রুশমি
ভার্জিনিয়ায় এ বছর শীতের প্রকোপ একেবারে নেই বললেই চলে। নিউইয়র্ক শুনলাম তুষার ঝড়ে একেবারে মুষড়ে পড়েছে। আমার ফুপি তুষার ঝড়ের তাণ্ডব সইতে না পেরে নিউইয়র্ক ছেড়ে পালিয়ে এসেছে আমাদের এখানে। গাড়ি নিয়ে আসেনি, এসেছে গ্রেহাউন্ড বাসে। শুভ্রাদির বাসা থেকে বেরোবার মুখেই বাবাজানের ফোন পেলাম। ফুপি নাকি কিছুক্ষণের মধ্যেই ভার্জিনিয়া পৌঁছে যাচ্ছে। আমাকে বাস স্টেশন থেকে ফুপিকে পিকআপ করতে হবে একেবারে সুনির্দিষ্ট সময়ে। ফুপি আমার বাবাজানের চেয়ে বয়সে তের বছরের বড়। তার বয়স আটষট্টি। বয়সের তুলনায় তাকে আরো বেশি বৃদ্ধা দেখায়। স্বভাবটা বড়ই খিটখিটে। অতিরিক্ত রক্ষণশীল মনোভাব সম্পন্ন। ফুপা দুবছর আগে মারা গেছে। ফুপা ফুপির দুই ছেলে। বড় ছেলে লন্ডনে থাকে। ছোটোজন বৌ বাচ্চাসহ তার সাথেই আছে তবে আম্মুজানের কাছ থেকে খবর পেলাম যে ছেলের বৌয়ের সাথে ফুপির বনিবনা হচ্ছে না। ছেলে শীঘ্রই অন্যত্র বাসা ঠিক করে কেটে পড়বে বৌ নিয়ে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই ফুপিকে একজন কঠোর, ঠোঁটকাটা এবং কিঞ্চিৎ নিষ্ঠুর মহিলা হিসেবে জেনে থাকলেও আমার বাবাজানের মতে তার বড় বোনের মতো মহিয়সী নারী আর হয় না। সে অন্ধের মতো বড় বোনকে শ্রদ্ধা করে এবং বোনের প্রতিটি কথা বেদবাক্য হিসেবে অবোধ নয়নে মেনে চলে। বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের বাড়িতে ফুপির কথা মতো জন্মদিন পালন করা হয় না। তার মতে জন্মদিন পালন করা বিদআত। বাবাজানকে এই কথা জানাতেই বাবাজান বোনের আদেশ বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিল। ছোটোর বয়স তখন আট। বেচারি সবেমাত্র জন্মদিন পালনের আনন্দটা একটু একটু করে উপভোগ করতে শুরু করেছে। আমরা ওই বয়সে কত আড়ম্বরপূর্ণ জন্মদিন উদযাপন করেছি। কিন্তু ছোটোর ভাগ্যে এসব কিছুই ধরল না। ফুপির মতের বিরুদ্ধাচার বাবাজান কিছুতেই করবে না। বেচারি ছোটো, স্কুলের বন্ধুদেরকে দাওয়াত দিয়ে ফেলেছে। বাসকিন রবিন্স থেকে ‘ফ্রোজেন’ থিমের ফুলশিট সাইজের আইসক্রিম কেক অর্ডার দেয়া হয়েছে। মেসিস থেকে ওর জন্য প্রিন্সেস ড্রেসও কিনে ফেলা হয়েছে জন্মদিন উপলক্ষে। আমি আর মেজো নিমন্ত্রিত বাচ্চাদের জন্য প্রায় গোটা পঞ্চাশেক গুডি ব্যাগস বানিয়ে ফেলেছি। সবকিছু প্ল্যান মাফিক এগোচ্ছে এমন সময় ফুপি ফোন করে বলল, সে নাকি কোন ইসলামিক সভা থেকে শুনে এসেছে বার্থডে পালন করা হারাম। কোনো মতেই এই গুনাহর কাজ আর দ্বিতীয়বার করা যাবে না। এতদিন করা হয়েছে বিধায় আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। ব্যাস! ফুপির আদেশ অমান্য করার সাহস আছে কার? বাবাজান ঘোষণা দিল, জন্মদিন হবে না!
সন্ধ্যেয় ফুপিকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরতে হলো আমার। কিন্তু দুঃখের কথা আর কী বলব ভাই? ফুপিরও আগমন হলো ভার্জিনিয়ায় আর সেই সাথে আমার ভাগ্যাকাশে দোর্দন্ডপ্রতাপে উদিত হলো শনি মহাশয়! ঘটনাগুলো যখন ঘটছিল একের পর এক তখনও আমি জানতাম না যে, আমার অজান্তে এবং অলক্ষ্যে এক অলৌকিক অদৃশ্য কলম জীবন নামের সফেদ খাতায় অদৃশ্য কালি দিয়ে এক আশ্চর্য উপন্যাস লিখে চলেছে অনবরত! জীবনের ওই অংশটুকু আমার নিজের কাছেই এত বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল যে নিজেকে আধুনিক বিশ্বের একজন সচেতন শিক্ষিত বাসিন্দা ভাবতে রীতিমতোন লজ্জা হচ্ছিল।
বাড়ি ফিরে দেখি বাবা, আম্মু এর মাঝেই রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে এসেছে। আম্মুজান ফুপির জন্য রান্না করছে। আমাদের রেস্টুরেন্টের কুজিন ইন্ডিয়ান। আমরা ওই খাবার খেতে খেতে এখন ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে গেছি। তাই আম্মুজান ইদানিং রোজ কাজ থেকে ফিরে এসে রান্না করে। আগে, আমাদের যখন শুধু কফিশপের বিজনেস ছিল তখন আম্মুজান ঘরেই থাকতো। সেই সময় গুলোতে আমাদের বাড়ি আয়নার মতো ঝকঝক তকতক করত সারাক্ষণ। বাংলাদেশ থেকে সদ্য আসা অতিথিদের ভিড় লেগে থাকতো হর হামেশা। আম্মুজান অতিথিদের যত্ন করে তৃপ্তি পেত। সাংসারিক কাজে তার উদ্যমের শেষ নেই। সেসব অতিথিদের বেশিরভাগই ছিল বাবাজানের ছাত্র। হয়তো স্কলারশিপ নিয়ে মাত্র দেশ ছেড়ে এসেছে বিদেশ বিভূঁইয়ে। চেনা জানা কেউ নেই তিন কূলে। ব্যাস বাবাজান সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। অতিথিরা আমাদের বাড়িতে থেকে আরাম পেত। সুসজ্জিত বাড়ি, দেশীয় সুখাদ্য, সকাল বেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা চা আর দেশীয় নাশতা। আতিথেয়তার প্রতিটি পদক্ষেপে আম্মুজান প্রগাঢ় যত্নের ছাপ ফেলে দিত। এই কেজো আর যান্ত্রিক দেশে আজকাল এমনটা কোনো গৃহিনীই ইচ্ছা থাকলেও করে উঠতে পারে না। আমি এবং আমার মেজো বোন ঝুমি একটু বড় হয়ে ওঠার পর ফুপি আদেশ দিল, মেয়েরা ঢ্যাং ঢ্যাং করে লম্বা হয়ে উঠছে, এখন আর বাইরের ছেলেপুলেকে বাড়িতে রাখা যাবে না। ব্যাস সেই থেকে আমাদের বাড়িতে অতিথিদের আনাগোনা কমে গেলো। এখন খুব কাছের আত্মীয়রা ছাড়া কেউ খুব একটা বেড়াতে আসে না আমাদের বাড়িতে।
আমরা তিনবোন ছয়টার মাঝে ডিনার সেরে ফেলি। আমরা তো এখন আর ঠিক বাঙালি নই। আমেরিকান সংস্কৃতি আমাদের ছিদ্রিত বাঙালি খোলসের সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ফাঁক অতিক্রম করে মিশে গেছে রক্তে। যতটুকু বাঙালিয়ানা অবশিষ্ট আছে ততটুকুও বুঝি খুব বেশি হলে আমাদের প্রজন্ম পর্যন্তই টিকে থাকবে। এরপরের প্রজন্মে আর বাঙালি সংস্কৃতির ছিটেফোঁটাও থাকবে না। আজকেও আমরা তিনবোন আগে আগে খেয়ে নিয়েছি। ফুপি, বাবাজান আর আম্মুজান একটু পরে খেতে বসবে। টেবিল সাজানো হচ্ছে। শুভ্রাদি কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছিল। ওর কন্ঠস্বর দুপুরবেলার চাইতে পরিষ্কার। নেশা কেটে গেছে মনে হয়। আবারও বোঝাতে চাইলাম, যে শিহাবকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা একটা চরম ভুল সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। তার উচিত সময় নিয়ে ভেবে দেখা। খুব একটা গা করল না আমার কথায়। গাঁইগুঁই করে ফোন রেখে দিল। যাক গে! যা খুশি করুক। আমার কী?
শিহাব
ডিনার সাধারণত সাতটার মধ্যে সেরে ফেলি। ঘুমোতে যাবার চার ঘণ্টা আগে খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ করা নিয়ম। আজ সময়মতো ডিনার করা হয়নি। ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘর ছাড়িয়ে গেছে। মম ডিনারের জন্য ডাকাডাকি করছে। বাংলাদেশি বাবা-মায়েদের সমস্যা একটাই, এদের ডিকশনারিতে ‘প্রাইভেসি’ বলে কোনো শব্দ নেই। গত এক ঘন্টা যাবৎ আমি ঘরের দরজা আটকে বসে আছি। এই এক ঘন্টায় মম চারবার এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেছে। আমি উত্তর দেইনি। মমের ধৈর্য সীমাহীন। আমি জানি সে মিনিট দশেকের মধ্যেই পঞ্চমবারের মতো আমার দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হবে।
আমি পিয়ানোর সামনে বসে আছি। পিয়ানো বাজাতে আমার খুব ভালো লাগে। শখের জিনিসের মধ্যে এই ব্ল্যাক গ্র্যান্ড পিয়ানো আর ব্ল্যাক পোরশে আমার নিজের টাকায় কেনা। গাড়ি অবশ্য কিনিনি, দু বছরের জন্য লিজ নিয়েছি। পিয়ানো জানালার সামনে রাখা। আমার ঘরের জানালাটা বিশাল বড়। বলতে গেলে পশ্চিম দিকের প্রায় পুরোটা দেয়াল জুড়ে তার বিস্তার। গ্রিল নেই। ব্লাইন্ড সরিয়ে দিলে দেয়ালজোড়া কাচের ভেতর দিয়ে উইলো ফরেস্টের অনেকখানি দেখা যায়।
আমাদের বাড়িটি পুরোনো ধাঁচের। পুরোনো বলেই পাপা বেশ কম দামে কিনতে পেরেছিল বছরখানেক আগে। বাড়ির আসবাবগুলোও পুরোনো। একটা রাস্টিক ভাব আছে বাড়ির সাজসজ্জায়। এই রাস্টিক ভাবটা আমার ভালো লাগে। মম পুনরায় দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। এবার কানে এসে লাগল অন্য রকম কথা। পিয়ানোর টুংটাং শব্দের মধ্যে আমি মমকে বলতে শুনলাম, ‘শিহাব! দরজা খোল। শুভ্রা এসেছে। তোর সাথে নাকি কথা বলতে চায়। বাইরে বসে আছে। আমি ভেতরে ঢুকতে দেইনি।’
পিয়ানোর রিডের ওপর চলতে থাকা আঙুল থমকে গেলো। উঠে পড়লাম বসা থেকে। ট্রাউজার আর টিশার্টের ওপর জ্যাকেট পরে নিলাম। দরজা খুলে বেরোতেই মম আমার পথ আটকে দাঁড়ালো, ‘ওই মেয়ের সাহস কত বড়! আমার বাড়িতে সরাসরি চলে এসেছে। লজ্জা শরম বলতে কিছু নাই! বেশরম একটা।’
আমি উত্তর না দিয়ে নিচে নেমে এলাম। শুভ্রা প্যাটিওর চেয়ারে বসে আছে। শীতের পরিষ্কার আকাশে আজ এক ঝাঁক নক্ষত্র। একটা দুর্বল চাঁদ হাজার খানেক নক্ষত্রের মাঝে রাজার মতো আসন গেঁড়ে বসেছে। বাতাস তীক্ষ্ণ এবং শীতল। আমাদের প্যাটিওর কয়েক গজ দূরেই নেইবারহুডের সরু রাস্তা। রাস্তার ওপারে মিস্টার জনস এর দোতলা বাড়িটা ক্রিসমাস উপলক্ষে জাঁকজমক সাজ সেজেছে। পুরো বাড়ি লাইটিং করা। পোর্চের ওপর সাজানো রেইনডিয়ারের মাথার ওপর জ্বলছে লাল আর সবুজ বাতি। পেট মোটা স্যান্টাক্লজের মাথার টুপি ঝিকমিক করে আলো ছড়াচ্ছে। সেই ঝিকিমিকি আলোর কিছুটা রেশ আমাদের বাড়ি অবধি এসে পড়েছে। দেখতে পেলাম শুভ্রার গায়ে ডার্ক কালারের একটা মোটা জ্যাকেট। মাথায় হুডি। মমের ওপর খুব রাগ হলো। এই শীতের রাতে বেচারি মেয়েটাকে বাইরে বসিয়ে রেখেছে। এই নিষ্ঠুরতার কোনো মানে হয়?
শুভ্রার কানে ফোন ধরা ছিল। আমাকে দেখে হাত নেড়ে ইশারায় বসতে বলল। আমি বসলাম ওর মুখোমুখি চেয়ারে। ওপাশে কেউ একজন ফোন রিসিভ করেছে। চারপাশ এত নিশ্ছিদ্র নীরব যে আমি ফোনের অপর প্রান্তের কথা স্পষ্ট ভাবে শুনতে পাচ্ছি।
—‘হ্যালো রুশমি, কী অবস্থারে? স্যরি আমি দুপুরে ঠিকমতো তোর সাথে কথা বলতে পারিনি। মাথা পুরা আউট হয়ে গিয়েছিল।’
রুশমিকে বলতে শুনলাম, ‘এখন কেমন আছ তুমি?’
—‘ভালো। এখন ভালো লাগছে। মাথা একদম পরিষ্কার।
—‘বেশ তো। তাহলে আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। ওই শিহাবকে ভুলেও বিয়ে করতে যেও না।’
—‘কেন?’
—‘ও তোমার যোগ্য নয়। শুভ্রাদি, সিরিয়াসলি! ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলে অনেক বড় ভুল করবে তুমি। একটু সময় দাও নিজেকে। ভেবেচিন্তে ডিসিশন নাও।’
রুশমির বলা কথাগুলো আমি শুনে ফেলেছি এটা বোঝার পর শুভ্রার চোখে একটা অনভিপ্রেত অস্বস্তি ফুটে উঠেছে। ফোনের লাইন কাটার জন্য আঁকুপাঁকু করছে সে এখন। কেটেও দিল কয়েক সেকেন্ডের মাথায়। এদিকে আমার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। তড়াক করে মেজাজটা চড়ে গেছে সপ্তমে। আমি শুভ্রার যোগ্য নই, এই একটা কথা তোতা পাখির শেখানো বুলির মতো বারংবার আওড়াচ্ছে কেন মেয়েটা? জনাথনের মতো হাইক্লাস জব না থাকলেও আমি বেকার নই। কথাবার্তা খারাপ বলি না। দেখতে শুনতেও চলে টাইপ। লোকে তো সুদর্শনই বলে। আমার চরিত্রগত কোনো সমস্যা নেই। নেই মদ খেয়ে টাল হবার মতো বাজে অভ্যাস। আমার জীবনের চব্বিশটা বসন্ত কেটে গেছে একজন মাত্র নারীর অপেক্ষায়। সেই নারী শুভ্রা। শুভ্রার প্রতি আমার একাগ্রতা নিখাদ এবং নির্জলা। আমার একটাই ত্রুটি যে আমি শুভ্রার চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের ছোটো। কিন্তু এতে শুভ্রার কোনো আপত্তি নেই। ওই পুঁচকে মেয়ে কে আমাদের ব্যাপারে কথা বলার? এতটা স্পর্ধা সে পায় কোত্থেকে? হীনমন্যতা জিনিসটা আমার মধ্যে কখনোই ছিল না। নিজের যা আছে তা নিয়েই আমি খুশি ছিলাম, তৃপ্ত ছিলাম। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করলাম এই মুহূর্তে এক দুর্দমনীয় তিতকুটে হীনমন্যতা আমাকে ঘায়েল করে ফেলতে চাইছে। রুশমি নামের মেয়েটির প্রতি ক্রমেই এক বীভৎস আক্রোশ জন্ম নিচ্ছে ভেতরে। এর আগে কেউ কোনোদিন আমার সম্পর্কে এমন বিরূপ ধারণা পোষণ করেনি। করেনি আমার যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ!
—‘কী খবর?’ শুভ্রা বলল।
—‘এইতো’
—‘আন্টি তো আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল না।’
—‘হুম’ আমি তখন অন্যমনস্ক ভাবে বুকের ভেতর আত্মবিশ্বাস হাতড়ে বেড়াচ্ছি, পাচ্ছি না। রুশমি আমার আত্মবিশ্বাসের খুঁটি নড়বড়ে করে দিয়েছে।
—‘হুম মানে কী? কিছু বলছিস না কেন?’
—‘শুভ্রাদি শোনো, পাপা মম আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না।’
—‘আমার ড্যাডও তো মেনে নেবে না। তাতে সমস্যাটা কোথায়?’
সমস্যাটা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। বাবা মায়ের অমতে শুভ্রাকে বিয়ে করলে তারা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবে এবং বাড়ি ছাড়া করবে। এতে খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। আমি প্রাপ্তবয়স্ক, আত্মনির্ভরশীল এবং স্বাবলম্বী পুরুষ। আর্থিক সংকটে পড়তে হবে না। মাথার ওপর ছাদ জুটে যাবে কোনো না কোনো উপায়ে। মূল সমস্যাটা হবে মমকে নিয়ে। মম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে ওস্তাদ! ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল একজন মানুষ আমার মা। আবেগের বশে হুট করে কী যে করে বসবে, তা আগে থেকে ধারণা করা দুষ্কর ব্যাপার।
.
শুভ্রা খুব জরুরি গলায় বলল, —‘শোন, আমরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে করব। তার আগে একটা কাজ করতে হবে। কাল একটু সেজেগুজে মিট কর আমার সাথে। ছবি তুলে ইনস্টাগ্রামে দিব। সবাই জানুক আমাদের রিলেশনের ব্যাপারটা।’
—’এসব শো অফ আমার পছন্দ না। ছবি টবি তুলব না। প্লিজ তুমি এই অনুরোধটা আমাকে দ্বিতীয়বার করো না।’
—‘শো অফের কী আছে? আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে ছবি তুলতে পারি না? তুই এরকম কেন?’
আধো আলো অন্ধকারে শুভ্রার চোখের দিকে চেয়ে আমি নিস্তেজ গলায় বললাম, ‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো শুভ্রাদি?
শুভ্রা একটু থমকে গেল। এই প্রশ্ন তার জন্য অপ্রত্যাশিত। আগেই বলেছি, ওর ভেতরে গভীরতা ব্যাপারটা একেবারে নেই বললেই চলে। মন দিয়ে কখনো কিছু ভাবতে শেখেনি ও।
পাপা কোন সময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ তাকে কাঠ কাঠ গলায় বলতে শুনলাম, ‘এই শিহাব, তুমি ভেতরে যাও। আমার শুভ্রার সাথে কথা আছে।’
শুভ্রা চট করে উঠে দাঁড়ালো, ‘আঙ্কেল তোমার সাথে পরে কথা বলব। আজকে একটু তাড়া আছে। এখন উঠি।
শুভ্রা কম চালাক নয়। পাপার ঠোঁটকাটা স্বভাবটা ওর জানা আছে। পাপাকে মুখ খোলার কোনো সুযোগ দেবে না সে। শুভ্রা জায়গাটা থেকে প্রস্থান করার পর পাপা আমাকে বলল, ‘শিহাব, তোমার বিয়ে আমরা ঠিক করে ফেলেছি। শুভ্রাকে তুমি ভুলে যাও।’
আমি একটা বড় নিঃশ্বাস চেপে বললাম, ‘বিয়ে করলে শুভ্রাকেই করব। নইলে নয়। আমার বয়স মাত্র চব্বিশ। বিয়ের বয়স চলে যাচ্ছে না।’
—‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এই সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না। বিয়েটা না হলে এই শুভ্রা মেয়েটা তোমার পিছু কিছুতেই ছাড়বে না। এই মেয়েটি মারাত্মক! একে জীবন থেকে সরাতে হলে অতি শীঘ্রই তোমার একটা বিয়ে দিতে হবে।’
—‘বিয়ে করলেই শুভ্রা আমার জীবন থেকে চলে যাবে পাপা? এতো সোজা?’
—‘এতই সোজা! তোমার বয়স এখনো কম। এসব বোঝার মতো সময় বা সামর্থ্য কোনোটিই হয়নি তোমার। তুমি বুঝতে পারছো না শুভ্রা তোমাকে ইউজ করছে। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে ও আর তোমাকে বিরক্ত করতে আসবে না।’
—‘শুভ্রাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
—‘তোমার মম বলেছে তুমি তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে না করলে সে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেবে।’
আমি পাপার দিকে আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। বললাম, ‘তোমরা কি চাও আমি আমার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করি?’
—‘মন ঠিক হয়ে যাবে।’
—‘যদি ঠিক না হয়?’
— ‘হবে।’
—‘হবে না। আমি আমাকে চিনি পাপা!
—‘তুমি তোমাকে কিছুই চেনো না। শুভ্রাকে বাদ দাও। কাল একবার সময় করে মেয়েটাকে দেখে এসো।’
—‘কোন মেয়ে?’
–‘যে মেয়েটাকে আমরা মনোনীত করেছি।’
—‘মাথা খারাপ!’
এমন সময় মম উপস্থিত হলো দৃশ্যপটে।
—‘শিহাব, তুমি যদি আমার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে না করো, তাহলে আমি না খেয়ে একদম মরে যাব বলে দিলাম!’
কী ভয়ঙ্কর অন্যায় আবদার! কী মারাত্মক হুমকি! আজকের যুগের যে কোনো শিক্ষিত মুক্তমনা মানুষের কাছে এই অন্যায় আবদার অবিশ্বাস্য ঠেকবে। অথচ আমার জীবনে এই অবিশ্বাস্য অদ্ভুত গল্পটাই আশ্চর্যজনক ভাবে সত্য হয়ে গিয়েছিল!
রুশমি
ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে। আমি লিভিং রুমে বসে বাবাজানের মাথায় তেল ঘষছি। টিভিতে খবর চলছে। ছোটো আর মেজো কার্পেটের ওপর বসে দাবা খেলছে আর গোয়াকামলি দিয়ে চিপস খাচ্ছে কুটুরমুটুর শব্দে। আম্মুজান আর ফুপি রান্নাঘরে। এমনই এক ছিমছাম পারিবারিক আনন্দঘন আবহে হঠাৎ আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের ঘনঘটার মতো আমাদের আস্তানায় হানা দিল লিও I এমন নয় যে সে এর আগে কখনো এ বাড়িতে আসেনি। এসেছে দু-তিনবার। তবে প্রতিবারই সঙ্গে ছিল ছোটোখাটো দল। একদম একা, বিনা নোটিশে, বিশেষ করে আমার স্বৈরাচারী ফুপুর উপস্থিতিতে এবারেই প্রথম আসা। দরজা খুলেছিল মেজো। আমি বাবাজানের মাথার তালুতে তেল ঘষতে ঘষতে শুনতে পেলাম লিওর গলা।
—‘রুশ কি বাড়িতে আছে?’
—‘আছে।’
মেজো আমাকে ডাকলো। আমার বুক কাঁপছে এক অজানা আশঙ্কায়। অন্য সময় হলে ভয়ের কোনো কারণ ছিল না। ফুপিকে নিয়েই সমস্যা। সে ব্যাপারটাকে কীভাবে নেবে? তাছাড়া লিওর সাথে তো আমার সম্পর্কটা ঠিক আগের মতো নেই। ও বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করেছে। বাংলায় একটা কথা আছে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। আমি যদিও কোনো অন্যায় করিনি তবুও এই মুহূর্তে আমার মনটা কোনো এক অজানা কারণে যেন পুলিশের ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বাবাজান বলল, ‘কে এসেছে?’
—‘বড়পুর বন্ধু।’ মেজো উত্তর দিল। ততক্ষণে লিও ভেতরে ঢুকে গেছে। আমার মাথায় আজকে হিজাব নেই। আমার ছোটো বোনরাও কেউ এ মুহূর্তে পর্দা করছে না। বাবাজান হয়তো এতে তেমন কিছু মনে করবে না। কিন্তু ফুপি? সে তো এই সংস্কার বিরুদ্ধ ঘটনা কোনো ভাবেই মেনে নেবে না!
লিও হাসিমুখে বাবাজানকে হ্যালো বলল। বাবাজান হাসলো। ভদ্রতার হাসি। আমাদের সারা বাড়ি ভরে আছে বিভিন্ন ধরনের ঝাঁঝালো স্পাইসের গন্ধে। এই মশলাদার বাতাসে লিওর কেমন লাগছে কে জানে। শ্বেতাঙ্গরা সচরাচর ইন্ডিয়ান স্পাইসের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। লিও কেলভিন ক্লেইনের কালো রঙের একটা জ্যাকেট পরে আছে, সাথে কালো জিনস। মাথার ব্লন্ড চুল শীতের খরসান বাতাসে রুক্ষ হয়ে আছে। সম্ভবত সাইকেল চালিয়ে এসেছে। ওদের বাসা খুব একটা দূরে নয়।
কিচেন থেকে আম্মুজানের গলার স্বর ভেসে এলো, ‘কে এসেছে?’
মেজো দৌড়ে ছুটে গেলো কিচেনে আম্মুজানকে খবরটা দিতে। আমি অপ্রস্তুত বোধ করছি। আমার উচিত লিওকে কিছু বলা। কিন্তু নার্ভাসনেস আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছে। লিও বেচারার ধারণাতেও নেই যে, কী মারাত্মক রকমের একটা ভুল সময়ে সে আমার বাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে। ও আমাদের ধর্মীয় নিয়ম কানুন তো কিছু জানে না। সংস্কারবদ্ধ সমাজটাকেও চেনে না। ওর জন্য এই মুহূর্তে খারাপ লাগছে। আমার উচিত ছিল টেক্সটের রিপ্লাই দেয়া, কল ব্যাক করা। ওসব কিছুই করিনি বলে সে বাধ্য হলো আমার বাড়িতে আসতে। দোষ আমার! সম্পূর্ণ আমার!
—‘তোমার কাছ থেকে বই ধার নিতে এসেছি। তুমি আমাকে তোমার কালেকশন দেখাবে?
আমি ভয়ে ভয়ে একবার তাকালাম বাবাজানের দিকে। বাড়ির অতিথিকে অপমান করে তাড়িয়ে দেবার মতো হীন মানসিকতা আমার বাবাজান ধারণ করে না, তা আমি জানি। কিন্তু আমার ভয় ফুপিকে নিয়ে। বাবাজানের ব্রেইন ওয়াশ করার জন্য ফুপির একটা বাক্যই যথেষ্ট।
উঠে দাঁড়ালাম, গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম, ‘এসো আমার সাথে।’
লিভিং রুমটা অতিক্রম করে সিঁড়ির কাছকাছি এসে যখন পৌঁছেছি তখন কিচেন থেকে ফুপির কর্কশ গলার স্বর শুনতে পেলাম, ‘এই অসময়ে কেউ কারো বাসায় আসে? কেন এসেছে ছেলেটা? কী চায়?’
ভাগ্যিস, লিও বাংলা বোঝে না। বুঝলে কী সীমাহীন বিব্রতকর পরিস্থিতিতেই না পড়তে হতো আমাকে। আমি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছি। লিও আমার পেছন পেছন নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে। হিজাব ছাড়া ও আমাকে এর আগে কখনো দেখেনি। আমার পিঠের ওপর খোলা চুল ছড়িয়ে আছে। অনেকে বলে আমার চুল নাকি সুন্দর। কথাটা অবশ্য আমার মিথ্যে বলে মনে হয়নি কখনো। আমি একটা ফিরোজা রঙের কোমর পর্যন্ত ব্লাউজ আর সাদা ট্রাউজার পরেছি। আমি জানি আমাকে এখন সুন্দর দেখাচ্ছে। এটাও জানি যে এই সৌন্দর্য লিওকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। আমার বুক কাঁপছে দুরদুর করে। আমার ঘরে কখনও কোনো পুরুষ বন্ধু আসেনি। এ বাড়ির মেয়েদের বেডরুমে পুরুষ বন্ধুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
ঘরে ঢুকে পছন্দের দুটো ল্যাম্পশেড জ্বালালাম। এদুটোতে সবচেয়ে বেশি আলো হয়। ঘরের এক কোণে রাখা বইয়ের শেলফটা দেখিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এইতো আমার বই। দেখো তোমার কোনটা পছন্দ হয়।’
লিও বইয়ের দিকে ঘুরেও তাকালো না। ওর নীল দুটি চোখ নিবদ্ধ হয়ে আছে আমার মুখের ওপর। আমিও ওকেই দেখছি। ও কয়েক পা এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো, খুব নিচু গলায় বলল, ‘তুমি ফোন ধরেছিলে না কেন? টেক্সটের রিপ্লাই দাওনি কেন?’
—‘তুমি সেদিন ওই কাণ্ডটা কেন করলে?
—‘কীসের কথা বলছ?’
—‘তুমি জানো।’
লিও কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল টানা কয়েক সেকেন্ড। তারপর কেমন অবশ গলায় বলল, ‘রুশি, তোমার কি কোনো আইডিয়া আছে যে তুমি কতটা সুন্দর?’
আমার হৃৎপিণ্ডের গতি অস্বাভাবিক। হাত পা কাঁপছে। লিওর একটা হাত আমার মাথার চুলের ওপর উঠে এসেছে। আমি জানি ও কী চায়। ওই চোখের দৃষ্টি আমি পড়তে পারছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর হাতটা চুল থেকে নেমে গালের ওপর এসে থামলো। আমার যে খুব একটা ভালো লাগছে তা নয়, আবার খারাপও লাগছে না। কিন্তু ভীষণ একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। যা হচ্ছে তাতে মনের কোনো ক্রিয়া নেই। পুরো ব্যাপারটা শারীরিক। আমি লিওর হাতটা সরিয়ে দিলাম আস্তে করে, ‘তুমি যেরকম ভাবছ সেরকম কিছুই নয়।’
লিও আমার মুখটা ওর দুহাতের মধ্যিখানে বন্দি করল, ব্যাকুলভাবে বলল, ‘আমি মুভ করছি নেক্সট মান্থে। বাবা মায়ের সাথে আর থাকছি না। তুমি চলে এসো। আমরা একসঙ্গে থাকব। আমরা তো বেস্ট ফ্রেন্ড তাই না? একসাথে থাকতেই পারি।’
বুঝতে পারছি না লিও আমার কাছ থেকে কী চায়? প্রেম নাকি বন্ধুত্ব? নাকি শুধুই শরীর? আমি বিভ্রান্তি নিয়ে চেয়ে আছি ওর দিকে। আমার মনের মধ্যে একটা পাপবোধ ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। আমার লজ্জা হচ্ছে এই ভেবে যে অন্য কেউ না দেখলেও আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাকে ঠিকই দেখছেন এই মুহূর্তে। সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও সেই মহান স্বত্তাকে তো ফাঁকি দেয়া সম্ভব না। তিনি কি আমাকে ক্ষমা করবেন? এই কথা মনে হতেই আমার চোখ ভিজে উঠল। নিজের ভেতরের প্রতিরোধের দেয়ালটা শক্তিশালী হয়ে উঠল নিমেষে। আমি আমার মুখের ওপর চেপে বসে থাকা লিওর দুটো হাত সরিয়ে দেবার জন্য উদ্যত হলাম। ঠিক সেই সময়ই ঘটল অঘটনটা। ঘরের দরজটা হঠাৎ নড়ে উঠল। দরজার ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিল ফুপি। লিওর হাতজোড়া তখনও আমার গালের ওপর রাখা ছিল, আর আমার হাত ওর হাতের ওপর!
ফুপির আকস্মিক আগমনে লিও বেশ বিব্রত হয়ে পড়ল। চকিতে হাত সরিয়ে নিল আমার গালের ওপর থেকে। ফুপির চোখ দুটো তেজে ধকধক করছে। চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে ঝিলিক দিচ্ছে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। আমার মেরুদণ্ড বরফ শীতল। আমি নড়তে পারছি না। এমন কি নিঃশ্বাস নিতে পর্যন্ত ভুলে গেছি। কয়েকটা নীরব ক্ষণ কেটে যাবার পর ফুপি আমাদের কাউকে কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। লিও প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল আমার দিকে। ওদের বাবা মায়েরা প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের বেডরুমে অনুমতি ব্যতীত ঢুকে পড়ে না। ওসব আঠারো হবার আগ পর্যন্ত তাও চলে। আঠারোর পর থেকে সন্তানরা স্বাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে থাকে। কিছুদিন ধরে আমার বান্ধবী হেইলির বাড়িতে ঝামেলা চলছিল। এল জি বি টি ক্লাবের সদস্য হয়েছে বলে তার বাবা-মা দুজনেই রাগ। হেইলি বাবা মায়ের রাগের ধার ধারে না। মুভ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আপাতত তার চাকরি বাকরি নেই তাই এপার্টমেন্টের খরচ ওঠাতে পারবে না। ঠিক করেছে ভ্যান গাড়িতে থাকবে। ভ্যান লিজ নেয়া হয়ে গেছে এর মাঝেই। সারাদিন ভ্যান চালিয়ে ঘুরবে এখানে সেখানে। আর সন্ধ্যা হলে সুবিধামতো জায়গায় পার্ক করে ঘুমিয়ে পড়বে। চমৎকার মজার একটা জীবন হবে। আমরা সব বন্ধুরা খুব এক্সাইটেড ওর নতুন জীবন নিয়ে। কিন্তু আমি ছাই এই মুহূর্তে কেন এসব ভাবছি? বলেছিলাম না? ইম্পরট্যান্ট সময়ে আনইম্পরট্যান্ট সব কথা আমার মাথায় এসে ভিড় করে! এখনো তাই হচ্ছে। আমার নিজের জান যায় যায় অবস্থা আর আমি ভাবছি হেইলির কথা!
—‘লিও তুমি এখন যাও। ত
—‘ওই লেডি কে?’
—‘আমার আন্ট।’
—‘তোমার আন্ট কি আমাকে দেখে রাগ করেছে?’
—‘হ্যাঁ করেছে। লিও প্লিজ তুমি এখন যাও। আমি … আমি তোমার সাথে পরে কথা বলব।’
সে রাতে লিও চলে যাবার আগে বেশ কিছুক্ষণ ভারী অদ্ভুত চোখে চেয়ে ছিল আমার দিকে। ওই চোখের দৃষ্টিটা দেখে আমি বুঝেছিলাম যে আজকের ঘটনা অনেক অনেক দিন মনে থাকবে তার। ওর জীবনে আমিই প্রথম এবং একমাত্র মুসলিম বন্ধু ছিলাম। একবার আমাকে কথায় কথায় বলেছিল লোকে কেন মুসলিমদের খারাপ বলে, টেরোরিস্ট বলে আমি জানি না, তুমি তো কত ভালো রুশি!’
আমি জানি এই ঘটনার পর মুসলিমদের সম্পর্কে ওর ধারণা পাল্টে যাবে। সে যাক, ওসব নিয়ে ভাববার সময় এটা নয়। আমার পায়ের তলায় এখন ভূমিকম্প। আমি ঘর থেকে বের হলাম না। চুপ করে বসে রইলাম বিছানার ওপর। আমার মন উৎকর্ণ। স্নায়ু টান টান। দরজার বাইরে অল্প বিস্তর শব্দ হলেই চমকে উঠছি। ভাবছি ফুপির মুখ থেকে ঘটনার বিবরণ শুনে বাবা আর আম্মু কতটা কষ্ট পেতে পারে। এই কষ্টের পরিণাম কী হতে পারে? ওরা কি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেবে? নাকি ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেবে? হঠাৎ মনে পড়ল সেদিন আম্মুজান বলেছিল, আমরা ঠিক করেছি তোমাকে বিয়ে দেব। ধক করে উঠল বুক। চোখের পলকে দিব্য দৃষ্টিতে যেন দেখে ফেললাম আমার পরিণতি। আমার বুদ্ধি একেবারে কম নয়। আমি টের পেয়ে গেলাম আগামী চব্বিশ ঘন্টায় আমার সাথে কী হতে যাচ্ছে। কী ভীষণ অস্থির যে লাগতে লাগল! মনে হচ্ছিল যেন আমি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো এক আসামি। একটু পরেই হয় আমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হবে নয় মৃত্যুদণ্ড।
.
কিছুক্ষণ পর নিচ থেকে বাবাজানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। খুব উঁচু গলায় কথা বলছে সে। শুনতে পেলাম ফুপির কণ্ঠস্বর। সেই সাথে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ, ওটা আম্মুজান। মেজো আর ছোটোর কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি জানি না নিচে আসলে কী হচ্ছে। কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে না। খুনের অভিযুক্ত অপরাধীকেও তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়। এরা আমাকে সেই সুযোগটুকুও দিচ্ছে না। কী করব? নিচে নেমে সরাসরি বাবাজানের সাথে কথা বলব কি? নাকি আম্মুজানের সাথে? আম্মুজান কাঁদছে কেন? এখানে তার তো কোনো দোষ নেই। নিশ্চয়ই ফুপি আম্মুজানকে কিছু বলেছে। আমাদের তিনবোনের যে কোন ব্যর্থতায় সে আম্মুজানকেই দায়ী করে আর সাফল্যে বাবাজানকে। অদ্ভুত এক মহিলা! আমার মায়ের সাথে এসব করে পার পেয়ে গেলেও আমার সাথে কোনোরকম ফাজলামো চলবে না। আমি এখন আর অল্পবয়সী কিশোরী নই। চাইলে এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারি। একবার বেরিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলে কারো বাপের সাধ্য নেই আমাকে আটকে রাখার।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে আমি ঘরের ভেতর পায়চারি করছি। নিচে এখনো জোর আলোচনা চলছে। গলার স্বর শুনতে পাচ্ছি কিন্তু আলোচনার সারবস্তু বুঝতে পারছি না। আমার কান্না পাচ্ছে। রাগ হচ্ছে বাবাজানের ওপর। সমস্ত পৃথিবীটা বিস্বাদ লাগছে। বাবাজান কি আমাকে এতটুকুও বিশ্বাস করে না? এই তার ভালোবাসা? নিজের মেয়ের সাথে সরাসরি কথা বলার সাহস নেই? বোন যা বোঝাচ্ছে তাই বুঝে যাচ্ছে? আশ্চর্য!
এশার নামাজ আদায় করে শুয়ে পড়লাম। ঘুম এলো না। অনেক রাত পর্যন্ত নিচে বাবা আর আম্মুকে ফিসফিস করে কথা বলতে শুনলাম। শেষ রাতে মেঘ ডাকতে লাগল। ওয়েদার ফোরক্যাস্ট বলেছে আগামী কাল ফ্রিজিং রেইন হবে। সকাল দশটা থেকে শুরু করে বিকেল পাঁচটা অবধি। দুর্দান্ত খারাপ আবহাওয়া। রাতে লিও একটা টেক্সট করেছিল।
রুশি, আই অ্যাম নট শিওর হোয়াট আই হ্যাভ ডান টু আপসেট ইউ। বাট হোয়াটেভার ইট ওয়াজ আই অ্যাম স্যরি। আই উইল স্টপ বাই টুমরো আফটারনুন অ্যারাউন্ড থ্রি পিএম। উই ক্যান টক অ্যাবাউট ইট ফেস টু ফেস। জাসট গিভ মি ওয়ান মোর চান্স। গুড নাইট। স্লিপ টাইট।
সকালে ঘুম ভাঙলো মেজোর ডাকে।
—‘বড়পু! ওঠো, কথা আছে!’
চোখ খুলে মেজোর ম্লান মুখখানা দেখে অজান্তেই চমকে উঠলাম, ‘কী হয়েছে?’
মেজো আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত চোখে চেয়ে থেকে গলার স্বর এক ধাপ নিচে নামিয়ে বলল, ‘বড়পু! কালকে তোমার বিয়ে!
শিহাব
শুভ্রার কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই। এতবার বারণ করা সত্ত্বেও গভীর রাতে সে ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিয়েছে আমাকে ট্যাগ করে। আমি ফেসবুকে একেবারেই নিয়মিত নই। ওখানে একটা অ্যাকাউন্ট যে আছে আমার নামে সেটাই মাঝে মাঝে ভুলে যাই। অতএব শুভ্রার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আমার চোখে পড়ার আগে আমার বাবা মায়ের চোখে পড়ে গেল। কারণ ফেসবুক ওদের দ্বিতীয় সংসার। ওখানে কোনো খবর চাউর হবে আর সেই খবর ওদের চোখে পড়বে না সে এক অসম্ভব ব্যাপার। এখন হলিডে সিজন। আমাদের সবার ছুটি। সকালে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠা হয়। আজ নাশতার টেবিলে গিয়ে দেখি পাপা কফির মগ সামনে নিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে। জাহিদ ওঠেনি এখনো। ওর খুব বেলা করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস।
—‘মম কোথায়?’
—’তার শরীর ভালো না।’
—‘কেন? হঠাৎ কী হলো?’
পাপা আমার মুখের দিকে চেয়ে ভরাট গলায় বলল, ‘শুভ্রার স্ট্যাটাস দেখার পর থেকে অসুস্থ বোধ করছে সে।’
আমি অবাক, ‘কীসের স্ট্যাটাস?’
—‘তুমি জানো না?’
—‘কই না! আমি তো কিছু জানি না!’
পাপা টেবিলের ওপর রাখা ট্যাব খুলে শুভ্রার স্ট্যাটাসটা খুঁজে বের করল। আমার চোখের সামনে ধরে বলল, ‘এই দ্যাখো।’
সেই মুহূর্তে ভীষণ রাগ হলো আমার শুভ্রার ওপর। এতো বার নিষেধ করার পরেও এমন একটা কাজ সে কেন করল? আমি তো গতরাতে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে এসব শো অফ আমার একেবারেই পছন্দ না।
—‘গভীর রাতে এই স্ট্যাটাস দেখে তোমার মমের বিপি হাই হয়ে গেছে।’
আমি গমগম করে বললাম, ‘বিপি হাই হওয়ার মতো তো কিছু হয়নি। তোমাদের সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি।’
পাপা শান্তভাবে আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, ‘ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। কথা আছে তোমার সাথে।’
—‘কী কথা? এখুনি বলো।’
—‘আগে খেয়ে নাও। তারপর বলছি।’
দুশ্চিন্তায় আমার ভেতরটা কাঁটা হয়ে গেলো। পাপা নিশ্চয়ই এমন কিছু বলবে যা শোনার পর আমার অ্যাপেটাইট চলে যাবে। আর এটা বুঝতে পেরেই সে আমাকে আগেভাগে খেয়ে নিতে বলছে।
আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘পাপা প্লিজ, যা বলার বলে ফেলো। আমাকে মেন্টাল টর্চার করো না।’
পাপা খুকখুক শব্দ করে একটু কেশে নিল, বলল, ‘তোমার বিয়ের তারিখ পড়েছে আগামীকাল। আমরা তাড়াহুড়া করতে চাইছিলাম না অবশ্য। কিন্তু মেয়ের বাড়ি থেকে চাপ এসেছে।’
—‘আই অ্যাম নট গেটিং ইউ। ইজ ইট আ জোক?’
—‘ইটস নট আ জোক। উই অলরেডি মেড আওয়ার ডিসিশন।
একটু থেমে পাপা আবার বলল, ‘ইউ ক্যান মিট দ্যা গার্ল টুডে। ইফ ইউ ওয়ান্ট।’
আমি আর্ত গলায় বললাম, ‘হুট করে বলছ কালকে আমার বিয়ে। মাই গড! মানে আমি কোন সময়ে বাস করছি? এটা কি টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি নাকি এইটিনথ সেঞ্চুরি? আই অ্যাম ড্রেডফুলি কনফিউজড!’
—‘বললাম তো আজকে মেয়েটির সাথে দেখা করে এসো। চেনা জানা হয়ে যাবে।’
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, ‘ইম্পসিবল!’
—‘কোথায় যাচ্ছ?’
উত্তর দিলাম না। পাপা বলল, ‘তোমার মায়ের সাথে দেখা করে যাও। সে অতিশয় চিন্তিত তোমাকে নিয়ে।’
.
আমি বেডরুমে এসে কাপড় পাল্টে নিলাম। পায়ে লাগালাম স্নো বুট। গাড়ির চাবি নিয়ে নেমে এলাম নিচে। বেরোবার মুহূর্তে কী মনে করে যেন থমকে দাঁড়ালাম একবার। চট করে ওপরে উঠে এসে মমের ঘরে উঁকি দিলাম। ঘর অন্ধকার। মম শুয়ে আছে বিছানায়। সেন্ট্রাল হিটিং এর পাশাপাশি অতিরিক্ত একটি হিটার চলছে ঘরে। সোয়েটার আর কোট পরা অবস্থায় ওই উত্তাপের আতিশয্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো।
—‘তোমার কী হয়েছে?’
মম তাকালো আমার দিকে। ঈষৎ কম্পনযুক্ত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছ?’
—‘ডোন্ট নো! মে বি আই অ্যাম গোইং টু হেল!’
—‘এভাবে কথা বলছ কেন?’
—‘অসময়ে শুয়ে আছ কেন? কী হয়েছে তোমার?’
মম হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও এগিয়ে গেলাম।
—‘বসো আমার পাশে।’
—‘বসব না। বলো কী বলবে?
—‘তোমার বিয়ের দিন ধার্য করা হয়েছে। আগামীকাল তোমার বিয়ে।’
—‘আমি এই বিয়ে করব না।’
মম আমার একটা হাত ধরে ব্যাকুল গলায় বলল, ‘আমরা কথা দিয়ে ফেলেছি মেয়ের বাবা-মাকে। প্লিজ তুমি অমত করো না। শুভ্রা ভালো মেয়ে না। ওর কত বড় সাহস আমার ছেলেকে নিয়ে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেয়। তোমার বিয়ে না হলে ওই মেয়েটা তোমার পিছু কিছুতেই ছাড়বে না। বোঝার চেষ্টা করো।’
আমি মমের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ স্থবির ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম বিছানার পাশে। তারপর চুঁ শব্দটি না করে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। পেছন থেকে মমকে বলতে শুনলাম, ‘কিছু বলে যাও বাবা! এভাবে চলে যেও না। দুশ্চিন্তায় আমার মাথার রগ ছিঁড়ে যাচ্ছে। মরেই যাব!’
পাপা কিংবা মম নয়, এই মুহূর্তে আমার আক্রোশের মূল কেন্দ্রবিন্দু শুভ্রা। কেন সে আমার নিষেধ অমান্য করল? কেন করল এই বাড়াবাড়ি? আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয় না? ক্রোধানলে পুড়তে লাগল ভেতরটা। দাঁতে দাঁত চেপে কোনোরকমে রাগটা হজম করে গাড়িতে উঠে বসলাম। এই মুহূর্তে শুভ্রাকে দু’চার কথা না শোনালে আমার গায়ের জ্বালা জুড়োবে না।
রুশমি
কারো সাথে কোনো কথা না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি। কাপড়চোপড় কিছু সাথে নেয়ার কথা মাথায় ছিল না। শুধু গাড়ির চাবি, ক্রেডিট কার্ড, জ্যাকেট, হিজাব আর পায়ে চপ্পল লাগিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। ভাবছি আর কোনোদিন বাড়ি ফিরব না। যে বাড়ির সদস্যরা আমাকে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম মূল্যটুকু দিতে পারল না, সেই বাড়িতে ফিরে যাওয়া আর না যাওয়ায় আসলে কোনো ফারাক নেই। আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি বাবাজানের আচরণে। একটা বার সে জানতে চাইল না এই বিয়েতে আমার মত আছে কি নেই। আশ্চর্য! বিয়ে করব আমি আর সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ওরা। এ কেমন পরিবারে জন্ম আমার? এই কাহিনী আমার বন্ধুরা শুনলে কী বলবে? কী ভাববে? ছিঃ! ছিঃ!! ছিঃ!!! লজ্জা আর আত্মগ্লানিতে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে। এতই যদি রক্ষণশীল হও তোমরা তবে কী দরকার ছিল আমাদের তিন বোনকে নিয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড হওয়ার। আমরা তো এই জীবন চাইনি। তোমরা আমাদের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে বলবে, গা ভেজাবে না। এতো অসম্ভব আবদার!
আজকে কফিশপে যাবার কথা ছিল। যে মেয়েটার সকালবেলার শিফট করার কথা সে আসেনি। তার নাকি গতরাত থেকে খুব জ্বর। কিন্তু আজ আমার কিছুতেই কাজে মন বসবে না। আমি কফিশপ গেলাম না। গাড়ি চালানো শুরু করলাম অজানার উদ্দেশ্যে। ওয়েদার অস্বাভাবিক গ্রুমি। একেবারে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম। ছাই রঙের মেঘ ঢেকে ফেলেছে গোটা আকাশ। সকাল থেকেই কান্নার মতো একটানা ঘ্যানর ঘ্যানর শব্দে বৃষ্টি ঝরছে। ভূপৃষ্ঠের ওপর সেই বৃষ্টি পড়তে না পড়তেই আয়নার মতো চকচকে বরফ হয়ে জমে যাচ্ছে। পৃথিবীটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ডিপ ফ্রিজের চেম্বার। শুকনো গাছের ডালে ডালে ভাঙা শার্সির টুকরোর মতো স্থির বিন্দু হয়ে জমে আছে বৃষ্টির ফোঁটা। এ সময় চলাফেরা করতে হয় সাবধানে। হিমায়িত বৃষ্টির পানি জমা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে আলুর দম হবার সম্ভাবনা আছে। গাড়িও চালাতে হয় খুব কেয়ারফুলি। একটু এদিক সেদিক হলেই চাকা স্লিপ করে।
কোন সময় ডিসি চলে এসেছি খেয়াল করিনি। কোথায় যাব, কী করব কিছুই জানি না। কেনেডি সেন্টারের পাশে স্টেসির এপার্টমেন্ট। ওর সাথে একবার দেখা করা যায়। হাইওয়েতে একটু বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালানো গেলেও শহরে ঢুকে যাবার পর তা আর সম্ভব হয় না। ওয়াশিংটন ডিসির মোড়ে মোড়ে সিগন্যাল। দল বেঁধে লোকজন রাস্তা পার হয়। তাই গাড়ি চালাতে হয় ধীরে সুস্থে। হঠাৎ একটা কান্ড হলো। দেখতে পেলাম মুখের সামনের সিগন্যালের সবুজ বাতি আচমকা রং পাল্টে হলুদাভ হয়ে উঠল। অর্থাৎ রেড সিগন্যাল জ্বলতে যাচ্ছে। গাড়ির গতি বেশি থাকায় থামতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো আমার। কঠিন ভাবে ব্রেক কষতে বাধ্য হলাম। চাকায় বিচ্ছিরি শব্দ করে থেমে গেলো গাড়িটা। সঙ্গে সঙ্গে আমার গাড়ির সাথে দুম করে ধাক্কা খেলো ঠিক পেছনের গাড়ি। ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেলো। আল্লাহর অশেষ রহমত যে ধাক্কাটায় জোর কম ছিল। এখন পেছনের গাড়ির কোনো ক্ষতি হলো কিনা কে জানে! ফল্ট তো আমার। ড্যামেজ হয়ে থাকলে আমার ইন্স্যুরেন্সকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমি গাড়ির কাচ নামিয়ে মাথা বের করলাম। দেখলাম পেছনের গাড়ির দরজা খুলে একজন বেরিয়ে আসছে। যে আসছে তার গায়ে ব্ল্যাক ওভার কোট। কোটের ভেতর দিয়ে অফ হোয়াইট হাই কলার সোয়েটার উঁকি দিচ্ছে। হাঁটার ভঙ্গিতে একটা দাম্ভিক ভাব আছে। মুখে আত্মবিশ্বাসের গাঢ় ছাপ। মাথায় ছোটো ছোটো সিল্কি চুল, খয়েরি চোখের মণি, চোয়াল দুটো খুব শক্ত আর ধারালো, গলায় উদ্ধত কণ্ঠমণি। খুব বেশিক্ষণ সময় লাগল না আমার চেহারাটা চিনে নিতে। ভীষণ চমকে উঠলাম মনে মনে, এই ছেলেটার সাথে বারবার কেন দেখা হচ্ছে আমার? আশ্চর্য তো! তবে আমার চাইতেও বেশি চমকে উঠেছে বোধহয় শিহাব। চমক এবং আক্রোশ এই দুইয়ে মিলেমিশে তীব্র হয়ে উঠেছে ওর মুখ। চোখজোড়া হিংস জন্তুর মতো জ্বলছে। গাড়ির জানালায় মুখ নামিয়ে বলল, ‘লুক, হুম আই ফাউন্ড হিয়ার! অসাম!’ এটুকু বলে মুখে একটা অদ্ভুত ভঙ্গি করল ও। তারপর চোখ সরু করে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল ‘আর ইউ স্পাইং অন মি?’
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি তখন বেকুব বনে গেছি। শিহাবের প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় লেগে যাচ্ছে জট। শিহাব বিষঢালা গলায় পরিষ্কার বাংলায় বলল ‘গাড়ি চালাতে পারো না তো বাসায় বসে থাকলেই পারো। কে বলেছে রাস্তায় নামতে?’
ব্যাটার কথার ধরণ দেখে প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেলো আমার।
—‘এভাবে কথা বলছ কেন? তোমার গাড়ি আমার পেছনে ছিল। এর মানে তুমিই আমাকে ফলো করছ।’
শিহাব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। লক্ষ্য করলাম ও হাসলে স্যাম ক্লাফ্লিনের মতো ঠোঁটের প্রান্তিক কোণের দু ধারে এবং গালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। সুন্দর দেখায়! স্যাম আমার খুব পছন্দের অ্যাকটর। এই দুঃসময়ে পছন্দের অ্যাকটরকে মনে পড়া পাগলামোর লক্ষণ। সত্যিই, আমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
—‘নামো গাড়ি থেকে! দেখো তুমি আমার হেডলাইট ভেঙে দিয়েছ।’
আমি ভেতরে ভেতরে একটু নার্ভাস হয়ে পড়ছিলাম। দুবছর হলো গাড়ি চালাই আমেরিকার রাস্তায়। এই প্রথম কোনো দুর্ঘটনা ঘটল। তাও আবার এই অসভ্য ছেলেটার গাড়ির সাথেই। এই ছেলে তো খুব ঝামেলা করবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এর সামনে কিছুতেই দুর্বল হওয়া যাবে না।
—‘হেডলাইট নিশ্চয়ই আগে থেকে ভাঙা ছিল। হেডলাইট ভেঙে যাবার মতো কোনো বড়সড় ধাক্কা লাগে নি। আমাকে এতটাই বোকা পেয়েছ তুমি?’ খুব গুছিয়ে কথাগুলো বললাম। বলতে পেরে একরকম শান্তি অনুভব করলাম মনে মনে।
শিহাবকে দেখে মনে হলো ও আমাকে জ্যান্ত গিলে খেতে পারবে এই মুহূর্তে, ‘স্ট্রেঞ্জ তো! এর মানে আমি মিথ্যে কথা বলছি?’
—‘বলতেই পারো!’ সামনের রাস্তায় চোখ নিবদ্ধ করে বললাম। মনে হলো শিহাব পকেট থেকে ফোন বের করছে। দাঁত কিড়মিড় করে বলতে শুনলাম, ‘অলরাইটি দেন। আই অ্যাম গননা কল দ্যা কপস!’
—‘আবার কপস কেন?’ ঘুরে তাকালাম আমি।’
—‘কারণ তুমি একটা ক্রিমিনাল!’
—‘আমি ক্রিমিনাল?’
—‘অ্যাবসোলিউটলি।’
—কী আশ্চর্য! আমি কী করলাম?
— শুভ্রার কাছে কনটিনিউয়াসলি আমার এগেইনস্টে কথা বলছ। আমি কিছু জানি না মনে করেছ? শুধু এই-ই নয়, দিনের পর দিন আমাকে ফলো করছ। হ্যারাস করছ। সিরিয়াসলি গার্ল! হোয়াট আর ইউ আপ টু?’
রাগে আমার সারা শরীর রি রি করে উঠল। এমন ঝগড়াটের রাজা তো জীবনে কখনো দেখিনি ভাই! ততক্ষণে সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। রাগে গজগজ করতে করতে আমি ইমার্জেন্সি ফ্ল্যাশ লাইট অন করে গাড়ি থেকে নামলাম। ঝগড়াটের রাজা নিজের গাড়ির কাছে এগিয়ে গেছে তখন। আমার পায়ে মোজা জুতো নেই। আছে ঘরে পরার সাধারণ একজোড়া স্যান্ডেল। গাড়ি থেকে নামতেই শীতল বাতাস পায়ের চামড়া একদম কামড়ে ধরল। চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। মেঘ ডাকছে থেকে থেকে। আমার গাড়ি থেকে ওর গাড়ির দূরত্ব মোটে কয়েক পা। ওই কয়েক পা এগোতে গিয়েই আজকের দিনের দ্বিতীয় অঘটনটা ঘটে গেলো। আমি খেয়াল করিনি যে বৃষ্টির পানি বরফ হয়ে জমে গেছে রাস্তায়। গাড়ি থেকে নেমে দুপা এগোতেই স্লিটের ওপর পা পিছলে গেলো একদম। শরবিদ্ধ ভীত হরিণীর মতো আর্তনাদ বেরিয়ে এলো গলা থেকে। আমার বুক খালি হয়ে গেছে। শরীরের সব রক্ত জমে হিম। আজকে মাথা ফেটে মরেই যাবো মনে হয়। সেরকম কিছু হবার আগেই ঝগড়াটে ছেলেটা বাতাসের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে আমাকে খপ করে ধরে ফেলল। আমি বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি, চোখের সামনেটা অন্ধকার। কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না। সে অবস্থায়ই ওকে বলতে শুনলাম, ‘উইন্টারে মানুষ এসব জুতা পরে বের হয়? তোমার কি স্নো বুট নেই?’
আমার বুক ধড়ফড় করছে। শিহাব তখনও আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে। ওর সবল বাহুর স্পর্শ টের পাচ্ছি আমি। ব্যাটা মনে হয় নিয়মিত জিম করে। হাতের পেশি খুব শক্ত! চট করে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে ওর বাহু বন্ধন থেকে। না চাইতেও মুখ দিয়ে বাক্যটা বেরিয়ে এলো, ‘তুমি আমাকে টাচ করলে কেন?’ কথাটা শুনতে পেয়ে শিহাব এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে আমার পিঠ থেকে হাত সরিয়ে নিল। আমি আবারও পা পিছলে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম। শিহাব শেষ পর্যন্ত অতটাও নিষ্ঠুর হতে পারলো না বোধহয়। পুনরায় এগিয়ে এলো আমাকে বাঁচাতে। কিন্তু এবার অন্যরকম কাণ্ড ঘটল। শিহাবের স্নো বুট পরা পা দুটোও ওই মারাত্মক পিচ্ছিল ফ্রোজেন রেইনের ওপর হড়কে গেল। এখন আবার বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। হিমেল শৈত্যপ্রবাহ আমাদের নিঃশ্বাস কেড়ে নেবে আরেকটু হলেই। শীতে আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। আমার মাথায় হিজাব থাকাতে রক্ষা কিন্তু শিহাবের মাথায় তো কিছু নেই। ওর চুলের ওপর টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গে জমে গিয়ে কাচরঙের বরফ বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। ঠান্ডায় বেচারার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারছি ও নিজেও ভারসাম্য ধরে রাখতে পারছে না এখন। বরফের কাচের ওপর পা কিছুতেই স্থির থাকছে না। পিছলে যাচ্ছে। ওর একটা হাত আমার পিঠের ওপর রাখা, অপর হাত আমি শক্ত করে ধরে আছি। আল্লাহ! আল্লাহ! আল্লাহ! কী হবে এখন?
শেষ পর্যন্ত শিহাব অনেক কষ্টে তার পা দুটো দাঁড় করাতে পারল স্থির ভাবে। আমি আর না পেরে ওর বুকের ওপর হেলে পড়েছি। এটা না করলে আমার পক্ষে এখন দাঁড়িয়ে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব না। লজ্জা করছে আমার। ভীষণ লজ্জা! ও কী পারফিউম মেখেছে কে জানে! কী সুন্দর একটা ঘ্রাণ! হঠাৎ ওকে বলতে শুনলাম, ‘তুমি আসলেই একটা ডিজাস্টার! সিরিয়াসলি! কে বলেছিল এরকম টেরিবল ওয়েদারে বাসা থেকে বের হতে?’
ধমক শুনে রাগে দুঃখে অপমানে কান্না চলে আসার উপক্রম হলো আমার। তবে কান্না আসার আগেই তাকিয়ে দেখলাম, পুলিশ এসে গেছে।
শিহাব
বৃষ্টির তোড় বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগতভাবে। হাত-পা জমে আসছে শীতে। একটা ঘন কালো অন্ধকার ক্রমেই আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরছে। মেঘের গর্জনে কানে তালা লাগার জোগাড়। পিচ্ছিল বরফের ওপর আমি অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে আছি। রুশমির সম্পূর্ণ ভার এখন আমার ওপর। মেয়েটা খুব বেশি লম্বা না। বুঝতে পারছি ওজনও তেমন হবে না। ওকে চট করে কোলে তুলে নিয়ে জায়গাটা থেকে সরে পড়লেই কিন্তু ঝামেলা শেষ। কিন্তু এমনটা করা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। মেয়েটার নকরা বেশি। একেবারে চরম অকৃতজ্ঞ। যেই আমি তাকে না বাঁচালে এতক্ষণে বরফের ওপর পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলত। সেই আমাকেই কিনা একটু আগে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলেছে, হাও ডেয়ার ইউ টাচ মি! কী ভীষণ আপত্তিকর কথা! যেন ওকে টাচ করার জন্য আমি মরে যাচ্ছি!
ঘটনা ঘটেছে শুভ্রার এপার্টমেন্টের সামনের রাস্তায়। এখান থেকে শুভ্রার ফ্ল্যাটের বারান্দাটা দেখা যায় স্পষ্ট। এই মেয়ে কি শুভ্রার বাসায়ই এসেছে কিনা কে জানে! আমার পা আবারও পিছলে যাচ্ছে। আমি স্থির ভাবে দাঁড়াতে পারছি না। রুশমি আমার বুকের ওপর এলিয়ে পড়েছে। আমি আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ওকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলাম। মেয়েটা মনে হয় কিছুই খায় না। একেবারে পাখির মতো হালকা! ঠিক সেই সময় চোখ পড়ল ছাতা মাথায় দিয়ে এক পুলিশ অফিসার এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। ইশ! একটু আগে লোকটাকে দেখতে পেলে তো মিস ডিজাস্টারকে আমার বহন করতে হত না। বৃষ্টির ক্ষুরধার স্পর্শে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে তখন। মনে হচ্ছে যেন আরেকটু হলেই সারা শরীর জমে বরফ হয়ে যাবে।
বিপজ্জনক পিচ্ছিল জায়গাটা অনেক কষ্টে অতিক্রম করে আমি আমার গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালাম। রুশমি কোল থেকে নেমেই সাপের মতো ফুঁসে উঠেছে। এমন ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে যেন আমি এইমাত্র ওর কোনো নিকটাত্মীয়কে খুন করে এসেছি। অফিসারের সামনেই কোমরে হাত রেখে ক্ষ্যাপাটে গলায় পাগলের মতো চিৎকার করে বলল, ‘তুমি এটা কী করলে? হ্যাঁ? এত বড় সাহস তোমার!’
বেয়াদব মেয়েটার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এখন কি ঝগড়া করার সময়? আর কিছুক্ষণ খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে এই ফ্রিজিং রেইন আমাকেই ফ্রিজ করে দেবে পুরোপুরি। বাঁচতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খোলা আকাশের নিচ থেকে কেটে পড়তে হবে। আমি মেয়েটার কথা পাত্তা না দিয়ে পুলিশকে বললাম, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। ইউ কেইম জাস্ট ইন টাইম। ইউ আর আ লাইফ সেভার।’
অফিসার আমার তোষামোদে খুব একটা গলল না। এই বৈরী আবহাওয়ায় ছাতা মাথায় নিয়ে ঘটনাস্থলে আসতে হয়েছে বলে বোধহয় তার মেজাজ আগে থেকেই খারাপ। সে থমথমে মুখে বলল, ‘ক্যান আই সি ইওর লাইসেন্স প্লিজ?’
লাইসেন্স টাইসেন্স চেক করতে গিয়ে আরো মিনিট পাঁচেক সময় পার হলো। অফিসারকে ঘটনা খুলে বললাম। রুশমি দেখি নিজেই দোষ স্বীকার করে নিল। আমার গাড়ির হেডলাইটের কাচটা সামান্য ভেঙেছে। বিশেষ কিছু ক্ষতি না। তবে রুশমি বলল ওর ইন্স্যুরেন্স এটার ক্ষতিপূরণ দেবে। আবহাওয়া একেবারেই অনুকূলে নেই বলে অফিসার আর বেশি কথা বাড়ালো না। মিনিট পনেরোর মধ্যে ঝামেলা নিষ্পত্তি হলো। গাড়িতে উঠে পড়লাম তড়িঘড়ি করে। সিগন্যালটা পার হয়ে ডান দিকে মোড় নিলাম। শুভ্রার এপার্টমেন্টের পার্কিং এ গাড়ি পার্ক করে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখি মিস ডিজাস্টার আগেভাগেই এখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমার দিকে একবার তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। দেখলাম ওর মাথার হিজাবে বিন্দু বিন্দু বরফ কণা জমে আছে। ভিজে গেছে অনেকখানি। ঠান্ডায় লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ। ছাই রঙের জ্যাকেট ভিজে সপসপ করছে। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না আমার। লিফটের দরজা খুলে গেলো। ভেতরটা ফাঁকা। ঢুকে পড়লাম নিঃশব্দে। রুশমি ভেতরে ঢোকার পর দরজাটা বন্ধ হলো। আমি দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছি। রুশমি আমার এক হাত সামনে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। এই লিফটটা খুব একটা বড় নয়। একসাথে খুব বেশি হলে ছয়জন ওঠা যাবে। শুভ্রার ফ্ল্যাট চারতলায়। হাত বাড়িয়ে বোতাম প্রেস করতে যাব, দেখি রুশমিও হাত বাড়িয়েছে। ওর বাড়ানো হাতটা দেখতে পেয়ে আমি হাত নামিয়ে নিলাম। একই কাজ সেও করল। আমার হাত উঠতে দেখে হাত নামিয়ে নিল। কী যন্ত্রণা! আমি আবারও হাত বাড়ালাম। সেও হাত বাড়ালো। হাত নামালাম পুনরায়। সেও হাত নামালো।
—‘প্রব্লেম কী?’
রুশমি ঘটাং করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে, ‘তোমার প্রব্লেম কী?’
—‘বাটন প্রেস করো।’ হুকুম করলাম।
—‘নিজে করো!’
ভীষণ অভদ্র তো মেয়েটা! বিরক্তিতে কাদা হয়ে লিফটের বোতাম চাপলাম। অভদ্র মেয়েটা এখনো ঘাড় উঁচু করে জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। যেন এখুনি পারলে জ্যান্ত গিলে খাবে। চাউনিটা ভীষণ রুক্ষ। কিন্তু চাউনি রুক্ষ হলেও ওর জন্ম কাজল পরা চোখদুটো খুব বেশি সুন্দর! দেখলে মনে হয় যেন ঈশ্বর পৃথিবীর সমস্ত মায়া ওই চোখজোড়ায় ঢেলে দিয়েছেন। এমন চোখের দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মন কেমন করে! আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। মেয়েটা আমার সাথে এমন করছে কেন কিছু বুঝতে পারছি না। শুভ্রাকে ফোন করে আমার নিন্দা করছে। দুর্ব্যবহার করে যাচ্ছে অনবরত। এই গুরুতর আক্রোশের কারণ কী?
শুভ্রা ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরনে গোলাপি রঙের স্লিভলেস নাইটি। কোঁকড়া চুলের গোছা ছড়িয়ে আছে ঘাড়ময়। কী প্রসাধন মেখেছে কে জানে, মুখের ত্বক খুব চকচক করছে। আমাদের দেখতে পেয়ে উদ্বেগ নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছিল? অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলি নাকি তোরা?’
—‘ড্রাইভিং না জেনে রাস্তায় নামলে যা হয় আর কি।’ তির্যক কণ্ঠে মন্তব্য ছুঁড়ে দিলাম।
—‘আরে হয়েছে কী বলবি তো!’
রুশমিকে বলতে শুনলাম, ‘তেমন কিছুই হয়নি শুভ্রাদি! তুমি ডেকেছ কেন আমাকে?’
—‘আমার বারান্দা থেকে তো সামনের রাস্তাটা স্পষ্ট দেখা যায়। গিয়ে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ দেখি তোরা দুজন পুলিশের সাথে কী সব মাথামুণ্ডু কথা বলছিস। ঘটনা কী কিছুই বুঝলাম না। শিহাবকে কল দিলাম। ও ধরল না। তাই তোকে ফোন করতে বাধ্য হলাম।’
.
ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে জুতো খুলে নিলাম। এসেছিলাম শুভ্রার সাথে ঝগড়া করব বলে কিন্তু রুশমি নামক আপদটার জন্য সেই ঝগড়াটুকুও শান্তিতে করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। শুভ্রার কী দরকার ছিল আপদটাকে এই অসময়ে ঘরে ডেকে আনার? গায়ের কোট খুলতে খুলতে রুশমি আর শুভ্রাকে হলওয়ে পার হয়ে ড্রইং রুমে ঢুকতে দেখলাম। মনে হচ্ছে রুশমি খুব সহজে এখান থেকে বিদেয় হবে না। শুভ্রার সাথে আমার ভীষণ ব্যক্তিগত কিছু কথা ছিল। যা এই মুহূর্তে না বললেই নয়। হাতে একেবারে সময় নেই। কী মুশকিলে যে পড়লাম!
ঘরের ভেতরটা হিটারের উত্তাপে উষ্ণ হয়ে আছে। মনে হচ্ছিল যেন দীর্ঘ সময় পর চামড়ার নিচের শিরা উপশিরা গুলোতে রক্ত সঞ্চালন হচ্ছে। শুভ্রা এক দৌড়ে গিয়ে ভেতর থেকে তোয়ালে নিয়ে এলো। আমি হাত বাড়ালাম তোয়ালেটা নেবার জন্য। ও আমার হাতে তোয়ালে দিল না। নিজেই এগিয়ে এসে আমার মাথার চুল মুছে দিতে লাগল। আরামে চোখ বুজে ফেললাম। শুভ্রার শরীরের উত্তাপ আমার মুখে এসে লাগছে। রক্তে একটা উন্মাদনা টের পাচ্ছি আমি। রুশমি দ্যা ডিজাস্টার এখানে উপস্থিত না থাকলে হয়তো এই মুহূর্তে আমি দু হাত বাড়িয়ে শুভ্রাকে জড়িয়ে ধরতে পারতাম। খুব ইচ্ছে হচ্ছে একবার ওকে জড়িয়ে ধরতে! কিন্তু আমার কপালটা এত মন্দ কেন কে জানে! শুভ্রাকে পেয়েও পাচ্ছি না মনের মতো করে!
শুভ্রা আমার মাথার চুল মুছে দিতে দিতে বলল, ‘রুশমি, তোর মাথা তো ভিজে গেছে। হিজাবটা খুলে ফ্যাল। সারাক্ষণ মাথায় এসব ছাইপাশ বেঁধে রাখিস কেন? খোল এখুনি! নইলে অসুখ করবে।’
—‘না। আমি ঠিক আছি।’ রুশমি বলল।
শুভ্রা নাছোড় বান্দা, ‘ঠিক আছি মানে? পাগল নাকি এই মেয়ে? জ্বর আসবে তো!’
শুভ্রা আমাকে ছেড়ে দিয়ে এবার রুশমির কাছে যাবার জন্য উদ্যত হলো। রুশমি হাত নেড়ে বলল, ‘শুভ্ৰাদি আমি ঠিক আছি। আই অ্যাম এবসোলিউটলি অলরাইট।’
আমার মোবাইল ভাইব্রেট করছে। পকেট থেকে বের করে দেখি পাপার কল। কলটা কেটে দিয়ে শুভ্রাকে ডাকলাম একবার, ‘শুভ্রাদি! খুব ইম্পরট্যান্ট কিছু কথা আছে তোমার সাথে।’
—‘বল না! বলে ফ্যাল!’
আমি আড়চোখে একবার দেখে নিলাম রুশমিকে। মেয়েটা হা করে চেয়ে ছিল আমার মুখের দিকে। চোখাচোখি হতেই চোখ নিচে নামিয়ে নিল। শক্ত গলায় শুভ্রাকে বললাম, ‘পার্সোনাল কথা। নিড সাম প্রাইভেসি।’
কথাটা শেষ হতে না হতেই রুশমি দেখি তড়াক করে লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ক্যাটক্যাট করে বলল, ‘এই শুভ্রাদি তোমরা থাকো। আমি যাই।’
—‘যাই মানে? মারব এক থাপ্পড়! বসে থাক চুপচাপ। আমি ব্রেকফাস্ট করিনি এখনো। আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করবি।’
—‘ঠিক আছে। আমি তাহলে ভেতরের ঘরে গিয়ে বসছি। তোমরা কথা বল।’ বলল রুশমি। যাক বাবা! একটু হলেও কাণ্ডজ্ঞান আছে মেয়েটার। যাও যাও! তাড়াতাড়ি ভাগো এখান থেকে। তোমাকে আর কিছুতেই আমার সহ্য হচ্ছে না। রুশমি পাশের ঘরে চলে যাবার পর অজান্তেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এলো। সোফার পিঠে হেলান দিয়ে একটু সময় চোখ বুজে থাকলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। এই মুহূর্তে ভেতরে কোনো ব্যথা, বেদনা বা রাগের টনটনে অস্তিত্ব নেই। সব অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়ে একটা ধু ধু শূন্যতা থাবা গেড়ে আছে। আমার কিছুই ভালো লাগছে না কেন যেন। কিচ্ছু না!
হঠাৎ হাতের ওপর একটা স্পর্শ টের পেলাম। চোখ খুলে দেখি শুভ্ৰা আমার পাশে এসে বসেছে।
—‘কী যেন বলবি বলেছিলি?’
আমি কিছু না বলে শুভ্রার দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। ওর মুখটা এখনো ছোটোবেলার মতো ডলপুতুল মার্কা টুলটুলে রয়ে গেছে। দেখলে গাল টেনে আদর করতে ইচ্ছে করে।
—‘কিছু বলছিস না কেন? কী হয়েছে?’
—‘শুভ্রাদি, তোমাকে এতবার নিষেধ করার পরেও তুমি কেন ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিতে গেলে? তাও আবার আমাকে ট্যাগ করে?’
শুভ্রা একটু নিভল, ‘ওমা! দিয়েছি তো কী হয়েছে?’
সোজা হয়ে বসলাম। ওর চোখের ওপর ক্ষুরধার দৃষ্টি রেখে তার চাইতেও অধিকতর ক্ষুরধার গলায় বললাম, ‘আমি নিষেধ করেছিলাম তো! তুমি আমার নিষেধ অমান্য করলে কেন?’
শুভ্রা ভ্রু কুঁচকে ফেলল, ‘তুই আমাকে বকা দিচ্ছিস?’
—‘হ্যাঁ দিচ্ছি!’
—‘সত্যি কথা বলতে এত ভয় কীসের? সত্যটা জানুক সবাই!’
—‘জানার সময় এখনো আসেনি। তোমার স্ট্যাটাস আমার প্যারেন্টস দেখে ফেলেছে। দেখবার পর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে কালকেই আমার বিয়ে দিয়ে দেবে।
কথাটা শুনে শুভ্রা কয়েক সেকেন্ড থৈ থৈ বিস্ময় নিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকলো আমার দিকে। তারপর হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘বিয়ে দিয়ে দেবে মানে? তুই কি মেয়ে নাকি? বিয়ে দেয়া এত সহজ? আজকালকার যুগে এসব হয় নাকি?’
ওর ডাকাতিয়া হাসি দেখে রাগে আমার ব্রহ্মতালু জ্বলে খাঁক হয়ে যাবার উপক্রম হলো, ‘হেসো না তো! আমার বাবা মাকে তুমি চেনো না। ওরা অনেক বেশি কনজারভেটিভ। আর আমার মা হচ্ছে একটা ড্রামা কুইন। ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করতে ওস্তাদ!’
—‘আরে ধুর! এটা কোনো কথা হলো? তুই সাফ জানিয়ে দে যে বিয়ে করতে পারবি না!’
—‘বলেছি এবং আরো অনেকবার বলব। কিন্তু আমি জানি লাভ কিছুই হবে না। মম অলরেডি বেডরিডেন গতকাল রাত থেকে।’
—‘বেডরিডেন কেন? কী হয়েছে আন্টির?’
—‘তোমার স্ট্যাটাস দেখে অসুস্থ হয়ে গেছে। প্রেশার হাই। বালিশ থেকে মাথা তুলতে পারছে না।’
—‘আজিব!’
—‘হ্যাঁ আজিব।’
শুভ্রা কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে দুটি হাত জড়ো করে ধরল নিজের নাকের ওপর। তারপর সেই জড়ো করা হাতের ওপর খুঁতনি রেখে কিছু একটা ভাবলো খানিকক্ষণ। বলল, ‘চল, আমরা আজকেই বিয়ে করে ফেলি।’
চমকে উঠলাম, ‘পাগল নাকি!’
—‘কেন? পাগলের কী আছে? তুই আমাকে ভালোবাসিস না?’
আমি শুভ্রার চোখে চেয়ে বললাম, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো?’
শুভ্রা নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, ‘বাসবো।’
একটা বড় শ্বাস পড়ল আমার, ‘বেসে নাও আগে। তারপর না হয় বিয়ে করার কথা ভেবো।’
শুভ্রা তীব্র চোখে তাকালো, ‘তোর মতলবটা কী?’
—‘আমার কোনো মতলব নেই শুভ্রা! আমি শুধু তোমার মনটাকে পরিপূর্ণ ভাবে পেতে চাই।
—‘খুব চটাং চটাং কথা বলতে শিখেছিস দেখছি!’
—‘হ্যাঁ শিখেছি।’
—‘তাহলে কী হবে? বাবা-মায়ের কথা মতো বিয়ে করে ফেলবি?’
—‘কিছুতেই না। এই বিয়েটা কী করে ক্যানসেল করা যায় সেটাই ভাবছি।’
—‘বলে দে বিয়ে করবি না। এত ভাবাভাবির কী আছে?’
—‘আমার বাবা-মা তোমার বাবা-মায়ের মতো না। ওরা আমার কথা মানতে চাইবে না। মম অসুস্থ হয়ে যাবে। কিছু হলেই মম অসুস্থ হয়ে যায়। একবার পাপার সাথে ঝগড়া করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরতে বসেছিল। এ এক আজব মহিলা!’
শুভ্রা বসা থেকে উঠে ঘরের ভেতর কয়েকবার পায়চারি করল চিন্তিত ভঙ্গিতে। মিনিট তিনেক সময় পর হঠাৎ আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠল, ‘আইডিয়া!’
আমি মুখ তুলে তাকালাম ওর দিকে, ‘শোন শিহাব! বিয়েটা করে ফ্যাল। বিয়ের পর বৌয়ের সাথে এমন মিস বিহেভ করা শুরু করবি যে বৌ যেন দুদিনের মাথায় লেজ তুলে পালায়। পারবি না?
কাতর একটা শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে, ‘উফ! শুভ্রাদি! তুমি যে একটা কী!’
শুভ্রা লাফ দিয়ে এগিয়ে এলো আমার কাছে। হাঁটু গেড়ে কার্পেটের ওপর ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘এটাই বেস্ট আইডিয়া।’
—‘শুধু শুধু একটা মেয়ের লাইফ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।’
—‘ইশ সেকেলে মানুষদের মতো কথা বলিস না তো। লাইফ নষ্ট হবে কেন? আজকাল এসব কোনো ব্যাপার নাকি? মাত্র কয়েক মাসেই যেন বৌ ভেগে যায় সেই ব্যবস্থা করবি। আমি তো আছিই সাথে। দেখবি ঠিক ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। উচিত শিক্ষা হবে তোর বাবা মায়ের। তুই শুধু আমার ওপর ভরসা রাখ। প্ল্যান মাফিক এগোতে হবে।’
রুশমি
শুভ্রাদির বিছানার ওপর পা তুলে বসে আছি আমি। মাথার হিজাব খুলে নিয়েছি। ঠান্ডায় মাথা ধরে গেছে। পাশের ঘরে শিহাব আর শুভ্রাদি ফিসফিস করে কী সব কথা বলছে। শিহাব ছেলেটা একটা আস্ত অসভ্য। রাস্তার মধ্যে হুট করে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছে। কত বড় সাহস! লজ্জা আর অপমানে আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছিল। অবশ্য শুধু ওর ব্যবহারেই নয়, আজকে নিজের বোকামিতেও আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। অ্যাকসিডেন্টটা যে শুভ্রার এলাকায় হয়েছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। গাড়িতে ওঠার পর তার কল পেয়ে আবিষ্কার করলাম যে আমি একেবারে ওর বাসার সামনে। কী কাণ্ড! এসব ভাবতে গিয়ে অদ্ভুত একটা জ্বালাপোড়া হচ্ছে মনে। বুক ছেয়ে আছে আকাশজোড়া হতাশায়! আমার সেলফোন ক্রমাগত বেজে চলেছে। আম্মুজান ফোন করছে। দশ বারোটার মতো মিসড কল জমে গেছে। আমি ফোন ধরছি না। হঠাৎ করে আম্মুজানের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। এই মহিলার অতিমাত্রার পতিভক্তির কারণেই আজকে আমার জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে। স্বামীর মুখের ওপর একটা কথা বলবার সাহস নেই। স্বামীর বড়বোন তার সংসারে দুদিনের জন্য বেড়াতে এসে সর্দারি করে বেড়ায়। সে মুখ বুজে সবটা সহ্য করে। স্বামীকে খুশি করাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। অন্যেরা বাঁচলো কি মরলো তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। ধরব না আমি এর ফোন …কিছুতেই ধরব না!
খানিক বাদে মেজো ফোন করল। ওর ফোনটা ধরলাম। ওর কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠার ছাপ।
—‘বড়পু, তুমি কোথায়?’
—‘বাইরে।’
—‘বাইরে কোথায়?’
—তাতে তোমার কী?’
—‘বাবাজান আজকে রেস্টুরেন্টে যায়নি। কফিশপেও না। কফিশপ আজকের জন্য ক্লোজ করে দেয়া হয়েছে।’
—‘খুব ভালো হয়েছে।
—‘বড়পু! তুমি কি পালিয়ে গেছো?’
—‘মনে হয়।’
—‘আচ্ছা। ভালোই করেছ। বাবাজান একটা বুড়া লোকের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
—‘তুমি কী করে জানলে?’
—‘দুলাভাই বলেছে। ঝুম্পা আপুর বর।’
—‘উনাকে কোথায় পেলে?’
—‘তোমার বিয়ের খবর পেয়ে সবাই চলে এসেছে।’
—‘দুলাভাই আর কী বলেছে?’
—বলেছে পরিস্থিতি খুব খারাপ। রুশমির হবু বর অতিশয় বৃদ্ধ এবং বদখত।’ আমার বুকটা কেঁপে উঠল একদম। এত কঠিন বাংলা মেজোর বলতে পারার কথা না। তাই বুঝতে পারছি খবরটা দুলাভাইয়ের কাছ থেকেই পেয়েছে ও। আমি আর একটাও কথা না বলে ফোন রেখে দিলাম। বাবাজান কেন আমার এই সর্বনাশ করতে যাচ্ছে? কী দোষ আমার? যে মানুষটাকে আমি জীবনে সবচাইতে বেশি ভালোবেসেছি, সেই মানুষটাই আজকে আমার জীবনটাকে ভেঙে তছনছ করে দিতে চাইছে। হঠাৎ আমার মরিয়মের কথা মনে পড়ল। মরিয়ম! আফগান লেখক খালিদ হোসাইনির উপন্যাসের নায়িকার নাম। মরিয়মের বাবা অতি অল্প বয়সে এক প্রৌঢ় লোকের সাথে তার বিয়ে দিয়ে দেয়। লোকটা রগচটা স্বভাবের। অত্যন্ত রাগী এবং মানুষ হিসেবেও বিশেষ ভালো নয়। মরিয়মকে বিয়ে করার কিছুদিনের মাথায়ই আরেকজন কিশোরী মেয়েকে সে বিয়ে করে ঘরে তুলে আনে। দুই স্ত্রীকেই সমান ভাবে নির্যাতন করে। অনেকদিন আগে পড়েছি বলে কাহিনী হুবহু মনে নেই। তবে এটা মনে আছে যে সবশেষে মরিয়ম আর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে খুন করে ফেলেছিল। পরবর্তীতে সেই খুনের দায়ে মরিয়মের মৃত্যুদণ্ড হয়। উপন্যাসটির নাম ‘আ থাউজেন্ড স্প্লেনডিড সানস।’ হোসাইনি এই সময়ের একজন শক্তিমান লেখক এবং আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তাঁর লেখা ‘কাইট রানার’ আমার অন্যতম ভালোলাগার একটি উপন্যাস। কিন্তু মরিয়মের পরিণতি আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। শেষটা আমাকে কাঁদিয়ে ছেড়েছিল। আমার ভাগ্যটাও কি তাহলে মরিয়মের মতোই হতে চলল? শেষমেশ আমার ভাগ্যে জুটলো কিনা বৃদ্ধ এবং বদখত চেহারার বর?
হঠাৎ শুভ্রাদির ডাক কানে এসে লাগলো, ‘এই রুশ! কোথায় তুই? শিগগির আয়। নাশতা রেডি।’
হিজাবটা মাথায় চড়িয়ে নিলাম। আমার মন জ্বালা করছে। মাথা ঠিক নেই। আমি সবাইকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব। বাবাকে, আম্মুকে, ফুপিকে…. সবাইকে বুঝিয়ে দেব যে তোমরা কিছুতেই ধরে বেঁধে আমাকে একটা বদখত লোকের সাথে বিয়ে দিতে পারো না। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেবার তোমরা কেউ না। তোমাদের কোনো অধিকার নেই। শিহাব না থাকলে হয়তো শুভ্রাদির সাথে বিষয়টা শেয়ার করতে পারতাম। এই মুহূর্তে কারো কাছে মনের কথা খুলে বলাটা আমার খুব দরকার। কিন্তু শিহাবের সামনে কিছুতেই নিজের কোনো রকম দুর্বলতা প্রকাশ করব না। ওই ঠোঁটকাটা ছেলেটা এসব নিয়েও হাসি তামাশা করে বসবে।
ডাইনিং এ এসে দেখি শুভ্রাদি টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। প্যানকেক, ওয়াফেল, ডিমের ওমলেট আর ব্রেডটোস্ট। কফি মেশিনে কফি বানানো হচ্ছে। সারা ঘর সিনামন আর কফির ঘ্রাণে ছেয়ে গেছে। এই ঘ্রাণটা আমার খুব ভালো লাগে। আমাদের কফিশপও এই ঘ্রাণে ম্ ম্ করে সর্বক্ষণ। আমরা ইচ্ছে করেই একটু পর পর ওয়াফেল বানাই যাতে কাস্টমাররা শপের ভেতরে ঢোকামাত্র সিনামনের ঘ্রাণ পায়। দেখলাম শিহাব টেবিলের ওপর কনুই রেখে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। হাতে ধরা সেলফোন বেজে চলেছে ক্রমাগত। সে ধরছে না। সেলফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু অপলক। আমি চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। শব্দ পেয়ে শিহাব একবার মুখ তুলে তাকালো আমার দিকে। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। বেয়াদ্দবটাকে দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অসহ্য! আসলে এখন আমার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এই যেমন কফির মগে চামচ নাড়ার শব্দটা অসম্ভব বিরক্ত লাগছে। মন চাচ্ছে চিৎকার করে বলি, ‘উফ শুভ্রাদি! থামো তো!’
শুভ্রাদি কিচেন থেকে এসে কফির মগ হাত থেকে নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। বললো, ‘ওমা! তোরা দুজন মুখটাকে এরকম হাঁড়ির মতো বানিয়ে রেখেছিস কেন? কথাবার্তা বল!
আমি কিছু বলার আগেই শিহাবকে ক্যাটক্যাট করে বলতে শুনলাম, ‘সবার সাথে কি কথাবার্তা জমে? তাছাড়া আমার টেস্টটা একটু অন্যরকম। অনেক রিফাইন্ড। আমি যার তার সাথে চট করে মিশতে পারি না।’ কথাটা বলে ও আড়চোখে একবার তাকালো আমার দিকে।
আমার মাথা দপ করে জ্বলে উঠল। রাগটা আর কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারলাম না। ছেলেটার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে গলায় বিষ ঢেলে বললাম, ‘তুমি ওই কাজটা কেন করলে?’
শিহাব বিস্মিত, ‘কোন কাজ?’
কত বড় শয়তান! ভাবটা এমন দেখাচ্ছে যেন সে কিছুই জানে না। শুভ্রাদির সামনে কথাটা বলতে আমার রীতিমতোন লজ্জা লাগছে। ওর বয়ফ্রেন্ড যে রাস্তার মধ্যে হুট করে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিল এই কথাটা মুখ ফুটে কী করে বলি? শুভ্রাদি নিশ্চয়ই দেখেনি দৃশ্যটা। দেখে থাকলে এই বেয়াদবকে আচ্ছা মতো বকে দিত। হঠাৎ মনে হলো শুভ্রাদির জানা দরকার যে, যাকে বিয়ে করার জন্য সে মরমে মরে যাচ্ছে সেই বিশেষ ব্যক্তিটি সুযোগ পেলেই মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া, কোলে তুলে নেয়া… এমনই সব বাজে কাজ করে অভ্যস্ত। আমি আর এক মুহূর্তও দেরি না করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, ‘শুভ্রাদি শোনো, তোমার বয়ফ্রেন্ড আজকে মাঝরাস্তায় সবার সামনে আমাকে কোলে নিয়েছে।’
শুভ্রাদি স্তম্ভিত হয়ে গেল একদম, ‘কী বলছিস?’
শিহাবের মুখটা হা হয়ে গেছে! আমি চোখের কিনার দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ওর তাম্রবর্ণের গালে লালচে একটা আভাস পড়েছে। খয়েরি চোখের মণি দুটো যেন এক্ষুনি কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। আমার খুব মজা লাগছে ছেলেটার এই নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে। মনে মনে লাফাচ্ছি আমি। হা হা হা! এখন বোঝো মজা। আমি নাকি ডিজাস্টার! ডিজাস্টারের দেখেছো কি ড্যুড? আসল ডিজাস্টার তো এবার আসবে তোমার জীবনে!
—‘কীরে শিহাব? রুশমি এসব কী বলছে?’
শিহাবের মুখে কথা নেই। আমি মিটিমিটি হাসছি আর গরম গরম প্যানকেকের ওপর মেপল সিরাপ ছড়াচ্ছি। আমার মনটা ওকে জব্দ করার আনন্দে গুনগুন করে গান গাইছে। আমি মুহূর্তের জন্য ভুলে গেছি যে কালকে আমার বিয়ে। তাও আবার অতিশয় বৃদ্ধ এবং বদখত এক লোকের সাথে!
—‘মাই গড! ইজ শী ক্রেজি অর হোয়াট?’ শুনতে পাচ্ছি শিহাব শুভ্রাদির সাথে কথা বলছে। ওর কণ্ঠ উত্তেজিত এবং রাগান্বিত। ও বলে চলেছে, ‘লিসেন শুভ্রাদি, ইউ হ্যাভ টু ট্রাস্ট মি। দিজ গার্ল? …ও মাই গড! আই ডোন্ট নো হোয়াট টু সে! দ্যা ট্রুথ ইজ …এই স্টুপিড মেয়েটাকে আমি হেল্প করেছি। ও রাস্তার মধ্যে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাচ্ছিল। আমি হেল্প না করলে এতক্ষণে হাসপাতালে থাকতো।’
—সেকী! চিৎপটাং হয়ে যাচ্ছিল কেন?’
—‘রাস্তায় বরফ জমে গিয়েছিল। বরফের ওপর হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল।’
শুভ্রাদিকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে এখন। ও একবার আমার দিকে আরেকবার শিহাবের দিকে তাকাচ্ছে। ওর ঘাড়টা স্প্রিং এর মতো ডান বাম করে যাচ্ছে ক্রমাগত। আমি কাঁটাচামচের মাথায় প্যানকেক গেঁথে মুখে পুরে দিচ্ছি ধীরে সুস্থে। আমার মাথা এখন ঠান্ডা।
—‘তুই পড়ে যাচ্ছিলি?’ শুভ্রাদির প্রশ্ন।
আমি প্যানকেক চিবোতে চিবোতে উদাস গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ যাচ্ছিলাম। সেজন্য কোলে নিতে হবে নাকি?’
শিহাব এবার গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে বলল, ‘ওটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এই মেয়েটা আমার গায়ের ওপর পড়ে যাচ্ছিল। হাঁটতে পারছিল না। আমারও পা টলছিল। সেই অবস্থায় পিচ্ছিল বরফের ওপর খুব বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ বলে মনে হয়নি আমার। তাই যত দ্রুত সম্ভব জায়গাটা থেকে সরে পড়েছি। আমি কি শখ করে ওকে কোলে নিয়েছি নাকি? একে তো গাড়ি চালাতে পারে না। রাস্তা ঘাটে এক্সিডেন্ট করে বসে, তার ওপর বড় বড় কথা। একেই বলে চোরের মায়ের বড় গলা।’
শুভ্রাদির মুখ কালো হয়ে গেছে। চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়েছে ও। আমি টের পাচ্ছি শিহাব আমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্রাদি বলল, ‘রুশমি তুই ভুল বুঝেছিস। শিহাব তোকে হেল্প করার জন্যেই কাজটা করেছে। ও মোটেও খারাপ ছেলে না।’
—‘হেল্প তো অন্যভাবেও করা যেত।’ আমি বললাম।
—‘আমি কীভাবে মানুষকে হেল্প করব সেটা এখন তোমার মতো একটা স্টুপিডহেড মেয়ের কাছ থেকে শিখতে হবে?’ শিহাব এবার সরাসরি আক্রমণ, করে বসল আমাকে।
আমিও যেন ঝগড়া করব বলেই প্রস্তুত হয়ে ছিলাম মনে মনে, সুযোগ পাওয়া মাত্র ঝেঁঝে উঠলাম একদম, ‘আমাকে স্টুপিড ডাকছ কোন সাহসে? মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছ ক্রমাগত। বেয়াদব ছেলে!’
শিহাব তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে। হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠে বলল, ‘আমি বেয়াদব? তুমি নিজে কী?
দেখতে পেলাম রাগে ওর চোয়াল দুটো পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। গালের চামড়া লাল। মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি তেড়ে আসবে আমাকে আঘাত করার জন্য। আমিও দমবার পাত্রী নই।
—‘আমি আর যাই হই না কেন অ্যাটলিস্ট তোমার মতো পারভার্ট নই।’ শিহাব হতভম্ভ হয়ে গেল, ‘আমি পারভার্ট?’
—‘হ্যাঁ পারভার্ট!’
বুঝতে পারছি আমার ভেতরে কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। মাথার ভেতর সর্বক্ষণ বৃদ্ধ এবং বদখত এই দুটো শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে। গোটা পৃথিবীটাই আমার কাছে এখন বৃদ্ধ এবং বদখত বলে মনে হচ্ছে। পৃথিবী চুলোয় যাক, শুভ্রা শিহাবের সম্পর্ক ভেঙে যাক, আমার কী? আমার তো বিয়ে হচ্ছে বৃদ্ধ আর বদখতের সাথে… হায় আল্লাহ! শেষমেশ বৃদ্ধ আর বদখত?
শুভ্রাদি বলছে, ‘প্লিজ তোরা ঝগড়া করিস না। দুজনেই ভীষণ ইমম্যাচিওর আচরণ করছিস। হয়েছে কী তোদের?’
শিহাব পা বাড়িয়েছে ততক্ষণে। শুভ্রাদি ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কোথায় চললি? ব্রেকফাস্ট করে যা।’
—‘ইম্পসিবল! এরকম অসভ্য একটা মেয়ের সাথে এক টেবিলে বসে নাশতা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘আমি অসভ্য নই। তুমি অসভ্য!’
শিহাব ঝট করে ঘুরে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘একদম চুপ! আরেকটা কথা বললে আবার কোলে তুলে নেব! দেখি তুমি কী করতে পারো!’
দপ করে নিভে গেলাম আমি। কী সাংঘাতিক! কী মারাত্মক! কী বাজে! শুভ্রাদির দিকে তাকিয়ে দেখি ও মিটিমিটি হাসছে। ওই হাসি দেখে আরো রাগ ধরে গেল আমার।
—‘তুমি হাসছ?’
শুভ্রাদি ঠোঁট চেপে হাসি থামাবার চেষ্টা করে বলল, ‘তুই একটা পাগলী আমার বয়ফ্রেন্ড মোটেও খারাপ ছেলে নয়।’
আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম, ‘শুধু হাসিটা ছাড়া অন্য কিছুই ভালো না তোমার বয়ফ্রেন্ডের।’
শুভ্রাদি খালি প্লেটে ওয়াফেল তুলে নিতে নিতে বলল, ‘ভালো মতো খেয়াল করলে দেখতি …আরো অনেক কিছুই ভালো।’
—‘দেখতে চাই না।’
—‘না দেখাই ভালো। মেয়েরা নাকি এমনিতেই ওর পেছনে লাইন দিয়ে আছে। একজন কমে গেল। এটা তো আমার জন্য সুসংবাদ।’
—‘কোনো মেয়ে লাইন দিয়ে নেই। ওগুলো সব মিথ্যা কথা। বানোয়াট!’
শুভ্রাদি মিটমিটিয়ে হাসে, কিছু বলে না। ট্রের ওপর নাশতা সাজিয়ে নিল। সম্ভবত ওই বেয়াদব ছেলেটার জন্য। আমি শুভ্রাদির দিকে তাকিয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু ভাবছি অন্য কিছু। আমার এই মুহূর্তে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, শুভ্রাদি তুমি শিহাবের কাছে যেও না। আমার পাশে এসে একটু বসো। আমার বড়ই বিপদ। কালকে আমার বিয়ে! বিয়েটা হচ্ছে একজন অতিশয় বৃদ্ধ এবং বদখত লোকের সাথে! আমি এখন কী করব? কথাগুলো বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু গলা ফেটে কিছুতেই বেরোচ্ছে না। আমার চোখের কার্নিশে এখন জল উপচে উঠেছে। জলের প্রাচীরের ভেতর দিয়ে আমি শুভ্রাদির চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম।