শিহাব
কপালে কার যেন হাতের স্পর্শ টের পেলাম। চোখ মেলে দেখি সাশা কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করছে আমাকে। নুডলসের মতো কোঁকড়া সোনালী চুল ফুলে ফেঁপে আছে মুখের চারধারে। কানে মেশিন। পরনে একটা নীল রঙের ফুল হাত শার্ট। আমার মাথাটা ডেস্কের ওপর রাখা ছিল। ওকে দেখতে পেয়ে মাথা তুললাম। হাসার চেষ্টা করে বললাম, ‘কিছু বলবে?’
সাশা কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে ইশারায় বলল, ‘ঘুমোবে না?’
—‘ঘুম আসছে না।’
—‘তোমাকে এমন কষ্ট পেতে দেখে আমার ভালো লাগছে না।’
ওর নন ভারবাল ল্যাঙ্গুয়েজ আমি এখন কিঞ্চিৎ বুঝি। যদিও এই বুঝায় আমার আশ মেটে না। মাঝে মাঝে ওর গলার স্বর শুনতে খুব ইচ্ছে হয়। আমি একটু হালকা ভাবে বললাম, ‘আমি মোটেও কষ্ট পাচ্ছি না। একদম ঠিক আছি।’
সাশা মোবাইল বের করে টাইপ করল,
—‘তোমার লেখা কতদূর?
—বেশিদূর এগোয়নি।’
—‘তুমি আমাকে অনুবাদ করে দেবে লেখাটা?’
—‘নিশ্চয়ই।’
—‘তুমি কি তোমার উপন্যাসে আমার কথা লিখবে শিহাব?’
—‘তোমার কথা তো আমাকে লিখতেই হবে সাশা!’
—‘তোমার মম ফোন করেছিল। কাল দুপুরে নিউইয়র্ক আসছে সে, তোমায় দেখতে।’
আমার মুখের ভঙ্গি পাল্টাতে সময় লাগল না। মমের সঙ্গ আজকাল আমি খুব একটা উপভোগ করতে পারছি না। দেখা হলেই নানাভাবে বিয়ে-শাদীর প্রসঙ্গ টেনে তোলে। তার ধারণা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেই আমার জীবনের সমস্ত দুর্গতি নাশ হয়ে যাবে। বিয়েই সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান। মম আজকাল আমার কাছে বড় বেশি দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। তাই সাশার দেয়া খবরটা আমাকে খুব একটা আনন্দিত করল না। চুপ করে রইলাম। বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কেনো সাশা? কেনো তুমি আমার সহস্রাব্দের নিরন্তর ঘুমটা ভাঙাতে এলে? আমিতো ঘুমিয়েই ভালো ছিলাম। ঘুমের ভেতর রুশানিয়া ছিল। আমার সুখ, শান্তি, ভালোবাসা ছিল। তুমি চলে যাও সাশা। প্লিজ তুমি চলে যাও! আমাকে দু হাজার পনের সালটা আরেকবার হৃদচক্ষু মেলে দেখতে দাও। মন দিয়ে অনুভব করতে দাও। সাশা পেছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। চোখের সামনে ওর হাতে ধরা সেলফোন। ও চার আঙুল দিয়ে ফোন চেপে ধরে বৃদ্ধাঙুলি দিয়ে লিখছে, তোমার সব কষ্ট আমি মুছে দেব শিহাব। এতো বেশি ভালোবাসব তোমাকে, যে তুমি সবকিছু ভুলে যেতে বাধ্য হবে।
আমি ওর লেখা অক্ষরগুলোর দিকে চেয়ে আছি আর মিটমিট করে হাসছি। ভুলতে কি আমি চেয়েছিলাম সাশা? আমি তো চেয়েছি সময় সাগর পাড়ি দিয়ে সেই দিনগুলোতে আরেকটি বার ফিরে যেতে। ফিরে গেছিও অনেকটা। আমার শরীর আছে দু হাজার বিশে, কিন্তু আত্মা পড়ে আছে দু হাজার পনেরতে। এখানে অক্টোবরের পাতা ঝরা দিন আর ওখানে মার্চ মাসের শেষ। দুটি সময়ে যেন আমি একই সাথে বিচরণ করছি। একই সাথে নিশ্বাস নিচ্ছি। কিন্তু শুধু নিশ্বাস নেয়া আর সত্যিকারের বেঁচে থাকায় যে কতটা তফাৎ তা আমার চাইতে ভালো আর কে জানে?
সাশা আমার হাত টেনে ধরেছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমাদের বিছানাটা লেখার ডেস্ক থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে। অতটুকু পথ পাড়ি দেয়া পর্যন্তও তর সইছে না যেন। ও আমার টি-শার্ট খুলে ফেলেছে এর মাঝেই আমার হাত ওর শার্টের বোতাম নিয়ে যুদ্ধরত। বোতাম খোলা বড়ই সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। অধৈর্য আমি এক টানে বোতামগুলো ছিঁড়ে ফেললাম। সরসর শব্দে সবকটা বোতাম ছড়িয়ে পড়ল কাঠের মেঝেতে। ওর ঠোঁট ক্রমাগত আমার মুখ স্পর্শ করে যাচ্ছে। আমাদের নিশ্বাস উত্তপ্ত। আমি নিশ্চয়ই এখন সমুদ্রমন্থনে নামব। সাশা ঠিকই বলেছে। ভুলে গিয়েই ভালো থাকব। হ্যাঁ আমি ভুলতে চাই, ভুলতে চাই সবকিছু এমনকি নিজেকেও নিজে ভুলে যেতে চাই। সাশা! তুমি আমাকে আমারই কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারো না চিরতরে? আমি আমার নিজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ! তুমি আমাকে বাঁচাও! তুমি আমাকে নাও! তুমি আমাকে সমস্ত বিশ্ব জগৎ ভুলিয়ে দাও!
কিন্তু তার আগেই কী হয়ে গেলো দ্যাখো, কে যেন আমার কানের কাছে বিড়বিড় করে বলল, এখানে পাতা ঝরার দিন আর ওখানে বসন্ত আসি আসি..! আমি এখন সাশাকে ছেড়ে দিয়েছি। ওর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে মাথা নত করে বসে আছি। মেঝেতে আমাদের কাপড়গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এলোমেলোভাবে। আমার ভেতর আর কোন উত্তেজনা নেই তার বদলে এক গভীর অবসাদ যন্ত্রণার মতো জড়িয়ে আছে সর্বাঙ্গে। আত্মগ্লানিতে বুকের পাঁজর গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের খোলস ছেড়ে শুধুই পুরুষ হয়ে ওঠাটা এতো কঠিন হয়ে পড়ে কেনো মাঝে মাঝে? মানব জন্মের বড়ই কষ্ট। পুরুষ জন্মের কোন কষ্ট নেই! অথচ এমন কিন্তু নয় যে সাশাকে কখনো আমি আদর করি না। প্রায়ই আমাদের মধ্যে বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসাবাসি হয়। মন তখন ঘুমিয়ে থাকে। জাগ্রত শরীর কড়ায় গন্ডায় সমস্ত হিসেব বুঝে নেয়। কিন্তু মাঝেমাঝে কী হয় জানো? কোন এক আশ্চর্য জাদুবলে আমার ভেতরকার দ্বিখণ্ডিত সত্তারা এক হয়ে মিশে যায়। শরীরের রক্ত মাংস হাড় এই সমস্ত কিছুতে প্যাঁচঘোচ লেগে পুরোটাই যেন এক আত্মায় রূপান্তরিত হয়। তখন আর শরীরটাকে কিছুতেই মন থেকে আলাদা করা যায় না। এই যেমন এখন যাচ্ছে না।
সাশা হাত বাড়িয়ে আমার মাথাটা টেনে নিয়েছে বুকের ওপর। আমি ওর নরম বুকে মাথা রেখে চোখের সামনে একটা হলদে দুপুর দেখতে পাচ্ছি। রুশমি আমার ঘর ছেড়ে চলে যাবার ঠিক কদিন পর মনে নেই তবে বাগানে এখন ড্যাফোডিলের কলি এসে গেছে। লনের ঘাসে কাঁচা সবুজ রং। দুদিন পরেই এই ঘাস জংলী ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে। আজকের বাতাস স্নিগ্ধ। কয়েকজোড়া কার্ডিনাল উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক চনমনে হলদে রোদ গায়ে মেখে। সন্ধ্যের ফ্লাইটে ক্যালিফোর্নিয়া যেতে হবে। কনফারেন্স আছে। এই সপ্তাহটা আমার আকণ্ঠ ব্যস্ততায় কেটেছে। অফিস, গানের প্র্যাকটিস সব মিলিয়ে একেবারে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। তবে কনসার্টের সময় পিছিয়েছে। এটা ভালো খবর। নইলে ক্যালিফোর্নিয়া যাবার কারণে কনসার্টে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হতো না হয়তো। আসলে ব্যস্ত থাকতে আমার ভালো লাগছে। নিজেকে ক্লান্ত করায় কোনো ক্লান্তি নেই আমার। ক্লান্ত মন কিছু ভাববার সময় পায় না। একটু অবসর পেলেই আমার ভাবন ঘরে রুশানিয়া এসে হানা দেয়। এটা আমার জেদ, রাগ, ঘৃণা নাকি ভালোবাসা তা আমি জানি না। শুধু জানি ওকে আমার ভীষণভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। এই কাছে পাওয়ার বাসনা এতটাই তীব্র যে মাঝে মাঝে আমার বুক ব্যথা করে। তল পেট চিনচিন করে। নিজেকেই নিজে আমি পাহারা দিয়ে থাকি সকাল-দুপুর-রাত্রি। কারণ ভুলবশত কিছু করে বসলে মেয়েটা হয়তো আবার চড় মেরে বসবে। অসভ্য আর বাজে বলে গালাগাল দেবে। এসব অপমান সহ্য করার চাইতেতো দূরে থাকাই শ্রেয়, তাই না? দিন শেষে আমার মতো সাধারণ মানুষের আত্মসম্মানবোধ টুকুই যে সবচেয়ে বড় সম্পদ!
উইক ডে তে সাধারণত রুশমি বাড়িতে থাকে। আমি লিভিং রুমটায় একবার উঁকি দিলাম। ও রাতের বেলা লিভিং রুমের সোফায় ঘুমায়। এর কারণ কী তা আমি জানি না। কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি। কারণ সে লিভিংরুমে ঘুমোনোর কারণে আমার একটা সুবিধা হয়েছে। অফিসে যাবার আগে ওর ঘুমন্ত মুখখানা একবার দেখে যেতে পারি। আজকে লিভিংরুম শূন্য। পুরো বাড়ি দুপুর বেলার আলস্য গায়ে মেখে ঝিম ধরে আছে। আমি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলাম। বেডরুমের দরজা খুলে ভেতরে পা বাড়িয়েছি ঠিক সেই সময় এক মহাপ্রলয় ঘটে গেলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নারীকণ্ঠের গলা ফাটানো এক আর্তচিৎকার ভেসে এলো কানে। চমকানো বক্ষ নিয়ে কয়েক হাত দূরে রুশমিকে আবিষ্কার করলাম। ওর বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত একটা বেগুনি রংয়ের তোয়ালে জড়ানো। খোলা চুল ভেজা। হাতে ধরা একটা সাদা পাঞ্জাবি। আমারই হবে। পাঞ্জাবিটা এখন মেঝেতে পড়ে গেছে। আমি স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ এবং চিত্রার্পিত। কী বলব, কী করব বুঝতে পারছি না। রুশমি ভর দুপুরবেলায় আমার ঘরে কী করছে? ওকে এরকম অবস্থায় আমি এর আগে কখনোই দেখিনি। এক অপ্রতিরোধ্য কুণ্ঠায় আমার হাত পা জমে গেছে। আমি ওর দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারছি না, আবার চোখ সরাতেও পারছি না। এতটা বিব্রত মনে হয় জীবনে এর আগে কখনো হইনি। কতক্ষণ কাটল জানি না। আমি তখনও বেডরুমের দরজার সামনে ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে আছি। রুশমি মাথা নিচু করে খুব দ্রুত পায়ে হেঁটে এগিয়ে আসছে দরজার দিকে। খুব সম্ভবত ও এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। ওকে জায়গা দেয়ার জন্য একপাশে সরে দাঁড়ালাম ব্যস্তভাবে। ঠিক সেই সময় রুশমিও জায়গা পরিবর্তন করল। অতএব আমরা মুখোমুখি পড়ে গেলাম। আমি কোন রকমে ‘স্যরি’ শব্দটা উচ্চারণ করে সরে পড়লাম আবার। সরলো সেও। ফলস্বরূপ আবারও দুজনে মুখোমুখি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো বেশ কয়েকবার। আমরা কেউ কিছু ইচ্ছে করে করছি না। দুজনেই বিব্রত, উদ্বিগ্ন এবং বিভ্রান্ত বলেই এমনটা হচ্ছে। অস্থির রুশমি একসময় বিরক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। এক পা বাড়াতেই মেঝেতে পড়ে থাকা আমার স্কেটিং বুটজোড়ার চাকার সাথে ওর পায়ের আঙুল লেগে গেলো। এতে অত ব্যথা পাবার মতো কী আছে জানি না কিন্তু রুশমি একদম গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠে ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে লাগল। কী কাণ্ড!
ব্যাক্কলের মতো প্রায় মিনিট খানেক সময় পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর কয়েক পা এগিয়ে এসে মেঝে থেকে স্কেটিং বুট জোড়া সরিয়ে নিলাম। আড়চোখে দেখলাম রুশমি নিজের ডান পায়ের বুড়ো আঙুল হাত দিয়ে চেপে ধরে অনেকটা কুঁজো হয়ে বসেছে বিছানার ওপর। মুখ দিয়ে একটা যন্ত্রণা কাতর স্বর বেরোচ্ছে। আমি আড়ষ্টতা নিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়েছি। সত্যি বলতে কি এমন মাত্রাহীন, অপ্রমিত আড়ষ্টতায় আমাকে এর আগে কোনদিন পায়নি। পুরুষ মানুষদের নাকি লজ্জা পেতে নেই। কিন্তু আমি মনে হয় এখন একটু একটু লজ্জা পাচ্ছি। তাও আবার একটা পিচ্চি মেয়ের সামনে। ব্যাপারটা ভীষণ হাস্যকর এবং অপমানজনক। নিজের ভেতরের অপ্রতিভ ভাবটাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বের করে দিতে চাইলাম। দু একবার কেশে নিয়ে কিছুটা স্মার্ট ভঙ্গিতে বলার চেষ্টা করলাম, ‘ব্যথা পেয়েছ?’
রুশমি মুখ তুলে চোখে চোখে একবার তাকালো শুধু আমার দিকে। কিছু বলল না। আমি ওর আহত পায়ের ওপর একটা হাত রাখার চেষ্টা করলাম। আমার ভেতরে একটা দ্বন্দ্ব চলছে। বাস্তবিক ভাবেই বুঝতে পারছি না এখন ঠিক কী করা উচিত। এই মেয়ের তো কোন ঠিক নেই। পা ছুঁয়ে ফেলার অপরাধে আবার চড় থাপ্পড় মেরে বসতে পারে!
এই মুহূর্তে আমার হাতটা ওর হাতের ওপরে পড়েছে। আমি গম্ভীর গলায় বলছি, ‘কই দেখি?’
রুশমি ক্ষতস্থান থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়েছে। পায়ের বৃদ্ধাঙুলি একটু রক্তজমাট লাল দেখাচ্ছে। এটুকু আঘাতে আহামরি কোনও ব্যথা পাওয়ার কথা না। মেয়েটা ঢঙ্গি আছে। ভাবতে ভাবতে আমি ওর আহত আঙুল ছুঁয়ে দিলাম। রুশমি এখন চুপ করে গেছে। একটু আগের কাতর কণ্ঠের আহা উহু আর নেই। একবার তাকালাম ওর দিকে। ‘ঠিক হয়ে যাবে’ ধীরস্বরে কথাটা বলে হাতটা সরিয়ে নিলাম আর ঠিক তখনই পূর্বের সেই আর্তনাদ ফিরে এলো ওর গলায়। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখি হাত দিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল চেপে ধরেছে আবার। যেন ব্যথায় জানটা একটু হলেই বেরিয়ে যাবে। আমি বিছানার ওপরে বসলাম। তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করলাম ওর মুখ। মুখটা এখন সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে না। ভেজা চুলে ঢেকে আছে অনেকটাই।
—‘তোমার কি খুব বেশি লেগেছে?’ কথাটা বলতে বলতে হাত বাড়িয়ে ওর পা নিজের কাছে নিয়ে আসলাম। আমাদের দুজনের মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা না থাকায় ওর পা আমার উরুর ওপর উঠে এসেছে অনায়াসে। ভাঁজ করা হাঁটু এখন সোজা। এই পর্যায়ে খুব সম্ভবত ওর ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে একটু সমস্যা হলো। তোয়ালেটা এমনভাবে গায়ে জড়ানো যে কোন মুহূর্তে… ওয়েল ইউ নো হোয়াট আই মিন! ভারসাম্য ঠিক রাখতে ও অপর পাটাও বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে। এখন দুটো পা আমার কোলে। আমি ওর রক্ত জমাট বাঁধা আহত বুড়ো আঙুলের ওপর হাত রেখেছি। এবং বাধঁছেড়া বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি যে, ওর আর্তনাদ ভোজবাজির মতো থেমে গেছে। তাকিয়ে দেখি বিছানার হেডবোর্ডে মাথা এলিয়ে দিয়েছে। জন্মকাজল দুটি চোখ এই মুহূর্তে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমারই দিকে। সেই চোখের ভেতর একটু যেন টলটলে জল আর অপ্রতিরোধ্য সংকোচ। লজ্জার লাল রংয়ে টকটক করছে ফর্সা গাল। এর বাইরেও ওই মুখে আরো কী যেন একটা আছে। সেই নাম না জানা কী যেনটা এখন আমার বুকের ‘পরে এসে বিঁধছে আলপিনের অগ্রভাগের অল্প অল্প খোঁচার মতো।
আজকে আমার ঘরটা হলদে রঙের খুশিয়াল রোদে ভরপুর হয়ে আছে। খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসছে বাসন্তী বনজ বাতাস। রুশমির ভেজা চুল হালকা হালকা উড়ছে সেই বাতাসে। ওর চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছে গলার কাছে, কণ্ঠার হাড়ে। মোমের মতো মসৃণ চন্দন রংয়ের বাহুর ওপর এক টুকরো ঝকঝকে হলদে রোদ্দুর খেলা করছে নিশ্চিন্তে। ওই কোমল সুন্দর শরীর যেন এখন দুঃসাহসী গোঁয়ার রোদের দখলে। কী আশ্চর্য! এই মুহূর্তে রোদটাকে আমার ঈর্ষা হচ্ছে। ওর এতো সাহস কী করে হয় যে রুশানিয়াকে ছুঁয়ে দেয়? আমি জানি বেগুনি রংয়ের তোয়ালেটা ওর বুকের যে জায়গায় গিয়ে থেমেছে তার ঠিক একটু নিচেই ডানদিকে কালো তিলটা। একটু আগেও আমার ওই তিলটা দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল, ছুঁতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু এই মাত্র রুশানিয়ার নিষ্পাপ চোখের দৃষ্টি যখন ভোরের প্রথম স্নিগ্ধ আলোর মতো ঠিকরে এসে পড়ল আমার হৃদয় বরাবর, ঠিক সেই সময় ওসব অবাধ্য দস্যি ইচ্ছেরা সব ঝুপ করে ভিজে গেল এক অবিমিশ্র পবিত্রতায়। এখন আমার মনে হচ্ছে শুধু ছুঁয়ে দিয়ে এই মানুষীকে কখনো নিজের করে পাওয়া যাবে না। একে পেতে হবে হৃদয় দিয়ে। হয়তো অনেক সাধনা করে। আমি জানি না আল্লাহ ওকে কী মাটি দিয়ে বানিয়েছে। এমন বিশুদ্ধ নির্মল নিখুঁত সৌন্দর্য পৃথিবীতে আর কেউ কোন দিন দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে। আমি ওর চন্দন রংয়ের ধবধবে ফর্সা দুটো পা কোলের ওপর নিয়ে বসে আছি। আহত আঙুলে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কিছু বলছি না। রুশমিও কিছু বলছে না। ক্রমেই এক আশ্চর্য অলৌকিক আবেশে আমার শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। বুকের খালি জায়গা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটির আশ্চর্য সান্নিধ্য আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, এতদিন আমার কিছুই ছিল না, অথচ আজ এই মুহূর্তে আমার সব আছে। সব!
রুশমি
‘চোখের দৃষ্টি যেন
মনের গীতি কবিতা,
বুকের ভালোবাসা
যেথায় রয়েছে গাঁথা।।’
আঙুলের কনকনে ব্যথায় ছটফট করতে করতে বিছানার ওপর বসলাম। শিহাব আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ নার্ভাস। নার্ভাসনেসের ঠ্যালায় বেচারা সেই তখন থেকে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খানিক বাদে ও আমার পায়ের আঙুলে একটা হাত রাখল। আর কী আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে গায়েব হয়ে গেলো ব্যথাটা। আমি অবাক চোখে চাইলাম ওর দিকে। এই মানুষ কি জাদু জানে? ও ছোঁয়া মাত্র ব্যথা নিরসন হয়ে যাবার কারণ কী? গম্ভীর মুখে ‘ঠিক হয়ে যাবে’ বলে যেই না সে হাতটা সরালো, অমনি বিষধর ব্যথাটা পুনরায় দাঁত বসিয়ে দিল। আমিও বাচ্চা মেয়েদের মতো কঁকিয়ে উঠলাম। শিহাব এবার পা ঝুলিয়ে বসল, বিছানার ওপর। আমার পা তুলে নিল নিজের কোলে। লজ্জায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। কিন্তু ওর ম্যাজিকাল হাতের স্পর্শে তখন পায়ের ব্যথাটা নেই হয়ে গেছে। আমি অপর পাটাও বাড়িয়ে দিয়েছি সামনে। নইলে বসতে সমস্যা হচ্ছিল। ব্যালেন্স পাচ্ছিলাম না।
শিহাব আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছে। কী যেন খুঁজছে আমার মুখে। আমার প্রচণ্ড লজ্জা লাগছে। ভয়ও হচ্ছে। একটু পরে ও চোখ নামিয়ে নিলো নিচে। আমি বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়েছি। ও মাথা নিচু করে আমার পায়ের আঙুলের দিকে চেয়ে আছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। আমি এখন ওর রোদে ডোবা মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছি। কাউকে শুধু চুপ করে চেয়ে দেখার মধ্যে যে এমন দুনিয়া কাঁপানো ভালোলাগা মিশে থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না আগে ভাই! ওর গালে আজকে এবড়োথেবড়ো দাড়ি। ঈষৎ খাড়া নাকের ওপর রোদ এসে খেলছে। রোদ খেলছে ছোট করে ছাটা চুলে। বাতাসে উড়ছে কপালের কাছের কয়েকটা এলোমেলো চুল। ওই চাবুকের মতো ধারালো শ্রীময় মুখখানার দিকে চেয়ে থেকে আমার বুক থেকে হঠাৎ একটা দীর্ঘ হতাশাজনিত ঘন শ্বাস পড়ল। কোত্থেকে এই অসহ্য সুন্দর মানুষটা আমার জীবনে টুপ করে এসে পড়ল আল্লাহ জানে! ইশ, কত ভালোই না হতো এই মানুষটা যদি শুধু আমারই হতো! ভাবছিলাম এসব আবোল তাবোল। হঠাৎ মুখ তুলল সে, কেমন যেন গম্ভীর গলায় বলল,
‘রুশানিয়া!’
—‘হুম?’ চুরি ধরা পড়ে যাওয়ায় একটু বিব্রত হয়ে পড়েছি আমি। চোখ সরিয়ে নিয়েছি অন্যদিকে।
—‘আমি যাচ্ছি!’ ওই দুটা মাত্র সাধারণ শব্দ আমার বুকে এসে তীক্ষ্ণ তীরের মতো লাগলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।
—‘কোথায়?’
—‘ক্যালিফোর্নিয়া।’
—‘কেনো?’ নিজের আঁতকে ওঠা গলার স্বর নিজেকেই চমকে দিচ্ছে যেন।
—‘কনফারেন্স আছে।
—‘কখন যাবে?’
—‘সন্ধ্যায়’।
—‘কদিনের ট্যুর?’
—‘তিনদিন।
—‘ও!’
চোখ সরিয়ে নিলাম আবার। কী দরকার কনফারেন্সে যাবার? অফিসে কি আর কোন কর্মচারী নেই? অধৈর্য গলায় বললাম, ‘কনফারেন্স এ তোমার কী কাজ?’
—‘প্রেজেন্টেশন আছে।’
ছাই প্রেজেন্টেশন! খুব ঢং করে কথা বলবে আর মেয়েগুলা সব ব্যাক্কলের মতো চেয়ে থাকবে তার দিকে। এটাই বিনোদন। সব জানা আছে আমার। কী আশ্চর্য! এই স্থূল এবং অতি গৌণ ব্যাপারটাই কেনো কুচুটে মেয়েমানুষের মতো সবার প্রথমে মাথায় এলো আমার? আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? হিংসুটে হয়ে যাচ্ছি? টিপিক্যাল স্টেরিওটাইপ চিন্তাধারার মেয়ে হয়ে যাচ্ছি?
শিহাব এখনো আমার পায়ের আঙুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন আমার পা দুটো ওর আদুরে পোষা বেড়াল। ও থামছে না। আমিও থামতে বলছি না। কারণ আমার ওই স্পর্শ পেতে ভালোলাগছে। বাবাজান ছাড়া জীবনে অন্য কোন পুরুষের সান্নিধ্যে আমি এতটা নিশ্চিন্ত বোধ করিনি। দ্যাখো না, ও আমার কত কাছে আছে, অথচ ওর আচরণে কোনো অভদ্ৰতা নেই। এত কম বয়সে এমন শালীনতাবোধ অত্যন্ত বিরল। একটা মন ভাবছে এসব। আবার অন্য মনটা বলছে, হয়তো আমার প্রতি ওর কোন ধরণের আকর্ষণই কাজ করে না। ওর মন তো শুভ্রাতেই মত্ত। এ কারণেই হয়তো এত কাছে এসেও আমাদের এর চেয়ে বেশি কাছে আর আসা হয় না। অথচ আমার মনটা যে আজকাল ওকে অনেক বেশি বেশি কাছে পেতে চায় সে বিষয়ে আমি এখন পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিত। কিন্তু এই চাওয়ার কাছে কিছুতেই আমি আমার মেয়েলি অহংকার বিকিয়ে দিতে রাজি নই। আগেও বলেছি, মরে গেলেও আত্মসম্মান বিসর্জন দেব না।
—তুমি এখন ঠিক আছো?’
—‘হুম’ আমি পা সরিয়ে নিলাম আস্তে করে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললাম, ‘আমি তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দেই?’
ও একটু অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। কয়েক সেকেন্ড আমার মুখে কী যেন একটা খুঁজে নিয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই!
আমি চেয়ারের ওপরে রাখা নিজের টি-শার্ট আর ট্রাউজারটা তুলে নিলাম। ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করলাম। বেরিয়ে এসে দেখি শিহাব পিয়ানোর সামনে বসেছে। ক্লজেট থেকে একটা ব্যাকপ্যাক বের করে আনলাম। এরপর জানি না কেনো, একদম দুম করেই প্রশ্নটা করে বসলাম, ‘শুভ্রার সাথে তোমার কেমন যাচ্ছে? সবকিছু?’
পিয়ানোর সুর থেমে গেছে। ও ঘুরে তাকিয়েছে আমার দিকে। আমি বিব্রতভাবে ব্যাকপ্যাকের চেইন খোলার চেষ্টা করছি। স্টুপিডের মতো একটা প্রশ্ন করে বসেছি। নিজের ওপরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। নিজেকেই নিজে খুব করে বকা দিচ্ছি। কী দরকার তোমার ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার? কে জানে, ক্যালিফোর্নিয়ায় হয়তো শুভ্রাও যাচ্ছে। এখন এসব শুনলেই তো মেজাজটা যাবে বিগড়ে। আর মেজাজ একবার বিগড়ে গেলে তুমি তো নিজেকে বশে আনতে পারো না কিছুতেই।
—‘ভালো না।’
চমকে তাকালাম ওর দিকে। জানালার ঠিক বিপরীত দিকে মুখ করে আছে বলে আলোর অভাবে এই মুহূর্তে ওর ভাবভঙ্গি স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু বুঝতে পারছি ও অপলক চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন করলাম,
—‘ভালো না কেনো?’
শিহাব এক হাতে গলার টাই খুলতে খুলতে বলল, ‘মনে হচ্ছে ওর প্রতি ভালোলাগাটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল। ভালোবাসা না।’
আমার এখন বুক কাঁপছে। কাঁপতে থাকা অন্তরটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে শিহরিত হয়ে এটাই জানান দিচ্ছে যে, এরকম কিছু ওর মুখ থেকে শোনার জন্য আমি মরমে মরে যাচ্ছিলাম গত কয়েকটা দিন। স্বাভাবিক থাকার খুব চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি কতটা জানি না।
শিহাব গলার টাইটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে আবারও পিয়ানোর দিকে ঘুরে বসেছে। আমি এখন ওর মাথার পেছন দিক আর পিঠ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ওর মুখটা দেখতে চাই। জানতে চাই ও কি সত্য বলছে নাকি মিথ্যা। নিঃশব্দে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। দাঁড়ালাম পিয়ানোর সামনে, ওর মুখোমুখি। গলায় নির্বিকার ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললাম, ‘তাই নাকি? হঠাৎ এরকম মনে হচ্ছে কেনো?’ শিহাব পিয়ানোর রিডে আঙুল রেখে স্তিমিত গলায় বলল, ‘শুভ্রাকে আমি ভালোবাসি না।’
— ‘কেনো?’
শিহাব চোখ তুলে তাকালো। আমি জানলাম, পৃথিবীতে এই এক জোড়া চোখই আছে। যে চোখ দৃষ্টি দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। এই ছোঁয়া ভয়ংকর। বুকের ভেতরটা কেমন তছনছ করে দেয় মুহূর্তের মাঝে।
—‘জানি না তো কেনো!’ ঠোঁট উল্টে নির্লিপ্ত গলায় বলে শিহাব
আমার শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে এক অদ্ভুত উত্তেজনায়। কৌতূহলে বন্ধ হয়ে আসছে নিশ্বাস। কোন রকমে বললাম, ‘কিন্তু শুভ্রা তো মনে হয় তোমাকে পছন্দ করে।’
পিয়ানো বাজানো বন্ধ করে একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে ও বলল, ‘হুম, আসলে শুভ্রাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। ওর মধ্যে ডিপনেস জিনিসটা নেই। কিন্তু প্রব্লেম হচ্ছে আমি কিছুতেই ওকে অ্যাভয়েড করতে পারছি না। মেয়েটার সেল্ফরেস্পেক্টও কম। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না।
আমার মনের মধ্যে ফায়ার ওয়ার্কসের মতো আনন্দ ধ্বনি বাজতে শুরু করেছে। আহা এতো সুখ আমি বহুদিন পাইনি। মন প্রজাপতি ফরফর করে ডানা মেলে দিয়েছে। একটা অবাধ্য হাসি ঠোঁটের কোণে জোর করে লুকিয়ে রেখে
বোকার মতো বললাম, ‘তুমি চাইলে আমি তোমাকে হেল্প করতে পারি।’
শিহাব বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তাকায়, কৌতূহলী গলায় বলে ‘হেল্প?’
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘হ্যাঁ হেল্প।’
ওর ঠোঁটে এখন মিটমিটে হাসি। বাদামি চোখে বুদ্ধির জোয়ার। মনে হচ্ছে ওই বুদ্ধিমান চোখে অচিরেই ধরা পড়ে যাব। ধরা পড়ার ভয়ে আমার বুক এখন ঢিবঢিব করছে। চোখ নামিয়ে বললাম, ‘তুমি শুভ্রাকে বলতে পারো যে আমাকে… মানে আমাকে তুমি ডিভোর্স দিচ্ছ না।’
—‘আচ্ছা?’
—‘হুম?’
—‘এটা বললে কী হবে?’
—‘না মানে, এটা বললে হয়তো ও বিলিভ করবে যে, ইউ হ্যাভ মুভড অন।’ আমি নিচের দিকে চোখ নামিয়ে রেখেছি। জানি না ও কী ভাবছে। যা ভাবার ভাবুক গে। আমার বলতে মন চেয়েছে ব্যাস বলে ফেলেছি। সব সময় অত রাখ ঢাক করে মনের ওপর চাপ দিতে হয় না। কিন্তু অহংকারী ছেলেটা না আবার এই প্রস্তাবকে আমার দুর্বলতা ভেবে বসে। ইশ কী মুশকিলে যে পড়লাম!
—‘নট আ ব্যাড আইডিয়া!’ ও বলল। আমি মুখে নির্বিকার ভাব ধরে রাখার অপরিসীম চেষ্টা করছি। কিছুতেই যেন বুকের কাঁপাকাঁপি মুখের ওপর ছাপ না ফেলে সেই চেষ্টায় নিজস্ব পৃথিবীর আকাশ পাতাল এক করে ফেলছি। ঠোঁট টেনে খুব উদাস ভঙ্গিতে বলছি, ‘হুম ট্রাই করে দেখতে পারো।’
চোরা চোখে দেখলাম ওর ঠোঁটে একটা সরস হাসি চেপে বসেছে। চোখ পিটপিট করে আমাকেই দেখছে। কী যেন ভাবছে নিবিড়ভাবে। আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি এই বলে যে, ও যেন কিছুতেই আমার মনের ভেতরটা পড়ে না ফেলে। আল্লাহ তুমি আমার ইজ্জত বাঁচাও!
—‘তাহলে আমাদের কী করতে হবে?’ হঠাৎ প্রশ্ন করল।
—‘কী করতে হবে?’ ওর প্রশ্নের ওপর আমার প্রশ্ন।
—‘না মানে, শুভ্রা এটা কেনো বিলিভ করবে যে আমাদের ডিভোর্স হচ্ছে না?’
–‘তুমি বলবে ওকে।’
—‘আমি বললেই বিশ্বাস করবে?’
—‘আমিও বলব।’
—‘তবুও যদি বিশ্বাস না করে?
আমি একটু সময় চুপ থেকে ধীরস্বরে বললাম, ‘তাহলে তুমি অভিনয় করবে যে তুমি শুভ্রাকে নয়, আমাকেই ভালোবাসো। পারবে না??
কথাটা শোনামাত্র ওর চোখের জমিন সেকেন্ডের মধ্যে দুই রকমের পট বদলালো। প্রথমে অগাধ বিস্ময়ে থমকে থাকা, তারপর একটু কেমন লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি অবনত করা। আর ঠিক তারপরেই নিঃশব্দে নিজের মনে হেসে ফেলা, হায় আল্লাহ! একটা মানুষের অভিব্যক্তি এতো সুন্দর কী করে হয়! তখন ওই অভিব্যক্তি আমার ভেতরটা অবশ করে দিয়েছে। দেহ মন এক অদ্ভুত নাম না জানা রহস্যলোকে আবিষ্ট হচ্ছে ক্রমে ক্রমে। এই রহস্যের কোন নাম নেই আমার কাছে কিন্তু এর সবটাই ভীষণ ভালোলাগার। তবে ভালোলাগার পাশাপাশি বেশ একটু অস্বস্তিও কাজ করছে ভেতরে। কারণ ও আবার ভেবে বসবে না তো যে, আমি ওকে বেঁধে ফেলার জন্য শুভ্রার বিরুদ্ধে এসব প্ল্যান করছি? এখন যদি গায়ে জ্বালা ধরানো কোন কথা বলে ফট করে আমাকে অপমান করে বসে? মনের মধ্যে এমনই সব আশংকা উঁকি দিচ্ছিল থেকে থেকে, ঠিক সেই মুহূর্তে ও মুখ তুলে শুধোল,
—‘একটা গান শুনবে?’
—‘কী গান?’
—‘পুরনো একটা বাংলা গান।’
—‘শুনব।’
কী সুন্দর ছিল সেই দিনটা! বাইরে দুপুর মরে আসছে ধীরে ধীরে। উইলো ফরেস্টের সারিবাঁধা গাছের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ব্যাকইয়ার্ডের গায়ে হেলে পড়ছে। নীল আকাশে কয়েকটা সাদা গন্তব্যহীন মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে অলস ভঙ্গিতে। এদিকে শিহাব গান শুরু করেছে।
মন শুধু মন ছুঁয়েছে
ও সেতো মুখ খুলেনি
সুর শুধু সুর তুলেছে
ভাষা তো দেয়নি
শেষ দুপুরের নরম রোদ জানালা গেলে এসে পড়েছে পিয়ানোর ওপর। শিহাব মাথা নিচু করে পিয়ানো বাজাচ্ছে। ওকে কখনো বলা হয়নি যে ওর গান আমার কতটা পছন্দের। বলা হয়নি আরো অনেক কিছু! বলব বলব করে অনেকটা সময় কেটে গেলো চোখের পলকে! আর কখনো বলা হবে কিনা কে জানে!
‘যখনি তোমার চোখে আমার মুখ খানি দেখি
স্বপনও কুসুম থেকে হৃদয়ে সুরভি মাখি ॥
তুমি কি সেই সুরভি পেয়েছ
স্বপনের দ্বার খুলেছ ॥
এই গানটা এর আগে কোনদিন শুনিনি। বাংলা গান খুব একটা শোনা হয় না তো! এবার ও মুখ তুলে আমার চোখের ওপর চোখ রেখে গাইছে,
চোখের দৃষ্টি যেন
মনের গীতি কবিতা,
বুকের ভালোবাসা
যেথায় রয়েছে গাঁথা ॥
আমিতো সেই কবিতা পড়েছি
মনে মনে সুর দিয়েছি
কেউ জানে নি ॥
আমি চুপ করে চেয়ে আছি গায়কের দিকে। চোখের কার্নিশ ভিজে যাচ্ছে অল্প অল্প অশ্রুতে। প্রথম বসন্তের মন কেমন করা মাতাল হাওয়ায় আমাদের চুল উড়ছে, মন উড়ছে টুকরো টুকরো সোনাবরণ রোদ উড়ছে, উড়ছে গুচ্ছ গুচ্ছ ভালোলাগা! আর এই ভালোলাগা আকাশে বাতাসে গোপনে গোপনে রটিয়ে দিচ্ছে একটা মাত্র বার্তা।
মন শুধু মন ছুঁয়েছে!
শিহাব
গান শেষ করে আমি চুপচাপ বসে আছি কয়েক সেকেন্ড হলো। রুশমি পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে কথা নেই। কেমন যেন একটা বিহ্বল ভাব। ওই ভাব দেখে বোঝা যায় গানটা ওর ভালো লেগেছে। তবুও নিশ্চিত হবার জন্য প্রশ্নটা করলাম, ‘ডিড ইউ লাইক দ্যা সং?’
ও কেমন অন্যরকম হাসলো, অন্যরকম গলায় বলল, ‘আই লাভড ইট!’
আমার মনটা এক বিশুদ্ধ আনন্দে চনমন করে উঠল মুহূর্তের জন্য। কারণ এই প্রথমবারের মতো রুশমি আমার প্রশংসা করল। আমার গানের গলার তারিফ করে না এমন লোকের সংখ্যা অতি নগন্য। আমি নিজেও কিছুটা জানি যে, জীবনে এই একটা মাত্র কাজ মোটামুটি ভালোই পারি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে এতদিনের এতসব প্রাপ্তির মধ্যেও বুঝি কোথায় একটা ঘাটতি ছিল, অপূর্ণতা ছিল। রুশমি যখন এই একটু আগে ওর গোলাপি রংয়ের পাতলা দুটো ঠোঁট নেড়ে অভিনব কায়দায় হালকা সুরেলা কণ্ঠে বলল, ‘আই লাভড ইট!’ ঠিক সেই মুহূর্তে কোন এক আশ্চর্য জাদুবলে আমার এতকালের সংগীত সাধনা জীবনের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতিটা পেয়ে গেলো। কাল থেকে আর গান গাইতে না পারলেও আমার কোন দুঃখ থাকবে না।
—‘তোমার ফ্লাইট কখন?’ রুশমির প্রশ্ন।
—‘আটটা।’
—‘লাঞ্চ করেছ?’
—‘না।’
—‘ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।’
খুব সহজভাবে কথাগুলো বলে শেষ করে ও সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। আমিও আর বসে রইলাম না। গোসল সেরে এসে দেখি রুশমি আমার ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে। মম কখনো আমার জামা কাপড় গোছায় না। এসব আমি নিজ হাতে করেই অভ্যস্ত। তাই রুশমির এই বাড়তি যত্নটুকু পেয়ে আমার অনভ্যস্ত মন বেশ একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। জানি না হঠাৎ করে মেয়েটা এত স্বাভাবিক আচরণ করছে কেনো। এর মেজাজ মর্জি বোঝা খুব কঠিন ব্যাপার। এই ভালো তো এই খারাপ। ব্যাগ গুছিয়ে রেখে সে নিচে নেমে গেছে। আমি ব্যাগটা একবার চেক করলাম। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস বাদ পড়ে গিয়েছিল। বাদ পড়া জিনিসগুলো গুছিয়ে নিলাম ব্যাগে। ট্যাক্স ফাইলিং এর কাজ ছিল। ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই রুশমি আবার হাজির হলো।
—‘লাঞ্চ রেডি। এসো খাবে।’
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একবার ওকে। ওর পরনে পিঙ্ক টি-শার্ট আর সাদা ট্রাউজার। টি-শার্টে হ্যালো কিটির ছবি আঁকা। ভেজা চুলের গোছা ছড়িয়ে আছে পিঠময়। নাকের নাকফুল দিনের আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে। ওই নাকফুল ছাড়া অন্য সবকিছু সুন্দর। কেনো যে মেয়েটা ওই বিশ্রী জিনিস নাকে পরে থাকে সবসময়!
—‘কী হলো?’ অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করে রুশমি
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আজকে হঠাৎ এতো বৌ বৌ আচরণ করছ। কারণটা কী? সব ঠিক আছে তো?’
রুশমির মুখটা দপ করে নিভে গেলো। চোখ পাকিয়ে, ঠোঁট বাঁকিয়ে ড্যামকেয়ার গলায় বলল, ‘মোটেও কোনও বৌ বৌ আচরণ করছি না।’
—‘তাই?’
—‘ঠিক তাই।’
—‘তাহলে কি বোন বোন আচরণ করছ?’
এবার কাজলকালো দুটি চোখে তেজের দীপ্ত শিখা ঝিলিক দিয়ে উঠল I
—‘ফাজলামো হচ্ছে?’
প্যান্টের পকেটে হাত রেখে নির্বিকার গলায় বললাম, ‘ফাজলামোর কী আছে? বোনরা কী রকম হয় তা তো আমি জানি না। আমার কোন বোন নেই। ‘ এটুকু বলে একটু থামলাম। তারপর যোগ করলাম, ‘অবশ্য আমার কোন বৌও নেই! মানে, সত্যিকারের বৌ। আমি অ্যাকচুয়েলি কনফিউজড যে, হোয়াট রোল ইউ আর ট্রায়িং টু প্লে নাও।’
এই মেয়েটার রেগে যেতে এক সেকেন্ডও লাগে না। কারণে অকারণে দিয়াশলাই কাঠির মতো ভস করে জ্বলে ওঠে। এখন কোমরে হাত রেখে জ্বলন্ত গলায় বলছে, ‘তোমার বোন কিংবা বৌ, এর কোনটাই হওয়ার শখ নেই আমার। ক্লিয়ার?
আমি সরু চোখে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে অনুসন্ধিৎসু কণ্ঠে বললাম, ‘দেন হোয়াই আর ইউ ডুইং অল দিস? লাইক, ব্যাগ গুছিয়ে দেয়া, লাঞ্চ রেডি করা। এসব তো প্রমাণ করে যে, তুমি আমাকে কেয়ার করো, তাই না?’
—‘বাজে কথা!’ থমথমে গলায় শব্দ দুটো উচ্চারণ করে ও চোখ সরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে। রাগে নাকি অপমানে কে জানে, ফর্সা গালজোড়া এখন টমেটোর মতো লাল টকটকে হয়ে গেছে।
—‘বাজে কথা?’ বলে একটু থামি। ভ্রু কুঁচকে ওর মুখটা পড়ার চেষ্টা করি। তারপর লঘু গলায় বলি,
—‘তাহলে আসল কথাটা কী রুশানিয়া?’
—‘আসল কথাটা তোমাকে আগেই বলা হয়েছে। আসল কথা হচ্ছে আই হেইট ইউ। তোমাকে আমি ঘেন্না করি। তোমাকে আমার বিরক্ত লাগে, অসহ্য লাগে।’
—‘হোয়াই ডু ইউ হেইট মি সো মাচ?’
ওকে এখন বিব্রত দেখাচ্ছে। ক্রমাগত হাতের নখ কামড়াচ্ছে দাঁত দিয়ে। চোখের দৃষ্টি অস্থির। অস্থির শ্বাস-প্রশ্বাস। কিয়ৎক্ষণ পরে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে অস্পষ্ট ভাবে বলল, ‘আমি জানি না।’
একটা বিষণ্ণ শ্বাস পড়ল আমার, ‘কখনো জানতে পারলে জানিও আমাকে। কেমন?’
ও সরে পড়ল জায়গাটা থেকে। যেন পালিয়ে বাঁচল। নারী মন আল্লাহ তায়ালার এক দুর্ভেদ্য সৃষ্টি। মন তো নয় যেন কুহেলিকাময় রহস্যনগরী। এই রহস্যনগরীর পথঘাট চেনা আমার মতো সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। নিচে নেমে দেখি ডাইনিং টেবিল বেশ পরিপাটি করে সাজানো। সাদা রংয়ের পোর্সিলিনের লম্বা ডিশে সাদা ভাত, একই ডিজাইনের ছোট বাটিতে মুরগির মাংস, সবজি, ডাল। টেবিলের এক পাশে জ্বলছে আইকিয়া থেকে কেনা কয়েক জোড়া সেন্টেড মোম। এই মোমগুলোতে আতর আতর খুশবু। অনেকটা ইনসেন্সের মতো। চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম, ‘তুমি খাবে না?’
—‘হুম।’ অবহেলায় উত্তর দেয় ও। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালে মনোযোগ দিয়ে। যেন এটা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
—‘এসব কি তোমার রান্না?’ প্রশ্ন করলাম।
—‘নাহ!’
—‘তাহলে কার?’
—‘আম্মুজানের।’
‘তুমি রান্না করতে পারো?’
—‘অল্প অল্প।’ এই টেবিলটা লম্বাটে। এক মাথায় আমি বসেছি অন্য মাথায় রুশমি। মাঝখানে বিস্তর দূরত্ব। আমি খাওয়া শুরু করিনি এখনো। রুশমিকে দেখছি। আর দেখে এটাই বুঝতে পারছি যে, মেয়েটা কোন কারণে নার্ভাস ফিল করছে। এই নার্ভাসনেসের কারণ আমার অজানা। ও কি লজ্জা পাচ্ছে? ছেলেদের সাথে কি ওর মেলামেশা একেবারেই কম? আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন অবশ্য অতি মাত্রায় রক্ষণশীল। রুশমির আচরণের এই অপ্রতিভ ভাবটা হয়তো পরিবার থেকেই পাওয়া। কিন্তু এর আগে কখনোই ওকে এতটা বিব্রত হতে দেখিনি যতটা আজকে এই মুহূর্তে দেখছি। জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে চেয়ারে। অস্থির চোখ ফেলছে এদিক সেদিক। দুই ভ্রুর মাঝখানের ইঞ্চি পরিমাণ জায়গায় একটা হালকা কুঞ্চন। গালে রক্তের লাল ছোপ। ঠোঁটের কোণে দুর্দমনীয় অস্বস্তি। ওকে দেখতে এখন এতো বেশি ইনোসেন্ট লাগছে যে, মন চাইছে কাছে টেনে নিয়ে আদর করি। লক্ষ লক্ষ চুমু খেয়ে বলি, ভয় কি তোমার বোকা মেয়ে? আমি আছি না? ভাবনাটা ঝাপটা বাতাসের মতো মাথায় আসতেই আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জা পেয়ে গেলাম। অজান্তেই চোখ নামিয়ে নিলাম নিচে।
—‘খাচ্ছ না যে?’ আস্তে করে প্রশ্ন করে ও।
—‘ভাত খেতে ইচ্ছে করছে না।’
—‘ভাত খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না? তাহলে কী খাবে? কী খেতে ইচ্ছে করছে?’
—’এমন কিছু, যেটা খেলে পেট ভরে না। কিন্তু মন ভরে।’ মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেলো।
ও ঘাবড়ে গেছে আমার কথা শুনে। দ্বিধাগ্রস্থ গলায় বলছে, ‘সেটা আবার কী জিনিস?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম – ‘এটা তোমার জন্য ধাঁধা। দেখি তুমি উত্তরটা খুঁজে পাও কিনা।’
ও এখন আমার গালের দিকে চেয়ে আছে। অনেকেই তাকায়। ওরা বলে আমার হাসি নাকি সুন্দর। রুশমিরও কি এমনটা মনে হয়েছে কখনো? আমার জানতে ইচ্ছে করছে। বললাম,
—‘তোমার কি মনে হয় আমার হাসি সুন্দর?’
ও থমকে গেছে। আজকে ওকে থমকে দিয়ে আর চমকে দিয়ে আমি মজা পাচ্ছি। প্লেটে ভাত তুলে নিতে নিতে দেখলাম ওর নিষ্পাপ মুখে একটা বিভ্রম খেলছে। চোখে অবিশ্বাস। ও মনে হয় ধারণাও করতে পারেনি যে আমি এরকম একটা বেফাঁস প্রশ্ন করে বসব হুট করে।
—‘মোটেও সুন্দর না!’ জোরালো গলায় বলে ও। আমি অবাক চোখে তাকাই। বোঝার চেষ্টা করি মেয়েটা সত্য বলছে নাকি মিথ্যা। ও আবার বলে ওঠে, ‘অসহ্য একটা হাসি।’
—‘তাই?’
—‘ঠিক তাই।’
—‘কিন্তু মেয়েরা তো আমার হাসির প্রশংসা করে।’
—‘মেয়েরা কারা? তোমার গার্লফ্রেন্ডরা?’
—‘আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই।’
রুশমি
এরকম কেনো হচ্ছে জানি না। জীবনে এই প্রথমবারের মতো আমি আমার নিজের কাছ থেকে ছুটে পালাতে চাইছি। আমার ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে, আর কিছুটা সময় আমি এই মানুষটার সামনে বসে থাকলে নির্ঘাৎ কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে বসব। হয়তো খুব দুর্ব্যবহার করব নইলে বোকার মতো বেফাঁস কিছু বলে বসব। আমার এখন একটু একটু সন্দেহ হচ্ছে যে, আমি মনে হয় ঠিক স্বাভাবিক কোন মানুষ নই। আগে কোন এক কালে ছিলাম হয়তো কিন্তু এখন আর নই। আমি বদলে গেছি। মনে হয় পাগলই হয়ে গেছি। কারণ এই ছেলেটা যখন কাছে থাকে না তখন ওর কাছে যাবার জন্য আমার পাগল পাগল লাগে, আর যখন সামনে এসে দাঁড়ায় তখন এর অস্তিত্ব আমাকে পাগল করে দেয়। এইসব নাম না জানা অলীক অনুভূতিরা আমার বুকের ভেতর ধীরে ধীরে ঘন কুয়াশার ভেতর থেকে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আমি ওদের দেখে দেখে, বুঝে বুঝে শিউরে উঠছি প্রতিনিয়ত। এই মুহূর্তে আমি দুরুদুরু বুক নিয়ে সামনে বসা মানুষটাকে আড়চোখে দেখছি। ওর পরনে একটা আকাশি রংয়ের টি-শার্ট। মাথার ভেজা চুল একটু উষ্কখুষ্ক। দাড়ি কামানো বাদামি গাল ফর্সা ফর্সা লাগছে। শেভিং লোশনের সুন্দর ঘ্রাণ উড়ে এসে লাগছে আমার নিঃশ্বাসে। সে এখন অখন্ড মনোযোগে ভাত চিবোচ্ছে। আর আমি অখন্ড মনোযোগে তার কণ্ঠমণির ওঠানামা দেখছি। আমার হাত পা শিরশির করছে। নিজেকে একটু বেশিই আনস্মার্ট লাগছে এই মুহূর্তে আর ওকে মাত্রাতিরিক্ত স্মার্ট। কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু কী বলব বুঝে পাচ্ছি না। একটু ভেবে চিন্তে ওর একটু আগে বলা কথার লেজ ধরেই কনভারসেশন শুরু করলাম।
—‘তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই?’
—‘না।’
—‘কেনো?’
—‘কেনো মানে?’
–‘মানে কেনো নেই?’
— শুভ্রার জন্য ওয়েইট করছিলাম।’ সোজা সাপটা উত্তর। শুনে আমার বুকের কোথায় যেন কাঁটার মতো কী একটা খচখচ করে উঠল। এই নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি পছন্দ হলো না। ত্যাড়া ভাবে বললাম,
—‘বেশ তো। শুভ্রাকে তো পেয়েই গেলে। এখন কী সমস্যা?’
—‘পেলাম কোথায়?’
—‘শুভ্রা তোমার জন্য মরে যাচ্ছে। আমাকে সকাল বিকাল কথা শোনাচ্ছে। পাওয়া আর কাকে বলে?’
—‘এভাবে পেতে চাইনি কখনো।’
—‘তাহলে কীভাবে পেতে চেয়েছিলে?’
শিহাব গাঢ় চোখে আমায় দেখে, কী যেন ভাবে মুহূর্তের জন্য। তারপর হালকা একটু মাথা নত করে চিন্তাযুক্ত কণ্ঠে বলে, ‘আসলে আমি খুব কনফিউজড হয়ে আছি বিষয়টা নিয়ে। আই নিড সাম টাইম।’ কথাটা বলে একটু থামল সে। তারপর আবার বলল, ‘তুমি খাচ্ছ না যে?’
—‘ক্ষিদে নেই।’
—‘তো ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? আমি খাব আর তুমি আমার দিকে হা করে চেয়ে থাকবে?’
—‘আমি মোটেও তোমার দিকে হা করে চেয়ে নেই।’
—‘আছ তো!’
অপমানে কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, ‘বেশ তো আর তাকাব না তোমার দিকে।
শিহাব সশব্দে হেসে উঠল, ‘তাকাতে মানা করিনি। তুমি দেখি জোক টোক বোঝ না একেবারেই। তোমার রসবোধ শূন্যের কোঠায়।’
কোনো উত্তর দিলাম না। কেনো এখানে বসে আছি তাও জানি না। এই দাম্ভিক অ্যারোগেন্ট ছেলেটার সামনে শুধু শুধু ক্যাবলাকান্তর মতো বসে থাকার কোন মানেই হয় না। আমার মন বলছে চলো উঠে যাই, কিন্তু অদৃশ্য এক দড়ি পা বেঁধে রেখেছে শক্ত করে। নড়তে পারছি না কিছুতেই। খাওয়া শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগল না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ও বলল, ‘কফি চাই তোমার?’
—‘হলে মন্দ হয় না।’
কফি মেশিনটা ডাইনিং এ। ডাইনিং এর সাথেই লাগোয়া কিচেন। মাঝখানে একটা উঁচু মার্বেল পাথরের কাউন্টার। কাউন্টারের ওপারে সিংক আর ডিশ ওয়াশার। ডিশ ওয়াশারে প্লেট বাসন গুছিয়ে রাখছিলাম, হঠাৎ দেখি ও কাউন্টারের অপর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
—‘ক্যাপাচিনো অর লাটে?’
—‘ক্যাপাচিনো।’
—‘এক্সটা শুগার?’
—‘না।’
—‘হুইপড ক্রিম?
—‘নোপ।’
উত্তরগুলো দিতে দিতে আমি ভাবছিলাম সারাদিন কত মানুষের জন্যই তো কফি বানাই। এখন আমার বর আমার জন্য কফি বানাচ্ছে। ব্যাপারটা কিন্তু মন্দ না! মিনিট পাঁচেক পর দেখতে পেলাম শিহাব দরজা খুলে বাইরে গিয়ে বসেছে। কফির মগ দুটো রেখেছে প্যাটিও টেবিলে। কাজ শেষ করে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ও মুখ তুলে বলল, ‘বসো, দাঁড়িয়ে কেনো?’
সদর দরজা বন্ধ করে বাদামি রংয়ের কাঠের চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম আমি, শিহাবের মুখোমুখি। আমাদের মাঝখানে ছোট্ট একটা কাঠের গোল টেবিল। টেবিলের মাঝ বরাবর চিনামাটির লাল ফুলদানিতে একগুচ্ছ সাদা রংয়ের স্নোড্রপস ফুল। আমিই রেখেছি আজ সকালে। এই প্যাটিওটা বেশ চওড়া। ছাই রঙের সিমেন্টের মেঝে। সিঁড়ির দুপাশে উঁচু টবে শোভা পাচ্ছে পাতাবাহার। আর বীমের গায়ে জড়িয়ে আছে গুল্মলতা। তিন ধাপের সিঁড়ি পার হলেই সবুজ লন। লনের ডান পাশে ছোট্ট ফুলের বাগান। ওপারে নেইবারহুডের নির্জন সরু রাস্তা। রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা দোতলা বাড়ি। বাড়ির পাশে ঘন জঙ্গল। আর বাড়ির তিনকোণা ছাদের মাথার ওপর এখন অলস ভঙ্গিতে তিনটা বালিহাঁস বসে আছে সূর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে।
—‘ডু ইউ মাইন্ড ইফ আই স্মোক হিয়ার?’ শিহাবের মার্জিত প্রশ্ন।
সিগারেট জিনিসটা আমার পছন্দ না। আমার বাবাজানের কোনদিন সিগারেটের নেশা ছিল না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললাম, ‘আই ডোন্ট মাইন্ড, গো অ্যাহেড।’
শিহাব পকেট থেকে সিগারেট বের করল। হঠাৎ করে বিষয়টা এলো আমার মাথায়। সময় নষ্ট না করে প্রশ্ন করে বসলাম,
—‘তুমি কীসের কথা বলেছিলে তখন?’
—‘কীসের কথা?’
—‘ঐযে, কী যেন খেলে পেট ভরে না কিন্তু মন ভরে।’
লক্ষ্য করলাম কথাটা শোনামাত্র ওর মুখে একটা চাপা হাসি উদ্ভাসিত হয়েছে। ঠোঁটে চেপে ধরা সিগারেটে লাইটার দিয়ে আগুন ধরাচ্ছে আর
মিটমিট করে হাসছে। কিছু বলছে না। ওর চোখ দুটো এখন সরু আর ছোট। সেই চোখে হালকা লজ্জা জড়িত হাসির রেশ। প্রখর চোয়ালের কাটা কাটা মুখটায় ছেলেমানুষি লজ্জার ছাপ পড়ায় অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে।
—‘উত্তরটা তুমিই খুঁজে বের করো। ‘মিটমিটে হাসিটা দুই ঠোঁটের প্রান্তবিন্দুতে ধরে রেখেই কথাটা বলল শিহাব। কফির মগে চুমুক দিতে দিতে। ওর মগে সেন্ট্রাল পার্কের লোগো আঁকা। ও মনে হয় ‘ফ্রেন্ডস’ এর খুব ভক্ত।
—‘সিগারেট?’ বললাম আমি।
উত্তর শুনে খুব হাসতে লাগল সে। ওই হাসির ধরন বলে দিল যে উত্তর সঠিক হয়নি। হাসিতে তাচ্ছিল্য আছে, কিন্তু সেই তাচ্ছিল্যে আমার এই মুহূর্তে কিছুই এসে যাচ্ছে না। আমার মনটা এক স্নিগ্ধ খুশির আবেশে ভরে আছে। আজকের দিনটা কী যে সুন্দর! ফিরোজা আকাশে নিরুদ্দেশ উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা রঙের শান্তিময় জান্নাতি মেঘের দল। ওই জান্নাতি মেঘের পবিত্রতা আমার বুকের মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ওরা নিশ্চয়ই ক্ষনিকের জন্য বেড়াতে এসেছে এ পৃথিবীতে। বৃষ্টি হয়ে ঝরবে না। মেঘ হয়ে এসেছে মেঘ হয়েই ফিরে যাবে। বসন্তের বাতাস লাগা বনের মধ্যে টিউটিউ স্বরে কার্ডিনাল ডাকছে থেকে থেকে। হাওয়ায় দুলছে ফুলদানির স্নোড্রপস ফুল, দুলছে বাগানের হলুদ ড্যাফোডিলের কলি। লনের সবুজ ঘাসে দুটা বাদামি চামড়ার খরগোশ ছুটোছুটি করছে তিড়িং বিড়িং করে। আর আমার ঠিক সম্মুখে শেষ দুপুরের অলৌকিক লালচে রোদ গায়ে মেখে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা। তার মুখে রহস্যময় চাপা হাসি। এই হাসির অর্থ আমি বুঝতে পারছি না। কিছু না বুঝেই বোকা বালিকার মতো মুগ্ধতার সাগরে ভাসছি। ভালোলাগার এক তীব্র সুখময় অনুভূতিতে কাঁপছি অনবরত।
—‘হয়নি।’
— ‘কফি?’
–‘ও হাসতে হাসতে মাথা নাড়ছে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে হাওয়ায়।’
—‘সঠিক উত্তরটা কী?
—‘আরেকদিন বলব।’
—‘আজকে নয় কেনো?’
—‘তোমাকে আরেকটু সুযোগ দিলাম। ভেবে দ্যাখো।’
—‘তাই?’
—হুম তাই।’
শিহাব
সূর্যের তাজা আলোক রশ্মি চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরেছে রুশমির মুখ। ওর কালো চুলে এখন রোদের সোনালী ছটা। দুরন্ত বাতাসে উড়ছে খোলা চুল। ধাঁধার উত্তরটা চাইলেই আমি ওকে বলে দিতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন সংকোচ লাগছে। এই মুহূর্তে আমি ওর পাতলা সুন্দর ঠোঁটজোড়ার ঠিক নিচের কালো তিলটার দিকে চেয়ে আছি। ওই কালো বিন্দুটা আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। আমার পুরো পৃথিবীটা ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে আসতে ওর ঠোঁটের কাছাকাছি বন্দি হয়ে যাচ্ছে। এই বিচিত্র উপলব্ধি আমাকে দিশাহারা করে তুলছে। স্নায়ু উত্যক্ত হচ্ছে। রক্ত কণিকায় এখন নিকোটিনের নেশার চাইতেও তীব্রতর যে নেশা খেলে যাচ্ছে তার নাম বোধহয় রুশানিয়া! হ্যাঁ, ঠিক তাই। সেদিনের পর থেকে সেই নেশা আমায় এক মুহূর্তের জন্যেও মুক্তি দেয়নি। আজ অবধি আমি ওই একটিমাত্র নেশায় প্রবলভাবে আসক্ত! একটু ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টায় প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞাসা করলাম -’তোমার প্ল্যান কী?
একটু ভেবে নিয়ে ও বলল – ‘গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করব।’
—‘এরপর?’
—‘আমার শখ একটা ফার্মল্যান্ড ওন করা। আমি হয়তো ফার্মগার্ল হবো। ইচ্ছে আছে। বাকিটা আল্লাহর হাতে।’
—‘ফার্মগার্ল?’ অবাক না হয়ে পারলাম না। এ যুগের মেয়েরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, ফ্যাশন ডিজাইনার কিংবা মডেল হতে চায়। কেউ কেউ হতে চায় কেবিন ক্রু, পাইলট মানে এতো এতো সব অপশন থাকতে ফার্মগার্ল? এমন অদ্ভুত অ্যামবিশনের কথা কে কবে শুনেছে?
—‘হ্যাঁ ফার্মগার্ল।’ দৃঢ় গলায় উত্তর দিল রুশমি
আমি জানি খবর যেরকমই হোক না কেনো গগনচুম্বী বিস্ময় প্রকাশ করা স্মার্টনেস বা আধুনিকতার লক্ষণ নয়। তাই বিস্ময়টুকু ঢোঁক গিলে ফেলে স্বাভাবিকভাবে বলার চেষ্টা করলাম –’ওকে সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং! তোমার কি এগ্রিকালচার নিয়ে পড়াশোনা করার ইচ্ছে আছে?’
—‘না, আমি খুব সম্ভবত ইকনোমিক্স নিয়ে পড়ব। আর ফার্মগার্ল হবার জন্য ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। আমার নিজস্ব পড়াশোনাই যথেষ্ট।’
—‘তো কীসের ফার্ম হবে তোমার?’
এই প্রশ্নে রুশমির জন্ম কাজল আঁকা ঐশ্বরিক দুটি চোখে এক থোকা স্বপ্ন ঝিলিক দিয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য। ও চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্য দিকে। ভাবালু কণ্ঠে বলল, ‘ভেজিটেবলস অ্যান্ড ফ্লাওয়ার্স!’
—‘আচ্ছা?’
—‘হুম, আমার স্বপ্ন কী জানো? গ্রিনগেবলস এর মতো ছোট্ট একটা দূরের গ্রামে চলে যাব।’
—‘গ্রিনগেবলস?’
—‘তুমি অ্যান অব গ্রিনগেবলস উপন্যাসটা পড়নি?’
—‘না, আই অ্যাম নট ইনটু রিডিং বুকস এনিমোর। আই মিন নভেলস অ্যান্ড দ্যাট কাইন্ড অফ থিং।’
রুশমি একটু নিভল মনে হয়, ‘একেবারেই পড় না?
—‘না না পড়েছি, কিন্তু খুব বেশি নয়। তোমার মতো অতটা বইপোকা নই আমি। একটা সময় পড়তাম। বেশ কিছু ক্লাসিক পড়া হয়েছে। যাই হোক, তোমার কথাটা শেষ করো।’
—ও হ্যাঁ, বলছিলাম গ্রিনগেবলসের কথা। ছোট্ট গ্রাম, ছোট্ট ফার্মল্যান্ড। সবজি আর ফুলের বাগান। দু একটা ঘোড়া থাকলে ভালো হয়। আরো ভালো হয় যদি আমার বাড়িতে কোন ইলেক্ট্রিসিটি না থাকে। অ্যনের বাড়িতে যেমন সন্ধ্যের পরপরই মোমবাতি আর হারিকেন জ্বলত, আমার বাড়িতেও ঠিক তেমনি করেই মোম আর হারিকেন জ্বলবে। দূরে সমুদ্রের পারে, জঙ্গলের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু চেস্টনাট ট্রির মাথায় আমার একটা ট্রি হাউজ থাকবে। ওটা হবে আমার লাইব্রেরি। কাজ শেষ করে বিকেল বেলা গাছের ওপরের লাইব্রেরিতে গিয়ে বসব। সাগর আর পাহাড় দেখতে দেখতে বই পড়ব।’
কেনো জানি না আমার এখন একটু একটু হাসি পাচ্ছে। এরকম ভাবসর্বস্ব কবি কবি কথা শুধু বইয়ের পাতায় পড়ে এসেছি, সামনাসামনি তো কখনও শুনিনি! তবে এর পাশাপাশি অবাক না হয়েও পারছি না। আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে ওর নিরীহ নির্মল স্বপ্ন। এতো সাধারণও কারো স্বপ্ন হতে পারে?
—রোজ ভোরবেলায় ফজরের নামাজের পরেই আমরা ফার্মের কাজ শুরু করে দেব। নানা জাতের সবজি আর ফুলের সমারোহে ভরে থাকবে আমাদের ফার্ম।’
—‘আমাদের?’ সরু চোখে প্রশ্ন করলাম।
—‘হ্যাঁ, মানে আমার আর বাবাজানের, আম্মুজানের।’ একটু ইতঃস্তত করে বলল রুশমি।
—‘ও আচ্ছা!’
—‘হ্যাঁ।’
—‘আমি আবার ভাবলাম…’
—‘কী ভাবলে?’
—‘ভাবলাম তুমি তোমার ফিউচার হাজবেন্ডের কথা বলছ।’
—‘ফিউচার হ্যাজবেন্ড?’
কফির মগে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, মানে… আমার সাথে ডিভোর্সের পর তুমি যাকে বিয়ে করবে।’
—‘আমি আর কখনো বিয়ে করব না।’
—‘কেনো?’
—‘এমনি, একবার বিয়ে করে শখ মিটে গেছে, তাই।’
আমি হাসার চেষ্টা করলাম, ‘তা কেনো? দ্বিতীয় বার হয়তো তুমি তোমার প্রিন্স চার্মিংকে পেয়ে যাবে। লাইফ ইজ ফুল অফ সেকেন্ড চান্সেস!’
রুশমি চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিল, গম্ভীর ভাবে বলল, ‘সবার ক্ষেত্রে কথাটা সত্য নয়।’
—‘তোমার পছন্দের কেউ নেই?’
ওর চিবুকটা এখন গলার সাথে লেগে গেছে। এই অনর্থক কুণ্ঠার কারণ আমার জানা নেই। মেয়েটা যেন কেমন অদ্ভুত!
—‘না,’ খুব আস্তে করে বলল ও।
—‘নো বয়ফ্রেন্ড?’
—‘নো বয়ফ্রেন্ড।’
এতো সুন্দর একটা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই এটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। তবুও আমি ওকে বিশ্বাস করলাম। করতেই হলো। কারণ আমি জানি রুশানিয়া কখনো মিথ্যা বলতে পারে না। আমার মনের মধ্যে একটা স্বস্তির বাতাস ঘুরপাক খাচ্ছে এখন। ওর কোন বয়ফ্রেন্ড নেই, প্রেম নেই এটা নিশ্চিতভাবে জানার পর এক অনির্বাচ্য শান্তিতে আমার বুক ভরে গেছে। কাটা ঘাসের ঘ্রাণ উড়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। সামনের বাড়ির ছাদের ওপর থেকে কয়েকটা মেটে রংয়ের বালিহাঁস প্যাকপ্যাক শব্দে এই মাত্র উড়ে গেলো নীল আকাশের দিকে। সুন্দর! জীবনটা বড়ই সুন্দর! সাড়ে ছটায় রিপোর্টিং। অনলাইনে যদিও চেকইন করে নিয়েছি তবুও খুব একটা সময় নেই হাতে। উঠে পড়লাম বসা থেকে। ঠিক সেই মুহূর্তে সেলফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। আসলে ওই টোনটা ছিল আমার দুর্ভাগ্যের ঘণ্টা ধ্বনি। আমাকে ঘণ্টা বাজিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, যে জীবনটা মোটেও ফুলশয্যা নয়। অন্তত আমারটা তো নয়ই।
রুশমি বলল, ‘তুমি এয়ারপোর্ট যাচ্ছ কী করে?’
—‘দেখি উবার কল করব।’ শুভ্রার পাঠানো মেসেজটা পড়তে পড়তে চিন্তিত গলায় বললাম।
—‘তা কেনো? আমি তোমাকে এয়ারপোর্ট ড্রপ করে আসব।’
আমি চুপ করে চেয়ে আছি সেলফোনের দিকে। কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না। একটা বিহর্ষ বিস্ময়বোধ আমাকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে। শুভ্রা এসব কী বলছে আবোলতাবোল? ওর মাথা ঠিক আছে তো?
রুশমি কিছু একটা বলছে এই মুহূর্তে। আমি ওর মুখ নিঃসৃত শব্দগুলোর কোন অর্থ অনুধাবন করতে পারছি না। আমার কানে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। মস্তিষ্ক শূন্য। ওর কথা গ্রাহ্য না করে বাড়ির ভেতর পা বাড়ালাম। সিঁড়ি ভেঙে সোজা উঠে এলাম ওপরে। বেডরুমের দরজা আটকে দিয়ে শুভ্রার ফোনে ডায়াল করলাম। একবার রিং পড়তেই ও ফোন রিসিভ করল,
—‘এসবের মানে কী?
—‘ইংরেজি বুঝিস না তুই?’ ক্যাটক্যাট করে প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে শুভ্রা।
—‘তুমি এতসব জানলে কী করে?’
—‘রুশমির এক ফ্রেন্ডের সাথে আমার কথা হয়েছে। খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড।’
—‘কোন ফ্রেন্ড? কী নাম?’
—‘নাম বলা যাবে না তোকে। তুই শুধু জেনে রাখ যে তোর বৌ যতটা ইনোসেন্ট ভাব ধরে থাকে সবসময় ততটা ইনোসেন্ট সে না। আর কী মিথ্যুক! মুখের ওপর বলে কিনা কোন বয়ফ্রেন্ড নাই। ওই ছেলেটার সাথে ওর প্রায় বছর খানেকের বেশি সময় ধরে রিলেশন ছিল। এখনো কথা হয় ফোনে। এমনকি বিয়ের পরে সে দেখাও করেছে ওই ছেলের সাথে।’
অনেক কষ্টে বললাম, ‘ছেলেবন্ধু তো থাকতেই পারে তাই না? থাকাটাই স্বাভাবিক।’
শুভ্রা কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘তা থাকতে পারে। কিন্তু বন্ধুর সাথে কি এতো ইন্টিমেট রিলেশনশিপ থাকা উচিত? মানে গাড়ির মধ্যে কিস করার মতো রিলেশন?’
চমকে উঠলাম, ‘কী বলছ?’
— ‘ঠিকই বলছি। আমি সব খবর নিয়ে ফেলেছি ওর সম্পর্কে। শোন শিহাব, আমার সাথে তুই থাকিস আর না থাকিস সেটা অন্য ব্যাপার। কিন্তু আমি কিছুতেই তোকে ওই মিথ্যুক মেয়েটার সাথে থাকতে দেব না।’
—‘তুমি কি আমাকে ছেলেটার নাম বলতে পারবে?
—‘লিওনার্দো সামথিং। পুরো নাম মুখস্থ করে বসে আছি নাকি?’
—‘শুভ্রাদি, আমার মনে হয় তোমার কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে।’
—‘ভুলের কী আছে? একটা আধুনিক মেয়ের কোন বয়ফ্রেন্ড নাই এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা? তুই স্টুপিড দেখেই এসব বিশ্বাস করেছিস।’
—‘কিন্তু আমাকে মিথ্যা বলে ওর লাভটা কী?’
—‘এসব মেয়েলি ট্রিক তুই বুঝবি না। মিথ্যা কথা বলে ইনোসেন্ট সেজে তোকে ফাঁসানো হচ্ছে।’
—‘আমার মনে হয় না আমাকে ফাঁসানোর কোনও ইনটেনশন ওর আছে।’
—‘ও গড! এতো বোকা হলে তোর লাইফ চলবে কী করে শিহাব?’
—‘ভালো লাগছে না এসব কথা বলতে। ফোন রাখছি।’
—‘শোন, আমার এপার্টমেন্টে আয় একটাবার। বিস্তারিত কথা বলব।’
—‘পসিবল না। আমি স্টেটের বাইরে যাচ্ছি। অফিসের কাজে।’
ফোন কেটে দিলাম। মাথাটা এলোমেলো লাগছে। গাঢ় বিষণ্ণতা ঝাঁকবাঁধা মৌমাছির মতো উড়ে এসে জাপটে ধরছে আমাকে। ভয়ংকর ভারী বিষাদে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে। একটু আগের স্নিগ্ধ আবেশ মাখা পৃথিবীটা হারিয়ে গেছে চোখের পলকে। চারপাশে এখন মন খারাপের গাঢ় সমুদ্র। এতটা মন খারাপ আমার বহুদিন হয়নি! কেনো এত খারাপ লাগছে কথাগুলো শোনার পর? একজন সুস্থ, সাধারণ সুন্দরী মেয়ের একটা কেনো, দশটা প্রেমিক থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ও আমাকে মিথ্যে বলল কেনো? আড়াল করল কেনো? ওকে কি পরিবারের লোকেরা এসব বিষয় গোপন করার কথা শিখিয়ে দিয়েছিল বিয়ের আগে?
আমি বসে আছি বিছানার ওপরে। আধা ঘণ্টার মাঝে বেরিয়ে না পড়লে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। অথচ আমার কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। পুরো পৃথিবীটাকে মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। রুশমি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বসা থেকে উঠে পড়লাম। তৈরী হয়ে নিলাম খুব দ্রুত। রুশমি বলেছে আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসবে। আমি প্রস্তাবটা নাকচ করে দিয়েছি। ওর মুখের দিকে তাকাতে এখন আর ইচ্ছে করছে না। আমার ভেতরে কী হচ্ছে জানি না। রাগ, দুঃখ, অভিমান এসব মানবীয় সূক্ষ্ম অনুভূতির কোনো ক্রিয়া-বিক্রিয়াই স্পষ্টত টের পাচ্ছি না। ভেতরটা অবশ অবশ লাগছে। শুভ্রাই ঠিক বলেছে। আমি স্টুপিড। স্টুপিড বলেই কৈশোরের মোহকে ভালোবাসা ভেবে এতকাল প্রেমহীন, নিরুত্তাপ একাকী জীবন যাপন করেছি। স্টুপিড বলেই রুশমির সুন্দর মুখ দেখে ধোঁকা খেয়েছি, ভেবেছি ওর বাইরের আবরণটার মতোই ভেতরটাও বুঝি পবিত্র আর নিষ্কলঙ্ক। বয়ফ্রেন্ড থাকা না থাকা নিয়ে আমার কোন আপত্তি নেই। আমার আপত্তি ওর মিথ্যে বলায়। আমি তো প্রথমদিনই শুভ্রার ব্যাপারে সব কিছু বলে ফেলেছিলাম। তাহলে ওর সত্যটা বলতে বাঁধল কোথায়?
মানুষের জীবনের সমস্যা গুলো বিচিত্র। যে যখন যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধুমাত্র সেই জানে জায়গাটার প্রকৃত চিত্র আসলে কেমন। দূর থেকে চোখ মেলে শুধু দেখা যায়, কিন্তু পরিপূর্ণ ভাবে অনুধাবন করা যায় না। এই মুহূর্তে অনেকেই হয়তো ভাবছ রুশমিকে আমি সরাসরি কিছু বলছি না কেনো? উত্তর হলো ছোটবেলা থেকেই আমার স্বভাব একটু অন্তর্মুখী ধরণের। নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করায় আমার জুড়ি নেই। অন্যকে কষ্ট দেয়ার চাইতে নিজেকে কষ্ট দেয়া আমার কাছে অনেক সহজ। কী দরকার রুশমিকে এসব প্রশ্ন করে বিব্রত করার? বেচারি হয়তো বাবা-মায়ের আদেশ পালন করেছে মাত্র। ছোট মানুষ, অত কিছু বোঝে নাকি? আমার নিজেরও তখন বয়স অল্প। মাত্র চব্বিশ। খুব বেশি পরিণত চিন্তা করার মতো বয়স তো ওটা না। তাই তো অবাধ্য মনটা কিছুতেই বিবেকের শাসন মানতে চাইছিল না। টের পাচ্ছিলাম বিশ্বাস ভেঙে গেছে কাচের টুকরোর মতো ঝনঝন করে। কয়েকটা এবড়োথেবড়ো ভাঙা কাচ হয়তো গেঁথে গেছে হৃৎপিণ্ডের দেয়ালে। অসহনীয় ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠছে বুক। সেই সন্ধ্যায় যন্ত্রণাবিদ্ধ একটা মন নিয়ে যখন ভার্জিনিয়া ছাড়লাম, তখনও অপরিণতমনস্ক আমি জানতাম না, যে রুশমি নামের মেয়েটা আমার মনোজগতে যে অলঙ্ঘনীয় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সেই আলোড়নের নাম রাগ নয়, ঘেন্না নয়, কষ্টও নয়! বরং তার নাম ভালোবাসা! একমাত্র ভালোবাসাই পারে মানুষকে এমন বিচিত্রতর, অব্যাখ্যেয় এবং দুয়ে সব অনুভূতির সম্মুখীন করে তুলতে।
রুশমি
ওর হয়েছে কী কে জানে! ঝুপ করে কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেলো। কোন কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে না, উত্তর দিচ্ছে না। কেমন অন্যমনস্ক একটা ভাব। সব তো ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ কী হলো! বেডরুমে এসে দেখি ঝিম ধরে বসে আছে বিছানায়। আমাকে দেখা মাত্র উঠে পড়ল। ভাবটা এমন যেন আমার উপস্থিতি সে টেরই পায়নি।
আমি এখন জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। ভাবছি ওর চরিত্রের এই দ্বিমুখীতার কারণ কী? একটু আগে প্যাটিওতে বসে এমন ভাবে গল্প করছিল যেন আমার কতদিনের চেনা পুরোনো বন্ধু। আর এখন? চোখে চোখে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত একটাবারের জন্য। এরকম অদ্ভুত মানুষ আমি জন্মে দেখিনি ভাই! আমাকে পেয়েছেটা কী? যখন যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যবহার। আমি কি খেলার পুতুল?
বাইরে বিকেল নেমে গেছে। রোদে আর উত্তাপ নেই। স্নিগ্ধ বাতাসে দুলছে বাগানের ড্যাফোডিলের কলি। সামনের বাড়ির মিসেস রবার্ট লন মোয়িং করছে। ভোঁভোঁ শব্দ করে ঘাস কাটছে মেশিনটা। খানিক দূরে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বারবিকিউ গ্রিলের কয়লায় আগুন ধরিয়েছে। উনি মিসেস রবার্টের বাবা। ঝকঝকে সোনালী রোদের গায়ে কয়লা পোড়া আগুনের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে অল্প অল্প করে। এতো সুন্দর চনমনে একটা দিন, অথচ আমার চারপাশে বাজছে মন খারাপের সুর। সকাল থেকে জ্বলতে থাকা সুখের মোমবাতিটা হঠাৎ যেন কেউ ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছে। আমার এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। ভালো লাগছে না কারণ এই মানুষটাকে আমি বুঝতে পারছি না একটা ফোঁটাও। ভালো লাগছে না কারণ আমার ভয় হচ্ছে ও চলে যাবার পরের তিনটা দিন বুঝি আমার ভয়াবহ খারাপ কাটবে। মানুষটা আমাকে অসম্ভব রকমের জ্বালাচ্ছে। আড়চোখে দেখলাম তৈরী হয়ে গেছে যাবার জন্য। এখন বিছানার ওপর ঝুঁকে বসে জুতোর ফিতে বাঁধছে। গায়ে মেরুন রংয়ের হাফহাতা টি-শার্ট আর কালো জিন্স। জুতোর ফিতে বাঁধা হয়ে গেলে উঠে দাঁড়ালো। কনুইয়ে ঝুলিয়ে নিল কালো লেদারের জ্যাকেট। কাঁধে ব্যাকপ্যাক। তাজ্জব বনে গেলাম তখন, যখন আমাকে কিছু না বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। ভদ্রতা জ্ঞান বলে কি কিছু নেই নাকি? আশ্চর্য! যাবার আগে কিছু তো অন্তত বলে যাবে! স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ জানালার সামনে। বুঝতে পারছি না আমার এখন কী করা উচিত। গায়ে পড়ে কথা বলতে যাওয়াটা আমার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ হবে। আত্মসম্মানের বলিদান হবে। আবার মনে হচ্ছে ও চলে যাবার আগে একটু কথা বলতে না পারলে বুঝি মরেই যাব। কী করা উচিত আমি জানি না। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি। তিনি নিশ্চয়ই আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন। উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্ব বুকের মধ্যে নিয়েই নিচে নামলাম। দেখলাম ও দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েছে সবেমাত্র। নিজেকে খুবই ঠুনকো আর সস্তা মনে হচ্ছে। বিশ্বাস হচ্ছে না যে আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এই ছেলের পিছু পিছু নিচে নেমে এসেছি শুধু এর সাথে দুটা কথা বলব বলে। আর এতসব করা সত্ত্বেও এই মানুষ আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না, ফিরেও তাকাচ্ছে না। নিজের চারিত্রিক অধঃপতন দেখে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি।
শিহাব প্যাটিওর থামের পাশে দাঁড়িয়েছে। খুব সম্ভবত উবারের জন্য অপেক্ষা করছে। চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। এখান থেকে ওর মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। চোখে সানগ্লাস, মুখে গাম্ভীর্য। ঠোঁটের কোণে ভাঁজ। আমি লক্ষ্য করেছি চিন্তিত মুহূর্তে ওর ঠোঁটের কোণে এরকম ভাঁজ পড়ে থাকে। ওই ভঙ্গিটায় একটা দাম্ভিক ভাব আছে। মনে হয় যেন পৃথিবীর সমস্ত দম্ভ উড়ে গিয়ে বসেছে ওই দুঠোঁটের প্রান্তিক কোণে।
—‘তোমার কী হয়েছে?’ আর না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। ও অবহেলায় ঘাড় ঘুরালো, অবহেলায় বলল, ‘কিছু না।’
—‘তাহলে এরকম করছ কেনো?’
সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো পুনরায়, শ্রাগ করে বলল, ‘কী করলাম?’
এরপর আর কী বলা যায়? যে মানুষটার সাথে আমার এখনো কোন রকমের বোঝাপড়াই হয়ে ওঠেনি তাকে নিশ্চয়ই হুট করে প্রশ্ন করা যায় না, যে তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেনো? এরকম কোন অভিযোগ করার মতো অধিকার তো আমার ওর ওপর জন্মায়নি। রাগ হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। মন চাচ্ছে উইয়ার্ড ছেলেটার চুলগুলো টেনে হিঁচড়ে ছিঁড়ে দেই। আঁচড় দিয়ে নখের দাগ বসিয়ে দেই গালে। কিন্তু মনের শহরের কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? এই বিক্ষোভ, তো এই কারফিউ, আবার এই বুঝি নামলো আনন্দ মিছিল! রাগটা উবে গেলো মুহূর্তের মাঝে। ওই বিকেল রোদে দাঁড়িয়ে থাকা, মেরুন টি-শার্ট পরা, চোখে সানগ্লাসওয়ালা অটল, অবিচল গম্ভীরমুখো ছেলেটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, হঠাৎ আমার বুকের ভেতরে এক অকাট্য সত্য উপলব্ধি সদ্য ঝিনুকের খোলস ছাড়িয়ে মুক্তো দানার মতো ঝরঝর করে ছড়িয়ে পড়ল এলোমেলো ভাবে। আমি বুঝলাম মানুষটা একটু কেমনতর অন্যরকম বলেই আমাকে সে এতো বেশি করে ভাবায়। সে তো আর দশটা সাধারণ পুরুষের মতো নয়, যারা উঠতে বসতে মেয়েদের প্রশংসা করে, খুব সহজেই মুগ্ধতা প্রকাশ করে ফেলে, অকারণ কথা বলে বাঁচালের মতো। ওরকম হলে আমি নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে এতটা ভাবতাম না। পাত্তাই দিতাম না! হঠাৎ মনে হলো এই মানুষ কোনদিন আমার কোন প্রশংসা করেনি আজ পর্যন্ত। গুণের তো নয়ই এমন কি রূপেরও না। অথচ আমার রূপের প্রশংসা করে না এমন লোক আমি জীবনে দেখিই নি বলতে গেলে। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি জানি যে, আমি সুন্দর।
একটা স্কাই কালারের নিশান আলটিমা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির সামনে। শিহাব সেলফোন হাতে নিয়ে কী যেন দেখলো। তারপর পা বাড়ানোর আগে একবার আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘আসছি। জাহিদকে দেখো কেমন?’ আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার মন কেমন করছে। মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলব যেকোনো মুহূর্তে। ও একটু থেমে কী যেন চিন্তা করে নিয়ে বলল, ‘শোন, এই তিনটা দিন বরং জাহিদকে নিয়ে তোমাদের বাসায় চলে যাও। মমের সাথে আমার কথা হয়নি। এখন তো বাংলাদেশে গভীর রাত। সকালে উঠে আমাকে ফোনে না পেয়ে অস্থির হয়ে যাবে। তুমি সন্ধ্যের দিকে একটা ফোন করে বলে দিও যে আমার হঠাৎ করেই যেতে হলো। আমি রাতে কথা বলে নেব ওদের সাথে। আর জাহিদের দিকে একটু খেয়াল রেখো। ও যেন রাত করে বাড়ি না ফেরে।’
আমি বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে বললাম, ‘ঠিক আছে।’ এবং লক্ষ্য করলাম ও বাবা-মা এবং ভাইয়ের কথা বলে গেলো, কিন্তু আমার কথা কিছুই বলে গেলো না। অথচ এইযে সে দূরে চলে যাচ্ছে, বাবা-মা ভাইয়ের তো কিছু এসে যাচ্ছে না এসে যাচ্ছে আমার! অন্য সবাই দিব্যি ভালো থাকবে, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে পৃথিবী ঘুরবে তার নিজস্ব কক্ষপথে, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে, দিন কাটবে, রাত আসবে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাবে টিকটিক করে, এদিকে শুধু আমি… কেউ জানবে না… কেউ দেখবে না…। সবার অলক্ষ্যে আর অগোচরে আমার মনের শহরে বয়ে যাবে রক্তগঙ্গা! রক্তগঙ্গা শব্দটা আমার মাথায় কেনো এসেছে জানি না। এসে গেছে যখন কী আর করা!
আমি মুখ নামিয়ে নিয়েছি নিচে। চারপাশ কুয়াশার মতো আবছা হয়ে আসছে ক্রমেই। ও হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে গাড়ির কাছে। একটাবার ফিরে পর্যন্ত তাকাচ্ছে না। কঠিন মানুষ! কী করে তুমি আমার সবকিছু এক নিমেষে বদলে দিলে কঠিন মানুষ? তুমি কি জাদুমন্ত্র জানো? তোমার কি ম্যাজিক ওয়ান্ড আছে? এখন আমার কী হবে? আমি থাকব কী নিয়ে?
কেউ একজন হাত রেখেছে কাঁধে। আমি একটু চমকালাম। কারণ এই নির্জনবাসে আমার কাছে কেউ খুব একটা আসে না। লিফ র্যাক দিয়ে শুকনো পাতা কুড়াচ্ছিলাম ডেকের ওপর থেকে। এটা দু হাজার আঠারোর শরৎ সন্ধ্যা। লেখাটা শুরু করার পর থেকে আমি যেন এক স্মৃতির জাদু বাক্সে বন্দি হয়ে পড়েছি। স্মৃতিগুলো আমাকে হাসাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে, ভাসাচ্ছে! কেবলই মনে হচ্ছে সময় বা কাল বলে আসলে কিছু নেই এ পৃথিবীতে। সময় একটা ভ্রম মাত্র। সত্য হলো শুধু মানব মনের অনুভূতি। অনুভূতিই মানুষকে দৃষ্টিশক্তি দেয়। অনুভূতির দৃষ্টির জোরেই আমার হৃদয়াক্ষী আজ আলো পেয়েছে। সেই আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে দু হাজার পনের সালের বসন্ত বিকেল। এইমাত্র আমার প্রিয় মানুষটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে তিনদিনের জন্য। আর সে চলে যাওয়া মাত্রই জীবনে প্রথমবারের মতো আমি টের পেয়েছি বিরহ যাতনা কাকে বলে। আমার বুকে এখন বিরহের বাঁশি বাজছে। প্রেমের অমৃত
মিশে গেছে আমার রক্তের স্রোতধারায়। কাঁধে এসে লাগা হাতের স্পর্শ যেন আমার মনটাকে সাঁড়াশি দিয়ে টেনে নামালো দু হাজার পনের থেকে দু হাজার আঠারো সালে। আমি চর্মচক্ষু মেলে মেজোর বিস্ময়মাখা মুখখানা দেখতে পেলাম। ও ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে গত মাসে। একটা বি এম ডব্লিউ গাড়িও কিনে ফেলেছে লোন নিয়ে। এখন সুযোগ পেলেই ড্রাইভ করে চলে আসে আমার এই নির্জন নিবাসে। মানুষ জন আসলে ভালোই লাগে। আম্মুজান সপ্তাহে একবার আসার চেষ্টা করে। সব সময় পারে না। বাবাজান চলে যাবার পর থেকে আম্মুকেই সব কিছু সামলাতে হচ্ছে। আমি তো বড় মেয়ে হয়েও সংসারের হাল ধরতে পারিনি। মেজো মাথা থেকে হিজাব খুলে নিচ্ছে আর কেমন অদ্ভুত চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি শুকনো পাতাগুলো ঝাড়ু দিয়ে উঠোনের ওপর ফেলছিলাম। রেলিং এর ওপর কয়েকটা জোনাকি উড়ছে। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে দল বেঁধে। একটু পরেই ঝুপ করে রাত নেমে যাবে। আশেপাশে আলোর কোনো রেশ থাকবে না। ঘুটঘুটে ঘন জঙ্গলে শুকনো পাতার ওপর ভারী পা ফেলে মড়মড় শব্দ তুলে ঘুরে বেড়াবে চতুষ্পদ জন্তুরা। শেয়াল ডাকবে হুক্কাহুয়া। আমি ল্যাপটপ খুলে বসে থাকব টেবিলের সামনে। রাত বাড়বে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাব অতীতে। আমার কিন্তু এখন অতীতে ঘুরে বেড়াতেই ভালোলাগে। বর্তমানটা ফাঁকা, বড্ড ফাঁকা!
—‘কী দেখছ এভাবে?’ প্রশ্ন করলাম।
—‘শিহাব ভাইয়া কালকেও এসেছিল।’
বড় একটা শ্বাস গোপন করে বললাম, ‘বেশ ভালো।’
—‘আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে উনাকে দেখে। মানুষটা ভালো নাই।
তুমি একটাবার অন্তত উনার সাথে দেখা করো।
—‘সেটা সম্ভব না।’
—‘তুমি চাইলেই সম্ভব হবে।’
আমি ঝাঁট দেয়া বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম, ‘তুমি তো সব জানো। সব জেনেশুনে এসব কথা কেনো বলছ?’
—‘বড়পু প্লিজ! তুমি মানুষটাকে বাঁচাও। হি ইজ ডায়িং।’
—‘অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।’
দায়সারাভাবে কথাটা বলে ভেতরের দিকে পা বাড়ালাম। বাতি জ্বালালাম ড্রইং রুমের। উত্তর দিকের জানালার পাল্লাটা গতরাতে কী করে যেন ভেঙে গেছে। একটা কালো মোটা বেড়াল বাড়ির আশেপাশের জংলা ঝোপে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। ডেকের ওপর ট্র্যাশ ব্যাগ রাখলে ব্যাগ ছিঁড়ে খাবারের সন্ধান করে। খুব সম্ভবত ওই বুনো বেড়ালটাই গভীর রাতে ঘরের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করেছিল। পুরোনো বাড়ির জানালার কপাট বলে কথা। গেছে একেবারে ভেঙে। এই পাল্লাটা ঠিক করতে হবে। নইলে রাতে খুব ঠান্ডা হাওয়া আসবে। আমি মেজোকে বললাম,
—‘তুমি এসেছ ভালোই হয়েছে। আমার একবার ডাউনটাউনে যেতে হবে। ওই দ্যাখো জানালার পাল্লাটা ভেঙে গেছে। ফিক্স করতে হবে।’
মেজো অধৈর্য গলায় বলল, ‘তুমি টপিক চেঞ্জ করছ কেনো? আমার কথা বুঝতে পারছ না?
আমি কফি বানানোর আয়োজন শুরু করলাম। এখন আমার সব সহ্য হয়ে গেছে। কষ্ট আমার কাছে নতুন কিছু নয়। বুকের ওপর ভারী পাথর নিয়েই নিশ্বাস নিতে হয় প্রতিনিয়ত। মনের কথা বলার একটা মানুষ নেই। বাবাজান ছিল চলে গেছে! আর বাবাজানের সাথে সাথে আমার নিজস্ব সুখ শান্তিও চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে। তবুও হঠাৎ হঠাৎ যখন ওর কথা শুনি তখন আমার ভালোলাগে। এখন ইচ্ছে করছে মেজোকে সামনে বসিয়ে ওর কথা জিজ্ঞাসা করি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ও কেমন হয়েছে এখন দেখতে, কী রংয়ের শার্ট পরেছিল? করে কী? চাকরি বাকরি করছে তো ঠিক মতো? এই সমস্ত খুঁটিনাটি আমার বড়ই জানতে ইচ্ছে করছে।
—‘বড়পু!’ আর্তনাদের মতো শোনায় মেজোর গলা।
— ‘বল।
—‘শিহাব ভাইয়া গতরাতে অনেকক্ষণ বসে ছিল। বেচারা মনে হয় রাতে ঘুমায়ও না। আমার খুব খারাপ লেগেছে দেখে। আর আম্মুজানের অবস্থাটা বুঝতে পারছ তুমি? সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না সব জেনে শুনেও।’
—‘বলতে নিষেধ করা হয়েছে।
—‘এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না প্লিজ!’
—‘চিন্তার কিছু নেই। শিহাব ঠিক হয়ে যাবে।’
—‘তুমি গায়েব হয়েছ প্রায় তিন বছর হতে চলল, এখনো সে তোমাকে ভুলতে পারেনি। আর কবে ভুলবে?’
—‘খুব শীঘ্রই। ওর সাথে ওর বাবা-মা আছে, সাশা আছে। এভ্রিথিং উইল বি অলরাইট।’
মেজো ঝাঁঝ নিয়ে বলে, ‘ওর মায়ের কথা আর বলো না। হার্টলেস মহিলা একটা!’
বুক ভার হয়ে আসছে। মেজো বুঝতে পারছে না আমার ভেতরটা কী রকম থরথর করে কাঁপছে। আরেকটু হলেই চোখ উপচে উঠবে জলে। কিন্তু আমাকে স্থির থাকতে হবে। ছোট বোনের সামনে কিছুতেই ভেঙে পড়া যাবে না।
—‘সর্বনাশ হবে কেনো? তোমার বয়স এখনো কম ঝুমি! অনেক কিছুই বোঝ না। মানুষের জীবনে কত সম্পর্ক ভাঙে আবার কত সম্পর্ক গড়ে! একটা সম্পর্কের পেছনে সারাজীবন কেউ পড়ে থাকে না।’
মেজো আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে থেকে ভারী করুণ গলায় বলল, ‘বড়পু, আমি জানি আমি এখনো অনেক ছোট। কিন্তু একটা ব্যাপার কী জানো? আমি শিহাব ভাইয়ার চোখে কিছু একটা দেখতে পেয়েছি। ও অন্য সবার মতো না। ওর জন্য তোমাকে ভুলে যাওয়াটা খুব সহজ কাজ হবে না। আমার মনে হয় তোমার একটাবার খোলামেলা ভাবে ওর সাথে কথা বলা দরকার। বেচারার সবকিছু জানার রাইট আছে।’
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললাম, ‘তুমি তো জানো বাবাজান আর আমি দুজন মিলে প্ল্যান করেছিলাম একটা ফার্ম ওন করব। মনে আছে?’
মেজো কফির মগ হাতে নিয়ে গমগম করে বলল, ‘মনে আছে।’
—‘আমি ভাবছি বাবাজানের স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করব। যদি আল্লাহ কপালে লিখে রাখেন আরকি।’
—‘আর এদিকে শিহাব ভাইয়া মরে যাক, তোমার কিছু এসে যায় না?’
আমার বিরক্তি চলে আসলো, ‘তোমাকে শিহাব এনচ্যান্টেড করে ফেলেছে। সেই তখন থেকে ওর নাম জপে যাচ্ছ। বললাম তো ওর পাশে সাশা আছে।’
—‘সাশাকে ও পছন্দ করে না।’
—‘করে। বন্ধু হিসেবে তো করেই।’
—‘তাতে লাভটা কী? ‘
—‘লাভ হচ্ছে সাশা ওকে সামলে নেবে। আর কদিন পরে সব স্মৃতি যখন আবছা হয়ে আসবে তখন তোমার শিহাব ভাইয়া আরেকটা বিয়ে করবে। ওর মা-বাবা প্রথমেই সাশার সাথে বিয়ে দিতে চাইবে না। তবে মুসলিম হয়ে গেলে নিশ্চয়ই দেবে, তাই না?’ এটুকু বলে একটু থেমে জরুরি গলায় আবার বললাম, –’মেজো, আমার শহরে যেতে হবে একবার। তুমি যাবে সাথে?’
—‘যেতে পারি। আজ রাতে থাকছি তোমার এখানে।’
—‘বেশ, থেকে যাও।’
এখন আমার ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে। সেই তো চলে গেলো ক্যালিফোর্নিয়া। আমি জাহিদকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে এসেছি। মহারাজের ফোন নম্বর নেই আমার কাছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচরণ আছে কিনা তাও জানি না। জাহিদ বলেছে তার ভাইয়ের একটা ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট আছে। তো সেই অ্যাকাউন্ট দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! এতো এতো ফলোয়ার! ভাই আমার বর এতো ফেমাস গায়ক তা তো আমি আগে জানতাম না!