হেমলকের নিমন্ত্রণ – ৫৭

৫৭

‘সবচেয়ে প্রিয়তম মানুষ রাগ করলে,
সেই রাগ হয় ভয়ংকরতম।’

— ইউরিপিডিস

***

জেলখানার ছোট্ট ঘরে মাত্র রাত নেমেছে।

এক কোণে জ্বলছে জলপাই তেলের প্রদীপ। নিভু নিভু আলো। সেই ডুবন্ত আলোয় একজোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাদের জীবনের শেষ হিসাব-নিকাশ করছেন। দুজনেই জানেন এই রাতই তাদের একসাথে কাটানো শেষ রাত। তারা নিঃশব্দে নিভু নিভু প্রদীপের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাইরে ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে।

তারা জানেন, দিন কেটে আবার রাত হবে। সেই রাতেও এমন করেই ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকবে। শুধু দুজনে পাশাপাশি বসে আর সেই ডাক শুনবেন না। বৃদ্ধ আগামীকাল পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন।

আগামীকালই সক্রেটিসকে হেমলক খেতে হবে। পবিত্র জাহাজ আজ এথেন্সে ফিরে এসেছে। আজ রাত সক্রেটিসের জীবনের শেষ রাত। শেষ রাতটি জেনথিপি সক্রেটিসের সাথে কাটাচ্ছেন। জেলখানায় আছেন জেনথিপি। ক্রিতো সব ব্যবস্থা করেছেন। জেনথিপি কোলের ছেলেটিকে নিয়ে এসেছেন। ছেলেটি মেঝেতে একটি মাদুরের উপর ঘুমাচ্ছে।

সক্রেটিস আর জেনথিপি নিঃশব্দে বসে আছেন। দুজনের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

সক্রেটিস বললেন, বউ, সারা জীবন তুমি চিৎকার করে কথা বলেছ। তুমি চুপ থাকলে আমার অসহ্য লাগে। কথা বলো। চুপ থেকো না।

জেনথিপি কিছুই বললেন না। তিনি কাঁদতে লাগলেন।

এই মেয়েটি সারা জীবন কেঁদেছে আর সেই কান্নায় সক্রেটিস শুধু বিরক্তই হয়েছেন। কিন্তু আজ বিরক্ত হচ্ছেন না। এই কান্নাকে তার খুবই আপন লাগছে, ভীষণ মধুর লাগছে। মনে হচ্ছে শুধু এই কান্নাটা দেখার জন্যই বেঁচে থাকা যায়। জীবনের প্রতি ভীষণ মায়া হতে লাগল সক্রেটিসের। তিনি জেনথিপির মাথায় হাত রাখলেন।

ধীরে ধীরে বললেন, জানো জেনথিপি, আমি কিন্তু মরব না। আমি বেঁচে থাকব।

‘অ্যা, জাহাজ আসেনি? কাল হেমলক খেতে হবে না?’

‘সেটি না, কালই হেমলক খেতে হবে। কিন্তু আমি বেঁচে থাকব। বেঁচে থাকব লেখার মধ্যে।

‘কার লেখায়?’

‘প্লেটোর লেখায়। প্লেটো আমাকে নিয়ে লিখবে। আমি তার চোখে আগুন দেখতে পেলাম। লেখার আগুন। আর একজন আছে। তার নাম জেনোফোন। সে নাকি লেখা শুরু করে দিয়েছে। জেনোফোন লিখছে এই খবর শুনেই প্লেটো জ্বলে উঠেছে। মনে হয় প্লেটোও লেখা শুরু করে দিয়েছে। ওর লেখার হাত এত মিষ্টি, একবার শুরু করলে শেষ না করে আর ওঠা যায় না। সেজন্য আমি বেঁচে থাকব। প্লেটোর কলমের মধ্যে বেঁচে থাকব।’

জেনথিপি বললেন, তাতে আমার কী লাভ? আমি কি কাল রাতে আপনাকে ছুঁতে পারব?

‘ছুঁতে পারবে না। তবে তোমারও কিঞ্চিত লাভ আছে। তুমিও সেই লেখায় থাকবে। আমাকে নিয়ে লিখলে, তুমি তো সেই লেখায় থাকবেই। জেনথিপিকে বাদ দিয়ে সক্রেটিসকে নিয়ে লেখা যাবে না।’

‘আমাকে নিয়ে কী লিখবে? লিখবে সক্রেটিসের একজন দজ্জাল বউ ছিল যে সারাজীবন শুধু সক্রেটিসকে জ্বালিয়েছে। হাড় ভাজাভাজা করে ফেলেছে। এটি ছাড়া আর কিছু লিখতে পারবে?

হেসে উঠলেন সক্রেটিস। বললেন, তোমার চিৎকার আর চেঁচামেচি আমার জন্য ভালো হয়েছে। অতি উত্তম হয়েছে। বাড়িতে থাকলে তুমি রাগ করো, সেজন্য আমি বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকতাম না। বনে-বাদাড়ে বসে চিন্তা করতাম। এতে নতুন নতুন জিনিস মাথায় আসত। তুমি রাগ করে আমার উপকারই করেছো। তার মানে জ্ঞানের জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী। না ভুল বললাম, তোমার রাগের কাছে ঋণী।

এতক্ষণে হাসলেন জেনথিপি। বললেন, কই, আমার কবিতা কই? এপোলোকে নিয়ে লেখার কথা ছিল। নতুন কী লিখেছেন?

গভীর রাতে প্রদীপের আলোতে দুজনে কবিতা নিয়ে বসেছেন। সক্রেটিস পড়ছেন আর জেনথিপি শুনছেন।

জেনথিপি খাবার বের করলেন। আজ তিনি সক্রেটিসের প্রিয় সবকিছু এনেছেন। ক্রিতোও খাওয়ার রেখে গেছেন। সক্রেটিস তেমন কিচ্ছু খাচ্ছেন না। জেনথিপি একটি দুটো আঙুর সক্রেটিসের মুখে তুলে দিচ্ছেন। কবিতা চলছে।

কিছুক্ষণ পরে দুজন মিলে প্রার্থনা করলেন। মৃত্যুর আগে দেব-দেবীকে একটু খুশি করা দরকার। এথেন্সের দেবী এথিনা আর এপোলোর কাছে প্রার্থনা করলেন। জেনথিপি আজ রাত জাগবেন। সক্রেটিস ঘুমালেও তিনি জেগে থাকবেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম রাত তারা জেগে কাটাতে পারেননি। আজ শেষ রাত জেগে থাকবেন।

জেনথিপির মনে পড়ে বিয়ের সেই রাতে জেনথিপির খুব ঘুম পেয়েছিল। সেই রাতে কোনো কথাই হয়নি। দ্বিতীয় রাতে সক্রেটিস ঘরে ঢুকেই বললেন, আসো, আমরা শপথ করি সত্য ও ন্যায় মিশিয়ে আমরা একসাথে জীবন কাটাব। জেনথিপি বলেছিল, শুধু সত্য আর ন্যায় দিয়েই হবে? ভালোবাসা লাগবে না? সক্রেটিস বললেন, আমাদের ভালোবাসাও শুধু সত্য আর ন্যায়ের জন্য। শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল জেনথিপির। এ কেমন মানুষ! একবার হাত ধরল না, মিষ্টি করে কিছু বলল না। জ্ঞানের আলাপ শুরু করল! সত্য আর ন্যায়! সত্য আর ন্যায় দিয়ে কী জীবন চলে? এগুলো কি খাওয়া যাবে, না রান্না করা যাবে? সেই রাতেই জ্ঞানের কথা অসহ্য লেগেছিল। রাগ করে তখুনি ঘুমিয়ে পড়েছিল জেনথিপি। সেই যে শুরু হলো, জীবনে আর রাগ কমেনি জেনথিপির।

আজকের শেষ রাতটা জাগবেন জেনথিপি।

সক্রেটিস বললেন, কাল তোমার অনেক কাজ। আমার দেহ পোড়াতে হবে। পোড়ানো শেষে হাড়-গোর কবর দিতে হবে। বিস্তর হাঙ্গামার ব্যাপার। একটু ঘুমাবে?

‘ঘুম? যেদিন আপনার নামে মামলা করল, সেদিন থেকেই আমার রাতের ঘুম শেষ। একবারে কাল থেকে ঘুমাব।’

‘তাহলে ছেলেমেয়েদের কথা বলো। সংসার চলবে কী করে?’

‘এতদিন যেমন চলছে, সেভাবেই চলবে। এসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। ঘর, সংসার, টাকা-পয়সা নিয়ে জীবনভর আপনার সাথে ঝগড়া করেছি। কোনোদিন আপনার কথা শুনতে চাইনি। আজ আমি আপনার কথা শুনব। সারা রাত শুনব।’

‘আমার কথা? আমার তো কোনো কথা নেই। আমি সারা জীবন যে কথা বলছি, সেগুলো সবই মানুষের জন্য কথা। নিজের কোনো কথা বলিনি।’

‘আজ আপনার নিজের জীবনের কথা বলেন। যা কাউকে বলেননি, সেটি বলেন।’

‘আমার জীবন? সক্রেটিসের জীবন? এটি আমার কাছেও নতুন বিষয়। এই বিষয়ে আমি কাউকে কোনোদিন কিছু বলিনি।’

‘আজ আমাকে বলেন।’

সক্রেটিস একটু থামলেন। বললেন, আমার সত্তর বছরের জীবন। সংক্ষেপে বললেও রাত শেষ হয়ে যাবে।

‘বিয়ের রাতে আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। আজ এই শেষ রাতটা জেগে কাটুক।’

সক্রেটিস বললেন, তাহলে মনে করো আমরা এই জেলের ঘরে নেই। মনে করো আমরা এজিয়ান সাগরের পারে সাদা বালিতে পা ছড়িয়ে শুয়ে আসি। আকাশে টলটলে পূর্ণিমা। সাগরের ঢেউ আমাদের দুজনের পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে। আমরা দুজনে তাকিয়ে আছি সাগরে দিকে। সাগর হেসে হেসে কথা বলছে চাঁদের সাথে।

জেনথিপি এতটা ভাবতে পারছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তিনি সক্রেটিসের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।

সক্রেটিস শুরু করলেন তার জীবন কথা :

আমি জন্মেছিলাম গ্রীষ্মকালে। ভরা পূর্ণিমার রাতে। আকাশভরা জ্যোৎস্না। মা খুব খুশি। তার বুকে জ্যোৎস্নার আনন্দ। মা বললেন, আমার ঘরে জ্যোৎস্না আসছে। কিন্তু আর কেউ খুশি হলো না। আমাকে দেখে আর সবাই বলে, ছেলের চেহারা তো দেখি ভয়াবহ, একেবারে বদখৎ। এই রকম বদখৎ ছেলে আমাদের বংশে আগে হয়নি। আরেকজন বলে পুরা এথেন্সেই এমন কদাকার ছেলে নেই। আমি বড় হতে থাকলাম একা একা। বাবা দরিদ্র মানুষ, সারাদিন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। গভীর রাতে বাড়ি ফেরেন। আমার মা একজন ধাত্রী। এথেন্সে আর কোনো মহিলা এই কাজ করে না। সেজন্য প্রতিদিনই মায়ের কাজ থাকত। আমাদের বাড়িতে কোনো দাস-দাসী নেই। আমি বাড়িতে সারাদিন একা একা থাকি।

স্কুল শুরু করলাম। স্কুলেও আমার সাথে কেউ মিশে না। আমি নাকি কুৎসিত। স্কুলেও আমি হয়ে গেলাম একেবারে একা। একা একা কোনায় বসে থাকি। সারাদিন একা একা ভাবি। ভাবতাম, স্কুলের ছেলেরা অন্যদের সাথে এত ভালো ব্যবহার করে, কিন্তু আমার সাথে মেশে না। আমি তো কোনো দোষ করিনি। তাহলে দোষটা কার? কী করলে এই সমস্যা দূর হবে? সারাদিন এই চিন্তা করি। এমন দিন গেছে, যে আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটানা বসে ছিলাম।

সেই অল্প বয়সেই বুঝে গেলাম, মানুষকে যা শেখানো হয়, মানুষ তাই করে। এই ছেলেগুলো শিখেছে, কুৎসিত মানুষকে অবজ্ঞা করা যায়। তাই ওরা আমার সাথে এমন ব্যবহার করছে। ওদের যদি শেখানো যায় যে, কুৎসিত হওয়া দোষের কিছু নয়, তাহলে ওরা এমন করবে না।

আমি বুঝলাম মানুষ স্কুলে গিয়ে যেমন হিসাব-নিকাশ শেখে, তেমনই জীবনকে সুন্দর করার জন্যও শিক্ষা দরকার। কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে সেটিও শেখা দরকার। সুন্দর জীবন একটি সাধনার ব্যাপার। এটি এমনি এমনি হয় না।

এটি বোঝার পর আমি শুরু করলাম, কীভাবে সুন্দর জীবন যাপন করা যায়, সেটি বের করার উপায়। শুরু হলো আমার গবেষণা। গবেষণার বিষয় মানুষ আর মানুষের জীবন। আমি কদাকার বলে মানুষ আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমি তাদের নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। তখন এথেন্সে নানা ধরনের জ্ঞান ছিল। একদল মানুষ গবেষণা করত রাজনীতি নিয়ে। কীভাবে সুন্দর করে নগর চালানো যায়। আরেক দল প্রকৃতি নিয়ে ভাবত। চন্দ্র-সূর্য, জোয়ার-ভাটা এসব নিয়ে। মানুষের জীবন নিয়ে ভাবনা তেমন হয়নি। আমি ঠিক করলাম, আমি মানুষ নিয়ে কাজ শুরু করব। জীবন সুন্দর করার উপায় বের করব। সেই যে শুরু করলাম, আজ এই সত্তর বছর সেই একই কাজ করে চলছি।

ছোট্টবেলায় হঠাৎ একদিন মনে হলো আমি খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারি। কথার পিঠে আচ্ছা রকম প্যাঁচ দিতে পারি। প্যাচের ওপর প্যাঁচ দিয়ে কথা বলতে আমার মতো আর কেউ পারে না। একা একা চিন্তা করতে করতে আমার মাথায় অনেক ভাবনা তৈরি হয়েছিল। অনেক যুক্তি জমা হয়েছিল মনের মধ্যে। আমি তখন প্রতিটি কথায়ই যুক্তি দিতে পারি। তো আমি দেখলাম যুক্তি আর কথার প্যাঁচ— এই দুটি মারাত্মক অস্ত্র আমার আছে। এই অস্ত্র নিয়ে আমি ছেলেদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। তবু ছেলেরা আমারে পাত্তা দেয় না, আমার কথা শোনে না। তখন খেয়াল করলাম, খালি যুক্তিতে মানুষ মজা পায় না। যুক্তির সাথে দরকার একটু রসিকতা। একটু হাসি-ঠাট্টা থাকলে, সেই কথা সবাই শোনে। আমি রসিকতার অভ্যাস শুরু করলাম। কিছু দিনেই দেখলাম আমি স্কুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছেলে। সবাই আমার কথা শুনতে ঘুরঘুর করে। আমি যুক্তিবাদী, আমি কথার পিঠে কথা বলতে পারি, আমি রসিক। সারা এথেন্সের ছেলেরা আমার ভক্ত। আমাকে সবাই ভালোবাসে।

আমার স্কুলের সমস্যা দূর হলো। আমি আর একা নয়। আমার পিছে স্কুলের সব ছেলে। তখন মোজমাস্তি করে দিন কাটালে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি সেটি করলাম না। মানুষ নিয়ে আমার গবেষণা বন্ধ করলাম না। সুন্দর জীবনের উপায় বের করতে আমি চিন্তা করেই চললাম। সেই চিন্তার মধ্যে একটি অদ্ভুত ব্যাপার শুরু হলো। কোনো কিছু নিয়ে গভীর চিন্তা শুরু করলে, আমি হঠাৎ হঠাৎ ধ্যানে চলে যেতাম। আমার বাইরের চেতনা থাকত না। অবচেতনে কিছু একটি শুনতে শুরু করলাম। কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে চাইলেই আমি অবচেতনে চলে যেতে পারতাম। তখন বিষয়টি বুঝিনি আমি মনে করতাম, আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নে কে যেন আমাকে সংকেত দিচ্ছে। পরে বুঝেছি, ঐটা আমার অবচেতন মনের সংকেত। এভাবে আমি দিনে দিনে হয়ে উঠলাম একজন ক্ষুদে চিন্তাবিদ।

চিন্তাবাজির সেই সময় এথেন্সে এলেন দার্শনিক জেনো। এই দার্শনিক খুব দুষ্টু। তিনি মানুষের সাথে প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলেন। একটা কিছু নিয়ে প্রশ্ন শুরু করেন। কেউ উত্তর দেয়। সেই উত্তর থেকে দ্বিতীয় প্রশ্ন। এভাবে চলতে থাকে। চলতে চলতে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। এই প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা আমি বন্ধুদের সাথে শুরু করলাম। তারা এটি খুব পছন্দ করল। নতুন মজা।

এই প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা আর চিন্তার অভ্যাস একই সাথে আমার পরম উপকার আর ভীষণ ক্ষতি, দুটোই করল। চিন্তা করে আমি নতুন নতুন ভাবনা পাই, আর সেগুলো ছেলেদের কাছে বলি। প্রশ্নের পর প্রশ্ন বলে তাদের সমস্যা দূর করে দিই। তাদের কাছে আমি হয়ে গেলাম বিশাল জ্ঞানী— একজন জ্ঞানবীর আর তাদের বাবাদের কাছে আমি ইঁচড়েপাকা শয়তান। তবে এর থেকে বড় আরেকটা ক্ষতি হলো, আমি চিন্তা আর প্রশ্ন খেলায় এমন ব্যস্ত যে, ঘরের কাজে আর আমার মন নেই। সংসারে মন নেই। একটি বৈরাগী বৈরাগী ভাব। খালি উড়ু উড়ু মন। সারাদিন খালি পায়ে ঘুরি আর মানুষ দেখি, মানুষের সাথে কথা বলি।

আমার ছোট্ট মনে একটি ভয় ঢুকে গিয়েছিল। একলা হওয়ার ভয়। আমি সারা জীবনে আর কোনোদিন একলা হইনি। মানুষ ছাড়া আমি থাকতে পারি না।

সেই সময় আমার সঙ্গী হলো চেরোফোন আর ক্রিতো। এই দুই বন্ধু আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ বানিয়ে দিল। ডেলফিতে গেল। ডেলফির ওরাকলও বলল, আমার চেয়ে জ্ঞানী মানুষ আর কেউ নেই। আমিও মানুষের পরীক্ষা নিতে শুরু করলাম। কে কত জ্ঞানী সেই পরীক্ষা। দেখলাম আসলেই মানুষ তেমন কিছুই জানে না। এভাবে জ্ঞানের তালাশ করতেই আমার জীবন কাটল।

ভেবেছিলাম কোনোদিন বিবাহ করব না। সারা জীবন জ্ঞানের সন্ধান করব। তা আর পারলাম কই? বাবা মারা যাওয়ার পর বুড়ো বয়সে বিবাহ করলাম। ক্রিতো ব্যবস্থা করল। বিয়ে করলাম তোমাকে। বিয়ে তো করলাম, কিন্তু সংসারী কি হতে পারলাম? হলাম গৃহী-সন্ন্যাসী।

এই হলো আমার বিয়ের আগের জীবন। আর বিয়ের পরের জীবন তো তুমি জানই। সেটি আর বলার কিছুই নেই।

জেনথিপি তন্ময় হয়ে শুনছিলেন।

তিনি বললেন, তার মধ্যেও যা জানি না, সেটি বলেন।

সক্রেটিস বললেন, যেটি জানো না, সেরকম কিছু বলতে হবে? সেরকম একটি ঘটনা আছে। বিরাট ঘটনা।

‘বলেন।’

‘ঘটনা হলো, আমার কিন্তু একটি দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা হয়েছিল।’

সক্রেটিস বলছেন আর জেনথিপির দিকে তাকাচ্ছেন। ভাবছেন এই বুঝি জেনথিপি রেগে গেল! কিন্তু আশ্চর্য, জেনথিপি রাগছেন না।

জেনথিপি মিষ্টি করে বললেন, সেই মেয়ের নাম মিরতো

সক্রেটিস অবাক। জেনথিপি জানেন? সক্রেটিসের মুখে কথা আটকে গেছে।

জেনথিপি বললেন, আমি জানি, কিছু লোক বুড়ো বয়সে আপনার বিবাহ ঠিক করেছিল। আপনি তাদের সাথে মেয়েকে দেখতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আর বিবাহ করেননি

সক্রেটিস বললেন, বিবাহ না করার অজানা কারণ তুমি জানো না?

জেনথিপি বললেন, আপনার মুখে শুনতে চাই।

সক্রেটিস ভাবছেন, জেনথিপিকে তো তিনি কিছুই বোঝেননি। এরকম কথা জেনেও জেনথিপি ঝগড়া করেননি, একবার তাকে বলেনওনি, এটি তো তার চরিত্রের সাথে মিলে না।

সক্রেটিস বললেন, তাহলে ঘটনা শোনো, তুমি জানো এথেন্সে একবার আইন হলো, বেশি বেশি সন্তান নিতে হবে। মানুষ বাড়াতে হবে। কিন্তু সন্তান হবে কী করে, মেয়েদের বিয়ে হয় না। মেয়ের সংখ্যা অনেক বেশি। যুদ্ধে, প্লেগে ছেলেরা মারা গেছে। মেয়েরা রয়ে গেছে। তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিল, ছেলেদের বেশি বেশি বিয়ে করতে হবে। সেই সময় আমার বয়স প্রায় তেষট্টি। তোমার দ্বিতীয় ছেলে হলো। সরকারি লোকজন এসে বলল, বুড়ো তুমি তো এখনও জোয়ান আছ, তুমি একটি বিয়ে করে ফেল। উচ্চঘরের মেয়ে। মেয়ের বাবা এথেন্সের গণতন্ত্রের নেতা ছিলেন। আমি দেখলাম, এই লোকগুলো নাছোড়বান্দা। তাই মেয়েটিকে দেখতে গেলাম। গিয়ে তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বললাম। সরকারি লোকেদের বললাম, মাফ করো। আমি একটি বিয়েই সামলাতে পারি না। আর একটি করলে জানে-প্রাণে মারা যাব। আমি বিয়ে করলাম না। কিন্তু লোকে ছড়িয়ে দিল যে, সক্রেটিস দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।

জেনথিপি জানেন যে সক্রেটিস দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। নিজেই সরে এসেছিলেন। তবু সক্রেটিসের মুখ থেকে শুনে ভালো লাগল। তার মনে অনেক দিনের একটি চিনচিনে ব্যথা ছিল। সেটি চলে গেল। মরণের আগের রাতে স্বামী না বুঝেই অনেক গভীর একটি ব্যথা কমিয়ে দিয়ে গেল।

জেনথিপি ভাবছেন, শুধু শুধু অভিমান করে কষ্টটা মনে পুষে রেখেছিলাম। আগে জিজ্ঞেস করলে, আগেই মিটে যেত। তিনি ভেবে দেখছেন, তিনি আসলে সারা জীবন সবকিছুতেই সক্রেটিসের সাথে অভিমান করে গেছেন। তাই দাম্পত্যের অনেক কিছুই উপভোগ করতে পারেননি। আজ শেষ রাতে তার অনেক কিছু মনে পড়তে লাগল। স্বামীর সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছেন। অকারণে রাগ করেছেন। গালি দিয়েছেন। এক-একটি ঘটনা মনে পড়ছে, আর কান্না পাচ্ছে। জেনথিপি কাঁদছেন। সারা জীবনের রাগের জন্য কাঁদছেন।

সক্রেটিস অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছেন না। সারা জীবনের অপরাধ এক রাতের কান্নায় ভাসিয়ে দিতে চাইছেন জেনথিপি। কিন্তু সেটির কোনো দরকার নেই। তার ওপর সক্রেটিসের কোনো রাগ নেই। বরং সক্রেটিস ভাবছেন— সারা জীবন এই মেয়েটিকেই শুধু কষ্ট দিয়েছেন। দুনিয়ার সব মানুষের জন্য সুন্দর জীবন খুঁজেছেন। শুধু জেনথিপিকে দিয়েছেন একটি অসুন্দর জীবন। সক্রেটিসেরও কান্না পাচ্ছে।

দুজন দুজনের দুঃখে কাঁদছেন। রাত বয়ে চলছে। একটি ঝিরঝির বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। খুব কাছেই একটি কুকুর ডাকছে। মনে হচ্ছে কুকুরটিও কাঁদছে। কুকুরের মতো প্রাণীদেরও কি বিরহ আছে? সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে একলা ফেলে চলে যাওয়ার বেদনা আছে?

অনেকক্ষণ চুপচাপ কাটল। জেনথিপি বারবার বাইরে তাকাচ্ছেন। তার ভয়— কখন যেন আকাশ ফরসা হয়ে যায়! রাতটি শেষ হয়ে যায়।

হঠাৎ সক্রেটিস বললেন, তুমি কখনো হেমলক গাছ দেখেছো?

জেনথিপি হেমলক গাছ দেখেননি।

সক্রেটিস বললেন, এই জেলখানার দারোয়ানের খুব আগ্রহ সে আমাকে হেমলক গাছ দেখাবে। আজ রাতেই আনার কথা। তুমি আছ বলে ঢোকার সাহস পায়নি। দাঁড়াও ডাক দিই।

জেনথিপি বললেন, এত রাতে ঘুমিয়ে লোকটা ঘুম আছে নিশ্চয়ই।

সক্রেটিস বললেন, ও রাতের দারোয়ান। ওর কাজই রাতে জেগে থাকা। আমি প্রতি রাতে ওর সাথে কথা বলি।

কিছুক্ষণ পরেই দারোয়ান এলো। তার হাতে একটি হেমলক গাছের ডাল। সে হাতে দস্তানা পরেছে। এই গাছ মারাত্মক বিষ। গাছের কোনো অংশে হাত লাগালেও বিপদ।

দ্বাররক্ষী বলল, আমি এই গাছ নিয়ে আসছি সেই সন্ধ্যায়। আপনাকে একা পাইনি।

সক্রেটিস আর জেনথিপি দেখছেন হেমলকের গাছের ডাল।

দ্বাররক্ষী খুব উৎসাহ নিয়ে দেখাচ্ছে। সে এই গাছের একজন বিশেষজ্ঞ।

সে বলল, এই যে দেখেন, চিকন ডাঁটার মতো একটি কাণ্ড। কাণ্ডের দুপাশে সমান পাতা। পাতাগুলো উজ্জ্বল সবুজ। গাজরের পাতার মতো। শুধু কাণ্ডের নিচের দিকে একটু বেগুনি ছিটছিট আছে। একটু লালচে ফোঁটা ফোঁটা দাগও আছে।

সক্রেটিস বললেন, বিষ হয় কোনখানে?

দ্বাররক্ষী বলল, সারা গাছই বিষ। যেখানে যত রস হয়, সব বিষ। পাতায় বিষ, ডাঁটে বিষ, ফুলেও বিষ। হেমলক ফুল হয় সাদা সাদা। ফুলগুলো কুট্টি কুট্টি ছাতির মতো। ফুলে রস হয়। তবে সেই রসের বিষ তত ভালো নয়। সবচেয়ে ভালো বিষ হয় ফলের রসে। হেমলক ফল ছোট্ট ছোট্ট বাদামি রঙের। গ্রীষ্মের শেষে ফল ধরে।

সক্রেটিস বললেন, পুরো গাছটি দেখতে কেমন?

দ্বাররক্ষী বলল, গাছটি বেশি লম্বা হয় না। বেশি হলে মানুষের সমান উঁচু হতে পারে। আপনি তো বেশি লম্বা নন। হেমলক গাছ আপনার চেয়ে অল্প একটু লম্বা হতে পারে।

সক্রেটিস হাসতে হাসতে বললেন, এটি একটি কথার মতো কথা বলেছ। হেমলক গাছ লম্বায় সক্রেটিসের চেয়ে বড়। সক্রেটিসের উচ্চতা হেমলকের চেয়ে কম।

সক্রেটিসের ইঙ্গিত দ্বাররক্ষী বুঝতে পারল না। সে মহাউৎসাহে হেমলকের বিবরণ দিচ্ছে। এই গাছ কোথায় হয়, কীভাবে চাষ করা লাগে, সবকিছুর বিবরণ দিচ্ছে। তার বিবরণে মনে হচ্ছে, আগামীকাল সকালে উঠেই সক্রেটিস হেমলক গাছ চাষ করবেন।

সক্রেটিস মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। হেমলকের সাথে তার নাম যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। হেমলক গাছটি সম্পর্কে জানা দরকার।

জেনথিপি বললেন, এই গাছে যে বিষ হয়, তা বোঝার কোনো উপায় নেই। অন্যান্য সাধারণ গাছের মতোই। বাগানে দেখলে তো চিনতাম না যে, এটি বিষ গাছ।

দ্বাররক্ষী বলল, হ, একেবারে মানুষের মতোই। কোনটা অমৃত-মানুষ আর কোনটা বিষ-মানুষ সেটি বোঝা যায় না।

সক্রেটিস তার ব্যাখ্যায় খুব খুশি হলেন। কথাটা দার্শনিকের মতো।

দ্বাররক্ষী চলে গেলেও সক্রেটিস অনেকক্ষণ ধরে হেমলক নিয়ে কথা বলছেন। এলোমেলো কথা। জেনথিপি তাকালেন সক্রেটিসের দিকে। সক্রেটিস হেমলকে মগ্ন হয়ে আছেন। এই গাছের রসে কাল তার মৃত্যু হবে।

সক্রেটিস মজা করে বারবার বলছেন, হেমলক গাছ লম্বায় সক্রেটিসের চেয়ে বড়। এই গাছে সাদা ফুল হয়। সবচেয়ে ভালো বিষ হয় হেমলক ফল থেকে।

জেনথিপির মনে হচ্ছে সক্রেটিসের ঘুম দরকার। তিনি জোর করে সক্রেটিসকে ঘুম পাড়াতে চাইছেন। তার মনে পড়ছে বিয়ের রাতে তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাদের প্রথম রাতে জেগেছিলেন সক্রেটিস। আজ শেষ রাত। সক্রেটিস ঘুমাক। জেগে থাকবেন জেনথিপি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *