হৃদয়াক্ষী – ১৬

রুশমি 

ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেছে। এতোটা বিপন্ন বোধ করছি যে মানুষটার চোখে চোখে তাকাতে পর্যন্ত পারছি না। প্রথমেই হাজার রকম প্রশ্ন করে বসেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর আমি তাকে কী করে দেই? উত্তেজনার বশে বলে ফেলেছি ইচ্ছে হলে থাকো, না হলে চলে যাও। এখন যদি সত্যিই চলে যায়? তখন কী হবে? কোন মুখে আবার আটকাবো ছেলেটাকে? হায় আল্লাহ! কী করব আমি? কিছু তো বুঝতে পারছি না। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আগুন চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। মুখ থমথম করছে রাগে। ও পাল্টায়নি একটুও। আগের মতোই একরোখা, জেদি আর অহংকারী রয়ে গেছে। এতো দেশ বিদেশ ঘুরলাম, এতো লোকের সাথে মেলামেশা করলাম, কই এমন অদ্ভুত ব্যক্তিত্বের মানুষতো একটাও চোখে পড়ল না। এই চিড়িয়া এক পিসই আছে পৃথিবীতে। এর অদ্ভুত আচার আচরণ শুধু চোখ চেয়ে দেখে দেখেই অনায়াসে সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। টের পাচ্ছি অনেক দিন বাদে আবারও আমার ভেতর পুরনো সেই চাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। স্রোতহীন মন্থর জীবন-নদীতে ফিরে এসেছে তরঙ্গ। উদ্বেগ মিশ্রিত আশ্চর্য এক ভয়ঙ্কর সুখে মথিত এবং ব্যথিত হচ্ছে হৃদয়। 

—‘কেমন লাগছে এসব?’ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে প্রশ্ন করল ও। চোখে এখনও আগুন। কিন্তু গলার স্বর পূর্বাপেক্ষা নমনীয়। বোঝা যাচ্ছে স্বাভাবিক হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে বেচারা। 

—‘কীসব?’ আমি লেকের পানির ওপর চোখ রাখলাম। 

—‘ফার্মল্যান্ড, বিজনেস, স্বাধীন জীবন এইসবই তো তোমার স্বপ্ন ছিল, তাই না? 

কড়া কড়া কথাগুলো যেন কথা নয়, একেবারে চাবুকের সপাং সপাং আঘাত। আমি মিনমিন করে বললাম, 

—‘ভালো লাগছে, খারাপ লাগবে কেন? 

—‘তোমার আম্মু কেমন আছেন?’ 

—‘আলহামদুলিল্লাহ।’ 

—‘পিচ্চি দুইটা?’ 

— ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।’ একটু থামলাম। তারপর খুব সাবধানে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার বাবা মা কেমন আছে?’ 

বাদামি চোখের তারায় ধক করে জ্বলে উঠল বহ্নিশিখা। ঠোঁটের দুই প্রান্তে ফুটে উঠল তীক্ষ্ণ ভাঁজ। 

—‘সৌজন্যর খাতিরে প্রশ্ন করা? নাকি সত্যিই মন থেকে জানতে চাইছ?’ চুপ করে গেলাম। নত হয়ে এলো চোখ। 

—‘পাঁচ বছর আগে তুমি যখন আমাকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছিলে তোমার জীবন থেকে, তখন আমার বাবা, মা, ভাই প্রত্যেকেই হাসপাতালে অ্যাডমিটেড ছিল। তোমার কাছে এসবের কোনো মূল্যই ছিল না। আজ এতদিন পরে এসে জানতে চাইছ, ওরা কেমন আছে? ইজ দ্যাট সাম কাইন্ড অফ জোক?’ 

আমার চিবুক গলার সাথে লেগে গেছে। বাঁধভাঙা একটা কান্না সুড়সুড়ি দিচ্ছে গলার কাছে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্নাটা ঢোঁক গিলে ফেলার চেষ্টা করছি। 

— কেন এরকম করেছিলে আমার সাথে? কী অপরাধ ছিল আমার?’ গলায় নির্বিকারত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বললাম, ‘একই প্রশ্ন কেন বারবার করছ? বললাম তো আমার ইচ্ছে হচ্ছিল না তোমাদের সাথে থাকতে। তোমার বাবা-মা, ভাই কাউকেই আমার পছন্দ ছিল না। তাই মুভ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’ 

—‘সিরিয়াসলি? তুমি কি ভেবেছ তোমার এসব লেইম কথাবার্তা আমি বিশ্বাস করব?’ 

কথাটা বলে ও খপ করে আমার ডান হাতটা খামচে ধরল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘টেল মি দ্যা ফাকিং ট্রুথ অর আই অ্যাম গননা রিপ ইওর হ্যান্ড ইন হাফ রাইট নাও।’ 

ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলাম, ‘ছাড়ো শিহাব! লাগছে!’ 

ওর ক্রুর চোখদুটো জন্তুর মতো জ্বলছে। হিংস্র গর্জন বেরোচ্ছে যেন গলা দিয়ে। ভয়ে আতঙ্কে আর যন্ত্রণায় কান্না পাচ্ছে আমার। ঠিক সেই সময় ফার্মের কর্মচারী রবার্তো প্রবেশ করল ব্যাক ইয়ার্ডে। দৃশ্যটা দেখে ও থমকে গেছে। চোখ বড় বড়, মুখ ফ্যাকাশে। ছেলেটির উপস্থিতি টের পাবার পর শিহাব আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে 

—‘কিছু বলবে?’ আহত হাতের কব্জি সামলে নিয়ে ভারী বিব্রত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম রবার্তোকে। 

রবার্তোর ইংরেজি বড্ড খারাপ। স্প্যানিশ ভাষায় বলল, —‘একজন লোক এসেছে নিউইয়র্ক থেকে। খামারে অপেক্ষা করছে। তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম ফোন ধরলে না তো।’ 

স্কুলে আমার স্প্যানিশ ভাষা শিখতে হয়েছিল। সেই বিদ্যা এখন খুব ভালোই কাজে লাগছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে একটু তটস্থ ভাবে বললাম, ‘কে এলো এই অসময়ে। চলো দেখি।’ 

মাথাটা ভনভন করে ঘুরছিল। এই বুদ্ধিভ্রষ্ট পাগল ছেলেকে আমি সামলাবো কী করে? আতঙ্কে আমার নিজেরই বোধ বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। খামারে এসে দেখলাম আম্মুজান যে বাংলাদেশি ছেলেটার কথা বলেছিল সেই ছেলে নিউইয়র্ক থেকে এসে পড়েছে। বুচার রুমে মাংস কাটাকাটি হচ্ছিল। আমরা সম্প্রতি আশেপাশের মুসলিম পরিবার গুলোর কাছে হালাল গরুর মাংস বিক্রি করা শুরু করেছি। নিউইয়র্ক থেকে আগত ছেলেটা হা করে মেশিন দিয়ে মাংস কাটা দেখছে। মনে হচ্ছে কাজ শেখার আগ্রহ আছে। বয়স কত ঠিক ঠাওর করা যায় না। লম্বা, ছিপছিপে শরীর। গায়ের রং বেশ ফর্সা। মুখে মাস্ক। চোখদুটোতে কেমন যেন দুঃখী দুঃখী ভাব। তাড়াহুড়োতে আমি মাস্ক পরতে ভুলে গেছি। আমাকে দেখা মাত্র ছেলেটা বিনয়ে গলে গিয়ে সালাম দিল। ভাবখানা এমন যে এর মাঝেই আমি ওর বস হয়ে গেছি। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আসায় বেচারা ক্লান্ত। খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা প্রশ্ন করায় জানালো, পথে খেয়ে নিয়েছে। কাজের কথা বলার মতো মানসিক স্থিরতা এখন আমার নেই। মুখ দেখে কেউ বুঝতে পারছে না কিন্তু আমার মনের তলানিতে সুনামি হচ্ছে। অনেক কষ্টে ভেতরকার উদ্বেগ উত্তেজনা আড়াল করার চেষ্টা করছি। ছেলেটার সাথে ভদ্রতাসূচক কিছু কথা বললাম। এতো দূর থেকে এসেছে নিশ্চয়ই বিশ্রাম প্রয়োজন এই ভেবে বাড়ির ভেতর নিয়ে এলাম। শিহাবকে যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে তার পাশের ঘরটা খালি। সেই ঘরেই ছেলেটাকে নিয়ে এলাম। বললাম, আপনি রেস্ট নিন। আশপাশটা ঘুরে দেখুন। কাল সকালে জরুরি আলাপ সেরে নেয়া যাবে। 

ফিরে এসে দেখি শিহাব অস্থিরভাবে পায়চারি করছে উঠোনে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আমাকে দেখতে পেয়েও কোনো ভাবান্তর পরিলক্ষিত হলো না তার মুখে। যন্ত্রচালিতের মতো পায়চারি করতে লাগল। আমি চেয়ার টেনে বসলাম। শিহাব আমার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে গুমোট গলায় বলল, 

—‘তোমার যদি আমাকে কিছু বলার না থাকে কিংবা বলতে না চাও তাহলে আমার আর এখানে থেকে সময় নষ্ট করে কাজ নেই। আমি বরং চলে যাই।’ 

অপ্রত্যাশিত কথাটা শোনামাত্র আমার বুক এমন ভাবে মোচড় দিয়ে উঠল যেন এইমাত্র মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আজরাইল হাজির হয়েছে সামনে। এর মাঝেই ফিরে যাবার জন্য এতো তাড়া কেন? কোথায় যাবে? সাশার কাছে? এর মানেটা কী দাঁড়ালো? অতীতের দুর্ভেদ্য রহস্য ভেদ করাই তাহলে আমার বাড়িতে থেকে যাবার পেছনের মূল কারণ? এর বাইরে অন্য কোনো কারণ নেই? ভালোবাসা না থাকুক একটুখানি মায়াও কি আর অবশিষ্ট নেই? না নেই তো! থাকলে তো এতো দ্রুত চলে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠত না। মনটা ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে। ভালো হয়েছে একে আমি সত্যটা বলিনি এমনিতেই এর মধ্যে পূর্বের আবেগ অনুভূতির ছিটে ফোঁটাও উপস্থিত নেই হয়তো সত্যটা জানার পর আমি তার কাছে আরো বেশি ঠুনকো হয়ে উঠতাম। কী আশ্চর্য! ক্ষণকাল আগেও আমি ভাবছিলাম ও বুঝি আমাকে আগের মতোই ভালোবাসে। অন্তত ওর চোখের দুটি তারায় আমি ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পাইনি। কিন্তু মানুষটার মনের অন্তর্নিহিত ভাব আমার সামনে এই মুহূর্তে পরিষ্কার ভাবে ধরা দিয়েছে। ভালোবাসার দীপ্তি নয়, বরং প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে ওখানে। 

—‘কিছু বলছ না যে?’ 

দুর্ভাবনার ঘোর কাটাতে একটু সময় লাগল। কোনোমতে সামলে নিয়ে বললাম, ‘বেশ তো! যেতে চাইছ যখন যাবে। কখন বেরোতে চাও?’ 

শিহাব সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘এইতো, সন্ধ্যে নামার আগেই।’ 

শিহাব 

রুশমির মুখে একটা থমথমে ভাব খেলছে। চোখে চাপা রাগ। বুঝতে পারছি আমার চলে যাবার প্রস্তাব শুনে ও খুশি হয়নি। কিন্তু ভাবটা এমন দেখাচ্ছে যেন আমার থাকা না থাকায় তার কিছুই এসে যায় না। ওকে আমি চিনি। বুক ফাটলেও মুখে কথা ফুটবে না। এই অন্তর্মুখীতা ধ্বংসাত্মক এবং ভয়ঙ্কর। আমি নিজেও অবশ্য যথেষ্ট ইন্ট্রোভার্ট। অনেকে এটাকেই ব্যক্তিত্ব বলে। আমি আমার এই স্বল্প পরিসরের জীবনে একটা ব্যাপার খুব ভালো ভাবে উপলব্ধি করেছি যে ব্যক্তিত্ববান মানুষদের পক্ষে জীবনে সুখী হওয়াটা খুব দুষ্কর ব্যাপার। এরা সুখের চাইতে আত্মসম্মানকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলে। তাই দিনশেষে এদের মতো নিঃসঙ্গ মানুষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যায় না। 

আমি সিগারেট শেষ করে চেয়ারে বসলাম। টেবিলে রাখা স্যানিটাইজার দিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজ করলাম। রুশমি এখন মনোযোগ দিয়ে হাতের আঙুলের নখ কামড়াচ্ছে। সেই পুরনো দিনের মতো। 

—‘এখনো নখ কামড়াও?’ 

—‘হ্যাঁ কামড়াই।’ 

—‘আমি ভেবেছিলাম তুমি বড় হয়ে গেছ! 

রুশমি মুখ থেকে হাতের আঙুল সরায়। তেরছা গলায় বলে, ‘বড় তো হয়েছি নিঃসন্দেহে। সময়ের সাথে সাথে কিছু মানুষ বড় হয়, কিছু মানুষ বুনো হয়। এটাই নিয়ম।’ 

শেষের কথাটা মনে হয় অপমান ছিল। আমি বড় হইনি, বুনো হয়েছি। এটাই বলতে চাইল সে। সরু চোখে ওকে একবার ভালো মতো দেখলাম। সুখ, শান্তি এবং সফলতা নিশ্চয়ই ওকে আজ সত্যিকার অর্থে বড় করে তুলেছে আর অপরদিকে অতৃপ্তি, বিষণ্ণতা এবং হতাশার অন্ধকার সাগরে নিরবচ্ছিন্ন নিমজ্জিত হতে হতে আমি ধীরেধীরে সভ্য থেকে অসভ্য হয়ে উঠেছি। ‘বুনো!’ শব্দটা বোধহয় আমার সাথে পুরোপুরিই মানানসই। 

আকাশে রোদ ছায়ার লুকোচুরি খেলা চলছিল। উতলা বাতাসে এদিক সেদিক উড়ছিল হলদে রোদ। বাতাস বইছে আর সেই বাতাসে ঝিকমিক করে রোদ উড়ছে। দৃশ্যটা ভারী সুন্দর। এই মুহূর্তে কয়েক টুকরো উড়ন্ত রোদ স্বচ্ছ কাচের টুকরোর মতো ঝিকোচ্ছে রুশমির নাকের ডগায়, পাতলা ঠোঁটে আর ঠোঁটের নিচের কালচে তিলে। কী যেন আছে ওই মুখে। গভীর কিছু! এতো জায়গায় ঘুরলাম, এতো মানুষ দেখলাম, কিন্তু এমন জাদু মাখানো আশ্চর্য সৌন্দর্য তো কোথাও পেলাম না! মন চাইছে ওকে বলি, রুশানিয়া, একটাবার খোলা চুলে এই আশ্চর্য রোদটার নিচে এসে দাঁড়াবে? ঝলমলে দিনের আলোয় খোলাচুলে তোমাকে কতদিন দেখি না! 

বলতে চাইলাম এক কথা কিন্তু বললাম সম্পূর্ণ অন্য কথা। 

—‘বড় হওয়া কিংবা বুনো হওয়ার ওপর মানুষের কিন্তু হাত নেই। জীবনের সুখ দুঃখ, প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সর্বোপরি পারিপার্শ্বিক অবস্থাই মানুষের পরিণতির জন্য দায়ী।’ 

—‘একজন সুশিক্ষিত মানুষ নিশ্চয়ই পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে শিখবে।’ 

—‘বেশ, তুমি তো অনেক শিখেছ মনে হয়। ইউ আর আ সাকসেসফুল উওম্যান। স্বাধীন, স্বাবলম্বী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ! এতো কম বয়সে এতো কিছু কজন পারে?’ 

—‘তুমি কি আমার সাথে রসিকতা করছ?’ 

—‘একেবারেই না! তোমার সাফল্য দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।’ একটু থেমে আবার বললাম, ‘এই ল্যান্ড কি তুমি কিনে নিয়েছ?’ 

—‘উঁহু, লিজ নিয়েছি।’ 

—‘কত বড় জায়গাটা?’ 

—‘তিরিশ একর। ফার্ম হিসেবে একেবারেই ছোট।’ 

—মন্দ কী? ধীরেধীরে বড় হবে।’ 

—‘ইন শা আল্লাহ।’ 

—‘নৌকাটা কার?’ 

—‘এই জায়গার মালিকের।’ 

— ‘মালিক কোথায় থাকে?’ 

—‘কানাডা।’ 

আমি চুপ করে গেলাম। প্রকৃতিতে শব্দের অভাব নেই। পাইন গাছের গুঁড়িতে বসে লাল ঝুটি ওয়ালা এক কাঠঠোকরা ঠকঠক করে কাঠ ঠোকরাচ্ছে। লেকের পানি ঢেউ ভাঙছে কলকল শব্দে। দূর থেকে গরু, ছাগল আর ঘোড়ার ডাক ভেসে আসছে। লেকের ওপারের জঙ্গলে হঠাৎ হঠাৎ শেয়াল ডাকছে। রুশমি আমার দিকে তাকাচ্ছে না। প্রকৃতি দেখছে। যেন অচেনা জায়গাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চিনে নিচ্ছে। হঠাৎ বলল, ‘তুমি চাইলে নৌকা ভাসাতে পার। মাছ ধরতে পার।’ 

—‘আমার মাছ ধরার লাইসেন্স নেই। তোমার আছে? 

—‘হ্যাঁ আছে, তুমি যাবে?’ 

—‘মাছ ধরার কোনো ইচ্ছে নেই। তবে পানি খুব পরিষ্কার। সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করছে। 

রুশমি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে আসি। মাছ ধরতে পারলে তোমাকে বারবিকিউ করে খাওয়াবো।’ 

কথাটা বলে ও এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না আর। ছুটে চলল বাড়ির ভেতর। 

রুশমি 

আমার কিচেনের পেছনে বেশ বড়সড় একটা প্যান্ট্রি আছে। ওখানেই মাছ ধরার সরঞ্জাম রাখা ছিল। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে ফিরে এসে দেখি শিহাব নৌকাটা খুঁটি থেকে খুলে নিয়েছে। ঠেলে ঠেলে নামাচ্ছে জলে। আমি এগিয়ে যেতেই বলল, ‘উঠে পড়!’ 

নৌকো তখনও পুরোপুরি জলে নামেনি। অর্ধেক সেঁটে আছে ডাঙায়। আমি ছিপ বড়শি নিয়ে উঠে পড়লাম। এর আগে কখনো এই নৌকোতে চড়া হয়নি। আজকে চড়তে পেরে ভালো লাগছে। শুধু ভালো লাগছে বললে ভুল হবে। বলতে হয় মনটা একদম আনন্দে ঝুমঝুম করছে। গত পাঁচ বছর যাবৎ যেন একটা গাঢ় বিষণ্নতার জাল আমাকে জাপটে ধরে রেখেছিল। কোনো কিছুতেই সুখ খুঁজে পেতাম না। প্রতিটা কাজ করতাম দায়িত্ব পালনের খাতিরে। যন্ত্রচালিতের মতো। আজকে এতদিন পরে আমার মনের সবকটা বদ্ধ জানালা যেন খুলে গেলো। ঝরঝরে তাজা হাওয়ায় ভরে গেলো বুক। আজকে অন্তত এই মুহূর্তে আমার কোনো দুঃখ নেই। কারণ আমার জীবনের সবচাইতে প্রিয় মানুষটা এখন আমার সাথে আছে, পাশে আছে। 

নৌকোটা একটু দুলছিল। পানিতে শব্দ হচ্ছে ছলাৎ ছলাৎ। শিহাব দুহাতে দুটো বৈঠা নিয়ে নৌকা বাওয়া শুরু করেছে। ওর ঠোঁটে একটা চিলতে হাসি লেগে আছে। চোখে সেই হাসির রেশ পড়েছে। চিবুকটা উঁচু। গলার সুডৌল কণ্ঠমণি দৃশ্যমান। 

—‘তুমি কি এখন বড়শি ফেলবে? নৌকা দাঁড় করাবো?’ ও প্রশ্ন করল। আমরা সবে মাত্র লেকের মাঝামাঝি এসেছি। লেকটা খুব বেশি প্রশস্ত নয়। সরুই বলা চলে। 

—‘না আরেকটু পরে।’ 

মাথার ওপরের আকাশ স্নিগ্ধ নীল রংয়ে মাখামাখি হয়ে আছে। ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ পালকির মতো চড়ে বেড়াচ্ছে নিশ্চিন্তে। আমাদের নৌকোর আশেপাশে এক পাল সাদা পালকের হাঁস প্যাকপ্যাক শব্দ করে সাঁতার কাটছিল। খাবারের খোঁজ করছে মনে হয়। লেকের দুপাশেই রেডহিলসের লালমাটির জঙ্গল। ও পাড়ের জঙ্গলে আমার দোতলা সাদা রংয়ের বাড়িটা শিরদাঁড়া সোজা করে দাপট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনের হ্যামক দুলছে হাওয়ায়। আর এ পাড়ের জঙ্গলে কয়েকটা হরিণ লেকের ধারে জড়ো হয়ে জল পান করছে। নৌকোটা ঢেউ ভেঙে দুলে দুলে চলছে। আমি এক মাথায়, শিহাব অন্য মাথায়। আমাদের মাঝখানে তিন চার হাতের দূরত্ব। 

—‘টিহাউজটা কোনদিকে? 

হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসল। চমকে উঠলাম। বুক কাঁপছে দুরদুর করে। ভালোলাগা, ভয়, লজ্জা এমনই সব পাঁচমিশালি অনুভূতিতে অবশ হয়ে আসছে ভেতরটা।

—‘তোমার মনে আছে?’ 

একটু অদ্ভুত চোখে চাইলো সে আমার দিকে। তারপর কেমন অন্যরকম গলায় বলল, ‘আমার সবকিছু মনে আছে!’ 

চোখ সরিয়ে নিলাম অন্যদিকে, ‘ট্রিহাউজ এখনো বানানো হয়নি।’ 

ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিলাম। তারপর আবার বললাম, 

—‘ডিনারে কী খাবে? যদি মাছ না পাই?’ 

—‘এমন কিছু, যা খেলে পেট ভরে না কিন্তু মন ভরে।’ 

এই কথাটা সে আগেও বলেছিল। অ্যাশবার্নের বাড়ির প্যাটিওতে বসে। আমি এখন এই রসিকতার অর্থ জানি। আর জানি বলেই অস্বস্তি আর নষ্টালজিয়ায় কেমন কুঁকড়ে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। আমার অবস্থা দেখে ও হাসতে লাগল, ‘ভয় পেলে নাকি?’ আমি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। অবাক চোখে সম্মুখে বসা মানুষটাকে দেখতে লাগলাম। ও হাসছে। ওর গালের চামড়ায় কয়েকটা ভাঁজ যুক্ত অলৌকিক নকশা ফুটে উঠেছে। আকাশের সাদা মেঘের রুপালি প্রাচীর ভেদ করে একগুচ্ছ কমলা রংয়ের বিকেল-গন্ধি রোদ নেমে এসেছিল তখন পৃথিবীর বুকে। ঘিরে ফেলেছিল আমাদেরকে চারপাশ থেকে। সেই কমলা রংয়ের ফুরফুরে মায়াবী রোদের ভেতর দিয়ে আমি আমার প্রিয় মানুষটার অলৌকিক হাসিখানা নিবিড় চোখে দেখতে লাগলাম। কী সুন্দর মাদক মাদক হাসি! দেখতে দেখতে নেশা লেগে যায়! 

এই মুহূর্তে কোনো শব্দ নেই আশেপাশে। শুধু জলের শব্দ আর হাঁসের ডাকাডাকির শব্দ। বাতাসে লেকের বুকের আঁশটে গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে আমি ওই গন্ধটা পাচ্ছি না। তার বদলে অদ্ভুত সুন্দর একটা ভালো লাগার ঘ্রাণ পাচ্ছি। ভালো লাগার ঘ্রাণটা ঠিক কী রকম তা কেবল মাত্র ভালোবাসার মানুষের পাশে থাকলেই টের পাওয়া যায়। 

—‘করোনা কী রকম প্রভাব ফেলছে তোমার বিজনেসে?’ প্রশ্ন করল সে। 

—‘তেমন খারাপ প্রভাব পড়েনি। কারণ অর্গানিক ফুড তো মানুষকে খেতেই হবে। এগুলো তো এসেনশিয়াল। কোনো শৌখিন জিনিস নয়। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি যে এই প্যান্ডেমিকের সময় দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছ। এটা কি ঠিক হচ্ছে?’ 

—‘ভুলের কী আছে?’ 

—‘করোনা আক্রান্ত হতে কতক্ষণ? সতর্ক থাকার পরেও মানুষ পার পাচ্ছে না। ইনফেক্টেড হচ্ছে। আমার বাড়ির কাছেই একজন মধ্যবয়সী কাপল থাকে। গত পাঁচমাস স্বামী-স্ত্রী এক মুহূর্তের জন্যও বাড়ির বাইরে বেরোয়নি। আমি গরুর দুধ, সবজি, মুরগি ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার দাবার সপ্তাহে একবার ওদের বাড়ির দরজার সামনে রেখে আসতাম। দাম দিত অনলাইনে। বাকি জিনিসপত্রও অনলাইনেই অর্ডার করত! কিন্তু কী দুর্ভাগ্য দ্যাখো এতগুলো দিন টানা বাড়িতে অবস্থান করার পরেও শুনলাম গত সপ্তাহে মহিলার করোনা পজিটিভ এসেছে। অতএব সতর্ক থেকেও লাভ হচ্ছে না। আর তুমি কিনা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছ?’ 

—‘সতর্ক থেকেও যদি লাভ না হয় তাহলে সতর্কতার দামটা আর থাকল কোথায়? তাছাড়া করোনা সকলেরই হবে। এই ভাইরাস থেকে অত সহজে মুক্তি পাচ্ছে না মানবজাতি। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। আজ নয় কাল সে আসবেই। যখন আসবে হাসিমুখেই তাকে বরণ করে নেব।’ 

–‘এসব বলতে নেই।’

—‘তোমার কথা বলো। বই পড়ার অভ্যাস আছে এখনো?’ 

—‘আগের মতো পড়া হয় না। সময় কই?’ 

—‘তোমার বুকশেলফে বাংলা অভিধান দেখলাম। কী করো বাংলা ডিকশনারি দিয়ে?’ 

—‘মাঝখানে কিছু লেখালেখি করেছিলাম। বাংলায়।’ 

—‘আচ্ছা?’ 

—‘হু, তুমি এখনো গান লিখো?’ 

শিহাব অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল—’শুধু গান নয়। আরো কিছু লিখেছি স্মৃতি থেকে। 

—‘তাই? 

—‘হুম, তুমি কী লিখছ?’ 

আমি তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারলাম না। আমি যে নিজের জীবন নিয়েই লিখছি কেন যেন এই সত্যটা ওকে জানাতে একটু দ্বিধা হচ্ছে। অপ্রস্তুত গলায় বললাম, ‘তেমন কিছু না, হঠাৎ লেখক হবার ভূত চেপেছিল মাথায় তাই একটু চেষ্টা করেছিলাম।’ 

—‘কিন্তু বাংলায় কেন? ইংরেজিতে কেন নয়?’ 

—‘তুমি তো জানো আমি বাংলা ভালোবাসি। বাংলায় লিখছি জানলে বাবাজান কী যে খুশি হতো!’ 

বাবাজানের প্রসঙ্গ উঠতেই হঠাৎ আমার গলার স্বরটা অন্যরকম হয়ে গেলো। চোখের দৃষ্টি হয়ে উঠল মেঘাচ্ছন্ন। 

—‘তোমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম। আমি দুঃখিত রুশমি!’ 

চুপ করে গেলাম। মনটা হঠাৎ গুমোট গুমোট লাগছে। আচ্ছা, শিহাব কি ভুলে গেছে যে ও আমাকে রুশমি নয়, রুশানিয়া ডাকত? বললাম, 

—‘তোমার লেখাটা পড়তে ইচ্ছে করছে।’ 

নৌকাটা এখন থেমে আছে হ্রদের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। শিহাব বৈঠা দুটো দুপাশে রেখে হাত গুটিয়ে বসে আছে। বাতাসে হালকা দুলছে নৌকা। শিহাব বলল, 

—‘ছোটমামা বলছিল ওর পরিচিত এক পাবলিশার আছে। সেই পাবলিশারের সাথে কথা বলবে লেখাটা ছাপানোর ব্যাপারে।’ 

—‘বাহ! এটাতো খুব ভালো খবর!’ 

হঠাৎ ওর গলার স্বর পাল্টে গেলো। যেন খুব জরুরি কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভাবে প্রশ্ন করল, 

—‘তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে?’ 

বিব্রত হয়ে পড়লাম। এসব প্রসঙ্গ না তুললেই কি নয়? অন্য কোনো সাধারণ টপিকে কথা বলা যায় না? সংকুচিত কণ্ঠে উত্তর দিলাম, 

— ‘না।’ 

উত্তর শুনে ও চিবুক উঁচু করে সরু দৃষ্টিতে তাকায়। ঠোঁট বাকিয়ে অনেকটা কৌতুকের ঢঙে বলে, 

—‘সো ফাইভ লং ইয়ারস অ্যান্ড নো বয়ফ্রেন্ড?’ 

—‘নো বয়ফ্রেন্ড।’ 

—‘কীভাবে সম্ভব?’ 

—‘এসব ছাড়াও মানুষের জীবনে আরো অনেক কিছু করার আছে। দেয়ার ইজ আ হোল আদার ওয়ার্ল্ড আউট দেয়ার!’ 

—‘কিন্তু রুশমি একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে তুমি কেন এমন একটা জীবন বেছে নেবে যেখানে…’ 

আমার মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করে উঠল। বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম, ‘এসব ছাড়া কি অন্য কিছু বলা যায়? তুমি এখানে এসেছ অতিথি হয়ে। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে যাবে নিজের জায়গায়। এই অল্পবিস্তর সময়ে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ না তুললেই কি নয়?’ 

ওর মুখটা মুহূর্তের মধ্যে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। চোখের তারায় ধক করে জ্বলে উঠল ক্রোধবহ্নি শিখা। কয়েক সেকেন্ড কুটিল চোখে চেয়ে রইল আমার দিকে। তারপর ক্ষিপ্রতার সাথে বৈঠা দুটো হাতে তুলে নিল। শিরশিরে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। তোমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার আমার নেই। আই অ্যাম ওয়েস্টিং ইয়োর টাইম। আই শুড প্রবাবলি লিভ!’ 

আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম, ‘না মানে, আমরা অন্যকিছু নিয়ে কথা বলতে পারি।’ 

ওর কণ্ঠ থেকে আগুন ঝরতে লাগল, ‘ইচ্ছে করছে না। মিথ্যেবাদী প্রতারক মানুষের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করার রুচি নেই আমার।’ 

আমার মনটা অপমানে একটুখানি হয়ে গেলো। চোখ নামিয়ে নিলাম নিচে। মাছ ধরার কথা ছিল। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করছে না। মন চাইছে লেকের পানিতে ডুব দিয়ে মরি। নৌকাটা ঘাটে আসতে খুব বেশি সময় নিল না। শিহাব এখনো রাগে ফোঁসফোঁস করছে। আমার দিকে তাকাচ্ছে না। আমি বিচলিত, শঙ্কিত এবং বিভ্রান্ত! সত্যিই কি চলে যাবে নাকি? কী আশ্চর্য! কয়েকটা ঘণ্টা অন্তত অতীতের হিসেবনিকেশ ভুলে গিয়ে বর্তমানকে উপভোগ করা যায় না? কেন সেই প্রসঙ্গই বারেবারে টেনে আনতে হবে যে প্রসঙ্গে আমি কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না। 

শিহাব 

মনে হচ্ছে এই সাক্ষাৎ হওয়ার চাইতে না হওয়াটাই ভালো ছিল। এতকাল বেঁচে ছিলাম ওকে আর একনজর দেখতে পাবার আশায়। কিন্তু আজকে আমি এ কী দেখলাম? কাকে দেখলাম? যে সাদাসিধে, অকপট, স্বপ্নপ্রবণ, ভাববিলাসী মেয়েটিকে আমি নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছিলাম সেই মেয়েটি তো হারিয়ে গেছে! ওই কাজল আঁকা চোখের ভেতর এখন শুধুই কুহক সর্বস্ব ইন্দ্রজাল, হারিয়ে গেছে আগের সেই নির্মলতা আর স্বচ্ছতা। হারিয়ে গেছে আমার রুশানিয়া! হারিয়ে গেছে আমার পৃথিবী! 

এই মুহূর্তে যে মেয়েটি আমার সাথে রয়েছে সে নিছকই একজন চতুর খেলোয়াড় এবং প্রবঞ্চক। এর চাইতে তো শুভ্রাও হাজার গুণে ভালো ছিল। আর সাশা… আহারে বোবা কালা ডিজেবল্ড মেয়েটা। মন থেকে ভালোবাসে আমাকে। সেই ভালোবাসার বিনিময়ে কিছুই পায়নি সে। আমি ওকে ইউজ করেছি তারপর স্বার্থপরের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। অন্যদিকে রুশমি নাকি আমাকে ভালোই বাসেনি কখনো! কী আশ্চর্য! কী হাস্যকর! নিজেকে একটা জোকার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে। 

গেস্টরুমে এসে পায়ে জুতো পরে নিলাম। ব্যাগ আগে থেকেই গাড়িতে তোলা আছে। হলওয়ে প্রায়ান্ধকার। এদিকে কোনও জানালা নেই বিধায় সূর্যের আলো পৌঁছুতে পারে না। শ্যান্ডেলিয়ারে মোমবাতি জ্বলছে। সেই আবছা আলোয় দেখতে পেলাম রুশমি আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। 

—‘এখুনি চলে যাচ্ছ?’ 

—‘হ্যাঁ যাচ্ছি।’ 

—ও বলছিলাম যে, ডিনারটা সেরে তারপর রওয়ানা দিলে ভালো হতো না?’ একটা বীভৎস রাগে আমার মস্তিষ্ক ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে রাগটা সংবরণ করার চেষ্টা করে বললাম, ‘তোমার সাথে আমি ডিনার করব কেন? তুমি আমার কে?’ 

রুশমি কিছু বলছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। 

—‘তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছ। তোমাকে যে কতটা ঘৃণা করি সেটা বলে বোঝানোর মতো কোনো শব্দ আমার ডিকশনারিতে নেই। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ! কেন করেছিলে এরকম? কেন আশা দিয়েছিলে মিছিমিছি?’ 

রুশমি চুপ। মাথা অবনত। 

—‘তোমার ফ্রিডম দরকার ছিল? একবার নাহয় চেয়ে দেখতে, আমি পারলে পুরো পৃথিবী দিয়ে দিতাম তোমাকে!’ একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে আবার বললাম, ‘তবে আজ আমার একটাই কষ্ট যে তোমাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবার মতো কোনো ক্ষমতা আমার নেই। কারণ তোমাকে কষ্ট দিলে, সেই কষ্টটা কোনো একভাবে বুমেরাং হয়ে আমার বুকে এসেই আঘাত করবে। তার চেয়ে বরং তুমি ভালো থাকো, যেমনটা আছ। আমি তোমাকে আর বিরক্ত করব না। আর হ্যাঁ, তোমার এই ঠিকানায় ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেব। সাইন করে দিও।’ 

কাষ্ঠপুত্তলিকার মতো অনড় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। আমার মেজাজ আরো চড়ে যাচ্ছে এই নীরবতা দেখে। ওকে পাশ কাটিয়ে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। প্রতারিত, উপেক্ষিত এবং অবহেলিত মন নিয়ে যান্ত্ৰিক পায়ে নেমে এলাম উঠোনে। বাইরে দিনের আলো মরে এসেছে। আকাশে শেষ বিকেলের হলুদ রোদ। একটু পর গোধূলি হবে। হলুদাভ শান্ত নিবিড় আলোর নিচে পৃথিবী এখন তন্দ্রাচ্ছন্ন। রুশমি পোর্চে এসে দাঁড়িয়েছে। কিছুই বলছে না। হয়তো কিছু বলার নেই। সব কথা কি আর বানান করে বুঝিয়ে বলতে হয়? এই নিশ্ছিদ্র নীরবতাই তো প্রমাণ করে যে আমার উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, থাকা না থাকা কিংবা অবস্থান প্রস্থানে তার কিছুই এসে যায় না। আমি তার জীবনের এক অনাহুত, অপ্রত্যাশিত, অপ্রয়োজনীয় অতিথি মাত্র! গাড়ির দরজা খুলে উঠে বসলাম। সিট বেল্ট বেঁধে নিলাম নীরবে। একটা দুঃসহ গ্লানিতে আমার বুক মথিত হয়ে উঠছে। সমুদ্রের প্রমত্ত জোয়ারের মতো ফিরে আসছে পাঁচ বছর আগের সেই বিচ্ছেদের ব্যাথা, সেই প্রদাহ, সেই অপমান! আর কতবার মেয়েটা আমাকে ভেঙেচুরে খানখান করবে? আর কতকাল ওকে ভালোবাসার অপরাধে আমাকে জ্বলতে হবে অভিশপ্ত লেলিহান আগুনে? 

গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম রুশমি পোর্চের একটা খুঁটি ধরে নিষ্প্রাণ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অনড় দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার মুখের ওপর। সেই দৃষ্টিতে কী গভীর বিষাদ গাঁথা! গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে অশ্রুজল। কাঁপছে ঠোঁট। দেখামাত্র আমার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। খুব দ্রুত সিটবেল্ট খুলে আজ্ঞাধীন ভৃত্যের মতো নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে লাগলাম বাতাসকে পেছনে ফেলে। উত্তেজনায় আমার চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে এসেছে। সেই আবছায়া আলোর মধ্যেই দেখতে পেলাম রুশমি পোর্চের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে এলোমেলো পায়ে। ওকে যেন চুম্বক টানছে। এদিকে আমি জানি না কোথায় যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। শুধু জানি আমাকে যেতে হবে। আমরা যখন মুখোমুখি পৌঁছেছি তখন শেষ সূর্যের ঝলমলে আলোক রশ্মি তির্যক সরলরেখার মতো দুজনের মাঝ বরাবর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোনালি আভা ছড়ানো মসৃণ আয়নার মতো আলোকরশ্মির ফাঁকে ফাঁকে আমি রুশমির কাজলকালো ভাসা ভাসা চোখদুটো দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট, আর ঠোঁটের নিচের ছোট্ট কালো বিন্দু। যে বিন্দুর মাঝে আমার নিজস্ব পৃথিবীটা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে এসে ক্রমশ বন্দি হয়ে পড়ছে। কয়েকটা অপার্থিব আশ্চর্য ক্ষণ নিঃশব্দে কেটে যাবার পর আমাদের দুইজোড়া ঠোঁট কোনো ভূমিকা ছাড়াই বশীভূতের মতো সন্নিবদ্ধ হলো এক দৃঢ়নিষ্ঠ চুম্বনে। দুর্দমনীয় অবাধ্য পিপাসা আমাকে পাগল করে তুলেছিল। আমি ওর ঠোঁটের মাঝে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চাইলাম। সাঁতরে পার হতে চাইলাম বিরহের গাঢ় সমুদ্র। অসংযত উপবাসী মন এক চুমুকে পান করতে চাইল ভালোবাসার নীল হ্রদ। পৃথিবী অশোকগুচ্ছের মতো স্নিগ্ধ হয়ে উঠল। যেন কোনো পবিত্র ঝর্ণাধারার জলপ্রবাহে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট আর পঙ্কিলতা। রুশমি আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। আমার হাত ওর পিঠের ওপর। হঠাৎ জিবে একটু নোনতা স্বাদ পেলাম। দেখলাম ওর নিচের ঠোঁটে এক ফোঁটা রক্ত ভেসে উঠেছে। অনুতপ্ত হলাম। আমি নিশ্চয়ই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সরি বলার জন্য মুখ খুলেছি ঠিক তখনই রুশমি আমার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কথা থামিয়ে দিল 

রুশমি 

শিহাব চলে যাচ্ছিল। আমি ঝাপসা চোখে শেষ বিকেলের নরম বিধুর আলোর ভেতর দিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছি। কষ্টে আমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিছু বলতে পারছি না। সইতেও পারছি না। এই কষ্টের কোনো নাম নেই। তবে আমার মন বলছিল ও ফিরে আসবে। জানতাম ফিরে আসবে! তাই সত্যি সত্যিই যখন গাড়ি থেকে ঝড়ের বেগে নেমে পড়ল তখন আমাকেও তাবৎ পৃথিবীর আর কোনো শাসন, কোনো যুক্তি বা শক্তি রুখতে পারল না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো ছুটে গেলাম। গোধূলি রঙা হলুদ আকাশ থেকে নেমে আসা সোনালি আভাযুক্ত আশ্চর্য এক আলোয় তখন পৃথিবী ভেসে যাচ্ছিল। সেই সাথে ভেসে যাচ্ছিল আমার পরিণত, বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন বিবেচক মন। আমি আচ্ছন্ন অবোধ বালিকার মতো মানুষটার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দুজনের মাঝখানে বেলাশেষের উত্তাপহীন সোনালী রোদের ঝিকিমিকি! সেই চোখ ঝলসানো চকচকে আলোর বন্যার মধ্যে কিছুক্ষণ থমকানো চোখে আমরা একে অপরের দিকে চেয়ে রইলাম। তারপর আমাদের ওষ্ঠযুগল চুম্বকের ন্যায় লগ্ন হলো। ওর স্পর্শ উগ্র এবং হিংস্র তবুও সুন্দর! আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করে দিলেও কিছু মাত্র আপত্তি নেই। ভালোবাসার একটা আশ্চর্য শক্তি আছে। মানুষ যখন ভালোবাসায় থাকে, তখন কষ্ট আর সুখের মধ্যে তফাৎ করতে ভুলে যায়। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার মতো সকল ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক অনুভূতিগুলো এক হয়ে মিলেমিশে স্বর্গীয় রূপ ধারণ করে। তখন সবটাই স্বর্গের মতো স্নিগ্ধ, মধুর আর অপাপবিদ্ধ! 

একটা সময় ওর ঠোঁট আমার গলার কাছে নেমে আসল। ঠিক সেই মুহূর্তে যেন সিন্ডারেলার গল্পের মতো আমার বুকের মধ্যে বারোটা বাজার ঘণ্টা বেজে উঠল ঢংঢং করে। চমকে উঠে আবিষ্কার করলাম মাথার হিজাব অনেকখানি সরে গেছে। আরেকটু হলেই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে গালের দগদগে পোড়া চামড়া। সরে পড়লাম চট করে। এস্তে ঘুরে দাঁড়ালাম। বাড়িতে ফিরে যাবার আগে শুধু একবার বলতে পারলাম, ‘তুমি চলে যাও শিহাব। আর কখনো এসো না এখানে।’ 

তীরের বেগে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। আমার গা শিউরে উঠছে। অদম্য ভীতির সঞ্চার হচ্ছে বুকের ভেতর। মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত কাঁপছে থরথর করে। শিহাব আমার পেছন পেছন দৌড়ে আসছে। কী যেন বলছে চিৎকার করে। উত্তেজনা আমার শ্রবণশক্তি কেঁড়ে নিয়েছে। আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না। দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। কিন্তু ঘরের দরজায় তো আলাদা কোনো তালা নেই। বেশ কয়েকবার তালা লাগানোর ভাবনা মাথায় আসলেও শেষমেশ আর হয়ে ওঠেনি। নিরুপায় হয়ে দরজার গায়ের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। জানি শিহাবের সাথে শক্তিতে আমি পারবো না। সে ইচ্ছে করলেই দরজা ঠেলে জোর খাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারবে। কী করব বুঝতে পারছি না। বড় বড় শ্বাস পড়ছে। হাপ ধরে গেছে। দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে কপাল বেয়ে। পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ধুপধাপ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে আগুন্তুক। ওই শব্দে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে। 

—রুশানিয়া! 

কতদিন পর নামটা শুনতে পেলাম! একটা কান্নার ঢেউ ছলাৎ করে আমার হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে নিয়ে এলো। মুখে হাত চেপে কান্না রোধ করার চেষ্টা করলাম। শিহাব দরজার ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে। 

—‘হঠাৎ কী হলো? এভাবে চলে এলে কেন?’ 

কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

—‘রুশানিয়া প্লিজ! কিছু তো বলো!’ 

এবার অনেক কষ্টে কান্না চাপা গলায় বললাম, ‘শিহাব, দয়া করে তুমি চলে যাও। তোমার পায়ে পড়ি।’ 

—‘আর কতবার তুমি আমাকে এভাবে তাড়িয়ে দেবে?’ ওর কণ্ঠস্বরে এখন তেজ নেই, আছে অগাধ বিষণ্ণতা। আমি দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে পড়েছি। আমার দুর্বল শরীর এত উত্তেজনা সইতে পারছে না। চোখে অন্ধকার দেখছি। দ্রুত চিন্তা করতে লাগলাম এখন কী করে মানুষটাকে ফেরানো যায়। চিন্তাগুলো খাপছাড়া, এলোমেলো। পলকা মেঘের মতো আসছে আর যাচ্ছে। স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে না কোথাও। 

—‘সত্যটা না জেনে আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুমি একটাবার আমাকে সব খুলে বলো। প্লিজ!’ 

আমি ভাবছি সত্য জানার অধিকার ওর নিশ্চয়ই আছে। দিনের পর দিন একটা মানুষকে এভাবে ঠকিয়ে যাওয়া কোনো নৈতিকতার আওতায় পড়ে না। আল্লাহ সুবহানাতায়ালা হয়তো এতদিন বাদে ধূমকেতুর মতো অকস্যাৎ ভাবে মানুষটাকে আমার সামনে এই উদ্দেশ্যেই হাজির করেছেন, যেন আমি সত্যটা নিজমুখে স্বীকার করে পাপমুক্ত হতে পারি। এসব ভাবছিলাম নিবিষ্ট চিত্তে। এর মাঝেই দেখলাম আমার ভেতরটা স্পষ্টভাবে দ্বিখন্ডিত হয়ে উঠল। একটা মন বলছে সবকিছু জানাবার এইতো সময়! অন্য মনটা এই সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে বিষের কাঁটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। রক্ত কণিকায় সঞ্চারিত করছে অনির্বচনীয় ভয়। সত্যটা জানার পর যদি ও আমাকে আরো বেশি ঘৃণা করে? যতটুকু মায়া ওর বুকের মধ্যে আমার জন্য এখনো প্রদীপের নিভন্ত দুর্বল শিখার মতো তিরতির করে জ্বলছে, কদর্য সত্যের অন্ধকার উপস্থিতিতে যদি সেই ক্ষীণ মায়ার শিখাটুকুও ভস করে নিভে যায়? তখন কী হবে? আমি পত্রিকায় বাংলাদেশের একজন এসিড ভিকটিমের সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। মেয়েটি বলেছিল দুর্ঘটনার পর তার স্বামী সাত বছরের সংসার এবং তিন বছরের কন্যা সন্তানকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। কারণ হলো মেয়েটির পরিবর্তিত ঝলসানো চামড়া। খসখসে রক্তাক্ত ঠোঁটজোড়া একবার জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বললাম, ‘দ্যাখো শিহাব, তোমার আমার মধ্যে যা ছিল, তা পাঁচ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। তুমি শুধু শুধু সময় নষ্ট করছ। প্লিজ চলে যাও।’

—‘কেন মিথ্যা বলছ? আমি জানি তুমি কিছু একটা লুকোচ্ছ আমার কাছ থেকে।’ 

—‘কিছু লুকোচ্ছি না। আমি জাস্ট…, আমি তোমাকে চাই না!’ 

ওপাশে নীরবতা। কান খাড়া করে কাঠের দরজার সাথে লেপ্টে আছি! ওর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। একটা সময় ওকে বলতে শুনলাম, 

—‘ঠিক আছে। আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু যাবার আগে কিছু কথা জানিয়ে যেতে চাই। আমার কিছু বলার আছে।’ 

ও একটু থামল। একটা কাঁপা কাঁপা শ্বাস পড়ল দরজার ওপাশে। তারপর বিষাদবদ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, 

—‘রুশানিয়া শোন, তুমি আমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়েছ। কথাটা শুনতে যতটা হালকা লাগছে আদতে এর ওজন ততটা হালকা নয়, বরং অত্যধিক ভারী। আমি অপমানিত হয়েছি, ব্যথিত হয়েছি, প্রতিশোধের আগুনে জ্বলেছি প্রতিনিয়ত। তুমি আমাকে ভালোবাসোনি কখনো। মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলোনি এ কথা ঠিক। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। এতটা ভালোবেসেছিলাম যে এর চেয়ে বেশি ভালো আর বাসা যায় না!’ 

আমার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। অব্যাখ্যেয় যন্ত্রণায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল শরীরের হাঁড়গোড়। বুক থেকে একটা কথা বিস্ফোরকের মতো বেরিয়ে আসতে চাইছিল, ‘ভালোবাসি!’ কখনো বলা হয়নি, বলতে পারিনি কিন্তু শিহাব! আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি! 

শিহাব বলছিল, -’একদিন তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। জানি না তোমার মনে আছে কিনা কিন্তু আমার স্পষ্টত মনে আছে তুমি বলেছিলে আমিই তোমার সবকিছু! নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিলাম। সেই বিশ্বাসটা যখন ভেঙে গেলো কাচের শিশির মতো ঝনঝন করে তখন…তখন আমার মনে হলো যেন কেউ হৃৎপিণ্ডটা উপড়ে তুলে নিয়েছে বুকের পাঁজর থেকে। এটা কী রকম কষ্ট তা আমি তোমাকে ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারব না। যে এরকম কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে একমাত্র সে-ই বুঝবে। সবকিছু ভুলে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। এখনো কারণে অকারণে তোমাকে মনে পড়ে। যাই করি না কেন, যেখানেই যাই না কেন, সারাক্ষণ আমার মনের মধ্যে শুধু তুমি তুমি আর তুমি! কী করে বুঝাই রুশানিয়া যে তুমি আমার কাছে কী! তুমি আমার চর্মচক্ষুর আড়ালে ছিলে এ কথা ঠিক, কিন্তু তোমার অজান্তেই তোমাকে আমি আমার হৃদয়াক্ষীতে বন্দি করেছি সেই কবে! সেখান থেকে তোমার মুক্তি নেই! ভেবেছিলাম দেখা হওয়ার পর খুব বড়সড় শাস্তি দেব তোমাকে। হয়তো খুন করব! কিন্তু আজ বুঝতে পারছি ভালোবাসা আমার কাছ থেকে সেই শক্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। আর যাই করি না কেন, তোমাকে কষ্ট দেবার সামর্থ আমার নেই। আমার জীবনাকাশে তুমি একটিমাত্র ধ্রুবতারা। তোমার মতো করে কিছুই আর কখনো ভালো লাগেনি। তুমি আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর জিনিস!’ 

কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে কেটে যাবার পর ও করুণ স্বরে বলল, ‘চলে যাচ্ছি। যাবার আগে শেষবারের মতো তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে দেবে? আর কখনো কিছু চাইব না!’ 

এতক্ষণের জমানো আর চাপানো কান্নাটা বুকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। কিছুতেই আর নিজেকে নিরস্ত করতে পারলাম না। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দরজাটা খুলেই ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমাকে সবল আলিঙ্গনে আবদ্ধ করল। ওর বুকে মাথা রেখে এমনভাবে কাঁদতে লাগলাম যে লোকে দেখলে মনে করবে এই মাত্র আমার কোনো আপনজনের বিয়োগ ঘটেছে। আমার এতদিনের ধৈর্য, সাহস এবং সংযমের বাধ যেন হুড়মুড় করে ভাঙতে লাগলো। কষ্ট গুলো, দুঃখ গুলো ভারহীন নরম তুলোর মতো বাতাসে উড়তে লাগলো। আমি ওর বুকের মাঝে, মনের মাঝে, হৃদয়ের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইলাম, মিশিয়ে দিতে চাইলাম। যেন এই একটা জায়গায়ই আমার মুক্তি আছে, আশ্রয় আছে, শান্তি আছে। 

শিহাব 

রুশমির নরম শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল কান্নার দমকে। মাথাটা আমার বুকের ওপর রাখা। চোখের জলে আমার টি-শার্ট ভিজে একাকার। ওকে এভাবে ভেঙে পড়তে কখনো দেখিনি। ওর এই অবস্থা আমার বুকে অসহনীয় ব্যথার উদ্রেক করছে। আমি ওর পিঠে হাত রেখে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। হিজাবটা ঘামে জবজব করছে। টান দিয়ে ওটা খুলে ফেললাম। চুলে হাত রেখে দেখি আঠালো আর ভেজা। দুহাত দিয়ে ওর মুখটা ওপরে তুলে ধরে বললাম, ‘এতো ঘামছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’ 

রুশমির চোখদুটি বন্ধ। বদ্ধ চোখের কোল উপচে গড়িয়ে পড়ছে জল। কান্নার ঢেউয়ে নাক ফুলে উঠছে, পানি ঝরছে। ফর্সা গালদুটো টকটকে লাল। দুই গালের ওপর ছড়িয়ে আছে একরাশ চুল। পরনের জামার গলাটাও একেবারে চিবুক পর্যন্ত ওঠানো। দেখে আমার নিজেরই কেমন হাঁসফাঁস লাগতে লাগল। বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ এসব পরে থাকো কেন?’ 

রুশমি মাথাটা আবারও আমার বুকের সাথে লেপ্টে দেয়। কাঁদতে থাকে ডুকরে ডুকরে। আমার মন গভীর বিষাদে ছেয়ে যায়। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। কপালে চুমু খাই। নরম স্বরে বলি, ‘কী হয়েছে রুশানিয়া? কাঁদছ কেন? তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। প্লিজ এভাবে কেঁদো না!’ 

হঠাৎ আমার একটা হাত ওর ডান কানের ঠিক নিচের চামড়ার ওপর পড়ল। চমকে উঠলাম। মনে হলো জায়গাটা বেশ খসখসে আর অমসৃণ। আমি মাথা ঝুঁকিয়ে একবার দেখতে চাইলাম। ঘরের ভেতর সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। ঠিকমতো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বললাম, ‘তোমার এখানে কী হয়েছে?’ 

প্রশ্নটা শোনামাত্র রুশমি যেন একটু থমকে গেলো। ওর শরীরের সব স্পন্দন থেমে এলো ক্ষণিকের জন্য। মাথা তুলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালো আমার মুখোমুখি। দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছল। তারপর জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ঘরের বাতি জ্বালালো। আমি লক্ষ্য করলাম ওর শরীর এখনো কাঁপছে থরথর করে। নিঃশ্বাসে একটা অন্যরকম শব্দ হচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো পাগলের মতো। চোখ ফোলা, ঠোঁট ফোলা, রক্তাভ গাল। কী কারণে যেন আমার আত্মা শুকিয়ে আসছে এক অনির্ণেয় শঙ্কায়। গা কাঁটা দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় টের পাচ্ছে যে অভাবনীয় কিছু একটা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। কী সেটা? মস্তিষ্কে জট লেগে আছে। কিছু ভাবতে পারছি না। নিশ্বাস বন্ধ করে চেয়ে আছি রুশমির দিকে। থিয়েটার শুরুর আগে দর্শকরা যেমন নিঃশব্দে থম ধরে বসে অপেক্ষা করে, আমার ভেতরটাও ঠিক সেরকম থমথমে নীরব হয়ে আছে। রুশমি ঘাড়ের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিল। ছ্যাঁত করে উঠল বুক। এলইডি বাল্বের ঝকঝকে আলোয় দেখতে পেলাম ওর ডান কানের ঠিক নিচ থেকে চিবুক বরাবর একটা কালচে দাগ ছড়িয়ে আছে। দাগটার কিছু অংশ গালের ওপরেও উঠে এসেছে। অনেক কষ্টে দুটো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম, ‘কী হয়েছে?’ 

এই প্রশ্ন শুনে রুশমি একটু অদ্ভুত হাসল। কী রকম যেন গা ছমছমে শীতল ওর হাসিটা। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো ভয়ে। এতটা ভয় বোধহয় জীবনে কখনো পাইনি। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি কি আমার রুশানিয়া? নাকি অন্য কেউ? হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। রুশমি চট করে ওর পরনের টপ খুলে ফেলল। চোখের সামনে ঝলক দিয়ে উঠল সাদা লঞ্জরি। পরমুহূর্তেই এক সুতীব্র বিদ্যুৎ অভিঘাতে চমকে উঠল আমার অন্তরাত্মা! যা দেখতে পেলাম তা ভাষায় বর্ণনা করার কোনো শক্তি বা উদ্যম আমার নেই। উত্তরমেরু থেকে ধেয়ে আসা কনকনে শীতল শৈত্যপ্রবাহ যেন এইমাত্র বয়ে গেছে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। অচল, অসাড় এবং হিমায়িত করে তুলেছে শরীরের প্রতিটি কোষ, পেশী এবং রক্তকণিকা। মৃত মানুষ কবর থেকে জেগে উঠে হেঁটে আসলেও বোধহয় এতটা শিউরে উঠতাম না। 

রুশমি একে একে পরনের সব কাপড় খুলে ফেললো। আমি দু তিন পা পিছিয়ে এসেছি। পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। শরীরে এই মুহূর্তে কোনো স্পন্দন নেই। বুকের ভেতর মন নামের যে জিনিসটা ছিল, যেটা মাঝেমাঝে টিকটিক করে মনুষ্যত্বের অস্তিত্বের জানান দিত, সেই জিনিসটা এই মাত্ৰ কেউ একজন অপ্রয়োজনীয় কাগজের মতো হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ট্র্যাশ করে দিয়েছে। আমি এখন নিস্পন্দ, নিস্তরজ চলন বলন শক্তিরহিত নিছক এক জড়পদার্থ। রুশমি কাপড়গুলো মেঝেতে ফেলে রেখে কয়েক পা হেঁটে বিছানার ওপর বসল। অন্যরকম অদ্ভুত গলায় কেটে কেটে বলল, ‘তোমার রুশানিয়া মরে গেছে শিহাব। এখন শুধু বেঁচে আছে এই বীভৎস মাংসপিণ্ড। তোমার কি একে ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে? 

রুশমি 

আজকে যে মুহূর্তে আমি ওর সামনে নিজের প্রকৃত বাস্তব রূপটা প্রকাশ করে ফেললাম সেই মুহূর্ত থেকে আশ্চর্যজনক ভাবে আমার বুকের সমস্ত ভার লাঘব হয়ে গেলো। ফুঁ দিয়ে কেউ একজন ধূলোর মতো উড়িয়ে দিল এতকালের ভয়, লজ্জা আর সমস্ত সংশয়। পিঠে যেন সাহসের দুটো অদৃশ্য ডানা গজিয়ে উঠল। আমার আর লুকানোর কিছু নেই, আড়াল করার কিছু নেই। অনেক অনেকদিন বাদে আমার বুকটা শান্তিতে, স্বস্তিতে আর তৃপ্তিতে টলমল করে উঠল। আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম। কিন্তু সামনে বসা মানুষটাকে দেখে আমার মায়া হচ্ছে। অপ্রত্যাশিত অভাবনীয় শোক তাকে পাথর করে তুলেছে। চোখের দৃষ্টি বিস্ফারিত এবং স্থির। শরীর বজ্রাহতের মতো নিস্পন্দ। শুধু এই নয়, আরো একটা ছায়া দেখেছি ওর চোখে। শিহরিত ভয়ের ছায়া। কী আশ্চর্য আল্লাহর এই দুনিয়া, তাই না? একটু আগে যে মানুষকে তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বলে মনে হচ্ছিল, মাত্র কিছুক্ষণের ব্যবধানেই সেই মানুষকে সে ভয় পেতে শুরু করেছে। আমি জানতাম এরকম কিছুই হবে। লন্ডনের সেই পার্সিয়ান ছেলেটাকে মনে পড়ছে। সেই ছেলেটার চোখেও এরকম ভীতির সঞ্চার ঘটেছিল সত্যটা জানার পর। আজকে আমার ভালোবাসার মানুষটির চোখেও একি রকমের ভয়, বিভ্রম এবং শঙ্কা! আমরা যতই বলি ভালোবাসা মনের ব্যাপার আদতে বোধহয় ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। শারীরিক উপস্থিতি, রূপ এবং সৌন্দর্য অনেকটাই প্রভাব ফেলে মানুষের অনুভূতির ওপর। এবং সেই প্রভাব কতটা প্রকট হতে পারে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আমার সম্মুখেই মূর্তিমান। আমি আর সময় নষ্ট না করে ওকে সবকিছু শুরু থেকে বলতে লাগলাম। ওর জাপান চলে যাবার পর আমার দুর্ঘটনা, ওকে কিছু না জানাবার সিদ্ধান্ত, আমাকে করা ওর মায়ের অনুরোধ, আমার ক্যান্সার, অপারেশন সবকিছু। ও মেঝেতে টানটান ভাবে পা ছড়িয়ে নিশ্চল হয়ে বসে ছিল। চোখজোড়া জানালার পর্দায় নিবদ্ধ। পলকহীন, স্থির, বিষণ্ণ বাদামি দুটি চোখের কার্নিশ উপচে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছিল জল। আমি বললাম, ‘তোমার মায়ের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই শিহাব। তোমাকে ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তটা আমি শুধুমাত্র তার কথার ওপর ভিত্তি করে নেইনি। বরং সত্যিই আমি মনেপ্রাণে চাইছিলাম আমার এই অভিশপ্ত জীবন থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে দিতে। সত্যটা জানার পর আমাকে তোমার করুণা ছাড়া আর কিছুই দেবার থাকত না। আর যেই তোমার চোখে একদিন ভালোবাসা দেখেছিলাম সেই তোমার চোখে অনুকম্পা দেখার চাইতে মৃত্যুও আমার কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য ছিল।’ 

শিহাবকে অনেকক্ষণ পর নড়ে উঠতে দেখলাম। আমার দিকে তাকালো না। নিঃশব্দে বসা থেকে উঠে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। আমি ঘরের বাতিটা নিভিয়ে দিলাম। জানালার পর্দা সরালাম। তারপর বিছানায় ফিরে এসে চুপচাপ বসে রইলাম প্রস্তরীভূত হয়ে। বাইরে জোছনা হয়েছে। নীল জোছনার ছায়া এসে পড়েছে আমার ঘরের মেঝেতে। বাতাসে জঙ্গলের গাছের পাতা নড়ছে। জোছনার আলো বাতাসের সাথে এদিকসেদিক গড়িয়ে পড়ছে। সেই নীল আলোর সাথে আমার বুকের ভেতর দীর্ঘকাল ধরে আটকে থাকা উৎকট দুর্গন্ধযুক্ত কষ্ট গুলোও যেন স্বর্গের পাখি হয়ে উড়ে উড়ে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি একটা অদ্ভুত শান্ত ভাব অনুভব করছি। শিহাব আমাকে আর আগের মতো করে ভালোবাসবে না এটা নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। শুধু একটা শূন্যতাবোধ আছে। আমার মন বাস্তবকে মেনে নেবার জন্য পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত। ও চলে যাক। আমি ওকে দূর থেকেই ভালোবাসব, এতদিন যেভাবে বেসেছি। সত্যটা জানাতে পেরেছি এটাই যথেষ্ট। এবার হয়তো আমি শান্তিতে মরতে পারব। 

হঠাৎ বিকট একটা শব্দ কানে এসে লাগল। দৌড়ে জানালায় এসে দেখি শিহাব উঠোনে রাখা গাড়ির চাকায় তারছেঁড়া উন্মাদের মতো পা দিয়ে আঘাত করছে। ওর গলা দিয়ে বনচারী হিংস্র জন্তুর গর্জনের মতো আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। কম্পিত বুক নিয়ে কোনোমোতে গায়ে কাপড় চড়িয়ে নিলাম। ত্রস্ত পায়ে নেমে এলাম নিচে। শিহাব কেমন পাগলের মতো করছে। গাড়িটার ওপর এমনভাবে চড়াও হয়েছে যেন ওটা ভেঙেচুরে খান খান করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তার দম ফেলানোর জো নেই। নিউইয়র্ক থেকে আসা ছেলেটা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। হা করে গিলছে দৃশ্যটা। অন্যান্য কর্মচারীরা ভাগ্যিস বিকেলের মাঝেই চলে গেছে। নইলে কী একটা বেইজ্জতি কাণ্ড হতো! আমি ছেলেটাকে বললাম, ‘ভাইয়া তুমি ভেতরে যাও। আমি উনাকে দেখছি।’ 

কথাটা বলে উঠোনে নেমে আসলাম। বুক ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে যেন ক্রুদ্ধ, ক্ষুধার্ত, হিংস্র এক বাঘের খাঁচায় ঢুকে পড়েছি। কী করব, কী বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। তখনও গাড়ির চাকায় আঘাতের পর আঘাত পড়ছে। আরেকটু হলেই চাকাটা খুলে পড়বে। আমি একবার ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘কী করছ তুমি? প্লিজ একটু শান্ত হও!’ আমার কথা মাটিতে পড়তে পারল না। তার আগেই সে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জানালার কাচে প্রবল বেগে ঘুষি বসিয়ে দিল। ফাটল ধরল কাচে। আত্মাকাপাঁনো এক প্রবল শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। আমি দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলাম। রক্তের ছিটে এসে পড়ল আমার মুখে। সেকেন্ড না গড়াতেই ও রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে আমার গলা চেপে ধরল। পোর্চে একটা সোলার লাইট জ্বলছিল। সেই আলোয় আমি সামনে দাঁড়ানো মানুষটার উগ্র হিংস্র মুখ দেখতে পেলাম। দপদপ করছে কপালের নীল রগ, নাকে ধোঁয়া, ঠোঁটের দুপাশে ক্রুর নিষ্ঠুরতা। ওর হাতের পাঁচ আঙুল ক্রমশ গেঁথে যাচ্ছে আমার গলায়। নিশ্বাস আটকে আসছে। তীব্র যন্ত্রণায় কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ। ও চিৎকারে ফেটে পড়ে বলতে লাগল, ‘এতো বড় ঘটনা আমার কাছ থেকে লুকাও? এতো বড় সাহস হয় কী করে তোমাদের? কে দিয়েছে তোমাদের এই স্পর্ধা? হ্যাঁ? মেরে ফেলব তোমাকে! তোমাকে মেরে আমার মাকেও মারব! আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার শাস্তি তোমাদেরকে পেতেই হবে!’ 

আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে এই মানুষটার হাতেই আমার মৃত্যু লেখা আছে। তবে একটু বুঝি মায়া অবশিষ্ট ছিল তার বুকে। সেই মায়া থেকেই বোধহয় অবশেষে ছেড়ে দিল আমার গলা। আমি কাশতে লাগলাম খকখক করে। সে গটগটিয়ে হেঁটে উঠোন পেরিয়ে গেলো। অদৃশ্য হলো লাল মাটির অন্ধকার পথটায়। আমি ওকে ডাকার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম কয়েকবার। গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরোচ্ছিল না। বাড়ি ফিরে এসে পানি টানি খেয়ে একটু ধাতস্থ হবার পর বুঝতে পারলাম যে এতক্ষণ ধরে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথাই ভেবে গেছি। ওই মানুষটার ওপর দিয়ে যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা একটাবার অনুধাবন করার চেষ্টা করিনি। হঠাৎ করেই ওর জন্য আমার মন কেমন পুড়তে লাগল। এতক্ষণের অনুভূতিশূন্য কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় জড়ভড়ত দেহে অকস্যাৎ শ্রাবণের মতো ঝরঝর করে যেন প্রাণের বর্ষণ ফিরে এলো। আর এই প্রথমবারের মতো বিলক্ষণ টের পেলাম যে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছি। ধাক্কাটা কোনো রকমে কাটিয়ে উঠতে পারলেও আমাকে এবং নিজের মাকে সে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না। এখন মনে হচ্ছে ওর মায়ের কথাটা না বললেও পারতাম। একটা আশ্রয় অন্তত অক্ষত থাকতো। বাবা-মা মানুষের স্পর্শকাতর জায়গা। সেই জায়গা নড়বরে হয়ে পড়লে মানুষ ভয়ঙ্কর অসহায়বোধ করে। আম্মুজান এর মাঝেই কয়েকবার ফোন দিয়েছে। একটা টেক্সট করে জানিয়ে দিলাম দুশ্চিন্তার কিছু নেই, সবকিছু ঠিক আছে। নিউইয়র্ক থেকে ছেলেটা ভালোয় ভালোয় এসে পৌঁছেছে। কাল সকালে কাজের কথা হবে। এখন সবাই খুব টায়ার্ড। 

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় পরে আমার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে শিহাব বাড়ি ফিরল। ডাইনিং এ বসে ছিলাম। দরজায় শব্দ হতেই ছুটে গিয়ে দেখি শিহাব হলওয়ে ধরে গেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ওর পিছু নিয়ে গেস্ট রুম অবধি আসলাম। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে মুখের ওপর দড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিল। শব্দটা এমন ভাবে বুকে গিয়ে ধাক্কা খেলো যে আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত। এরপর আর কী? আমি ভ্যাবলার মতো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। দুপুরের পর থেকে কিছুই খাইনি। এখন মাথা টলছে। হাত পা ঝিমঝিম করছে। বমি বমি লাগছে। গত কয়েকটা বছর আমার জীবন নিস্তরঙ্গ নদীর মতো ছিল। তরঙ্গহীন জীবনযাপনেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আচমকা আসা এই প্রলয়ঙ্করী ঢেউ তাই আমার রুগ্ন, বিপন্ন দুর্বল মনটাকে একদম পাগল বানিয়ে ছাড়ছিল। নিরুপায় হয়ে দরজাটা খুটখুট করে অবিরত নাড়তে লাগলাম। কতক্ষণ পেরিয়েছিল হিসেব নেই। হঠাৎ দমকা ঝড়ের হাওয়ায় যেন দরজা খুলে গেলো। শিহাবের চোখজোড়া রক্তলাল, চুল অবিন্যস্ত, চোয়াল লোহার চাইতেও কঠিন। চাউনিতে আগুন! 

—‘কী চাই?’ 

আমার চোখ পড়ল ওর ডান হাতের ওপর। ওখানে একতাল রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গেছে। দেখামাত্র বুক কেঁপে উঠল। সাবধানী গলায় বললাম, ‘একটু ভেতরে আসতে দেবে?’ ক্রুর চোখে আরো কিছুক্ষণ আমার দিকে নীরবে চেয়ে থেকে ও দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো। 

ভেতরে এসে ক্যাবিনেট খুলে ফার্স্টএইড বক্সটা বের করলাম। শিহাব আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘এসব লাগবে না! কী বলার আছে চট করে বলে বিদেয় হও এখান থেকে।’ 

কথাটা বলার ধরণ এতো কঠিন ছিল যে কষ্টে রীতিমতন কান্না পেয়ে গেলো। গলা অসম্ভব কাঁপছিল বলে কিছু বলতেও পারলাম না। ফার্স্টএইড হাতে নিয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ঠিক তখনই আবার হুঙ্কার, 

—‘কথা কানে যায় না?’ 

—‘তোমার হাত… 

—‘আমার হাত নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না!’ 

এবার হন্যে হয়ে বললাম, ‘ব্যান্ডেজ না করলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।’

ও দু পা এগিয়ে এলো আমার দিকে। হাত থেকে বক্সটা নিয়ে কাটা কাটা গলায় বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। আই উইল টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ। প্লিজ লিভ।’ 

অপমানিত এবং বিতাড়িত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা তীব্র কষ্ট ঘনিয়ে আসছিল বুকে। কেন আমার সাথে এমন যাচ্ছেতাই দুর্ব্যবহার করা? কেন এই নিষ্ঠুরতা? সব দোষ কি একা আমার? আমি তো পরিস্থিতির স্বীকার হওয়া এমন এক অসহায় মেয়ে, যার জন্য টানা দুটা বছর শুধু বেঁচে থাকাটাই ছিল সবচেয়ে বড় লড়াই। সেই লড়াইটা আমি একা একা লড়েছি। কেন এই একাকীত্ব বরণ করে নিয়েছিলাম? ওই মানুষটার জন্যই তো, তাই না? সে যেন ভালো থাকে, নিরাপদে থাকে, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে সেই উদ্দেশ্যেই তো ভিটেমাটি ছেড়ে আমার দেশান্তরী হওয়া। এসব ভাবনা আমার মাথায় আসছে আর এক বুক অভিমান ভেতরটায় টলটল করছে। যেই না আমার পোড়া চামড়ার খোলস বেরিয়ে পড়ল, অমনি সব ভালোবাসা জানালা টপকে পালিয়ে গেলো। তার আগ পর্যন্ত তো খুব ইনিয়ে বিনিয়ে কাব্য করা হচ্ছিল। সব পুরুষই এক রকম। এদের কাছে বাইরের খোলসটাই মূল্যবান। সৌন্দর্যের পূজারি, গভীরতাহীন ঠুনকো মানসিকতার এসব পুরুষদের আমি ঘৃণা করি। খুব ভালো হয়েছিল পাঁচ বছর আগে ওকে আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই এখন এই অবহেলা অতটা গায়ে লাগছে না। এমনই সব এলোমেলো চিন্তা আর প্রত্যাখ্যানের মর্মান্তিক দুঃখ বুকে নিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। কেন যে আমার জীবনে এরকম একটা ঘটনা ঘটতে গেলো? কেন আমার জীবনটা আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হলো না? কেন আমি লিও স্টেসির মতো ভালোবাসার ঘর বাঁধতে পারলাম না? কেন আমার কোল আলো করে এমিলির মতো ছোট্ট সুন্দর পরী কখনো আসবে না? কেন কেউ কোনোদিন আমাকে মা বলে ডাকবে না? হঠাৎ অনেকদিন পরে এই একটামাত্র দুঃসহ যন্ত্রণা বক্ষচেরা কান্নার আর্তনাদ হয়ে আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। স্বপ্নে দেখলাম নানা বর্ণের ফুলের রাজ্যে আমি হারিয়ে গেছি। কী সুন্দর দেখতে ফুলগুলো! কী সুন্দর ঘ্রাণ! এর মাঝে একটা ফুলের ঘ্রাণ একটু অন্যরকম সুন্দর। অনেকটা সেই মানুষটার গায়ের ঘ্রাণের মতো, যাকে আমি ভালোবাসি! হঠাৎ দূর থেকে একটা ডাক ভেসে আসে কানে। কে যেন রুশানিয়া বলে ডাকছে। প্রায় রাতেই স্বপ্নে আমাকে কেউ একজন ডাকে। তবে আজ মনে হল স্বপ্নে নয়, বাস্তবেই ডাকছে। আমার একলা থাকার অভ্যাস। মাঝরাতে কেউ আমার ঘরে ঢোকে না। তাই হঠাৎ এক আগুন্তুকের অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি প্রথমে আমাকে কিছুটা চমকে দিল। 

ঘর অন্ধকার। তবে আকাশের গোল চাঁদটা থেকে ফিনকি দিয়ে জোছনা ঝরছে। সেই জোছনা আমার ঘরের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। পাতলা নীল অপার্থিব চাঁদের আলোয় আমি দেখলাম শিহাব জানালার পাশে মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে ও আমাকে ডাকছিল কিনা সে বিষয়ে আমি সুনিশ্চিত নই। এই মুহূর্তে সে নিশ্চুপ। আমি ধীরেধীরে বিছানা থেকে নামলাম। শব্দ পেয়ে ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আমার দিকে। তারপর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এদিকে এসো।’ 

আমি আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে ওর কাছে ছুটে গেলাম। ও আমাকে বুকে টেনে নিল। 

শিহাব 

এতকালের সমস্ত জিজ্ঞাসা আর কৌতূহল মিটে যাবার পর পুরোদস্তুর বোকা বনে গেলাম। এতটাই বোকা যে নিজের দিকে নিজে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা বোধ হচ্ছে। সার্কাসের ক্লাউন বলে মনে হচ্ছে নিজেকে। মনে হচ্ছিল যেন যে জীবনটাকে আমি নিজের বলে জানতাম, সেই জীবনের ওপর আদতে আমার কোনো রকমের নিয়ন্ত্রণ নেই। আমি একজন আজ্ঞাবাহী যান্ত্রিক রোবট মাত্র। ভেতরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। মন চাইছে একটা বিস্ফোরণে পুরো পৃথিবীটাকে উড়িয়ে দেই। এতো বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো অথচ আমি কিছুই জানতে পারলাম না! আমার বাবা মা ভাই, বন্ধু কেউ আমাকে একটাবার কিছু জানাবার প্রয়োজন বোধ করল না। এতো সূক্ষ্মভাবে ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়া হলো যে আমার মনে এরকম কোনো সন্দেহের উদ্রেকও হলো না। আমি কোনো একভাবে জানতাম যে মম এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী, তবে তার ভূমিকা যে এতটা মারাত্মক তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। একেকবার মনে হয়েছিল রুশমির বাবা মেয়েকে বাধ্য করেছে এই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য যেহেতু শেষের দিনগুলোতে সে আমাকে ঠিক পছন্দ করতে পারছিল না। আবার এটাও ভেবেছি যে হয়তো রুশমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেনি। হয়তো সে লিওকেই ভালোবাসে। কারণ লিও তার জীবনের প্রথম ভালোলাগা ছিল। এসব ভেবে কতটাই না ঘৃণা করেছি রুশমিকে 1 কতবার কতভাবে দোষারোপ করেছি আমার জীবনটা এভাবে ভেঙেচুরে নষ্ট করে দেয়ার জন্য। এমনকি একটু আগেও আমার মন চাইছিল গলা টিপে ওকে হত্যা করি। ওর কোনো অধিকার নেই আমার মন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলার। আবার মনে হচ্ছে জাপান না গেলে এই ঘটনা আমার কাছ থেকে লুকোনো সহজ হতো না। আমি উপস্থিত থাকলে এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটতই না। রুশমিকে আমার একা ফেলে রেখে অত দূরে যাওয়া উচিত হয়নি। 

মানুষের জীবনের একটা বিস্তৃত সময় কেটে যায় শুধু নিজের ভেতরকার সত্তার সাথে যুদ্ধ করে। এই অন্তর্দ্বন্দই মূলত মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। কারণ আমার জানামতে পশুপাখিরা নিজের সাথে তর্ক করে না। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো আমিও খুব দ্রুত অন্তর্বিবাদে লিপ্ত হয়ে গেলাম। এই লড়াইয়ে কত রূপের ‘আমি’ র সাথে যে সাক্ষাৎ হলো। বোকা আমি, চালাক আমি, বিবেচক আমি, প্রতিশোধপরায়ণ আমি, প্রেমিক আমি… এতরকম আমি’র মধ্যে শেষ অবধি শুধু একটা আমিই লড়াইয়ে টিকে গেলো কোনোরকমে। যে আমিটা একদিন রুশানিয়াকে ভালোবেসেছিল, সেই আমিটা চোখে চোখ রেখে বলল, সত্যিকারের ভালোবাসাকে পেতে হলে হরেক রকম কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। অপেক্ষা করতে হয়। তুমি কি এই পরীক্ষায় হেরে গেলে শেষমেশ? তোমার রাগ, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধপরায়ণতা কি তোমার ভালোবাসার চাইতে বড় হয়ে গেলো? 

বুকের মধ্যে এই বিস্ফোরক রণক্ষেত্র নিয়েই মাঝরাতে আমি যখন পায়ে পায়ে দোতলার ঘরে উঠে এলাম, তখন দেখি রুশমি গুটিশুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি ওর পাশে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলাম। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে কাঁদছে। মনটা এতো খারাপ হয়ে গেলো যে কী বলব। ওর চোখের জল মুছে দিলাম, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। তারপর জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম নিঃশব্দে। একটু বাদে টের পেলাম ও বিছানা থেকে নেমে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলাম। ও আমার বুকের সাথে লেপ্টে গেলো, আর অমনি বারুদের গন্ধ ওয়ালা যুদ্ধের ময়দানে ঝমঝমিয়ে নামল শান্তির বৃষ্টি। রুশমির শরীরটা পাখির মতো নরম। কী সুন্দর ঘ্রাণ ওর চুলে! এতো নরম, এতো স্নিগ্ধ একটা মেয়েকে কেন এমন নারকীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হবে? প্রকৃতির এটা কেমন বিচার? 

আমি ওর চুলের মধ্যে নাক ডুবিয়ে বললাম, ‘আমার ভালোবাসায় তোমার এতটুকু বিশ্বাস ছিল না রুশানিয়া? আমি যে তোমার ভেতরটাকে ভালোবেসেছিলাম! বাইরের শরীরকে নয়। তোমার এই রক্ত মাংসের শরীরের ভেতর দিয়ে তোমার হৃদয়টাকেই পেতে চেয়েছি সবসময়!’ 

রুশমি আমার কণ্ঠমণিতে পরপর দুটো চুমু খেলো। কিছু বলল না। 

—‘আমি তো শুধুই তোমার প্রেমিক কিংবা স্বামী হতে চাইনি। জীবনসঙ্গী হতে চেয়েছি। বাংলায় একটা শব্দ আছে অর্ধাঙ্গ। সেই অর্ধাঙ্গ হতে চেয়েছি। যদি তুমি আমাকে সত্যিই নিজের অর্ধাঙ্গ মনে করতে তাহলে এই ঘটনা কখনোই আমার কাছ থেকে লুকোতে না। একা একা এত কষ্ট সইতে গেলে কেন?’ 

—‘ভেবেছিলাম সময়ের প্রভাবে তুমি আমাকে ভুলে যাবে। নতুন করে জীবনটাকে শুরু করবে। হয়তো এখন আমাদের দেখা না হলে সবকিছু ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যেত।’ 

—‘কখনোই কিছু ঠিক হতো না! রুশমি তুমি কি এখনো বুঝতে পারছ না যে আমি শুধু তোমাকে… শুধুমাত্র তোমাকেই ভালোবাসি!’ 

—‘ভালো তো আমিও তোমাকে বাসি! এতো বেশি ভালোবাসি যে গত পাঁচ বছর একটা মুহূর্তও তোমাকে ভুলে থাকতে পারিনি। জানো শিহাব, রোজ রাতে আমি তোমার ডাক শুনতে পেতাম। মনে হতো কোনো অন্ধকার অরণ্যে তুমি পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে আমাকে ডাকছ। আমার খোঁজ করছ।’ 

—‘আমি সত্যিই তোমাকে মনে মনে ডাকতাম। মানুষের আত্মার বোধহয় আলাদা রকমের একটা শক্তি আছে। আমার ডাক ঠিক ঠিক তোমার কানে এসে লাগত। কী অদ্ভুত!’ 

—‘হাসপাতালের বীভৎস যন্ত্রণাকাতর দিনগুলোতে তোমাকে একটাবার দেখতে খুব ইচ্ছে হতো। সেই দিনগুলো এতো ভয়াবহ ছিল! মনে পড়লে এখনো আমার গা শিউরে ওঠে। তারপর আমার ক্যান্সার ধরা পড়া, অপারেশন, একটার পর একটা বিপদ। 

—‘তুমি যে শরীরে এতবড় অসুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে আমি একটাবারও বুঝতে পারিনি। বুঝলে কখনওই তোমাকে ফেলে জাপান যেতাম না।’ 

—‘আমি নিজেও তো বুঝিনি। মেনস্ট্রেশন ইররেগুলার ছিল, অ্যাবনরমাল ব্লিডিং ছিল, ওয়েইট লস হচ্ছিল। কিন্তু ধারণাই ছিল না যে এটা ক্যান্সারের দিকে মোড় নিচ্ছে।’ 

—‘আমিও তো কিছু টের পাইনি। আমারই দোষ।’ 

—‘তোমার দোষ নয় শিহাব। সবকিছু এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে আমরা কেউ কিছু বুঝার মতো সময়ই পেলাম না।’

—‘তুমি আমাকে কাল সকালে রিপোর্টগুলো একবার দেখিও তো।’ 

—‘আমাকে কেউ কখনও মা বলে ডাকবে না, জানো?’ 

—‘কী এসে যায়? তুমি বেঁচে আছ, এটাই যথেষ্ট!’ 

রুশমি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নাজড়ানো কাঁপা গলায় বলল, —‘কিন্তু তোমার তো বাচ্চাদের অনেক পছন্দ।’ 

—‘তার চেয়ে বেশি পছন্দ তোমাকে! 

ওর কান্নাটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। দুঃসহ কষ্ট ঢেউ ভাঙছিল বুকে। এরকম ফুলের মতো স্নিগ্ধ সুন্দর একটা মেয়েকে আগুন জ্বালিয়ে দেবে, পুড়িয়ে দেবে, ক্যান্সারের মতো ঘাতক ব্যাধি আক্রমণ করবে, যন্ত্রণা দেবে এসব ভাবা যায়? আমি ওর পাখির মতো নরম শরীরটা কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে এলাম। তারপর পোড়া ত্বক ভরিয়ে দিলাম অজস্র চুম্বনে। ও বলল, ‘আগুনে পোড়ার কষ্ট কী তুমি জানো না শিহাব। যেন কখনো জানতে না হয়। আল্লাহ যেন তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিপদ থেকে মুক্ত রাখেন। শুধু জেনে রাখো, আজকে যে মুহূর্তে তুমি আমাকে স্পর্শ করলে আমার সব যন্ত্রণা উধাও হয়ে গেলো। আমার কুশ্রী রূপ সুশ্রী হয়ে উঠল। 

আমি ওর মুখে আঙুল চেপে ধরে বললাম, ‘তুমি কখনোই কুৎসিত নও। সব সময় সুন্দর! তুমি আমার হৃদয়াক্ষী। তোমাকে যখন দেখি হৃদয়াক্ষী মেলেই দেখি রুশানিয়া! আমার অন্ধকার হৃদয় তোমার আবির্ভাবে আলোকিত হয়। তোমার আলোই আমাকে সামনে চলার পথ দেখায়। তুমি কুৎসিত হতেই পারো না।’ 

—‘তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো কেন? পাগল!’ 

আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললাম, ‘জানি না কেন। শুধু জানি ভালোবাসি!’ 

রুশমি 

ভোরে ঘুম ভাঙতেই আমি তার মুখটা দেখতে পেলাম। এটা যে স্বপ্ন নয়, পুরোদস্তুর বাস্তব, তা টের পাওয়া মাত্র একটা সুখের শিহরণ বয়ে গেলো শিরদাঁড়া বেয়ে। আজকের ভোরের বাতাসে কী যেন একটা মিশে আছে নেশার মতো! সেই নেশা আমার বুকের ভেতর থেকে থেকে আনন্দের শঙ্খধ্বনি বাজাচ্ছে। খোলা জানালা গলে রোদের সরলরেখা তেরছা হয়ে এসে পড়েছে মেঝেতে। সেই রোদে মন ভালো করা কাঁচা সোনার রং। ওর মাথাটা বালিশের ওপর কাত করে রাখা। রোদের আভা খেলছে ঘরের সিলিং এ, বিছানার চাদরে। খেলছে ওর কাটাকাটা সুন্দর মুখে, নাকের ভাঁজে, হাতের নিটোল সুগঠিত পেশিতে। আমি দেবদূতের মতো সুন্দর মানুষটার দিকে অপলক চেয়ে রইলাম। খানিক বাদে ও নড়ে উঠল। অর্ধনিমীলিত ঘুমো চোখে আমার দিকে তাকিয়েই একটা হাসি দিল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘গুড মর্নিং রুশানিয়া!’ 

— ঘুম ভেঙে গেলো?’ 

—‘তোমার বন্ধুরা তো সকাল হবার আগেই ডাকাডাকি শুরু করে। ঘুমোবার উপায় আছে নাকি? তুমি থাকো কী করে এদের সাথে?’ 

বন্ধুরা বলতে যে আমার খামারের পশুপাখিদের বোঝানো হয়েছে সেটা ধরতে পেরে হেসে ফেললাম। সত্যিই খুব ভোরবেলায়ই ওদের হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়। চাইলেও ঘুমানো যায় না। তার ওপর আজ জানালা হাট করে খোলা ছিল। বাইরের জাগ্রত শব্দময় ভোর অনায়াসে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম, ‘ব্রেকফাস্টে কী চাই?’ 

ও আলসে গলায় বলল, ‘তোমাকে।’ 

আমার ঠোঁটে চাপা হাসি, ‘ফাজলামো করো না!’ 

— ‘ফাজলামো না, সিরিয়াসলি!’ 

রেস্টরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখি ও এখনো বিছানায় গড়াচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আমার নিত্যদিনের মতো কুৎসিত মনে হলো না। বরং মুখটা ঝলমলে দেখাচ্ছে। পোড়া দাগগুলোও যেন অতটা ভয়ঙ্কর নয়। সচরাচর ওই দাগগুলো আড়াল করার জন্য আমি সকাল বেলা উঠেই নিজেকে প্রায় প্যাকেট করে ফেলি। আজকে মনে হচ্ছে এই দাগ কারো চোখে পড়লেও কিছু এসে যায় না। আমার ভালোবাসার মানুষটা তো এভাবেই আমাকে ভালোবাসছে। তাহলে আর পৃথিবীকে ভয় কীসের? শেক্সপিয়ারের নাটকের একটা লাইন মনে পড়ছে, ‘Love looks not with the eyes, but with the mind; And therefore is winged Cupid painted blind!’ কী ভীষণ জীবন্ত সত্য এই কথাগুলো। ভালোবাসা মনের দৃষ্টি দিয়েই দেখে। চোখের দৃষ্টি দিয়ে নয়। কত অন্ধ মানুষও তাই মনের চোখ দিয়ে পৃথিবীর রূপ রং অনুভব করে। উপভোগ নয়, মানুষ হয়ে বাঁচতে চাইলে অনুভব করতে শেখো। উপভোগ তো পশুপাখিও করে। জিন্স আর টিশার্ট পরে নিচে নেমে এলাম। মাথায় হিজাব পরেছি কিন্তু গালের দাগটা আজ প্রকাশ্য। একটুও লজ্জা বা অস্বস্তি লাগছে না। আমার মন আজ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর! 

কিচেনে ডিমের ওমলেট করছিলাম। জানালার বাইরের দিকের কার্নিশে বসে দুটা ছাই রংয়ের কাঠবিড়ালি কুটকুট করে পিয়ার খাচ্ছে। আমিই খেতে দিয়েছি ওদের। আজ তাপমাত্রা বেশি নয়। এয়ারকন্ডিশন বন্ধ করে দরজা জানালা খুলে দিয়েছি। শীতের ফুরফুরে মিষ্টি রোদ ডোবা বাতাস সারা বাড়িময় খেলে বেড়াচ্ছে। শিহাব কখন দোতলা থেকে নেমে এসেছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় চমকে উঠলাম। ও একটু বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘তুমি বাসার মধ্যে হিজাব পরে থাকো কেন?’ 

—‘নিউইয়র্ক থেকে একটা লোক এসেছে গত সন্ধ্যায়। এ বাড়িতেই আছে। তাছাড়া খামারের লোকজনও চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাড়িতে ওদের অবাধ যাতায়াত। অফিশিয়াল কাজকর্ম সব বাড়ির বৈঠকখানাতেই হয়।’ 

শিহাব আমাকে ছেড়ে দিয়ে ডিশ ওয়াশারটার গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। ওর পরনে অ্যাশ কালারের হাফপ্যান্ট, সাদা টিশার্ট। কপালে ভাঁজ, মুখে অসন্তোষের ছাপ। বললাম, ‘কী হলো?’ 

ও শ্রাগ করল, ‘তুমি এই পুরো বাড়িতে একলা থাকো। একটা অজানা, অচেনা লোক তোমার বাড়িতে রাত কাটাচ্ছে। মানে, আই ডোন্ট গেট দিস লোকটা চোর, ডাকাত, রেপিস্ট নাকি করোনায় ইনফেক্টেড, তোমার কি এ বিষয়ে কোনো আইডিয়া আছে? হাও কুড ইউ বি সো শিওর যে এই লোক তোমার কোনো ক্ষতি করবে না?’ 

আমি একটু বেকুব বনে যাওয়া গলায় বললাম, ‘লোকটা তো কাজের খোঁজে এসেছে। ক্ষতি করবে কেন?’ 

ও মুখ বাঁকায়। সার্কাজম করে বলে, ‘ও তাইতো রুশমি! লোকটা কেন তোমার ক্ষতি করবে? সে তো সার্টিফাইড এঞ্জেল! আকাশ থেকে পাঠানো হয়েছে তোমার জন্য। 

আমি হেসে ফেললাম। ওর কোনো ধারণা নেই বিগত পাঁচ বছরের জীবনযুদ্ধ আমাকে কতটা পাল্টে দিয়েছে। আমি একজন সাবলম্বী নারী। বাবাজান চলে যাবার পর থেকে আমার ছোট দুইবোন এবং আম্মুজানের দায়িত্ব অনেকখানিই আমার ওপর বর্তেছে। জীবনের কাছ থেকে ঠেকে ঠেকে অনেক কিছু শিখেছি। অভিজ্ঞতার ঝুলিটা ভারী হয়েছে। মানুষের মুখ এবং গতিবিধি দেখে তার ভেতরটা পড়তে পারি। আত্মরক্ষার নানা কৌশল আমার জানা আছে। পকেটে সব সময় পেপার স্প্রে থাকে। ঘরে গুলি সমৃদ্ধ বন্দুক আছে। কী করে চালাতে হয় সেটাও আমার জানা। তবে শিহাব যে আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত সেটা বুঝতে পেরে আমার ভালো লাগছে। আমি তর্ক করলাম না আর। হাসিমুখে কাজ করতে লাগলাম। 

ব্রেকফাস্টের টেবিলে ও বলল, ‘তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও। আমরা ভার্জিনিয়া যাচ্ছি। বেলা বারোটার মধ্যেই রওয়ানা দিতে চাই।’ 

আমি একটু থমকে গেলাম মনে মনে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বললাম না। আজ বিকেলে নতুন ট্রেনচিং মেশিন কিনতে যাবার কথা মেরিকে সাথে নিয়ে। সেলে পেয়েছি। তাছাড়া ক্ষেতের স্প্রিংকলার সিস্টেমে প্রব্লেম হচ্ছে। মেরামতের লোক আসার কথা বেলা তিনটায়। আরো কিছু কাজ আছে যেগুলো আমার উপস্থিতিতে সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। নতুন ছেলেটার সাথে কথা বলতে হবে। কাজ টাজ শেখাতে হবে। তাছাড়া ভার্জিনিয়া গিয়ে আমার শাশুড়িকে মুখ দেখাবো কী উপায়ে? সে তো একরকম অর্ধচন্দ্র দিয়ে তার বাড়ি থেকে আমাকে বিদেয় করেছে। আমিও ঠিক করেছিলাম তার ছেলের জীবন থেকে চিরতরে সরে যাব। হৃদয়হীনা শাশুড়ি এবং মেরুদণ্ডহীন শ্বশুরের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ানোর কথা চিন্তা করতে গিয়েই ঘাম ছুটে গেলো আমার। মেরুদণ্ডহীন এ কারণে যে আমার দুর্ঘটনা নিয়ে ওই লোকটার নিজস্ব কোনো দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। স্ত্রী যা বলেছে সোনা হেন মুখ করে তাই সে মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। 

আম্মুজানকে ফোন করে বললাম তুমি আজকের ফ্লাইটেই ফ্লোরিডা চলে এসো। তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। পারলে মেজো আর ছোটোকেও নিয়ে এসো। জরুরি তলব পেয়ে আম্মু বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। আমার কণ্ঠের চাপা আনন্দটা অবশ্য টের পেতে খুব একটা বিলম্ব হলো না। বারবার হন্যে হয়ে জানতে চাইছে, কীসের সারপ্রাইজ? কোনো সুখবর আছে কি? 

আমি বললাম, ‘বলেই যদি দেই কীসের সারপ্রাইজ তাহলে সারপ্রাইজ তো সারপ্রাইজ রইল না। এসেই দ্যাখো না!’ 

মেজো আর ছোটর অনলাইন ক্লাস চলছে। করোনাকালীন সময়ে প্লেন জার্নি না করাই শ্রেয়। তাছাড়া ফার্মের পশুপাখির গায়ের গন্ধ মেজোর পছন্দ নয়। ফার্ম থেকে সে সহস্র হাত দূরে থাকতে চায়। তাই ভেবেছিলাম আম্মুজান আর ছোট রাজি হলেও মেজো কিছুতেই এমুখো হবে না। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। দেখা গেলো বাতাসে রহস্যের আঁচ পেয়ে মেজোর আর তর সইছে না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফ্লাইটের টিকেট বুকিং দিয়ে ফেলল। আমার মজা লাগছে খুব। অনেকদিন বাদে মনটা কী রকম দুর্দান্ত আনন্দে যে ক্রমাগত বাকবাকুম করে যাচ্ছে তা বলে বোঝাতে পারব না ভাই! খামারের কর্মচারীদের সাথে শিহাবকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমার স্বামী হিসেবে। সবাই খুব অবাক। আমি যে বিবাহিতা এই ঘটনাটা বিশ্বাস করতে যেন ওদের খুব কষ্ট হচ্ছে। ওরা ঠিক করেছে শিহাবের আগমন উপলক্ষ্যে আজ সন্ধ্যায় বারবিকিউ পার্টি করবে। মদ্যপান এবং নাচগান হবে। অতএব দুপুর বারোটার মধ্যে ভার্জিনিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার প্ল্যানটা শিহাবকে বাতিল করতে হলো। খামারের কাজকর্ম দেখে আর বনের হরিণ শিকারের প্রচেষ্টায় সময় কাটল তার। হরিণ অবশ্য পাওয়া গেলো না। তবুও শিহাব বেশ খুশি। ওর চোখ থেকে বিষাদের ছায়া উবে গেছে। প্রসন্নতার হাসি লেগে আছে মুখে। মানুষটার এই সুখী সুখী চেহারা দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগছে! আমি ঠিক করেছি জীবনে আর কোনদিন ওকে কষ্ট দেব না। ও যদি এই মুহূর্তে সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ওর সাথে ভার্জিনিয়া উড়াল দিতে বলে, তবে তাই দেব। 

দুপুরে আমরা ডাল, ভাত আর মুরগির ঝাল মাংস খেলাম। সাথে ফার্মফ্রেশ ব্রাসেলস স্প্রাউট। নিউইয়র্ক থেকে আসা ছেলেটাও আমাদের সাথে লাঞ্চ করল। বিকেলে যখন পুব দিগন্তে আকাশ কালো করে মেঘ ঘনিয়ে এলো, দূরের বন ছন্নছাড়া বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, শিহাব রেজার ঠিক সেই সময় সাঁতার কাটার শখ জাগলো। আমার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এলো। পানিতে নামার নাকি এটাই পারফেক্ট সময়। যেই বলা সেই কাজ। ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ল জলে। পানি আজকে অতটা উষ্ণ নয়। আমার পরনে সুইম স্যুট নেই। জিন্স আর টপ্স পরে কি মন মতো সাঁতার কাটা যায় নাকি? ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল কিছুক্ষণের মাঝেই। ডাইনির চুলের মতো ঢেউখেলানো ছাই রংয়ের মেঘে মেঘে ছেয়ে গেলো, গোটা আকাশ। জঙ্গলের গাছের পাতায় গুমরে উঠে কাঁদতে লাগল হাওয়া। বৃষ্টির জল গলন্ত রুপোর মতো মিশে যেতে লাগল লেকের জলের সাথে। সাঁতার কাটার সময় বৃষ্টির শব্দে কানে তালা লেগে যায়। মনে হয় দুনিয়াতে জল ছাড়া আর কিছুই নেই। লেকটা সরু। সাঁতরে অপর পাড়ে পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগল না। পাড় ঘেঁষেই জঙ্গলের শুরু। একটা শিং ওয়ালা হরিণ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্য ঝোপের আড়ালে, গাছের নিচে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদেরকে পাড়ে উঠতে দেখে চট করে ছুটে পালালো। বৃষ্টিতে মাটি পিচ্ছিল হয়ে গেছে। আমাদের পায়ে জুতো নেই। মাটিতে বেশকিছু কাঁটা জাতীয় গাছ আছে। পাইন গাছ থেকে খাঁজযুক্ত পাইনকোন পড়ে থাকে এদিক সেদিক। ওগুলোতে পা পড়লে ইনজুরড হবার সম্ভাবনা আছে। আমরা সাবধানে পা ফেলে একটা মেপল গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। আশেপাশে বেশকিছু পাইন গাছ খাঁড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদেরকে ঘিরে। সামনে লম্বা লম্বা ঘাসের ঝোপ। লেকের জলে বৃষ্টি তুমূল এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাতাস বড্ড মাতাল! হঠাৎ টের পেলাম শিহাব আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। 

—‘কী দ্যাখো?’ 

—‘তোমার চোখে কী আছে রুশানিয়া?’ বৃষ্টির শব্দের সাথে কণ্ঠস্বর মিশে যায়। রহস্যময় দৈববাণীর মতো শোনায়। 

—‘কী আছে?’ আমি অবাক হওয়ার ভান করি।

ও আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আমার চোখের পাতায় চুমু খায়। তারপর নেশা জড়ানো গলায় বলে, ‘তোমার চোখে আমার পৃথিবী আছে!’ 

শিহাব 

রুশমির চোখজোড়া যে বৃষ্টির মধ্যে অন্যরকম সুন্দর দেখায় তা আমি আজকেই প্রথম আবিষ্কার করলাম। লম্বা লম্বা পাপড়িগুলোর ওপর বৃষ্টির ফোঁটা এসে আটকে পড়ছে, তার ঠিক নিচেই কালো কাজল রেখায় ঘেরা টলটলে দুটো চোখের মণি। বৃষ্টির রুপো রং জলে ওর চোখের কাজল মুছে যায় না, বরং আরো গাঢ় এবং সতেজ হয়ে ওঠে। এতো সুন্দর যে তাকালেই বুকটা কেমন হু হু করে। আমরা মেপল গাছের গুঁড়ির নিচে বসে আছি। চারিদিকে বৃষ্টির ঝাপসা আচ্ছাদন। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ। গাছের পাতায় বৃষ্টির শনশন আর লেকের পানির ছলাৎ ছলাৎ এক আশ্চর্য মায়ার উদ্রেক করছে প্রকৃতিতে। বাতাসে ভেজা মাটির ঘ্রাণ। রুশমির মাথাটা আমার কাঁধের ওপর রাখা। আমি শক্ত করে ওর হাত ধরে আছি। কেউ কিছু বলছি না। চুপ করে মুহূর্তটাকে অনুভব করছি শান্তিতে আমার মন ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা বিষয় মাথায় এলো। জানি না এই মুহূর্তে প্রসঙ্গটা তোলা ঠিক হবে কিনা, তবে বিলম্ব না করে বলে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে। 

—‘রুশানিয়া!’

—‘হুম।’ 

—‘একটা কথা বলতে চাইছিলাম।’ 

ও ঘাড় তুলে আমার মুখের দিকে চাইল, ‘বলো।’ 

আমি ওর কপালে পড়ে থাকা চুল সরিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ বিপন্ন ভাবে চেয়ে রইলাম কাজলকালো চোখদুটোর দিকে। তারপর একটু সাবধানে বললাম, ‘নিউইয়র্কে একটা জব পেয়েছিলাম। এ বছরের শুরুতে। চাকরির খাতিরে নিউইয়র্ক মুভ করতে হয়েছিল।’ 

—‘তাই?’

—‘হ্যাঁ’ 

—‘তারপর?’ লক্ষ্য করলাম ও নিশ্বাস বন্ধ করে চেয়ে আছে আমার দিকে। মুখে চাপা উদ্বেগ। আমি একটু বিব্রত গলায় বললাম, 

—‘ওখানে যাবার কয়েক মাসের মাথায় সাশা এসে হাজির হলো মানে আমার অ্যাপার্টমেন্টে।’ 

—‘ও আচ্ছা।’ 

—‘হুম। 

—‘তারপর?’ 

—‘তারপর, কাছেই একটা স্কুলে ওর জব হলো।’ 

—‘ওয়াও! সাউন্ডস পারফেক্ট!’ 

এবার কোনও ভূমিকা ছাড়াই বলে ফেললাম -’আই স্লেপ্ট উইদ হার।’

রুশমি খুব একটা চমকালো না। কিছুক্ষণ নির্বাক চোখে চেয়ে রইল শুধু। তারপর বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বলল, ‘জানানোর জন্য ধন্যবাদ।’ 

—‘আমি ভীষণ দুঃখিত। আমাকে কি তুমি ক্ষমা করতে পারো?’

রুশমি কিছুক্ষণ চুপচাপ পাথরের মতো বসে রইল বৃষ্টির দিকে চোখ ফেলে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। অধৈর্য গলায় বললাম, ‘কিছু বলবে না?’ 

ও এবার আমার দিকে ফিরে তাকালো, ‘তুমি কি সাশাকে ভালোবাসো?’

হতভম্ব হয়ে গেলাম প্রশ্নটা শুনে। বিস্ময় ডোবা কণ্ঠে বললাম, ‘তুমি কি পাগল? ওকে আমি ভালোবাসব কেন?’ 

রুশমি ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ও তোমাকে এতো ভালোবাসল। তোমার মনে অন্য কেউ আছে এটা জানার পরেও সর্বস্ব দিয়ে দিল তোমার জন্য। আর তুমি ওকে একটুও ভালোবাসতে পারলে না? এটা কি ঠিক করলে?’ 

—‘তুমি কি আমার সাথে রসিকতা করছ? সাশার সাথে কাটানো সময়গুলোতে শুধু তোমাকেই মনে পড়ত! অথচ আমি পাগলের মতো তোমাকে ভুলে যাবার চেষ্টা করছিলাম। পারছিলাম না। আমার কষ্টটা কি তুমি একবার বুঝার চেষ্টা করবে? মাঝে মাঝে মনে হতো সাশা নয়, তুমিই আমার সাথে আছ। একটা সময় বুঝতে পারলাম বিষয়টা ঠিক হচ্ছে না। আমি ওকে ঠকাচ্ছি। নিজেকেও ঠকাচ্ছি। চাকরিটাও ভালো লাগছিল না। সাতপাঁচ ভেবে একদিন সকালে ওর উদ্দেশ্যে একটা নোট লিখে রেখে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছি না। হয়তো সাশাও আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি। হয়তো তুমিও পারবে না…’ 

মনটা ক্রমেই খুব বিষণ্ণ হয়ে উঠছিল। রুশমি আমার কাঁধের ওপর মাথাটা আবার এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘সাশা তোমাকে ক্ষমা করেছে শিহাব। কারণ ও সবকিছু জেনেশুনেই তোমাকে ভালোবেসেছে। আর আমিও তোমাকে ক্ষমা করেছি। কারণ আমি জানি তোমার শরীরটায় ওর সাময়িক দখল থাকলেও মনের ওপর শুধু আমারই দখল ছিল।’ 

—‘সাশা একবার বলেছিল তুমি নাকি চাও আমি ওকে বিয়ে করি। এটা কি সত্য?’

—‘হ্যাঁ সত্য, প্রথম সাক্ষাতের দিনই বুঝেছিলাম ও তোমাকে পছন্দ করে। মেয়েটা এমনি ভালো। খুব ইনোসেন্ট। যখন তোমাকে ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম তখন মনে হলো ওর চেয়ে বড় বন্ধু আমাদের আর নেই। নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করার মতো মানুষ আজকের দুনিয়ায় কজন আছে বলো? সাশা সেইসব বিলুপ্তপ্রায় মানুষগুলোর একজন। ওকে বললাম তুমি শিহাবকে এমনভাবে দেখে রেখো যেন ওর জীবনে অন্য কোনো মেয়ের প্রয়োজন না পড়ে কখনো। 

হঠাৎ মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো। রুশমির ভেজা চুলের গোছা হাত দিয়ে মুঠোবন্দি করে বললাম ‘অন্য মেয়ে মানে? তুমি আমাকে কী ভাবো?’ 

ওর মাথাটা পেছনের দিকে হেলে গেছে। চিবুক খাড়া। টপটপ করে বৃষ্টির জল ঝরে পড়ছে ফর্সা গালের ওপর। সুন্দর দেখাচ্ছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে মুখে হালকা হাসি নিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে একজন অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ভাবি। তোমার মতো ভালো মানুষ আর একজনও দেখিনি জীবনে। কিন্তু তোমার এই ভালোমানুষ মনের পেছনেও তো একটা পুরুষ মানুষের মন লুকোনো আছে। তাই না?’ 

ওকে ছেড়ে দিলাম,- ‘শুধুমাত্র তিনমাস সাশার সাথে ছিলাম। বাকিদিনগুলো একা একাই কাটিয়েছি। কাজটা তুমি ঠিক করোনি রুশমি। এর মানে তোমার আদেশ মানতে গিয়েই সাশা এরকম নাছোড়বান্দা হয়ে আমার পিছে লেগেছিল।’ 

—‘শুধু আমার কথা শুনে নয়, ও তোমাকে ভালোবাসে।’ একটু থেমে গলায় রসিকতার সুর টেনে ও বলল, ‘সব তোমারই দোষ। তোমাকে এতো অ্যাট্রাকটিভ হতে কে বলেছিল?’ 

গলায় ড্যাম কেয়ার ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম, ‘কেউ বলেনি। সম্পূর্ণ নিজের সিদ্ধান্ত।’ 

ও আমার মাথায় একটা গাট্টা মারল, ‘স্টুপিড!’ 

রুশমি 

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ আম্মুজান আমার বোনদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হলো। আম্মুর অ্যাজমার সমস্যা আছে। প্লেনে অনেকটা সময় মাস্ক পরে থাকতে হয়েছে বিধায় তার সমস্যাটা বেড়েছে। শিহাব ব্যাকইয়ার্ডে ছিল খামারের লোকজনদের সাথে। ওখানে বারবিকিউ হচ্ছে। স্প্যানিশ মিউজিকের সাথে সালসা ড্যান্স হচ্ছে। বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। মেজো আর ছোট এসেই হইহই শুরু করেছে। কী সারপ্রাইজ থাকছে আমার তরফ থেকে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই ওদের। মেজোর বদ্ধমূল ধারণা মিছিমিছি সারপ্রাইজের কথা বলে আমি ওদেরকে টেনে নিয়ে এসেছি। কারণ একটাই, একাকী দিন কাটাতে আমার ভালো লাগছিল না। অতএব আমার ছোটবোনরা মোটামুটি নিশ্চিত যে তাদের বোরিং বড় আপুর কাছ থেকে কোনো চমকসমৃদ্ধ খবর পাওয়া রীতিমতন অবিশ্বাস্য ব্যাপার। 

ওরা ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমে এসে বসল। আম্মুজান বলছে, ‘রুশমি তোমার আমাদেরকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল সেটা বললেই তো আমরা চলে আসতাম। সারপ্রাইজের কথা বলার কী দরকার ছিল?’ 

আমি মিটিমিটি হাসছি। মনে হচ্ছে সারপ্রাইজ না পেয়ে ওরা তিনজনেই খুব মনোঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। আম্মুজান বাচ্চাদের মতো অভিমান করছে। চোখে মুখে হতাশ ছাপ। বললাম, ‘তোমরা একটু ওয়েইট করো। সারপ্রাইজ এখনই হাজির হচ্ছে।’ 

খুব মজা লাগছিল আমার। বাবাজানকে মিস করছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস বাবাজান কোনো না কোনোভাবে আমাদের সাথে আছে। সবটাই দেখছে, শুনছে, অনুভব করছে! শিহাবের হাত চেপে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকলাম। ওর মুখে একগাল হাসি। আমার মা বোনরা চমকের ধাক্কায় পাথর বনে গেছে। ভুলে গেছে দম নিতে। কয়েকটা সেকেন্ড তিনমূর্তি প্রস্তরীভূত হয়ে চেয়ে রইল শুধু। প্রথম প্রতিক্রিয়াটা এলো ছোটর কাছ থেকে। উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল সে। তারপর লাফঝাঁপ শুরু করল পাগলের মতো। সে নাকি বিশ্বাস করতে পারছে না এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি। আম্মুজান কাঁদছে। শিহাব আম্মুর পাশে বসে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। মেজো আমার হাত টেনে ধরে অন্য দিকে নিয়ে এসেছে। সে সবটা শুনতে চায়। 

অনেক অনেকদিন পর আমি আম্মুর মুখে যে তৃপ্তির ছায়াটা দেখতে পাচ্ছি তার তুলনা নেই। শিহাব আমাদের ভাঙাচোরা বিষণ্ন পরিবারটায় যেন প্রাণের আভাস নিয়ে এসেছে। চারিদিকে আনন্দের একটা ফুরফুরে হাওয়া। আম্মু শিহাবের সাথে অনেকটা সময় ধরে কী নিয়ে যেন আলোচনা করল। আমার উপস্থিতি সেই আলোচনায় নিষিদ্ধ। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমোতে যাবার আগে আম্মু বলল, ‘তুমি আগামীকাল ভার্জিনিয়া যাও শিহাবের সাথে। ওর কথা মেনে চলো। এখন আর কোনো গোঁয়ার্তুমি করো না। কয়েকদিন থেকে এসো। এদিকটা আমি সামলাবো।’ 

—‘কিন্তু আম্মু, আমার শাশুড়ি তো আমাকে দেখে খুশি হবে না। উল্টো রেগে যাবে। তুমি তো জানো ওই বাড়িতে আমাকে আর কেউ চায় না।’ 

—‘ওটা তোমার স্বামীর বাড়ি। তোমার স্বামী কী চাইছে সেটাই মুখ্য। অন্যদের ব্যাপারে অত ভাববার কিছু নেই।’

পরিশিষ্ট 

শিহাব 

প্রায় ষোল ঘণ্টার ড্রাইভ শেষে ভার্জিনিয়া পৌঁছুলাম। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে গেছে। বরফে ঢাকা আমাদের নেইবারহুডের রাস্তা। বাড়ির দোচালা ছাদেও সাদা আস্তর পড়েছে। চাবি আমার ওয়ালেটেই ছিল। দরজা খুলে দেখি লিভিং রুমে জাহিদ আর পাপা বসে আছে। টিভিতে সকার খেলা চলছে। রুশমি নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল আমার পেছনে। পাপা আমাকে দেখে বেশ চমকিত। একটু ঠেস মারা গলায় বলল, ‘অবশেষে মনে পড়ল আমাদের কথা?’ 

মম কিচেনে ছিল। পাপার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ছুটে এলো লিভিং রূমে। রুশমির ওপর চোখ পড়ে গেছে সবার। কেউ কিছু বলছে না। থমকে গেছে। আমিও কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছি না। এ বাড়ির প্রতিটি সদস্য জেনে বুঝে আমার ওপর সাঙ্ঘাতিক অন্যায় করেছে, যে অন্যায় বা অপরাধ অমার্জনীয়। এই সমস্ত কিছুই সজ্ঞানে উপলব্ধি করার পরেও আমি এদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে পারছি না, কারণ হাজার হলেও এরা সবাই আমার আপন লোক। সবচেয়ে বড় কথা আমার মনে এখন বিদ্রোহ বা বিষণ্নতার চাইতে প্রসন্নতাই বেশি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রুশানিয়াকে আমি আমার জীবনে ফিরে পেয়েছি। ওকে সাথে নিয়ে ফিরতে পেরেছি নিজের বাড়িতে। একটামাত্র বিশেষ প্রাপ্তির বিনিময়ে আমার এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবীকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করছে। আমি স্থিরতার সাথে বললাম, 

—‘আমার স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ!’ 

জাহিদ কথা বলল, অনেকটা বিব্রতভাবে, ‘ওয়েলকাম ব্যাক ভাবি!’ 

মম পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। তার মুখে প্রলয়ের আভাস। একটু একটু কাঁপছে তার ঠোঁট। আমি তার চোখের দিকে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘মম তোমার অপরাধ মানুষ হিসেবে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারব না। তবে সন্তান হিসেবে ক্ষমা করে দিলাম!’ কথাটা শেষ করে রুশমির হাত টেনে ধরে বললাম, ‘ওপরে চলো।’ 

রুশমি হাত সরিয়ে নিল, ‘তুমি যাও। আমি আসছি।’ 

রুশমি 

অ্যাশবার্নের দোতলা বাড়িটা অসংখ্য স্মৃতি গায়ে মেখে সটান দাঁড়িয়ে ছিল বিকেল বেলার মিঠে রোদে ডুব দিয়ে। গতরাতে মনে হয় স্নোফল হয়েছে। রাস্তাঘাট শুভ্র শীতল বরফে ঢাকা। শিহাবের সাথে বাড়ির ভেতর যখন ঢুকেছি তখন আমার বুক কাঁপছে, অস্বস্তি হচ্ছে। কেমন যে লাগছে বলে বোঝাতে পারব না। তবে আমি তো আর পাঁচ বছর আগের সেই ভীত বিভ্রান্ত নববধূটি ট নই। আমার আত্মবিশ্বাস অনেকখানি বেড়ে গেছে। বিরহের অনলে জ্বলে পুড়ে আমাদের ভালোবাসা এখন বিশুদ্ধ এবং নিকষিত। এই ভালোবাসা আমার মনকে অন্যরকম এক শক্তি দিয়েছে। 

শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর আমাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে। কারো চোখের পলক পড়ছে না। যেন এক আকস্মিক বৈদ্যুতিক বজ্রপাতের প্রভাবে তারা সবাই নিষ্প্রাণ পাথর বনে গেছে। শিহাবের ওর মাকে বলা কথাটা আমার ভালো লেগেছে। সে বলেছে, ‘মম তোমার অপরাধ মানুষ হিসেবে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারব না। তবে সন্তান হিসেবে ক্ষমা করে দিলাম। কথাটার তাৎপর্য অনেক গভীর। এ কথা শোনার পর মানুষটার প্রতি আমার সম্মান আরো অনেকখানি বেড়ে গেছে। আমি দেখছিলাম আমার শাশুড়ি থরথর করে কাঁপছে। উত্তেজনায় তার দুটি গাল রক্তাভ হয়ে উঠেছে। তবে এ কয়েক বছরে যেন তার বয়স দশ বছর বেড়ে গেছে। মাথার চুলে সাদা রং, চামড়ায় ভাঁজ। চোখের কোলে গভীর কালো দাগ। আমার মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা। আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা একজন মূমুর্ষ রোগী। জীবন মরণ নিয়ে টানাটানি। এই মহিলা হঠাৎ আবির্ভাব হয়ে বলল, আমি যেন আমার প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে চিরতরে দূরে সরে যাই। তখন আমার কী রকম কষ্ট লেগেছিল তা কি একটাবারের জন্যও সে অনুভব করতে পারবে? যে নিরবচ্ছিন্ন আগুনে আমি গত পাঁচটা বছর ক্রমাগত পুড়ে পুড়ে গলন্ত মোমের মতো নিঃশেষ হয়েছি সেই আগুনের ভয়াবহতা কি এই মানুষ কখনো টের পাবে? আমার হয়তো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু আমার শিক্ষা আমাকে এতটুকু বোধশক্তি দিয়েছে যে মাঝেমাঝে প্রতিশোধের ভার প্রকৃতির ওপরেই ছেড়ে দিতে হয়। আজকে এই মুহূর্তে এই মানুষটার চোখের দিকে চেয়ে আমি টের পাচ্ছি যে গত পাঁচ বছর প্রকৃতি এর ওপর কম শোধ তোলেনি। অনেক ঘুরে ঘুরে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে, ঠেকে ঠেকে আমার ভালোবাসাই শেষ অবধি জয়ী হয়েছে। এমনটাই হবার ছিল! সৃষ্টিকর্তা আমাদের অলক্ষ্যে যে লেখা লিখে চলেছেন সেই লেখা ইচ্ছে মতো সম্পাদনা করার স্পর্ধা কারো নেই। 

পাপা বলল, ‘তুমি ফিরে এসেছ, আমরা খুশি হয়েছি। ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে রেস্ট নাও। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছ। 

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শিহাব জায়গাটা থেকে সরে যাবার পর ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, ‘আমি নিজের ইচ্ছায় শিহাবের সাথে দেখা করিনি। হঠাৎ দেখা হয়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টার পরেও আপনাদের দেয়া আদেশ শেষ পর্যন্ত পালন করতে পারলাম না, আমি দুঃখিত।’ 

মম কাটা গাছের মতো ধপ করে কাউচের ওপর বসে পড়েছে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদছে বাচ্চা মেয়েদের মতো। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলছে, 

—‘আমারই দোষ। আমি ভেবেছিলাম কিছুদিন কেটে গেলে তোমরা একে অপরকে ভুলে যাবে। আমি তোমাদের সম্পর্কের গভীরতাটা বুঝতে পারিনি। সত্য কথা হচ্ছে তোমার প্রস্থানের সাথে সাথে আমি আমার ছেলেটাকেও হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার সংসারটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তোমার অভিশাপ লেগে গিয়েছিল মনে হয়। তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?’ 

আমি ক্রন্দনরত মানুষটার পাশে বসলাম। তার একটা হাত ধরে বললাম, ‘অযথা নিজেকে দোষারোপ করবেন না। আল্লাহ তায়ালার সব পরিকল্পনার পেছনেই একটা নিগূঢ় উদ্দেশ্য থাকে। তাছাড়া শিহাবকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তটা আমি শুধুমাত্র আপনার কথার ওপর ভিত্তি করে নেইনি। আমার হীনম্মন্যতাও অনেকাংশে দায়ী ছিল। অথচ যার ভালোর জন্য আমরা এই কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম, পুরো ঘটনার পরিক্রমায় সেই মানুষটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের উচিত সেই মানুষটা যেন আর একটুও কষ্ট না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।’ 

মম অস্ফুটে বলল, ‘তুমি এসেছ, এখন সব ঠিক হয়ে যাবে!’ 

দোতলায় শোবার ঘরে এসে দেখি বিকেলের ঝকঝকে আলোয় চারপাশ ভরে আছে। দেয়ালজোড়া প্রশস্ত কাচের জানালাটার সামনের টুলে বসে পিয়ানো বাজাচ্ছে শিহাব। পরিচিত একটা সুর। জানালার ওপাশের উইলো ফরেস্ট ছেয়ে আছে শ্বেত শুভ্র বরফ কণায়। এক ফালি রোদ লুটিয়ে পড়েছে শিহাবের হাতের আঙুলে, পিয়ানোর রিডে। এই দৃশ্যটা যে আমার কী ভীষণ প্রিয়! আমার গলায় একটা সুখের কান্না সুড়সুড়ি দিচ্ছে। মন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে আশ্চর্য আবেশে! কতদিন পর ওকে পিয়ানো বাজাতে দেখছি, শুনছি! ক -ত দি -ন প-র! 

এমনই এক শীতকালীন হিমগন্ধি দিনে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। ঘটনাগুলি কী অদ্ভুত! ভাবতে গেলে অবাক লাগে! ও মগ্ন হয়ে বাজনা বাজাচ্ছিল। আমি পেছন থেকে গলা জড়িয়ে ধরলাম। ও আমার হাত টেনে ধরে কোলের ওপর বসিয়ে দিল। গুটিসুটি হয়ে আলতোভাবে ওর বুকে মাথা রাখলাম। পিয়ানো বাদকের হাতের দশ আঙুল তখনও রিডের ওপর। গুনগুন করে একটা গানের সুর তুলছে গলায়। মসৃণ উষ্ণ নিশ্বাস এসে পড়ছে আমার কপালে। আমি ওর বাহুডোরে বন্দি। ওই হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক, গানের গুনগুন, পিয়ানোর সুর আর বেলাশেষের বরফ ধোয়া সোনালি রঙের খুশিয়াল রোদটা মিলেমিশে একাকার হয়ে হঠাৎ একটা হলুদ বসন্ত দিনে রূপান্তরিত হলো। নাকে এসে ধাক্কা খেলো সাউদার্ন ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণ। উতলা বাতাসে এলোমেলো উড়তে থাকল মুক্তো দানার মতো চেরিফুলের গোলাপি পাপড়ি। আমরা ক্রমশ ডুবে যেতে লাগলাম সুখের এক অতলান্ত গাঢ় অনুভূতির প্রচ্ছন্ন সাগরে। 

শোন, ফুল গন্ধে ডোবা হলুদ বরণ অমর্ত্য সুন্দর বসন্ত দিন! তুমি এভাবেই আমাদের ঘিরে রেখো আজীবন। ছেড়ে যেও না কখনও! 

-সমাপ্তি- 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *