রুশমি
জাহিদ হাতমুখ না ধুয়েই ডাইনিং এর চেয়ারে বসে পড়েছে। ও ডিনার করেছে বাইরে। এখন খাবে না। তবে ভাব দেখে মনে হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলার আছে তার
—‘ভাবি শোনো, কাল রাতে কী করছ?’
ও আমাকে সম্প্রতি ভাবি ডাকা শুরু করেছে। শাশুড়ির পীড়াপীড়িতে একরকম বাধ্য হয়েই ডাকছে বলা যায়। নইলে ও যা বিচ্ছু ছেলে নিজের বাবা-মাকেও পারলে নাম ধরে ডাকে। আমি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। জাহিদ কথা বলতে চাইছে বলেই বসলাম, নইলে ওদিকে যা একটা সিনেমা শুরু হয়েছে না ভাই! ওই সিনেমার জ্বালায় এখান থেকে এই মুহূর্তে সরে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। সাশা মেয়েটা পারলে শিহাবের একদম কোলে উঠে যায়। আজিব কারবার। টেক্সটই তো করছ! তা একটু দূরত্ব বজায় রেখে টেক্সট করলে কী এমন ক্ষতিটা হয় শুনি? দুজনের চোখ মোবাইলের স্ক্রিনে আটকে আছে আঠার মতো। উইয়ার্ড ব্যাপার!
—‘কেনো কী হবে কাল রাতে?’ প্রশ্ন করলাম।
—‘জঙ্গলে যাব। আই স্ সামথিং ইন দ্যা উত্স লাস্ট নাইট। ফ্রম মাই উইন্ডো।’
শিহাব মুখ তুলল, ‘কী দেখেছ?’
—‘সামথিং প্যারানরমাল।’
শিহাব ভ্যাক করে হেসে দিল, ‘তোমার মাথাটা একদম গেছে।’
—‘তুমি কখনোই আমার কথা বিশ্বাস করো না ভাইয়া। এটা ঠিক না।
—‘এসব আজগুবি কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।’
—‘আচ্ছা চলো আমার সাথে। গেলেই দেখবে।’
লক্ষ্য করলাম সাশা এখন কানে হিয়ারিং ডিভাইস লাগিয়েছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছে দুই ভাইয়ের কথোপকথন। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘গিয়ে হবেটা কী?’
—‘জঙ্গলের ভেতরে একটা হন্টেড হাউজ আছে। আমরা ওই জায়গাটা এক্সপ্লোর করব। আমার দুজন ফ্রেন্ড আসবে। তুমিও চলো।’
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিহাব বলল, ‘ও কোথাও যাবে না। আর তুমিও কোথাও যাবে না অত রাতে।
—‘প্লিজ ভাইয়া। আমার ফ্রেন্ডদের সাথে প্ল্যান হয়ে গেছে।’
—‘প্ল্যান ক্যানসেল করো।’ প্লেটে খাবার তুলে নিতে নিতে গম্ভীর গলায় আদেশ দিল শিহাব। দেখলাম ও নিজের প্লেটে না, প্রথমে সাশার প্লেটেই খাবার তুলে দিল। ঈর্ষা জিনিসটা আমার ভেতরে নেই বলেই জানতাম। সেটা কীরকম, কেমন দেখতে তাও ছিল অজানা। কিন্তু আজকে এই মুহূর্তে, সাশার প্রতি ওর এই আকাশচুম্বী দরদ দেখে ক্যাকটাসের কাঁটাটা এমন ভাবে কলিজায় বিঁধতে লাগলো যে আমার সমগ্র চেতনা একযোগে সরব কণ্ঠে জানান দিয়ে উঠল, ‘ইহাই ঈর্ষা!’
আশ্চর্য! একটা ডিজেবল্ড মেয়ে, যে কিনা বলতে পারে না, শুনতে পারে না… সেই বেচারিকে কিনা আমার হিংসা হচ্ছে! ধিক তোমাকে রুশমি! শত সহস্র ধিক!
—‘ক্যানসেল করতে হবে না। আমি যাব!’ কঠিন স্বরে ঘোষণা দিলাম। শিহাব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে, ‘মানে কী?’
জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলাম, ঠান্ডাভাবে উত্তর দিলাম, ‘আমি যাব ওর সাথে জঙ্গলে।’
—‘কেউ যাবে না!’ শিহাবের গলার স্বর চড়ে গেলো। চড়ল আমার মেজাজও।
—‘তুমি কে নিষেধ করার?’ কোমর বেঁধে নামলাম যুদ্ধ ময়দানে।
শিহাব হাতে ধরা স্পুনটা নামিয়ে রাখলো প্লেটে। লক্ষ্য করলাম ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। বাদামি চোখজোড়ার চাউনি এখন নিষ্ঠুর। নার্কের ভাঁজে ক্রোধের রেখা স্পষ্ট।
—‘পাপা মমের অনুপস্থিতিতে আমিই হেড অফ দ্যা হাউজহোল্ড। আমার কথা তোমরা শুনতে বাধ্য।’
আমি কটাক্ষ করে বললাম, ‘আসছে হেড অফ দ্যা হাউজহোল্ড! জাহিদ শোন, তোমার প্ল্যান ক্যানসেল করতে হবে না। আমি যাব তোমার সাথে। এটাই ফাইনাল।’
জাহিদ একটু থতমত খেয়ে গেছে। ভয়ার্ত চোখে একবার ভাইকে আরেকবার আমাকে দেখছে। আমি শিহাবের দিকে তাকাচ্ছি না এখন। ধীরস্থিরভাবে নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিচ্ছি। আমার যেখানে ইচ্ছে আমি সেখানে যাব, ও কে মানা করার? ও সাশাকে কোলে নিয়ে বসে থাকুক। আমার ওপর অত নজরদারি কেনো? পৃথিবীর সব মেয়ে কি তার কেনা গোলাম নাকি? আমি শুভ্রা কিংবা সাশা নই। আমার একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। প্রয়োজনে আমি নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে রাজি আছি কিন্তু ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে রাজি নই।
কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে কাটার পর শিহাবের হিমহিম কঠিন কণ্ঠস্বরটা কানে এসে লাগলো, ‘রুশমি লিসেন, সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এখন পাপা মম বাড়িতে নেই তাই আমার ওপর দায়িত্বটা একটু বেশি। আশা করি ব্যাপারটা তুমি বুঝতে পারছ। গভীর রাতে জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়াটা কোনও ওয়াইজ ডিসিশন বলে মনে হচ্ছে না আমার। পাপা ফিরে আসুক। তারপর যেও। আমিই নিয়ে যাব তোমাদের।’
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম, ‘বাড়ির পাশের জঙ্গলে যাবার জন্য তোমাকে লাগবে? আনবিলিভেবল! তুমি তো রোজ অন্ধকার জঙ্গলে গিয়ে বসে থাকো। আমরা যেতে পারব না কেনো?’
—‘আমার কথা আলাদা। আমার অভ্যাস আছে। জাহিদ ছোট মানুষ। ওকে আমরা রাতের বেলা একলা ছাড়ি না।’
—‘আমি তো যাচ্ছি ওর সঙ্গে। এরপরেও তো কোন সমস্যা হবার কথা না।’
শিহাব কপালে ভাঁজ ফেলে কী যেন চিন্তা করল একটুক্ষণ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব। আমার সাথে যাবে।’
—‘তোমার সঙ্গে আমরা কোথাও যাব না!’
—‘বেশ তো তাহলে আমাকে ছাড়াও কোথাও যাবে না।’
বিরক্তিতে আমার মুখ তখন কুঁকড়ে গেছে। এমনিতেই সারা বছর বাবাজানের নিষেধাজ্ঞার ভেতরে থেকে জীবনটা একেবারে নিরামিষ হয়ে গেছে। বিয়ের পরেও আরেকটা আস্ত বাবাজান টাইপ লোকের খপ্পরে পড়লাম দেখি। কী যন্ত্রণা!
সাশা হা করে কথা গিলছিল। ফ্রেকেলস ওয়ালা মুখের চামড়ায় এখন সীমাহীন বিস্ময়। জাহিদ ইংরেজি বললেও আমার আর শিহাবের বেশিরভাগ কথা হচ্ছিল বাংলায়। তাই আমাদের কথার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না সাশা। হঠাৎ ও একটা কাণ্ড করে বসল। শিহাবের থমথমে ঠোঁটজোড়ার দু প্রান্ত হাতের দুই আঙুল দিয়ে টেনে ধরে ইশারায় কিছু একটা বলল। ইশারার মর্মার্থ হলো, এবার একটু হাসো! শিহাবও একদম বাধ্য ছেলে হয়ে সঙ্গে সঙ্গে একশ ভোল্টের বাতির মতো ফকফকা হাসি দিয়ে উঠল। তারপর সেকেন্ড গড়ানোর আগেই সাশা ওর ভাঁজ পড়া হাসি থইথই গালে চকাম করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। থাম্বস আপ দেখিয়ে বলল… মানে কিছু একটা বলল ইশারায়। কী বলল তা আর আমি জানি না। আমার দম তখন আটকে গেছে গলার কাছে। শিহাব যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে খাবার চিবোচ্ছে। জাহিদও নির্বিকার। যেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। মাথা ঝিমঝিম করছে। কানের কাছে শুনতে পাচ্ছি ঝিঁঝি পোকার ডাক। এর মানে এসব ব্যাপার ওদের মাঝে প্রায়শই হয়ে থাকে। কী সাংঘাতিক! কী জঘন্য! কী ভীষণ বাজে একটা ছেলের সাথে বাবাজান আমাকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে! আমার এখন সুইসাইড করতে মন চাইছে! বাবা-আম্মুর ধারণা ছিল মুসলমানের ছেলে মানেই একেবারে ফেরেশতা! এখন দেখো তোমাদের ফেরেশতার মতো জামাইয়ের কাণ্ড- কারখানা!
তাৎক্ষণিকভাবে উঠে পড়লাম চেয়ার ছেড়ে। একটা কান্নার ঢেউ আমার বুকের গভীর থেকে কণ্ঠ বরাবর উঠে আসছে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে। আচ্ছা আমি কি ওভার রিঅ্যাকট করছি? ওটা হয়তো একটা বন্ধুসুলভ আচরণ ছিল। আমিই ভুল ভাবছি। বড় বেশি ছোট আমার মনটা। এই ছোট মনটাকে আজ এই মুহূর্তে হাজার চেষ্টা করেও ইঞ্চি পরিমাণ বড় করতে পারছি না। আমার এতো খারাপ লাগছে কেনো? ওকে তো আমি স্বামী হিসেবে মেনে নেইনি কখনোই। ও যা ইচ্ছা করুক, আমার তাতে কী?
গোসল সেরে, নামাজ পড়ে, সোজা চলে গেলাম বিছানায়। ভেবেছিলাম ঘরদোর পরিষ্কার করব। কিন্তু আজ আর কিছুই হবে না। শরীর ক্লান্ত। মন আমার তার চাইতেও বেশি ক্লান্ত। দরজায় ধাক্কা পড়ছিল। ধাক্কার ধরণ দেখে বুঝতে পারলাম ওটা জাহিদ। দরজা হালকা একটু ফাঁক করে বললাম, ‘কী ব্যাপার?
জাহিদ বাইরের জামা কাপড় পাল্টে নিয়েছে। ওর গায়ে এখন ঢলঢলে টি- শার্ট আর হাফ প্যান্ট। শরীরে এক ফোঁটা মাংস নেই এই ছেলের। কঙ্কালসার দেহটা ঠ্যাংঠ্যাঙা লম্বা। শিহাবকেও ছাড়িয়ে গেছে উচ্চতায়। ও একটু বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। থুতনিতে গজানো একটু একটু দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলছে, ‘তোমার কী হলো হঠাৎ? না খেয়ে চলে এলে যে?’
—‘খিদে নেই।’
—‘ভাইয়া ডাকছে তোমাকে।’
—‘বলে দাও ঘুমাচ্ছি।’
জাহিদের ঠোঁটে একটা চিকন হাসি ফুটল, ‘কিন্তু তুমি তো ঘুমাচ্ছ না।’
—‘এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব। খুব ঘুম পাচ্ছে।’
—‘ভাইয়া একটু বেশি বেশি করে। কালকে আমি যাবোই যাবো। ওর মানা শুনব না। তুমি যাবে?’
—‘অফকোর্স! আই অ্যাম ইন! নিজেকে কী ভাবে তোমার ভাই? ওকে আমি পাত্তা দেই নাকি?’
জাহিদ খুশি হলো আমার কথা শুনে। আমি বললাম, ‘এখন যাও তুমি। আজকে ঘুমিয়ে নেই। কাল তো রাত জাগতে হবে, তাই না?’
জাহিদ চলে যাবার পর শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ওর সামনে এর আগে কখনো হিজাব ছাড়া যাইনি। আজকে তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। তবে অস্বস্তিটা বেশিক্ষণ টেকসই হলো না। জাহিদ ছোট মানুষ। আমার একটা ছোট ভাই থাকলে নিশ্চয়ই তার সামনে আমি পর্দা করতাম না। জাহিদও যে আমাকে বড় বোন হিসেবেই দেখে সেটা এ কদিনে টের পেয়ে গেছি খুব ভালোভাবে। ছেলেদের চোখ আমি পড়তে পারি। সব মেয়েরাই পারে!
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় পর দরজার বাইরে পদশব্দ শুনতে পেলাম। চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম বিছানায়। পিয়ানোর সুর কানে এলো না সেই রাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের বাতিগুলো নিভে গেলো। অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুম এলো না। বুকে রাক্ষুসে ক্যাকটাসের কামড় টের পাচ্ছিলাম। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। চোখের পর্দায় দৃশ্যটা বার বার ভেসে উঠছে। শিহাব ওর অসহ্য সুন্দর হাসিটা হাসছে আর সাশা… না, আমার এসব বলতেও আর ভালো লাগছে না। আধো জাগরণে দুঃস্বপ্নর মতো সেই দৃশ্যটাই দেখতে লাগলাম ঘুরে ফিরে।
শিহাব
রুশমি আসলেই একটা বাচ্চা। নইলে কেউ মাঝরাতে জঙ্গলে যাবার জন্য অমন বায়না ধরে? ওর আর জাহিদের মাঝে কোন তফাৎ নেই। বেচারি অনেক সকালে উঠে কাজে গিয়েছিল আজ। খাওয়া-দাওয়া না করেই ঘুমিয়ে গেছে। তার ঘুমের সমস্যা হবে বলে আমি পিয়ানোর সামনে বসিনি সে রাতে। শুভ্রা ফোন করেছিল। ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে বিছানায় যেতে দেরি হলো। তবে ভোরবেলা ঠিক ঠিক ঘুম ভেঙে গেলো যথাসময়ে। সেই সকালটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। মনে থাকবে সব সময়। বাইরে থম ধরা হিমেল আকাশ। জানালার ওপর সূর্যের আলো এসে পড়েছে। একটু বাদেই তুষার ঝড় শুরু হবে। তিন থেকে চার ইঞ্চি পরিমাণ তুষার জমে যাবে মাটিতে। বাড়ির সামনের প্যাটিওতে এখনই কিছু লবন ছিটিয়ে রাখতে হবে। গাড়িটা স্ট্রিট পার্কিং করা আছে। গ্যারাজে ঢুকিয়ে রাখা দরকার। ভাবতে ভাবতেই ঘুমন্ত রুশমির দিকে তাকালাম একবার। আর তাকানো মাত্র অদ্ভুত এক দৃশ্যে আমার চোখ আটকে গেলো। আমি দেখতে পেলাম ওর কাজলটানা দুটি চোখের লম্বা ঘন পাঁপড়ির ওপর টলমল করছে কয়েকবিন্দু জল। দেখতে পেলাম চোখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া শুকনো জলের দাগ… সুস্পষ্ট এবং সুগভীর!
কম্বল দিয়ে ওর শরীর ঢাকা। বালিশের ওপর এলিয়ে আছে একরাশ কালো চুল। কান্না ভেজা চোখ দুটির দিকে অনেকটাক্ষণ চেয়ে রইলাম নিষ্পলক। ওই জলের দাগ আমার ভালো লাগছে না। মনটা ক্রমেই বিষণ্ণ হয়ে উঠছে। এতো সুন্দর চোখে কান্নার দাগ মানায় না। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে এলাম খাটের কাছে। আমার বুক কাঁপছে দুরদুর করে। আমি জানি অত কাছে যাওয়া ঠিক নয়। বিশেষ করে সেই মানুষটার… যে মানুষটা আমার কেউ না। যে মানুষটা দুদিন পরেই আমার জীবন থেকে চলে যাবে, চিরতরে। কিন্তু বিবেকের ডাক শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমাকে চুম্বকের মতো টানছে ঐ নরম বালিশের ওপর রাখা নরম সুন্দর মুখখানা… টানছে ঐ জন্মকাজল পরা ঐশ্বরিক দুটি চোখ… টানছে গোলাপি রঙের ঠোঁট, টানছে ঠোঁটের নিচের গাঢ় কালো বিন্দু, যে বিন্দুতে পৃথিবীর সমস্ত মায়া ভিড় করে আছে এখন! আমি ওর পাশে বসলাম আস্তে করে। এই তুষারগন্ধা সাদা সকাল আমাকে অন্যরকম করে দিয়েছে। অন্যরকম করে দিয়েছে ঐ পবিত্র, নিষ্কলঙ্ক মুখ। বাতাসে আজ মিশে আছে অন্যরকম এক শিহরণ! জীবনে প্রথমবারের মতো ভেতরে একটা অনির্বচনীয় কম্পন অনুভব করছি আমি। এর আগে কোনদিন আমার ভেতরটা এমন দুকূল ছাপানো স্পন্দনে আন্দোলিত হয়নি। আমি আলতো করে ওর চোখের পাশের জলের দাগ মুছে দেবার চেষ্টা করলাম। ওর মুখের ত্বক কী মসৃণ! একদম মোমের মতো! হঠাৎ ঘুমন্ত চোখের পাঁপড়ি যন্ত্রের মতো খুলে গেলো। রাজ্যের বিস্ময় এখন ওই চোখে। আমি অপ্রস্তুতভাবে হাত সরিয়ে নিয়েছি। অপরাধবোধের প্রাবল্যে আমার মুখটা একটুখানি হয়ে গেছে। অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে আছে বুক। রুশমি মাথাটা চট করে তুলে আনলো বালিশ থেকে। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা থাপ্পড় এসে পড়ল আমার ডান গালে। রুশমি দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘এখানে কী করছ তুমি? ফাজিল ছেলে!’
আমি এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছি যে, আমার মুখ হা হয়ে আছে কিন্তু সেই মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোচ্ছে না। এতক্ষণের শান্ত, স্নিগ্ধ পৃথিবীটা মুহূর্তের মাঝে খানখান হয়ে ভেঙে যাচ্ছে চোখের সামনে। আমি কিছু বলতে পারছি না, নড়তে পারছি না। কোন এক অভিশপ্ত যাদু আমার সমস্ত শরীরটা পাথরে রূপান্তরিত করে দিয়েছে।
রুশমি বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে আর চিৎকার করে বলছে ‘তুমি কি আমাকে শুভ্রা ভেবেছ? সাশা ভেবেছ? কোন সাহসে তুমি আমার এত কাছে এলে? হ্যাঁ?
উঠে পড়লাম বসা থেকে। কোন দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে এলাম দরজা খুলে। আমার বুকে মোচড় দিচ্ছে। দুঃসহ যন্ত্রণায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে শরীরের সমস্ত হাড়। এই অপমান কোনদিন ভুলতে পারব কিনা জানি না। হে আল্লাহ! আমাকে এই অপমান ভুলে যেতে সাহায্য কর!
রুশমি
শিহাব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে এই একটু আগে। আমি স্তব্ধীভূত হয়ে বসে আছি বিছানার ওপর। কাঁটার মতো কী যেন একটা খচখচ করছে গলার কাছে। শিহাব আমার পাশে কী করছিল? গতকাল রাতে সাশার সাথে ওর মেলামেশার কথা আমি তো ভুলিনি। এটাও ভুলিনি যে বাসর রাতেই সে স্পষ্টরূপে জানিয়ে দিয়েছিল শুভ্রার প্রতি ওর ভালোবাসার কথা। এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তির পর ছেলেটা আমার কাছে কী চায়? চরিত্রগত সমস্যা আছে নাকি? ওর শুভ্রা আছে, সাশা আছে, এরপর আবার উপরি হিসেবে আমাকেও চাই? ছিঃ ভাবতেই ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠছে।
বেঁচে থাকতে গিয়ে আমরা মানুষেরা নিজের সাথে নিজে কত রকমের অভিনয় যে করে থাকি হর হামেশা! কেউ কেউ হয়তো আঁতকে উঠছ আমার কথা শুনে। নিজের সাথে অভিনয়? সেও আবার সম্ভব নাকি? সম্ভব। ভীষণভাবে সম্ভব! কতটা সম্ভব তা আজ এই দু হাজার আঠারো সালের দোরগোড়ায় এসে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এখন অক্টোবর। মাঝ রাত্তির। আমি শুয়ে আছি আম্মুজানের পাশে। আমার চোখে ঘুম নেই। ঘুমের বদলে আছে দু হাজার পনের সাল। সেদিনের সেই তুষার আচ্ছন্ন শীতের সকালটা ঘরের অন্ধকার দেয়ালের ওপর চলচ্চিত্রের মতো ভেসে উঠেছে। ওই তো শ্বশুরালয়ের শোবার ঘরের কুইন সাইজ বেডের ওপর হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছি আমি। মাথার চুল আলুথালু, গায়ে খুব সম্ভবত সাদা রংয়ের একটা স্লিপিং স্যুট। অন্যমনস্কভাবে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কামড়াচ্ছি। নিজের সাথে অভিনয় করে পেরে উঠছি না আর কোন ভাবেই। নানা যুক্তি দিয়ে ভিতরকার মনটাকে শিহাবের প্রতিকূলে নেয়ার চেষ্টা করছি। তা তো পারছিই না উল্টো আমার মনটা ওর জন্য কেমন কেমন করছে! অস্থিরতায় তোলপাড় হচ্ছে। কেনো ওকে মারতে গেলাম? কেনো ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করলাম না? কাজটা মোটেও ঠিক হয়নি। হাজার হোক ও তো আমার স্বামী। বয়সেও কিছু বড় হবে। এতদিন ধরে আমার সাথে কোনও অন্যায় আচরণ করেনি মেয়েদেরকে সে সম্মান করতে জানে। আজকে হয়তো কোন বিশেষ কারণে একটু পাশে এসে বসেছিল। কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি ফট করে চড় বসিয়ে দিলাম। কী আশ্চর্য! এই আমিই কিনা গতকাল হীনমন্যতায় ভুগছিলাম এই ভেবে যে, এত দিন হয়ে গেলো আমার বিয়ে করা বর আমাকে একটিবার ছুঁতে পর্যন্ত চায়নি। আর আজ যখন ভোরবেলা চোখ খুলে ওকে এত কাছে পেলাম তখন কিনা… ইশ! আমি আর ভাবতে পারছি না কিছু। এই মুহূর্তে পাপবোধ ছিঁড়ে খাচ্ছে আমাকে। বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের ভেতর পায়চারি করা শুরু করেছি। ও কোথায় গেছে জানি না। আমার নিশ্চয়ই একবার স্যরি বলা উচিত। আমার এই গোঁয়ার্তুমি আর উদ্ধত আচরণ নিশ্চয়ই আমার প্রিয় আল্লাহও পছন্দ করছেন না। এখন আমার কান্না পাচ্ছে। সব রাগ গিয়ে পড়ছে সাশার ওপর। কেনো মেয়েটা আমার বরের গালে চুমু খেতে গেলো? সারা রাত এই তিক্ত অনুভূতি আমাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেয়নি। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে সামনে পেলে নির্ঘাত কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিতাম। কী সাংঘাতিক নিষ্ঠুর চিন্তা! আইরনি হচ্ছে সেদিনকার সেই নিষ্ঠুর আমি জানতাম না যে বিপদ কালে একদিন এই সাশার কাছেই আমাকে হাত পাততে হবে। কী কান্ড দেখো না, যে সাশাকে আমি প্রাণ ভরে ঘেন্না করছি, হিংসা করছি, সেই সাশাই কিনা একদিন হবে আমার বিপদের একমাত্র বন্ধু! আল্লাহর দুনিয়া সত্যি, বড়ই বিচিত্র।
আমি অস্থির পায়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। আমার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে শিহাবের কাছে ক্ষমা চাইতে না পারলে আমার প্রাণ পাখিটা ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাবে। আল্লাহর কী রহমত… ঠিক সেই সময় আমি ওকে দেখতে পেলাম নিচে। ব্যাকইয়ার্ডে একটা পেট মোটা পাঞ্চিং ব্যাগ পরিত্যক্ত অবস্থায় স্ট্যান্ডের সাথে লটকে থাকতে দেখেছি এতদিন। আজকে সেই পাঞ্চিং ব্যাগের সামনেই শিহাবকে আবিষ্কার করলাম। হাতে গ্লভস পরে কালো বস্তার মতো ব্যাগটাকে সজোরে ঘুষিয়ে যাচ্ছে সে। এই শীতের মধ্যে তার গায়ে একটা ছাই রংয়ের পাতলা গেঞ্জি। আমি দোতলা থেকে ওর কুঞ্চিত কপাল দেখতে পাচ্ছি। ঘামে ভেজা চুল দেখতে পাচ্ছি। হাতের বাইসেপসের ফুলে ওঠা রগ দেখতে পাচ্ছি। সময় নষ্ট না করে চট করে নিচে নেমে এলাম। ফ্রন্ট ডোর দিয়ে বেরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে ঘুরে আসলাম। তাড়াহুড়ায় গায়ে কোন গরম কাপড় চড়াতে ভুলে গেছি।
শিহাবের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি। কেনো জানি না আমার বুক কাঁপছে এপিলেপ্সির রোগীর মতো। ওর ক্রোধান্বিত অগ্নিমূর্তি দেখে কেমন ভয়ও হচ্ছে। ধুপধাপ শব্দে ঘুষি পড়ছে মোটা কোল বালিশের মতো পাঞ্চিং ব্যাগের ওপর। প্রবলভাবে দুলছে ব্যাগটা ঝড়ের কবলে পড়া অসহায় গাছের ন্যায়। শিহাবের দৃষ্টি সেদিকেই নিবদ্ধ। তার গ্লভস পরা হাত মুষ্টিবদ্ধ। চোয়াল পাথরের মতো শক্ত। বাদামী চোখের তারায় তেজের স্ফুলিঙ্গ জ্বলছে ধিকধিক করে। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে পেট মোটা ব্যাগটায় একটার পর একটা ঘুষি মেরে যাচ্ছে। ওই আঘাত যেন আমারই হৃৎপিণ্ডে এসে পড়ছে। আমি শিউরে উঠছি মনে মনে। হাত পা এর মাঝেই অবশপ্রায় হয়ে এসেছে ঠান্ডায়। বাতাস খুব শীতল। তাপের ছিটেফোঁটা নেই।
—‘শিহাব!’ ডাকলাম, অনেক কষ্টে।
ও ঘুষানো বন্ধ করে ক্রুর চোখে ঘুরে তাকালো আমার দিকে। হাঁপাচ্ছে ফোঁসফোঁস শব্দে। ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কপাল বেয়ে। মুখ যন্ত্রণাক্লিষ্ট। ওই যন্ত্রণা চিহ্ন দেখে আমার বুক মোচড় দিচ্ছে। বুঝতে পারছি আমার ওপর চড়াও হওয়া রাগটাই পাঞ্চিং ব্যাগের ওপর ঝাড়া হচ্ছে। সেদিন আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম, যে রেগে গেলে বা কষ্ট পেলে এই মানুষটা নিজেকেই শাস্তি দেয়, অন্যকে নয়। অথচ আমাকে দ্যাখো, আমার তো নিজেকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয় না কখনো। সেই সাহসই নেই। স্বার্থপর আমি… ভীষণ স্বার্থপর!
শিহাব
—‘একটু কথা বলতে পারি?’
রুশমি প্রশ্নটা খুব সম্ভবত আমাকেই করেছে। আমি শুনতে পেয়েছি স্পষ্টভাবে। কিন্তু কোন উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করছি না। একটু আগে আমি মনে মনে শপথ নিয়েছি যে এই মেয়েটির সাথে জীবনে আর কোনদিন কোনও কথা বলব না। এমনকি এর চোখে চোখেও চাইব না। ওর সাথে সমস্ত লেনদেন আজকেই চুকেবুকে গেছে। পাপা মম ফিরে আসার আগেই ওকে আমি ডিভোর্স দেব। আর আজকের পর থেকে এই মেয়ের সাথে একই ঘরে কোন মতেই থাকব না। আমার পুরনো জীবনটা ফেরত চাই। জীবনের আর ইঞ্চি পরিমাণ জায়গাও এই মেয়ের সাথে শেয়ার করতে রাজি নই আমি।
হাতের গ্লভস খুলে প্যাটিও চেয়ারের ওপর রাখলাম। পানির বোতল থেকে পানি পান করলাম। তারপর কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে হাঁটা শুরু করলাম উইলো ফরেস্টের দিকে। ওদিকে যাবার এখন কোন প্ল্যান ছিল না। এই মেয়েটার কাছ থেকে পালানোর নিমিত্তেই যেতে হচ্ছে।
রুশমি আমার পেছন পেছন হেঁটে আসছে। আমি একবার ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ‘কী চাই?’
—‘একটু কথা ছিল।’
—‘সময় নেই।’
আমি আবারও হাঁটতে শুরু করেছি। শীত কালের জঙ্গল ফাঁকা। পা চালানো যাচ্ছে দ্রুত। আকাশের কোনও রং নেই এখন। তাকালে মনে হয় যেন মাথার ওপর ধূ ধূ শূন্যতা। ঠান্ডা বাতাস মিনিটের মধ্যেই আমার শরীরের সমস্ত ঘাম শুষে নিয়েছে। শীত করছে। ঠান্ডায় নিশ্বাস নিতে বেগ পেতে হচ্ছে। সূঁচের মতো হিম গায়ের চামড়া বিদ্ধ করে যাচ্ছে ক্রমাগত। জ্যাকেট ছাড়া বেরিয়ে পড়া একবারেই উচিত হয়নি।
ক্রিকের ধারে যখন পৌঁছেছি, তখন চারপাশে তুলোর উড়াউড়ি শুরু হয়ে গেছে। পেঁজা তুলো বরফ কুচি উড়ে এসে লাগছে চুলে আর মুখে। ক্রমেই চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে অগণিত শ্বেতবর্ণ তুষার কণিকায়। যতদূর চোখ যায় শুধু চোখ ধাঁধানো সাদা। আকাশ আর পৃথিবী এক হয়ে মিশে যাচ্ছে। গোটা আকাশটা চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গুড়িগুড়ি মেঘের মতো মুখ থুবড়ে পড়ছে যেন ভূপৃষ্ঠের ওপর। এই শীতল তাণ্ডব অবশ্য বুকের গভীরে পৌঁছয়নি। বুক এখনো অপমানে জ্বলছে। থাপ্পড়টা আমি ভুলতে পারছি না কিছুতেই। রুশমি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ওর দিকে তাকাচ্ছি না। আমার চোখ ক্রিকের পানির ওপর নিবদ্ধ। পানি বয়ে যাচ্ছে, পাথরে ধাক্কা খাচ্ছে, জলপ্রপাতের মতো ঝিরঝির একটা শব্দ হচ্ছে। বরফকণা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে পানির ওপর। আমি পানির স্রোতের ধ্বনি, আর স্নোফলের মিহি শব্দ, এই দুইয়ের মধ্যে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছি। পাশে দাঁড়ানো মানবীটির উপস্থিতি এড়িয়ে যেতে চাইছি মনে প্রাণে। কিন্তু এড়িয়ে যাওয়াও কি আর অত সহজ? হঠাৎ মনে হলো, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তুষারে ঝাপসা হওয়া সূর্যের আলোর ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দেখি রুশমি এর মাঝেই শীতে কুঁকড়ে গেছে। মুখে রক্তের কোন ছায়া নেই। চামড়া সাদাটে। নাকের ডগা লাল। শুষ্ক ঠোঁট দুটো কাঁপছে থরথর করে। শ্বেতবর্ণ তুষারে ঢেকে গেছে ওর খোলা চুল। ঘন লম্বা আঁখি পল্লবেও ভিড় করেছে বরফ কণা।
—‘রুশমি! বাড়ি ফিরে যাও!’
—‘কী বললে?’ ওর গলা অসম্ভব কাঁপছে।
— বলেছি বাড়ি ফিরে যাও।’
—‘এর আগে কী বললে?’
—‘মানে কী?’
—‘তুমি কি আমাকে রুশমি ডাকলে?’
এই প্রশ্নের মাথামুণ্ডু আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু বুঝতে পারছি মেয়েটা আর কিছুক্ষণ এই পাতলা কাপড় পরে তুষারমণ্ডিত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাত মরে যাবে। আমি ওর হাত টেনে ধরে বললাম, ‘বাসায় চলো!’
ভাব দেখে মনে হচ্ছে রুশমি নড়তে পারছে না। পা দুটো পাথরের মতো গেঁড়ে বসেছে মাটিতে। আমি এক হাত দিয়ে ওর কাঁধ আঁকড়ে ধরে হাঁটছি। এভাবে চললে নয় মিনিটের পথ নব্বই মিনিটেও শেষ হবে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার ওকে কোলে তুলে নিতে হলো। এর আগের বার মিস ডিজাস্টারকে সাহায্য করার পরিণাম ভুলিনি। কিন্তু মানবিকতা বলে তো একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া হাজার হলেও ডিজাস্টার এখন আমার স্ত্রী। বাড়ির বেজমেন্টে যখন এসে পৌঁছেছি তখন আমার নিজেরই ঠান্ডায় হাত পা জমে গেছে। শীতের হিংস্র দাঁত শুষে নিয়েছে শরীরের সব রক্ত। মনে হচ্ছে ব্লাড সার্কুলেশন বন্ধ হয়ে গেছে। জানি না রুশমির কী অবস্থা। ওকে ফায়ারপ্লেসের সামনে, কার্পেটের ওপর বসিয়ে দিলাম। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালালাম। একটু পর তাকিয়ে দেখি রুশমি কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়েছে। দৌড়ে গিয়ে স্টোরেজ থেকে একটা কমফর্টার নিয়ে এলাম। ওকে শোয়া থেকে টেনে তুলে গায়ে জড়িয়ে দিলাম কম্বলটা। উঠতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি ও আমার হাত চেপে ধরেছে। চোখ পড়ল ওর নাকের নিচের এক ফোঁটা টকটকে লাল রক্তের ওপর। অতিরিক্ত শুষ্কতা থেকে এরকম হয়। আমি ওর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। আঙুল দিয়ে রক্তটুকু মুছে নিলাম। ওর মাথার চুলে আর গলায় এখনো পেঁজা তুলো বরফ পড়ে আছে। কিছু বরফ গলে পানি হয়েছে। রক্তশূন্য মুখের সাদাটে চামড়ায় ভেসে আছে নীল রগ। শুধু কাজল কালো দুটি চোখ এত রুক্ষতার মাঝেও জিয়ন্ত এবং সতেজ।
ফায়ারপ্লেসের এক হাত দূরে বসেছি আমরা। জানালার বাইরের পৃথিবী এখনো তুষারে আবছা। রুশমি কম্বলের একটা পাশ আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে, স্তিমিত গলায় বলছে, ‘তোমার শীত করছে না? এটা নাও।’
আজ সকালে কাছে গিয়েছি বলে ও আমাকে চড় মেরেছিল। আর এই মুহূর্তে নিজেই পাশে বসতে বলছে। এই মেয়েটাকে আমি বুঝি না। আর বুঝি না বলেই বোধহয় একে আমি ইদানিং একটু একটু ভয় পাই। আজ ভোর বেলার পর থেকে ভয়টা আরো বেড়ে গেছে। কারণ আজ আমি নিজের ভেতরে এক অন্যরকম স্পন্দন আবিষ্কার করেছি। যে স্পন্দন পৃথিবীর অন্য কোনো নারীর সংস্পর্শে এলে আমার হয় না। আমার সচেতন মনটা বারে বারে ভোর বেলার অপমান স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, বলছে আত্মসম্মানবোধ থাকলে এর থেকে দূরে সরে যাও। অথচ অবচেতন মন বলছে একটু সময় পাশে থাকলে ক্ষতি কী? আমি কম্বলের এক পাশ গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি। বসেছি ওর পাশে। ফায়ারপ্লেসের দিকে মুখ করে।
—‘তুমি কী বলছিলে? প্রশ্ন করলাম হঠাৎ।
—‘কোথায়? কখন?’
—‘ইন দ্যা উডস। একটু আগে।’
—‘কী বলেছিলাম?’
—‘তোমাকে আমি রুশমি নামে ডেকেছি কিনা জানতে চাইছিলে?’
রুশমি চুপ করে আছে। উত্তর না পেয়ে ওর দিকে তাকালাম একবার। কী কাণ্ড! এত সুন্দর চোখের একটা মেয়ের ওপর কি রাগ করে থাকা যায়? যে মানুষের মন আছে, সে মানুষ কখনো এমন অলৌকিক চোখের মেয়ের ওপর খুব বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারবে না। আমার ভেতরটা ক্রমেই নরম হয়ে আসছে। সকাল বেলার সেই কম্পমান স্পন্দন ফিরে এসেছে বুকে। আমি বাতাসে পবিত্র একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি। ওর দিকে চেয়ে আছি নির্বাক। মুখের ত্বক শুকনো, নিষ্প্রাণ। তবুও ঠোঁটের নিচের ওই কালো তিলটা পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ হাতে নিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। থাপ্পড়ের কথা আমি বেমালুম ভুলে গেছি। এই তুষারধবল ঠান্ডা দিনে আগুনের সামনে রুশানিয়ার পাশে ওর শরীরের উত্তাপের ছোঁয়ায় চুপচাপ বসে থাকতে আমার ভালো লাগছে। ভালোলাগার তরঙ্গ এত উত্তাল হয়ে আছে যে এখন বিবেকের শাসন আর কোনভাবেই মানা যাচ্ছে না।
রুশমি
আজ মনে হচ্ছে আমার বলার আছে অনেক কিছু! কিন্তু কে যেন জিভ টেনে ধরে রেখেছে শক্ত করে। একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছি না। শিহাব আমার কাঁধের ওপর একটা হাত রেখেছে। ওর মুখটা ঝুঁকে আছে আমার মুখের দিকে। আর আমি চিবুক উঁচু করে, কপালে চোখ তুলে চেয়ে আছি ওর দিকে। ওর উষ্ণ মোলায়েম নিশ্বাস এসে পড়ছে আমার মুখে। দুই জোড়া চোখ চুম্বকের মতো আটকে আছে পরষ্পরের সাথে। কেউ কিছু বলছি না অথচ দুজনের চোখই যেন অনেক কথা বলছে। এটা কোনও সাধারণ ঘটনা নয়। এরকম হবার পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। কারণটা কী তা আমার স্পষ্ট জানা নেই। শুধু মনের খুব গভীরে আজ আমি জানি যে, এই ছেলে যদি অন্য মেয়েদের ছেড়ে দেয় তবে এর জন্য আমি পৃথিবী ছাড়তে পারি! কী লেইম সব চিন্তা ভাবনা তাই না? এসব কি কখনো কাউকে বলা যায়? যায় না, তবে এটুকু তো বলাই যায় যে আজ ভোর বেলার স্পর্ধিত আচরণের জন্য আমি লজ্জিত। হ্যাঁ এটা বলতেই তো এসেছিলাম। কিন্তু বললাম সম্পূর্ণ অন্য কথা।
—‘তুমি তো আমাকে রুশমি ডাকো না কখনো। আজকে হঠাৎ রুশমি ডাকলে কেনো?’
কথাটা শুনে শিহাব দ্বিধাজড়িত চোখে কিছু সময় আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর হেসে উঠল নিঃশব্দে। আমি ওর হাস্যোজ্জ্বল গালে একটা হাত রাখলাম। ধীরস্বরে বললাম,
—‘তোমার হাসিটা আমার অসহ্য লাগে!’
—‘আচ্ছা?’
ছোট্ট শব্দটা উচ্চারণ করে শিহাব একটু থামে। অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে কী যেন খোঁজে আমার মুখে, তারপর স্পষ্ট গলায় বলে,
—‘আমার আর কী কী অসহ্য লাগে তোমার, রুশানিয়া?’
ওর হাসি তখন থেমে গেছে। মুখজোড়া ফুটে উঠেছে অদম্য কৌতূহল। আমি এখনো ওর উত্তপ্ত নিশ্বাস টের পাচ্ছি। টের পাচ্ছি হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন। কাঠ পোড়ার শব্দ আর হৃদয়ের ধুকপুক ছাড়া আশেপাশে আর কোন শব্দ নেই এখন। আমি ওর মুখের ওপর থেকে এখনো হাত সরিয়ে নেইনি। আমার মনটা এক অনাবিল অথচ অনির্বচনীয় সুখে ভরে গেছে। রক্ত কণিকায় ঘুঙুর বাজছে রুমঝুম শব্দে। আমি ওর চোয়ালের ওপর হাতের আঙুল নামিয়ে এনেছি, অনেকটা ফিসফিস করে বলছি,
—‘তোমার জ’ লাইন।’
শিহাবের মুখে হাসি ফিরে এসেছে।
—‘আর?’
এখন ওর ঠোঁটের ওপর আমার হাত, ‘অসহ্য!’
ও হাসছে। আর আমার বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা হচ্ছে। আমি ওর কণ্ঠমণি ছুঁয়ে দিয়েছি এবার। আমার মেরুদণ্ড শিরশির করছে। আমি স্পষ্টভাবে টের পাচ্ছি যে, বিগত বেশ কিছুদিন যাবত অবচেতন মনে এই কাজটা আমি করতে চেয়েছি বহু বহুবার! বুকের ভেতর ট্রেন ছুটছে ঝিকঝিক। আর আমি মন্ত্র পাঠ করার মতো বলে চলেছি।
‘অসহ্য! অসহ্য! অসহ্য!’
শিহাব আমার আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। ওর ঠোঁট এখন আমার ঠোঁটের খুব কাছে। বাদামি চোখজোড়ায় ভর করেছে নিশ্ছিদ্র মাদকতা। সেই মদির দৃষ্টি স্পষ্টভাবে চেয়ে আছে আমার ঠোঁটের নিচের কালো তিলটার দিকে। আমি জানি এখন কী হবে। আমার শরীর অসাড়। ও আমার এত কাছে আছে, তবুও যেন এটা কোন কাছে থাকাই নয়। এর চেয়ে আরো বেশি রকমের কাছে নিশ্চয়ই থাকা যায়। এই মুহূর্তে আমি ওর বেশি রকম কাছেই থাকতে চাইছি। এত কাছে যেন আমাদের দুজনের আত্মার মাঝে ইঞ্চি পরিমাণ তফাত্ত না থাকে।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে শিহাবের পেছনে একটা ছায়া দেখতে পেয়ে ইলেকট্রিক শক খাবার মতো চমকে উঠলাম। থমকে গেলাম!
আমার সাথে সবসময় এমন হয়। যা আমি খুব করে চাই, তা আমার হতে হতেও হয় না। কী করা যাবে? কিছু মানুষ জন্মায়ই এমন প্রতিকূল ভাগ্য নিয়ে। আমার আম্মুজান বলে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। বেশ তো… এটাও তবে ভালোর জন্যই হলো। এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই আমার একটা ডিস্ট্র্যাকশন প্রয়োজন ছিল। এই ছেলেটার কাছ থেকে দূরে থাকাটা নিঃসন্দেহে আমার জন্য উত্তম।
আমি দূরে সরে এসেছি। শিহাবের প্রতিক্রিয়া কী জানি না। আমার চোখ আটকে গেছে ওর ঠিক এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছিপছিপে দেহের মেয়েটার ওপর। একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। এই মুহূর্তে স্বচ্ছভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছি না। তবে একটা ব্যাপার খুব ভালোমতো বুঝতে পারছি যে অদম্য এক তারছেঁড়া বিভীষণ ক্রোধ আগুনের শিখার মতো দপ করে জ্বলে উঠেছে আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে। ফায়ারপ্লেসের আগুনে কাঠ পুড়ছে যেমন খটখট শব্দে, ঠিক তেমন ভাবে আমার ভেতরটাও পুড়ছে ক্রোধের আগুনে। তবে সশব্দে নয়, নিঃশব্দে।
আজ এত দিন পর বুঝতে পারি ওই মাথানষ্ট, স্থূলবুদ্ধি, তারছেঁড়া ক্রোধটাই ছিল আমার সর্বনাশের মূল। হায়, তখন যদি বুঝতাম যে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে মাথা ঠান্ডা রাখা কতটা জরুরি। আমার ইগো, আমার রাগ, আমার মিথ্যে মেয়েলি অহংকার… এই সমস্ত ঋণাত্মক অনুভূতি আমার জীবন থেকে খুব সুন্দর কিছু সময় কেড়ে নিয়েছে। হয়তো ওটা আমার পরীক্ষা ছিল, কিংবা ছিল নিয়তি। যদি পরীক্ষা হয়ে থাকে তবে সেই পরীক্ষায় আমি হেরে গেছি। আর যদি নিয়তি হয়ে থাকে তবে এতটুকুই বলব যে নিয়তির সাথে যুদ্ধ করে কে কবে জিতেছে? কিন্তু আজ বড়ই আফসোস হয় এই ভেবে যে, নিজের কাছে নিজের সম্মান রক্ষার্থে বোকার মতো নিজেকেই ঠকিয়ে যাচ্ছিলাম সেই দিনগুলোতে। এরকম সবার হয় কিনা আমি জানি না। তবে আমার হয়েছিল আর হয়েছিল বলেই সেসব দিনের কথা আজ আমি লিখে রাখছি। অবশ্য একদিন কিছু একটা লিখব বলেই কথা দিয়েছিলাম তাকে। তার ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা বলে মাতৃভাষার ওপর আমার দখল অত্যন্ত দুর্বল। তার ধারণা মিথ্যে প্রমাণ করার জন্য বলেছিলাম, লিখলে বাংলায়ই লিখব। শুনে হেসেছিল সে। বলেছিল, ‘বাংলায় লিখবে? ভেবে বলছ তো? লিটারেচার ইজ সামথিং এক্সটা। যে ভাষায় আমরা কথা বলি। সাহিত্যের ভাষাটা ঠিক সেরকম নয়। জানো তো?’
আমার হাতে ম্যাগনোলিয়ার একটা ভাঙা ডাল। বসন্ত বাতাস ভরে আছে নানা রকম ফুলের মিষ্টি গন্ধে। হাতে ধরা ডালটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে অন্যমনস্কভাবে গোলাপি বরণ ফুলের পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে নিচ্ছিলাম আমি। ছিঁড়তে ছিঁড়তেই বললাম, ‘সাহিত্যের ভাষা কেমন তা ঠিক জানি না। তবে লিখলে আমার মনের ভাষা দিয়েই লিখব।’ এটুকু বলে থামলাম। চোখ মেলে চাইলাম ওর দিকে। ক্ষীণ গলায় বললাম, ‘তুমি পড়বে?’
–‘নিশ্চয়ই পড়ব। মনের ভাষার চাইতে সুন্দর আর কোন ভাষা হতেই পারে না!’
ইয়া আল্লাহ! আমার স্মৃতির রেলগাড়ি ভুলবশত ভুল স্টেশনে ঢুকে গেছে। আমি তো সাহিত্যিক নই। হয়তো সাহিত্যের ভাষা জানি না বলেই আমার এই আত্মকথন বড় বেশি সৃষ্টিছাড়া আর গোলমেলে। আমি ছিলাম দু হাজার পনেরোর তুষারাবৃত এক সকালে। হঠাৎ গতিপথ পাল্টে গেলো। ট্রেন এসে থামলো ভুল গন্তব্যে। ওখানে বসন্ত! সেই বসন্তটা কী যে সুন্দর ছিল! সেবার আমি প্রথম বারের মতো জেনেছিলাম যে প্রকৃতির বসন্তের চাইতে মনের বসন্ত আরো বেশি সুন্দর! সময়সুড়ঙ্গ ধরে স্মৃতির ট্রেন আবারও পনেরোর ফেব্রুয়ারিতে গিয়ে পৌঁছুলো। ওখানে শুভ্রা এখন কট্টর চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। উঠে দাঁড়িয়েছে শিহাবও। ওর মুখের ভাবভঙ্গি কী রকম তা জানি না। কারণ আমি কোনদিকে তাকাচ্ছি না। তারছেঁড়া, পাগলপাড়া রাগ আমাকে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বানিয়ে দিয়েছে।
—‘কী হচ্ছিল?’ ক্যাটক্যাট করে প্রশ্ন করল শুভ্রা। ভাবতে অবাক লাগে একটা সময় এই শুভ্ৰাদিকে আমি কত ভালোবাসতাম। অথচ আজ সে আমার চক্ষুশূল বৈ কিছুই নয়।
—‘তুমি কখন আসলে?’ শিহাব এগিয়ে গেছে ওর দিকে।
—‘আজ সকালের ফ্লাইটেই ভার্জিনিয়া পৌঁছালাম। ভাবলাম তোর সাথে দেখা করি। আংকেল আন্টি যেহেতু নেই ‘
শুভ্রা কথাগুলো বলছে শিহাবকে, কিন্তু ক্রুর চোখে চেয়ে আছে আমারই দিকে। রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলছে। কানে বাজছে বাসররাতে বলা শিহাবের কথাগুলো। সেই রাতে ও জানিয়ে দিয়েছিল শুভ্রাকেই তার চাই। আর গতকাল রাতে… ওই সাশা মেয়েটা… ছিঃ ছিঃ ছিঃ আমি কেনো বারবার ভুলে যাই যে, এই ছেলেটা আমার এতটা অ্যাটেনশন পাওয়ার যোগ্য না? আমার উচিত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে একে আমার জীবন থেকে বের করে দেয়া!
এক ছুটে বেরিয়ে এলাম ঘরটা থেকে। শুভ্রা আমার পেছন পেছন আসছে। আমি বেজমেন্টের সিঁড়ি ভেঙে ফার্স্ট ফ্লোরের দরজা খুলছি। ডাইনিংটা অন্ধকার হয়ে আছে। দরজার চৌকাঠে পা রেখেছি মাত্র। এমন সময় শুভ্রা আমার একটা হাত পেছন থেকে চেপে ধরল।
—‘রুশমি ডিয়ার, কোথায় যাচ্ছিস? একটু দাঁড়া।’
আমি হাত ছাড়িয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। মুখের কথা আটকে গেছে। চোখ ভরে গেছে জলে। চোখের জল লুকোনোর জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছি। শুভ্রা বলছে,
—‘এই বাড়িতে পড়ে আছিস কেনো নির্লজ্জের মতো? নিজের বাপের বাড়ি চলে গেলেই তো পারিস।’
শিহাবের গলার আওয়াজ পেলাম সেই মুহূর্তে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসছে সে।
—‘কী হয়েছে? সমস্যা কী?’
শুভ্রা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, রুশমি এখানে কী করে?’
—‘কী করে মানে? আমাদের তো এখনো ডিভোর্স হয়নি।’
আমি শুভ্রার কাছ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে হাঁটা শুরু করেছি। দ্রুত পা চালিয়ে দোতলায় উঠে এলাম। শুনলাম শুভ্রা বলছে, ‘ডিভোর্স হয়নি বলেই এত মাখামাখি করতে হবে?’
শুভ্রার বলা প্রতিটা শব্দ সূঁচের মতো বিধছে গায়ে। পাগল পাগল লাগছে আমার। এখন মনে হচ্ছে বেশ করেছি ওই ফাজিল ছেলেটাকে চড় মেরে। ওর মতো দুশ্চরিত্র পুরুষকে একবার নয়, একশোবার চড় মারা উচত। তবে একশোবার তো আর মারতে পারিনি। মেরেছিলাম মোটে দুবার। দ্বিতীয় চড়ের পরিণাম ছিল ভয়াবহ। আমি তো আসলে ভুলের রানি! এ ছোট্ট জীবনে কত ভুল যে করলাম তার ইয়ত্তা নেই।
বেডরুমে এসে ক্লজেট থেকে স্যুটকেস বের করলাম। আর এক মুহূর্তও এই বাড়িতে থাকব না। শুভ্রাই থাকুক এখানে। আমার শাশুড়ি ফোন করলে সব সত্যি কথা বলে দেব। আর কোন রাখঢাক চলবে না। সবাই পেয়েছে কী আমাকে? আমিও তো একটা মানুষ, নাকি? স্যুটকেসে এলোমেলো ভাবে কাপড়গুলো রাখছি আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। রাগ আমাকে পাগল করে দিয়েছে না ভুল বললাম, আমাকে আসলে পাগল করেছিল ভালোবাসা। মানুষকে এমন পুরোদস্তুর উদ্ভ্রান্ত আর খ্যাপাটে করে তোলার ক্ষমতা বোধহয় শুধুমাত্র ভালোবাসা নামক ঘাতক ব্যাধিটিরই আছে।
শিহাব
‘ডিভোর্স হয়নি বলেই এতো মাখামাখি করতে হবে?’ শুভ্রা বলছিল।
আমি দেখছি রুশমি তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো মেয়েটা। শুভ্রাকে বললাম, ‘ও এখনো আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আমার বৌ-তো আমার বাড়িতেই থাকবে, তাই না?’
শুভ্রা আমার কথা শুনে থমকে গেছে। বড় বড় ডাগর দুটি চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
—‘কী ব্যাপার শিহাব? তোর মন ঘুরে গেছে নাকি?’
—‘মন ঘুরাঘুরির কিছু নাই এখানে।’
কথাগুলো পাশকাটানো গলায় বলে ডাইনিং টেবিলের কাছে এগিয়ে এলাম। জগ থেকে পানি ঢেলে নিলাম গ্লাসে। চুমুক দিতে গিয়ে আড়চোখে দেখলাম একবার শুভ্রাকে। ও এলোমেলো নিশ্বাস ফেলছে। কালো ওভারকোট তুষার ভেজা। গ্লাস নামিয়ে রেখে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম, ‘তুমি তো মনে হয় শীতে জমে গেছো। দাঁড়িয়ে কেনো? বসো। কফি চলবে?’ শুভ্রা দু পা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল। নরম গলায় বলল, ‘শিহাব লিসেন। অনেক হয়েছে। তুই রুশমিকে বল এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। তুই কি ভেবেছিস আমি জনাথনকে শিক্ষা দেবার জন্য তোকে বিয়ে করতে চাইছি? এটা পুরোই তোর ভুল ধারণা।’ এটুকু বলে ও আমার গালের ওপর একটা হাত রাখল, ‘তোকে আমি অনেক পছন্দ করি শিহাব। আমি জানি একমাত্র তোর সাথেই আমি সত্যিকারের সুখী হতে পারব লাইফে। প্লিজ লক্ষীটি! তুই রুশমিকে ছেড়ে দে!’
ঘটনাটা কয়েক মাস আগে ঘটলে হয়তো এই মুহূর্তে আমি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবতাম। কিন্তু আমার সুখ বোধহয় প্রকৃতির খুব একটা পছন্দনীয় বিষয় নয়। যা আমি চাই, তা কখনোই পাওয়ার মতো করে পাই না। আর যা চাই না, তা অযথাই ঘাড়ে এসে চেপে বসে। শুভ্রা বলছে রুশমিকে ছেড়ে দিতে। আমিও চেতনে-অবচেতনে এই কথাটা বহুবার বহুভাবে ভেবেছি। কিন্তু জানি না কেনো, এই মুহূর্তে ব্যাপারটা ভাবতে গিয়েই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে রুশমিকে ছেড়ে দিলে আমি বাঁচব কী করে? এই দিশাহারা মনটা নিয়ে আর পেরে উঠছি না। আমি চেয়ে আছি শুভ্রার দিকে কিন্তু ভাবছি রুশমিকে। আচ্ছা… ও কেনো বলল আমাকে ওর অসহ্য লাগে? ওই অসহ্য শব্দটায় তো ঘৃণা ছিল না। ছিল অন্যকিছু। ওই অন্যকিছুটা কী, তা আমাকে জানতেই হবে।
শুভ্রার সামনে থেকে চট করে সরে এলাম। পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল শুভ্রা, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলাম। ঘরে এসে দেখি রুশমি ব্যাগ গোছাচ্ছে।
—‘কী ব্যাপার?’
ও প্রশ্নের কোন উত্তর দিচ্ছে না। এক রাশ কালো চুলে ঢেকে আছে মুখের একটা পাশ।
—‘কথা বলছ না কেনো? এসব কী হচ্ছে?’
—‘তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। বিরক্ত করো না প্লিজ।’ ওর গলা একটু কাঁপছে। ও কি কাঁদছিল এতক্ষণ?
—‘আমি আবার কী করলাম?’
ঠিক সেই সময় ঘরের দরজাটা কেউ একজন সশব্দে খুলল। শুভ্রার ববকাট ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা দৃশ্যমান হয়ে উঠল দরজার ফাঁক বরাবর। কয়েক সেকেন্ড আমার আর রুশমির দিকে অনুসন্ধানী চোখে চেয়ে থেকে অনুমতি না নিয়েই ঘরে ঢুকে পড়ল সে। খুব নির্বিকার গলায় রুশমিকে বলল, ‘তুই যাচ্ছিস?
—‘মানে কী?’ রুশমির গলায় তেজের স্ফূরণ।
শুভ্রা ধীরস্থির এবং শান্ত, ‘তোর বাবার বাড়ি যাচ্ছিস না?’
আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। মেয়েদের সত্যিই বুঝতে পারি না আমি একটা ফোঁটা! শুভ্রা তো এমন ছিল না। এই স্বার্থান্বেষী, খিটখিটে, হ্যাংলা শুভ্রার মাঝে আমার সেই পুরোনো দিনের ছেলেবেলার স্নিগ্ধ শুভ্রাদিটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! ওকে দেখে এখন আর আমার ভেতর কোন মুগ্ধতা কাজ করে না। বরং কেমন যেন অস্বস্তি হয়। গলায় মাছের কাঁটা বিঁধে গেলে যে রকম লাগে, অস্বস্তিটা ঠিক সেরকম।
—‘আমি কোথায় যাব আর কোথায় যাব না, সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে?’
শুভ্রা বিকৃত মুখ করে বলল-’তুই জাহান্নামে যা। শুধু আমার বয়ফ্রেন্ডের বাসা থেকে বের হ। এই মুহূর্তে।’
রুশমির চেহারাটা হঠাৎ পাল্টে গেলো। পাগলাটে রাগের ছোপ মুছে গিয়ে ওর মুখে আচমকা ভর করল এক নিশ্ছিদ্র কঠোরতা। দৃঢ় গলায় ওকে বলতে শুনলাম, ‘আমি কোথাও যাব না। এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। আমার শতভাগ অধিকার আছে এই বাড়ির ওপর। তুমি কে আমাকে এসব কথা বলার? তোমার এতো সাহস হয় কী করে?’
শুভ্রা নিভে গেছে। হতবাক চোখে তাকিয়ে আছে রুশমির দিকে। আমিও স্তব্ধ এবং নির্বাক। গুচ্ছের বিস্ময় আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে। কয়েকটা সেকেন্ড নিঃশব্দে গড়ানোর পর শুভ্রা প্রায় চিৎকার করে উঠে আমাকে বলল, ‘তুই চুপ করে আছিস যে? এই মেয়েটাকে কিছু বলবি না?’
আমি আসলেই কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবছি এই পর্যায়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করাটাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু
ভাবনা মোতাবেক কাজ করা গেলো না। জানালার গ্লাস ভেদ করা সাদা রংয়ের সূর্যের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম রুশমির কাজলকালো ডান চোখটার কোল ঘেঁষে একটা রূপালি রংয়ের জলের ধারা নেমে আসছে নিঃশব্দে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রাণপণে কান্না চাপানোর চেষ্টা করছে ও।
শুভ্রাকে বললাম, ‘এখন তুমি যাও। পরে কথা হবে তোমার সাথে।’
—‘তাড়িয়ে দিচ্ছিস আমাকে?’
—‘তাড়িয়ে দিচ্ছি না। অনুরোধ করছি। প্লিজ শুভ্ৰাদি! এখন তুমি ফিরে যাও। বাড়িতে জাহিদ আছে। ও যদি মমকে খবরটা জানিয়ে দেয় তো খুব বিপদ হয়ে যাবে।’
—‘তুই তাহলে সন্ধ্যায় আমার সাথে দেখা কর। উই আর গোয়িং আউট টুনাইট।’
রুশমিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে বললাম, ‘জানাবো তোমাকে পরে।’
—‘পরে না, এখনই বল। প্রমিজ কর আজকে সন্ধ্যায় দেখা করবি আমার সাথে।’
—‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
শুভ্রা চলে যাবার পর নরম অথচ গম্ভীর গলায় রুশমি বলল, ‘তুমি কি চাও আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?’
প্রশ্নটায় কী ছিল জানি না, শোনামাত্র আমার বুক একদম খালি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এত কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন এর আগে কখনো হইনি। রুশমি আমার কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো একরাশ খোলা চুল ওর চন্দন রংয়ের মুখের চারপাশে চালচিত্রের মতো স্থির হয়ে আছে। চোখের ভেতর তখনও জল। এই মেয়েটাকে কেউ আমার হয়ে বলে দেবে কি? যে ওর চোখের জল আমার সহ্য হয় না? আমার মতো ইন্ট্রোভার্ট মানুষদের যে নিজ মুখে এসব বলতে বড়ই কষ্ট! বিশেষ করে সেই মানুষটাকে, যে মানুষ কিনা উঠতে বসতে আমাকে অপমান করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বোধ করে না। বুকটা ক্রমেই ভারী হয়ে আসছে। আমি কী চাই তা আমি নিজেই জানি না। শুধু জানি ওই মুখের দিকে নির্বাক চেয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে। এই একটুখানি ভালোলাগাই এখন আমার জীবনে অবশিষ্ট আছে। কিন্তু এই ভালোলাগা তো চিরস্থায়ী নয়। ও তো চলে যাবে আজ নয়তো কাল। ওকে যে যেতেই হবে। যে চলে যাবার জন্যই উদ্যত সর্বদা তাকে জোর করে বেঁধে রাখার সাধ্য কার আছে?
—‘আমার চাওয়া না চাওয়ায় কি কিছু এসে যায়?’ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম।
—‘তুমি সব সময় এতো প্যাঁচ করে কথা বলো কেনো?’
—‘আমি আবার কী করলাম?’ বেকুব বনে যাওয়া গলায় বললাম। এবার আমি সত্যি জানি না আমার দোষটা কোথায়।
—‘আসলে তোমাকে আমার প্রশ্নটা করাই ভুল হয়েছে। তোমার কিছু বলতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি। তোমার মতো ফালতু লোকের সাথে এক ঘরে থাকব না।’
—‘তুমি সবসময় আমার সাথে এরকম অফেন্সিভ আচরণ করো কেনো?’
—‘কারণ তুমি একটা ভীষণ বাজে মানুষ! গার্লফ্রেন্ড, বৌ, সব কিছু চাই তোমার। তাই না?’
—‘আমি কি তা বলেছি কখনো?’
—‘বলতে হবে কেনো? আমি কিছু বুঝি না মনে করেছ? তোমার কি ধারণা দুনিয়ার সব মেয়েকেই তুমি চাওয়া মাত্র পেয়ে যাবে? এমনটা ভাবলে তুমি ভুল করবে শিহাব রেজা! আমাকে পাওয়া অত সহজ না।’
মেজাজটা এবার কেমন লাগে? যেন আমি ওকে পাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি। ~’তোমাকে কেউ পেতে চাইছে না।’
—‘আমাকে তুমি চাও না? তাহলে একটু আগে কী হচ্ছিল?’
আমি না বোঝার ভান করে ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘কী হচ্ছিল?’
—‘তুমি আমাকে কিস করতে যাচ্ছিলে।’
মুখে কপট হাসি ফুটিয়ে বললাম, ‘সিরিয়াসলি? তুমি তাই ভেবেছিলে? তোমাকে? মানে আমি তোমাকে… ও… নো! ইউ অ্যান্ড আই… ইটস নেভার গননা হ্যাপেন। রুশমিকে একটু বিভ্রান্ত দেখালো। অপমানের হালকা ছায়া পড়ল ওর অপাপবিদ্ধ সুন্দর মুখশ্রীতে।
অনেকটা দুর্বল গলায় বলল, ‘ইয়া, ইটস নেভার গননা হ্যাপেন। কারণ তোমাকে আমার অসহ্য লাগে। আমি তো তোমাকে বলেছি।’
—‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি।’
বলতে বলতে হঠাৎ কথাটা মাথায় এলো। সরু চোখে বিভ্রান্ত রুশমির দিকে চেয়ে থেকে বললাম, ‘তুমি কি শুভ্রাকে নিয়ে জেলাস?’ এই প্রশ্নে রুশমি আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়ল। এই পিচ্চি মেয়ের এতো রাগ তা কে জানত! দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
—‘ফাজলামো কর? শুভ্রাকে আমি হিংসা করব কীসের জন্য?’
—‘তা জানো তুমি। আমি কী করে বলব?’
রুশমি কোমরে হাত রেখে একদম ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘শুভ্রাকে আমি করুণা করি। আই পিটি হার! কারণ ও তোমার মতো একটা অসভ্য ছেলের পাল্লায় পড়েছে।’
—‘আমি অসভ্য?’
—‘তুমি পৃথিবীর সেরা অসভ্যদের একজন।’
কথাটা আমার বুকের ওপর শেলের মতো গিয়ে বিঁধলো। কেনো অযথাই আমাকে কষ্ট দাও রুশানিয়া? এতটা নিষ্ঠুরভাবে কথাগুলো না বললেই কি নয়? আমাকে জীবনে কেউ কোনদিন এতো সব তিক্ত কথা বলেনি জানো? আমি যেখানেই গিয়েছি, যাদের সাথে মিশেছি, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই আমাকে ভালোবেসেছে, সম্মান দিয়েছে। একমাত্র তুমি, হ্যাঁ তুমিই একমাত্র মানুষ যার মনের মধ্যে কিনা আমার জন্য রয়েছে আকাশ সমান বিদ্বেষ এবং বিতৃষ্ণা!
দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বললাম, ‘আমার বাবা-মা ফিরে আসা পর্যন্ত কি অপেক্ষা করা যায়?’
রুশমি এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে বলল, ‘তা যায়। কিন্তু আমি তোমার সাথে এক ঘরে আর থাকব না। আলাদা ঘর চাই আমার।’
রুশমি একটু আগে স্যুটকেস নিয়ে নিচে নেমে গেছে। ওই স্যুটকেসের বাইরেও ওর অসংখ্য জিনিস এই ঘরের আনাচে কানাচে রয়ে গেছে। সমস্ত জিনিস আঁটানোর জন্য আরো দুটা এক্সটা স্যুটকেস কমপক্ষে লেগে যাবে। শুভ্রা আজ যাবার আগে একটা অদ্ভুত কথা বলে গেছে। নিচে নেমে দেখি ও প্যাটিওর চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে স্মোক করছে। তুষারপাত থেমে গেছে তখন। আমি গাড়ির ছাদের বরফ পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে নিচে নেমেছি। জাহিদ খুব সম্ভবত এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। ওর একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। শুভ্রার উপস্থিতি আমাকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। আমি চাই না জাহিদের সাথে ওর সাক্ষাৎ হোক। জাহিদটার যা পেট পাতলা, মমকে নির্ঘাৎ বলে দেবে।
শুভ্রা সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে আমার মুখের ওপর সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, স্পষ্টগলায় বলল, ‘কীরে শিহাব? কাপড় পাল্টানোর মতো ফট করে মন পাল্টে ফেললি? এতই সোজা?’
প্রশ্নটা আমার বুকের মধ্যে ঢং করে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে গেলো। জীবনে এই প্রথমবারের মতো নিজের দিকে চোখ মেলে চাইতে কুণ্ঠা বোধ হলো আমার। বেশ কিছুদিন যাবৎ ধরে আমি আমার উড়নচন্ডী মনটার কোন হদিশ পাচ্ছি না সঠিকভাবে। ওখানকার আবহাওয়া ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছে। মন চরাচর সর্বক্ষণ অশান্ত, উন্মনা এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, মনটা আমার কোথাও স্থির হয়ে বসছে না। না অফিসের কাজে, না গানে, না সংসারে! আমার হয়েছে কী? আর এইযে শুভ্রা বলল কাপড় পাল্টানোর মতো করে মন পাল্টানো! এই অভিযোগ তো একেবারে অসত্য নয়! কারণ কটা দিন আগেই শুভ্রাকে আমি মনে প্রাণে চাইতাম। বিয়ে করতে চেয়েছি কিনা কখনো তা স্পষ্টভাবে মনে পড়ে না, তবে এটুকু অন্তত চাইতাম যে ও আমাকে মন থেকে ভালোবাসুক। অথচ এখন শুভ্রাকে দেখে আমার সমগ্র নারী জাতির ওপর বিতৃষ্ণা জন্মে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নারী মাত্রই হিংসাপরায়ণ, কুচক্রী এবং পরশ্রীকাতর। এরা শুধু নিজের স্বার্থটাই বোঝে। ব্যতিক্রম আমার মা। আমার মায়ের মতো সহনশীলা, মৃদুভাষী, মমতাময়ী নারী আমি খুব কম দেখেছি এই জীবনে। হঠাৎ মনে হলো, রুশমিকে বিয়ে করে অন্য কিছু না হলেও, মায়ের মন রক্ষা করা হয়েছে অন্তত। এই বা কম কী? শুভ্রা এ বাড়ির বৌ হিসেবে কখনোই মানানসই হতো না। তেল আর জল যেমন মেশে না কখনো, মম আর শুভ্রাও কখনো মিশতো না।
আমি কিছুক্ষণ শুভ্রার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে জায়গাটা থেকে সরে দাঁড়ালাম। ভেতরটা তেতো হয়ে আছে। আত্মবিশ্বাসে টান পড়েছে। শুভ্রাকে ভালোলাগত, এখন আর লাগে না। রুশমিকে ভালোলাগে কিনা জানি না তবে এটুকু জানি ওর উপস্থিতি আমাকে শান্তি দেয়। শুভ্রার মধ্যে এই শান্তিটুকুর অনুপস্থিতি আছে। কিন্তু এইসব টুকরো টুকরো অনুভূতি দিয়ে নিশ্চয়ই ভালোবাসা হয় না। নাকি কাউকে ভালোবাসবার মতো যোগ্যতাই আমার নেই?
আইস স্ক্র্যাপার দিয়ে গাড়ির ছাদের বরফ পরিষ্কার করতে করতে ভাবছিলাম একতরফা ভালোলাগা বিষয়টা নিশ্চয়ই ভালো কিছু নয়। ছোটবেলায় শুভ্রার প্রতি ফিলিংসটা একতরফা ছিল, এখন রুশমির প্রতি শান্তিময় অনুভূতিটাও একতরফা। আমার ভাগ্যটা এমন কেনো? জীবনে যেসব মেয়েরা আমাকে পছন্দ করেছে, ভালোলাগার কথা জানিয়েছে, তাদের কাউকেই আমার মনে ধরেনি। তারা অযোগ্য ছিল এমন কিন্তু নয়। কিন্তু কেনো যেন গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়েদের আমার ভালোলাগে না। হঠাৎ করেই একটা জটিল সমীকরণ যেন সমাধান হয়ে গেলো চোখের সামনে। শুভ্রার গায়েপড়া ভাবটার জন্যই এখন ওকে আমার আর ভালো লাগছে না। আগের সেই ড্যামকেয়ার, ব্যক্তিত্বময়ী, ধরা ছোঁয়ার বাইরের শুভ্রাকেই আমার পছন্দ ছিল। আর রুশমিকে নিয়ে আমি এত ভাবছি কারণ ও আমাকে দুই পয়সার দাম দিতে চাইছে না। ওর এই একগুঁয়েমি এবং অবাধ্যতা আমার পুরুষোচিত আত্মসম্মানে আঘাত হানছে। ওকে কাছে পেতে চাওয়াটা আসলে কোন দিক দিয়েই ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা নয়। বরং এক ধরণের জেদ। এই জেদকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। শুভ্রাকে কাছে পাবার জেদকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিলাম, দ্বিতীয়বার একই ভুল করব না কিছুতেই। রুশমি যত ইচ্ছে আমাকে অপমান করুক, অবহেলা করুক, ওসব আর গায়েই মাখব না!
রুশমি
শুভ্রা দেখি যায়নি এখনো। প্যাটিওতে ঠ্যাং তুলে বসে সিগারেট ফুঁকছে। আমি কাজে যাবার জন্য তৈরী হয়ে নিচে নেমেছি। জাহিদ সকালে একটা ডিম পোচ খায় টোস্ট দিয়ে। আর এক গ্লাস চকলেট মিল্ক। ওর জন্য নাশতা রেডি করে টেবিলে রেখেছি। বেরোবার সময় দেখলাম হাত মুখ ধুয়ে নিচে নেমেছে ও। শিহাব সকালে সিরিয়াল ছাড়া কিছু খায় না। তবুও ওর জন্য ডিমের ওমলেট করে রেখে এসেছি। এগুলো কিছুই আমি মন থেকে করিনি। শাশুড়ির আদেশ পালন করেছি শুধু। এই দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা নিজের কাজ নিজে করেই অভ্যস্ত। আমার আম্মুজান আমাদের তিনবোনকে ছোটবেলা থেকে আত্মনির্ভরশীল হতে শিখিয়েছে। কিন্তু আমার শাশুড়ির ছেলে দুটো হয়েছে একদম আলালের ঘরের দুলাল। এদের ভাব দেখে মনে হয় যেন রান্নাঘরের কাজ করা পুরুষমানুষের জন্য হারাম। কী আজগুবি কাহিনী!
আমার মন অশান্তিতে ডুবে আছে। বাবাজানকে বললাম এতো খারাপ আবহাওয়ায় স্টোর বন্ধ করে দেয়া উচিত। বাবাজান নাছোড়বান্দা। দুপুরেই নাকি তাপমাত্রা সাত ডিগ্রিতে উঠে যাবে। চনমনে রোদ চড়বে আকাশে। অতএব স্টোর বন্ধ করার প্রশ্নই আসে না।
শুভ্রা আমাকে দেখে বিজ্ঞ গলায় মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ভুল করছিস রে রুশমি। বিশাল বড় ভুল করছিস।’
একবার ভাবলাম এসব ফালতু কথা কানে না নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাব। কিন্তু কী মনে করে যেন দাঁড়িয়ে পড়লাম। চড়া গলায় বললাম, ‘কীসের ভুল?’
শুভ্রা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। গলাটা একটু খাদে নামিয়ে বলল, ‘শিহাব কোনো সোজা বান্দা না। তুই যদি ভেবে থাকিস মন্ত্র পড়ে বিয়ে করেই ওকে পেয়ে যাবি, তাহলে খুব বড় ভুল করছিস। আমি জানি ওর মধ্যে একটা এক্স ফ্যাক্টর আছে। ওই এক্স ফ্যাক্টরটা সবাইকে টানে। তোকেও টানছে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তিথি বলেছিল ছেলেটার মধ্যে কী যেন আছে। হুদাই ভালোলাগে।’
—‘শুভ্রাদি! তোমার এসব ফালতু প্যাঁচাল বন্ধ করো।’
—‘ফালতু প্যাঁচাল না। ট্র থিং! রুশমি ডিয়ার! আমি জানি তুইও শিহাবকে একটু একটু ভালোবাসার চেষ্টা করছিস। তোরও হয়তো ওকে হুদাই ভালোলেগে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জেনে রাখিস এই হুদা ভালোলাগা আর ভালোবাসায় বিরাট বড় তফাৎ আছে। শিহাব যদি কারো সাথে থাকতে পারে তাহলে সেটা একমাত্র আমি। ভালোবাসলে ও আমাকেই বাসবে।
এখানে উল্লেখ্য যে ‘হুদা’ শব্দটার অর্থ তখনও আমি জানি না। বাংলাদেশে দশ বছর থেকে এসেছি। আমার বাবা-মাও সব সময় বাংলায় কথা বলে বাড়িতে। কিন্তু এই হুদা শব্দটাতো কোনদিন তাদেরকে উচ্চারণ করতে শুনিনি। যাই হোক, আমি সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে বললাম,
—‘তুমি এখান থেকে যাও!
—‘তুই কবে যাবি?’ স্বার্থপরের গলায় প্রশ্ন করে শুভ্রা।
—‘আমি যাব না শুভ্ৰাদি!’
—‘কী আশ্চর্য! কেনো যাবি না?’
—‘যাব না কারণ আমি আমার বাবাজানের কথামতো এখানে এসেছি, বাবাজানের কথামতোই এখান থেকে যাব। আমাকে তাড়াতে হলে তোমাকে আমার বাবাজানের সাথে কথা বলতে হবে।
আর এক মুহূর্তও দেরি না করে গাড়ি বারান্দায় নেমে এলাম। একটু দূরে শিহাব ওর গাড়ির বরফ পরিষ্কার করছে। আমার গাড়িটা গ্যারেজের ভেতরে রাখা ছিল। তাই বরফ পরিষ্কারের ঝামেলা নেই এখন। মাথায় শুভ্রার বলা কথাগুলো মাছির মতো ভনভন করছে। মনটা এতো বেশি খারাপ হয়ে আছে যে মনে হচ্ছে এর চাইতে মৃত্যুও ভালো ছিল। একটু আগে ভাবছিলাম রাগের মাথায় হুট্ করে আলাদা ঘরে চলে যাওয়াটা সঠিক সিন্ধান্ত হয়নি। কী হবে যদি রাতে ঘুমোতে যাবার আগে একবার পিয়ানোর বাজনা শুনতে ইচ্ছে করে? কী হবে যদি পিয়ানো বাজানো অবস্থায় ওর ধ্যানমগ্ন অবিচল গম্ভীর মুখখানা একটাবার অন্তত দেখতে ইচ্ছে করে? ওই একটুখানিই তো সুখ ছিল আমার জীবনে। ওটাও নিজের দোষে নিজেই খোয়ালাম বেকুবির বশে। কিন্তু এখন শুভ্রার কথাগুলো শোনার পর মনে হচ্ছে, যা করেছি উচিত কাজ করেছি। আল্লাহ ইজ দ্যা বেস্ট প্ল্যানার। তিনি নিশ্চয়ই আমার জন্য উত্তম কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন। খুব ভালো করেছি ঘর ছেড়ে দিয়ে।
কফিশপে আজ সকাল সকালই বাবাজানের সাথে দেখা হলো। বাবাজানের পরনে সাদা ঢোলা পাঞ্জাবি। গায়ে সুন্দর আঁতরের গন্ধ। আজকে খুব সম্ভবত দুপুর বেলায় মসজিদে নামাজ পড়াবে সে। আমাকে দেখে বলল …
—‘জামাই কেমন আছে?’
আমি কাউন্টার টুলে বসে ম্যাকাডেমিয়া নাট কুকি চিবোচ্ছিলাম। একটু আগে ব্রেকফাস্টের রাশটা থেমে গেছে। এখন ভিড় নেই দোকানে। সকালে নাশতা করে বাড়ি থেকে বের হইনি। পেটে চনমন করছে খিদে। সুযোগ পেয়েই পেট পুজো করতে বসে গেছি। বাবাজানের প্রশ্নে দায়সারাভাবে উত্তর দিলাম।
—‘ভালোই।’
বাবাজান কাউন্টারের উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে গাড়ির চাবি। ভ্রু কুঁচকে চাবির রিংটা চরকির মতো ঘুরাচ্ছে সে। অপর হাত গালের লম্বা লম্বা দাড়িতে। বাবাজানের দাড়ি সব এর মাঝেই পেকে সাদা হয়ে গেছে। আম্মুজান জোর করে সেই সাদা দাড়িতে কালো রং লাগিয়ে দিয়েছে। চুলেও।
—‘কিছু বলতে চাও?’ আমি তার মুখের দিকে চেয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলাম।
—‘তুমি কেমন আছ?’
কঠিন প্রশ্ন! মিথ্যে বলার অভ্যাস নেই। তাছাড়া এই মুহূর্তে মিথ্যে বলার চেষ্টায় উদ্যমের অভাব বোধ করছি। তাই চুপ করে রইলাম।
—‘শিহাব মানুষ হিসেবে কেমন?
আমি এবারেও চুপ করে রইলাম।
—‘উত্তর দিচ্ছ না যে?’
—‘উত্তরটা এখনো জানি না বাবাজান! যেদিন জানতে পারব, সেদিন নিশ্চয়ই তোমাকে জানাবো।’
—‘আমি সাধারণত মানুষ চিনতে ভুল করি না। আমার মনে হয়েছে ছেলেটা ভালো। কিন্তু গান বাজনার দিকে মনোযোগ বেশি। এই ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে না।’
আমি চোখ নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছি। আচ্ছা, এমন কেনো হচ্ছে কেউ কি আমাকে বলবে? ওর প্রসঙ্গ কেউ তুললে, ওর নাম উচ্চারণ করলে, আমার বুকের ভেতরটা অযথাই কেনো অমন শিরশির করে ওঠে? এই কয়েক ঘণ্টা আগেও ওই মানুষটার ওপর একটা তিতকুটে রাগে গোটা অন্তর ছেয়ে ছিল। অথচ এই মুহূর্তে বাবাজান যখন ওর নাম একটাবারের জন্য উচ্চারণ করল, তখন মনে হলো যেন ওই নামটা শোনার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম চাতক পাখির মতো। মনে হলো ওর কথা এমনি ভাবে কেউ বলতে থাকুক অনন্তকাল ধরে। ছোটবেলায় ও কেমন ছিল, কোথায় ছিল, কী তার প্রিয় রং, কী তার প্রিয় খাবার? কিংবা প্রিয় গান? এত সুন্দর গান গাওয়া ও কার কাছ থেকে শিখল? সন্ধ্যেবেলায় ক্রিকের ধারে একলা বসে ও ভাবে কী অত? আমার ভীষণ ওর মনের ভেতরটা পড়ে দেখতে ইচ্ছে করে একবার।
—‘তোমার মন খারাপ কেনো মা?’ বাবাজানের প্রশ্ন।
আমি হাসার চেষ্টা করলাম, ‘মন ঠিক আছে।’
এটুকু বলার পর আমার হঠাৎ মনে পড়ল, ‘বাবাজান, গতকাল কফিশপে একটা ছেলে এসেছিল। সে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চায়। ওরা নাকি একটা প্রজেক্ট রান করছে এই বিষয়ের ওপর। মনে হয় ডকুমেন্টারি টাইপ কিছু বানাচ্ছে। আমি তোমার কথা বলেছি। তুমি কি ছেলেটাকে একটু সাহায্য করতে পারবে?’
—‘আমার কেনো সাহায্য করতে হবে? তোমার কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেই?’
একটু আমতা আমতা করে বললাম, ‘আছে, তবে তোমার চাইতে কম।’
—‘মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে তুমি যা জানো তাইই জানাও তোমার বন্ধুদের। প্রয়োজনে নিজের জানার পরিধি বাড়াও। পড়াশোনা করো।’
—‘কিন্তু আমি তো তোমার মতো করে জানি না।’
—‘চেষ্টা করেই দেখো না! কেনো? নিজের দেশ নিয়ে কথা বলতে তোমার ভালো লাগে না? মানুষ যাকে ভালোবাসে তার বিষয়ে বেশি বেশি কথা বলতে চায়, তার কথা বেশি করে শুনতে চায়। আমার তো সারাক্ষণ দেশের গল্প করতে ইচ্ছে করে সবার সাথে।’
কথাটা শোনামাত্র হৃৎপিণ্ডটা কে যেন সজোরে খামচে ধরল। বাবাজান বলল, মানুষ যাকে ভালোবাসে তার কথা নাকি বেশি বেশি শুনতে চায়, বলতে চায়। আমি তো ওকে সীমাহীন ঘৃণা করি, তবুও কেনো সর্বক্ষণ ওর কথা শোনার জন্য, ওর একটুখানি খবর পাওয়ার জন্য মনটা সর্বদা অমন আঁকুপাঁকু করতে থাকে?
শিহাব
আমাদের রমেশ কাকু আজ সকালে হার্ট অ্যাটাক করেছেন। খবরটা দিয়েছে পাপা। বলেছে এখুনি যেন আমি একবার হাসপাতালে গিয়ে উনাকে দেখে আসি। রমেশ কাকু আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। দুমাস হলো বাড়ি বদলে আর্লিংটন চলে গেছেন। পাপার আদেশ রক্ষার্থে কাইজার হাসপাতালে কাকুকে এক নজর দেখতে যেতেই হলো। অবস্থা এখন অনেকটাই স্টেবল। তবে ডাক্তার বলেছেন দুশ্চিন্তা না কাটালে আশংকা থেকেই যাবে। রমেশ কাকুর জীবনের গল্পটা ভারী করুণ। আশির দশকে কলকাতা ছেড়েছিলেন তিনি। বৈধ কাগজ পত্রের অভাবে দেশে ফিরতে পারলেন না টানা বিশ বছর। কাগজ যখন হলো, তখন তাঁর বৃদ্ধ বাবা-মা পরলোক গমন করেছেন। দেশে ফিরে যাবার আর কোন তাগিদ রইল না। এখানেই বিয়ে করলেন এক কম বয়সী বাঙালি মেয়েকে। একটি পুত্র সন্তানও হলো। এই দেশে খেটে যেতে পারলে টাকার অভাব নেই। কাকু কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা রোজগার করেছেন। কিন্তু এই কাঁড়ি কাঁড়ি সহায় সম্পত্তি তার সংসার টিকাতে পারল না। কম বয়সী বাঙালি মেয়ে স্বামী সন্তান ফেলে রেখে একদিন পালিয়ে গেলো এক পাইলটের হাত ধরে। এরপর কাকু দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। এবার হলো অন্য রকম বিপদ। দ্বিতীয় স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়ল একেবারে ফোর্থ স্টেজে গিয়ে। খুব বেশিদিন বাঁচলেন না। কাকুর বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে রইল একমাত্র পুত্র সন্তান। কিন্তু সেই সন্তানের কাছ থেকেই শেষ বয়সে জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা পেলেন। তাঁর পুত্র এক আইরিশ যুবকের সাথে গভীর প্রণয়ে আবদ্ধ। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকায় সমকামী বিয়ে বৈধতা পেলেই দ্রুত বিয়ের কাজটা সেরে নেবে। এই খবর কাকুর নিঃসঙ্গ, একাকী জীবনের ওপর যেন বজ্রাঘাতের মতো পতিত হলো। এতো বড় ধাক্কা সইতে পারলেন না তিনি। এই ঘটনায় আমাদের সবার খুব মন খারাপ। কাকুর ছেলে প্রণবকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। খুব ভালো মনের মানুষ। কিন্তু একটু স্বার্থপর হয়তো! আমি যখন এই ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলতে গেছি, তখন ও আমাকে বলেছে সত্যিকারের ভালোবাসলে নাকি মানুষকে একটু স্বার্থপর হতে হয়।
দু-হাজার পনেরো সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধতা পেলো। ওবামার মতো মহান ব্যক্তি কী করে এমন ন্যাক্কারজনক প্রথার প্রবর্তন করল এই দুঃখে যখন আমাদের মতো অগণিত রক্ষণশীল পরিবারের কর্তা ব্যক্তিদের রাতের নিদ্রা হারাম হবার যোগাড়, ঠিক সেই সময়ে প্ৰণব ঘোষণা করল আইরিশ প্রেমিককে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। রমেশ কাকু তখন আর বেঁচে নেই। প্রথম হার্ট অ্যাটাকের ঠিক পনের দিন পরেই দ্বিতীয়বার কলান্স করল তাঁর হৃদযন্ত্র। এবার আর যুদ্ধে জেতা গেলো না। প্রণব আমাকে দাওয়াত দিয়েছিল ওর বিয়েতে। তখন অবশ্য আমার বিয়ে খেয়ে বেড়ানোর মতো মানসিক অবস্থা নেই।
সেদিন ছিল রবিবার। হাসপাতাল থেকে ফিরে দেখি আমার বেশকিছু বন্ধু উপস্থিত হয়েছে বাড়িতে। মনে পড়ল আজ গান প্র্যাকটিসের দিন। এই অযুহাতে শুভ্রার সাথে আউটিংটা এড়ানো গেলো। সামনের সপ্তাহে কনসার্ট আছে। বাংলাদেশ থেকে এক নামকরা গানের দল আসছে। সেই দলের সাথে আমরাও পারফর্ম করব। প্র্যাকটিস চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর আমরা ক্রিস্টাল সিটির কাবাব প্যালেসে গিয়ে কাবাব খেলাম। ওদের বিখ্যাত মাসালা চা খেলাম। এই রেস্টুরেন্ট উইকেন্ডে সারারাত খোলা থাকে। আমাদের আড্ডা চলল রাত বারোটা পর্যন্ত। বাড়ি ফিরে আসার পর আমার মন অনেকটা শান্ত, স্থির এবং নিশ্চিন্ত। দোতলার সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ভাবছিলাম যাক আজকে অন্তত আমি যা চেয়েছি, তা পেরেছি। সকালের পর থেকে রুশমির কথা আর একটাবারের জন্যেও ভাবিনি। মিস্ ডিজাস্টার আমার ঘর নিজ থেকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে বড় বাঁচা বাঁচিয়েছে। ওর বদান্যতায় আমি আবার আমার সেই পুরোনো আমাকে ফিরে পাবো। ফিরে পাবো নিজের শোবার ঘর, নিজের বিছানা, নিজের একান্ত ছোট্ট ছিমছাম পৃথিবী। কিন্তু গোসল টোসল সেরে বিছানায় গিয়ে শুতেই একটা কাণ্ড হলো। হঠাৎ মনে হলো বিছানার চাদরে আর বালিশে যেন মিষ্টি একটা ঘ্রাণ লেগে আছে। কেউ বলে দিল না কিন্তু আমি কী করে যেন বুঝে গেলাম ওটা রুশমির চুলের ঘ্রাণ। চট করে উঠে পড়লাম। চাদর আর বালিশের ওয়ার পাল্টে নিলাম। কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। ঘ্রাণটা কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছে না। আবারও চাদর পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ক্লজেট থেকে পরিষ্কার চাদর আনতে গিয়ে দেখলাম হ্যাঙ্গারে রুশমির একটা গোলাপি রংয়ের স্লিপিং স্যুট ঝুলছে। স্লিপিং স্যুটে অজান্তেই একটা হাত রাখলাম। লক্ষ্য করলাম ইস্ত্রির টেবিলের ওপর অফিসে যাবার শার্ট প্যান্ট গুছিয়ে রাখা আছে। এসব আমি করিনি, নিশ্চয়ই রুশমিই করেছে। ভাবন ঘরের যে কপাটটা আমি সচেতনভাবে বন্ধ করে রাখতে চাইছিলাম সারাটা দিন ধরে, সেই বদ্ধ কপাট রাত্রির নির্জনতায় বিনা অনুমতিতে নির্দ্বিধায় খুলে পড়ল। আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম যে এই মুহূর্তে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে রুশমি কোথায় আছে, কেমন আছে? নিচতলায় অনেকগুলো ঘর খালি পড়ে আছে। ঠিক কোন ঘরটা ও বেছে নিয়েছে? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? একবার ভাবলাম নিচে গিয়ে খোঁজ করি। কিন্তু যথারীতি ইগো মহাশয় বাধ সাধলেন।
দ্বিতীয়বার চাদর পাল্টানোর পরেও কোন লাভ হলো না। রুশমির চুলের মিষ্টি সৌরভ আমার মাথায় গেঁথে গেছে। আমি চুপচাপ পিয়ানোর সামনে বসে আছি এখন। বাইরে সাদা বরফের ওপর জোছনার আলো ঠিকরে পড়ছে। জানালা খুলে দিয়েছি। বাতাসে হিম উড়ছে। উড়ছে নীল রংয়ের মসৃণ জোছনা। কষ্টের মতো কী যেন একটা আমার নিঃশ্বাসে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। আমি চাই শীতের রুক্ষ ছোবল ভিতরকার সমগ্র স্থূল মানবিক অনুভূতিকে বিবশ করে দিক। সবচেয়ে ভালো হতো যদি এই শৈত্যস্পর্শ আমার গোটা মনটাকেই জমিয়ে বরফ করে দিত। বরফের নিশ্চয়ই কোন ইমোশন থাকে না!
আমার ঘুম আসছে না। পিয়ানো বাজাতেও ইচ্ছে করছে না। মনের আবছা কোণে আমি টের পাচ্ছি যে, এই মুহূর্তে আমার ওকে এক নজর দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। সকাল বেলার পর থেকে আর দেখিনি তো! আমি চোখ বন্ধ করলাম। চকিতে উন্মোচন হলো হৃদয়াক্ষী। স্পষ্ট দেখতে পেলাম সেই আশ্চর্য সুন্দর জন্মকাজল ছোঁয়া ঐশ্বরিক দুটি চোখ। আমার দিকেই চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। আমি বিড়বিড় করে বললাম,
‘কে তোমাকে বলেছিল এতো সুন্দর হতে রুশানিয়া?’
রুশমি
সেই রাতটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। ধবধবে সফেদ বরফের ওপর জোছনা থইথই করছে। সাদা আর নীলে ভরে গেছে মধ্যরাতের আঁধার পৃথিবী। মেঘহীন হিমবর্ষী আকাশে নিঃশব্দে জেগে আছে সোনার থালার মতো অপূর্ব মোহনীয় চাঁদ। আমি লিভিং রুমের সোফায় বসে আছি ঘরের বাতি নিভিয়ে। আমার পাশেই জানালা। জানালায় জোছনা ধোয়া তুষারাবৃত অপার্থিব রাত। একটু আগে শিহাব বাড়ি ফিরেছে। আমি অন্ধকারে বসে থেকে ওর আগমন দেখেছি। ফিরে এসেছে খুব ভালো কথা কিন্তু একটা বার আমার খোঁজ করেনি। জানি করবেও না। এই মুহূর্তে আমাকে দোতলার শোবার ঘরের বিছানাটা টানছে। বিরহ কী জিনিস তা আগে জানতাম না। আজ মনে হচ্ছে বিরহের বিষ আমার রক্তে রক্তে ঢুকে গেছে। এই বিরহ কি দোতলার প্রশস্ত জানালা ওয়ালা সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘরটার জন্য, নাকি সেই ঘরের অসহ্য হাসিওয়ালা বাসিন্দাটির জন্য সে বিষয়ে মনের মাঝে দ্বিধা আছে। আমি সোফার ওপর শুয়ে পড়েছি এখন। জানালার কাচ ভেদ করে এক টুকরো জোছনা এসে পড়েছে আমার হাঁটুর ওপর। আজ রাতে ঘুম আসবে না। আর মহারাজ নিশ্চয়ই দোতলার ঘরে আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছে। ওর হলো ইচ্ছে ঘুম! শোয়া মাত্র ঘুমের সমুদ্রে তলিয়ে যায়! কী হয়েছে জানি না। আমার শুধুই দোতলার শোবার ঘরটায় ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে। বিছানায় বসে বই হাতে নিয়ে চুপটি করে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে পিয়ানো বাদকের দিকে। কিন্তু কে যেন পায়ে অদৃশ্য একটা শেকল বেঁধে দিয়েছে। এখন এই শেকল ছিঁড়ে ফেললেই আমি নিজের কাছে হেরে যাব। হেরে গিয়ে লাভটা কী হবে? নিজের কাছেই নিজের সম্মানহানি হবে। ও তো আমাকে কখনো ভালোবাসবে না! ও ভালোবাসতে পারেই না। পারলে শুভ্রাকেই বাসতো।
এমন নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন পুরুষ আমি জন্মে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি ভাই! যেন ঘর ছেড়ে দেয়াটা আমার বিশাল বড় অন্যায় হয়ে গেছে। যেন আমার সাথে তার জন্ম জন্মান্তরের শত্রুতা। আমি কেমন আছি, কোথায় আছি তা ভদ্রতা করেও একটিবার জানতে চায় না। খুব ভোরবেলা অফিস চলে যায়। অফিস থেকে ফিরে এসে শুরু হয় রোজকার নিয়মমাফিক শরীর চর্চা। তারপর একগাদা ছেলেপেলে এসে ভিড় জমায় বাড়িতে। বেজমেন্টে গানের প্র্যাকটিস চলে। সেদিন আমি লিভিং রুমে বসে আছি। হঠাৎ দেখি হাতে গিটার নিয়ে একটা বাঙালি ছেলে ঘরে ঢুকল। পাশে শিহাব। আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। ছেলেটা আমাকে দেখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো শিহাবের দিকে। শিহাব সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল, ‘ওর নাম রুশমি। আমার বৌ।’
এই প্রথম ও কারো সাথে স্ত্রী হিসেবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। ভালোলাগায় আমার কানের কাছে ঝিঁঝি ধরে গেছে তখন। ‘আমার বৌ!’ শব্দ দুটো কত ছোট্ট, অথচ কত স্নিগ্ধ!
ওদের প্র্যাকটিস শেষ হতে হতে রাত দশটা এগারোটা বেজে যায়। ডিনারটা আমরা গানের দল আসার আগে, সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই সেরে ফেলি। আমি জাহিদকে বলেছি আমাদের এই আলাদা থাকার ব্যাপারটা যেন শ্বশুর- শাশুড়ির কাছ থেকে আপাতত চেপে যায়। জানি না ও কতদিন পেটে কথা রাখতে পারবে। ও যে শুধু ছেলেমানুষ তাই-ই নয়, একটু বোকাও আছে। কোথায় কী বলতে হয় জানে না। এই যেমন পরশু রাতে ছোট মামা আর উনার গার্লফ্রেন্ড ‘ন’ আন্টি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। ওদের ঝগড়াঝাঁটি মিটে গেছে। আম্মুজান রোজই এটা সেটা রান্না করে পাঠায়। সেদিন পাঠিয়েছিল সবজি খিচুড়ি আর হাঁসের মাংস। ন’ আন্টি আর ছোট মামা পাশাপাশি বসেছে। ছোটমামার পাশে শিহাব। গত কয়েকটা দিন শিহাব আমার সাথে নিজ থেকে কোন কথা বলেনি। আমিও বলিনি। কিন্তু কথা না বললেও ও যে আমাকে লক্ষ্য করে তা আমি জানি। এই যেমন একটু আগেই সে চুরি করে আমাকে দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিয়েছে চোরটা। এরকম সময়ে হঠাৎ জাহিদ আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বসল,
‘তোমরা সেই তখন থেকে ইশারায় কী কথা বলছ?’
আমি চোখ নামিয়ে নিয়েছি নিচে। আড়চোখে দেখলাম শিহাবের মুখটা লজ্জায় একটুখানি হয়ে গেছে। ছোটমামা মিটমিট করে হাসছে। আর জাহিদ উত্তরের আশায় চেয়ে আছে বড় ভাইয়ের মুখের দিকে। এই হচ্ছে আমার ওয়ান অ্যান্ড অনলি ব্রাদার ইন ল’। কমনসেন্স বলতে কিছুই নেই ছেলেটার ঘটে।
এসব টুকরো টুকরো নানাবিধ ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমি আমার নিজের ভেতরে ধীরে ধীরে এক অন্যরকম আমাকে আবিষ্কার করছিলাম। আমি জানতাম আমার বিবাহিত জীবনে শান্তি নেই। একটা মিথ্যে সম্পর্কের বোঝা দিনের পর দিন বয়ে চলেছি। এটাও জানি যে আমার স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত। এতো কিছু জানার পরেও যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকি ততক্ষণ আমার মন এক আশ্চর্য প্রশান্তিতে আবিষ্ট হয়ে থাকে। ওই স্বল্পবাক, গম্ভীর ছেলেটার অবহেলা সইতেও আজকাল আমার খারাপ লাগে না। যখন ও বাড়িতে থাকে না, তখন সারা বাড়িতে ভূতের মতো একলা ঘুরে ঘুরে ওর কথাই ভাবি এতো বেশি ভাবি যে মাঝে মাঝে ভাবতে ভাবতে আমার কান্না পায়। গল্পের বইয়ের পাতায়ও মন বসে না তখন আর। বালিশে মুখ গুঁজে একলা একলা কাঁদি। ও যখন সন্ধেবেলায় অফিস থেকে ফেরে, তখন ওর ক্লান্ত মুখখানা দেখে আমার বুক ঠান্ডা হয়, চোখ জুড়োয়। আমি এখন বুঝি আল্লাহ সুবহানাতায়ালা পবিত্র কোরআনে ‘কুলনেস অফ ইওর আইজ’ বলতে আসলে কী বুঝিয়েছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজ থেকে গিয়ে ওর সাথে কয়টা কথা বলি। কিন্তু যখন ও কোন কারণবশত সামনে এসে দাঁড়ায়, চোখে চোখ রাখে, তখন কোত্থেকে যেন গুচ্ছের সংকোচ এসে মনের কোণে ভিড় জমায়। অযথাই বুক কাঁপে। অস্বস্তিতে জমে যায় ভেতরটা। কোন কথাই আর গুছিয়ে বলা হয়ে ওঠে না।
শিহাব বাড়িতে না থাকলে আমি ওর ঘর গুছাই। গোসলের জন্য ওই ঘরের বাথরুমটাই ব্যবহার করি। কারণ নিচতলার দুটোই হাফ-বাথরুম। গোসল করার উপায় নেই। সেদিন কী বার ছিল মনে নেই তবে আমার ছুটি। অর্থাৎ উইক ডে। সকাল থেকেই মনটা ভীষণ ফুরফুরে। কারণ বসন্ত সমাসন্ন। বাগানে ড্যাফোডিলের কলি এসেছে। অফিসে যাবার আগে শিহাব মোয়িং মেশিন দিয়ে লনের ঘাস কেটে গেছে। কাটা ঘাসের গন্ধে ম্ ম্ করছে চারপাশ। শীতের রুক্ষতা উবে গেছে। দুষ্টু কাঠবিড়ালিরা ছুটোছুটি করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উঠোন। গাছের ডালে উড়ে উড়ে মনের আনন্দে শিস দিয়ে যাচ্ছে লাল পাখনার কার্ডিনাল। আমি সকাল থেকে ব্যাক ইয়ার্ডে বসে এঞ্জেলা কার্টারের ‘দ্যা ব্লাডি চেম্বার’ পড়েছি। বেলা বারোটার দিকে গাড়ি নিয়ে বেরোলাম। হোম ডিপো গিয়ে ক্যামেলিয়া, ডালিয়া আর ভার্জিনিয়া ব্লুবেলস এর বাল্ব কিনলাম। আমার মন ভীষণ ভালো। বসন্ত এসে গেছে। মন ভালো না হয়ে যাবে কোথায়?
হোম ডিপো থেকে ফিরে গরম জল দিয়ে গোসল করলাম। গোসল সেরে টাওয়েল পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়েছি মাত্র। চেয়ারের ওপর শিহাবের একটা সাদা রংয়ের পাঞ্জাবি পড়ে আছে। আমি পাঞ্জাবিটা হাতে তুলে নিয়েছি। ও প্রায়ই ডিওরের পারফিউম মাখে। এই পারফিউম আমার পছন্দের। আমি এখন পারফিউমের ঘ্রাণ পাচ্ছি। আমার মন সেই সৌরভে মূর্ছিত হয়ে যাচ্ছে। আমি পাঞ্জাবিটা বুকে চেপে ধরে রেখেছি। স্নিগ্ধতার ঝাপটা এসে লাগছে আমার রক্ত কণিকায়। হঠাৎ ঘরের দরজাটা কেউ একজন সশব্দে খুলে ফেলল। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল চকিতে। না চাইতেই মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো এক আর্তচিৎকার। এই ভর দুপুরবেলায় আমার ঘরে কোন ডাকাত পড়ল? শিহাব তো এ সময় অফিসে থাকে! জাহিদ কলেজে। আমি এতো ভয় পেয়ে গেছি যে আমার হাত পা এপিলেপ্সির রোগীর মতো ঠকঠক করে কাঁপছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাবার যোগাড়। ভয়ার্ত চোখ মেলে চেয়ে দেখি মূর্তিমানই বটে! তার গায়ে অফ হোয়াইট ইন করা ফরমাল শার্ট। কালো প্যান্ট। কিন্তু এই অসময়ে বাড়ি ফেরার কারণ কী? লজ্জায় আমার মাথা নুইয়ে গেছে। হৃৎপিণ্ড কাঁপতে কাঁপতে বিকল হবার যোগাড়। কী বলব, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। হায় খোদা, এ কেমন বিপদে ফেললে তুমি আমাকে? শিহাব স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। খুব সম্ভবত সে নিজেও অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। আমাকে নিশ্চয়ই এ সময় নিজের ঘরে আশা করেনি। ছিঃ কী লজ্জা! কী লজ্জা! লজ্জায় তোমার মরে যাওয়া উচিত রুশমি! তুমি এখনো নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে আছ? মনে হলো এই ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তোয়ালেটা বুকের ওপর শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে রেখে আমি দ্রুত পা বাড়ালাম। কিন্তু ও আমার পথ আটকে দিল। ইচ্ছে করে করেনি। আমার যাবার জায়গা করে দিতে গিয়েই এই বিপত্তি ঘটল। আমি বিব্রত ভাবে বাম পাশে সরে এলাম। আনফরচুনেটলি শিহাবও ঠিক সেই সময়ই বাম পাশে সরল। এভাবেই কয়েকবার আমরা না চাইতেও মুখোমুখি পড়ে গেলাম। একটা সময় আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তখনই শিহাবের স্কেটিং বুটের চাকার সাথে আমার পায়ের আঙুল লেগে গেলো ঘটাং করে। মুহূর্তের মাঝে তীব্র টনটনে ব্যথায় প্রায় নীল হয়ে গেলো আঙুল। কঁকিয়ে উঠলাম আমি।