনিই তো বলেছেন কাজ জমিয়ে না রাখতে, নিজেকে কাজ দেখতে, আর তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে, তাই না?”—অবাক হয়ে যতীনবাবু জিজ্ঞেস করেন।
বসু হেসে ওঠেন। এইবার যতীনবাবু বুঝতে পারেন ওটা আসলে বসুর প্রশংসা ছিল, অভিযোগ মোটেই নয়। “আপনি মশাই এত দ্রুত কাজ সারেন যে আমিও পেরে উঠি না”, বসু হাসতে হাসতে আবার বলেন।
বামফ্রন্ট নির্বাচনী-প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা শুরু করে। মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই সরকার সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তি দেওয়ার সময় বন্দীদের দলের রাজনৈতিক রং দেখা হয়নি। ১৭০০ নকশাল আর কংগ্রেস বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। কংগ্রেস এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে প্রায় ১০,০০০ হাজার মামলা তুলে নেওয়া হয়। মিশাতে আটক প্রায় দুশোরও বেশি লোককে মুক্তি দেওয়া হল। “আমি প্রতিশোধের নীতিতে কোনওদিনই বিশ্বাসী নই”, বসু বললেন, “প্রতিশোধ নিয়ে কিছুই লাভ হয় না। আমি সদর্থক কাজকর্মেই বিশ্বাস রাখি, নেতিবাচক নীতি বা সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। পুরোনো কর্মের বদলা নিয়ে শক্তি আর সময়ের অপচয় করে লাভ কি?”
জানুয়ারিতে ‘নিউইয়র্ক টাইম্স’-এর এক সাক্ষাৎকারে বসু বলেছিলেন, “সংবিধান অনুযায়ী রাজ্যের ক্ষমতা খুবই সীমিত, বড় কোনও পরিবর্তন আনার, সে অর্থনৈতিক বা সামাজিক যাই হোক না কেন, রাজ্যের অধিকার নেই। কিন্তু এই সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই আমরা জনগণের জন্য অনেক কিছু করতে পারি, একেবারে মৌলিক পরিবর্তন হয়তো আমরা আনতে পারব না, তবে জনগণের জীবনযাত্রার মান খানিকটা বাড়াতে অবশ্যই সহায়তা করতে পারি। তবে অবশ্য, কেন্দ্রে, দিল্লীতে যদি আমাদের ক্ষমতা পেতাম, তবে ছবিটা সম্পূর্ণ অন্য রকম হত।” বিরাট বিরাট- প্রতিশ্রুতি দেওয়া বসুর স্বভাবে ছিল না। “আমাদের কাজই দেখিয়ে দেবে আমরা কি করতে পারি আর কি করতে পারি না”–বসু মন্তব্য করেন। বসু আরও বলেন, “যদি আমরা প্রতিশ্রুতি পালনই না করতে পারি তো প্রতিশ্রুতি দিয়ে কি লাভ? আমরা তো আর জনগণকে ঠকাতে আসিনি। আমরা তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে আর আমাদের প্রতি তাদের আস্থার মর্যাদা দিতে এসেছি।”
মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বসুর প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে দু’টি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়—ভূমিসংস্কারের ক্ষেত্রে এবং গ্রামবাংলায়। প্রায় দুই দশক পর ১৯৭৮ সালে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা বামফ্রন্ট সরকারের এক বিরাট কাজ। বসু এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত জেলায় জেলায় এ নিয়ে সভা করেন। “আসলে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শোষিত কৃষকদের চেতনা জাগানো আর যাতে তারা নিজেদের অধিকারের জন্য নিজে দাঁড়াতে পারে।”
নিজের সরকারের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বসুর মনে কোনও ভ্রান্ত ধারণা ছিল না। “আমরা প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করেছি”, বসু জানালেন, “একদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আর একদিকে বিরোধী গণমাধ্যম। কয়েকটি গণমাধ্যম প্রথম থেকেই আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আসছে।” তাছাড়া কংগ্রেসের নানা চক্রান্ত তো ছিলই। সবচেয়ে কঠিন সমস্যা ছিল উদ্বাস্তু পুনর্বাসন। দণ্ডকারণ্য থেকে আসা উদ্বাস্তুর স্রোত, মরিচঝাঁপিতে তাদের শিবির—সরাসরিভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা বসুকে সে সময় করতে হয়েছিল। সমস্যা ক্রমশ গুরুতর আকার ধারণ করে, কংগ্রেসের আর জনতা দলের উসকানিতে। বসু দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই- এর সঙ্গে দেখা করেন এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। মোরারজী সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন। “মোরারজী খুবই একরোখা ছিলেন, তবে এক এক সময় তিনি বেশ যুক্তিপূর্ণ কথা বলতেন”, বসু বললেন। উদ্বাস্তু সমস্যা বিষয়ে মোররাজী বসুকে আশ্বস্ত করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে উদ্বাস্তুদের সরিয়ে নেওয়া হল। ১৯৭৮ সালের আগস্ট সেপ্টেম্বরে এল বিধ্বংসী বন্যা। ১২০০ লোক মারা গেল, ১২টা রাজ্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল। ত্রাণকার্যের অভিজ্ঞতা বসুর আগেই ছিল, এবার শুরু হল ক্ষমতায় থেকে ত্রাণকার্য চালানোর ব্যবস্থা করা— ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকম ছিল। ছোটখাটো নানা সমস্যা দেখা দিতে লাগল, ত্রাণ সামগ্রীর সরবরাহ সংক্রান্ত, ত্রাণ সামগ্রীর অপচয় ইত্যাদি নিয়ে—এর মধ্যে গণমাধ্যমের বিকৃত তথ্য পরিবেশনও ছিল।
১৯৭৯ সালের গোড়ার দিকে দেখা দিল সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা। আলিগড়, জামসেদপুর এবং অন্যান্য জায়গায় দাঙ্গা শুরু হল। পশ্চিমবঙ্গে এবং কেরালায় গোহত্যা বন্ধের দাবীতে পাউনার আশ্রমে ২২শে এপ্রিল থেকে অনশন শুরু করলেন আচার্য বিনোবা ভাবে। বসু চলে গেলেন পাউনারে, আচার্য ভাবের সঙ্গে দেখা করলেন। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে আচার্য অনশন ভঙ্গ করলেন। জুন মাসে নদীয়া জেলার চাপড়ায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার স্মৃতি বসুর মনে তখনও তরতাজা। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন সে সময়। “এই সাম্প্রদায়িক শক্তিই আমাদের দেশের ভাঙন ধরাচ্ছে”–বসু মন্তব্য করলেন। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম মেয়াদের তৃতীয় বছরেই বসু বুঝতে পেরেছিলেন পুঁজিবাদী কাঠামোর ভিতর থেকে কমিউনিস্ট ধ্যানধারণা বাস্তবে রূপায়িত করা কতটা কঠিন কাজ। এদিকে নিজেদের ভেতরকার বিরোধ এবং ইন্দিরা গান্ধীর ক্রমশ বাড়তে থাকা শক্তির কারণে কেন্দ্রে জনতা দলের সরকার পূর্ণমেয়াদ টিঁকে থাকতে পারল না। কংগ্রেস চরণ সিংকে মাত্র ২৩ দিনের জন্য সমর্থন দিয়েছিলেন, তারপর চরণ সিং হয়ে গেলেন পাঁচ মাসের জন্য এক তদারকি সরকারের মাথা। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এলেন, পেলেন ৩৫৪টি আসন। বামফ্রন্ট সরকার আবার কেন্দ্রে বৈরী সরকারের অধীনে কাজকর্ম করতে লাগল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট যদিও ৩১টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসনে জিতেছিল তবুও বসু আত্মসন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি। বাতাসে বিপদের গন্ধ পেয়ে এক জনসভায় বসু বলেছিলেন “কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিতে পারে, যাই হোক, আমরা ভয় পাব না। কারণ জনগণ আমাদের সঙ্গে আছেন।” ১৯৮১ সালের মার্চ আর এপ্রিল মাসে রাজ্যে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ৩রা এপ্রিল অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। কংগ্রেস আন্দোলনকারীরা বাস-ট্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। সারাদিন রাইটার্সে থেকে বসু কড়াহাতে এই অবস্থার মোকাবিলা করেন। ৭ই এপ্রিল কলকাতার মানুষ এর প্রতিবাদে এক বিশাল মিছিল বার করে।
সি. পি. আই. (এম)-কে ইন্দিরা গান্ধী শত্রু হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯৭৭ সালে তাঁর পতনের অন্যতম কারণ তিনি এই দলকেই মনে করতেন। তাছাড়া এই দল ইন্দিরা-বিরোধী জয়প্রকাশের আন্দোলনের সমর্থক ছিল। অতএব সুযোগ পেলে এই দলকে কোণঠাসা করে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা তাঁর অবশ্যই ছিল। কিন্তু গোয়েন্দাবিভাগের রিপোর্ট তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টাতে খানিকটা সাহায্য করে। তিনি শুনেছিলেন প্রথম পাঁচ বছরে বামফ্রন্ট সরকার এত ভাল কাজ করেছিল যে তারা জনগণের আস্থা অর্জন করে নিয়েছিল। তাছাড়া জ্যোতি বসুর মত সমান মাপের নেতাও তখন কংগ্রেসে ছিল না।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার সাতদিন পরে বসু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। বসুর আলোচ্য বিষয় ছিল আসামের সংখ্যালঘু সমস্যা। আলোচনা শেষে বসু ইন্দিরাকে বলেছিলেন “আমরা আপনি জিতেছেন শুনে একটু উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম ঠিকই তবে এটা যে আপনার বিরাট জয় সেটা অস্বীকার করা যায় না।” ইন্দিরা শ্লেষটুকু ধরতে পেরেছিলেন।