হৃদয়াক্ষী – ৪

শিহাব 

সুন্দরীদের অহংকার থাকে এটা তো জানা কথা। কিন্তু তাই বলে এমন গগনচুম্বী অহংকার! কোন দেশের রাজকন্যা আসছ তুমি ভাই? বহু সুন্দর মেয়ে দেখেছি আমি, কেউ তো কোনদিন এমন মাত্রাতিরিক্ত অমার্জিত আচরণ করেনি। মুখের ওপর বলে কিনা ‘তোমাকে আমার অসহ্য লাগে!’ কী সাংঘাতিক! অপমানে আমার মাথার শিরা দপদপ করছে। ঠিক করেছি ওর সাথে আর কোনো কথাই বলব না। ভদ্রতার দাম যে দিতে পারে না, তার সাথে যেচে পড়ে ভদ্রতা দেখাতে যাওয়া আর উলুবনে মুক্তো ছড়ানো একই কথা। 

আমি বেজমেন্টে ওয়ার্ক আউট করছিলাম। উঁচু ভলিউমে আয়রন মেইডেনের গান বাজছে। ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়ালো? এখন থেকে আমার নিজের ঘরে আমি যখন তখন প্রবেশ করতে পারব না? নিজের বেডরুমে দরজা নক করে, অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হবে? মম কি ওকে শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছিল? হয়তো দিচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটা আমাকে দেখা মাত্র অমন হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো চমকে উঠল কেনো? এসব ঢঙের মানে কী? নিজের মায়ের সামনে এতটা ব্রিতকর পরিস্থিতিতে এর আগে কখনো পড়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। 

আজ ক্রিসমাস ইভ। শুভ্রা ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে। দাওয়াতটা আসলে জনাথনের বাসায়। জনাথন নাকি গতকাল গভীর রাতে ওকে ফোন করে স্যরি বলেছে এবং ক্রিসমাস ইভে নিজের বাসায় ইনভাইট করেছে। শুভ্রা চায় আমি যেন ওর সাথে জনাথনের বাড়িতে যাই। খুব সম্ভবত আজ সন্ধ্যায় আমার শ্বশুরবাড়িতে একবার যেতে হবে। পাপা বলছিল সকালে, শ্বশুর মশাই নাকি আমাদেরকে সপরিবারে দাওয়াত করেছেন। কী করব বুঝতে পারছি না। দোটানায় পড়ে গেছি। শ্বশুরবাড়ির দাওয়াত নাকচ করার সাহস পাচ্ছি না। শুভ্রাকে কষ্ট দিতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। বিরক্ত লাগছে সব কিছু। এদিকে আমার বন্ধুরা সকাল থেকে নানাভাবে জ্বালাতন করা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ওরা আমার বিয়ের খবর পেয়ে গেছে। পারলে এখুনি আমার বাড়িতে চলে আসে নতুন বৌয়ের মুখ দর্শন করতে। বন্ধু বলতে বাংলাদেশি এবং ভারতীয় বন্ধুদের কথাই বলছি। আমেরিকানদের মধ্যে গায়ে পড়া স্বভাবটা তেমন একটা নেই। আমেরিকান বন্ধু এবং কলিগরা আমি নিজ থেকে বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে মুখ খুলবে না। 

ওয়েইট লিফটিং করতে করতে ভাবছিলাম হঠাৎ ভাগ্য তারকা আমার ওপর এতটা অপ্রসন্ন হয়ে উঠল কেনো? আমার তো ছিমছাম পরিচ্ছন্ন একটা জীবন ছিল। অফিস, গান, ওয়ার্ক আউট এসব নিয়েই দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছিল। যখন শুভ্রা ছিল না, রুশমি ছিল না, কোনো নারীর ছায়া ছিল না জীবনে, তখন তো আমি ভালোই ছিলাম। না না ভুল বললাম! শুভ্রা সর্বদাই আমার কল্পনায় ছিল… স্বপ্নে ছিল… নিভৃতচারী হৃদয়াক্ষী কন্যা হয়ে। আজ সেই স্বপ্নে বাস্তবতার জিয়নকাঠি ছোঁয়াতে গিয়ে টের পেলাম কিছু স্বপ্ন ঘুমিয়ে থাকা অবস্থাতেই সুন্দর এবং জীবন্ত। ওদেরকে বাস্তবে নামাতে নেই। আমার স্বপ্নে পাওয়া হৃদয়াক্ষী কন্যার সাথে বাস্তবের শুভ্রার বিস্তর তফাৎ আছে। তবুও… আমি চাই শুভ্রা আমাকে ভালোবাসুক। নইলে নিজের কাছেই নিজে হেরে যাব চরমভাবে। নিজের মনের অবস্থা দেখে দারুণ অবাক হচ্ছি। মনে হচ্ছে বুকের খুব গভীর আকাশে ভ্রুকুটিবক্র ঘন কালো মেঘের এক পুরু স্তর জমে গেছে। এই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরার অবকাশ পাচ্ছে না। থমথমে গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করছে মনের রাজ্যে। এই বৈরী আবহাওয়ার কারণ কী আমি জানি না। বাবা-মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে আমার ছোট্ট জগৎটা সুখে, আনন্দে এবং স্বস্তিতে সদা পরিপূর্ণ। আমার কাঁধে সংসারের বোঝা নেই। আমার বাবা একজন শক্ত সমর্থ উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চাকরি না করেও বাবার পয়সায় খেয়ে দেয়ে দিন কাটাতে পারব। শুধু একটা দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করা হয়েছিল এত দিনে। সেই দায়িত্ব হলো নিজের বিয়ে করা বৌকে সঙ্গ দেয়া। এই দায়িত্ব পালনেও আমি পুরোপুরি ব্যর্থ। সঙ্গ দেয়ার জন্য প্রেম থাকাটা আবশ্যক নয়। বন্ধু হয়েও একজন আরেকজনের পাশে থাকা যায়। কিন্তু রুশমির মতো দুর্বিনীত স্বভাবের মেয়ের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা অসম্ভব! ওর সাথে এক রাত কাটিয়েই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পরবর্তী – দিনগুলো কাটবে কী করে? অফিসটা শুরু হয়ে গেলেই বাঁচি। 

ওয়ার্কআউট শেষে নিজের ঘরে ফিরে গেলাম না আর। বেজমেন্টের ওয়াশরুমেই শাওয়ার নিলাম। বের হয়ে দেখি শুভ্রা ফোন করছে। ফোন ধরতেই বলল, ‘রুশমিকে ফোনটা দেতো!’ 

—‘তোমার কি ধারণা রুশমিকে আমি সারাক্ষণ কোলে নিয়ে বসে থাকি?’

—‘ননসেন্সের মতো কথা বলিস না।’ 

—‘ননসেন্স আমি না, তুমি! রুশমি কোথায় জানি না। ওর নাম্বারে কল করো।’ 

ফোনের লাইন কাটার পর টের পেলাম আমি শুধু মানসিক ভাবেই ক্লান্ত নই, শারীরিক ভাবেও যথেষ্ট ক্লান্ত। শরীর জুড়ে নেমে আসছে বিষণ্ণ অবসাদ। রাতে ভালো ঘুম হয়নি বলেই হয়তো চোখজোড়ায় নিরন্তর ঘুম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখন। উপরতলায় উঠে দেখি সবাই এর মাঝেই ডাইনিং এ জড়ো হয়েছে। জাহিদ আর আমার কাজিনরা খাবার নিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসে পড়েছে। খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। দুশ্চিন্তামুক্ত চমৎকার জীবন ওদের! দেখে ঈর্ষা কবলিত হয়ে পড়লাম। 

মম বলল, ‘শিহাব! এখানটায় বসো।’ 

রুশমির পাশের চেয়ারটার দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছে। চুপচাপ মমের আদেশ পালন করলাম। পাপা, বড় চাচা আর চাচী বসেছেন টেবিল ঘিরে। উনারা কানাডা থেকে এসেছেন গতকাল বিকেলে, আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে। নাশতার আয়োজন বেশ ভালো। পরোটা, গরুর মাংস, আলু ভাজি, খিচুড়ি। আমি এসব কিছুই খাবো না। শুধু সিরিয়াল খাবো। পাপাকে গদগদ গলায় বলতে শুনলাম, ‘রুশমি, তুমি কি জানো আমাদের শিহাব খুব ভালো গান গাইতে পারে?’ বিরক্তিতে ঠোঁট বেঁকে গেলো আমার। আমি গান গাইতে পারি তা জানতে পেরে এই মেয়ে করবেটা কী? 

রুশমি একটু আলগা গলায় বলল, ‘তাই নাকি?’ 

—‘হ্যাঁ তাই। শিহাব তুমি খেয়ে উঠে একটা গান শোনাও আমাদেরকে। –’উঁহু, এখন না।’ 

—‘কেনো? গান গাইতে সমস্যা কোথায়?’ 

‘মুড নাই।’ 

মম আমার কপালে একটা হাত রেখে বলল ‘জ্বর আসেনি তো?’ 

আমার মায়ের এই এক বদ অভ্যাস। মুখ গোমড়া দেখলেই সে উড়ে এসে কপাল ছুঁয়ে বলবে, জ্বর আসেনি তো? যেন জ্বর ছাড়া মানুষের জীবনে আর কোন সমস্যা নেই, থাকতে পারে না। এই মুহূর্তে অবশ্য আমার একটু জ্বরজ্বর বোধ হচ্ছে। তবে সেই জ্বর শরীরে নয়, মনে। ঘন কালো পুঞ্জীভূত মেঘের স্তর গুমোট উত্তাপ তৈরী করেছে সেখানে। এই মানসিক জ্বর থেকে আরোগ্য লাভের উপায় কী? 

—‘জ্বর তো নেই। তুই মুখটাকে এমন প্যাঁচার মতো বানিয়ে রেখেছিস কেনো?’ 

আমি উত্তর দিলাম না। চুপচাপ সিরিয়াল খেতে লাগলাম। পাপা বলল, ‘শিহাব শোন, আজকে তো ক্রিসমাস ইভ। অন্য কোনদিকে প্ল্যান করো না। তোমার শ্বশুরবাড়িতে দাওয়াত আছে।’ 

সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না, মুখ না তুলেই বললাম ‘আমার ফ্রেন্ড অনেক আগে থেকে দাওয়াত দিয়ে রেখেছে পাপা। এখন কোনভাবেই প্ল্যান চেঞ্জ করা সম্ভব না, স্যরি। 

—‘কোন ফ্রেন্ড? 

—‘তুমি চিনবে না।’ 

—‘কখন দাওয়াত?’ এবার বড় চাচা প্রশ্ন করলেন। 

—‘সন্ধ্যায়।’

—‘বেশ, ফ্রেন্ডের বাসা থেকে ঘুরে এসো। শ্বশুরবাড়ি রাত করে গেলেও সমস্যা নেই। তাছাড়া আজকে মনে হয় তোমাকে ওখানে রাত কাটাতে হবে।’ 

বিরক্তির মাত্রা তড়াক করে কয়েক ধাপ উপরে উঠে গেলো। আড়চোখে তাকালাম পাশে বসে থাকা রুশমির দিকে। সেও আড়চোখে আমাকেই দেখছিল চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় ভ্রুজোড়া তুলে কেমন একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল মুখের। এই ভঙ্গির অর্থ হলো, ‘কেমন শাস্তি হলো ড্যুড? এখন তুমি পালাবে কোথায়?’ 

আমি সজোরে ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘রাতে থাকব না কারো বাসায়।’

বড় চাচী হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমাদের শিহাব লজ্জা পাচ্ছে। দেখো না লজ্জায় মুখ টুখ একদম লাল হয়ে গেছে!’ 

হাসি ছোয়াঁচে। চাচির হাসি শেষ হতে না হতেই সারা টেবিলে হাসির রোল পড়ে গেল। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর হো হো করে হেসে যাচ্ছে। আমি খাওয়া থামিয়ে ব্যাক্কলের মতো চেয়ে আছি। সামনে বসা মানুষ গুলোর পৈশাচিক হাসি দেখছি। হঠাৎ চোখ পড়ল। রুশমিও হাসছে। মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কেঁপে কেঁপে হাসছে। সিরিয়ালের বাটিটা এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। 

রুশমি 

নাশতা সেরে আমরা বাড়ির সামনের লনে এসে দাঁড়ালাম। আমি, জাহিদ আর ওদের দুজন কাজিন। কাজিনরা ধরে বেঁধে শিহাবকেও সাথে নিয়ে এসেছে। শিহাব কালো রংয়ের জ্যাকেট গায়ে দিয়ে কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রাগের চোটে নাশতাটাও শেষ করতে পারেনি বেচারা! আমার খুব হাসি পাচ্ছে ওকে দেখে। বুঝতে পারছি বেচারার মানসিক অবস্থা এখন একেবারেই ভালো নয়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো ওর এই ভালো না থাকাটা আমাকে এক নিষ্ঠুর এবং বর্বর আনন্দ দিচ্ছে। আমি কি স্যাডিস্ট? না, মোটেও আমি তা নই। অন্তত ছিলাম না এতদিন। কিন্তু এই মুহূর্তে শিহাবের জন্য আমার এক ফোঁটাও মায়া হচ্ছে না। এই মনোভাব নিঃসন্দেহে স্যাডিস্টিক। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল। জ্যাকেটের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখলাম শুভ্রাদির নাম ভাসছে স্ক্রিনে। 

—‘হ্যালো রুশমি!’ 

—‘বলো শুভ্রাদি।’ 

—‘আজকে সন্ধ্যায় নাকি তোদের বাসায় শিহাবকে দাওয়াত দিয়েছে?’

—‘সেরকমই তো শুনলাম।’ 

—‘ক্যানসেল কর।’ গম্ভীর গলায় আদেশ করল শুভ্রাদি। 

—‘আমি কী করে ক্যানসেল করব? দাওয়াত কি আমি দিয়েছি নাকি?’ 

—‘যে দিয়েছে তাকে ফোন করে বল আজকে এসব চলবে না।’ 

এবার মেজাজটা হালকা বিগড়ে গেলো। 

—‘স্যরি এটা আমার পক্ষে সম্ভব না।’ 

‘বোঝার চেষ্টা কর রুশমি, আজকে জনাথনের বাসায় পার্টি আছে। 

শিহাবকে আমার সঙ্গে যেতেই হবে যে করেই হোক।’ 

—‘জনাথন কোত্থেকে আসলো আবার?’ 

—‘গতরাতে ফোন করেছিল।’ 

—‘ফোন দেয়া মাত্র তুমি ওকে ক্ষমা করে দিলে?’ 

—‘মাথা খারাপ? মোটেও ক্ষমা করিনি। আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে সাথে নিয়ে ওর পার্টি অ্যাটেন্ড করতে চাই। ওকে দেখিয়ে দেব যে ওর চলে যাওয়ায় আমার কিছুই এসে যায়নি। প্লিজ রুশমি! হেল্প মি আউট!’ 

—‘শিহাব যাক না তোমার সাথে। ওকে কে মানা করেছে?’ 

—‘ঠিক আছে। তাহলে এই কথাই থাকলো। তুই চলে যাস তোদের বাসায়। শিহাব আমার সাথে যাবে। ওকে?’ 

—‘আসলে আমার ওপর কিছু ডিপেন্ড করছে না। আমাদের প্যারেন্টসরা ঝামেলা না করলেই হলো।’ 

—‘রুশমি ডিয়ার! তুই একটু ম্যানেজ কর। হেল্প কর আমাদের। প্লিজ!’

—‘না শুভ্রাদি, তোমার বয়ফ্রেন্ড হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। এমন বজ্জাত ছেলের উপকার করতে আমার মন চাচ্ছে না। তবে… 

—‘তবে কী? ‘ 

—‘ও যদি আমাকে হাম্বল রিকোয়েস্ট করে তাহলে ভেবে দেখতে পারি।

—‘আচ্ছা করবে রিকোয়েস্ট। আমি বলে দেব।’ 

—‘ঠিক আছে। বলে দিও হাম্বলি রিকোয়েস্ট করতে হবে। একেবারে বিনীত অনুরোধ।’ 

—‘হ্যাঁ বিনীত অনুরোধই তো করবে। ও ভদ্র ছেলে।’ 

—‘যা ভদ্ৰ! আহা!’

—‘রাখছি তাহলে।’

—‘রাখো।’ 

ফোনের লাইন কেটে গেলো। আজকের দিনটা খুব সুন্দর। লনের ঘাস, গাড়ির ছাদ আর ড্রাইভওয়ে ঢেকে গেছে শ্বেত শুভ্র বরফে। সাদা বরফের ওপর ঝকঝকে স্বচ্ছ রোদ্দুর থইথই করছে। অসংখ্য টুকরো টুকরো কাচের প্রতিবিম্বে ভরে গেছে চারপাশ। বরফের আয়নায় আকাশ তার মুখ দেখছে সারাক্ষণ। আলোর সমুদ্রে ভাসছে পৃথিবী, হীরের মতো চমক দিচ্ছে। প্রকৃতি ঠান্ডা, নিস্পন্দ এবং শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন! লনের সামনেই নেইবার হুডের সরু রাস্তা। এসোসিয়েশনের লোক রাস্তার ওপর থেকে বরফ সরিয়েছে। রাস্তার দুধারে বরফপুঞ্জ জমিয়ে রেখেছে উঁচু ঢিবির মতো। বরফ গলানোর জন্য লবন ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে চারপাশে। রাস্তার ওপাড়ে একটি দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে কয়েকটি টিনেজ মেয়ে তুষারের ওপর লাফঝাঁপ করছে, ফটোশ্যুট করছে, ধবধবে বরফে শুয়ে পড়ে স্নো অ্যাঞ্জেল আঁকছে। আজকের টেম্পারেচার মাইনাস টু। আমি শাড়ির ওপরে লালরঙের মোটা জ্যাকেট পরেছি। মাথায় পরেছি সাদা হিজাব। মুখের চামড়া ঠান্ডায় কুঁকড়ে গেছে। পায়ে স্নো বুট। প্রায় আট ইঞ্চির মতো বরফ জমে গেছে। শাড়ির কুচিটা সাবধানে উঁচু করে ধরে আছি যেন পায়ের সাথে আটকে না যায়। আমার সো বুট পেঁজা তুলো বরফের ভেতর দেবে গেছে। আমাকে দেখতে নিশ্চয়ই কিম্ভুত দেখাচ্ছে। অবশ্য এ মুহূর্তে কেউ আমাকে দেখছে না। আমার ব্রাদার ইন ল’ এবং তার কাজিনরা একটু দূরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা শলা পরামর্শ করছে। শিহাব আমার চার পাঁচ হাত দূরত্বে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো পকেটে। সামনের বাড়ির সোনালী চুলের কিশোরী মেয়েগুলি ওকে লক্ষ্য করছে। উচ্চস্বরে হাসাহাসি করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। জাহিদ এবং তার সঙ্গীদের সাথে এর মাঝেই মেয়েগুলোর হাই হ্যালো হয়ে গেছে। শিহাব কিছুই গ্রাহ্য করছে না। এক টুকরো স্বচ্ছ রোদ ঝিকমিক করে নেচে বেড়াচ্ছে ওর কালো চুলের মাথায়, তীক্ষ্ণ নাকের অগ্রভাগে। ঘন ভ্রুর নিচের খয়েরি মণি খচিত চোখ দুটিতে দূরের দৃষ্টি। আজকের এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকাল তাকে টানছে না, টানছে না সামনের বাড়ির ষোড়শী কিশোরীদের লাস্যময়ী খুঁনসুটি। ওর মুখে থমথমে বৈরাগ্য। চোয়াল কঠোর, নিষ্ঠুর.. অথচ সুন্দর! ওই ধারালো চোয়ালের জন্য যেকোন মেয়ে ওকে কাছে পেতে চাইবে। কিন্তু আমি তো যেকোন মেয়ে নই। আমি কখনই কারো চেহারা দেখে প্রেমে পড়ব না। পড়ব না…পড়ব না… জীবনেও পড়ব না! 

হঠাৎ একটা কাণ্ড হলো। জাহিদ এক মুঠো বরফ আচমকা শিহাবের গাল বরাবর ছুঁড়ে মারল। ধ্যান ভঙ্গ হওয়া ক্রুদ্ধ সন্ন্যাসীর মতো চমকে উঠলো শিহাব। চোখ দুটো জ্বলে উঠল ধক করে। ওই ভয়ংকর রক্তচক্ষু দেখে জাহিদ হড়বড় করে বলল, ‘আমি কিছু করিনি। রুশমি করেছে!’ 

বুক কেঁপে উঠল। প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠে প্রতিবাদ করতে চাইলাম। কিন্তু তার আগেই দেখি শিহাব ঝুঁকে দাঁড়িয়ে মুঠো ভর্তি করে বরফ তুলে নিচ্ছে হাতে। একটা মুহূর্তও নষ্ট না করে দৌড় দেবার জন্য উদ্যত হলাম। কিন্তু দৌড়োবো কী করে? আমার পরনে যে শাড়ি! 

তবুও আমি দৌড়াচ্ছি। দিগ্বিদিকের খরশান বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে মুখে। চামড়া ফেটে যাচ্ছে। ঠোঁট এত শুষ্ক যে মনে হচ্ছে যেন আরেকটু হলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে। সম্মুখে সাদার বিস্তার ছড়িয়ে গেছে বহু দূর অবধি। আমি ক্রমশঃ বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। এদিকটা জনবিরল। কেনো এভাবে দৌড়াচ্ছি জানি না। মনে হচ্ছে যেন স্বয়ং যমদূত আমাকে তাড়া করছে। থেমে পড়লেই নির্মম থাবায় জান কবজ করে ফেলবে। শাড়ি সামলে তুষারাবৃত এবড়োথেবড়ো পথে দৌড়োনো আর এভারেস্ট জয় আমার কাছে এখন সমতুল্য। কষ্ট হচ্ছে। বর্শার ফলার মতো ক্ষুরধার শীতল বাতাস আমার নিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে। চোখের দৃষ্টি অস্পষ্ট। আবছা দেখতে পাচ্ছি দূরের নিষ্প্রাণ জঙ্গল। হঠাৎ আমার পা দুটো টাল খায়। লক্ষ্য করি সামনের বরফ ঢাকা পথ উত্তাই হয়ে অনেকখানি নিচে নেমে গেছে। তারপরের ছবিগুলো ঝাপসা। শুধু মনে আছে উত্তাই দিয়ে আমি পিছলে গড়িয়ে পড়ছি। তীক্ষ্ণমুখ কাঁটাযুক্ত আগাছায় আমার হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে যাচ্ছে। শরীর বেঁচে যাচ্ছে মোটা জ্যাকেটের বদৌলতে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড নেই। বুক খালি, পেট খালি। আমাকে যেন অনেক উঁচু থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে মৃত্যুর অন্ধকার গহ্বরে। শ্বেতশুভ্র হিমেল পৃথিবী মুহূর্তের মাঝে নিকষ কালো মর্গের ডিপ ফ্রিজ হয়ে উঠেছে আমার কাছে। মনে পড়ে আমার ঠোঁট ক্রমাগত নড়ছিল। দোয়া ইউনুস পড়ছিলাম। আমি বাঁচতে চাই। এভাবে মরতে চাই না। আমি প্রস্তুত নই এখনো আমার মনিবের কাছে ফিরে যাবার জন্য! 

পরের কয়েকটা মুহূর্ত আমার স্মৃতিতে ঝিরঝির করা টেলিভিশনের পর্দা কিংবা সার্ভারবিহীন ভিডিওর মতো থমকানো। স্মৃতির সার্ভারে সংযোগ ফিরে আসার পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা উইলো গাছের মোটা গুঁড়ির নিচে। চোখের সামনে একজনের আবছা মুখ। সূর্যরশ্মি চতুর্দিক থেকে তির্যকভাবে নেমে এসে মুখটাকে ঘিরে ধরেছে। লাল, নীল, বেগুণী রঙের অসংখ্য বুদবুদ তৈরী করছে। আলোর বন্যায় চোখ খোলা রাখা দায়। কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে রইলাম। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় যন্ত্রণা টের পাচ্ছি। বুক ফেটে কান্না আসছে। তবে বেঁচে আছি এই-ই ঢের! আলহামদুলিল্লাহ! 

—‘রুশমি!’ 

ডাকটা ক্ষীণভাবে কানে লাগলো। ঠোঁট নাড়ার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। একটা দুঃসহ যন্ত্রণা ভেতর থেকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে তেড়ে এসে আমার কণ্ঠ রোধ করে দিল। 

—‘রুশানিয়া!’ 

—‘হুম?’ 

—‘এদিকে তাকাও। লুক অ্যাট মি।’ 

শিহাব পাঞ্জা লড়ার মতো শক্ত করে আমার একটা হাত ধরল। শরীরটা টেনে তুলল ওপরের দিকে। উঠে বসলাম। 

—‘তুমি কি মাথায় ব্যথা পেয়েছ?’ 

আমি কিছু বলতে পারছি না। স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। এখন আমার চোখে জল উপচে পড়ছে। যে যমদূতের ভয়ে আমি দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে পালাতে চাইছিলাম। সেই যমদূতই এখন আমাকে উদ্ধার করতে এসেছে। কী কাণ্ড! হঠাৎ ভয়-ভীতি যন্ত্রণা সমস্তকে ছাপিয়ে জগৎজোড়া কুণ্ঠা কোত্থেকে যেন তেড়ে এসে ছলাৎ করে ভিজিয়ে দিয়ে গেলো ভেতরটা। চোখ নামিয়ে নিলাম নিচে। শিহাব আমাকে বসা থেকে টেনে তুলল। শাড়ির কুঁচিটা পেটিকোটের যে জায়গায় গুঁজে দেয়া হয়েছিল, সে জায়গা থেকে সরে গেছে। আমার শাশুড়ি সুন্দর করে পিন আটকে দিয়েছিল। কুচি এলোমেলো হয়নি। শুধু পুনরায় আগের জায়গায় গুঁজে দিলেই মোটামুটি সামলে নেয়া যাবে। কিন্তু শিহাবের সামনে এই কাজটা করতে আমার লজ্জা লাগছে। কী করব বুঝতে পারছি না। পা ফেলতেও কষ্ট। গোড়ালি খুব সম্ভবত মচকে গেছে। হাঁটুর চামড়া কেটে গেছে। 

—‘হাঁটতে পারবে?’ 

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলাম। কিন্তু আমি জানি হাঁটতে আমার কষ্ট হবে। লজ্জায় সে কথা বলতে পারছি না। শাড়ির কুঁচি এক হাতে উঁচু করে ধরে পা বাড়ালাম। শিহাব আমার হাত ছাড়েনি। আমি যেন অশীতিপর বৃদ্ধা। ছেড়ে দিলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব। আমার কানে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। শরীর অবশ। বুকজোড়া ভয় এখনো খুবলে খুবলে খাচ্ছে সমস্ত সত্তা। খাড়াই বেয়ে ওপরে উঠলাম না আমরা। বাড়ির পেছন দিকে হেঁটে এলাম। ভালোই হলো। ফ্রন্ট ডোরে জাহিদরা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সামনে এই বিধ্বস্ত অবস্থায় উপস্থিত হতে আমার লজ্জা হচ্ছিল। এই বাড়ির বেজমেন্টটা একটা বিশাল বড় হলরুম। মেঝেটা কাঠের। বেশ কয়েকটা সোফা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। দেয়ালে ফায়ারপ্লেস। বৈদ্যুতিক নয়। একেবারে সনাতন ফায়ারপ্লস। একটা ইলেকট্রিক গিটার, ড্রাম, আর দুটো পুরোনো আমলের বড় বড় স্পীকার রাখা। বাকি জায়গা ব্যায়াম করার সরঞ্জামে ঠাসা। শিহাব আমাকে একটা সোফার ওপর বসিয়ে দিল। আমার শরীর এখনো কাঁপছে। হাত জমে গেছে ঠান্ডায়। শিহাবের মাথার চুলে বিন্দু বিন্দু বরফ লেগে আছে। কালো জ্যাকেটে সাদা ছোপ। চোখজোড়ায় চাপা উৎকণ্ঠা। ও আমার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসেছে। আমার পায়ের জুতো খুলে নিতে নিতে বলছে, ‘কোথায় লেগেছে তোমার?’ 

—‘জানি না। কিছু ফিল করতে পারছি না।’

—‘কী হয়েছিল? হঠাৎ এভাবে ছুটলে কেনো পাগলের মতো?’ 

আমি খুব ধীরে ধীরে বললাম, ‘তুমিই তো আমাকে মারতে আসছিলে।’ 

আমার নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি শুনে শিহাব হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে কিছুক্ষণ। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেলো। ওর খয়েরি চোখদুটো হঠাৎ যেন জাদুর আয়নায় রূপান্তরিত হলো। আমি আমার নিজের মুখটা সেখানে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ঐতো দেখতে পাচ্ছি আমার ফ্যাকাসে মুখ, শীতে কুঁচকে যাওয়া খসখসে চামড়া, শুষ্ক ঠোঁট… আশ্চর্য! আশ্চর্য! এত স্পষ্টভাবে জগতের কোন আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পারিনি এর আগে। এই লোকাতীত মুহূর্তটির কোন ব্যাখ্যা নেই… শুধু উপলব্ধি আছে। কিন্তু সেই উপলব্ধি আমার জ্ঞানচক্ষুর রুদ্ধদ্বার উন্মোচন করতে পারেনি সেদিন। আমি বুঝতে পারিনি… যে পৃথিবীতে এই একজন মাত্র মানুষ, যার চোখের ভেতরেই আমার চিরস্থায়ী নিরাপদ নিবাস! আমি এতটা চমকে গেছি যে আমার চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। প্রবলভাবে বুক কাঁপছে। স্তব্ধীভূত হয়ে ওর চোখের ভেতরের আমাকে দেখছি। ওর মুখটা স্থিরভাবে আমার দিকে তাক করা। আমার খুব একবার বলতে ইচ্ছে করল, তোমার চোখের ভেতর ওটা কে শিহাব? তুমি জানো? 

এরপরের কয়েকটা মিনিট আমরা কেউ কোন কথা বললাম না। একটা সময় শিহাব উঠে গিয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসলো। আমার শরীরের অবশ ভাব কেটে গেছে। সংবেদনশীলতা ফিরে এসেছে। ক্ষত স্থানগুলি ব্যথার জানান দিচ্ছে ধীরে ধীরে। টের পাচ্ছি কপালে, পায়ের গোড়ালিতে আর হাঁটুতে ভালোই লেগেছে। শিহাব আমার কপালের জমাট রক্ত তুলো দিয়ে ক্লিন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তারপর খুব শান্তভাবে প্রশ্ন করল, ‘অন্য কোথাও কেটেছে তোমার?’ 

আমি দুদিকে ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘না।’ 

মিথ্যা বললাম। হাঁটুতে লেগেছে খুব। ওকে সঙ্গত কারণেই সেটা বলতে চাই না। 

ফার্স্টএইড বক্স গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘বেশ। তুমি তাহলে এখন ওপরে যেতে পারো।’ 

আমি বাধ্য মেয়ের মতো উঠে দাঁড়ালাম। আমার ভেতরের প্রতিবাদী সত্তাটা হঠাৎ ভস করে নিভে গেছে। যে আমি সকাল থেকে এই ছেলেটার সাথে ঝগড়া করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম সেই আমিই এখন এর মুখ নিঃসৃত আদেশ বিনা বাক্যব্যয়ে পালন করলাম। 

শিহাব 

ওই চোখ দুটো ভয়ঙ্কর সুন্দর! শুধু চোখ দিয়ে মেয়েটা মানুষ খুন করতে পারবে। এরকম একটা কথা আমার মাথায় এলো কারণ আজকে এই একটু আগে ও যখন আমার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে ছিল, তখন একটা অশুভ সঙ্কেত নিজের বুকের গভীরে ঢংঢং শব্দে বিস্ফোরকের মতো বেজে উঠতে শুনেছি। শীতের তীব্রতা ওর মুখের শেষ রক্তকণিকাটুকুও শুষে নিয়েছে। ফ্যাকাসে শুষ্ক ঠোঁট। চামড়া খসখসে। শুধু চোখজোড়া দীঘির জলের মতো সতেজ। বিধাতা বড় যত্ন করে ওই দুচোখে কৃষ্ণ কাজল এঁকে দিয়েছেন। এই চোখ কোন সাধারণ চোখ নয়। এই চোখ ঐশ্বরিক! এতো সুন্দর, এতো প্রাঞ্জল, এতো নিষ্পাপ ওই চাউনি… তবুও আমার কেনো যেন ভালো লাগল না। বরং অদ্ভুত একটা ভয় হিংস্র ব্যাঘ্রের মতো টুটি চেপে ধরতে চাইল। কেনো যেন মনে হলো ওদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে খুন হয়ে যাব। কী সাংঘাতিক! ও চলে যাবার পর আমি ঝুম হয়ে বসে ছিলাম। মম কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। গলার স্বরে চমকে উঠলাম, 

—‘আব্বু, তোমার কী হয়েছে? 

আমি মমের দিকে কিছুক্ষণ স্থবিরভাবে চেয়ে রইলাম। মম আমার মাথায় হাত রাখলো। পাশে বসল। 

—‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’ 

প্রশ্নের উত্তরে মমকে জড়িয়ে ধরলাম কোল বালিশের মতো। কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বললাম, ‘শরীর ঠিক আছে।’ 

—‘এরকম দেখাচ্ছে কেনো?’ 

— ‘জানি না।’ 

—‘আব্বু শোনো। রুশমি মেয়েটা ভালো। কয়েকদিন সময় দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

—‘হুম ডাইনীর মতো ভালো।’ 

—কী বলছ আবোল তাবোল? এতো সুন্দর একটা মেয়ে কেনো ডাইনির মতো হবে?’ 

—‘ডাইনির মতো সুন্দর।’ মম কাছে এসে বসাতে মনটা শান্ত লাগছে। ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসছে আমার। ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে। 

—‘কী পাগল ছেলে! ডাইনীর মতো সুন্দর আবার কেমন কথা?’ 

—‘সত্যি কথা। 

—‘তুমি বড় হবে কখন শিহাব? আজীবন বাচ্চাদের মতো আচরণ করলে হবে?’ 

—‘হবে।’ 

—‘হবে না। এখন একটু বড় হও বাবা। মেয়েটার দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। 

—‘ডাইনির দায়িত্ব নিতে পারব না।’ 

—‘ছিঃ এমন কাপুরুষের মতো কথা বলে না।’ 

ঘুমিয়ে পড়েছি কখন জানি না। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখি মম কাঠ হয়ে বসে আছে আগের ভঙ্গিতেই। আমার মাথাটা তার কাঁধের ওপর কাত করা। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। বোকা চোখে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। 

—‘ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?’ 

—‘হ্যাঁ।’ 

—‘কতক্ষণ ঘুমালাম?’ 

—‘হবে ঘণ্টা খানেক। 

—ঘণ্টা খানেক ধরে তুমি একই ভাবে বসে আছ?’ 

—‘কী করব? নড়লে তো তোমার ঘুম ভেঙে যেত।’ 

একটা বড় নিশ্বাস পড়ল। এই হচ্ছে আমার মা! যে আজীবন শুধু অন্যের সুখের কথাই ভেবে এসেছে। 

জাহিদ এসে খবর দিল সাশা এসেছে আমার সাথে দেখা করতে। মনে পড়ল এই হলিডেতে সাশার সাথে একবারও দেখা করা হয়নি। প্রতি বছর ক্রিসমাস ইভে আমি হরেক রকম গিফ্‌ট নিয়ে ওর বাড়ি গিয়ে হাজির হই। গত তিন চারদিনে আমার দৈনন্দিন জীবনের ঘড়ির কাঁটা যেন উল্টো দিকে ঘুরে গেছে। লুপ্ত হয়েছে বাস্তব জ্ঞান। সাধারণ ব্যক্তি সত্তা হারিয়ে গেছে শুভ্রা এবং রুশমি এই দুই নারীর অসাধারণ অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাদুর্ভাবে। সাশা সতেরো বছরের এক উচ্ছল প্রাণবন্ত তরুণী। দেখে অবশ্য মনে হয় বয়স খুব বেশি হলে তেরো কি চোদ্দ হবে। থাকে আমাদের তিনটা বাড়ি পরেই। নুডলসের মতো কোঁকড়া সোনালী চুল। সাদা চামড়ার মুখে অসংখ্য বাদামি রংয়ের বিন্দু বিন্দু ফ্রেকলস (freckles)… হাসলে হলুদ দাঁতের মাড়ি অবধি দেখা যায়। সহজ, সরল, আদুরে হাসি ওর। সবুজাভ চোখ দুটো বিষণ্ণ কিন্তু অসম্ভব বাঙময়। হ্যাঁ বাঙময়! ওর চোখ অনেক কথা বলে। কারণ জন্ম থেকে আজ অবধি ওর মুখ কখনো কথা বলতে পারেনি। শ্রবণ করতে পারেনি কোন শব্দ। প্রকৃতি সূচনালগ্ন থেকেই মেয়েটির বাকশক্তি এবং শ্রবণশক্তি কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তার বদলে দিয়েছে এক অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মস্তিষ্ক এবং তার থেকেও অনেক বেশি মানবিক হৃদয়। চমৎকার ছবি আঁকে। স্টাউন্টনের স্কুলে পড়াশোনা করছে। ডরমিটরিতে থাকছে আপাতত। ভ্যাকেশনে বাড়ি আসে। বাড়িতে শুধু বাবা ছাড়া কেউ নেই। ওর বয়স যখন ছয়, তখন ওর মা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছিল। মেয়েটার জীবন ভারী দুঃখের। আর দুঃখের বলেই বছর তিনেক আগের এক হ্যালোয়িনের সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে ট্রিক ওর ট্রিট করতে এসে ও যখন হুট করে ইশারায় বলে বসল আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়, তখন আমি না করতে পারলাম না। না করার প্রশ্নই আসে না। আমার জীবনে সাশা এক বিস্ময়ের নাম। ওর অনেক গল্প আছে। গুগল থেকে বাংলাদেশের দরিদ্র পথশিশুদের দুঃখ-দুর্দশার কথা প্রথমবারের মতো জানতে পেরে ও কেঁদে ফেলেছিল। ঠিক করেছে বয়স আঠারো পেরোনোর পর একবার বাংলাদেশে যাবে। দরিদ্র পথশিশুদের জীবনযাত্রা নিজ চোখে দেখবে। এবং ওদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। কদিন আগের রানাপ্লাজা ধ্বসের ঘটনা ওকে আরো প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। সে অনেক কথা। এই উপন্যাসে শুধুমাত্র আমার জীবনের গল্প বলব বলেই মনস্থির করেছি। সাশাকে নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে হয়তো আলাদা একটা বই লিখতে হবে। তবে একটা কথা না বললেই নয় যে আমার জীবন উপন্যাস সাশাকে ছাড়া কখনোই পূর্ণতা লাভ করবে না। ওপরে উঠে এসে দেখলাম সাশা ডাইনিং এর চেয়ারে বসে আছে। একটা রয়েল ব্লু কালারের টি-শার্ট ওর পরনে আর ব্লু-জিন্স। নুডলসের মতো সোনালি কোঁকড়া চুলগুলো ফুলে ফেঁপে ঘাড়ময় ছড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই দৌড়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। ওর নন ভার্বাল ল্যাঙ্গুয়েজ আমি সম্পূর্ণটা বুঝি না। কিছু কিছু বুঝি, এই যেমন আই লাভ ইউ, আই অ্যাম স্টারভিং, আই অ্যাম স্লিপি, এই ধরণের ছোট ছোট জেশ্চার। গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারার সময় সাশা কানে হিয়ারিং এইড ব্যবহার করে। কিন্তু ঘরোয়া সাক্ষাতে কানে যন্ত্র রাখতে চায় না। আমরা টেক্সটিং এর মাধ্যমেই কথা বলি। আজকে ও আমাকে সর্বপ্রথম যে টেক্সটটা করল, (এখানে বঙ্গানুবাদ দেয়া হলো।) 

‘জানতাম না তুমি বিয়ে করেছ।’ 

আমি অপ্রস্তুত হেসে লিখলাম, ‘আমি নিজেও জানতাম না। এটা একটা অদ্ভুত ঘটনা সাশা! নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগছে।’ 

তার মুখ দেখে বুঝলাম হুট করে বিয়ে করে ফেলার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করা হয়নি, এটা একটা কারণ হতে পারে। লিখলাম, ‘তোমাকে আগে থেকে জানাতে পারিনি বলে দুঃখিত।’ 

সাশা একটু সময় স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর লিখল, ‘আমার ক্রিসমাসের উপহার কোথায়?’ 

এবার ভীষণ লজ্জিত হয়ে পড়লাম। গত চারদিন আমার ওপর দিয়ে যে ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে তাতে আমি যে নিজের নামটা ভুলে যাইনি সেটাই এক বিস্ময়। কিন্তু এসব বাস্তব কথা বাচ্চা মেয়েকে কে বোঝাবে? 

—‘কেনা হয়নি। পেয়ে যাবে কয়েক দিনের মধ্যেই। ‘সত্যটা লিখতে কষ্ট হলো। কিন্তু এই অকপট, নির্মল চিত্তের মেয়েটিকে আমার সত্য বলা ছাড়া উপায় নেই। মিথ্যা বলছি এটা টের পেয়ে গেলে ও ভয়ানক কষ্ট পাবে। এমন সময় জাহিদের সাথে রুশমিকে দেখলাম ডাইনিং হলে প্রবেশ করতে। জাহিদ ইশারায় সাশাকে পরিচয় করিয়ে দিল রুশমির সাথে। চোখের পলকেই বুঝতে পারলাম, আমারই মতো, সাশাও রুশমিকে পছন্দ করেনি। সাশাকে পড়তে পারা খুব সহজ। যে কেউ ওর সরল মনের ভাষা নিমেষে পড়ে নিতে পারবে। সে ছলনা করতে ভালোবাসে না। সৌজন্যতার বাহুল্য মেয়েটার মধ্যে নেই। যাকে পছন্দ হয় না তার সামনে থেকে অকপটে মুখ ঘুরিয়ে সরে পড়ে। আজকেও তাই করল। এই আচরণে রুশমির মুখে একটা কালো ছায়াপাত ঘটে যেতে দেখলাম। তবে ওর মুখের ভাবান্তর স্পষ্টরূপে দেখার সময় পেলাম না কারণ সাশা তখন সদর দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে। আমি ওর পথ আটকালাম। হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম ড্রয়িং রুমে। 

সাশা উপস্থিত থাকাকালীন শুভ্রার ফোন পেলাম। রুশমিকে নাকি আমার বিনীত অনুরোধ করতে হবে ও যেন আমার বাবা-মাকে ম্যানেজ করে। উড়িয়ে দিলাম কথাটা। আমার বয়েই গেছে! ম্যানেজ করার কিছু নেই। পাপা মমকে এর মাঝে জানিয়ে দিয়েছি সন্ধ্যায় বন্ধুর বাসায় যাব। ঝামেলা চুকে গেছে। রুশমির সাহায্যের আর কোনও প্রয়োজন নেই। এই মেয়ে নিজেকেই নিজে টেক কেয়ার করতে পারে না। আমাকে কী করে সাহায্য করবে? দৌড়োতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, হাঁটতে গিয়ে পিছলা খায়… লিটারেলি একটা ডিজাস্টার! আমি তো মজা করে বরফ ছুঁড়তে যাচ্ছিলাম। যেই সিনেমাটা দেখালো ভাই! অবিশ্বাস্য! এরকম ন্যাকা মেয়ের সাথে কথা বলারই কোন রুচি অবশিষ্ট নেই। অনুরোধ তো দূরের কথা! 

ঝামেলা বাঁধালো মম। বিয়ের পরদিন নতুন বৌকে ফেলে রেখে একলা একলা বন্ধুর পার্টিতে যাওয়া নাকি কোন ভাবেই সমীচীন নয়। যেখানেই যাই, বৌকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেই হবে। অন্যথায় সে আমাকে কিছুতেই বাড়ির বাইরে পা রাখতে দেবে না। অতএব… শুভ্রার পার্টিতে রুশমিকে, অর্থাৎ আমার বিবাহিতা ঝগড়াটে, ডাইনির মতো সুন্দর বৌকে সাথে নিয়ে যাবার জন্যই প্রস্তুত হতে হলো। 

মমকে দেখলাম খুব আগ্রহ নিয়ে রুশমিকে সাজিয়ে দিতে। আমার ঘর ছেড়ে দিতে হলো ওদের সাজগোজের জন্য। মম যেন একটা ছোট্ট পুতুল কিনে এনেছে দোকান থেকে। পুতুলের মতোই আদরে সোহাগে যত্নে মনের মতো সাজাচ্ছে নতুন বৌকে। রুশমিও কেনো জানি না, আমার সাথে যতটা রুড ছিল, তার ছিটেফোঁটাও আমার পরিবারের মানুষগুলোর সাথে ছিল না। ওকে পেয়ে সবাই আনন্দিত, নিশ্চিন্ত এবং প্রফুল্ল। একমাত্র আমিই আনন্দিত হতে পারছিলাম না। আমার মনে পড়ে সেই সন্ধ্যায় রুশমি একটা ল্যাভেন্ডার ব্লু রংয়ের লম্বা গাউন পরেছিল। সাথে রং মিলানো হিজাব। বাইরে বিষণ্ণ শীতরাত্রি। নেইবারহুডের সবগুলো বাড়ি ক্রিসমাসের সাজে সজ্জিত, আলোয় ঝলমল। সেসব বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে এ সময় প্রাণবন্ত পারিবারিক কোলাহল কানে এসে লাগে। কানে এসে লাগে ক্রিসমাসের গান। জানালা দিয়ে দেখা যায় লম্বা লম্বা আলোকসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রি। স্যান্টার টুপি পরে ঘুরে বেড়ায় শিশু এবং বৃদ্ধরা। মোট কথা উৎসবের আমেজে চারপাশটা মেতে ওঠে ঝুমঝুম করে। 

সময় খুব আশ্চর্য বস্তু। আমরা যে সময়টার মধ্যে ডুবে থাকি অর্থাৎ বর্তমানটা বেশিরভাগ সময়ই আমাদের কাছে তাৎপর্যবিহীন ভাবে ধরা দেয়। জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত পার করার সময় আমরা টের পাই না যে সময়ের আকাশ থেকে একটা মহা মূল্যবান তারা খসে পড়ছে। তাই অধিকাংশ মানুষ বর্তমানকে গুরুত্ব না দিয়ে অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়ে থাকে। আমিও ব্যতিক্রম নই। সেই সন্ধ্যায় রুশমি যখন আমার পাশে এসে চুপটি করে বসল গুটিশুটি হয়ে, তখন আমি জানতাম না, এই ছোট্ট টুকরো ঘটনাটি একদিন স্মৃতির ঘরের দরজায় এমন প্লাবনের মতো এসে আছড়ে পড়বে, যে এর প্রতিটি খুঁটিনাটি আমি বিশদভাবে মনে করতে বাধ্য হব। 

হ্যাঁ মনে পড়ছে… আর মনে পড়ছে বলেই আজ আমি এই স্মৃতিকথা লিখছি। অতীত আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি নিজেকে দেখছি আমাদের অ্যাশবার্নের পুরোনো আমলের বাড়িটার দোচালা গাড়ি বারান্দায়। সন্ধ্যার নীলচে আলোর মধ্যে চারপাশের বরফ সাদা প্রকৃতিকে মনে হচ্ছে যেন দক্ষ শিল্পীর হাতে গড়া কোন উচ্চমার্গীয় সাদাকালো কারুকাজ। হিমবর্ষী আকাশের গায়ে তুষারাবৃত পৃথিবীর মুখ প্রতিফলিত হচ্ছে। আকাশটাকেও তাই সাদাটে দেখাচ্ছে। গাড়ির ছাদে বরফ জমে গেছে। স্পেড দিয়ে বরফ পরিষ্কার করছি। হাই হিল জুতোয় টুকটুক আওয়াজ তুলে রুশমি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নাকে এসে লাগছে সুন্দর একটা মেয়েলি পারফিউমের ঘ্রাণ। 

রুশমি 

শিহাব গাড়ির ছাদের ওপর থেকে বরফ পরিষ্কার করছে। আমি অনুগত স্ত্রীর মতো কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ওর কাজ দেখছি। অনুগত ভাব দেখানোর কারণ হলো আমার শ্বশুর-শাশুড়ি বাড়ির পোর্চে উপস্থিত আছে এই মুহূর্তে। দুজনেই আমাদেরকে লক্ষ্য করছে। প্রথমবার আমরা স্বামী-স্ত্রী একত্রে বাইরে যাচ্ছি। এই ঘটনায় আমাদের চেয়ে আমাদের মা-বাবারাই যেন বেশি আনন্দিত এবং উত্তেজিত। সন্ধ্যার আবছা আলোয় শিহাবের মুখের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছি। কেমন ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যেন আমার উপস্থিতি সে টেরই পায়নি। আমি লক্ষ্য করেছি সকালের ঘটনাটার পর থেকে ও আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। ঝগড়া করার সুযোগ দেয়া তো দূরের কথা চোখে চোখে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। এই নির্লিপ্ততা আমার ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে নির্লিপ্ত শিহাবের চাইতে ঝগড়াটে শিহাবই ভালো ছিল। আমি যে কী বিপদে পড়েছি ভাই, কী করে বলি? যে মানুষটাকে আমার অসহ্য রকমের খারাপ লাগছে সেই মানুষটার সাথেই ভাগ্য আমাকে বারে বারে জুড়ে দিচ্ছে। এমন দুর্ভাগ্য যেন আমার শত্রুরও না হয়। 

সেই সন্ধ্যায় কনকনে হিমবর্ষী আকাশের নিচে মোটা জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবছিলাম, কেনো আমি ওকে এতো বেশি ঘেন্না করছি? সে তো আমাকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেনি। বাবা-মায়ের আদেশ পালন করেছে শুধু। তাহলে ওর দোষটা কোথায়? দোষ আছে বৈকি। যে শুভ্রার জন্য সে আমার সাথে বিয়ের প্রথম প্রহর থেকে বাজে ব্যবহার করে আসছে সেই শুভ্ৰা যে ওকে নিছক সস্তা পণ্যের মতো ব্যবহার করছে এটা বুঝতে না পারাটাই ওর সবচেয়ে বড় দোষ। তবে আমার ধারণা ও অনেক কিছুই বোঝে না। কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করে। এই যেমন আজ বিকেলে একটা বোবা কালো মেয়ে (ওর খুব ভালো বন্ধু) এসেছিল বাড়িতে। মেয়েটিকে প্রথমবার দেখেই আমি বুঝে গেছি শিহাবকে সে ভালোবাসে। শুভ্রা বাসে না, কিন্তু সেই মেয়েটি বাসে। যে ব্যাপারটা আমি এক মুহূর্তে টের পেয়ে গেছি শিহাব সেই ব্যাপারটা এতো বছরের বন্ধুত্বেও টের পায়নি। এটা কী করে সম্ভব আমি জানি না। ওকে দেখে তো বোকা বলে মনে হয় না। বরং বাদামি দুটি চোখে বুদ্ধি সারাক্ষণ ধকধক করে জ্বলতে থাকে। তাহলে ওই কিশোরী মেয়েটির মনের কথা সে বোঝে না কেনো? আমি এসব ভেবে যাচ্ছি অনবরত আর আমার ভেতরের মনটা আমাকে ভ্রুকুটি করে শাসাচ্ছে। সে বলছে এই ছেলেটাকে নিয়ে এত ভাববার কিছু নেই। অথচ ভাবাটাই স্বাভাবিক নয় কি? মানুষটার সাথে মাত্র গতকাল আমার বিয়ে হয়েছে। এখন সে যত খারাপই হোক না কেনো আমার চিন্তাজগতে তার প্রভাব থাকবেই। আমার তো আর ওর মতো শুভ্রা নেই। দিনরাত যার নামে ধ্যান করব। 

গাড়ি পরিষ্কার করা হয়ে গেলে শিহাব রিমোট চেপে দরজার লক খুলল। নিষ্প্রাণ গলায় আদেশ দিল, ‘গেট ইন দ্যা কার।’ আমি একবার পেছন ফিরে তাকালাম। শ্বশুর-শাশুড়ি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনের এক টুকরো বারান্দায়। চেয়ে আছে আমাদের দিকে চাতক পাখির মতো। আমি তাকাতেই হাত নেড়ে বলল, ‘খোদা হাফেজ।’ 

আমিও হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। শিহাব কোনদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। দরজা বন্ধ করল খুব শব্দ করে। যেন অনেকদিনের জমে থাকা রাগ ঝাড়ল দরজাটার ওপরে। আমি জানি ও কেনো রেগে আছে। আমি সাথে যাচ্ছি বলেই ওর এত রাগ। আমার সঙ্গ তার সহ্য হচ্ছে না! অথচ তার বোঝা উচিত যে আমি নিজের ইচ্ছেয় কিছুই করছি না। বিবেকবান ব্যক্তি হলে সে নিশ্চয়ই অসহায় একটা মেয়ের সাথে অকারণে এমন দুর্ব্যবহার করতে পারত না। আমিও তো একটা মানুষ। আমারও তো মন বলে কিছু আছে নাকি? এত অল্প বয়সে এতটা ধৈর্য আমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে আদৌ ধরতে পারত কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। গাড়িতে ওর পাশে উঠে বসেছি। ভেতরটা অপমান আর লজ্জায় একদম কুঁকড়ে আছে। আত্মবিশ্বাসের খুঁটি নড়বড়ে হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে। গত পরশুদিন এই গাড়ির সাথেই অ্যাকসিডেন্ট করে বসেছিলাম। কত ঝগড়াও করলাম গাড়ির ড্রাইভারের সাথে অ্যাক্সিডেন্টের পরে। আজকে সেই গাড়িতেই কিনা আমাকে অসহায়, পরাজিত, অক্ষম ব্যক্তির মতো উঠে বসতে হলো। হোয়াট অ্যান আয়রনি! গাড়ি চলতে শুরু করল নেইবারহুডের সরু রাস্তা দিয়ে। আমি জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছি। সন্ধ্যের ফিকে আলোয় মরা গাছের ডালপালা গা ভর্তি তুষার নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। তুষারাবৃত রাতগুলোয় আকাশ আলোকিত হয়ে যায়। লাইট রিফ্লেকশনের কারণেই এটা হয়। এখনও তাই হচ্ছে। পরিষ্কার শীতল আকাশ গোলাপি আভায় ঢেকে আছে। রাস্তার দুধারে স্তূপীকৃত বরফের পাহাড়। আমরা একটার পর একটা আলোকসজ্জিত বাড়ি পার হয়ে যাচ্ছি। সামনের রাস্তা পাহাড়ের মতো উঁচুতে উঠে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন পেট মোটা এক রূপালি চামড়ার অজগর শুয়ে আছে। গাড়ি একটুও টাল না খেয়ে মসৃণ ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। রেডিওতে বেজে যাচ্ছে ক্রিসমাসের গান। 

Last Christmas I gave you my heart 
But the very next day you gave it away
This year, to save me from tears
I’ll give it to someone special 

আড়চোখে একবার তাকালাম পাশে বসা মানুষটার দিকে। মুখ সম্মুখে তাক করা। চোখের দৃষ্টি পাথরের মতো নিশ্চল। যেন আমার দিকে তাকানো নিষেধ। কথা বলাও নিষেধ। এই নির্দয়, ক্রুরমতি আচরণ আমাকে পীড়া দিচ্ছে। জীবনে কোন পুরুষ আমাকে কোনদিন এতটা অবহেলা করেনি। চলেই তো যাব এর জীবন থেকে। কিন্তু চলে যাবার আগে মানুষ হিসেবে অণুমাত্র মূল্যায়নটুকু তো পেতে পারি, নাকি? কী কারণে জানি না… আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। এই নিষ্ঠুর ছেলেটার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কারণ এমন নিষ্ঠুর মানুষ আমি আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। গাড়ি তখন হাইওয়েতে উঠে এসেছে। আমি হঠাৎ কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই বলে বসলাম, ‘আমাকে এদিকে কোথাও নামিয়ে দাও।’ 

শিহাব একটু চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে। তাকিয়েই আবার চোখ সরিয়ে নিল সামনে। গম্ভীরভাবে বলল, ‘বুঝলাম না।’ 

আমি কণ্ঠে দৃঢ়তা আনার চেষ্টা করলাম, ‘না বুঝার কী হলো? কাছেই স্টারবাক্স আছে। আমাকে ওখানে নামিয়ে দাও।’ 

—‘তোমার কফি চাই?’ 

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ওর দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললাম, ‘পার্টিতে যেতে চাইছি না। আর আমার মনে হয় তুমি এবং শুভ্রা … তোমাদের কেউই আমার উপস্থিতি পছন্দ করবে না।’ 

হাইওয়েতে কোন আলো নেই। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির আলোতেই পথ চলতে হচ্ছে। অন্ধকারে শিহাবের মুখের ভাবান্তর স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। ও সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। মনোযোগ দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সিগন্যালে থামলো গাড়ি। হাত বাড়িয়ে 

রেডিওটা বন্ধ করল। তারপর আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, 

—‘আমাদের পছন্দ অপছন্দতে তো কিছু এসে যায় না, তাই না? তোমার যদি আসতে ইচ্ছেই না করে তাহলে প্রথমে না করে দিলেই পারতে। মাঝপথে এসে নাটক দেখানোর অর্থ কী?’ 

আমি চট করে কিছু বলতে পারলাম না। অপমানে আমার ভেতরটা জমে আছে। খুব ছোট হয়ে আছে মনটা। আমাকে বোঝার মতো একটা মানুষ নেই পৃথিবীতে। এই ছেলেটাকে কে বোঝাবে যে বিয়ের পরের দিনই শাশুড়ির আদেশ অমান্য করাটা আমার জন্য অসম্ভব একটা ব্যাপার। আমার শিক্ষা, ভদ্রতা জ্ঞান এবং নৈতিকতাবোধ আমাকে এমন কাজ করা থেকে বিরত রেখেছে। 

—‘শখ করে আসিনি। এসেছি বাধ্য হয়ে।’ 

—‘বেশ তো। তাহলে বাধ্য হয়েই চলো পার্টিতে। এখন হঠাৎ এতো অবাধ্য হয়ে উঠলে কেনো?’ 

আমি গোঁ ধরা গলায় বললাম, ‘না আমি যাব না। আমাকে নামিয়ে দাও। মেট্রো করে বাসায় চলে যাব।’ 

শিহাব হতভম্ব ভাবে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সজোরে মাথা নেড়ে বলল, ‘ইম্পসিবল।’ 

খুব রাগ ধরে গেলো, ‘ইম্পসিবল মানে? আমি বলছি আমি নেমে যাব। তুমি না করার কে?’ 

—‘পাগলামো করো না।’ 

—‘পাগলামো আমি করছি না। তুমি করছ। কী মনে করো নিজেকে? যখন যা ইচ্ছা করে যাচ্ছ!’ 

সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। শিহাব স্টিয়ারিং এ হাত রেখে থমথমে গলায় বলল, ‘ঝগড়া না করলে তোমার ভালো লাগে না। তাই না?’ 

—‘তোমার সাথে ঝগড়া করার কোন রুচিই নেই আমার।’ 

–‘রুচি এবং ইচ্ছা দুটোই মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে আছে তোমার।’

—‘মোটেও না। তোমার সাথে ঝগড়া কেনো, কোন কথা বলারই রুচি নাই।’

—‘তুমি কি সবার সাথেই সব সময় এমন ক্যাটক্যাট করে কথা বলো? নাকি আমি স্পেশাল?’ 

—‘আমি ক্যাটক্যাট করে কথা বলি?’ 

—‘বলো তো।’ 

—‘আর তুমি?’ 

—‘আমি তো নরমালিই কথা বলছি। তুমি আয়নায় নিজের মুখটা দেখো একবার। দেখলেই বুঝবে।’ 

—আমার রাগ বেড়ে যায়, ‘কী বুঝব?’ 

—‘বুঝবে এরকম ক্যাটক্যাট করে কথা বললে তোমাকে কী রকম বাজে দেখায়।

—‘আমাকে বাজে দেখায়?’ হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার একুশ বছরের জীবনে এমন ভয়াবহ কথা আমাকে কেউ বলেনি। একটা উৎকট আক্রোশ সারা শরীর কাঁপিয়ে দিয়ে গেলো। বুঝতে পারছি ভীষণ টিপিক্যাল ন্যাকা মেয়েদের মতো রিঅ্যাকট করছি। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারছি না। পাশে বসা বেয়াদব ছেলেটাকে আমার আঁচড়ে কামড়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। লাখি মেরে গাড়ির জানালা দিয়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে! 

‘রুক্ষ আচরণ করলে সবাইকেই বাজে দেখায়। নির্বিকার গলায় বলল শিহাব। 

আমার ব্রহ্মতালু অগ্নি উত্তাপে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে বললাম, 

—‘মোটেও আমাকে বাজে দেখায় না। বাজে দেখায় তোমাকে… তোমার গার্লফ্রেন্ডকে… তোমার…’ 

কথাটা শেষ হবার আগেই শিহাব হেসে উঠল। 

(আল্লাহ! ওর হাসিটা অসহ্য সুন্দর!) 

—‘শুভ্রা আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে অ্যাট্রাক্টিভ মেয়ে!’ 

কথা সরে গেলো মুখ থেকে। কী বলতে গিয়েছিলাম তা বেমালুম ভুলে বসে থাকলাম। কটমটে চোখে ওর দিকে চেয়ে রইলাম শুধু। আমার যে বয়স তখনও অল্প! একজন সুদর্শন যুবক (আইনত যে আমার স্বামী) মুখের ওপর শুনিয়ে দিচ্ছে আমি অন্য নারীর চাইতে কম আকর্ষণীয়, এই ভয়াবহ সত্যটা সহজভাবে মেনে নেবার মতো মানসিক পরিপক্কতা কিংবা বাস্তব জ্ঞান তখনও আমার হয়ে ওঠেনি। খুবই খারাপ লাগছে। অপমানে কাঁটা হয়ে গেছে ভেতরটা। কান্না পাচ্ছে। উঁচু গলায় বলে উঠলাম, ‘গাড়ি থামাও। আমি নামব।’ 

হঠাৎ চার চাকার বাহনটার ভেতরে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেলো। কোন ভূমিকা ছাড়াই একেবারে সিংহের মতো গর্জে উঠল শিহাব, 

—‘চুপ করো। বসে থাকো চুপচাপ!’ 

ধমক খেয়ে বুক কেঁপে উঠল একদম। আমার বাবা-আম্মুও কখনো আমাকে এতো জোরে ধমক দেয়নি। কান্নার দমকে ঠোঁট কেঁপে উঠল। আর একটা কথাও না বলে অন্ধকারে চুপচাপ বসে বসে কাঁদতে লাগলাম। 

শিহাব 

এই মেয়েটাকে নিয়ে পড়েছি মহাবিপদে। মাঝরাস্তায় হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে পড়তে চায়। আশেপাশে কোথাও কোন মেট্রোস্টেশন নেই। বাস নেই। এই হাড়কাঁপানো শীতের মধ্যে হাইওয়েতে নেমে করবেটা কী? যাবে কোথায়? কোন বিপদ হলে তো আমার ঘাড়েই দোষটা পড়বে তাই না? এতই যদি বিরক্ত লাগে আমার সঙ্গ তাহলে প্রথমেই না করে দেয়নি কেনো? বললেই পারত শরীর খারাপ লাগছে, বাইরে বেরোবো না। ব্যাস ল্যাঠা চুকে যেত। বাড়ি থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এসে এখন মাঝরাস্তায় এসব ঢং দেখানোর মানে কী? হাজার চেষ্টা করেও মেজাজ বশে রাখতে পারছি না। শুভ্রা ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে জানি না। রুশমিকে সে দাওয়াত করেনি। ওকে দেখে রেগে যাবার সম্ভাবনা আছে। আবার নাও রাগতে পারে। শুভ্রার সাইকোলজি আমি বুঝি না। মাঝে মাঝে ওকে খুব দুর্বোধ্য মনে হয়। তবে জনাথনের পার্টিতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট। ও জনাথনকে বোঝাতে চায় যে জনাথন ওকে ডাম্প করে অন্য মেয়ের কাছে চলে গিয়ে থাকলেও শি ইজ এবসোলিউটলি অলরাইট উইদ হার নিউ বয়ফ্রেন্ড! জেনে বুঝেও সজ্ঞানে এই প্রহসনের অংশ হতে যাচ্ছি আমি। কেনো যাচ্ছি? উত্তরটা স্পষ্ট! শুভ্রাকে আমার ভালো লাগে। ওকে দেখতে, ওর কাছে থাকতে, ওর সাথে সময় কাটাতে আমার ভালো লাগে। তাছাড়া ডিপ ডাউন ইনসাইড, আই ক্যান ফিল যে শুভ্রা আজ নয়তো কাল আমাকে ভালোবাসবে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হবার আগ পর্যন্ত ধৈর্য আমাকে ধরতেই হবে! 

অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামালাম। শুভ্রাকে ফোন করতেই বলল ও লবিতেই অপেক্ষা করছে। দুই মিনিটের মধ্যে হাজির হবে। শিস বাজিয়ে স্টিয়ারিং এর ওপর হাতের দশ আঙুল নাচাচ্ছিলাম অন্যমনস্কভাবে। হঠাৎ মনে হলো রুশমি বোধহয় কাঁদছে। কান্না জড়ানো ভারী নিশ্বাস আর নাক টানার শব্দ কানে লাগছে। ওর মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে জানালার দিকে। একটু একটু কাঁপছে কি? মেয়েটাকে এভাবে ধমক দেয়া হয়তো উচিত হয়নি। বেচারি ধমক খাওয়ার পর একদম চুপসে গেছে। ছেলেমানুষ রয়ে গেছে এখনো। কান্নাকাটির মতো কিছু হয়েছে নাকি? আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেলো তো! 

এই মুহূর্তে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছি না ঠিক কী করা উচিত। কিছু বলতে গেলে যদি আবার ক্যাটক্যাট করে ওঠে? এই মেয়ের কিছু ঠিক নেই। হ্যাঁ… এখন আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি যে, মেয়েটা কাঁদছে। ওর কান্নাটা আমার ভালো লাগছে না। জানালার কাচে টোকা পড়ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি লং কোট গায়ে দিয়ে শুভ্রা দাঁড়িয়ে আছে। জানালার কাচ নামালাম। বললাম, ‘উঠে বসো গাড়িতে।’ 

শুভ্রা গলা বাড়িয়ে আমার পাশের সিটে বসা মানুষটাকে একবার দেখলো। বাধঁছেড়া বিস্ময় নিয়ে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এটা কে?’ 

—‘রুশমি!’ 

ল্যাম্পপোস্টের হলদে আবছা আলোয় শুভ্রার মুখটা বিরক্তিতে কুঁকড়ে যেতে দেখলাম স্পষ্টভাবে। রুশমি তখনও উল্টোদিকের জানালায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। হয়তো কাঁদছে এখনো। শুভ্রা আমার জানালা থেকে সরে পড়ল। গটগটিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেলো রুশমির দিকে। জানালায় টোকা দিল আমি সতর্কভাবে তাকালাম ওদের দিকে। শুভ্রা রুশমিকে কী বলবে কে জানে। বেচারি এমনিতেই ধমক খেয়ে কাদা হয়ে গেছে। এখন শুভ্রা অফেন্সিভ কিছু না বললেই হয়। শুভ্রা ওপাশটায় গিয়ে দাঁড়াতেই আমি গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে দিলাম। রুশমি সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ভঙ্গিটা বলে দিল এই মুহূর্তে শুভ্রার সাথে কোনও প্রকার বাকবিতণ্ডায় যেতে চায় না সে। শুভ্রা খুব মধুর গলায় বলল, ‘রুশমি ডিয়ার! পেছনে চলে আয়। আমাকে সামনে বসতে দে। প্লিজ?’ 

কথাটা শোনার পর… কেনো? কে জানে! রুশমি হঠাৎ চোখ তুলে একপলক চাইল আমার দিকে। ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় দেখতে পেলাম ওর কাজল ডোবা আশ্চর্য সুন্দর চোখদুটোতে রুপো রংয়ের বিন্দু বিন্দু জল চিকচিক করছে। কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। আমি কোন কথা খুঁজে পেলাম না, শুধু টের পেলাম এখুনি… এইমাত্র… ওই জন্মকাজল পরা ঐশ্বরিক চোখের আশ্চর্য দৃষ্টিটা আলোর চেয়েও তীব্র বেগে ছুটে এসে একদম আমার হৃৎপিণ্ড বরাবর ছুরির মতো গেঁথে গেলো! তীব্র ব্যথায় চিলিক দিয়ে উঠল ভেতরটা। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। মনের খুব গভীরে আবছাভাবে বুঝতে পারলাম ওই চোখদুটোকে আমি ভয় পাই। রুশমি সিটবেল্ট খুলতে যাচ্ছিল। আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, ‘থাক! খুব বেশি দূরের পথ তো নয়। এই কয়েকটা মিনিট তুমি পেছনেই বসো শুভ্রাদি!’ 

কথাটা বলেছিলাম কারো দিকে না তাকিয়ে। আদেশ দেয়ার সুরে। শুভ্রা কী ভাবছে জানি না। রুশমি কী ভাবছে তাও জানি না। আমার বলতে ইচ্ছে হয়েছে তাই বলেছি। উচিত অনুচিত ভেবে বলিনি। কয়েক সেকেন্ড কেটে গেলো নীরবে। আমি সামনের রাস্তায় চোখ সিঁটিয়ে রেখেছি। আমার কপালে সম্ভবত চিন্তার কয়েকটা ভাঁজ পড়ে গেছে। অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। বুঝতে পারছি রুশমি আমার দিকে চেয়ে আছে। বাইরে দাঁড়ানো শুভ্রার গতিবিধি আমার অজানা। একটা সময় শুভ্রা পেছনের সিটে উঠে বসল। 

—‘জনাথনের অ্যাড্রেসটা দাও।’ শুভ্রাকে বললাম। 

—‘অনেক আগেই টেক্সট করেছি তোকে। ভুলে গেছিস?’ 

নিজের বোকামিতে বিরক্ত হলাম। সত্যিই তো, সেই বিকেলবেলায় শুভ্রা ঠিকানাটা পাঠিয়ে রেখেছিল আমার ফোনে। জনাথনের বাসা বাল্টিমোরে। জি পি এসে অ্যাড্রেসটা দিতেই দেখি প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে। শুভ্রা খোঁটা দিতে ভুলল না, 

—‘খুব বেশি দূরের পথ নয়। তাই না শিহাব? 

আমি স্মার্ট হবার চেষ্টা করলাম, ‘না… একেবারেই দূর নয়। মাত্র চল্লিশ মিনিট।’ 

আড়চোখে দেখলাম রুশমি কাঠ হয়ে বসে আছে। পেছনের সিটে যেতে না চাইবার কারণ কী হতে পারে? ও আমাকে যতটা অপছন্দ করে তাতে তো আমার পাশে বসে থাকার চাইতে পেছনে গিয়ে বসাটাই ওর জন্য বেশি স্বচ্ছন্দের হওয়ার কথা। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম… অনেকক্ষণ ধরে… এমনকি শুভ্রা গাড়িতে উঠে বসার পরেও… আমি শুধু রুশমিকেই ভেবে যাচ্ছি অনবরত! 

রুশমি 

মানবমন কী আশ্চর্য এবং অভেদ্য কুহেলিকায় আচ্ছন্ন সর্বদা, তাই না? ভাবতে গেলে অবাক লাগে! আমার মনের ভীষণ আবছা একটা কোণে শুভ্রার প্রতি যে একটু একটু করে বিরূপ ভাবের সঞ্চার হচ্ছিল তা আমি টের পেলাম তখন, যখন গাড়ির জানালায় মাথা ঝুঁকিয়ে শুভ্রা মধুর চেয়েও সুমিষ্ট গলায় বলল, ‘রুশমি ডিয়ার, পেছনে চলে আয়। আমাকে সামনে বসতে দে প্লিজ!’ 

কথাটা কানে ঢোকা মাত্র এক ব্যাখ্যাতীত ঋণাত্মক অনুভূতিতে আমার ভেতরটা গাঁট হয়ে গেলো। যুক্তিহীন এক বোবা অপমানবোধ অজগরের হা করা বিশাল মুখের মতো তেড়ে এসে আমাকে আপাদমস্তক গ্রাস করতে চাইল যেন। আমার আপন সত্তাটি মুহূর্তের মাঝে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে উঠল। ভেতর থেকে একটি চিরাচরিত নারী সত্তা আলাদিনের জিন হয়ে কুন্ডলি পাকিয়ে বেরিয়ে এসে কদাকার চেহারা সমেত ভ্রুকুটি করে তাকালো আমার দিকে। মস্তিষ্কের বদ্ধ দ্বারে খুটখুট করে কড়া নেড়ে জানিয়ে দিয়ে গেলো যে, শুভ্রা… খুব স্বার্থপর একটা মেয়ে। শিহাবকে যতই অপছন্দ করি না কেনো আল্লাহর নামে আমি তো তাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছি। এখন শুভ্রা যে সজ্ঞানে, পরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করছে এটা জানার পরেও প্রতিবাদ না করে বসে থাকলে কি আমার আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন? এটা ছিল চিরাচরিত নারী সত্তার মতামত। আমার আপন আমিটা কিন্তু বলছে অন্য কথা। সে বলছে, শিহাবকে তো আমি স্বামী হিসেবে এখনো মন থেকে গ্রহণ করতে পারিনি। ঘেন্না ছাড়া অন্য কোন অনুভূতিই আমার নেই ওর প্রতি। এর পাশ থেকে কেটে পড়তে পারলেই বাঁচোয়া। আমার উচিত শুভ্রার কথা মতো পেছনে গিয়ে বসা। এভাবেই মনের মধ্যে ক্রমাগত ভালো মন্দের লড়াই চলছিল। নিরুপায় হয়ে শিহাবের দিকে একবার তাকালাম। আর তাকাতেই জানি না কেনো আমার এতক্ষণের প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকা বিক্ষিপ্ত, বিকারগ্রস্ত, বিভক্ত সত্তা দুটো হঠাৎ ম্যাজিকের মতো একটি পরিপূর্ণ মানুষী মনে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। আমি খুঁজে পেলাম আস্থা, সহায় এবং সাহস। পায়ের তলার পিচ্ছিল মাটি শক্ত হয়ে উঠল। আমি যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারলাম অনেক অনেকক্ষণ পর। তারপর শিহাব যখন শুভ্রাকে পেছনের সিটে বসতে বলল, তখন সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা এক নিগূঢ় ধোঁয়াটে কারণবশত আমার হঠাৎ খুব ভালো লাগল, শান্তি লাগল, স্বস্তি লাগল! আমি দুৰ্জ্জেয় সেই কারণ নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। সদ্য প্রাপ্ত অনাবিল শান্তিতে আকণ্ঠ ডুব দিলাম। 

এই মুহূর্তে শুভ্রা আমার দিকে কুটিল চোখে চেয়ে আছে। অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু খারাপ লাগছে না। মাথার ভেতরটা স্বচ্ছ জলের মতো টলটলে হয়ে উঠছে ক্রমশ। আমি এখন পরিষ্কারভাবে ভাবতে পারছি। বুঝতে পারছি শিহাবের সাথে বিয়ে হওয়াটা আমাকে এত কষ্ট কেনো দিয়েছে। কষ্টের মূল কারণ শুভ্রা। শুভ্রা না থাকলে শিহাবকে মেনে নিতে নিশ্চয়ই আমার অতটা কষ্ট হতো না, যতটা কষ্ট এখন হচ্ছে। আমার বাবা-আম্মু আর দশটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো করেই আমাকে শিখিয়েছে কী করে যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে হয়। আমি হয়তো মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধে এর মাঝেই আঁটঘাট বেঁধে নেমে পড়তাম যদি না শুভ্রার উপস্থিতি এই মুহূর্তে আমার জীবনে না থাকতো। 

—‘রুশমি, তোর কোন বয়ফ্রেন্ড নাই?’ হঠাৎ প্রশ্নটা ভেসে আসল, পেছন থেকে। একটা বয়ফ্রেন্ড নেই বলে খুব আফসোস হলো। কী ভালোই না হতো এখন যদি আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারতাম, হ্যাঁ আমারও একটা বয়ফ্রেন্ড আছে! 

—‘না।’ 

— ‘বলিস কী?’ 

—‘শুনলে তো কী বললাম।’ 

একটু সময় নীরবতা। তারপর সন্দিগ্ধ কণ্ঠের প্রশ্ন, ‘ওয়েল… ছিল নিশ্চয়ই। ব্রেকআপ হয়ে গেছে। তাই না?’ 

টের পাচ্ছি শিহাব আমাকে চোখের কোণ দিয়ে দেখছে। অর্থাৎ উত্তরটা সেও জানতে চায়। 

—‘কখনোই ছিল না।’ 

শুভ্রা অদ্ভুত হাসলো, ‘সিরিয়াসলি?’ 

—‘সিরিয়াসলি।’ 

—‘কিন্তু কেনো?’ এবার শুভ্রার প্রশ্ন শুনে মনে হলো যেন বয়ফ্রেন্ড না থাকা একটা গুরুতর অপরাধ। 

—‘জানি না।’ 

শুভ্রা আর কোন কথা বলল না। কথা বলল না শিহাবও। বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে হয়তো আমার উপস্থিতি ওদের দুজনের কারুরই ভালো লাগছে না। কিন্তু আশ্চর্জ্জনকভাবে ওদের এই ভালো না লাগাটা আমার মধ্যে কোন রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে না। আমার মনটা শান্ত হয়ে আছে। কারণ একটু আগে শিহাব যখন শুভ্রাকে পেছনের গদিতে বসতে বলেছে তখনই আমি জেনে গেছি যে আমি সেখানেই আছি, যেখানে আমার থাকার কথা। শিহাবের পাশে বসে থেকে আমি একটুও অনধিকারচর্চা করছি না। বরং এই মুহূর্তে এটাই আমার একমাত্র করণীয় কর্তব্য বলে মনে হচ্ছে। নিজের মনের কথা আমি স্পষ্টভাবে পড়তে পারছি এখন। হ্যাঁ এই বিয়েটা টিকবে না জানা কথা। কিন্তু আমি কোনভাবেই চাই না যে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে শিহাব শুভ্রাকে বিয়ে করুক। কারণ শুভ্রা ওকে ঠকাবে। আমি চাই না শিহাব দ্বিতীয় বার বিয়ে করেও ঠকে যাক। কেনো এরকম কথা আমার মনে এলো হঠাৎ জানি না। কিন্তু এসেছে এটাই বড় কথা। 

জনাথনের বাড়িটা জাঁকজমক সেজেছে ক্রিসমাস উপলক্ষে। অ্যাম্বার লাইট জ্বলছে সারা বাড়ির গা জুড়ে। বাড়ির সামনের পাতা বিহীন গাছগুলোতেও লতার মতো জড়িয়ে দেয়া হয়েছে মরিচ বাতি। বাগানের মাঝখানে ঝিকিমিকি আলোর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে আছে যীশু এবং মেরির মূর্তি। বাড়ির ভেতর থেকে গানের আওয়াজ ছুটে আসছে। 

Santa baby, I want a yacht, and really, 
that’s not a lotBeen an angel all year 
Santa baby, so hurry down the chimney tonight 

গাড়ি থেকে নামতেই শুভ্রা বিনা বাক্য ব্যয়ে শিহাবের পাশে দাঁড়িয়ে ওর বাহু জড়িয়ে ধরল। তারপর এমন দ্রুত গতিতে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল যেন এক সেকেন্ড দেরি হয়ে গেলে খুব মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। আমার দিকে একবার তাকানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না। কিন্তু তাকালো শিহাব। সিঁড়ি ভেঙে পোর্চের ওপর পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ও আমাকে। কিন্তু শুভ্রার তোড়জোড়ে দম ফেলানোর সময় পেলো না বোধহয়। ঢুকে পড়তে হলো ভেতরে। স্বাভাবিক ভাবেই আমি পেছনে পড়ে গেছি। হাই হিল পরে খুব বেশি দ্রুত হাঁটতে পারি না। হোঁচট খাবার সম্ভাবনা থাকে। তাই তাড়াহুড়া না করে ধীরে ধীরেই বাড়ির ভেতর ঢুকলাম। ঢোকার মুখে প্রশস্ত করিডোর, তারপর সুবিশাল লিভিং রুম। ঢুকতেই অপরিচিত কয়েকজন নারীপুরুষ হেসে ‘মেরি ক্রিসমাস’ বলল। আমিও বললাম। ঘরের চারকোণায় চারটা লম্বা লম্বা আলোকসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রি। গিজগিজ করছে মানুষ। কেউ বসেছে সোফায়, কেউ কেউ আবার জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে গল্প করছে, মদ্যপান করছে। গান বেজে যাচ্ছে হালকা আওয়াজে। গানের তালে তালে নেচে চলেছে কিছু ফূর্তিবাজ নারী-পুরুষ। 

শুভ্রা আর শিহাবকে দেখতে পেলাম। গায়ের গরম কাপড় খুলে ফেলেছে এর মাঝেই। হলঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই অজস্র মানুষের সমাগমে আমি একেবারেই একলা এবং অনাহুত। এখানে কাউকে আমি চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না। কোণার দিকের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম চুপচাপ। শুভ্রাকে আমার বিরক্ত লাগছে। হ্যাঁ সত্যি বলতে কি শিহাবের চাইতেও শুভ্রাকে এখন আমার বেশি বিরক্ত লাগছে। হাসতে হাসতে বারবার শিহাবের গায়ের ওপর ঢলে পড়ছে। এমন বেহায়া মেয়ে আমি এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ল না। শুভ্রা আজকে ভিন্টিজ সাজ সেজেছে। একটা অলিভ কালারের স্লিভলেস গাউন ওর গায়ে। ডানদিকের হাঁটুতে লম্বা ফাঁড়া। হাঁটার সময় ফর্সা হাঁটু বেরিয়ে আসে। চন্দন রঙের বুকের ভাঁজে হীরের লকেট ঝুলছে। মাথায় অলিভ কালারের ব্যান্ড। বব ছাট চুলগুলো কার্ল করা। পুরোনো দিনের হলিউড মুভির নায়িকাদের মতো লাগছে ওকে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভিন্টিজ লুকের শুভ্রাকে দেখাচ্ছে দারুণ। কিন্তু আমার পোড়া চোখদুটোকে বেশি টানছে ওর পাশের জন। শিহাব একটা সিম্পল সাদা শার্ট পরেছে, সাথে কালো কাপড়ের প্যান্ট। খুব সাধারণ, কিন্তু খুব আশ্চর্য রকমের আকর্ষণীয় সুন্দর। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একটা মুখের ওপর চোখ পড়তেই আমার আত্মা কেঁপে উঠল প্রবলভাবে। 

শিহাব 

–‘রুশমির নাকি কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। এটা বিশ্বাস যোগ্য কথা হলো?’ 

ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে শুভ্রা বলল, নিচু গলায়। ও আমার কনুই জড়িয়ে ধরে আছে অনেকক্ষণ হলো। যেন ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাব কিংবা পালিয়ে যাব। 

—‘বিশ্বাসযোগ্য হবে না কেনো?’ 

শুভ্রা আমার দিকে চোখ বড় করে তাকালো, ‘বোকার মতো কথা বলিস না শিহাব। এই দেশে ছেলেমেয়েরা বারো তের বছর বয়স থেকে প্রেম করে। আঠার হবার আগেই বিছানায় যায়। আর তুই বলছিস রুশমির এতো বয়স পর্যন্ত একটা সিম্পল প্রেম হয়নি? এটা বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা?’ 

শুভ্রার বলা কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আমি জানি না কেনো, ঐযে হলরুমের একদম কোণার দিকের আলোকসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রির পাশে সোফার ওপর একলা বসে থাকা কাজল চোখের মেয়েটা, ওকে দেখলে আমার মনে হয় পৃথিবী উল্টে গেলেও ওই মুখ কখনো মিথ্যে বলতে পারবে না। ঝগড়ায় সে শতভাগ পারদর্শী সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। কিন্তু মিথ্যা? নাহ… রুশানিয়া কখনো মিথ্যা বলতে পারে না! 

—‘আমার মনে হয় মেয়েটা সত্য বলছে।’ 

শুভ্রা গলায় ঝাঁঝ ঢেলে বলল, ‘মোটেও না। এসব ঢং করছে। ভাবছে হাজবেন্ডের সামনে বয়ফ্রেন্ডের কথা বললে সমস্যা হবে। টিপিক্যাল বাংলাদেশি মেন্টালিটি। আসলে রুশমিদের ফ্যামিলিটাই চরম খ্যাত বুঝছিস? ওর মাকে দেখছিস না? গেঁয়ো একটা মহিলা।’ 

আমি আমার শাশুড়ির চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। শান্ত মুখশ্রীর সাধারণ একজন মহিলা। কথা বলে খুব ধীরস্থিরভাবে, নিচু স্বরে। খুব একটা আলাপ হয়নি তার সাথে তবে যতটুকু হয়েছে তাতে গেঁয়ো কিংবা খ্যাত বলে মনে হয়নি তো! অবশ্য খ্যাত বলতে আসলে কী বা কাকে বোঝায় তা আমার সঠিকভাবে জানা নেই। আমার দাদাজান রংপুরের একটা ছোট্ট গ্রামে থাকেন। সারাদিন পান খেয়ে ঠোঁট লাল। কথা বলেন আঞ্চলিক ভাষায়। শুভ্রা দাদাজানকে দেখলে কী বলবে? 

আমি একটু হেসে বললাম, ‘আমারও তো কোনও গার্লফ্রেন্ড ছিল না কখনো। তুমি কি আমাকেও বিশ্বাস করো না?’ 

শুভ্রা আমার কাঁধে মাথা রেখে মিষ্টি গলায় বলল, 

—‘তুই তো আমার!’ 

হঠাৎ একটা আশ্চর্য কাণ্ড হলো। আমি দেখলাম রুশমি ছুটে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। ফোঁসফোঁস শব্দে নিশ্বাস ফেলছে। মুখজোড়া ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আতঙ্কে। আমার আর শুভ্রার মুখের কথা সরে গেছে। আমরা হা করে চেয়ে আছি রুশমির দিকে। রুশমি কোন কথা না বলেই একটা অবিশ্বাস্য কাজ করে বসল। আমার ডান কনুইয়ের ওপর লতার মতো জড়িয়ে থাকা শুভ্রার বাহু ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল। চাপা স্বরে বলল, ‘শুভ্রাদি সরো তো। একটা প্রব্লেম হয়েছে। প্লিজ ওর হাতটা ছেড়ে দাও।’ 

শুভ্রা হাত ছাড়ল না, বরং আরো শক্ত করে চেপে ধরে স্তম্ভিত গলায় বলল, ‘কীসের প্রব্লেম? কী হয়েছে তোর? এসব কী ধরণের অসভ্যতা?’ 

রুশমি ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে করতে বলল, ‘উফ, পরে এক্সপ্লেইন করছি। এখন প্লিজ তুমি ওর হাতটা ছাড়ো।’ একটু থেমে সে আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘শিহাব প্লিজ। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। একটা ঝামেলা হয়ে গেছে। তুমি এদিকে এসো আমার সাথে।’ 

আমি এতটাই হতভম্ব হয়ে গেছি যে মুখ দিয়ে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারছিলাম না। কয়েকটা সেকেন্ড সময় লাগল ধাতস্থ হতে। শুভ্রার হাতটা সরিয়ে দিয়ে রুশমিকে বললাম, ‘বলো।’ 

—‘আমার এক বড়বোন মানে আমার কাজিন, ঝুম্পা আপু… উনি এসেছে এই পার্টিতে।’ 

শুভ্রা প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তো আমরা কী করব?’ 

রুশমি শুভ্রার কথা গ্রাহ্য না করে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ঝুম্পা আপুর সামনে শুভ্রার ব্যাপারটা ডিসক্লোজ করো না প্লিজ! উনি কিছু টের পেয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার বাবা আর আম্মুকে পুরো ফ্যামিলির কাছে ছোট হতে হবে।’ এটুকু বলে থামলো রুশমি। তারপর করজোড়ে বলল, ‘প্লিজ! হেল্প মি আউট!’ 

আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। হতভম্ব চোখে চেয়ে আছি ওর দিকে। 

এমন সময় একজন হিজাবধারী নারীকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। ইনাকে আমি আগে দেখেছি। খুব সম্ভবত আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে। 

—‘আরে, নতুন জামাই বৌকে পেয়ে গেলাম। কী ভাগ্য আমার!’ আমাদের দেখেই মহিলা হাসিতে মাখামাখি কণ্ঠে বলে উঠল 

আমি অপ্রস্তুত হাসলাম। রুশমিও হাসছে। আড়চোখে দেখলাম শুভ্রার পাশে জনাথন এসে দাঁড়িয়েছে ওর নতুন গার্লফ্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে। শুভ্রা নিশ্চয়ই এখন জনাথনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে চাইবে। এদিকে রুশমি বলছে ওর কাজিনের সামনে ডিসক্লোজ করা যাবে না, যে আমি শুভ্রার বয়ফ্রেন্ড। নিদারুণ এক দ্বিধায় পড়ে গেছি। এই মহিলা শুভ্রার ব্যাপারটা জেনে গেলে আমার নিজের জন্যও সমস্যা হতে পারে। পাপা মম আমাকে বিশ্বাস করেছে। বিয়ের পরদিন বন্ধুর পার্টিতে যাবার নাম করে শুভ্রার কাছেই এসে ভিড়েছি এটা জানতে পারলে ওই দুটি মানুষ নিখাদ কষ্ট পাবে। কিন্তু শুভ্রার তো ঠিক এই মুহূর্তেই আমাকে প্রয়োজন ছিল। কী করব? কী করা উচিত? ভেতরে দ্বন্দ্ব চলছে কিন্তু মুখে জোর করে সাবলীল ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছি। রুশমি ওর কাজিনকে বলল, ‘ঝুম্পা আপু, চলো আমরা ঐদিকটায় গিয়ে বসি।’ বুঝলাম শুভ্রার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার জন্যেই এই সিদ্ধান্ত। আমি আর কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে অনুসরণ করলাম। খুব বিরক্ত লাগছে। রুশমির কাজিন উদয় হবার আর সময় পেলো না। বেচারি শুভ্রা! ওর সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেলো! 

ঝুম্পা আপু হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘জনাথন কি শিহাবের ফ্রেন্ড?’ 

রুশমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল ‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি এখানে কী করে?’

—‘জনাথন তো তোর দুলাভাইয়ের কলিগ।’ 

—‘তাই নাকি?’ 

—‘হ্যাঁ। দাঁড়া তোর দুলাভাইকে ডাকি এদিকে। সে কলিগদের নিয়েই ব্যস্ত। আমি বোর ফিল করছিলাম। ভাগ্যিস তোদের পেয়ে গেলাম।’ কথাটা বলে ঝুম্পা আপু পার্স থেকে ফোন বের ডায়াল করল। খানিক বাদে একজন স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক এসে যোগদান করল আমাদের সাথে। ভদ্রলোক আমাকে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল। বেশিরভাগ প্রশ্ন আমার পড়াশোনা এবং চাকরি বাকরি সংক্রান্ত। আমি আলোচনায় মন দিতে পারছি না। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। শুভ্রা এসে যেকোন মুহূর্তে গন্ডগোল বাঁধাতে পারে। 

এখন হলঘরের মূল বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। ড্যান্স ফ্লোরে মসৃণ নীল আলো জ্বলছে আর নিভছে। একটা সফট রোমান্টিক স্প্যানিশ গান বেজে যাচ্ছে। কয়েকজন যুগলবন্দি ছেলেমেয়ে গানের সাথে নেচে যাচ্ছিল। হঠাৎ রুশমির কাজিন বলল, ‘এই তোরা নাচিস না কেনো? মাত্র গতকাল বিয়ে হয়েছে এখনই এরকম ম্যাদামারা হয়ে গেলে হবে?’ 

উল্লেখ্য, ‘ম্যাদামারা’ শব্দটা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন এবং এর অর্থ আমি জানি না। কিন্তু ঠিক সেই সময় আবছা আলো আধারিতে শুভ্রাকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মনে হলো নাচের আইডিয়াটা আসলে খারাপ না। শুভ্রা কোনও সিন ক্রিয়েট করার আগে আমার উচিত এখান থেকে কেটে পড়া। আমি একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে রুশমির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘শ্যাল উই?’ 

এই প্রস্তাবে রুশমির কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা আমার মনে নেই। কারণ আমি চেয়ে ছিলাম শুভ্রার দিকে। শুভ্রার ক্রুদ্ধ, রাগান্বিত, ভেঙে পড়া মুখটা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে ওকে দেয়া প্রতিশ্রুতি আমি রাখতে পারছি না। ভীষণ স্বার্থপর আচরণ করছি। কিন্তু কী করে বোঝাবো শুভ্রাকে যে আমার পাপা মমের মন রক্ষার জন্য আমাকে স্বার্থপর হতেই হচ্ছে। আমি নিরুপায়। সত্যি ভীষণ নিরুপায় এবং অসহায়! 

বিয়ের পরদিন, জনাথনের ক্রিসমাস পার্টিতে আমরা প্রথমবার নেচেছিলাম। রুশমির নরম হাত আমার মুঠোবন্দি। আমরা গানের তালে তালে পা ফেলছি। ঝুম্পা আপু ক্যামেরা নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের ছবি তুলছে। সে এই ছবি নাকি ফেসবুকে পোস্ট করবে। রুশমির একটা হাত আমার কাঁধের ওপর রাখা। ওর মুখটা অবনত। লম্বা চোখের পাঁপড়ি দেখতে পাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না মুখের অভিব্যক্তি। আমার বুকের ওপর ওর উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ছে। একটা মিষ্টি ঘ্রাণ পাচ্ছি নাকে। ওর কোমরে একটা হাত রেখেছি আলতোভাবে। গান বেজে চলেছে। আশির দশকের বিখ্যাত গান। ফ্রাংকো ডি ভিটার Te Amo। চারপাশে মসৃণ নীল আলো। এত কাছ থেকে আমি রুশমিকে এই প্রথমবারের মতো দেখছি। ও লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জা পেলে ওকে আরো বেশি সুন্দর দেখায়। আমার বৌ-টা আসলে অনেক সুন্দর! কথাটা কি আগেও বলেছি? বলে থাকলে এই পৌনঃপুনিকতার জন্য দুঃখিত। 

তিন মিনিটের মাথায় গানটা শেষ হলো আর শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আশেপাশে যে যুগলরা ছিল তারা সবাই সঙ্গী এবং সঙ্গিনীর ঠোঁটে চুমু খেয়ে ফেললো। এমনটাই হবার কথা ছিল হয়তো। আমি তখনও রুশমির হাত ধরে আছি। শুভ্রার জন্য দীর্ঘদিন ধরে মনে মনে অপেক্ষা করেছি বলে আজ পর্যন্ত কোন মেয়েকে চুমু খাইনি। আজকে শুভ্রা আমার খুব কাছে থেকেও নেই। আবার রুশমি যেভাবে আছে সেটাকেও থাকা বলে না। আমার ভাগ্যটা এমন কেনো? 

এবার রুশমি ভয় পেয়ে গেছে। হয়তো ভাবছে আমিও অন্যদের দেখাদেখি কিছু একটা বাড়াবাড়ি করে ফেলবো। ফাঁদে পড়া পাখির মতো ছটফট করছে। ওর অবস্থা দেখে আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছে। একটু কেমন লজ্জাও লাগছে। আমি ওর হাতটা ছেড়ে দিলাম। ও পালিয়ে বাঁচলো। 

রুশমি 

আমার খুব মজা লাগছে। এই মুহূর্তে শুভ্রার বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত এবং ঈর্ষা কবলিত মুখটা দেখে ভেতরে ভেতরে পৈশাচিক এক আনন্দ অনুভব করছি। কোন ন্যায়-অন্যায় বোধ কাজ করছে না মাথায়। বরং ঠোঁটে একটা মিটমিটে নির্বিকার হাসি লেগে আছে। খাবারের প্লেট নিয়ে আমরা চারজন গোল হয়ে বসেছি। শুভ্রা একটু দূরে ওয়াইনের প্লাস সমেত দাঁড়িয়ে থেকে রুক্ষ চোখে দেখছে আমাদের। শিহাব ওর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। খুব মনোযোগী ভঙ্গিতে ঝুম্পা আপু আর হাসিব ভাইয়ের (ঝুম্পা আপুর বর) সাথে গল্প করছে। আমি ক্র্যানবেরি সস দিয়ে ম্যাশড পটেটো খাচ্ছি তারিয়ে তারিয়ে আর চোরা চোখে শুভ্রাকে দেখছি। অন্যের কষ্টে আনন্দিত হওয়াটা নিশ্চয়ই অনেক বড়সড় পাপ কিন্তু এই মুহূর্তে আমার বিবেচক মনটা কোথায় হারিয়েছে জানি না। আনন্দের চোটে পাপ পুণ্যের হিসাব করার ফুরসত পাচ্ছি না। নিরর্থক এই অনুভূতি আমি কোন যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারছি না। শুধু এক নিদারুণ যুক্তিহীন বোকা অথচ সুমধুর হর্ষ-বীন নিরন্তর বেজে যাচ্ছে মনগভীরে। সব কিছু ঠিক ছিল। মসৃণ ছিল। কিন্তু এই মসৃণ ভাবটা নষ্ট করে দিল ঝুম্পা আপুর একটা অতিশয় লেইম জোক। হঠাৎ কথা নেই, বার্তা নেই, আউট অফ নো হোয়্যার ঝুম্পা আপু আমুদে গলায় ওর বরকে বলে বসল, ‘দ্যাখো, আমাদের রুশমি বিয়ে করে কী খুশি! চোখ মুখ খুশিতে চকচক করছে!’ 

আমার মুখটা ভস করে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। শিহাব চট করে ঘুরে তাকালো আমার দিকে। আমি ওর চোখে চোখে তাকাতে পারলাম না। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। মন চাইছে ঝুম্পা আপুকে… – নেহাৎ বয়সে বড় বলে বেঁচে গেলো মেয়েটা। নইলে ওর খবর ছিল আজকে। সিরিয়াসলি? এটা কোন কথা হলো? মানে কেনো আমি বিয়ে করে খুশি হবো? শিহাবকে আমি দুই চোখে দেখতে পারি না! আরে আমি তো শুভ্রার নাজেহাল অবস্থা দেখে খুশি হচ্ছি। এই কথা ঝুম্পা আপুকে বুঝাই কী করে? রাগে গা জ্বালা করে উঠল। এই অহংকারী ছেলেটার সামনে এসব কথা বলার কোন মানে হয়? এই ছেলে এমনিতেই নিজেকে হিরো ভাবে। ভাব দেখলে মনে হয় শুধু আমি না, দুনিয়ার সব মেয়ে যেন ওর সাথে লটকে যাবার জন্য বসে আছে। এখন ঝুম্পা আপুর এই ফালতু, লেইম জোকটা যদি সে বিশ্বাস করে বসে? রাগে দুঃখে আমার নিজের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। চোখের কোণ দিয়ে শিহাবকে এক নজর দেখলাম। মুখে একটা বঙ্কিম হাসি নিয়ে আমার ঠোঁটের নিচের কালো তিলটার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আছে। ফাজিল ছেলে! এতো হাসির কী আছে? মোটেও আমি তোমাকে বিয়ে করে খুশি নই। তুমি একটা বিরক্তিকর! 

ঝুম্পা আপু ক্ষান্ত হলো না, ‘এখন আবার লজ্জা পাচ্ছে। দ্যাখো, দ্যাখো রুশমি লজ্জা পাচ্ছে!’ 

কী আশ্চর্য! আমি যেন মিউজিয়ামে সাজানো কোন দুর্লভ বস্তু। সবাই লাইন ধরে এখন দেখতে আসবে আমাকে! দ্যাখো দ্যাখো রুশমি লজ্জা পাচ্ছে! দ্যাখো দ্যাখো রুশমি বিয়ে করে খুশিতে পাগল হয়ে গেছে! দ্যাখো দ্যাখো রুশমি এটা করছে, ওটা করছে! 

হাসিব ভাই হাসতে হাসতে যোগ করলেন, ‘লজ্জা তো পাবেই। তুমি বেচারিকে খামোখা এতো বিরক্ত করছ কেনো? তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে কেটে পড় এখান থেকে। নতুন বিবাহিত দম্পতিকে একটু স্পেস দাও।’ 

শিহাব 

রুশমির ঠোঁটের নিচে, ডান দিকে একটা কালো তিল আছে। ও খুব ফর্সা তো, তাই ফর্সা মুখে কালো রংয়ের বিন্দুটা নজর কাড়ে। মনে হয় যেন কোন দক্ষ শিল্পী পুরো মুখটা যত্ন করে আঁকবার পর এক চিমটি কালো রং ছুঁইয়ে দিয়ে বাড়তি সৌন্দর্য যোগ করেছে। একটু আগে ঝুম্পা আপু বলেছে রুশমি নাকি বিয়ে করে খুব খুশি। কথাটা শোনামাত্র রুশমির চেহারা হয়েছিল দেখার মতো। ওর অবস্থা দেখে আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে হাসিটা সংবরণ করলাম। এদিকে শুভ্রার কট্টর দৃষ্টি আমাকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না। ও অনেকক্ষণ ধরে ড্রিংক করে যাচ্ছে। যদি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে সবার সামনে একটা সিন ক্রিয়েট করে বসে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। এতক্ষণের এতো অভিনয় সব ভেস্তে যাবে। 

খাওয়া দাওয়ার পালা খুব দ্রুত শেষ করে আমি বাইরে বেরিয়ে আসলাম স্মোক করার বাহানায়। বেরোনোর সময় দেখলাম হাসিব ভাই জনাথন আর ওর গার্লফ্রেন্ডের সাথে রুশমির পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। পালিয়ে বাঁচলাম জায়গাটা থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝুম্পা আপুদের সঙ্গে নিয়ে রুশমি বেরিয়ে এলো। মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। শুভ্রা কোন ঝামেলা করেনি এটা ভাবতে আমার ভালো লাগছে। শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে ওর প্রতি। সেই সাথে একটা অপরাধবোধও কাজ করছে। বেচারির সমস্ত পরিকল্পনা বিফলে গেলো। ঝুম্পা আপুরা চলে যাবার পর আমি আর রুশমি কিছুক্ষণ গোলাপি আভাযুক্ত হিমায়িত খোলা আকাশের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম যার যার নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন হয়ে। রাস্তায় সারি বেঁধে সব গাড়ি রাখা। ধার ঘেঁষে সাদা বরফের স্তুপ। গাছের গায়ে তুষারের প্রলেপ। শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে থেকে থেকে। ক্রিসমাসের সাজের আলোয় ঝলমলে চারপাশ। সেই আলোয় আমি রুশমির খাড়া নাকের নোজপিনটা দেখতে পাচ্ছি। দেখছি ওকে কিন্তু ভাবছি শুভ্রাকে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। জানি না কী করে ম্যানেজ করব রগচটা মেয়েটাকে। ভাবনার ঘোর কাটতে না কাটতেই দেখি শুভ্রা বেরিয়ে আসছে জনাথনের বিল্ডিং থেকে। তীব্র শীতের মধ্যে ওর গায়ে স্লিভলেস গাউন ছাড়া অন্য কোন মোটা কাপড় নেই। এই মেয়ের কি শীত করে না? অবশ্য ও অনেক ড্রিংক করেছে। শীত কেটে যাবার কথা। 

স্তব্ধ চোখে চেয়ে আছি ওর দিকে। এবার নিশ্চয়ই একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি সেই বিস্ফোরণ মোকাবেলা করার। কথা সাজিয়ে নিচ্ছি নাটকের স্ক্রিপ্টের মতো। শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছি। যুৎসই শব্দ পাচ্ছি না। কী করলে, কীভাবে কী বললে ও আমাকে ক্ষমা করবে জানি না। কিন্তু শুভ্ৰা আমাকে কিছু বলল না। দেখতে পেলাম গটগট করে হেঁটে রুশমির পেছনে এসে দাঁড়ালো। কাঁধ চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে ঘুরিয়ে নিল নিজের দিকে রুশমি থতমত খেয়ে গেছে। থমকানো চোখে চেয়ে দেখছে শুভ্রাকে। 

—‘তোর প্রব্লেম কী? হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ট্রাইং টু ডু বীচ? হ্যাঁ?

—‘আমি কী করলাম?’ রুশমি বলল স্তম্ভিত কণ্ঠে 

—‘ন্যাকামো করিস না! আমি কিছু বুঝি না মনে করেছিস? বোকা পেয়েছিস আমাকে?’ শুভ্রার গলার স্বর এতো উঁচুতে উঠে গেছে যে মনে হচ্ছে যেন আরেকটু হলেই ওর কণ্ঠনালী ছিঁড়ে যাবে। আমি কী করব বুঝে পাচ্ছি না। নাকাল ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি দৃশ্যটা। নিশ্চয়ই কিছু বলা উচিত এই মুহূর্তে। কিন্তু আমার মুখ নড়ছে না। কেউ যেন সাঁড়াশি দিয়ে জিব টেনে ধরে রেখেছে। অসাড় হয়ে আসছে হাত পা। 

রুশমি আমতা আমতা করে বলল, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না!’ 

—‘তুই শিহাবকে ফাঁদে আটকাতে চাইছিস? বশ করতে চাইছিস? হ্যাঁ? ফাজিল মেয়ে কোথাকার! তুই আমার বয়ফ্রেন্ডকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছিস? এতো বড় সাহস তোর! 

—‘বাজে বোকো না শুভ্ৰাদি!’ 

—‘আমি বাজে? বাজে হচ্ছিস তুই। তোর কোন বয়ফ্রেন্ড নেই। কখনো কারো সাথে প্রেম করিস নাই। এসব মিথ্যা মিথ্যা কথা বলে প্রমাণ করতে চাইছিস যে তুই কতটা সতী সাবিত্রী, তাই না?’ 

রুশমি এবার আমার দিকে অসহায় চোখে তাকালো একবার, ‘এই মেয়ে পাগল হয়ে গেছে।’ 

শুভ্রা এবার সত্যিই বিকারগ্রস্তের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি! পাগল হয়েছি কারণ তুই… তুই আমার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করে আমার চোখের সামনে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস। আর এসব আমার চুপ করে সহ্য করতে হচ্ছে।’ 

রুশমি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘আমি কেনো তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করব? স্টেঞ্জ! ইউ আর সিক শুভ্রাদি! ইউ আর লিটারেলি আ সিক পার্সন। তোমার বয়ফ্রেন্ডের প্রতি আমার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নাই। আই হেইট হিম!’ 

জানি না কেনো, ওর বলা শেষ বাক্যটা আমাকে হঠাৎ কেমন চমকে দিয়ে গেলো। মনে হলো যেন এতো নিষ্ঠুর কথা আমি আমার জীবনে এর আগে কোনদিন শুনিনি। অথচ ব্যাপারটা কোন একভাবে আগে থেকেই জানতাম। রুশমি আমাকে ঘৃণা করছে বা করবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে সব জেনে বুঝেও স্পষ্টরূপে নিজ কানে এই নির্বিকার স্বীকারোক্তি শুনতে কেনো যেন ভালো লাগল না। আমি ব্যথিত চোখে একবার তাকালাম ওর দিকে। ও টেনে টেনে দৃঢ় গলায় কথাটা আরেকবার বলল, ‘আই হেইট শিহাব। না পারতে আছি ওর সাথে।’ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *