সায়েন্স ফিকশন
ভৌতিক কাহিনি

১০. এগিয়ে চলো অসম্ভবের মুখে

এগিয়ে চলো অসম্ভবের মুখে

সেকালে নদী ছিল একটা, বেশ বড়োই। নাম ছিল ওব।

এখন আর ওব নদী নেই, তার বদলে আছে একটা সাগর। ওই নদীটার উপরেই উঁচু বাঁধ দেওয়া হয়েছে চারপাশ ঘুরিয়ে। একটা গোটা দেশ জলের তলায় এখন। লোকে ওব সাগরই বলে তাকে। কেন বলবে না? কৃষ্ণসাগর, কাস্পিয়ান যদি সাগর পদবাচ্য হয়, ওব এমন কী অপরাধ করেছে?

অকারণে বাঁধ দেওয়া হয়নি নিরীহ নদীটার উপরে। বৈজ্ঞানিক প্রয়োজন ছিল দারুণ। অফুরন্ত বিদ্যুৎ দরকার, কোথা থেকে তৈরি হয়? তৈরি করো এমন জলাধার, যা থেকে কৃত্রিম প্রপাত বার করা যাবে, নায়গ্রারই আকারের। নাও তারপর, কত বিদ্যুৎ চাই, টানতে থাকো তা থেকে।

ওই ওব সাগরেরই বাঁধের উপরে কেন্দ্রীয় মহাকাশ গবেষণার সদরদপ্তর। আমায় আসতে হয়েছিল সেই দপ্তরে একটা বিশেষ গরজে। খুলেই বলা যাক কথাটা।

মহাকাশযানের ডাক্তার আমি। তিন তিন বার মহাকাশে অভিযান করেছি এ যাবৎ। ডাক্তার বলতে কিন্তু মানসিক ব্যাধিরই ডাক্তার বুঝবেন সবাই, দূর শূন্যে মানুষের বিকার ঘটে দেহের চাইতে মনের ভিতরই বেশি। কাজেই উদরাময়ের চিকিৎসক বরং না-থাকলেও চলে আন্তর্নক্ষত্র ব্যোমযানে, চিত্ত বিকারের প্রতিকার করবার মতো ডাক্তার একান্তই অপরিহার্য।

সদরদপ্তরে এসেছি যে ব্যাপারের নথিপত্র হাতড়াবার জন্য, তার ঘটনাকাল ছিল, এই ধরুন পঞ্চাশ বছর আগে। মোটামুটি ধরে নিন ১৯৭০-এর দু-দিন আগে বা পরে। তখন মঙ্গলে যেতে একটা বিমানের এক বছরের মতো লাগত, বুধে পৌঁছোতে দু-বছরের সামান্য কম।

ইঞ্জিন? সামান্য কাজ ছিল ইঞ্জিনের, পৃথিবী ছাড়বার সময় একটুখানি, আর গন্তব্যে পৌঁছাবার আগে আর একটুখানি। গ্রহবিজ্ঞান সম্পর্কিত কোনো পর্যবেক্ষণ? বিমান যখন চলছে, তখন ও কাজ কেউ করত না, ব্যবস্থাই ছিল না তা করবার। ও-কাজের জন্য মানমন্দির ছিল, এখানে-ওখানে স্পুটনিকের পিঠে পিঠে।

তাহলে ধরুন, ইঞ্জিন চালাবার ঝক্কি নেই, পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব বা সুযোগ কিছু নেই, এক বা দু-বছরব্যাপী বিমানযাত্রায় বৈমানিকদের কাজ কী রইল? বলতে গেলে কিছুই না। বাধ্যতামূলক এই যে নিষ্ক্রিয়তা, এর দরুন মনের উপর পড়ত অস্বাভাবিক চাপ। সেই চাপ থেকে আসত স্নায়বিক বৈকল্য, তা থেকে মানসিক ব্যাধি।

বই পড়া? রেডিয়ো শোনা? তার সুযোগ যথাসম্ভব থাকত বই কী! কিন্তু তার উপর নির্ভর করে বছরের পর বছর কাটাতে হলে কারও মাথা যে ঠিক থাকতে পারে না, এটা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। হাতে-কলমে মেহনতের কাজ, ওর একটা উপযোগিতাই আলাদা। মানুষকে দেহে-মনে সুস্থ রাখতে ওর জুড়ি আর কিছু নেই। ওর অভাব পূরণ হতে পারে না বই পড়ে বা রেডিয়ো শুনে।

কীসে তাহলে হবে পূরণ? পূরণ হবে হাতে-কলমে খাটবার সুযোগ বৈমানিকদের দিতে পারলে। অনেক মাথা খাটিয়ে পরিচালকেরা স্থির করলেন, দূরপাল্লার বিমানযাত্রায় এখন থেকে এমন এমন লোক বহাল করতে হবে, বিমান চালনার কাজ ছাড়াও অন্য কোনো একটা শখের কাজের উপরে যাঁদের ঝোঁক আছে। বাগান করা, ছুতোরের কাজ করা, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা, দাবা খেলা— এসবের উপরে আসক্তি এখন থেকে মহাকাশযাত্রীদের অন্যতম প্রধান গুণ বলে গণ্য হবে।

বাগান করা? হ্যাঁ, বিশাল বিশাল মহাবিমান, তাদের গায়ে লম্বা একটা বারান্দা থাকে যদি কাচে ঢাকা, তার ভিতর গাছ হতে পারবে না কেন? হয় যদি, তাতে বৈমানিকদের চিত্তের ধৈর্যও বৃদ্ধি পাবে; তা ছাড়া, দৈবাৎ কখনো অক্সিজেনে টান যদি পড়ে, কলুষিত নিঃশ্বাস বায়ুকে শোধিত করে শ্বাসগ্রহণের যোগ্য করে তুলবার উপায় একটা থাকবে তারই মধ্যে।

যাক, এইভাবেই এক শ্রেণির পাইলটের উদ্ভব হল পৃথিবীতে, উঁচুস্তরের গণিতের উপরে যাদের প্রবল নেশা। ইঞ্জিনিয়ারেরা কবিতা লিখছে, বা ন্যাভিগেটরেরা প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধারের জন্য মাথা ঘামাচ্ছেন— এ দৃশ্য আর বৈমানিকমহলে বিরল রইল না।

পৃথিবী ত্যাগ করে বিমান যখন আকাশে ওড়ে তখন টেলিভিশন চালু থাকে কয়েক দিন মাত্র। রেডিয়ো শোনা যায় তারপরে আরও মাসখানিক। তারপর বৈমানিকের সম্বল রইল আর ওই নিজস্ব নেশাটি। দিস্তে দিস্তে কাগজ সে ভরিয়ে ফেলুক ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে বা আঁক কষে কষে, আপত্তি করবে না কেউ।

‘পোলাস’ বিমানে বৈমানিক ছিল ছ-জন। অ্যালেক্সি জেরুবিন ক্যাপ্টেন, তিনি ওস্তাদ আঁকিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার দু-জন, তাঁদের দু-জনের ভিতর আবার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে একটা— দাম্পত্য সম্পর্ক। এমন বিমানে তাঁরা কাজ নেন না, যেখানে দু-জনেরই ঠাঁই হবে না। মজা এই, তাঁদের বহাল করবার জন্য রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কোম্পানিতে কোম্পানিতে। দু-টিই নিষ্ঠাবান দাবাড়ু, ছক পেতে বসে তাঁরা পরস্পরের কিস্তিমাতের চিন্তায় মশগুল থাকবেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এ জিনিস খুবই উপভোগ্য মনে হয় কর্তাদের মধ্যে।

প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, ওঁরা দাবা খেলতেন নতুন পদ্ধতিতে, যাতে মন্ত্রীর সংখ্যা একটা নয়, দুটো, যাতে চৌষট্টির জায়গায় একাশিটা ঘর থাকে ছকে।

আপাতত পোলাসের কথা থাকুক, কেন্দ্রীয় দপ্তরের কথা আরও কিছু বলে নেওয়া যাক আগে। বাড়িটা যেন জল থেকে উঠে আকাশে উড়ছে। সাদা জাহাজ পাল তুলে দরিয়া পাড়ি দিচ্ছে। এমনটাও কখনো কখনো মনে হতে পারে ভাবুকদের।

পনেরো জন লোক দেখতে পেলাম সাকুল্যে। দুই-চার জন আগের পরিচিত আমার। সবাই অল্পদিনের জন্য এসেছেন এখানে। অস্ট্রেলিয়া থেকে এক লেখক এসেছেন, প্রথম আন্তর্নক্ষত্র অভিযানের বিবরণ সংগ্রহ করতে। লেনিনগ্রাডের এক বিজ্ঞানী এসেছেন। মঙ্গল গ্রহের সম্বন্ধে সব কিছু খুঁটিনাটি তাঁর বিশেষ প্রয়োজন। ভারত থেকে এসেছেন এক ভাস্কর, প্রতিভা আছে তাঁর, কিন্তু অভিমান নেই।

এ ছাড়া ইঞ্জিনিয়ার এসেছেন দু-জন, স্যারাটোভ থেকে এক পালোয়ান যুবক, আর জাপান থেকে এক বেঁটে বিনয়ী প্রৌঢ়। দু-জনে মিলে কী যেন একটা গবেষণা করছেন যৌথভাবে, কী সেটা, জানা সম্ভব হল না। জিজ্ঞাসা করতেই সেই জাপানি ভদ্রলোক অতি বিনয়ের লাজুক হাসি হেসে উত্তর দিলেন, ‘অতি সামান্য ব্যাপার মশাই, আপনার মতো ব্যক্তির মনোযোগ আকর্ষণ করার মতো কিছু নয়।’

কিন্তু আসল কথায় আসা যাক এইবার।

এসেই দেখা করলাম ডিরেক্টরের সঙ্গে। এখনও বেশ শক্তসমর্থ রয়েছেন ভদ্রলোক, তবে চক্ষু দু-টি প্রায় যেতে বসেছিল কয়েক বছর আগে, তাঁরই রকেটের ভিতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়া ফলে। সেই থেকেই চোখ অসুস্থ। বাধ্য হয়ে রকেটে রকেটে ছোটাছুটি বন্ধ করে এই ডিরেক্টটরি নিয়েছেন। ভদ্রলোকের চশমাটা দেখবার মতো। তিনখানা কাচ একসাথে জোড়া, রং নীল।

আমার বক্তব্য শুনে নিয়ে তিনি বললেন, ‘বার্নার্ডের তারা? ওতে অভিযান হয়েছিল তিন বার, জানেন তো?’

লজ্জিত হয়ে বললাম, ‘কিছুই জানি না স্যার! আমার জ্ঞান খুব কম।’

মাথা নেড়ে তিনি জবাব দিলেন, ‘কম নয়, তবে ভিন্নমুখী। আপনি গবেষণা করেছেন সিরিয়াস, প্রোসিয়ন আর সিগনি-৬১ সম্বন্ধে। ওসব নক্ষত্রপুঞ্জে যত অভিযান হয়েছে, আপনার নখদর্পণেই আছে তা।’

আমার মতো সামান্য লোকের ইতিকথা ওঁর এমন কণ্ঠস্থ, এ দেখে অবাক হতে হল আমায়।

‘অ্যালেক্সি জেরুবিন প্রথম অভিযানে অধিনায়ক ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে সব কিছু তথ্যই পাবেন আপনি। আধঘণ্টার মধ্যেই পাবেন। একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসুন গিয়ে পাঠাগারে। সব পৌঁছে দেবে ওরা।’

নীল চশমার পিছনে চোখ অদৃশ্য। কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হল— ভদ্রলোকের স্বর বিষাদে আচ্ছন্ন।

পেয়ে গেলাম কাগজপত্র। কাগজগুলোতে হলদে ছোপ ধরেছে। কালিও অস্পষ্ট এক এক জায়গায়; কিন্তু দুর্বোধ্য নয় কোথাও। ইনফ্রা-রেড কপি (লাল-উজানি আলোর নকল) রয়েছে সব কিছুর।

জানালা দিয়ে দেখা যায় ওব সাগরের তরঙ্গোচ্ছ্বাস। বড়ো ঢেউ কূলে আছড়ে পড়ছে, তারপর জল খাচ্ছে মসৃণভাবে উলটি-পালটি। যেন কোনো অদৃশ্য পাঠক পাতা উলটে যাচ্ছেন এক রহস্য-রোমাঞ্চ ভরা গল্প-কাহিনির।

বার্নার্ডের তারায় অভিযান সে-যুগে ব্যাপারটা ছিল বিপদসংকুল। পৃথিবী থেকে ছয় আলোকবর্ষ দূরত্বে ওই নক্ষত্র। রকেটকে অর্ধেক পথ অতিক্রম করতে হবে দ্রুততালে, বাকি অর্ধেক ঢিমেতালে। ওখানে পৌঁছে আবার ফিরে আসতে সময় লাগবে।

আন্দাজ ছিল এইরকম যে, যাওয়া-আসার সময় লাগবে চৌদ্দো বছর। রকেটের আরোহীদের ওই সময়টার মধ্যে কাজ করতে হবে ধরুন চল্লিশ মাসের মতো। কিন্তু বিপদ এইখানে যে, ওই চল্লিশ মাসের ভিতরে আটত্রিশ মাস ধরেই রকেটের ইঞ্জিনকে চালু রাখতে হবে পুরোদমে।

অতিরিক্ত জ্বালানি রাখবার জায়গা নেই রকেটে। এখনকার লোকে ওটাকে খুবই একটা ঝুঁকির ব্যাপার বলে মনে করবে নিশ্চয়ই। কিন্তু সে-যুগে ওর আর উপায়ান্তর ছিল না। চৌবাচ্চা সব এঁটে বন্ধ করা। বরাদ্দের অতিরিক্ত ধরবে কোথায়?

উপায় ছিল না। কিন্তু পথে যদি দেরি হত একটু, তার ফল হত সাংঘাতিক।

ক্যাপ্টেন বাছাইয়ের ব্যাপারটার খুঁটিনাটি সব কথাই রয়েছে কাগজপত্রে। প্রার্থীর পর প্রার্থী বাতিল হয়ে যাচ্ছে। না-হলে আশ্চর্য হত সেটা। অভিযানটা হবে বিশেষরকম বিপদজনক। ক্যাপ্টেন যিনি হবেন, শুধু ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সরেস হলেই হবে না তাঁর, মাথা-ঠান্ডা লোক হতে হবে তাঁকে, তারও উপরে হতে হবে দুর্জয় সাহসী।

লোকের পর লোক বাতিল হয়ে যাচ্ছে, তারপরে হঠাৎই সবাই একবাক্যে সায় দিলেন— অ্যালেক্সি জেরুবিনকেই দেওয়া হোক এ-পদ।

তিনটে পাতা ওলটাবার পরে ইতিহাস পাওয়া গেল জেরুবিনের। সে ইতিহাস পড়বার পরে বুঝতে আর কষ্ট হল না যে, অন্য সবাইকে ডিঙিয়ে এই বিশেষ লোকটিই কেন মনঃপূত হলেন নির্বাচকদের। লোকটির ভিতরে সমানভাগে বিদ্যমান ছিল বরফ আর আগুন। প্রবীণ অধ্যাপকের চিন্তাশীলতা আর দুর্মদ যোদ্ধার নির্ভীকতা। আগের জীবনে বহু বহু দুঃসাহসিক ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছেন উনি। অলঙ্ঘ্য বাধাকেও লঙ্ঘন করবার আশ্চর্য ক্ষমতা লোকটির ছিল যেন সহজাত।

ক্যাপ্টেন পছন্দ করে দিলেন নির্বাচক সমিতি। তারপর যথারীতি অন্য বৈমানিক নিয়োগ করলেন জেরুবিন নিজেই। কিন্তু নিয়োগের পদ্ধতিই অদ্ভুত জেরুবিনের। দেশ-বিদেশের লোকের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করলেন না তিনি। পাঁচটি মাত্র লোকের কাছে চিঠি লিখলেন একসাথে। পাঁচটিই এর আগে কোনো-না-কোনো সময়ে সহকর্মী ছিলেন তাঁর। চিঠিতে তিনি শুধু জিজ্ঞাসা কলেন, ‘একটা বিপজ্জনক অভিযানে যেতে রাজি আছেন?’

প্রত্যেকেই বলে পাঠালেন, ‘আপনার নেতৃত্বে যদি হয়, এক্ষুনি রাজি।’ নথির ভিতরে ফোটো আছে সবগুলি লোকের। ক্যাপ্টেন জেরুবিনের বয়স তখন ছাব্বিশ, কিন্তু চেহারা সে তুলনায় ভারিক্কি। ভরাট মুখ, চোয়ালের হাড় উঁচু, ঠোঁটে ঠোঁট চাপা, ঈগল পাখির মতো নাক, ঢেউ খেলানো নরম চুল। চোখ দুটো বিশেষভাবে নজরে পড়ে। এদিকে শান্ত, কিন্তু কোণে কোণে বিজলির ঝলক যেন।

অন্য সবাই জেরুবিনের চেয়ে বয়সে ছোটো। দু-টি ইঞ্জিনিয়ার, স্বামী-স্ত্রী। ছেলেমানুষ বললেই হয়। ন্যাভিগেটরের মুখের চেহারা যেন ধ্যানস্থ ঋষির মতো। এক যুবতি ডাক্তার, চোখে-মুখে অশেষ গাম্ভীর্য। নাক্ষত্রিক পদার্থবিজ্ঞানী একজন, সারা মুখে পোড়া দাগ। শনি গ্রহের উপগ্রহ যে ডায়োন, সেখানে একবার বিমান ভেঙে পড়ে ক্যাপ্টেন-সহ তিনি মারাত্মকভাবে পুড়ে যান বছর দুই আগে।

ন্যাভিগেটরটি গায়ক ও গীতিকার। ডাক্তারনিটি জীববিদ্যায় গবেষণা করছেন, পদার্থবিজ্ঞানী নানা ভাষার অধ্যয়নে রত, গোটা পাঁচেক আয়ত্ত করছেন, এখন ব্যস্ত আছেন ল্যাটিন আর প্রাচীন গ্রিক নিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার দু-টি দাবা খেলেন ফাঁক পেলেই।

কিন্তু জেরুবিন? তাঁর শখ ছবি আঁকা। শুধু আঁকা নয়— ওই বিষয় নিয়ে গবেষণা করা। প্রাচীন মহাশিল্পীরা যেভাবে রং ফোটাতেন ছবিতে, এখন আর কেউ তা পারে না। তাঁদের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গেই উজ্জ্বল রং যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে। জেরুবিনের সাধনা— সেই প্রাচীন উজ্জ্বলতা আবার তিনি ফুটিয়ে তুলবেন ছবির রং-এ। এ নিয়ে তাঁর পরীক্ষানিরীক্ষার অন্ত নেই।

ছ-টি বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষকে নিয়ে বার্নার্ডের নক্ষত্রে যাত্রা করল পোলাস। পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর মসৃণভাবে কাজ শুরু করল, পারমাণবিক বিদ্যুৎস্ফুলিঙ্গ তা থেকে বেরুতে লাগল অবিরাম অদৃশ্য ধারায়। যত ছুটছে বিমান, গতি বেড়ে যাচ্ছে ততই। প্রথম প্রথম কাজ করা কঠিন ঠেকছে, এমনকী নড়াচড়াও। ডাক্তারনি কড়া নিয়ম বেঁধে দিলেন, প্রত্যেকের আহার, নিদ্রা ও ব্যায়ামের।

ধীরে ধীরে সবাই এসে থিতিয়ে গেলেন একটা ধরাবাঁধা ছকের ভিতরে। বাগান সাজানো হয়ে গেল, কাচের ঘর তৈরিই ছিল, গাছপালাও সঙ্গে এসেছিল। রেডিয়ো-টেলিস্কোপ বসানো হল, যন্ত্রের সাথে যন্ত্র গেঁথে। জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলা এসে গেল। রিঅ্যাক্টরের খবরদারি এবং সব কিছু কলকবজার তদারকিতে আর কতটুকু সময় যায়? নিয়ম করে প্রত্যেকে প্রতিদিন অন্তত চার ঘণ্টা সময় দিতে লাগলেন, নিজের নিজের বৃত্তিগত বিষয়ের চর্চায়।

তারপর যে যার শখ নিয়ে সময় কাটাও। ক্যাপ্টেন রং গুলছেন, ন্যাভিগেটর গান লিখছেন, ইঞ্জিনিয়ার-স্বামী কিস্তি দিচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার-পত্নীকে।

এমনি সময়ে দেখা দিল বিপদের পূর্বাভাস। জ্বালানি শুদ্ধ নয়।

পৃথিবী থেকে বেরুবার পরে সাত মাস কেটে গিয়েছে। হঠাৎ একদিন দেখা গেল যে জ্বালানির খরচ দারুণরকম বেড়ে গিয়েছে। লগ বইয়ে একটা ছোট্ট মন্তব্য, ‘কেন বেড়ে যাচ্ছে জ্বালানির খরচ, কিছুই বুঝতে পারছি না।’ সেই সে-যুগে, বিজ্ঞানীরা এ কথা জানতেন না যে, পারমাণবিক জ্বালানিতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সামান্যতম ভেজাল থাকলেও রিঅ্যাক্টরের কাজ দারুণরকম ব্যাহত হতে পারে।

জানলা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ছে আমার ওব সাগরে দিগন্তছোঁয়া তরঙ্গবিক্ষোভ। বাতাসে এসেছে উদ্দাম আবেগ, ঢেউয়ের পরে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে দূরন্ত আক্রোশে, কংক্রিটে বাঁধা তিরভূমিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য। বৃথাই দাপট তার। পারবে কেন অটলকে টলাতে?

জ্বালানির ভেজাল ধরা পড়ল যখন, ক্যাপ্টেন নিজের ঘরে দোর বন্ধ করে বসে গেলেন আঁক কষতে। অনেকক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে সহকর্মীদের ডেকে পাঠালেন পরামর্শ সভায়। ‘এই যে ভেজালটা ধরা পড়ল, তার ফল কী কী দাঁড়াবে, সবাই অবশ্যই বুঝতে পেরেছ। তবু আমি প্রাঞ্জল করে বর্ণনা করবে পরিস্থিতিটা। জ্বালানি যা আমরা নিয়ে বেরিয়েছিলাম, তা যাওয়া এবং আসা, দুই পিঠের খরচার পক্ষে পর্যাপ্ত ছিল। অর্থাৎ বার্নার্ডে পৌঁছোবার পরে আমাদের হাতে থাকার কথা ছিল শতকরা পঞ্চাশ ভাগ জ্বালানি। ঠিক তো?’

সবাই ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

‘কিন্তু বর্তমানে যে হারে জ্বালানি খরচা হচ্ছে, তাতে পৌঁছোবার পরে আমাদের সম্বল থাকবে মাত্র শতকরা আঠারো ভাগ জ্বালানি। তা দিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া শক্ত হবে।’

‘শক্ত কেন, অসম্ভব।’ বলল গীতিকার ন্যাভিগেটর, ‘এ অবস্থায় বার্নার্ড পর্যন্ত যাওয়ার মানে হচ্ছে, ফিরে না-যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা। অর্থাৎ বার্নার্ডে দেহরক্ষা করা।’

‘ঠিক,’ বললেন জেরুবিন, ‘এ ক্ষেত্রে আমাদের বিচার্য হল এই যে, বার্নার্ড পর্যন্ত যাওয়া আমাদের উচিত, না এখান থেকেই ফিরে যাওয়া উচিত। কী বলো তোমরা?’

জনে জনে জবাব দিল, ‘বিচার আপনি করুন। আপনি যা সংগত মনে করবেন, আমরা তাই করব।’

জেরুবিন বললেন, ‘বার্নার্ড তারকা আবিষ্কার করার জন্য আমরা বেরিয়েছি। ফিরবার পক্ষে অসুবিধা হবে— এই ভয়ে যদি আমরা অর্ধপথ থেকে ফিরে যাই, সেটা হবে কাপুরুষের কাজ। আমরা কাপুরুষ নই। আবিষ্কারের কাজটা তো আগে করি, তারপরে চিন্তা করব ফেরার কথা; তবে এ আশ্বাস আমি দিচ্ছি, শতকরা আঠারো ভাগ জ্বালানি সম্বল করেও পোলাস ঠিকই ফিরে যাবে পৃথিবীতে। শক্ত হলেও সম্ভব হবে তা।’

‘ফিরে যাবে?’ সবাই জিজ্ঞাসু নেত্রে, সংশয়ের দৃষ্টিতে একবার তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে। যতটা জ্বালানি দরকার, তার তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র সম্বল করে পোলাস ফিরে যাবে পৃথিবীতে?

তাদের সে দৃষ্টির অর্থ বুঝলেন জেরুবিন, উত্তরও দিলেন, ‘অসম্ভব লাগছে, নয়? কিন্তু জেরুবিন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে এর আগেও কয়েক বার। অসম্ভবের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াতেই তাঁর উল্লাস, তা তো তোমরা সবাই জানো।’

পোলাস যথাসময়ে বার্নার্ড তারকার একমাত্র গ্রহে গিয়ে অবতরণ করল, শতকরা আঠারো ভাগ জ্বালানি সম্বল নিয়ে।

গ্রহটার আকার প্রায় পৃথিবীর সমান। কিন্তু অন্য কোনো দিকেই পৃথিবীর সঙ্গে সামান্যতম সাদৃশ্যও তার নেই। এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত গভীর বরফে ঢাকা, কারণ বার্নার্ড সূর্য আকারে আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক বড়ো হলেও তার আলো প্রায় আমাদের চাঁদের মতোই ঠান্ডা। সে-গ্রহে আবিষ্কারের কিছু নেই। খনিজ পদার্থ থাকতেও পারে ওই বরফের স্তূপের নীচে, কিন্তু বরফ কেটে তা বার করবার জন্য এ অভিযান নয়।

অতএব ফেরো। জেরুবিন আদেশ দিলেন, ‘এইবার ফোরো।’

ফিরব? এই আঠারো ভাগ জ্বালানির উপর ভরসা করে? সে তো বেরুতে-না-বেরুতেই মৃত্যু!

কিন্তু না, মৃত্যু নয়। পোলাস ফিরবে পৃথিবীতে নিরাপদেই। ফেরার উপায় নিজের মাথা থেকে বার করেছেন জেরুবিন। বিমান থেকে সব কিছু বাড়তি বোঝা নামিয়ে দাও— গাছ সমেত বাগান, জ্বালানির খালি ট্যাঙ্ক, পার্টিশন, আসবাব, ইলেকট্রনিক পর্যন্ত। লোকও একজন কমবে, কারণ নতুন পারমাণবিক জ্বালানি এই গ্রহে বসে তৈরি করবার জন্য একজন কেউ থেকে যাবে এখানে। ওই ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সাহায্যে সে তা করবে, এইখানে বসে সেই শক্তি সে সঞ্চায়িত করতে থাকবে মহাশূন্যে ধাবমান পোলাসের ভিতর।

সহকর্মীরা প্রত্যেকেই আবেদন করেছিল, ‘এখানে থাকবার সম্মান আমায় পেতে দিন।’ জেরুবিন কর্ণপাত করেননি কারও কথায়। ক্যাপ্টেনের আদেশ অগত্যা মাথা পেতে নিয়েছিল সহকর্মীরা। বিমানের সব জিনিসপত্র, একমাত্র খাদ্য ছাড়া, জেরুবিনের সঙ্গে গ্রহে রেখে দিয়ে তারা পোলাসকে চালিয়ে দিল শূন্যপথে, শুষ্ক নয়নে, কিন্তু বিদীর্ণ বক্ষে।

যেটুকু পারমাণবিক তাপ তৈরি করছেন জেরুবিন এই গ্রহে বসে, সঙ্গেসঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ঈথারের তরঙ্গে তরঙ্গে, সেই জ্বালানির সাহায্যে। পোলাস ফিরে যাচ্ছে পৃথিবীর পথে। এদিকে নিজে তিনি তাপহীন অনন্ত তুষারের রাজ্যে পড়ে আছেন। পড়ে থাকতে হবে চৌদ্দো বছর, কারণ তাঁকে নিয়ে যাবার জন্য দ্বিতীয় বিমান এখানে চৌদ্দো বছরের কমে আসতে পারবে না।

গিয়েছিল বিমান চৌদ্দো বছর পরে। জেরুবিনের কাচের ঘরের বাগান তারা পেয়েছিল, কিন্তু পায়নি জেরুবিনকে। তারা ফিরে আসার পরে আবার গেল আর এক অভিযান। তারাও জেরুবিনকে পেল না, কিন্তু পেল তাঁর আঁকা একখানি ছবি। ছয় আলোকবর্ষ তফাতে নির্বাসিত পৃথিবীর সন্তান জেরুবিন পৃথিবীরই পল্লিদৃশ্যের একটি সুন্দর ছবি এঁকে গিয়েছেন, মৃত্যুর মুখোমুখি বসে।

আমি জেরুবিনের আঁকা সেই ছবি দেখলাম দপ্তরে। অবাক কাণ্ড! প্রাচীন ইতালীয় শিল্পগুরুদের মতোই রঙের আশ্চর্য বাহার সেই ছবিতে ফুটিয়েছেন জেরুবিন। ওদিক দিয়েও অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি।