রুশমি
এতো জোর দিয়ে কথাটা আমি কেনো বললাম? উত্তর জানা নেই। শুভ্রা আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টিবাণ ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে আমার ভেতর, বাহির সমস্তটা। সহস্র তীক্ষ্ণমুখী আলপিন যেন ক্রমাগত হুল ফুটিয়ে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ডের জমিনে। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। হরেক রকম প্রশ্নের ভারে মাথাটা এলোমেলো হয়ে আছে। শুভ্রা আমাকে এভাবে অপমান করছে কেনো? কেনো বলছে শিহাবকে আমি ফাঁদে ফেলতে চাইছি? কেনো ঝুম্পা আপু বলল বিয়ে করে খুশিতে আত্মহারা হয়েছি? কেনো দুনিয়ার সব মানুষ এই অহংকারী ছেলেটার সামনে আমাকে বারেবারে অপমান করার জন্য মুখিয়ে আছে? কী দোষ করেছি আমি?
—‘এতই যদি হেইট করিস তাহলে এতক্ষণ এসব সিনেমা করলি কেনো শুনি?’ শুভ্রার চাঁছাছোলা প্ৰশ্ন।
আমি আর কোন উত্তর দিতে পারলাম না। একটা হৃদয় মোচড়ানো কান্না এবার আমার কণ্ঠরোধ করে দিল। চোখের সামনের দৃশ্যটা ভাঙা কাচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যেতে লাগল। শিহাব কথা বলল এতক্ষণে, ‘শুভ্রাদি, লিসেন, এদিকে তাকাও। তুমি আমার সাথে কথা বলো!’
শুভ্রা স্প্রিং এর মতো ঘটাং করে ঘুরিয়ে নিল ওর ঘাড়।
‘শিহাব শোন, এক্ষুনি এই মেয়েকে ওদের বাসায় রেখে আয়। আমি আর কিছুতেই এসব সহ্য করব না। আজকে তোর আমার পাশে থাকার কথা ছিল। জনাথনকে বলেছিলাম আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে পার্টি অ্যাটেন্ড করব। কিন্তু দেখা গেলো আমার বয়ফ্রেন্ড আমারই সামনে অন্য মেয়ের সাথে নেচে বেড়াচ্ছে। এই অপমানের পর আমার কি বেঁচে থাকা উচিত?’ অনেকগুলো কথা এক নিশ্বাসে বলে নিয়ে থামলো শুভ্রা।
তখন চোখের জলে আমার গাল ভেসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই অপমানের চেয়ে মরে যাওয়া ভালো ছিল। ঝাপসা চোখে দেখতে পেলাম শিহাব কয়েক পা এগিয়ে এসে শুভ্রার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। একটু ঝুঁকে ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলছে, ‘এতো অধৈর্য হলে হবে না। তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে।’
—‘আমি ধৈর্য ধরতে পারব না। তুই আজকেই এই মেয়েকে আমাদের লাইফ থেকে তাড়াবি।’
—‘এতো সোজা নয় ব্যাপারটা।’
—‘কেনো? সোজা নয় কেনো?’
শিহাবকে স্পষ্ট বলতে শুনলাম, -’কারণ রুশমি আমার আইনত বিবাহিতা স্ত্রী। তুমি বললেই আমি ওকে জীবন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারব না। আর এই বিয়ের সাথে শুধু আমরা দুজনই না, বরং আমাদের পুরো পরিবার জড়িয়ে আছে। হুট করে কোন ডিসিশন নেয়া যাবে না।’
আমি চোখের জল মুছে নিয়েছি। শিহাবের মাত্র বলা কথাটা আমার মনোবল কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিয়েছে। বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুনে ঠান্ডা বাতাস লেগেছে। সেই আগুন এখন প্রায় নিভু নিভু। শিহাবকে আমার নিজের চাইতে অনেক বেশি ম্যাচিওর্ড বলে মনে হচ্ছে এখন। একই সাথে নিজেকে একটু কেমন বোকা বোকাও লাগছে। লৌকিকতা, যৌক্তিকতা, সামাজিকতা… এই সমস্ত কিছুকে পেছনে ফেলে আমার বোকা মস্তিষ্ক কিনা শুধু ইগো নিয়েই পড়ে থাকলো? শিহাব তো আমার বিয়ে করা বর। শুভ্রার কথা যদি সত্যিও হয়ে থাকে, যদি শিহাবকে আমি বশে আনার চেষ্টা করেও থাকি তাতে তো অন্যায় কিছু নেই! বরং অন্যায় করছে শুভ্রা।
—‘হঠাৎ তোর সুর পাল্টে গেলো? রহস্য কী?’ সন্দেহের সুর বাজতে থাকল শুভ্রার কণ্ঠে।
—‘রহস্যের কিছু নেই। রুশমির সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, এটা ফ্যাক্ট। তুমিই তো বলেছিলে বিয়েটা করে ফেলতে। বলোনি? এখন এতো ইস্পেশন্ট হচ্ছ কেনো?’
—‘আমি তো জানতাম না এরকম একটা ধড়িবাজ মেয়ের সাথে তোর বিয়ে হতে যাচ্ছে। জানলে…’
—‘শুভ্রাদি প্লিজ! আর একটা বাজে কথা তুমি বলবে না!’ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে শব্দ গুলো উচ্চারণ করল শিহাব। চেয়ে দেখলাম ওর মুখ রাগে থমথম করছে। কপালে ভাঁজ। চোয়াল পাথরের মতো শক্ত। শুভ্রা ধমক শুনে একটু থতমত খেয়ে গেছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে আছে শিহাবের দিকে। কিছু বলছে না।
‘গাড়িতে উঠে বসো।’ শিহাব বলল আমাকে। খুব কঠিন গলায়। আমি আর একটা মুহূর্তও নষ্ট না করে পার্কিং লটের সারিবদ্ধ অসংখ্য গাড়ির ভিড়ে ব্ল্যাক পোরশেটা খুঁজতে লাগলাম। শিহাব রিমোটের বোতাম চাপল। কয়েক কদম দূরে ওর গাড়ির হেডলাইট জ্বলে উঠল ভস করে। দৌড়ে গিয়ে উঠে বসলাম ড্রাইভারের পাশের গদিতে। জানি শুভ্রা রেগে যাবে। কিন্তু আমি ওকে শিহাবের পাশে কিছুতেই বসতে দেব না। অন্তত আমার উপস্থিতিতে তো নয়ই।
তোমরা অনেকে নিশ্চয়ই আমার সাইকোলজি বুঝতে পারছ না। ভাবছ, এই মেয়েটা নেহাৎ পাগল। সত্যি বলতে কি আমার নিজেরও নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছিল সেদিন। ভেতর থেকে কে যেন ভর্ৎসনা দিয়ে বলে উঠছিল বারংবার, ‘তুমি তো শিহাবকে ঘেন্না করো, তাহলে শুভ্রা ওর পাশে বসলে তোমার ক্ষতি কী?’ এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমার মস্তিষ্ককে বোবায় ধরেছে। শুধু শূন্যতা ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই এ মুহূর্তে। আমি শকুনের মতো তীক্ষ্ণ শিকারী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখছি একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শিহাব আর শুভ্রাকে। শিহাব জনাথনের বাড়ির দিকে দৌড়ে গেলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই ফিরে এলো হাতে একটা কোট নিয়ে। শুভ্রার গায়ে পরিয়ে দিল কোটটা, মনে হয় একটু যত্নের সাথেই। ওদের গায়ে জনাথনের বাড়ির অ্যাম্বার লাইটের ঝিকিমিকি আলো এসে পড়েছে। সেই আলোয় দেখতে পেলাম শুভ্রার পা টলছে। শিহাব এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে ওকে। শুভ্রা শিহাবের কাঁধের ওপর মাথা রেখেছে। ভাবটা এমন যেন শিহাব ছেড়ে দিলেই গড়িয়ে পড়ে যাবে মাটিতে। এই শারীরিক দুর্বলতা একটু আগে ঝগড়া করার সময় কোথায় ছিল? ঢং যত্তসব!
গাড়িতে আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। শুভ্রা ওর অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে আরো একদফা ঢং করল। সে মদ খেয়ে এতই মাতাল যে একা একা নাকি লিফট দিয়ে ওপরে উঠতে পারবে না। শিহাবকে সঙ্গে যেতে হবে। শিহাব ও দেখলাম বিনা বাক্য ব্যয়ে রাজি হয়ে গেলো। ফলস্বরূপ আমি একলা একলা গাড়িতে বসে রইলাম। অপেক্ষারত সময়টায় একেকটা মিনিটকে একেকটা ঘণ্টা বলে মনে হচ্ছিল। মন বড়ই অস্থির। বারবার ঘড়ি দেখছি। এতো দেরি হওয়ার কী কারণ? আম্মুজান এর মাঝেই কয়েকবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। আমার শাশুড়িও ফোন করেছে। বাড়িতে সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। শুভ্রা আবার শিহাবকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আজ রাতে নিজের কাছে রেখে দেবে না তো? দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনায় বুক ভার হয়ে আছে। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। কী করব বুঝতে পারছি না। শিহাবের ফোন নম্বরও নেই। শুভ্রার নম্বর আছে কিন্তু ও তো বেহেড। ওকে ফোন করা আর না করা একই কথা। কতক্ষণ কেটেছিল তা আজ আর স্পষ্ট মনে পড়ে না। মনে আছে একটা সময় অ্যাপার্টমেন্টের গেইট থেকে শিহাবকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। ও আমার সাথে কোন কথা বলল না। চুপচাপ ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। ডিসি থেকে ভার্জিনিয়া, অর্থাৎ আমাদের ভিয়েনার বাড়িতে আসতে বিশ মিনিটের মতো সময় লাগলো। এই পুরো সময়টায় শিহাব আমার দিকে একটা বার ঘুরেও তাকালো না। যেন আমি কোন বড়সড় গর্হিত কাজ করে ফেলেছি। আমার দিকে যেন তাকানো নিষিদ্ধ, কথা বলাও নিষিদ্ধ।
শ্বশুর-শাশুড়ি চলে যাবার পর বাবাজান আমাকে তার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিল। আমি মুখ নিচু করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে আমার মাথায় একটা হাত রেখে বলল, ‘রুশমি, মামণি আমার, আমি যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি। জানি তুমি আমার ওপর রেগে আছ এই মুহূর্তে। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন তুমি বুঝবে যে তোমার বাবা তোমাকে যোগ্য পাত্রের হাতেই সম্প্রদান করেছে।’
আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল জল। বাবাজান আমাকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকে মাথা রেখে আমি জানলাম যে এই মানুষটার ওপর রাগ করে থাকা, আর বেঁচে থেকে নিশ্বাস না নেয়া আমার জন্য সমতুল্য।
বিছানা কাঁচা গোলাপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। ফুলের সুবাসে মাতোয়ারা চারপাশ। ঘরের ভেতর জ্বলছে আমার পছন্দের সব ল্যাম্পশেড। বাবাজানের ঘর থেকে ফিরে এসে দেখলাম বাবাজানেরই টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে শিহাব আমার বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
—‘তুমি বাংলা পড়তে পারো?’ রবীন্দ্র রচনাবলীর দিকে ইঙ্গিত করে ও প্রশ্ন করল।
—‘হ্যাঁ।’
—‘রিয়েলি?’ শিহাব খুব অবাক।
—‘রিয়েলি।’
কেমন অবিশ্বাসের চোখে তাকালো ও আমার দিকে। যেন আমার বাংলা পড়তে পারাটা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। ওকে দেখে মনে হলো কিছু একটা বলতে চায়। মুখ খুলল। আবার চুপও করে গেলো। আমিও আর কিছু বললাম না। চুপচাপ ক্লজেট থেকে এয়ারবেড বের করে নিয়ে বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে নিলাম। নিজের বিছানা ছেড়ে দিলাম ওর জন্য। শুয়ে পড়ার আগে ঘরের সবকটা বাতি নিভালাম এক এক করে। অনেক রাত অবধি এপাশ ওপাশ করলাম। ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না। জেগে জেগে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলাম। তখন ঘড়িতে কটা বাজে আমার মনে নেই। রাত গভীর। হঠাৎ ডাকটা কানে এসে লাগলো… না কানে নয়, বলতে হয় বুকে এসে লাগলো।
—‘রুশানিয়া!’
—‘হুম?’
—‘ইউ সেইড… ইউ হেইট মি… ইজ ইট ট্রু?’
হিমহিম কন্ঠের ওই একরোখা আচমকা প্রশ্নটা আমার হাতে পায়ে অনির্বচনীয় এক শিরশিরানির উদ্রেক করে গেলো। চুপ করে রইলাম কয়েকটা সেকেন্ড। তারপর বললাম,
—‘ইটস ট্রু। আই হেইট ইউ শিহাব!’
ও তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলল না। আমি কান পেতে আছি কিছু একটা শোনার জন্য। কেনো জানি না, আমার বুক খুব ধড়ফড় করছে। চারদিকে নিশ্ছিদ্র নীরবতা। শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। একটা সময় আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওকে বলতে শুনলাম,
—‘রুশানিয়া!’
—‘হুম’
—‘আই হেইট ইউ মোর!’
—‘নোটেড!’
বললাম আস্তে করে। টের পেলাম চোখের জলে আমার বালিশ ভিজে যাচ্ছে। কাউকে ঘৃণা করায় যে এতো কষ্ট তা এর আগে কখনো বুঝিনি আমি!
শিহাব
আমার শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেই খুব আন্তরিক, অমায়িক এবং নরম স্বভাবের মানুষ। কিন্তু আপ্যায়নের অতিরিক্ত আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগছিল না। আমি খুব একটা ভোজন রসিক নই। যতটা সম্ভব তেল মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি। এই বাস্তবতাটুকু তারা বুঝতে সম্পূর্ণ অপারগ। শক্ত গলায় কিছু বলতেও পারছিলাম না। মম আর পাপা আমার দুরবস্থা দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছিল। হাসছিল জাহিদও। জাহিদ তো সুযোগ বুঝে বলেই ফেলল ফিসফিসিয়ে, ‘বাঙালি বিয়ে করলে কী ঝামেলা এবার বুঝো। খাইয়ে খাইয়ে মেরে ফেলবে। আমি তো জীবনেও বাঙালি মেয়ে বিয়ে করব না।’
—‘আচ্ছা? তাই নাকি? মমকে জানিয়ে দেই তোমার সিদ্ধান্তটা?’
জিব কাটল জাহিদ, ‘না না এখনই না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমিই বলব সময় মতো।
চুপ করে গেলাম। মনে মনে ভীষণভাবে চাইলাম, আমার মতো পোড়া কপাল যেন আমার ছোট ভাইটার না হয়। বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় চিত্তে বলিষ্ঠ পুরুষের মতো ও যেন নিজের মতামত জানাতে পারে, নিজের পছন্দের জীবনসঙ্গীকে বেছে নিতে পারে। আমার মতো কাপুরুষোচিত কাজ যেন ওকে কখনোই করতে না হয়। বিয়ের দ্বিতীয় দিন সহধর্মিণীর কাছ থেকে যেন শুনতে না হয় যে সে কতটা ঘৃণিত, এবং তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী তাকে কতটা ঘৃণা করে।
ব্যাপারটা আমাকে কেনো যেন অযৌক্তিকভাবে পীড়া দিচ্ছে। নিরর্থক এক গাত্রদাহ হচ্ছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না রুশমি আমাকে এতটা ঘৃণা কেনো করে? আমি তো ওকে বিয়ের রাতেই মুক্তি দিয়েছি। বলেছি ও যেখানে খুশি যেতে পারে, আমি বাধা দেব না। আমি যে নিজের ইচ্ছায় বিয়েটা করিনি এই ব্যাপারটাও তার অজানা নয়। আমরা দুজনেই পরিস্থিতির শিকার। দুজনকেই বাবা-মায়ের মন রক্ষার খাতিরে নিজস্ব ইচ্ছা বা পছন্দ বিসর্জন দিতে হয়েছে। তাছাড়া একটু ভালোমতো খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, রুশমির চাইতে ক্ষতিটা আমারই বেশি হয়েছে। কারণ আমাকে এই বিয়ের জন্য শুভ্রার সাথে বোঝাপড়া করতে হয়েছে। যে মানুষটার জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করে এসেছি সেই মানুষটাকেই দূরে ঠেলে দিতে হয়েছে। শুভ্রা কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পেয়েছি আমিও। অন্যদিকে রুশমিকে কোনও ঝামেলাই পোহাতে হয়নি। ওর কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল না। কোন ভালোবাসার মানুষ ছিল না। ছিল না কোন কমিটমেন্ট। তাহলে কেনো এই অপরিমেয় বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ধারণ করে থাকা? কেনোই বা আমার প্রতি এই নিরবধি ঘৃণা? আমার দোষটা কোথায়?
পরদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসে আমি ঠিক করেছিলাম পাপা মমকে বুঝিয়ে বলব যে এই বিয়েটা কোনভাবেই কার্যকর হবার নয়। করজোড়ে অনুরোধ করব যে তারা যেন আমাকে আর রুশমিকে এই ইচ্ছা বিরুদ্ধ, বোঝার ন্যায় সম্পর্কের বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়। ওয়ার্কআউটের সময়টায় আমি কথা গুছিয়ে নিয়েছি। ব্যায়াম শেষ করে কয়েকবার রিহার্সালও দিয়ে ফেলেছি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। যে করেই হোক এই বৈরীভাবাপন্ন বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে। এমন মানুষের সাথে আমি এক ছাদের নিচে দিন কাটাতে পারব না যে মানুষ কিনা আমাকে অষ্টপ্রহর প্রাণভরে ঘৃণা করে।
মোটামুটি তৈরী হয়েই বেজমেন্ট থেকে ওপরে উঠে এসেছিলাম। দেখলাম জাহিদ আর পাপা লিভিং রুমের সোফায় বসে টেলিভিশনে ন্যাশনাল ফুটবল লীগের খেলা দেখছে। ডাইনিং এ মমের পাশে রুশমি দাঁড়িয়ে আছে। মম খুব সম্ভবত কেক বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথা বলছে রুশমির সাথে। টেবিলের ওপর কেক তৈরির নানা সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রুশমিকে দেখলাম একটা পাত্রে কেকের ব্যাটার তৈরী করতে। ওর পরনে সাদা রঙের ঢোলা শার্ট। মাথায় সাদা হিজাব। মুখে প্রসন্ন হাসি। আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। যে মেয়েটা আমাকে এক মুহূর্তের জন্য সহ্য করতে পারে না, আমি যার দিবা-রাত্রির চক্ষুশূল সেই মেয়েটাই এখন আমার মায়ের সাথে হেসে কথা বলছে, হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? একটা অদ্ভুত বিস্ময়ে গুম হয়ে রইলাম আমি। যা কিছু মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছিলাম তার সমস্তটাই ওলটপালট হয়ে গেলো। মেয়েটাকে আমার হিপোক্রেট মনে হচ্ছে। দুই নাম্বার মনে হচ্ছে। যদি এই বিয়ে টিকিয়ে রাখতে না চায় তবে আমার বাবা- মায়ের সাথে অত ভালো ব্যবহার করা কেনো? এর মানে কি সে চাইছে ভাঙ্গনটা যেন আমার দিক থেকে আসে এবং অভিভাবকরা ভেবে নেয় যে আমার তরফ থেকেই চেষ্টার কমতি ছিল? ভারী ধুরন্ধর মেয়েতো! আমার সাথে চব্বিশ ঘণ্টা দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে, আবার আমারই পরিবারের সদস্যদের হাসিমুখে ধোঁকা দেয়া হচ্ছে!
মম আমাকে বলল, ‘শিহাব এদিকে এসো। তোমার বৌকে কেক বানানো শিখাচ্ছি। শিখে যাচ্ছে খুব দ্রুত। বুদ্ধি আছে।’
মমের মুখের চাপা আনন্দের জোয়ারটা আমি লক্ষ্য করলাম। খুশিতে রমরম করছে তার চোখের তারা। রুশমিকে দেখলাম মুখে শান্ত হাসি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। চোখ অবনত। আমার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো এই ভেবে যে, ঠিক এমনি ভাবে শুভ্রাকে আমি আমার মায়ের পাশে কোনদিন দেখব না। অথচ কত ভালোই না হতো যদি রুশমির পরিবর্তে এই মুহূর্তে শুভ্রা দাঁড়িয়ে থাকত মমের পাশে। শুভ্রার কথা মনে পড়তেই ওর ফোন পেলাম। বলল, এখুনি দেখা করতে চায়। খুব নাকি জরুরি কথা আছে। আমি কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়লাম। শুভ্রার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি ও মদের বোতল খুলে বসেছে। মুখজোড়া হতাশা। চোখের নিচে কালি। আমাকে দেখা মাত্র বলল,
—‘জনাথন বিয়ে করছে ওর গার্লফ্রেন্ডকে এই সামারে। চল শিহাব আমরাও বিয়ে করে ফেলি।’
—‘জনাথন বিয়ে করছে বলেই তোমার বিয়ে করতে হবে?’
—‘হ্যাঁ, ওকে আমার একটা শিক্ষা দিতেই হবে।
—‘শুভ্রাদি, আমি তো আগেই বলেছি যে তোমাকে আমি সেদিনই বিয়ে করব যেদিন তুমি মন থেকে আমাকে… শুধুমাত্র আমাকে ভালোবাসবে।’
শুভ্রা এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু।
—‘সেই দিনটা কি কখনো আসবে শুভ্রাদি?’ প্রশ্ন করলাম ধীরস্থির ভাবে।
—‘কিন্তু শিহাব … তুই তো আমাকে ভালোবাসতি!’
—‘তুমি তো বাসতে না।’
—‘তাহলে কী করতে চাস তুই?’
—‘কিছুই না… আমাকে সময় দাও। নিজেকেও সময় দাও।’
শুভ্রার চোখে জল টলমল করছিল। কিছুক্ষণ ওই টলটলে চোখ নিয়েই আমার দিকে চেয়ে থাকল। তারপর দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে কাঁপা গলায় বলল, ‘আমাকে একটা হাগ দিয়ে যা। শক্ত করে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না শিহাব!’
আমি চুপচাপ এগিয়ে গেলাম। সেই সন্ধ্যায় আমার অনেকদিনের লালিত পালিত, আরাধ্য স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত হলো। আমি শুভ্রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম নিজের বুকের সাথে। কিন্তু কোথায় যেন একটা অস্বস্তি বিঁধে আছে। কিছুতেই সহজ হতে পারছি না। আর সহজ হতে পারছি না বলেই হয়তো আমার ভালো লাগছে না। আমি মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে পারছি না। এই নিবিড় আলিঙ্গনে আমার আভ্যন্তরীণ উৎকণ্ঠা এবং দুশ্চিন্তা বিন্দু মাত্র অপসৃত হচ্ছে না। যাকে আমি বহুদিন ধরে বহুবার মনে মনে কামনা করে এসেছি আজ তাকে কাছে পাবার পরে আমার মধ্যে কোন প্রকার উত্তেজনা কাজ করছে না। উল্টো এক সীমাহীন বিমৰ্ষতা চারপাশ থেকে ঝাপটে ধরেছে। আমি এমন কেনো? আমার কি কোন সমস্যা আছে? কোনও মেন্টাল বা ফিজিক্যাল ডিজঅর্ডার? এতদিন ধরে আমি যে অনুভূতিটিকে ভালোবাসা ভেবে এসেছি সেটা কি তবে ভালোবাসা নয়? নাকি এটাই ভালোবাসা? খুব করে চাওয়া… তারপর পেয়ে যাবার পর সেই চাওয়ার আর কোনও মূল্য না থাকা!
এরকম তো হবার কথা ছিল না। কিন্তু হয়ে গিয়েছিল। যে ঘটনা ঘটবার জন্যই নির্দিষ্ট, সেই ঘটনাকে উল্টো পথে ধাবিত করার সাধ্য কারো নেই। ওটা ছিল দু হাজার চৌদ্দ সালের ডিসেম্বরের এক শীতল রাত্রি। আজকে… এই দু হাজার বিশ সালের সেপ্টেম্বরের গ্রীষ্ম সন্ধ্যায় একলা ঘরে বসে থেকে, উনত্রিশ বছর বয়স্ক শিহাব সম্যকরূপে জানে যে শুভ্রা তার মোহ ছিল। ইনফ্যাচুয়েশন ছিল। ভালোবাসা ছিল না। অথচ এই নির্জলা সত্যটুকু কতই না দুর্বোধ্য হয়ে ধরা দিয়েছিল সেদিন চব্বিশ বছর বয়সী অপরিণত মনস্ক শিহাবের কাছে!
এই মুহূর্তে আমার চোখের পর্দায় দু হাজার চৌদ্দ সাল। যেন একটা বিশাল বড় স্ক্রিনের মনিটর খোলা আছে সম্মুখে। সেই মনিটরে আমি শুভ্রার ড্রইংরুমটা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। আমরা দুজন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রা কালো রঙের একটা শর্ট প্যান্ট পরেছে। গায়ে কোমর পর্যন্ত ব্লাউজ। রংটা খুব সম্ভবত নীল। পূর্ব দিকের দেয়ালের ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। বাইরে তাপমাত্রা মাইনাস থ্রি। শুভ্রার উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ছে আমার বুকের ওপর। আমি ভাবছি আমার ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল আছে। শুভ্রাকে আমি কত করে চাইতাম একটা সময় অথচ আজ কাছে পাবার পর মনে হচ্ছে যেন সেই চাওয়ায় ভুল ছিল।
—‘শোন, রুশমির সাথে বেশি মেলামেশা করিস না।’ হঠাৎ বলে উঠল শুভ্রা।
—‘মেলামেশা বলতে?’
—‘তোরা একই ঘরে থাকিস। আমার খুব ভয় হয়।’
আমি হেসে ফেললাম, ‘কীসের ভয় তোমার শুভ্রাদি?’
—‘রুশমি তোকে সহজে ছাড়বে না শিহাব… তুই সাবধানে থাকিস।’ শুভ্রার বাহু বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। আমার মনটা বিশ্রী রকমের অস্বস্তিতে ভরে গেছে। নিজেকে অনুভূতিহীন জড়পদার্থ বলে মনে হচ্ছে।
—‘রুশমি খুব সহজেই ছেড়ে দেবে আমাকে। ও না ছাড়লে আমি ছাড়ব। ওসব নিয়ে তুমি চিন্তা করো না।’
—‘তুই আমার কথা মন দিয়ে শোন। মেয়েটাকে ধারে কাছে আসতে দিবি না। মেয়েটা কিন্তু খুব চালাক। তোকে বলেছে ওর কোন রিলেশন ছিল না বিয়ের আগে। আই অ্যাম মোর দ্যান শিওর এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা।’
আমি চুপ করে রইলাম… রুশমি হয়তো চালাক হতে পারে, কিন্তু মিথ্যেবাদী কোন ভাবেই নয়!
পরের কয়েকটা দিন খুব খারাপ কাটল। শুভ্রার হ্যাংলামো আমার ভালো লাগছে না। এদিকে রুশমি আমাকে ঘৃণা করে এটা জানার পর থেকে ওর সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র রুচি হচ্ছে না। যতটা সম্ভব ওকে এড়িয়ে চলছি। বন্ধুদের সাথে সময় কাটাচ্ছি। বাংলাদেশি বন্ধুরা আমার নতুন বৌ দেখতে আগ্রহী। ওদের সামনে এখনো রুশমিকে নিয়ে যাইনি। এদের মাঝে কেউ কেউ আবার আমার আর শুভ্রার ব্যাপারটা জানে। তাই অনেকের সাথেই আগের মতো স্বচ্ছন্দ্য ভাবে মিশতে পারছি না। আমি ইন্ট্রোভার্ট। নিজের সমস্যার কথা মানুষকে বলে বেড়াতে পছন্দ করি না।
অফিস খোলার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রুশমি মনে হয় রাত জেগে বই টই পড়ে। অনেক বেলা অবধি ঘুমোয়। অন্যদিকে আমার নিয়মমাফিক জীবন। ঘুমোতে যাই রাত দশটার মধ্যে, জেগে উঠি ছটার আগে। খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে দিনের প্রথম সূর্যের আলোয় রুশমির ঘুমন্ত মুখখানার দিকে তাকাই একটাবারের জন্য। চেয়ে দেখি ওর চোখের ঘন পাপড়ি, নাকের নোজপিন, ঠোঁটের নিচের কালো তিল… ঠিক এরকমই একটা গাঢ় কালো তিল ওর ডান বুকের ওপর আছে। একদিন সকালে শার্টের খোলা বোতামের ভেতর দিয়ে আমি তিলটা দেখে ফেলেছিলাম। বলতে নেই, এরপরের দিন আরো একবার ঐ তিলটা এক নজর দেখবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু সেদিন শার্টের বোতাম ছিল আটকানো। মাঝে মাঝে ওর মুখের ওপর চুল এসে পড়ে থাকে। চুলের জন্য মুখটা স্পষ্টভাবে দেখা যায় না। আমার তখন খুব ইচ্ছে করে চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দেই, তারপর ওই মুখটা মন ভরে দেখি! এরকম ইচ্ছে কেনো হয় তা আমি জানি না। তবে এটুকু জানি যে সারা দিনের মধ্যে ভোর বেলার এই অংশটুকুই আমার খুব প্রিয়। ঘুমন্ত রুশমির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে!
রুশমি
মনে হয় স্কলারশিপটা হবে না। অত ভালো ছাত্রী তো আমি নই! স্টুডেন্ট লোন নিয়েই পড়া শুরু করতে হবে। হলিডে সিজন শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেছে যার যার মতো। শুধু আমারই কোন কাজ নেই। দিন রাত ঘরে বসে আছি। বই পড়তে আর কতক্ষণ ভালো লাগে? মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি নিরুদ্দেশ। এক দুপুরে লিওর সাথে দেখা করলাম। আমি বিয়ে করেছি এই ঘটনা ওকে বিশ্বাস করাতে বেগ পেতে হলো। ও খুব একটা দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিল, ‘গুড ফর ইউ!… ইফ ইউ আর হ্যাপি… আই অ্যাম হ্যাপিয়ার।
তবে সময়টা ভালো কেটেছে। আমরা একসাথে লাঞ্চ করেছি। বিকেল বেলায় আইস স্কেটিং করেছি।
শিহাব অফিসের জন্য বেরিয়ে যায় সকাল নটার মধ্যে। শ্বশুর-শাশুড়ি, জাহিদ এরাও দশটা বাজার আগেই বেরিয়ে পড়ে। সবাই কাজের মানুষ। একমাত্র আমি বাদে। ওদিকে আমার বাবা আম্মুরও দমবন্ধ করা ব্যস্ততা। মেজো আর ছোটোর স্কুল খুলে গেছে। আমি কফিশপের কাজটা আবার শুরু করব বলে মনস্থির করলাম। পাশাপাশি স্টুডেন্ট লোনের জন্য অ্যাপ্লাই করছি। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে নিশ্চয়ই। শিহাবের সাথে আমার তেমন একটা কথা হয় না বললেই চলে। আমাদের এই দূরত্ব বাড়ির লোকেরাও টের পাচ্ছে। আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া দেখতে পেয়েছি। আমার শাশুড়ি নানাভাবে ছেলেকে আমার কাছে ভিড়ানোর চেষ্টা করছে। হানিমুনে যাবার জন্য জোরাজুরি করছে। শিহাব কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। ওর জীবনটা সকাল সন্ধ্যা অফিস, ওয়ার্ক আউট, মিউজিক আর উইলো ফরেস্টের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উইলো ফরেস্টের ব্যাপারটা আমি ধরতে পেরেছি কদিন আগে। রোজ ডিনারের পর কিছু সময়ের জন্য শিহাব উধাও হয়ে যায়। জাহিদের কাছ থেকে জানতে পারলাম ওই সময়টায় উইলো ফরেস্টের ভেতরের কোথায় যেন চুপচাপ গিয়ে বসে থাকে তার বড় ভাই। এটা নাকি অনেক দিনের অভ্যাস। উইলো ফরেস্ট থেকে সাড়ে আটটার দিকে ও বেডরুমে আসে। দরজা খুলে আমাকে এক ঝলক দেখে। তারপর সৌজন্যতার গলায় আলগোছে বলে, ‘হেই রুশানিয়া! হাউ ইজ গোইং?’
আমি ছোট করে উত্তর দেই। মাঝে মাঝে শুধু ‘হেই শিহাব!’ বলে চুপ করে থাকি। সারাদিনে অতটুকুই বাক্য বিনিময় হয় আমাদের মাঝে। তবে ওর রুশানিয়া ডাকটায় একটা স্মার্ট ভাব আছে। শুনতে ভালো লাগে।
ও ঘরে ফিরে এসে গোসল সেরে নেয়। জানালার সামনে বসে আপন মনে পিয়ানো বাজায়। দশটার আগেই মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। এদিকে আমার অনেক রাত অবধি ঘুম হয় না। ল্যাম্পশেডের আলোয় চুপচাপ বই পড়ি। শিহাবের নির্লিপ্ততা আমাকে পীড়া দেয়। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়। দুর্ভাবনারা পাগল করে তোলে। ক্রমেই ডিপ্রেশনে পেয়ে বসছে আমাকে। কারো সাথে এই সিচুয়েশন শেয়ার করা দরকার। কিন্তু সেরকম বন্ধু আমার নেই। মেজোর সাথেই বলা যায় একমাত্র। ওর মন খারাপ হবে ভেবে কিছু বলতে পারছি না। আম্মুজানকেও বলতে পারছি না ঠিক একই কারণে। কিন্তু কতদিন অভিনয় করে যাব? আজ নয়তো কাল সত্যটা ওদের জানতেই হবে। শুভ্রা আমাকে প্রায়ই ফোন দেয়। ফোন দিয়ে আজেবাজে কথা বলে। এই যেমন পরশু দিনকে হুট করে ফোন দিয়ে বলল, ‘তুই এখনো বসে আছিস কেনো ওই বাড়িতে? তোর কি লজ্জা শরম নাই? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করতে হবে?
আমি কোন উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। তবে ওর প্রশ্ন দুটো আমাকে ভাবিয়েছে সারাদিন। অনেক ভেবেও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। নিজেকে নিজের কাছে বোঝা বলে মনে হয় আজকাল। মনে হয় আমি বুঝি একা… খুব একা! আমার কোন বন্ধু নেই। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। কেউ আমাকে বোঝে না! সেইসব ভালো না লাগা, প্রবল হতাশার দিনগুলিতে একদিন হঠাৎ একটা জিনিস খুব ভালো লেগে গেলো। ভালো লাগার জিনিসটা হলো শিহাবের গান! বিয়ের প্রায় তিন সপ্তাহ পরের এক দুপুরবেলায় আমার শাশুড়ির অনুরোধে শিহাব একটা গান গেয়ে শুনিয়েছিল আমাদের। The Beatles এর hey jude
সেদিন ছিল রবিবার। আমার বাবাজান শার্লিগেট মসজিদে জোহরের নামাজের ইমামতি করেছে। আমরা সপরিবারে গিয়েছিলাম মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করতে। নামাজ শেষে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হলো আমার শ্বশুরবাড়িতে। খাওয়া দাওয়ার পর আমার শাশুড়ির অনুরোধে শিহাব আমাদের গান গেয়ে শোনালো। জানালায় শীতের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুর। আকাশ পরিষ্কার নীল। সেই বছর ঘন ঘন তুষারপাত হয়েছিল। সাদা বরফে ঢেকে গিয়েছিল বাড়ির পেছনের উইলো ফরেস্ট। যতদূর চোখ যায় শুধু আদিগন্ত সাদার বন্যা। আর সেই সাদার ওপরে রোদ ছায়ার অবিরাম লুকোচুরি খেলা। শিহাব জানালার ধারে পিয়ানোর সামনে বসেছে। পিয়ানোর ওপর একটা গানের খাতা খোলা। আমরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছি। কেউ বিছানায়, কেউ চেয়ারে, কেউ বা আবার কার্পেটে। শিহাবের পরনে ছাই রংয়ের সুতি পাঞ্জাবি। আমি লক্ষ্য করেছি ও কয়েকদিন যাবৎ দাড়ি কামায় না। তাই ওর গালে এখন গুড়িগুড়ি দাড়ি। সোনালী রোদে মুখ ডুবে আছে। ও চুইংগাম চিবোচ্ছে আর পিয়ানো বাজাচ্ছে। চুইংগাম মুখে নিয়েই গান গাইছে। আমি ওর মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি ঈষৎ খাড়া নাক, কাটা কাটা চোয়াল, উদ্ধত কণ্ঠমণি। আমার মনে হচ্ছে এতো নিখুঁতভাবে চুইংগাম চিবোতে বুঝি এর আগে কখনো কাউকে দেখিনি। চুইংগাম চিবোনোর ধরণের কারণেই বোধহয় ওকে এই মুহূর্তে অনেক বেশি ভালো দেখাচ্ছে। আমি চুপ হয়ে গেছি একদম। এতো ভালো গান করে এই ছেলে এই তথ্যটা আমার জানা ছিল না। এর মাঝেই হঠাৎ আম্মুজান কী একটা বলে যেন ওর গানের খুব প্রশংসা করল, ও আম্মুজানের দিকে তাকিয়ে হাসলো একবার নীরবে। আমি ওর রোদে ডোবা, গালে ভাঁজ পড়া হাসির দিকে চেয়ে রইলাম। আমার বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা হচ্ছে কারণ… ওর হাসিটা অসহ্য রকমের সুন্দর! ব্যথা হচ্ছে কারণ… ওর গানের গলা অদ্ভুত শক্তিধর! ব্যথা হচ্ছে কারণ… যে মানুষটাকে আমি সীমাহীন ঘেন্না করি, সেই মানুষটার এত এত ভালো দিক আমার মোটেই ভালো লাগছে না!
এরপর থেকে যখনই ওর হাসিটা দেখি… আমার বুকের গভীরে চিনচিনে ব্যথা হয়। কিন্তু এই ব্যথায় একটা সুখের মতো স্নিগ্ধতা আছে। সেই স্নিগ্ধতা টুকু টের পেলাম দুদিন বাদে, যেদিন নিজ থেকে ওর সাথে কথা বলতে গেলাম লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে। একটা সুন্দর সুর ও আজকাল প্রায় রাতে বাজায়। আমার খুব জানার ইচ্ছে এটা কোন গানের সুর। তাই ভেবেছি আজকে সরাসরি জানতে চাইব।
ও গোসল সেরে এসে পিয়ানোর সামনে বসেছে। আমি বুকের ওপর বই চেপে ধরে পেছনে এসে দাঁড়ালাম নিঃশব্দে। আমার অস্বস্তি লাগছে। কারণ বিয়ের পর কখনো আমি ওর সাথে নিজ থেকে কথা বলিনি। আজকেই প্ৰথম।
ঘরের ভেতরটা হিটারের উত্তাপে উষ্ণ হয়ে আছে। পিয়ানোর বাজনার সাথে শিহাব গুনগুন করে একটা সুর ভাজছিল। ঠিক এই সুরটাই ও গত তিনরাত ধরে রোজ বাজায়। এদিকটায় আলো খুব কম। বিছানার পাশে একটা হলুদ রংয়ের ল্যাম্পশেড জ্বলছে। সেই আলোর অল্প একটু রেশ ধূলোর মতো এসে পড়েছে শিহাবের মাথার চুলে। আমি এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে ওর আলোর ধূলোমাখা ঝরঝরে ছোট ছাটের চুল গুলি দেখছি। জানালার প্রশস্ত কাচে বাইরের সফেদ রাত ভেসে আছে। দিগ্বিদিক বিস্তৃত শুভ্র তুষার হিমবর্ষী নিশীথ আকাশের গায়ে সাদার নকশা আঁকছে। জমে থাকা বরফপুঞ্জ জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকার কিছুটা হটিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ চোখ পড়লে মনে হয় যেন আকাশ থেকে পেঁজাতুলো মেঘ নেমে এসে চেপে বসেছে বনের গাছের ডালে ডালে।
শিহাব খুব সম্ভবত আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে। পিয়ানোর রিডের ওপর চলতে থাকা ওর আঙুল গুলো মুহূর্তের জন্য থমকে গেছে। আমি দম আটকে দাঁড়িয়ে আছি আর মনে মনে আশা করছি ও ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাবে। কিন্তু তাকানোর পর ঠিক কী বলে কথোপকথন শুরু করব তা নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমার মাথায় একশ চিন্তা খেলে গেলো। ও ফিরে তাকালো না। পিয়ানোর রিডের ওপরে পড়ে থাকা আঙুল সচল হলো। আমার ভেতরে একটা উৎকণ্ঠা কাজ করছে। আমি জানি এই উৎকণ্ঠা অর্থহীন। ওর সাথে এই মুহূর্তে কথা বলাটা কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমার পড়ে আছে। কিন্তু এই ছেলেটার নির্লিপ্ততা আমাকে ক্যাকটাসের ধারালো কাঁটার মতো বিদ্ধ করে তুলছে। ক্যাকটাসের কাঁটার কথা মাথায় আসতেই বছর তিনেক আগের এক দুপুর মনে পড়ল। সেবার গ্রীষ্মের ছুটিতে আমরা ফিনিক্স বেড়াতে গিয়েছিলাম সপরিবারে। সেডোনা ন্যাশনাল পার্কের ধূলো ধূসরিত পাথুরে উপত্যকায় আমাকে হঠাৎ জাম্পিং ক্যাকটাস আক্রমণ করেছিল। কী ভয়ংকর সেই আক্রমণ! মনের আনন্দে হেঁটে বেড়াচ্ছি মরুভূমির বালির ওপর, হঠাৎ একটা কাঁটা যুক্ত ছোট্ট আগাছা লাফিয়ে উঠে পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরল। তীব্র ব্যথায় কনকন করে উঠল পা। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে বাবাজানকে ডাকলাম। এরকম অদ্ভুত জিনিস আমি জীবনে কখনো দেখিনি। ক্যাকটাসের মতো নিরীহ উদ্ভিদ কেনো এবং কী করে আমার ওপর এই অতর্কিত আক্রমণ করতে পারে তার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাবাজান একটা গাছের ডাল দিয়ে কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদটা সরালো আমার পায়ের ওপর থেকে। কিন্তু ততক্ষণে রাক্ষুসে ক্যাকটাস আমার চামড়ায় দাঁত গেঁথে দিয়েছে। রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে ক্ষতস্থান। এতো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা আমার জীবনে সেই প্রথম। অনেকদিন ওই রাক্ষুসে গাছ আমাকে স্বপ্নে তাড়া করে এসেছে। আমি জানতাম না যে গাছ কখনো লাফিয়ে মানুষের গায়ে উঠতে পারে। ভেবেছিলাম নির্ঘাৎ ভূত প্রেত কিছু একটা হবে। কিছুদিন বাদে বাবাজানের অনুপ্রেরণায় এই নির্দিষ্ট ক্যাকটাস সম্পর্কে পড়াশোনা করে জানলাম যে এটা ভূত প্রেত কিছুই নয়, আল্লাহ সুবহানাতায়ালার সৃষ্ট এক আশ্চর্য উদ্ভিদ। অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা আমার পুরোনো বাজে অভ্যাস। এ মুহূর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি পিয়ানোবাদকের পেছনে। অথচ বহু দিন আগের সেই রাক্ষুসে ক্যাকটাসের কথা ভেবে চলেছি। কোন এক বিচিত্র কারণে আমার মনে হচ্ছে যেন ওই রাক্ষুসে ক্যাকটাস এখন আমার কলিজা কামড়ে ধরেছে। গত কয়েকদিন ধরে আমার অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু সেনসেশন হচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই ডিপ্রেশনের লক্ষণ। আমার উচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাথে কথা বলা। হ্যাঁ, খুব দ্রুত একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। কিন্তু সেটা তো পরের কথা। এখন এই নিরর্থক উৎকণ্ঠা থেকে আমায় মুক্তি দেবে কে? কেনো এমন উদ্ভট একটা ভাবের সঞ্চার হচ্ছে আমার মনে? কেনো মনে হচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তে শিহাব আমার দিকে একটাবার ফিরে না চাইলে, কথা না বললে কলিজায় দাঁত কামড়ে পড়ে থাকা রাক্ষুসে ক্যাকটাসটাকে কিছুতেই অপসারণ করা যাবে না?
শিহাব
মনো দিল না বধূ
মনো নিল যে শুধু
আমি কী নিয়ে থাকি …
—শচীন দেব বর্মণ
.
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। রুশমি কি আমাকে কিছু বলতে চায়? রাতের এই সময়টায় ও সাধারণত বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকে। ভাবটা এমন যে বোমা মেরে কেউ বাড়ি শুদ্ধ উড়িয়ে দিলেও সে বই থেকে মুখ তুলবে না। আজকে হঠাৎ কী হলো? জানালার কাচে আমি ওর আবছা ছায়া দেখতে পাচ্ছি। ও পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। আমার কি আগ বাড়িয়ে কথা বলা উচিত? কিন্তু আমার তো ইচ্ছে করে না। ছোট বেলা থেকেই আমার আত্মসম্মান বোধ অত্যন্ত জাগ্রত। যে মেয়েটা দৃঢ় কণ্ঠে নির্বিকারে স্বীকার করে গেছে সে আমাকে ঘৃণা করে, সেই মেয়েটার সাথে নিজ থেকে কথা বলতে যাবার আগে নিজের আত্মাদরের অকাতর বিসর্জন দিতে হবে। বারবার ঘৃণার ব্যাপারটা শুনতে হয়তো একঘেয়ে লাগতে পারে। কিন্তু কী করব? বিষয়টা আমার মনের সাথে সুপার গ্লুর মতো আটকে গেছে। এই ঘাতক ভাবনা শুধু ব্যক্তিগত জীবনেই না, কর্মজীবনের ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। গতকাল অফিসে হলভর্তি লোকের সামনে প্রেজেন্টেশন দিতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো, কেনো রুশমি আমাকে এতটা অপছন্দ করে? ঐযে ক্যাথরিনাকে দেখো, জার্মান বংশোদ্ভূত সুন্দরী মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে আমি জানি। পুরুষমানুষ একটা বয়সে পৌঁছনোর পরে, কোন নারী তার প্রতি আসক্ত হলে খুব সহজেই টের পায়। আমিও ব্যতিক্রম নই। আধুনিক মেয়েরা মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটায় খুব সাবলীলভাবে। মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ওদের কোন কার্পণ্য নেই। ক্যাথরিনা আশেপাশে থাকলে ওর প্রলোভনসঙ্কুল আচরণ আমার চোখ এড়ায় না। আমি বুঝি নানা কায়দায় সে আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। অথচ আমার বিয়ে করা বৌ আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না। আমার ভাগ্যটা এত খারাপ কেনো? এই আবেগ সর্বস্ব লুতুপুতু প্রশ্নটি আমার মাথায় এলো তখন, যখন আমি কোম্পানির নতুন প্রজেক্টের ভেহিকেল ডিজাইন এবং কন্ট্রোল সিস্টেম নিয়ে পনের মিনিটের বক্তব্য রাখতে যাচ্ছি।
রুশমি এখন জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। আমি ওর কোমর পর্যন্ত খোলা চুলের গোছা দেখতে পাচ্ছি। একটা সুন্দর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছে। জানালার সামনে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই খোলা চুলের গোছা দুহাত দিয়ে মুড়িয়ে নিল ও। ঘাড়ের ওপর মস্ত এক খোঁপা করল। আমার চোখে পড়ল সাদা লেসের নাইটি। যার পেছনের অনেকাংশ খোলা। চোখে পড়ল মোমের মতো ফর্সা মসৃণ পিঠ। ঘুরে দাঁড়ালো ও। আমার পিয়ানোর সুর তখন থেমে গেছে। জানি না কেনো হৃৎপিণ্ডও থমকে গেছে ক্ষণিকের জন্য। আমি ওর ঠোঁটের নিচের কালো তিলটার দিকে চেয়ে আছি। কিন্তু ভাবছি ডান বুকের তিলটার কথা। এখন ঠিক যেখানে ওর নাইটির বোতাম গিয়ে থেমেছে তার এক ইঞ্চি নিচেই… আমার ভেতরে নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। নিজেকে আমার পারভার্ট মনে হচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ল, রুশমি আমাকে একবার পারভার্ট ডেকেছিল! মনে পড়তেই ভেতরটা আত্মগ্লানিতে কুঁকড়ে গেলো। চোখ সরিয়ে নিলাম। মুড খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটা কেনো অযথা আমাকে বিরক্ত করছে? প্রব্লেম কী? সেলফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। আমার মুখে একটা স্বস্তির হাসি ফুটে উঠল। মনে হলো এই মুহূর্তে ফোনটা না এলে খুব বিপদে পড়ে যেতাম।
রুশমি
এতকাল আমার ধারণা ছিল সৌন্দর্য জিনিসটায় মেয়েদেরই শুধু একচেটিয়া অধিকার। কিন্তু আমার ধারণা পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। এই মুহূর্তে শিহাব যখন পিয়ানোর ওপর রাখা সেলফোনটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নিঃশব্দে হেসে উঠল, তখন টের পেলাম যে এই হাসি আমার বুকে শুধু চিনচিনে ব্যথার উদ্রেকই করে না, বরং একটা স্নিগ্ধতার পরশও বুলিয়ে যায়। আর ওই স্নিগ্ধতা টুকুই চোখের সামনে এক অকাট্য সত্যের দ্বার উন্মোচন করে গেলো নির্দ্বিধায়। সত্যটা হলো, এই মূহুর্তে ওর অসহ্য সুন্দর হাসিটা আমার অসহ্য রকমের ভালো লাগছে!
কথার ধরণ শুনে বুঝলাম ‘ন’ আন্টি (নাম গোপন করা হলো সঙ্গত কারণে) ফোন করেছে। সে খুব কাছের কেউ নয়। শিহাবের ছোট মামার গার্লফ্রেন্ড। বয়স শিহাবের কাছাকাছিই হবে। মামার সাথে আবার শিহাবের সম্পর্ক খুব ভালো, বন্ধুর মতো। বলতে কি ছোটমামার বয়সও খুব বেশি নয়। ঊনত্রিশ কি তিরিশ হবে। তো…. ‘ন’ আন্টির সাথে মামার ব্রেকআপ হয়েছে কিছুদিন আগে। এখন রোজ রাতে ‘ন’ আন্টি একবার করে শিহাবকে ফোন দিয়ে শলা পরামর্শ করে। আন্টির ধারণা শিহাবই পারবে মামাকে তার কাছে ফিরিয়ে দিতে। এসব কথা শুনেছি জাহিদের কাছ থেকে। জাহিদকে খুব সম্ভবত শিহাবই বলেছে। আমি কোন দিন মুখ ফুটে কিছু বলিনি কিন্তু আজকে বলছি, ‘ন’ আন্টির এই যখন তখন অসময়ে ফোন করাটা আমার একেবারেই পছন্দ ছিল না। শিহাব, তুমি যখন এই লেখা পড়ছ… আদৌ কোনদিন পড়বে কিনা জানি না। পড়ে থাকলে তোমার কেমন লাগছে, তুমি কী ভাবছ জানি না কিন্তু সেই রাতে আন্টির ফোন পেয়ে তোমার ঠোঁটে একটা অসহ্য সুন্দর হাসি ফুটে উঠেছিল। আমি ভাবছিলাম আমার প্রতিই তোমার রাজ্যের যত নির্লিপ্ততা, অথচ ন’ আন্টির ফোন তোমাকে আকণ্ঠ খুশিতে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে!
আমি বই হাতে নিয়ে জানালার কাচে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শিহাব পিয়ানোর টুলে বসে ফোনে কথা বলছে। ওর চোখের দৃষ্টি জানালার বাইরে। কিন্তু সেখানে খুব বেশিক্ষণ স্থির হলো না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দৃষ্টিটা আমার মুখের ওপর এসে পড়ল। প্রথমে আমার চোখ, নাকফুল… তারপর খুব ধীরে ধীরে ওই বাদামি চোখের তারা আমার ঠোঁটের নিচের কালো তিলটাকে ছুঁয়ে দিল। ‘ছুঁয়ে দিল’ শব্দটা বললাম কারণ, সেই প্রথমবারের মতো আমি জেনেছিলাম যে চোখ দিয়েও কেউ কাউকে এত গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিতে পারে!
শিহাব ফোন নামিয়ে রেখেছে। আমার বুক কাঁপছে প্রবলভাবে। একটু আগে ও আমার দিকে এমনভাবে কেনো তাকালো? ও কি সব মেয়েদের দিকেই এভাবে তাকায়? কী ছিল ওই চোখের চাউনিতে? সেই প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো শব্দের সমাহার আমার নিজস্ব ছোট্ট ডিকশনারিতে নেই। শুধু এতটুকু বলতে পারছি যে, ওই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমি ভীষণ রকমের এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলাম, আমার যেন পায়ের তলায় মাটি নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই। ওই দৃষ্টির জাল আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। আমার মনের দিঘির জলের গভীর থেকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সম্পূর্ণ অন্যরকম এক মেয়েলী অনুভূতি। এই অনুভূতিকে কেনো আমি মেয়েলী বললাম তার কারণ খুব একটা সুস্পষ্ট নয়, তবে কেনো যেন মনে হলো এমন সূক্ষ্ম অনুভূতি শুধু মেয়েদেরই হতে পারে। ঠিক সেই সময় লক্ষ্য করলাম… ওর ওপরের ঠোঁটটা নিচের ঠোঁটের চাইতে অপেক্ষাকৃত সরু এবং হালকা। স্টেসি একবার এরকম ঠোঁট নিয়ে একটা কথা বলেছিল… আজ এই মুহূর্তে সেই কথা মনে পড়তেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা লজ্জাজনিত শিরশিরে ঢেউ খেলে গেলো আচমকা। আমি চোখ নামালাম নিচে। নামাতেই ওকে কাঠকাঠ গলায় বলতে শুনলাম, ‘কেউ কি আমাকে কিছু বলতে চায়?’
কথার ধরণটা দেখো! যেন এই ঘরে আমি বাদেও অন্য লোকের উপস্থিতি আছে। লজ্জার রেশটা তখনও কাটেনি বলে চট করে রেগে যেতে পারলাম না। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে কী বলব তা বুঝতে পারছি না। শুধুমাত্র গান শুনবার জন্য ওর পিছনে সেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি এটা বলতে আত্মসম্মানে বাধছে। কিন্তু অন্য কিছু তো মাথায় আসছে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিশ্চয়ই আমার বলা উচিত। নইলে ছেলেটার কাছে সস্তা হয়ে যাব। আমার ব্যক্তিত্ব আমাকে আপাততঃ এর কাছে এতটা সস্তা হবার অনুমতি দিতে চাইছে না। একবার কেশে উঠলাম অপ্রস্তুতভাবে। তারপর ওর ঠিক উল্টো পাশে পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘তোমার প্ল্যানটা কী? ‘
—‘কীসের প্ল্যান?’
—‘না মানে… এভাবে কতদিন চলবে?’ পিয়ানোর কালো কাঠের ওপর বইটা রেখেছি আমি। আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করছি বইয়ের মলাটে। আমার চোখ অবনত। বুঝতে পারছি ও আমার দিকে চেয়ে আছে। এখন অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ খুব অল্প বয়স থেকে আমার পর্দা করা অভ্যাস।
—‘তোমার কি আমাদের বাড়িতে থাকতে খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে?’
—‘তোমরা কী ডিসিশন নিলে?’ প্রশ্নের উত্তর প্রশ্ন দিয়েই দিলাম।
—‘আমরা?’
—‘হ্যাঁ… তুমি আর শুভ্রা।
শিহাব কিছু বলছে না। চুপ করে আছে। দেয়াল ঘড়িতে টিকটিক শব্দে বয়ে চলেছে সেকেন্ডের কাঁটা। আমি এখনো মুখ নিচু করে বইয়ের ওপর আঁকিবুকি করছি। একটা মিনিট পরে শিহাব বলল, ‘আমাদেরটা আমরা বুঝব। তোমার যদি খুব বেশি সমস্যা হয় তাহলে এক কাজ করো বরং, তুমি কয়েকদিনের জন্য তোমাদের বাসা থেকে ঘুরে এসো। হয়তো ভালো লাগবে।’
শিহাব
রুশমি মুখটা এমনভাবে নিচু করে রেখেছে যে, ওই মুখের হালচাল বোঝার সাধ্য এখন আমার নেই। তবে আমি বুঝতে চাই ওর মনোভাব। বলেছি কয়েকদিনের জন্য বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। এটা কি যৌক্তিক কথা হয়েছে? নাকি ওকে আমার পুরোপুরিভাবে মুক্তি দেয়া উচিত? ও শুভ্রার কথা জানতে চাইছে। শুভ্রার ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেই পরিষ্কার নয়, ওকে কী বলব? তাছাড়া ওকে তো আমি কোনভাবেই বিরক্ত করছি না। সারাদিন বাড়িতে থাকি না বললেই চলে। শুধু রাতের কিছুটা সময় নিজের ঘরে কাটাই। তাও এমন কোন কাজ জ্ঞানত করি না যাতে তার কোন সমস্যা হতে পারে। এরপরেও চলে যাবার জন্য অত তাড়া কীসের?
—‘আর তুমি যদি চাও তাহলে তোমাকে আমি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিতে পারি। যে কোন সময়। তোমাকে শুধু আমাদের প্যারেন্টসদের ম্যানেজ করতে হবে।
রুশমি মুখ তুলে চাইলো, ‘প্যারেন্টস দের ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার একার?’
—‘না তোমার একার না। আমারও দায়িত্ব। তবে এই মুহূর্তে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তুমি তো জানো আমার দাদাজান খুব অসুস্থ। পাপা, মম নেক্সট উইকে দেশে যাচ্ছে। পাপার মন এমনিতেই খুব খারাপ। এই সিচুয়েশনে ডিভোর্সের ব্যাপারটা ওদেরকে জানাতে চাইছি না। ওরা ফিরে আসুক, তারপর বলব। তুমি কি ওদের ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে রুশানিয়া? নাকি তোমার খুব তাড়া?’
রুশমি কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল খানিক ক্ষণ মাথা নিচু করে। বইটার ওপর চোখ পড়ল। বইয়ের নাম Veronika decides to die । বইয়ের নামটা এমন কেনো? ও সারা দিন বাড়িতে একলা সময় কাটায়। মাথায় কোন আবোলতাবোল চিন্তা আসে নাতো আবার? ভাবলাম বইটা নিয়ে একটু আলাপ করব কিন্তু তার আগেই ও জায়গাটা থেকে সরে দাঁড়ালো। আমার বুক চিরে একটা নিশ্বাস পড়ল, দীর্ঘ হয়ে! রুশানিয়া হয়তো এ বাড়িতে আর থাকতে চাইছে না। না চাইলে… আমি নিশ্চয়ই ওকে জোর করব না। আশ্চর্য! জোর করার তো প্রশ্নই আসে না! ও আমাকে ঘৃণা করে… আর আমি ওকে তার চাইতেও বেশি রকমের ঘৃণা করি। এসব কথাতো হয়ে গেছে। বিয়েটাও চুকে বুকে গেছে মনের দিক থেকে অনেক আগেই। তাহলে এসব নিয়ে আর কেনো ভাবা মিছিমিছি?
আমার হাতের আঙুল ফিরে গেছে পিয়ানোর রিডে। ওদিকে সেলফোন বাজছে। শুভ্রার ফোন। এই মুহূর্তে কলটা ধরতে ইচ্ছে করছে না। সেলফোনের দিকে চেয়ে থেকে একটা গানের সুর গুনগুন করছি আমি অন্যমনস্ক ভাবে।
‘মনো দিল না বধূ …
মনো নিল যে শুধু …’
এই গানটা কেনো আমার মাথায় এসেছে কদিন আগে জানি না। এসেছে তো এসেছেই আর যাবার নাম নেই। ফোনটা বেজে যাচ্ছে। শুভ্রা অপেক্ষা করছে আমার জন্য ফোনের অপর প্রান্তে। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরছে গান….
পিয়া তোর অবুঝ হিয়া
খোঁজে কোন সবুজ টিয়া
দিতে চাস আমায় ফাঁকি
আমি কী নিয়ে থাকি
মনো দিল না বধূ
মনো নিল যে শুধু
আমি কী নিয়ে থাকি
মনো দিল না
রুশমি
সপ্তাহে তিনদিন আমি কফিশপে কাজ করি। আমাদের কফিশপটা দোতলা। সামনে খুব সুন্দর একটা প্যাটিও আছে। প্যাটিওতে কয়েক জোড়া সাজানো গোছানো টেবিল। গ্রীষ্মকালে এই টেবিল গুলোর একটাও খালি থাকে না। সারা বছর ব্রেকফাস্টের সময়টায় জমজমাট ভিড় হয়। আমাদের স্যান্ডউইচ তৈরী হয় হালাল মিট দিয়ে, তাই মুসলিম কাস্টমারের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে। কর্মময় তিনটি দিন ভালোই কাটে। কফির ঘ্রাণ আমাকে প্রাণবন্ত করে তোলে। নানা বয়সী খদ্দেরদের সাথে গল্প জমে যায়। এলিসা নামের একটি কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে, কাছাকাছিই ওর বাসা, প্রায় উইকেন্ডে বই হাতে নিয়ে আমাদের এখানটায় চলে আসে। ওর পছন্দ মোকা লাটে। ওর কফিটা আমিই বানাই যত্ন করে। বেশি করে মার্শমেলো আর চকলেট সিরাপ দিয়ে। এলিসা চুপচাপ বসে বই পড়ে আর কফিতে চুমুক দেয়। চলে যাবার আগে কিছুক্ষণ বই নিয়ে গল্প করে। শুধু নির্দিষ্ট কোন বই নয়, এলিসার রাজনীতিতেও খুব আগ্রহ। তার জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। কথা বলে আরাম পাওয়া যায়। আমিও রোজ একটা করে বই নিয়ে আসি। যখন কোন কাজ থাকে না, কাস্টমার থাকে না, তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়ি।
সেদিন ছিল ছুটির দিন। তারিখটা ফেব্রুয়ারির চার অথবা পাঁচ। ভিড়ের মাঝে আমি এলিসাকে দেখতে পাচ্ছি। ওর পাশে অপরিচিত একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। কাউন্টারের সামনে কাস্টমারের বিশাল লাইন। ব্রায়ান নামের একটি সাদা চামড়ার ছেলে নতুন যোগদান করেছে কাজে। সে এখনো অনেক কিছুই পারে না। রেজিস্ট্রার রান করা শেখেনি, কফি বানানোতেও ভুলভাল করছে। আম্মুজান সময় মতো এসে পড়ায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। গায়ে অ্যাপ্রন জড়িয়ে চট করে কাজে লেগে গেলো আম্মুজান। কাজ করতে করতেই একটু ফিসফিস করে আমাকে বলল, ‘তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি তো বাড়িতে নেই। আমার মনে হয় তোমার আজ তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।’
—‘এখন তো অনেক রাশ। একটু পরে যাই।’
—‘আমি ম্যানেজ করছি। প্রব্লেম নেই। তুমি যাও। ডিনারের মেনু কী তোমাদের?’
—‘জানি না তো!’
—‘তুমি কিছু একটা রান্না করতে পারো।’
আমি লাজুক গলায় বললাম, ‘আমি আবার কিছু রান্না করতে পারি নাকি?’
—‘তুমি তো বাসায় একবার বাটার চিকেন রান্না করেছিলে। আজকে ট্রাই করে দেখতে পারো।’
আমি উত্তরে কিছু বললাম না। শ্বশুরবাড়িতে আমি কখনোই কিছু রান্না করিনি এর আগে। প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু আমার শাশুড়ি যাবার আগে কিচেনের সমস্ত খুঁটিনাটি অর্থাৎ কোথায় কী রাখা আছে তা পইপই করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। তার কথার ধরণে মনে হয়েছে সে মনে মনে শতভাগ নিশ্চিত যে তার অনুপস্থিতিতে সংসারের হাল আমিই ধরব। এমনটা ধারণা করা অবশ্য খুব অস্বাভাবিক বা অন্যায় কিছু নয়। আমার যদি একটা স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন থাকতো তবে হয়তো এসব টুকটাক সাংসারিক কাজ করতে ভালোই লাগতো। কিন্তু এখন ব্যাপারটা অন্যরকম। আমি জানি যে ওই বাড়িতে আমি দুদিনের অতিথি। শিহাব জানিয়ে দিয়েছে ওর পাপা মম দেশ থেকে ফেরত এলেই ডিভোর্সের কথাটা তুলবে। আমিও চাই ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চুকেবুকে যাক। এসব মিথ্যে অভিনয় আর কতদিন চলবে?
অ্যাপ্রোন খুলে নিয়ে কাউন্টার থেকে বেরোনোর মুখেই দেখি এলিসা হাত নেড়ে ডাকছে আমায়। এগিয়ে গেলাম। ওর চুলে নতুন রং করেছে। আগে ছিল সবুজ, এখন বেগুনি। কোঁকড়ানো বেগুনি চুলগুলি ফুলেফেঁপে ছড়িয়ে আছে ঘাড়ময়। পাশে বসা ছেলেটিও কৃষ্ণাঙ্গ। বেশ লম্বা আর ছিপছিপে।
—‘ও হচ্ছে স্টিফান। তোমাদের ইন্ডিয়া নিয়ে একটা রিসার্চ ওয়ার্ক করছে সম্প্রতি। তুমি কি ওকে হেল্প করতে পারবে? আমার জানা মতে তোমার বাবা-মা ইন্ডিয়া থেকে এসেছে, তাই না?’
অবাক গলায় বললাম, ‘না ইন্ডিয়া থেকে না। তারা এসেছে বাংলাদেশ থেকে।’
স্টিফান হেসে বলল, ‘গ্রেট! আমি আসলে বাংলাদেশি একজনকেই খুঁজছিলাম। বাংলাদেশের লিবারেশন ওয়ার সম্পর্কে তুমি কিছু জানো?’
—‘তুমি ঠিক কী জানতে চাও?’
স্টিফান ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করতে করতে বলল, ‘তোমার কি দশটা মিনিট সময় হবে?’ আমি লক্ষ্য করলাম ছেলেটির কথা বলার ভঙ্গি অত্যন্ত অমায়িক এবং মার্জিত। শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে এই মার্জিত ভাবটা প্রায়শই প্রত্যক্ষ করা যায়। এদের কথাবার্তায় বুদ্ধি ঝিলিক দেয়। এদের মধ্যে যারা খারাপ এবং বখাটে তাদের দুর্নীতি সীমা অতিক্রম করে যায়। আবার যারা ভালো তাদের ভালোত্বের পরিধিও পরিমাপের অযোগ্য হয়ে দাঁড়ায়।
হাতের কব্জিতে বাঁধা অ্যাপল ওয়াচটার দিকে তাকালাম একবার, ‘আজ তো সময় হবে না। তবে মনে হয় আমার ড্যাড তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার চাইতে তার জ্ঞান বেশি।’
—‘সে কি একজন ফ্রিডম ফাইটার ছিল?’
—‘না সে ফ্রিডম ফাইটার ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স অতি অল্প ছিল। তবে তার বড় ভাই অর্থাৎ আমার আঙ্কেল মুক্তিযোদ্ধা ছিল।’
ব্রায়ানের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল, ‘দারুণ খবর! তুমি কি তোমার ড্যাডের সাথে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করে দিতে পারবে?’
—‘নিশ্চয়ই, তোমার ফোন নম্বরটা দাও।’
শিহাব
আজ ছুটির দিন। পাপা মম গতকাল বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছে। রুশমির উইকেন্ডে কাজ থাকে। খুব সকালে ও বেরিয়ে গেছে। জাহিদ গেছে ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে। অতএব সারাদিন আমি বাড়িতে একা। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠেছিলাম। ব্রেকফাস্ট সেরে বাড়ির সামনে জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করলাম। লন্ড্রি করলাম। বেজমেন্টের পূর্ব দিকের দেয়ালটার অনেকাংশের আস্তর খসে গেছে। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম সময় পেলে দেয়ালটা মেরামত করব। সরঞ্জাম সব কেনা আছে। আজকে আর কোন ব্যস্ততা ছিল না বিধায় কাজটা সেরে ফেললাম। এসব করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে গেলো। লাঞ্চের পরের অনেকটা সময় কাটল উইলো ফরেস্টে, ক্রিকের ধারে। গত দুদিন তুষারপাত হয়নি। তবে ওয়েদার ফোরক্যাস্ট বলছে কাল সকালে টানা কয়েকঘণ্টা তুষার ঝড় হবে। আমি মোটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে পাথরের ওপর বসে রইলাম চুপচাপ। আজকাল একলা থাকতে ভালো লাগে না। একাকী মুহূর্তগুলোতে দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসে। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেই শান্তি। উইকেন্ডে সাধারণত কনসার্ট টনসার্টে যাওয়া হয় বন্ধুদের সাথে। এই সপ্তাহে সেরকম কোন প্ল্যান নেই।
ক্রিকের পানি তীব্র শীতের ভেতরেও কুলকুল করে বয়ে চলেছে বিরামহীন ভাবে। আমার প্রিয় ড্রিমি চেরি ফেয়ারি এখন মৃত। অল্প কিছুদিন পরেই ওর ডালপালা ভরে উঠবে মুক্তো দানার মতো অসংখ্য গোলাপি রঙের চেরিফুলে। আমার মনটা বসন্ত বসন্ত করছে। এই শীতের রুক্ষতা আর ভালো লাগছে না। শুভ্রা অফিশিয়াল ট্যুরে গেছে গত পরশুদিন। আমার নিজেরও একটা ট্রেনিং এর উদ্দেশ্যে জাপান যাবার কথা। এখনও দিন ক্ষণ ঠিক হয়নি। পাপা মম যেহেতু অনেকদিন পর দেশে গেছে তাই অন্তত মাস খানেকের আগে আর ফিরবে বলে মনে হয় না। আমার চিন্তা জাহিদকে নিয়ে। এই ছেলেকে খুব বেশি ফ্রিডম দেয়া যাবে না কোন মতেই। মাস দেড়েক আগের এক রাতে ওকে আমি ম্যারুয়ানা সহ পাকড়াও করেছিলাম জঙ্গলের ভেতর। বন্ধুদের সাথে বসে মহা আনন্দে গাঁজা টানা হচ্ছিল। সেই থেকে সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসা ওর জন্য বাধ্যতামূলক। ভাবছি আমাকে নেহাত চাকরির খাতিরে দেশের বাইরে যেতে হলে, জাহিদটার কী হবে? শ্বশুর-শাশুড়ির জিম্মায় রাখা যায় কয়েকটা দিন। আমি জানি ও খুব রেগে যাবে। আক্রোশে ফেটে পড়ে বলবে, আমার বয়স এখন উনিশ। তোমাদের কোন অধিকার নেই আমাকে এভাবে কন্ট্রোল করার। রুশমিকে এ কদিনে যতটা চিনেছি তাতে মনে হয়েছে আমি বাদে জগতের প্রতিটা মানুষের জন্যেই ওর অন্তরে মায়ার নহর আছে। পাপা, মম এবং জাহিদের প্রতি সে যথেষ্ট কেয়ারিং। হয়তো আমার অনুপস্থিতিতে সে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই জাহিদের টেক কেয়ার করবে।
কয়েকটা গাছের গুঁড়ি কেটে নিলাম কাস্তে দিয়ে। আমাদের বেজমেন্টের ফায়ারপ্লেসটা গ্যাস কিংবা বিদ্যুতে চলে না। কাঠ দিয়েই আগুন জ্বালাতে হয়। এসব কাঠ কিনতে পাওয়া যায়, কিন্তু যেখানে ফ্রিতে জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করতে পারছি সেখানে অযথা পয়সা খরচ করা কেনো? বেজমেন্টে হিটিং ঠিকমতো পৌঁছোয় না বলে মাঝে মাঝে ফায়ারপ্লেস ব্যবহার বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। সন্ধ্যের মুখে মুখে বাড়ি ফিরলাম। রুশমি ফিরেছে কিনা কে জানে! আমার মন বলছে আজ হয়তো সে এ বাড়িতে আর ফিরবে না। কফিশপ থেকে বাবার বাড়ি চলে যাবে। যেখানে খুশি যাক, আমার কী! একটা মেয়ে সারাক্ষণ চোখের সামনে মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা দেখতেও তো খারাপ লাগে। ও বরং নিজের বাড়িতেই ফিরে যাক। ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক!
আগেও বলেছি, স্মৃতি খুব আশ্চর্য জিনিস। অনেকসময় স্মৃতি আমাদের বন্ধ চোখের দুয়ার খুলে দেয়। এমন কিছু জিনিস দৃষ্টিগোচর করে তোলে যা চলমান সময়ে বুঝেও আমরা না বোঝার ভান করি, এড়িয়ে চলি। আজকে এই দু হাজার বিশ সালের গ্রীষ্ম বিকেলে, ম্যানহাটনের অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনিতে… সাশার পাশে নিশ্চুপ বসে থেকে আমি দু হাজার পনেরো সালের সেই শীত সন্ধ্যেটা চোখের সামনে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। সাশা কাজ সেরে আসার সময় চুরোজ নিয়ে এসেছে। সাথে স্টারবাক্সের কফি। একটু আগে খুব এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনের লেক পানিতে টইটুম্বুর। ভেজা বাতাস নিশ্চিন্তে উড়ে বেড়াচ্ছে বহুতল ভবনের বারান্দায়। সাশা কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর গভীর মনোযোগের সাথে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি চুরোজে কামড় বসাচ্ছি। চেয়ে আছি সাশার সবুজ চোখের দিকে। চেয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু আমি আসলে ওকে দেখছি না। আমি দেখছি দু হাজার পনেরো সালের ফেব্রুয়ারির এক শীত সন্ধ্যা। আমাদের অ্যাশবার্নের দোতলা বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ডে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। আমার কাঁধে কয়েকটা কাটা গাছের গুঁড়ি। ওয়াক আউট দরজার সামনে গাছের গুঁড়িগুলো নামিয়ে রেখেছি। আমার পরনে একটা কালো রংয়ের জ্যাকেট। মাথায় হুডি। আমি ভাবছি রুশমি বাপের বাড়ি চলে গেলেই ভালো হবে। আমিও বাঁচব, সেও বাঁচবে। ওর চলে যাওয়াটা আমাদের দুজনের জন্যই মঙ্গলজনক। মহাকালের মনিটরে চোখ রেখে, আজ আমি চব্বিশ বছরের শিহাবের কপালে স্পষ্ট কয়েকটা কুঞ্চন রেখা দেখতে পাচ্ছি। ওই কুঞ্চন রেখার পেছনের কারণটা এতদিন পরে এসে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। মনের অনেক গভীরে…। আমি আসলে ভাবছিলাম রুশমি চলে গেলে আমার দিন শুরুর রুটিনটা পাল্টে যাবে। আমার যে রোজ ঘুম থেকে উঠে ওকে দেখার অভ্যাস! গত চল্লিশ দিনে একবারের জন্যও এই রুটিনের হেরফের হয়নি। এখন রুশমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে, আমার যদি ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ওকে একটা বারের জন্য দেখতে খুব ইচ্ছে করে… তখন কী হবে?
রুশমি
বাড়ি পৌঁছুলাম ভর সন্ধেবেলায়। চাবি দিয়ে তালা খুললাম। ভেতরে ঢুকে দেখি পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। সুনসান নীরব। এরা দুই ভাই গেছে কই? চট করে ড্রইং রুমের বাতি জ্বালালাম। শিহাব কি বাড়িতে নেই নাকি? কাঁধের ব্যাগটা কাউচের ওপর রেখে এক দৌড়ে দোতলায় উঠে এলাম। বেডরুম ফাঁকা। সারাটা রাস্তায় এই দুশ্চিন্তাটাই কুরেকুরে খাচ্ছিল আমাকে। কেনো যেন মনে হচ্ছিল বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে দুই ভাই কোন না কোন বাহানায় বাইরে বেরিয়ে গেছে। শিহাবের কান্ডটা দেখো। আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সেই খবরটা একবার নেবার প্রয়োজন বোধ করল না। এতো নিষ্ঠুর এই ছেলেটা! মানুষের তো বাড়ির পোষা কুকুরের ওপরেও মায়া জন্মায়। আচ্ছা আমি কি কুকুরের চেয়েও অধম?
করিডোর আর সিঁড়িঘরের সব কটা বাতি একের পর এক জ্বালিয়ে দিলাম। ঘড়িতে পৌনে ছটা বাজে। জাহিদের সন্ধ্যের আগে বাড়ি ফেরার কথা। কোনো খবর নাই এখনো। আর এই শিহাব গেছে কোথায়? শুভ্রার ফ্ল্যাটে গিয়ে বসে নেই তো আবার? আমার শাশুড়ি দেশ ছেড়েছে দুদিনও হয়নি এখনো। এর মাঝেই এত অনিয়ম? সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম দুই ভাইকে। না পেয়ে দিশাহারা লাগতে লাগলো। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলাম। ডাইনিং রুম সংলগ্ন বেজমেন্টের দরজার কাছে কান পেতে শুনলাম নিচ থেকে মিউজিক শোনা যায় কিনা। মিউজিক চলতে থাকলে বুঝতে হবে শিহাব বাড়িতে আছে। ওয়ার্কআউট করছে। কানে কোন শব্দ এলো না। নিচের তলায় পিনপতন নীরবতা
ইশ এতো রাগ হচ্ছে আমার যে কী বলব! অথচ রাগ করার মতো তেমন কোন যুক্তিযুক্ত কারণ নেই। ওদের কেউ আমাকে কথা দেয়নি যে সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফিরে আসবে। আমিই ব্যাক্কলের মতো ধরে নিয়েছিলাম যে বাড়ি ফিরেই ওদের দেখা পাবো। ডিনারে কী রান্না করব সেটা নিয়েও মনে মনে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি আসলেই একটা আস্ত রাম ছাগল। কাজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছি। যেন আমার জন্য বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করে আছে! এ যেন আমার অনেকদিনের পুরোনো সংসার। কী ভীষণ বোকামি! শিহাব নিশ্চয়ই শুভ্রার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে বসে আছে। অসভ্য একটা ছেলে! বাবা-মা দেশ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটিং শুরু হয়ে গেলো! রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে। চুল তো ছিঁড়লাম না, কিন্তু একটানে হিজাবটা খুলে ফেললাম। তখনো দাঁড়িয়ে আছি বেজমেন্টের দরজার সামনে। হিজাবটা খুলে হাতে নিয়েছি। ঠিক সেই সময় দরজাটা কেউ একজন ভেতর থেকে খুলল, সশব্দে। একলা নীরব বাড়িতে ওই আকস্মিক নড়ে ওঠা দরজা রীতিমতন চমকে দিল আমাকে। গলা দিয়ে নিজের অজান্তেই একটা আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো।
চিৎকার দিয়ে এক পা পিছিয়ে এসেছি আমি। বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে। তাকিয়ে দেখি দরজার ফাঁক গেলে একটা মাথা বেরিয়ে এসেছে জিরাফের মতো। বাদামি একজোড়া চোখ বিস্ময় নিয়ে দেখছে আমাকে। যেন আমি কোন চিড়িয়াখানার বস্তু। এরকম আজব বস্তু ওই বাদামি চোখের তারাদ্বয় বুঝি এর আগে কোনদিন অবলোকন করেনি। আমি এতো ভয় পেয়ে গেছি যে কোন কথা বলতে পারছি না। বিস্ফারিত চোখে শুধু চেয়ে আছি। বুক ধড়ফড় করছে। গলা তেষ্টায় চৌচির।
—‘তুমি ঠিক আছো?’
—‘এভাবে কেউ আসে নাকি?’ হাঁপানি রোগীর মতো ধুঁকে ধুঁকে বললাম।
—‘কীভাবে আসার কথা ছিল?’ লম্বা মানুষটা নির্বিকার গলায় প্রশ্ন করে।
—‘আশ্চর্য! তোমার পায়ের কোন শব্দ পেলাম না যে!’
বাদামি চোখজোড়া বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকল। তারপর কী মনে করে যেন হেসে উঠলো নিঃশব্দে। গালের চামড়ায় ভাঁজ পড়া অসহ্য হাসিটা।
—‘আমি তো হেঁটে আসিনি। উড়ে উড়ে এসেছি। তাই শব্দ পাওনি।’
—‘ফাজলামো হচ্ছে?
—‘ফাজলামো না। সত্যি! জাহিদ নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে যে, এ বাড়িতে একটা ভূত আছে। আমিই সেই ভূত। অশরীরীরা নিঃশব্দে চলাফেরা করে। তাই তুমি আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পাওনি।’
ফাজিল ছেলেটার ফাজিল কথায় আমার নিশ্চয়ই রেগে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি রাগতে পারছি না। উল্টো আমার মনটা হঠাৎ কানায় কানায় ভরে গেছে। যেন মধ্য সমুদ্রের উত্তাল জলোচ্ছাসের মুখে হঠাৎ একটা দ্বীপের দেখা পেয়েছি। ওই দ্বীপ চোখের সামনে জেগে না উঠলে জ্বলোচ্ছাস আমায় নির্ঘাত ডুবিয়ে দিত, ভাসিয়ে নিত। দরজার সামনে থেকে সরে এসেছি তখন। বুকের ওপর জমে থাকা বরফের চাইয়ের মতো কঠিন রাগটা ঝপ করে নেমে গেছে। মনের অলিন্দে যেন শীতসকালের মিষ্টি এক ফালি রোদ এসে পড়েছে। আরাম লাগছে। হালকা একটা ফুরফুরে ভাবে ছেয়ে গেছে ভেতরটা। ও শুভ্রার অ্যাপার্টমেন্টে যায়নি। এটাই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম খবর এই মুহূর্তে। আমার মন চাইছে এই খবরটা চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে শুনিয়ে দেই। যদিও নিজের কাছেই নিজেকে বড় বেশি দুর্বোধ্য বলে মনে হচ্ছে। যে মানুষটা সচেতন অবস্থায় সর্বক্ষণ আমার গাত্রদাহের কারণ, অবচেতনে তারই উপস্থিতি আমাকে মানসিক বিশাম দিচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীরা মন চরাচরের এই দ্ব্যর্থব্যঞ্জক জটিল পরিস্থিতির কী নাম দেবেন?
.
—‘জাহিদ কোথায়?’ গায়ের জ্যাকেট খুলে নিতে নিতে প্রশ্ন করলাম, ওর দিকে না তাকিয়েই।
—‘নো আইডিয়া। কল করে দেখি।’ কথাটা বলে ও আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো ড্রইং রুমে। আমি চেয়ারে বসে জুতো খুললাম। উত্তেজনার বশে জুতো নিয়েই পুরো বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছি। ভুল হয়ে গেছে। আমাকেই তো পরিষ্কার করতে হবে। নিজের দোষেই কাজ বাড়ল।
ড্রইং রুমে এসে দেখি শিহাব কাউচের ওপর বসেছে, পায়ের ওপর পা তুলে। হাতে রিমোট। আমাকে দেখতে পেয়েই বলল, ‘জাহিদের সাথে কথা হয়েছে। হি ইজ অন দ্যা ওয়ে।’
–‘পারফেক্ট।’ বললাম ছোট্ট করে। শিহাব কথাটা বলেই টিভির দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। আমি দেখলাম ও কালো ট্রাউজারের সাথে একটা বটল গ্রিন রংয়ের নির্ভানার টি-শার্ট পরে আছে। ও হয়তো নির্ভানা ভালোবাসে। আমারও অপছন্দের নয়। কদিন ধরে একটা সূক্ষ্ম ব্যাপার টের পাচ্ছিলাম। অন্যমনস্ক, আনমনা শিহাবকে চুপ করে চেয়ে দেখতে আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে ও যখন গভীর মনোযোগের সাথে পিয়ানো বাজায় তখন। ওর চাবুকের মতো ধারালো চোয়াল, প্রশস্ত বুক, সুগঠিত পেশী, মেদহীন কোমর এই সমস্তটাই আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে পুরুষরাও দৈহিকভাবে অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী হতে পারে।
—‘খাবার অর্ডার করছি। তুমি কী খাবে?’
ধ্যান ভাঙলো আমার। একটু অপ্রস্তুত গলায় বললাম, ‘না… অর্ডার করবে কেনো? আমি কিছু রান্না করব।’
শিহাব চোখ তুলে তাকালো।
—‘খাওয়া যাবে?’
—‘খেয়ে দ্যাখো।’
—‘থাক। তোমার কষ্ট করতে হবে না। সারাদিন কাজ করেছ। ইউ মাস্ট বি টায়ার্ড। কী খাবে বলো, আমি অর্ডার করে দিচ্ছি।’
একটু সময় চুপ করে রইলাম। ঘরদোর নোংরা হয়ে আছে। আমার শাশুড়ি গতকাল চলে যাবার পর থেকে কিছুই আর ক্লিন করা হয়নি। অতএব রান্নার কাজটা যদি না করতে হয় তাহলে একদিক দিয়ে বাঁচোয়া। সেই সময়টুকু আমি ঘর পরিষ্কার করায় ব্যয় করতে পারব।
—‘আমি হালাল হারাম ফলো করি। সো এনিথিং হালাল ইউ ক্যান অর্ডার।’
—‘ওকে, সাউন্ডস গুড।’
—‘জাহিদকে আস্ক করে দেখতে পারো ও কী খেতে চায়।’
— জাহিদ ডিনার করে আসছে।’
—‘ও!’
শিহাব মোবাইলের স্ক্রিনে মুখ নামালো। আমি বুঝতে পারছি না এখন আমার ঠিক কী করা উচিত। টিভিতে ফুটবল খেলা চলছে। আমার ফুটবলে বিন্দু মাত্র ইন্টারেস্ট নেই। কেনো যেন অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে আছে ভেতরটা I এর আগে কখনো একলা বাড়িতে ওর সাথে আমার থাকা হয়নি। আজকেই প্রথম আমরা স্বাভাবিক ভাবে একজন আরেকজনের সাথে কথা বললাম। ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাই ঘুরে দাঁড়ালাম। আর দাঁড়ানো মাত্রই ডাকটা কানে এসে লাগলো।
—‘রুশানিয়া!’
বুক কাঁপে… জানি না কেনো ওই ডাকটা শুনলে আজকাল আমার প্রবল ভাবে বুক কাঁপে!
—‘জি’ ঘুরে তাকালাম।
—‘এক গ্লাস পানি দিতে পারবে?’ ও মোবাইলে চোখ রেখেই অনুরোধ করল।
—‘শিওর।’
সেই প্রথম ও আমার কাছে কিছু চাইল। আপন লোকের মতো। আমার ভেতরটা বিবশ হয়ে আছে। কোন অনুভূতি টের পাচ্ছি না এই মুহূর্তে। তবে এই অনুভূতিহীন সময়টা কোন এক অজানা কারণে আমার খুব ভালো লাগছে! যত্নের সাথে পরিষ্কার একটা গ্লাসে ফিল্টার থেকে পানি ঢেলে নিলাম ড্রইংরুমে এসে দেখি শিহাব তখনও মোবাইলের স্ক্রিনে মুখ নামিয়ে রেখেছে। আমি ওর সামনে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছি। ও মুখ উঁচু করে তাকিয়েছে আমার দিকে। সিলিং এ ঝুলে থাকা ঝাড়বাতির একরাশ হলুদাভ আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। বাদামি চোখদুটো আমার চোখের ওপর নিবদ্ধ, নিশ্চল! কী কারণে জানি না… আমার নিশ্বাস তখন থমকে গেছে! বিচলিতভাবে অস্ফুটে একবার বললাম, ‘পানি!’
আর ঠিক সেই মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম আমার হাতে ধরা পানির গ্লাসটা থরথর করে কাঁপছে!
শিহাবের চোখ সরে এসেছে আমার হাতের ওপর। আমার হাত কাঁপছে তো কাঁপছেই! এই অনর্থক কাঁপাকাঁপির কারণ কী? নিজের ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এই মুহূর্তে। চোখের সামনেটা ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে রাগে। দেখতে পেলাম সামনে বসা বাদামি চোখের ছেলেটার ঠোঁটের দুই কোণে একটা চাপা হাসি বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিচ্ছে। তড়াক করে মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গেলো। এখানে হাসির কী আছে? আমি কি কমেডি শো করছি নাকি?
—‘পানি!’ দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করলাম শব্দটা
ও আর একটুও সময় নষ্ট না করে আমার হাতের ওপর হাত রাখলো। স্পর্শটা টের পেয়ে কাঁটার মতো কী যেন একটা বিঁধল আমার বুকে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম ওর দিকে, তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, ‘আমার হাত ধরেছ কেনো?’
ওর ঠোঁটের হাসিটা তখনও মুছে যায়নি, আমার হাতে হালকা একটু চাপ দিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ঠিক আছ?’
—‘ঠিক আছি!’ অনেক কষ্টে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বললাম।
এবার গ্লাসটা হাতে তুলে নিল শিহাব। ঠোঁটের হাসিটা জোরালো হয়েছে। হাসি নিয়েই গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমার মুখে সার্কাস শো চলছে। ঠিক কতক্ষণ সময় নিয়ে ও এক গ্লাস পানি চুমুক দিয়ে পান করেছিল সেদিন? মনে নেই। তবে মনে আছে পানি খাবার পুরো সময়টুকু আমি এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম বোকার মতো। দাঁড়িয়ে থাকার কোন সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। অনায়াসে জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার ডান হাতের উল্টো পিঠে, যেখানে ওর হাতের ছোঁয়া লেগেছিল একটু আগে, সেই জায়গাটা অপর হাত দিয়ে চেপে ধরে ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে আছি আমি। ও গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আমাকেই দেখছে। আমি ভাবছি ওর হাতের চামড়া এতো খসখসে আর রুক্ষ কেনো? কী করে ওই হাত দিয়ে? ইট ভাঙে নাকি? ছেলেদের হাতের ত্বক কি এমনই হয়? কই আমার বাবাজানের হাত তো এতো শক্ত নয়।
ও পানি খাওয়া শেষ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। কয়েক পা হেঁটে এসে গ্লাসটা নামিয়ে রেখেছে সেন্টার টেবিলের ওপর। তারপর ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে ড্যামকেয়ার ভাবে প্রশ্ন করছে, ‘তোমার হাত কাঁপছিল কেনো?’
গোল ডিম শেপের সেন্টার টেবিলটার এক প্রান্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আরেক প্রান্তে শিহাব। আমাদের মাথার ওপর একটা ফুলের মতো বিশাল আকারের ঝাড়বাতি ঝুলে আছে। আমি ঝাড়বাতির হলুদ আলোয় ওর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। প্রশ্নটা আমাকে বিচলিত করে তুলেছে। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। অথচ আমিও ভীষণভাবে জানতে চাই উত্তরটা। কিন্তু এই ছেলেটার সামনে কিছুতেই বেকায়দায় পড়তে চাই না আপাতত। নিজের সম্মান রক্ষার্থেই আমাকে স্ট্রং থাকতে হবে।
গলায় নির্বিকার ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললাম, ‘হাত কেনো কাঁপছিল সেটা হাতই জানে। আমি কী করে বলব? হাতকে প্রশ্ন করো!’
এই কথায় ওর ঠোঁটের বিদ্যুৎ হাসিটা ফিরে এসেছে। দুই গালে ভাঁজ ফেলে হাসতে হাসতে মেঝের দিকে চোখ নামিয়েছে ও। আমি হাসিটার দিকে চেয়ে আছি আর মনে মনে বলছি, কেনো তোমাকে এতো সুন্দর করে হাসতে হবে শিহাব? বেশি সুন্দর জিনিস আমার সহ্য হয় না। দম বন্ধ হয়ে আসে! তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও?
মনের কথা মনেই রইল। মুখে বললাম, ‘হাসির কী আছে?’
শিহাব চোখ তুলে তাকিয়েছে, ‘হাসির কী আছে তা হাসিই জানে। আমি
কী করে বলব? হাসিকে প্রশ্ন করো!’
—‘আমাকে নকল করছ কেনো?’
—‘নকল করলাম কোথায়? শিখলাম!’
—‘কী শিখলে?’
—‘কথা এড়িয়ে যাওয়া।’
—‘আমি কথা এড়িয়ে গেছি?’
—‘সেরকমই তো মনে হলো!’
—‘সেরকম কেনো মনে হলো?’
—‘কী জানি!’ ওপরের পাতলা ঠোঁট দিয়ে নিচের পুরু ঠোঁট ঢেকে ফেলে উদাস গলায় বলল শিহাব। ওর ঠোঁটজোড়া দেখলে আমার স্টেসির বলা একটা কথা খুব মনে পড়ে। এই মুহূর্তেও মনে পড়ছে। কিন্তু সেই কথাটা আমি কাউকে বলব না। ওটা শুধু আমার আর স্টেসির মধ্যেই থাক।
শিহাব
রুশমি সাদা আর পিচ রংয়ের মিশেলের টি-শার্ট পরে আছে। উপরে একটা ঢোলা ফর্মাল শার্ট ছিল। যেটা একটু আগে ও খুলে রেখেছে। এখন লম্বা চুল দুই কানের পাশ ঘেঁষে বুকের ওপর এসে পড়েছে। জন্ম কাজল পরা চোখজোড়ায় তেজের শিখা জ্বলছে দপদপ করে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো তেজের আগুনও ওই ঐশ্বরিক চোখে প্রবেশ করে স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। অগ্নি স্ফূরিত হওয়া অলৌকিক সুন্দর চোখ দুটি দেখতে আমার ভালো লাগছিল। আমি ভাবছিলাম লোকে ভালো লাগার জন্য কতকিছুই না করে এক জীবনে! কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করেও শেষ অবধি অনেকেই কাঙ্ক্ষিত সেই ভালোলাগার দ্বার প্রান্তে পৌঁছতে পারে না। এদিকে আমি কী ভাগ্যবান দ্যাখো! আমার কিছুই করা লাগছে না। নিজের বাড়ির ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে আছি নিশ্চিন্তে, আর আমার চোখের সামনে উপস্থিত আছে জীবন্ত এক ভালোলাগা! অনেকটা গানের মতো। গান গাইতে আমার অহেতুক ভালোলাগে। এই মুহূর্তে রুশমির রাগী মুখটার দিকে চেয়ে থেকে গানেরই মতো এক অহেতুক ভালোলাগায় মনটা কুলকুল করে ভরে গেছে। এই ভাবনা ভেতরে ভেতরে চমকে দিচ্ছে আমাকে। কারণ বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ নিজের ভাগ্যকে ক্রমাগত দোষারোপ করে আসছিলাম। অথচ এখন মনে হচ্ছে ভাগ্য তারকা এই পরীর মতো সুন্দর মেয়েটাকে আমার জীবনে নিয়ে না এলে আমি কখনোই জানতাম না যে ভালোলাগার জন্য সব সময় হাওয়া বদল, টাকা ওড়ানো কিংবা গান গাওয়াই আবশ্যিক নয়। হঠাৎ হঠাৎ কিছু জিনিস এমনিই ভালোলেগে যেতে পারে। আর এরকমটা হয় শুধুমাত্র ভাগ্যবানদেরই সাথে!
—‘তুমি আমার হাত ধরলে কেনো তখন?’ ক্যাটক্যাট করে প্রশ্নটা করল রুশমি।
—‘তোমার হাত ধরা যাবে না এটা কোন আইনে লেখা আছে?’
—‘চান্স পেয়েই একটা মেয়ের হাত ধরে ফেললে ফট করে? কী অসভ্য!’
—‘মেয়ে কোত্থেকে আসলো আবার এখানে?’
—‘আমাকে কি তোমার মেয়ে বলে মনে হয় না?’
—‘তুমি তো একটা পিচ্চি!’
—‘আমি পিচ্চি?’ রুশমির দুটি হাত তখন আপনাআপনি উঠে গেছে ওর পাতলা সরু কোমরে।
—‘হ্যাঁ। বয়সে তো তুমি আমার কিছু ছোটই হবে। সাইজেও ছোট। মানুষটাই ছোট!’
ওর মুখটা অপমানে একটু খানি হয়ে গেলো।
—‘মোটেও আমি ছোট না। আমি… আমি ঠিকই আছি।’ বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা দিল সে।
—‘তাই নাকি?’
—‘হ্যাঁ। ঠিক তাই… অ্যাটলিস্ট তোমার মতো জায়ান্ট না।’
—‘আমি জায়ান্ট?’
—‘হ্যাঁ জায়ান্ট। দৈত্য একটা পুরা।’
হেসে ফেললাম। রুশমি তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠল, ‘যখন তখন হাসবা না খ্যাকখ্যাক করে। তোমার হাসি আমার অসহ্য লাগে!’
ও কথাগুলো বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। ফর্সা গাল টমেটোর মতো লাল দেখাচ্ছে এখন। চিবুকটা সিলিং এর দিকে একটু উঁচু করা। নাকের পাটা ফুলে ঢোল। এদিকে আমি হাসি থামাতেই পারছি না। মেয়েটাকে রাগাতে পেরে আমার মজা লাগছে। নিজের মানসিকতায় নিজেই অবাক হচ্ছি। অন্যের কষ্টে আত্মপ্রসাদ লাভ করছি। এটা মোটেও কোন সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ নয়!
রুশমি ওর টমেটোর মতো লাল মুখ নিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে এখন। আগুন গলায় বলছে, ‘আমাকে পিচ্চি বললে কেনো? কোন দিক দিয়ে পিচ্চি মনে হয় আমাকে তোমার?’
আমি ওকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলাম। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম, ‘হাইট কত? পাঁচ ফিট হবে?’
—‘ফাজলামো হচ্ছে?’
—‘ফাজলামো কেনো? তোমাকে দেখতে তো পাঁচ ফিটেরও কম মনে হয়।’
—‘আচ্ছা? আর কী কী মনে হয় তোমার আমাকে দেখে?’
—‘মনে হয় পনের ষোল বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে। আন্ডার ওয়েইট। ম্যালনিউট্রেশনে ভুগছ।’
রুশমির চোখজোড়া বোতামের মতো গোল হয়ে গেছে। আরেকটু হলে কোটর থেকে বেরিয়ে যাবে। আমি কথাটা বলে শেষ করে ধীরেসুস্থে কাউচের
কাছে ফিরে এসেছি। রুশমি দাঁত কিড়মিড় করে বলছে ‘তুমিই প্রথম। যে আমাকে নিয়ে এমন কিছু বলল। এর আগে কোন ছেলে আমাকে এসব কথা বলেনি।’
আমি পায়ের ওপর পা তুলে বসলাম। হাতে টিভির রিমোট নিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললাম, ‘তাই নাকি? কী বলে ছেলেরা তোমার সম্পর্কে?
—‘বলে…’
একটু থামল রুশমি। কথার মাঝে ঘনঘন ব্রেক নেয়াটা মনে হয় ওর অভ্যাস।
—‘কী বলে?’ আমি ওর চোখে চেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো প্রশ্ন করলাম।
—‘বলে আমি অনেক সুন্দর।’
হাসিটা এবার রুখতে পারলাম না। হাসতে হাসতে বললাম, ‘যেসব ছেলেরা এসব বলে তাদের রুচি সম্পর্কে আমার ডাউট আছে।’
.
মুখে বললাম ঠিকই কিন্তু মনে মনে আমি জানি যে, ওরা ভুল কিছু বলে না। রুশানিয়াকে যে পুরুষ সুন্দর বলবে না, সে কোন পুরুষই না। আমি কথাটা বলে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম টিভির দিকে। ও কিছু বলছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছে কে জানে!
রুশমি
আমার এই সাড়ে একুশ বছর বয়সের জীবনে এতটা অপমান আমাকে এর আগে কেউ করেনি। অপমানের হিংস্র ছোবল কলিজায় লেগে গেছে। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলছে। ধোঁয়া বেরোচ্ছে দুই কান দিয়ে ভসভস করে। অসভ্য ছেলেটা নির্লিপ্তভাবে টিভি দেখছে এখন। আমার মন চাইছে ওর মাথাভর্তি ছোটছোট চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলি কিংবা রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে এসে সোজা ঢুকিয়ে দেই পেটের মধ্যে। নাগিনের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম, ‘তুমি নিজেকে কী ভাবো হ্যাঁ?
শিহাব টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই ড্যাম কেয়ার গলায় বলল, ‘টল, হ্যান্ডসাম অ্যান্ড চার্মিং!’ এটুকু বলে শেষ করে ও ঘুরে তাকালো আমার দিকে, শ্রাগ করে বলল, ‘এগুলো আমার কথা না, মেয়েরা বলে!’
আমি দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললাম, ‘যেসব মেয়েরা এসব বলে তারা বোকা আর বাজে। আর এসব বাজে মেয়েদেরকে ইমপ্রেস করার জন্যই তো তুমি সারাদিন বানরের মতো লাফঝাঁপ করে এরকম জায়ান্ট মার্কা বডি বানিয়েছ। শেইম অন ইউ!’
আমার কথাগুলো শুনে ও কেনো যেন খুব হাসতে লাগলো। আমি জানি এই মুহূর্তে রেগে যাওয়া একেবারেই উচিত হচ্ছে না। কারণ আমার রাগ এই অসভ্য ছেলেটাকে আনন্দ দিচ্ছে। সব জেনে বুঝেও আমি রাগটাকে দমন করতে পারছি না। আমার কলিজায় ক্যাকটাসের কাঁটা ফিরে এসেছে। ওখানে মনে হয় রক্তক্ষরণ হচ্ছে এখন। ছেলেটা একটু আগে কী বলল? আমাকে মেয়ে বলে মনে হয় না? এটার মানে কী? এ কারণেই কি এতগুলো দিন একই ঘরে রাত কাটানো সত্ত্বেও, ও আমাকে একটাবারের জন্যেও ছুঁয়ে দেখতে চায়নি? আমি কি দেখতে এতই খারাপ? তাহলে লিও কেনো আমাকে চুমু খেয়েছিল? কেনো ‘ক’ ভাইয়া ( আমার দুঃসম্পর্কের কাজিন) বলেছিল যে আমার চোখ দেখলে ওর সমুদ্রের কথা মনে হয়? আরো যেসব পুরুষ, যাদের চোখে আমি নিজের জন্য মুগ্ধতা দেখে এসেছি এতকাল তাদের সবার তাহলে রুচি খারাপ?
শিহাব আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে, ভ্রু নাচিয়ে বলছে, ‘কী হলো?’
—‘তুমি খুবই… খুবই ফালতু একটা মানুষ।’ রাগে জ্বলতে জ্বলতে বললাম কথাগুলো। খেয়াল করলাম কেউ একজন দরজা নাড়ছে। মাথার ওপর জ্বলন্ত উনুন নিয়েই সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। নিশ্চয়ই জাহিদ এসেছে। কিন্তু দরজা খুলে যাকে দেখলাম তাকে দেখবার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না এই অসময়ে। সাশা দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা লম্বা কালো কোট। মাথায় হুডি। সবুজ চোখ দুটি মেলে নির্বাক চেয়ে আছে আমার দিকে। চেয়ে আছি আমিও। কোনও এক অজানা কারণে এই মেয়েটিকে আমার ভালোলাগে না। অথচ বেচারি কথা বলতে পারে না, কানেও শুনতে পায় না। ওর প্রতি তো আমার মায়া হওয়া উচিত ছিল! কিন্তু মায়ার বদলে অন্য কিছু হচ্ছে… ভয়ের মতো, যন্ত্রণার মতো দুঃসহ কী যেন একটা… আমি এই অনুভূতিটির সঠিক নাম জানি না!
দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়েছি। শিহাবকে দেখে সাশা পায়ের জুতো না খুলেই দৌড়ে ছুটে গেলো। বিরক্তিতে আমার ভ্রু কুঁচকে গেছে তখন। জুতোভর্তি কাদা আর বরফ নিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে যায় কেউ? কমন সেন্স বলতে কিচ্ছু নেই। শিহাব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। সাশা ওকে জড়িয়ে ধরেছে শক্ত করে। আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠিক সেই সময় আবার কেউ একজন দরজা নাড়ল। খুলে দেখি খাবার নিয়ে এসেছে ডেলিভারি ম্যান। খাবারের বাক্সগুলো হাতে নিলাম। দরজা আটকে দিয়ে ডাইনিং এ যাবার সময় দেখতে পেলাম সাশা কাউচের ওপর বসেছে, শিহাবের পাশে। আমি আগেও দেখেছি ব্যাপারটা, ওরা টেক্সটের মাধ্যমে কথা বলে। এই মুহূর্তে শিহাব মোবাইলের কিপ্যাডে আঙুল চালাচ্ছে আর সাশা পাশে বসে থেকে ওর মুখের দিকে অপলক চেয়ে আছে। সাশার চোখে গভীর আচ্ছন্নতা। শিহাব কি এসব টের পায় না? নিশ্চয়ই টের পায়। মেয়েদের এই মনোযোগ ও প্রাণভরে উপভোগ করে। বাজে… ভীষণ বাজে!
খাবারের বাক্সগুলো টেবিলের ওপর ফেলে রেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম। এই মুহূর্তে আমার রাগটা নেমে গেছে। কিন্তু তার বদলে মনের মাঝে ভিড় করেছে এক সীমাহীন বিষণ্নতা। মেয়েটার এই মুহূর্তে আসার কী দরকার ছিল? আর কেনোই বা সে শিহাবের এতো গা ঘেঁষে বসেছে? অমন হাভাতের মতো আমার বরের মুখের দিকে চেয়ে থাকাই বা কেনো? এসব আর ভালোলাগছে না! কেনো জানি না… আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে এই মুহূর্তে। একটা তিতকুটে বাতাসের ঝাপটা মনের সবকটা জানালা একে একে বন্ধ করে দিচ্ছে। আমি অক্সিজেনের অভাব বোধ করছি। দুজন একলা ছিলাম… ঝগড়া হচ্ছিল… ও আমাকে অপমানের পর অপমান করে যাচ্ছিল… তবুও সেই অপমান যেন এই মেয়েটার ঝটিকা আগমনের চেয়ে ঢের ভালো ছিল!
শিহাব
সেদিন ভেবেছিলাম সাশার অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব আমাকে আনন্দিত করেছে। কিন্তু আজ এতগুলো দিন পরে এসে, সময় সুড়ঙ্গের স্মৃতির জঞ্জাল ভেদ করে অতীতকালের সেই আমাকে যখন আমারই আপন হৃদয়াক্ষী মেলে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, তখন বুঝতে পারছি যে সাশার আগমন সেদিন আমার ভেতরে আনন্দ নয় বরং দুঃখ ঘেঁষা একটা তেতো ভাবের জন্ম দিয়েছিল। তেতো ভাবটা কী কারণে জানি না। শুধু জানি, যে সাশা উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, এই যে রুশমি ঘর ছেড়ে চলে গেলো ডাইনিং এ… এই চলে যাওয়াটা আমার ভালো লাগছে না একটুও। সাশা প্রায় উইকেন্ডেই ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি চলে আসে। এলে একবার অন্তত আমার সাথে দেখা করে যায়। এই মুহূর্তে ওর সঙ্গ উপভোগ করতে পারছি না। সত্যি বলতে কি, ওর সঙ্গ খুব কম সময়ই আমি উপভোগ করি। প্রিয় সাশা, এই উপন্যাস যদি কখনো ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় এবং তুমি যদি কখনো এই অংশটুকু পড়ে থাকো, তাহলে জেনে রেখো, যে এটা সেই সময়ের কথা, যখন তুমি আমার কাছে শুধুই একজন আবেগী নিষ্পাপ এবং সহজ সরল শিশু ছিলে। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম অভিভাবকের মতো, হয়তো কখনো কখনো বন্ধুর মতো। এই ভালোবাসা ছিল নিখাদ। কিন্তু তোমার আমার মানসিকতার ফারাক তখন আকাশ পাতাল। তুমি সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো কিশোরী। আমি বছর চব্বিশের বিবাহিত যুবক। বয়সের তফাতের জন্যই হয়তো তোমার সাথে কাটানো সময়গুলো আমি খুব একটা উপভোগ করতে পারি না, খুঁজে পাই না কথা বলার টপিক। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি বলে এসব কথা কখনো বলা হয়ে ওঠেনি। সত্যি বলছি তোমার কষ্টে আমারও কষ্ট হয়। না, এটা করুণা নয়। এটাও একরকম ভালোবাসা। পৃথিবীতে সব ভালোবাসার রং এক রকম হয় না। আর সব ভালোবাসায় প্রেম থাকে না। তুমি আমার মনের যে স্থানে আছ সেই স্থানটি ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে আছে সত্যি… কিন্তু প্রেমের উপস্থিতি সেখানে নেই… কখনো ছিল না! প্রিয় সাশা, আজ আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই যে তুমি আমার জীবনাকাশের এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, আর রুশানিয়া সেখানে একটি মাত্র ধ্রুবতারা!
সাশা আমার পাশে এসে বসেছে। টেক্সট করে যাচ্ছে ক্রমাগত। সম্প্রতি ও একটা সাপ পোষা শুরু করেছে। সাপের নাম রেখেছে হ্যারি। ক্লাসে যাবার আগে হ্যারিকে খাঁচায় পুরে রাখে। ফিরে এসে খাঁচা খুলে দেয়। হ্যারি ইচ্ছে মতো সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। রাতে ঘুমোনোর সময় মাথার কাছে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে। সে নাকি মরা ইঁদুর ছাড়া কিছুই খায় না। তবে একটা ভালো দিক হলো, সে অনেকক্ষণ পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে পারে। এতে খরচ কমে। সাশা জানতে চায় আমিও কি সাপ পোষায় আগ্রহী কিনা। আমি সাপ পুষলে নাকি তার ভালোলাগবে। ওকে বোঝালাম আমার আগ্রহ থাকলেও মম কিছুতেই এতে রাজি হবে না। সাপ তো দূরের কথা, মমের যন্ত্রনায় একটা কুকুর পর্যন্ত আমরা পুষতে পারিনি কখনো। কুকুর, বেড়াল, খরগোশ সবকিছুতেই তার চরম ভীতি।
জাহিদ ফিরল মিনিট দশেকের মধ্যেই। খানিক বাদে রুশমি যখন আমাদেরকে খাবার টেবিলে ডাকলো তখন জানি না কেনো ওর মুখখানা বর্ষার প্রথম দিনের ঘন কালো আকাশের মতো থমথমে হয়ে আছে। ও হালাল ছাড়া খায় না বলে মেডিটেরেনিয়ান ফুড অর্ডার করেছি, একটা ইয়েমেনি রেস্টুরেন্ট থেকে। রেস্টুরেন্টের নাম ‘সাবা।’ তোমরা নর্দার্ন ভার্জিনিয়ায় বেড়াতে এলে এই রেস্টুরেন্টের খাবার অবশ্যই ট্রাই করবে। এটা হাইলি রেকমেন্ডেড। কিন্তু মনে হচ্ছে রুশমির খাবার পছন্দ হয়নি। মুখের ভাব দেখে তাই মনে হচ্ছে। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু যত্নশীল মনোভাব সম্পন্ন। চোখের সামনে কেউ মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালোলাগে না। হয়তো পরিবারের বড় ছেলে বলেই এই কেয়ারিং ভাবটা রক্তে রক্তে মিশে গেছে। আমি ভুলে যাচ্ছি যে রুশমি এই পরিবারের স্থায়ী সদস্য নয়, পাপা মম মাস দেড়েক পরে ফিরে এলেই ও আমার জীবন থেকে চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ওর মন ভালোথাকা না থাকা নিয়ে আমার এই অকারণ উৎকণ্ঠা একেবারেই বেমানান।