১০. তিতলি-২

১০. তিতলি-২

আমার মাঝে মাঝে বয়েসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেদিন অর্জুনের সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে বিশেষ করে। অর্জুনকে একটু ক্লান্ত লেগেছিল সেদিন, একটু বুঝি পড়ন্ত। অথচ আমার তো একটুও পড়ন্তবেলার কথা মনে হয় না? আয়নার সামনে দাঁড়ালেও একজন যুবতিকে দেখি, বুকের অভ্যন্তরে তাকালেও একজন যুবতিকে দেখি। সেদিন, শিরা-ধমনির সমস্ত লাফালাফি স্তব্ধ করে, শান্ত মনে যখন ভাবছিলাম, ট্যাক্সিতে আসতে আসতে, তখন মনে হচ্ছিল, অজুর্নের সঙ্গে আমার বুঝি অনেকখানি বয়েসের তফাত হয়ে গেছে। ও যেন প্রৌঢ়ত্বে পা দিয়েছে। আমার নিজেকে প্রৌঢ় বলে মনে হয় না। বয়েসের হিসেব কষা অনেকদিনই ছেড়ে দিয়েছিলাম। রাহুলের সঙ্গে যখন থেকে আছি। রাহুল আমার চেয়ে বছর কয়েকের ছোট,—যদিও দেখলে উলটোটাই মনে হবে। কিছুতেই আমাকে বয়েসের প্রসঙ্গ তুলতে দিত না রাহুল—আমি যতই ওর ওপরে সর্দারি করতে চাইতাম বয়েসে বড় বলে, তত ও আমাকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিত, আমার চেয়ে মাথার অনেকটা উঁচু বলে, গায়ে অনেক বেশি বল রাখে বলে।

মেল-ইগোর ক্লাসিক উদাহরণ।

অর্জুন আমার ক্লাসমেট ছিল না। দু-ক্লাস উঁচুতে পড়ত। অর্জুনদা বলাটাই উচিত হত, কিন্তু অর্জুন নিজেই বলেছিল ও দাদা, দিদি, মাসি, পিসি এসব ডাক পছন্দ করে না। নামটা তো আছে ডাকবার জন্যেই। কলেজে কেউই ওকে অর্জুনদা বলত না—ও সকলকেই নাম ধরে সম্বোধন করতে শিখিয়েছিল। পুরোনো বাড়ির ছেলে হলে কী হবে, ওর মনটা চিরকালই সবায়ের আগে আগে চলত। অর্জুন ইংল্যান্ডে চলে যাবার পরের বছর আমি আমেরিকাতে যাবার সুযোগ পেলাম। আর তার দুবছরের মধ্যেই সব শেষ।

প্রথমে চিঠি বন্ধ।

তারপর ফোন বন্ধ।

তারপর ফোন ধরাও বন্ধ।

তারপর ঠিকানা বদল।

দেশ, ঘর বদল।

.

ছোট্ট মোবাইল ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে সুর করে বাজছে। স্নানঘর থেকে প্রায় ছুটে এল তিতলি।

‘হ্যালো? হ্যালো? তিতলি? তিতলি বলছিস? আমি, আমি—’

‘বুঝেছি বল।’

‘তোরা নিশ্চয়ই ভীষণ ব্যস্ত?’

‘তা একটু ব্যস্ত তো বটেই।’

‘আমি একটু দেখা করতে চাই।’

‘চৈতন্যমঠে আসছিস তো? দেখা হবে একুশে।’

‘ওরকম না। তার আগে। আলাদা করে একটু দেখা। তোদের বাড়িতে যেতে পারি? কিংবা তুই যদি একটু বাইরে কোথাও—’

‘অর্জুন, আয়্যাম রিয়্যালি টু মাচ বিজি। আই ডোন্ট হ্যাভ দ্য টাইম।’

‘রাগ করে আছিস। রাগ তো করবারই কথা। আমার কথাগুলোও একটু বলতে দে? এত বছর ধরে যে কথাগুলো মাথার মধ্যে বুকের মধ্যে বয়ে বয়ে বেড়চ্ছি, সেগুলো একবার বলে ফেলতে সুযোগ দে তিতি।’

‘বাড়ি থেকে বেরোনো খুব মুশকিল। বাড়িতেই কথা বলতে পারিস।’

‘সংকু? মিতু? ওরা তো থাকবে।’

‘একজন গেস্ট হাউসে, অন্যজন শ্বশুরবাড়িতে।’

‘তুই একলা রয়েছিস?’

‘সর্ট অফ। বন্ধুরা আসে, রিলা মৌসুমি, ওরা আসে রোজই। দিদিও এসে সারাদিনই থাকে। তাছাড়া তুই প্রিভেসি চাইলেই আমিও যে প্রিভেসি চাইব তার তো মানে নেই? আমার তো মনে হয় ওদের থাকাই ভালো। সেইসব দিনে তো ওরা সবাই ছিল। রিলা, শিবুদা,—এখন হঠাৎ ওদের নিয়ে অস্বস্তি হচ্ছে কেন?’

‘তিতি, তুই কিছুই শুনিসনি কী?’

‘কী শুনব?’

‘আমাদের যে অনেক বছর ডিভোর্স হয়ে গেছে? শুনেছিস?’

‘সো? হোয়াই ইজ দ্যাট ইম্পর্ট্যান্ট টু মি? ইটস ইওর বিজনেস। ইওর লাইফ। নাথিং টু ডু উইথ মি।’

ওদিকে অর্জুন চুপ করে থাকে। তারপর ম্রিয়মান কন্ঠস্বরে বলে, ‘না তিতি, ওটা সবটা তোর মনের কথা নয়। হতে পারে না। ঠিক ঠিক কথা বলছিস না তুই। রাগের কথা বলছিস।’

‘অর্জুন, আই মাস্ট গো ব্যাক টু মাই ওয়ার্ক। আর ইউ ফিনিশড?’

‘নো। প্লিজ , তিতলি প্লিজ ।—প্লিজ লিসন—আই হ্যাভ আ ফিউ ইমপর্ট্যান্ট থিংস টু টেল ইউ। একটা দিন সময় দে। প্লিজ —’

‘একটা দিন। আর ইউ ক্রেজি? এক ঘণ্টা হতে পারে। আফটার অল দিস ইজ ওভার। কাজের পর আই ক্যান গিভ ইউ অ্যান আওয়ার—বাট নট নাউ।’

অর্জুনের গলার স্বর পালটে যায়—’বাট আই ওয়ান্ট ইট নাউ! দেখা যখন হয়েছে, তখন কয়েকটা কথা তোকে বলতেই হবে আমার। আই মাস্ট টক টু ইউ। নাউ। টু-ডে। এক্ষুনি, ইফ পসিবল। বাট এনি টাইম উইল স্যুট মি ফাইন।’

সেই ছেলেবেলার মতোই জেদি রয়ে গেছে। গোঁয়ার—গোঁ ধরলে ছাড়বে না। রাগের বদলে হাসি পেয়ে গেল তিতলির।

‘ও-কে—দেন, আই গেস আই কুড ডু ইট রাইট অ্যাওয়ে। এক্ষুনি স্নান করে এলাম। এখনও কেউ আসেনি। সবাই খেয়ে উঠে আসবে।’

‘থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, তিতি—এখনই চলে আসছি তবে। ইন হাফ অ্যান আওয়ার।’

এক কাপ কফি নিয়ে বারান্দাতে এসে বসল তিতলি। এত সুন্দর বারান্দাটা মা’র দেখাই হল না। উলটোদিকে সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট দেখা যায়। রাত্রে এই রাস্তা আর ওই বিদ্যালয় সব মুছে গিয়ে থাকে বিন্দু বিন্দু আলো—জ্যোতিষ্কের মতো জ্বলে অন্ধকারে—যেন অনন্ত আকাশ—দিনের আলোয় সবকিছু অত্যন্ত দীনদরিদ্র, সব সীমারেখা স্পষ্ট, সব আকার-প্রকার রহস্যবিহীন। রাত্রি ভালো লাগে তিতলির।

এই ফ্ল্যাটটা দিনের বেলায় ভালো এত সবুজ দেখা যায় বলে। বাগান, গাছপালা দিয়ে ঘেরা। আর রাতে ভালো সব কিছু মুছে যায় বলে। শুধু কিছু স্তব্ধ আলো, কিছু গাড়ির চলন্ত আলো। তিতলি খাতা বের করে টিক দিতে থাকে। কাকে কাকে কার্ড দেওয়া গেছে। কাকে কাকে দেওয়া বাকি। আর বিশেষ বাকি নেই।

বেশি তো আত্মীয়স্বজন নেইও ওদের চেনা। দিদির শ্বশুরবাড়ি, মামাবাড়ি, মাসিরা, বন্ধুবান্ধব। বাপের বাড়ির দিকে তো বড়পিসিমা ছাড়া কেউ নেই। বড়পিসিমা বাবার বড়দিদি, তিনি থাকেন শ্রীরামপুরে। ওঁর চিঠিটা দেবদাই কুরিয়ার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। বড়পিসিমা তো পারবেন না, পানুদা,-বৌদিরা কেউ আসবেন।

কিছু কিছু চিঠি পোস্টে যাচ্ছে। ঠিক নিমন্ত্রণ নয়, জানান দেওয়াই উদ্দেশ্য—এঁরা কলকাতার বাইরে থাকেন—মৎস্যমুখীতে যাদের আশা করছে না তিতু-মিতু। রাহুলকে কি চিঠি পাঠাবে একটা?

কী হবে?

চিঠি তো বাংলায় হয়েছে।

রাহুল জানবে না।

দিদি বলেছিল তবু পাঠানো উচিত ইংরেজিতে একটা নোট লিখে—’এতদিন একসঙ্গে ঘর করলি, একটা খবরও দিবি না?’

রাহুলের নামে একটা কার্ড লিখে ফেলল তিতলি। সঙ্গে দু-লাইন। Ma passed away, She couldn’t move into her new apartment. The memorial services will be held on the 21st. and the dinner on the 23rd.

ঘণ্টা বাজল।

কলম রেখে, কার্ডগুলোর ওপরে একটা ভারী বই চাপিয়ে দরজার দিকে চলল তিতলি। দরজার সামনে এসে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়াল, নিশ্বাস নিল।

তারপর দরজা খুলল।

‘কী রে? দ্যাখ, কীরকম চটপট চলে এসেছি।’ হইহই করে মিতুল ঢুকে আসে। একাই একটা দলের মতো।

‘কী অবস্থা? আজ ক’টা জায়গায় যাওয়া? আর কী? সবই প্রায় শেষ। হাতে দিনও আছে মাত্র তিনটে।’ তারপর মিতুল ভালো করে তিতলির মুখখানা দ্যাখে।

‘কী হল আবার? শরীর খারাপ নাকি?’

‘না। বোস দিদি। বলছি। কফি খাচ্ছি। তুই খাবি? নাকি একটু পরে খাবি? আবার করব। এক্ষুনি অর্জুন আসবে?’

মিতুল এসেই বসে পড়েছে সোফাতে। মিতুলের উচ্ছ্বসিত ভাব হঠাৎ চুপসে যায়।

‘কে আসবে বললি? অর্জুন?’ তারপর একটু সময় নিয়ে—’অর্জুন এখানে?’

‘হ্যাঁ এখানে। ফোন করেছিল। আসতে চায়। ইনফ্যাক্ট এখুনি আসবে। তোদের কথাও বলছিল।’

‘মা’র কথা জানল কী করে?’

‘আমি বলেছি। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল গতকাল। ব্যাংকে কার্ড দিলাম।’

‘আমাকে তো বলিসনি?’

‘না:। কী বলতাম? এই তো শুনলি। এবার স্বচক্ষে দেখবি।’

‘আমি এসে পড়ে অসুবিধে হয়ে গেল না তো?’

‘কী যে বলিস! বেঁচে গেছি তুই এলি বলে। ওর অসুবিধে হলে হবে। আমার খুবই সুবিধে হল।’

‘আসছে কেন?’

‘কিছু জরুরি কথা বলবে বলে।’

‘তুই শুনবি? তিতু? তোর কি শোনা উচিত, ওর জরুরি কথাগুলো, এই দশবছর পরে? তোর জীবনটাকে একদম ঘেঁটে দিয়েছে ছেলেটা। তুই রাহুলকে কেন শুধু ছাড়লি বল তো, জগতের সবাই অর্জুন নয়।’

‘দিদি, রাহুলের কথা তো তুই জানিস না—ও এত লোভী, এত ইমম্যাচিওর, ওর সঙ্গে আমি আর সম্পর্ক রাখতে পারব না। এর ভেতর অর্জুন নেই। অর্জুন একাই দুর্বল নয় রে দিদি। ছেলেগুলো সবাই একটু দুর্বল নয় রে দিদি। ছেলেগুলো সবাই বড্ড দুর্বল, আর বড্ড লোভী হয় দেখলাম।’

‘অ্যাই। জেনেরালাইজ করবি না তো তিতু। বাবার কথা ভাব। অশোককে দেখ। দাদাভাইও তো আছে সামনে। সব ছেলেরাই কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গ করে না। তোর লাকটা খারাপ। তার চেয়েও খারাপ লাক তোর বয়ফ্রেন্ডদের। হাতের চাঁদ পায়ে ঠেলেছে অর্জুন। রাহুলের কী ব্যাপার, তা তুমিই জানো। সে তো বাবা এখনও ওই ফ্ল্যাটেই আছে, তুমিই ওকে ছেড়ে চলে এসেছ—ব্যাপারটা কী? আজ আমাকে সব কিছু খুলে বলতে হবে। তুই সমানে ঢেকেঢুকে vague আর mysterious করে রাখছিস রাহুলের ঘটনানা। ছেলেটা তো ভালো—আমরা সবাই দেখেছি। সবারই পছন্দ—’

ডোরবেল বেজে ওঠে।

মিতুল-তিতলি মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। চোখে চোখে কী কথা হয় দুই বোনে, তিতলি বসে থাকে, মিতুল উঠে যায় দরজা খুলতে।

‘মিতুল।’

‘এসো অর্জুন।’

অর্জুন ঢুকে আসে মিতুলের পিছনে পিছনে। আজ পরনে সাদা পায়জামা আর আকাশি নীল রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি—তাতে সাদা রং দিয়ে কিছু উড়ন্ত বলাকা আঁকা—আর বলাকার সারির উপরে চার ছত্র কবিতা—’যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে—সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া—যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে—যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া…’ আর বলাকার নীচে দু-ছত্র…’তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।’

‘শ্রাবন্তীর পাঞ্জাবি?’ তিতলি কথা শুরু করে।

‘হ্যাঁ, ওই, একটা এক্সিবিশন হচ্ছিল।’

‘কে কিনে দিল?’ মিতুলের প্রশ্ন।

‘কে আবার দেবে? নিজেই কিনেছি।’

‘সুন্দর বানায়। না? কেয়া-চৈতালি?’

‘অভি-র জন্যে যে টি-শার্টটা কিনেছি সেটা আরও সুন্দর। কালোতে সোনালি দিয়ে হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্ট আঁকা, এই তোদেরই মতন। আর লেখা ‘কলিকাতা চলিয়াছে নাড়িতে নাড়িতে’—একটা ল্যাম্প পোস্টও আঁকা আছে।—খুব সুন্দর, আর Kolkata লেখা। অভির ভীষণ পছন্দ।’

‘অভি?’ মিতুলই কথা চালাচ্ছে।

‘আমার ছেলে। অভিমন্যু।’

‘কত বড় হল?’

‘বড়? প্রায় আমার মাথায় মাথায়। কিন্তু বয়েস বেশি নয়। বারো চলছে।’

‘ওর মা কোথায়?’

‘কেপটাউনে।’

‘তোমাদের খবর লোকমুখেই শুনতে পাই।’

‘আমার কোনও খবর নেই।’

‘তাহলে কী বলতে এসেছ আজ?’

‘পুরোনো কথা। যে কথাগুলো তোমাদের বলা হয়নি।’

‘কফি খাবি?’ তিতলির কথায় একটু প্রাণবন্ত দেখায় অর্জুনকে।

‘কফি করছিস? দে তবে।’

তিতলি উঠে যায়।

‘আমাদের জীবনটা খেলাচ্ছলে কেটে গেল মিতুল। কোথাও পৌঁছুল না।’

‘সেরকম তো কথা ছিল না। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই তো জীবন আরম্ভ করেছিলে। তুমিই তো তীরে গিয়ে তরী ডুবিয়ে দিলে অর্জুন।’

‘সবাই খুব মাতাল ছিলাম সেদিন। একত্রিশে ডিসেম্বরের পার্টির রাত্রি। কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল না।….’

‘তুমি কী করেছিলে?’ মিতুল অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে বসে।

অর্জুন কোনও উত্তর দিল না।

চুপ করে সামনে টেবিলটার ধোঁয়াটে কাচের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

তিতলি ট্রেতে তিন কাপ কফি, আর বিস্কিট এনে টেবিলে রাখল। সবাইকে হাতে হাতে তুলে দিল কফির কাপ—’দুধ? চিনি?’

‘নো থ্যাংক ইউ’ অস্ফুটে উচ্চারণ করে অর্জুন মুখটা কাপের দিকে নামায়।

‘দ্যাখো, গরম!’ প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে তিতলি।

‘ঠিক আছে—’ চোখ তুলে হাসে অর্জুন। ‘মুখ যা পোড়ানোর, আগেই তো পুড়িয়ে বসে আছি।’

দু-এক চুমুক কফি পানের পরে অর্জুনই নিস্তব্ধতা ভাঙে।

‘জীবনটা বড্ডই আমার হাত ফসকে পালিয়ে যেতে চায় মিতুল। বারবার দেখছি, চাই এক, হয় আর এক। তোমরা তো জানো কী চেয়েছিলুম আর কী পেয়েছি।’

‘সেটা কী অদৃষ্টের দোষ অর্জুন? না মানুষের? আমি পুরুষকারে বিশ্বাসী।’

‘পুরুষকার?’ অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল অর্জুনের ঠোঁটে আর চোখে।—

‘একদিন তো আমিও ভাবতুম পুরুষকারই মানুষের কর্ম কিন্তু জীবনে পরের পর যা ঘটে যেতে দেখলুম তাতে অদৃষ্টে অবিশ্বাস করবার উপায় নেই আর।’

তিতলি কিছুই বলে না। কফির কাপে আস্তে আস্তে চামচে নেড়ে টুংটুং শব্দ করে যায়। মিতুল ভুরু কুঁচকে বলে,—’শব্দটা বন্ধ কর!’

তিতলি চামচে আর নাড়ায় না।

‘এই তো আমাদের দুজনকেই দ্যাখো না, আমাদের মধ্যে যেটা ঘটে গেল, সেটা পুরুষকার, না অদৃষ্ট ছিল?’

‘তুমি কী বলতে চাইছ অর্জুন? যে নেহাত তোমার অদৃষ্টদোষেই তুমি তিতলিকে জিল্ট করে অন্য মেয়েকে বিয়ে করেছিলে? তাতে তোমার নিজস্ব কোনও দায়িত্ব ছিল না? এটাই বলছ তো?’

তিতলি বলে, ‘থাক না, দিদি। যা হয়েছে হয়েছে—এখন ওসব নিয়ে আর ভাবি না। ভাবতেও চাই না।’

অর্জুন চুপ করে থাকে। খানিক নি:শব্দতার পরে মিতুলের দিকে চেয়ে অর্জুন বলল, ‘যদি বলি, হ্যাঁ, তাই? আমার অদৃষ্টদোষে সেই রাত্রে, একত্রিশে ডিসেম্বরের পার্টিতে আমরা সকলেই প্রবল মাতাল হয়ে পড়েছিলাম এবং কী করে কী হয়ে গিয়েছিল বুঝতেও পারিনি। যে ছেলেটাকে তোমরা চেনো, সেই ছেলেটা কখনও মাতালও হয়নি, স্ত্রী-সঙ্গমও করেনি। অথচ ওই রাত্রে কী যে ঘটে গেল আমি জানি না। ওই মাতাল অর্জুনকে আমিও চিনি না। একে অদৃষ্টও ছাড়া কী বলব? প্রচণ্ড মাতাল হয়ে তো আমরা সারারাত বেহেড—সকালে আমাদের দুজনকে একত্রে ঘুমন্ত আবিষ্কার করল অনিলার দাদা। তারপরেই অনিলার প্রেগন্যান্সি। এবং আমার জীবনে পড়ল পূর্ণচ্ছেদ।’ মিতুল কিছু বলল না।’

তিতলি চুপ।

‘আমি তোকে কি লিখতুম তিতু? লজ্জায়, ঘেন্নায় তোকে ফোন করা, চিঠি লেখা বন্ধ করে দিলুম। এত বড় দুর্ঘটনার পরে আমার পালাবার পথও বন্ধ করে দিল ওরা। অনিলা জেদ ধরে বসল বাচ্চাটা রাখবে, অ্যাবর্ট করাবে না। বাড়িতে ফোন করে ওর বাবাকেও জানিয়ে দিল। আমার বাবাকেও। ওর বাবা চলে এলেন, আমাকে জবরদস্তি বিয়ে দেবেন বলে। আমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হল।’

‘জবরদস্তি করতে হবে না।’ আমি বললুম, ‘আমার সন্তানের দায়িত্ব আমিই নেব।’ এ ছাড়া কিই বা করতে পারতাম আমি সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে?’

তখনও সেভাবে কিছুই জানা হয়নি অনিলা সম্বন্ধে। ধীরে ধীরে জানলাম যে সে সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে নয়। মাঝে মাঝে একেবারে অসুস্থ হয়ে মানসিক রোগের হাসপাতালে যেতে হয় ওকে। ওর প্রচণ্ড ইন্ডিয়া-বিদ্বেষ, ইন্ডিয়ান-বিদ্বেষ, এসবই সেই মনোরোগের অঙ্গ।—সেসব জানতে অনেকদিন দেরি হয়েছিল।

বিয়ে হল লন্ডনেই। অভিমন্যু জন্মাল। আমি তারই মধ্যে পাস করে একটা চাকরি খুঁজতে লাগলুম।

বাচ্চা জন্মানোর কিছুদিন পরেই অনিলা দেশে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে পড়ল। সেখানে ওদের কাজের লোকজন আছে। বাচ্চা ধরবার লোক পাবে। আমাকে সুদ্ধু নিয়ে দেশে চলল। সেখানে আমার জন্য অনেক চাকরি নাকি পড়ে রয়েছে।

আমার মা-বাবা-ঠাকুরদা-ঠাকুমা সবাই রইলেন কলকাতায়। আমি চললুম কেপটাউনে। অনিলাদের সেখানে বিশাল ব্যাবসার রাজ্যপাট। সত্যি আরামের অপরিসীম বিলাসের জীবন। আমিও গিয়েই কাজ পেয়ে গেলুম। ওখানকার একটা কলেজের লেকচারার। ক্রমশ অভিমন্যুই হয়ে দাঁড়াল আমার জীবনের কেন্দ্র। প্রায় মাতৃহীন শিশু বললেই চলে। সন্তানের প্রতি অনিলার যেমন অতিরিক্ত আগ্রহ এসেছিল তার জন্মের আগে, তেমনিই অনাগ্রহ এসে গেল জন্মের পরে। অভি-কে সহ্যই করতে পারত না অনিলা। কী একটা আক্রোশ ছিল ওর প্রতি।’

হঠাৎ ওকে থামিয়ে দিয়ে তিতলি বলল—

‘অনিলা—অনিলা করছিস যে বড়? লন্ডনে তো নীলা বলতিস।’

‘বলতুম। সেইটেই ওর ডাকনাম। ডাকনামে ডাকতে আর প্রবৃত্তি হয় না।’ একটু থেমে বলল —’ওর অত্যাচারের রকমটা অস্বাভাবিক! অভিকে নিয়ে পালিয়ে না এলে—’

শিউরে উঠে চুপ করে যায় অর্জুন।

‘একটা ভুলের মাসুল সারাজীবন ধরে গুনতে হবে একজন মানুষকে? আর অভি? সে তো শিশু—সে বেচারি কী দোষ করেছিল, যে তার জীবনে এত জটিলতা, এত বেদনা, এত বঞ্চনা এসে পড়বে? তবুও তুমি ”পুরুষকার” শব্দটা উচ্চারণ করবে, মিতুল?’

মিতুল চুপ।

‘মাপ চাইবার সাহস আমার নেই যেভাবে তিনজন মানুষের জীবনে আমি অশেষ যন্ত্রণা এনেছি—তিতলির, অভি-র এবং আমার নিজের।—তাতে করে ”ক্ষমা কর”, ইত্যাদি ওজনদার কথা উচ্চারণ করতেও মুখে বাধে।’

তবু বলছি। তিতলি মনে রাগ-দু:খু পুষে রাখিসনি। তাতে জীবন তেতো হয়ে যায়। ক্ষমা করে দিলে নিজেরই মুক্তি। দেখবি জীবনের স্বাদ পালটে যায়।’ অজুনের স্বর ক্লান্ত শোনায়। একটু চুপ থেকে আবার অসহায়ভাবে বলল—

‘তিতলি তুই তো আমাকে চিনিস। তুই বিশ্বাস কর, আমার কিছুই মনে নেই রে। কিছু স্মৃতি নেই। আমার স্মৃতিতে সেই রাত্রি ছিল শুধু মদের।’

কাপগুলো কুড়িয়ে নিয়ে মিতুল এবারে উঠে দাঁড়ায় ট্রে হাতে।

‘থাকগে। ওসব পুরোনো কথা আর ঘেঁটে কী হবে। যা হবার হয়ে ফুরিয়ে গেছে। অভিমন্যু এসে গেছে তো কলকাতায়, মাসিমার কাছে মানুষ হচ্ছে। এটাই বড় কথা। তিতলি ঠিকই থাকবে। ওর জন্য ভাবিস না। আমরা সবাই খুব শক্ত ধাতুর তৈরি।’ মিতুল হেসে চলে যায়। তিতলি উঠে গিয়ে পরদাগুলো টেনে দিতে থাকে।

‘চল তিতলি, ভাত খেয়ে নিবি এবারে। তোর বন্ধুরা সব এসে পড়বে।’ মিতুল ওঘর থেকে বলে, ‘আমাদের সঙ্গে তোকে খেতে বলতে পারছি না অর্জুন—তিতলির তো অশৌচ চলছে, হবিষ্যি করছে, একুশে শ্রাদ্ধের দিন আমাদের সঙ্গে ভোগপ্রসাদ খেয়ে যাস। আর তেইশে ‘মৎস্যমুখী’-তে অভিমন্যুকে অবশ্যই নিয়ে আসিস। আমাদের সঙ্গে খেয়ে যাবে।’ ট্রে রেখে বেরিয়ে আসে মিতুল।

‘কোন স্কুলে পড়ছে ও?’

‘ডন বস্কোতে দিয়েছি। কিন্তু ওর বাংলা পড়ায় খুব মন-টন আছে দেখি। মায়ের কাছে গল্প শুনে শুনে এটা হয়েছে। ফেলুদা, প্রফেসর শংকু, সব পড়ে।’

‘মা’র কথা বলে না?’ মিতুলের কৌতূহল চরিতার্থ করে অর্জুন।

‘না: মা’র স্মৃতি তো সুখের নয়। ভীতিপ্রদ।’

অর্জুন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, তিতলির দিকে একবার দেখে নেয় আড়চোখে, তারপর মিতুলকে বলে—

‘তোমরা দুজনেই ছিলে ভালো হল। একা তিতলি থাকলে ওরও কষ্ট হত। আমরাও অসুবিধা হত বলতে…। আসি মিতুল, তিতলি আসি—একুশ তারিখে দেখা হবে।’

.

অর্জুন চলে যাবার পরে মিতুল হঠাৎ বলে উঠল,—’রাহুলের সঙ্গে অমন হুট করে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে এলি কেন, তা জানি না। ফিরে গিয়ে ওটা ফের reactivate করবার চেষ্টা করবি। রাহুল তো চমৎকার ছেলে। তোকে খুব যত্ন করত, ভেরি কেয়ারিং—’

‘দিদি, তোমাকে তো বললাম। ও ভয়ানক ইমম্যাচিওর, অ্যান্ড হি হ্যাড লেট মি ডাউন। এতটা যখন শুনলি তখন বাকিটাও বলছি শোন। এক ক্যানেডিয়ান রোমান্স রাইটার অর্থাৎ চিপ প্রেমের কাহিনির কর্মার্শিয়াল রাইটার—সিরিয়াস সাহিত্যসাধক নয়—এসেছিল আমাদের শহরে রোমান্সের মেটেরিয়্যাল খুঁজতে—রাহুলটা এত বোকা, নিজেই তার মেটেরিয়্যাল হয়ে গেল। তার সঙ্গে উন্মত্ত হয়ে দুটো মাস স্বপ্নের মধ্যে কাটিয়ে এখন তার আমাকে আর ভালোই লাগছে না। ঘরসংসারে আর তার মন নেই। আমিও বোরিং হয়ে গেছি। সে কেবল বাহামায় আর লাসভেগাসে আর নায়াগ্রায় ছুটে বেড়াতে চায়। আমিও এই বয়েসে ওরকম হালকা পলকা চরিত্রের পুরুষকে আমার জীবনে আর চাই না দিদি। সো আই সেইড,—’গুড বাই—ফাইন্ড আপ্লেস ফর ইওরসেলফ ইন দিজ ফিউ মান্থস।’ ওর হাতে সময় আছে। আমি ফিরতে চাই পরিচ্ছন্ন ফাঁকা ফ্ল্যাটে। আই ওয়ান্ট নো সাইনস অফ অ্যানাদার ট্রেইটর ইন মাই লাইফ। মোস্ট মেন আর ট্রেইটরস।’

‘এ কথা ঠিক নয় তিতু। আবার ওই সব বলছিস? তোকে না এক্ষুনি বললাম বাবার কথা মনে কর। অশোকের কথা, দাদার কথা, ইউ মাস্ট স্টপ থিংকিং নেগেটিভ। থিংক পজিটিভ, তিতু। প্লিজ , থিংক পজিটিভ! উই মাস্ট থিংক পজিটিভ টু গেট পজিটিভ রেজাল্টস ফ্রম আওয়ার অ্যাকশনস ইন লাইফ।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *