হৃদয়াক্ষী – ৯

শিহাব 

বছরের প্রথম বৃষ্টি ছিল সেদিন। আমি লনের মাঝ বরাবর এসে পৌঁছেছি। এমন সময় শুভ্রা দৌড়ে ছুটে এলো আমার কাছে। লক্ষ্য করলাম রুশমি দাঁড়িয়ে আছে প্যাটিওর কিনার ঘেঁষে। ওর মুখে খেলছে চাপা উদ্বেগ। যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চায় আমাকে। খুব কাছেই তার বন্ধুরা জড়ো হয়েছে। আমি এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি লিও নামের ছেলেটার নীল রংয়ের দুটি উজ্জ্বল চোখের তারা রুশমির ডান গালের ওপর টর্চের আলোর মতো স্থিরীকৃত হয়ে আছে। ছেলেটা কথা বলছে অন্য একজনের সাথে কিন্তু চেয়ে আছে রুশমির দিকে। দৃশ্যটা আমার বুকের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধল। রুশমি কি ওর বন্ধুর এই দুর্বলতাটুকু টের পায়? নিশ্চয়ই পায়। হয়তো উপভোগও করে টু সাম এক্সটেন্ট। নইলে অত আদর করে বাড়িতে ডেকে আনা কেনো? 

—‘কোথায় গিয়েছিলি?’ শুভ্রার প্রশ্নটা গতিময় ঝড়ো বাতাস কেটে কিছুটা আবছা হয়ে এসে লাগলো আমার কানে। 

—‘একটু কাজ ছিল।’ অল্প কথায় উত্তর দিলাম। দেখতে পেলাম রুশমি হাত নেড়ে, ইশারায় ডাকছে আমাকে। পা বাড়ালাম ওর ডাকে সাড়া দিয়ে। ততক্ষণে অবশ্য শুভ্রা আমার হাত ধরে ফেলেছে। এলোমেলো বাতাসে বোধহয় আমার চুলে কিছু একটা উড়ে এসে পড়েছিল। শুভ্রা আঙুল দিয়ে জিনিসটা সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস? কথা আছে তোর সাথে।’ 

আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘একটু দাঁড়াও। আসছি। উইল বি রাইট ব্যাক।’ 

প্যাটিওর শেষ সিঁড়িতে এসে যখন দাঁড়িয়েছি, লক্ষ্য করলাম লিও তখনও চেয়ে আছে রুশমির দিকে। কোনো এক নির্জন রাতে, সবার চোখের আড়ালে, একটা বদ্ধ গাড়ির ভেতর এই ছেলেটার সাথে আমার বৌ অন্তরঙ্গ কিছু সময় কাটিয়েছে, বিষয়টা আমি হাজার চাইলেও ভুলতে পারছি না কিছুতেই। সামনে তাকিয়ে দেখি কাজলকালো দুটি চোখে এখন ভয়, কুণ্ঠা এবং দ্বিধার এক আশ্চর্য সমাহার। 

—‘কিছু বলবে?’ 

—‘তোমার মনে আছে আমাদের একটা ডিল হয়েছিল যে শুভ্রার সামনে অ্যাকটিং করতে হবে?’ 

—‘মানে?’ রুশমির বলা কথাটার মর্মোদ্ধার করতে একটু সময় লেগে গেলো। তখন বৃষ্টি নেমে গেছে ঝমঝম করে। আমার মাথার ওপর ছাদ নেই বিধায় প্রথম ঝাপটাতেই পুরোপুরি ভিজে গেলাম। 

—‘এমন কিছু করো, মানে অ্যাকটিং… যাতে শুভ্রা বুঝতে পারে যে ইউ আর টোটালি ইনটু মি।’

আমি হতভম্ব চোখে তাকালাম ওর দিকে। মেয়েটাকে একদম বুঝতে পারি না। একটা দুয়ে রহস্য সর্বক্ষণ এর সর্বাঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। সব সময় সদর্পে বলে বেড়ায় আমাকে নাকি সে ঘৃণা করে, আবার এখন শুভ্রাকে আমার জীবন থেকে দূরে সরানোর জন্য অভিনয় করতে চাইছে, তাও আবার নিজের এক্স বয়ফ্রেন্ডের সামনে! এমনই সব বিক্ষিপ্ত চিন্তা মগজের মধ্যে একটা অচ্ছেদ্য জট পাকিয়ে তুলছিল ক্রমে ক্রমে। কিন্তু জট লাগা সব প্রতিকূলতাপূর্ণ ভাবনার মাঝেও টের পাচ্ছিলাম যে রুশমি কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত যুক্তি, তর্ক এবং প্রশ্ন ছাপিয়ে একটা আশ্চর্য ভালোলাগা আমার মনের ওপরে ময়ূরের পেখমের মতো নরম মৃদু পরশ বুলাতে শুরু করেছে। এদিকে ক্ষুরধার বিদ্যুতের প্রতাপে আকাশ ক্ষণে ক্ষণে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে। বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছে পৃথিবী। চারিদিকে বৃষ্টির সাদা জাল। আমি বুঝতে পারছি না ঠিক কী করা উচিত। স্নায়ুবিক চাপ অনুভব করছি। বুকের মধ্যে বড্ড কাঁপাকাঁপি! রুশমিকে জড়িয়ে ধরব? কিন্তু এই মেয়ের তো ঠিক ঠিকানা নেই। যদি সবার সামনে চড় থাপ্পড় মেরে বসে? 

—‘কী করব?’ বিপন্ন গলায় প্রশ্ন করলাম। 

—‘এনিথিং! দাঁড়িয়ে আছ কেনো? 

আমি একবার স্বগতোক্তির সুরে শব্দটা উচ্চারণ করলাম, ‘এনিথিং?’ তারপর ওর গোলাপি পাতলা অধরের দিকে চেয়ে সকৌতুকে বললাম, ‘কিস করব তোমাকে?’ ভেবেছিলাম প্রশ্ন শুনে মেয়েটা রেগে যাবে। স্বভাবসিদ্ধ খ্যাপা গলায় বলে বসবে ‘তুমি একটা অসভ্য!’ কিন্তু আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে ও ফট করে বলে ফেললো, ‘ডু ইট!’ 

একটা বিস্ময়ের ধাক্কা তেড়ে এসে আমাকে স্তব্ধ করে দিয়ে গেলো। সরু চোখে তাকালাম ওর দিকে। কথাটা বলে শেষ করে ও মুখ নিচের দিকে নামিয়ে নিয়েছে। ফর্সা গাল আরক্ত। চোখের লম্বা ঘন পল্লব কম্পনরত, ভীত এবং দ্বিধাপ্রস্ত। গোলাপি ঠোঁটের নিচের কালো তিলটা এই মুহূর্তে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম শুভ্রা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলছে, ওপরে উঠে আয়। জ্বর আসবে। 

আমি প্যাটিওর ওপরে উঠে এসেছি। শিরায় শিরায় একটা ইঙ্গিতময় রক্ত সঞ্চালন টের পাচ্ছি। একটা ট্রেন ছুটছে বুকের ওপর দিয়ে। এতকাল জানতাম ভালোবাসা ছাড়া কারো কাছাকাছি যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা, জানি না ওকে আমি ভালোবাসি কিনা? শুধু এটুকু জানি ওই মুখটা আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। একটা অদৃশ্য হাত পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে যেন সামনে এগিয়ে দিল। আমি আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে রুশানিয়াকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রাখলাম। প্রচ্ছন্ন আলোর এক মোহময় উষ্ণ সমুদ্র আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো বাস্তব পৃথিবী থেকে যোজন যোজন দূরে! ওর পাতলা কোমরের ওপর আমার একটা হাত নেমে এসেছে। এতো নিখুঁত, সুন্দর, বঙ্কিম কাঠামো আমি এর আগে কখনো ছুঁয়েছি বলে মনে পড়ে না। আমার চামড়ার নিচের রক্তকণিকা শিস দিচ্ছে, গান গাইছে, মন চাইছে এই মুহূর্তটা যেন কোনদিন শেষ না হয়! 

—‘শুভ্রা কি এখনো উপস্থিত আছে?’ জানতে চাইলাম। 

রুশমি একবার চোখ মেলে তাকালো সামনে, মাথা নেড়ে বলল, ‘আছে।’ 

—‘আমাদের কি অ্যাকটিং কন্টিনিউ করা উচিত?’ 

—‘উচিত।’ 

আমি যে এতো ভালো অ্যাকটিং করতে পারি তা সজ্ঞানে উপলব্ধি করলাম তখন, যখন রুশানিয়ার নরম দুটি ঠোঁট সম্পূর্ণরূপে আমার ঠোঁটের আয়ত্তে চলে এলো, যখন ওর বিস্ফোরন্মুখ উত্তপ্ত নিশ্বাসে আমার নিশ্বাস মিশে গেলো, পাখির পালকের মতো নরম পা’জোড়া অনায়াসে উঠে এলো আমার স্নিকারসের ওপর, যখন ওর হৃদযন্ত্রের স্পন্দন আমার রক্তের স্পন্দনের সাথে এক অদৃশ্য কাটাকাটি খেলায় মত্ত হলো, ঠিক তখনই গভীরভাবে অনুভব করলাম যে, আমি এক দারুণ দক্ষ অভিনেতা এবং এই অভিনয় টুকুর বিনিময়ে আমি আমার সারাটা জীবন বিক্রি করতে রাজি আছি। মিথ্যে অভিনয় যদি এত সুন্দর হয় তাহলে এই মিথ্যে নিয়েই কাটিয়ে দিতে চাই বাকি জীবন। 

জাহিদের উপস্থিতি অস্বস্তিতে ফেলে দিল। বিচ্ছুটা প্যাটিওর সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছে কখন কে জানে। হঠাৎ বলতে শুনলাম, ‘ও গড! মাই আইজ আর কাভারড! আই হ্যাভ সিন নাথিং, ট্রাস্ট মি!’ 

আমি রুশমিকে ছেড়ে দিয়েছি। রুশমি এক দৌড়ে পালিয়ে গেছে বাড়ির ভেতরে। জাহিদের দিকে একটা ঘুষি তাক করে ধমকে উঠে বললাম, ‘আসার আর সময় পেলে না? পারফেক্ট টাইমিং! অ্যাসহোল!’ 

জাহিদ মুখ বাঁকালো, ‘গেট আ রুম গাইজ!’ 

প্যাটিওতে এখন জাহিদ ছাড়া কেউ নেই। বৃষ্টির ধার তখনও কমেনি। জাহিদ এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে বাস্কেট বল নিয়ে এসেছে। জুতো খুলে খালি পায়ে নেমে গেছে উঠোনে। মাটিতে বল ড্রপ করে বলছে, ‘চলো খেলি।’ 

ব্যাকইয়ার্ডে একটা পোর্টেবল বাস্কেটবল হুপ আছে। বছর চারেক আগে জাহিদের জন্মদিনে পাপা উপহার দিয়েছিল। আমি কোনও কথা না বলে পা থেকে জুতো জোড়া খুলে নিলাম। টি-শার্ট খুলে বৃষ্টির জল নিংড়ে বের করলাম। বৃষ্টিতে আমার আর ভিজতে ইচ্ছে করছে না। কারণ আমার ঠোঁটে এখনো রুশানিয়ার ঠোঁটের স্বাদ লেগে আছে। আমি চাই না ওই স্বাদ, গন্ধ আর স্পর্শ বৃষ্টিজলে ধুয়ে মুছে যাক। কিন্তু জাহিদটাও নাছোড়বান্দা। জোরজার করে খালি গায়েই আমাকে নামিয়ে ছাড়ল খোলা আকাশের নিচে ব্যাকইয়ার্ডে এসে দেখি রুশমির বন্ধুরা সব এখানেই জড়ো হয়েছে। কাদা কাদা হয়ে গেছে সারা উঠোন। ছোট চুলের মেয়েটা আমার কোলবালিশের মতো পেটমোটা পাঞ্চিং ব্যাগে ঘুষি মেরে যাচ্ছে একটার পর একটা। ওর হাতে রেসলিং গ্লভস, পরনে কালো রংয়ের স্পোর্টস ব্রা আর জিন্সের শর্টস। শুভ্রাকে দেখতে পাচ্ছি না আশেপাশে কোথাও। রুশমি বেজমেন্টের ওয়াকআউট দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে বাকি বন্ধুদের সাথে। ওই অংশটুকুতে ছাদ আছে বিধায় বৃষ্টির জল ওদের ছুঁতে পারছে না। কিন্তু রুশমির জামা অনেকখানি ভিজে গেছে। মাথার নীল রংয়ের হিজাবটাও ভেজা। আমার দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিল ও। চোখ সরিয়ে নিলাম আমিও। শরীর আর মনজুড়ে কেমন যেন আড়ষ্টতা! আড়ষ্টতার পাশাপাশি একটা ভালোলাগার সুখী শিহরণ বয়ে যাচ্ছে বুকের পাঁজরের খাঁজে খাঁজে। এই অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নতুন! 

ছোট চুলওয়ালা মেয়েটা আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘হেই রেসলার, লেটস ফাইট! কাম অন! গিভ ইট আ শট!’ 

—‘আই ডোন্ট ফাইট উইদ গার্লস।’ বাস্কেটে বল শ্যুট করে বললাম। 

মেয়েটা মনে হয় একটু রেগে গেছে। ক্যাটক্যাট করে বলল, ‘হোয়াই? ডু ইউ থিংক মেন আর স্ট্রংগার দ্যান উইমেন?’ 

—‘নো …. দ্যাটস নট দ্যা পয়েন্ট।’ 

–‘দেন হোয়াই ডোন্ট ইউ ফাইট উইদ দেম?’ 

—‘আউট অফ রেস্পেক্ট আই গেস!’ 

—‘হোয়াট?’ 

—‘ইউ হার্ড মি! ডিডন’ট ইউ?’ 

রুশমি 

জাহিদের সামনে ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েছিলাম। খেয়াল করিনি কখন সে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কণ্ঠস্বরটা কানে এসে লাগতেই পড়িমরি করে দৌড় দিলাম ভেতর বাড়ির দিকে। শুভ্রা ড্রইং রুমে বসে আছে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। লক্ষ্য করলাম তার ফর্সা মুখের চামড়ার ভাঁজে ঝিলিক দিচ্ছে তেজ। কুঞ্চিত কপালে স্পষ্ট হয়ে আছে নীল রগ। নাকের ছিদ্রপথ দিয়ে যেন ড্রাগনের মতো অগ্নি স্ফূলিঙ্গ বেরোচ্ছে। 

—‘কাজটা ঠিক করলি না। তুই সেদিনকার মেয়ে হয়ে আমার সাথে পাল্লা দিচ্ছিস?’ 

—‘পাল্লা দেয়ার কী আছে? আজব!’ 

—‘অনেক হয়েছে! এবার তুই বুঝবি কত ধানে কত চাল। শিহাব আমার না হলে তোরও হবে না কোনদিন। জেনে রাখ। আমি তোদের দুজনকেই আচ্ছা শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব।’ এটুকু বলে শুভ্রা আঙুলে তুড়ি বাজালো, যেভাবে সব সময় বাজায়, ‘দেখে নিব তোদেরকে! 

কথাটা বলে শেষ করে ও ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে গেলো। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে ঢালল গলায়। ভ্রু কুঁচকে কী যেন গভীরভাবে চিন্তা করল কিয়ৎক্ষণ। তারপর গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। আমি পুরো দৃশ্যটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলাম। বলতে নেই শুভ্রার এই রূপ আমাকে মনে মনে একটু ভয় পাইয়ে দিয়েছে। আল্লাহ জানে আমাদেরকে শিক্ষা দেবার নাম করে এই মেয়ে কী অঘটনটাই না ঘটিয়ে বসে। 

এই ভয় অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না আমার মাঝে। কারণ আজকে আমার মন ডুবে আছে এক মনোরম অনুভূতির সাগরে। প্রথম প্রেমের অমৃত, বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে মাখো মাখো হয়ে মিশে আছে মনের সব কটা দেয়াল জুড়ে। স্পর্শগুলো এখনো জীবন্ত! চকলেটের স্বাদের মতো মিষ্টি আর মসৃণ! 

আমার বন্ধুদেরকে পাওয়া গেলো বেজমেন্টে। ব্যাকইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। হেইলি পেটমোটা ঝুলন্ত বস্তায় পাঞ্চ করে যাচ্ছে অবিরত। বৃষ্টির জল ওকে ছিঁড়েখুরে একাকার করে দিচ্ছে একদম। কিন্তু সে নির্বিকার। স্কুলে নাম্বার ওয়ান রেসলার ছিল। ছেলেদের কুপোকাৎ করতে মিনিটও লাগতো না। দেখতে হ্যাংলা পাতলা হলে কী হবে? শরীরে একেবারে অসুরের শক্তি! লিও বলল, ‘আমার মনে হয় তোমার হাজবেন্ড আমাকে পছন্দ করে না। তুমি কি আমাদের ব্যাপারে কিছু বলেছ তাকে?’ 

আমি ব্যাক্কলের মতো চেয়ে রইলাম ওর মুখের দিকে। বুঝতে পারছি না শিহাবের ঠিক কোন ব্যবহারটা ওকে এমন ভাবনা ভাবতে বাধ্য করেছে। লিও আমার নির্বাক (বোধহয় কিছুটা নির্বোধও) মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ভস করে একটা হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল, আলতো গলায় বলল, ‘রুশ হোয়াই আর ইউ সো সিম্পল অ্যান্ড ইনোসেন্ট? প্লিজ ওয়েক আপ! ইটস টাইম টু গেট স্মার্ট অ্যাবাউট লাইফ!’ 

জানি না লিও কথাগুলো দ্বারা আদতে কী বোঝাতে চাইল। যে মানুষটাকে আমি এতো করে চাই, যে মানুষটাকে আমি আল্লাহর নাম নিয়ে নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছি, তার কাছ থেকে সত্য লুকোনোর মতো হঠকারীতা আমি করতে পারব না মরে গেলেও। তাছাড়া লুকোবো কোন যুক্তিতে? আমার দিক থেকে তো কোন দোষ বা দুর্বলতা ছিল না! কী কান্ড দ্যাখো! এই মুহূর্তে আমি কোন জটিল ভাবনা ভাবতেই পারছি না। একটু আগের টুকরো স্মৃতি বারবার মনের দরজায় এসে ঘণ্টা বাজিয়ে যাচ্ছে। আমি অকারণে শিহরিত হচ্ছি। বুকের খাঁচায় ফরফর করে একটা রঙিন প্রজাপতি ইচ্ছেমতো উড়ে বেড়াচ্ছে সেই তখন থেকে। ইশ! আজকের দিনটা এতো সুন্দর কেনো? এই মেঘমেদুর আকাশের নিচে, বৃষ্টি জলে ভেজা পৃথিবীটা যেন মিটমিট করে শুধু হেসেই যাচ্ছে। সুবহানআল্লাহ! বেঁচে থাকাটা বড়ই সুন্দর! 

শিহাব ব্যাকইয়ার্ডে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মাঝে হেইলিকে বলতে শুনলাম সে শিহাবের সাথে কুস্তি লড়তে চায়। শিহাব সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে মেয়েদের সাথে ফাইট করে না। কথাটা জেনে আমার ভালো লেগেছে। কিন্তু হেইলি বেশ আপসেট হয়ে গেছে। রেগেমেগে ফিরে এসেছে বাড়ির ভেতর। আর কোন কাজ না পেয়ে মাথা মুছতে আরম্ভ করেছে টাওয়েল দিয়ে। লিওকে দেখলাম দুই ভাইয়ের সাথে খেলতে নেমে গেছে উঠোনে। আর সেই মুহূর্তে আমার কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ল যে শিহাব সত্যিই লিওকে . পছন্দ করে না। কারণ লিও উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে জায়গাটা থেকে সরে গেছে। গম্ভীর মুখ নিয়ে হেঁটে এসেছে আমাদের দিকে। আমি ওর চোখে চোখ রাখতে পারছি না কেনো যেন। বুক কাঁপছে ধুকপুক করে। আমার ঠিক পাশে এসে এক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়ালো সে। 

—‘আমার ফেইসে কি কিছু হয়েছে?’ বাংলায় প্রশ্ন করল, ধারালো গলায়। আমি ওর বৃষ্টি ভেজা মুখের দিকে চেয়ে বললাম, কী হবে? 

—‘কিছু লেগে আছে?’ 

—‘বৃষ্টির পানি।

—‘অন্য কিছু?’

–‘না।’ 

—‘তাহলে তোমার বান্ধবীরা আমার দিকে ওরকম হা করে তাকিয়ে আছে কেনো?’ 

—‘আজাইরা কথা বলার আর জায়গা পাও না?’ 

—‘আজাইরা না। সিরিয়াসলি! তুমিও তো সেই তখন থেকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছ। কারণটা কী? 

মেজাজটা কেমন লাগে? ফোঁস করে একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই তোমার দিকে তাকিয়ে থাকব। যাও ভাগো! ফালতু!’ 

ওর ঠোঁটে এখন একটা ফিচেল মার্কা হাসি, ‘কে ফালতু?’ 

—‘তুমি!’ 

—‘একটু আগে তো এই ফালতু মানুষটাকে…’

কেউ যেন ম্যাচের কাঠিতে ঘষা দিয়ে আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল, ‘তুমি না একদম বাজে। তোমার উপকার করতে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। শুভ্রার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অ্যাকটিং করেছি। এর চেয়ে বেশি কিছুই না।’ 

শিহাব ঠোঁট উল্টে বলে, ‘হুম অ্যাকটিং, ইউ আর আ গুড অ্যাকটর দো!’ ইংরেজি বাক্যটা শুনে স্টেসি ঘুরে তাকিয়েছে। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে শিহাবকে বললাম, ‘ওপরে যাও, মাথা মুছো। নইলে নির্ঘাত জ্বর আসবে।’ 

—‘আমার জ্বর আসলে তোমার কী?’ এখন ওয়াকআউট ডোরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে শিহাব। ওর চিবুক উঁচু। চোখে কৌতূহল সমেত হাসির রেশ। বুঝতে পারছি সে আসলে আমার মনের খবর যাচাই করতে চায়। জীবনেও বলব না! তোমাকেই প্রথমে হার মানতে হবে শিহাব! আমি কিছুতেই হার মানব না! মরে গেলেও না! 

—‘আমার কী হবে? কিছুই হবে না। 

—‘তাহলে?’ 

—‘উফ! তুমি এতো বিরক্তকর কেনো?’ 

—‘আমাকে তোমার বিরক্ত লাগে?’ 

—‘ভীষণ!’ 

—‘কেনো?’ 

—‘জানি না!’ 

—‘কেনো জানো না রুশানিয়া?’ 

—‘কেনো জানি না তা জানি না! প্লিজ যাও!’ 

—‘কেনো জানি না, তা জানি না!’ 

আমার কথাগুলো শুধু মক করল ও। আর কিছু বলতে শুনলাম না। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। ওর চোখের দিকে তাকাতে আমার বড়ই ভয়। যা হবার হোক ভাই ওই আত্মসম্মানটাই সবচেয়ে দামি আমার কাছে। না তাকিয়েও টের পেলাম ও হেঁটে হেঁটে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। আমার বন্ধুরা সন্ধ্যে সাতটার দিকে বিদায় নিল। শিহাব ডিনার করল না। আমি আর জাহিদ ডিনার সেরে নিলাম আটটার ভেতর। সে রাতে ঘুম এলো না কিছুতেই। ড্রইং রুমের সোফায় ঠায় বসে রইলাম। পরদিন খুব সকালে কাজ। জর্জ ওয়াশিংটনে আমার অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। নেক্সট টিউজডে থেকে ক্লাস শুরু। অনেকদিন পর আবার স্কুল শুরু করার আনন্দে আমি আপ্লুত এবং উত্তেজিত। এতো রকম ব্যস্ততার ভেতরেও আমার একটাবার ওর কাছে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। মনটা মাছির মতো ভনভন করে ওই একটা জায়গায়ই উড়ে বসছে বারেবারে। রাত গভীরে দোতলা থেকে ভেসে আসা পিয়ানোর মোহময় সুর আমার বুকের মধ্যে এক অদম্য তৃষ্ণার সঞ্চার করছে। মন চাইছে সমস্ত মান, সম্মান আর অহংকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওপর তলায় ছুটে যাই। একবার ওর প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে কান পেতে শুনি, ওখানে খুব গভীরে হঠাৎ হঠাৎ কেউ আমার নাম ধরে ডেকে ওঠে কিনা! 

ভেবে ভেবেই রাত পার হয়ে গেলো। সকালে ওর সাথে দেখা হলো না। কাজ থেকে ফিরে এসে দেখি সে বাড়িতে নেই। তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। আমি জানি কোথায় গেলে ওকে পাওয়া যাবে। সেই জায়গায় তো আমারও রোজ বিকেলে বই পড়তে যাবার কথা। আমি বইসহ কিছু টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিলাম। যেভাবে আমরা তিনবোন মাঝে মাঝে পিকনিকে যাই, ঠিক সেভাবে। ঝুড়ির ভেতর সাজালাম ফল, কুকিজ, কেক আর চায়ের ফ্লাক্স। সাথে কাপ পিরিচ। 

বেরোবার মুখে দেখি শিহাবের ব্ল্যাক কালার পোরশে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাইনিং এর জানালায় চোখ পড়তেই দেখতে পেলাম দৃশ্যটা। সাথে জাহিদও আছে। কী করব বুঝতে পারছি না। বেরিয়ে পড়ব? নাকি ওদের জন্য অপেক্ষা করব? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি আর ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে আছি জানালার সামনে। এর মাঝেই দেখলাম জাহিদ বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। ওর পরনে একটা হাঁটু ছোঁয়া হাফপ্যান্ট আর সবুজ রংয়ের পাতলা টি-শার্ট। জাহিদটার খাওয়া দাওয়ার প্রতি অতিমাত্রার অনীহা। শরীর শুকনা কাঠি। দেখলে বোঝা যায় না বয়স উনিশ। মনে হয় খুব বেশি হলে পনের হবে। আমার শাশুড়ি আজ সকালেও ফোন দিয়ে বলেছে জাহিদকে যেন রোজ দুটা করে ডিম দেয়া হয়। কিন্তু এতো বড় ছেলেকে কি জোর করে খাওয়ানো সম্ভব? এই ছেলে ডিমের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া খাওয়া দাওয়া নিয়ে আদিখ্যেতা করার মতো যথেষ্ট সময় আমার হাতে নেই। বাইরে কাজ করে এতবড় বাড়ির দেখাশোনা করাটা চাট্টি খানি কথা নয়। উইকেন্ডে শিহাব ইয়ার্ডের টেক কেয়ার করে। কিন্তু বাড়ির ভেতরটা তো আমাকেই সামলাতে হয়। শুধু ড্রইং আর ডাইনিং ভ্যাক্যুম করতেই চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগে যায়। কিচেন ক্লিন করা তো ইতিহাস! থালা বাসন ধোয়া, লন্ড্রি করা, কাজের অভাব আছে নাকি সংসারে? জাহিদের ঘর গত দেড়মাস ধরে ঝাড়া মোছা হয় না। সে বরাবরই একটু ময়লা থাকতে ভালোবাসে। 

—‘কী হয়েছে?’ 

আমার কুঁচকে থাকা ভ্রুজোড়ার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল জাহিদ। 

—‘কিছু না। তোমরা কী করছিলে? 

—‘কায়াকিং।’ 

গাড়ির র‍্যাকে লাগানো ছোট হলুদ রংয়ের নৌকোটা এতক্ষণে নজরে এলো আমার। 

—‘কোথায় গিয়েছিলে?’ 

—‘বার্ক লেক।’ 

—‘বাহ! বেশ তো!’ 

—‘ভাবি শোনো, আজকে রাত বারোটার সময় আমরা একটা সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করেছি।’ 

জাহিদ দরজার সামনের টুলের ওপর বসে জুতো খুলতে খুলতে কথা বলছিল। আমার চোখ জানালা থেকে সরছে না। কালো গাড়িটা রাস্তার ধারে প্যারালাল পার্কিং করে রাখা হয়েছে। গাড়ির চালক দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে মাত্র। জাহিদের মতো তার পরনেও হাঁটু ছোঁয়া ছাই রংয়ের হাফপ্যান্ট। সাদা টি-শার্ট। চোখে সানগ্লাস। শেষ বিকেলের হালকা রোদের ভেতর দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে আসা মানুষটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আমার হঠাৎ মনে হলো সে আসলে রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটছে না, হাঁটছে আমার হৃৎপিণ্ডের জমিনের ওপর দিয়ে। আমার হৃৎপিণ্ড ওই চরণস্থাপনের ভারে নিষ্পেষিত হয়ে চলেছে অবিরাম। আমি ভুগছি হৃদয়ের এক গভীরতর অসুখে। এই অসুখ থেকে আরোগ্য লাভের উপায় কী, কে জানে! 

—‘সারপ্রাইজ পার্টি?’ প্রশ্ন করলাম, অনেকটা অন্যমনস্ক গলায়। 

শিহাব বাড়ির দরজায় চলে এসেছে। আমি দরজার নব ঘোরানোর শব্দ পাচ্ছি। আমার শ্বাস-প্রশ্বাসে ক্রমেই এক অস্বাভাবিকতা ভর করছে। একটা মানুষ কী করে এতো উদ্বেগ আর চাঞ্চল্যর সৃষ্টি করতে পারে প্রতিবার? ভাবতে গিয়ে শুধুই অবাক হই। দরজা খুলে সে ভেতরে ঢুকেছে। কপালে আর নাকের ভাঁজে চিকচিক করছে ঘাম। আমাকে দেখে একটা সৌজন্য হাসি হাসলো। চোখে ‘থেকে খুলে নিল সানগ্লাস। 

—‘আজকে সাশার বার্থডে। সো, আমি আর ভাইয়া ঠিক করেছি ওর জন্য একটা সারপ্রাইজ পার্টি দেব। ওর বাবা এখন আউট অফ টাউন। বেচারি একা একা করবে কী বলো?’ 

থমকে গেলাম। কেউ যেন ভারী লোহার হাতুড়ি দিয়ে ঘটাং করে আঘাত করেছে বুকের পাঁজরে। চিলিক মারা একটা ব্যথার সৃষ্টি হয়েছে জায়গাটায়। দরজার সামনে একটাই টুল। জাহিদ উঠে যাবার পর শিহাব ওই টুলের ওপর বসেছে। একটু ঝুঁকে জুতোর ফিতে খুলছে। আমাকে এক নজর দেখে নিয়ে বলল, ‘কয়েকজন গেস্ট আসবে বাসায়। খাবার দাবার আছে? নাকি বাইরে থেকে অর্ডার করব?’ 

আমি হাতে ধরা ঝুড়িটার দিকে একবার তাকালাম। ওখানে পিকনিকের সরঞ্জাম। বই, ফলমূল, স্ন্যাক্স আর চায়ের ফ্লাক্স। শুধু শুধু এসব আয়োজন করেছি। আমার কথা তো কেউ ভাবেনি। দুই ভাই কায়াকিং করে বাড়ি ফিরেছে বান্ধবীর জন্মদিনের উৎসব পালন করার গ্র্যান্ড প্ল্যান সঙ্গে নিয়ে। আমার যে বিকেল বেলা একটু নিরিবিলিতে খোলা আকাশের নিচে বসে বই পড়তে ভালো লাগে, প্রিয়জনের সাথে টুকিটাকি গল্প করতে ভালো লাগে এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আছে কি কারো? 

—‘তুমি কোথাও যাচ্ছিলে?’ জাহিদ আমার হাতে ধরা ঝুড়িটার দিকে চেয়ে ক্যাবলাকান্ত হাসি দিয়ে প্রশ্ন করল। জাহিদকে মাঝে মাঝেই আমার খুব ব্রেইনলেস বলে মনে হয়। বিশেষ করে এই ক্যাবলাকান্ত হাসিটা যখন দেয় তখন কেনো যেন খুব রাগ ধরে। শিহাবের মতো ধারালো ব্যক্তিত্ব ওর হয়নি হয়তো আরেকটু বয়স বাড়লে হবে। বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে বোধহয় ব্যক্তিত্ব জিনিসটা একটু বেশি বয়সেই ধরা দেয়। এটা আমার মতামত। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে এমন কোনও কথা নেই।

আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ড্রইংরুমে চলে এলাম। ঝুড়িটা নামিয়ে রাখলাম সেন্টার টেবিলের ওপর। সোফায় বসে শুনতে পেলাম দুই ভাই সারপ্রাইজ পার্টির প্ল্যান করে চলেছে এখনো। শিহাবের মতে সাশার চকলেট চিপ ফ্লেভার পছন্দ। জাহিদ এতে দ্বিমত পোষণ করছে। তার ধারণা চকলেট চিপ নয়, সাশার পছন্দ ওরিও কুকিজ অ্যান্ড ক্রিম। এই বিষয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে বাজি ধরাও হয়ে গেলো। যে জিতবে সে বিশ ডলার পাবে। এসব আলোচনার সবটাই আমার কানে আসছে। নিজেকে অবাঞ্ছিত বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বাড়ির সাথে, এ বাড়ির মানুষগুলোর সাথে আমার বিন্দুমাত্র যোগসাজশ নেই। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সাশার ফ্রেকলস ওয়ালা মুখ, নুডলসের মতো সোনালী কোঁকড়া চুল, সবুজাভ চোখ, মাড়ি দেখানো হাসি। সেই সাথে আমি দেখতে পাচ্ছি ওই দৃশ্যটা, খাবার টেবিলে শিহাব আর সাশা পাশাপাশি বসে আছে। অকারণেই সাশা শিহাবের গলা জড়িয়ে ধরে… থাক আমার কী? আমি তো চলেই যাব এই বাড়ি ছেড়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি হয়তো দু তিন সপ্তাহের মধ্যেই ফিরে আসবে। তারপর এই মিথ্যে সংসার সংসার খেলা ফুরিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। সব খেলাই একসময় ফুরিয়ে যায়। কোনোটা আগে, কোনোটা পরে! আমার শরীর খারাপ লাগছে। তলপেটে ব্যথা। আজ সারারাত থাকবে ব্যথাটা। পেইন কিলার খাবার পরেও যাবে না। মুখভর্তি অরুচি। দুপুরে কফি ছাড়া কিছুই খেতে পারিনি। এখন বমি বমি ভাব হচ্ছে। 

শিহাব ড্রইং রুমে এসেছে, ‘কিছু বললে না যে?’ 

কেনো যেন খুব রাগ হয়ে গেলো আমার। একদম সাপের মতো ফোঁস করে ফণা তুলে বললাম, ‘কী বলব?’ 

শিহাব হকচকিয়ে গেছে আক্রমণাত্মক কথার ধরণে। আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে… খাবার অর্ডার করব?’ 

—‘কয়জন আসছে?’ 

—‘দশ বারো জন। 

—‘আমি সারাদিন কাজ করে একটু আগে বাড়ি ফিরেছি। প্রচন্ড টায়ার্ড। তুমি কি আমাকে এখন কিচেনে গিয়ে খাবার তৈরি করতে বলছ?’ 

—‘না না, সেরকম কিছু বলিনি জাস্ট তোমার ওপিনিওনটা জানতে চাইলাম। ওকে, আমি খাবার অর্ডার করছি; স্যরি টু বাগ ইউ…’ 

জাহিদ উপস্থিত হলো হঠাৎ, 

—‘ভাবি চলো, পার্টিসিটি যাব।’ 

—‘কেনো? পার্টিসিটি কেনো?’ তেড়েমেড়ে প্রশ্ন করলাম। 

—‘ঘর সাজাতে হবে না? আমি ওসব ভালো বুঝি না। মম তো নেই বাড়িতে। তুমিই চলো সাথে।’ 

দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম, ‘আমি যাব না!’ 

শিহাব আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চাইল, ‘তোমার কী হয়েছে?’ 

আমি চুপ করে সোফার পিঠে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। দুই ভাই বিস্ময়বিদ্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার এখন কান্না পাচ্ছে কেনো যেন। অশান্তিতে বুক ভার হয়ে আছে। কিছুই ভালো লাগছে না। হে আল্লাহ! এমন কেনো লাগছে আমার? একটা বোবা কালা হতভাগ্য মেয়েকে এতো ঈর্ষা করা কি মোটেও উচিত কাজ হচ্ছে? আমি কি মনুষ্যত্ববোধ হারিয়ে ফেলছি দিনকে দিন? এমন আকাশচুম্বী হীনম্মন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকব কী করে? 

একটা বড় নিশ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। উঠে দাঁড়িয়ে জাহিদকে বললাম, ‘আচ্ছা চলো, যাই।’ 

বেরিয়ে এলাম জাহিদের সাথে। শিহাব রয়ে গেলো বাড়িতে। পার্টিসিটি থেকে আমরা পিংক আর গোল্ডেন কালারের বেলুন কিনলাম। সাথে কিনলাম ট্যাসেলস, ব্যানার, বার্থডে গার্ল লেখা টিয়ারা। বাসকিন রবিন্সে গেলাম আইসক্রিম কেক কিনতে। চকলেট চিপ এবং কুকিজ অ্যান্ড ক্রিম, দুটা ফ্লেভারই কেনা হলো। সাশার জন্য দুই ভাইয়ের দরদ দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় হচ্ছে। আমি না পারছি কিছু বলতে, না পারছি সইতে। বাড়ি ফিরে এসে দেখি শিহাবের কয়েকজন মিউজিশিয়ান ফ্রেন্ড এসেছে। বেজমেন্টে জোরেশোরে প্র্যাকটিস চলছে। 

আমি আর জাহিদ ডাইনিং রুম সাজালাম। সোনালী আর গোলাপি ডেকোরেশনে ঘরটা বেশ জাঁকজমক হয়ে উঠল কিছুক্ষণের মাঝেই। শিহাবের দেখা পাওয়া গেলো না আর। নেক্সট উইকে খুব সম্ভবত ওদের একটা কনসার্ট আছে। এই সপ্তাহেই হবার কথা ছিল। কোন কারণে পিছিয়ে গেছে। জাহিদ কাজ করার সময় বেশ কয়েকবার প্রশ্নটা করেছে, ‘তোমার কি মন খারাপ?’ 

—‘না, মন খারাপ কেনো? ঠিক আছি!’ 

হাসার চেষ্টা করে ক্ষীণ গলায় উত্তর দিয়েছি। যদিও আমার চোখমুখ ফেটে পড়ছে ভিতরকার রাগ এবং উত্তেজনায়। মন অশান্তিতে বিষাক্ত হয়ে আছে। মনে মনে যার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম সারাদিন সে মানুষ দিনশেষে একটা বার আমার খোঁজ পর্যন্ত নিল না। বাড়ি ফেরার পর থেকেই জন্মদিনের উৎসব নিয়ে মত্ত হয়ে আছে। অথচ আমি কিনা কত আকাশ পাতাল ভেবেছি। মনের গুমোট আকাশে টুকরো মেঘের মতো নানামুখী ভাবনারা ভেসে ভেসে ঝরে গেছে বৃষ্টি হয়ে। কখনো কখনো ঝিলিক দিয়েছে আশার আলো। মনে হয়েছে হয়তো শুভ্রাকে রিজেক্ট করার পেছনের কারণটা আমি। আমার যেমন ওকে ভালো লাগছে, ওরও হয়তো আমাকে ভালোই লাগছে। তাই শুভ্রাকে জীবন থেকে সরিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা বোধ করেনি সে। এসব ধারণা ভুল। ওর পৌনঃপুনিক উদাসী আচরণই প্রমাণ করে যে আমার প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। 

ঘর সাজানো হয়ে গেছে। আমি ওপরে উঠে এসেছি। গোসল করার জন্য দিনে একবার আমাকে দোতলায় আসতেই হয়। নিচতলায় কোনও ফুলবাথরুম নেই। কাজ থেকে ফিরে এসেই পিকনিকে যাবার জন্য তাড়াহুড়া করে তৈরী হয়ে নিয়েছিলাম। শাওয়ার নেয়া হয়ে ওঠেনি 

শিহাবের বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে। চাদর কুঁচকানো, বালিশ পড়ে আছে মেঝেতে। ডেস্কের ওপরে কয়েকটা ছড়ানো ছিটানো কাগজ। খোলা জানালা দিয়ে ছুটে আসা বেলাশেষের ঠান্ডা বাতাসে খসখস শব্দে উড়ছে কাগজগুলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেড কাভারটা টেনেটুনে ঠিক করলাম। আগপিছ কিছু চিন্তা না করেই শুয়ে পড়লাম বিছানার ওপর। সারাশরীর জুড়ে অবসাদ। বুকের ওপর বিষণ্নতার ভারী পাথর। মুখ বিস্বাদ। কতক্ষণ কেটেছে জানি না। দরজাটা কেউ একজন খুলেছে আস্তে করে। বাইরে সন্ধ্যা নেমে গেছে তখন। ঘর অন্ধকার। ঠোঁটে নোনতা স্বাদ আর কানের ডগায় জলের ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে বুঝলাম যে এতক্ষণ আমি কেঁদেছি নিঃশব্দে। একটা লম্বা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে বিছানার দিকে। আমি বাতাসে আমার প্রিয় মানুষটার দেহের ঘ্রাণ পাচ্ছি। আমার হৃৎপিণ্ডের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

মাথার কাছে এসে থেমে পড়ল মূর্তিটা। ল্যাম্পশেড জ্বালালো। হলুদ বাতি ধারালো ছুরির মতো আঘাত হানলো আমার চোখে। দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললাম। 

—‘তুমি ঠিক আছ? 

গম্ভীর গলার প্রশ্ন। 

—‘হুম।’ 

—‘শিওর?’ 

চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিলাম। শিহাব বিছানার পাশে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে, তীক্ষ্ণ চোখে। শোয়া থেকে উঠতে বসতে বসতে বললাম, ‘আমি আসলে শাওয়ার নিতে এসেছিলাম। একটু সিক লাগছিল তাই শুয়ে পড়েছি। স্যরি।’ 

শিহাব ব্যস্ত গলায় বলল, ‘শুয়ে থাকো। সমস্যা নেই। উঠছ কেনো? 

—‘উঠে যাই, গোসল করব।’ মেঝেতে পা জোড়া নামিয়ে দিয়ে বললাম।

—‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’ 

—‘না।’ 

—‘বাট ইউ লুক পেইল!’ 

—‘তেমন কিছু না।’ 

—‘তেমন কিছু না মানে কী? কী হয়েছে?’ 

আমি চোখ তুললাম। ল্যাম্পশেডের ফিকে আলোয় ওর মুখখানা আবছা হয়ে আছে। গম্ভীর কাটাকাটা ধারালো মুখশ্রীতে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত বাঙময় চোখ। সাধারণত ওই চোখের দিকে তাকালে আমার পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে আসে, মানসিক জ্বালা পোড়া কমে যায়। কষ্টগুলো আর কষ্ট বলে মনে হয় না। কিন্তু আজকে আমার বুকে রাগ আর অভিমান গিজগিজ করছে। যাও না তুমি তোমার সাশার কাছে, জন্মদিন পালন করো, হইচই আর ফূর্তি করো। আমি বাঁচি, মরি তাতে তোমার কী এসে যায়? 

— ‘ঠিকই আছি।’ দায়সারা উত্তর দিলাম। 

—‘কিন্তু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না ঠিক আছ। চলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’ 

খুব তাড়া দিয়ে কথাটা বলে উঠল সে। যেন এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে না গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অথচ ডাক্তারের কাছে যাবার মতো কোনও বিষয়ই না এটা। এই ছেলেকে এখন বোঝাই কী করে! কী মুসিবৎ! 

—‘ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। আমি শাওয়ার নিব।’ 

কথাটা বলে শেষ করে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা। যাকগে, রাতের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। এসব নিয়ে অত চিন্তার কিছু নেই। 

—‘রুশানিয়া!’

—‘হুম।’ 

—‘চলো ডাক্তারের কাছে। তোমাকে দেখে কেমন যেন লাগছে।’ 

আমি ঘুরে তাকালাম, ‘কেমন লাগছে? কুৎসিত?’ 

ও হতভম্ব হয়ে গেছে প্রশ্ন শুনে, ‘এটা কেমন কথা?’ 

—‘তাহলে কী বলতে চাইছ?’ 

—‘বলতে চাইছি তোমার যদি শরীর খারাপ লাগে দেন ইউ শুড টক টু ইওর ডক্টর। স্বাস্থ্য নিয়ে হেলাফেলা করা উচিত না।’ 

—‘আই অ্যাম অ্যাবসোলিউটলি অলরাইট।’ 

—‘ইউ ডোন্ট সিম অলরাইট।’ 

—‘হয় এরকম আমার প্রতিবারই ফার্স্ট ডে’ তে… ইউ নো।’ 

কী বলব খুঁজে পাচ্ছি না। আমতা আমতা করছি। ও ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে আমার দিকে। আমার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে, লজ্জাও। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর ওর ভ্রু জোড়া সহজ হলো। একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল বাদামি চোখের তারায়। তারপর চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিলো অন্যদিকে। আমি আর কোনও কথা না বলে বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। 

শিহাব 

ওয়েল, ইটস আ লিটল বিট অকওয়ার্ড। কারণ মেয়েলি ব্যাপার নিয়ে এর আগে কোনদিন কোনও মেয়ের সাথে আমার আলাপ হয়নি। রুশমি কথাটা বলে ফেলার পর ভীষণ বিব্রত বোধ করছিলাম। প্রত্যুত্তরে ঠিক কী বলা যায়, কী বলা উচিত বুঝতে পারছি না। ও জায়গাটা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সরে পড়ায় বেঁচে গেলাম। তবে মেয়েটাকে এতটা অসুস্থ এর আগে কখনো দেখিনি। চোখ সাদা, ঠোঁট শুকনো, ত্বক রক্তশূন্য আর ফ্যাকাশে। ওই চেহারা দেখে মন খারাপ হয়ে গেছে। ওপরে এসেছিলাম গিটার নিতে। ব্যান্ডের ছেলেরা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কিন্তু এখন আমার ওদের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে যে কোনও অজুহাতে সব কটাকে বিদায় করে দেই। ক্যানসেল করে দেই বার্থডে পার্টি। সাশার এ বছর আঠারো পূর্ণ হলো। বেচারির বাবা গেছে নিউইয়র্ক, একটি জরুরি কাজে। আজকের রাতটা সে বাড়িতে একদম একা কাটাবে। অথচ আঠারো বছরের জন্মদিন প্রতিটি মানুষের জীবনেই স্মরণীয় হওয়া বাঞ্ছনীয়। না, ভুল বললাম আসলে বাঞ্ছনীয় কিছু নয়। জন্মদিন পালন না করেও অসংখ্য মানুষের জীবন কেটে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। এসব বাহুল্যতায় পৃথিবীর কিছু এসে যায় না। তবুও সাশা বড়ই দুঃখী একটা মেয়ে। এখানে ওর বন্ধু-বান্ধবও তেমন একটা নেই। কানে শোনে না আর কথা বলতে পারে না বলে ওর বয়সী বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে ওকে বলতে গেলে এড়িয়ে চলে। তাই আমরা দুই ভাই মিলে ঠিক করেছিলাম জন্মদিন উপলক্ষে বেচারিকে একটা সারপ্রাইজ দেব। 

বেজমেন্টে গানের প্র্যাকটিস চলছে। আমরা ওয়ারফেজের ট্রিবিউট দিচ্ছি এই কনসার্টে। দেশ থেকে কয়েকজন নামকরা শিল্পী আসছেন। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে টিকিট বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। আমার বন্ধুরা বিয়ারের ক্যান নিয়ে এসেছিল। এসব বিয়ারে অ্যালকোহোলের মাত্রা একেবারেই কম। তবুও পাঁচ-ছয়টা খাবার পর আমার এখন মাথা ঝিমঝিম করছে। গান বাজনা ভালো লাগছে না। রুশমির জন্য মন কেমন করছে। সেদিন ঠিক কোন গানটার ওপরে আমরা কাজ করছিলাম এখন আর মনে পড়ে না। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি শুধুমাত্র রুশানিয়া ছাড়া অন্য সব কিছুই আমার স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে এসেছে। এমনকি জাহিদের এক্সিডেন্টের দিনটাও এখন আর ঠিকঠাক মনে পড়ে না। মনে করতে চাই ও না। মাঝে মাঝে মন নামক যন্ত্রটাকে গলা টিপে হত্যা করতে ইচ্ছে হয় আমার। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় থাকুক না সে তার মতো। সে আছে বলেই তার চোখ দিয়ে আমি আমার হৃদয়াক্ষী মেয়েকে দেখতে পাই, যখন ইচ্ছে তখন! এই যেমন এখন দেখতে পাচ্ছি। এমনভাবে দেখতে পাচ্ছি যে, আমার মনে হচ্ছে না এটা অতীতকাল। সবকিছু স্পষ্ট আর জীবন্ত! আমাকে দেখা যাচ্ছে আমার বেডরুমের দরজার বাইরের হলওয়েতে। গান বাজনা ফেলে রেখে ওপরে উঠে এসেছি। ঘরের ভেতরে ঢোকা ঠিক হবে কি হবে না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। 

কতক্ষণ কেটেছে জানি না। এখন আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। বেডসাইড ল্যাম্পশেডটা টিমটিম করে জ্বলছে। উইলো ফরেস্টের গাছের পাতায় পাতায় হাওয়া বইছে শনশন। বাতাসে সাউদার্ন ম্যাগনোলিয়ার বুনো ঘ্রাণ। জানালার ওপাশে সবুজ পাখনার কয়েক জোড়া ফায়ারফ্লাই উড়ে বেড়াচ্ছে নির্বিঘ্নে। রুশমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। কী শ্যাম্পু মেখেছে কে জানে, একটা সুগন্ধি ওই চুল থেকে উড়ে উড়ে আমার নাকে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। ওর পরনে আকাশি রংয়ের স্লিপিং স্যুট। ঢোলা ফুল হাত শার্ট, ঢোলা প্যান্ট। ও সবসময় ঢিলাঢালা জামা কাপড় পরে। বাড়ির মধ্যেও! আমি আয়নার মধ্যে আবছা হয়ে পড়ে থাকা ওর প্রতিবিম্বর দিকে চেয়ে আছি। শুকনো মুখ, রক্তশূন্য ত্বক তবুও চোখজোড়া কী অদ্ভুত সুন্দর! আল্লাহ ওই চোখ দুটো কী দিয়ে গড়েছেন জানি না। এতো গভীর, এতো পবিত্র! ওদিকে তাকালে আমার বুক স্নিগ্ধতায় ভরে যায়। নিশ্বাস বিশুদ্ধ হয়! 

—‘কেমন আছ এখন?’ 

রুশমি উত্তর না দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। 

—‘আলহামদুলিল্লাহ।’ 

—‘কোথায় যাচ্ছ?’ 

— ‘নিচে।’ 

— ‘কেনো?’ 

—‘রেস্ট নিব।’ 

—‘নিচে অনেক হইচই।’ 

ওকে একটু দ্বিধাপ্রস্ত দেখালো। 

—‘এখানেই শুয়ে পড়ো। তোমাকে কেউ ডিস্টার্ব করবে না।’ একটু থেমে বললাম, ‘কিছু খাবে?’ 

—‘না। ইচ্ছে করছে না। 

ও কেমন যেন গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মায়া হচ্ছে আমার। আমি আস্তে করে ওর হাত থেকে তোয়ালেটা তুলে নিলাম। ডেস্কের চেয়ারের ওপর ঝুলিয়ে দিলাম। ঘুরে তাকিয়ে দেখি ও বিছানার ওপর উঠে বসেছে। 

—‘বাতি নিভিয়ে দেব?’ 

—‘দাও।’ 

বাতি নিভিয়ে দিলাম। ঘরটা এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালার ওপারের আকাশে ঘন মেঘের জাঁকজমক সমাহার। বৃষ্টির রেশটা কাটেনি এখনো। রাতে হয়তো আরো এক পশলা নামবে। অন্ধকারে আমি রুশমির ছিপছিপে দেহ ক্ষীণভাবে দেখতে পাচ্ছি। আকাশি রংটা আঁধারের গায়ে ফুটে আছে অনেকটা আলোর মতো। এই মুহূর্তে আমার এখান থেকে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। কে জানে রুশমি হয়তো মনে মনে বিরক্ত বোধ করছে। না চাইতেও বারংবার আমি ওর বিরক্তির কারণ হয়ে উঠি কেনো যেন। তাছাড়া মেয়েটাকে মনে হয় আজকাল আমি একটু ভয়ও পাই। কখন কোন সময় হুট করে অপমান করে বসে তার ঠিক নেই। এখন এমনিতেও আবহাওয়া কিছুটা বেগতিক মনে হচ্ছে। ভাবছি মান-সম্মান বাঁচিয়ে দূরে সরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। 

—‘তোমার কি আর কিছু লাগবে?’ 

রুশমি চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। জানি না কেনো, হঠাৎ মনে হলো ও বুঝি কাঁদছে। বাতাসে ভারী নিশ্বাসের শব্দ। 

—‘রুশানিয়া?’ 

—‘হুম।’ 

—‘তুমি ঠিক আছ?’ 

—হুম।’

—‘কিছু লাগবে?’ 

—‘হুম।’

—‘কী লাগবে বলো? আমি এনে দিচ্ছি।’ 

রুশমি নিশ্চুপ, নাক টানছে ঘনঘন। 

—‘তুমি কাঁদছ কেনো?’ এবার আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। একটু চড়ে গেলো গলার আওয়াজ। 

—‘জানি না।’ 

আমি ওর কাছে এগিয়ে গেলাম। হাঁটু গেড়ে বসলাম মেঝেতে, ওর সামনে। 

—‘তোমার কি বেশি শরীর খারাপ লাগছে?’ 

— ‘না।’ 

—‘তাহলে কাঁদছ কেনো?’ 

—‘জানি না।’ 

—‘আম্মু-আব্বুকে ফোন করে আসতে বলব?’ 

—‘না।’ 

একটা হতাশ নিশ্বাস পড়ল আমার, ‘দেন টেল মি হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ। এরকম কান্নাকাটি করলে তো…। কাম অন, আমার এসব ভালো লাগছে না। 

রুশমি এবার নড়ে উঠেছে। পা টেনে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলছে, ‘তুমি যাও। আমি ঠিক আছি।’ 

উঠে দাঁড়ালাম, ‘তোমার কী যেন লাগবে বলেছিলে?’ 

–‘হুম।’ 

—‘বলো কী লাগবে? 

—‘তোমাকে!’ 

বুকে একটা ধাক্কা এসে লাগলো। যেন কালবৈশাখীর উত্তাল আচমকা হাওয়ায় মনের একটা জানালার পাল্লা দড়াম শব্দ করে খুলে গেলো। এখন সারাটা মনঘর জুড়ে কেমন মিষ্টি ঝড়ের পূর্বাভাস! 

—‘হ্যাঁ?’

—‘কিছু না!’ 

—‘কী বললে?’ 

—‘কিছু বলিনি তো!’ 

থম ধরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকারে। আমি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি ওর কথা। 

‘তোমাকে!’ ছোট্ট এই বাংলা শব্দটা যে এতো সুন্দর, শ্রুতিমধুর আর শক্তিশালী তা আমি আজকেই প্রথম জানলাম। সেলফোনটা বাজছিল, নিচ থেকে আমার বন্ধু ফোন করছে। লাইন কেটে দিলাম। রুশানিয়া বলেছে ওর নাকি আমাকে প্রয়োজন। বাকি পৃথিবী গোল্লায় যাক! 

—‘তুমি যেতে পারো। তোমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। 

রুশমি বলল, সৌজন্যতার গলায়। আমি এ কথার কোনও প্রত্যুত্তর না করে বিছানার ওপর বসলাম। ওর পায়ের কাছে। বসামাত্র সে এক লাফে কয়েক ইঞ্চি দূরে সরে গেলো। আমি যেন অদ্ভুত। আমার ছোঁয়া লাগাটাও যেন পাপ। 

—‘কী হলো?’

—‘কী হবে?’ 

—‘ব্যাঙের মতো লাফিয়ে উঠলে কেনো?’ 

—তোমাকে জায়গা দিলাম… বসার জন্য।’ 

—‘ও!’ বলি আমি ছোট করে। আর কোনও কথা খুঁজে পাই না। চুপ করে থাকি। ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা কোঁকড়া বাতাস ছুটে এসে মেরুদণ্ডে ঠান্ডা শিহরণ জাগায়। কালো আকাশে উড়তে থাকা ছাইরঙা গম্ভীরমুখো মেঘরাশি উইলো ফরেস্টের মাথার ওপর মুকুটের মতো চড়ে বসে। উতলা বাতাসে বনের গাছের পাতা নড়ে শনশন… শনশন… তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে আমার হৃদস্পন্দন ধুকপুক… ধুকপুক! 

কে যেন ব্যাকইয়ার্ডের বাতি জ্বালায়। এক টুকরো হলদে ম্লান আলো ধপ করে এসে পড়ে বিছানার ওপর। সেই আলোয় রুশানিয়ার স্নিগ্ধ মুখশ্রী আবছা হয়ে ফুটে ওঠে আমার চোখের সামনে। ওর চোখ সিলিং এর দিকে নিবদ্ধ। হাতদুটো আড়াআড়ি করে রাখা বুকের ওপর। বালিশে ছড়ানো একরাশ কালো চুল। চুপ করে ঐদিকে চেয়ে থেকে কী ভাবছে জানি না। যত কাছের মানুষই হোক না কেনো, কেউ কখনো অন্য কারো মনের কথা পড়তে পারে না। আর পারে না বলেই জীবন প্রতিনিয়ত এতো বিপুল সম্ভাবনায় ভরপুর। অনিশ্চিত এবং অজানা সত্যগুলোই বেঁচে থাকার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে ক্রমাগত। যেমন এই মুহূর্তে আমার সত্য সন্ধানী মন কয়েক ইঞ্চি দূরে শুয়ে থাকা রহস্যময়ী দুর্বোধ্য মেয়েটিকে পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করতে চাইছে। এই আবিষ্কারের নেশা এতটাই তীব্র যে আমার মনে হচ্ছে এতে সফল না হলে বুঝি আমি শান্তিতে কোনোদিন মরতেও পারব না। অথচ এতো রকম দ্বিধা দ্বন্দ্বে না ভুগে মেয়েটাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেই হয়। কিংবা মনের কথা খুলে বললেই হয় যে, ওকে আজকাল আমার খুব বেশি মাত্রায় ভালো লাগছে। যেকোনও বিবেকবান এবং বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ নিশ্চয়ই এটাই করবে। আমারও ঠিক তাই করা উচিত। কিন্তু, হ্যাঁ একটা কিন্তু লেগে আছে মনের মধ্যে কাঁটা হয়ে। রুশমি যদি আমার প্রতি ঠিক একই ধরণের অনুভূতি ধারণ না করে থাকে, যদি মুখের ওপর না করে দেয়, কিংবা খুব ভয়ংকর অপমানজনক কিছু বলে বসে, তখন কী হবে? ওর প্রত্যাখ্যান আমি মেনে নিতে পারব না। প্রত্যাখ্যানের চাইতে বরং এই ঝাপসা, ধোঁয়াটে এবং বিচিত্র সম্ভাবনায় ভরপুর পরিস্থিতিই নিরাপদ 

ঘরের ভেতর পথ ভুল করে একটা জোনাকি ঢুকে পড়েছে। অন্ধকারে ঝিকমিক করে জ্বলছে ওর সবুজ আলোর ডানা, স্বপ্নের মতো। ওই আলোটুকু আমাদের মধ্যে কথার যোগান দিল। রুশমিকে খুব স্তিমিত গলায় বলতে শুনলাম, 

—‘আমার আঠারো বছরের জন্মদিনে বাবাজান একটা জোনাকি উপহার দিয়েছিল। কাচের জারের ভেতর ছোট্ট একটা সবুজ পাখনার পরী।’ 

আমি ওর মুখপানেই চেয়ে ছিলাম। ঐশ্বরিক চোখজোড়ার কাজল রেখার ভেতর দিয়ে চিকচিক করছে অল্প একটু অশ্রু। পাতলা ঠোঁটের কিনার ঘেঁষে একটা মিহি হাসি। ওই হাসির ওপর নিবিড় চোখ নিবদ্ধ করে ক্ষীণগলায় বললাম, ‘একটা পরীকে আরেকটা পরী উপহার দেয়া! ব্যাপারটা বেশ মজার!’ 

—‘কী বললে?’ প্রশ্নটা করতে করতে ও পাশ ফিরে শুলো। এই শোয়ার ভঙ্গিটা চিত্তাকর্ষক। একটা ঢেউ প্রতীয়মান হয়েছে এখন ওর ছিপছিপে মেদহীন শরীরে। 

—‘কী বললে তুমি এইমাত্র?’ ও দ্বিতীয়বার প্রশ্নটা করল। 

—‘তুমি কী বলেছিলে তখন?’ 

—‘কখন?’ 

—‘একটু আগে?’ 

ও চুপ করে কী যেন ভাবে। আস্তে করে বলে, ‘কখন কী বলেছি অত মনে আছে নাকি? 

আমি হাসি, ‘আমারও মনে নেই।’ 

একটু থেমে আবার বললাম, ‘জারের ভেতর জোনাকি কেনো? 

—‘আমি জোনাকি খুব ভালোবাসতাম!’ উড়তে থাকা সবুজ পাখনার 

পোকাটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল রুশমি। 

—‘এখন বাসো না?’ 

—‘কী জানি!’ ঠোঁট উল্টে উত্তর দিল। 

—‘রুশানিয়া!’ 

—‘হুম।’ 

—‘তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? বাবাকে নাকি আম্মুকে?’ 

ও হাসে, বাচ্চা মেয়ের মতো আদুরে গলায় বলে, ‘দুজনকেই!’ 

—‘আচ্ছা?’ 

—‘হ্যাঁ।’ 

—‘একটুও কমবেশি নেই?’ 

দেখে মনে হলো সে খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। ঘন কালো একরাশ চুলের নিচের পাতলা কপালটায় স্পষ্ট দুটো ভাঁজ ফুটে উঠেছে। ব্যাকইয়ার্ড থেকে জাহিদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। সাথে আরেকটি অচেনা ছেলের গলা। কেউ এসেছে বোধহয়। 

—‘কমবেশি নেই।’

—‘শিওর?’ 

—‘হ্যাঁ শিওর, কেনো করলে প্রশ্নটা?’ 

—‘এমনিই!’ 

—‘তুমি?’

—‘আমি?’ 

—‘হ্যাঁ, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? পাপা, মম, জাহিদ নাকি তোমার বান্ধবীদের?’ 

চোখ বুজে কোনও এক বান্ধবীর মুখচ্ছবি মনে করার চেষ্টা করলাম। ক্যাথরিনাকে ছাড়া অন্য কাউকে মনে পড়ল না। যদিও সে আমার বান্ধবী নয়, কলিগ 

—‘এই মুহূর্তে কোনো বান্ধবীর কথা মনে পড়ছে না। তবে আমি আমার মমকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।’ 

—‘পাপাকে বাসো না?’ 

—‘বাসি, তবে আমার মা…। আমার মায়ের মতো ভালো মানুষ আমি জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। শি ইজ দ্যা মোস্ট জেনেরাস পারসন আই হ্যাভ এভার সিন!’ 

—‘আই বেট শি ইজ!’ 

শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে কথাটা বলল রুশমি 

—‘পাপার সাথে আজ বেশ অনেকক্ষণ কথা হলো।’ 

—‘তাই?’ 

—‘হুম, পাপা চায় তুমি আরো পড়াশোনা করো। ‘ বাঁকা হাসলাম, ‘পিএইচডি?’ 

—‘হ্যাঁ পিএইচডি।’ 

— ‘হবে না।’ 

— ‘কেনো?’ 

—‘ইন্টারেস্ট নেই। তবে গানের ওপর পিএইচডি করতে রাজি আছি। সেটা তো পাপার পছন্দ হবে না।’ 

—‘শুনেছি তুমি হার্ভার্ড থেকে পাশ করা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। তা পিএইচডি তে এতো অনীহা কেনো?’ 

—‘পিএইচডি’র জন্য যে ধৈর্য প্রয়োজন সেটা আমার আর নেই। তাছাড়া আমার তো অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছে কখনও ছিল না। খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার মতো একটা চাকরি হলেই যথেষ্ট। পুঁথিগত পড়াশোনায় আর মন নেই। এখন আমি পৃথিবীটাকে পড়তে চাই। জীবনটা খুব ছোট। এই ছোট জীবনে আমার মতো সাধারণ মানুষের নতুন করে কিছু সৃষ্টি করবার নেই। সৃষ্ট যা কিছু আছে তাই-ই চোখ ভরে শুধু দেখতে চাই। মন দিয়ে বুঝতে চাই।’ 

একটু থেমে বললাম, –’উঠলে কেনো? শরীর ভালো লাগছে এখন? হেডবোর্ডে মাথা এলিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘কিছুটা।’ 

সেলফোন ভাইব্রেট হচ্ছে। ভাইব্রেশনটা বিছানা কাঁপিয়ে দিচ্ছে একদম। নিচতলা থেকে আমার বন্ধু ফোন করছে। ভোকাল ছাড়া ওদের প্র্যাকটিস নিশ্চয়ই জমছে না। আমার উচিত ফিরে যাওয়া। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। মারাত্মক রকমের অসহায় বোধ করছি। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় রুশমি একটা অদ্ভুত কথা বলল। সরাসরি আমার চোখের দিকে চেয়ে নির্বিকারে বলে বসল, 

—‘ফোনটা সুইচড অফ করে দিলেই হয়!’ 

—‘হ্যাঁ?’ 

ও গম্ভীর হয়ে গেছে। জানালার বাইরে চোখ নিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, ‘কোনও কথা একবারে বোঝে না। স্ট্রেঞ্জ!’ 

ভাইব্রেট হতে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে আমি থমকানো চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। আধো আলো অন্ধকারে তার মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। বাতাসে উড়ছে খোলা চুল। নোজপিন ঝিলিক দিচ্ছে। জানি না আমার কী করা উচিত! বাট এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে মেয়েটা যদি আমাকে আজ রাতে ব্লুরিজ মাউন্টেনের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ থেকে লাফ দিয়ে মরতে বলে তবে আমি বুঝি নির্দ্বিধায় সেটাও করতে রাজি আছি। এসব অনুভূতিরা এতকাল কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে! গান আমার জীবনের এক নিবিড় ভালোলাগার জায়গা। গানের অনুশীলন সবচেয়ে প্রিয় কাজগুলির একটি। অথচ আজ সেই প্রিয় কাজ আমাকে টানছে না। রুশানিয়া কি তবে আমার কাছে গানের চাইতেও বেশি প্রিয় হয়ে উঠছে ধীরেধীরে? সেটাও কি সম্ভব? 

রুশমি 

আমার আজকে হয়েছে কী জানি না! সেই তখন থেকে উল্টাপাল্টা বলেই যাচ্ছি। ছেলেটা আমাকে কী ভাবছে কে জানে! মান-সম্মান বলতে কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না। এখন অন্ধকারে চমকলাগা বড় চোখে চেয়ে আছে আমার মুখের দিকে। ওই দৃষ্টিবাণ আমাকে অস্থির করে তুলছে। কানে নিরবচ্ছিন্ন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কেনো যেন গতকালকের বৃষ্টিভেজা বিকেলটা আমার মনে পড়ছে এই মুহূর্তে। ওই স্পর্শগুলো এখনো জীবন্ত। সংকোচে একটুখানি হয়ে যাচ্ছে মন। সেই সাথে একটা দুর্গম, গোপন ভালোলাগায় আটকে আসছে নিশ্বাস। ক্লান্তিময়, জীর্ণ এবং একঘেয়ে দিনের শেষে এই মেঘমেদুর বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা আকাশের নিশ্চুপ রাত্রি যেন প্রকৃতির দেয়া এক অপূর্ব উপহার আমার জন্য! এমন আশ্চর্য মোহময় ক্ষণ আমার জীবনে এর আগে কখনো এসেছে বলে মনে পড়ে না। কারণ এতো কাছাকাছি, আপন মানুষের মতো ওকে এই প্রথমবারের মতো পাওয়া আমার। ও কাছে আছে, পাশে আছে, বন্ধুদের কাছে যায়নি। সাশার জন্মদিন নিয়ে ব্যস্ত হয়নি। এই এক চিলতে ঘটনা আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটায় রূপান্তরিত করেছে। আমার এখন আর শরীর খারাপ লাগছে না। পেটের ব্যথাটাও হালকা এবং সহনীয়। 

—‘তোমার নোজপিন…’ হঠাৎ বলে বসল শিহাব। কোনও ভূমিকা ছাড়াই।

—‘কী হয়েছে নোজপিন?’ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। 

—‘নোজপিন পরো কেনো?’ গমগমে গলায় বলল ও, আমার নাকের ওপর কড়া দৃষ্টি স্থাপন করে। 

—‘এটা কেমন কথা!’ আমি অবাক। 

—‘ভালোলাগে না!’ 

বুকের মধ্যে খচ করে একটা কাঁটা বিঁধল, ‘কী ভালোলাগে না? 

—‘নোজপিন!’ বলার ভঙ্গিটা খুব স্মার্ট! কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠস্বরে অহংকারের মতো ঝাঁঝালো কী যেন মিশে আছে। ওই ঝাঁঝটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। 

—‘তোমার ভালোলাগা না লাগায় কিছু এসে যায় না!’ সোজাসাপ্টা মন্তব্য আমার। 

—‘ফেয়ার এনাফ! ‘ 

—‘আমি চলে যাবার পর বিয়ে করো একটা ভালোলাগার মেয়েকে। যে নোজপিন পরে না।’ 

এ কথা শুনে ফাজিল ছেলেটা ফিচেল হাসে, কেমন যেন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তুমি চলে যাচ্ছ নাকি?’ 

—‘যাবোই তো!’ 

—‘কবে?’ 

—‘খুব শীঘ্রই।’ 

ও রহস্যজড়ানো হিম গলায় বলল, ‘‘যদি যেতে না দেই?’ 

শিউরে উঠলাম। আত্মায় তির তির করা কাঁপন লাগল। নিশ্বাসে পড়ল টান। এই ছেলেটা আমাকে নির্ঘাত মেরে ফেলবে! উঠোনে একটা বাতি জ্বলছিল। একটু আগে নিভে গেছে। চারপাশ এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি না শুধু নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। 

—‘যেতে দেবে না কেনো?’ 

—‘আমার ইচ্ছা!’ 

—‘জোর করে আটকে রাখবে?’ 

—‘যদি রাখি?’ 

—‘যদি রাখো?’ 

—‘হ্যাঁ।’ 

—‘হ্যাঁ? 

ও চুপ করে যায়। আমিও চুপ। আমার কেনো যেন খুব ইচ্ছে করছে ওকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি, যেতে দিও না কোনোদিন, কখনো, কোথাও যেতে দিও না। বেঁধে রাখো, জোর করে আটকে রাখো। আমি চিরদিনের জন্য তোমার বন্দিনী হয়েই থাকতে চাই। ভাবতে ভাবতে আমি চমকে উঠেছি। অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছি আমার ভিতরকার নারীবাদী, আধুনিক, বাস্তবিক মনটাকে কোন এক অপরিজ্ঞাত, গূঢ় অনুভূতি এক লহমায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এই অনুভূতির নামই কি ভালোবাসা? যে অনুভূতি কষ্ট নাকি সুখ তা ঠিক মতো ঠাওর করা যায় না, সময় দিয়ে বাঁধা যায় না, দেখা বা ছোঁয়া যায় না, কোনো শব্দ দ্বারা বর্ণনাও করা যায় না। কোনো কিছু না বুঝেই এর অলঙ্ঘনীয় দুর্মর দৌরাত্ম্যে বোকার মতো আকণ্ঠ ডুবে যেতে হয়, হেরে যেতে হয়; কখনো কখনো মরেও যেতে হয়! এই আশ্চর্য অনুভূতিই কি তবে ভালোবাসা? 

—‘চিন্তা করো না। তোমার যখন ইচ্ছে যেতে পারো। আমি বাধা দেব না। ‘বেশ কিছুক্ষণ পর কথা বলল শিহাব। 

—‘ডিভোর্সের পর তুমি কী করবে? প্ল্যান কী?’ সতর্ক গলায় প্রশ্ন করলাম। 

— ‘জানি না।’ 

—‘কেনো? পৃথিবীকে পড়বে না?’ 

ও নিঃশব্দে হাসে, ‘হয়তো!’ 

—‘তোমার কি কোনও পছন্দ আছে? মানে…, শুভ্রাকে তো এখন তুমি আর পছন্দ কর না। তার পরিবর্তে অন্য কেউ…’ 

আমার কথাটা শেষ হবার আগেই ও স্পষ্ট গলায় বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আই থিংক আই লাইক সাম ওয়ান।’ 

হৃৎপিণ্ডটা কে যেন খামচে ধরল শক্ত করে। 

—‘তাই?’ 

—‘হুম!’ 

— ‘কে সে?’ 

—‘আছে একজন!’ 

—‘তাকে কি তুমি ভালোবাসো?’ 

— ‘জানি না, কিন্তু তাকে আমার খুব ভালোলাগে!’

—‘তাকে কি তুমি বিয়ে করবে?’ 

শিহাব শব্দ করে হেসে উঠল, ‘বিয়েটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় না।’ 

মন খারাপের মেঘে ছেয়ে গেছে বুক। কান্না পাচ্ছে! আমি জানি এই কথাটা সে কেনো বলেছে। বলেছে কারণ যে মেয়েটাকে সে পছন্দ করে, সেই মেয়েটি অন্য ধর্মের। তাকে বিয়ে করা খুব সহজ কাজ হবে না। 

শিহাব 

যে কথা হয়নি বলা কখনও 
চোখে চোখ রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
সে কথা গিয়েছে চলে চুপিচুপি 
কোন এক গোপন পথ ধরে 
আমার হৃদয়াক্ষী থেকে
তোমার হৃদয়াক্ষী তরে! 

.

রুশমি হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেছে। আমিও কথা খুঁজে পাচ্ছি না। নৈঃশব্দটা ক্রমাগতভাবে নিদারুণ এক অস্বস্তির উদ্রেক করে চলেছে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার না পেয়ে হালকাভাবে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার খবর বলো। প্ল্যান কী?’ 

—‘আপাতত পড়াশোনা আর কাজ ছাড়া অন্য কোনো প্ল্যান নেই। পড়তে হবে, পাশাপাশি কাজ করে স্টুডেন্ট লোন শোধ করতে হবে।’ 

—‘তুমি স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলে?’ 

‘করেছিলাম, হয়নি। আমি তোমার বা শুভ্রার মতো অত ভালো স্টুডেন্ট নই।’ কথাটা বলে ও কিছুক্ষণ বিরতি নিলো। তারপর কেমন অন্যরকম গলায় বলল, 

—‘শিহাব!’ 

হঠাৎ নিজের নামটা ওর মুখে শুনতে পেয়ে মনে মনে একটু চমকে উঠলাম। ও কি আমাকে জীবনে এই প্রথমবারের মতো নাম ধরে ডাকল? আগে কখনো ডেকেছে কিনা আমার মনে পড়ে না। ডাকলেও অন্তত এভাবে ডাকেনি। ডাকটা যেন কেমন অদ্ভুত, একটু ব্যাকুল একটু করুণ। যেন মহাকালের ওপার থেকে বহু কাল পরে ঘুম ভাঙানিয়া ডাক ডেকে উঠেছে আমারই আত্মার এক নিগুঢ়তম অংশ। 

—‘বলো রুশানিয়া, শুনছি।’ 

—‘ডু ইউ বিলিভ ইন টু লাভ?’ 

গম্ভীর অথচ স্তিমিত গলায় প্রশ্ন করল রুশমি। প্রশ্নটা আমার বুকে আলতো টোকা দিয়ে গেছে। কারণ এ ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন আমি আগে কখনো হইনি। বলতে গেলে এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা ভাববার অবকাশও হয়নি কখনো। অত ভেবে লাভ কী? দিন শেষে ভালো থাকাটাই তো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাই না? রুশমি যদি জীবনসঙ্গী হয়ে সারাটা জীবন পাশে থাকে, তাহলে আমার ভালো লাগবে, খুব বেশিই ভালো লাগবে। আপাতত এইটুকুই স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করতে পেরেছি। এই উপলব্ধির উৎপত্তি সত্যিকারের ভালোবাসা থেকে নাকি মোহ থেকে সেই দ্বন্দ্বের মধ্যে এখন যেতে ইচ্ছে করছে না। তবে একটা কথা আমি হলফ করে বলতে পারি যে রুশমিকে যতটা ভালো লাগছে, এতটা ভালো জীবনে অন্য কোনো মেয়েকেই কখনো লাগেনি, শুভ্রাকেও না! 

অন্ধকারে আবছা হয়ে আসা রুশমির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা গাঢ় গলায় বললাম, –’আমার কী মনে হয় জানো? ভালো থাকাটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যাকে পাশে পেতে ভালোলাগে, তার পেছনেই সময় ব্যয় করা উচিত।’ 

—‘ভালোলাগায় ভোগের তৃপ্তি, ভালোবাসায় ত্যাগের সাধন।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন! 

চমকে উঠলাম, ‘মাই গড! তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়েছ?’ 

—‘কেনো পড়ব না?’ 

—‘দেশের বাইরে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে রবীন্দ্রনাথ আওড়াচ্ছে, এতো অবিশ্বাস্য!’ 

—‘আমি প্রাইমারি লেভেল পর্যন্ত বাংলাদেশে পড়েছিলাম। তাছাড়া বাংলাসাহিত্য নিয়ে আমার নিজস্ব পড়াশোনা আছে।’ 

—‘দেশ থেকে অনার্স মাস্টার্স পাশ করে বিদেশে এসে লোকে বাংলা ভুলে যায়। গর্ব করে বলে বাংলা পড়তে পারি না! সে জায়গায় তুমি… ওয়াও! আমি সত্যিই মুগ্ধ হলাম! যাই হোক, এই ত্যাগের ব্যাপারটা ঠিক মানতে পারছি না। আমার যা ভালোলাগে, যা আমার প্রিয়, তা আমি আমার করেই রাখতে চাই সারাজীবন। ত্যাগের মহিমার কাছে নিজের সুখ বিক্রি করতে চাই না। তবে…’ 

— ‘তবে? 

—‘তবে আমার আত্মসম্মান বোধ অত্যন্ত প্রবল। ক্ষণিকের ভালোলাগার জন্য আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে রাজি নই আমি।’ 

এসব কথা যখন অবলীলায় বলে যাচ্ছিলাম তখনও আমি জানতাম না যে ভালোবাসা নামক অনির্বচনীয় অনুভূতিটির প্রাবল্য মানুষের আত্মমর্যাদাবোধ, বিবেক, বিচক্ষণতা এবং মানবিক নীতিবোধ মুহূর্তের মধ্যে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়ার মতো অলৌকিক ক্ষমতা রাখে। প্রকৃত ভালোবাসার জন্য লোকে জীবন দিতেও দ্বিধা করে না, আত্মমর্যাদা তো কোন ছার! আর এ কারণেই, এ কারণেই রুশমি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবার এতোগুলো বছর পরেও তোমার স্মৃতি আজও আমি নির্লজ্জের মতো বয়ে বেড়াই। আমার আত্মমর্যাদা তো জলের দামে বিকিয়ে দিয়েছি তোমার কাছে সেই কবে! আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কী মনে হয় জানো? মনে হয় তুমি বুঝি কখনো আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসোনি। কিংবা বেসে থাকলেও সেটা ছিল তোমার ওই রাবীন্দ্রিক ভালোবাসা। যে ভালোবাসা ত্যাগে হয় সিদ্ধ। তোমার ওই আত্মত্যাগী মহান ভালোবাসার অসীম দৌরাত্ম্যে সবদিক থেকে হেরেছি শুধু আমি। আর তুমি…. তুমি হয়তো স্বার্থপরের মতো পালিয়ে গিয়ে জিতে গেছ রুশানিয়া! হ্যাঁ যাকে তুমি ত্যাগ বলো তাকে আমি সহজ বাংলায় স্বার্থপরতা বলি। তোমার এই স্বার্থপরতা এতো বেশি প্রকট এবং নির্লজ্জ যে, একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন নষ্ট করতেও সে দ্বিধা বোধ করেনি। তোমার আমার এই হৃদয়ঘটিত টানাপোড়েনে সাশাকে জড়াবার কী দরকার ছিল বলতে পারো? সেই বেচারিকে তো করুণা ছাড়া জীবনে আর কিছুই দিতে পারিনি আমি! 

সেই সন্ধ্যেটার কথা এখন মনে পড়ছে আমার। দুহাজার আঠারো সালের ডিসেম্বর মাস। আমি অফিসে যাই না প্রায় বিশদিন হয়ে গেছে। চাকরিটা বোধহয় এবার আর টিকবে না। আমার দুশ্চিন্তায় পাপা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমাদের ছিমছাম সুখের পরিবারটায় কার যেন গাঢ় অভিশাপ লেগে গেছে। কোথাও এক রত্তি শান্তি নেই। আমার মাথায় দিবারাত্রি চব্বিশ ঘণ্টা শুধু তুমি, তুমি আর তুমি! তোমার নেশা আমার আর কাটেই না! দুনিয়াটা তো একটুখানি নয়। সুবিশাল এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে আমার একটা ছোট্ট রুশানিয়া কোথায় লুকিয়ে আছে তা জানবার মতো কোনো উপায় নেই। আমি এতটাই অসহায়! তোমার আম্মু আর বোনেরাও নাকি তোমার খবর জানে না। এটা কি বিশ্বাস হবার মতো কোনও কথা? সেইরকম উথালপাথাল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দিনগুলির এক বিষণ্ন সন্ধ্যায় সাশা আমার সামনে উপস্থিত হয়ে বলল (মানে টেক্সট করল), 

‘রুশমি চায় তুমি আমাকে বিয়ে করো।’ 

আমি থমকে গেছি, চমকে গেছি! মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস নিতে ভুলে গেছি।

—‘তুমি জানো রুশমি কোথায় আছে?’ 

ও চুপ করে আছে। আমার পৃথিবীটা কাচের টুকরোর মতো ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়তে লাগলো। এ কাদের সাথে বসবাস করছি আমি? সবাই কেনো আমাকে এমন দুর্দান্ত উপায়ে ঠকিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন? সাশা যদি তোমার ঠিকানা জেনে থাকে তাহলে এতদিন ঘুণাক্ষরেও এ কথা বলেনি কেনো? উদ্ভ্রান্তের মতো ওর শার্টের কলার চেপে ধরলাম, ‘বলো রুশমি কোথায়?’ 

আমার হাতের চাপে পিষ্ট হয়ে হাঁসফাঁস করছে ও। আমি ওকে এতো জোরে নাড়া দিচ্ছি যে, ওর মাথাটা ঘাড়ের ওপর লটপট করছে স্প্রিং এর মতো। মনে হচ্ছে যেকোন মুহূর্তে খসে পড়বে। চোখ বড়বড়। মুখ হা, গালে রক্তের আভাস। 

একটা সময় মুক্তি দিলাম ওকে। হাতে ধরিয়ে দিলাম সেলফোন। চিৎকার করে বললাম, ‘রুশমির ঠিকানা বলো, এক্ষুনি!’ 

সাশার কানে হেয়ারিং এইড লাগানো। সে আমার কথা শুনতে পেয়েছে। কাঁপা হাতে টাইপ করছে কিছু একটা। 

—বলব কিন্তু এক শর্তে। 

—কী শর্ত? 

—আমাকে তোমার বিয়ে করতে হবে! রুশমি এটাই চায়। 

তারপর কী হয়েছিল জানো রুশানিয়া? বোবা মেয়েটার কান বরাবর ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম। পরে ভেবে দেখেছি দোষ আসলে সাশার না, আমারও না, দোষটা শুধুই তোমার। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে দোষ তোমার ওই আত্মত্যাগী, অতি মহান রাবীন্দ্রিক ভালোবাসার। যে ভালোবাসা তোমাকে, আমাকে, সাশাকে কাউকেই কোনদিন সুখী করেনি। করবেও না! 

তবুও মরে যাবার আগে শেষবারের মতো একবার তোমার চোখে চোখ রেখে জানতে চাই কেনো তুমি আমাকে এত বড় শাস্তি দিয়েছিলে? কী দোষ ছিল আমার? তোমার বাবা কিংবা আমার মা কি তোমার এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনভাবে দায়ী ছিল? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? পরিবারের মন রক্ষার্থে তুমি আমার জীবনে এসেছিলে, আবার সেই পরিবারের জন্যই আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। হিসাবটা কিন্তু খুব সহজ। আমিই বাজে ছাত্রের মতো সহজ সমীকরণটার জটিল সমাধান খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমি আসলে তোমার কোথাও ছিলাম না। তোমার সমস্তটা জুড়ে ছিল শুধু সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন এবং আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর মনোভাব। এসব কথা নানা সময়ে আমার মাথায় টুকরো মেঘের মতো এসেছে আবার ভেসেও গেছে। আজ নতুন করে মনে পড়ল তোমার দেয়া সেই ভালোবাসার সংজ্ঞার সুবাদেই। এলোমেলো ভাবনারা স্মৃতির কক্ষপথে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। আমি দুর্বল লিখিয়ে। লেখাজোকার নিয়ম কানুন জানা নেই একেবারেই। ছিলাম তো দুহাজার পনের সালে! কী আশ্চর্য ব্যাপার তাই না? সময় পরিভ্রমণের জন্য স্পেস-টাইম কন্টিনিউয়াম বা আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে কোনো গবেষণাই আমাকে করতে হয় না। শুধু ধ্যানমগ্ন হয়ে হৃদয়াক্ষীর দ্বার উন্মোচন করলেই নিমেষে পারি দেই ত্রিমাত্রিক জগতের সময়সমুদ্র! মানুষের মন পৃথিবীর এক এবং অভিন্ন টাইমমেশিন। এই টাইমমেশিনের বিকল্প কিছু আবিষ্কার হয়নি, কখনো হবেও না! আমাদের অ্যাশবার্নের দোতলা বাড়ির বেডরুমে অন্ধকারে বসে আছি আমরা দুজন। আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো রুশানিয়া? এই মুহূর্তে আমি তোমার হৃদয়ের উত্তাপ টের পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে এই ঝুম অন্ধকারের একলা নৈঃশব্দে তোমার মন থেকে আমার মন অবধি একটা নিষ্কণ্টক, মসৃণ গোপন রাস্তা তৈরী হয়ে গেছে। আজকের পর থেকে আমার আর কখনোই তোমাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে হবে না। বলতে হবে না তোমারও। আমাদের না বলা কথাগুলো, দৃশ্যমান কবিতার মতো আপনাআপনিই পৌঁছে যাবে ওই অদৃশ্য গোপন রাস্তা ধরে আমার হৃদয়াক্ষী থেকে তোমার হৃদয়াক্ষীতে। এতসব অতলান্ত উপলব্ধির পরেও কোথায় যেন একটা কিন্তু থেকেই যায়। সেই কিন্তুটা বোধহয় আমার ভাগ্য। হ্যাঁ, ভাগ্য তারকা আমার ওপরে কখনোই খুব একটা সুপ্রসন্ন ছিল না। দরজায় ধাক্কা পড়ছে। কথপোকথনে ইস্তফা দিয়ে এবার আমাকে উঠতেই হবে। নিচতলায় বন্ধুরা এখনো অপেক্ষারত। গানের প্র্যাকটিসের পরেও কিছু অফিশিয়াল কাজ পড়ে আছে যেগুলো রাতের মধ্যেই সমাপ্ত করা বাঞ্ছনীয়। নতুন চিফ অ্যাডমিন্সট্রেটর খুব একটা সুবিধার লোক নয়। ওয়ার্কোহলিক খটোমটো জাপানি বয়স্ক ভদ্রলোক। এর আগমনে আমাদের কাজের চাপ বেড়ে গেছে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *