হৃদয়াক্ষী – ৩

শিহাব 

মস্তিষ্কে জট পাকিয়ে গেছে। স্পষ্টভাবে কিছু ভাবতে পারছি না। কোনো ভাবনাই স্থির থাকছে না, পূর্ণতা পাচ্ছে না। খণ্ড খণ্ড মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। এই মুহূর্তে কী করা উচিত জানি না। সকাল থেকে শুভ্রার ফ্ল্যাটেই বসে আছি। রুশমি মেয়েটা একটু আগে বেরিয়ে গেছে। এমন ঝগড়াটে মেয়ে আমি আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। ঝগড়াটে, অভদ্র এবং অকৃতজ্ঞ। সে যাই হোক! আমার এখন ওকে নিয়ে ভাববার সময় নেই। আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাবার দুটো উপায় শুভ্রা আমাকে বাতলে দিয়েছে। এক নম্বর উপায় হলো আজকেই পালিয়ে বিয়ে করে ফেলা। দুই নম্বর হলো বাবা মায়ের পছন্দনীয় মেয়েকে বিয়ে করে এক মাসের মাথায় ডিভোর্স নেয়া। প্রথম, উপায়টা আমার জন্য অধিকতর কঠিন। কারণ পাপা মমকে না জানিয়ে তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করার সাহস কিংবা ইচ্ছা এর কোনোটিই আমার নেই। তাছাড়া শুভ্রা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে ও আমাকে এখনো ভালোবাসতে পারেনি। আমিও জানিয়ে দিয়েছি ও যেদিন আমাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবে একমাত্র সেদিনই ওকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে। এর মানে এক নম্বর উপায়টি প্রাথমিক পর্যায়েই বাতিলের খাতায় চলে গেছে। দুই নম্বরটা নিয়েই ভাবছি এখন। পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার কিছু দায় বুঝি না চাইতেও আমাদেরকে আজীবন বহন করে যেতে হয়। শুধুমাত্র মানবিকতার খাতিরেই আমি শুভ্রার দ্বিতীয় পরিকল্পনাটির সাথে একমত হতে পারছি না। একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই। যে মেয়েটিকে আমি চিনি না, জানি না, যে কোনোদিন আমার কোনো ক্ষতি করেনি, যার সাথে এই পার্থিব জীবনের কোনোরূপ লেনদেন কখনো ছিল না আমার, সেই মেয়েটিকে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য স্কেপগোট বানাই কী করে? শুভ্রা আমাকে বোঝাচ্ছে অনেক। আজকাল নাকি ডিভোর্স কোনো ব্যাপার না। বিয়ে করে এক মাসের মাথায় তালাক দিয়ে দিলেই সব ঝামেলা খতম। এতে করে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। শুভ্রার ধারণা একবার ডিভোর্স হওয়ার পর আমার বাবা-মা কিছুতেই আমাকে আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলার সাহস পাবে না। এরপর যখন খুশি শুভ্রাকে বিয়ে করতে পারব। আমি ভাবছি গোটা পৃথিবীটা শুভ্রার চিন্তা জগতের মতো সহজ হলে ভালোই হত। শুভ্রার সামনে একটা সম্ভাবনার দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে আরো দশটা দরজা খুলে যায়। ওর জীবনটা কখনো একটি বিন্দুতে স্থির থাকে না। এটা না হলে ওটা, ওটা না হলে সেটা। শুভ্রা খুব সুখী! 

বাড়ি ফিরলাম সন্ধ্যের পর। এসে দেখি পাপা আমার জন্য অপেক্ষা করছে ড্রইং রুমে। আমাকে দেখামাত্র কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলল, ‘তোমার মমের শরীরটা ভালো না। একবার দেখা করে এসো।’ 

আমি পাপার কথার কোনো উত্তর দিলাম না। কাউচে বসে চুপচাপ জুতোর ফিতা খুলতে লাগলাম। খোলা হয়ে যাবার পর জুতোজোড়া একপাশে সরিয়ে রেখে বললাম, ‘মমের শরীর খারাপ? নাকি মন খারাপ?’ 

—‘দুটোই।’ 

পাপা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা খুঁজে নিয়ে বলল, ‘তুমি মেয়েটাকে একবার দেখে এসো। আমার বিশ্বাস দেখলে তোমার পছন্দ হবে। তোমার মমের খুবই পছন্দ হয়েছে…। 

আমি হাত তুলে থামিয়ে দিলাম পাপাকে, ‘দেখতে হবে না।’ 

উঠে পড়লাম বসা থেকে। পাপা খুব সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘বিয়েটা তুমি করছ তো বাবা, তাই না?’ 

—‘আমার মতামতের কোনো মূল্য কি আছে?’ 

—‘নিশ্চয়ই তোমার মতামতের মূল্য আছে। কিন্তু আমরা তোমাকে অনুরোধ করছি, বিয়েটা তুমি করো। কন্যার পিতাকে আমি কথা দিয়েছি। কন্যার পিতা চান বিয়েটা যেন আগামী কাল সম্পন্ন হয়।’

আমি স্থিরতার সাথে বললাম, ‘ঠিক আছে পাপা, তোমাদের অনুরোধ আমি রাখছি। কিন্তু এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছ থেকে একটা জিনিস চাইব, দেবে?’ 

পাপা অবাক হলো, ‘কী জিনিস?’ 

—‘আজ নয়। পরে কোনো এক সময় চেয়ে নেবো। তখন কিন্তু না করো না।’ পাপা বিষয়ী মানুষ। আবেগের বশে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া তার স্বভাবে নেই। মৌখিক চুক্তিও না। সে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আমাকে আগাগোড়া দেখলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর বিস্ময়বিদ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কী চাও তুমি? আমাকে কি একটু হিন্ট দেয়া যায়?’ 

আমি বড় একটা শ্বাস ফেললাম, ‘না পাপা, হিন্ট দেয়া যাবে না।’ 

কথাটা বলে আমি আর দাঁড়ালাম না। সেই রাতটা বিনিদ্র কাটল। তাপমাত্রা মাইনাস ওয়ান। তীব্র হাড়কাঁপানো সেই শীত রাত্রিটির অনেকাংশ আমি কাটিয়ে দিলাম উইলো ফরেস্টে ক্রিকের ধারে বসে। মাঝে মাঝে প্রকৃতির চাইতে বড় সঙ্গী মানুষের বুঝি আর হয় না। পরিষ্কার আকাশে একটা ক্ষয়া চাঁদ জেগে আছে। তাকে ঘিরে উৎসবে মেতেছে গুচ্ছ গুচ্ছ নক্ষত্র। দুর্বল চাঁদের পাতলা নীল আলোয় ভেসে আছে লতাপাতা বিহীন শুষ্ক জঙ্গল। আমি আগুনের পাশে বসে আছি। কাঠ পুড়ছে খটখট শব্দে। বাতাস ভরে গেছে কাঠ পোড়া গন্ধে। ক্রিকের পানি কলকল শব্দে গান গেয়ে যাচ্ছে বিরতিহীন ভাবে। গভীর রাতের অরণ্যের একটা আলাদা রূপ আছে। আমি কবি সাহিত্যিক হলে হয়তো এই রূপের বর্ণনা সুচারু রূপে লিখতে পারতাম। এই দিগ্বিদিক বিস্তৃত আপামর সৌন্দর্যমণ্ডিত বন-বনানীর যথার্থ রূপ অঙ্কন করার মতো শব্দ আমার ভাণ্ডারে নেই। আমি পড়তে ভালোবাসি, কিন্তু লিখতে অতটা না। আমার এই জীবন উপন্যাস যদি কখনো প্রকাশ পায় তবে পাঠক সুনিশ্চিতভাবে এতে অল্পবিস্তর ভাষাগত দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করবে। কারণ বাংলা আমার প্রাণের ভাষা হলেও আমার দৈনন্দিন জীবনে এই প্রাণাধিক প্রিয় ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্র অত্যন্ত ক্ষীণ। যেহেতু আমার মনের ভাষা এবং মাতৃভাষা বাংলা তাই নিজের জীবন নিয়ে লিখতে গিয়ে এই ভাষাকেই মনোনীত করলাম। যদিও এটা আমার পূর্ণজীবনী নয়। আমার জীবনের একটা অংশমাত্র। যে অংশটুকু না ঘটলে আমি হয়তো কখনোই জানতাম না যে পৃথিবীতে অদৃষ্ট বলে সত্যিই কিছু আছে। আমি ছিলাম কর্মে বিশ্বাসী। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাম, মানুষ তাকেই পায় যার জন্য সে সাধনা করে। আমার পাপা মম জীবনের একটা সুদীর্ঘ সময় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করেছে। আজকের সুখের সংসার তাদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসল। আমার মতে ভাগ্য বলে কিছু নেই পৃথিবীতে। মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য গড়ে। কিন্তু আগামীকাল আমার জীবনে যে ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে তার সাথে এই ধারণার একটি সুস্পষ্ট দ্বন্দ্ব আছে। 

রাত বাড়ার সাথে সাথে হু হু করে শীতের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। আমার গায়ে মোটা জ্যাকেট। মাথায় হুডি। অনবরত আগুনের ওপর হাত সেঁকছি। তেমন একটা লাভ হচ্ছে না। শীতের তীব্রতা আমাকে অশীতিপর বৃদ্ধের ন্যায় জরাগ্রস্ত করে তুলছে ধীরে ধীরে। মাঝে মাঝে আত্মপীড়ন করতে আমার ভালো লাগে। অল্পবিস্তর আত্মপীড়ন আত্মার শুদ্ধতা বৃদ্ধি করে। এই মুহূর্তে শীতের ভয়ঙ্কর ছোবল মন গভীরের অবিরত জ্বালা পোড়াকে অবশ করে তুলছে। পাপা আর মমকে আমি সারাজীবন কষ্ট করতে দেখেছি, আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য। আমি চাই ওদের বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে কাটুক, শান্তিতে কাটুক। আবার এ-ও সত্য শুভ্রা ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকেই আমি কখনো ভালোবাসতে পারবো না। হঠাৎ মনে হলো কথাটা… আমি কি শুভ্রাকে সত্যিই ভালোবাসি? ভালোবাসি বলেই কি ওকে বিয়ে করতে চাই? 

.

নক্ষত্রখচিত হিমবর্ষী আকাশের নিচে, একলা অরণ্যে কমলা আগুনের পাশে বসে থেকে আমি আজ স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করলাম যে, শুভ্রাকে আমি ভালোবাসি তার চাইতেও বড় সত্য হলো, আমি চাই শুভ্রা আমাকে ভালোবাসুক! আমার ভেতরের প্রেমিক মনটা মরে গেছে অনেক আগেই। এখন যে মন জেগে আছে সে প্রতিশোধ ছাড়া কিছুই বোঝে না। আমি চাই শুভ্রা আমার কৈশোর এবং তারুণ্যের অগণিত অতন্দ্র রাত্রিগুলো ফিরিয়ে দিক। যে রাত্রিগুলো ছিল সীমাহীন একাকিত্বে ঘেরা! 

রুশমি 

Love is, when God says to you, 
I have created everything for you 
And you say, I have left everything for You!

–Rumi 

.

বাড়ি ফিরে এসেছি। মেজো যখন ফোন করে বলল যে আম্মুজান খুব কান্নাকাটি করছে তখন আর ফিরে না এসে পারলাম না। বিকেলে লিওর সাথে দেখা হয়েছে। ওকে বলিনি কালকে আমার বিয়ে। বলতে লজ্জা লেগেছে। ও জানতে চেয়েছে আমি ওর সাথে কোনো রিলেশনশিপে যেতে চাই কিনা। উত্তরে বলেছি আমার কিছু সময় দরকার। বলেছি প্রেমিক হিসেবে না চাইলেও বন্ধু হিসেবে ওকে আমি পাশে চাই। বিকেলটা সুন্দর কেটেছে। লেক অ্যাকোটিক পার্কে অনেকক্ষণ ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা। ও বারবার বলছিল, ‘রুশি, তোমার কিছু একটা হয়েছে। কী হয়েছে আমাকে বলবে না?’ আমি এড়িয়ে গেছি। কিছুক্ষণ পর আমাদের সাথে স্টেসি আর হেইলি এসে যোগ দিয়েছিল। হেইলির ভ্যানে বসে ডিনার করেছি। ওরা চিকফিলের চিকেন খেয়েছে, যে খাবারটা ওদের অনেক প্রিয়। আমি শুধু সালাদ খেয়েছি, যেহেতু আমি হালাল হারাম ফলো করি, তাই খাবার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ওরা কেউ বোঝেনি আমার মনের ওপর দিয়ে কী ঝড়টাই না বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা বুঝি আমার স্বাধীনতার শেষ দিন। কাল থেকে শুরু হবে কারাগারে বন্দি জীবন। অথচ কেউ কিন্তু আমার হাত পায়ে শেকল বেঁধে রাখেনি। আমি চাইলে এই মুহূর্তে সব কিছু ছেড়ে- ছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে পারি। আজ আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে বদ্ধ খাঁচা খুলে দেই, ইচ্ছেরা সব মুক্ত পায়রা হয়ে উড়ে যাক নীল আকাশে। সেই সুযোগ এবং সামর্থ্য আমার আছে। এই দেশে কিছু না কিছু একটা কাজ করে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে পারব। কিন্তু হাতে পায়ে দৃশ্যমান কোনো শেকল না থাকলেও কী করে যেন বুকের ভেতর একটা অদৃশ্য শেকলের অস্তিত্ব টের পাচ্ছি আমি। সেই অদৃশ্য শেকলের ঝনঝন শব্দ আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে বাহ্যিক ভাবে আমি যতটা স্বাধীন, আত্মিক ভাবে ততটাই পরাধীন। হাজার চাইলেও বাবা আর আম্মুকে কষ্ট দিতে পারব না। কারণ তাদেরকে কষ্ট দিলে উপরে যিনি বসে আছেন সেই অনন্ত অসীম সর্বশক্তিমান সত্তা আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না! আর তিনি ক্ষমা না করলে আমার এই অন্তর দহন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে পেতে শেষতক অগ্নি লাভায় রূপান্তরিত হবে। আমি তো আমাকে তাঁর কাছেই সঁপে দিয়েছি। আমার প্রকৃত মুক্তি শুধু তাঁর মাঝেই নিহিত। তাছাড়া প্রকৃত মুক্তি বলতে কিছু এই পার্থিব জীবনে নেই। এ জীবন তো পরীক্ষা কেন্দ্র। প্রশ্ন যত কঠিনই হোক না কেন পরীক্ষা আমাকে দিতেই হবে! আমার কবি রুমির একটি উক্তি মনে পড়ছে, ‘Love is, when God says to you, I have created everything for you And you say, I have left everything for You! কী সুন্দর উক্তি! আহা কী সুন্দর! উক্তিটা মনে পড়তেই আমার চোখ জলে ভিজে উঠল। এই অন্যমনস্কতা বন্ধুদের অস্থির করে তুলছিল। স্টেসি বলল আমাকে ও কোন এক সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে নিয়ে যাবে। আমার নাকি মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। মানসিক উৎপীড়ন আমাকে খুব বেশিক্ষণ বন্ধুসঙ্গ উপভোগ করতে দিল না, বিদায় নিলাম। 

ফিরে এসে দেখি অতিথিতে বাড়ি ভরে গেছে। বাংলায় একটা কথা আছে, আম্মুজানকে কথাটা প্রায়ই বলতে শুনি। যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই। কথাটির যথার্থতা আজ সম্যকরূপে উপলব্ধি করতে পারলাম। বাবাজান, আম্মুজান, ফুপি এদের কারো সাথেই আমি কোনো বাক্য বিনিময় করলাম না। গোসল সেরে এশার নামাজ আদায় করলাম। তারপর ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। নিচে খুব হইচই হচ্ছে। ভার্জিনিয়ায় আমাদের আত্মীয় বলতে শুধু ঝুম্পা আপুরাই আছে। নিউইয়র্কে দুই মামা থাকে। আম্মুর চাচাতো ভাই। তাদের সাথে সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। সম্ভবত বিয়ের কথা তাদেরকে জানানোও হয়নি। এই মুহূর্তে বাড়িতে ঝুম্পা আপু, তার বর এবং আম্মু আব্বুর কিছু বন্ধু-বান্ধবী উপস্থিত আছে। আমার কোনো ভয় হচ্ছে না, রাগও হচ্ছে না। যা হচ্ছে তার নাম অভিমান। আমি ঠিক করেছি বাবাজানের সাথে আমি আর কোনোদিন কথা বলব না। সে আমাকে বিয়ে দিয়ে সুখী হতে চায় তো? হোক, খুব সুখী হোক! আমার সুখ তাকে সুখী করে না জানি, কিন্তু তার সুখ আমাকে এখনো সুখী করে। আজীবন করবে! 

খানিক বাদে আম্মুজান এসে আমার পাশে বসল। আমি তার দিকে ফিরেও চাইলাম না। আমার মাথায় একটা হাত রেখে সে বলল, ‘তোমার বাবাজানের সাথে যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স মাত্র উনিশ। তোমার বাবাজানের তেইশ। বিয়ের আগে আমাদের একটা বারের জন্যেও দেখা হয়নি। আমাদের যুগটা কিন্তু খুব বেশি আগের নয়। সেই যুগে এরকম ঘটনা ছিল বিরল। তবুও আমি আপত্তি না করে বাবা-মায়ের পছন্দকে মেনে নিয়েছিলাম। এটাই আমার নিয়তি ছিল। দেখো আল্লাহর রহমতে তোমার বাবা আর আমার ভেতরে ভালোবাসার কমতি কখনো ছিল না।’ 

আম্মুজান এসব কথা বলছে খুব নিচু গলায়। আমি চুপ করে শুনছি। চোখের জলে আমার বালিশ ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ আম্মুজান একটা আশ্চর্য প্রশ্ন করল। গলার স্বর আরো এক ধাপ নিচে নামিয়ে সাবধানী গলায় বলল, ‘রুশমি, প্রশ্নটা তোমাকে করা ঠিক হচ্ছে কিনা জানি না। তবে আমার জানা উচিত বলেই জানতে চাইছি, তোমার কি কোনো পছন্দ আছে?’ 

আমি ভেতরে ভেতরে খুব চমকে উঠলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো আফসোস হলো এই ভেবে যে, কেন আমার কোনো পছন্দ নেই? যদি লিওকে সত্যিই ভালোবাসতে পারতাম তাহলে হয়তো এ মুহূর্তে আম্মুজানকে সদর্পে কথাটা জানাতে পারতাম। কিন্তু হায়! সেই ভাগ্যটুকুও তো আমার হলো না। আমি কোনো উত্তর দিলাম না। এই প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আম্মুজান দ্বিতীয় প্রশ্নটি করল, ‘যে ছেলেটির সাথে তোমার বিয়ে হতে যাচ্ছে, তুমি কি তার ছবি দেখতে চাও?’ আমার কান্নার তোড় বেড়ে যাচ্ছে। আমি এখন কাঁদছি এই দুঃখে যে কেন আমি কাউকে ভালোবাসতে পারলাম না। যে বৃদ্ধ এবং কুৎসিত লোকটার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে তাকে কি কোনোদিন আমি ভালোবাসতে পারব? সবার ভাগ্য কি আমার বাবা আর আম্মুর মতো ভালো হয়? 

জানি না আম্মুজান কতক্ষণ আমার পাশে বসে ছিল। কাঁদতে কাঁদতে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো ঝুম্পা আপুর ডাকে। আধো চোখ মেলে দেখি ঝুম্পা আপু আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। হাসতে হাসতেই বলল, ‘ওঠ ছেড়ি! আজকে তোর বিয়ে!’ 

শিহাব 

বিয়ের দিন পাপা, আমি আর জাহিদ একই রকম পাঞ্জাবি পরলাম। সাদার ওপর সাদা কাজ করা। এগুলো গত বছর বাংলাদেশ থেকে নিয়ে এসেছিল মম। বরযাত্রী সব মিলিয়ে পনের জন। আমার এক চাচা থাকেন কানাডায়, তিনি সপরিবারে এসেছেন। আর এসেছেন ছোটমামা এবং পাপার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব। আমার কোনো বন্ধুকে বলা হয়নি। কাউকে কিছু বলার মতো অবস্থায় ছিলাম না সেদিন। নিজেকে নিছক যন্ত্র ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিল না। যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি সে দেখতে কেমন, কী তার নাম বা পরিচয়, এর কিছুই আমি জানতাম না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তাই না? আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো? মেয়েটার বিষয়ে ন্যূনতম কৌতূহল বোধও কাজ করছিল না আমার ভেতরে। আসলে বিয়েটা তো আমি করছি না। করছে আমার পরিবার। ভোর বেলা শুভ্রা ফোন করে বলেছে ওর কাছে এমন প্ল্যান আছে যে প্ল্যান মোতাবেক কাজ করলে নতুন বৌ এক মাসের মাথায় ভেগে যাবে। শুভ্রাকে কে বোঝাবে নতুন বৌ কবে ভাগবে সেটা আমার চিন্তার বিষয় নয়। এসবে আমার কিছু এসে যায় না। আমি চাই শুভ্রার ভালোবাসা। ওর ভালোবাসা পাবার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করেছি দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ মাস! যেদিন শুভ্রা আমাকে বলবে ‘শিহাব আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ সেদিন সমস্ত পৃথিবী ছেড়ে-ছুড়ে ওর কাছে ছুটে যেতে আমার কোনোই দ্বিধা থাকবে না। আমার বাবা-মায়ের মন আমি এই যাত্রায় রক্ষা করলাম। দ্বিতীয় যাত্রায় তারা আমার মন রক্ষা করবে, এমনটাই কথা হয়ে গেছে। আমি অপেক্ষায় আছি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের! 

কনের বাড়ি ভিয়েনা মেট্রো স্টেশনের কাছে। আমরা পৌঁছে গেলাম সকাল সাড়ে নটা নাগাদ। বাড়ির ড্রইং রুমে বসানো হলো বরপক্ষের লোকজনদের। পাপা একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, বলল, ‘উনি মেয়ের বাবা।’ 

ইনাকে আমি চিনি, পাপার বন্ধু। এর আগে কয়েকবার গেট টুগেদারে দেখা হয়েছে কিন্তু এর পরিবার সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমার। এর মেয়েকেও কখনো দেখিনি। আমি সালাম দিয়ে লোকটার সাথে হ্যান্ডশেক করলাম। দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের পাশে একজন হিজাব পরা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। পাপা জানালো ইনি কন্যার মাতা। 

নিকাহ হবে সাড়ে দশটায়। প্রায় জনা বিশেক লোক বৈঠক খানায় বসে আছে। আমি কারো সাথেই খুব একটা কথা বলছিলাম না। একজন পেট মোটা ভদ্রলোক আমার পাশে বসে নানারকম প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কী চাকরি করি, কোথায় পড়াশোনা করেছি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যান্ত্ৰিক গলায় উত্তর দিচ্ছি। আমার ভেতরটা অবশ। কোনো উত্তেজনা নেই। দেখলাম পাপা, চাচা এবং কনের বাবা দেনমোহর নির্ধারণ করা নিয়ে ব্যস্ত। 

রুশমি 

আমাকে একটা মেজেন্টা রঙের জামদানি শাড়ি পরানো হয়েছে। সাথে মেজেন্টা হিজাব। একজন পাকিস্তানি মেকআপ আর্টিস্ট এসেছে আমার মুখ সাজিয়ে দেবার জন্য। আমি আয়নার সামনে চিত্রার্পিত হয়ে বসে আছি। আর্টিস্ট আমাকে সাজাচ্ছে যত্ন করে। আমাকে ঘিরে আছে ঝুম্পা আপু, ফুপি এবং দুজন মাঝবয়সি মহিলা। এরা আম্মুর বান্ধবী। মেজোকে দেখছি আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চায়। কিন্তু ফুপির ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। 

সাড়ে দশটা নাগাদ নিচে নেমে এলাম। আমার মাথায় একটা লম্বা ঘোমটা দেয়া। সম্মুখের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ঝুম্পা আপু আর আম্মুজান দুদিক থেকে আমার হাত ধরে রেখেছে। ওদের দেখানো পথে আমি পা বাড়াচ্ছি। নিজেকে কাষ্ঠ পুত্তলিকা মনে হচ্ছে। সকালে কিছুই খাইনি। গতকাল সন্ধ্যায়ও শুধু সালাদ ছাড়া পেটে কিছু পড়ে নি। শরীর অত্যধিক দুর্বল। মানসিক ভাবেও অত্যন্ত দুর্বল বোধ করছি। এই মুহূর্তে যেন পুলসিরাত পার হচ্ছি। হাঁটু কাঁপছে ঠকঠক করে। মন চাচ্ছে এখুনি পালিয়ে যাই। চিৎকার করে বলি, বৃদ্ধ এবং বদখত লোকটাকে আমি বিয়ে করতে চাই না। প্লিজ! তোমরা আমার এই সর্বনাশ করো না! আমার আর্তচিৎকার বুকের ভেতরেই গুমড়ে গুমড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কণ্ঠনালী অতিক্রম করে মুক্ত বাতাসে বেরোতে পারছে না। আমি ব্যাকুল হয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে লাগলাম। তিনি ছাড়া আমার অন্য কোনো আশ্রয়স্থল নেই! 

ঘরের মধ্যবর্তী একটি সোফায় বসানো হলো আমাকে। মেজো সুযোগ বুঝে পাশে বসে পড়ল। কানে কানে বলল, ‘বড়পু, দুলাভাই দুষ্টুমি করেছিল তোমার যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে বৃদ্ধ না। তুমি বিশ্বাস করবা না…’ ও কথাটা শেষ করতে পারল না। একজন পাজামা পাঞ্জাবি পরা লোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তখন। আমি তার পা জোড়া দেখতে পাচ্ছি শুধু। ইনি মনে হয় বিয়ের কাজী। আমাকে বলা হলো কলমা পড়তে। আমি পড়লাম। এখন আমার কনসেন্ট চাওয়া হচ্ছে। কনসেন্ট থাকুক আর না থাকুক কবুল আমাকে বলতেই হবে! সেই মুহূর্তে জীবনে প্রথমবারের মতো আমি আমার বরের নামটা নিজ কানে শ্রবণ করলাম। নামটা আমার চেনা! হঠাৎ টের পেলাম একটা হাড়কাঁপানো শীতে আমার শরীরের সব রক্ত হিম হয়ে আসছে। মেরুদণ্ডে বিদ্যুতের মতো শিরশির করে বয়ে যাচ্ছে সুতীব্র শিহরণ। কিছুতেই মাথা সোজা রাখতে পারছি না। 

শিহাব 

শুধু এক মুহূর্তের এ নহে ঘটনা,
অনাদিকালের এই আছিল মন্ত্ৰণা! 

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

.

শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা দেয়া মেয়েটা আমার কয়েক হাত দূরে বসে আছে। মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে চাইছিও না অবশ্য। ভেতরটা এ মুহূর্তে পুরোপুরি স্পৃহাশূন্য। ভাবছি এমন ঘটনাও কখনো কোনো আধুনিক মানুষের জীবনে ঘটে নাকি? আমার নিজের জীবনটার প্রতি কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণই তবে রইল না? আবার ভাবছি মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন আছেই বা কী এ জগতে? আমরা মানুষেরা নিজেদের ইচ্ছেগুলোকেও বোধহয় সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমাদের ইচ্ছে নিয়ন্ত্রিত হয় অন্য কোনো অদৃশ্য শক্তির ইচ্ছে দ্বারা। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা মনে পড়ছে। আমি তাঁর গানের একনিষ্ঠ ভক্ত এ কথা ঠিক তবে খুব একটা কাব্যপ্রেমী নই। কিন্তু এই মুহূর্তে কবিতাটা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আমার বুক অকারণে দুরদুর করে কাঁপছে। ঘোমটা টানা অচেনা মেয়েটির দিকে কম্পিত বক্ষ নিয়ে আড়চোখে চেয়ে আছি আর মনে মনে কবিতার লাইনগুলো মনে করার চেষ্টা করছি… ‘এ সংসারে একদিন নববধূবেশে/ তুমি যে আমার পাশে দাঁড়াইলে এসে/ রাখিলে আমার হাতে কম্পমান হাত/ সে কি অদৃষ্টের খেলা, সে কি অকস্মাৎ?/ শুধু এক মুহূর্তের এ নহে ঘটনা/ অনাদিকালের এই আছিল মন্ত্রণা। 

ঠিক সেই মুহূর্তে কনের নামটা আমার কানে এসে লাগল। এই নামের একটা মেয়েকে চিনি আমি। সেই মেয়েটি অসভ্যের চূড়ান্ত! যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে তার স্বভাব কেমন কে জানে! 

নিকাহ নামায় সই হয়ে যাবার পর কনেকে আমার পাশে বসানো হলো। এরপর আমাদের মাথা ঢেকে দেয়া হলো একটা বড়সড় ওড়না দিয়ে চারিদিক থেকে একগাদা লোকজন আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে। ভিড়ের মধ্যে একটা ফোঁটা বাতাস চলাচল করছে না। এত হই চই যে কানে তালা লেগে যাবার যোগাড়। চোখের সামনে একটা ডিম্বাকৃতির আয়না ধরা। ভিড় থেকে কেউ একজন বলছে, ‘আয়নায় কী দেখা যায়?’ আমি নিস্পৃহ থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু ভেতরকার উত্তেজনা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারছি না। শ্বাস- প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। আয়নায় চোখ পড়তেই মেয়েটিকে দেখলাম। তার দৃষ্টি অবনত, মুখের গড়ন লম্বাটে, নাকে নোজপিন, ঠোঁটের নিচে একটা কালো তিল। মেয়েটা চোখ তুলে তাকাতেই আমার হৃদযন্ত্রের স্পন্দন থেমে গেল! পৃথিবী ক্ষণিকের জন্য থমকে গেলো তার নিজস্ব কক্ষপথে! বাতাসে এখন কোনো অক্সিজেন নেই…! আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না… এক বীতশ্রদ্ধ বীভৎস চমকে আমার দম আটকে আসছে। কয়েকটা সেকেন্ড আমরা দুজনে দুজনের দিকে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম। আর তারপর যা ঘটল তা এ পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে বিব্রতকর এবং অপমানজনক ঘটনা। আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী শুভদৃষ্টি বিনিময়ের সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেল। অর্থাৎ আমি এতটাই ভয়ংকর, যে আমাকে দেখা মাত্র আমার বৌ ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। অপমানে জমে গেলাম। চমৎকার! তোমার দ্বারাই এসব সম্ভব রুশমি! মানুষকে অপদস্থ করায় তোমার জুড়ি নেই! 

রুশমি 

চোখের ওপর কেউ যেন পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। চারধারে অন্ধকারের সাগর। যন্ত্রণায় মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে। অনেক কষ্টে চোখ খোলার পর কার যেন একটা মুখ দেখতে পেলাম আবছা। পুরনো, বিকল হয়ে যাওয়া টিভির পর্দার মতো ঝিরিঝিরি করে কাঁপতে লাগল চোখের সামনের দৃশ্যপট। আমার কিছুই মনে পড়ছে না। কী হয়েছিল, কোথায় আছি, কেন এত মানুষের ভিড় আমাকে ঘিরে, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে আপাতত নেই। ক্রমশঃ এক ঐকান্তিক অন্ধকার আমাকে গ্রাস করে নিতে চাইছে। আমি আঁধার সাগরে ডুবছি, ভাসছি, সাঁতরে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। হঠাৎ হঠাৎ ওপরের পৃথিবীর আলোর ঝলকানি শাণিত ছুরির মতো আমার চোখের দরজায় আঘাত হানছে। দুঃসহ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি। একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর দূরের ঘন্টার মতো কানে এসে লাগছে ‘রুশমি! রুশমি!’ 

চোখের পাতা দুটো অনেক কষ্টে মেলে ধরে দেখলাম আম্মুজান ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। তার ঠিক পাশেই দুটো ভীতিগ্রস্ত মুখ। বাবাজান আর ফুপির। আমি শুয়ে আছি আমার ঘরের বিছানায়। মাথার হিজাব খুলে ফেলা হয়েছে। শাড়ির আঁচল দুমড়ে মুচড়ে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। কয়েকটা সেকেন্ড স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইলাম তিনমূর্তির দিকে। তারপর ধীরেধীরে শূন্য মস্তিষ্ক ভরে গেলো টুকরো টুকরো স্মৃতিতে। মনে পড়ল একটু আগেই আমার বিয়ে হয়ে গেছে। তার সাথে এ-ও মনে পড়ল যে বিয়েটা যার সাথে হয়েছে সেই মানুষ বহু দিন আগে থেকে অন্য এক নারীতে চরমভাবে আসক্ত! 

ধড়ফড় করে উঠে বসলাম শোয়া থেকে। দেখলাম ঘরের মধ্যে বাবা, আম্মু আর ফুপি ছাড়াও আরও দুজন মহিলার উপস্থিতি আছে। টের পাচ্ছি বাবাজান আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। কিন্তু আমি তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। আমার বুকভর্তি হয়ে আছে দুর্বিষহ অভিমানে। এই অভিমান মোমের মতো নয় যে প্রিয়জনের সান্নিধ্যে গলে যাবে, এই অভিমান লৌহ পিণ্ড হয়ে গেঁড়ে বসেছে বুকের অনেক গভীরে। যে মানুষটাকে আমি জীবনে সবচাইতে বেশি ভালোবাসতাম সেই মানুষটার মুখের দিকে চাইতে আজ আমার সীমাহীন বিতৃষ্ণা। মানুষের জীবনে এরকম মুহূর্তও যে আসে তা আমার এর আগে জানা ছিল না। আমার শরীর এখনো দুর্বল। মাথা ভার, চোখে জ্বালা। সোজা হয়ে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। ঝুম্পা আপু গেটোরেটের একটা বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা খেয়ে নে। তোর প্রেশার একদম লো।’ বোতলটা কাঁপা হাতে তুলে নিয়ে বললাম, ‘তোমরা সবাই একটু যাও তো এই ঘর থেকে। আমার আম্মুজনের সাথে কথা আছে।’ 

ঝুম্পা আপুর চোখে পাতলা একটা বিস্ময়রেখা ফুটে উঠতে দেখলাম। সেই সাথে কিঞ্চিৎ অপমানবোধ। এদিক সেদিক একবার চেয়ে নিয়ে দ্রুত ঘরটা ছাড়লো সে। বাকিরাও বেরিয়ে গেল কিয়ৎ সময়ের মধ্যেই। গেলো না শুধু ফুপি আর বাবা। আমি আম্মুজানের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা স্বরে বললাম, ‘আম্মুজান! তোমার সাথে আমার কথা আছে!’ 

আম্মুজান পাশে এসে বসলো। আমার মাথায় একটা হাত রেখে বলল, – ‘বলো মা! কী বলতে চাও বলো।’ 

আমি আমার মায়ের ভালোমানুষি বোকাসোকা মুখটার দিকে কয়েক সেকেন্ড হিম চোখে তাকিয়ে রইলাম। সে কি আমার কথা বুঝতে পারছে না? আমি যে কথাগুলো অন্য কোনো তৃতীয় ব্যক্তির সামনে বলতে চাইছি না এই পানির মতো তরল ব্যাপারটা বুঝতে পারা কি এতই দুঃসাধ্য? 

—‘এভাবে নয়। সবাইকে যেতে বলো।’ 

আম্মুজানের মুখে ভয়ের একটা সুস্পষ্ট ছাপ পড়ল। এ এক আশ্চর্য বোকা মানবী! তার মেয়ের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তা নিয়ে এর কোনো ভয় নেই। যত ভয় সব স্বামী আর স্বামীর বড় বোনকে নিয়ে। বাবাজান হুকুম দেয়ার সুরে বলল, ‘যা বলার আমাদের সামনেই বলো।’ 

হায়! এরা বুঝতে পারছে না যে হুকুম তামিল করার মতো সাধারণ লুতুপুতু মনটা আমার মরে গেছে। আজীবন বড় বাধ্য মেয়ে ছিলাম। সেই বাধ্যবাধকতার চরম পুরস্কার পেলাম আজ! ফুপিকে আমরা সবাই ভয় পেয়ে অভ্যস্ত। ছোটোবেলা থেকে আজ অবধি ফুপির সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় কোনো কথা বলিনি আমি। তাঁর সাথে জোর গলায় কথা বলার সাধ্য আমার বাবা মায়েরও নেই। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। ওরা জানে না যে মাত্ৰ কিছুক্ষণ আগে, তিনবার কবুল শব্দটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতরটা একদম ম্যাজিকের মতো পাল্টে গেছে। এত সহজে কী করে পাল্টালো সেটা এক বিস্ময়! ঠিক যেমন শিহাবের সাথে আমার বিয়েটাও আমার কাছে এক বিস্ময় চিহ্ন ছাড়া কিছুই না। আমি কারো দিকে না তাকিয়ে অত্যন্ত কঠিন গলায় বললাম, ‘আম্মুজানের সাথে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে। প্লিজ লিভ আস এলোন।’ 

ফুপি এতক্ষণে মুখ খুলল। স্বভাবসুলভ বাজখাঁই গলায় বলে বসল, ‘কেন আমাদের সামনে বলতে সমস্যা কী? আমরা কি তোমার পর?’ 

আমার ভেতরে যে ঠিক কী হচ্ছিল তার সঠিক বর্ণনা দেয়ার সাধ্য আমার আজও নেই। শুধু মনে আছে এক বিকট চিৎকারে ফেটে পড়েছিলাম সেদিন উন্মাদের মতো। আম্মুজান থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। তার সেই ভয়ার্ত মুখটা মনে পড়লে এখনো খুব কষ্ট হয়। 

—‘আপা। আপনারা নাহয় একটু বাইরে গিয়ে দাঁড়ান।’ 

সেই প্রথম আম্মুকে ফুপির সামনে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় কিছু বলতে শুনলাম। কতটাই বা আর কড়া? আমার মা নরম সরম মেনিমুখো মানুষ। তার কড়া হবার দৌড়ও খুব বেশি বেগবান নয়। কড়া হতে গিয়েও পারল না। কেঁদে ফেলল শেষমেশ। হাতজোড় করে বলল, ‘আমার মেয়েটা আজকে চলে যাচ্ছে। প্লিজ আপনারা একটু দয়া করেন। আমাকে ওর সাথে একলা একটু কথা বলতে দিন।’ 

বাবাজান বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। ফুপি ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মুখের ত্বকের বলিরেখার ফাঁকে ফাঁকে ধকধক করছে তেজ। আম্মুজান মুখে ওড়না চাপা দিয়ে কাঁদছে। আমি বিছানার ওপর শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছি নিশ্চল পাথর হয়ে। আজকে আমার বুকজোড়া সাহস! নিজেকে এতটা সাহসী এর আগে কখনো মনে হয়নি। আমি যেন কোনো বীরাঙ্গনার চেয়ে কম নই। অথচ এই সাহসের সিকি ভাগও যদি চব্বিশ ঘন্টা আগে আমার মধ্যে সঞ্চারিত হতো তাহলে এই বিয়েটা আমাকে করতে হতো না… আসলে ব্যাপারটা সেরকম নয়। এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে বিয়ে করে বাবাজানের আদেশ মান্য করেছিলাম বলেই ভেতরে ভেতরে একরকম জিতে গিয়েছিলাম সেদিন। সেই নিখাদ বিজয়টুকুই আমার মনে সাহসের সঞ্চার করেছিল। এই পৃথিবীটা আমাদের চোখের সামনে যেমন, আসলে ঠিক তেমনটা নয়। এর রূপ, বর্ণ, গন্ধ সমস্ত কিছুর একটি অন্তর্নিহিত রূপ আছে। বাইরে থেকে আমরা যেটা বিজয় বলে মনে করি, ভেতর থেকে হয়তো সেটা চরম পরাজয়। আমি সেদিন জিতে গিয়েছিলাম, বাবা মায়ের মন রক্ষা করে। কিন্তু আমার বাবাজান হেরে গিয়েছিল ভেতরে ভেতরে। সেই হার তাকে এক অসহনীয় মানসিক পীড়ায় জর্জরিত করে তুলেছিল পরবর্তী দিনগুলোয়! সে কথা এখন থাক। এখন বরং আমার বিয়ের দিনটির কথাই বলি। ফুপি কয়েক সেকেন্ড পর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। 

—‘বলো রুশমি, কী বলতে চাও?’ আম্মুজান আমার গা ঘেঁষে বসলো। 

—‘তোমরা এ কার সাথে বিয়ে দিলে আমাকে?’ 

আম্মুজানের মুখটা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ‘এভাবে বলছ কেন?’

এবার আর পারলাম না। ডুকরে কেঁদে উঠে বললাম, ‘তোমরা কি জানতে না এই ছেলে শুভ্রাকে পছন্দ করে? কেন এই সর্বনাশ করলে আমার?’ 

—‘আরে না। ব্যাপারটা সেরকম নয় রুশমি। শিহাবের মা বলল, শুভ্ৰা ওকে জাস্ট ইউজ করতে চাইছে। ছেলেটার বয়স অল্প তো তাই বুঝতে পারছে না।’ 

আম্মুজানের মাথায় কিছুই বুদ্ধি নেই। আমি কাঁদছি, খুব কাঁদছি! কাঁদতে কাঁদতে আমার হিক্কা উঠে যাচ্ছে। আম্মুকে কে বলবে যে আমি যা জানি তা ওরা জানে না। ওরা জানে না যে, এই ছেলে আমার জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছাড়বে। এই ছেলের চোখে আমি শুভ্রাকে কাছে পাওয়ার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা দেখেছি। ও আমাকে কোনোদিন ভালোবাসবে না। আমাকে কেন আমার ধারণা ও কাউকেই কোনোদিন সত্যিকারের ভালোবাসতে পারবে না। ওর ভেতরটা খটখটে শুকনো। হায় খোদা! এর চেয়ে তো বৃদ্ধ আর বদখত লোকের সাথে বিয়ে হওয়াও ঢের ভালো ছিল। 

আম্মুজান আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, ‘তোমার বাবাজান খোঁজ খবর নিয়েছে, ছেলে খুবই ভালো। এত বছর আমেরিকায় থাকে। কোনো স্ক্যান্ডাল নেই, খারাপ অভ্যাস নেই। লেখাপড়ায় ভালো, ইঞ্জিনিয়ার। বাবা- মাকে সম্মান করতে জানে। এই যুগে এমন ভদ্র ছেলে পাওয়া দুষ্কর। তুমি শুধু শুধু মন খারাপ করছ বোকা মেয়ে! এখন ওঠো, হাতমুখ ধুয়ে খেয়ে নাও। তারপর একটু ঘুমোও। সন্ধ্যায় আমাদের রেস্টুরেন্টে বরপক্ষের লোকজনদের খাওয়ানো হবে। তারপর তোমাকে নিয়ে যাবে ওরা।’ 

হঠাৎ এক অন্যরকম দুশ্চিন্তা চেপে ধরল আমাকে। ও আল্লাহ! শুভ্ৰাদি আমাকে কী ভাববে? এই মুখ কী করে দেখাবো আমি ওকে? কে বিশ্বাস করাবে ওকে যে এই বিয়ে আমি জেনে শুনে করিনি। কবুল বলার আগ পর্যন্তও আমি জানতাম না আমার বর কে? এত খারাপ কেন হলো আমার ভাগ্যটা? যে ছেলেটার সাথে গতকাল কোমর বেঁধে ঝগড়া করলাম, মনে মনে গালাগাল দিলাম তার বাড়িতেই কিনা এখন বধূবেশে আশ্রিত হিসেবে যেতে হচ্ছে? এমন ঘটনা ঘটেছে কখনো কারো সাথে? কেউ বিশ্বাস করবে এই গল্প? কাঁদতে কাঁদতে আবারও অজ্ঞান হয়ে যাবার দশা হলো আমার। কিন্তু কান্নাও বা আর কতক্ষণ করা যায়? সব দুঃখই একসময় সহনশীল হয়ে যায়। আমি ছোটোবেলা থেকেই খুব একটা বোকা মেয়ে নই। পরিস্থিতি সামলে চলার অভ্যাস আছে আমার। একটা সময় কান্নার রেখা মুছে নিলাম। মুখ থেকে সাজগোজ তুলে নিয়ে গোসল করলাম। লক্ষ্মী মেয়ের মতো খাবার খেয়ে নিলাম। অতিথিরা আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। আমি কারো দিকে মুখ তুলেও চাইলাম না। দুপুরে একটু গড়িয়ে নিলাম বিছানায়। বুকটা খালি খালি লাগছিল। কী যেন নেই! কী যেন একটা নেই! কী যে নেই তা আমি সঠিক জানি না। শুধু জানি এই বাড়ি ছেড়ে আজ আমি চলে যাব। তারপর… আর কোনোদিন আসবো না! আসবো আসবো, যেদিন বাবাজান আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, শুধুমাত্র সেদিনই আবার বাড়িমুখো হব। তার আগে না! 

শিহাব 

ঘটনাটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ওই নোজপিন পরা, অভদ্র, উদ্ধত, বেয়াদব মেয়েটার সাথেই কিনা শেষমেশ আমার বিয়ে হয়ে গেল? কীভাবে সম্ভব? আমি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছি না তো? হয়তো একটু পরেই আমার ঘুম ভেঙে যাবে। চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করব স্বাভাবিক, সাধারণ, ছিমছাম এক শীতের সকালে, নিজের চিরচেনা বিছানায়। ঘুম থেকে উঠে দেখব জীবনটা আগের মতোই আছে। রুশমি নামের কোনো ডিজাস্টার আমার শান্ত স্থির জীবনে করাল ছায়া হয়ে প্রবেশ করেনি কখনো। আমি ভালো আছি। স্বাভাবিক আছি। শান্তিতে আছি! 

শুভ্রাকে কিছুই বলিনি এ ব্যাপারে। কোত্থেকে খবর পেয়েছে কে জানে। বিয়ের কনে অজ্ঞান হয়ে যাবার পর আর বেশিক্ষণ সেখানে অবস্থান করতে পারলাম না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগেনি। আধাঘন্টার মধ্যেই খবর পেলাম তার জ্ঞান ফিরেছে। সেই সময় শুভ্রা ফোন করতে করতে আমাকে অস্থির করে তুলেছে। এখুনি দেখা করতে চায়। পাপা আর মম তেমন একটা ঝামেলা না করলেও পাপার দাড়িওয়ালা বন্ধু (যিনি কিনা আইনত এখন আমার শ্বশুর) বেরোবার মুহূর্তে বাধ সাধলেন। কিছু না খেয়ে নাকি বাড়ি থেকে বেরোনো যাবে না। একরকম জোর খাটিয়েই শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হলো আমাকে। শুভ্রার সাথে দেখা হলো ফেয়ারঅক্স মলে। ভেতরে ঢুকতে হলো না। চিজ কেক ফ্যাক্টরি সংলগ্ন পার্কিং লটেই পেয়ে গেলাম ওকে। মাথার চুল এলোমেলো। রাগে থমথম করছে মুখ। বেসামাল অবস্থা। 

—‘এটার মানে কী? তুই রুশমিকে বিয়ে করলি কোন আক্কেলে?’ 

—‘তুমি কী করে জানলে? 

শুভ্রা পাগলের মতো চিৎকার করে বলল, —‘রুশমির ছোটোবোন ফেসবুকে পিকচার আপলোড করেছে। এসব কোন ধরণের ফাইজলামি হ্যাঁ? 

আমি ভীষণ হকচকিয়ে গেছি তখন। মাথা এলোমেলো লাগছে। কী বলব, কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। শুভ্রা সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘রুশমি এত বড় শয়তান তা তো আমি জানতাম না!’ 

—‘রুশমি কিছুই জানত না। আমিও জানতাম না।’ 

—‘তুই কী করে শিওর হলি যে রুশমি জানতো না?’ 

আমি চুপ করে রইলাম। সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। রুশমি আগে জানলে আমাকে দেখা মাত্র অজ্ঞান হয়ে যেত না। আমাকে সে কোনো এক বিচিত্র কারণে অত্যধিক ঘৃণা করে। তার বিয়ে আমার সাথে হতে যাচ্ছে এই তথ্য জানা থাকলে কিছুতেই সে বিয়েতে রাজি হতো না। এ ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। শুভ্রা অস্থিরভাবে হাঁটাহাঁটি করছে। আজকের ওয়েদার ভালো না। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। চারপাশ কুয়াশায় ঘোলা হয়ে আছে। মুক্ত আকাশের নিচের সুবিশাল পার্কিং লটটার ওপর দিয়ে জ্ঞানশূন্য পাগলা বাতাস সুতীব্র বেগে শোঁ শোঁ শব্দে বয়ে যাচ্ছে। আমরা দুজনেই ভারী কাপড়ের জ্যাকেট পরে আছি। তবুও শীত মানছে না। ঠান্ডা বাতাস মুখের চামড়ায় ধারালো ছুরির পৌঁচ বসাচ্ছে ক্রমাগত। 

—‘আচ্ছা শোন। এক দিক থেকে ভালোই হয়েছে। মেয়েটা যেহেতু অন্য কেউ নয়, আমাদের রুশমিই। সেহেতু ডিভোর্সটা নিতে তোর খুব বেশি সমস্যা হবে না।’ 

—হুম’ ছোটো করে উত্তর দিলাম। এ কথা সত্য যে রুশমিকে তাড়াতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হবে না। রুশমি নিজেও এই সম্পর্ক বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে চাইবে বলে আমার মনে হয় না। আর এমনিতেই যে ঝগড়াটে মেয়ে, হয়তো কাল পরশুর মধ্যেই ঝগড়া টগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাবে। ভালোই হলো একদিক থেকে। ইনোসেন্ট একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করা হবে ভেবে আমার মনে যে পাপবোধটা জন্ম নিয়েছিল, রুশমিকে বিয়ে করার পর সেই পাপবোধ ম্লান হয়ে গেছে। বরং এই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত কথা মনে পড়তেই আমার বুকের আকাশ জুড়ে একটা সুখী সুখী ঝিরঝিরে হাওয়া বয়ে গেলো মুহূর্তের জন্য। রুশমি বলেছিল আমি নাকি শুভ্রার যোগ্য পাত্র নই। প্রকৃতির লীলাখেলা বোধহয় একেই বলে। সেই অযোগ্য ছেলেটির গলায়ই কিনা শেষমেশ তোমাকে ঝুলতে হলো রুশমি! হাঃ হাঃ হাঃ তুমি আমাকে যোগ্য মনে করোনি কিন্তু তোমার বাবা-মা তো আমাকে যোগ্য মনে করেছে! কোথায় গেলো তোমার সব অহংকার, হ্যাঁ? এখন তুমি যাবে কোথায়? সেই অযোগ্য ছেলেটির দ্বারগ্রস্থই তো হতে হলো তোমাকে!

সন্ধ্যায় স্যুট টাই পরে আরেক দফা বর সাজতে হলো মমের জোরাজুরিতে। আমি অবশ্য কোনো কিছুতেই এখন আর তেমন একটা আপত্তি করছি না। আমার মগজ ঠান্ডা হয়ে গেছে। আমি শত ভাগ নিশ্চিত পাপা মম যাই বলুক না কেন, এই বিয়ে দুদিনও টিকবে না। আমার আলাদা ভাবে কোনো চেষ্টাই করতে হবে না। বিয়েটা খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে যাবে। বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব আমেজ ছড়িয়ে গেছে। মম খুব আগ্রহ নিয়ে সাজগোজ করছে। শুনলাম এটাই নাকি একমাত্র অনুষ্ঠান নয়। এরপর পাপা বিরাট আয়োজন করে বৌভাতের অনুষ্ঠান করবে। জাহিদকে খুব প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। নতুন বৌয়ের আগমন উপলক্ষে বাড়ির সম্মুখ ভাগে আলোক সজ্জা করা হচ্ছে। সাজানো হচ্ছে আমার ঘর। আপাতত নিজের ঘর থেকে আমি নিজেই বিতাড়িত। সাজানো গোছানোর কাজে জাহিদকে সাহায্য করছে আমার চাচাতো ভাই সাদিক। ওদের মনে আনন্দের সীমা নেই। আমি এসব চুপচাপ দেখছি আর মনে মনে হাসছি। কেউ জানে না, কিন্তু আমি জানি যে ওই ঠোঁটকাটা, অভদ্র মেয়েটা কিছুতেই এই বাড়িতে মানিয়ে চলতে পারবে না। মম ভাবছে একেবারে সহজ সরল ঘরোয়া একটি মেয়েকে ছেলের বৌ করে নিয়ে আসছে সে। কিন্তু ঘটনা উল্টো। মেয়েটির কোনোভাবেই মমের সাথে বনিবনা হবে না, হতেই পারে না। 

.

রেস্টুরেন্টটা শুনলাম আমার শ্বশুর মশাইয়ের মালিকানাধীন। ভেতরে জায়গা খুব একটা বড় নয়। আমরা সব মিলিয়ে বরযাত্রী বিশ জন। কনে পক্ষর লোকজনসহ মোট লোকসংখ্যা হয়তো পঁয়তাল্লিশ হবে। তাতেই একদম দম বন্ধ করা অবস্থা। আমাকে বসানো হলো রেস্টুরেন্টের এক কোণার একটি রাজকীয় চেয়ারে। মিস ডিজাস্টারকে বসানো হলো আমার পাশে। পুরো অনুষ্ঠানে একটা বারের জন্যও আমি ওর দিকে ফিরে তাকাইনি। সত্যি বলতে তাকানোর কোনো তাগিদও অনুভব করিনি। আমার ভেতরটা অনুভূতি শূন্য হয়ে আছে। সীমাহীন নির্বিকারত্ব একটা অবশ অবশ ভাব এনে দিয়েছে। মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে কেউ বোমা মেরে গোটা বিল্ডিং উড়িয়ে দিলেও আমি বিচলিত হব না। এমন কি রুশমির বাবা যখন আমার হাতে মেয়ের হাত তুলে দিল তখনও আমি কোনো উত্তেজনা টের পেলাম না ভেতরে। রুশমির মা কাঁদছে, বোনরা কাঁদছে। মেয়েদের কান্নাকাটিতে ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। কিন্তু রুশমি এক ফোঁটাও কাঁদছে না। এই মেয়েটা কেমন অদ্ভুত! শুষ্ক, আবেগশূন্য, নিষ্প্রাণ পাথরের মতো। কারো জন্য বোধহয় কোনো মায়া টায়া নেই ওর মাঝে। দেখলাম যন্ত্রচালিতের মতো হেঁটে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলো। নিজের বাবা-মাকে একটা বার ঠিকমতো জড়িয়েও ধরল না। স্ট্রেঞ্জ! যে মেয়ের নিজের বাবা-মায়ের জন্য কোনো টান নেই, সে মেয়ের আমার বাবা-মায়ের জন্য টান আসবে কোত্থেকে? 

.

বাড়ি ফেরার পর কেমন একটা অচেনা অস্বস্তিতে পেয়ে বসলো আমাকে। এতক্ষণের শান্ত স্থির ভাবটা চকিতে উবে গেলো। বধূবরণ করা হলো বেশ সময় নিয়ে। জাহিদ, সাদিক আর ওদের বন্ধুরা হইচই করে বাড়ি মাথায় তুলল। বেডরুমে ঢুকে দেখি আর্টিফিশিয়াল ফুল দিয়ে বিছানা সাজানো হয়েছে। সাদা আর গোলাপি রঙের ফুলগুলো দেখে চোখে আরাম লাগছিল। কিন্তু মনের মধ্যে এক বিন্দু ভালো লাগাও নেই। আমার এতদিনের নিজস্ব ঘরটা কিনা আজকের পর থেকে ওই বিরক্তিকর মেয়েটার সাথে শেয়ার করতে হবে! এই দুঃখে মরে যাবার মতো অবস্থা হচ্ছিল। মনে হচ্ছে যেন আমার ঘর, বিছানা সমস্ত কিছু অপবিত্র হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে জাহিদসহ আরো কিছু লোকজন উপস্থিত আছে ঘরে। আমি সুযোগ বুঝে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ভাবছিলাম এখন পালিয়ে গেলে কেমন হয়? কিন্তু পালানো কি অতো সোজা? সিঁড়ির গোড়ায় মমের সামনে পড়ে গেলাম। 

—‘কী ব্যাপার? মুখটাকে অমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছ কেনো? বিয়ের দিন কেউ এরকম মুখ বানিয়ে ঘোরে নাকি? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?’ 

আমতা আমতা করে বললাম, ‘না, সমস্যা… নেই।’ 

—‘কোথায় যাচ্ছ?’ 

কী মুশকিল! ভেবেছিলাম নিচে নেমে একটু নিরিবিলিতে স্মোক করব। আমার মায়ের জ্বালায় সেটাও সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। 

—‘এইতো একটু হাঁটতে যাচ্ছি।’ 

—‘এত রাতে?’ 

— ‘হ্যাঁ।’ 

—‘পাগল নাকি? বাইরে ভয়াবহ ঠান্ডা। নতুন বৌ ফেলে এখন হাঁটতে যেতে হবে না। যাও নিজের ঘরে যাও।’ 

পাপাকে দেখতে পেলাম ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে। পাপা আমার হাতে একটা টাকার বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেনমোহরের টাকা। দিয়ে দিও বৌমাকে মনে করে। 

—‘এখনই দিতে হবে?’ 

—‘হ্যাঁ এখনই, আজ রাতেই। এটাই নিয়ম।’ 

অগত্যা আমাকে পকেট ভর্তি ডলার সমেত পরাজিত সৈনিক হয়ে ফিরে আসতে হলো নিজের ঘরে। ফিরে দেখি তখন ঘর খালি হয়েছে। জাহিদরা কেউ নেই। অর্থাৎ ঘরের ভেতর এখন শুধুই রুশমি। আমি দরজার বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম থম ধরে। এসব কথা বলতে খুব অস্বস্তি! কিন্তু লেখকদের নাকি মিথ্যে বলতে নেই, সেই শর্ত মোতাবেক বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ওই সময়টায় নিদারুণ এক স্নায়বিক চাপ অনুভব করছিলাম ভেতরে। আমার ঘরে মম ছাড়া অন্য কোনও দ্বিতীয় নারীর ছায়া পড়েনি আজ পর্যন্ত। আমার অনুপস্থিতিতে এই ঘরে কারো ঢোকা বারণ। অফিসে যাবার আগে রুমের দরজা লক করে চাবি সমেত বেরিয়ে যাই। কারো সাধ্য নেই তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকার। আজকের পর থেকে কি আর আগের নিয়ম চলবে? চালানো কি সম্ভব? এসব ভাবনা আমাকে ক্রমশ বিচলিত করে তুলছে। মনে হচ্ছে এক ভয়াল হিংস্র থাবা অন্ধকার থেকে তেড়ে এসে জোরপূর্বক আমার ব্যক্তিগত সুখ, শান্তি এবং স্বস্তিটুকু কেড়ে নিতে চাইছে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না! 

.

দরজাটা আলতো শব্দে ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। ল্যাম্পশেডের পেলব হলদে আলোয় ভরে আছে ঘর। দেখলাম গোলাপি আর সাদা ফুল ছড়ানো বিছানার ওপর লাল শাড়ি পরা রুশমি মাথা নিচু করে স্থবির হয়ে বসে আছে। ঘরের দরজা বন্ধ করলাম। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলাম কাঠ হয়ে। পা নড়ছে না, কী মুশকিল! রুশমি এক বিন্দুও নড়েনি। ভাবটা এমন যেন আমার উপস্থিতি সে টেরই পায়নি। আমি ভাবছি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে এখন কী বলব। কী বলা উচিত? একদিক থেকে বাঁচোয়া যে শুভ্রাকে নিয়ে কিছু আলাদা ভাবে বলতে হবে না। রুশমির সব কিছুই আগে থেকে জানা আছে। তাহলে বলবটা কী? দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এসব আবোল তাবোল ভাবছি। ঠিক সেই মুহূর্তে রুশমি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আমার দিকে চাইল। সারাদিনে এই প্রথমবারের মতো ওর মুখখানা দেখলাম। মাথা ঢাকা লাল রঙের হিজাবে। মুখে রং টং মাখা। মেয়েদের সাজগোজের অত কিছু আমি বুঝি না। সবটাই রং বলে মনে হয়। অজস্র হিজিবিজি রঙের মধ্যেও ওর চোখদুটো শ্রী হারায়নি। এত সুন্দর চোখের একটা মেয়ে কেনো অমন খটোমটো, রাগী আর ঝগড়াটে হবে সে রহস্য ভেদ করার ক্ষমতা আমার নেই। হঠাৎ নজর পড়ল ওর চোখের নিচ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের দাগের ওপর। দেখামাত্র বুঝলাম যে মেয়েটা এতক্ষণ কাঁদছিল। হঠাৎ মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো। আমার তো নিজের বাড়ি, নিজের সব কিছু, তবুও নার্ভাস লাগছে। আর এই মেয়েটা আপনজনদের ছেড়েছুড়ে সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় এসে ফেঁসে গেছে। ওর কী রকম লাগছে কে জানে! বেচারি! আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক। কী বলব খুঁজে পাচ্ছি না। হয়তো সেও কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। ঘরের কোথাও কোন শব্দ নেই। হিটার চলছে, আমার কপাল ঘামছে। অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে আছে অন্তর। নিজের কাছে নিজেকে ভীষণ আনস্মার্ট লাগছে। এতটা বিচলিত কখনো শুভ্রার সামনেও হইনি। এই মেয়েটার ব্যক্তিত্বে কি আলাদা রকমের একটা ধার আছে? আছে মনে হয়। নইলে এমন হাঁসফাঁস লাগবে কেনো? 

রুশমি 

বিদায় লগ্নে বাবাজানের সাথে আমি কোন কথা বলিনি। ফুপির সাথেও না। অথচ বাবাজানকে একটা বার দেখবার জন্য বুক ফেটে যাচ্ছিল। সেই ইচ্ছেটাকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেছি। আজকের দিনটা আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের পরিমাণ অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। সবাইকে ফেলে চলে আসার সময় একটুও কাঁদিনি। ভেতরটা বরফের মতো জমাট হয়ে ছিল। হাসি, কান্না, রাগ, দুঃখ এই সমস্ত স্থূল অনুভূতির অনেক উর্ধ্বে উঠে গিয়েছিলাম আমি। নিজেকে সাধু সন্ন্যাসী মনে হচ্ছিল। শুধু কর্তব্য পালন করাই যেন আমার একমাত্র ব্রত। এই কর্তব্য পালনের নিরবচ্ছিন্ন পরিক্রমায় পার্থিব আবেগের কোন স্থান নেই। 

আমার শ্বশুর মশাইয়ের বাড়িটি বেশ পুরোনো। রেনোভেট করা হয়েছে। সবকিছুই ঝকঝকে তকতকে, তবে বাড়ির প্ল্যান এবং বড় বড় কামরা দেখেই আঁচ করা যায় যে এ বাড়ির বয়স পঞ্চাশ বছরের কম হবে না। সত্যি বলতে কি বাড়িটা আমার ভালো লেগেছে। যদিও পুরো বাড়ি দেখার মতো সময় এখনো পাইনি। কিন্তু যতটুকু দেখেছি, তাতেই ভালো লেগেছে। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে এই ঘরটা। এই ঘরের পশ্চিম দিকের কাচের জানালাটা বিশাল। একেবারে সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত নয়, তবে দেয়ালের অধিকাংশ জায়গা জুড়েই এই জানালার বিস্তার। পর্দা সরিয়ে দিলে ভেতর থেকে খোলা আকাশ দেখা যায়। দেখা যায় অনেক দূর-দূরান্ত অবধি ছড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গল। জানালার ঠিক সামনেই একটি কালো রঙের তিন পা বিশিষ্ট বিশাল আকারের গ্র্যান্ড পিয়ানো রাখা। পিয়ানোর সাথে একটি টুল। পাশে হাওয়াই গিটার। এসব দেখে বুঝলাম শিহাব মনে হয় গান টান করে। ঘরটা খুব বেশি বড় নয়। আসবাব বলতে একটা কুইন সাইজ বেড়, পড়ার টেবিল আর ওই পিয়ানোটা। ড্রেসিং টেবিলও নেই। বিছানা নকল ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। সাদা আর গোলাপি রঙের ফুল। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি মানুষ কেমন তা এখনো বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে আমাকে বেশ আগ্রহ নিয়েই তারা ঘরের বৌ করে এনেছে। এখন আমি ফুলের বিছানায় বসে আছি। একটু আগেও এই ঘরে আমার ব্রাদার ইন ল’ সহ আরো কিছু মানুষজনের উপস্থিতি ছিল। এই মুহূর্তে কেউ নেই। একলা হতেই এতক্ষণের জমে থাকা বরফ কান্নাটা গলে পানি হয়ে গেলো। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি কান্না থামাতে, কিন্তু পারছি না! আমি কাঁদছি বাবাজানের জন্য, কাঁদছি আম্মুজানের জন্য, কাঁদছি ছোট বোনদের জন্য… কাঁদছি এই ভেবে যে, আজকের পর থেকে আমি আমার বাবার বাড়িতে আর কোনদিন যাব না। কাঁদছি কারণ আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্যের, সতেজ সজীব দিনগুলির ওপর একটি ইতিরেখা টানা হয়ে গেছে। কাঁদছি এই ভেবে, যে মানুষটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে সে মানুষটা কোনদিন আমাকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারবে না, আর সে অন্য একজনকে পছন্দ করে এটা জানার পর আমিও তাকে কখনো মন থেকে গ্রহণ করতে পারব না। নিজের সর্বনাশ আমি দিব্যচোখে স্পষ্টরূপে দেখতে পাচ্ছি! 

.

খুট করে দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। শব্দটা বুকে গিয়ে একটা ধাক্কা দিল। ইশ! একলা একলাই তো ভালো ছিলাম! কী দরকার ছিল ছেলেটার এখানে আসার? অবশ্য তার নিজের ঘরে সে ফিরে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। আমিই তো বাইরের মানুষ। এতকাল বাবার বাড়িতে আশ্রিত ছিলাম, এখন শ্বশুরবাড়িতে আশ্রিত হব। পরজীবী হয়েই জীবনটা কাটাতে হবে মনে হয়। অথচ আমি চাইলেই এই আশ্রিত জীবন থেকে মুক্তি পেতে পারি। এ বাড়িতে নিশ্চয়ই আমি দীর্ঘদিন থাকব না। পড়াশোনা, চাকরি-বাকরির সুবাদে কত জায়গায় যেতে হবে! আজকাল কেউ এক জায়গায় পড়ে থাকে নাকি? তাইতো, আরে তাইতো! অযথাই ভয় পাচ্ছিলাম এতক্ষণ। নিজেকে যতটা দুর্বল ভাবছিলাম, ততটা দুর্বল আসলে আমি নই। শিক্ষা আমাকে অনেক আগেই মুক্তি দিয়েছে। শুধু মুক্তি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এই মুক্তো ডানা মেলে উড়াল দেবার সঠিক সময় নির্ধারণ করার জ্ঞানটুকুও দিয়েছে। এখন শুধুই সেই সঠিক কাঙ্ক্ষিত সময়ের অপেক্ষা। 

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম ওর দিকে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ছাই রঙের স্যুট টাই, সাদা শার্ট। আমার থেকে বেশ অনেক খানিই লম্বা! ঐযে বলেছিলাম না? ইম্পরট্যান্ট সময়ে আনইম্পরট্যান্ট কথা ভাবা আমার একটা বাজে অভ্যাস। এই মুহূর্তে শিহাবের সুন্দর গড়নের লম্বা শরীরটা দেখে মনে হলো, আমি নিজে আরেকটু লম্বা হলে ভালোই হতো। ধ্যাত্তেরিকা… যতসব অবান্তর ভাবনা। আমার উচ্চতা পাঁচ ফিট আড়াই ইঞ্চি। যথেষ্ট লম্বা আছি। এই বিরক্তিকর ছেলেটার মতো তালগাছ হব নাকি? দেখলাম বিরক্তিকর ছেলেটা পরনের কোট খুলে হাতে নিয়েছে। গলার টাই নাড়াচাড়া করতে করতে এগিয়ে আসছে সামনে। আমার বুক কাঁপছে। হাতে পায়ে একটা শিরশিরে ভাব। সে মুহূর্তে ওর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলাম হলদে ল্যাম্পশেডের আলোয়। মনে হলো যেন একটু অস্বস্তি খেলছে ওই মুখে। 

—‘হ্যালো!’ শব্দটা উচ্চারণ করে একটু হাসলো সে। 

—‘হাই!’ অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলাম। 

শিহাব বিছানার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে টাকার একটা বান্ডিল ছুঁড়ে মারল আমার মুখের সামনে, বিছানার ওপর। 

—‘মানে কী?’ 

—‘ডাওরি।’ নির্বিকার গলায় উত্তর দিল। 

রাগে সারা গা রি-রি করে উঠল আমার। নিজেকে ভিখিরি মনে হচ্ছে। 

—‘ইজ দিস সাম কাইন্ড অফ জোক? আমি কি টাকা চেয়েছি তোমার কাছে?’ শিহাব আগের চাইতেও বেশি নির্বিকার গলায় বলল, ‘দিতে বলা হয়েছে তাই দিয়েছি। এত রিঅ্যাকট করার কিছু নেই।’ 

আমি টাকার বান্ডিলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম কার্পেটের ওপর। 

—‘ফেলে দিলে কেনো? বিয়েতে ডাওরী দিতে হয় তুমি জানো না?’ ফুঁসে উঠল শিহাব। 

—‘ওয়াও! তুমি কি ভেবেছ দেনমোহর শোধ করে দিলেই ইউ ক্যান টাচ মি? ভুলেও এমনটা ভেবো না! খবরদার আমার কাছে আসবে না।’ 

শিহাবের মুখটা লাল হয়ে উঠল। লজ্জায় নাকি রাগে কে জানে! কয়েকটা সেকেন্ড আগুন চোখে আমার দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। ভাঁজ পড়ল গালে। বেশ কিন্তু দেখতে ছেলেটা! কাটা কাটা ক্ষুরধার চেহারা। হাসলে আরো বেশি ভালো দেখায়। 

.

আমার দিকে আঙুল তাক করে বলল, ‘লিসেন গার্ল! তোমাকে টাচ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। আমার রুচি এতো খারাপ না। আমি শুভ্রাকে ভালোবাসি। খুব দ্রুতই তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করব। গট ইট?’ 

এমন নয় যে বিষয়টা সম্পর্কে আমি অবগত নই। কিন্তু কেনো যেন এই মুহূর্তে ওর মুখ থেকে ‘আমি শুভ্রাকে ভালোবাসি’ বাক্যটা শুনতে ভালো লাগল না। 

—‘কী দেখছ?’ ত্যাড়া গলায় প্রশ্ন করল শিহাব। 

—‘কেনো তোমার দিকে কি তাকানোও যাবে না? তাকালে তোমার রূপ ধ্বংস হয়ে যাবে?’ 

—‘হ্যাঁ যাবে।’ 

—‘যা একজন রূপবান পুরুষ! আহা একেবারে প্রিন্স চার্মিং।’ 

.

শিহাব কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল আমার দিকে। পকেটে হাত রেখে মাথা নিচু করে বেশ কয়েকবার পায়চারি করল ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা। আমি হিংস্র চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার মাথায় আগুন, চোখে জ্বালা। বুক ভর্তি ঘৃণা! এই মানুষটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে পালিয়ে যাই দূরে কোথাও। বিয়ের রাতে যার স্বামী দৃঢ় গলায় ঘোষণা দেয় যে সে অন্য একজন মেয়েকে ভালোবাসে, সেই মেয়ের তো পালিয়ে যাওয়াই উচিত, তাই না? একটা সময় হাঁটা থামিয়ে শিহাব আমার দিকে দু পা এগিয়ে এলো। চেয়ার টেনে নিয়ে বসল এক হাত দূরত্বে। দেখলাম ওর মুখে এখন রাগ নেই। শুধু গাম্ভীর্যের একটা গাঢ় ছায়া। 

—‘শোনো রুশমি, তোমার নাম তো রুশমি তাই না?’ 

—‘নাহ! আমার নাম রুশানিয়া।’ 

বিদ্রূপটা বুঝতে পেরে ওর ভ্রু দুটো আগের চাইতে আরো বেশি কুঁচকে গেলো। আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, —‘রুশানিয়া লিসেন, আই নো উই আর গোয়িং থ্র আ ভেরি রাফ প্যাঁচ, বাট নেইদার অফ আস ইজ রেস্পন্সিবল ফর দ্যাট। আমাদের প্যারেন্টসরা তাদের নিজেদের ইচ্ছে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের মাথা ঠান্ডা রেখে পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করতে হবে। বুঝতে পারছ? 

এসব ভারী ভারী কথা শুনতে আমার একটুও ভালো লাগছে না। আমার পৃথিবী এই মুহূর্তে এলোমেলো এবং লণ্ডভণ্ড। এখন কোনও যুক্তির কথা আমার মাথায় ঢুকবে না। আমি মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। 

—‘ব্যাপারটা হচ্ছে আমার পাপা মম শুভ্রাকে কিছুতেই মেনে নিতে চাইছে না। বাট তুমি তো জানো যে শুভ্রা আর আমি আমরা দুজনেই দুজনকে চাই। তো… দেখো বাচ্চাদের মতো ঝগড়াঝাঁটি করে তো লাভ নেই। আমি বলি কি, তুমি বরং কিছুদিন পর তোমাদের বাসায় চলে যাও। আর ফিরে আসার দরকার নেই। আমাদের প্যারেন্টসরা জানতে চাইলে বলব যে, আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হচ্ছে না। আমরা সেপারেশন চাই।’ 

—‘সেপারেশনই যদি চাও তাহলে বিয়ে করলে কেনো?’ 

শিহাব অসহায় গলায় বলল, ‘বিয়েটা করা ছাড়া তো কোন উপায় ছিল না। আমার মা না খেয়ে মরে যাচ্ছিল।’ 

—‘তো? এখন বিয়ে ভেঙে গেলে তোর মা না খেয়ে মরবে না?’ পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলাম। 

—‘একী! তুমি তুই তোকারি করছ কেনো? 

—‘তুই তোকারি করছি কারণ তুই আমার কাছে তুচ্ছ। তুই সম্বোধন করা মানে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করা। এটা তুই জানিস না? ইংরেজিতে সেই বিশেষ সুবিধাটি নেই। বাংলায় আছে।’ 

.

শিহাবের তামভ্র গাল রাগে আর অপমানে টকটকে লাল হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি একটা প্রকট হতভম্ব ভাব বিমূঢ় করে তুলেছে ওকে। আমি কেনো তুই তোকারি করছি নিজেও জানি না। আসলে আমার ইচ্ছে হচ্ছে সামনে বসা ছেলেটাকে আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে দেই। ব্যাটা তুই ডিভোর্সই যদি দিবি তাহলে বিয়ে করলি কেনো? তুই আগেই নাকচ করে দিলে তো আমার বাবাজান তোর গলায় জোর করে আমাকে ঝুলিয়ে দিত না। 

—‘তুমি কিন্তু ভীষণ অফেন্সিভ আচরণ করছ।’ 

—‘একশবার করব। ছাড়তেই যদি হয় তাহলে বিয়ে করছিলি কেনো?’

—‘করেছি আমার বাবা-মায়ের জন্য।’ 

—‘সেপারেশনের পর বাবা-মায়ের কী হবে?’ 

—‘কী আবার হবে? বলব যে আমি চেষ্টা করেছি। বাট ওয়ার্ক আউট করেনি।’ 

.

আমার কান দিয়ে উত্তাপ বেরোচ্ছে। পাগল হতে খুব বেশি দেরি নেই বোধহয়। এই ছেলেটা একটা অসভ্য, নির্দয় এবং কাপুরুষ! একে আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি তড়াক করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ফুঁসতে ফুঁসতে বললাম, ‘বেশতো! তাহলে আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি!’ 

শিহাব চট করে আমার একটা হাত ধরে ফেলল, ‘এত রাতে কোথায় যাবে তুমি?’ 

— খবরদার আমাকে ছোঁবে না! জেনে রাখো আমি ওই সব সস্তা মেয়েদের মতো নই, যাদেরকে তুমি সবসময় ছুঁয়ে অভ্যস্ত।’ 

শিহাব আমার হাত তো ছাড়লই না বরং রক্তচক্ষু দিয়ে একবার আমাকে আগাগোড়া দেখে নিল। এরপর আরো শক্ত করে চেপে ধরল হাতটা। চাপা গর্জন করে বলল, —‘তোমাকে তো বলেছি তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কথাটা কি বিশ্বাস হয় না? নিজেকে কী ভাবো তুমি?’ 

এতো জোরে কেউ কোনদিন আমার হাত চেপে ধরেনি। মনে হচ্ছে এখুনি কব্জিটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। এতো নিষ্ঠুর, এতো অসদয়, এবং এতো বাজে মানুষ কেউ কোনদিন দেখেছে পৃথিবীতে? ঘেন্নায় আমার মুখ বেঁকে যাচ্ছে, বুক ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে। 

—‘হাত ছাড়ো! চিৎকার করব কিন্তু এখন! 

শিহাব এবার কব্জি ছেড়ে দিয়ে আমার কাঁধের ওপর দুটি হাত রাখল, জোর করে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘যেখানে যাবার কাল সকালে যাবে;এই মাঝরাতে নয়। একটু পরেই স্নোফল শুরু হবে। ড্রাইভ করতে পারবে না।’ 

এবার আর কিছু বলবার মতো শক্তি খুঁজে পেলাম না। বুকের ভেতর অনেক অভিযোগ, অনেক অভিমান গুমড়ে গুমড়ে উঠছে, কিন্তু সঠিক শব্দের অভাবে সেইসব অনুভূতিরা প্রকাশ হবার ভাষা পাচ্ছে না। গাড়ি ড্রাইভ করব কী? আমার গাড়ি তো আমি আনিইনি এখানে; আনবো ও না। ওটা বাবাজান কিনে দিয়েছিল। তার দেয়া কোনও জিনিস আমি আমার সঙ্গে রাখতে চাই না আর। 

—‘শোনো রুশানিয়া, ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমাকে আর ডিস্টার্ব করো না প্লিজ।’ 

আমি উঠে দাঁড়িয়ে একরোখা গলায় বললাম, ‘তোমার বিছানায় আমি ঘুমোবো না। মেঝেতে শোবো।’ 

—‘ওয়াইজ ডিসিশন।’ কথাটা বলে ও ক্লজেটের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। লাইট জ্বালিয়ে কী সব ছাইপাশ করল কে জানে। মিনিট দুয়েকের মাথায় একটা কমফোর্টার নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখলাম। কমফোর্টারটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে বলল, ‘আর কিছু লাগবে?’ 

.

মেঝে কার্পেট মোড়ানো। তাছাড়া ঘরের ভেতর হিটার চালু করা আছে। কম্বল ছাড়াও রাত কাটানো যাবে দিব্যি। ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে পূর্ব দিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা স্যুটকেসটার দিকে এগিয়ে গেলাম। এই স্যুটকেস আমার বাবার বাড়ি থেকে দেয়া হয়েছে। জানি না কী আছে ভেতরে। ডালা খুলে দেখলাম ভেতরটা কাপড় চোপড়ে ঠাসা। সব গুলোই নতুন। এগুলো আম্মুজান কিনেছে নাকি আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কিনেছে সে বিষয়ে অবগত নই। শাড়ি, টি-শার্ট, জিন্স, টপ সবই আছে। স্যুটকেসের পাশে একটা গয়নার বাক্স রাখা। এই মুহূর্তে যে লম্বা হারটা আমি গলায় পরে আছি সেটা খুলে খুব সম্ভবত এই বাক্সেই রাখতে হবে। শাড়ি পরার অভিজ্ঞতা আমার একেবারে নেই বললেই চলে। শাড়ি পরা এবং খোলা দুটোই বেশ ঝামেলা যুক্ত কাজ। এই মুহূর্তে যে ভারী শাড়িটা আমি পরে আছি, যেটা কিনা জিলিপির মতো দুর্ভেদ্য সব প্যাঁচ দিয়ে আমার গায়ে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে, একাধিক সেফটিপিন সমেত। সেই শাড়িটা খোলার কথা ভাবতেই আমার গায়ে জ্বর চলে আসছে। তাছাড়া এই ছেলেটার উপস্থিতিতে আমি কাপড় পাল্টাবোই বা কী করে? আমার তো এর সামনে হিজাব খুলতেই লজ্জা হচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো গতকাল পর্যন্তও যে মানুষ আমার কাছে নিছক একজন পরপুরুষ বৈ অন্য কিছুই ছিল না, সে মানুষ এই একদিনের ব্যবধানে আমার নিজস্ব পুরুষ হয়ে গেলো। এখন এর সামনে পর্দা না করলেও আমার কোনো পাপ হবে না। কিন্তু নিজস্ব শব্দটা উচ্চারণ করা যতটা সহজ, গ্রহণ করা বা অনুভব করাটা ততটাই কঠিন। কে আপন আর কে পর সেই সত্য নির্ধারণ করার ক্ষমতা শুধুমাত্র মানুষের মনকেই দেয়া হয়েছে, সমাজকে নয়। 

.

স্যুটকেসে ভিক্টোরিয়াস সিক্রেটের একটা গোলাপি রঙের স্লিপিং স্যুট পেলাম। সিল্কের লম্বা হাতা টপ, ট্রাউজার। গোসল সেরে, জামা কাপড় পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি ঘরের বাতি নেভানো। স্নো ফল শুরু হয়ে গেছে। পশ্চিমের দেয়ালজোড়া জানালার বাইরে ফুলঝুরির মতো উড়ছে বরফকণা। শিহাব পিয়ানো বাজাচ্ছে। একটা চেনা গানের সুর। কোন গান তা ঠিক ধরতে পারছি না। বৃষ্টি আমার ভালোলাগে, ভালোলাগে তুষারপাতও। কিন্তু বৃষ্টি আর তুষারপাতের মধ্যে বিশদ তফাৎ আছে। বৃষ্টি নামে দুর্বার গতিতে, চারপাশ কাঁপিয়ে, ঝমঝম শব্দে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে। অন্যদিকে তুষারপাত শান্ত, ধীরস্থির। এর একটা শব্দময় নৈঃশব্দ আছে। প্রাথমিকভাবে শুধু নৈঃশব্দটাকেই টের পাওয়া যায়, কিন্তু কান খাড়া করলে মিহি ঝিরিঝিরি ঐশ্বরিক এক কলতান শোনা যায়। এর প্রভাব মারাত্মক। একবার সদলবলে ভূপৃষ্ঠে নেমে এলে সহজে বিদেয় হতে চায় না। মাটি কামড়ে পড়ে জমে থাকে বেশ কিছুদিন। তবুও স্নো ফল আমার মনের মাঝে অন্যরকম শিহরণ জাগায়। এমন রাতে জানালার ধারে ল্যাম্পশেডের আলতো আলোয় গায়ে কম্বল জড়িয়ে, হাতে গল্পের বই নিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। হঠাৎ আমার এতকালের জমানো আদরের বইগুলোর জন্য মন কেমন করে উঠল। কাল একবার মেজোকে ফোন করে বলতে হবে আমার বইগুলো যেন মনে করে নিয়ে আসে। 

.

বিছানার ওপর বসলাম। ভেজা চুলে ঝাড়ন দিতে লাগলাম তোয়ালে দিয়ে। অস্থির ভাবটা কেটে গেছে। মনের জট ছাড়ছে একটু একটু করে। ভারী শাড়িটা পাল্টে ফেলার পর আরাম লাগছে। এই মুহূর্তে ঘরময় ছড়িয়ে থাকা অন্ধকারটাও আরাম লাগছে। আরাম লাগছে জানালার বাইরের ওই অবিরাম তুষারপাত। বিন্দু বিন্দু শ্বেত রঙের বরফকণিকায় ঢেকে যাচ্ছে রাতের অন্ধকার। জঙ্গলের লম্বা লম্বা গাছগুলোর ন্যাড়া মাথায় সাদা প্রলেপ পড়ছে ধীরে ধীরে। মধ্যরাতের প্রকৃতির এই সাদা কালো রঙের খেলায় পৃথিবীটাকে আশ্চর্য নগর বলে ভ্রম হচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। মনে হচ্ছে যেন রূপকথারা সহস্র বছরের ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে এক্ষুনি। পৃথিবী চলে যাবে রাজকুমার, রাজকন্যা আর দৈত্য-দানবদের দখলে। আমাদের মতো রক্ত মাংসের সাধারণ মানুষদের এখানে কোন স্থান থাকবে না। পিয়ানো বেজে যাচ্ছে। টুলের ওপর বসে থাকা শিহাবের অন্ধকারাচ্ছন্ন নিশ্চল মূর্তিটা আমি দেখতে পাচ্ছি। এখন বুঝতে পেরেছি এটা কোন গান। জন লেলনের ‘ইমাজিন।’ ওই সুর আর বাইরের তুষারকণার ফুলঝুরি যেন একই তারে বাঁধা। দুটোই আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। আমার বুক হু হু করছে। কান্না পাচ্ছে, মনে হচ্ছে এই সামাজিক আবর্ত ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাইরের শীত রাত্রির রূদ্র, ঊষর অথচ শুভ্র সৌন্দর্যে মহিমান্বিত প্রকৃতির সাথে মিশে যাই, হারিয়ে যাই, বিলীন হয়ে যাই! কিন্তু আমি কোথাও যেতে পারছি না। চুপটি করে বসে আছি। আমার চোখের সামনে তুষারাবৃত গাঢ় রাত আর একজন ধ্যানমগ্ন যুবক। কোন এক বিচিত্র কারণে বিয়ের রাতের ওই এক টুকরো দৃশ্যটা মনের দেয়ালে বাঁধাই করা ছবি হয়ে আটকে গিয়েছিল। স্মৃতির পাতা উল্টাতে গেলে ওই ছবিটায় আজও চোখ আটকে যায় কারণে অকারণে। সেই রাতে মনে রাখার মতো কিছুই ঘটেনি তবুও ওই এক টুকরো দৃশ্য সম্পূর্ণ বিনা কারণেই মনে পড়ে যায় হঠাৎ হঠাৎ। মনে পড়লেই… থাক, সেই গল্প পরে হবে। 

শিহাব 

আমাদের বাসর রাতে তুষারপাত হয়েছিল। জানালার কাচ ভরে গিয়েছিল শিমুল তুলোর মতো শত-সহস্র মিহিদানা বরফকুচিতে। আমি পিয়ানো বাজাচ্ছিলাম। এই গানটা মাত্র কদিন আগে একটা কনসার্টে গেয়েছি। আমাদের এদিকে বাংলাদেশিদের বেশ কিছু সংগঠন আছে। সেসব সংগঠন থেকে প্রায়ই কনসার্ট-টনসার্টের আয়োজন করা হয়। গায়ক হিসেবে মোটামুটি সুনাম আছে বলে মাঝে মাঝে আমার ডাক পড়ে। তবে লাস্ট কনসার্টটা ছিল আমার এক জাপানি বন্ধুর ব্যান্ড দলের। ওদের ভোকাল অসুস্থ ছিল বলে আমি একদিনের জন্য প্রক্সি দিয়েছি। এ মুহূর্তে গান গাইতে ইচ্ছে করছে খুব কিন্তু অপরিচিত মেয়েটির সামনে সংকোচ বোধ হচ্ছে। অথচ নিজের মনের স্বস্তির জন্য হলেও এখন গান করাটা আমার খুব দরকার। আমি টের পাচ্ছি মেয়েটা আমার পেছনে এসে বসেছে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটিকে মন প্রাণ দিয়ে ঘেন্না করার পরেও এর উপস্থিতি আমাকে ভাবাচ্ছে। ভালোবাসা এবং ঘেন্না, মানুষের মনে এই দুই বিপরীতমুখী অনুভূতির উৎসরণ হয় সর্বোচ্চ আবেগ থেকে। এই দুই অনুভূতি তাকে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করে থাকে। আমরা দুই ধরণের মানুষকে সব সময় মনে রাখি, যাকে খুব বেশি ভালোবাসি আর যাকে খুব বেশি ঘেন্না করি। এ কারণেই হয়তো জ্ঞানী লোকে বলে ভুলে যাওয়া আর ক্ষমা করার চাইতে বড় শান্তি আর হয় না। ঘেন্নার বিষয়বস্তু ভুলে যাওয়াই সমীচীন। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ এই সমীচীন এবং প্রাজ্ঞ কাজটি করতে ব্যর্থ হয়। যেমন আমি ব্যর্থ হচ্ছি এই মুহূর্তে। পিয়ানো বাজাতে বাজাতে আমি ভাবছি মেয়েটাকে ফ্লোরে থাকতে দেয়া নিশ্চয়ই উচিত কাজ হবে না। নারী জাতির প্রতি সহজাত সম্মান বোধ থেকেই এমনটা মনে হচ্ছে আমার। তাছাড়া মেয়েটা তো আর সারা জীবন এ বাড়িতে থাকবে না। দুদিনের জন্য এসেছে। একরকম অতিথিই বলা চলে… ভাবনায় ছেদ পড়ল সেলফোনের রিংটোনে। শুভ্রা ফোন করছে। ধরতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে বলল, ‘কী করছিস তোরা? এখনো ঘুমাসনি?’ 

হঠাৎ যেন চৈতন্য ফিরল আমার। ঘড়িতে রাত বারোটা। এতক্ষণে ঘুমে কাদা হয়ে যাই অন্যদিন। আজকে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই চোখে। এই ব্যতিক্রম রাতটা নিশ্চয়ই আমার আজীবন মনে থাকবে! 

—‘না ঘুমাইনি।’ 

—‘কী করিস?’ 

উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না। প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কী করছ?’ 

—‘রুশমি কোথায়?’ 

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে দেখলাম একবার। রুশমি বসে আছে বিছানার ওপর। 

—‘আছে।’ 

—‘ফোন দে তো ওকে। কথা বলব। 

আমি লাউডস্পিকার অন করে বসা থেকে উঠলাম। ফোনটা রুশমির সামনে বিছানার ওপর রেখে বললাম, ‘শুভ্রা তোমার সাথে কথা বলবে।’ 

—‘হ্যালো রুশমি!’ 

রুশমি চুপ করে আছে। অন্ধকারে ওর মুখের ভাবভঙ্গি বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে ও খুব অস্বস্তিতে ভুগছে। শুভ্রা আবার বলল, 

—‘রুশমি, তুই শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?’ 

—‘হ্যাঁ, বলো শুভ্রাদি। শুনছি।’ 

—কী করলি তুই এটা?’ 

—‘আমি আবার কী করলাম? তোমার স্টুপিড বয়ফ্রেন্ড আমাকে হুট করে বিয়ে করে ফেলেছে। 

মেয়েটার অসভ্যতা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মুখ হা হয়ে গেলো কিন্তু উচ্চারণ করবার মতো কোনো শব্দ খুঁজে পেলাম না। অদ্ভুত বেয়াদব একটা মেয়ে! শুভ্রা বলল, 

—‘শিহাব কিছুই জানতো না।’ 

—‘আমিও জানতাম না।’ 

—‘আচ্ছা শোন, যা হবার হয়ে গেছে। তোর ওপর আমার বিশ্বাস আছে। তুই তো জানিস শিহাব অ্যান্ড আই, উই হ্যাভ আ থিঙ্গ ফর ইচ আদার, রাইট? আগামীকাল তোদের বাড়ি ফিরে যা। আর আসার দরকার নেই। আঙ্কেল আন্টিকে বলিস শিহাবকে তোর পছন্দ হয়নি।’ 

.

শুভ্রার কথার ধরণ শুনে মনে হচ্ছে আগামীকাল রুশমির বাবার বাড়ি ফিরে যাওয়াটা পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ। মাঝে মাঝে শুভ্রাকে আমার খুব বোকা মনে হয়। যেমন এই মুহূর্তে ওকে একটা আস্ত গর্দভ বলে মনে হচ্ছে। রুশমি চুপ করে আছে। শুভ্রা অস্থিরভাবে বলল, ‘কথা বলছিস না কেনো?’ 

রুশমি একটু কেশে নিয়ে বলল, ‘শোনো শুভ্ৰাদি কাল যাব নাকি পরশু যাব তা ঠিক বলতে পারছি না। তবে যাব দিস ইজ ফর শিওর। এ নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।’ 

—‘যাবি তো বটেই কিন্তু যত তাড়াতাড়ি যাবি ততই সবার মঙ্গল। তাই না? আচ্ছা তুই শিহাবকে ফোনটা দে। 

আমি ফোন হাতে নিয়ে লাউডস্পিকার অফ করলাম। 

—‘শিহাব শোন, ঘরের বাইরে যা তো একটু। কথা আছে তোর সাথে।’

—‘বাইরে যেতে হবে কেনো?’ 

—‘কেনো নতুন বৌকে ফেলে বাইরে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে তোর? বৌকে কোলে নিয়ে বসে থাকবি?’ 

আমি একটু ঘাবড়ে যাওয়া গলায় বললাম, ‘বাজে বকছ কেনো?’ 

—‘তাহলে বাইরে যেতে প্রব্লেম কী?’ 

আমি বাইরে বেরোবার আগে রুশমিকে বললাম, ‘তুমি বিছানায় শুয়ে পড়। আমি মেঝেতে ঘুমোবো।’ 

রুশমি কোন উত্তর দিল না। অন্ধকারে মূর্তির মতো বসে রইল। ঘর থেকে বেরিয়ে হলওয়ে পার হলাম। এই করিডোরের এক প্রান্তে জাহিদের রুম, অন্য প্রান্তে পাপা আর মমের। আমারটা মাঝখানে পড়ে গেছে। আজকে বাড়িতে মেলা অতিথি। ড্রইং রুম, লিভিংরুম, বেজমেন্ট কোথাও খালি জায়গা নেই। বাইরে আবহাওয়া বৈরী। ফোন নিয়ে যাব কোথায়? তাছাড়া নিচে এখনো কেউ কেউ জেগে আছে। গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। বিয়ের রাতে বৌকে একলা ফেলে আড়ালে গিয়ে ফোনে কথা বলাটাকে ওরা কীভাবে নেবে? শুভ্রাকে এসব বোঝাবে কে? করিডোরে দাঁড়িয়েই কথা বলতে হলো, নিচু স্বরে। কথা হলো প্রায় মিনিট পাঁচেক সময়। সত্যি বলতে কি শুভ্রার সাথে আমার আরো বেশি সময় কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। সারাদিন ব্যাপী যে ঝড়টা আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সেই দুর্যোগপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা একমাত্র শুভ্রাকেই বলা যায় এখন। কিন্তু পাছে কেউ টের পেয়ে যায়, সেই ভয়ে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। ফিরে এসে দেখি রুশমি শুয়ে পড়েছে। আমি শাওয়ার নিয়ে কাপড় পাল্টে নিলাম। তারপর মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। বাইরে তখনও তুষার ঝরছে। ঘুম আসছে না। বুঝতে পারছিলাম রুশমিও ঘুমোয়নি। শুয়ে শুয়ে জানালার বাইরের স্নো ফল দেখতে লাগলাম। ঘুম যখন ভাঙলো তখন চারপাশ ঝকঝকে আলোয় ছেয়ে গেছে। একেবারে ব্রাইট উইন্ট্রি মর্নিং যাকে বলে। চারপাশে চোখ ধাঁধানো সূর্যের আলো। জানালার বাইরে চেয়ে দেখি সাদা বরফে ঢেকে গেছে পৃথিবী! উইলো ফরেস্টের সারি সারি গাছ সাদা তুলোর টোপর পরেছে। শুভ্র বরফের গায়ে চিকচিক করছে রূপালি রোদ্দুর। শীতের রৌদ্র ঝলমলে সকাল আমার খুব পছন্দ! এতো আলো বছরের অন্য কোন সময় পাওয়া যায় না। এই সৌন্দর্য প্রতি বছর কম করে হলেও দু-তিনবার দেখার সৌভাগ্য হয়। কিন্তু সেদিন সেই তুষারাবৃত রূপালি সকালে আচমকা এমন একটা দৃশ্যের ওপর চোখ আটকে গেলো, যে দৃশ্য আমি এর আগে কোনদিন দেখিনি! আমি দেখলাম আমার নিত্য দিনের অতি সাধারণ আটপৌরে বিছানায় একটি পরীর মতো মেয়ে শুয়ে আছে। কোমর পর্যন্ত কম্বল টানা। খোলা চুল ছড়িয়ে আছে বালিশের ওপর। গায়ে একটা হালকা গোলাপি রঙের স্লিপিং স্যুট। মুখের ওপর শীত সকালের রূপালি রোদের প্রলেপ। বন্ধ চোখের ঘন কালো লম্বা পাঁপড়ি হালকা হালকা কাঁপছে। তীক্ষ্ণ নাসিকায় ঝিকোচ্ছে একটা নাকফুল। ঠোঁটের নিচে, ডান দিকে একটা গাঢ় কালো রঙের তিল। সেই প্রথম বারের মতো টের পেয়েছিলাম যে আমার বৌ-টা আসলে সাংঘাতিক রূপবতী! এ কারণেই কি ওর এমন আকাশচুম্বী অহংকার? বাংলায় একটা কথা আছে, অতি বড় সুন্দরী না পায় বর, অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস পড়ল আমার, অতিরিক্ত সুন্দরীদের কখনো বিয়ে করতে নেই! আমার ভাগ্যটা নিতান্তই খারাপ। 

.

কম্পমান পাঁপড়ি দুটো হঠাৎ প্রসারিত হয়ে উঠল। থমকে গেলাম আমি। এভাবে ধরা পড়ে যাবার কোন ইচ্ছে ছিল না। চোখ সরিয়ে নিলাম। আবার তাকালাম। দেখলাম জন্ম কাজল পরা দুটো চোখ ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমার দিকে। হাসার চেষ্টা করলাম একটু, ‘গুড মর্নিং! রুশানিয়া!’ 

রুশমি 

দরজায় ধাক্কা পড়ছে। আমি শোয়া থেকে উঠে বসেছি। শার্টের একটা বোতাম খুলে গিয়েছিল। অপ্রস্তুতভাবে সেই বোতাম আটকাচ্ছি। চোখ মেলেই আবিষ্কার করেছি শিহাব আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। কতক্ষণ ধরে দেখছে আমাকে আল্লাহ জানে! কী বিশ্রী ব্যাপার! আমি অঘোরে ঘুমাচ্ছি, আর কেউ একজন আমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে আছে, বিষয়টা ভাবতেই কেমন গা ঘিনঘিন করছে। শিহাব আমাকে ‘গুড মর্নিং’ দিয়েছে। বলেছে, গুড মর্নিং রুশানিয়া। ও আমাকে গতরাতেও বেশ কয়েকবার এই নামে সম্বোধন করেছে। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না। ডাক নাম দেবার মতো কোন সহজ সম্পর্ক ওর সাথে আমার এখনো হয়ে ওঠেনি। 

.

দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা পড়ছে। শিহাব উঠে গিয়ে দরজা খুলল। ওপাশ থেকে একটা নারী কণ্ঠ বলল, তোমরা উঠেছ? ব্রেকফাস্ট করতে এসো। সবাই 

অপেক্ষা করছে।’ 

—‘আসছি।’ 

দরজা বন্ধ করে শিহাব শুষ্ক একটা হাসি হেসে বলল, 

—‘মম ডাকছে।’ 

—‘কেনো?’ 

—‘শুনলে না? ব্রেকফাস্ট রেডি।’ 

—‘তো আমি কী করব?’ 

—‘ব্রেকফাস্ট করবে না? 

—‘আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। নিজের কাজ কর।’ 

—‘তুমি অল দ্যা টাইম আমার সাথে এমন মিসবিহেভ করো কেনো? আগুন চোখে তাকালাম, – ‘মিসবিহেভ করি কারণ তোমাকে আমার অসহ্য লাগে!’ 

ওয়াও! কথাটা বলতে পারার পর দারুণ একটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনের কথা চেপে না রেখে উগরে দিতে হয়। এতে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটে। এখন আমার মনে ভিটামিন লেগেছে। ছেলেটার মুখের ওপর কথাগুলো ছুঁড়ে দেয়া মাত্র এতক্ষণের গুমোট ভাবটা ফুড়ুৎ করে উড়ে গেছে। আমি জানালার বাইরে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি একটা বড়সড় ঝগড়ার জন্য। শিহাব নিশ্চয়ই এখন জ্বালা ধরানো কোন কথা বলবে। বলুক, আমিও ছেড়ে দেব না কিছুতেই। ও একটা শোনালে আমি দশটা শুনিয়ে দেব। 

দরজা বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। তাকিয়ে দেখি শিহাব কিছু না বলেই চলে গেছে। অপমানের হলকা এসে গায়ে লাগলো। এই ফাজলামোর মানে কী? পরমুহূর্তেই দরজা খুলল কেউ একজন। মাঝারি আকৃতির এক মহিলা ঘরে ঢুকল। বব কাট চুল। পরনে একটা ক্রিম কালারের সালওয়ার কামিজ। গায়ের রং চাপা হলেও মুখখানা সুশ্রী। এই মহিলা আমার শাশুড়ি। গতকাল একে আমি দেখেছি শুধু। কথা হয়নি। আমি কখনোই খুব একটা আনস্মার্ট নই। তবে বয়স এখনো কম বলে মুরুব্বিদের দেখলে ভেতরটা কোন কারণ ছাড়াই আড়ষ্ট হয়ে ওঠে। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। শাশুড়ি সুন্দর হেসে বলল, ‘বসো বসো। কেমন আছো তুমি?’ 

—‘আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?’ 

সে চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। এই ঘরে একটাই চেয়ার। পড়ার টেবিল সংলগ্ন।

—‘আমি খুব ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ।’ 

এরপর ঠিক কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। অস্বস্তিতে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। বিছানার ওপর এখনো ফুলের ছড়াছড়ি। চাদর কুঁচকানো। হঠাৎ চোখ পড়ল মেঝের ওপর টাকার বান্ডিলটা পড়ে আছে, অবহেলায়। শাশুড়ির চোখে না পড়লেই হয়! শিহাবের কম্বলটা দুমড়ে মুচড়ে ছড়িয়ে আছে খাটের পায়ের কাছে। এই ছেলেটা মনে হয় খুব অগোছালো। ভারতীয় উপমহাদেশের ছেলেগুলো এমনই হয়। অনেক বয়স পর্যন্ত এদের মায়েরা মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। একবার আমার এক আমেরিকান বন্ধু এই নিয়ে খুব ঠাট্টা করেছিল। হাসতে হাসতে বলেছিল, ইন্ডিয়ান ছেলেরা কাপড় কাঁচতে জানে না, রান্না করতে জানে না, ঘরদোর সাফ করতে জানে না। সবকিছু ওদের মায়েরা করে দেয়। আমার প্রশ্ন হলো গার্লফ্রেন্ডের সাথে বিছানায় গিয়েও কি ওরা মায়ের সাহায্য নেয়? ভীষণ অসভ্য একটা কৌতুক। অসভ্য হলেও আমরা সবাই হেসেছিলাম। শুধু নিখিলেশ, যে কিনা মাত্র কদিন আগে কলকাতা ছেড়ে এসেছে, সে কৌতুকটা শুনে মুখ ভার করে ফেলেছিল। যেন কৌতুকটা তাকে নিয়েই করা হয়েছে। 

.

মাথা নিচু করে আছি। বুঝতে পারছি আমার শাশুড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আমাকে। আমি বিব্রত বোধ করছি। দুশ্চিন্তায় আমার দাঁত দিয়ে হাতের নখ খুঁটতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে সেটা করা সম্ভব হচ্ছে না। 

—‘তুমি শাড়ি পরতে পারো আম্মু?’ গলার স্বর ভীষণ মিষ্টি 

আমি চোখ তুলে তাকালাম। তার মতো মিষ্টি করেই বলার চেষ্টা করলাম, ‘জি না।’ 

—‘আচ্ছা কোন সমস্যা নেই। তোমার চাচী শাশুড়ি একটা কাতান শাড়ি গিফট করেছেন তোমাকে। শাড়িটা পরলে তিনি খুশি হবেন। তুমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি শাড়ি পরিয়ে দেব।’ 

বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘জি আচ্ছা।’ 

শাড়ি পরানোর সময় এক কান্ড হলো। আমি পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছি। শাশুড়ি শাড়ির কুচি ঠিক করছে। ব্লাউজটা ঠিকঠাক লাগেনি আমার গায়ে। ঢলঢল করছে শার্টের মতো। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে গেছে আমার। হঠাৎ দড়াম শব্দে দরজা খুলে শিহাব ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল একদম! মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা শাড়িটার একপাশ চট করে হাতে তুলে নিয়ে শরীরটা আড়াল করলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় পাথর হয়ে গেছি আমি। শিহাবও থমকে গেছে। দরজার হাতল ধরে ব্যাক্কলের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সেকেন্ড না গড়াতেই ওর শ্যামবর্ণ মুখে রক্ত এসে ঝলক দিল। চোখ সরিয়ে নিল চকিতে। তারপর লজ্জায় লাল হওয়া গাল নিয়ে শক্ত স্বরে বলল, ‘স্যরি!’ 

দরজা আটকে দিয়ে প্রস্থান করল সে। শাশুড়ির সামনে বেকায়দায় পড়ে গেছি। তার চোখে চোখে তাকাতে পারছি না। মনে হচ্ছে সে মুচকি মুচকি হাসছে। তার হাসি আমাকে আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। শাড়ি পরানো হয়ে গেলে সে আমাকে আগাগোড়া একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘বাহ্ চমৎকার লাগছে তোমাকে!’ 

.

শাড়ির রং টা আমার পছন্দ হয়েছে। পেঁয়াজ রং। এই রংটার দিকে তাকালেই শান্তি শান্তি একটা ভাব হয়। কিন্তু মনে হচ্ছে শার্টের মতো ঢলঢলে ব্লাউজটা শাড়ির সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে। তাছাড়া এই রংয়ের কোন হিজাব আমার নেই। পেঁয়াজ রংয়ের শাড়ির সাথে কালো হিজাব কেমন বেমানান ঠেকবে না? সাদা মানালেও মানাতে পারে। এসব হাবিজাবি গুরুত্বহীন কথা আমি কেনো ভাবছি জানি না। শুভ্রাদি বলে দিয়েছে আমি যেন আজ কালের মধ্যেই এ বাড়ি থেকে বিদেয় হই। আমি নিজেও জানি আমার পক্ষে এখানে বেশিদিন থাকা কিছুতেই সম্ভব না। প্ল্যান করে ফেলেছি। আজ রাতেই কাউকে কিছু না জানিয়ে স্টেসির সাথে ওর ভ্যান গাড়িতে মুভ করব। স্টেসি আমাকে সন্ধ্যের পর পিকআপ করে নেবে। হঠাৎ টের পেলাম শাশুড়ি আমার একটা হাত চেপে ধরেছে। মুখ তুলে চাইলাম পাশে দাঁড়ানো ছোটখাটো মহিলাটির দিকে। তার চোখ দুটি এখন ঈষৎ জলসিক্ত। মুখভর্তি মায়া। 

—‘আম্মু শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি।’ 

—’জি বলুন।’ 

সে আমার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে ব্যাকুল গলায় বলল, ‘আমার ছেলেটাকে তুমি ওই বাজে মেয়ে শুভ্রার হাত থেকে বাঁচাও।’ 

শুভ্রাদিকে তখনও আমি শত্রুপক্ষ ভাবতে পারিনি। তাই ওকে বাজে বলাটা আমার পছন্দ হলো না। বাঙ্গালি মায়েরা কখনো নিজের ছেলের দোষ খুঁজে পান না। অন্যের মেয়ের ঘাড়ে দোষ চাপাতে সব সময় ওস্তাদ ইনারা। এটা আমার কথা নয়। আম্মুজানের কথা। ফুপির সাথে তাঁর ছেলের বৌয়ের কলহ সংক্রান্ত একটি বিষয়ে একবার ঠিক এরকমই মন্তব্য করেছিল আম্মুজান। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে শাশুড়ি বলল, 

—‘আমাদের তো মেয়ে নেই। আজকে থেকে তুমিই আমাদের মেয়ে। আমার অনেক দিনের শখ ছিল তোমার মতো ভদ্র, সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়েকে ছেলের বৌ করে নিয়ে আসব। আমার ছেলেটা আম্মু বাইরে থেকে যতই শক্ত পোক্ত হোক না কেনো ভেতরের দিক দিয়ে একদম নরম। শুভ্রা মেয়েটা যে ওকে ইউজ করতে চাইছে সেটা ও বুঝতে পারছে না।’ 

.

আমি চোখ নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছি। কোন কথা বলছি না। মহিলাকে আমার কিঞ্চিৎ স্বার্থপর মনে হচ্ছে। আমি কেনো উনার ছেলেকে শুভ্রার কাছ থেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নেব? এ বিষয়ে তো আগে থেকে আমার কোন মতামত নেয়া হয়নি। আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার একে কে দিয়েছে? 

—‘আম্মু! তুমি আমাকে কথা দাও। তুমি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনবে। প্লিজ কথা দাও!’ 

এবারেও কিছু বলতে পারলাম না। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। মুখে উৎকণ্ঠা। আজকে আমার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথা। এই খবরটা মহিলাকে কী করে দেই? কিন্তু যে করেই হোক খবরটা আমাকে দিতেই হবে। তাকে বুঝতে হবে তার ছেলের ভালোমন্দ সংক্রান্ত দায়িত্ব নেবার জন্য আমি প্রস্তুত নই। আমার আলাদা একটা জীবন আছে। আমার সেই আলাদা, নিজস্ব জীবনে তার কিংবা তার পুত্রের কোন ভূমিকা নেই। আমার সহ্যের বাঁধ ভাঙছে। চিৎকার করে বলতে মন চাইছে, ‘এটা আমার জীবন! দয়া করে আমাকে আমার মতো বাঁচতে দাও তোমরা!’ মনের চিৎকার মুখের দুয়ার আলতো করে উন্মোচন করে দিল। আমি জোর গলায় বলতে যাচ্ছিলাম… ‘আপনার প্রস্তাবে আমার সম্মতি নেই।’ তার আগেই কথাটা কানে এলো, ‘শিহাবের দাদাজান খুব অসুস্থ। তিনি চাইছেন আমরা যেন কয়েকটা মাস দেশে গিয়ে তাঁর সাথে থেকে আসি। টিকেট করা হয়ে গেছে। আগামী মাসের তিন তারিখে ফ্লাইট। শুভ্রা মেয়েটা যা শুরু করেছে এরকম অবস্থায় ছেলেকে একলা ফেলে আমি যাই কী করে বলো? তাই তাড়াহুড়া করেই বিয়েটা দিয়ে দিলাম। তুমি কি আমার ওপরে রাগ করে আছ মা-মণি? আমি কি খুব বড় অন্যায় করেছি? আমাকে কি স্বার্থপর মনে হচ্ছে তোমার? যেদিন মা হবে সেদিন বুঝবে যে ছেলে-মেয়ের মঙ্গলের জন্য বাবা-মাকে মাঝে মাঝে একটু স্বার্থপর হতে হয়।’

.

সমস্যা হচ্ছে আমার মনটা অত্যধিক নরম। মানুষের কষ্ট আমাকে চিরকাল কষ্ট দেয়। অন্যের কষ্টের চাইতে নিজের কষ্ট আমার কাছে অনেক বেশি সহনীয় এবং স্বস্তিপূর্ণ। শিহাব নামের ছেলেটাকে আমি এতোটাই ঘেন্না করছি যে, এই মুহূর্তে তার মায়ের প্রতি চিমটি পরিমাণ সহানুভূতি প্রদর্শনও আমার জন্য সম্পূর্ণ বেমানান। কিন্তু আমার অতি কমজোর মানবিক হৃদয় এই বেমানান কাজটিই করে বসল। মহিলার জন্য আমার সহানুভূতি একেবারে উথলে উঠল। আমি ভুলে গেলাম আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবাজান এই মহিলার একগুঁয়ে বেয়াদব ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দেয়ার মতো। আমি ভুলে গেলাম এই মহিলা হাজার চাইলেও এর ছেলের সাথে জীবন কাটানো আমার পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না কারণ এর ছেলে অন্য একজনকে মনে প্রাণে কামনা করে। সেই মেয়ে তাকে জাদু করে রেখেছে। জাদুর বশ এক জীবনে কখনো কাটবে বলে মনে হয় না। 

এতো কিছু জেনে বুঝেও মহিলার প্রতি আমার মায়া হলো। কাছে এগিয়ে তার একটা হাত ধরে বললাম, ‘এতো ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি। দেখা যাক কী হয়। আল্লাহ যা করবেন ভালোই করবেন। বিশ্বাস রাখুন। 

শাশুড়ি আমার দিকে পলক তুলে তাকাল। তার চোখে কয়েক বিন্দু জল চিকচিক করছে। জলের সাথে সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে গুচ্ছের মায়া। হঠাৎ মনে হলো, ঠিক এরকম মায়া আমি অন্য একজোড়া চোখে দেখেছি সম্প্ৰতি। সেই চোখের মণির রং খয়েরি! 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *