হেনরি হাউস

হেনরি হাউস

কালিম্পং-এর ক্যামেলিয়া লজে তো জায়গা পাওয়া যাবে না স্যার৷ সব ঘরই বুক হয়ে গেছে৷

কথাটা শুনেই মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেছিল অনিমেষের৷ গরমের ছুটিতে এবার দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়া হবে, অনেকদিন ধরেই ঠিক করা আছে৷ তবে দার্জিলিং বেড়াতে যাওয়া মানে তো আর শুধুই দার্জিলিং নয়৷ চারদিন দার্জিলিং দুদিন কর্শিয়াং আর দুদিন কালিম্পংও৷ সব মিলিয়ে আটদিনের একটা জমজমাট ট্যুর৷ রিমির স্কুলে সেশন ব্রেকের ছুটি৷ রূপা স্কুলে পড়ায় বলে তারও ছুটি নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই৷ বাকি থাকল শুধু অনিমেষ৷ তার ব্যাঙ্কের চাকরিতে ছুটির কড়াকড়ি থাকলেও এবার দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে৷ ট্রেনের রিজার্ভেশন সারা৷ দার্জিলিং আর কর্শিয়াং-এ টুরিস্ট লজে ঘর মিলেছে৷ বুকিং কমপ্লিট৷ বাকি ছিল কালিম্পং৷ সেখানেই বাধল গোল৷ প্রথম পছন্দ ক্যামেলিয়া৷ ইন্টারনেটে দেখে ভারি পছন্দ হয়েছে রূপা আর অনিমেষ দুজনেরই৷ গলফ কোর্সের উল্টোদিকে হোটেল৷ চারপাশের দৃশ্য চমৎকার৷ ভিতরের ব্যবস্থাও সুন্দর৷ অনলাইনে বুকিং-এ সমস্যা হচ্ছে দেখে অনিমেষ তাই নিজেই চলে গেছিল ওদের ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসে৷

দেখুন না একবার ভালো করে৷ একটাই ঘর তো লাগবে৷ কোনওভাবে যদি ম্যানেজ করা যায়…

হোটেলের কর্মচারীটি একেবারে আগাগোড়া পেশাদার লোক৷ তাই অনিমেষের এহেন অন্যায় আবদারেও দাঁত না খিঁচিয়ে, ঠোঁটের কোনে হালকা একটা হাসি ঝুলিয়ে আবার সামনের কম্পিউটারের পর্দায় চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন, লাভ নেই কিছু৷ খালি নেই একটাও….তবে….

সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক অনিমেষ৷ তবে কী? তার মানে নিশ্চয় একটা কিছু ব্যবস্থা হবে৷

দেখুন আমাদের এই লজটা একদম নতুন৷ মাত্র তিন বছর হল তৈরি হয়েছে৷ চারতলা বিল্ডিং, মডার্ন অ্যামেনিটিজ৷ কিন্তু এর আগে যে বাংলোটায় আমাদের হোটেল ছিল সেটা এখনও আছে৷ যদিও সেটা পুরোনো প্যাটার্নের৷ সেখানে যদি থাকতে রাজি থাকেন তাহলে একবার দেখতে পারি৷

কথাটা শুনে প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেছিল অনিমেষ, পুরোনো মানে কী, ভাঙাচোরা নাকি?

আরে না না৷ সবই ঠিকঠাক৷ ব্যবস্থাও একইরকম৷ শুধু বাড়িটা এখনকার মতো ঝাঁ-চকচকে নয়৷ ইনফ্যাক্ট আমাদের অনেকে পুরোনো ক্লায়েন্ট তো ক্যামেলিয়ায় না থেকে হেনরি হাউসে থাকাই প্রেফার করেন৷ বেশ একটা কোলোনিয়াল ফ্লেভার পাওয়া যায়৷

বাড়িটার নাম বুঝি হেনরি হাউস?

হ্যাঁ৷ এক ব্রিটিশ চা-বাগানের মালিকের বাংলো ছিল ওটা৷ পরে হাত বদলে হোটেল হয়েছে৷ দেখুন থাকবেন তো বলুন, দেখে নিই৷

দোনোমোনো করে রাজি হয়ে গেল অনিমেষ৷ হেনরি হাউসে ঘর পাওয়া গেল৷ বুকিংও হয়ে গেল সেদিনই৷ তবে মনে একটা খুঁতখুঁতুনি ছিলই৷ কিন্তু আজ সকালে গাড়িটা যখন নুড়ি ঢালা রাস্তাটা দিয়ে এসে পোর্টিকোতে দাঁড়াল, তখন নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল তার৷ ভদ্রলোক বলেছিলেন বটে যে ব্রিটিশ আমলের বাংলো, কিন্তু সে যে এতটা ছিমছাম সুন্দর অনিমেষ ভাবতেই পারেনি৷

চারিদিকে ছড়ানো সবুজ ঘাসের লনের মাঝখানে দোতলা হেনরি হাউস৷ বাড়িটার রঙ হালকা হলুদ আর সাদায় মেশানো৷ ছাদ টুকটুকে লাল টালির৷ তবে বাড়ির রঙ তেমনভাবে চোখে পড়ে না৷ কারণ দেওয়াল বেয়ে উঠে গোটা বাড়িটাকেই ছেয়ে ফেলেছে সবুজ পাতায় ভরা একটা লতা৷ খুব ছোট ছোট বিন্দুর মতো গোলাপি-বেগুনি ফুলে ভরে আছে সেই লতা৷ দেখে মনে হচ্ছে যেন বিদেশি কোনও রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে বাড়িটা৷ এখনই দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসবে সোনালি চুলের সুন্দরী রাজকন্যা৷

রিমি তো গাড়ি থেকে নেমেই সামনের লনে খানিকটা ছোটাছুটি করে নিল৷ একটা লোমওলা কুকুর বসে ছিল রোদে গা পেতে৷ নির্ঘাৎ সে ব্যাটা হেনরি হাউসের পাহারাদার৷ সেও ছুটলো রিমির পিছুপিছু৷ বাংলোটা যে রূপারও খুব পছন্দ হয়েছে সেটা তার মুখের খুশি খুশি ভাব দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না৷

জিনিসপত্র নিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখা গেল সেখানকার ব্যবস্থাও চমৎকার৷ একতলায় মস্ত লাউঞ্জ, ডাইনিং রুম, কিচেন, বিলিয়ার্ড রুম আর একটা ছোট্ট লাইব্রেরি৷ ওপরের চারটে ঘরে থাকার ব্যবস্থা৷ কাঠের মেঝে, কাঠের সিঁড়ি৷ তার ওপর মোটা কার্পেট পাতা৷ চলাফেরায় শব্দ হয় না মোটেই৷ ম্যানেজার জানালেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকের ঘরটায় অনিমেষদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে৷

বাগানের দিকে ঘর৷ সবথেকে ভালো ভিউ এই ঘরটা থেকেই পাওয়া যায় বুঝলেন তো৷ ভাগ্য ভালো থাকলে সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলা দিয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবেন৷

ম্যানেজার যে মোটেই বাড়িয়ে কিছু বলেননি সেটা বোঝা গেল ঘরে ঢুকেই৷ জানলার পর্দা সরাতেই হিমালয় যেন আদর করে ডেকে নিল দু-হাত বাড়িয়ে৷ বাগানের সবুজ ঘাসের লন গিয়ে মিশেছে পাহাড়ের ঢালে৷ সেখানে পাহারাদারের মতো মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একসারি সবুজ পাইনের গাছ৷ তার ওপাশে ঢেউয়ের মতো নীল-সবুজ পাহাড়ের সারি ক্রমশ হালকা হতে হতে আকাশ আর মেঘের সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার৷ বেলা হয়ে গেছে৷ মেঘের দল তাই নেমে এসেছে নীচে৷ কিন্তু ভোরবেলা, মেঘেদের দুষ্টুমি শুরু হওয়ার আগে, নিশ্চিত ওখান থেকেই হাতছানি দেবে সোনার পাহাড়৷

দুপুরে ডাইনিং হলে খেতে গিয়ে আলাপ হল অন্য দুটি ঘরের বাসিন্দাদের সঙ্গে৷ কৃষ্ণনগর থেকে বেড়াতে এসেছে বেশ বড় একটি পরিবার৷ দুটি ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তারা৷ তবে এবার তাদের গন্তব্য দার্জিলিং৷ খাওয়া সেরেই রওনা দেবে৷ বিকেলে নতুন অতিথি আসবে ওই ঘরে৷

হেনরি হাউসের রান্না চমৎকার৷ ভাত, ঝুরি ঝুরি আলু ভাজা, মুগের ডাল, ফুলকপির তরকারি, মুরগির মাংস আর স্যালাড দিয়ে খাওয়াটা বেশ জম্পেশই হল৷ দুপুরে তাই একটু গড়িয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না৷ বিকেলে উঠে অনিমেষ দেখল দোতলার অন্যদুটো ঘরেই লোক এসে গেছে৷ তবে তাদের ঠিক উল্টোদিকের ঘরটা তখনও তালা বন্ধ৷ সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁদিকের এই ঘরটার লাগোয়া একটা বারান্দা আছে৷ তাতে গোটা দুয়েক চেয়ার পাতা৷ সেই গোলাপি ফুলে ভরা লতাটা ছেয়ে আছে বারান্দার দেওয়ালেও৷ চা-এর কাপ নিয়ে সেই বারান্দায় বসাটা ভারি আরামের৷ সকালবেলা এখানে বসেও দিব্যি সূর্যোদয় দেখা যায়৷

কিন্তু সূর্যোদয় দেখতে হলে তো ভোর ভোর উঠতে হবে৷ তাছাড়া পাহাড়ি জায়গায় সন্ধের পরে আর বিশেষ কিছু করার থাকে না৷ তার ওপর আবার ম্যানেজার বলে দিলেন, ডিনার খেয়ে নিতে হবে সাড়ে নটার মধ্যেই৷ কারণ গেস্টদের খাওয়া হয়ে গেলে, রান্নাঘর, ডাইনিং রুম সব জায়গায় তালা লাগিয়ে তাঁরা নিজেদের কোয়ার্টারে চলে যান৷ গেটের বাইরে পাহারা চৌকি আছে, সেখানে শুধু দারোয়ান থাকে৷

কিন্তু রাতে যদি কোনও দরকার হয়, আপনাদের ডাকব কী করে?

মোবাইল নম্বর দিয়ে যাব৷ ফোন করবেন৷ চলে আসব৷ আমার কোয়ার্টার কাছেই৷ হেঁটে আসতে দশ মিনিট লাগে৷

কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বলা হলেও বাস্তবে কথার সঙ্গে কাজের কোনও মিল থাকবে কী না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল অনিমেষের৷ তবে মাথা ঘামায়নি৷ কারণ মাটন কারিটা এত ভালো খেতে হয়েছিল যে অন্য কোনও দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া যাচ্ছিল না৷

কিন্তু সাড়ে নটার মধ্যে খেয়ে নিলেই তো আর ঘুমিয়ে পড়া যায় না৷ অভ্যাসই নেই৷ কলকাতায় তো সাড়ে নটা মানে সবে সন্ধে রাত্তির৷ অফিস থেকে এসে এক কাপ চা নিয়ে বসার সময়৷ তাই জামা-কাপড় বদলে, আসার সময় স্টেশনে কেনা একটা ইংরাজি থ্রিলার হাতে নিয়ে বিছানায় লম্বা হল অনিমেষ৷ মার্চের মাঝামাঝি৷ দিনের বেলায় ঠান্ডা নেই মোটেই৷ কিন্তু রাতে কম্বলের তলায় ঢুকে আরামই লাগছিল৷ রিমি সন্ধে থেকে লনে ছোটাছুটি করেছে৷ তাই ঢুলছিল খাওয়ার সময়েই৷ রূপারও শোয়ার একটু পরেই দিব্যি ফুসুর ফুসুর নাক ডাকতে লাগল৷ অনিমেষের কিন্তু ঘুম পায়নি মোটেই৷ তাছাড়া বইটাও খুব ইন্টারেস্টিং৷ তাই পিঠে বালিশ দিয়ে বসে পড়ে যাচ্ছিল মন দিয়ে৷ তবে রূপাদের ঘুমোতে যাতে অসুবিধা না হয়, সেজন্য বড় আলোটা নিভিয়ে নিজের মাথার কাছের রিডিং ল্যাম্পটা জ্বেলে নিয়েছিল৷

রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা৷ বইয়ের মধ্যে রীতিমত ডুবে আছে অনিমেষ৷ হঠাৎ কেমন যেন একটা অস্বস্তি হওয়ায় সামনে তাকিয়ে চমকে উঠল৷ অনিমেষ আধশোয়া হয়ে বসে আছে খাটে৷ তার ঠিক উল্টোদিকেই বাথরুমের দরজা৷ দরজার ডান পাশে বেশ বড় আয়না লাগানো পুরোনো দিনের ড্রেসিং টেবিল৷ একঝলেক অনিমেষের মনে হল ড্রেসিং টেবিলের সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মুখ দেখা যাচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে যেন মুখ নিচু করে কিছু খুঁজছে৷ পুরুষ না মহিলা বোঝা যাচ্ছে না৷ ভয়ানক চমকে ধড়মড় করে উঠে বসে আবার আয়নার দিকে তাকাল অনিমেষ৷ কোথাও কিছু নেই৷ বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না ঝকঝক করছে৷ তবে ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা চিমসে গন্ধ৷ গন্ধটা কি আগে ছিল? কোনও পোকা-টোকা মরল নাকি?

অনিমেষ এমনিতে সাহসী ছেলে৷ তাই প্রথমেই হাত বাড়িয়ে ঘরের বড় আলো জ্বালল৷ তারপর উঠে গোটা ঘর-বাথরুম ঘুরে এল একবার৷ কোথাও কিছু নেই৷ অদ্ভূত গন্ধটাও আর সেভাবে নাকে লাগছে না৷ ড্রেসিং টেবিলটা ঘরে ঢোকার দরজার ঠিক উল্টোদিকে৷ বন্ধ দরজার গায়ে একটা হুকে অনিমেষের জ্যাকেট আর টুপিটা ঝুলছে৷ আয়নার ভিতরে সে দুটোর ছায়া পড়েছে৷ মনে মনে হাসল অনিমেষ৷ বোঝাই যাচ্ছে আধো অন্ধকারে টুপিটাকেই তার মানুষের মাথা বলে মনে হয়েছে৷ আসলে এরকম একটা পুরোন বাংলো বাড়িতে থাকলেই তো নানারকম অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার মাথার মধ্যে ঘোরে৷ তাতেই এমন দৃষ্টি বিভ্রম৷

পড়ার গতিটা কেটে গেছিল৷ রাতও অনেকটাই হয়েছে৷ তাই বই বন্ধ করে শুয়ে পড়ল অনিমেষ৷ ঘুমিয়েও পড়ল একটু পরে৷ যদিও মাঝরাতে আর একবার তার মনে হল ড্রেসিং টেবিলের সামনে কেউ যেন কিছু খুঁজছে৷ আর সেই চিমসে গন্ধটাও আবার ফিরে এসেছে৷ কিন্তু তখন চোখের পাতা ভারি৷ তাই ভালো করে কিছু বোঝার আগেই ঘুমের চাদর আপাদমস্তক ঢেকে ফেলল তাকে৷

সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন বাইরে ঝকঝকে আকাশ৷ নীলচে সবুজ পাহাড়ের শেষে রূপোলি রেখায় ধীরে ধীরে সোনালি রঙ ধরছে৷ রূপা আর রিমিকে কোনওরকমে টেনে তুলে সূর্যোদয় দেখা আর তারপর সারাদিন গাড়ি নিয়ে ডেলো থেকে শুরু করে কালিম্পং-এর এধারে-ওধারে লম্বা চক্করে রাতের কথা আর মনে নেই মোটেই৷ হোটেলে ফিরতে সন্ধে৷ লাউঞ্জে বসে চা খাওয়ার সময় অনিমেষের মনে হল হোটেলটা আজ যেন একটু বেশি চুপচাপ৷ ম্যানেজারের কাছে জানা গেল ওপরের একটা ঘরে গেস্ট আসার কথা আছে৷ কিন্তু ট্রেন অস্বাভাবিক লেট করায় তারা আজ রাতের কালিম্পং পৌঁছতে পারবে কীনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই৷

তিনজনেই খুব টায়ার্ড বলে রাতের খাবারটা ঘরেই দিতে বলা হয়েছিল৷ খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়েও পড়া হল তাড়াতাড়ি৷ ঘুমিয়ে পড়েছিল অনিমেষ৷ কিন্তু কিসের একটা চেঁচামেচিতে আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল৷ পাশে রাখা মোবাইলে দেখল রাত মাত্র এগারোটা৷ দরজার বাইরে একটা কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ গেস্টরা তার মানে এসে পৌঁছেছে অবশেষে৷ উদ্বিগ্ন বয়স্ক মানুষের গলা৷ যদিও ভাষাটা মনে হচ্ছে বাংলা নয়৷ রূপা আর রিমি ঘুমোচ্ছে অঘোরে৷

একটু সময় অপেক্ষা করেও কথা থামছে না দেখে খাট থেকে নামল অনিমেষ৷ কারুর কোনও বিপদ-আপদ হল কীনা দেখা দরকার৷ ম্যানেজার তো বলেছিল রাতে তারা সবাই কোয়ার্টারে চলে যায়৷ দরজা খুলে বেরিয়ে অনিমেষ দেখল করিডরের আলোটা জ্বলছে না৷ কিন্তু তাদের ঘরের ঠিক উল্টোদিকের দরজাটা খোলা৷ ভিতরে আলো দেখা যাচ্ছে৷ আর সেখান থেকেই কথাবার্তার আওয়াজটা আসছে৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক আধবুড়ো সাহেব৷ ফুল হাতা শার্টের সঙ্গে গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট৷ ওপরে একটা বুককাটা পুরোনো প্যাটার্নের কার্ডিগান৷ আপনমনে বকবক করছেন৷ অনিমেষ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে৷ তার দিকে একবার তাকালেনও৷ কিন্তু কিছুই যেন দেখতে পেলেন না৷ দৃষ্টিতে একটা অদ্ভূত উদ্বেগ আর বিষণ্ণতা৷ তারপর পা টেনে টেনে চলে গেলেন বারান্দার দিকে৷

ঘরের ভিতর থেকে একটা অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ আসছে৷ কিছু একটা যে হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে৷ কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো জানা দরকার৷ অনিমেষ ধীরে ধীরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো৷ রেলিংয়ে ভর দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সাহেব৷ সন্ধে বেলায় রীতিমত ঝকঝকে আকাশ ছিল৷ কিন্তু এখন যেন কোথা থেকে মেঘ এসে ঢেকে ফেলেছে৷ তারার আলোটুকুও নেই৷ চারপাশটা চাপ চাপ অন্ধকারে ঢাকা৷ শুধু খাদের ধারের পাইনগাছগুলো তারমধ্যেও জুজুবুড়ির মতো মাথা দোলাচ্ছে৷ বাংলোর সামনের রাস্তার স্ট্রিটলাইটগুলোও এখন আর জ্বলছে না৷ মনে হচ্ছে যেন একটা অন্ধকার প্রাগৈতিহাসিক গুহার মধ্যে ঢুকে আছে হেনরি হাউস৷

স্যরি বাবু৷ তোমাকে আজ আর একবার ডঃ ওয়াটসনকে নিয়ে আসতে হবে…..এত রাতে যাওয়া৷ আজ ঠান্ডাও পড়েছে৷ আমি জানি যে আমি তোমাকে বারবার বিরক্ত করছি৷ ডঃ ওয়াটসনও বিরক্ত হবেন নিশ্চয়৷ বাট আই অ্যাম হেল্পলেস৷ ডরোথির কষ্ট আর চোখে দেখা যাচ্ছে না৷ আই কান্ট টলারেট ইট এনি মোর৷ আমি চাইছি ঈশ্বর ওকে ডেকে নিন৷

চিমসে মতো একটা গন্ধ বারান্দাটায়৷ কনকনে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে৷ কিন্তু অনিমেষের শীত করছে না৷ কারণ তার গায়ে একটা পুরোনো মোটা চাদর৷ শার্টের হাতার কাছে একটু সেলাই খুলে গেছে৷ রাত পোশাকের পাজামা নয়, সে পরে আছে একটা ধুতি৷ সাহেবের কথাগুলো ভালো করে শোনার জন্যই যেন একটু এগিয়ে বারান্দার রেলিং-এর ধারে গিয়ে দাঁড়াল অনিমেষ৷

ডরোথিকে তো তুমি কমবয়সে দেখোনি বাবু৷ কী সুন্দর দেখতে ছিল! অ্যান্ড ফুল অফ লাইফ৷ সারাক্ষণ হাসছে, গান গাইছে৷ সাজগোজ করতে ও চিরকালই খুব ভালোবাসে৷ অলওয়েজ লুকিং প্রিটি৷ সাহসও ছিল খুব৷ আমি যখন এই চা-বাগানের কাজ নিয়ে ইন্ডিয়া এলাম, সবাই ওকে বারণ করেছিল আমাকে বিয়ে করতে৷ বাট শি ওয়াজ সো ডেয়ারিং৷ ও কারুর কথা শোনেনি৷ আমার সঙ্গে চলে এল ইন্ডিয়াতে৷ তখন চা-বাগানে গাছ লাগানো হচ্ছে৷ হোল ডে আই ওয়াজ বিজি৷ বাট শি নেভার কমপ্লেইনড৷

অন্ধকারে আস্তে আস্তে চোখ সয়ে আসছে অনিমেষের৷ বাংলোর হাতা থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে কিছুটা গেলেই ক্যামেলিয়া লজ৷ চারতলা বাড়িটা দিব্যি দেখা যায় বারান্দা থেকে৷ কিন্তু এখন সেখানে শুধুই অন্ধকারের সমুদ্দুর৷ টেলিভিশন সেন্টারের এক চোখো দৈত্যের মতো লাল আলোটাও সময়ের পাঁচিলের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে৷ রাস্তার ওপাশে গলফ ক্লাবের সাদা রঙ করা কাঠের বেড়াটা উধাও৷ একটা কালো প্যাঁচা নিঃশব্দে ডানা নেড়ে উড়ে গেল৷ তার পাখার ঠান্ডা হাওয়া লাগল অনিমেষের মুখে৷

জানো তো বাবু ডরোথি যখন আমার সঙ্গে পার্টিতে যেত, সবাই ওর সঙ্গে নাচতে চাইত….ওর দিদি বলেছিল ইন্ডিয়াতে শুধু সাপ, বাঘ আর ম্যালেরিয়ার ভয়৷ কিন্তু ডরোথি পরে আমাকে বলেছে, ইন্ডিয়ার মতো এত সুন্দর জায়গা ও আগে দেখেনি৷ স্পেশালি কালিম্পং তো হেভেনলি৷ এই বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে কত গল্প করেছি আমরা…. শোনো বাবু তুমি ডঃ ওয়াটসনকে বলবে যে ওকে আসতেই হবে৷ হি মাস্ট কাম৷ আর একটা দিন ওকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে৷ টুমরো ইজ হার বার্থ ডে৷ ডরোথি আমার কাছে একটা গিফট চেয়েছে৷ আমাদের এত বছর বিয়ে হয়েছে, ও যখন যা চেয়েছে আমি দিয়েছি৷ আই মাস্ট ফুলফিল হার লাস্ট উইশ৷ সি ওয়ান্ট আ ডিপ রেড লিপস্টিক…ডিউক টি গার্ডেনের মিঃ স্যামসন কলকাতা গেছেন৷ ওনাকে আমি বলে দিয়েছি৷ ও নিয়ে আসবে৷ হি উইল কাম ব্যাক টুমরো৷ ততক্ষণ ডরোথিকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে…বাবু তুমি আর দেরি কোরো না, ডঃ ওয়াটসনকে বোলো…

সাহেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই পিছনে থেকে একটা গলার আওয়াজ শোনা গেল….

লুক ডার্লিং….

অনিমেষ চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল বারান্দার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক মেমসাহেব৷ দেখেই বোঝা যায় একসময় অপরূপ সুন্দরী ছিলেন৷ কিন্তু এখন রুগ্ন চেহারা৷ দু-চোখের কোলে কালি৷ এলোমেলো চুল৷ সাধারণ একটা গাউন পরা৷ গায়ে গরম জামা৷ মুখে কোনও প্রসাধনও নেই৷ শুধু ঠোঁটে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিক লাগানো…

কিন্তু মেমসাহেব হাঁফাচ্ছেন৷ এক্ষুনি যেন পড়ে যাবেন….

ও মাই গড…

সাহেব দৌড়ে গিয়ে মেমসাহেবকে প্রায় কোলপাঁজা করে নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন৷ চাদরটা বারান্দার রেলিং-এ উঠে থাকা পেরেকে আটকে গেছে৷ ছাড়াতে কয়েক সেকেন্ড দেরি হল অনিমেষের৷ তারমধ্যেই সব ভোঁ-ভাঁ৷ বারান্দার দরজায় এসে অনিমেষ দেখল করিডরের আলোটা আগের মতোই জ্বলছে৷ তাদের ঘরের উল্টোদিকের দরজায় ল্যাচ টানা, তালা লাগানো৷ অনিমেষের পরনে আবারও চেনা রাত পোশাক৷ চমকটা সামলে ওঠার আগেই তাদের ঘর থেকে একটা পরিত্রাহি আর্তনাদ কানে এল অনিমেষের৷ রূপার গলা৷ কোনওরকমে ছুটে ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালতেই চোখে পড়ল খাটের ওপর উঠে বসে চিৎকার করছে রূপা৷ ভয়ে চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে৷ মুখ সাদা৷

অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করার পর রূপা বলল, একটু আগে ঘুম ভেঙে সে দ্যাখে যে অনিমেষ বিছানায় নেই৷ রূপা ধরেই নিয়েছিল যে অনিমেষ বাথরুমে গেছে৷ নিজেও একবার যাবে কী না ভেবে উঠে বসতেই তার নজরে পড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে৷ প্রথমটায় রূপা ভেবেছিল অনিমেষই হয়তো৷ কিন্তু তারপরেই বুঝতে পারে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি একজন মহিলা৷ ড্রেসিং টেবিলের আয়নার কাছে মুখটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কিছু করছেন তিনি৷ আর গোটা ঘরটা ভরে আছে একটা চিমসে গন্ধে৷ ব্যাপারটা বুঝেই রূপার গলা থেকে ভয়ের একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে৷ আর সেটা শুনেই মহিলা ঘুরে দাঁড়ান, একজন মেমসাহেব বুঝলে৷ বড় বড় চোখ৷ গাউন পরে আছে৷…আমার দিকে একবার তাকিয়েই বেরিয়ে চলে গেল, দরজাটা বন্ধ ছিল, গলে চলে গেল….

বাকি রাতটা ঘরের আলো জ্বালিয়ে কোনওরকমে কাটাল দুজনে৷ ভোরের আলো ফুটছে দেখে শুয়ে পড়েছিল৷ সাতটা নাগাদ বেড-টি নিয়ে এল লজের বেয়ারা মজিদ৷ তার পিছনেই ম্যানেজার অমর গিরি৷ অনিমেষের মুখের দিকে একবার তাকিয়েই বেয়ারাকে চাটা রেখে, চলে যেতে বললেন তিনি৷ তারপর নিজেই কাপে চা ঢেলে দিতে দিতে বললেন, ভুলটা আমারই৷ কাল যে ১২ মার্চ খেয়াল ছিল না আমার৷ প্রতিবারই মনে করে রাখি৷ ওই দিনটায় গেস্ট নিই না৷ এবার যে কী করে ভুলে গেলাম৷ আসলে আমার মেয়েটার কিছুদিন ধরেই এত শরীরটা খারাপ…স্যরি স্যার৷

ব্যাপারটা কী একটু খুলে বলুন তো….

অনিমেষের কথায় একটু বিষণ্ণ হেসে, টি-পট থেকে নিজের জন্যও এক কাপ চা ঢেলে নিলেন অমর গিরি৷ তারপর বললেন, উইলিয়াম হেনরি ছিলেন টি প্ল্যান্টার৷ ব্রিটিশ৷ ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন৷ ব্যবসা ভালো বুঝতেন৷ মানুষটিও নাকি ভালো ছিলেন৷ তাঁর স্ত্রী ডরোথি হেনরি৷ অপূর্ব সুন্দরী৷ দুজনের মিলমিশও ছিল খুব৷ স্বামী-স্ত্রী মিলে প্ল্যান করে এই হেনরি হাউস তৈরি করেন৷ বাংলোর গায়ে এই যে লতা দেখছেন, এটা নাকি মিসেস হেনরির নিজের হাতে লাগানো৷ ভালোবেসে ফেলেছিলেন কালিম্পংকে৷ ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে ইউরোপ চলে গেল৷ কিন্তু স্বামী-স্ত্রী গেলেন না৷ নিউমোনিয়া হয়েছিল মেমসাহেবের৷ তখন এসব জায়গায় ডাক্তার-বদ্যি পাওয়াই যায় না৷ তবু ওয়াটসন নামে একজন ছিলেন তিনিই চিকিৎসা করেছিলেন৷ শুনেছি চা-বাগানের হেডক্লার্ক ছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক৷ হেনরি তাঁকে খুব পছন্দ করতেন৷ শেষ জীবনটা সাহেবের দেখাশোনাও তিনিই করেন৷ মেমসাহেবের জন্মদিন ছিল ১২ মার্চ ৷ তার আগেরদিন রাতে খুব বাড়াবাড়ি হয়৷ বাঙালিবাবু নাকি রাতের অন্ধকারে পায়ে হেঁটে ওয়াটসনকে ডাকতে গেছিলেন৷ কিন্তু ডাক্তার আসার আগেই ভোররাতে মিসেস হেনরি মারা যান৷ বছর খানেক পরে উইলিয়াম হেনরি মারা যাওয়ার পর ছেলে-মেয়েরা এসে বাড়ি বিক্রি করে চলে যায়৷ কিন্তু সাহেব আর মেমসাহেব নাকি এখনও প্রতি বছর ১২ মার্চ রাতে ফিরে আসেন এই বাড়িতে৷ কীসের টানে কে জানে?

ফেরার ট্রেন রাতে৷ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়বে ওরা৷ মনটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে অনিমেষের৷ বারবার চোখ চলে যাচ্ছে বন্ধ দরজাটার দিকে৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রূপা তৈরি হচ্ছে৷ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ কেমন যেন চমকে উঠল অনিমেষ৷

রিমিকে নিয়ে রূপা ডাইনিং হলে গেছে৷ অনিমেষ সোজা গিয়ে ঢুকল ম্যানেজারের ঘরে, ওঁদের ঘরটা একবার খুলে দিন প্লিজ…

ওপরের ঘরটা? কেন বলুন তো?

দরকার আছে৷ জরুরি দরকার৷ খুলে দিয়ে আপনি নিচে নেমে আসুন৷

খুব অবাক হয়ে মিঃ গিরি চাবির রিংটা নিয়ে ওপরে উঠলেন৷ তিনি নেমে আসতে উঠে এল অনিমেষ৷ দরজার পাল্লা দুটো ভেজানো৷ হালকা চাপ দিতেই খুলে গেল৷ ভিতরটা আধো অন্ধকার৷ জানলার পর্দা টানা আছে৷ স্কাইলাইট দিয়ে সামান্য আলো আসছে৷ অনিমেষ ঘরের ভিতরে দু-পা এগোতেই হঠাৎ কোথা থেকে উড়ে আসা হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেল দরজার পাল্লাদুটো৷ সেই চিমসে গন্ধটা ফিরে আসছে৷ অনিমেষ পকেট থেকে বার করল লিপস্টিকটা৷ রূপার মেক-আপ বক্সে ছিল৷ গাঢ় লাল রঙ৷ সামনের টেবিলের ওপর লিপস্টিকটা রাখল অনিমেষ৷ চিমসে গন্ধটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ একটা হালকা মিষ্টি ল্যাভেন্ডারের গন্ধ৷ অনেকদিনের সাধ মিটেছে ডরোথি উইলিয়ামসের৷ নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ল্যাচ টেনে দরজাটা বন্ধ করে দিল অনিমেষ৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *