হৃদয়াক্ষী – ৮

শিহাব 

একটার পর একটা সাইন্টিফিক সেশন চলছে। বিভিন্ন দেশ থেকে নামকরা প্রফেসর এবং বিজ্ঞানীরা এসেছেন এই অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপোতে। আমি কোনো টপিকেই মন লাগাতে পারছি না। আমার মাথায় ইঞ্জিন কন্ট্রোল, ভেহিকেল সেফটি এবং ট্রান্সমিশন কন্ট্রোলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঠাঁই পাচ্ছে না। রুশমির প্রতারণা মস্তিষ্কের তারে তারে জট লাগিয়ে দিয়েছে। প্রতারণা শব্দটা হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে যায়, কিন্তু সব কিছু শোনার পর নিজেকে আমার প্রতারিত বৈ অন্য কিছুই মনে হচ্ছে না। কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন লাঞ্চ ব্রেকের সময় শুভ্রার ফোন পেলাম। 

—‘তোর বৌয়ের খবর জানিস নাকি? দেখলাম ওদের কফিশপের সামনে বসে এক কালা ছেলের সাথে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে।’ 

—‘তুমি কি স্পায়িং করছ ওর ওপর? 

—‘করতে হচ্ছে।’ 

—‘কেনো করতে হচ্ছে?’ 

—‘করতে হচ্ছে কারণ আমি তোর ভালো চাই শিহাব।’ 

— ‘প্লিজ শুভ্রাদি, আমার বৌয়ের ওপর স্পাইং করা বন্ধ করো। এসব একেবারেই ভালো লাগছে না।’ 

শুভ্রা রহস্য জড়ানো কণ্ঠে বলল, – ‘কালো ছেলেটার সাথে ওকে রোজ দেখা যাচ্ছে কফিশপে। তোর আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?’ 

—‘দেখা যাচ্ছে তো হয়েছে কী? হয়তো রেগুলার কাস্টমার হবে। শুভ্রা হোহো করে হেসে উঠল, ‘একটা বাজে কথা মুখে চলে এসেছিল। 

বললাম না তোর মন খারাপ হবে দেখে।’ 

—‘শুভ্রাদি প্লিজ। ফোন রাখো। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’ 

—‘তুই কবে ফিরছিস?’ 

—‘কেনো জানতে চাইছ?’ 

—‘স্প্রিং তো চলে এলো। ঠিক করেছি তোর সাথে আউটিং এ যাব।’ 

—‘কোথায় যাবে?’ 

—‘তুই কবে ফিরছিস বল না!’  

—‘পরশু সকালে।’ 

—‘পরশু তো ছুটি। আমি তাহলে পরশুদিন বিকেল বেলা তোকে বুক করলাম। তোর বৌ যেন আবার ঝামেলা না লাগায়।’ 

—‘আমি শিওর না।’ 

—‘মানে?’ 

—‘মানে, আমি বিজি থাকব। কাজ আছে।’ 

—‘শিহাব, আর ইউ ট্রাইং টু অ্যাভয়েড মি?’ 

চুপ করে রইলাম। 

—‘পরশু বিকেলে তুই আমার সাথে বিচে যাচ্ছিস। ভার্জিনিয়া বিচ। গট ইট?’ 

উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিলাম। এই মুহূর্তে সমগ্র নারীজাতটার ওপর আমার তুমুল বিতৃষ্ণা হচ্ছে। শুভ্রা রুশমির নামে অভিযোগের ঝড় তুলছে। অথচ ও নিজে কি খুব সৎ? যদি জনাথনকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে আমার পেছনে অযথা এতো সময় নষ্ট করা কেনো? কোত্থেকে আসে এতো উদ্যম? যতটুকু সম্মান বাকি ছিল এই মেয়েটার জন্য আমার বুকের কোণে, সেটাও উবে গেছে। জগতের সব মেয়েরাই কি শুভ্রা আর রুশমির মতো অস্থিরমতি, মিথ্যেবাদী আর গভীরতাশূন্য হয়? সৃষ্টিকর্তা মেয়েদের বাইরের দিকটা গড়তেই বেশি সময় খরচ করে ফেলেছেন, ভেতরটা তাই একদম বিচ্ছিরি আর কুৎসিত! সেই সময়ের মানসিক অবস্থা লিখে প্রকাশ করা আমার দ্বারা সম্ভব না, কারণ আমি হয়তো খুব একটা ভালো লিখিয়ে নই। আমার মন এতো বিষিয়ে গিয়েছিল যে ভার্জিনিয়া ফেরার আগের রাতে মানসিক অসঙ্গতি বশত একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলাম। ওই ট্যুরে সঙ্গী হয়েছিল আমার কলিগ ম্যাক্স। ম্যাক্সকে এক কথায় ওমেনাইজার বলা যায়। আটাশ বছর বয়সের মাঝেই সে বিশের অধিক সংখ্যক নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এই নিয়ে তার গর্বেরও শেষ নেই। নিজের কীর্তির কথা সে বড় গলায় যত্রতত্র বলে বেড়ায়। দেখতে সুদর্শন এবং কথাবার্তায় চরম পারদর্শী হওয়ায় মেয়েরাও খুব সহজেই ওকে দেখলে পটে যায়। 

এসব বিষয়ে আমার আর ম্যাক্সের অভিজ্ঞতায় আকাশ পাতাল ফারাক। ওর সংখ্যা যেখানে বিশ অতিক্রম করেছে আমার সংখ্যা সেখানে শূন্য। নারীদেহ এখনো আমার কাছে আদিগন্ত এক রহস্য বৈ কিছুই নয়। যে রহস্য দূর থেকে দেখেই অভ্যস্ত ছিলাম এতকাল, আজকে এই বিষাদময় বিষণ্ণ রাত্রিতে সেই রহস্য ভেদ করার মতো দুঃসাহসিক ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু ম্যাক্সের প্ররোচনায় শেষ পর্যন্ত ওর সঙ্গী হতে রাজি হলাম। কারণ আমার একটা ডিস্ট্র্যাকশন প্রয়োজন ছিল। রুশমির মিথ্যাচার আর শুভ্রার নির্লজ্জতা আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে। এই মানসিক পীড়া থেকে আমার মুক্তি চাই। 

বার, পাব কিংবা নাইটক্লাব আমার কাছে নতুন কিছু নয়। বন্ধুদের সাথে বেশ কবার যাওয়া হয়েছে এসব জায়গায়। হালকা পাতলা মদ্যপান করলেও কখনো কোন নারীর অঙ্গস্পর্শ হয়নি। কিন্তু স্ট্রিপ ক্লাবে এই প্রথম আসা। স্বাভাবিক ভাবেই নার্ভাস ফিল করছিলাম। কী মিউজিক চলছিল মনে নেই। শুধু মনে পড়ে সবুজ একট আবছা আলোর ভেতরে আমি আর ম্যাক্স বারটুলে বসে আছি। আমাদের হাতে শ্যাম্পেনের গ্লাস। এখানে ক্যাসিনোও আছে। কাছাকাছি একটা দল খুব হইচই করে জুয়া খেলছে। বারটপ ড্যান্স চলছে। নৃত্যরত স্টিপারদের বক্ষ উন্মুক্ত। আমার পাশে বসা এক প্রৌঢ় পুরুষ বারটেবলের ওপর অবিরত ডলার উড়াচ্ছে। এই টাকা স্ট্রিপারদের জন্য। চারপাশে মদ, মেয়ে মানুষ আর জুয়াখেলার উন্মাদনা। এদিকে রক্তে অ্যালকোহোলের ছোঁয়া লাগার পর আমার আশপাশটা দৈবাৎ পাল্টে গেছে। মজাই লাগছে। বেশ ফুরফুরে একটা ভাব। শরীরটা পাখির মতো হালকা। এতক্ষণের চাপা বিষণ্ণতা কেটে গেছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটা নরম হাতের স্পর্শ টের পেলাম। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি কালো চুলের এক স্প্যানিশ মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার খুব কাছে। পরনে লাল ব্রা আর শর্টপ্যান্ট। ম্যাক্সের দিকে তাকালাম। ইশারায় কিছু একটা বলল। বুঝলাম এই মেয়েকে সে যোগাড় করেছে আমার জন্য। মেয়েটা এখন আমার হাত চেপে ধরেছে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোনদিকে যেন। আমি এসব জায়গায় আগে আসিনি। এখানকার নিয়মকানুন সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। আমার এখন শরীর খারাপ লাগছে। বমি বমি ভাব হচ্ছে। প্রাণপণে মেয়েটার হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছি, আবার চাইছিও না। কারণ আমি জানি এই মুহূর্তে এখান থেকে সরে পড়লে ম্যাক্স আমাকে নিয়ে নির্ঘাৎ হাসি তামাশা করবে। অফিসে গিয়ে আমার এই অপারগতার কথা সবাইকে বলবে রসিয়ে রসিয়ে। কিন্তু ম্যাক্স তো জানে না আমি বিবাহিত। অফিসের কেউই জানে না। জানানো হয়নি। যে বিয়ে টিকবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই সেই বিয়ের কথা লোকজনকে জানানোর ইচ্ছে হয়নি। 

মেয়েটা সাজগোজ ওয়ালা মুখ আর কড়া লিপস্টিক পরা ঠোঁট নিয়ে কী যেন বলছে। এতো জোরে মিউজিক বেজে চলেছে যে ওর কথাগুলো কান পর্যন্ত আসার আগেই হারিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। আমার বমি ভাবটা তীব্রতর হয়েছে। মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিলাম। বেচারি কয়েক হাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। 

আমি আর কোনও দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে এসেছি রাস্তায়। মুখে খোলা হাওয়ার ঝাপটা লাগার পর দমবন্ধ ভাবটা একটু কেটেছে। তবুও শরীর খারাপ লাগছে। বমি হয়ে গেলে ভালো লাগত। রাস্তার ধারে ফুটপাথের ওপর বসে সিগারেট ধরালাম। ম্যাক্স কোথায় জানি না। ফ্রাইডে নাইট বলে প্রচুর লোকসমাগম এদিকটায়। পার্কিং লট গাড়িতে ভরা। হঠাৎ মনে হলো আমার পাশে কেউ একজন এসে বসেছে। তাকিয়ে দেখি স্প্যানিশ মেয়েটা। ওর পরনে এখন কালো জিন্সের জ্যাকেট। মেয়েটির উপস্থিতি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। আমার কি ওকে স্যরি বলা উচিত? নাকি কোনও কথা না বলে এখান থেকে সরে পড়া উচিত? 

—‘লাইটার হবে?’ মেয়েটি বলল। আমি পকেট থেকে লাইটার বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। ও লাইটারটা হাত দিয়ে ধরল না। ঠোঁটে চেপে ধরা সিগারেটটা একটু এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি লাইটার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম সিগারেটের মাথায়। মেয়েটির দিকে এখন তাকাচ্ছি না। কেনো যেন সংকোচ হচ্ছে। আর রাগ হচ্ছে ম্যাক্সের উপর। কী রকম বিব্রতকর একটা পরিস্থিতিতে আমাকে ফেলে দিল ছেলেটা। এসবের কোন মানে হয়? 

—‘তুমি ঠিক আছ?’ মেয়েটি প্রশ্ন করল। খুব আন্তরিক গলায়। যেন ও আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু। 

—‘হুম!’ ঘাড় নাড়লাম আলতো করে। 

—‘তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি? ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কেনো?’

বিব্রত গলায় বললাম, ‘দ্যাখো, আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি। ঘটনাটা হঠাৎ ঘটে গেছে। স্যরি।’ 

—‘কিন্তু কেনো? তোমার কি আমাকে যথেষ্ট সুন্দরী বলে মনে হয় না?’

—‘ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। আসলে… আসলে আমি ম্যারিড।’ 

মেয়েটা কিছুক্ষণ ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর হো হো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল একদম, ‘সিরিয়াসলি? এমন মজার কথা আমি জীবনে কখনো শুনিনি!’ 

আমি ওর দিকে তাকালাম। চেহারাটা এখন আর মনে পড়ে না। তবে মনে পড়ে একটা বুদ্ধির ছটা ছিল ওই মুখে।

—‘মজার কেনো?’ প্রশ্ন করলাম। 

—এখানে রোজ কত কত ম্যারিড লোক আসে তুমি জানো? যখন ওরা · আমাদের কাছে থাকে, তখন নিজেদের বৌদেরকে ভুলে যায়।’ 

—‘তাই?’ 

—হুম তাই। তোমার বন্ধু অযথা আমার সময়টা বরবাদ করল।’ 

আমি খুব সংকোচের সাথে প্রশ্ন করলাম, 

—‘তোমাকে কি সে টাকা দিয়েছে?’ 

মেয়েটি লাস্যময়ী হাসে, লাস্যময়ী গলায় বলে ‘না দেয়নি। টাকা তো তোমার দেয়ার কথা!’ 

কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে পড়লাম। 

—‘তাই নাকি? আমি তো আসলে এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। কত দিতে হবে তোমাকে?’ 

—‘দিতে হবে না। তুমি আমাকে টাচ করোনি! 

—‘তবুও, মানুষের সময়ের একটা দাম আছে, তাই না?’ 

—‘থাক লাগবে না। তোমার দেয়া সিগারেটের আগুনটাই সেই দাম মিটিয়ে দিয়েছে। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি স্প্যানিশ?’ 

—‘না।’ 

—‘তোমার অরিজিন কোথায়? টার্কি?’ 

—‘না।’ 

—‘ইটালি?’ 

—‘না’ 

একটু চুপ করে কী যেন ভাবে ও। তারপর বলে, –’ইন্ডিয়া?’ 

—‘না। বাংলাদেশ। 

—‘বান্ডাদেশ?’ 

হেসে ফেললাম। বুঝলাম, ও বাংলাদেশের নাম এর আগে কখনো শোনেনি

–‘আই লাইক ইওর স্মাইল!’ 

বলল মেয়েটা, আর দশটা সাধারণ মেয়েরই মতো। অথচ রুশমি বলেছিল আমার হাসি নাকি তার অসহ্য লাগে। কী অদ্ভুত একটা মেয়ে, এই অদ্ভুত মেয়েটাকে যত ভাবি ততই অবাক হই! 

সামনে খোলা রাস্তা। একটু পরপর হুশহাশ শব্দে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির আলোয় আমি একটু একটু মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছি। ভাবছি আজকে যদি এর ডাকে আমি সাড়া দিতাম, তাহলে কী হতো? রুশমি কি ব্যাপারটা জানার পর কষ্ট পেত? রেগে যেত? নাকি পাত্তাই দিত না? 

—‘তোমার স্ত্রীকে নিশ্চয়ই তুমি খুব ভালোবাসো। তাই না?’ 

হঠাৎ প্রশ্নটা কানে এসে লাগলো। চমকে উঠলাম মনে মনে। বাবা-মাকে ভালোবাসি, ছোটভাইকে ভালোবাসি কিন্তু রুশানিয়াকে ভালোবাসি কিনা তা তো ঠিক বুঝতে পারি না! ভালোবাসা কি কখনো বুকের মধ্যে এতো ক্লেশ, এতো অশান্তি আর এতো উৎপীড়নের উদ্রেক করতে পারে? আমি তো জানতাম ভালোবাসা সুন্দর, পবিত্র এবং স্নিগ্ধ! এই যদি হয় ভালোবাসার প্রকৃত স্বরূপ তবে এই ভালোবাসা কে কবে চেয়েছিল? আমার রবীন্দ্রনাথের একটা গানের লাইন মনে পড়ল হঠাৎ, 

তোমরা যে বলো দিবস-রজনী ‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’
সে কি কেবলই চোখের জল? সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ? 

এই প্রশ্ন আমাকে আজ অবধি কুরেকুরে খায় ভেতরে ভেতরে। 

—‘লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ? 

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ও আবার বলল, ‘তোমার স্ত্রীর ছবি আছে? দেখাবে আমাকে? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি নিশ্চয়ই অনেক দিন পর্যন্ত তোমার গল্প করব মানুষের সাথে। কারণ তোমার মতো ডিসেন্ট ম্যান আমি জীবনে আর একটিও দেখিনি। 

আমি মনে মনে খুব হাসলাম। আমি নাকি ডিসেন্ট! তবে সে আমাকে সুযোগ পেলেই অসভ্য বলে গালাগাল দেয় কেনো বলতে পারো? 

রুশমির একটা ছবি আছে আমার মোবাইলে। একটাই, এটা হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছিল মম। আমাদের বিয়ের রাতের ছবি। আমরা ফুল ছড়ানো বিছানার ওপর বসেছি দুজনে পাশাপাশি। বসানো হয়েছে জোর করে। আমার মুখে রাজ্যের বিরক্তি। রুশমির বিরক্তিটা অবশ্য টের পাওয়া যাচ্ছে না। ওর মাথায় লাল রংয়ের হিজাব। রংটা বেশি ক্যাটক্যাটা। একেবারে চোখ ধাঁধানো আর সেই চোখ ধাঁধানো লালের ঠিক নিচে যে স্নিগ্ধ মুখশ্রী। সেই মুখশ্রীতে কী আছে তা আমি জানি না, শুধু জানি ওদিকে তাকালে… তাকালে বুকে একটা অতলান্ত অনুভূতি জেগে ওঠে মুহূর্তের মাঝে। শুধু চেয়েই থাকতে ইচ্ছে হয়! 

—‘তোমার ওয়াইফ খুব সুন্দর!’ 

আমি ছবির ওই জন্মকাজল চোখজোড়ার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে বললাম, ‘হ্যাঁ, একটু বেশিই সুন্দর!’ 

মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, ‘ইউ নো হোয়াট? শী ইজ আ লাকি গার্ল। এতো ভালোবাসা সবার ভাগ্যে জোটে না। ইশ আমাকে যদি কেউ এতোটা ভালোবাসতো!’ 

মম এসেছে আমার অ্যাপার্টমেন্টে। আমি সোফার ওপর শুয়ে আছি। আজ ছুটির দিন। পৃথিবীটা এখন আর আগের মতো নেই। পৃথিবী বদলে গেছে। করোনার প্রকোপে থমকে গেছে আধুনিক বিশ্ব। রোজ লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি ভাবি এতো লোক প্রতিদিন মরে কিন্তু আমি মরি না কেনো? মরে গেলেই তো বেঁচে যেতাম! মম মুখের মাস্ক খুলে আমার সম্মুখের সোফায় বসল। গমগমে স্বরে বলল, ‘তুমি কি ওই বোবা মেয়েটাকে বিয়ে করেছ?’ 

—‘তোমার সাথে কথা বলতে আমার ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও এখান থেকে মম। প্লিজ ডিস্টার্ব করো না।’ 

মম এই অপমান গায়ে মাখলো না, আগের চাইতেও শক্ত গলায় বলল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তোমরা কি বিয়ে করেছ?’ 

আমি হাসলাম, ‘এই প্রশ্নটা তুমি এর আগেও অনেকবার করেছ। তোমার কি আমার কথা বিশ্বাস হয় না? আমি তো বলেছি, বিয়ে জীবনে একবারই করেছিলাম। আর করব না!’ 

মমের মুখখানা বিতৃষ্ণায় কুঁকড়ে গেলো, ‘ছিঃ এই দিন দেখার আগে আমার মৃত্যুহলো না কেনো?’ 

আমি চুপ করে আছি। আমার চোখ শূন্যে নিবদ্ধ। কিছু শুনছি না ঠিক মতো, দেখছিও না। আমার চোখের সামনে এখন ক্যালিফোর্নিয়ার আলো ঝলমলে এক রাত। পাশে অপরিচিতা স্প্যানিশ মেয়ে। আমি রুশমির ছবিটার দিকে চেয়ে আছি অপলক। কাল খুব ভোরে আমার ফ্লাইট। সব কিছু ঠিক থাকলে দুপুর বারোটার মধ্যে ভার্জিনিয়া পৌঁছে যাব। রুশমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে? নাকি আমার আগমনের কথা বেমালুম ভুলে বসে থাকবে? 

—‘বোবা একটা মেয়ের সাথে একই ফ্ল্যাটে পড়ে আছ। তোমার লজ্জা করে না?’ দাঁত কিড়মিড় করে বলছে মম। বিরক্তি নিয়ে বললাম – ‘বোবা বলে ডেকো না। শুনতে খারাপ লাগে। মেয়েটার একটা নাম আছে।’ 

—‘মৃত্যুর পর আমি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেব? কী শিক্ষা দিয়েছি আমি আমার সন্তানদের?’ 

শোয়া থেকে উঠে বসলাম, ‘তুমি কি জানো রুশমি কোথায়? বাই এনি চান্স?’ 

মম তাৎক্ষণিক ভাবে চোখ নামিয়ে নিল নিচে, ‘না।’ 

— ও কি বেঁচে আছে?’ 

— ‘জানি না।’ 

—‘তোমার কি ওর মায়ের সাথে এর মাঝে কথা হয়েছে?’ 

—‘ওরা কোথায় আছে জানি না।’ 

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। তারপর না চাইতেও আমার কন্ঠনালী দিয়ে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসলো, ঢালু জায়গা থেকে গড়িয়ে পড়া মার্বেলের মতো মসৃণ গতিতে এবং ঘড়ঘড় শব্দে। 

—‘আমার সাথে কেনো এমন হলো মম?’ 

—‘যা হয়েছে, ভালোর জন্যই হয়েছে। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন, এটা জেনে রেখো।’ 

—‘এটাকে ভালোথাকা বলে?’ 

—‘না বলে না। কিন্তু খুব শীঘ্রই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর তোমার পাপা তোমার জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। বাংলাদেশে থাকে। ভদ্র ঘরের মেয়ে। বিয়ের পর এখানে নিয়ে আসব। তোমার লাইফে সব কিছু সেটেল্ড হয়ে যাবে। ভালো চাকরি আছে, বাবা-মা ভাই নিয়ে সুন্দর ছিমছাম পরিবার আছে। এখন একটা লক্ষ্মী মেয়ে ঘরে নিয়ে আসলেই সব ঠিকঠাক। আর কী চাই?’ 

আমি কিছুক্ষণ মমের থমথমে মুখটার দিকে নিবিড় চোখে চেয়ে থাকলাম। তারপর অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললাম, ‘আর কী চাই? আমার একটা রুশানিয়া চাই মম! দিতে পারবে?’ 

রুশমি 

I want to do with you what spring does with the cherry trees! 

—Pablo Neruda 

.

কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি, ঐযে স্টিফান। ওর সাথে এই দুদিনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক আলাপ হলো। ও বিকেলের দিকে কফিশপে চলে আসত। বাবাজান মেজো আর ছোটকেও পাঠিয়ে দিয়েছে এই আলোচনায় অংশ নেবার জন্য। আমরা তিনবোন কফিশপের পোর্টে বসে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছি স্টিফানের সাথে। আলোচনা শুধু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। ব্রিটিশ শাসন এবং দেশভাগের প্রসঙ্গও উঠে এসেছে। স্টিফানের একটা প্রশ্ন আমাকে চমকে দিয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। ও প্রশ্ন করেছিল, ‘দেশভাগ তোমাদেরকে কী দিয়েছে? কেমন হতো যদি বাংলাদেশ নামে আলাদা একটি ভূখন্ডের অধিকারী না হয়ে তোমরা আজীবন ভারত বা পাকিস্তানের অংশ হয়েই থেকে যেতে?’ 

মেজো উত্তর দিয়েছিল, ‘আমার মতে এটা ভালো হতো। তাহলে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা আরো বেশি শক্তিশালী হতাম।’ 

আমি চমকে উঠেছিলাম ওর উত্তর শুনে। বলে কী এই মেয়ে! স্টিফানকে বললাম, ‘ছোট মানুষ। না বুঝেই কথা বলে। ইন্ডিয়া কিংবা পাকিস্তান, এর কোনটার অংশ হয়েই আমরা টিকে থাকতে চাইনি কখনো। আমরা চেয়েছি স্বাধীন, সার্বভৌম একটি দেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে আলাদা একটি জায়গা। দেশভাগের সময় ব্রিটিশদের চরম ভুল ছিল শুধুমাত্র ধর্মের ওপর ভিত্তি করে আমাদেরকে পাকিস্তানের সাথে লটকে দেয়া। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মাঝখানে ছিল ভারত। দুটি দেশের সংস্কৃতিতে আকাশ পাতাল ফারাক। কী করে দুই প্রান্তের দুটি দেশের মানুষ একাত্ম হবে? এদের মুখের ভাষাই তো আলাদা! ব্রিটিশদের ওই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বোঝা আমাদেরকে টানতে হয়েছে আরো বহু বছর। আর ভারতের অংশ হিসেবে টিকে থাকার কথা আমরা ভাবতেই পারি না। ভারতে তো অগণিত প্রাদেশিক ভাষা আছে। যার মধ্যে বাংলাও একটি। কিন্তু পৃথিবীর মানচিত্রে শুধুমাত্র বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের একটি আলাদা জায়গা আছে, যার নাম কিনা বাংলাদেশ, এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের একটি বিষয়।’

ঝুমি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘কিন্তু বড়পু, আমার মনে হয় আমরা ইন্ডিয়া হয়ে থাকলেই বেশি ভালো হতো। রাষ্ট্র হিসেবে আমরা…’ 

—‘চুপ করো ঝুমি! তুমি বড্ড বোকা!’ 

স্টিফান হাসে। মাজা মাজা কালো চামড়ার ওপর ঝকমকিয়ে ওঠে সাদা দাঁত। নরম স্বরে বলে, ‘ওকে বকছ কেনো? আমি ওর যুক্তিটাও শুনতে চাই।’ 

ঝুমি খুশি হয়ে বকবক শুরু করে। এভাবে নানামুখী আলোচনা সমালোচনায় আমাদের বিকেলগুলো ভালোই কাটছিল। জাহিদকে আমাদের বাড়ির গেস্টরুমে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। বাবা-আম্মু ওর খুব যত্ন করছে। আম্মু বলেছে আল্লাহ তায়ালা তার পুত্রসন্তানের শখ মিটিয়ে দিয়েছে এই দুই ভাইয়ের মাধ্যমে। মেজো আর ছোটর সাথে জাহিদের ভালোই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সমস্যা একটাই, জাহিদের সামনে ঝুমি সুমিকে হিজাব পরে থাকতে হয়। বাড়ির ভেতর হিজাব পরে থাকতে থাকতে বেচারিরা ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে গেছে। আমরা রাত জেগে মুভি দেখি। দাবা অথবা উনো খেলি। সবাই খুশি, সবাই সুখী! সুখ নেই শুধু আমার মনে। জাহিদের সাথে শিহাবের রোজ একবার কথা হয়। জানি না আমার কথা কিছু জানতে চায় কিনা! আমি ওর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টের গানগুলো প্রায়ই শুনি। জাহিদ বলেছে ওগুলো নাকি একটাও শিহাব নিজে আপলোড করেনি। বড় ভাইয়ের হয়ে জাহিদই আপলোড করেছে। শুনে আমার মনে একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, এই অ্যাকাউন্টটা বুঝি শিহাবের নাম করে জাহিদই চালায়। কারণ শিহাবকে আমি যতটা চিনেছি তাতে মনে হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের গুণ জাহির করে বেড়ানোর মতো শৌখিন মানসিকতা ওর একেবারেই নেই। সে ভীষণ ইন্ট্রোভার্ট একটা মানুষ 

শিহাবের ফিরে আসার দিনটির কথা মনে পড়ছে। আমি খুব সকাল সকাল অ্যাশবার্নের বাড়িতে এসেছি। ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজে লেগে গেছি কোমর বেঁধে। জাহিদ সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেছে। কাজ থাকা সত্তেও আমি কাজে যাইনি আজ। ছুটি নিয়েছি। জাহিদ বলেছে শিহাব দুপুর বারোটার মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবে। একটু পরপর ঘড়ি দেখছি। অযথাই বুক কাঁপছে আমার। সময় যেন কাটছেই না। সোয়া বারোটার দিকে প্যাটিওতে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির সামনের রাস্তাটার দুটি পাশ ম্যাগনোলিয়া গাছ দিয়ে ঘেরা। শীতকালে গাছগুলো চোখে পড়েনি অত। বসন্তের আগমনে ওদের রূপে আগুন লেগেছে। গোলাপি ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে ডাল। ওই রাস্তাটা এখন জান্নাতের মতো সুন্দর। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মনে হয় যেন জান্নাতের বাগানে হাঁটছি। খোদার পৃথিবী এত সুন্দর যে এই স্থানকেই মাঝে মাঝে বেহেশত বলে ভ্রম হয়। তাহলে বেহেশত আরো কতই না সুন্দর হবে! ভাবা যায়? না, যায় না! 

আজকের দিন রোদ ঝলমলে। বাতাস বেশ ঠান্ডা। এখন ফুলের পরাগায়নের সময়। চারপাশে পলেন উড়ছে ক্রমাগত। আমার পলেনে এলার্জি আছে। শুধু আমারই নয়। আমেরিকার বেশিরভাগ লোকেরই পলেনের কারণে 

এই সময় ঠান্ডা, কাশি আর জ্বর হয়। 

একটা কালো টয়োটা গাড়ি বাড়ির সম্মুখ বরাবর এসে দাঁড়ালো ঠিক বেলা সাড়ে বারোটার সময়। খুব তেষ্টা লাগার পর এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেলে কী রকম শান্তি লাগে তা প্রতিটি মানুষ জানে। কিন্তু চোখের তৃষ্ণা মেটার পর কেমনতর অলৌকিক সুখী অনুভূতিতে বুক ভরে যায় কানায় কানায়, তা কি সবাই জানে? আমি অন্তত জানতাম না। জানলাম আজ, এই মাত্র! 

গায়ে কালো জ্যাকেট, কালো জিন্স, আর চোখে কালো সানগ্লাস পরে মানুষটা যখন ঝকঝকে রোদ মাথায় নিয়ে গোলাপি ম্যাগনোলিয়ার ছায়াঘেরা রাস্তার ওপর পা রাখল, ঠিক সেই মুহূর্তে, আমার কাঠফাটা রোদ্দুরে চৌচির হওয়া তৃষাতুর বক্ষে হঠাৎ এক পশলা আকাশ ভাঙা বৃষ্টি নামলো ঝমঝমিয়ে! আমি সেই অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে চুবুচুবু হয়ে ওকে দেখতে লাগলাম। কাঁধে ব্যাকপ্যাক নিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে চোখ পড়েছে আমাদের। আমার মেরুদণ্ড শিরশির করছে। হাত পা অসাড়। 

—‘হেই রুশানিয়া! হাউ ইজ গোয়িং?’ 

—‘প্রিটি গুড, সো ফার! 

বুকের ভেতর হরেক রকম অনুভূতি তুষারকুচির মতো ফুলঝুরি হয়ে উড়ছে। মনে মনে বলছি আমি কেমন আছি তা তুমি জেনে কী করবে? একটা বার মনে পড়েছে কি গত তিনদিনে আমার কথা? অভিমানের পাশাপাশি এক সুগভীর সুখানুভূতিতে আমার মন আচ্ছন্ন। ও ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে প্যাটিওতে উঠে আসছে। আমি এখান থেকে ওর দেহের ঘ্রাণ পাচ্ছি। এই ঘ্রাণ শুধু আমি ছাড়া অন্য কেউ পায় কিনা জানি না। কেমন যেন মাদক আর পাগল করা ঘ্রাণ। লজ্জা লাগছে এই ভেবে যে, চলে যাবার দিন কী অভদ্রতাটাই না ছেলেটা আমার সাথে করেছিল। আজ আবার লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আজকেও যদি অপমান করে তবে সেই অপমান সইবার মতো শক্তি আমার আছে কি? 

এই কদিন ও দাড়ি কামায়নি। মুখে গুড়িগুড়ি এবড়োথেবড়ো দাড়ির জঙ্গল। বাদামি চোখজোড়া ক্লান্তিতে মাখামাখি। একটু লালচে। মনে হচ্ছে রাতে ঘুমায়নি। এছাড়াও ওর চোখে এখন একটা বিভোর ভাব আছে। এই ভাবটা আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি। গত তিনদিনে মনে হয় ও একটু রোগা হয়েছে। রোগা হওয়ায় চেহারার ধার বেড়ে গেছে। সেই মুখের ধার আমার কলিজার ওপর এসে আঘাত হানছে। চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। কয়েকটা সেকেন্ড আমরা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। একজন আরেকজনের দিকে চেয়ে থেকে। তারপর ও প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে আনলো। আমার দিকে মুঠোবন্দি হাত এগিয়ে দিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আই ওয়ান্ট টু ডু উইদ ইউ, হোয়াট স্প্রিং ডাজ উইদ দ্যা চেরি ট্রিজ!’ খুব ধীরস্বরে বললেও আমি স্পষ্টভাবে ওর কথাগুলো শুনতে পেয়েছি। আমার হৃৎপিণ্ড এক ধাক্কায় গলার কাছে চলে এসেছে। এটা Pablo Neruda’ র খুব বিখ্যাত এক কবিতার লাইন। শিহাব আমার হাতের মুঠোয় কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছে। আমি কম্পমান হাতের মুঠো খুলে স্তব্ধ হয়ে গেছি। আশ্চর্য সুখে আমার দেহ মন ভরে গেছে। চোখের কোণে টলমল করছে জল। এই প্রথম ওর কাছ থেকে কিছু উপহার পেলাম। 

পেলাম এক মুঠো চেরিফুল! 

শিহাব 

রুশমি আমার কথাগুলো শুনতে পেয়েছে কিনা জানি না। না শুনলে বেঁচে যাই। তবে পাছে আবার শুনে ফেলেছে সেই আশংকায় ভেতরটা এখন আড়ষ্ট হয়ে গেছে। মন আঁকুপাঁকু করছে নানারকম প্রতিকূল চিন্তায়। এয়ারপোর্টের সামনে চেরিগাছটা দেখেই মুঠো ভর্তি ফুল কুড়িয়ে নিয়েছিলাম গাছের গোড়া থেকে, অনেকটা অন্যমনস্কভাবে। চেরিফুল অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখলেই আমার কুড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করে। এটা অনেকদিনের পুরোনো অভ্যাস। কিন্তু আজ বাড়ি ফিরে রুশমিকে যখন দেখলাম, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে, তখন মনে হলো ফুলগুলো যেন ওর জন্যই কুড়িয়ে আনা। কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই তুলে দিলাম ওর হাতে। তারপর ওই কবিতার লাইনটা… হঠাৎ কেনো যে অসতর্কতা বশত বেরিয়ে গেলো আমার মুখ থেকে! আশ্চর্য! 

গোসল সেরে, কাপড় পাল্টে নিচে নেমে এসেছি। উদ্দেশ্য, ক্রিকের ধারে যাব, পাথরের ওপর বসে শান্তিতে একটা সিগারেট ধরাব। তারপর যদি জটলাগা মাথাটা একটু পরিষ্কার হয়! দেখলাম রুশমি ড্রইং রুমের সোফায় সিডনি শেলডনের বই হাতে নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল, 

—‘খেতে এসো।’ 

—‘ক্ষিদে নেই।’ দুই পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে দিয়ে বললাম। 

—‘খেয়ে এসেছ?’ 

—‘না। ব্রেকফাস্ট হেভি ছিল। ক্ষিদে পায়নি এখনো।’ 

কথাটা বলে শেষ করে এক মুহূর্তও দেরি করিনি আর। বাইরে বেরিয়ে এসেছি। ব্যাকইয়ার্ডে পৌঁছনোর পর ঠিক পেছনে একটা ছায়া আবিষ্কার করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রুশমি। বুকের ওপর বই ধরা। খোলা চুল। পরনে একটা ফিকে নীল রংয়ের সুতি জামা। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা। গলা আর হাতের কাছে কীরকম যেন… লেস বলে মনে হয় এটাকে। নট শিওর! বাট জামাটাতে একটা ভিন্টিজ ভাব আছে। এই মুহূর্তে হাতে বই ধরে থাকা খোলা চুলের রুশমিকে শেক্সপিয়ারের নাটকের নায়িকা বলে চালিয়ে দেয়া যাবে নির্দ্বিধায়। 

—‘কী চাই?’ একটু হয়তো রুড শোনালো আমার প্রশ্নটা। রুশমির মুখে চকিতে একটা গাঢ় ছায়া পড়ল। এক সেকেন্ড কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ 

জঙ্গলের দিকে ইশারা করে বললাম,-–‘উইলো ফরেস্ট।’

—‘ক্যান আই ওয়াক উইদ ইউ?’ 

—‘শিওর!’ বললাম, একটু অস্বস্তি নিয়ে। 

তখন আকাশজোড়া ঘোর দুপুর। অরণ্যের ঘন বৃক্ষরাজির কচি সবুজ পাতার ওপর থইথই করছে রোদ। বুনো ঝোপের গায়ে বেগুনি আর হলদে জংলী ফুলের ছড়াছড়ি। ক্লান্ত এবং মন্থর নিস্তব্ধতা জড়িয়ে আছে প্রকৃতিতে। বনপথ শান্ত সুনিবিড়। রুশমি একটু দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছিল। আমি আগে, ও পেছনে। একটা কিশোর ছেলে হঠাৎ সাইকেলে টুং টাং ঘণ্টা বাজিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো ঢালু লাল মাটির সরু এবড়োথেবড়ো পথটা দিয়ে। এছাড়া আশেপাশে অনেকদূর অবধি কোন মানুষের দেখা নেই। 

আচ্ছা, রুশমি কি আমাকে কিছু বলতে চায়? কিছু দিন ধরে ওর আচরণে আমি অল্পবিস্তর পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। আগে সে আমাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলত, ক্যাটক্যাট করে কথা বলত, সুযোগ পেলেই অপমান করত। ইদানিং ওর মধ্যে আগের সেই উদ্ধত ভাবটা নেই। বরং একটু যেন নরম, অনুগত এবং মার্জিত। বুঝতে পারছি না মেয়েটাকে সরাসরি ওর অতীত সম্পর্কে প্রশ্ন করা ঠিক হবে কিনা। অবশ্য এই প্রসঙ্গে তো আগেও কথা হয়েছে। সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে তার কোন প্রেম ছিল না, বয়ফ্রেন্ড ছিল না। শুভ্রা তাহলে এসব তথ্য কোত্থেকে পেলো? বানিয়ে বানিয়ে বলছে না তো? কিন্তু শুভ্রাকে আমি যতটুকু চিনি একেবারে মন গড়া কথা বলার মতো মানুষ সে না। তাছাড়া যা রটে, তা কিছুতো বটে! 

ভাবতে ভাবতে আমার নিজের ওপর রাগ ধরে যাচ্ছিল। আমি কখনো মেয়েদের নিয়ে ভাবতাম না এত। শুভ্রাকে আমার ভালো লাগত, কিন্তু ও কোনদিন এতটা ভাবায়নি আমাকে। অবসরে ক্রিকের ধারে বসে বসে আমি গানের কথা ভাবতাম। ভাবতে ভাবতে মাথায় নতুন নতুন সুরের আনাগোনা হত। ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাবার স্বপ্ন দেখতাম। সাশার মতো, আমিও ভাবতাম একদিন আমাদের তৃতীয় বিশ্বের সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য খুব অভাবনীয় কিছু একটা করে ফেলব। দেশে থাকা হয় না। কিন্তু মনটা সব সময় দেশের মাটিতেই পড়ে থাকে। মিস করি। ভীষণ ভাবে মিস করি। 

ক্রিকের পানিতে ঢেউ তুলছে একটা অবাধ্য বাতাস। রোদ নাচছে ওই ঢেউ ভাঙা পানির ওপর। শব্দ হচ্ছে ঝিরঝির ঝিরঝির। ওই পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ড্রিমি চেরি ফেয়ারির সারা শরীর ভরে গেছে মুক্তোদানার মতো অসংখ্য চেরিফুলে! ফুলসমেত একটা বাঁকা ডাল ক্রিকের রূপালি জলের ওপর পড়েছে। হলুদ রংয়ের একটা ছোট্ট ওয়্যাবলার পাখি দোল খাচ্ছে ওই ডালের ওপর বসে। মিহি সুরে ডাকছে। চেরি গাছের পাশে একটা হোয়াইট ম্যাগনোলিয়া ট্রি দাঁড়িয়ে আছে রাজকীয় ভঙ্গিতে। এই গাছের আকৃতি ঝোপালো। গম্বুজের মতো দেখতে। কয়েকটা সাদা ফুল ফুটে আছে ওর গায়ে। এই হোয়াইট ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণ ভারী সুন্দর! 

লক্ষ্য করলাম রুশমি পাথরের ওপর পা ফেলে ফেলে ওপাড়ের দিকে যাচ্ছে। ক্রিকটা সরু। পার হতে খুব বেশি সময় লাগলো না। আমি এপাড়ের একটা পাথরের ওপর নিশ্চুপ বসে থেকে ওপাড়ের দৃশ্য দেখছি। 

বছরের এই সময়টায় আমি ড্রিমি চেরি ফেয়ারিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। এ সময় আমার সারাক্ষণ ঠিক এখানটায় ওর সামনে চুপটি করে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আজকের সোনালী দুপুরে, ওই চেরিগাছের নিচে বসে থাকা ফিকে নীল রঙের ঘের ওয়ালা জামা পরা পিঠের ওপর একরাশ চুল ছড়িয়ে দেয়া রুশানিয়ার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, আমি বুঝি কখনো স্বপ্নেও এতো পবিত্র দৃশ্য দেখিনি। এই দৃশ্য অপার্থিব! অলৌকিক! আমার চোখের সামনের এক টুকরো জমিনটা নিশ্চয়ই এই জরাজীর্ণ পৃথিবীর কোন অংশ নয়। এই জমিন স্বৰ্গীয়! 

—‘কী দেখছ?’ হঠাৎ প্রশ্ন ছুটে আসে ওপাড় থেকে এপাড়ে। ঘোর ভাঙে আমার। ইতস্তত করে বলি, 

—‘গাছটাকে।’ 

—‘গাছটাকে?’ অবাক হয় রুশমি। 

আমাদের মাঝখানে বিশ কদমের দূরত্ব। এটা কোন দূরত্বই নয়। তবুও রুশমি এতো জোরে কথা বলছে যে মনে হচ্ছে যেন সে আটলান্টিকের ওপাড়ে বসে আছে। আমি গলায় একটু নির্বিকার ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলি, ‘হ্যাঁ গাছটাকে। ওর নাম ড্রিমি চেরি ফেয়ারি। ওকে আমি ভালোবাসি।’ 

–‘কী?’ 

কথাটা শুনে ও কেনো যেন খুব চমকে উঠল। একটু বুঝি অসন্তুষ্টও হলো। যেন মানুষ হয়ে গাছকে ভালোবাসা মহাপাপ। 

—‘ভালোবাসি।’ 

—‘কাকে?’ রুশমি হতভম্ব।

—‘চেরিগাছটাকে।’ 

রুশমির ভ্রু কুঁচকে গেছে। চোখে অবিশ্বাস। 

—‘গাছকে কেউ কোনদিন ভালোবাসে?’ 

—‘বাসলাম তো! ইজ’ন্ট শী বিউটিফুল?’ 

রুশমি কোন উত্তর না দিয়ে আগের চাইতেও বেশি রকমের গম্ভীর হয়ে গেলো। বাতাসে গোলাপি চেরির ঝালর উড়ছে, উড়ছে রুশমির খোলা চুল আর ফিকে নীল জামার ঘের। ও হাত দিয়ে চুল সামলাচ্ছে আর কাজল কালো ঐশ্বরিক দুটি চোখ মেলে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। ছবির মতো সুন্দর! নাহ, আসলে ছবির চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। এত সুন্দর মেয়ে পৃথিবীর কোনও শিল্পী দেখেনি কখনো, বাজি ধরে বলতে পারি! আমি শিল্পী হলে ওই চেরিফুলের রাজকীয় ঝালরের নিচে বসে থাকা অপূর্ব সুন্দর রাজকন্যাকে নিশ্চয়ই স্থিরচিত্রে বন্দি করতাম। 

—‘এই জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে। এখানে আমি বিকেলবেলা বই পড়তে আসব।’ স্বগতোক্তির মতো কথাটা বলে একটু থামল সে। তারপর আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল, 

—‘তোমার ট্যুর কেমন কাটল?’ 

আমি সিগারেটে আগুন ধরিয়েছি একটু আগে। ধোঁয়া ছাড়লাম, ‘খারাপ না, একটা স্ট্রিপ ক্লাবে গিয়েছিলাম। লাস্ট নাইট।’ 

রুশমি নড়ে উঠল কথাটা শুনে। গাছের গায়ে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে উঠল ওর মেরুদণ্ড। চোখের বিস্ময়ের সাথে মিশে গেলো তেজের হলকা। 

—‘কেনো?’ 

—‘কেনো যায় মানুষ ওসব জায়গায়? তুমি জানো না?’ 

রুশমি থমকানো চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ওর চোখের দৃষ্টি পড়ার চেষ্টা করছি। সেখানে এখন প্রলয়ের পূর্বাভাস। অপেক্ষায় আছি ওর মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। কিন্তু ও কিছু বলছে না। স্তব্ধ হয়ে আছে শুধু। পাতলা সুন্দর দুটি ঠোঁট কিঞ্চিৎ ফাঁকা। রোদের এক টুকরো সোনালি ঝিকিমিকি এসে পড়েছে ওখানে। ঠোঁটজোড়া এখন কমলার কোয়ার মতো সতেজ দেখাচ্ছে। যেন টুপ করে খেয়ে ফেলা যাবে। নিজের লাগামছাড়া অবাধ্য ভাবনায় নিজেই বিব্রত হয়ে পড়লাম। চোখ সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। কিন্তু চুম্বকের আকর্ষণ কাটল না। আবারও দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ওই ঠোঁটের ওপরেই। হঠাৎ মনে হলো আমি যদি এখন এপাড় থেকে ওপাড়ে ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খাই, ও কি খুব রেগে যাবে? 

রুশমি 

‘I will bring you happy flowers from the mountains,
bluebells, dark hazels, and rustic baskets of kisses! 

— Pablo Neruda 

.

একটু আগে এই স্থানটিকে আমার মায়ালোক বলে ভ্রম হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ স্থান। এই সরু জলাশয়ের স্রোত আর পাখির কিচিরমিচির, হেম রংয়ের চকচকে রোদ্দুর, মাথার ওপরের নীল নির্জন অন্তরীক্ষ, গোলাপি মুক্তোর মতো চেরিফুলের ছাউনি, বাতাসে মিশে থাকা সাউদার্ন ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণ আর ওপাড়ের পাথরের ওপর বসে থাকা মনোহর হাসিওয়ালা পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় পুরুষটি। এই সমস্তটাই আমার মনের শহরকে এক অলৌকিক আলোতে উদ্ভাসিত করে তুলেছিল। আমি ভাসছিলাম আনন্দ সাগরে। কিন্তু এখন আর সেই আনন্দ সাগরের বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই। আমার বাবাজান বলে ক্রোধ, লোভ, হিংসা এই ইন্দ্ৰিয়গত দুষ্টু প্রবৃত্তি বা রিপুগুলির দাসত্ব মানুষকে নিকৃষ্ট কীটে রূপান্তরিত করে। এদেরকে কোনভাবেই নিজের মধ্যে স্থান দেয়া যাবে না। অথচ আমাকে দ্যাখো, আমার কী হচ্ছে! এই মুহূর্তে একটা ফোঁটা বল পাচ্ছি না ভেতরে! শক্তি পাচ্ছি না, বুদ্ধি পাচ্ছি না! আমি পরাজিত! দুর্ধর্ষ এক ডাকাতিয়া ঈর্ষার কাছে আমি আজ নতমস্তকে পরাজিত। ঈর্ষায় আমার ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে যাচ্ছে। চেরিগাছকে ভালোবাসাটা তেমন গুরুতর কিছু নয়। যদিও কথাটা শোনামাত্র আমার ইচ্ছে হয়েছে একটা কোদাল নিয়ে এসে গাছটাকে এই মুহূর্তে উপড়ে ফেলি, কিংবা ওর গায়ে ফুটে থাকা অপূর্ব সুন্দর চেরিফুলগুলি টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলি। পরমুহূর্তেই মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি এই বলে যে, গাছ তো গাছই। মানুষ তো নয়! গাছকে হিংসা করা কি আর মানুষকে মানায়? কিন্তু এখন আবার কী শুনলাম? স্ট্রিপক্লাব! কেনো? তোমাকে আমি মিছিমিছি আমার বাবাজানের সাথে তুলনা করেছি শিহাব। তুমি তো মোটেও আমার বাবাজানের মতো নও! আমার বাবাজান কোনও পরনারীর দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায় না। আর তুমি? তা সারারাত নগ্ন মেয়েছেলের সাথে কাটিয়ে, সকাল বেলা আমার জন্য চেরিফুল নিয়ে আসা কেনো? এই প্রহসনের অর্থ কী? 

বই খুলে আমি বইয়ের পাতায় মন ডুবানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি। কিন্তু ওখানে এখন ঘোর বিদ্রোহ। দাউ দাউ করে অগ্নি মশাল জ্বলছে। চোখের বারান্দায় আরেকটু হলেই বন্যা নামবে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখেছি। আমি জানি আমার কেনো এখন কান্না পাচ্ছে। নিজেকে আর কত ফাঁকি দেব? নিজের কাছে নিজে ধরা পড়ে গেছি বহু আগে। জানি না আমার ভাগ্যটা এত খারাপ কেনো! যে মানুষটাকে এতো করে চাই, সে মানুষটাকেই কেনো বাইরের পৃথিবী অমন হাতছানি দিয়ে ডাকছে অনবরত? আমি তো জানি না কী উপায়ে ওকে দুনিয়ার সবার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে শুধুমাত্র নিজের করে রাখা যায়। উপায়টা যদি কেউ আমাকে বাতলে দিত! 

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে এত কিছুর পরেও আমার মন ওর প্রতি বিরূপ হচ্ছে না। সে আমার কাছে ক্ষমা চায়নি, তবুও আমি কোন এক বিচিত্র কারণে আজলা ভর্তি ক্ষমা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি। আড়চোখে দেখলাম ফুলপ্যান্ট গুটিয়ে নিয়ে পানিতে নেমেছে। ক্রিকের জল পরিষ্কার। পরিষ্কার জলের গায়ে চিকচিক করছে সূর্যরশ্মি। জলের নিচের পাথরকুচি খালি চোখে স্পষ্ট দেখা যায়। শিহাব হাঁটুজল ঠেলে সোজা এগিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে জল গভীর। ছেলেটা কোথায় যায়? মাঝ বরাবর গিয়ে থামল সে। ঢেউ ভাঙ্গা জলের ওপর থেকে, দুহাত বাড়িয়ে, ঝুঁকে নিয়ে কিছু একটা কোলে তুলে নিল। ভালোমতো তাকিয়ে দেখি একটা মেটে রং চামড়ার শেয়ালছানা। বেচারার একটা পা একটু বেঁকে গেছে। সামান্য রক্তপাতও হচ্ছে বলে মনে হলো। শিহাব এখন শেয়ালছানাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাঁটুজল ঠেলে এই পাড়ে এগিয়ে আসছে। ছোট্ট শেয়ালটা ওর প্রশস্ত বুকের সাথে মাথা লাগিয়ে রেখেছে। সবল সুগঠিত বাহুদ্বয় যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে এক রত্তি প্রাণীটাকে। কী আশ্চর্য! আমার এখন ওই এক রত্তি শেয়ালছানাটাকেও হিংসে হচ্ছে। হায়, আমার কেনো পা ভাঙে না? হাত ভাঙে না? এই শেয়াল ছানার ভাগ্য তো আমার চেয়ে ঢের ভালো! ছিঃ কী সাংঘাতিক বাজে চিন্তা। মাফ করো! হে খোদা! তুমি আমাকে মাফ করো। শিহাব পাড়ে উঠে এসেছে। শেয়ালছানাটাকে নামিয়ে দিয়েছে মাটিতে। বুক ভর্তি মমতা নিয়ে বলছে, ‘ইশ বেচারা মনে হয় সাঁতার পারে না। ক্রিক পার হতে গিয়ে ডুবে গিয়েছিল। দ্যাখো পায়ে খুব ব্যথা পেয়েছে। ওর মা কোথায় কে জানে!’ 

আমি ভ্রুকুটি বক্র চোখে শেয়ালটার দিকে চেয়ে আছি। এই শেয়াল, এই চেরিগাছ আর ওই স্ট্রিপক্লাবের মেয়েরা এদের প্রত্যেকের ওপর আমার এই মুহূর্তে অদম্য এক অমানবিক রাগ হচ্ছে। 

কী ছেলেমানুষই না ছিলাম। তাই না? অথচ দ্যাখো মাত্র তিনটা বছরে আমি কত খানি বদলে গেছি! দুহাজার পনেরোর রুশমি আর দুহাজার আঠারোর রুশমিতে কী আকাশ পাতাল ফারাক! দুইজন যেন দুই গ্রহের বাসিন্দা। কোন মেয়ে ওর দিকে এক নজর তাকালেও যে আমি সহ্য করতে পারতাম না, সেই আমি কিয়ৎ ক্ষণ আগে সাশাকে টেক্সট করে বলেছি, 

তুমি কি শিহাবের প্রপার টেককেয়ার করতে পারছ হানি? 

সাশা লিখেছে -শিহাব ওর বেডরুমে গেলে বাজে ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেয়। ঠিক একই কাজ সে তার মা-বাবা এবং ভাইয়ের সাথেও করছে। ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একমাত্র তুমিই পারবে ওকে সামলাতে রুশমি। আবারও বলছি, ফিরে এসো। 

—যদি আসতে পারতাম, তাহলে আমার চেয়ে সুখী আর কে হতো বলো? কিন্তু এই বিপদের দিনে তুমিই আমাদের একমাত্র পরম বন্ধু সাশা! শিহাবকে তুমি বাঁচাও। প্রয়োজনে ওকে বিয়ে করো। ধর্মান্তরিত হও। আমি জানি তুমি ওর জন্য সবকিছু করতে পারবে। 

—শিহাব তো আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। বিয়ে করবে? এখন তো মনে হচ্ছে তুমিও পাগল হয়ে গেছ। 

—কাম অন সাশা, ইউ আর আ গার্ল। ইউ নো হোয়াট আ ম্যান ওয়ান্টস, রাইট? 

—গতরাতে ওর দুর্ব্যবহার হজম করেও টানা অনেকগুলো ঘণ্টা ওর ঘরে ছিলাম। সে ড্রিঙ্ক করেছে আর গান শুনেছে। আমার সাথে কোন কথা বলেনি 1 আমি ওর এতো গা ঘেঁষে বসে ছিলাম কিন্তু আমাকে একটাবার ছুঁয়েও দেখেনি। মাঝে মাঝে তাকে আমার অ্যাবনরমাল মনে হয়। 

—আরেকটু ধৈর্য ধরো। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুমি জানো না সাশা, আমার অবর্তমানে কোনও নারী যদি ওর জীবনে এতটুকুও দখল দিতে পারে, তবে সেই নারী হবে একমাত্র তুমি। ও তোমাকে ভালোবাসে। প্রেমিকা হিসেবে নয়, কিন্তু বন্ধু হিসেবে বাসে। বন্ধুত্ব প্রেমে রূপান্তরিত হতে মানুষের সেকেন্ডও সময় লাগে না। তোমাদের এত সময় লাগছে কেনো? 

—কারণ তোমার বর শুধু তোমাকেই চায়। হি ইজ ম্যাডলি ইন লাভ উইদ ইউ! আর আমার মতো ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব মেয়েকে কে ভালোবাসবে বলো? আমি ওর ভালোবাসা ডিজার্ভ করি না! 

—ওহ সাশা! এভাবে বলো না। তুমি কত উদার এবং মহৎ হৃদয়ের মানুষ তা আমি জানি। তোমাকে নিশ্চয়ই ঈশ্বর উত্তম প্রতিদান দেবে। তুমি ভালো থাকবে, খুব ভালো। 

এসব লিখছি কাঁপা কাঁপা আঙুলে আর এদিকে আমার বুকের মধ্যে ম্যাজিকের মতো ফিরে আসতে চাইছে পুরোনো দিনের সেই ছেলেমানুষ, কুচুটে আর হিংসুটে রুশমি। চোখের সামনে আমি এক সোনাবরণ রোদ্দুরে ছাওয়া ঝকঝকে দিন দেখতে পাচ্ছি। শেয়াল ছানাটা এখন জঙ্গলে ফিরে গেছে। শিহাব আমার কয়েক হাত দূরে একটা উইলো গাছের গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। উতলা বাতাসে ওর কপালের কাছের ছোটছোট চুলগুলি এলোমেলো উড়ছে। আমি বইটা বুকে জড়িয়ে ধরে ওর দিকেই চেয়ে আছি। ওর চিবুকটা এখন একটু উঁচু করা, বুদ্ধির ঝিলিক ওয়ালা চোখদুটি সরু আর তীক্ষ্ণ। 

—‘তোমার কী হয়েছে?’ অনুসন্ধিৎসু কন্ঠে প্রশ্ন করে ও। 

—‘কিছু না। ‘শব্দ দুটো উচ্চারণ করে চোখ সরিয়ে নিয়েছি স্বচ্ছ জলের ওপর লাফাতে থাকা রোদের আঁকাবাঁকা রেখার ওপর। 

—‘আমি ক্লাবে গিয়েছি বলে তুমি রাগ করেছ? 

মুখ বাঁকালাম, ‘বয়েই গেছে আমার রাগ করতে! এতো সময় নেই!’ 

বুক এখন অস্বস্তিতে জাড় হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন সামনে দাঁড়ানো মানুষটার বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টিজোড়া আমার অন্তরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়ছে, সারা হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় করে পড়ে ফেলছে সমস্ত কথা, যেসব কথা আমি বলিনি কোনদিন কাউকে, বলতে চাইও না! 

আমি ওপাড়ের বনের দিকে চেয়ে আছি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে রৌদ ছায়ার খেলা চলছে। চলছে কাঠবেড়ালির ছুটোছুটি। শিহাব আমার দিকে এক পা-দু পা করে এগিয়ে আসছে। আমি অস্বস্তিতে দাঁত দিয়ে হাতের আঙুলের নখ কামড়াচ্ছি আনস্মার্ট মেয়ের মতো। 

—‘রুশানিয়া?’ 

এই প্রথম আমি ওর ডাকে সাড়া দিলাম না। 

—‘তুমি কি মিথ্যে কথা বলতে খুব ভালোবাসো?’ 

চমকে তাকালাম। ও আমার খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। এতো কাছাকাছি যে, ওকে জায়গা দেবার জন্য আমার কিছুটা পিছিয়ে যেতে হয়েছে। চেরিগাছের সাথে এখন আমার পিঠ ঠেকে গেছে। 

—‘কী আশ্চর্য! মিথ্যে বলব কেনো?’ 

—‘তাহলে একটা প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবে?’ 

আমি চুপ করে আছি। দেখতে পাচ্ছি ওর খোঁচা দাড়িওয়ালা ছিপছিপে ধারালো চোয়ালে রোদ এসে পড়েছে। বশীভূতের মতো চেয়ে আছি ওদিকে আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে যদি আমি ওর গালে একটু আদর করে দেই তাহলে খুব বড়সড় পাপ হবে না। কী আজব! পাপ পুণ্যের কথা আমি চিন্তা করছি কেনো? ও তো আমার স্বামী। অধিকার তো ওর ওপরে আমার আছেই। বরং অধিকার নেই ওসব মেয়েদের, যাদেরকে ও সঙ্গ দিয়ে এসেছে সারাটা রাতভর। মনটা আবার শক্ত হয়ে যায়। গমগম করে বলি, ‘কী প্রশ্ন?’ 

—‘তুমি কি সত্যিই আমাকে ঘৃণা করো?’ 

চোখ নামালাম নিচে। অদম্য সংকোচ এখন আমার কণ্ঠরোধ করে দিয়েছে।

—‘চুপ করে আছ কেনো? উত্তর দাও!’ 

আমি কম্পনরত চোখের পাঁপড়িজোড়া তুলে তাকালাম আবার ওর দিকে। ওর মসৃণ নিশ্বাস এসে লাগছে আমার মুখে। একটু আগে আমার হাত থেকে বইটা পড়ে গেছে ধপ করে মাটিতে। ও ডান হাতটা চেরিগাছের গায়ের ওপর এমন ভাবে রেখেছে যে আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে আমি বন্দি। চাইলেই ঝুঁকে গিয়ে বইটা তুলে নিতে পারব না। আমার চোখের সামনে এখন ওর উদ্ধত কণ্ঠমণি। সুন্দর, নিখুঁত! গা শিরশির করে। বুক কাঁপে! সেদিকে একবার তাকিয়ে, ঈষৎ বাঁকা গলায় বলি, ‘কেনো?’ 

—‘মানে?’ 

—‘স্ট্রিপক্লাবে কেনো গিয়েছিলে?’ নিজের স্মার্টনেসে আমি নিজেই মুগ্ধ! কী সুন্দর করে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললাম! 

—‘তোমার মন খারাপ হয়েছে এটা শুনে?’ 

—‘কী করেছ ওখানে গিয়ে?’ 

—‘কী আর করব! মেয়ে দেখলাম!’ 

এবার এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিলাম, ‘তা ওদের কাছেই থেকে যেতে। ফিরে আসার কী দরকার ছিল?’ 

ওর ঠোঁটে এখন ফিচেল হাসির রেশ। চোখে চাপা কৌতুক। ধাক্কা খেয়ে নিজের বুকে একটা হাত রেখে বলছে, ‘দ্যাট হার্টস! আই অ্যাম উন্ডেড!’ 

—‘স্টপ মেসিং উইদ মি। 

ও আবারও এক পা এগিয়ে এসেছে আমার দিকে। আমি মাটি থেকে সিডনি শেলডন তুলে নিয়ে ধূলো ঝাড়ছি। 

—‘তুমি নিষেধ করলে আর যাব না।’ এটুকু বলে সামান্য বিরতি নিয়ে সে একটা গান ধরেছে গুনগুন করে, 

‘আর কারো পানে চাহিব না আর 
করিব এ আমি প্রাণপণ 
ওহে তুমি যদি বলো 
এখুনি করিব বিষয় বাসনা বিসর্জন’ 

আমার হাসি পাচ্ছে ভীষণ। হাসি চেপে কপট রাগের সুরে বলছি, ‘আমার বয়েই গেছে নিষেধ করতে।’ 

—‘তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।’ 

শিহাব আবারও আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। 

—‘কোন প্রশ্ন?’ 

—ডু ইউ রিয়েলি হেইট মি?’ কেমন চোখা অথচ ধীরস্থির গলায় প্রশ্ন করে ও। —তখন কী বলছিলে?’ আবারও প্রসঙ্গ পাল্টে নিলাম চমৎকারভাবে। আহ নিজের বুদ্ধির তারিফ করতে মন চাইছে আমার! ব্রাভো রুশমি, ব্রাভো! 

— ‘কখন?’ 

—‘চেরিফুলগুলো দেয়ার সময়?’ 

প্রশ্ন শুনে ও প্রথমে একটু বিব্রত হয়, তারপর হাসে। হাসতেই থাকে নীরবে। রোদ এসে নাচে ওর কুঞ্চিত গালে, সুন্দর দেখায়। চেরিফুল দোল খায় বাসন্তী হাওয়ায়। কাছেই একটা কার্ডিনাল ডাকতে থাকে মন কেমনের সুরে। ভালো লাগে! কপালে এলোমেলো চুল এসে পড়েছিল আমার। শিহাব আঙুল দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিল। আমার চোখের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে ভরাট গলায় মন্ত্র পড়ার মতো উচ্চারণ করল, ‘I will bring you happy flowers from the mountains, bluebells, dark hazels, and rustic baskets of kisses! I want to do with you what spring does with the cherry trees!’ 

—‘শেষের লাইনটা দ্বারা কী বোঝায়?’ 

—‘দ্যা পোয়েট ওয়ান্টস টু মেক হিজ লাভার, দ্যা হ্যাপিয়েস্ট পারসন ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড!’ 

—‘ইজ দ্যাট সো?’ 

—‘ইনডিড। দ্যাট লাইন ইজ অ্যান এক্সট্রা অর্ডিনারি মেটাফোর।! 

সেলফোনটা বাজছে জামার পকেটের ভেতর। অসময়! বড্ড অসময়! কিন্তু একদিক দিয়ে ফোনটা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কারণ আমার এই মুহূর্তে খুব লজ্জা করছে কেনো যেন। ফোনের পর্দায় চোখ লুকাতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। 

লিও ফোন করেছে। ধরতেই কলকল করে বলল, ‘তুমি কোথায়? আমরা তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’ 

—‘বাড়ির সামনে?’ 

—‘হ্যাঁ, মানে তোমার ইন ল’জ হাউজের কথা বলছি।’

–‘তাই? আচ্ছা ওয়েইট করো। আমি আসছি।’ 

ফোন কেটে দিয়ে শিহাবকে বললাম, ‘আমার বন্ধুরা এসেছে।’ 

শিহাব 

ড্রইং রুমের সোফায় তিনটা ছেলেমেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। রুশমি আমার আগেই ফিরে এসেছিল। বন্ধুর ফোন পেয়ে আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি। খাঁচা থেকে মুক্তি পাওয়া পাখির মতো ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে। যেন এতক্ষণ সে আমার হাতে বন্দি ছিল। উড়তে পেরে আনন্দের সীমা নেই। ওই আনন্দ আমার মনটাকে এক ধাপ নিচে নামিয়ে দিয়েছে। কারণ আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি ওর কাছে আমার সঙ্গর চাইতে বন্ধুদের সঙ্গই বেশি উপভোগ্য। 

বাড়িতে ঢোকার মুখেই ড্রইং রুমটা পড়ে যায়। না চাইতেও ছেলেমেয়েগুলোর সাথে দেখা হয়ে গেলো। রুশমি দাঁড়িয়েই ছিল, হাতে বই নিয়ে। আমাকে দেখতে পেয়ে ছেলেমেয়েগুলোকে বলল, ‘গাইজ, মিট মাই হাজবেন্ড।’ 

প্রথমবারের মতো ও কারো সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল স্বামী হিসেবে। এই অতি স্বাভাবিক আচরণে সামান্য অবাক না হয়ে পারলাম না। মেয়েদের মধ্যে যার চুল ছোট করে ছাটা আর দেখতে একদম বাঁশের কঞ্চির মতো শুকনা সে-ই প্রথমে এগিয়ে এলো আমার দিকে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের নাম বলল, ‘হেইলি।’ 

সংগোপনে একটি হতাশার নিশ্বাস মোচন করলাম। রুশমির সাথে মিথ্যে বলার স্বভাবটা একেবারেই বেমানান। অবশ্য পৃথিবীতে সবকিছুই যে মানানসই হতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিছু মানুষের গোটা জীবনের খাতাটাই থাকে অগণিত ভুল এবং অসামঞ্জস্যতায় ভরা। হয়তো আমি আর রুশমিও সেইসব ভুলে ভরা জীবনের খাতাওয়ালা মানুষ গুলিরই স্বগোত্রীয় তাই তো আমাদের সবকিছু ঠিক হতে হতেও কেনো যেন কিছুই আর ঠিক হয়ে ওঠেনি কখনো! 

কথা না বাড়িয়ে জায়গাটা থেকে সরে আসলাম। বেডরুমে এসে ঝটপট তৈরী হয়ে নিলাম। ছোটমামার সাথে একবার গাড়ির শোরুমে যেতে হবে। নতুন গাড়ি কিনবে বলে মনস্থির করেছে সে। তার ধারণা গাড়ির যন্ত্রাংশ এবং অ্যাকসেসোরিজ সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো। কথাটা একেবারে ভুল নয়। তাছাড়া গাড়ির শোরুমে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার আগ্রহের কমতি নেই। নিজের গাড়িটাও চেঞ্জ করতে হবে। তৈরী হয়ে ঘর ছেড়ে বেরোচ্ছি এমন সময় দেখি রুশমি ওপরে উঠে আসছে। দোতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। 

—‘কোথায় চললে?’ 

—‘একটু কাজ আছে।’ 

কিয়ৎক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। রুশমি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমার মুখে হিজিবিজি অক্ষরে খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য লেখা আছে। যে লেখা পড়তে বড়ই কষ্ট।

—‘তুমি ঠিক আছ?’ অনেকটা সময় পর্যবেক্ষণের পর তার প্রথম প্রশ্ন।

একটু গম্ভীর গলায় বললাম, ‘এই ছেলেটা তোমার বন্ধু?’ 

—‘হ্যাঁ বন্ধুই তো!’ 

—‘তাই?’ 

— ‘মানে কী?’ 

—‘কীসের মানে?’ 

—এই প্রশ্নের মানে কী? 

—‘না মানে, জানতে চাইছিলাম শুধুই বন্ধু, নাকি স্পেশাল বন্ধু?’ 

রুশমি এবার একটু বিব্রত হয়ে গেছে। ভ্রুকুটিবক্র কপাল নিয়ে পিটপিট করছে চোখ। আগেও লক্ষ্য করেছি ব্যাপারটা। ও কোন বিষয় নিয়ে দ্বিধায় ভুগলে লম্বা চোখের পাপড়ি গুলো ঘনঘন ব্লিঙ্ক করে। ইনোসেন্ট দেখায়। কিন্তু এই ইনোসেন্স যে মিথ্যে এবং বানোয়াট তাতো আমি এখন জেনে গেছি। আর সত্যটা জেনে যাবার পর ওই নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে থেকে আমার আর আগের মতো ভালো লাগছে না। বরং কষ্ট হচ্ছে। রুশমি একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আসলে স্পেশাল নয়। তবে আমার মনে হয় লিও আমাকে পছন্দ করত। তবে সেরকম আহামরি পছন্দ না। একটু একটু।’ 

—‘আচ্ছা?’ 

—‘হু, আর জাস্ট সো ইউ নো, হি অ্যাকচুয়েলি কিসড মি ওয়ান্স ইনসাইড দ্যা কার।’ 

শুভ্রার দেয়া তথ্যের সাথে রুশমির বলা কথা হবহু মিলে যাওয়ায় আমার বুকটা কেনো যে অমন মোচড় দিয়ে উঠল জানি না। যে রুশানিয়াকে আমি এতদিন ধরে চিনতাম, সেই পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক, নিষ্পাপ রুশানিয়ার অস্তিত্বটুকু মুহূর্তের মাঝে কেমন যেন আবছা হয়ে এলো চোখের সামনে। বিতৃষ্ণার গাঁজলা উঠতে থাকল মনে। প্রশ্রয় না থাকলে একটা ছেলে কী করে এতটা সাহস পায়? ও তো আমার বিয়ে করা বৌ। কই, আজ পর্যন্ত ওকে বিনা অনুমতিতে তো ছুঁতে পারিনি। মনে পড়ল সেদিন ভোরবেলা শুধুমাত্র পাশে বসার অপরাধে সে আমাকে চড় মেরেছিল। সেই ঘটনার জের ধরে আমাদের শোবার ঘর পর্যন্ত আলাদা হয়ে গেলো। অথচ যে ছেলেটা ওকে গাড়ির মধ্যে চুমু খেয়েছিল একদা, সেই ছেলে কিনা আজকে আমারই বাড়িতে এসে বসে আছে অতিথি হয়ে। চমৎকার! 

—‘তারপর?’ 

—‘তারপর আর কী?’ 

—‘কী?’ 

—কিছুই না!’ 

—‘কিছুই না?’ 

—‘নাহ!’ 

আমি ওকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। টের পেলাম ও আমার পেছন পেছন আসছে। 

—‘তুমি কি রাগ করলে?’ প্রশ্নটা ছুটে এলো পেছন থেকে। 

—‘না।’ 

মুখে উত্তর দিলাম ছোট্ট করে, কিন্তু মনে মনে বললাম, আমার রাগে তোমার আদৌ কি কিছু এসে যায় রুশমি? সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব, লক্ষ্য করলাম রুশমি ড্রইং রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওকে ডেকে উঠলাম হঠাৎ, 

—‘রুশমি!’ 

ও ঘুরে তাকিয়েছে। মুখে হতভম্ব ভাব। 

—‘তোমার হিজাব কোথায়?’ 

জিব কেটে বলল, ‘ইশ! তাই তো!’ 

কথাটা শেষ করে ও সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল একটা। প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে ঘুরে তাকিয়ে করুণ গলায় একবার বলল, ‘স্যরি! একদম ভুলে গিয়েছিলাম।’ 

প্রত্যুত্তর না করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। শরীর দিয়ে রাগের হলকা বেরোচ্ছে। সুষ্ঠুভাবে চিন্তা করতে পারছি না কিছুই। বিবেক বলছে এই সামান্য ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। আজকালকার যুগে এসব কোনো ব্যাপার হলো নাকি? কিন্তু বিবেকের বিধি নিষেধ মানতে চাইছে না মন। ভেতরটা বিদ্রোহে গাঁট হয়ে আছে। একবার মনে হলো ছেলেটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেই। আমার রুশানিয়াকে ছোঁবার মতো সাহস ওর হয় কী করে? কিন্তু রুশমিরই বা আক্কেলটা কেমন? এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে শ্বশুরবাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, আমাকে ডিভোর্স দেবার পর রুশমি আবার এই ছেলেটার কাছেই ফিরে যাবে না তো? ভাবনাটা মাথায় আসতেই মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। তেজের স্ফুলিঙ্গ ক্রমশ নিভে এসে বুক ভর্তি হয়ে গেলো ভারী এক নিষ্প্রতিভ, বিষণ্ণ বাতাসে। 

শোরুমে যাবার পর নতুন নতুন সব গাড়ির ভিড়ে ডুবে গিয়ে আস্তে আস্তে মন হালকা হয়ে আসছিল। গাড়ি অবশ্য আজ কেনা হলো না। মামা আরো কয়েক জায়গায় দেখেশুনে, যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। মামার সাথে বাইরেই লাঞ্চ সেরে নিলাম। সকালের ঝলমলে রোদ এখন কেটে গেছে। আকাশে রূপালি মেঘের ভিড়। সেই সব রুপো রঙের মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে ঝরল বাড়ি ফেরার মুখে। ফিরে এসে দেখি একেবারে সোনায় সোহাগা অবস্থা। রুশমির বন্ধুদের সাথে শুভ্রাও এসে যুক্ত হয়েছে। 

রুশমি 

ওই একটা দিনে যে এতো রকম চমক অপেক্ষা করছিল তা জানা ছিল না। লিওকে দেখার পর শিহাবের প্রতিক্রিয়াটা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বড় রকমের চমক। আমাকে হিজাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়াটাও কম আশ্চর্যজনক নয়। এর মানে যতটা না আমি নিজে নিজেকে লক্ষ্য করি তার চাইতেও অনেক বেশি সূক্ষ্মভাবে সে আমাকে লক্ষ্য করে। যাই হোক, ওর ঈর্ষাটা কিন্তু আমার দারুণ লাগছে! যথোপযুক্ত শিক্ষা হয়েছে একদম! ওকে একটা যথার্থ শিক্ষা দেবার জন্য মনে মনে মুখিয়ে ছিলাম। এখন তো আমার আনন্দের সীমা নাই আহা! 

কিন্তু সেই আনন্দের জোয়ারে ভাটা পড়তেও খুব বেশি সময় লাগলো না। শুভ্রার আগমন হলো ঠিক বিকাল পৌনে চারটার সময়। লাঞ্চের পর আমরা লনে জড়ো হয়ে ফ্রিজবি খেলছিলাম। শুভ্রা এসেই হড়বড় করে বলল, ‘শিহাব কোথায়? আমাদের একটু বাইরে যাওয়ার প্ল্যান আছে।’ 

শুভ্রা মাঝে মাঝে খুব ঢং করে কথা বলে। ঢং করার দিনগুলিতে সে ব্রিটিশ অ্যাক্সেন্টে কথা বলতে ভালোবাসে। মানে ও যে ব্রিটিশদের মতো কথা বলতে পারে সেটা আশেপাশের লোকজনকে জানানোর জন্য মরিয়া হয়ে পড়ে। কী কারণে জানি না, কেনো যেন মনে হলো, শুভ্রা কোন এক ভাবে জানে যে লিও ব্রিটিশ। লিওর কারণেই এই দিনটাকে সে ঢং করার স্পেশাল দিন হিসেবে বেছে নিয়েছে। 

আজ অনেকদিন পর আবহাওয়া একটু উষ্ণ বলে মেয়েরা শর্টস পরে বেরিয়েছে। শুভ্রাও ব্যতিক্রম নয়। ওর পরনে একটা জিন্সের হাফপ্যান্ট। স্লিভলেস পিংক কালারের ব্লাউজ। চোখে রোদ চশমা। তার গায়ের রং এতো লালচে ছিল না। ছিল ধবধবে ফর্সা। এখন নিশ্চয়ই ট্যান করিয়েছে। অথচ, সে এমনিই যথেষ্ট সুন্দরী। এম আই টি থেকে পাশ করা মেধাবী ছাত্রী। অ্যামাজানের মতো প্রমিনেন্ট কোম্পানিতে জব করছে। মেয়েটার এতো আছে তবুও যেন সত্যিকারের আক্কেল নেই। আর সত্যিকারের আক্কেল নেই বলেই ও জানে না, সৌন্দর্য জিনিসটা যতখানি বাহ্যিক, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আত্মিক। ভেতরটা কুৎসিত হলে, বাইরের মোহময় চটকের কোন দাম নেই। হঠাৎ করেই আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। ধূলোর গন্ধ নিয়ে বইছে ঝড়ো বাতাস। বছরের প্রথম বৃষ্টিতে প্রতি বছর এরকম ধূলো ধূলো গন্ধ হয়। ম্যাগনোলিয়ার পাঁপড়ি উড়ছে বাতাসে এলোমেলো ভাবে। নেইবারহুডের সরু রাস্তাটা লাল গালিচা বলে ভ্রম হচ্ছে। বৃষ্টিটা নেমে পড়বে যে কোন মুহূর্তে। আমি ভ্রু কুঁচকে শুভ্রার দিকে চেয়ে আছি। শুভ্রা কিন্তু আমাকে দেখছে না। আড়চোখে লিওকে দেখছে। লিওর প্রতি ওর আগ্রহটা আমাকে ভাবাচ্ছে। সে কি কিছু জানে আমার আর লিওর ব্যাপারে? 

—‘কোথায় যাবে তোমরা?’ প্রশ্ন করলাম। 

—নট শিওর।’ বলে একটু থামল শুভ্রা। তারপর ধূর্ত গলায় বলল, ‘ইটস আ ডেট।’ 

অনেক কষ্টে রাগ সংবরণ করে বললাম, 

—‘শুভ্রাদি লিসেন, শিহাব আমার বিয়ে করা বর বুঝছ? তুমি প্লিজ শুর পেছনে আর সময় নষ্ট করো না।’ 

শুভ্রা চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘শিহাব ওয়াজ মাই ব্যাকআপ।’ 

প্রচন্ড রাগের মধ্যেও খিক করে হেসে ফেললাম, ‘সিরিয়াসলি? মানুষের ম্যারিড লাইফ শেষ হয়ে যাচ্ছে এদিকে আর তুমি আছ তোমার ব্যাকআপ নিয়ে? হাও ওল্ড আর ইউ? ফোরটিন? আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।’ 

বৃষ্টির আগমনী বার্তা পেয়ে বন্ধুরা খেলা থামিয়ে দৌড়ে ছুটে গেছে প্যাটিওতে। আমিও পা বাড়িয়েছি সেদিকে। শুভ্রা আমার পেছন পেছন আসছে আর বলছে, ‘কিন্তু তুই তো ওকে পছন্দ করতি না। হঠাৎ কী হয়ে গেলো?’ 

প্যাটিওর সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রেখে আমি শুভ্রার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ‘হয়ে গেছে।’ 

—‘কী হয়ে গেছে?’ 

—‘পছন্দ। 

কথাটা বলার সময় আমার বুক কাঁপছিল। কারণ এই প্রথমবারের মতো সত্যটা কারো সামনে অকপটে স্বীকার করলাম। প্যাটিওতে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্টেসি বলল, ‘আজকে আমরা বৃষ্টিতে ভিজব আর সাইকেল চালাব। কী বলো তোমরা? আইডিয়াটা কেমন?’ 

শুনে শুভ্রা আমাকে বাংলায় বলল, ‘তুই বরং বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সাইকেল চালা ফ্রেন্ডদের সাথে। আমাকে আর শিহাবকে ছেড়ে দে, কেমন?’ 

আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। আমি জানি যে, এই রাগ একেবারেই অমূলক। কারণ শিহাব কদিন আগে নিজ মুখে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে সে শুভ্রাকে আর চায় না। তবুও এক বীভৎস রাগে আমার কন্ঠনালী থেকে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পুড়ে একদম খাক হয়ে যাচ্ছে। 

গলায় বিষ ঢেলে বললাম, ‘তুমি এতো শেইমলেস কেনো? একটা কথা তোমাকে কতবার বলতে হবে?’ 

—‘তোকে একটা কথা কতবার বলতে হবে? তুই বাপের বাড়ি ফিরে যাস না কেনো?’ 

—‘আমি যাব না।’ 

—‘কেনো যাবি না?’ 

—‘কারণ আমার হাজবেন্ড চায় না আমি যাই।’ 

একথা শুনে শুভ্রা কেমন যেন একটা ভঙ্গিমা করল মুখের। মনে হয় তাচ্ছিল্যের। আসন্ন বৃষ্টির ভেজা বাতাস ওর চুল উড়াচ্ছে পতাকার মতো। সেই চুল হাত দিয়ে সামলাতে সামলাতে কী যেন বলতে যাচ্ছিল সে। তার আগেই চোখ আটকে গেলো একটু দূরে, নেইবারহুডের রাস্তার দিকে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি শিহাব হেঁটে আসছে লন পার হয়ে। সঙ্গে গাড়ি নেই। মনে হয় অন্য কেউ ড্রপ করেছে। শুভ্রা মুখে তাচ্ছিল্যের ভাবটা বজায় রেখেই বলল, ‘তোর ধারণা ভুল। শিহাব শুধু আমাকেই চায়। তুই চলে গেলে ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। ভদ্র মানুষ তাই মুখ ফুটে তোকে কিছু বলতে পারছে না। দ্যাখ তোর সামনেই আমি ওকে কিস করব।’ 

শেষ বাক্যটা শোনা মাত্র হৃৎপিণ্ডে কোন এক হিংস্র জন্তুর থাবা পড়ল যেন। আঁতকে উঠে বললাম, ‘কী বলছ?’ 

শুভ্রা আঙুলে তুড়ি বাজালো, ‘আই অ্যাম গননা কিস হিম রাইট নাও। যদি সে রেস্পন্স করে, দেন হি ইজ মাইন। আর না করলে সেটা পরে দেখা যাবে!’ 

এসব কী বলছে এই বেয়াদব, মাথামোটা, অসভ্য মেয়েটা? অনেক কষ্টে চিঁচিঁ করে একবার বলতে চাইলাম, ‘প্লিজ, এসব করতে যেও না শুভ্রাদি। ফর গড সেক!’ 

কিন্তু আমার মৃতপ্রায় স্বরনালী দিয়ে কথাগুলো বেরোবার আগেই দেখতে পেলাম শুভ্রা লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে যাচ্ছে শিহাবের কাছে। উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে। হাত পা কাঁপছে। শুভ্রা কি সত্যিই কিছু করে বসবে নাকি? আর শিহাব যদি রেস্পন্স করে ফেলে? পুরুষ মানুষের বিশ্বাস আছে? ভয় হচ্ছে আমার। প্রচন্ড ভয়! সাপের মতো বিষধর ভয়টা মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছোবল মারছে ক্রমাগত। চেতনা বুঝি প্রায় লুপ্ত হবার পথে। শুভ্রাকে দেখতে পেয়ে শিহাব লনের মাঝামাঝি জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। একবার তাকালো আমার দিকে। অস্পষ্ট আধো চেতনার মধ্যেও আমি বুঝতে পারছিলাম যে, পরিস্থিতি আমাকেই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কিন্তু উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় শরীর অসাড় হয়ে এসেছে। অনেক কষ্টে হাত নেড়ে ইশারায় শিহাবকে কাছে ডাকলাম। কিন্তু ও যদি আমার ডাক অগ্রাহ্য করে তাহলে কী উপায় হবে? শুভ্রা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি শুভ্রার মুখ দেখতে পাচ্ছি না এই মুহূর্তে। শিহাব একটু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছে আমার দিকে। আরেকবার ওকে ইশারায় ডাকলাম। এবার কাজ হলো। শুভ্রাকে কিছু না বলেই ও বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু শুভ্রা মুহূর্তের মাঝে ওর হাত ধরে ফেলল। 

বিকেল পাঁচটার সময় ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকার। হাওয়ায় উড়ছে নানা জাতের বাসন্তী ফুলের রঙিন পাঁপড়ি। শিহাবের মাথার চুলে একটা ফুলের পাঁপড়ি আটকে গেছে। শুভ্রা আঙুল দিয়ে পাঁপড়িটা সরিয়ে দিচ্ছে আর কী যেন বলছে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে। ওদের কথা ঢেকে যাচ্ছে মেঘের গর্জন এবং হাওয়া চলাচলের শব্দে। হায় খোদা! শিহাবকে তো আটকে ফেলেছে মেয়েটা। আমার উচিত ওখানে এই মুহূর্তে ছুটে যাওয়া। কিন্তু আমি নড়তে পারছি না কেনো? কেনো আমার হাত পা এমন পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে আসছে? দম বন্ধ করা অবস্থায় দেখতে পেলাম শিহাব শুভ্রার হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। হেসে একবার কী যেন বলল। তারপর শুভ্রাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত পায়ে ছুটে এলো বাড়ির দিকে। 

আমি একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম, থামের গায়ে হেলান দিয়ে। ও সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠে এসেছে। একটা নেভিব্লু রংয়ের টি-শার্ট ওর পরনে, কালো জিন্স। বাতাসে মাথার চুলগুলো একটু উষ্কখুষ্ক হয়ে গেছে। দুচোখে বিস্ময় আর কৌতূহল। ঠোঁটের কোণে হালকা দুশ্চিন্তার ভাঁজ। একধাপ নিচে দাঁড়িয়ে আছে বলে আমার আর ওর উচ্চতা এখন প্রায় সমান। 

শিহাব আমার মুখটা কয়েক সেকেন্ড নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে বলল, —‘কিছু বলবে?’ 

আমি দেখলাম হিংস্র দৃষ্টি মেলে শুভ্রা হেঁটে এগিয়ে আসছে। বাতাসে ভীষণ জোর। এতো জোর যে মুখের কথা কেঁড়ে নিচ্ছে একদম। স্টেসিরা শিহাবকে দেখে একটু দূরে সরে গেছে। সভ্য এবং ভদ্র সমাজের লোকেরা মানুষের প্রাইভেসিতে হানা দেয় না। ওসব শুভ্রার মতো অসভ্য লোকদের কাজ। 

—তোমার মনে আছে তোমার সাথে আমার ডিল হয়েছিল যে শুভ্রার সামনে অ্যাকটিং করতে হবে?’ 

একটু সময় লাগলো ওর কথাটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে, ‘মানে?’ 

শুভ্রা প্রায় চলেই এসেছে আমাদের কাছাকাছি। সেই সময় ঝমঝমিয়ে নামলো বছরের প্রথম বৃষ্টিটা। প্যাটিওর ছাদ আমার মাথা বরাবর এসে থেমে গেছে। বৃষ্টি তাই আমাকে ভেজাতে পারল না কিন্তু শিহাবকে পুরোদস্তুর ভিজিয়ে দিল। এতে অবশ্য তাকে বিচলিত হতে দেখা গেলো না। সে এক চুলও না নড়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে থাকলো ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে। আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঝলসে উঠল বিদ্যুতের নীল আলোয়। তারপর বিকট শব্দে পড়ল বাজ। শুভ্রা উঠে এসেছে প্যাটিওতে। বৃষ্টির ঝমঝম আর বাজ পড়ার শব্দে ওর কান পর্যন্ত আমাদের কোন কথা যাওয়ার কথা না। একটুও সময় নষ্ট না করে দ্রুত বললাম, ‘এমন কিছু করো, মানে অ্যাকটিং যাতে করে শুভ্রার মনে হবে ইউ আর টোটালি ইনটু মি।’ 

শিহাব এতক্ষণে কথাটা বুঝতে পেরেছে। ভিজে চুবচুবু হওয়া মুখে এখন একটা হতভম্ব ভাবের প্রাদুর্ভাব হয়েছে। আমার গায়ে ক্রমাগত বৃষ্টির ধারালো ছাট এসে পড়ছে। বাতাস ভর্তি হয়ে আছে ভেজা ভেজা বুনো ফুলের ঘ্রাণে। স্টেসি, লিও আর হেইলি প্যাটিওর চেয়ারগুলো দখল করে বসে পড়েছে। চলছে আড্ডা আর হাসাহাসি। এদিকে শিহাব দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলছে, ‘কী করব?’ 

—‘জানি না। ডু সামথিং! লাইক এনিথিং! ‘ 

শুভ্রা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে পায়ে পায়ে। আমি অধৈর্য হয়ে গেছি, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেনো?’ 

শিহাব আড়চোখে একবার শুভ্রাকে দেখে নিয়ে বিভ্রান্ত গলায় বলল,’হোয়াট শুড আই ডু? কিস করব তোমাকে?’ 

দম বন্ধ করে বললাম, ‘ডু ইট!’ 

এ কথা শোনার পর বৃষ্টিতে আবছা হওয়া শিহাবের মুখখানা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে এলো প্রথমে। তারপর চোখ হয়ে উঠল সরু, চিবুকটা একটু চোখা ভাবে উঁচু হয়ে গেলো। স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হলো গলার সুডৌল কণ্ঠমণি। এই ভঙ্গিটা আমার পছন্দের। যখন ও অল্পবিস্তর লজ্জা পায় আর গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করে তখন ঠিক এই ভাবে চিবুক উঁচু করে, কপালে হালকা ভাঁজ ফেলে চোখ সরু করে তাকায়। চোখের তারায় তখন লজ্জাজড়িত একটা মিষ্টি হাসির রেশ পড়ে। ভালো লাগে! কিন্তু কথাটা বলে ফেলার পর আমার নিজেরই ভীষণ লজ্জা করছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে মাটির সাথে মিশে একদম ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারলে বেঁচে যেতাম। 

শুভ্রা শিহাবের ডান বাহুতে একটা হাত রেখে বলছে, ‘তুই বৃষ্টিতে ভিজছিস কেনো? ওপরে উঠে আয়।’ 

আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। বুকের খাঁচার হৃৎপিণ্ড এতো জোরে স্পন্দিত হচ্ছে যে, সেই স্পন্দনের শব্দ আমি নিজ কানে শুনতে পাচ্ছি শিহাব শুভ্রার ডাকে সাড়া দিয়ে ওপরে উঠে এসেছে। দাঁড়িয়েছে শুভ্রার মুখোমুখি। আমার অন্তরাত্মা কাঁপছে থরথর করে এই আশংকায় যে এক্ষুনি বুঝি শুভ্রা কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে বসবে। আর অঘটনটা বাই এনি চান্স ঘটে গেলে জানি না কী হবে! আমি মনে হয় শুভ্রাকে খুন করব! শিহাবের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও আমাকেই দেখছে। চুল থেকে, টি-শার্ট থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির জল। আরেকবার প্রকট শব্দে বজ্রপাত হলো আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে। বজ্রপাতের বিকট শব্দে আমাদের সবার হৃদযন্ত্র বিকল হবার যোগাড়! সেইরকম বুক কাঁপানো অস্থির মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম শিহাব আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি গায়ে একটুও জোর পাচ্ছি না আর। ভাবতে পারছি না কিছুই। মনে হচ্ছে এক্ষুনি দাঁড়ানো থেকে পড়ে যাব কাটা গাছের মতো। কীভাবে কী হলো জানি না। হঠাৎ আমি নিজেকে ওর ভূজবন্ধনে আবিষ্কার করলাম। নাকে এসে লাগল ওর শরীরের ঘ্রাণ। নিশ্বাস এসে আটকে গেছে গলার কাছে। থমকে গেছে মেঘমেদুর বাতাস। মিথ্যে অভিনয়ের মঞ্চ আন্দোলিত হয়েছে সত্যিকারের অনুভূতি আর উত্তেজনায়! আমি আর আমার মধ্যে নেই। আমার সমস্তটা হরণ হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে, বিনাশ হয়ে গেছে সম্মুখের ওই দুর্বার, দুর্বোধ্য এবং বিধ্বংসী পুরুষের আকস্মিক আক্রমণে! 

প্রথমে ও আমার নিচের ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। বাতাস ভরে গেছে একটা চ’ কারান্ত মিষ্টি শব্দে। বুক কাঁপছে প্রবল স্পন্দনে। ভেজা ঠোঁটের বৃষ্টিজল আমার জিব পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ভিজে গেছে চিবুক, হিজাব, জামার গলা। আশেপাশে কে আছে, কোথায় আছে তা আর এখন জানি না। শুধু হৃত্যন্ত্রের ধুকপুকানি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ চোখে। ওই চোখজোড়ায় এখন অদ্ভুত মাদকতা। কতক্ষণ কেটেছে জানি না। একটা সময় চাপা গলায় ওকে বলতে শুনলাম . ‘ইজ শী স্টিল অ্যারাউন্ড?’ 

আমি ওর কাঁধের পাশ দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ধারে কাছে এই মুহূর্তে কেউ নেই। পুরো প্যাটিও ফাঁকা। কিন্তু সঠিক উত্তর দিতে কেনো যেন ইচ্ছে করল না। সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ বলতে চাইলাম শুভ্রা এখনো উপস্থিত আছে। কেনো বললাম জানি না। কিন্তু জীবনে এই প্রথমবারের মতো মিথ্যে বলার পর আমার অনুশোচনা হলো না। 

—‘আমাদের কি অ্যাকটিং কন্টিনিউ করা উচিত?’ ও প্রশ্ন করল। 

—‘উচিত’ আমার সোজাসাপ্টা উত্তর। 

তারপর সেকেন্ড অতিবাহিত হবার আগেই বৃষ্টিস্নাত দুটি অধর, দুটি হৃৎপিণ্ডে অতলান্ত শিহর তুলে দৃঢ়বদ্ধ হলো, লগ্ন হলো, এক গভীর চুম্বনে! 

বাইরে তখনও ঝুম বৃষ্টি! 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *