1 of 2

হেমলকের নিমন্ত্রণ – ২০

২০

‘রক্তপাত ছাড়া যে জয়, সে জয়ই সবচেয়ে গৌরবের।’

—পিটাকাস

***

সভ্য উপায়ে মানে মারামারি কাটাকাটি না করে, বীর হওয়ার আয়োজন অলিম্পিক। হাজার বছর ধরে গ্রিকরা মনে করে— যুদ্ধে যে সেরা, সেই হলো বীর। যুদ্ধের মাঠে অন্যকে হত্যা করে নিজে বেঁচে ফিরতে পারলেই সে বীর। হোমারের বীর একিলিস তাদের অনুপ্রেরণা। বীর হবে রক্ত পিপাসু, বীর হবে খুনি।

এক সময় কিছু গ্রিক মানুষ ভাবল বীরত্ব শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যাপার নয়। মানুষ ইচ্ছে করলে, মানুষ না মেরেও বীর হওয়া যায়। এই ভাবনা থেকে রক্তপাত ছাড়া বীরত্ব প্রকাশের জন্য তারা একটি খেলার আবিষ্কার করল। সেই খেলার নাম অলিম্পিক।

খেলার ময়দান এথেন্স থেকে তিনশ মাইল দূরে অলিম্পিয়া নামক একটি জায়গায়। সারা গ্রিসের পুরুষরা দৌড়, বর্শা ছোড়া, রথ চালানোর মতো খেলায় অংশ নেয়। এখানে যে জেতে সেই হলো নতুন বীর। অলিম্পিয়ায় হয় বলে এর নাম অলিম্পিক।

সারা পৃথিবীর মানুষ এখানে আসে। ঘোড়া, রথ, গাধা যার যা আছে সব নিয়ে লাইন ধরে আসে। অলিম্পিয়ার পাশে দুটি নদী একসাথে মিলেছে। নদীপথেও অনেক মানুষ আসে।

অলিম্পিয়া জায়গাটি খুবই সুন্দর। চারিদিকে শুকনো খরখরা পাহাড়ের মাঝে হঠাৎ এক টুকরো শান্ত-সবুজ মাটি। যেন নেই-নেইর মাঝে হঠাৎ করেই অনেক কিছু আছে। পাশেই সুন্দর ঝরনা। এঁকেবেঁকে নিচে নেমে গেছে। শান্ত নদী চলছে কুল কুল শব্দে। লোকে বলে একদিন দেবতাদের রাজা জিউস অলিম্পাস পাহাড়ে বসে খুঁজছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটি। সারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত জিউস হঠাৎ অলিম্পিয়া[৬০] নামক নগরের একটি জায়গা দেখে বললেন, হ্যাঁ, এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্থান। তিনি তার অস্ত্র বজ্র ছুড়ে মারলেন। এখানে তৈরি হলো জিউসের মন্দির। এই মন্দিরকে কেন্দ্র করেই হয় অলিম্পিক খেলা।

গ্রিকরা তাদের সব কাজে দেবতাদের নিয়ে আসে। দেবতাদের নাম নিলে মানুষকে যা খুশি বোঝানো যায়, যেভাবে খুশি চালানো যায়। তাই অলিম্পিক খেলায়ও দেবতা এসেছে। ধুমধাম করে খেলার সাথে ধর্মকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ বিশ্বাস করে দেবতাদের মাধ্যমেই অলিম্পিক শুরু হয়েছে।

গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী অলিম্পিক শুরুর কথা মোটামুটি এরকম—

জিউসের ছেলে মহাবীর হারকিউলিসকে বারোটি শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে পঞ্চম শাস্তিটি ছিল এলিস নগরের রাজার ঘোড়ার আস্তাবল পরিষ্কার করা। এই রাজার ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘোড়া। সেই ঘোড়ার আস্তাবল এমন নোংরা হয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে সেটি পরিষ্কার করা সম্ভব ছিল না। হারকিউলিস ভালোমানুষি করে শাস্তি মেনে নিয়েছিল। সে ঘোড়ার আস্তাবল পরিষ্কার করতে এলো। কিন্তু এত বড় বীর হারকিউলিস— সে কিনা ঘোড়ার বিষ্ঠা পরিষ্কার করবে? রাজা তাকে লোভ দেখাল— এটি পরিষ্কার করতে পারলে, তোমাকে আমার ঘোড়াগুলো থেকে দশ ভাগের এক ভাগ ঘোড়া দিয়ে দেব। লোভে পড়ল হারকিউলিস। ঘোড়ার লোভে জান-প্রাণ দিয়ে কাজ শুরু করল। পুরো আস্তাবল ঝকঝকে, তকতকে করে তুলল। রাজাকে বলল, রাজা, তোমার লম্বা নাক দিয়ে ওঁকে দ্যাখো, কোথাও ঘোড়ার মূত্রের কোনো গন্ধ নেই।

কিন্তু কেউ কথা রাখে না। রাজাও রাখল না। রাজা ঘোড়া দিল না। এমন বেইমানি সহ্য হলো না হারকিউলিসের। রাগে সে লণ্ডভণ্ড করে ফেলল এলিস নগরী। সব ভেঙে চুরমার। ভাংচুর শেষ হলে তার মনে হলো— এমন ধ্বংসের কাজ কি আমার মতো বীরকে মানায়? মাথা গরম করে কী করলাম? হারকিউলিসের স্বভাব ছিল এরকম— সে হঠাৎ মাথা গরম করে উল্টা-পাল্টা কাজ করে ফেলত। তারপর অনুতাপ করে ভালো ভালো কাজ করত। এবারও তার খুব অনুতাপ হলো। ভালো কিছু করতে হবে। সে ঘোষণা করল— এই এলিস নগরের অলিম্পিয়াকে তিনি বিখ্যাত করে যাবেন।

হারকিউলিস একটি খোলা জায়গায় ছয়শ পা হাঁটল। হেঁটে বলল, এখানে শুরু হবে দৌড় প্রতিযোগিতা। এই দৌড়ের নাম হবে স্টেডিওন। আর যেখানে এই স্টেডিওন দৌড় হবে, সেই মাঠের নাম হবে স্টেডিয়াম[৬১]। সেই থেকে স্টেডিয়ামে শুরু হলো অলিম্পিক খেলা।

তো বিজয়ীর পুরস্কার কী হবে? এটি ভাবতে গিয়ে হারকিউলিস হঠাৎ দার্শনিক হয়ে গেল। তার মনে হলো, টাকা-পয়সা তো হাতের ময়লা। অলিম্পিকে কোনো টাকা-পয়সা পুরস্কার দেওয়া হবে না। সম্মানটাই হবে পুরস্কার। এই ভেবে সে একটি জলপাই গাছ লাগাল জিউসের মন্দিরের পাশে। বলল, এই জলপাই শাখার মুকুট পরিয়ে দেওয়া হবে বিজয়ীকে।

এভাবে শুরু হয় অলিম্পিক। ধীরে ধীরে সারা গ্রিসের সব নগর থেকে মানুষ আসতে থাকে এই খেলায়। শর্ত একটিই— খেলোয়াড়ের মাতৃভাষা অবশ্যই গ্রিক হতে হবে।

অলিম্পিয়ায় এই প্রতিযোগিতা চার বছর পর পর হয়। সারা গ্রিসের চারটি শহরে এরকম প্রতিযোগিতা হয়। শহরগুলো হলো করিন্থ, নিমিয়া, ইসথিমিয়া এবং অলিম্পিয়া। চারটা শহরে প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে খেলা আয়োজন হয়। সেজন্য অলিম্পিয়ায় আয়োজন ফিরে আসে চার বছর পর পর

অলিম্পিক হয় গ্রীষ্মকালে। গ্রীষ্মের তৃতীয় পূর্ণিমার দুদিন আগে শুরু হয়। তখন কয়েক মাস ধরে দেশ-বিদেশের খেলোয়াড়রা আসতে থাকে। তারা অনেকদিন আগেই সেখানে গিয়ে তাঁবু ফেলে। কয়েক মাস ধরে চলে প্রশিক্ষণ।

অলিম্পিকে স্পার্টার মানুষই বেশি জয়ী হয়। তাদের তাঁবুতে লোকও বেশি। কিন্তু এই বছর এথেন্সের তাঁবু সবচেয়ে বড়। এবার এথেন্সের খেলোয়াড়দের নিয়ে এসেছেন পেরিক্লিস নিজে। তার সাথে আছে হেরোডোটাস। তাকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন পেরিক্লিস। সেখানে হেরোডোটাস এথেন্সের মহিমা বলবে।

আরও চমক আছে। এবার এথেন্সের বাহিনীর সাথে এসেছে আসপাশিয়া অলিম্পিকে মেয়েরা আসতে পারে না। খেলোয়াড় বা দর্শক কোনো কিছুতেই মেয়েদের কোনো জায়গা নেই। তবু পেরিক্লিস সাহস করে নিয়ে এসেছেন আসপাশিয়াকে। আসপাশিয়া খেলার মাঠে যেতে পারবে না। শুধু হেরোডোটাসের অনুষ্ঠান দেখতে পারবে।

অলিম্পিক পাঁচ দিন চলে। পঞ্চম দিন খেলা শেষে হেরোডোটাসের গল্প বলার অনুষ্ঠান হবে। এই অনুষ্ঠান সফল করতে এথেন্সের অনেক মানুষ এসেছে। এটিতেও আসপাশিয়ার একটি গুড়া বুদ্ধি আছে। তার বুদ্ধিতেই পেরিক্লিস ঘোষণা দিয়েছেন, এবার এথেন্সের যে কেউ বিনামূল্যে অলিম্পিকে আসতে পারবে। সব খরচ দেবেন পেরিক্লিস একা। তাই এই বছর এথেন্সের মানুষ অনেক বেশি। সাতটা বিশাল তাঁবু তাদের।

সক্রেটিসকে আসার জন্য আসপাশিয়া অনেক বলেছিল। সক্রেটিসেরও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি। তার বাবা অসুস্থ। ক্রিতো আর চেরোফোন এসেছে। আসার আগে তারা সবাই মিলে সক্রেটিসের সাথে মস্করা করছিল :

আসপাশিয়া সক্রেটিসকে বলেছিল, দুঃখ কোরো না, আমি যা দেখব, ফিরে এসে তোমাকে বলব। আমি হলাম তোমার দ্বিতীয় নয়ন।

সক্রেটিস বলেছিল, তুমি নয়ন হলে আমার আর কিছুই দেখা হবে না। কারণ তুমি সেখানে কিছুই দেখতে পারবে না। মেয়েরা অলিম্পিকের মাঠে ঢুকতেই পারে না।

আসপাশিয়া বলেছিল, তাহলে ক্রিতো আর চেরোফোন হবে আমার চোখ। তারা দেখে এসে আমাকে বলবে। তারা হবে আমার দ্বিতীয় নয়ন। আর আমি বলব তোমাকে। আমি হবো তোমার তৃতীয় নয়ন।

অলিম্পিকে এসে আসপাশিয়া আসলেই কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। সে মোটামুটি তাঁবুতে বন্দি। ক্রিতো আর চেরোফোন তার দ্বিতীয় নয়নের কাজ করছে। খুব উৎসাহের সাথেই করছে। তারা তাঁবুর বাইরে যায়, আর একটু পর পর ফিরে এসে ধারাভাষ্য দেয়। তাদের এই ছেলেমানুষি দেখে পেরিক্লিস মনে মনে হাসেন। মুখে কিছু বলেন না।

এখানে এসে আসপাশিয়ার একেবারে মাথা নষ্ট। পৃথিবীর কোনো অনুষ্ঠানে এত লোকের সমাগম হতে পারে, এটি তার ধারণাতেই ছিল না। আগে লোকের মুখে শুনেছে। তবু নিজের চোখে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে।

এই খেলার জন্য সারা অলিম্পিয়া সাজানো হয়েছে। আঁকা হয়েছে নতুন নতুন ছবি। মূর্তিগুলো রং করা হয়েছে। একেবারে ঝলমল করছে অলিম্পিয়া। মানুষে কিলবিল করছে। সারা পৃথিবীর যেখানে গ্রিক ভাষা বলতে পারে, সেখান থেকেই লোক এসেছে। এথেন্স, স্পার্টা, থিবস, সিসিলি, কস, ক্রিতি— সবখান থেকে এসেছে। রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি, নেতা সব গিজগিজ করছে। রাজা নিজে আসতে না পারলেও দূত পাঠিয়েছে। প্রত্যেক নগরের খেলোয়াড়, প্রশিক্ষক, কর্মকর্তা, দাস— সব মিলিয়ে এক একটি বিশাল মিছিল। তাদের সাথে গাড়ি বোঝাই উপহার। বড় বড় নগরের সাথে আছে গায়ক দল, আছেন স্বভাব কবি। কোনো কিছুর অভাব নেই।

অভাব শুধু একটি জিনিসের। অলিম্পিকের কোথাও কোনো নারী নেই। নারী বিবর্জিত এমন বিনোদন পৃথিবীতে আর নেই।

প্রথম দিন খুব সকালে শুরু হলো বিশাল অলিম্পিক মিছিল। শোভাযাত্রা করে সবাই এলো জিউসের মন্দিরের সামনে। অলিম্পিয়ায় তিনটি মন্দির একটি জিউসের, একটি তার স্ত্রী হেরার, আর অন্যটি ধন-সম্পদের দেবী দিমিত্রার। জিউসের মন্দিরের পাশে হারকিউলিসের লাগানো জলপাই গাছ।

এই জলপাই গাছের শাখা দিয়েই মুকুট বানিয়ে পুরস্কার দেওয়া হয় বিজয়ীকে সম্পদের দেবী দিমিত্রার মন্দিরে টাকা-পয়সা উপহার রাখা হয়। এই মন্দিরের পেছনেই অলিম্পিক স্টেডিয়াম। সেখানেই দৌড়, বর্শা-নিক্ষেপ, চাকতি- নিক্ষেপ, দীর্ঘ লম্ফ হয়। স্টেডিয়ামের দক্ষিণে ঘোড়-দৌড়ের মাঠ।

অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য পুরোহিত একটি পবিত্র শূকর বলি দিল। সাথে সাথে বাদ্য বেজে উঠল। সকল খেলোয়াড় লাইন ধরে দাঁড়াল। মন্দিরের পুরোহিতের সাথে তারা শপথ নেবে। তারা সুরে সুরে বলছে অলিম্পিক শপথ—

‘আমি দেবতা জিউসের নামে শপথ করে বলছি— আমি একজন গ্রিক আমি গ্রিক ভাষায় কথা বলি। এই পবিত্র খেলায় অংশ নিতে আমি গত দশ মাস ট্রেনিং করেছি। আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, এই খেলায় আমি কোনো রকম অনৈতিক উপায়ের আশ্রয় নেব না।’

এরপর খেলার বিচারক ও রেফারিরা শপথ নিলেন। তারা বললেন, আমরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এই খেলা পরিচালনা করব। কোনো প্রকার ঘুষ বা লোভের আশ্রয় নেব না। বিচারের গোপনীয়তা পুরোপুরি রক্ষা করব।

শপথের পর উপহার প্রদান। বিভিন্ন নগরের রাজা, নেতা ও রাষ্ট্রদূতেরা তাদের উপহার সারি সারি করে রাখল। কারা কী এনেছে সবাইকে দেখাতে হবে। দেখা যাবে কার কত সম্পদ, কোন্ নগর কত ধনী। এই বছর এথেন্সের উপহার সবার থেকে অনেক অনেক বেশি। লোকজন একবার উপহার দেখে আর একবার পেরিক্লিসের দিকে তাকায়। তাকায় আর চোখ টাটায়।

উপহার দেওয়ার পর বালকদের খেলা। বালক মানে যাদের বয়স বারো থেকে আঠারো। কোনো জন্ম সনদ নেই। তাই এক-একজন বালক আসছে, আর পরিচালকরা বড় বড় চোখে তাদের মুখ দেখছে। গালে ঘষা দিয়ে দেখছে দাঁড়ি উঠেছে কিনা। তারাই ঠিক করছে, কে বালক আর কে বালক নয়।

ময়দানের কোনায় ছোট ছোট ভিড় দেখা যাচ্ছে। সেগুলো জ্ঞানী লোকদের জায়গা। সেখানে কবিরা কবিতা পড়ছেন, সফিস্টরা জ্ঞানের কথা বলছেন। ক্রিতো আর চেরোফোন সেদিকে গেল।

চেরোফোন বলল, ঐ যে কবি পিনডার।

পিনডার এখন গ্রিসের জীবিত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে নামি। বুড়ো হয়ে গেছেন। বয়স ষাটের বেশি। কিন্তু অলিম্পিকে না এসে থাকতে পারেন না। বিখ্যাত কবিকে ঘিরে অনেক মানুষ। গাছের ছায়ায় বসে কবি পিনডার[৬২] কাঁপা কাঁপা গলায় কবিতা[৬৩] বলছেন—

‘দিন মাস বছর যাবে, ক্লান্ত হবে মহাকাল
তবু পথ গোনা শেষ হবে না
অলিম্পিকের চেয়ে বড় কোনো সমাগম
মহাবিশ্বে আর হবে না, হবে না’

দর্শকরা তুমুল হাততালি দিল। এটি পিনডারের যৌবনে লেখা কবিতা, এখন সবার মুখে মুখে। এটি প্রায় অলিম্পিকের থিম কবিতা হয়ে গেছে। অনেকটা অলিম্পিক সংগীতের মতো।

ক্রিতো বলল, ইস, সক্রেটিস খুব মিস করল। পিনডারের নিজের মুখে কবিতা শোনা খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। তারা তাড়াতাড়ি তাঁবুতে গিয়ে আসপাশিয়াকে পিনডারের কবিতাটি শোনাল। শুনেই আসপাশিয়ার মাথায় আর একটি গুঁড়া বুদ্ধি এলো। কবি পিনডারকে দিয়ে এথেন্সের জন্য কবিতা লেখাতে সে পেরিক্লিসকে বুদ্ধি দিল।

পেরিক্লিস কবি পিনডারকে তাঁবুতে নিয়ে এলেন।

আসপাশিয়াকে দেখে কবি একেবারে লা-জবাব। কবি ভাবতেই পারেননি— অলিম্পিকের তাঁবুতে নারী আছে। সেই নারী আবার এমন অসম্ভব রূপবতী। এই রূপে যে কারও মাথা ঘুরে যাবে। কবির বুড়ো মাথা, তাই আরও বেশি ঘুরে গেল। তিনি তখুনি পেপিরাস বের করলেন। আসপাশিয়াকে নিয়ে কবিতা লিখবেন। এমন নারীর জন্য ফটাফট কবিতা লিখতে না পারলে তিনি কিসের কবি!

আসপাশিয়া মিষ্টি করে বলল, কবি, আপনি অবশ্যই কবিতা লিখবেন। তবে আমাকে নিয়ে নয়, কবিতা লিখবেন এথেন্সকে নিয়ে।

কবি মাথা পুরোই আউলা হয়ে গেছে। তিনি বলছেন, এমন রূপ দেখে যদি ঝরঝর করে কবিতা না আসে, সে আবার কিসের কবি? কবিরা হলো রূপের কারবারি। রূপ যেখানে, কবিতাও সেখানে। রূপের মতো রূপ দেখলে, কবিতা কি ভেতরে আটকে থাকতে পারে? সব উথলে উথলে পড়ে।

পেরিক্লিস উঠে দাঁড়ালেন। বুড়োর ভীমরতি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, কবিবর, আমার এথেন্স এই নারীর চেয়ে কম রূপবতী নয়। সেই রূপ দেখলেও আপনার কবিতা উথলে উথলে পড়বে।

পেরিক্লিসের গম্ভীর স্বর ওষুধের মতো কাজ দিল। কবির মাথা ঠিক হয়ে গেল। তিনি লজ্জা পেলেন। তখুনি এথেন্সের জন্য দুটি কবিতা লিখলেন। পেরিক্লিস তাকে দুই টেলেন্ট রুপার মুদ্রা দিলেন। কবি কিছুতেই নেবেন না। আসপাশিয়ার সম্মানে কবিতা। তার জন্য দাম নিলে রূপের অসম্মান হয়। পেরিক্লিস টাকাটা পিনডারের দাসের কাছে দিয়ে দিলেন।

.

অলিম্পিকের দ্বিতীয় দিন রথের প্রতিযোগিতা। রথচালনা ধনীদের খেলা। রথ বানাতে টাকা লাগে। ঘোড়া পালন করতেও টাকা লাগে। আবার রথ চালানোয় জীবনের ঝুঁকি আছে। সেজন্য রথের মালিক নিজে রথ চালায় না। চালানোর জন্য মানুষ ভাড়া করে। তাই রথচালনা বহুত খরচান্ত ব্যাপার।

খরচান্ত ব্যাপার হলেও, শুধু টাকা দিয়ে অলিম্পিক জয়ের জন্য আর কোনো খেলা নেই। তাই ঘোড়ার মাঠে বিপুল দর্শক। এখানে টাকার শব্দ শোনা যায়। টাকার একটি নেশা আছে। এই মাঠে টাকার সাথে রক্তের নেশাও আছে। রথের মাঠে রক্তও ঝরে। যত রক্ত, তত আনন্দ। রথ চালাতে গিয়ে প্রতি বছরই দুর্ঘটনা হয়। ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে অনেকে মারা যায়।

তৃতীয় দিন পূর্ণিমা। এদিন সকালে একশ ষাঁড় বলি দেওয়া হয়। এরপর দৌড় প্রতিযোগিতা।

চতুর্থ দিন কুস্তি, বক্সিং এবং পেনক্রাশন[৬৪]।

অলিম্পিকের প্রতিযোগিরা সব ন্যাংটা। গ্রিক খেলোয়াড়রা কেউ মাঠে কাপড় পরে না। গ্রিক শব্দ জিমনেশিয়াম এসেছে জিমনোস থেকে। জিমনোস মানে নগ্ন। জিমনেশিয়াম হলো এমন জায়গা যেখানে নগ্ন হয়ে যাওয়া যায়। এরা জিমনেসিয়ামে নগ্ন হয়ে প্র্যাকটিস করে আর খেলায় অংশও নেয় ন্যাংটা হয়ে।

তবে প্রথম দিকের অলিম্পিকগুলো এমন ন্যাংটা অলিম্পিক ছিল না। একবার দৌড়ানোর সময় মেগারা শহরের এক প্রতিযোগীর কাপড় খুলে যায়। ঘটনাক্রমে সে প্রথম হয়ে যায়। মানুষ বলতে শুরু করল- ন্যাংটা হয়ে দৌড়ালেই প্রথম হওয়া যায়। শুরু হলো কাপড় খুলে ফেলা। এখন আর মাঠে কোনো কাপড় পরা প্রতিযোগী নেই।

পাঁচ দিনে শেষ হয়ে গেল। এবারও স্পার্টার প্রতিযোগিরাই বেশি পদক জিতল। তাদের অনেক আনন্দ। এই পাঁচদিন পেরিক্লিস দাঁত চেপে স্পার্টার জয় দেখেছেন। এবার এথেন্সের সময়। আজ সন্ধ্যায় হেরোডোটাস বক্তৃতা দেবেন।

***

৬০. এথেন্স থেকে প্রায় ৩০০ কি:মি: পশ্চিমে গ্রিসের পেলোপোনেসিস অঞ্চলে প্রাচীন অলিম্পিয়া নগরী। এখানে খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।

৬১. গ্রিক শব্দ stadion থেকে stadium শব্দটি এসেছে।

৬২. কবি পিনডার (খ্রি পূ ৫১৮-৪৩৮): প্রাচীন গ্রিসের গীতিকবি। সক্রেটিসের সময়ে জীবিত কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। তিনি অলিম্পিক বিজয়ীদের নিয়ে কবিতা লিখতেন।

৬৩. কবি পিনডার (Pindar) এর Olympian 1 কবিতার অংশ, D. A. Svarlien কর্তৃক ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা করেছি।

৬৪. পেনক্রাশন হলো প্রাচীন অলিম্পিকে শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। এতে কিল, ঘুষি, লাথি, কুস্তি যেভাবে পারে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *