॥ ৯৯ ॥
নীল আকাশের প্রতিবিম্বে নীলাভ জল, তাতে ছলাৎ ছল ঢেউ ভাঙছে। পচা পাট আর বাঁশের একটু কটু গন্ধ । পিছল পাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে। দণ্ডকলস আর কাঁটাঝোপে আকীর্ণ এই জায়গাটা আসলে আঘাটা। মানুষের মল শুকিয়ে আছে এখানে সেখানে। জলে ছোট্টো একটা ছৈ-তোলা নৌকো। একটু দূরে নোঙর করেছে। কাউকে দেখা যায় না। |
উচু পাড়ের ওপর হেমকান্ত দাঁড়ালেন। সতর্কভাবে চারদিক দেখে নিলেন। কেউ ধারেকাছে নেই। দ্রুত পায়ে তিনি নামতে লাগলেন। শেয়ালের গর্ত, উঁচু নিচু জমি, মাটির ঢেলা—চলা বড় শক্ত। তবু হেমকান্ত দ্রুতবেগ বজায় রাখলেন। ধুতি কাঁটাঝোপে লেগে ফড়ফড় করে ছিড়ে গেল। চামড়ায় চিড় ধরল কয়েক জায়গায়। জুতো কাদায় মাটিতে মাখামাখি। শেষ কয়েক পা ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গেলেন। উঠলেন, আবার পড়লেন। অবশেষে খানিকটা দমফোট অবস্থায় জলের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন। নিজের শারীরিক অবস্থার দিকে খেয়াল নেই। কিছু টেরও পাচ্ছেন না। আকুল, তৃষ্ণার্ত দুই চোখে চেয়ে রইলেন অদূরে বাঁশের লগিতে বাঁধা নৌকোর ছৈয়ের অন্ধকার মুখটির দিকে।
পরে ডায়েরীতে লিখেছিলেন “..শরীর বলিয়া যে একটা ছাইবস্তু আছে তাহা তো টেরই পাই নাই। কাঁটাঝোপ, খানাখন্দ, পিছল মাটির সেই নাবালকে যেন রাজপথ মনে হইতেছিল । কাঁটায় কাটিয়া ছিড়িয়া গিয়াছে অনেক, পতনে কালশিটাও পড়িয়াছে, তদপেক্ষা গুরুতর নদীতটের ওই অংশে বিষধর সর্পের অভাব নাই, তাহার একটা অনায়াসে দংশন করিতে পারিত। কিন্তু আমি জানি ব্যথা-বেদনা সর্প দংশন কিছুই তখন আমি টের পাইতাম না। শরীরী হইয়াও সেই মুহুর্তে আমি শরীরের অনেক ঊর্ধ্বে বিরাজ করিতে ছিলাম। এক বাধাবন্ধনহারা আকর্ষণ, এক নাড়িছেড়া টান আমাকে যেন আছাড়ি-পিছাড়ি করিয়া লইয়া যাইতেছিল।
“ঘটনার কথা পরে লিখিতেছি। তাহার আগে আমার এই শরীর-চেতনার কথা বলিয়া লই। নদীতটে সেই দিনের সেই অভিজ্ঞতা লইয়া যতই ভাবিতেছি ততই যেন এক ঘন কুয়াশায় ঢাকা রহস্যের যবনিকা থিরথির করিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে। যেন কী একটা সত্য ধরা পড়িবে পড়িবে করিতেছে। অনেক ভাবিয়া ভাবিয়া ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবল মনে হইতেছে, স্নেহের টান যদি শরীর ভুলাইতে পারে তবে বৃহত্তর স্নেহ, আরও প্রগাঢ় স্নেহ হয়তো বা শরীরের মোহ চিরদিনের মতো ঘুচাইতে সক্ষম।
“মানুষ মরিতে ভয় পায়। মৃত্যুকে জয় করাই তাহার জৈবিক চাহিদা। বাঁচিব, মরিব কেন, এই বার্তাই তাহার অন্তস্তল হইতে নিয়ত প্রবাহিত হইতেছে। আমিও জীব। কিন্তু প্রিয় পুত্রের দর্শনাভিলাষে সেদিন ওই দুর্গম পথে মৃত্যু ঘটিলে বা ঘটিবার উপক্রম করিলে তো বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করিতাম না! কেন? তাহার কারণ ওই স্নেহ। স্নেহ যে কী প্রগাঢ় বস্তু ইহা যে কত মূল্যবান এবং যুগে যুগে যে কেন স্নেহ, প্রেম, ভালবাসার এত জয়গান করা হইয়াছে তাহাও অল্পসল্প বুঝিতে পারিতেছি। প্রেম মৃত্যু উপশমকারী, ইহার মতো নিদান আর নাই।
“ঈশ্বরকে আমি তেমন ভালবাসিতে পারি নাই। যাঁহারা পারিয়াছেন তাঁহারা ভাগ্যবান। ভালবাসিবার পূর্বে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসটা পোক্ত হওয়া দরকার। তাঁহার সৃষ্ট জগতের সবকিছুরই অস্তিত্ব প্রকাশমান, কেবল তাঁহার অস্তিত্বই প্রমাণের অপেক্ষা রাখে—ইহা কি দৃষ্টিকর্তার এক প্রচণ্ড রসিকতা! সমস্যাও সেখানেই। যাহাকে দেখি নাই, যাহার অস্তিত্বের তেমন কোনো প্রকট প্রমাণ নাই, কেবল কতকগুলো শাস্ত্রগোলা কথা আছে, তাহাকে যুক্তির খাতিরে এবং পুরোহিতদের ভয়ে না হয় মানিয়া লওয়া গেল। কিন্তু ভালবাসা তো সেই পথে আসিবে না!
“সত্য বটে, সেই বিরাট বিপুল নিরাকারকে ভজিবার জন্য আবহমানকাল হইতে মানুষ নানা প্রতীক খাড়া করিয়া আসিয়াছে। আমাদের তো তেত্রিশ কোটি প্রতীক। কালী, দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, শিব, কৃষ্ণ অভাব নাই। কিন্তু এই প্রতিমা পূজার ব্যাপারটি মানিয়া লইলেও আমি কি জানি কেন ইহার মধ্যে একটি ছেলেমানুষী দেখিতে পাই। মাটি, সোনা বা রূপা যাহা দিয়াই গড়িয়া লও না কেন উহা তো মানুষেরই নির্মাণ। তাহাকে দেবতা ভাবিয়া হৃদয় উদ্বেল হইবে কি করিয়া?
“উপরন্তু আর একটি কথাও আছে। এই পুতুল পূজা করিয়া একটি আত্মসন্তুষ্টি পাওয়া যায় বটে, কিন্তু ইহাতে প্রবৃত্তির গায়ে হাত পড়ে না, ফলে বিগ্রহ পূজারীর মধ্যেও চৌর্যবৃত্তি, হীনমন্যতা এবং ঈর্ষা প্রবল। ধর্মের নানা দিক। কিন্তু লৌকিক পূজা পার্বণের ভিতর আমি কোনো অবলম্বন আজিও খুঁজিয়া পাই নাই।
“নলিনী বাঁচিয়া থাকিতে একদা আমাকে বলিয়াছিল, দাদা,পুরোহিতের কাছে ধর্ম ব্যাখ্যা শোনার চেয়ে নাস্তিক হওয়া ভাল। কুলগুরু বা পুরোহিত সে দুই চোখে দেখিতে পারিত না। সে প্রায়ই বলিত, তিনি রূপ ধরে আসেন, তাঁকে জন্মাতেই হয় বারবার, নইলে চলবে কী করে?
“নলিনী তাহার ঠাকুরের মধ্যে তাঁহাকে পাইয়াছিল। সে যে সঠিক পথেরই সন্ধান পাইয়াছিল তাহা তাহার চোখ মুখের দীপ্তিতেই প্রতিভাত হইত। অকালমৃত্যু তাহাকে সংসারের বন্ধন হইতে মুক্তি দিয়াছে, কিন্তু সেই ঘটনার ব্যাখ্যা কিরূপে করিব? কতবার ভাবিয়াছি, এই তো কাছেই পাবনা। যাই ঠাকুরকে একবার দেখিয়া আসি। কিন্তু গড়িমসি করিয়া যাওয়া হয় নাই। গিয়া পড়িলে হয়তো এই জন্মেই জন্মের রহস্য ভেদ করিতে পারিতাম। হয়তো সেই শাশ্বতকে পাইতাম, যাহা নলিনী পাইয়াছিল, যাহা কালক্রমে কৃষ্ণও পাইবে।
“হ্যাঁ, কৃষ্ণর কথা! তাহার কথাই তো বলিতে বসিয়াছি, আজ আমার কত আনন্দ। ডায়েরী লিখিবার পূর্বে বার বার অঙ্গ শিহরিত হইয়াছে। তাহার মুখখানি দেখিয়াছি। প্রাণ ভরিয়া দেখিয়াছি। কতদিন বাঁচিব কে জানে! হয়তো এই আয়ুতে আর বেড পাইব না! কর্মচক্রে সে। কতদূর ভাসিয়া যাইবে, আমিও বা গিয়া কাশীর কোন গলিতে খাবি খাইতে খাইতে মরিব!
“ছৈ সহ নৌকা নীল জলে দুলিতেছে, ভাসিতেছে। উপরে অখণ্ড আকাশ, জলে তাহারই শতধা ভঙ্গুর ছায়া। ঠিক এই জীবনের মতো। একটি শাশ্বত, একটি মায়া। তবে মায়ার ভিতরেও ওই শাশ্বতেরই খণ্ড খণ্ড ছায়া আছে। যে ছায়া লইয়া থাকে সে তাই থাক। যে আরো কিছু চায় সে উপরের দিকে চাহিবেই।
“আবার দর্শন। বড় জ্বালা হইল। বুড়া বয়সে কেবল কথা আসে, টিকা-টিপ্পনী আসে। রাজেনবাবু বলেন, মনুও বলে, আমি নাকি বুড়া নই। ভাল কথা। কিন্তু এই বকবগানি কিসের লক্ষণ তাহাও কি বলিয়া দিতে হইবে?
“যাহা বলিতে ছিলাম। নৌকা দুলিতেছে, ভাসিতেছে, আমার বক্ষদেশ আন্দোলিত হইতেছে। শ্বাস গাঢ় হইয়া আসিতেছে। চোখের পলক পড়িতেছে না। খবর সত্য তো! সে আসিয়াছে তো! তাহার কোনো বিপদ ঘটিবে না তো!
“আচমকা ছৈ-এর ভিতর হইতে একজন সুঠাম মাঝি বাহির হইয়া আসিল। লগিটা অবহেলায় তুলিয়া লইল। তাহার পর একটি ঝাঁকুনিতে নৌকাটিকে একেবারে তীরবর্তী করিয়া সংক্ষিপ্ত একটা হাঁক মারিল, আসুন কর্তা!
“কম্পিত পদে ও বক্ষে তাড়াতাড়ি গিয়া নৌকায় উঠিলাম। লোকটা নিম্নস্বরে কহিল, ভিতরে যান।
“ভিতরে ঢুকিলাম। একদম শেষ প্রান্তে একটি সবল চেহারার কিশোর বসিয়া আছে। বেশভূষা মলিন। কিন্তু অমলিন তাহার হাসিটি। আমি বজ্রাহতের মতো দাঁড়াইয়া পড়িলাম। মাত্র এই কয়েক মাসের মধ্যে কৃষ্ণর কি এত পরিবর্তন হইয়াছে? এ যে সেই বালক নহে। এ যে রীতিমতো যেবিনোদ্দত পুরুষ! মুখের সেই কমনীয়তা কোথায় গেল? ছৈ-এর ভিতরকার প্রদোষবৎ স্বল্প আলোকেও তাহার মুখের রেখাগুলির কাঠিন্য ও কর্কশভাব চোখে পড়ে।
“সে উঠিল। বলিল, বাবা, আপনি কেমন আছেন?
“আমি জবাব দিতে পারিলাম না। দীর্ঘকাল পরে সেই বিস্মৃত কণ্ঠে বাবা ডাক শুনিয়া আবেগে আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হইল, সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। আমি তার দিকে কম্পিত একখানি হাত বাড়াইয়া দিলাম।
“সে সবল দুই বাহুতে আমাকে ধরিল। ধীরে ধীরে পাটাতনে বসাইয়া দিল। তারপর কোমল কণ্ঠে বলিল, আপনার শরীর ভাল আছে তো বাবা?
“তাহাব কণ্ঠে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। নিজের পুত্র কন্যাদের নিকট আমি যথার্থ ভালবাসা পাই নাই, তাহাদেরও আমি যথাযথ ভালবাসি নাই। ব্যতিক্রম শুধু এই কৃষ্ণ। আমার পিতৃহৃদয় কেবল কেন যেন তাহাকে কেন্দ্র করিয়াই মথিত হয়। আর সেও বিশ্বসংসারে সকলের নিকট অপদার্থ বলিয়া চিহ্নিত তাহার এই বাপটিকে কেন যেন বুক ভরিয়া ভালবাসে।
“আমি কিছুক্ষণ নীরবে অশ্রুবিসর্জন করিলাম। আবেগ কিছু প্রশমিত হইল। সেও অশ্রুসিক্ত দুখানি চোখ বারংবার মার্জনা করিল।
“আমি প্রশ্ন করিলাম, তুমি কেমন আছ?
“ভাল আছি বাবা। আপনি অকারণ ভাববেন না।
কোথায় আছ, কী খাও, কী পরো কিছুই তো জানি না।
“সে হাসিয়া কহিল, তার তো কিছু ঠিক থাকে না বাবা। আমাদের দলটা পুলিশের সঙ্গে লড়াইতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কে মরেছে, কে ধরা পড়েছে তা জানি না। একা একা কিছুদিন পালিয়ে বেড়াই। তারপর একদিন হঠাৎ পাবনার ঠাকুরের আশ্রমে হাজির হয়ে যাই। কাকার ঠাকুর তো, তাই সেখানেই আশ্রয় নিলাম।
“একটা নিশ্চিন্তের দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিলাম, নিলে! যাক বাঁচা গেল।
“সে ভূ কুঞ্চিত করিয়া কহিল, নিলাম, কিন্তু সব কথা ঠাকুরকে বলিনি। কেমন সংকোচ আর ভয় হল।
“আমি মৃদুস্বরে কহিলাম, যাঁকে গুরু বলে মানবে তাঁর কাছে কোনো কথা গোপন করতে নেই।
“সে হাসিয়া কহিল, আমি তো অগ্নিমন্ত্রে আগেই দীক্ষা নিয়েছি। আমাদের কর্মধারার সঙ্গে ঠাকুরের কিছু অমিল আছে। উনি বোধহয় আমাদের কর্মধারার সমর্থক নন। আমাকে উনি হঠাৎ এক রাত্রে বাঁধের ধারের তালুতে ডেকে পাঠালেন। তারপর খুব স্নেহের সঙ্গে বললেন, ঢাকায় চলে যাও, সেখানে গিয়ে সারেণ্ডার করো।
উনি বললেন?
হ্যাঁ। শুনে আমি চমকে উঠলাম। আমি কে বা কোথা থেকে এসেছি তা তো ওঁকে বলিনি। একটা ছদ্ম নাম আর ঠিকানা দিয়েছি মাত্র। কিন্তু উনি দিনরাত মানুষ ঘাঁটেন, কাজেই অনুমানশক্তি তীব্র এবং তীক্ষ্ণ। অনুভূতি ভীষণ প্রখর।
তুমি কী বললে?
আমি কিছু বলিনি। মাথা নিচু করে ছিলাম। উনিই বললেন, এভাবে পালিয়ে বেড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং সারেণ্ডার করলে পথ পাবে। তখন আমি বললাম, আমার বিরুদ্ধে খুনের চার্জ আছে। ধরলে ফাঁসি দেবে। উনি তবু বললেন, যা বলছি তা করলে ভালই হবে। এখানে নয়, ঢাকায় চলে যাও। সেখানে সারেণ্ডার করো।
তুমি কি তাঁকে বিশ্বাস করতে পারছে না?
“কৃষ্ণ কিছুক্ষণ ভূকুঞ্চন করিয়া কী ভাবিয়া কহিল, তাঁকে আমার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। মানুষের প্রতি ওরকম অগাধ ভালবাসা আর কারো মধ্যে কখনো দেখিনি। অদ্ভুত মানুষ। কিন্তু সারেণ্ডার করার ব্যাপারে আমার দ্বিধা আছে।
তুমি বুদ্ধিমান, বিবেচক। আমি আর তোমাকে কী বলতে পারি? যা ভাল বুঝবে করবে।
না বাবা, আমি আপনার পরামর্শও চাই। সাত দিন আগে আমি ঢাকায় যাচ্ছি বলে আশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু ঢাকায় যেতে মন সরেনি। এখানে গত চারদিন ধরে এই নৌকোয় বাস করছি। ছোড়দির বিয়ের খবর পেয়েছি।
“আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলাম। কহিলাম, আরও একটা খবর তোমার জানা দরকার। তোমার কাছে সত্য গোপন করতে পারব না, তাতে তুমি আমাকে ঘৃণা করলেও না।
“সে মৃদু হাসিয়া কুণ্ঠিত স্বরে বলিল, আপনাকে বলতে হবে না। আমি জানি। মনুপিসি আমাদের নতুন মা হয়েছেন।
জানো তাহলে!
জানি বাবা।
আমাকে তোমার ঘৃণা হয় না?
আপনার জন্য আমার ভারি দুশ্চিন্তা ছিল। আমি বেরিয়ে এসেছি, ছোড়দির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, আপনি একা। দেখাশোনার কেউ নেই। মনুপিসি আপনার ভার নেওয়ায় আমার দুশ্চিন্তা গেছে।
সত্যি বলছো?
“কৃষ্ণকান্ত দুটি অকপট চোখে আমার দিকে চাহিয়া বলিল, বাবা, আমি তো নিজের মাকে দেখিনি। মনু পিসিকেই মা বলে জানি। মনুপিসির মতো আপনজন আমাদের আর কে আছে?
“বুক হইতে এক পাষাণভার নামিয়া গেল। মনে হইল, আমার অন্য পুত্রকন্যা জামাতা ও বধূমাতারা আমার যতই নিন্দামন্দ করুন আর যতই কলঙ্ক নিক্ষেপ করুন, আমার আর তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। বড় নিশ্চিন্ত, বড় সুখী বোধ করিলাম। তারপর প্রসঙ্গান্তরে গিয়া প্রশ্ন করিলাম, এখন তাহলে কী করবে?
সেটা জানতেই আপনার কাছে আসা। আপনি বলে দিন কী করব।
“আমি সামান্য হাসিলাম। সংসারী অদূরদর্শী মানুষ আমরা, আমাদের সাধ্য কি যে কাহাকেও সৎ পরামর্শ দেই? কিসে ভাল হইবে, কিসে মন্দ হইবে সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা করিবার মতো জ্ঞান ও বিচারবোধ কয়টি লোকের থাকে? কয়জনই বা অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করিয়া কাজ করিতে পারে? মাথা নাড়িয়া কহিলাম, যার আশ্রয়ে গেছ তার পরামর্শই মেনে চলো। তাতেই ভাল হবে।
আপনি বলছেন?
বলছি। তাঁর ওপর নলিনীর বড় বিশ্বাস ছিল। তিনি যা বলবেন তাই করো। অগ্র পশ্চাৎ তিনি যত দেখতে পান আমরা তা পাই না।
“এককথায় হঠাৎ কৃষ্ণর মুখ উদ্ভাসিত হইয়া গেল। কিছুক্ষণ স্মিত মুখে বসিয়া থাকিয়া সে হঠাৎ নত হইয়া আমার পদধূলি গ্রহণ করিয়া বলিল, আমার দ্বিধার ভাবটা কেটে গেছে।
“আমি মাথা নাড়িলাম বলিলাম, ফেরারী জীবনে বিপদ অনেক। তাছাড়া তুমি এখন বিচ্ছিন্ন, একা। এর চেয়ে সারেণ্ডার করাই ভাল।
“কৃষ্ণ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিল, আশ্রমে অনেক রাজনৈতিক নেতা আসেন। ঠাকুর রাজনীতি বিষয়ে ভালই খোঁজখবর রাখেন। তিনি যখন সারেণ্ডার করতে বলছেন তখন তার পিছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। গত কদিন ধরে সেই কারণটা অনেক ভেবেও ধরতে পারিনি।
“আমি কাঙালের মতো তাহার মুখখানি আমার দুই চক্ষু দিয়া পান করিতেছিলাম। কহিলাম, যখন একটা খুঁটি পেয়েছে তখন সেইটেই ধরে থাকো। জীবনের সব ক্ষেত্রেই একটি কেন্দ্রবিন্দু থাকা দরকার, একটা বিশ্বাসের স্থল। আমার তেমন কিছু ছিল না বলেই জীবন থেকে অনেকটা বিচ্যুত হয়েছি। নলিনী খানিকটা তাঁকে অবলম্বন করেছিল। কিন্তু যতদূর জানি, ঠাকুর তাকে পাকাপাকিভাবে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। নলিনী হবে হচ্ছে করে বিলম্ব করছিল। না করলে হয়তো তার অপঘাত হত না।
“কৃষ্ণ আমার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া ছিল। কহিল, আপনি যা বললেন তাতে আমার দ্বিধা আরো কেটে গেল। আমি আজই তাহলে ঢাকা রওনা হই?
আজই? বিশাখার বিয়েটা…?
“সে মাথা নাড়িল। বলিল, আমার কথা বাড়িতে উচ্চারণও করবেন না বাবা। শুভকাজে মানুষের মন ভারাক্রান্ত হবে। শুধু আপনি জানলেন, আর মনুপিসি যেন জানেন। আর কেউ না।
“নৌকা ইতিমধ্যে মাঝগাঙে আসিয়া পড়িয়াছে এবং মাঝি মহা উৎসাহে জাল ফেলিতেছে। পকেটে কিছু টাকা আনিয়াছিলাম। বাহির করিয়া কৃষ্ণর হাতে দিয়া কহিলাম, তোমার কাজে লাগবে।
“সে ঈষৎ শিহরিয়া বলিল, এত টাকা কোন কাজে লাগবে? অল্প কিছু দিন।
“আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া কহিলাম, বিষয় সম্পত্তি সব তোমারই থাকবে। ফিরে এসে নিও।