০৫. এখন আমি সাবধান হয়ে গিয়েছি

এখন আমি সাবধান হয়ে গিয়েছি, আর তাড়াতাড়ি না, আস্তে আস্তে এ গিয়ে দরজা খুললাম, আর খুলেই দেখলাম শ্ৰীমতি অনুসূয়া দেবী দাঁড়িয়ে। যাঁর একমাত্র দাবী হল তিনি আমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন। ভগবান জানে মাইরি, কিসের দাবী এবং কে সেই দিব্যি দিয়েছিল, আমি তাবা-তুলসী নিয়ে হলফ করে বলতে পারি, আমি এর কিছুই জানতাম না। দেখলেই বোঝা যায়, অনসূয়া দেবী ক্লান্ত, বড় বড় চোখে ব্যথার ছায়া, একটু বা বিরক্তি, তারপরে জানি না সেখানে কোন উদ্বেগে ছাপও আছে কি না। আপাতদৃষ্টিতে যে শান্ত মাতৃমূর্তি দেখা যাচ্ছে, জানি, তার মধ্যে অনেক অভিযোগ-অনুযোগ ইত্যাদি সব চাপা পড়ে রয়েছে, যেগুলো ব্যক্ত করার ইচ্ছে থাকলেও জানে, সময় বা সুযোগ নেই। বা সময় সুযোগ থাকলেও আর একজনের গ্রাহ্য করার মত অবস্থা নয়।

অনুসূয়া দেবী এগিয়ে এসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ডক্টর বাগচিকে ফোন করেছিলি? কী বললেন?

সত্যি বলতে কি, কথাটা শুনলাম, তাই এখন আমার মনে পড়ল যে, আজ ডক্টর বাগচিকে অনুসূয়া দেবীর স্বামী সম্পর্কে একটি খবর দেবার ছিল ও ওষুধ বদলানো হবে কি না এই সংবাদটাও নেবার ছিল, অথচ কথাটা আমার একবারের জন্যও মনে পড়নি এবং কোনদিনই মনে পড়ে না, এটা জেনেও বারে বারেই কেন যে এসব দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমি বুঝতে পারি না। যেন, তুমি ভুলেই যাও, আর যাই কর, তোমার মনে থাকুক বা না থাকুক, তোমাকে আমরা এ বিষয়ে সব সময়েই বলে যাব, কারণ এটা তোমার কর্তব্য, এবং কর্তব্য থেকে তোমার বিচ্যুতি যাতে না ঘটে, সেটাই আমাদের দেখা উচিত, অতএব—অতএব আমার যা মুখে এল তাই বললাম; হ্যাঁ, খবর দেবার তো কথা ছিল, কিন্তু অফিসে গিয়েই দেখি, ইমিডিয়েটলি বাইরে একটা কাজের জন্য যাবার অর্ডার রয়েছে, চেয়ারে পর্যন্ত বসতে পাইনি, এমন তাড়াহুড়ার ব্যাপার যে, তারপরে আর মনেই ছিল না।

অবিশ্যি এটা সত্যি কথাই যে, কথাটা এখন নিছক মিথ্যে বললেও এরকম আমাকে মাঝে মধ্যে যেতে হয়, কারণ আমার চাকরিটাই সেরকম, প্রায় সারা পশ্চিমবঙ্গব্যাপী যে কোন জেলাতেই চলে যেতে হতে পারে। অবিশ্যি বেশী দূরে গেলে হয়তো কিছু সময়ের নোটিস পাওয়া যায়, কিন্তু কলকাতার মধ্যে বা চব্বিশ পরগণা বা হুগলি, বিশ পঁচিশ মাইলের মধ্যে হলে, সঙ্গে সঙ্গেই চলে যেতে হতে পারে, তাই মিথ্যে বললেও সততার সঙ্গে তার একটা যোগাযোগ আছে যাতে আমার মায়ের পক্ষে তার প্রতিবাদ করা সম্ভব নয়। প্রতিবাদই বলতে হয়, কারণ আমি জানি, এ ধরনের বাজে কথা অকপটে আমি এত বলেছি, এবং সেগুলো সবই মিথ্যে তা মায়ের পক্ষে একেবারেই না বোঝার কোন কারণ নেই, যদিচ বুঝেও প্রতিবাদ করার উপায় নেই যেহেতু উভয় পক্ষই জানে, তাতে ব্যাপারটা খুব সুবিধে হবে না, অতএব মা মনে মনে ভাবেন, হারামজাদা, তবু তোকে ছাড়ব না তোকে দিয়ে আমি এসব কাজ করাবই, কারণ ছেলে হিসেবে তুমি বাধ্য, সংসারের সবকিছু দেখাশুনা করার, আর ছেলে ভাবে, তোমার স্বামী শাহেনসা ঘরে বসে বসে দশ রকম ব্যাধিতে ভুগবেন, আর আমাকে রোজ রোজ ডাক্তারের কাছে জ্যেষ্ঠ পুত্রের কর্তব্য করতে যেতে হবে, সে গুড়ে বালি। যদিচ আপাতত মা ও ছেলেকে দেখে, পরস্পরকে কিছুই বোঝা যাবে না, দুজনের মাঝখানে জন্মগ্রহণ বা জন্মদান করার সূত্র ধরে যে সব দাবীদাওয়াগুলো জন্মায়, সে সবের কোন কিছুই নেই, কারণ তার কোন যুক্তি নেই (আমার তাই বিশ্বাস।) এবং মাতা ও পুত্র এমনি কতগুলো চলতি নিয়মের নিষ্প্রাণ চলন্ত ছবির (তার মানে কি, বায়স্কোপের ছবি?) মতই আমরা চলেছি, অথচ সত্যি বলতে কি, তৎসত্ত্বেও যে ছাড়াছাড়ি হয় না, তার কারণ, উভয় পক্ষেরই কিছু লেনদেনের ব্যাপার আছে, আর সবটাই মিথ্যে ও শূন্য, এই আমার ধারণা, যদিচ এ ধারণা মিথ্যে হতে পারে, কি আসল কথা হল এই রে, মায়ের দিকে কোন সত্য-টত্য আছে কি না জানি না, কিন্তু আমার কাছে সবই মিথ্যে, আমি কিছুই অনুভব করি না।

এর পরেই আমি জানি, মা বাবার কথা বলবে, এবং আমার আচরণের ত্রুটিগুলোর কথা এমন একটা আহিংস বেদনামথিত স্বরে বলবে, যেটাকে এরকমের ছলনা বলেই আমার মনে হয়, কারণ ওভাবে বললে যদি ছেলের হৃদরের পরিবর্তন হয় (হৃদয় বহুকাল পাথর হয়ে গেছে মা, ওটিকে তার গলাতে হচ্ছে না।) যার অর্থ হল, নিজেদের প্রয়োজনে লাগানো যায়, উপকার দিলেই হৃদয়ের পরিবর্তন বলে গণ্য করা যাবে কি না! এবং মা বললও তাই, উনি আজ কদিন ধরে তো ঘর থেকেই প্রায় বেরুতে পারছেন না, সকালবেলা বেরিয়ে যাস, রাত্রে ফিরিস, ফিয়েও তো একটু যেতে পারিস। শত হলেও বাপ তো।

সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই, মা যখন বলছে যে, শত হলেও উনি আমার বাপ, এবং এটা কখনো বুঝাতে পারি না, উনি জন্মদাতা হয়েছে বলেই আমার কাছে এই সব দাবিদাওয়াগুলো কেন। এখন, নিচে বিদিশার সঙ্গে ওই লোকটার যদি কিছু হয়ে যায়, ভাল কথায়, দৈহিক মিলন বলতে হবে বোধ হয়, সান্ত্বনা হিসেবে খুবই অসুবিধাজনক যদিও, তাই, দু-তিন মিনিটের মধ্যেই প্রেমের এক হাত পরাকাষ্টা দেখে দিতে হবে, এবং তাতে যদি একজন দশ মাস দশ দিন পরে পৃথিবীতে এসে পড়ে, যার বিষয়ে কোন চিন্তা মূর্তি, ছবি, আচার আচরণ, কোন কিছুর চিহ্ন দূরে থাক, নিতান্ত সুখের উন্মাদনাতেই মশগুল, তারপরে ভবিষ্যতে তার কাছে জন্মদাতা বলে গোঁফ মোচড়ানো, দাবিদাওয়াগুলোর মানে কী। যে এল, আসার জন্যে তার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা, দায়দায়িত্ব কিছুই নেই, এবং যে মুহূর্তে এল, সেই মুহূর্তেই ওর গায়ে একটা চিমটি কেটে দেখ, ওরই লাগবে, ও-ই চেঁচাবে, তোমার গায়ে কোথাও লাগবে না। (লে হালুয়া!), এটা কী রকম একটা অবিচার বলে বোধ হচ্ছে না? তোমরা যা খুশি তাই কর তো, কিন্তু আমি কেন এলাম, এ কৈফিয়তটা আমাকে কেউ দেবে না, একটা কুকুরের বাচ্চাকেও কেউ দেয় না, সে চায়ও না, কেননা, তার কোন ইচ্ছা অনিচ্ছা ভাবনা চিন্তা নেই, কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারে না, অথচ আমার আবার সে সব আছে, অতএব এ চিন্তাটা আমার মাথায় ঠেলে উঠলেই, তখন অত্যন্ত অসহায়ভাবে নিজেকে একটা ইচ্ছেওয়ালা কুকুরের বাচ্চা বলে মনে হয়, একটা, কী বলব, দুঃসহই বলতে হবে, একটা দুঃসহ ঘৃণা উথলে উঠতে থাকে, উথলে উঠতে থাকে এই কারণেই যে, আমার ইচ্ছেগুলো আমার ইচ্ছে পূর্ণ হবার নয়, কতগুলো নিয়ম কানুনের মারফত আমাকে চলতে হয়, যে শিক্ষাকানুনগুলোর সঙ্গে আমার ইচ্ছার কোন মিল নেই অথচ যেহেতু আমার ইচ্ছাগুলোকে জলাঞ্জলি দিয়ে চলা একেবারেই সম্ভব নয়, সেই হেতু আমি একটি মিথ্যেবাদী হয়ে উঠেছি, এবং নিয়মকানুনগুলোকে কাঁচকলা দেখাচ্ছি, যেমন সবাই দেখাচ্ছে। আর ইচ্ছগুলো ভীরু কুকুরের বাচ্চার মতই ভেতরে ঘেঁউ ঘেঁউ করে মরছে, কারণ ইচ্ছে মানেই তো সে স্বাধীন, অথচ সেই স্বাধীনতাকে মেনে নিয়ে আচরণ করব সে সাহস নেই, স্বাধীনতাকে সকলের মত আমিও বেজার ভয় পাই। আমি আমার গর্তের মধ্যে বেশ রসেবশেই আছি। সকলেই গর্তের মধ্যে আছে, আমার বাবা তার নিজের গর্তের মধ্যে বেশ ভালই আছেন, মরবার ভর নিয়ে, আত্মসুখের জন্য চিরজীবন সংগ্রাম করে, যেখানে পাপপূণ্যের কোন প্রশ্ন থাকতে পারে না, অর্থাৎ সেই চলতি নিয়মকানুন বা নিয়ন্ত্রণই বলা যায়—সবগুলোকে কাঁচকলা দেখিয়ে, অথচ গায়ে আঁচড়টি লাগেনি (শাহেনসা লোক!) উপযুক্ত লোকদের লাগেও না, যে কারণে আমাকে শুধু চাকরির অন্ধিসন্ধি অলিগলিই নিজে দেখিয়ে দেননি, চলাফেরাটাও একটু চোখ কান মেলে যাতে হয় চুপিচুপি গলায় সেটা সাবধান করতেও ভোলেননি, অর্থাৎ চাকরির মধ্যে ঘুষ বদমাইসি ফেরেববাজীর নানান রাস্তায় আমি যেন একটা পাকা ধূর্ত শেয়ালের মত চলতে পারি, গোঁফের ডগায়ও যেন একটু রক্ত লেগে না থাকে। বাপ তো শত হলেও, ছেলের এটুকু উপকার না করলে চলবে কেন, কেবল ভদ্রলোকের গর্তের মধ্যে ওই একটা দোষ নিয়মকানুনের দোহাই দিয়ে বাপের দাবিদাওয়াগুলো পেশ না করে পারেন না। কারণ তিনি আমার কাছে কৃতজ্ঞতা দাবী করেন, কারণ সেই একই যে, তার দাবি তিনি আমাকে পৃথিবীতে এনেছেন, যে-পৃথিবীতে আমি বাস করছি, (ওহো, কী অপূর্ব জায়গা, আমার গোটা জীবনটাই আজ এই সময় পর্যন্তই তার প্রমাণ) এবং যদি এখন জিজ্ঞেস করি, বেশ করেছেন, কিন্তু কেন? তা হলেই রাগের চোটে কথা বন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা চীৎকার করেই উঠবেন, ইউ ডেভিল, ইউ ডেয়ার টু আস্ক… আথবা এর থেকেও খারাপ কিছু, বেরিয়ে যা শুয়ারের বাচ্চা আমার সামনে থেকে এবং তা গেলেই আমার যাওয়া হয় না, আমি যে এসে পড়েছি। আর এই সব দাবিদাওয়ার পেছনে যে নৈতিক যুক্তিগুলো আছে সেগুলো তিনি আমাকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছেন, অর্থাৎ ছোটবেলার বাঁচিয়ে রেখেছেন, ওর নিজের ইচ্ছামত জামাকাপড় পরা, খাবার, শিক্ষা সবকিছু দিয়ে, সেটাও নিজে ইচ্ছা এবং বাসনা চরিতার্থ করার জন্যেই, যতদিন আমার ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলো জেগে ওঠেনি। হ্যাঁ, বলা যায়, মেরে ফেলেননি কেন হয়তো ফেলতেন, কিন্তু বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছেন, তাই রেখেছেন, তখন যদি জানতেন, আমি ঠিক আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার দাস হব না তাহলে কে জানে, আপনার খুন করবার সাহস হয়তো হত, কিন্তু আর সকলের মত আপনি ইচ্ছা চরিতার্থ করতেই বেশী মনোযোগী হয়েছিলেন, কারণ এই ব্যাপারে পশুরাও আপনার মতই করে থাকে, কারণ, সত্যি বলতে কি, রোজকার যত রকম প্রাকৃতিক ব্যাপারে মতই, ওটা নিজের তাগিদেই করেছেন। যেমন কার্যকারণ জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও, রাস্তার কুকুর তার বাচ্চাগুলোকে চাটে, আর মুখে নিয়ে আশ্রয়ে ঢোকায়, কারণ ওটা প্রবৃত্তি, খিদে পেলে খাবার মতই। যদি না পারতেন, তাহলে এ দেশের হাজার হাজার বাচ্চার মত আমিও কুকুরের বাচ্চার মত রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াতাম, অকালেই পটল তুলতাম, অনাথ আশ্রমে জায়গা হত, কিংবা অভাবের তাড়নায় বা আপনার বদমেজাজের একটি থাপ্পড়েই মানবলীলা সংবরণ করতে হত। মোট কথা, ওই দাবিদাওয়াগুলোর কোন ভিত্তি নেই, এখন আমি যখন নিজের অনিচ্ছার এই পৃথিবীতে উপস্থিত, তখন আমার ইচ্ছাই আমাকে চালাবে, যদিচ যেই ইচ্ছার স্বাধীনতাকে প্রকাশ করতে ভয় পাই বলে। আমি একটা গর্তে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছি এবং বেশ মিথ্যে কথা বলে সকলের সঙ্গেই দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছি, কারণ আমরা তো জানি, আর কেউ সত্যি কথা বলি না, সত্যি আচরণ করি না, তাই প্রত্যেকেই একটি করে গর্ত বেছে নিয়েছি, আর পরাধীনতার সুখে বেশ আছি।

তবু সত্যি বলতে কি, গর্তের সুখ, পরাধীনতা যাকে বলে, তাকে মাঝে মাঝে স্বাধীনতা এমন তেড়ে আসে যে, গর্তের সুখটুকু যায়-যায় হায়-হায় করে ওঠে, যেমন কি না একজন পকেটমারকে ধরে সবাই মিলে যখন রক্তাক্ত করে, আর আমি তার প্রতিবাদ করি, কারণ এতে পকেটমার-অপরাধের সুরাহা হবে না, এটা আইনও নয়, অক্ষম ক্রোধের, কী বলল, জিঘাংসা মাত্র, তা হলে আমাকেও রক্তাক্ত করে ছেড়ে দেবে। কারণ আমি স্বাধীন ভাবে সত্যি বলে ফেলেছি। আইনের হাতে ছেড়ে দিতে বলেছি। কিন্তু এই স্বাধীনতার বদলে, আমিও যদি সকলে যা করে, সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লোকটাকে ঠ্যাঙাতাম, কিংবা চুপ করে দেখতাম আর বেশ গর্তের, নির্ঝঞ্ঝাট গর্তের ভিতর থেকে উপভোগ করতাম, সেটাকেই আমি পরাধীনতা বলতে চাইছি। অর্থাৎ, যা অন্যায় অবিচার ভুল আর মিথ্যা, যা আমাদের জীবনের চার পাশে শিকড় গেড়ে বসে আছে, যে কোন দিকে চোখ তুলে তাকালেই তা দেখা যায়, এমন মেলে নিয়ে থাকাটাই গর্তের সুখে থাকা। পরাধীনতা যাকে বলে, আর এর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আমাকে ঠেলে দিতে চাঃ, মাকে আমি বনতে চাই, তেড়ে আসে। এবং এই তেড়ে আসাটা নিজেই অনেক সময় জানতে পারি না, যে কারণে বলতে হয়, নিজেকেই বোধ হয় ঠিক চিনি না, জানি না, কেননা, যেমন ধরা যাক, আমার পরাধীনতা এবং গর্তের সুখের মধ্যে, প্রায়–কী বলব—প্রায় মধ্যমণির মতই তো নীতা ছিল, যাকে বলে, গর্তের সুখের মধ্যমণি, স্বাধীনতাই তাকে হঠাৎ মেরে ফেলল। দিব্যি দুজনে মিথ্যে বলে, মিথ্যে নিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম, যেটাকে বোধ হয় আপোষ বা, কী জানি, একেই অ্যাডজাস্টমেণ্ট বলে কি না, এই সব করে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম, তুমিও যা, আও তাই, এই রকম চিন্তা করেই, বেশ মানিয়ে গুছিয়ে চালিয়ে যচ্ছিলাম, কিন্তু আপোষহীন স্বাধীনতা, যাকে বলে একেবারে অচমকা কনুয়ে ভর করে বসল, নীতার গলায় চেপে বসল, যার মানে, আমি আমার গর্তের বাইরে চলে এসেছিলাম। কেননা, ও নীতা, ওর সঙ্গে এত ছলনা, মিথ্যা, উভয় পক্ষেই, ঠিক সহ্য করা যাচ্ছিল না, যে কারণে পরাধীনতার আপস সইল না। জীবনে আর কখনো এরকম গর্তের বাইরে আসিনি, যে কারণে এখন তাড়াতাড়ি ভেতরে আবার লুকোবার তালে আছি, ঢোক্‌ ঢোক্‌, (শালা) পালা পালা জলদি, এইভাবে বলছি আর খুনের সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন করার কথা ভাবতে হচ্ছে। জানি না একবার বাইরে বেরিয়ে পড়লে আর ভিতরে যাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সত্যি, স্বাধীনতা একদিক থেকে অতি কুৎসিত, যদিও নীতা মরার পর, সেই যে কী বলে, একটা প্রশান্তি না কি, একটা অগাধ শান্তি বোধ করছি।

কিন্তু যাই হোক, আমি এখন গর্তে, এবং গর্তের ভেতর থেকেই, আপাতত অনুসূয়া দেবীকে, গর্তের ভাষাতেই ভাষাতেই বললাম, আজ রাত্রে আর দেখা করব না, কাল অফিসে বেরোবার আগে একবার যাব।

যাব না জানি, কারণ আমি যখন যাব মনে করব, তার আগেই জীপের হর্ন শোনা যাবে, তখন আমাকে ছুটেই বেরিয়ে যেতে হবে, আর এখন একটা মুখের ভাব করলাম যেন, মদ-টদ খেয়ে এসেছি, এ অবস্থার আর পিতৃদেবের কাছে আমাকে যেতে বলো না। দেখলাম অনসূয়া দেবীর কাছে সেটা কাজে লাগল, আসলে যাওয়াটাই তো বড় কথা নয়, এবার ইচ্ছে আছে, সেটাই বড় কথা, অর্থাৎ হাতে আছি এই জাতীয় একটা সান্ত্বনা এবং সেই সঙ্গেই এখন না যেতে চাওয়ার সুমতিও একটা মস্তবড় কথা। শালুক চিনেছে……। মা সরে গেল, আমি সোজা বাথরুমের দিকে গেলাম, এবং বাথরুমে ঢুকেই উৎকট দুর্গন্ধে আমার গা-ঘুলনো শরীর আরো ঘুলিয়ে উঠল, যার কারণটাও আমার জানা যে জগদীন্দ্রনাথ (পিতৃদেব) বাথরুমে এসেছিলেন, এ দুর্গন্ধের বৈশিষ্ট্যটা তারই, আথচ জল ঢেলে দিয়ে যাননি, পারতেন কি না জানি না, পারলে তিনি দেবেন না, তিনি কর্তা, কেন তোমরা ঢেলে দিতে পার না যেন এমনি একটা ভাব, অথচ অপারগ হলেও কাউকে বলতে দোষ কী, বা না এলেই বা ক্ষতি কী, ভাবতে ভাবতেই, এ পুরলো ঘটায়, আমি ঝেঁজে চীৎকার করে উলাম, বাথরুমে কে এসেছিল, কে?

এত জোরে চীৎকার করলাম যে, বিদিশা সবে নিচে থেকে ওপরে আসছিল, ও ছুটে এল, আর চাকরটা কোথায় ছিল জানি না, সে আরো আগে ছুটে এল, এবং বলল, বাবা এসেছিলেন।

রাগে এবং ঘৃণায় একই মুহূর্তে একটা অসুস্থতা বোধে, আমি আগের মতই উৎকার করে উঠলাম, এসেছিলেন তো জল ঢেলে দিতে কী হয়েছিল, দুর্গন্ধে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবার যোগাড়। বেডপ্যান আছে কী করতে?

ইতিমধ্যে চাকরটা বালতি বালতি জল ঢালতে আরম্ভ করেছে এবং বিদিশা (শেষ চুমোর আবেশটা বোধ হয় মাটিই হয়ে গেল, মনে মনে নিশ্চয় ছোটনোক ইতর ইত্যাদি বলে গালাগালিও দিচ্ছে আমাকে।) আমার দিকে একবার তাকিয়ে যেন চুপ করতে বলতে চাইল আমাকে এবং যেন আর ব্যবহারে খুবই অবাক হয়েছে, বিরক্তি হয়েছে, এরকম একটা ভাব করে মুখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল। গোটা বাড়িটা যেন ভূতের বাড়ির মত একেবারে নিশ্চুপ কী বলব, যেন দম বন্ধ করে রয়েছে মনে হল, কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। চাকরটা বেরিয়ে যেতেই দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম এবং পিতৃদেবের মুখখানি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, বিছানায় শোয়া গম্ভীর থমথমে মুখ, (আসলে এখন খুনীর চেয়েও ভীষণ হয়ে উঠেছেন মনে মনে, বোধ হয় এই মুহূর্তেই কেউ আমার কাটামুণ্ডুটা নিয়ে যেতে পারলে তাকে পুরস্কার দিয়ে দিতে পারেন, আলাউদ্দীনের কাছে খিজিরের কাটামুণ্ডু!) মনে মনে যা বলছেন বুতেই পারছি। চোখ দিরে যদি রাগের চোটে জলও বেরিয়ে পড়ে, তা হলে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, আর মায়ের অবস্থাও প্রার তথৈবচ, যদিও বাবার মত ঠিক অতটা ভয়ংকর না, তা হলে উপায় থাকলে সামনে এসে আমাকে একটু ধাক ধামক করতে পারলে ভাল হত। চারটার ওপর দিয়েই মায়ের রাগ যাবে এবং একটু অনুশোচনাও বটে, যদি জানা থাকত, স্বামী গিয়েছিলেন বাথরুমে তা হলে নিজেই একটা ব্যবস্থা করতে পারতেন। কিন্তু আমার বারোটা বেজে গিয়েছে, কারণ আমি দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম এই জন্যে যে, চীৎকার করার পক্ষেই ইলেকটি কের তারে ঘা মারলে যে রকমা বলেন, একটানা শব্দ হয় খানিকক্ষণ ধরে, সেই রকম শব্দ হচ্ছিল আমার শরীরের ডান দিকটা জুড়ে, যদিও শব্দটা বাইরে ভেসে আসছিল না ঠিকই, কিন্তু ভেতরে যেন অবিকল সেরকমই ঝন্‌ ঝন্‌ করে বাজছিল, যাতে আমি যন্ত্রণা বোধ না করলেও একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম, কারণ টা মাথা ভাবধি গিয়ে পৌঁছুচ্ছিল বেন। এটা আবার কী রকম ব্যাপার বুনতে পারলাম না, এরকম আর কখনো হয়নি, যেন আমি হঠাৎ পড়ে যেতে পারি, তাই দরজাটা ধরেই আমি দাঁড়িয়েছিলাম, এবং মুখে আবার সেরকম জল কাটতে আরম্ভ করেছিল, যার অর্থ বমি নিশ্চিত। অথচ, এমন কি মদ খেয়েছি, মাতাল তো একেবারেই হইনি, এর থেকে অনেক বেশি খেয়ে থাকি, যদিও এর থেকে কম খেয়েও এক-একদিন শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যা, দি গেট ভাল না থাকে এবং এখনো দেই, শোঝ। হিরে ছিল নীতার বাথরুমে এখন একটা সারতে গিয়ে তার একটা বেগ দাঁতে দাঁত পিষে চাপতে হয়েছিল।

প্রায় দু মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবার পর, বেসিনটার কাছে না গিয়ে আস্তে আস্তে নিচের নর্দমার মুখের কাছে গিয়ে বসে, মাথাটা নিচু করতেই টক জলের সঙ্গে মেশানো জাদুর মত তরল পদার্থ বেরিয়ে এল, অনেকটা তাড়ির মত বমিটার স্বাদ। তাড়ির স্বাদ আমি অনেকবার জেনেছি, একবার তো বীরভূমের এক জায়গায় অফিস থেকে একটা ইনভেস্টিটগেশনে (আমার চাকরির মধ্যেও আবার তদন্ত-টদন্তর বলার আছে, অনেকটা পুলিসের মতই বলতে গেলে, যদিও পুলিস নয়, তবে মানুষের শারি ব্যবস্থা তাতেও আছে এবং তা শেষ পর্যন্ত পুলিসের হাত দিয়েই হয়ে থাকে, বা অন্যভাবেও হতে পারে।) গিয়ে, তিন দিন ধরে শুধু তাড়িই খেতে হয়েছিল, অবিশ্যি যথাপূর্বং তদন্তের শেষ পর্যন্ত একটা ঘুষের রক্ষা করে যখন ফিরে আসি, তখন কয়েক বোতল মদ এসে জুটেছিল। যাই হোক, এখন বমির সঙ্গে নীতার মাংসও বেরিয়ে এল, অনেকটা হাল্কা আর সুস্থ বোধ করতে লাগলাম, যদিও কানের পাশগুলো জ্বালা করছে। জল দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়ালাম, কেননা নীতার বাথরুমের সেই বেগটা আমাকে এখানে ছেড়ে যায়নি, একটা অস্বতি হচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত পারজামাটা আমাকে খুলতেই হল। প্যান-এর ওপরে বসতে না বসতেই জলতেষ্টা বোধ করতে গেলাম, কিন্তু জল পাওয়া এখন সম্ভব নয়, আর কি এতটা গোলমাল ইদানিং কালের মধ্যে অনেকদিন হয়নি। সত্যি বলতে কি, আজ নীতার সঙ্গে দেখা হওয়ার ঠিক আগে থেকেই শরীরের মধ্যে একটা অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল, যেটা নীতার ওখান থেকে বেরুবার পর বেড়ে উঠেছে। মনে হয়, নীতাকে তাকে যদি মরতে না হত, এবং দুজনে বেশ একটা আবেশে (রমণের আবেশ থাকে বলা যায়।) গায়ে গা দিয়ে হোটেলে গিয়ে, আর একটু টেনে, নেচে, খেয়ে ফিরতে পারলে এসব কিছুই হয়তো হত না। অনেক সময়ই এরকম দেখেছি, পেটে হয়তো গোলমাল বা শরীরটা হয়তো ম্যাজম্যাজ করছে, বেশ একটা ভয়-ভয়ই লাগছে, বাড়ি ফিরে গিয়ে হয়তো বিছানা নিতে হবে, কিন্তু তখনই, হঠাৎ কোন মেয়ের সঙ্গে র‍্যালা আরম্ভ করে দিলাম, বা গাড়ি নিয়ে দূরের পথে কোথাও ছুটতে হল, কিংবা ঢকঢক করে মদ খেতে আরম্ভ করলাম, অমনি অসুস্থতা সব কোথায় হারিয়ে গেল, যেন ভূত পালিয়ে গেল ওঝার ধাক্কার। এ সব কথা ডাক্তারেরা, শুনলে হয়তো মাতালের বা বদমাইসের কথা বলে উড়িয়ে দেবে, কিন্তু (উঃ পেটটা খামচাচ্ছে যেন।) এরকম অবস্থা আমার অনেকবার হয়েছে এবং আজও সম্ভবত আমি বেশ বহাল তবিয়তে এসে বিছানায় এলিয়ে পড়তে পারতাম, ঘুমিয়ে পড়তে পারতাম, সকালবেলা দেখা জোত, বেশ ভালই আছি, যদি নীতা না মরত।

Leave a Reply to samadru53 Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *